Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তত্ত্বাবধান মানে–জীবে প্রেম || Narayan Gangopadhyay

তত্ত্বাবধান মানে–জীবে প্রেম || Narayan Gangopadhyay

রবিবারের সকালে ডাক্তার মেজদা কাছাকাছি কোথাও নেই দেখে আমি মেজদার স্টেথিসকোপ কানে লাগিয়ে বাড়ির হুলোবেড়াল টুনির পেট পরীক্ষা করছিলাম। বেশ গুরগুর করে আওয়াজ হচ্ছে, মানে এতদিন ধরে যতগুলো নেংটি ইঁদুর আরশোলা টিকটিকি খেয়েছে। তারা ওর পেটের ভেতরে ডাকাডাকি করছে বলে মনে হচ্ছিল। আমি টুনির পেট সম্পর্কে এইসব দারুণ দারুণ চিন্তা করছি, এমন সময় বাইরে থেকে টেনিদা ডাকল : প্যালা, কুইক–কুইক!

স্টেথিসকোপ রেখে এক লাফে বেরিয়ে এলুম বাড়ি থেকে।

–কী হয়েছে টেনিদা?

টেনিদা গম্ভীর হয়ে বললে, পুঁদিচ্চেরি।

মনে কোনওরকম উত্তেজনা এলেই টেনিদা ফরাসী ভাষায় কথা বলতে থাকে। তখন কে বলবে, স্রেফ ইংরিজির জন্যেই ওকে তিন-তিনবার স্কুল ফাঁইন্যালে আটকে যেতে হয়েছে।

আমি বললুম, পুঁদিচ্চেরি মানে?

–মানে ব্যাপার অত্যন্ত সাঙ্ঘাতিক। এক্ষুনি তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে। ক্যাবলা কিংবা হাবুল সেন কাউকে বাড়িতে পেলুম না–তাই সঙ্গে তোকেই নিয়ে যেতে এসেছি।

–কোথায় নিয়ে যাবে?

–কালীঘাটে।

–কালীঘাটে কেন?–আমি উৎসাহ বোধ করলুম। কোথাও খাওয়াটাওয়ার ব্যবস্থা আছে বুঝি?

–এটার দিনরাত খালি খাওয়ার চিন্তা!–বলে টেনিদা আমার দিকে তাক করে চাঁটি তুলল, সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে তিন হাত দূরে ছিটকে গেলুম আমি।

–মারামারি কেন আবার? কী বলতে চাও, খুলেই বলো না।

চাঁটিটা কষাতে না পেরে ভীষণ ব্যাজার হয়ে টেনিদা বললে, বলতে আর দিচ্ছিস কোথায়?সমানে চামচিকের মতো চাঁকাক করছিস তখন থেকে। হয়েছে কী জানিস, আমার পিসতুতো ভাই ডোম্বলদার ফ্ল্যাটটা একটু তত্ত্বাবধান–মানে সুপারভাইজ করে আসতে হবে।

–তোমার ভোম্বলদা কী করছেন? কম্বল গায়ে দিয়ে লম্বা হয়ে পড়ে আছেন?

–আরে না না! ডোম্বলদা, ডোম্বল-বৌদি, মায় ডোম্বলদার মেয়ে ব্যাধি-সবাই মিলে ঝাঁসি না গোয়ালিয়র কোথায় বেড়াতে গেছে। আজই সকালে সাড়ে দশটার গাড়িতে ওরা আসবে। এদিকে আমি তো স্রেফ ভুলে মেরে বসে আছি, বাড়ির কী যে হাল হয়েছে কিছু জানি না। চল–দুজনে মিলে এই বেলা একটু সাফ-টাফ করে রাখি।

শুনে পিত্তি জ্বলে গেল। আমি তোমার ডোম্বলদার চাকর নাকি যে ঘর ঝাঁট দিতে যাব? তোমার ইচ্ছে হয় তুমি যাও।

টেনিদা নরম গলায় আমাকে বোঝাতে লাগল তখন।–ছি প্যালা, ওসব বলতে নেই-পাপ হয়। চাকরের কথা কেন বলছিস র‍্যা–এ হল পরোপকার। মানে জীবসেবা। আর জানিস তো–জীবে প্রেম করার মতো এমন ভালো কাজ আর কিচ্ছুটি নেই?

আমি মাথা নেড়ে বললুম, তোমার ভোলদাকে প্রেম করে আমার লাভ কী? তার চেয়ে আমার হুলো বেড়াল টুনিই ভাল। সে ইঁদুর-টিদুর মারে।

টেনিদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, কলেজে ভর্তি হয়ে তুই আজকাল ভারি পাখোয়াজ হয়ে গেছিস ভারি ডাঁট হয়েছে তোর! আচ্ছা চল আমার সঙ্গে বিকেলে তোকে চাচার হোটেলে কাটলেট খাওয়াব।

–সত্যি?

–তিন সত্যি। কালীঘাটের মা কালীর দিব্যি।

এরপরে জীবকে–মানে ভোলদাকে প্রেম না করে আর থাকা যায়? দারুণ উৎসাহের সঙ্গে আমি বললুম, আচ্ছা চলো তাহলে।

বাড়িটা কালীঘাট পার্কের কাছেই। তেতলার ফ্ল্যাটে ভোলা থাকেন, ভোম্বল-বৌদি থাকেন, আর তিন বছরের মেয়ে ব্যাম্বি থাকে।

টেনিদা চাবি খুলতে যাচ্ছিল, আমি হাঁ-হাঁ করে বাধা দিলুম।

–আরে আরে, কার ঘর খুলছ? দেখছ না–নেমপ্লেট রয়েছে অলকেশ ব্যানার্জি, এম. এস. সি.?

–ডোম্বলদার ভালো নামই তো অলকেশ।

শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল। এমন নামটাই বরবাদ? ডোম্বলদার পোশাকি নাম দোলগোবিন্দ হওয়া উচিত। ভূতেশ্বর হতেও বাধা নেই, এমনকি কালীচরণও হতে পারে। কিন্তু অলকেশ একেবারেই বেমানান–আর অলকেশ হলে কিছুতেই ভোলা হওয়া উচিত নয়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসব ভাবছি আর নাক চুলকোচ্ছি, হঠাৎ টেনিদা একটা হাঁক ছাড়ল।

–ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি নাকি হাঁ করে? ভেতরে আয়।

ঢুকে পড়লুম ভেতরে।

গোছাবার সাজাবার কিছু নেই–সবই ভোম্বল-বৌদি বেশ পরিপাটি করে রেখে গেছেন। দিব্যি বসবার ঘরটি–আমি আরাম করে একটা সোফার ওপর বসে পড়লুম।

–এই, বসলি যে?

–কী করব, করবার তো কিছুই নেই।

–তা বটে।–টেনিদা হতাশ হয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখল একবার,ধুলো-টুলোও তো বিশেষ পড়েনি দেখছি।

–বন্ধ ঘরে ধুলো আসবে কোত্থেকে?

–হুঁ, তাই দেখছি। কিছুক্ষণ নাক-টাক চুলকে টেনিদা বললে, কোনও উপকার না করে চলে গেলে মনটা যে বড় হু-হুঁ করবে র‍্যা! আচ্ছা–একটা কাজ করলে হয় না? ঘরে ধুলো না থাকলেও মেজের ওই কার্পেটটায় নিশ্চয় আছে। আর ধুলো থাকবে না অথচ কার্পেট থাকবে–এ কখনও হতেই পারে না, এমন কোনওদিন হয়নি। আয়–বরং এটাকে—

কার্পেট ঝাড়বার প্রস্তাবটা আমার একেবারেই ভালো লাগল না। আপত্তি করে বললুম, কার্পেট নিয়ে আবার টানাটানি কেন? ও যেমন আছে তেমনি থাক না। খামকা–

–শাট আপ! কাজ করবি নে তো মিথ্যেই ট্রাম ভাড়া দিয়ে তোকে কালীঘাটে নিয়ে এলম নাকি? সোফায় বসে আর নবাবী করতে হবে না প্যালা, নেমে আয় বলছি–

অগত্যা নামতে হল, সোফা আর টেবিল সরাতে হল, কার্পেট টেনে তুলতে হল, তারপর একবার মাত্র একটি বার ঝাড়া দিতেই ডি লা গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস!

ঘরের ভেতরে যেন ঘূর্ণি উঠল একটা! চোখের পলকে অন্ধকার।

টালা থেকে ট্যাংরা আর শেয়ালদা থেকে শিয়াখালা পর্যন্ত যত ধুলো ছিল একসঙ্গে পাক খেয়ে উঠল।–সেরেছে, সেরেছে, বলে এক বাঘা চিৎকার দিলুম আমি, তারপর দুলাফে আমরা বেরিয়ে পড়লুম ঘর থেকে নাকে ধুলো, কানে ধুলো, মুখে ধুলো, মাথায় ধুলো। পুরো দশটি মিনিট খক-খক খকখক করে কাশির প্রতিযোগিতা। এর মধ্যে আবার কোত্থেকে গোটা দুই আরশোলা আমার নাকের ওপর ডিগবাজি খেয়েও গেল।

কাশি বন্ধ হলে মাথা-টাথা ঝেড়ে, মুখ-ভর্তি কিচকিচে বালি নিয়ে আমি বললুম, এটা কী হল টেনিদা?

টেনিদা গাঁক-গাঁক করে বললে, হুঁ! কেমন বেয়াড়া হয়ে গেল রে! মানে এত ধুলো যে ওর ভেতরে থাকতে পারে–বোঝাই যায়নি। ইস–ঘরটার অবস্থা দেখছিস?

হ্যাঁ-দেখবার মতো চেহারাই হয়েছে এবার। দরজা দিয়ে তখনও ধোঁয়ার মতো ধুলো বেরুচ্ছে–সোফা, টেবিল, টিপয়, বুক-কেস, রেডিয়ো-সব কিছুর ওপর নিট তিন ইঞ্চি ধুলোর আস্তর! ভোল-বৌদি ঘরে পা দিয়েই স্রেফ অজ্ঞান হয়ে পড়বেন।

দু-হাতে মাথা চুলকোতে চুলকোতে টেনিদা বললে, ইঃ–একেবারে নাইয়ে দিয়েছে রে!

আমি বললুম, ভালোই তো হল। কাজ করতে চাইছিলে, করো এবার প্রাণ খুলে! সারা দিন ধরেই ঝাঁট দিতে থাকো!

দাঁত খিচোতে গিয়েই বালির কিচকিচানিতে টেনিদা খপাৎ করে মুখ বন্ধ করে ফেলল।

–তা ঝাঁট তো দিতেই হবে। বাড়িতে এসে এই দশা দেখবে নাকি ভোম্বলদা?

–আবার ঝাড়তে হবে কার্পেট!

–নিকুচি করেছে কার্পেটের! চল–ঝাটা খুঁজে বের করি।

ঝাঁটা আর পাওয়া যায় না। বসবার ঘরে নয়–শোবার ঘরে নয়, শেষ পর্যন্ত রান্নাঘরে এসে হাজির হলুম আমরা।

-আরে ওই তো ঝাঁটা!

তার আগে জাল-দেওয়া মিট-সেফের দিকে নজর পড়েছে আমার।

–টেনিদা!

–কী হল আবার?–টেনিদা খ্যাঁক-খ্যাঁক করে বললে, সারা ঘর ধুলোয় এককার হয়ে রয়েছে–এখন আবার ডাকাডাকি কেন? আয় শিগগির–একটু পরেই তো ওরা এসে পড়বে!

–আমি বলছিলুম কীকান দুটো একবার চুলকে নিয়ে জবাব দিলুম : মিট-সেফের ভেতর যেন গোটা-তিনেক ডিম দেখা যাচ্ছে।

–তাতে কী হল?–একটা মাখনের টিনও দেখতে পাচ্ছি। টেনিদার মনোযোগ আকৃষ্ট হল।

–আচ্ছা, বলে যা।

–দুটো কেরোসিন স্টোভ দেখতে পাচ্ছি দু-বোতল তেল দেখা যাচ্ছে–ওখানে শেলফের ওপর একটা দেশলাইও যেন চোখে পড়ছে।

–হুঁ, তারপর? আমি ওয়াশ-বেসিনটা খুলোম।

–এতেও জল আছে–দেখতে পাচ্ছ তো?

–সবই দেখতে পাচ্ছি। তারপর?

আমি আর একবার বাঁ কানটা চুলকে নিলুম : মানে সামনে এখন অনেক কাজ–যাকে বলে দুরূহ কর্তব্য। ঘর থেকে ওই মনখানেক ধুলো ঝেটিয়ে বের করতে ঘন্টাখানেক তো মেহনত করতে হবে অন্তত? আমি বলছিলুম কী, তার আগে একটু কিছু খেয়ে নিলে হয় না? ধরো তিনটে ডিম দিয়ে বেশ বড় বড় দুটো ওমলেট হতে পারে—

–ব্যস-ব্যস, আর বলতে হবে না! টেনিদার জিভ থেকে সড়াক করে একটা আওয়াজ বেরুল : এটা মন্দ বলিসনি। পেট খুশি থাকলে মেজাজটাও খুশি থাকে। আর এই যে একটা বিস্কুটের টিনও দেখতে পাচ্ছি–

পত্রপাঠ টিনটা টেনে নামাল টেনিদা, কিন্তু খুলেই মুখটা গাজরের হালুয়ার মতো করে বললে, ধেৎ!

–কী হল, বিস্কুট নেই?

–নাঃ, কতগুলো ডালের বড়ি! ছ্যা-ছ্যাঁ!–টেনিদা ব্যাজার হয়ে বললে, জানিস, ভোম্বল-বৌদি এম. এ. পাশ, অথচ বিস্কুটের টিনে বড়ি রাখে। রামমাঃ।

আমি বললুম, তাতে কী হয়েছে? আমার এলাহাবাদের সোনাদিও তো কীসব থিসিস লিখে ডাক্তার হয়েছে–সেও তো ডালের বড়ি খেতে খুব ভালোবাসে।

–রেখে দে তোর সোনাদি!–টেনিদা ঠক করে বড়ির টিনটাকে একপাশে ঠেলে দিয়ে। বললে, বলি, মতলব কী তোর? খালি তক্কোই করবি আমার সঙ্গে, না ওমলেট-টোমলেট ভাজবি?

-আচ্ছা, এসো তা হলে, লেগে পড়া যাক।

লেগে যেতে দেরি হল না। সসপ্যান বেরুল, ডিম বেরুল, চামচে বেরুল, লবণ বেরুল, লঙ্কার গুঁড়োও পাওয়া গেল খানিকটা। শুধু গোটা-দুই পেঁয়াজ পাওয়া গেলেই আর দুঃখ থাকত না কোথাও।

টেনিদা বললে, ডি লা গ্র্যান্ডি। আরে, ওতেই হবে। তুই ডিম তিনটে ফেটিয়ে ফ্যাল–আমি স্টোভ ধরাচ্ছি ততক্ষণে।

ওমলেট বরাবর খেয়েই এসেছি, কিন্তু কী করে যে ফেটাতে হয় সেটা কিছুতেই মনে করতে পারলুম না। নাকি, ফোঁটাতে বলছে? তা হলে তো তা দিতে হয়। কিন্তু তা দিতে থাকলে ও কি আর ডিম থাকবে? তখন তো বাচ্চা বেরিয়ে আসবে। আর বাচ্চা বেরিয়ে এলে আর ওমলেট খাওয়া যাবে না–তখন চিকেন কারি রান্না করতে হবে। আর তা হলে–

টেনিদা বললে, অমন টিকটিকির মতো মুখ করে বসে আছিস কেন র‍্যা? তোকে ডিম ফেটাতে বললুম না?

–ফেটাতে বলছ? মানে ফাটাতে হবে? নাকি ফোঁটাতে বলছ? ফোঁটাতে আমি পারব সাফ বলে দিচ্ছি তোমাকে।

–কী জ্বালা!–টেনিদা খেঁকিয়ে উঠল : কোনও কাজের নয় এই হতচ্ছাড়াটাখালি খেতেই জানে! ডিম কী করে ফেটাতে হয় তাও বলে দিতে হবে? গোড়াতে মুখগুলো একটু ভেঙে নে–তারপর পেয়ালায় ঢেলে চামচ দিয়ে বেশ করে নাড়তে থাক। বুঝেছিস?

আরে তাই তো! এতক্ষণে মালুম হল আমার। আমাদের পটলডাঙার ‘দি গ্রেট আবোর-খাবো রেস্তোরাঁ’র বয় কেষ্টাকে অনেকবার কাঁচের গেলাসে ডিমের গোলা মেশাতে দেখেছি বটে।

পয়লা ডিমটা ভাঙতেই একটা বিচ্ছিরি বদ গন্ধে সারা ঘর ভরে উঠল। দোসরা ডিম থেকেও সেই খোশবু।

নাক টিপে ধরে বললুম, টেনিদা–যাচ্ছেতাই গন্ধ বেরুচ্ছে কিন্তু ডিম থেকে!

টেনিদা স্টোভে তেল ভরতে-ভরতে বললে, ডিম থেকে কবে আবার গোলাপ ফুলের গন্ধ বেরোয়? নাকি ডিম ভাঙলে তা থেকে হালুয়ার সুবাস বেরুবে? নে–নিজের কাজ করে যা।

–পচা বলে মনে হচ্ছে আমার।

–তোর মাথার ঘিলুগুলোই পচে গেছে–টেনিদা চটে বললে, একটা ভালো কাজের গোড়াতেই তুই বাগড়া দিবি! নে–হাত চালা। তোর ইচ্ছে না হয় খাসনি–আমি যা পারি ম্যানেজ করে নেব।

–করো, তুমিই করো তবে বলে যেই তেসরা নম্বর ডিম মেজেতে ঠুকেছি—

গলগল করে মেজে থেকে যে বস্তু বেরিয়ে এল, তার যে কী নাম দেব তা আমি আজও জানি না। আর গন্ধ? মনে হল দুনিয়ার সমস্ত বিকট বদ গন্ধকে কে যেন ওর মধ্যে ঠেসে রেখেছিল–একেবারে বোমার মতো ফেটে বেরিয়ে এল তারা। মনে হল, এক্ষুনি আমার দম আটকে যাবে।

–গেছি–গেছি বলে আমি একদম ঠিকরে পড়লুম বাইরে। সেই দুর্ধর্ষ মারাত্মক গন্ধের ধাক্কায় বোঁ করে যেন মাথাটা ঘুরে গেল, আর আমি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লুম শিবনেত্র হয়ে।

–উঁরে ব্বাপ–ই কীঁ গন্ধ র‍্যা!–টেনিদার একটা আর্তনাদ শোনা গেল। তারপর—

এবং তারপরেই–

টেনিদাও খুব সম্ভব একটা লাফ মেরেছিল। এবং পেল্লায় লাফ। পায়ের ধাক্কায় জ্বলন্ত কেরোসিন স্টোভটা তেল ছড়াতে ছড়াতে বলের মতো গড়িয়ে এল–সোজা গিয়ে হাজির হল ডোম্বলদার শোবার ঘরের দরজার সামনে। আর ডোম্বল-বৌদির সাধের সম্বলপুরী পদ দাউদাউ করে জ্বলে উঠল তৎক্ষণাৎ!

টেনিদা বললে, আগুন–আগুনফায়ার ব্রিগেড বসবার ঘরে টেলিফোন আছে। প্যালা-দৌড়ে যা–জিরো ডায়েলফায়ার ব্রিগেড–

ঊর্ধ্বশ্বাসে ফোন করতে ঢুকেছি, সেই পাকার কার্পেটে পা আটকে গেল। হাতে টেলিফোনও তুলেছিলুম, সেইটে সুদুই ধপাস করে রাম-আছাড় খেলুম একটা। ক্র্যাংকড়াৎ করে আওয়াজ উঠল। টেলিফোনের মাউথ-পিসটা সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে দু-টুকরো। যাক, নিশ্চিন্দি! ফায়ার ব্রিগেডকে আর ডাকতে হল না!

উঠে বসবার আগেই ঝপাস–ঝপাস!

টেনিদা দৌড়ে বাথরুমে ঢুকেছে, আর দুবালতি পনেরো দিনের পচা জল চৌবাচ্চা থেকে তুলে এনে ছুঁড়ে দিয়েছে সম্বলপুরী পদার ওপর। আধখানা পর্দা পুড়িয়ে আগুন নিবেছে, কিন্তু শোবার ঘরে জলের ঢেউ খেলছে–বিছানা-পত্ৰ ভিজে একাকার, খানিকটা জল চলকে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলটাকেও সাফ-সুফ করে দিয়েছে।

নিজেদের কীর্তির দিকে তাকিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম আমরা। বাড়ি-ভর্তি পচা ডিম আর পোড়া কাপড়ের গন্ধবসবার ঘরে দুইঞ্চি ধুলোর আস্তর–শোবার ঘর আর বারান্দা জলে থইথই–আধ-পোড়া পদাটা থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে, টেলিফোনটা ভেঙে চুরমার।

একেই বলে বাড়ি সুপারভাইজ করা–এর নামই জীবে প্রেম!

ঠিক তখনই নীচ থেকে ট্যাক্সির হর্ন বেজে উঠল–ভ্যাঁ–ভ্যঁপ–প!

টেনিদা নড়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে মাথা সাফ হয়ে গেছে ওর। চিরকালই দেখে আসছি এটা।

–প্যালা, কুইক।

কিসের কুইক সেকথাও কি বলতে হবে আর? আমিও পটলডাঙার ছেলেট্যাক্সির হর্ন শুনেই বুঝতে পেরেছি সব। সিঁড়ি দিয়ে তো নামলুম না–যেন উড়ে পড়লুম রাস্তায়!

ট্যাক্সি থেকে ভোম্বলদা নামছেন, ভোম্বল-বৌদি নামছেন, ডোম্বলদার ছোঁকরা চাকর জলধরের কোলে ব্যাম্বি নামছে।

আমাদের দেখেই ভোম্বলদা চেঁচিয়ে উঠলেন–কীরে টেনি, বাড়িঘর সব–

–সব ঠিক আছে ভোম্বলদা–একেবারে ছবির মতো সাজিয়ে দিয়ে এসেছি বলেই টেনিদা চাবির গোছাটা ছুঁড়ে দিলে ভোলার দিকে। তারপর হতভম্ব ডোম্বলদা একটা কথা বলবার আগেই দু-জনে দুলাফে একটা দুনম্বর চলতি বাসের ওপর।

আর দাঁড়ানো চলে এরপর? এক সেকেণ্ডও?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress