Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

রোগী প্রচুর কথা বলছে

রোগী প্রচুর কথা বলছে। বর্তমান জগৎ বা পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে এখনও কৌতূহল দেখা যায় না। সর্বদা অতীতে স্থিতি। তবে স্মৃতিচারণ আগের মতো অতটা বিক্ষিপ্ত নয়। একটা নির্দিষ্ট ছক যেন আঁচ করা যায়। যে ঘটনাটি মনে পড়ে তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে রোগী এখন সমর্থ। শুধু তাই নয়, ঘটনার সঙ্গে তার জীবনের সম্পর্কের হদিসও স্পষ্ট। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে একদিন যে যোগাযোগ ছিল এবং এই যোগাযোগের টানাপড়েনেই যে জীবন এ সত্যটা ধীরে ধীরে তার চেতনায় আসছে।

রাতের নার্সের ওপর রাগ করে দুদিন সকলের সঙ্গে কথা বন্ধ করেছিল। নির্দেশ অনুযায়ী ওষুধের মাত্রা সাতদিন বাড়ানো চলল। এখন আবার স্বাভাবিক অর্থাৎনূ্যনতম মাত্রায় চালু। খিদে ও ঘুম মোটামুটি। সব মিলিয়ে রোগীর অবস্থা উন্নতির দিকে বলে মনে হয়। তবে অসুস্থতার দায়িত্ব অস্বীকার করে।

অতীতের স্মৃতি মন্থনে দেখি পরিবার নিকটজন বন্ধুবান্ধবের প্রতি তার আবেগ অনুভূতি একান্তভাবে অপূর্ণ। এমনভাবে কথা বলে যেন কোনও তৃতীয় ব্যক্তির জীবনকাহিনীর বিবরণ দিচ্ছে। যেন সে ব্যক্তি ভিন্ন সত্তা। বাস্তবের সঙ্গে সমস্যাটা কী নিজেকে মেনে নেওয়ার তীব্র অনিচ্ছা থেকে উদ্ভূত?

.

আমি কি সাফাই গাইছি? জীবিকাকে কেন্দ্র করেই পুরুষের জীবন আর আমার সেখানেই ঘাটতি খামতি। উন্নতির মইয়ে মাঝবরাবর উঠে আটকে গেলাম। শেষ ধাপে চড়ে বিজয় ঘঘাষণা হল না। অথচ কম ইন্ডাস্ট্রির আমি মদত যুগিয়েছি? সেগুলির মধ্যে দুটি লাভজনক হয়েছে। কটি অচিরেই রুগ্ণ বাদবাকির অস্তিত্ব শুধু কাগজে কলমে। প্ল্যান থেকে প্রোডাকশনের স্টেজেই এল না। এ সবের দায়ভার কি একা আমার? প্রত্যেকটির ক্ষেত্রে আমি আর পাঁচটা ফিনানসিয়াল ইনস্টিটিউশনের সঙ্গে একমত হয়ে সুপারিশ করেছি। এই তো খুব বিজ্ঞাপন-টিজ্ঞাপন দিয়ে কটকে অফিস খুলল সূর্য ব্রুয়ারিজ, খাঁটি দিশি মালিকানা, কারখানা পারাদীপে। তার তৈরি ককেস বিয়ার বাজারে রপ্তানি দিতে না দিতেই কোম্পানি লালবাতি। যার শেয়ারের দাম সেরদরে কাগজের চেয়ে বেশি নয় সেই কোম্পানি প্লান্ট সহ মোটা দামে কিনে নিল রাজ্য সরকার। প্রাক্তন মালিক মহান্তি কটকের বেস্ট এরিয়া তুলসীপুরে বিরাট বাড়ি করেছে, মার্বেলের মেঝে সেগুনকাঠের জানালা দরজা। সন্ধ্যায় স্কচ খেতে খেতে নাতনির সঙ্গে দাবা খেলে। যে মানবগোষ্ঠীতে উৎপাদন শুধু মালিকের ব্যক্তিগত ভোগের জন্য, যেখানে বিবর্তন এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের পর্যায়ে আসেনি সেখানে ইন্ডাস্ট্রি বসানোর অজুহাতে সরকারের মাথায় হাত বুলিয়ে মোটা টাকা বের করে নিয়ে ব্যক্তিবিশেষের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বৃদ্ধির প্রলোভন কে রুখবে। বসে খাবার ধান্দা যেখানে জীবনের পরমার্থ সেখানে বাণিজ্যের লেনদেন চলবে কী করে। হ্যাঁ আমার কর্তব্য ছিল প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি লোন কতটা এবং কেমন ভাবে সদ্ব্যবহার হচ্ছে দেখা। মনিটরিং করা তো বাইরে থেকে রিপোর্ট নেওয়া। দরকার ছিল গোয়েন্দাগিরি। তবে কার টাকা কে খরচ করে। পাবলিক সেক্টর মানে তো রুলিং পলিটিক্যাল পার্টির স্বার্থ অনুযায়ী হরির লুঠ। আর আমি তো সে খেলায় চুনোপুটি।

যেমন ধরা যাক গীতা থাপারের টি আই এল অর্থাৎ থাপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কেসটা। ভদ্রমহিলার তখন খুব নামডাক। ভারতের সবচেয়ে নামী মহিলা শিল্পোদ্যোগী যাঁর কেরিয়ার শুরু হরিয়ানায়, দুধ বেচে যিনি বছর পনেরোর মধ্যে একটি ছোটখাটো সাম্রাজ্যের অধিশ্বরীওষুধের কারখানা থেকে হাইফ্যাশানের জুতো তৈরি বা জল-স্থল অন্তরীক্ষে মাল ও মানুষ বহনের এজেন্সি—কী করেননি। চেহারাও তেমনি ইমপ্রেসিভ। ফর্সা লম্বা চওড়া কাঁধ ছাপানো একটাল কলপের দাক্ষিণ্যে কালো কুচকুচে চুল, চড়া মেকআপ, ঘন রঙের শাড়ি ব্লাউজ। পাঁচ মাইল দূর থেকে জানান দেয় খাঁটি আর্যকন্যা। সে সময় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর জহর নামে একটা কোট ছিল, সেটা গায়ে পড়লে কয়েক দশক সময় কোথায় উবে যেত। বাস্তবে তিনি যে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী, জহর কোট গায়ে চলে যেতেন তার চেয়ে পঞ্চাশ বছর পেছনে। এই সময় হজমটা তার অস্তিত্বের এত গভীরে স্থায়ী ছিল যে বহু বছর আগে তাঁর প্রথম মন্ত্রিত্বের সময় যে আমলার কাজে বিশেষ সন্তোষ পেয়েছিলেন এখন তিরিশ বছর বাদে সেই আমলাটিকে খুঁজে পেতে তর তামিলনাড়ুর অপেক্ষাকৃত অখ্যাত অবসরপ্রাপ্ত জীবন থেকে তুলে নিয়ে এসে সরকারের উপদেষ্টা পদে স্থাপিত করেন এবং সে পদটিতে ভদ্রলোক বছর দুয়েক সম্পূর্ণ কাজকর্ম ছাড়া কাটিয়ে একদিন ইস্তফা দিয়ে আবার তামিলনাড়ুতে ফিরে যান। জহর কোটের এমন মাহাত্ম্য যে এটি গায়ে পরলেই রাজ্যজুড়ে বিশাল বিশাল ইস্পাত প্রকল্পের স্বপ্ন মুখ্যমন্ত্রীর চোখে ভাসে। যেমনটি দেখা যেত একসময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ভারতে। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী সে কালের লোক। অতএব, দেশি-বিদেশি অনাবাসী সব জাতের সাদা কালো হলুদ সব রঙের শিল্পপতিদের তার রাজ্যে আমন্ত্রণ আপ্যায়ন, স্থানীয় খবরের কাগজে পাতা জুড়ে ছবিসহ বিস্তৃত বিবরণ। রেডিও টিভিতে ফলাও করে রাজ্য সরকারের সঙ্গে শিল্পপতিদের আলাপ-আলোচনার অগ্রগতির সংবাদ পরিবেশন। রাজ্যের যেখানে সেখানে ঘেঁটুপুজোর মতো ভূমিপুজোর ধুম (যার প্রত্যেকটিতে অমলকুমার দাসের উপস্থিতি লক্ষণীয়)।

সেই সময় এমন অনুকুল মাটিতে গীতা থাপারের মতো করিয়ে কম্মে মহিলার যে সাদর অভ্যর্থনা হবে তাতে আশ্চর্য কী। বিশেষ করে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী যখন স্ত্রীজাতির উন্নতি বিধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বয়সকালে তিনি শ্রেণী নির্বিশেষে স্ত্রী জাতিয়ার উন্নতির উৎস ছিলেন। এখন বার্ধক্যে তাঁর রেকর্ড হল রাজ্যে প্রতিটি মহিলা মহাবিদ্যালয় পরিদর্শন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে আতিথ্য গ্রহণ করতে গিয়ে অনুষ্ঠানের কয়েক ঘণ্টা আগেই হঠাৎ উপস্থিত হয়েছেন এবং সেখানকার ছাত্রী অধ্যাপিকাদের তাকে অন্তরঙ্গ আপ্যায়নের সুযোগ দিয়েছেন (নিন্দুকেরা অবশ্য বলে এর ফলে যে কলেজে বি. এ.-র টিউটোরিয়েল ক্লাস করার মতো জায়গা নেই, সেখানে এম. এক্লাস খোলার প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে এসেছেন। ) এমন নারীদরদী মুখ্যমন্ত্রীর আমলে যে মহিলা মালিকানায় টি আই এল রাজ্যের দ্বিতীয় ইস্পাত প্রকল্পের যোজনা প্রস্তুত করতে না করতেই তার অনুমোদন এবং কার্যে রূপান্তর ঘটবে তাতে আশ্চর্য কী। বলাবাহুল্য আই পি বি আই এর পক্ষ থেকে আমার অর্থাৎ অমল কুমার দাসের ভূমিকা অকৃপণ সহযোগিতার। উত্তর ভারতীয় কর্মতৎপরতা যে পূর্বভারতীয় দীর্ঘসূত্ৰী আলস্যের কত বিপরীত, টাকা খরচের ব্যাপারে চোখের সামনে প্রমাণ হয়ে গেল। ঢাকঢোল পিটিয়ে এক শুভদিনে প্রকল্প কার্যকরী, ব্লাষ্ট ফারনেস চালু। সে উপলক্ষে বড়াখানা এত বছর পেরিয়ে এত কাণ্ডকারখানার পরও মনে জ্বলজ্বল করছে। একেবারে চোখের সামনে ভাসে।

—এই যে অমলবাবু চুপ কইর‍্যা বাইরের দিকে তাকাইয়া এত কী ভাবসেন?কতক্ষণ ঘরে ঢুকসি ট্যারও পান নাই, কী এত ভাবছেন? আবার ছায়া দেবনাথ।

অগত্যা অমল উত্তর দেয়

-তেমন কিছু নয়। একটা পার্টির কথা মনে হল।

—পার্টি! বা বেশ কথা। এইটা একটু ভাল কইর‍্যা বলেন দেখি। আমি তো বাঙ্গাল, কস্মিনকালেও পার্টিফার্টি দেখি নাই। খালি আপনার হিন্দি ফিলিমে দেখি। আপনি তো বহু পার্টি করসেন।

-আরে আমার লাইফটাই তো ছিল একটার পর একটা পার্টি। হয় সোশ্যাল নয় অফিসিয়াল বা সেমিঅফিসিয়েল। কোন সালে বা মাসে আমি কী করছিলাম যদি জিজ্ঞাসা করো তো আমার প্রথমেই মনে হবে কোন্ কোন্ পার্টি অ্যাটেন্ড করেছিলাম।

এই পার্টিটার কথা তো বিশেষ করে মনে আছে অমলের। হ্যাঁ চোখের সামনে ভাসে মস্ত পর্দায় একটা স্টিল লাইফ। শৌখিন ঘরণীর দেওয়ালে যেমন শোভা পায় টেবিলের ওপর এক রাশ ফলের ছবি। স্পষ্ট দেখতে পায় সাদা ঢাকা দেওয়া গোল টেবিলের ওপর রঙবেরঙের একটি ফলের পাহাড়। চূড়ায় রয়েছে ফুলের মতো সাজানো পাকা পেঁপে। লম্বালম্বি সরু সরু করে কাটা তার গাঢ় কমলা রঙের ফালিগুলির পাঁপড়ি। পিঠটা পাতা সবুজ, ওপরে মিশকালো বিচির সারি। দুর থেকে মনে হতে পারে যেন দক্ষিণ এশিয়া বা আফ্রিকার উষ্ণ অঞ্চলের একটি নাম না জানা ফুল। তারই তলায় পুরো এক থাক হালকা হলুদ দিশি কদলী বা মর্তমান কলা। পাহাড়ের কোলে ম্যাটমেটে মেরুন আপেল ছড়ানো। মাঝের থাকে সবুজ দক্ষিণী কমলা। আর এই বিশাল রঙবেরঙের সম্ভারের সামনে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো পাতলা শ্যামবর্ণা দু-চারজন লোক। পরনে সাদামাঠা সার্টপ্যান্ট, হাবভাবে দ্বিধা। কারও হাতে কমলা, কারো বা কলা কিংবা আপেল। পেঁপেটা কী ভাবে নেবে বোধ হয় বুঝতে পারছে না। স্পষ্টতই এরা স্থানীয়, ভূমিপুত্র। সব বড় বড় জমায়েতেই এ ধরনের কিছু বেমানান রবাহূত অতিথি থাকে। একটু দূরে লনের বাইরের সীমানায় মেহেদির বেড়ার কাছে সন্তর্পণে ঘোরাঘুরি করছে কটা দিশি কুকুর। উচ্ছিষ্টের আশায়। দিশি তো, আর কী চাই।

ছায়া দেবনাথ বাধা দেয়।

—আচ্ছা এটা একটা কী বর্ণনা করতাসেন বলেন তো? পার্টি হইতাসে, জায়গাটা কোথায় কারা গেস্ট, ক্যামন ভোজনের ব্যবস্থা, কিছুই তো বললেন না। খালি কটা ফলফুলুরি বাজে লোক দিশি কুত্তা। আপনি না সত্যই আশ্চর্য।

সত্যি আশ্চর্য। পৃথিবীর একটি গরিব পিছিয়ে পড়া উপমহাদেশে সবচেয়ে গরিব পিছিয়ে পড়া রাজ্যের মধ্যে একটির রাজধানীতে সেই এলাহি পানভোজনের এই সামান্য অকিঞ্চিত্ত্বর দৃশ্যটি অমলের সবচেয়ে আগে মনে পড়ল। কেন আলিগড়ি কুর্তা পাজামা পরা দীর্ঘদেহী প্রায় গৌরবর্ণ পুরুষ, ডিজাইনার সালোয়ার কামিজ বা এক্সকুসিভবুটিকের শাড়িতে সুসজ্জিত অতি মহার্ঘ রূপটানে অধিক রমনীয় রমণীর দল–যাদের পাঁচজনের একজনকে মনে হয় বুঝি সুস্মিতা সেন আইশারিয়া রাই তারা সব গেল কই? চারিদিকে হিন্দুস্থানি ইংরিজির ফোয়ারা অল্পবয়সিদের কলকল হাসি ঠাট্টা তামাসা।

থাপার পরিবারের পরের জেনারেশন সবান্ধবে হাজির মনে হয়। আসল কথাই তো বলা হয়নি। টি আই এল অর্থাৎ থাপার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড-এর নতুন স্টিল প্ল্যান্টের ব্লাস্ট ফারনেস চালু হওয়া সেলিব্রেট করতে সেদিন উপস্থিত কজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, একজন আবার সস্ত্রীক। সঙ্গে পদমর্যাদা অনুযায়ী পার্শ্বচরের ঝক। বলাবাহুল্য রাজ্য সরকারের বাছাইকরা কজন মন্ত্রীও আছেন। আছেন আমলাতন্ত্রের সবচেয়ে ওপরের সারির পদাধিকারীরা, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার স্থানীয় প্রতিনিধি। এক কথায় রাজধানীর এভরি ওয়ান হু ম্যাটার্স।

—কোথাকার রাজধানী? ছায়া দেবনাথের বাধাদান। সব কথা তার অতি স্পষ্ট হওয়া চাই।

—ওড়িশার। ওড়িশা রাজ্যটা আছে তো? না কি উকলকন্ধমালকোশলকলিঙ্গ হয়ে গেছে। আমাদের মুনিঋষিরা কবেই বলে গেছেন আমি এক, বহু হব। অসমকে দেখ না অরুণাচল-মেঘালয় মিজোরাম আরও কত কি, মনেও থাকে না ছাতা-মাথা। ওটার পাবলিক নাম তো দ্য প্রবলেম অফ নর্থইস্ট। আমি পুরনো দিনের মানুষ। ওড়িশার এক লম্বাচওড়া কথা কওয়া লম্বাচওড়া মুখ্যমন্ত্রীর মতো টাইম মেশিনে সর্বদা বছর বিশ তিরিশ আগের সময়ে বাঁধা।

–কী যে সব রেফারেন্স দ্যান বুঝি না। তাছাড়া এত পিছাইয়া থাকেন ক্যান্? আজকের দিনটা কী ক্ষতি করল?

—আজকের দিনটার তো কোনও মানে নেই।

–কেন বলুন তো? হঠাৎ ছায়ার বাংলাটা ঠিক হয়ে যায়।

—আজকে তো আমি কেউ নই। ৩০২নং ঘরের পেশেন্ট।

—তখন কেউ ছিলেন?

—ছিলাম না? তখন চাকরি ছিল। কর্মই তো পুরুষের জীবন। ইন্ডিয়ার বেশ কয়েক জায়গায় আমি চাকরি করেছি। তবে সবচেয়ে বেশিদিন ছিলাম ভুবনেশ্বরে। সে সময়টা ছিল আমার জীবনের স্বর্ণযুগ।

আর তার আগে পরে কি তাম্রযুগ রৌপ্য যুগ? আপনি না পুরুষ মানুষ। এত সোনারূপায় মন ক্যান? এই দ্যাখেন আমরা তো কবে থাইক্যা প্লাস্টিক দস্তা টেরাকোটা এই সবেরই গয়না পরি। সোনারূপার কারবার কবে উইঠ্যা গেসে গিয়া।

–আরে স্বর্ণযুগ একটা কথার কথা। কতটা ভাল সময় বোঝানোর জন্য। সোনা খুব দামি তো।

—আচ্ছা কী কইতাছিলেন কন দেখি।

–উঃ ছায়া, তুমি থেকে থেকে বাঙাল হয়ে যাও কী করে বল তো। মাঝে মাঝে তো দিব্যি ঠিক মতো কথা বলল।

—চিন্তা করবেন না। লেখার সময় বাংলাদেশ বেতারের ভাষাই লিখি।

.

স্থান ওবেরয় ভুবনেশ্বর পাঁচতারা হোটেল। জনবসতি থেকে সে সময় একটু দুরে তার অবস্থিতি। চারদিকে ফঁকা, মাঝখানে যেন এক রাজপ্রাসাদ। নামী স্থপতির হাতে নকশা, মেঝেতে গ্রানাইট মার্বেলের ছড়াছড়ি। পানভোজনের কক্ষগুলিতে সোফাকৌচ চেয়ারের আচ্ছাদনে, সিলিং-এ দেওয়ালে দামি কাঠের কারুকাজে সর্বত্র এথনিক ছোঁওয়া। হয় ওড়িশার সুপরিচিত তাঁত বস্ত্রের নকশা নয়তো স্থানীয় বিখ্যাত মন্দিরশৈলী অনুসারী। সবই অবশ্য তৈরি রাজ্যের বাইরে। আজকে এত অতিথি সমাগম যে ভেতরে কুলোয়নি। গেট দিয়ে ঢুকে যে বিরাট লনটি একপাশে পড়ে সেখানেই আয়োজন। আলোর মালায় লেখা চোখে পড়ে ঢুকেই। টি আই এল ওয়েলকামস্ ইউ।

বাগানটিও আধুনিক। অর্থাৎ সেই আদ্যিকালের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তাজমহল কলকাতার ঘটি বড়লোকের তৈরি জ্যামিতিক আঁদের নয়। কোথাও গোল বা চারকোণা ক্ষেত্র নেই। নেই চারিদিকে সরলরেখায় নানারকম ফুলগাছ পাতাবাহার মন্দিরঝাউ। লনের আকৃতিই অসমান সামঞ্জস্যহীন। কোথাও চওড়া কোথাও সরু, যেন নদীর স্রোতের মতো বয়ে গেছে। জমি সমতল নয়। মাটি ফেলে জায়গায় জায়গায় ঢেউ খেলানো। এক একটি ঢেউয়ের ওপরে পাম গাছের ঝাড় যার তলায় সাজানো ছোট বড় মাটির কলসি বিভিন্ন আকারের টেরাকোটা পাত্র। লনের দুধারে অসমান ফুলগাছের ঝোঁপ। মুসান্ডা জবা রঙ্গন পাউডারপাফ। এক একটি ঝোপে এক এক রঙের ফুল। অর্থাৎ শুধু জাতি নয় রঙ হিসেব করেও গাছ লাগানো।

–বাপরে এত কেরামতি। কে করে কে এত? ছায়া দেবনাথের চোখেমুখে আন্তরিক বিস্ময়। অমল ভাবে, বেচারা গরিব ঘরের মেয়ে এত ফ্যাশানের বাগান কোথায় বা দেখবে। মায়া হয়। উত্তর দেয়,

–সে সময় বাগান করার বাই হয়েছিল সকলের। তাছাড়া ওড়িয়া মিডল আর আপার ক্লাসের বাগানে রুচি আছে। ওয়ান অফ দেয়ার মেনি প্লাস পয়েন্টস।

-বাগিচা করায় তো মেহনৎ লাগে। ওড়িয়ারা তাহলে খুব পরিশ্রমী?

-আরে না না সেরকম খাঁটিয়ে কিছু নয়। প্রচুর লোক লাগানো হত। তাদের মধ্যে তেলেগু লেবারই বেশি। এক একটি বাগানের পেছনে একটি করে বাহিনী।

–তাহলে খরচ তো এলাহি।

-সে তো বটেই, মালি মুলিয়ার মাইনে, গাছের বীজ চারা সব স্টেটের বাইরে থেকে আনা, সাব ইত্যাদির ব্যবস্থা। সবচেয়ে বড় কথা জল। ভুবনেশ্বরে তো শুকনো লাল মাটি। সেখানে মানুষই জল পায় না। একটি বাগান বাঁচিয়ে রাখা মানে হাতি পোষা। দেখতেই ভাল। তবে আমার খুব ভাল লাগত। আমি লোকের বাড়ি ক্লাব বা হোটেলের বাগানে যাই অতিথি হিসেবে। খরচ বা লোক খাটাবার মাথাব্যথা কিছুই আমার নেই। অল্প সময়ের বাসে শুধু একটাই ভূমিকা সম্ভব-কনজুমারের। আমি শুধু ভোজা।

–তারপর কী হইল?

–আবার তারপর। আচ্ছা বেশ। প্রত্যেকটি ফুলের ঝোপে টুনি বাবে ফুল ফুটে আছে। আবার যেখানে প্রকৃতি ফুল ফুটিয়েছে সেখানে বাল্বের আলো তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে জ্বলছে। লনে মেকসিকান গ্রাসের ঘন সবুজ মখমল। ইচ্ছে করে জুতো খুলে খালি পা ডুবিয়ে দিই। এত নরম ঘাস। লনের শেষ প্রান্তে নানা রঙের পাথরের চাই দিয়ে নকল পাহাড়। তার ফাঁকফোকরে লাগানো হয়েছে রকমারি কাটাগাছ ক্যাকটাস। কোথাও গোল গোল বল ধরে আছে, আবার কোথাও বা লম্বা শিড়িঙ্গে, এক আধটায় ঘন আগুন রঙের ফুল। রক গার্ডেনের নীচে লনের চেয়ে সামান্য উঁচু মঞ্চ। সেখানে দিশিমতে গানবাজনার আয়োজন। অর্থাৎ গাইয়ে বাজিয়েরা তলায় বসবে। যদিও গান আরম্ভ হয়নি কিন্তু মঞ্চের সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো মোল্ডেড চেয়ারে বসে বেশ কিছু দর্শক-বেশির ভাগ মধ্যবয়সী, অপেক্ষাকৃত কম সুসজ্জিতা এবং তেমন হিন্দি ইংরিজি না জানা মহিলার দল। হাতে বা পাশে নামানো পানীয়ের গেলাস। কমলা কি টমাটোর রস, অথবা সিট্রা সেভেন আপ পেপসি।

গলা ভেজানোর উদ্দেশ্যে অমল ইতিউতি চায়। লনের ডান দিকে সাদা চাদরে ঢাকা পর পর দুটি লম্বা টেবিলে পানীয়ের সম্ভার। টেবিলের পেছনে ব্যস্ত কর্মীর সারি। একটিতে টাটকা ফলের রস ও এরিয়েটেড ড্রিংকস্—সেখানে ভিড় প্রধানত মহিলা ও টিনএজারদের। অন্যটিতে অমলের অভীষ্ট। টেবিলের সামনে পরপর কয়েক সারি পুরুষের দল। কারো কারো সঙ্গিনীরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলার ভান করে অপেক্ষা করছে কখন সফল সঙ্গীটি দুহাতে দুটি গেলাস নিয়ে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসবে। গলা উঁচু করে অমল দেখে সব প্রিমিয়াম ব্র্যান্ড স্কচ-ওল্ড স্মাগলার, সিগ্রামের ছড়াছড়ি। রাম ভদকা বিয়ার পর্যন্ত ইম্পোর্টেড। অমল তার পছন্দ মতো একটি লার্জ স্কচ, বরফ সোডা সহ নিয়ে বেরুল। যথারীতি হ্যালো হাউ আর ইউ, নমস্কার, ক্যায়সে হ্যায় জী, দিল্লিমে বহুৎ ঠাণ্ডা ইত্যাদি অর্থহীন অথচ অত্যাবশ্যক আলাপে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে। এর জন্যই তো পার্টি জমায়েত। একেই বলে সোস্যালাইজিং—অপরিচিত বা সামান্য পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে আলোআঁধারিতে ওপর-ওপর হাল্কাহাল্কা আদান প্রদান যা সে রাত শেষ হওয়ার আগে সকলে ভুলে যাবে। এর চেয়ে বোধহয় বেশ্যার সঙ্গে তার বাবুর সম্পর্ক বেশি গভীরে যায়। চারিদিকে ফিটফাট উর্দিপরা ছোঁকরা বেয়ারার দল। সবার মুখে হিন্দি। একটার পর একটা ট্রে মুখের সামনে তোলা। জী লিজিয়ে, কেয়া হ্যায়? জী তন্দুরী পনীর, জী চিকেন টিক্কা, জী মাটন শিক কাবার, কিমা বল, ভেজিটেবিল পাকোরা চিজ অ্যান্ড পাইন অ্যাপ্ল…। বাপরে, শেষই হয় না। প্রত্যেকটা ট্রে থেকে একটা করে চাখলেও পেট ভরে যাবে।

স্টেজের দিক থেকে ঠুকঠাক তবলা বাঁধার আওয়াজ। এস্রাজ বেহালার মৃদু কাঁকে। গান শুরু হল বলে। সোনালি জরির কাজকরা কালো গলাবন্ধ ও কালো চোস্ত সজ্জিত গায়ক। বিউটিশিয়ানের কুশলী হাতে লালচে কালো মেহেদি রাঙা অবিন্যস্ত চুল। শুধু জুলপি দুটো সাদা। গায়ের রঙ গমের শীষ। ফোলাফোলা মুখ। যেন চেনাচেনা লাগছে। হ্যাঁ, এই তো সঞ্জীব উদাস যার একটার পর একটা বউ অ্যাকম্প্যানিস্টের সঙ্গে পালিয়ে গেছে। লোকটা এত নামধাম করেছে অথচ অ্যাকম্প্যানিস্ট কেন যে ঠিকমতো বাছতে পারে না কে জানে। এ সবের মধ্যে অমল খুঁজে কেন্দ্র ও রাজ্যের মন্ত্রীদের সঙ্গে হেঁ হেঁ করে আসে।

–বাব্বা। মন্ত্রীটন্ত্রীদের সঙ্গে আপনার দহরম মহরম সিল নাকি? ছায়ার প্রশ্ন। কৌতূহল কৌতুক কে জানে। অমল উত্তর দেয়,

–আরে, ভুবনেশ্বরে বাসের ওইটাই তো মজা। আমার মতো চুনোপুঁটিও সেখানে ভি আই পি। কলকাতায় থাকলে আমাকে কে পুঁছত। এই সবের জন্যই তো আমি রীতিমতো কাঠখড় পুড়িয়ে ঝাড়া বারোটি বছর ভুবনেশ্বরে রয়ে গেলাম।

–তাই বলতাসিলেন ভুবনেশ্বরে থাকাটা আপনার জীবনে স্বর্ণযুগ।

–এই তো দিব্যি বুঝতে শিখেছ। এখন বাংলাটা একটু–

–আরে রাখেন আপনার বাংলা। আপনাদের ওয়েস্ট ব্যাঙ্গল তো বহুভাষী রাজ্য। আপনাদের কাজকর্ম আপিসকাছারি আদালত কোত্থানে বাংলা চলে বলেন তো? কটা সাইন বোর্ড আছে কলকাতা শহরে বাংলায়? ভাষার কথা রাখেন। ভুবনেশ্বরে আপনার স্বর্ণযুগের কথা বলেন। সেটা বরং একটা নতুন জায়গা। আমি তো কখনও যাই নাই পুরী ভুবনেশ্বর। জায়গাটা ক্যামন?

চমৎকার। নতুন পরিচ্ছন্ন পরিকল্পিত শহর। চওড়া চওড়া রাস্তা। দুদিকে গাছের সারি। ব্যাঙ্গালোর অফ দি ইস্ট। অমলের জীবনে ভুবনেশ্বরের কোনও তুলনা নেই। কলকাতা তার কাছে লাগে! হলই বা জন্মস্থান, কর্মস্থান তো নয়, হ্যাঁ কাগজে কলমে অমল কিছুকাল কলকাতায় কাজ করেছে। সেটা দুঃস্বপ্ন। ভুলে যেতে চায়। কাগজে কলমে তো কত কীই থাকে। সে অনুযায়ী তো অমল কুমার দাসের কর্তব্যকর্মনতুন শিল্পদ্যোগে আর্থিক সাহায্যদান। কিন্তু ওটাতো ভিত্তিভূমি যার ওপর দাঁড়িয়েছিল অমলের জনসংযোগের বিরাট সৌধটি। পাবলিক রিলেশানই তো তার জীবন। ভুবনেশ্বরে সরকারি বেসরকারি বাণিজ্যিক সমস্ত রকম অনুষ্ঠানে অমল কুমার দাসের উপস্থিতি অবধারিত। সে সর্বত্র নিমন্ত্রিত। এই সম্মান সে জন্মভূমি কলকাতায় কখনও পেত। কে গ্রাহ্য করে তাকে সে শহরে যেখানে তার পরিচিতি আমাদের অমল? আরে আমাদের অমলকে মনে আছে? সেই যে ভূপেন স্যারের কাছে ইংরিজি নিয়ে রগড়ানি খেত বাংলা যুক্তাক্ষর উচ্চারণ করতে পারত না, বেটা কলকাত্তাই স-স করত, বাপটা ছিল কংগ্রেসের চাই। ইঞ্জিনিয়ারিং-এ অ্যাডমিশন তো কোটাতে….ইত্যাদি। এই তো হচ্ছে শালা কলকাতা। ভুবনেশ্বরে সে আই পি বি আই-এর ম্যানেজার। একটা চেয়ারে বসে। হাতে তার মোক্ষম অস্ত্র। একটা কলমের খোঁচায় কত ভবিষ্যতের আম্বানি হিন্দুজাকে খতম করে দিতে পারে।

–তার মানে দ্যাশে পাত্তা না পাইয়া আপনি বিদ্যাশে যাইয়া বসলেন। তাই ভুবলেশ্বরের লাইগ্যা আপনার এত প্রাম। বাঁশবনে শিয়াল রাজা।

ছায়া মেয়েটা একেবারে বাঙাল। এতটুকু রাখঢাক সভ্যতা ভব্যতা শেখেনি। যা মুখে আসে তাই ফট করে বলে দেয়। সামলানো দরকার,

–দেখো ছায়া, আমার বয়সটা খেয়াল আছে? এত ফাজলামি করো কেন?

–আহা চটেন ক্যান। একটু ঠাট্টা করসিলাম। ছায়ার ছায়াবাজি আর অমল কুমারের ধান্দাবাজি। তারপর কী হইল বলেন।

ঘণ্টাখানেক অনর্গল হিন্দি-ইংরিজি আলাপের পর অমল হঠাৎ শোনে খাঁটি ওড়িয়ায় সম্ভাষণ, পেছন থেকে–

–নমস্কার, মিঃ দাস কেত্তে বেলে আসিলে? মুখ ফিরিয়ে দেখে টাটার স্থানীয় কর্তা টি মিশ্র, সঙ্গে সাধারণ শ্যামলা চেহারার মাঝবয়সি মহিলা, পরনে তিনহাজারি বোমকাই শাড়ি। অমল আবার ওড়িয়াটা তেমন রপ্ত করতে পারেনি। ছেলেবেলা থেকে ভাষা ব্যাপারটাতেই সে কঁচা। কত কষ্টে মাতৃভাষা বাংলাটা ঠিকমতো বলতে শিখেছে। ইংরিজি তো পদে পদে মৈত্রেয়ী শোধরায়। কাজেই বাংলাতেই উত্তর দেয়,

-না, আপনি আর আলাপ করালেন কবে, ঠেস দিয়ে বলে। এতকাল টাটা কোম্পানির গরবে গরবী টি মিশ্র অমল কুমার দাসের মতো মাঝারি মাপের ম্যানেজারকে পাত্তাই দিত না, হলই বা ফিনানসিয়াল ইনস্টিটিউশনের কর্তা। ভুবনেশ্বর ক্লাবের বার-এ বেটার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়। কখনও নমস্কারটুকুও করে না, সর্বদা এমন ভাব যেন অমল কুমার দাস তার নজরের যোগ্যই নয়। আজ হঠাৎ প্রেম উথলে উঠল কেন?

-ডিনর খাইছন্তি? সমস্তে কহুছন্তি বঢ়িয়া করিছি। বহুৎ গুড়া আইটেম। চালস্তু, যিবা খাইবাবু।

গেল। সত্যি খাওয়াটা দুর্ধর্ষ। মাছমাংস সবজি সব পদের একাধিক ব্যঞ্জন। ভেটকি ফ্রাই, প্রন ওরলি। চিকেন তন্দুর, চিকেন বাটার মসলা, বোনলেস মাটন কষা, কিমা মটর। ভাতকটির জায়গায় নিরামিষ পোলাও, ফ্রায়েড রাইস, কুলচা নান পুরি। নিরামিষের মধ্যে ডাল ফ্রাই, রাজমা। পালক পনির, গোবিআলু এবং সেই অবধারিত নবরতন কারি যা কিশমিশ-টিশমিশে এত মিষ্টি যে অমলের মতো খাস কলকাত্তাই জিভেও অরুচি। স্যালাডের জন্য একটা আলাদা টেবিলে আয়োজন–তখন তো হেলথ ফুড-এর বাই সকলের। সারি সারি কঁচা শাকসবজি রকমারি আকারেকাটা, রঙ মিলিয়ে সাজানো বিভিন্ন স্টাইলে মেশান। কিছু বিলিতি সস মাখা। আবার কোনওটা দিশি রায়তা–সাদা দই-এ শসা টমাটো গাজর পেঁয়াজের কুচি। উপরে ছড়ানো মশলার গুঁড়ো। শুধু স্যালাডেই একজনের পুরো খাওয়া হয়ে যায়।

কোথায় যেন অমল শুনেছিল বিদেশে বুফে মানে লম্বা টেবিলে সাজানো বহু প্রকার পদ যার থেকে অতিথিরা যার যার পছন্দ মতো কয়েকটা বেছে নেয়। আমাদের দেশে বুফে মানে পাত পেতে খাবার বদলে দাঁড়িয়ে খাওয়া। অর্থাৎ প্রত্যেকের প্রত্যেকটি পদ নেওয়া চাই। ফলে এক একজনের প্লেটে এই উঁচু স্তূপ। ডালের সঙ্গে কিমা মটর, চিকেন বাটার মশলার সঙ্গে রায়তা। সব মিলেমিশে অদ্ভুত ঘাট যার সর্বত্র একটাই স্বাদ, প্রচুর তেলমশলায় অভ্রান্ত উত্তর ভারতীয়ত্ব। সবাই হাপুসহুপুস করে খাচ্ছে। ছেলেবেলায় অমল কলকাতার বাড়িতে দেখেছে গা থেকে প্রথম কাজে এসে নতুন ঝি-চাকর গোগ্রাসে গিলছে। ঠাট্টা শুনত, ব্যাটা ভাত নিয়েছে দেখ বেড়াল ডিঙোতে পারে না। দু বেলা নিয়মিত পেট পুরে খাবার অভ্যাস যাদের নেই তাদের কাঙালিপনায় সকলের সকৌতুক ক্ষমাই থাকত। চাকুরি জীবনে বুফে লাঞ্চ ডিনারের হিড়িকে অমল দেখে মধ্যবিত্ত উচ্চমধ্যবিত্ত সকলেরই সেই কাঙালি মানসিকতা। প্রত্যেকে ফঁসির খাওয়া খাচ্ছে। অমল আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাল খেতে জুত পায় না। নিরামিষ-টিরামিষগুলো বাদই দেয়।

—সুইট ডিশ নেবে তো? মিশ্র এখনও অমলের সঙ্গ ছাড়েনি। তার স্ত্রী বলা বাহুল্য নিরামিষের দলে—এখানে তো বেশির ভাগ লোক বিশেষত মেয়েরা অধিকাংশ দিন নিরামিষ খায়। কিন্তু আজ মিশ্র অমলের প্রতি এত সদয় কেন তো বোঝা যাচ্ছে না।

-হ্যাঁ নেব। চলুন দেখি কোথায়।

মিষ্টির টেবিলে তিনরকম আয়োজন। এক ধারে গরম গরম জিলিপি। অন্যদিকে বেয়ারা প্লেটে সাজিয়ে দিচ্ছে ভ্যানিলা আইসক্রিম আর তার ওপরে ঢালা গরম গরম চকোলেট সস। কী নেবে ভাবছে এমন সময় মাঝখানের অন্নদাতাটি সাগ্রহে বলে উঠল,

-লিজিয়ে সাব রসমালাই লিজিয়ে।

রসমালাই। খট করে কানে লাগে। দেখে সারি সারি চিনে মাটির বাটিতে খুদে খুদে রসগোল্লার পায়েস জাতীয় কিছু। রসমালাইয়ের ভারতীয়করণ।

থাক বাবা। আইসক্রিমই নেয়।

-হোটেলটা বঢ়িয়া চালিছি, নুহে? ম্যাজিসিয়ান যেমন দুহাতে তিনখানা বল নিয়ে অনায়াসে লোফালুফিকরে প্রায় তেমনই দক্ষতার সঙ্গে মিশ্র জিলিপি আইসক্রিম ও রসমালাই খাবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কেমন বিরক্ত লাগে অমলের। ইচ্ছে হয় মিশ্রর এই খুশিখুশি গদগদ ভাবে পিন ফুটিয়ে দেয়।

–কোথায় আর চলছে। এখন দুদিন এই টি আই এল-এর দৌলতে কিছু খদ্দের জুটেছে। একটা বড় ককটেল ডিনার পার্টির কনট্রাক্ট পেয়েছে। আদার ওয়াইজ অবস্থা খুব খারাপ।

—সতরে! কাঁহিকি? ওড়িশারে তো ট্যুরিজম ভাল চালে।

—টুরিজম ভাল চলে সত্যি, আ মেজর সোর্স অফ স্টেট রেভিন। তবে আসে মেইনলি বেঙ্গলি ট্যুরিস্ট এবং তাদের বেশির ভাগ মিল ক্লাস। ফাঁইভস্টার হোটেলে কজন ওঠে? তাছাড়া বাঙালিরা সাধারণত পুরীতে বেস করে ওড়িশা ঘোরে, ভুবনেশ্বরে থাকে না।

—বঙ্গালি মানে রহু নাহান্তি সত হেই পারে। কিন্তু ফরেনার বহুৎ আসুছন্তি। মু নিজে কেত্তে থর এইঠি ফরেন টুরিস্ট দেখিছি।

—সে সব ফরেনার রাশিয়ান ইষ্টইয়োরোপিয়ান। একটা সময়ে রুবল রুপি এক্সচেঞ্জ রেট ওদের কাছে খুব সুবিধাজনক হওয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ট্যুরিস্ট আসত। আর এই ওবেরয় পেত ব্লক বুকিং। সোভিয়েত ইউনিয়নের কোলান্সের পর থেকে সে সব বন্ধ। হিন্দি রুশি ভাইভাই জমানা খতম। দ্য হ্যানিমুন ইজ ওভার।

—কেড়ে অদ্ভুত দুনিয়া হেইছি দেখন্তু মিঃ দাস। হজার হজার মাইল দূররে কৌঠি কম্যুনিস্ট সিসটেম ফেইল কলা, আউ আম ওড়িশারে হোটেল চালুনি।

-গ্লোবালাইজেশানের যুগ মিঃ মিশ্র। আমরা সবাই কানেক্‌টেড। কেউ আইল্যান্ড নই। এমন সবজান্তা ভঙ্গিতে অমল বলে যেন কথাগুলো রোজ খবরের কাগজে মিশ্র-র চেখে পড়ে না। বেটা উড়েকে পেয়েছে একদিন হাতে। আজ চারিদিকে হিন্দি-ইংরিজি দাপটে বঙ্গালির সঙ্গে খাতির জমাতে এসেছে। মনে পড়েছে কারা ঘরের পাশের মানুষ। অমল যেন ঘাস খায়।

ওদিকে মঞ্চে গান শুরু হয়ে গেছে। মোহে আয়ি না জগসে লাজ ম্যায় অ্যায়সা জোর সে নাচি আজ কি ঘুংরু-উ-উ টুট গয়ে-এ, ঘুংরু-উ টুট গয়ে এ-এ ঘুংরু-উ-উ টুট গয়ে। তবলা এস্রাজ বেহালার সঙ্গত। অল্পবয়সি ফর্সাফা ইংরিজিবলা যে দলটি হাসিগল্পে সবচেয়ে সোচ্চার তারা মঞ্চের সামনে খোলা জায়গাটিতে নাচ শুরু করেছে। স্পষ্টত শহরে তারা অতিথি।

এ সব নাচের মজা হচ্ছে যে যা ইচ্ছে করতে পারে। কোনও কিছু তালিম লাগে না। খালি গানের তালেতালে শরীরের বিভিন্ন অংশ দোলানো। অমল নিজেও কত ডান্স করেছে। ড্রিংসের পর দারুণ এক্সারসাইজ। হজম ঘুম সব কিছুর পক্ষে ভাল।

—আপনি নাচতেন না কি? হেসে গড়ায় ছায়া দেবনাথ।

-হাসছ? বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। সে সব বয়সকালের কথা। জানো তখন আমার শরীরটা অনেক ভারী ছিল। তাই নিয়েই ডান্স করতাম। দম ছিল খুব। কত রোগাপাতলা ছোঁড়াদের হারিয়েছি। তাদের হাঁফ ধরে যেত আমি চালিয়ে যেতাম।

তবে সে রাতে অমল নাচেনি। তার নাচফাচ ওই নিজেদের মধ্যে। অর্থাৎ একতা ক্লাবের একান্ত জমায়েতেই সীমাবন্ধ। সেখানে সে সকলের অমলদা। এখানে সে আই পি বি আই-এর ম্যানেজার, নাচের প্রশ্ন ওঠে না। কোনও একটা অলিখিত নিয়মে এ ধরনের আনুষ্ঠানিক নৈশভোজে সরকারের সঙ্গে যুক্ত কারও প্রচলিত সংযমের গণ্ডী পেরনোর উপায় নেই। তারা শুধু দর্শক। তবে এখন সব দর্শকদের দৃষ্টি একটি মেয়ের দিকে। গায়ে হাত কাটা গেঞ্জি। রঙ গাঢ় গোলাপি যাকে বলে রানি পিংক। তলায় কালো আঁটসাঁট শর্টস। কাঁধ ছাপিয়ে সোজা কালো একটাল চুল, তার ছাঁটকাট যেন অনেকটা বহুকাল আগে দেখা এলিজাবেথ টেলরের ক্লিওপেট্রা মনে করিয়ে দেয়। মাথার তালুতে রাখা গেলাস। তাতে হাল্কা হলুদ পানীয়। হুইস্কি না? গেলাসটা হাতে না ছুঁয়ে মেয়েটি দিব্যি তাল মিলিয়ে চলছে। নাচ না সার্কাস ম্যাজিক। সে রাতে চারিদিকে কেমন ম্যাজিক ম্যাজিক আবহাওয়া। বাগানটা টুনি বাল্বে পরির রাজ্য। চারিদিকে মানুষজন যেন অন্য গ্রহের, যেখানে দারিদ্র্য নেই, নেই পিছিয়ে পড়ার অভিশাপ। এমন কি গীতা থাপারের নেহাত সাদামাঠা বেঁটেখাটো শ্যামবর্ণ মিলিটারি ছাঁট চুল স্বামীটিও তেমন সাধারণ নন। সোনালি জরির কাজ করা জমকালো গলাবন্ধে যেন আজ তার কেমন যাদুকর যাদুকর ভঙ্গি। অপেক্ষাকৃত বয়স্কদের নাচের আসরে ভাগ নিতে নেতৃত্ব দিলেন তিনি। গেঞ্জি হাফপ্যান্ট পরিহিতা যাদুরীর সঙ্গে খানিকক্ষণ সঙ্গত। সামাজিকতা তার কর্তব্য। গীতা থাপারের ওপর যে কোনও প্রচারমুখী নিবন্ধে অবধারিত মিঃ থাপারের সহাস্যমুখ বিজ্ঞাপন-স্ত্রীর কৃতিত্বে গর্বিত, তার উন্নতিতে সর্বপ্রকারে সহযোগী, প্রয়োজনে ঘরগৃহস্থালী শিশুপালনে উল্লেখযোগ্য দায়বহনকারী, সাপোর্টিভ হাসব্যান্ড ইত্যাদি। এক কথায় নতুন ভারতের নতুন পুরুষ। হাই ক্যালি পত্নীর লো ক্যালি পতি। চিরাচরিত পুরুষপ্রধান দুনিয়ার সফল স্বামীর গরবে গরবিনী স্ত্রীর উত্তরআধুনিক নারীবাদী প্রতিরূপ।

ভারী ভারী সিল্ক আর পোশাকি গহনায় জবুথবু মহিলার দল দর্শকের আসনে। হাঁ করে গিলছে উদ্দাম নাচের দৃশ্যটি। মুখে টুশব্দটি নেই। বাড়ি ফিরে গিয়ে স্বামীদের বলবেন,

—পঞ্জাবি ঝিঅগুড়া দেখিল। ছি ছি লাজলজ্জা কিচ্ছি নাহি।

এদিকে ছেলেমেয়েদের পঞ্জাবি বানাবার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। নামকরা ওড়িয়া পরিবার মানেই একটি অনওড়িয়া সাধারণত পঞ্জাবি বউ বা মা। আগের জেনারেশানে যেমন ছিল বাঙালি মা বা বউ। এমনকি পুষ্যি নেবার বেলাতেও বাঙালি। ওড়িশার কীর্তিমান পরিবারে খাঁটি ওড়িয়া রক্ত দুর্লভ। প্রথম প্রথম অমলের অবাক লাগত। কটক ভুবনেশ্বর এমন কিছু বড় শহর নয়। মহানগরীর পাঁচমেশালি পরিবেশ নেই। খবরের কাগজে সর্বদা ওড়িয়া জাতীয়তাবাদের জয়গান-অনওড়িয়া বিরাগ সমস্ত রাজনৈতিক দলের সর্বসম্মত নীতি। এখন তার মজা লাগে। সত্যি কথা বলতে কি এই আপাতবিরোধ আর অদ্ভুত কিছু মনে হয় না, বরং ওড়িয়াদের সঙ্গে সহমর্মিতা বোধ হয়। বাঙালি জাতীয়তা বলে তো কিছু নেই। বাঙালি তো হয় ইন্ডিয়ান নয় ইন্টারন্যাশনাল। যেটুকু বাঙালিয়ানা কলকাতায় আছে তাতে শুধু আঁতলেমি, সাহিত্য থেকে আর্টফিল্ম। অমল সে সবের ধার ধারে না কোনওদিন। আর বাঙালির পলিটিক্স এখন একরঙা, লাল। অমল একুশে পা দিতে না দিতেই দেখেছে তেরঙ্গার দিন অবসান, হা। তাদের পাড়াতে এখনও কংগ্রেস জেতে। কিন্তু বলি জিতে হয়টা কী? সে রমরমা দিন তো আর নেই। বরং ওড়িশায় সেদিক দিয়ে কিছু সম্ভাবনা আছে। এই তো ববি মুখার্জির ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড পুরনো কংগ্রেসি বলে বেঙ্গলে চিংড়ি চাষ করতে পারছিল না। অমলের মারফত এখানে লাইন পেয়ে গেছে। বালেশ্বরে প্রাইম লোকেশান-এ দিব্যি ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। সঙ্গে জামাইবাবু ও দুজন ওড়িয়া তাদের একজন আবার ডাকাবুকো আই এ এস-বলাবাহুল্য বেনামে। কংগ্রেসিকে কংগ্রেসি না দেখলে চলে। বাঙালি হয়ে লাভ কী! বেঙ্গলে করে খেতে পারবে?

-এই যে অমলবাবু, কেমন আছেন? পার্টি কেমন জমেছে দেখেছেন? পাশের চেয়ারে এসে বসে তপন মিত্র। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিনানসিয়াল কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার রিজিওন্যাল ম্যানেজার।

–দারুণ। ফ্যানটাসটিক। যেমন ড্রিংক্স তেমনই খাবার। ব্লাস্ট ফারনেস চালু হতেই। যদি এই তাহলে প্রোডাক্ট যখন বাজারে যাবে তখন কী রকম পার্টি হবে বুঝুন।

—তখন লবডঙ্কা।

–সে আবার কি। লবডঙ্কা মানে? কেমন একটা অজানা ভয় অমলকে গ্রাস করে।

—সেদিন কি আর আসবে মনে করছেন? আমার তো ইনফরমেশান ব্লাস্ট ফারনেস চালুফালু কিছুই হয়নি। পুরনো টায়ার কিছু পুড়েছে।

অমলের পা দুটো কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। এই শীতেও। চারটে প্রিমিয়াম স্কচ, ফাঁইভস্টার ডিনারের সতৃপ্ত আমেজ যেন নিমেষে উধাও।

-যাঃ কী যে বলেন। আপনার মশাই সন্দেহ বাতিক। এত বড় একটা ব্যাপার, সেন্টার স্টেট সব গভর্মেন্ট ইনভড, কার্ড ছেপেছে। আর আপনি কি না বলছেন সব ধাপ্পা।

—একজাক্টলি, সব ধাপ্পা। আপনি তো মশাই খুব সাকুলেট করেন। সবাই বলে ভুবনেশ্বরের ককটেল-ডিনারে দুটো কমন ফিচার, বিসলেরি সোডা আর অমল দাস। টি আই এল-এর জেনারেল ম্যানেজার বি সি খান্নাকে জানেন তো? সেই যার অ্যানুয়েল কমপেনসেশাসন নাকি থ্রি পয়েন্ট ফাঁইভ প্লাস পার্কসবলে কত ঢাকঢোল পেটানো? জানেন গত তিনমাস ধরে সে মাইনে পায় না? এবারে অমলের মাথার মধ্যে টং করে কি একটা বাজল। সত্যি তো গুজবটা তারও কানে এসেছে। আশ্চর্য, কথাটাকে পাত্তা দেয়নি কেন? দিতে চায়নি বলে।

-তাহলে এমন এলাহি খানাপিনা পাবলিসিটি কিসের জন্য?

-অবাক করলেন মশাই। আপনার মতো ঝানু লোক দেখি দুধের খোকা হয়ে গেলেন। সামনে লোকসভার ইলেকশন, রুলিং পার্টির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। গভমেন্ট আর গীতা থাপার, দুজনেরই এক উদ্দেশ্য এক স্বার্থ। পাবলিকের চোখে ধুলো দাও। যা নেই তা আছে বলে দেখাও। সকলেই ম্যাজিসিয়ান।

-তাহলে কী হবে? অমলের মুখ ফস্কে বেরিয়ে যায়। হয়তো মুখেচোখে তেমন কিছু ভাবও ফোটে। তপন মিত্র বলে,

–আরে, ঘাবড়াচ্ছেন কেন। আপনার আই পি বি আই গীতা থাপারকে মোটা টাকা লোন দিয়েছে বলে। দূর মশাই। টাকা তো কত কে দিয়েছে। আমরা দিইনি? তাতে কী আমার রাতে ঘুম হচ্ছে না? আমাদের কোনও দায়িত্ব নেই। বুঝলেন না আমরা হচ্ছি পাবলিক সেক্টরের পাবলিক সারভেন্ট। আমাদের মারে কে। পরের টাকা পরমানন্দ যত ভোগে যায় তত আনন্দ। এই তত পাবলিক সেক্টরের ফিলজফি। ভয় পাচ্ছেন কেন। আপনি আমি সব এক দলে, দশে মিলে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ। চলুন আরেকটা ড্রিংক নিয়ে এসে আরাম করে গান টান শোনা যাক। শুনলাম সব ইম্পোর্টেড লিকোয়ের রেখেছে। ভাল কনিয়াকও। আফটার ডিনার যদি কেউ ইচ্ছে করেন। চলুন চলুন যা পাওয়া যায়।

ঠিক। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও। এতো অমলেরও জীবন দর্শন। তপন মিত্র নিল একটা কাম্পারি, অমল কনিয়াক। কিন্তু এনজয় করার মতো মনটা আর নেই। কমিনিটে যেন সব বদলে গেছে, আলো ঝলমলে পরীর রাজ্য আস্তে আস্তে কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। চারিদিকে হিন্দি ইংরিজি কোলাহল, এমনকী মঞ্চ থেকে মাইকে ভেসে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া ঘুংরু-উ-উ টু টগয়ে-এতার কানে প্রায় অবোধ্য গুঞ্জন। সুসজ্জিত নারীপুরুষের দল ধীরে ধীরে রঙরূপ হারিয়ে হয়ে যাচ্ছে সারি সারি ছায়ামূর্তি। রঙিন চকচকে গ্লসি প্রিন্ট থেকে কালো নেগেটিভ। টি আই এল, একতার আগামী বিচিত্রানুষষ্ঠানের প্রধান স্পনসর। এটি করার জন্য গীতা থাপারকে কম ভুজুং ভাজুং দিতে হয়েছে। মোটা লোন-এর আকর্ষণীয় মোড়কে কালচারের ক্যাপসুল। তপন মিত্তিরের তো আর সে সমস্যা নেই সে তো শুধু একতার ফাংশন দেখতে শুনতে আসে। আর অমল তো থাকে পর্দার পেছনে। মঞ্চে

পুতুলদের পা বাঁধা সুতো তারই হাতে ধরা। এবারে ছমাস আগে থেকে বুক করা—কুমার ভানু অ্যান্ড পার্টি। কটকইনডোর স্টেডিয়ামে মেগাফাংশনের পরিকল্পনা। ভুবনেশ্বরে অমলের শেষ সর্বভারতীয় অনুষ্ঠান। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বারো বছর রয়ে গেছে। ব্যাঙ্ক আর কিছুতেই রাখবে না। বদলি করলে ভুবনেশ্বর ছাড়তে হবে। ভুবনেশ্বর ছাড়লে অমল কি আর অমল থাকবে? তার একতা ক্লাব মৈত্রেয়ী

-নমস্কার। ক্যায়সে হ্যায় মিঃ দাস?

অমলের চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ে। সামনে বেণীপ্রসাদ কেজরিওয়াল, ওড়িশায় স্থায়ী বাসিন্দা মাড়োয়ারিদের প্রধান, বেশ কবছর উৎকল চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রাজস্থানের সতীখ্যাত ঝুনুঝুনু থেকে কপুরুষ আগে লোটাকম্বল অবলম্বন করে হাওড়ায় আগমন। অতঃপর হাওড়া বাসে বাণিজ্যে সাফল্যলাভ, ব্যবসা প্রসারণ এবং বর্তমানে স্থিতি অধিকতর সবুজ ক্ষেত্র ওড়িশায়। কটকে চৌধুরীবাজারে পৈতৃক বাড়ি। খুবই ভাল চলিত বাংলা ও ওড়িয়া বলেন। আজ হঠাৎ হিন্দি? এই কদিন আগেতো ইন্ডাস্ট্রিজ মিনিস্টারের ঘরে একটা অ্যাগ্রো বেসড জয়েন্ট সেক্টর ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে ডিসকাশানে অমল গিয়ে দেখে ঘরে বসে কেজরিওয়াল। মন্ত্রী ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান আর এম ডি-র পাঠানো নোট পড়ে বলেছেন মাদ্রাজ আর কেরালায় যদি ওড়িশার কেন্দু লিফ অর্থাৎ বিড়ি পাতার এত চাহিদা এবং আমাদের সম্বলপুর এলাকার কেন্দু যখন বেস্ট কোয়ালিটি, ওরা খুব ভাল দাম দিতে রাজি, তাহলে ওখানেই বেশি করে পাঠাতে হয়। স্টেট ভাল প্রফিট করবে। ব্যস অমনি মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছে।

—আইজ্ঞা আম ওড়িশারু সবু বাহারে চালি যাউচি। আপন আইজ্ঞা সিএমকু টিকি কহন্তু। চিফ মিনিস্টার ইন্টারভিন নকলে সর্বনাশ হেই যিব। আউটসাইডার মানে আসি সবু বহি কিরি নেই যিবে। আম্ভে ওড়িয়ামানে কিছি পাইবু নি…

.

প্রকৃতির অকৃপণ দান ছড়িয়ে আছে ওড়িশার মাটিতে জঙ্গলে। আর তোমরা কজন কেজরিওয়াল বাজোরিয়া ঝুনঝুনওয়ালা দিব্যি কটা নন্দমহান্তি সাহুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে কেন্দু শালসিড তেঁতুলের বিচি কাঠ গ্রাফাইট ক্রোমাইট গ্রানাইট যেখানে যা পাচ্ছ মিনিমাম দামে লুটেপুটে একচেটিয়া বাজারের ফায়দা ওঠাচ্ছ শুধু ওই এক বেদমন্ত্র জপে, আম ওড়িশা আম্ভে ওড়িয়ামানে। বাইরের কাউকে ঢুকতে দেব না। নিজের পাঁঠা নিজে যেমন ইচ্ছে কাটব।

.

আচ্ছা আমাদের ভারতীয় জাতীয়তাবাদও কি অনেকটা ওই ধাঁচের নয়? পশ্চিমের বহু সাধনায় অর্জিত বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা প্রয়োগ করে এদেশে সাহেবরা গড়ে তুলেছিল কলকারখানা ব্যবসাবাণিজ্য এবং সেগুলি চলবার মতো আইনশৃঙ্খলাশাসিত বিরাট সাম্রাজ্য। সেই রেডিমেড আলিবাবার ধনভাণ্ডারের ওপর স্বত্ব সাব্যস্ত করাই কি ছিল আসল উদ্দেশ্য? আমাদের দেশ থেকে পঁচা মাল নিয়ে সাহেবদের কলকারখানায় উৎপাদন রমরমা। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব আমাদের দৌলতে। আর সেই আমরা বিলেতে তৈরি জিনিস কিনতে বাধ্য হই। বেশি দামে। অর্থাৎ আমাদের ধনসম্পদ সব বাইরে চলে যাচ্ছে। হরিচরণ দাস বিএবিএল কংগ্রেসকর্মী দেশপ্রেমিক কত ক্ষোভে ঘরে বাইরে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের শোষণের চক্রান্ত ব্যাখ্যা করতেন। আমার ছেলেবেলাতেও ছিল তার রেশ। তখনও তিনি কলকাতা কর্পোরেশনে স্থানীয় প্রতিনিধি।

স্বাধীনতার দুদশক যেতে না যেতেই পূজ্যপাদ পিতৃদেব কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়লেন। টমসন জনসন ম্যাকলয়েড ম্যাকেঞ্জিদের শিল্পবাণিজ্য স্বাধীন হতে লাগল বিড়লা গোয়েঙ্কা খৈতান সিংহানিয়াদের হাতে। নতুন মালিকরা গরিব দেশের সন্তান, অতএব তাদের নীতি খরচ কম মুনাফা বেশি। সাম্রাজ্যবাদী ধনতন্ত্রী পশ্চিম থেকে দরিদ্র প্রাক্তন উপনিবেশকে আত্মরক্ষা করতে হয় দরজা জানালা বন্ধ করে। শুরু হল মিশ্র অর্থনীতির ঘোমটার আড়ালে একচেটিয়া মুনাফাবাজির স্বর্ণযুগ। তৃতীয় বিশ্বের মাটিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের বীজে ফলল নতুন ফসল—অর্থও প্রতিপত্তির মেলবন্ধন। কজন লোকপ্রতিনিধি কোন শিল্পপতির লবিতে থাকবে তার হিসেব অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন। চিত্তরঞ্জন দাশের অনুগামী হরিচরণ দাস নয়া জমানায় হালে পানি পান না। কতদিন লাগল বুঝতে যে তাঁদের মতো দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদীর আর প্রয়োজন নেই? ইংরিজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তো শিখণ্ডীমাত্র। পেছনে আসল শক্তি আসল সংগ্রাম বাংগুর বাজাজ বাজোরিয়ার, যাঁরা সামতান্ত্রিক বণিক থেকে ধনতান্ত্রিক পুঁজিপতিতে রূপান্তরিত হতে চলেছেন। বার্ধক্যের প্রান্তে হরিচরণ কি হৃদয়ঙ্গম করলেন গুজরাতি ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ভুক্ত আইনজীবি মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী ইন্ডিয়ান নামে একটি অলীক জাতির পিতা কারণ এই উপমহাদেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তনের পটভূমিতে তিনি বুর্জোয়া পুঁজিপতি আঁতাতের মূর্ত বাস্তব রূপায়ণ। তার ছাগলদুধ উপবাস কৃচ্ছসাধন অহিংসা-সত্যাগ্রহ রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের বিভিন্ন সোপান।

হরিচরণ কেমন হঠাৎ বুড়িয়ে গেলেন। বাইরের জগতের প্রতি আকর্ষণ চলে গেল। যে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে-সংসার নিয়ে বহুবছর মাথা ঘামাননি, দাদাদের তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি দেশসেবা করে বেড়িয়ে ছিলেন এখন দিনরাত শুধু তাদের দিকেই মন। এবং ঠিক তখন কনিষ্ঠ পুত্রের শিক্ষাসমাপ্তে গৃহে প্রত্যাবর্তন। এতকাল অর্থাৎ আমার বাল্যকৈশোরে ও প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন একটা আবছা ব্যক্তিত্ব। পরীক্ষার ফল বেরুলে, অসুখ বিসুখে আমার প্রতি তার নজর পড়ত। বলতে গেলে আমার জগতে তার অস্তিত্ব ছিল একেবারে প্রান্তে। এখন হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল তিনি আমার অভিভাবক। লেগে গেল উঠতে বসতে বিরোধ। প্রসঙ্গ মৈত্রেয়ী।

এদিকে তখন আমার কর্মজীবনের শুরু। প্রথম চাকরি ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডে। ইংরেজ আমলের অতি পুরনো সংস্থা, কারখানা টিটাগড়ে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে মালিক এইচ আই ভি গুজরগিয়া। অধুনা সরকারের অধিগ্রহণে। সেখানে চাকরি করতে গিয়ে দেখি আমার অধীত বিদ্যা সম্পূর্ণ ফালতু কারণ আমার একমাত্র কাজ হল বুক পেতে দেওয়া। সংস্থার যে কোনও শাখার ইচ্ছেমতো তীর মারার স্থায়ী জীবন্ত নিশানা হচ্ছি আমি। প্রোডাকশন ম্যানেজারের হুকুম শতকরা এত উৎপাদন বাড়াতে হবে মিঃ দাস প্লিজ সি টু ইট। ধেয়ে এলো ল্যাজে-নীল-আলো তীর। কারখানার শ্রমিকদের উত্তর এ মেশিন কবেকার জানেন, ওভারটাইম ছাড়া উৎপাদন বাড়বে না। দপদপ লাল আলো জ্বলছে বাণের ফলায়। অ্যাকাউন্টস্ আর মারকেটিং থেকে একযোগে আক্রমণ কস্ট অফ প্রোডাকশান চড়ে যাবে; প্রোডাক্টের দাম না বাড়ালে চলবে না, গুজরাট মহারাষ্ট্রের কখগ পফব কোম্পানির সঙ্গে তাল রাখা অসম্ভব। মিঃ দাস প্লিজ পারসুয়েড দেম। স্যাট স্যাট সবুজ বেগুনি চমকাচ্ছে তীরের পুচ্ছগুলি। আচ্ছা, ৭০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গে ইংরেজ আমলের অবশিষ্ট শিল্পগুলিতে শ্রমিক-ম্যানেজার-মালিকদের কোঁদল দেখেই কি রামানন্দ সাগরেরা রামরাবণ কুরু-পাণ্ডবদের মহাসময়ে অমন দুর্ধর্ষ তীর ছোঁড়াছুড়ির প্রেরণা পেয়েছিলেন? তখনও হিন্দু মেগা সিরিয়ালের উত্থান ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে শীঘ্র আসিতেছে বলতে গেলে পরবর্তী আকর্ষণ। তাই বোধ হয় আমিও একটা যুৎসই বিশাল ঢাল তুলে ধরবার চেষ্টা করি। বিনীত অভিমত—যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, ব্যবস্থাপনায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রয়োজনবোধে সূর্যাস্তের শিল্প থেকে সূর্যোদয়ের শিল্পে রাস্তা খোঁজা ও সেই অনুযায়ী শ্রমিকদের নতুন অনুশীলন। ব্যস এক্কেবারে চক্রব্যুহে অভিমন্যু। সম্মিলিত আক্রমণ—নতুন যন্ত্র মানে ছাঁটাই, প্রশিক্ষণ আবার কী, শালা বাতেল্লা দিচ্ছে চলবে না চলবে না। সবচেয়ে বড় কথা, একজন জুনিয়ার সদ্যপাশ ইঞ্জিনিয়ার এত আপইটি কোম্পানির পলিসিমেকিং-এ নাম গলায়! রিয়েলি, অ্যাবসোলিউটলি আনথিংকেবল ইন আওয়ার ডেজ।

অতএব, অমল কুমার দাসের মানে মানে বিদায়গ্রহণ। পরে যখন শুনলাম বি ই এল বন্ধ, নিজেকে একটু অপরাধী মনে হয়েছিল। কর্মজীবনে হাতেখড়িই ব্যর্থতায়।

আমার দ্বিতীয় চাকরি হাওড়া আয়রন ওয়ার্কসে। এটাও সেই প্রাচীন ব্রিটিশ আমলের। এখন মালিক সি এফ গন্নোরিয়া। না, এই পর্বে আমার খেদ-অপরাধবোধ কিছুই হয়নি কারণ আমি কাজকর্ম ভাল করে বুঝে নিতে না নিতে শুরু হল তিপ্পান্ন দফা দাবিতে শ্রমিক ধর্মঘট। নেতৃত্বে পেশাদার ইউনিয়ন লিডার শিবপদ বাঁড়ুয্যে। প্রতিদিন কারখানার গেটে ঠিক বেলা এগারোটায় যার জ্বালাময়ী ভাষণ শোনা যেত, বড় সাহেব ম্যানেজিং ডিরেক্টর বারীন মিটার, যাঁর ডাক নাম ব্যারি—ঘেরাও। মারপিট। ১৪৪ ধারা জারি, পুলিশ পাহারা, লক আউট। দ্রুতগতি রুদ্ধশ্বাস নাটকটিতে আমার ভূমিকা প্রায় দর্শক পথচারীর কারণ মালিকের দালাল বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু আমি টার্ফে করব এমন দুঃসাহস ছিল না। যে বঙ্গের ভাণ্ডারে শুধুই বিবিধ নিপীড়ন, তার থেকে মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিতের নিস্তার প্রবাসে। চলে গেলাম হায়দ্রাবাদ সাদার্ন অ্যাসবেস্টস প্রাইভেট লিমিটেড-এ। তারপর ইন্ডাস্ট্রিয়াল পোমোশন ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায়। ভুপালে কিছুদিন অতঃপর ভুবনেশ্বরে স্থিতি। বাঙালি লেখক বুদ্ধিজীবী নেতারা সর্বদা যে একটা অর্থহীন বাক্যবন্ধ কপচান—বাংলা তথা ভারত—সেটা বোধহয় আমাদের মতো শিকড়হীন ভেসে বেড়ানো ভাল চাকুরেদের জন্য। আচ্ছা ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড, হাওড়া আয়রন ওয়ার্কসের হাজার হাজার বেকার শ্রমিকদের কী হল? তাদের জন্যও কি বাংলা তথা ভারতের দ্বার উন্মুক্ত? গুলি মারো। চাচা আপন প্রাণ বাঁচা।

হায়দ্রাবাদে থাকতে শুনি ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর প্রাক্তন মালিক এইচআইভি গুজরগিয়া বেজোয়াডাতে নতুন করে কারখানা খুলেছেন। ভুপালে থাকার সময় জানতে পারলাম হাওড়া আয়রন ওয়ার্কসের সি এফ গন্নোরিয়া এম পি, মহারাষ্ট্র সীমান্তে বড় করে লগ্নি করেছেন নতুন শিল্পোদ্যোগে। পশ্চিমবঙ্গ এখন শুধু বিপণন কেন্দ্র। পুঁজি তুলে নিয়ে গিয়ে সবাই আজ তৈরি মাল বেচে এখানে। এ ধরনের অবস্থাকে কারা যেন ঔপনিবেশিক শোষণ ধনক্ষয় বলে গলাবাজি করত? আমার পূজ্যপাদ পিতৃদেব কংগ্রেসনেতা হরিচরণ দাস না?

ইডিয়ট! দি গ্রেট বোং। ভান করে যেন ইন্ডিয়ায় সবার সেরা। সবচেয়ে চালাক। সবজান্তা। আসলে একটা গণ্ডমুখ, জিরো—শূন্য।

.

—কী ভাবতাসেন? হঠাৎ চুপ মাইরা গ্যালেন ক্যান? ছায়া দেবনাথ খোঁচায়।

—না। এই এলোমেলো আগে পরে পাঁচরকম কথা মনে আসে আর কি। তুমি চাও পরপর শুধু ঘটনা আর তাই দিয়ে একটা নিটোল নাটক যেখানে আদি মধ্য অন্ত প্রত্যেক ভাগ পরিষ্কার। জীবনটা কি সেবকম? কখনও এগোই কখনও পেছোই। স্মৃতি তো একটা সরলরেখা নয়।

—স্মৃতি তা হইলে ক্যামন? যেন ভারি সহজ প্রশ্ন।

—ইসিজি করা দেখেছো? রেখাটা চলেছে উঁচু নিচু এদিক ওদিক। তবে হ্যাঁ এগোচ্ছে।

—তা সেই রকমই চলেন। আমি কি মানা করতাসি না কি।

–কী যেন বলছিলাম, হ্যাঁ। ভুবনেশ্বরের সেই পার্টি। কেজরিওয়ালের কথা। পরশুদিন ওই কেজরিওয়াল—যে গভর্নর হাউসের পাশে বিরাট প্রাসাদ করেছে বলে অমল নাম দিয়েছিল ছোট লাট, যার বাগানের ডালিয়া চন্দ্রমল্লিকা ফি বছর ফ্লাওয়ার শো এ ফার্স্ট প্রাইজ পায়—সেই কেজরিওয়াল লাঞ্চে ডেকেছিল কিছু অফিসারদের। বলাবাহুল্য অমলও নিমন্ত্রিত। খুবই ভাল খাওয়া নতুন স্টাইলের নিরামিষ, হাল্কা সুস্বাদু। প্রাচীন উত্তর ভারতীয় প্রণালীতে তেল ঘি মশলার শ্রাদ্ধ নয়। শেষে কলকাতা থেকে আনানো দই মিষ্টি—এ রাজ্যে ভোজনবিলাসে স্টেটাস সিম্বল। চিফ সেক্রেটারি থেকে শুরু করে অনেক উচ্চপদস্থ অফিসার সস্ত্রীক উপস্থিত। কেজরিওয়ালের স্ত্রী কিন্তু বেরুলেন না। তিনি পর্দানশিন। এখনও। তিনি বাস করেন সেই সময়ে যখন তার শাসশসুরের দাদাজি দাদিমা সুদূর ঝুনুঝুনু থেকে এসেছিলেন বাঙ্গাল মুলুকে। ওড়িয়া এক বর্ণও বলেন না। ছেলেমেয়ে নাতিনাতনির ওড়িয়া অক্ষরপরিচয় নিয়ে মাথা ঘামান না। কোনও ওড়িয়া পরিবারের সঙ্গে তার যাতায়াত লোক-লৌকিকতা নেই। তবে হ্যাঁ, কেজরিওয়ালের ছেলের বউ কনভেন্টে পড়া, সেই হোস্টেল। লায়ন্স ক্লাবে এঁরা অ্যাকটিভ মেম্বার। মাঝেমধ্যে মফস্বলে আই ক্যাম্প, বিনামূল্যে গরিব বৃদ্ধবৃদ্ধার ছানি কাটা ঝড়-জল বন্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে টোকেন অ্যামাউন্ট দান কখনও বা লেডিজ ক্লাব স্থাপন, যার কাজ দেওয়ালি জন্মাষ্টমী হোলিতে দুঃস্থদের গাঁটরিবাঁধা খুঁতো নতুন জামাকাপড় ও লাড্ড বিতরণ। এবং সেই ক্লাবে যাবার অছিলায় প্রায়ই বৈকালিক পদচারণা। মেদহ্রাস ও সমাজসেবা। ওড়িয়াতে যাকে বলে টেকাকরে জোড়া এ আম্ব এক ঢিলে দুটি আম পাড়া। এই তো হচ্ছে আম ওড়িশা আর আম্ভে ওড়িয়ামানে। কত তোমাদের মতো মাড়োয়ারিদের ওড়িয়া ন্যাশনালিজম তা আর এই অমল কুমার দাসের জানতে বাকি নেই। তোমরা হচ্ছ বহুরূপী জাত। যখন যেখানে থাকো সেখানকার মানুষ বনে যাও। সবটাই কামোফ্লেজ। পরিবেশের রঙে রঙ মিলিয়ে ঘাপটি মেরে বসা। শিকার ধরার জন্য। এই তো ওবেরয়-এ সেন্ট্রাল মিনিস্টার আর তাদের চেলাদের পেছন পেছন ঘুরছ। রাতারাতি সব ইন্ডিয়ান, মুখে হিন্দির খই ফুটছে। বলি সতী হল কবে না…।

-তা কেজরিওয়ালজি, আপনি তো খুব ভাল বাংলা ওড়িয়া বলেন জানতাম এখন তো দেখছি হিন্দিও কম জানেন না।

-কী যে বোলেন মিঃ দাস। হিন্দিই তো আমাদের আসোল ভাষা। ঘরে তো হিন্দিই বোলি। তাছাড়া ন্যাশনাল ল্যাংগুয়েজ বোলে কোথা। মাড়োয়ারি বাড়ির হিন্দি আর এখানে ওবেরয়-এ দিল্লিমার্কা হিন্দি যে ঠিক এক নয় তা অমলের বিলক্ষণ জানা। তবে হিন্দির রকমফের এত যে কোন্‌টা ঠিক হিন্দি আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারেনি। দুরদর্শনে সমাচারের হিন্দি না কি হিন্দি সিনেমার হিন্দি। মুখে বলে,

—তা ব্লাস্ট ফারনেস চালু হওয়া কেমন দেখলেন?

-ঠাট্টা কোরছেন মিঃ দাস? আপনি ব্যাঙ্কার, আমি বিজিনেসম্যান। আমাদের চোখে কি ধুলো দেওয়া যায়। হ্যাঁ, ব্লাস্ট ফারনেস সত্যি সত্যি চালু হোবে যখন আমি ইস্টিল প্ল্যান্ট কোরব।

—আপনিও স্টিল প্ল্যান্ট করবেন না কি?

-বাঃ কোরব না। সোবই আউটসাইডার এসে কোরবে। কোত একর জমি পেয়েছি জানেন?

এই আরেক ধান্দা। একজন ধীরজ পাল একজন গীতা থাপার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে। রাঘববোয়াল। সব বাইরের লোক। এদের এক এক ঘাইতে রাজ্যের অর্থনীতি কত হাত তলায় বসে যায়। আর এদের দেখিয়ে যে মৃত্তিকার সন্তানসন্ততি আম্ভে ওড়িয়ামানে পবিত্র মাতৃভূমি আম ওড়িশার শত শত একর দখল করে বসে থাকে তার খেয়াল কে রাখে। পরে মন্ত্রিত্ব বদল হলে আগের সরকারের একজন অপেক্ষাকৃত সৎ অতএব অপ্রধানদপ্তরধারী প্রাক্তন মন্ত্রী অমলকে সখেদে বলেছিলেন, বুঝিলে মিঃ দাস যে আমকু গুড মর্নিং গুড নাইট কহিলা আমে ভাবিলু সে ওড়িশারে ইনভেস্ট করিব। তাকু সবু দিও। এবে দেখন্তু অবস্থা। রাজ্যটাহি বিকিগলানি।

.

ছবছর বয়সে ঠাকুরদার কাছে শিখেছিলাম ইংরেজ আমল ছিল বাঙালির স্বর্ণযুগ। এতদিন এতবছর পরে হৃদয়ঙ্গম করেছি তার কারণ, সাহেবরা আমাদের নিজেদের কাছ থেকে বাঁচিয়ে রাখত।

আমার জীবনের যে অধ্যায়টিকে আমি স্বর্ণযুগ মনে করি তার পেছনেও কি সেই এক যুক্তি কাজ করে? আমি কি সে সময়ে নিজের কাছ থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম? টি আই এলের কেচ্ছা, তার স্পনসর হওয়ার সমস্যা, একতার শেষ অনুষ্ঠানের বিপর্যয় যার ফলে আমার ও মৈত্রেয়ীর সম্পর্কে আমূল পরিবর্তন—এসবই কি আমার চরিত্রের কোনও ছিদ্র থেকে উদ্ভূত অবধারিত পরিণতি না কি শুধুমাত্র একের পর এক সম্পর্কহীন দুর্ঘটনামাত্র? যার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই। হয়তো কোনও তাৎপর্যও নেই। আমরা অবস্থার দাস সত্যি, কিন্তু সে অবস্থা কি অনেকখানি নিজেদেরই সৃষ্টি নয়? একতাক্লাব আমার জীবনের কেন্দ্র হয়ে উঠল কেন?একতার মধ্যে দিয়ে আমি ছড়িয়ে পড়েছিলাম বহু মানুষের জীবনে। আমি তো শুধু নিজেকে নিয়ে থাকতাম না। অর্থাৎ নিজের কর্মস্থল, সংকীর্ণ আধাসামাজিক হালকা মেলামেশা যেটা একজন ব্যাচেলার প্রবাসীর পক্ষে স্বাভাবিক শুধু সেই চৌহদ্দির মধ্যেই তো আমি সীমাবদ্ধ ছিলাম না।

–আচ্ছা আপনি নিজের কথা না কইয়া রাজ্যের কথা কইতাসেন ক্যান? কে ব্যবসা করল কে পাবলিকরে ঠকাইল তাতে আপনার হিরো আর হিরোয়িনের কী? আপনারা তো ব্যবসা করতেন না। আমি তো এই স্টোরির মাথামুণ্ডু বুঝতাসি না।

-আরে বুঝবে বুঝবে। জীবনটা তো শুধু ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নায়ক নায়িকার প্রেম বিরহ মিলনের কাহিনী নয়। বাস্তবে কতটুকু সময় আমরা নারীপুরুষের সম্পর্কে দিই বলো তো? আসল কথা কি জানো? সবাই চায় নিজেকে জাহির করতে। সেটা সব চেয়ে ভালভাবে কিসে হয় বল তো? অন্যের ওপর ক্ষমতা দেখিয়ে। ওটাই বেসিক ইনস্টিংট। তাই তো সেক্স অ্যান্ড ভায়োলেন্স এত পপুলার। যেমন করে পারো অন্যকে কজা কর।

-না না ও সব সাইকোলজির কথা রাখেন। আমি হইলাম গিয়া বাঙ্গাল। অতশত বুঝি না। ঠিকমত বলেন দেখি। ভুবনেশ্বর জায়গাটা ক্যামন। আপনাদের ওই একতা ক্লাব লইয়াই ক্যান এত মাথাব্যথা। তার সঙ্গে হিরোয়িনটার কী সম্পর্ক। খোলসা কইর‍্যা বলেন।

.

কটক থেকে ভুবনেশ্বর ওড়িশার রাজধানী উঠে আসবার বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত শহর হিসেবে ভুবনেশ্বর তেমন জমে ওঠেনি। বহুদিন পর্যন্ত জায়গাটা ছিল বলতে গেলে শুধু সরকারি চাকুরেদের কলোনি। ভুবনেশ্বর ক্লাব একরকম অফিসার্স ক্লাব আর অফিসার মানে রাজ্য ও কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ আমলা। শেষে দরজা খুলল বেসরকারি বাণিজ্যিক সংস্থার দিকে। সে একটা সময়। যে কোম্পানি ভুবনেশ্বরে নতুন শাখা খোলে, তার মুখ্য কর্তাব্যক্তি হয়ে আসে একজন বাঙালি। গ্রিভস কটন-এর সুশান্ত ঘোষ, টেলকোর রণজিৎ মিত্র, ক্রম্পটন গ্রিভস-এর সুবিনয় মুখার্জি, এলজির প্রদীপ চক্রবর্তী। আরও কত কে।

দেখাদেখি পাবলিক সেক্টরেরও একই নীতি। ইউকো ব্যাঙ্কের সিদ্ধার্থ পাল, কোল ইন্ডিয়ার অভিজিৎ কুণ্ডু, রিজিওন্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির দিব্যেন্দু মুখার্জি, কৃষ্ণেন্দু ব্যানার্জি, ইন্ডিয়ান অয়েলের সঞ্জয় গুপ্ত, অম্লান ঘোষ। এছাড়া বিভিন্ন হোটেলে নতুন নতুন ম্যানেজার, অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। চারিদিকে বাঙালি। এদের নিয়ে একতাক্লাবের ছোট্ট উপনিবেশ।

এত ভাল চাকুরে বহিরাগত আসার দরুন সরকারি অফিসার ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি বিশাল বাড়িগুলোর মোটা টাকার ভাড়াটে জুটতে শুরু করল। সবচেয়ে কুলীন ফরেস্ট পার্ক যেখানে নতুন রাজধানী পত্তনের সময় সরকারের উচ্চস্তরের পদাধিকারীদের স্থাবর সম্পত্তি অর্জন। তার পরের খেপে সূর্যনগর, সত্যনগর, শহীদনগর। হাল আমলের শৌখিন এলাকা নুয়াপল্লি। আমজনতা ও অপেক্ষাকৃত সাধারণ বহিরাগতদের জন্য চন্দ্রশেখরপুরে সরকারি বাসগৃহ। এরপর বারামুণ্ডায় সরকারি হাফফিনিসড বাড়ি। শহর জমে ওঠার সবচেয়ে বড় লক্ষণ বাজারের আমূল পরিবর্তন। শহরের মধ্যে চার নম্বর ইউনিটে এজি অফিসের যথেষ্ট সংখ্যক বাঙালি কর্মীদের বাসস্থান হওয়ার দরুন চাহিদা এবং যোগানের অবধারিত আইন অনুসারে সেখানে ঠিক রাস্তার পাশে কিছু মাছওয়ালা বসতে শুরু করে। ক্রমে সেখানে দেখা যায় শহরের সেরা মাছের বাজার। সে বাজারে সকালে যে মাছ বিক্রি হয় না তার স্থান শহরের প্ল্যান করা মেন মারকেটে বিকেলে। একতা ক্লাবের জমায়েতে বা যে কোনও দুজন নবাগত বাঙালি এক হলেই আলাপ আলোচনার প্রসঙ্গে মাছ ও ভুবনেশ্বর স্তুতি। শুনতে শুনতে একতার অ্যাডভাইসার একজন সিনিয়র বাঙালি আই এ এস ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন,

—মাছ আসছে আপনারা এসেছেন বলে। আগে মোটেই এমনটি ছিল না। আমি তো সেভেন্টিজ-এ এখানে পোস্টেড ছিলাম। তখন মাছ পেতে হলে ঠিক সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে স্টেশন গোলিয়ায় হাজির হতে হত। অর্থাৎ ভুবনেশ্বর স্টেশন থেকে ইউনিট থ্রিতে ঢোকবার মুখে চৌরাস্তার মোড়ে ফুটপাত জনা তিনচার মাছওয়ালা সাত আটশ থেকে বড় জোর হাজার বারোশো গ্রাম ওজনের কালা, কচিৎ রুই নিয়ে বসত। আর থাকত সস্তার চাঁদা ভাঙর।

—সেকী! এখন তো দারুণ মাছ পাওয়া যায়। বড় বড় রুই কালা। যে দামের চিংড়ি আসে কলকাতায় তো স্বপ্ন। ইলিশ মেলে সিজনে। এমন কি চিতলও দেখা যায়।

—চিতল তো শুধু বাঙালিরাই খায় বোধ হয়। এখানে রকমারি মাছ তো খেতে দেখিই। তবে বড় মাছ সব অন্ধ্রের চালান। লোকাল আমদানি বলতে কৌশল্যা-গঙ্গা থেকে কিছু। তাছাড়া অন্যান্য মাছ বিশেষ করে চিংড়ি আমার তো ধারণা বাঙালি জেলেরাই ধরছে। আসলে সমুদ্রের ধার দিয়ে প্রচুর বাইরে থেকে জেলে বসে গেছে। আমার সন্দেহ সবাই বাংলাদেশি, তারাই ধরছে।

-বলেন কি। এখানেও বাঙাল!

–একবার আমি রিলিফ কমিশনার থাকার সময় ট্যুরে গেছি। বন্যার পর সব ভয়াবহ অবস্থা। সমুদ্রের ভেতর ছোট ছোট দ্বীপগুলো প্রায় ডুবে গেছে। তারই একটা থেকে শুনি ডাকছে। পরিষ্কার বাঙাল ভাষায়। ওদের মাছ ধরার নৌকোগুলোও একটু আলাদা। চৌকো ধরনের পাল, বাদাম। পুরো কোস্ট জুড়ে এমন কি চিল্কা হ্রদেও বাঙালদের মাছ ধরার নৌকো। তাই তো এত চিংড়ি পাচ্ছেন। এখানে যারা চিংড়ির ব্যবসা করে লাল সব প্রন। কিং, প্রন প্রিন্স, তারাই বাংলাদেশিদের বড় মুরুব্বি।

-আশ্চর্য তো। এমনিতে তো শুনি এরা নাকি আউটসাইডার বিশেষ করে বঙ্গালি আসা মোটেই ভাল চোখে দেখে না। বাস্তব দেখুন কত আলাদা। আমি নিজে তো ফ্র্যাংকলি স্পিকিং সব সময় কো অপারেশন পাই।

—টাকা, টাকা মিঃ দাস। তার কাছে কোনও ইডিওলজি টেকে না।

সবার উপরে টাকাই সত্য। আসলে ব্যবসাবাণিজ্য করতে গেলে খানিকটা সহিষ্ণু হতেই হয়। যাকেনইলে কাজ হবে না তার পেছনে লাগলে লোকসান। যাকে জিনিস বিক্রি করতে হবে তার সঙ্গে মিষ্টি কথা বলা দরকার। আর্থিক লেনদেনের মধ্যে দিয়ে অনেকসময় সভ্যতার বিস্তার। যার সঙ্গে আমার কোনও রকম আদান প্রদান নিষ্প্রয়োজন তাকে শত্রু বলে চিহ্নিত করা সোজা। যে মানবগোষ্ঠী নিজেদের যত বেশি অন্ধিসন্ধি বন্ধ করে রাখে তারা ব্যবসা করতে শেখে না। তাদের সমৃদ্ধি ততই কম, অভাব ততই নিদারুণ এবং একদিন শোষণ অবশ্যম্ভাবী। ভুবনেশ্বরে প্রথমে আসার পর অফিসের অর্ডারলি পিয়ন যখন সকালে বাজার এনে সহায্যে সগর্বে বলত,

-সার, আইজ্ঞা দেখন্তু, বঢ়িয়া মাছর।

এবং অমল চেয়ে দেখত একটা সাতশো-আটশশা পেট নরম পোনামাছ, অবাক হয়ে বলত

-দুর, এটা কী মাছ এনেছিস। কাটাভর্তি হবে তাছাড়া পেট নরম। পিয়নটি হা হা করে উঠত।

-আইজ্ঞা, দিশি মাছ। পুরা জিইথিলা। দিশি অর্থাৎ স্থানীয় এবং জিইথিলা মানে জ্যান্ত ছিল কয়েক ঘণ্টা আগে ধরার সময়। বরফ ছাড়া ভুবনেশ্বরের গরমে যে এর মধ্যে নরম হয়ে গেছে সেটা তার কাছে কিছুনয়। অমল এদিকে জাত ঘটি, পাকা মাছ ছাড়া খেতে পারে না। অতএব, বিলিতি ঠাকুর ফেলে দিশি কুকুরকে সমাদর করার মহৎ জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হতে পারেনি। শহীদনগরে তার বাড়ি থেকে চার নম্বর ইউনিট বীর সিং-এ হেঁটে যাওয়া শক্ত। সাইকেল চালানো ও জানে না। সাতসকালে সপ্তাহে একদিন অমলই গাড়ি নিয়ে চার নম্বরে অস্ত্রের চালান বড় মাছ কিনতে যেত। তবে কবছর যেতে না যেতেই সমস্যার সমাধান বাজারের নিয়মে। শহীদনগরে এত বাঙালির বাস হয়ে গেল যে কিছু মাছওয়ালা বাড়ি বাড়ি মাছ ফেরি করতে লাগল। জানে বিক্রি হবেই। ফলে সে দশকে যে বাঙালি ভুবনেশ্বরে বদলি হয় সেই মোহিত। বাড়ি বয়ে টাটকা মাছ, কলকাতায় বাপের জন্মের কেউ দেখেনি বা শোনেনি। একতা ক্লাবের সদস্যরা সব কিছু নিয়ে তর্ক করে বটে কিন্তু একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে সম্পূর্ণ একতা, এমন মাছ খেয়ে সুখ কলকাতায় নেই। বাঙালি খাদ্যাবাসের আর দুটি বৈশিষ্ট্য, সরু সেদ্ধ চাল ও ব্র্যান্ডনাম ছাড়া খোলা ভাল পাতা চা—তাও ভুবনেশ্বরে পাওয়া যেতে শুরু করেছে। আর কী চাই। তাছাড়া সবাই স্বীকার করে ভুবনেশ্বরে তারা যে স্বাচ্ছন্দ্যে, যে স্বাধীনতায় স্বামী-স্ত্রী জোড়ায় জোড়ায় বাস করছে। কলকাতায় তা মোটেই সম্ভবপর নয়—গুরুজন আত্মীয়-কুটুম্বের বাধানিষেধ ভ্রুকুটির প্রশ্ন নেই। দিব্যি সবাই বাড়িতে পার্টি দিচ্ছে। স্বামী স্ত্রী মিলে মিশে হুল্লোড় করছে। প্রায় সকলেরই কোম্পানি ভুবনেশ্বর ক্লাবে সদস্য। সেই সুবাদে সপরিবারে ক্লাবে আসা যাওয়া। সেখানে গরমের দিনে সন্ধেবেলা দেবদারু ঘেরা ঘন সবুজ লনে কিংবা আধুনিক সুইমিং পুলের ধারে উঁচুনিচু টেরেস করা বসার জায়গায় যে আরাম তা কলকাতায় কোথায়। হ্যাঁ। সেখানেও বড় বড় ক্লাবটাব আছে। কিন্তু সেখানে চাকরির দৌলতে প্রবেশের অধিকার অনেক উঁচুতলার সাহেবদের। ভুবনেশ্বরে সকলেই বড় সাহেব। কোম্পানির খরচে আধুনিক বাসস্থান, গাড়ি, কখনও বা ড্রাইভারও। ভুবনেশ্বরের প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ।

অমল জানে কলকাতায় ইংরেজদের তৈরি ডাকসাইটে ক্লাব আছে। বেঙ্গল ক্লাব, টলি ক্লাব, সাটারেডে ক্লাব। আরও কত। সেখানে সদস্য সব কোইহ্যায় জমানার বাঙালি বক্সওয়ালা ও প্রফেশনাল প্রথম সারির ডাক্তার ব্যারিস্টার বা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট। অমল কুমার দাসের তিন পুরুষ সেসব জায়গায় ঢোকেনি। ঢোকার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। কলকাতায় তাদের কাছে ক্লাব মানে পাড়ার নেতাজি ব্যায়াম সমিতি। ভাঙা রেলিং ঘেরা তিনকোনা ফাঁকা জায়গা, ভেতরে একটা ছোট একতলা ঝরঝরে বাড়ি। সেখানে প্রথম যুগে বাঙালি যুবকদের শারীরিক উন্নতির মহৎ সংকল্পে ডাবেল, বারবেল ইত্যাদি সহযোগে আজীবন অকৃতদার মাস্টারদার কড়া খবরদারিতে হইয়ো হইয়ো হত। মাস্টারদার পরলোক প্রাপ্তির পর দ্বিতীয় যুগেইনডোর গেমস, অর্থাৎ তাস ক্যারাম গুলতানি। অধুনা স্রেফ গুণ্ডা রিক্রুটমেন্ট সেন্টার। নেতাজী ক্লাবের এহেন বিবর্তন অনেকটাই অমলের চোখে দেখা। তাই ভুবনেশ্বর ক্লাবে পা দিয়ে তার মনে হল যেন অন্য গ্রহে এসেছে। প্রায় খ্রিস্টার হোটেলের মতো বিলিতি পরিবেশ, রিসেপশনিস্ট ছোঁকরার মুখে ইংরিজি, এয়ার কন্ডিশান করা বার, উর্দিপরা বেয়ারা। সভ্যরা সব শহরের মাথা মাথা লোক। সকাল সন্ধে লনে টেনিস খেলা, ভেতরে বিলিয়ার্ডস। হ্যাঁ, তাসও আছে। ব্রিজ ছাড়া স্টেকেও খেলা হয়। সবুজ সোয়েড আঁটা চারকোণা ছোট ঘোট টেবিলে মাঝ বয়সি মহিলাদের বাজি ধরে খেলতে দেখে প্রথম প্রথম অমল একটু চমকে গিয়েছিল। তবে সব হাই ক্লাস সোসাইটি লেডিজ খেদিপেঁচি নয়। স্বামীরা যখন বার-এ, স্ত্রীরা কী করে সময় কাটান? বিশেষ করে যারা ড্রিংক-ফ্রিংক করেন না। মাঝে মাঝে কেটা ট্রমবোলা, হাউজিসভ্যদের পুত্রকন্যাদের নাচগান কুইজে পারদর্শিতা প্রদর্শন, ৩১শে ডিসেম্বর, দেওয়ালি, হোলি ইত্যাদি উপলক্ষে কনসার্ট, বারবিকিউ ইত্যাদি। কবছর যেতে না যেতেই ক্লাবের একজিকিউটিভ কমিটিতে ইলেকটেড মেম্বার অমলকুমার দাস—যে অমলকুমার দাসের ঠাকুরদার বাবা হাঁটুতে কাপড় তুলে বলদ ঠেঙিয়ে জমিতে লাঙ্গল চষত, যার ঠাকুরদা ভাগ্যবশত দুপাতা ইংরিজি পড়তে পেরে কলকাতায় বঙ্গলক্ষ্মী স্মৃতিতে বাবু হয়ে বসলেন, যার বাবা হরিচরণ দাস বিএ বিএল দেশপ্রেমিক, কংগ্রেসকর্মী, দেশের না হলেও পাড়ার নেতা। সেই অমল কুমার দাস আজ আরও এক ধাপ উঠল। পুরুষানুক্রমিক সামাজিক সিঁড়িভাঙায় সে সফল।

তবে তার জন্য খেসারত কম দিতে হয়নি। যেমন ধরা যাক পিয়ালীর টাঙ্গাইল শাড়ি প্রদর্শনী। ক্রমটন গ্রিভ-এর সুবিনয় মুখার্জির স্ত্রী পিয়ালী সুবিনয়ের কোম্পানি ড্রাইভার বুড়ো রামলালকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে করে খোদ ফুলিয়া থেকে বিশাল বিশাল স্যুটকেস বোঝাই শাড়ি এনে যখন তাদের ফরেস্ট পার্কের অমন সুন্দর সাজানো গোছানো লিভিংরুমে গাদা করল তখন সুবিনয় ধরে পড়ল অমলকে।

—দাদা, বাড়িতে তো আর টেকা যাচ্ছে না। একটা কিছু ব্যবস্থা করুন। একেবারে গুদাম ঘরে আছি। যে দিকে তাকাই শুধু শাড়ি আর শাড়ি। রিসিভার কেড়ে নেয় পিয়ালী,

—খবরদার দাদা ওর কথা শুনবেন না। কিসের অসুবিধা অ্যাঁ? এই এত বড় ঘর। কলকাতায় আমরা যে ফ্ল্যাটে থাকতাম তার পুরোটা এখানকার লিভিং রুমে ধরে যায়। তার একটা কোণে বাক্সগুলো রেখেছি। ওকে কুটোটি নাড়তে হয়েছে? এই তো তুলিকে রুচিকায় পাঠিয়ে-হ্যাঁ হ্যাঁঁ, তুলি তো রুচিকাতেই কন্টিনিউ করছে। আপনার জন্যইতো ভর্তি হতে পারল। স্কুলটা মন্দ নয়। বাড়ির একেবারে কাছে, তা যা বলছিলাম। তুলিকে স্কুলে পাঠিয়ে আমি রান্নাটা করে ফেলি। ওতো বড়জোর দেড়-দুঘন্টার ব্যাপার। তারপর সারাটা দিন আমি ফ্রি। তখন শাড়িটাড়িগুলো নিয়ে বসি। আপনিই বলুন হোলসেলে কেনা, আমাকে তো আবার প্রাইস ট্যাগ লাগাতে হয়। এতে এনার কী এমন অসুবিধা?

—তা বাড়িতে একটা বুটিক-টুটিক খুলে ফেল না।

—খুলব? বলছেন? আমিও দাদা তাই ভাবছিলাম। আচ্ছা সোনার বাংলা নামটা কেমন হবে বলুন তো?

-ওসব বাংলাফাংলা দিয়ে নাম রেখো না। বাংলার যা ছিরি। বাঙালি গন্ধ থাকলে লোকে ভাবে লালবাতি জ্বলে গেছে।

—তা যা বলেছেন। তবে আমি তো এককুসিভলি টাঙ্গাইল বেচব, তাই ওই নামটা সুটেবল ভাবছিলাম। জানেন টাঙ্গাইল ধনেখালির এখানে বেশ ভাল মারকেট? ওড়িশায় কটনহ্যান্ডলুম খুব এক্সপেনসিভ, সবাই তাই সিনথেটিক আর সাউথ কটন পরে। কোনওটাই কমফর্টেবল নয়। টাঙ্গাইল এখানে আইডিয়েল ফর এভরিডে ওয়্যার। স্পেশালি ফর সামার। গরম তো বছরে দশমাস।

-তা ঠিক। তবে নামটা ভেবে চিন্তে দিও।

—সে দেব খন। কিন্তু দাদা একটা রিকোয়েস্ট ছিল।

—বলে ফেল।

—ভুবনেশ্বর ক্লাবে আমার একটা একজিবিশন করিয়ে দিন।

অগত্যা করাতেই হল। এত সহজে অবশ্য হল না। ক্লাবের সেক্রেটারি তখন বিজয় মহান্তি। ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায় নেমেছে। চিংড়িও করছে। নিউ জেনারেশান ওডিয়া। অতি চালু। প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে কি না,

–পিয়ালী মুখার্জি ক্রমটন গ্রিভ এর মিঃ এস মুখার্জির মিসেস তো? তা ক্রমটন গ্রিভস্ একটা ক্লাব নাইট স্পনসর করুক না। এই একটা অন্তারী হোক। সঙ্গে মিসেস মুখার্জির টাঙ্গাইল শাড়ির একজিবিশান থাকতে পারে।

শেষ পর্যন্ত তাই করতে হল। প্রচুর লোক এসেছিল। সন্ধে হতে না হতে গাড়ির সার বেঁধে গেল। ক্লাবের বিশাল কম্পাউন্ডে আঁটল না, বাইরে বড় রাস্তায় লম্বা সারি। ক্লাবের দালান একেবারে ঠাসা। ভুবনেশ্বরের যত নর্থ ইন্ডিয়ান এবং স্মার্ট, অর্থাৎ হিন্দিবলিয়ে, ওড়িয়া টিনএজার আছে সবাইহাজির। সকলের আকর্ষণ অন্তারী তে। এদিকে পিয়ালি শাড়ি সাজিয়ে মুখ চুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিন্দি অন্তাক্ষরির দাপটে তার বাঙালি ব্যবসার অন্ত। ক্লাবের মাথাদের স্ত্রীরা দায়সারা ভাবে একটা রাউন্ড দিলেন। বাদবাকির উৎসাহ আগ্রহ শূন্য। শেষে একতার সদস্যরা এবং তাদের তত স্মার্ট অর্থাৎ সর্বভারতীয় নয় এমন ওড়িয়া প্রতিবেশিনীরা দল বেঁধে সব কিনে নিল।

অর্থাৎ কি না অমলকুমার দাসই বিক্রিবাটা করাল। পরের বছর একজিবিশনের ভেন্যু আর অতটা হাইক্লাস এবং ইন্ডিয়ান ওরফে হিন্দি কালচার অধ্যুষিত কোথাও রাখল না। ভুবনেশ্বরের উচ্চপদস্থচাকুরেদের স্ত্রীরা একটা মহিলাসমিতি করেছে। শহীদগনরে খেলাঘর নামে বাচ্চা রাখবার একটা ফ্রেশ ওঁরা চালান। তাদের হলঘরটা ছুটির দিনে দিব্যি সত্তায় পাওয়া গেল। পাড়াপ্রতিবেশী অর্থাৎবাঙলিরাই ক্রেতা। না, অমল কোনওদিন এই বাঙালি জাতটাকে বুঝতে পারে না।

অথচ পাকেচক্রে বাঙালিদের দায় অমলের ওপর বর্তেছে। ভুবনেশ্বরে একটি বাঙালি পোস্টেড হওয়া মানে অমলকুমার দাসের দায়িত্ব বাড়া। প্রথমে তার বাড়ি। শহীদনগরকে মাঝখানে রেখে খোঁজার পরিধি উত্তরে চন্দ্রশেখরপুরে দক্ষিণে পুরনো ভুবনেশ্বর থেকে পুরীর রাস্তা লুইস রোড পর্যন্ত বিস্তৃত। কোম্পানির এলেম, ব্যক্তির পদাধিকার ইত্যাদি অনুযায়ী পাড়া ও বাড়ির শ্রেণী বিভাজন। তারপর ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার ব্যবস্থা। অর্থাৎইংলিশ মিডিয়াম, এম আই এল বা মডার্ন ইন্ডিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ যা ভারতীয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী হওয়ার কথা মাতৃভাষা কিন্তু বাস্তবে নিজের রাজ্যের বাইরে গেলেই হিন্দি। যদি বেশিদিন ভুবনেশ্বরে থাকে তো থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ সংস্কৃত। ভুবনেশ্বরের যে দু-চারটি স্কুলে এ সব ব্যবস্থা আছে তার প্রত্যেকটিতে অমলকুমার দাস অতি পরিচিত মুখ। সেন্ট জোসেফ কনভেন্টের মাদার সুপিরিয়র তো তাকে দেখলেই বলে ওঠেন,

–এগেন ইউ, মিঃ দাস। এভরি টাইম ইউ কাম ইউ ব্রিং আ নিস। সো মেনি নিসেজ অ্যান্ড নেফিউজ। বুড়ি আবার মুচকি হাসে। বি এ ভি স্কুলে এক অবস্থা। রুচিকা নতুন স্থানীয় পঞ্জাবি মহিলারা চালান। সেখানে আচার ব্যবহার একটু ভাল। দেখলেই তাড়া করে না।

ছেলেমেয়েদের স্কুল ভর্তির পালা শেষ হলে অমলের তিন নম্বর ডিউটি–স্ত্রীদের কাজকর্মের সন্ধান। নিউ উইন্ডসর হোটেল যেটা আগে ওড়িয়া মালিকানায় হোটেল নীলাচল ছিল অধুনা স্বত্বাধিকারী কলকাতার এক মারোয়াড়ি গোষ্ঠী। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বিমল কুণ্ডুর স্ত্রী মাথা খেয়ে ফেলছে। বাচ্চাদের কোচিংক্লাস বসাবে বাড়িতে। তার লিফলেট ছাপিয়ে দিতে হবে। শুধু ছাপিয়ে দিলেই হবে না, সেই হলদে গোলাপি কাগজের গোছ যার প্রত্যেকটিতে শ্রীমতী মঞ্জু কুণ্ডুর স্পেশাল কোচিং-এর স্পেশাল গুণাগুণের ফিরিস্তি ক্যাপিটাল লেটারে বিজ্ঞাপিত, সেগুলি যাতে ভুবনেশ্বরের প্রধান প্রধান খবরের কাগজ অর্থাৎইংরিজি সান টাইমস্ওড়িয়া সমাজ, সংবাদধরিত্রীইত্যাদির রবিবারের সংস্করণের সঙ্গে হকারদের হাতে বাড়ি বাড়ি বিলি হয় তার ব্যবস্থা করা।

এ তো তবু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। এক্স অর্থাৎ মধুশ্রীকে নিয়ে কত ঝামেলা। মধুশ্রীর স্বামী সৌম্যেন বাঙালি মতে তার নামের ইংরিজি বানানে য ফলার অনুরূপ ওয়াই ব্যবহার করে (যদিও তখন উত্তর ভারতের ইংরিজি বানানে এসব ক্ষেত্রে ওটা বাদ দেওয়াই ফ্যাশান) অতএব, তার ডাক নাম হয়েছে ওয়াই এবং সেই ওয়াই-এর সূত্রে তার বেটার হাফ যিনি বিলিতি মতে স্বামীর আগে আগে হাঁটবেন, তাঁর নাম এক্স। এক্স এবং ওয়াই দুজনে প্রেসিডেন্সি কলেজের ভাল ছেলেমেয়ে। ওয়াইএখানে এসেছে এক টায়ার কোম্পানির রিজিওন্যাল ম্যানেজার হয়ে। লম্বা পাতলা ছিপছিপে ঝকঝকে ছেলে। এক্স ভারী মিষ্টি মেয়ে, চমৎকার গান গায়। একতার সব পার্টিতে দুজনে মিলে জমিয়ে রাখে। কিন্তু তাতেই কি এদের আশ মেটে। এক্স কিসে যেন ফার্স্টক্লাস। নেট নামে কী একটা পরীক্ষায় পাশ। ওটা নাকি ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি টেস্ট। এখন তার ইচ্ছে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা। অথবা পি এইচ ডি-র জন্য গবেষণা। বাপরে বাপ,আজকাল বাঙালি মেয়েগুলো যা হয়েছেনা। থামতেই জানে না। অমলকুমার দাস ডি পি আই অফিসে খোঁজ খবর করে জানল নেট ফেট পাশ করলে কী হবে, ওড়িয়া ভাষায় স্কুল পাশ সার্টিফিকেট না দেখাতে পারলে কোনও কলেজে পড়ানো তো দূরের কথা চাকরির ইন্টারভিউতেই ডাকবে না। কুছ পরোয়া নেই। সমানে এক্সের ম্লান মুখ দেখা আর দাদা এখানে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার শোনার পর মরিয়া হয়ে অমল কলিঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের কাছে নিয়ে হাজির করল এক্স-কে। ভদ্রলোক খুব সমাদর করলেন কলকাতার প্রথম শ্রেণী নেট ক্লিয়ার করা মেয়েকে। দুজনকে চা-ও খাওয়ালেন। আলাপ হল বিভাগের আরও দুজন জুনিয়রের সঙ্গে। চাকরির কথা উঠতেই কিন্তু কিন্তু করে বললেন,

-দেখুন ভেকেন্সি আছে। নেট পার করা ক্যান্ডিডেটও আমরা পাচ্ছি না। কিন্তু সমস্যা অনেক। প্রথম কথা জানেনই তো আমি ডাইরেক্টলি নিতে পারি না। কাগজে বিজ্ঞাপন বেরুলে অ্যাপ্লাই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, একটা আউটসাইডার ইনসাইডার ব্যাপার আছে। লাস্ট ইয়ার জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্ট স্টেটের বাইরে থেকে দুতিনজনকে নেয়। ফলে প্রচণ্ড অ্যাজিটেশান। স্টাফ মেম্বাররা ঘেরাও। এসব ঝামেলা বুঝলেন কেউ ফেস করতে চায় না। পলিটিক্স ঢুকে এডুকেশনাল ইনস্টিটিউশনের আর স্যাংটিটি থাকছেনা। অ্যাকাডেমিকদের আর পাওয়ার কী বলুন!

ন্যাকা, ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানো না। পলিটিক্স কি তোমাদের মদত ছাড়াই ঢুকছে নাকি। যে যার পেটোয়া ছাত্রছাত্রী আঁকড়ে অপেক্ষা করছে সুযোগের। কেমন করে ঢোকানো যায়। মুখে অমল কিছু বলে না। অতঃপর এক্সের ভরসা কেন্দ্র সরকার। নালকো অর্থাৎন্যাশনাল অ্যালয় কর্পোরেশনকে ভিত্তি করে গবেষণার পরিকল্পনা করে ফেলে এক্স। ওখানে পাঁচমিশালি লোক। অসুবিধে নেই। পাবলিক সেক্টরেরও কিছু উপযোগিতা আছে। তাছাড়া নালকের চেয়ারম্যান ভি আর ত্রিবেদী উত্তরপ্রদেশের লোক, একতা-র অ্যাডভাইসারও। ওড়িয়া জাতটার অনেক গুণ। সাধারণত ভদ্র নিরীহ, বাঙালিদের মতো কথায় কথায় দপ করে জ্বলে ওঠে না। আঁতলেমির ধারে কাছে নেই। অমলদের অর্থাৎ উত্তর কলকাতার ঘটিদের মতো ক্যুনিজমে অস্বস্তি বোধ করে। এখানে সি পি এম উচ্ছেদ হয়ে গেছে। দু একটা থার্টিজ-এর ঘাটের মরা সি পি আই টিম টিম করছে। পটল তুললেই ব্যস এন্ড অফ কম্যুনিজম ইন ওড়িশা। কটকে গেলে অমলের বেশ যেন চেনাচেনা লাগে। সেই সরু সরু আঁকাবাঁকা গলি, আবর্জনা, গায়ে গায়ে লাগা ধসাপচা রঙ ওঠা বাড়ি। রাস্তায় চায়ের দোকান, হোটেলে বাঙালি জিভের চেনা স্বাদ। ঠিক যেন উত্তর কলকাতার জ্ঞাতি। শুধু তফাত এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকা ছোটখাটো মন্দিরে। অমলের চোখে এদের একমাত্র দোষ, কারণে অকারণে অনওড়িয়া বিদ্বেষ। এই তো একতার মেম্বার হেমেন বড়ুয়ার স্ত্রী স্মিতাকে কী নাজেহালই না করল। মেয়েটা পড়াশুনায় ভাল, অসম থেকে মোটা নম্বরের এম এ। এখানে বি এ ভি স্কুলে একটা টিচারের ভেকেন্সিতে অ্যাপ্লাই করেছিল। ইন্টারভিউর ডাক এল। যে কেরানী প্রার্থীদের আসল সার্টিফিকেট টেস্টিমোনিয়াল ইত্যাদি মিলিয়ে নেয় তার কাছে প্রথমে গেছে। ওর নাম যোগ্যতা ইত্যাদি পড়ে গম্ভীর মুখে বলেছিল হেই পারিবনি। আম এইঠি গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি পরা রেকগনাইজড নুহে। স্মিতা তো প্রচণ্ড ঘাবড়ে গিয়ে হেমেনকে টেলিফোন ও হেমেন অমলকে। বিএভি স্কুল সর্বভারতীয় সংগঠন। ব্রহ্মানন্দ আবার কবে ওড়িয়া ছিলেন। গভর্নিং বডির সদস্যদের এবং সদস্যদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালীদের চটাপট টেলিফোনে লাগায় অমল। সবাই স্থানীয় পঞ্জাবি যাঁরা অনেকেই ব্যবসাদার এবং আই পি বি আইয়ের অমলকুমার দাসের সঙ্গে সুসম্পর্কে আগ্রহী। তাছাড়া সত্যি কথা বলতে কি পঞ্জাবিদের কাছে কলিঙ্গ গুয়াহাটি সমান। অতএব, তারা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে বললেন, সে কি কথা। গুয়াহাটি ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি আলবাৎ রেকগনাইজড। ইন্টারভিউ দিক ক্যান্ডিডেট।

স্মিতা ইন্টারভিউতে সিলেক্টেড হল। স্কুলের অফিসে জয়েন করে স্টাফ কমনরুমে গিয়ে বসেছে। রুটিন কী, কোন কোন বই পড়াতে হবে ইত্যাদি জানা দরকার। কেউ কথা বলে না। পরপর পাঁচদিন এক অভিজ্ঞতা। সকাল থেকে বিকেল স্মিতা বসে। একটা কথা কেউ তার সঙ্গে বলে না। ছদিনের দিন ইস্তফা। হেমেন আর স্মিতা দুজনেরই পরে ক্ষোভ। হেমেন তো বলেই ফেলে,

—দেখলেন দাদা কি সাংঘাতিক। এদিকে অসমে কত ওড়িয়া ভাল ভাল চাকরি করছে। সমস্ত নর্থ-ইস্ট ভর্তি হয়ে গেছে ওড়িয়া প্রফেসর-টিচার, ওড়িয়া পাবলিক সেক্টর একজিকিউটিভ। আর আমরা দু-চারজন এখানে এলে এই ব্যবহার।

সান্ত্বনা দেয় অমল। কীই বা আর করবে। শিলং-এর বাঙালি অভিজিৎ চৌধুরী হেড অফিসে পোস্টেড। অমলেরই প্রায় সম-সাময়িক। একবার মিটিং-এ গিয়ে কথায় কথায় স্মিতার কাহিনী তাকে শুনিয়েছিল অমল। অভিজিৎ চৌধুরী হেসে কুটোপাটি। অমল অবাক। হাসি থামলে অভিজিৎ একটানা গড় গড় করে যে বৃত্তান্তটি বলে গেল তার মোন্দা কথা হল স্মিতা বড়ুয়ার বাবা এবং মা যাদের অভিজিৎ ছোটবেলায় বিলক্ষণ জানত দুজনেই শিলং এর লোক এবং বঙ্গালখেদা আন্দোলনে অতি সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। কাগজেটাগজে গরম গরম প্রবন্ধ, সভাসমিতিতে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, বঙ্গালদের কুকর্মের ফিরিস্তি। আজ তারা জন্মস্থান শিলং থেকে বিতাড়িত। একসময় তারা যেমন বঙ্গালদের বিদেশি ভেবেছিলেন, তাড়াতে চেয়েছিলেন আজ অন্যেরা তেমনই তাদের বিদেশি ভাবে তাড়িয়ে দেয়। এবং সেই অন্যরা বঙ্গাল নয়, তাদেরই ঘরের লোক, আপনজন, শতশত বছরের প্রতিবেশী ভূমির সন্তান।

—সো দ্য সার্কল হ্যাস কাম টু দ্য ফুল সাইকল, বৃত্ত সম্পূর্ণ। ইন্ডিয়ানরা যাদের কাছে। বিদেশি, ইন্ডিয়াতে তাদের পুত্রকন্যা বিদেশি। অভিজিতের সহাস্য উপসংহার।

সত্যি কথা বলতে কি অমলের এ সমস্ত স্বদেশি বিদেশি ভূমিপুত্র বহিরাগত বিরোধ একেবারে ভাল লাগে না। তার কাছে প্রাণী-জন্ম মানে জীবনধারণের সমস্যা। মানুষের প্রধান কাজ জীবিকা অর্জন। যে যেখানে পারো দুটো করে খাও। ব্যস।

—এটা কি একটা কথা হইল। ছায়া দেবনাথ আপত্তি জানায়। মাইনষের স্বদেশ, নিজের জায়গা থাকব না। যেইখানে চোদ্দো পুরুষের বাস সেই মাটিতে তার অধিকার মানতেহ হহব।

—মানুষ তো গাছ নয় যে একটা জায়গায় আজীবন থিতু হয়ে থাকবে। বনজঙ্গলের জানোয়ারও নয়। তাদেরই শুধু একটা নিজস্ব এলাকা বাঁধা।

-বাঃ আর আমাদের যার যার একটা এলাকা বাঁধা থাকব না? স্বদেশ কারে কয়?

–ওই জানোয়ারদের মতো বাঁধাধরা এলাকা। এই মাটির ওপর আমাদের অধিকার চিরকালের জন্য চূড়ান্ত। ব্যক্তিগত মালিকানা নিয়ে কত কী তর্ক। মাটির ওপর গোষ্ঠীগত একচেটিয়া অধিকারের বিরুদ্ধে টুশব্দটি করার সাহস নেই।

–থাক বাবা। আপনি আর নিজস্ব থিওরি কপচাইবেন না। বরং আপনার গল্পটা বলেন।

আমাদের এক্সঅর্থাৎ মধুশ্রী তার রিসার্চটা শেষমেষ ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো বাঙালির অগতির গতি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই করছে। একমাত্র সেখানে তাকে কেউ বহিরাগত বা বিদেশি বলতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি আমি ওড়িয়াদের কাছ থেকে বরাবর ভাল ব্যবহার পেয়েছি। মিনিস্টার অফিসার বিজনেসম্যান সবাই সবসময় কোঅপারেট করে। সেটা কি শুধু আমার চেয়ারের মাহাত্ম? না তা মোটেই নয়। তাদের স্বভাবের গুণ নিশ্চয় আছে। বাঙালিদের সঙ্গে চাকরি ক্ষেত্রে তারা প্রতিযোগিতায় যেতে চায় না।

এত দোষের কী? কে না জানে আমাদের বাপঠাকুরদারা আগেভাগে হামলে পড়ে ইংরিজি শিখে ব্রিটিশ আমলে সব চাকরি-বাকরির বাজার একচেটিয়া দখল করে রেখেছিল। এখন তার শোধ তুলবেনা অনন্যরা। ইল্লি আর কি। মধুশ্রীর স্বামী তো দিব্যি ভাল চাকরিবাকরি করে। তার নিজের আবার চাকরির দরকার কী! প্রতিযোগিতার ঝামেলায় না গেলেই তো সব শান্তি। বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে থাক, বাচ্চামানুষ রান্নাবান্না-ঘরকন্না। ব্যস, আগে তুমি এগিয়ে ছিলে এখন তুমি পিছনে হটো। তবেই না ইন্ডিয়ায় সবাই মিলেমিশে থাকবে। তাতে যদি তুমি আর তুমি না থাক তো না রইলে। কার কী আসে যায়।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *