Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » চার্লসের স্বর্ণসম্পদ || Anil Bhowmick

চার্লসের স্বর্ণসম্পদ || Anil Bhowmick

কেরিনিয়া বন্দর ছেড়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজ এলো মাঝ সমুদ্রে। এবার দেশে ফিরে যাওয়ার কথা তুলল ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা। মারিয়া কিছু না বললেও সেও যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যেতে চায় এটা ওর মুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল।

অগত্যা ফ্রান্সিস সেদিন বিকেলে জাহাজের ভেক-এ উঠে এলো। পেছনে মারিয়া, হ্যারি, বিস্কো। ফ্রান্সিস মুখে কিছু বলে নি। বন্ধুদের দেশে ফেরার জন্য বার বার তাগাদা শুনে গেছে।এখন ফ্রান্সিস জাহাজ চালক ফ্লেজারকেকী নির্দেশ দেয় সবাই সেটা শোনবার জন্যে ভেক-এ এসে জড়ো হল।

ফ্রান্সিস ফ্রেজারের কাছে এলো। বলল–ফ্লেজার, দিক ঠিক করে জাহাজ দেশের দিকে চালাও। কথাটা শুনেই সব ভাইকিং বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল–ও-হো-হো। এই ধ্বনি ওদের আনন্দের, প্রতিবাদের আবার সঙ্কল্পেরও ধ্বনি।

একদল উঠে গেল পাল খাটাবার কাঠের ওপরে। দড়িদড়া টেনে–পালগুলো ঠিক করে দিতেই পালগুলো ফুলে উঠল হাওয়ার তোড়ে। জাহাজ চলল দ্রুতগতিতে। দাঁড় বাইবার প্রয়োজন নেই। তবু দাঁড় বাইতে বেশ কয়েকজন ভাইকিং দাঁড়ঘরে নেমে এসে দাঁড়ে হাত লাগাল। জাহাজের গতি আরো বাড়ল। সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে জাহাজ চলল দ্রুতগতিতে। মারিয়ার দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস হেসে বলল–কি? খুশি তো?

ভীষণ খুশি। মারিয়া প্রায় লাফিয়ে বাচ্চা মেয়ের মতো বলে উঠল।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। নির্মেঘ আকাশ। বাতাসও বেগবান। জাহাজ চলেছে দ্রুতগতিতে।

সেদিন ভোর ভোর সময়ে নজরদার পেড্রোর হাঁক শোনা গেল–ডাঙা-ডাঙা দেখা যাচ্ছে। কয়েকজন ভাইকিং জাহাজের ডেক-এ শুয়ে ছিল। একজন উঠে বসল। গলা চড়িয়ে বলল–পেড্রো ভালো করে দেখো ডাঙা বালির মাটির না পাথরের। পেড্রো চোখ কুঁচকে তাকাল। তখনই সূর্য যেন সমুদ্রের জলের ঢেউয়ের মধ্যে থেকে উঠল। রোদ ছড়াল। পেড্রো তাকিয়ে দেখতে দেখতে গলা চড়িয়ে বলল-পাথুরে ডাঙা। ঢালু হয়ে সমুদ্রের পার পর্যন্ত এসেছে। ডেক-এ বিস্কোও শুয়ে ছিল। ওর ঘুম ভেঙে গেল। বিস্কো উঠে দাঁড়াল। মাস্তুলের ওপরে বসে থাকা পেড্রোকে চেঁচিয়ে বলল–পেড্রো ভালো করে দেখো। আমি ফ্রান্সিসকে ডাকতে যাচ্ছি। পেড্রোও গলা চড়িয়ে বলল কিছুক্ষণের মধ্যে তোমরাও দেখতে পাবে।

বিস্কো চলল ফ্রান্সিসকে ডাকতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি ডেক-এ উঠে, এলো। পেছনে মারিয়া।ফ্রান্সিস রেলিঙে ভর দিয়ে ডাঙার দিকে তাকিয়ে রইল। সমুদ্রের না বুকে ঘন কুয়াশা। স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস অপেক্ষা করতে লাগল কখন কুয়াশা কেটে যায়। ওদের ভাগ্য ভালো। একটু পরেই হঠাৎ সব কুয়াশা কেটে গেল। সকালের রোদে স্পষ্ট দেখা গেল ডাঙা। পাথুরে ডাঙা। ঢালু হয়ে সমুদ্রের জল পর্যন্ত নেমে এসেছে। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কী করবে এখন?

-ফ্লেজারের কাছে চলো। ফ্রান্সিস বলল। তিনজনে এবার চলল জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে। ওরা ফ্লেজারের কাছে এলো। ফ্রান্সিস বলল–ফ্লেজার–ডাঙা দেখা যাচ্ছে। জাহাজকিতীরে ভেড়ানো যাবে?না নৌকো নিয়ে যেতে হবে? ফ্লেজার জাহাজের হুইল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল–যতদূর মনে হচ্ছে সমুদ্রের তির পর্যন্ত জাহাজ নিয়ে যাওয়া যাবে।

–তাই নিয়ে চলো। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া একটু ভীত স্বরে বলল—এখানে নামবে নাকি?

–উপায় নেই। কোথায় এলাম এটা না জানতে পারলে কতদূরে কোনোদিকে আমাদের দেশ–সেটা বুঝবো কী করে। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি বলল–রাজকুমারী আপনার কী মনে হয়? কোথায় এলাম আমরা?

–সঠিক তো বলতে পারবো না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি আমরা এখনও ভূমধ্যসাগর থেকে বেরোতে পারিনি। আমরা সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে দক্ষিণ মুখে আসছি। যদি আমার হিসেব ঠিক থাকে তবে এখন যে ডাঙা দেখছি সেটা মাল্টা দ্বীপপুঞ্জের কোনো দ্বীপ।

রাজকুমারীর অনুমান সঠিক। হ্যারি বলল।

–সেটা জেনে খোঁজ না করলে জানা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল। ফ্লেজারকে বলল ফ্লেজার, জাহাজ যদি তির পর্যন্ত যায় তবে তীরের কাছে যাও।

–হ্যাঁ–জাহাজ তির পর্যন্ত যাবে। ফ্লেজার বলল। তারপর তীরের দিকে জাহাজ চালাল।

দূর থেকে দেখা গেল–একটা ছোটো জাহাজ তীরে দাঁড়ানো আছে। বোঝাই যাচ্ছে এটা জাহাজঘাটা। এবার জাহাজঘাটার পরেই লোকজন যাওয়া আসা করছে এটা দেখা গেল। ফ্রান্সিস এবার সাবধান হল। দিনের বেলা জাহাজ ভেড়ানো ঠিক হবেনা। ফ্রান্সিস বলল-ফ্লেজার-জাহাজঘাটায় এখন এই দিনের বেলা জাহাজ ভেড়ানো ঠিক হবে না। এখানকার খোঁজখবর আমরা রাতে আনতে যাবো। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল ডানদিকের ঐদিকের তীরের কাছেই ঝোঁপজঙ্গল শুরু হয়েছে। আমরা সন্ধেবেলা ঐদিকের তীরেই জাহাজ ভেড়াবো। এখন তো এখানেই নোঙর ফেলো। আমরা এখন আর এগোবো না।

–বেশ। ফ্লেজার বলল। তারপর বিস্কো আর কয়েকজনকে বলল–নোঙর ফেলো। বিস্কোরা নোঙর ফেলতে গেল। ফ্লেজার আর কয়েকজন বন্ধুদের বলল–পাল নামাও। আমরা আর এগোব না। বন্ধুরা চলল পাল নামাতে। নোঙর ফেলা হল। পাল গুটিয়ে ফেলা হল। জাহাজ থামল। ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজটা দোল খেতে লাগল।

এখন কোনো কাজ নেই। ভাইকিংরা এখানে-ওখানে জড়ো হয়ে গল্পগুজব করতে লাগল।

বিকেলে পশ্চিম আকাশে রঙিন মেঘ দেখা গেল। গভীর কমলা রঙের সূর্য আস্তে আস্তে সমুদ্রের ঢেউয়ের মধ্যে যেন ডুবে গেল। কিছুক্ষণ পরেই পশ্চিম আকাশের কমলা রং মিলিয়ে গেল। অন্ধকার নামল।

রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কোকে বলল–রাত গম্ভীর হলে আমরা ডাঙায় নামবো। তৈরি হয়ে এসো। মারিয়া পাশেই দাঁড়িয়েছিল। ও বলে উঠল আমিও যাবো। ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–না। তোমাকে নিয়ে যাবো না।

–আপনাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বিদেশ বিভুই। আমরা এখানকার কিছুই জানি না। যদি বিপদে পড়ি আপনি থাকলে আমাদের বিপদ বেড়ে যাবে কমবে না। হ্যারি বলল।

-ঠিক আছে ঠিক আছে। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল। তারপর চলে গেল।

তখন রাত গভীর। ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কোকে নিয়ে জাহাজের ডেকে উঠে এলো। দেখল ফ্রেজার হুইলের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।দু’জন ভাইকিং বন্ধু নোঙর তুলল। কয়েকজন ভাইকিং ফ্লেজারের নির্দেশে দাঁড়ঘরে নেমে গেল। দাঁড় বাওয়া চলল। ফ্লেজার হুইল ঘুরিয়ে জাহাজ চালাল তীরের দিকে। জাহাজটা আস্তে আস্তে সমুদ্রতীরে ভিড়ল। কাঠর পাটাতন পাতা হল। যথাসম্ভব নিঃশব্দেই সব কাজ হল।

পাটাতনের ওপর দিয়ে ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কো হেঁটে তীরে নামল। একটু মাঠমতো। তারপরই জঙ্গল শুরু হয়েছে। ওরা মাঠ পার হয়ে চলল। জোছনা উজ্জ্বল। কাছাকাছি সবই দেখা যাচ্ছে। ওরা একটু পরেই জঙ্গলে ঢুকল। বন খুব ঘন নয়। ছাড়াছাড়া গাছপালা। ঘাস-ঢাকা মাটিতে কোথাও কোথাও ভাঙা জোছনা পড়েছে। ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলল।

বনজঙ্গল শেষ হল। বনজঙ্গল থেকে বেরিয়ে দেখল একটা বড়ো রাস্তা উত্তরমুখো চলে গেছে! দুপাশে পাথর আর কাঠের বাড়ি। বস্তি এলাকা।

ফ্রান্সিরা দাঁড়িয়ে পড়ল। কোনো বাড়িতে ডেকে খোঁজ নেবে ফ্রান্সিস এরকমই ভাবছিল। তখনই হঠাৎ ডানদিকে গলিমতো একটা পথ দিয়ে জনা দশেক সৈন্য এসে হাজির হল। সৈন্যদের বুকে বর্ম মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই। ঝোলা হাতা হাঁটুঝুল ঢোলা জামা। কোমরে ফেট্টি তাতে তলোয়ার গোঁজা। প্রয়োজনে এঁদের সঙ্গে লড়া যাবে। একেবারে ফ্রান্সিসদের মুখোমুখি। চাঁদের উজ্জ্বল আলোয় সবই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। দুদলই দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্ত। সৈন্যরা প্রায় ফ্রান্সিসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস তলোয়ার ফেলে দিল। পাথুরে মাটিতে শব্দ হল-ঝনাৎ। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–হ্যারি শাঙ্কো-তলোয়ার ফেলে দাও। ফ্রান্সিসদের অস্ত্র ত্যাগ করতে দেখে সৈন্যদের মধ্যে থেকে থুতনিতে ছুঁচোলো দাড়িওয়ালা একজন সর্দার গোছের সৈন্য এগিয়ে এলো। গ্রীক ভাষায় বলল–তোমরা তো এখানকার লোক নও।

হ্যারি বলল।–না। আমরা ভাইকিং। বিদেশি।

–এখানে কেন এসেছো? লোকটি বলল।

–দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো আমাদের নেশা। হ্যারি বলল।

সর্দার ওর সঙ্গীদের দিকে তাকাল।

তখন সঙ্গীদের মধ্যে একজন বলল–তোমরা এখানে কী করে এলে?

জাহাজে চড়ে। হ্যারি বলল।

–তোমাদের জাহাজ কোথায়? সর্দার জানতে চাইল।

–ঐ জঙ্গলের পরে সমুদ্রতীরে ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে। হ্যারি বলল।

–তোমরা এখন কোত্থেকে আসছো? সর্দার জিজ্ঞেস করল।

সাইপ্রাস দ্বীপ থেকে। হ্যারি বলল।

–মিথ্যে কথা। সদার গলায় জোর দিয়ে বলল।

–ভাইকিংরা মিথ্যে কথা বলে না। হ্যারিও গলা চড়িয়ে বলল।

–তোমরা রাজা তৃতীয় পিটারের গুপ্তচর। খোঁজ নিতে এসেছো আমাদের সৈন্য সংখ্যা কত। কোথায় কোথায় আমাদের ঘাঁটি। লোকটি বলল।

–আমি আবার বলছি। আমরা কোনো রাজার গুপ্তচরনই। আমরা ভাইকিং। জাহাজে চড়ে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াই। সমস্ত পৃথিবীই আমাদের ঘরবাড়ি। হ্যারি বলল।

সর্দার থুতনির ছুঁচোলো দাড়িতে কয়েকবার হাত বুলোলো। তারপর বলল–যাক গে–তোমাদের বন্দি করা হল। কালকে দলপতি যা হুকুম দেবেন তাই পালিত হবে।

কী কথা হল বলো। ফ্রান্সিস বলল।

হ্যারি আস্তে আস্তে সর্দার যা বলল সেসব জানাল। ফ্রান্সিস বলল হ্যারি উপায় নেই। রাজা তৃতীয় পিটারের নাম আমরা এই প্রথম শুনলাম এসব বলেও রেহাই পাবো না। অগত্যা এখন বন্দিদশা মেনে নেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। সর্দার বলল– এবার চলো। একজন সৈন্য ফ্রান্সিসদের তলোয়ার নিয়ে চলল।

সর্দার ফ্রান্সিসদের আগে রাখল। পেছনে সৈন্যরা আসতে লাগল। চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে দেখা গেল দুপাশে নিঝুম বাড়িঘরদোর। ফ্রান্সিসরা হেঁটে চলল। ফ্রান্সিসের শুধু এক চিন্তা–ওদের যে বন্দিশালায় রাখা হবে সেটা কেমন।

কিছুক্ষণ পরে সর্দার ওদের একটা খোলা মাঠমতো জায়গায় নিয়ে এলো। মাঠটার চারদিক কাটা তারে ঘেরা। প্রবেশদ্বারের সামনে আনা হল। প্রবেশদ্বারও কাটা তার পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে তৈরি। সবাই প্রবেশদ্বারের সামনে এসে দাঁড়াল। দু-তিনজন পাহারাদার খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছিল।

সর্দার পাহারাদারদের কী বলল। একজন পাহারাদার কোমরের ফেট্টি থেকে চাবির তোড়া বেরকরল। চাঁদের আলোয় তোড়ার ঠিক চাবিটা বের করল।কাঁটাতারের দরজাটা খুলল। ফ্রান্সিসদের ঠেলে ঠেলে ঢুকিয়ে দিল। হ্যারি জানে এ ধরনের ব্যবহার ফ্রান্সিস সহ্য করবে না। তাই গলা চড়িয়ে বলল–ফ্রান্সিস–সব মেনে নাও। মাথা গরম করো না। ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না রুখে দাঁড়াল না। ওরা বন্দি শিবিরে ঢুকল। দেখল–আগেও কিছু বন্দি মাটিতে শুয়ে বসে আছে।

ফ্রান্সিসরা কাঁটাতারের বেড়ার কাছে বসল। ফ্রান্সিস ধুলোটে মাটিতে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল–হ্যারি তুমি ঘুমিয়ে নাও। রাত জাগা তোমার সইবে না।

–কিন্তু তুমি? হ্যারি বলল।

–বাকি রাতটা জেগেই কাটাবো। ফ্রান্সিস বলল।

শাঙ্কো বলল–না ফ্রান্সিস–তুমি ঘুমোও আমি জেগে থাকবো। কপালে দুহাত রেখে ফ্রান্সিস চোখ বুজল। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়ল না। নানা চিন্তা মাথায়।

ভোর হল। সকালের উজ্জ্বল রোদ ছড়ালা কাঁটাতারে ঘেরা বন্দি শিবিরে। উত্তর দিকের জঙ্গল থেকে বিচিত্র পাখির ডাক শোনা গেল। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল-যাও তো ঐ বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে এসো। এই দলপতি কেমন লোক। ওদের বন্দি করেছেন কেন-মাল্টা এখান থেকে কতদূর সব খবর নিয়ে এসো।

হ্যারি আগে থেকে বন্দিদের কাছে গেল। গ্রীক ভাষায় ওদের সঙ্গে কথা বলতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে হ্যারি ফিরে এলো। তখনই পাহারাদারেরা সকলের খাবার নিয়ে ঢুকল। বন্দিদের বসতে বলল। সামনে একটা করে বড়ো পাতা দেওয়া হল। খেতে দেওয়া হল গোল কাটা রুটি আর আলু শাক-সজীর ঝোল। খেতে খেতে হ্যারি বলল ওরা প্রায় সবাই দস্যুতার জন্যে এখানে কয়েদ হয়ে আছে। এখনকার শাসক দলপতি নাকি অদ্ভুত লোক। নিজেই টহলদার সৈন্যদের সঙ্গে পাহারা দেয়। দলপতির নাম সিক্কা। মাল্টা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। হ্যারি একটু থেমে বলল–সবচেয়ে মারাত্মক খবর হল কয়েকদিন পরেই এখানে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে। সুস্থ সবল বন্দিদের সেই হাটে বিক্রি করা হবে।

-বলো কি! ক্রীতদাস কেনাবেচা যারা করে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র মানবিকতা বোধ থাকেনা। তাদের কাছে ক্রীতদাসরা গরু ছাগলের মতো। বোঝাই যাচ্ছে আমরা ভয়ানক বিপদে পড়েছি। শুধু বন্দির জীবন মেনে নেওয়া যায় কিন্তু ক্রীতদাসের জীবন মেনে নেওয়া অসম্ভব। ফ্রান্সিস বলল।

–কী করবে এখন? হ্যারি বলল।

–পালাবার উপায় বের করতে হবে। এখানকার পাহারার ব্যবস্থা দেখে পালানোর উপায় ভাবতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

একটু বেলা হতে বন্দি শিবিরের দরজার সামনে সৈন্যদের তৎপরতা দেখা গেল। তার মানে ওদের দলনেতা সিক্কা হয়তো আসবে। তারই তোড়জোড় শুরু হল।

কিছুক্ষণ পরে দরজা খুলে গেল। একজন বৃদ্ধকে নিয়ে সিক্কা ঢুকল। এ কি? এ তো সেই থুতনিতে ছুঁচোলো দাড়িওয়ালা লোকটা। সিক্কা বুঝল ফ্রান্সিসরা একটু অবাকই হয়েছে। সিক্কা ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। হাসি নয়। যেন দাঁত খিঁচিয়ে বলল–এবার ক্রীতদাসের হাটে আমরা ভালো দর পাবো। এরকম বলিষ্ঠদেহী সাদা মানুষ তো সব সময় পাওয়া যায় না। ফ্রান্সিস বুঝল ওদের ক্রীতদাসের কেনাবেচার হাটে বিক্রি করা হবে। ফ্রান্সিস বসেছিল। এবার দ্রুত উঠে দাঁড়াল। স্পেনীয় ভাষায় বলল–আমাদের কেন ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করা হবে? আমাদের অপরাধ কী?

–বাঃ তোমরা তো রাজা পিটারের গুপ্তচর। তোমাদের মেরেই ফেলতাম কিন্তু তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছি ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করবো বলে। সিক্কাও স্পেনীয় ভাষায় বলল।

–আগে প্রমাণ করুন যে আমরা রাজা পিটারের গুপ্তচর। যদি প্রমাণ করতে পারেন তাহলে যে শাস্তি দিতে চান দেবেন। আমরা সেই শাস্তি মেনে নেব। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমাদের ব্যাপারে অত খোঁজখবর করা যাবে না। তোমাদের ক্রীতদাস কেনাবেচার হাটে বিক্রি করা হবে। ব্যস। সিক্কা বলল।

ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। মাটিতে বসে পড়ল।

সিক্কা দস্যুদলের কাছে গেল। বলল–তোমাদেরও বিক্রি করা হবে। সব মিলিয়ে এবার আমার ব্যবসা ভালোই হবে। সিক্কা খুক খুক করে হাসল। তারপর দরজার দিকে চলল। যেতে যেতে গলা চড়িয়ে বলল–এদের যত্নটত্ন করবি। ভালো খেতে দিবি। কারো যেন অসুখ না করে। সবারই একেবারে তরতাজা চেহারা চাই। তবে না ক্রীতদাস বেচাকেনার হাটে বেশি দাম পাবো।

সিক্কা বেরিয়ে গেল। দরজা বন্ধ হল।

ফ্রান্সিসদের বন্দিজীবন কাটতে লাগল। ফ্রান্সিস সারাক্ষণ শুয়ে থাকে আর ভাবে কীভাবে এই বন্দি শিবির থেকে পালানো যায়।

দুদিন একইভাবে কাটল।

তৃতীয় দিন। তখন ফ্রান্সিসরা সকালের খাবার খেয়েছে। ফ্রান্সিস সামান্য ঘাসধুলোর ওপর শুয়ে পড়ল। মাথায় এক চিন্তা কী করে মুক্তি পাবো।

একটু পরে হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস–ওঠো আমাদের সমস্যা আরো বাড়ল। ফ্রান্সিস চোখের ওপর থেকে দুহাতের কনুই সরিয়ে তাকাল। বলল–ওকথা বলছো কেন?

রাজকুমারী বিস্কো পেড্রো আরো কয়েকজন বন্দি হল। হ্যারি বলল।

বলো কি? ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। দেখল-দরজা খোলা হল। রাজকুমারী বিস্কোরা ঢুকছে। ফ্রান্সিস বলে উঠল–সর্বনাশ। আর পালাবার ভরসা নেই। ক্রীতদাসের হাটে আমরা বিক্রি হয়ে যাবো।

মারিয়ারা ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। বসল।

ফ্রান্সিস রেগে বলে উঠল–তোমরা এত অধৈর্য হয়ে পড়লে কেন?মারিয়াবিস্কো– তোমরা কেন এলে?

–তোমাদের কোন খোঁজ নেই দুদিন ধরে। আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি? মারিয়া একটু কান্নাভেজা গলায় বলল।

–আমাদের খুঁজতে এসে লাভের মধ্যে আমাদের সমস্যা বাড়ালে। ফ্রান্সিস বলল।

–আমরা তোমারিয়া বলতে গেল। ফ্রান্সিস ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল– খুব অন্যায় করেছো। জানো দুদিন পরে এখানে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে। ভেবেছিলাম তার আগেই পালাবো। তোমরা ধরা পড়লে–আর কোনো উপায় নেই। ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি হতে হবে।

–এর মধ্যে তো একটা উপায় বের করতে পারবে। মারিয়া বলল।

-ক্রীতদাস কেনাবেচা যারা করে তারা যে কী হৃদয়হীন তা তোমার জানা নেই। এদের কবল থেকে বাঁচতে গেলে হয় মরতে হবে নাতো সারাজীবন পঙ্গু হয়ে থাকতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া চুপ করে রইল তারপর কেঁদে ফেলল। বলল–তাহলে এদের আমি বলবো যে আমাকে বিক্রি করুক তোমাদের যেন মুক্তি দেয়।

–এ কথাটা তুমি বলতে পারলে? ফ্রান্সিস আস্তে বলল। মারিয়া কোনো কথা না বলে কাঁদতে লাগল। হ্যারি মারিয়ার কাছে এসে বসল। বলল-রাজকুমারী আপনি কান্নাকাটি করলে আমাদের মন দুর্বল হয়ে যাবে। আপনি শান্ত হোন। ফ্রান্সিস নিশ্চয় পালাবার কোনো উপায় বের করবে। শুধু আপনি ভেঙে পড়বেন না–এই অনুরোধ। মারিয়া চোখ মুছল। আস্তে আস্তে শান্ত হল।

শাঙ্কো এতক্ষণ ফ্রান্সিসদের কথাবার্তা শুনছিল। এবার বলল–ফ্রান্সিস আমি আজ রাতেই পালাবো। ফ্রান্সিস আর হ্যারি চমকে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–তুমি কি পাগল হলে। এই কাঁটাতারে ঘেরা বন্দিশিবির থেকে পালানো অসম্ভব বলবো না। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে।

–ফ্রান্সিস, শুধু আমিই পালাবো। বাইরে থেকে তোমাদের মুক্তির ব্যবস্থা করবো। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক আছে। আমাকে বোঝাও কী করে পালাবে? ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। বলল–চলো–দেখাচ্ছি। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। দু’জনে চলল সদর দরজার দিকে।

দরজার কাছে এসে শাঙ্কো একজন পাহারাদারকে স্পেনীয় ভাষায় বলল-জল আনন। জল ফুরিয়ে গেছে। পাহারাদারটি বলে উঠল–তা কি করে হয়। সকালেই কাঠের পীপেয় জল ভরা হয়েছে।

–ঠিক আছে। তুমি দেখবে এসো। শাঙ্কো বলল। পাহারাদার দরজার তালা খুলে ঢুকল। চলল খাবার জল আছে কিনা দেখতে। অন্য পাহারাদারটি তলোয়ার উঁচিয়ে দরজা পাহারা দিতে লাগল।

শাঙ্কো মৃদুস্বরে বলল–ফ্রান্সিস দরজার দুপাশে আর ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখো শুধু তারে বাঁধা। ফ্রান্সিস পায়চারি করতে করতে লক্ষ্য করল। শাঙ্কোর কথা ঠিক। ফ্রান্সিস বলল–ঠিক আছে। কিন্তু ওপরে হাত পাঁচেক কাটা-তারে ঘেরা।

–ঐটুকু সাবধানে পেরোতেই হতে হবে। শাঙ্কো বলল।

–তবু তুমি আহত হবেই। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। সেসব কাটাটাটা ভেন-এর ওষুধেই সেরে যাবে। কিন্তু পালাবার এই সুযোগ ছাড়া যাবে না। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না। তখনই পাহাদারটি এলো। ভাঙাভাঙা স্পেনীয় ভাষায় বলল–তোমাকে কে বলেছে যে জল নেই। পীপে ভর্তি জল।

–তাহলে কেউ মিথ্যে করে বলেছে। শাঙ্কো বলল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো নিজেদের জায়গায় ফিরে এলো।

ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো–তুমি দরজার মাথা দিয়ে পালাতে চাও। কিন্তু ঐখানে রাতে মশাল জ্বলে আর পাহারাদারেরা পাহারা দেয়।ওদের নজর এড়িয়ে উঠে পালাতে পারবে?

–ফ্রান্সিস–আকাশের দিকে তাকাও। শাঙ্কো বলল। ফ্রান্সিস কথাটার অর্থ বুঝল না। ওপরে খোলা আকাশের দিকে তাকাল। দেখল আকাশে কালো মেঘের আসা যাওয়া চলছে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে বলল–বৃষ্টি হবে। দরজার মাথায় রাখা মশাল নিভে যাবে। পাহারাদাররাও সৈন্যদের ছাউনিতে চলে যাবে। তখন সাধারণ তারে পা রেখে রেখে ওঠা যাবে। বাকি হাত চার-পাঁচেক কাটা-তার পার হতে হবে। এই বলতে চাও।

শাঙ্কো হেসে বলল–ফ্রান্সিস তোমার বুদ্ধি চিন্তার কাছে আমরা ছেলেমানুষ।

ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল–উঁহুশাঙ্কো–তুমি অনেক চিন্তাভাবনার পরিচয় দিয়েছে। এবার কাজটা করা। তার জন্যে এখন প্রয়োজন ঝড় বৃষ্টির। আকাশের মেঘ দেখে যা বুঝতে পারছি সন্ধে নাগাদ ঝড়বৃষ্টি শুরু হবে। আমরা ভাইকিং। সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াই। ঝড়বৃষ্টির আগাম সংকেত আমরা সহজেই বুঝি। সাবাস–শাঙ্কো।

ফ্রান্সিসদের অনুমান সত্যি হল। সন্ধের পরেই আকাশ ঘন মেঘে ঢেকে গেল। আকাশে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। বিদ্যুতের আঁকাবাঁকা রেখা আকাশটা যেন চিরে ফেলতে লাগল। সেই সঙ্গে বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দ।

প্রচণ্ড হওয়ার ঝড় ঝাঁপিয়ে পড়ল বন্দিশিবিরের ওপরে। শুরু হল বৃষ্টি। দরজার মাথায় রাখা মশাল নিভে গেল। পাহারাদার দু’জন সৈন্যদের ছাউনিতে চলে গেল। একজন ছাউনির জানালা দিয়ে বন্দিশিবিরের দিকে নজর রাখল।

গভীর অন্ধকারে শুধু বিদ্যুতের আলো ঝলসে উঠছে যখন, তখন যা মুহূর্তের জন্যে দেখা যাচ্ছে।

–ফ্রান্সিস পালাচ্ছি। এই বলে শাঙ্কো দ্রুত বন্দিশিবিরের দরজার কাছে এলো।

সাধারণ তারগুলোয় পা রেখে রেখে হাত দিয়ে ধরে ধরে উঠতে লাগল। এবার কাটাতার পার হওয়া। এটুকু উঠতে কয়েক প্যাঁচ কাঁটাতার হাত দিয়ে ধরতে হল। পায়ে ভর নিতে হলো। তাতেই কাটাতারের খোঁচায় হাত পা জখম হল।

এবার শুধু কাঁটা তার পার হওয়া। শাঙ্কো উঠতে লাগল। তাতে পায়ে গায়ে কাঁটাতারের কাটা ফুটতে লাগল। বুকে গায়েও কাটা ফুটতে লাগল। শাঙ্কোর পোশাক রক্তে ভিজে গেল। কানের কাছে বৃষ্টিঝরার একটানা শব্দ। অন্ধকার চোখের সামনে। শুধু বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠা। ঐ দু এক মুহূর্তে। তারপর নিচ্ছিদ্র অন্ধকার।

শাঙ্কো মুখ বুজে সব যন্ত্রণা সহ্য করতে লাগল। একসময় ওঠা শেষ হল। এবার নামা। শাঙ্কো কাঁটা ছাড়া তার দেখে দেখে নামতে লাগল। তখনও বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। পাহারাদার তার সৈন্যদের ছাউনির জানালা দিয়ে দেখল, সঙ্গীকে ডাকাডাকি করল। সঙ্গীকে পেল না। ওদিকে বন্দি পালাচ্ছে। পাহাদারটি খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে এলো। শাঙ্কোও লাফ দিয়ে মাটিতে নেমেছে পাহারাদার তখনই ওর সামনে এসে দাঁড়াল। শাঙ্কোর পোশাক ছেঁড়া খোঁড়া।শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে উঁবুহয়ে পোশাকের মধ্যে হাত বাড়িয়ে ছোরাটা বের করল। পাহারাদার তলোয়ার চালাল। শাঙ্কো ছোরা দিয়ে ঠেকাল। শাঙ্কো ভালো করেই বুঝেছিল শুধু ছোরা দিয়ে পাহারাদারের আক্রমণ ঠেকানো যাবে না। শাঙ্কো দ্রুত একবার চারপাশটা দেখে নিল। বাঁদিকে একটু দূরেই দেখল জঙ্গলমতো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ছুটল। পাহারাদারও তলোয়ার হাতে ওর পেছনে পেছনে ছুটল।

শাঙ্কো জঙ্গলে ঢুকে পড়েই দিকপাল্টে বাঁদিকে সরে গেল। দ্রুত জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। পাহারাদার তখনও জঙ্গলে শাঙ্কোকে খুঁজছে।

এবার শাঙ্কো আস্তে আস্তে জঙ্গলে ঢুকল। ডালপাতার আড়াল থেকে পাহারাদারটির দিকে এগোতে লাগল। পাহারাদারের হাত কয়েক পেছনে এসে দাঁড়াল। শাঙ্কো একটু মাথা নিচু করে তৈরি হল। বৈদ্যুৎ চমকালো। বিদ্যুতের আলোয় আন্দাজ করে পাহারাদারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। হাতের ছোরাটা পাহারাদারের পিঠে ঢুকিয়ে দিল। পাহারাদারটি শাঙ্কোর ধাক্কা সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল। কয়েকবার নড়েচড়ে মরে গেল।

শাঙ্কো তখন হাঁ করে হাঁপাচ্ছে। মাটিতে বসে পড়ল। একটুক্ষণ হাঁপালো।

তারপর ছোরাটা কোমরে গুঁজল। পাহারাদারের পোশাক টেনে খুলল। নিজের কাঁটাতারের ঘন্টা লেগে শতচ্ছিন্ন পোশাকটা খুলল। তারপর পাহারাদারের পোশাকটা পরল। পোশাকের মাথার কাছে কাপড়টা বেশি। ওটা দিয়ে মাথা ঢাকা যায়। শাঙ্কো পাহারাদারের তলোয়ারটা নিল।

কোমরের মোটা বেল্টটা লাগাতে লাগাতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো।

তখন ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে বিদ্যুৎ চমকানো বন্ধ হয় নি।

অন্ধকারের মধ্যে শাঙ্কো আস্তে আস্তে কাঁটাতারে ঘেরা বন্দিশিবিরের পেছনের দিকে এলো। ফ্রান্সিসরা ঐদিকটাতেই বসেছিল। শাঙ্কো কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এসে চাপা গলায় ডাকল–ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস। ফ্রান্সিস বৃষ্টিভেজা মাটিতেই শুয়ে ছিল। ডাক কানে যেতেই দ্রুত উঠে বসল। পেছনদিকে তাকাল। তখনই বিদ্যুৎ চমকালো। ও শঙ্কোকে দেখতে পেল। তাড়াতাড়ি উঠে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এলো।

শাঙ্কো বলল–আমি পোশাক পাল্টেছি। তলোয়ারও পেয়েছি। এখন কী করবো?

দলপতি সিক্কার–সৈন্যদের মধ্যে মিশে থাকো। পরশু ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে। তখন আমাদের তো বন্দিশিবিরের বাইরে আনা হবে। হাটে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন পালাবার উপায় ভাববো। লড়াই করে নয়। বুদ্ধি খাঁটিয়ে অক্ষত দেহে আমাদের পালাতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

–তাহলে সব ভালো করে দেখতে হবে। একটা উপায় বের করবোই। শাঙ্কো বলল।

কাটাতারে ঘষা খেয়ে তুমি খুব আহত হওনি তো? হ্যারি এগিয়ে এসে বলল।

তা সে হয়েইছি। ও ভেনের ওষুধে সেরে যাবে। এখন কী করে পালাবো সেটা ভাবতে হবে। শাঙ্কো বলল। তারপর ও সৈন্যদের ছাউনির দিকে চলল।

রাত শেষ হয়ে এসেছে। শাঙ্কো ওপরে আকাশের দিকে তাকাল। দেখল আকাশ সাদাটে হয়ে আসছে। সূর্যোদয়ের বেশি দেরি নেই।

একটু পরেই সূর্য উঠল। আলো ছড়ালো সৈন্যদের ছাউনিতে বন্দি শিবিরে। ওপাশের জঙ্গলে পাখির ডাক শুরু হল।

শাঙ্কো সৈন্যদের ছাউনিতে এ-ঘর ও-ঘর দেখতে লাগল। সব ঘরেই সৈন্যদের সংখ্যা বেশি। পশ্চিম দিকে একটা ছোট্ট ঘর দেখল। কাছে এগিয়ে এলো। ঘরটায় মাত্র একজন সৈন্য আছে। শাঙ্কো ঐ ঘরটাই বেছে নিল। ঘরে আর একটা খালি লোহার খাট।

শাঙ্কো ঘরটায় ঢুকল। দেখল সৈন্যটি ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে উঠে বসল। সৈন্যটি হাই তুলতে তুলতে শাঙ্কোকে দেখতে পেল। তারপর গ্রীক ভাষায় শাঙ্কোকে বলল–ভাই তুমি কি কাউকে খুঁজছো?’ শাঙ্কো হাসল। আঙ্গুল দিয়ে মুখ গলা দেখিয়ে আবার হাসল।

ও বোবা কালা। সৈন্যটি বলল। শাঙ্কো হাত দিয়ে জল খাওয়ার ইঙ্গিত করল। সৈন্যটি বুঝল জলতেষ্টা পেয়েছে লোকটার। ও ঘরের কোণায় রাখা মাটির পাত্র দেখাল। শাঙ্কো গিয়ে জল খেয়ে এলো।

সৈন্যটি চুপ করে বসে রইল। শাঙ্কোর সঙ্গে আর কী কথা বলবে। তবু হাত নেড়ে ইঙ্গিতে জানতে চাইল বোবা কালা লোকটা কোন্ দেশের কোত্থেকে এসেছে। শাঙ্কোও হেসে আঙ্গুল নেড়ে বোঝাল ও এই দেশেরই লোক। সৈন্যটি কী বুঝল কে জানে। সে চুপ করে রইল। এবার শাঙ্কো খালি লোহার খাটটা দেখিয়ে ইঙ্গিতে বোঝাল এ খাটে সে শুতে চায় থাকতে চায়। সৈন্যটি মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল।

সৈন্যটি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শাঙ্কো তখন খালি খাটেই শুয়ে পড়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছে। কত রাত জাগতে হয়েছে। সারা শরীরে হাতে পায়ে কাঁটাতারের খোঁচা। সেসব ঢাকতে শাঙ্কো হাত দুটো খোলা জামার পকেটে রাখল। সৈন্যটির নজরে পড়লে নিশ্চয়ই জানতে চাইবে কী করে কাটল।

কিছুক্ষণ পরে সৈন্যটি খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকল। দু’জনের খাবারই এনেছে। ঘুমন্ত শাঙ্কোকে ডাকতে গিয়ে দেখল শাঙ্কোর কাটা ছেঁড়া হাত। ও খাবারটা শাঙ্কোর বিছানাতেই রাখল। নিজেও খেল না। শাঙ্কোর ঘুম ভাঙার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

বেশ কিছুক্ষণ পরে শাঙ্কোর ঘুম ভাঙল। ও উঠে বসল। একটু সময় গেল বুঝতে যে ও এখন কোথায় আছে। সৈন্যটিকে দেখে বুঝল সব। সঙ্গে সঙ্গে ও হাত দুটো পকেটে পুরল। সৈন্যটি হেসে বলল–ঐ কাটা ছেঁড়া দাগ কি সবসময় পকেটে ঢেকে রাখতে পারবে? শাঙ্কো বোকার হাসি হাসল। সৈন্যটি ওর খাবার দেখিয়ে বলল–এবার তো হাত বের করতে হবেই। শাঙ্কো হেসে একবার মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে খেতে লাগল। খেতে খেতে সৈন্যটি শাঙ্কোকে ইঙ্গিতে বোঝাল-তোমার হাত মুখ এরকমভাবে কেটে ছড়ে গেল কেন?শাঙ্কো গাছে চড়ার ইঙ্গিত দিয়ে বোঝাল গাছে উঠতে গিয়ে হাত মুখ কেটে ছড়ে গেছে। সৈন্যটি মাথা নেড়ে বোঝাল ও বুঝতে পেরেছে। সৈন্যটি বেরিয়ে গেল। শাঙ্কো আবার ঘুমিয়ে নিল।

ওদিকে খোলা আকাশের নীচে বন্দিশিবিরে ফ্রান্সিসরা ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে গেল। জল বেশি জমে নি। পুবদিকে ঢাল বেয়ে বৃষ্টির জল চলে গেছে। তবু মাটি তো ভেজা। ফ্রান্সিসরা ভেজা মাটিতেই শুয়ে বসে রইল। ফ্রান্সিসদের এরকম অভিজ্ঞতা আগেও হয়েছে। বন্ধুরাও খুব একটা কাবু হয়নি। কিন্তু মারিয়া দুহাত বুকের কাছে নিয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইল।

ফ্রান্সিস উঠে গিয়ে ওর জামাটা খুলে ফেলল। ভেজা জামাটা দিয়ে মারিয়ার মাথা মুখ হাত পা মুছে দিতে লাগল।বিস্কো হ্যারিও জামা খুলে মারিয়ার মাথা হাত পা মুছিয়ে দিল। মারিয়ার শরীর একটু শুকোল। আগের ঠাণ্ডা ভাবটা আর রইল না।

সকালের খাবার খাওয়া হয়ে গেছে। কাঁটাতার আর কাঠে তৈরি দরজা দিয়ে দলপতি সিক্কা ঢুকল। হেসে সকলের দিকে তাকিয়ে বলল–কাল রাতে তোমাদের খুব অসুবিধে হয়েছে তাই না? আমার বন্দিশিবিরটা এমনি। মাথার ওপরে খোলা আকাশ।

দলপতি সিক্কা এবার মারিয়ার দিকে তাকাল। মুখে চুকচুক শব্দ করে বলল–আহা একে তোরা অন্য জায়গায় নিয়ে গেলি না কেন। দ্যাখ তো কী অবস্থা হয়েছে চেহারার। বেচাকেনার হাটে তো দাম পড়ে যাবে। একে অন্দরমহলে নিয়ে যা। চানটান করে নতুন পোশাক পরুক।

একজন পাহারাদার মারিয়ার দিকে এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বলল– উনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।

–তাহলে তো আরো ভালো। রাজকুমারী বলে কথা। সিক্কা হেসে বলল।

-আমি যাবো না। মারিয়া গলা চড়িয়ে বলে উঠল। ফ্রান্সিসও বলে উঠল–না– রাজকুমারীকে নিয়ে যেতে দেব না।

হ্যারি উঠে দাঁড়াল। বলল ফ্রান্সিস বাধা দিও না। এই নরককুণ্ডে রাজকুমারী আর একদিনের জন্যে থাকলেও অসুস্থ হয়ে পড়বেন। তাতে আমাদের সমস্যা বাড়বে বই কমবে না। অন্দরমহলে গিয়ে স্নান করে শুকনো পোশাক পরলেই রাজকুমারী সুস্থ থাকবেন। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বসে পড়ল। আর কোনো কথা বলল না। মারিয়া মাথা নেড়ে বলে উঠল–না আমি যাবো না। হ্যারি বলল রাজকুমারী আপনি আমাদের সকলের বিপদ ডেকে আনবেন না। আপনি যান। আপনি সুস্থ থাকুন এটাই আমরা চাই।

মারিয়া ফুঁপিয়ে উঠল। তারপর পাহারাদারদের সঙ্গে চলে গেল। দলপতি সিক্কাও বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা চুপ করে বসে রইল।

ওদিকে সৈন্যটি শাঙ্কোকে নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে গেল। শাঙ্কোর গায়ে সিক্কার সৈন্যদের পোশাক। কাজেই কেউ সন্দেহ করল না। শাঙ্কো বোবা কালার অভিনয় করতে লাগল।

খেয়েটেয়ে শাঙ্কো এবার চলল সমুদ্রতীরের দিকে। যেখানে ওদের জাহাজটা রয়েছে শাঙ্কো সেখানে এলো। জাহাজ থেকে পার অব্দি পাতা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল।

বন্ধুরা ছুটে এলো। সবাই জানতে চায় ফ্রান্সিসদের কথা। শাঙ্কো সকলের দিকে তাকিয়ে একে একে সব ঘটনা বলে গেল।

ফ্লেজার বলল–এখন কী করবে?

–দলপতি সিক্কা ফ্রান্সিসদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রির জন্যে তুলবেই। এখন পালানোর কথা ভাবতে হবে। কীভাবে ফ্রান্সিসদের মুক্ত করা যায়–এসব ভাবতে হবে। তার ব্যবস্থা করতে হবে। শাঙ্কো বলল।

–তুমি এখন কী করবে? ফ্লেজার বলল।

–আমি আজকের রাতটা জাহাজেই থাকবো। শাঙ্কো বলল। তারপর গায়ের পোশাকটা খুলে ফেলল। দেখা গেল ভেতরে ওদের পোশাকটাও ছিঁড়ে গেছে। বুকে পিঠে রক্তের দাগ। হাতেই সবচেয়ে দাগ বেশি। তখনও অনেক ক্ষতে রক্ত জমে আছে।

শাঙ্কো চারদিকে তাকিয়ে ভেনকে খুঁজল। ভেন এখানে নেই। শাঙ্কো ভেনের কাছে যাবে বলে এগোচ্ছে তখনই দেখা গেল ভেন ওর ওষুধপত্রের থলে নিয়ে আসছে। ভেন সকলের দিকে তাকিয়ে বলল-”তোমরা শাঙ্কোকে বিরক্ত করো না। ওর এখন বিশ্রাম প্রয়োজন।

সবাই চলে গেল। কয়েকজন রইল। ওরা চুপ করেই রইল।

ভেন শাঙ্কোকে বলল জামা খুলে ফেল। শাঙ্কো ওদের দেশীয় পোশাকটা খুলে ফেলল। এবার ভেন বলল-নড়াচড়া করো না।

ভেন থলে থেকে দুটো কাঁচের বোয়াম বের করল। বোয়াম দুটো রেখে থলে থেকে পরিষ্কার ন্যাকড়া বের করল। তারপর দুটো বোয়ামেরই ওষুধে ন্যাকড়াটা ভিজিয়ে নিয়ে শাঙ্কোর কাটাছেঁড়া জায়গায় ওষুধ লাগাতে লাগল। এবার দেখা গেল শাঙ্কোর শরীর হাত পা কাটাতারের খোঁচায় কীভাবে কেটে গেছে। ভেন বারকয়েক ওষুধটা লাগাল। তারপর বলল–এখন পোশাক খুলেই রাখো। যাও শুয়ে পড়ো গে।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে উঠে নিজের কেবিনঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জ্বালা যন্ত্রণা কমল অনেকটা।

সেই রাতটা শাঙ্কো জাহাজেই রইল।

পরদিন সকালেই সকালের খাবার খেয়ে চলল বন্দিশিবিরের দিকে। তার আগে দলপতি সিক্কার সৈন্যদের পোশাকটা পরে নিল। এখন এই পোশাকটাই ভরসা। সিক্কার সৈন্যদের চোখে ধূলো দেওয়ার এটাই বড়ো অস্ত্র।

অল্পক্ষণ পরেই শাঙ্কো বন্দিশিবিরের কাছে এলো। দেখল এর মধ্যেই বন্দিশিবিরের বাইরে লোকজন জমে গেছে।

বন্দিশিবিরের পাশেই একটা পাথরের মঞ্চমতো। তার মাঝখানে একটা গোল কাঠের থামমতো। তাতে দড়ি বাঁধা। সামনেই একটা পাথরের আসনমতো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দলপতি দু’জন বৃদ্ধকে সঙ্গে নিয়ে এলো। বৃদ্ধ দু’জন বোধহয় তার পরামর্শদাতা।

একজন সৈন্যের পাহারায় মারিয়াকে আনা হল। মারিয়ার পোশাক এখন এ দেশীয় মেয়েদের মতো পা পর্যন্ত ঢাকা ঢোলা জামা। মারিয়াকে সৈন্যটি বন্দিশিবিরে ঢোকাল।

ফ্রান্সিসরা এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস মারিয়ার মুখ চোখ দেখেই বুঝল মারিয়া রাত্রে ঘুমোয় নি। ফ্রান্সিস বললতোমার শরীর ভালো তো? মারিয়া মাথা কাত করল।

তখনও ক্রীতদাসের মঞ্চে ভোলা হয়নি।শাঙ্কো চারদিকে নজর রেখে ঘুরতে লাগল। শাঙ্কোর পরনে সিক্কার সৈন্যদের পোশাক। কাজেই কেউ সন্দেহ করল না।

শাঙ্কো উত্তর দিকের ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা বিরাট চেস্টনাট গাছ দেখতে পেল। শাঙ্কো তাড়াতাড়ি সেদিকে গেল। ঝোঁপজঙ্গল সরিয়ে এগিয়ে গেল। চেস্টনাট গাছটা দেখল। তারপর ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরো এগোল। দেখলো ওখানে একটা খাদমতো। খাদের পরেই সবুজ ঘাসে ঢাকা উপত্যকা। সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কোর পালানোর উপায় ভাবা হয়ে গেল। ও দ্রুত ছুটল সমুদ্রতীরের দিকে। ওদের জাহাজে এলো। তখন শাঙ্কো মুখ হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।

ফ্লেজার এগিয়ে এলো। বলল–কী ব্যাপার শাঙ্কো?

–ফ্রান্সিসদের পালাবার উপায় বের করেছি। তুমি শিগগিরি আমাকে বেশ লম্বা মোটা কাছি দাও। ফ্লেজার ছুটে গেল ওদের কাঠ দড়ি কপিকল এসব রাখবার ঘরের দিকে।

কাছি নিয়ে ফ্লেজার একটু পরেই এলো। শাঙ্কো কাছিটা কোমরে বুকে পাচালো। তারপর চলল বন্দি শিবিরের দিকে।

বন্দি শিবিরের সামনে পৌঁছে দূর থেকেই দেখল আটজন ডাকাত মূরকে সেই পাথরের বেদীতে তোলা হয়েছে। শাঙ্কো লক্ষ্য করল–মূরদের হাত পা বাঁধা হয় নি। শাঙ্কো অস্ফুট স্বরে বলে উঠল–ও-হো-হো। তাহলে ফ্রান্সিসদের হাত পা বাঁধা হবে না।

শাঙ্কো একটু দূরে দূরে থেকে জঙ্গলটায় ঢুকল। চেস্টনাট গাছের গুঁড়ির সঙ্গে কাছিটার একটা মুখ বাঁধল। তারপর বাকি কাছিটা খাদে ঝুলিয়ে দিল। তারপর ঝোঁপঝাড়ের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল অনেক লোক জড়ো হয়েছে।

তখনই ফ্রান্সিসদের আনা হল। সঙ্গে মারিয়া। ফ্রান্সিসদের হাত পা বাঁধা নয়। খুশিতে শাঙ্কোর মন নেচে উঠল। ফ্রান্সিসদের পাথরের বেদীর পাশে দাঁড় করানো হল। ফ্রান্সিস তখন ভাবছে–এইভাবে ক্রীতদাসের জীবন মেনে নেবে?কিন্তু ও তো নিরুপায়।সিক্কার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামা যেত। কিন্তু তাতে বেশ কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু মারা যেত। মারিয়াকে নিয়ে পালানো যেত না।ফ্রান্সিসের এই আশঙ্কার মধ্যেও ক্ষীণ আশা শাঙ্কো মুক্ত আছে। ও যদি কোনো উপায় বের করে।

শাঙ্কো সিক্কার সৈন্যদের পোশাক পরে বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে লাগল। ফ্রান্সিসদের পেছন দিয়ে যাওয়া-আসা করতে লাগল আর মৃদুস্বরে ওদের দেশীয় ভাষায় বলে যেতে লাগল–উত্তরে জংলার কাছে ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে বিরাট চেস্টনাট গাছ। গাছের গুঁড়িতে আমি কাছি বেঁধে রেখেছি। কাছি ধরে ঝুলে নীচে উপত্যকায় নেমে যাব। তারপর সমুদ্রতীরের দিকে ছুটবে। জাহাজে উঠবে।

এবার রাজকুমারী মারিয়াকে দু-তিনজন সৈন্য হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলো। মারিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলনা-না।তবু সৈন্যরা জোর করে মারিয়াকে নিয়ে আসতে লাগল। তখন অতলোকের গুঞ্জন থেমে গেল। শুধু ফিসফাস শোনা যেতে লাগল রাজকুমারী-রাজকুমারী।

মারিয়া শুধু একবার তাকিয়ে নিল ফ্রান্সিসের দিকে। তারপর আর বাধা দিল না। পাথরের বেদীতে উঠল। কোনোদিকে তাকাল না। শুধু সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। কাঠের থামের সঙ্গে মারিয়াকে দড়ি দিয়ে আগা করে বাঁধা হল।

উপস্থিত খরিদ্দারদের মধ্যে দামাদামি শুরু হয়ে গেল।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসকে ফিসফিস্ করে বলল–হাত দুটো পেছনে আনন। ফ্রান্সিস পেছনে হাত নিল। শাঙ্কো এর বড়ো ছোরাটা ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে বলল–এবার কাজ হাসিল করো।

ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ছুটল দলপতি সিক্কা যে পাথরের আসনে বসে আছে সেই দিকে। সিক্কার সৈন্যরা কিছু বোঝবার আগেইফ্রান্সিস সিক্কার গলায় ছোরা চেপে ধরল।দাঁতচাপা স্বরে বলল–তোমার সৈন্যদের বলো এখান থেকে চলে যেতে।

ফ্রান্সিসের এই কাণ্ড দেখে লোকজন সব পালাতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা প্রায় জনশূন্য হয়ে গেল। সিক্কার কিছু সৈন্য তখনও ছিল। ফ্রান্সিস ছোরার চাপ বাড়াল। দলপতি সিক্কা বলল–বলছি–বলছি। এবার সিক্কা গলা চড়িয়ে বলল–সৈন্যরা তোমরা এখান থেকে চলে যাও। সৈন্যরা আর কী করে। দলপতির প্রাণ বিপন্ন। এখান থেকে চলে যেতেই হবে। সৈন্যরা দলবেঁধে চলে গেল।

এবার ফ্রান্সিস বিস্কোকে বলল–বিস্কো রাজকুমারীকে তুমি নিয়ে যাও। তোমরা সকলে চলে যাও উত্তরের ঐ বিরাট চেস্টনাট গাছের কাছে। গাছটায় মোটা কাছি বাঁধা আছে। কাছি ধরে নেমে একটা উপত্যকা পাবে। সেটা ধরে সমুদ্রতীরে জাহাজে চলে যাও।

সব ভাইকিং বন্ধুরা ছুটল চেস্টনাট গাছটার দিকে। বিস্কো বেদীতে উঠল। মারিয়ার গায়ে বাঁধা দড়িটা খুলে ফেলল। তারপর মারিয়াকে পাথরের বেদী থেকেনামিয়ে আনল। শরীরে অসহ্য ক্লান্তি। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল–মারিয়া মনে জোর আনো। কাছি ধরে নীচে নামতে পারলেই আমাদের মুক্তি। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। মারিয়া ফ্রান্সিসের কথা শুনে একবার থমকে দাঁড়াল তারপর হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু হাঁটতে গিয়ে শরীর ছেড়ে দিয়ে ঘাসে-ঢাকা মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে মারিয়াকে তুলে কাঁধে শুইয়ে নিল।বিস্কো যতটা সম্ভব দ্রুত পায়ে ছুটল চেস্টনাট গাছটার দিকে।

বিস্কো যখন কাছিটার কাছে এলো ততক্ষণে বাকি বন্ধুরা কাছি ধরে ধরে নীচের উপত্যকায় নেমে গেছে। বিস্কো নিচু হয়ে কাছিটা ধরল। বলল–রাজকুমারী আমরা মুক্তির দোড়গোড়ায়। যতটা সম্ভব জোরে আমাকে ধরে থাকুন। মারিয়া দুহাত বাড়িয়ে বিস্কোর কোমর ধরে রইল।

বিস্কো আস্তে আস্তে কাছি ধরে নামতে লাগল। একটু হাঁপানো গলায় মারিয়া বলল– ফ্রান্সিস শাঙ্কো ওরা তো এলো না।

–ওদের জন্যে ভাববেন না। এখন শুধু একটাই সমস্যা আপনাকে নিরাপদে জাহাজে নিয়ে যাওয়া। বিস্কো বলল।

বিস্কো হাঁপাতে হাঁপাতে নীচের দিকে তাকাল। দেখল–আর হাত দশেক নামলেই উপত্যকায় নামা যাবে। বিস্কো হাঁপাতে হাঁপাতে উপত্যকায় নেমে এলো।

ওদিকে ফ্রান্সিস তখনও দলপতি সিক্কার গলায় ছোরা চেপে আছে।

শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল–এতক্ষণে মারিয়া আর বন্ধুরা উপত্যকায়। নেমে গেছে। ওরা জায়গাটা চেনে না। এইজন্যে আমাকে এখুনি যেতে হবে। একটু থেমে বলল–ফ্রান্সিস চলো–তাড়াতাড়ি।

এবার ফ্রান্সিস দলপতি সিক্কার গলা থেকে ছোরাটা তুলে নিয়ে ছুটল চেস্টনাস্ট গাছের দিকে। দু’জনে গাছটার নীচে এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো তুমি আগে নেমে যাও। আমি পরে নামবো। কিন্তু তোমার হাত কাটাছেঁড়া। পারবে কাছি ধরে ধরে নামতে?

–আমি হাত দুটো বেশি কাজে লাগাবো না। দুই হাঁটু দিয়ে কাছি দিয়ে নেমে যাবো। আমার জন্যে ভেবো না।

–বেশ। নামো তবে। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো নামতে শুরু করল। একটু সময় নিয়ে শাঙ্কো উপত্যকায় নেমে গেল।

ফ্রান্সিস এতক্ষণ খোলা তলোয়ার হাতে আট দশজন সৈন্য ছুটে আসছে।

এবার ফ্রান্সিস কোমরে গোঁজা ছোরাটা বের করল। গাছের সঙ্গে বাঁধা কাছিটা পোঁচ দিয়ে দিয়ে অর্ধেকটা কাটল। তারপর সৈন্যরা এসে পৌঁছুবার আগেই কাছি ধরে ধরে ফ্রান্সিস দ্রুত নেমে এলো। দেখল শাঙ্কো পেছনে পেছনে অনেক দূর চলে গেছে।

ওদিকে দু’জন সৈন্য কাছি ধরে নেমে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস কাছি ধরে প্রাণপণে হাঁচকা টান দিতে লাগল। অর্ধেক কাটা কাছিটা ছিঁড়ে গেল। সৈন্য দু’জন ছেঁড়া কাছির সঙ্গে ছিটকে পড়ল। নীচের উপত্যকার একটা পাথরের চাঙের ওপর দু’জনে পড়ল। দু’জনেই মারা গেল।

এবার ফ্রান্সিস ছুটল হ্যারি শাঙ্কোদের দলের দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস বন্ধুদের কাছে এসে পৌঁছল। সবাই ধ্বনি তুলল–ও হো-হো।

ফ্রান্সিস বললকাছি ছিঁড়ে দিয়ে এসেছি। দু’জন সৈন্য কাছি ছিঁড়ে পড়ে গেছে। কিন্তু ওরা হাল ছেড়ে দেবে বলে মনে হয় না। দলপতি সিক্কার সৈন্যরা জাহাজঘাটা পর্যন্ত ধাওয়া করতে পারে।

মারিয়া মুখ বুজে সহ্য করতে লাগল। ফ্রান্সিস মারিয়ার পাশে এলো। ডান হাতে মারিয়াকে ধরে নিয়ে চলল।

ফ্রান্সিসরা যখন জাহাজঘাটায় পৌঁছল তখন দেখল দলপতি সিক্কার আট দশজন সৈন্য ছুটে আসছে। তাই দেখে ফ্রান্সিসের বন্ধুরা যারা জাহাজে ছিল তারা খোলা তলোয়ার হাতে জাহাজের পাটাতন নিয়ে নেমে এলো। সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। লড়াই শুরু হল। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে গলা চড়িয়ে বলল–আমার দলের সবাই জাহাজে উঠে যাও। লড়াই করতে যেও না।

অল্পক্ষণের মধ্যেই দলপতি সিক্কার সৈন্যরা হার স্বীকার করল। আহতদের ফেলে রেখে বাকিরা পালিয়ে গেল।

বিজয়ী ভাইকিংরা আনন্দে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। সব ভাইকিংরাই গলায় গলা মেলাল–ও-হো-হো-।

ফ্রান্সিস মারিয়াকে ধরে ধরে কেবিনঘরে নিয়ে এলো। বলল–আর কোনো কথা নয়। এখন শুধু বিশ্রাম। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে নাও। রাঁধুনি বন্ধু বলেছে রান্না সারতে দেরি হবে।

ওদিকে ডেক-এ তখন আড্ডা শুরু হয়েছে। শাঙ্কো হাত, পা নেড়ে বাকি ঘটনাটা বলছে।

ভেন ওষুধের থলে নিয়ে এলো। শাঙ্কোকে বলল–চুপ করো–জামাটামা খোল। শাঙ্কো গলা থামিয়ে জামাটামা খুলল। ভেন দেখল শাঙ্কোর হাত থেকে অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। ভেন শাঙ্কোর ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর একটা ঝোলা থেকে একটা ওষুধ আঙ্গুলে তুলে নিয়ে দু-হাতের তেলোয় ঘষে ঘষে তিনটে বড়ি বানালো। শাঙ্কোকে বলল–দিনে একটা করে খাবে। এখন বকবকানি থামিয়ে নিজের কেবিনঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো। তোমার এখন সম্পূর্ণ বিশ্রাম দরকার।

শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। চলল নিজের কেবিনের দিকে।

সেদিন শেষ রাতে সমুদ্রে ঘন কুয়াশা পড়েছে। মাস্তুলের মাথায় বসে নজরদার পেড্রো ঐ কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে চারদিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছিল না। একঘেয়েমির জন্যেই বটে–পেড্রোর আবার একটু তন্দ্রা এসেছিল। কতক্ষণ পেড্রো তন্দ্রায় চুলছে জানে না। হঠাৎই সজাগ হয়ে দেখল কুয়াশার মধ্যে দিয়ে দুটো ফেল্লুকা অর্থাৎ যুদ্ধ জাহাজ ওদের জাহাজের দুধার দিয়ে আসছে। পেড্রো ঘাবড়ে গেলেও ভয় পেল না। জলদস্যুদের জাহাজ নয়। দুটো জাহাজেই সবুজ নীল পতাকা উড়ছে। কিন্তু পেড্রো বুঝে উঠতে পারলো না ফেলুকা দুটোর উদ্দেশ্য কী। ওরা ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে আসছে না লড়াই করতে আসছে। পেড্রো চিৎকার করে বলল– ভাইসব সাবধান। ফ্রান্সিসকে বলল দুটো যুদ্ধ জাহাজ আমাদের জাহাজের দুপাশ দিয়ে চলেছে।

ডেক-এ শোয়া দু-তিনজন ভাইকিং এর ঘুম ভেঙে গেল পেড্রোর চিৎকারে। ওরা দেখল ওদের জাহাজকে মাঝখানে রেখে দুটো যুদ্ধ জাহাজ চলেছে একই গতিতে।

কুয়াশার মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখল দুটো জাহাজেই গ্রীক সৈন্যদের মতো বুকে বর্ম মাথায় শিরস্ত্রাণপরা কিছু সৈন্য দুটো জাহাজেরই ডেক-এ ঘোরা ফেরা করছে।

ওরা ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে ডেক-এ উঠে এলো। রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়াল দু’জনে। পেছনে আরো কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু। পাশের জাহাজ থেকে একজন সৈন্য গ্রীক ভাষায় জিজ্ঞেস করল–তোমরা কারা? হ্যারি থেমে থেমে গ্রীক ভাষাতেই বলল–আমরা ভাইকিং।

–তোমরা কোথায় যাচ্ছো? সৈন্যটি জিজ্ঞেস করল।

–দেশে ফিরে যাচ্ছি। হ্যারি বলল।

-ঠিক আছে। আমাদের দলপতি আনগেভিন তোমাদের সঙ্গে কথা বলবেন। তোমরা জাহাজ থামাও। আমরাও জাহাজ থামাবো। সৈন্যটি বলল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে সব বুঝিয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল-বলো যে আমরা তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যেতে চাই। আমরা জাহাজ থামাবো না। হ্যারি বলল সেকথা। সৈন্যটি বলল–তোমরা যদি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করো তাহলে কামানের গোলা ছুঁড়ে তোমাদের জাহাজ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেব। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কথাটা। ফ্রান্সিস মাথা নীচু করে একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল– বলল যে আমরা দলপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমরা জাহাজ থামাবো। হ্যারি সৈন্যটিকে বলল সেকথা। সৈন্যটি বলল–তাহলে আমূরাও জাহাজ থামাচ্ছি।

ফ্রান্সিস ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–পাল নামাও। জাহাজ থামাও। ভাইকিং বন্ধুরা পাল খাটানোর কাঠে উঠল। একে একে পালগুলো গুটিয়ে ফেলল। দাঁড়িদেরও দাঁড় টানা বন্ধ করতে বলা হল।

তিনটি জাহাজই দাঁড়িয়ে পড়ল।

তখন সকাল হয়েছে। যুদ্ধ জাহাজের সৈন্যদের মধ্যে বেশ তৎপরতা দেখা গেল। কিছু পরেই ওদের দলপতি আনগেভিন যুদ্ধ জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। তার পরনে ধর্মযাজকদের পোশাক কালো জোব্বা। মাথায় কালো কাপড়ের ঢাকনা। ফ্রান্সিসরা একটু অবাকই হল। ধর্মযাজক হয়েও আনগেভিন সৈন্য, যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে কোথায় চলেছে?

আনগেভিন দু’জন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। হ্যারি এগিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন হ্যারির পেছনে পেছনে এলো। হ্যারি গ্রীক ভাষায় বলল–আমরা ভাইকিং। লড়াই নয় আমরা শান্তি চাই। আনগেভিন বলল আমরা কিন্তু লড়াই চাই। তবে তোমাদের সঙ্গে নয়। তোমরা ভাইকিং। বীরের জাতি। এই যুদ্ধে তামাদের সাহায্য চাই। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল কথাগুলো। ফ্রান্সিস বলল– বলো যে আমরা দেশে ফিরে যাচ্ছি। কোনো কারণেই কোনো যুদ্ধের সঙ্গে আমরা জড়াবো না। আপনাদের সমস্যা আপনারাই মেটান। হারিআনগেভিনকে বলল সেকথা।

আনগেভিন মাথা নেড়ে বলল–তা হবে না। তোমাদের আমার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তৃতীয় পিটারের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কথাটা হ্যারির মুখে শুনে এবার ফ্রান্সিসদের চিন্তা হল। এরপর ফ্রান্সিসদের শেখানো মতো হ্যারি বলতে লাগল।

হ্যারি বলল–দেখতেই পাচ্ছেন আমাদের ঢাল নেই লোহার বর্ম নেই লোহার শিরস্ত্রাণ নেই। রাজা তৃতীয় পিটারের সশস্ত্র যোদ্ধাদের সঙ্গে আমরা লড়বো কী করে।

–তোমাদের ঢাল বর্ম শিরস্ত্রাণ সব দেওয়া হবে। আনগেভিন বলল।

–তা সত্ত্বেও যদি আমরা যুদ্ধ না করি। ফ্রান্সিস বলল। তাহলে কামান দেগে তোমাদের জাহাজ ধ্বংস করা হবে। আনগেভিন বলল। ফ্রান্সিস চিন্তায় পড়ল। ফ্রান্সিস যুদ্ধ জাহাজ দুটো ভালো করে দেখল। দেখল দুটো জাহাজেই কামান বসানো আছে। ইচ্ছে করলেই আনগেভিন ওদের জাহাজ ধ্বংস করতে পারে। ফ্রান্সিস বলল–আমি আমার বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে পরে আপনাকে জানাচ্ছি আমরা কী করবো।

–বেশ। আমি অপেক্ষা করছি। ততক্ষণ তোমাদের জাহাজও অপেক্ষা করবে। আমাদের জাহাজও দাঁড়িয়ে থাকবে। আনগেভিন বলল। তারপর দু’জন সৈন্যের সাহায্যে নিজেদের জাহাজে চলে গেল।

ফ্রান্সিস তখন হ্যারিকেবলল–সব বন্ধুকে ডেক-এ আসতে বলল।মারিয়াও যেন আসে।

সকালের খাওয়া সেরে সবাই ডেক-এ এসে জড়ো হল। ফ্রান্সিস বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বলতে লাগলভাইসব–আমরা একটা গভীর সমস্যায় পড়েছি। কিছুক্ষণ আগে দুটো জাহাজের অধিকারী ও দলনেতা আনগেভিন আমাদের জাহাজে এসেছিল। সে ধর্মযাজকের পোশাক পরে অথচ যুদ্ধে মানুষের মৃত্যু রক্তক্ষয় চায়। কেন বুঝলাম না। যাহোক কাছেই মাল্টা দ্বীপপুঞ্জ। সেখানকার রাজা এখন তৃতীয় পিটার। তাকে যুদ্ধে হারিয়ে মালটা অধিকার করাই আনগেভিনের উদ্দেশ্য। সে চায় তার দলের হয়ে আমরা লড়াই করি। ফ্রান্সিস থামল।

–তাদের হয়ে আমরা লড়াই করতে যাবো কেন? আমরা এখন দেশে ফিরে যাবো। বিস্কো বলল।

– বিস্কো–ফ্রান্সিস বলল– আমিও ঠিক এই কথাটাই আনগেভিনকে বলেছি। উত্তরে আনগেভিন বলেছে তাহলে সে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। সমস্যাটা এখানেই। দেখতেই পাচ্ছো ওদের যুদ্ধ জাহাজে কামান রয়েছে। কাজেই ওরা ইচ্ছে করলে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করতে পারে। ফ্রান্সিস থামল। তারপর বলল–এবার ভাইসব তোমরাই স্থির কর কী করবে। সবাই চুপ করে রইল। এরকম একটা সমস্যায় ওঁদের পড়তে হবে এটা ওরা স্বপ্নেও ভাবেনি।

শাঙ্কো বলে উঠল– ভাইসব– এই সমস্যার সমাধান ফ্রান্সিস আর হ্যারির ওপর ছেড়ে দাও। ওরা দু’জনে যা বলবে তাই মেনে নাও। শাঙ্কো আর হ্যারির ওপর ছেড়ে দাও। ওরা দু’জনে যা বলবে তাই মেনে নাও। শাঙ্কো হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলল হ্যারি তুমি কী বলো? হ্যারি একটু চুপ করে থেকে বলল –ভাইসব –খুবই গভীর সমস্যায় আমরা পড়েছি। আনগেভিনের দলে আমাদের যোগ না দিলে উপায় নেই। দু দুটো যুদ্ধ জাহাজের নজরদারি এড়িয়ে আমরা পালাতে পারবো না। পালাবার চেষ্টা করলেই জাজ সুদ্ধ সবাই আমরা ভীষণ বিপদে পড়বো। ওরা কামানের গোলা ছুঁড়ে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করবে। আমরা ভীষণ বিপদে পড়বো। হ্যারি থামল। ফ্রান্সিসকে বলল –ফ্রান্সিস তুমি কী বলে?

ফ্রান্সিস বলল –হ্যারি– আমি তোমার সঙ্গে একমত। আমরা আনগেভিনের পক্ষেই যোগ দেব। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই। তবে এই লড়াই আমরা করবো আত্মরক্ষামূলক। কারণ এই লড়াই থেকে আমাদের কোনো লাভ নেই। আনগেভিনের লক্ষ্য তৃতীয় পিটারকে পরাজিত করে মাল্টা দখল করা এবং রাজা হওয়া। এর জন্যে আমরা কেন প্রাণ দিতে যাবো। আমরা যতটা সম্ভব শরীর বাঁচিয়ে লড়াই করবো। ফ্রান্সিস থামল।

হ্যারি সব ভাইকিং বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–তাহলে ফ্রান্সিসের প্রস্তাবে তোমরা রাজি। সকলেই চুপ করে রইল। সবাই বুঝতে পারল এ ছাড়া উপায় নেই। দু-দুটো যুদ্ধ জাহাজের পাহারা থেকে ওদের জাহাজ বের করে নিয়ে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শুধু শাঙ্কো বলল–ফ্রান্সিস আবার দেশে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।

ফ্রান্সিস বলল–তা ঠিক– তবে দেশে ফিরে কী হবে। যা ঘটতে যাচ্ছে সেটাও একটা বিচিত্র অভিজ্ঞতা। আমরা চিন্তা শুধু একটাই–আমাদের কারো যেন প্রাণহানি না ঘটে।

সভা ভেঙে গেল।

বিকেলে ফ্রান্সিস হ্যারিকে নিয়ে আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজে গেল। আনগেভিনের কেবিনঘরে বসেই ওরা কথা বলল। ফ্রান্সিস নিজেদের সম্মতির কথা জানাল। আরো বলল–আপনারা জয়ী হলেই আমরা কিন্তু দেশের দিকে জাহাজ চালাবো।

–ঠিক আছে। আমাদের লক্ষ্য যুদ্ধে জয়লাভ করা। আনগেভিন বলল।

সন্ধের পর থেকে আনগেভিন যুদ্ধ জাহাজ দুটি সামনে চলতে লাগল পেছনে ফ্রান্সিসদের জাহাজ।

পরদিন সকালে আনগেভিনের দূত হিসেবে একজন লোক এলো। হ্যারির সঙ্গে কথা বলল। হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল–আনগেভিন বলে পাঠিয়েছেন যে পঁচিশটি যুদ্ধাস্ত্র অর্থাৎ বর্ম ঢাল আর শিরস্ত্রাণ আমাদের দেবে। এর বেশি অস্ত্র ওদের মজুত নেই। আমাদের পঁচিশজনকে যেতে বলছে ওদের যুদ্ধ জাহাজে। যুদ্ধাস্ত্র আনতে।

চলো। আমরা নিশ্চইযাবো। এরকম যুদ্ধাস্ত্র ছাড়া তৃতীয় পিটারের সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। তখনই ভাইকিং বন্ধুদের ফ্রান্সিস হ্যারিকে দিয়ে ডেকে পাঠাল। সবাই এলে বন্ধুদের থেকে চব্বিশজনকে বেছে নিল। তারপর দলবেঁধে চলল আনগেভিনের যুদ্ধ হাজাজে। যাবার সময় ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–তুমি লড়াইতে নামবে না। তুমি মারিয়ার সঙ্গে থাকবে।

ফ্রান্সিস বিস্কো শাঙ্কোসহ পঁচিশজন বর্ম শিরস্ত্রাণ ঢাল হাতে নিজেদের জাহাজে ফিরে এলো। এইসব যুদ্ধাস্ত্র পেয়ে সবাই খুশি। ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–হ্যারি তুমি বলে এসো যে আমাদের যে সববন্ধুরা যুদ্ধাস্ত্র পেল না তারা লড়াই করবে না। হ্যারি সেকথা আনগেভিনকে গিয়ে বলে এলো। আনগেভিন বলল–যুদ্ধ না করুক কিন্তু যুদ্ধরত সৈন্যদের সাহায্য করতে হবে। হ্যারি তাতে সম্মত হল।ফ্রান্সিসকে এসেবললও সেকথা। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে।

পরদিন দুপুর নাগাদ নজরদার পেড্রো মাস্তুলের ওপরে ওর বসার জায়গা থেকে চেঁচিয়ে বলল–ডাঙা দেখা যাচ্ছে–ডাঙা।

একটু পরেই আনগেভিন হ্যারিকে ডেকে পাঠাল। হ্যারি এলে বলল– আমরা মাল্টায় এসে গেছি। আমরা মাল্টার উত্তর দিকে নামবো। এখানেই আছে সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ। সেই দুর্গ আমরা পিটারের সৈন্যদের যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে দখল করবো। তোমার বন্ধুদের সৈন্যদের যুদ্ধের জন্যে তৈরি হতে বলো। তৈরি হয়ে তারা যেন আমাদের দুই জাহাজে চলে আসে। তোমাদের জাহাজ তো যুদ্ধ জাহাজ নয়। তোমাদের জাহাজ একটু দূরে থাকবে। হ্যারি জাহাজে ফিরে এসে সব ফ্রান্সিসকে বলল।

মাল্টার তীরভূমি দেখা গেল। তিনটি জাহাজই তীরভূমির কাছে এলো। দেখা গেল তীরভূমিতে পাথরের চাঁই নেই। প্রায় সমতল পাথুরে রাস্তামতো ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমে এসেছে। এতে সৈন্যদের চলাফেরার সুবিধেই হবে। যুদ্ধ জাহাজ থেকে তিরপর্যন্ত কাঠের পাটাতন পাতা হল।

আনগেভিনের নেতৃত্বে তার সৈন্যরা আর ফ্রান্সিসরা অস্ত্রসজ্জিত হয়ে পাতা কাঠের পাটাতন দিয়ে হেঁটে নেমে এলো। পাথুরে রাস্তামতো ঢালু জায়গা দিয়ে সকলেই উঠতে লাগল। রাজা তৃতীয় পিটারের কোনো সৈন্যের দেখা পাওয়া গেল না। খুশিতে আনগেভিনের সৈন্যরা তলোয়ার বর্শা উঁচিয়ে হৈ হৈ করে উঠল। ওরা ভেবেছিল যুদ্ধে নামতে হবে। অথচ দেখা গেল সমুদ্রতীরে রাজা পিটারের একটা সৈন্যও নেই।

ফ্রান্সিস একটু অবাকই হল যখন দেখল বিনা বাধায় ওরা এগিয়ে চলল। কিছুটা এগোতেই এবার একটা বড়ো দুর্গ দেখা গেল। পাথরের দুর্গার চারপাশ ঘিরে পাথুরে দেয়াল। আনগেভিন তার সৈন্যদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল–সেন্ট অ্যাঞ্জেলা দুর্গ আমরা জয় করবো। সব সৈন্যরা হৈ হৈ করে উঠল। শূন্যে তলোয়ার ঘোরাল। বর্শা ওঠাতে নামাতে লাগল।

সামনে একটু উত্রাইমতো। সেটা পার হতেই দেখা গেল রাজা পিটারের সৈন্যরা দুর্গ-ঘেরা পাথুরে প্রাচীরের চারদিকে ছড়িয়ে আছে।

আনগেভিনের নেতৃত্বে সৈন্যদল এগিয়ে চলল দুর্গের দিকে। মাত্র হাত পঞ্চাশেক দূরে থাকতেই আনগেভিন চিৎকার করে হুকুম দিল–আক্রমণ করো। তার সৈন্যরা শূন্যে তলোয়ার ঘোরাতে ঘোরাতে অন্যদল বর্শা উঁচিয়ে দ্রুত ছুটে গিয়ে দুর্গরক্ষী সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসরাও তাদের পেছনে পেছনে ছুটে গেল। দুর্গের চারপাশ ভরে উঠল যুদ্ধরত সৈন্যদের অস্ত্রে ঝনঝনা রণহুংকার আর উৎসাহের ধ্বনিতে। তারপরই শোনা গেল আহতদের আর্ত চিৎকার।

লড়াই চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল রাজা পিটারের সৈন্যদের সংখ্যা কমে গেছে। যারা তবু লড়াই করছিল তারা পিছু হটতে হটতে দুর্গের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিল। আনগেভিনের সৈন্যদের হাতে দুর্গ পতনের মুখে। তীব্র লড়াই চলল। রাজা পিটারের সৈন্যরা এদিক-ওদিক ছুটে পালাতে লাগল। এতে আনগেভিনের সৈন্যদের ও যুদ্ধরত ভাইকিংদের উৎসাহ দ্বিগুণ হল। রাজা পিটারের সৈন্যদের বন্দি করা হতে লাগল। এবার দুর্গের ভেতের আশ্রয় নেয়া সৈন্যদের বন্দি করার জন্যে আনগেভিনের সৈন্যরা জলস্রোতের মতো দুর্গটায় ঢুকতে লাগল। দুর্গের মধ্যেও বেশ কিছুক্ষণ লড়াই চলল। তারপর পরাজিত রাজা পিটারের সৈন্যদের বন্দি করা হল। রাখা হল দুর্গের কয়েদঘরে।

যুদ্ধ শেষ। এবার ফ্রান্সিস ওর বন্দুদের খুঁজে খুঁজে বের করে দুর্গের একটি ঘরে নিয়ে এলো। সবাই যুদ্ধ ক্লান্ত। অনেকেই শুকনো ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিসের বিশ্রাম নেই। বন্ধুদের গুণে গুণে দেখল–তিনজন এখানো আসেনি। তারা যুদ্ধে মারা গেছে কিনা আহত হয়েছে সেই খোঁজে ফ্রান্সিস দুর্গের বাইরে এলো। নিহত আহত সৈন্যদের মধ্যে ফ্রান্সিস বন্ধুদের খুঁজতে লাগল। অনেক নিহত আহত সৈন্যদের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এক আহত বন্ধুকে পেল। আহত বন্ধুটাকে তুলে দাঁড় করাল। দেখল বন্ধুটির পিঠে তলোয়ারের কোপ গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ফ্রান্সিস ওকে বলল–তুমি একটু অপেক্ষা করো। আরো দু’জন বন্ধুর খোঁজ পাচ্ছি না। ওদের কী হয়েছে দেখি, তুমি ততক্ষণ এখানে অপেক্ষা করবো। আমিই তোমাকে দুর্গে নিয়ে যাবো। জাহাজ থেকে বৈদ্য ভেনকে এনে তোমার চিকিৎসা করাব। এই বলে আহত বন্ধুটিকে ওখানে বসিয়ে রেখে ফ্রান্সিস আর দু’জন বন্ধুকে খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণ যুদ্ধের জায়গায় ঘুরে ঘুরে ফ্রান্সিস দুই বন্ধুকে পেল। কিন্তু জীবিত বা আহত নয়। যুদ্ধে দু’জনেই মারা গেছে।

ফ্রান্সিসের গভীর দুঃখে চোখে জল এলো। এই বিদেশ বিভুইয়ে এসে বন্ধু দু’জন মারা গেল। দেশে ফিরে তাদের বাবা-মাকে অনেক কষ্টে শান্ত করতে হবে। ফ্রান্সিস ভাবল যুদ্ধে নামলে মৃত্যু হতেই পারে। এই নিয়ে মন খারাপ করে লাভ নেই। বরং এখন কী কী কাজ করতে হবে সেটাই ভেবে নিল।

ফ্রান্সিস আহত বন্ধুটির কাছে ফিরে এলো। ওকে তুলে ধরে আস্তে আস্তে দুর্গের দিকে নিয়ে চলল। বন্ধুটির পিঠ থেকে তখনও চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। বেশ কষ্ট করেই বন্ধুটিকে ফ্রান্সিস দুর্গে নিয়ে এলো। ওরা যে ঘরে আশ্রয় নিয়েছিল সেই ঘরেই আহত বন্ধুটিকে রাখল। তারপর বিস্কোকে বলল–জাহাজ থেকে ভেন হ্যারি আর এ মারিয়াকে এখানে নিয়ে এসো। বিস্কো চলে গেল।

ফ্রান্সিস এবার বন্ধুদের বলল–আমাদের দুই বন্ধু যুদ্ধে মারা গেছে। কথাটা শুনে সব ভাইকিংরা নিজেদের মধ্যে কথা বলা বন্ধ করল। মাথা নিচু করে সবাই মৃত বন্ধু দু’জনের স্মৃতির প্রতি ভালোবাসা জানাল।

দুর্গের ডানদিকে একটু দূরে কবরখানা। বিকেলে আনগেভিন সেখানে এলো। যেসব সৈন্য যুদ্ধে মারা গেছে তাদের কবর দেওয়া হল। ফ্রান্সিস মারিয়া হ্যারি অন্য কিছু বন্ধু তাদের মৃত দুই বন্ধুর দেহও কবর দিল।

সন্ধে নামতেই সবাই দুর্গে ফিরে এলো। ওদের ঘরেই ফ্রান্সিসরা এলো। দেখল– বৈদ্য ভেন-এর ওষুধে আহত বন্ধুটি এখন অনেকটা ভালো হয়েছে।

একটু রাত হতে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল–হ্যারি আনগেভিনের নির্দেশ তো আমরা মেনেছি। যুদ্ধ করেছি। আনগেভিনকে সেকথা বলতে হবে–চলো।

বলবো যে যুদ্ধে জয়ও হয়েছে। এবার আমরা দেশের দিকে যাবো। সৈন্যদের জিজ্ঞেস করে দুর্গের সবচেয়ে ভালো ঘরটায় এলো। দেখল-আনগেভিন কয়েকজন অনুচরকে নিয়ে পাখির পালকে তৈরি বিছানায় বসে আছে। যুদ্ধজয়ের আনন্দে আনগেভিন মশগুল।

হ্যারি বলল–আনগেভিন–আপনি যুদ্ধে আমাদের সাহায্য চেয়েছিলেন। আমরা লড়াইতে অংশ নিয়েছি। আপনি সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ জয় করেছেন।

–হ্যা–তোমাদের সাহায্য আমাদের খুব কাজে লেগেছে। তোমাদের লড়াই করা তো দেখলাম। সত্যিই তোমরা দুঃসাহসী যোদ্ধা। আনগেভিন বলল।

হ্যারি বলল–যুদ্ধে আপনাকে সাহায্য করেছি। এবার আমরা আমাদের দেশের দিকে জাহাজ চালাতে চাই।

না–আনগেভিন বলল–এখনও আমরা রাজধানী ভ্যালেত্তা জয় করতে পারি নি। ভ্যালেত্তা জয় করা পর্যন্ত তোমাদের সাহায্য চাই।

–কিন্তু এসব তো আপনাদের দেশের ব্যাপার–আপনাদের দেশের সমস্যা। এসবের সঙ্গে আমাদের জড়াচ্ছেন কেন। এই যুদ্ধেই আমরা দুই বন্ধুকে হারিয়েছি। হ্যারি বলল।

–ও সব বুঝি না–ভ্যালেত্তা দখলের লড়াইয়ে তোমাদেরও থাকতে হবে। আমরা ভ্যালেত্তা জয় করবো। আমি মাল্টার রাজা হব। তখন তোমরা ছাড়া পাবে তার আগে নয়। আনগেভিন বলল।

হ্যারি একথা ফ্রান্সিসকে বলল। ফ্রান্সিস বলল–এখন আনগেভিনের কথা মানতেই হবে সময় সুযোগ বুঝে পালাবো আমরা। ফ্রান্সিস ওদের ভাষায় বললে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি দুর্গের ঘরের দিকে এলো। সবাই এগিয়ে এলো কী হবে এখন জানতে। ফ্রান্সিস বলল, ভাইসব–আনগেভিন এখনই আমাদের মুক্তি দিতে রাজি নয়। রাজধানী ভ্যালেত্তা দখল না হওয়া পর্যন্ত আনগেভিনের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে। লড়াইও করতে হবে।

–আমরা লড়াই করবোনা–আমরা দেশে ফিরে যাবো। শাঙ্কো বলল।কিছু ভাইকিং ও বন্ধু সেটা সমর্থনও করল। ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো আনগেভিনকে এসব কথা আমরা না বলেছি। কিন্তু আনগেভিন আমাদের চলে যেতে দেবে না। ও কোনো কথাই শুনতে রাজি নয়।

–আমরা তো এখন বন্দি নই। গভীর রাতে জাহাজ নিয়ে পালাতে পারি। ফ্লেজার বলল। ফ্রান্সিস বলল–ফ্লেজার–এখন যুদ্ধ চলছে। আনগেভিনের সৈন্যরা রাত জেগে ওদের যুদ্ধ জাহাজ পাহারা দিচ্ছে। আমরা জাহাজে চড়ে পালাতে গেলে ওরা কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। আমরা তাহলে অনেকেই মারা যাবো। যারা বেঁচে থাকবে তারাও দেশে ফিরে যেতে পারবেনা। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলতে লাগল– আমরা আমাদের অটুট জাহাজ নিয়ে পালাবো ঠিকই তবে সেটা সময় ও সুযোগ বুঝে।

বিকেলের দিকে ফ্রান্সিসরা খবর পেল যে কয়েকদিন বিশ্রাম নিয়ে আনগেভিন তার সৈন্যদল নিয়ে স্থলপথে রাজধানী ভ্যালেত্তা আক্রমণ করবে। সৈন্যদলের সঙ্গে ফ্রান্সিসদেরও যেতে হবে।

সেদিন গভীর রাতে দূরে কামানের গোলার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস হ্যারি শাঙ্কোদের ডাকল। আস্তে আস্তে সবারই ঘুম ভেঙে গেল। ফ্রান্সিস বলল–মনে হচ্ছে রাজা পিটারের সৈন্যরা জলপথে লড়াই করতে এসেছে।

ততক্ষণে দুর্গে সাজো সাজো রব পড়ে গেছে। সব সৈন্যরা যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে তৈরি হল। দু’তিনজন সৈন্য আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজ থেকে সংবাদ নিয়ে এসেছে–রাজা পিটারের সৈন্যরা তিনটি যুদ্ধজাহাজে এসে আনগেভিনের জাহাজ আক্রমণ করেছে।

ফ্রান্সিস বলল–শাঙ্কো তৈরি হও। কামানের গোলা ছুঁড়ে দু’পক্ষই যুদ্ধ করবে। মাঝখান থেকে আমাদের জাহাজটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ঐ জাহাজই আমাদের একমাত্র ভরসা। চলো–আমাদের জাহাজটা বাঁচাতে হবে।

শাঙ্কোকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস ঘরের বাইরে এলো। দেখল তখন আনগেভিনের সৈন্যরাও ঘুম ভেঙে উঠে পড়েছে। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো অন্ধকারে উত্তর মুখো দিক ঠিক রেখে চলল। ওদিকেই সমুদ্রতীরে আনগেভিন আর ওদের জাহাজ রয়েছে।

অন্ধকার সমুদ্রতীরে এসে পৌঁছল ওরা। দেখল–আনগেভিনের গোলন্দাজ বাহিনীও ওদের যুদ্ধ জাহাজ থেকে কামানের গোলা ছুঁড়ছে।

ফ্রান্সিস এবার ছুটতে শুরু করে বলল–শাঙ্কো তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের জাহাজটা কামানের গোলার হাত থেকে বাঁচাতে হবে। দু’জনেই ছুটতে লাগল।

সমুদ্রতীরে লাগানো কাঠের পাটাতন দিয়ে দু’জনে ওদের জাহাজে উঠে এলো। ফ্রান্সিস ছুটে গেল নোঙরের দড়িটার দিকে। দু’জনে নোঙরের দড়িটা টেনে নোঙর তুলে ফেলল। তারপর একটা লম্বা কাছি নীচের কেবিনঘর থেকে শাঙ্কো নিয়ে এলো ফ্রান্সিসদের নির্দেশে। কাছিটার মাঝামাঝি জায়গাটা জাহাজের মাথায় বাঁধল। ফ্রান্সিস বলল–কাছির মাথাটা কোমরে বাঁধ। এই বলে নিজেও কাছিটা কোমরে বাঁধল। তারপর জাহাজের মাথার কাছ থেকে দু’জনে জলে ঝাঁপ দিল। মারিয়া অন্য ভাইকিং বন্ধুরা জাহাজের রেলিং ধরে দেখতে লাগল–কী করে ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জাহাজটা টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে।

দু’জনে প্রাণপণে কাছি টেনে নিয়ে সাঁতরাতে লাগল। তখনইফ্রান্সিস দেখল অন্ধকার আকাশে আলো ছড়িয়ে দুপক্ষের জাহাজ থেকেই কামানের গোলা ছুটে আসছে। কাছিতে টান পড়ায় ফ্রান্সিসদের জাহাজটা একটু নড়ল ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো সমান টান রাখলো। জাহাজটার মুখ আস্তে আস্তে ঘুরতে লাগল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে ধ্বনি দিল–ওহো হো। শাঙ্কোও ধ্বনি দিল ওহোহো। জাহাজ থেকে বন্ধুরা চিৎকার করে উঠল। এবার ফ্রান্সিসদের জাহাজ আনগেভিনের যুদ্ধ জাহাজ দুটি থেকে অনেকটা সরে এলো। তখনই একটা কামানের গোলা এসে পড়ল আনগেভিনের একটা যুদ্ধজাহাজের পেছন দিকে। পেছনের হালের কাছে আগুন ধরে গেল। ফ্রান্সিসদের জাহাজ তখন বেশদূরে চলে এসেছে। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে ঐ আগুন ফ্রান্সিসদের জাহাজেও ছড়িয়ে পড়ত। ভাগ্য ভালো বলতে হবে।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো জাহাজটা আরো দূরে টেনে নিয়ে চলল। ফ্রান্সিস দেখল– আনগেভিনের সৈন্যরা দড়ি বাঁধা কাঠের পাত্রে সমুদ্র থেকে জল তুলে তুলে আগুন নেভাচ্ছে। তখনও আগুন বেশি ছড়ায় নি। জল ঢালারও বিরাম নেই। ফ্রান্সিস বুঝল– আগুন নিভে যাবে। অবশ্য জাহাজের হালের জায়গায় অনেকটাই পুড়ে গেছে।

ওদিকে রাজা পিটারের একটা জাহাজে কামানের গোলায় আগুন লেগে গেছে। রাজা পিটারের সৈন্যরা অনেক চেষ্টা করেও আগুন আয়ত্তে আনতে পারল না। জাহাজটায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। বোধহয় অস্ত্র-ঘরে মজুত কামানের গোলায় আগুন ছড়িয়ে পড়ল। কামানের গোলাগুলো দুম্ দাম্ ফাটতে লাগল। আকাশে অনেক উঁচুতে আগুনের ফুলকি উড়ল। অরো কয়েকটা গোলা ফাটল। সৈন্যরা জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আগুনে পোড়া জাহাজটার বাকি অংশ জলে ডুবে গেল।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো ওদের জাহাজটা অনেক দূরে টেনে এনেছে তখন। ওদিকে কামান দাগা শেষ হ’ল। ডেক-এ উঠে দু’জনেই শুয়ে পড়ল। দু’জনেই ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। মারিয়া আর অন্য বন্ধুরা ছুটে এলো। ফ্রান্সিস হাঁপাতে হাঁপাতে মারিয়াকে বলল– একটু বিশ্রাম পেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে ফ্রান্সিস নিজের কেবিনঘরে ঢুকলো। ভেজা পোশাক ছেড়ে শুকনো পোশাক পরল। শাঙ্কো নিজের কেবিনঘরে এলো। দুজনেই একটু পরে ঘুমিয়ে পড়ল। তখন রাত শেষ হয়ে এসেছে। মারিয়া আর ঘুমলো না। ফ্রান্সিসের শিয়রে বসে রইল।

সকাল হতেই রাজা পিটারের সৈন্যরা তাদের দু’টো জাহাজ থেকে নেমে আসতে লাগল। তাদের একটা জাহাজ তো গতরাতে পুড়ে গেছে। তাদের সেনাপতি মান্দোর নেতৃত্বে সৈন্যবাহিনী চলল সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গ অধিকার করতো। কিছু সৈন্য চলল—আনগেভিনের একটা যুদ্ধ জাহাজ দখল করতে।

ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। তাড়াতাড়ি ডেক-এ উঠে এলো। দেখল–যুদ্ধ শুরু হতে দেরি নেই। শাঙ্কো উঠে এলো। ফ্রান্সিস বলল–চলো–টেনে জাহাজটাকে ডাঙার, কাছে নিয়ে যাই।

দুজনেই দাঁড়ঘরে নেমে এলো।দাঁ ড় বাইতে লাগল। একটু পরেই জাহাজটা তীরভূমির খুব কাছে এলো।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো কাঠের পাটাতন পেতে জাহাজ থেকে মাটিতে নেমে এলো। তারপরই ছুটল দুর্গের দিকে।

ততক্ষণে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আনগেভিনের সৈন্যরা দুর্গের সামনের ময়দানে যুদ্ধ করছে রাজা পিটারের সৈন্যদলের সঙ্গে। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। উৎসাহব্যঞ্জক ধ্বনি চিৎকার, আহতের আর্তনাদে জায়গাটা ভরে উঠেছে।

ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো সমুদ্রতীর থেকে দুর্গের কাছে এলো। দুর্গের পেছন ফিরে ঘুরে এসে ওরা আনগেভিনের সৈন্যদলের সঙ্গে যোগ দিল।

যুদ্ধ চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্রান্সিস বুঝল রাজা পিটারের এই সেনাবাহিনী দুর্ধর্ষ। ওরা যুদ্ধে নিপুণ।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দেখা গেল আনগেভিনের সেনাবাহিনী দুর্গের দিকে পিছুহটছে। তাদের মধ্যে অনেকেই আহত। মারাও গেছে অনেক। রাজা পিটারের সৈন্যরা সমান চাপ রেখে লড়াই চালাতে লাগল।

হারের মুখে এসে দাঁড়াল আনগেভিনের সৈন্যদল। ওরা রণক্ষেত্র থেকে পালাতে লাগল। অনেকেই পিছিয়ে দুর্গে আশ্রয় নিতে লাগল।

এক সময় লড়াই করতে করতে বিস্কো ফ্রান্সিসদের পাশে এলো। তলোয়ার চালাতে চালাতেই বলল–ফ্রান্সিস, দুর্গের পেছনের দরজা দিয়ে আনগেভিন পালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু সমুদ্রতীরে পৌঁছবার আগেই আনগেভিন ধরা পড়েছে। এখন সে সেনাপতি মান্দোর হাতে বন্দি। কথাটা শুনেই ফ্রান্সিস তলোয়ার চালানো বন্ধ করল। চিৎকার করে বলল– বন্ধুরা-ভাইসব অস্ত্রত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রের একপাশে দু’হাত তুলে দাঁড়াও। এখৰ আমাদের লড়াই করা অর্থহীন। আমরা বন্দিত্ব মেনে নেব।

ফ্রান্সিসের বন্ধুরা সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ার মাটিতে ফেলে দিল। বর্ম শিরস্ত্রাণও মাটিতে ফেলে দিল। তারপর ফ্রান্সিসের নির্দেশে দু’হাত ওপরে তুলে রণক্ষেত্র থেকে সরে এলো।

পিটারের সৈন্যরা তুমুল চিৎকার ধ্বনি তুলে দুর্গের দিকে ছুটে গেল। দলে দলে সৈন্যরা দুর্গৰ্টায় ঢুকতে লাগল। আনগেভিনের সৈন্যদের বন্দি করতে লাগল।

যুদ্ধ শেষ। আনগেভিনের যে সৈন্যরা দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল তারাও হার স্বীকার করল।

ফ্রান্সিসদেরও রাজা পিটারের সৈন্যরা বন্দি করল। ওদের নিয়ে চলল দুর্গের মধ্যে। ওদের হাত বেঁধে দুর্গের চত্বরে বসিয়ে রাখা হল। ওদিকে আনগেভিনের সৈন্যদের দুর্গের ঘরে ঘরে ঢুকে মান্দোর সৈন্যরা বন্দি করতে লাগল।

এভাবে বসে থাকাটা ফ্রান্সিসের কাছে অপমানজনক মনে হল। ও হ্যারিকে বলল রাজা পিটারের সেনাপতিকে গিয়ে বলল যে আমরা ভাইকিং। আনগেভিন আমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তার দলের সঙ্গে আমাদেরও যুদ্ধে যোগ দিতে বাধ্য করেছে। হ্যারি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। সেনাপতি মান্দার একজন সৈনিককে বলল– আমরা সেনাপতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

–সেনাপতি মান্দো এখন বিশ্রাম করছেন। সৈন্যটি বলল।

ঠিক আছে। তুমি মান্দোকে গিয়ে বলো আমরা ভাইকিং। আমরা এখানকার লোক নই। বিশেষ প্রয়োজনে তার সঙ্গে দেখা করতে চাই। হ্যারি বলল।

-বেশ-বলে দেখছি। সৈন্যটি চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সৈন্যটি ফিরে এলো। বলল–তোমারাই তো ভাইকিং?

–হ্যাঁ হ্যারি বলল।

–সেনাপতি তোমাদের দেখা করার অনুমতি দিয়েছেন। সৈন্যটি বলল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি উঠে দাঁড়াল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সৈন্যটার পেছনে পেছনে চলল। যেতে যেতে দেখল–যুদ্ধ শেষ। আহত সৈন্যরা গোঙাচ্ছে। আর্তনাদ করছে। আনগেভিনের জীবিত সব সৈন্যই বন্দি হয়েছে। দুর্গের চত্বরে সারি দিয়ে বসে আছে।

দুর্গের সবচেয়ে ভালো ঘরটাতে পালকের বিছানায় সেনাপতি মান্দো বসে আছে। ফ্রান্সিস আর হ্যারি মান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। মান্দো বলল–শুনলাম তোমরা ভাইকিং–বিদেশি। আনগেভিনের সৈন্যদের হয়ে তোমরা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল কেন?

–নিরুপায় হয়েই আমাদের যুদ্ধে অংশ নিতে হয়েছে। আনগেভিন আমাদের বন্দি করেছিল আমাদের জাহাজ আটক করেছিল। আমাদের ভয় দেখিয়েছিল যে তার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমরা যদি রাজা পিটারের সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করি তাহলে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ধ্বংস করে দেবে। আমাদের জীবন বাঁচাতে জাহাজ বাঁচাতে বাধ্য হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছি, তা নইলে এই যুদ্ধে আমাদের কী লাভ? আমরা যুদ্ধ চাই না–শান্তি চাই। হ্যারি বলল।

-বুঝলাম–মান্দো বলল কিন্তু উপায় নেই। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছো কাজেই তোমাদের বন্দি হয়েই থাকতে হবে। কাল সকালে রাজা পিটার এখানে আসবেন। তিনি তোমাদের ব্যাপারে যা করতে চান করবেন। আমি কিছু করতে পারবো না।

–বেশ। তাহলে তো আমাদের আনগেভিনের সৈন্যদের মতোই বন্দি হয়ে থাকতে হবে। হ্যারি বলল।

-হ্যাঁ। কাল আনগেভিনের বিচার হবে। সঙ্গে তোমাদেরও বিচার হবে। রাজা তৃতীয় পিটার যা বিচার করবেন তাই হবে। মান্দো বলল।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি নিজেদের জায়গায় ফিরে এলো। হ্যারির বন্ধুদের জানাল সেনাপতি মান্দোর সঙ্গে কী কথাবার্তা হয়েছে। সবাই বুঝল রাজা পিটার এখন যা বলবেন তাই হবে।

রাত হল। বন্দিদের খেতে দেওয়া হল। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সবাইকে খেতে হল।

খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস মাথার পেছনে দুহাত রেখে পাথুরে চত্বরে শুয়ে পড়ল। হ্যারিও আধশোয়া হল। ফ্রান্সিস একটা ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হল যে মারিয়া জাহাজেই আছে। এই বন্দিদশা মারিয়া সহ্য করতে পারতো না।

ফ্রান্সিস খোলা আকাশের দিকে তাকাল। ভাঙা চাঁদ। জ্যোৎস্না অনুজ্জ্বল। তারা জ্বলছে। ফ্রান্সিসের ভাবনার শেষ নেই। রাজা পিটার ওদের নিয়ে কী করবেন কে জানে। যদি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার অপরাধে ওদের কয়েদখানায় বন্দি করে রাখে তাহলে বিপদ। জাহাজে মারিয়া রয়েছে–যে বন্ধুরা অস্ত্রশস্ত্র পায় নি বলে যুদ্ধে যোগ দেয় নি তারা রয়েছে। ফ্রান্সিসরা বন্দি হলে ওরা দিশেহারা হবে–যেভাবে হোক সবারইমুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্রান্সিসের দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।

শেষরাতে একটা শিরু শি ঠাণ্ডা হাওয়ায় ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। বেশ শীত শীত করতে লাগল।

আর ঘুম আসছে না। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাই ফ্রান্সিসের বাড়ির কথা মনে হল। কোথায় সাদা ধগ্ধপে পালক-নরম বিছানা বালিশ সাজানো ঘর। জানালায় হালকা নীল পর্দা আর কোথায় এই দুর্গের পাথুরে চত্বর। পিঠের হাড়ে ব্যথা হয়ে গেছে–মাথার পেছনেও ব্যথা। বাকি রাতটুকু ফ্রান্সিসের আর ঘুম এলো না।

সকালে দুর্গে মান্দোর সৈন্যদের মধ্যে সাজো সাজো রব। রাজা পিটারের শৌখিন জাহাজ নাকি আসতে দেখা গেছে। সৈন্যরা সব দুর্গের বিরাট কাঠের সদর দরজার সামনে সার বেঁধে দাঁড়াল। এক সারি সৈন্যের হাতে বর্শা। পেতলের বর্শায় সূর্যের আলো পড়ে ঝলকাচ্ছে।

একটু বেলায় রাজা পিটার একটা সাদা ঘোড়ায় চেপে এলেন। ঘোড়ার গায়ে মাথায় নানা রঙের সাজ। রাজা পিটারের মাথায় মুকুট নেই। পোশাক লাল রঙের জোব্বামতো। তাতে সোন রুপোর সুতোর কাজ করা। রাজা পিটারের বয়েস বেশি নয়। মুখে গোঁফ থুতনিতে অল্প দাড়ি।

রাজা পিটারের পেছনে পেছনে এলো রাজার দেহরক্ষীর দল। তাদের পরনে বিচিত্র রঙদার পোশাক।

রাজা পিটারকে দেখে সৈন্যরা জয়ধ্বনি করল। রাজা সদর দেউড়ি দিয়ে সৈন্যদের মাথা নিচু করে অভিবাদন নিতে নিতে দুর্গে ঢুকে গেলেন। সেই পালকের বিছানা পাতা ঘরে গিয়ে রাজা বসলেন।

একটু পরেই হাত বাঁধা অবস্থায় আনগেভিনকে রাজার কাছে আনা হল। রাজা আনগেভিনকে বললেন–বেশ তো সিলিলিতে ধর্মকর্ম নিয়ে ছিলেন। হঠাৎ মাল্টার রাজা হবার শখ হল কেন?

–আপনার শাসনে সিসিলি জেনোয়ার যেসব লোক এখানে আছে তারা ক্ষুব্ধ। তারাই আপনাকে হারিয়ে মাল্টার রাজা হতে আমাদের ডেকে এনেছে। আনগেভিন বলল।

–এখন রাজা হওয়ার বদলে কয়েদঘরে পচতে হবে। রাজা হেসে বললেন। জেনে রাখুন–মাল্টার উচ্চবংশীয় মানুষেরা কিন্তু আমার বশ্যতা স্বীকার করেছে। তারা চায় আমিই যেন রাজা থাকি আর মাল্টাবাসীদের কল্যাণ করি। একটু থেমে রাজা বললেন এই আনগেভিনকে কয়েদঘরে আটক করে। তার আগে ওর পিঠে কুড়িবার চাবুক মারবে।

আনগেভিনকে নিয়ে সৈন্যরা চলে গেল।

অন্য সৈন্যদের সম্বন্ধে রাজা পিটার আদেশ দিলেন–এখানকার কয়েদঘরে যতজন আঁটে ততজনকে বন্দি করে রাখে।! বাকিদের আনজুতে নিয়ে যাও। ওখানকার কয়েদঘরে বন্দি করে রাখবে।

রাজার বিচার শেষ হল। তখন সেনাপতি মান্দো এগিয়ে এসে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–একদল বিদেশি আনগেভিনের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। তাদের কী করা হবে।

তাদের কাউকে নিয়ে এসো। সব, শুনি আগে। রাজা বললেন। মান্দো একজন সৈন্যকে পাঠালো ফ্রান্সিসদের ডেকে আনতে।

কিছুক্ষণ পরে হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস এলো। দু’জনেই মাথা একটু নুইয়ে নিয়ে শ্রদ্ধা জানাল। রাজা পিটার বললেন–শুনলাম তোমরা ভাইকিং। আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে।

হ্যারি বলল–আমরা যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছি

–কেন? রাজা পিটার বললেন।

কারণ আনগেভিনের সৈন্যরা কিছুদিন আগে গভীর রাতে আমাদের জাহাজ দখল করেছিল। আনগেভিন সেন্ট অ্যাঞ্জেলো মানে এই দুর্গ অধিকার করতে আসছিল। আমাদের বলল তার সৈন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়ে এই দুর্গ অধিকার করতে আমরা যেন সাহায্য করি। হ্যারি বলল।

–তোমরা অস্বীকার করলেই পারতে। রাজা পিটার বললেন।

–আমরা সে কথা বলেছিলাম। হ্যারি বলল।

–আনগেভিন কী বলল। রাজা পিটার জানতে চাইলেন।

–আনগেভিন বলেছিল মানে আমাদের ভয় দেখিয়েছিল–আমরা যুদ্ধে যোগ না দিলে সে কামান দেগে আমাদের জাহাজ ডুবিয়ে দেবে। হ্যারি বলল।

-সেই ভয়েই তোমরা আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে এসে যুদ্ধ করেছিল।

–এবার বলো তো তোমরা এই ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে এসেছ কেন? রাজা পিটার বললেন।

–এ কথার উত্তর আমার বন্ধু ফ্রান্সিস স্পেনীয় ভাষায় দেবে। আমার বন্ধুটি গ্রীক ভাষা জানে না। এই বলে হ্যারি ফ্রান্সিসকে দেখাল। রাজা পিটার এবার স্পেনীয় ভাষায় ফ্রান্সিসকে বললেন–বলো–তোমার কী বলার আছে। ফ্রান্সিস বলতে লাগল–আমরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসি। কত মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাছাড়া কোথাও কোনোরকম গুপ্তধন গুপ্ত ঐশ্বর্যের সংবাদ পেলে আমরা তা উদ্ধার করি। সেইজন্যই এই অঞ্চলে আসা।

–এরকম গুপ্তধন উদ্ধার করতে পেরেছো? রাজা পিটার বললেন।হ্যারি বললেন– অনেক ধন-সম্পদ আমার এই বন্ধু উদ্ধার করেছে।

–গুপ্তধন উদ্ধার করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাও। এতে একরকম চুরি ডাকাতিই বলা যায়। রাজা পিটার বললেন। ফ্রান্সিস বললেন–আপনি এটুকু বিশ্বাস আমাদের করতে পারেন যে আমরা চোর ডাকাত নই। যত গুপ্তভাণ্ডার খুঁজে বের করেছি সবই যাদের প্রাপ্য তাদেরকেই দিয়েছি। নিজেরা একটা রুপোর মুদ্রাও নিইনি। হ্যারি বলল– আমার বন্ধু ফ্রান্সিস চিন্তা করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে গুপ্তসম্পদ উদ্ধার করেছে।

রাজা পিটার একটুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বললেন–আমাদের এই মাল্টাতেও একটা গুপ্তধন ভাণ্ডারের কথা আমরা জানি। সেই গুপ্তধন ভাণ্ডার আজ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেও কেউ উদ্ধার করতে পারেনি। তোমরা উদ্ধার করতে পারবে? ফ্রান্সিস বলল সব ঘটনা জেনে এবং কোথায় থাকতে পারে সেটা সেই জায়গায় গিয়ে জেনে তবেই বলতে পারবো সেই গুপ্তধনভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে কিনা। আপনি আগে ঘটনাটা বলুন।

একটু কেশে নিয়ে রাজা পিটার বলতে লাগলেন–খুব বেশিদিনের কথা নয়। বছর পঞ্চাশের আগে–এখান থেকে দক্ষিণদিকে আনজুনামে একটা জায়গা আছে। সেখানে ছিলেন চার্লস নামে একজন ভূস্বামী। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে চার্লস প্রচুর স্বর্ণমুদ্রা অলঙ্কারের অধিকারী হয়েছিলেন। সকলেই একথা জানতো কিন্তু কেউ কখনো চোখে দেখে নি। চার্লসের স্ত্রীও জানতেন না। তারা নিঃসন্তান ছিলেন। স্ত্রী আগেই মারা যান। চার্লস পিসায় গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি মারা যান। স্বর্ণমুদ্রা অলঙ্কার তিনি কোথায় রেখে গেছেন তাও তিনি কাউকে বলে যান নি।

–চার্লস কি কোনো সূত্র রেখে যান নি? ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

–না–কোনো সূত্র রেখে যান নি। নানাভাবে গত পঞ্চাশ বছর ধরেই খোঁজাখুঁজি চলছে। কেউ কোনো সূত্র বের করতে পারেনি। রাজা পিটার বললেন।

–তাহলে আমাকে একবার আনজু যেতে হবে। ঐ জায়গায় খোঁজখবর করে বলতে পিরবো চার্লসের ঐ ধনভাণ্ডার উদ্ধার করতে পারবো কি না। ফ্রান্সিস বলল।

-ঠিক আছে। এই ব্যাপারে তোমাদের আমি সমস্ত সুযোগ-সুবিধে করে দেব। দেখো–যদি উদ্ধার করতে পারো। রাজা পিটার বললেন।

এই সময় হ্যারি বলল–গ্রীক ভাষায় অভিজ্ঞ একজনকে আমাদের চাই রাজা পিটার তার কাছে-বসা একজন প্রৌঢ় ব্যক্তিতে দেখিয়ে বলল–ইনি সাজ্জিও–পাঁচটা ভাষা ইনি অনর্গল বলতে পারেন লিখতেও পারেন। সারা মাল্টাদ্বীপে সাজ্জিওর মতো ভাষাভিজ্ঞ বিদ্বান কেউ নেই। ফ্রান্সিস আর হ্যারি সাজ্জিওকে মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানাল। সাজ্জিও এতক্ষণ চুপ করে বিছানার একপাশে বসেছিলেন। এবার হেসে তিনিও একটু মাথা ঝোকালেন। ফ্রান্সিস বলল–প্রয়োজনে আমরা সাজ্জিওর সাহায্য নেব।

সাজ্জিও ফ্রান্সিসদের দেশীয় ভাষায় বললেন–আমি আনন্দের সঙ্গে আপনাদের সাহায্য করবো। ফ্রান্সিস আর হ্যারি অবাক। তারা আবার মাথা নুইয়ে সাজ্জিওকে সম্মান জানাল।

এবার ফ্রান্সিস রাজা পিটারকে বলল–আমার বন্ধুরা এখানে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। তাদের মুক্তি দিন এই আর্জি জানাচ্ছি।

রাজা পিটার বললেন–এসব পরে ভাববো। আগে চার্লসের গুপ্ত ধনসম্পদ উদ্ধার করো। তারপরে তোমার বন্ধুরা মুক্তি পাবে। রাজা বলেন।

–সমুদ্রতীরে আমাদের জাহাজ রয়েছে। সেখানে আমাদের দেশের রাজকুমারী রয়েছে। কিছু বন্ধুও সেই জাহাজে রয়েছে। তাদের কী ব্যবস্থা করবেন?

রাজা পিটার সেনাপতি মালোকে ইশারায় ডাকলেন। দু’জনে কী কথা হল। রাজা পিটার বললেন–তোমাদের রাজকন্যা ও বন্ধুদের জাহাজেই বন্দি করা হয়েছে।

ফ্রান্সিস বললেন–মান্যবর রাজা–আনগোভিনের হয়ে লড়াই করতে গিয়ে আমাদের দুই বন্ধু মারা গেছে, একজন আহত হয়েছে। এই যুদ্ধে আমরা ইচ্ছে করে জড়াই নি। অথচ দুই বন্ধুকে হারিয়েছি। তাই অনুরোধ ঐ জাহাজেই বন্দি করে রাখুন। এখানে উন্মুক্ত আকাশের নীচে থাকতে গিয়ে হয়তো আরো বন্ধুকে হারাবো। আপনি দয়া করে আমার বন্ধুদের ঐ জাহাজেই বন্দি করে রাখুন। এতে ওদের শারীরিক ক্ষতি হবে না।

-বুঝলাম–রাজা পিটার মাথা নেড়ে বললেন–কিন্তু তোমরা যারা ধনসম্পদ খুঁজবে তোমারা তো সুযোগ বুঝে বন্দি বন্ধুদের নিয়ে জাহাজ চালিয়ে পালাতেও পারো।

ফ্রান্সিস বুঝল–রাজা পিটারের মনের সন্দেহ কিছুতেই দূর করা যাবে না। ফ্রান্সিস বলল ঠিক আছে। আমার বন্ধুদের কয়েদঘরে রাখুন। মাথার ওপর একটা ঢাকা তো থাকবে।

–এবার যাতে আমরা আনজু যেতে পারি তার ব্যবস্থা হলে ভালো হয়। হ্যারি বলল। রাজা পিটার সেনাপতি মালোকে কাছে ডাকলেন ফ্রান্সিসদের সাহায্য করার কথা বললেন।

ফ্রান্সিস ও হ্যারি মাথা একটু নুইয়ে রাজা পিটারকে সম্মান জানিয়ে দুর্গের বাইরে এলো।

দুর্গের বাইরে এসে দেখল–একটা শস্যটানা ঘোড়ার গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সেনাপতি মান্দো গাড়ির কাছে দাঁড়িয়েছিল। ফ্রান্সিসরা কাছে আসতে বলল, এই গাড়োয়ান আপনাদের আনজু নিয়ে যাবে। চার্লস-এর বিরাট অট্টালিকা গীর্জা গ্রন্থাগার দেখতে পাবেন ওখানে।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি গাড়িতে উঠল। গাড়ি চলল আনজুর দিকে। পথের দুপাশে! গাছপালা টিলা ঝর্ণা।

হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস দেখো কী সুন্দর প্রকৃতি।

ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি–প্রকৃতি দেখার মতো মনের অবস্থা আমার নেই। অনেক চিন্তা মাথায়।

বিকেল নাগাদ ফ্রান্সিসরা আনজু পৌঁছল। দু’জনে উঠল গিয়ে এক সরাইখানায়। গাড়ির গাড়োয়ানকে সঙ্গে নিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল।

দু’জনে যখন চার্লস-এর অট্টালিকার সামনে এলো তখন সন্ধে হয় হয়। দেয়াল ঘেরা অট্টালিকা। দেয়ালের মধ্যে প্রধান প্রবেশ পথ। ফ্রান্সিসরা প্রবেশ পথের সামনে এসে দেখল দুজন পাহারাদার বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।ফ্রান্সিসরা একজন পাহারাদারকে বেশ কষ্ট করে বোঝাল যে ওরা চার্লস-এর অট্টালিকা গীর্জা দেখতে এসেছে। একথাও বলল যে ওরা বিদেশি।

প্রহরী একজন ফ্রান্সিসদের ইশারায় সঙ্গে আসতে বলল। ফ্রান্সিস হ্যারি প্রহরীর পেছনে পেছনে চলল। ঢুকেই বিরাট হলঘর। হলঘরের মাঝখানে শ্বেতপাথরের গোল টেবিল। চারপাশের দেয়ালে কয়েকজনের ছবি। বোঝা গেল চার্লস ও চার্লসের পূর্বপুরুষদের ছবি। প্রহরী ওদের নিয়ে হলঘরের কোণায় একটা পাথরের ঘরে ঢুকল। ফ্রান্সিসরা ঘরটায় ঢুকে দেখল একটা কালো কাঠের বাঁকা পায়াওয়ালা চেয়ারে বসে আছেন টাকমাথা একজন প্রৌঢ়। প্রহরী প্রৌঢ়কে কী বলল। প্রৌঢ়টি হেসে গ্রীক ভাষায়, বলল–মান্যবর চার্লসের এই অট্টালিকা গীর্জা গ্রন্থাগার এসব আমিই দেখাশুনো করি। আমার নাম গাইদা। হ্যারি ফ্রান্সিসকে কথাটা বুঝিয়ে বলল।

ফ্রান্সিস বলল–বলল যে আমরা চার্লসের গুপ্ত ধনভাণ্ডার খুঁজে বের করতে এসেছি। রাজা পিটার আমাদের অনুমতি দিয়েছেন।ওরা কথা বলছেতখনই ঘরে সাজ্জিও ঢুকলেন। হেসে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে সাজ্জিও বললেন–রাজা পিটার আপনাদের সাহায্য করবার জন্যে আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখা গেল গাইদা চেয়ার ছেড়ে উঠে সাজ্জিওকে সম্মান জানাল।

সাজ্জিও গাইদাকে বলল–আপনি আপনার কাজ করুন। আমিই এদের সব দেখাচ্ছি। তারপর ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে বললেন–চলুন–আমিই আপনাদের সব দেখাচ্ছি।

তিনজনে ঘর থেকে বেরিয়ে হলঘরে এলো। পাথরে তৈরি হলঘরে পাথরের গায়ে কুঁদে কুঁদে ফুল লতাপাতার কাজ করা। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির সামনে এসে সাজ্জিও বললেন–এই ছবিটা হচ্ছে মান্যবর চার্লসের ছবি। ফ্রান্সিসরা দেখল–এক প্রৌঢ়ের ছবি। সাধারণ পোশাক পরনে। মুখটা হাস্যোজ্জ্বল নয়। কেমন বিষাদময়।

ফ্রান্সিস বলল–সাজ্জিও–একটা কথা বলি।ছবিটা দেখে মাননীয় চার্লসকে কেমন বিষাদগ্রস্ত মনে হচ্ছে।

সাজ্জিও বললেন–ঠিকই ধরেছেন। এই ছবি আঁকার সময় চার্লসের এক পালিতা কন্যা মারা গিয়েছিল। তারপরই চার্লস তার জাঁকজমকের জীবন ত্যাগ করে প্রায় সাধুর জীবন কাটাতে লাগলেন। একটা গীর্জাঘর তৈরি করালেন। সেই গীর্জাতেই তিনি যীশুর আরাধনায় বেশিসময় কাটাতেন। গীর্জা চালাবার জন্যে একজন ধর্মযাজককে আনতে জেনিভা গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁর শেষ ইচ্ছামতো এই গীর্জার প্রাঙ্গণেই তাকে সমাহিত করা হয়।

-মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর ধনসম্পদের কথা কাউকে বলে যাননি এটাই শুনেছি। ফ্রান্সিস বলল।

–হ্যাঁ–এটা রহস্যময়ই থেকে গেল। তার মৃত্যুর পর অনেকেই তার ধনসম্পদ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউ সেই বিপুল ধনসম্পদের হদিস করতে পারে নি। সাজ্জিও বললেন।

মনে হয় ভালো করে খুঁজলে কোনোনা কোনো সূত্র পাওয়া যেতই। হ্যারি বলল।

এবার সাজ্জিও হেসে বললেন–তাহলে সত্যি কথাটা বলি। প্রায় এক বছর ধরে মান্যবর চার্লসের অট্টালিকা গ্রন্থাগার গীর্জা আমি তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কিন্তু কোনো সূত্র পাই নি।

ফ্রান্সিস বলল–তাহলে তো আপনি অনেক কিছুই জানেন।

–তা কিছু তো জানিই। যেমন গ্রন্থাগারে রক্ষিত সমস্ত গ্রন্থ আমি পড়েছি। বাসস্থান অট্টালিকা গীর্জা সব জায়গা খুঁজেছি। কিন্তু সবই ব্যর্থ। সাজ্জিও বলল।

–এই খোঁজাখুঁজি কি নিজের ইচ্ছেয় করেছেন? হ্যারি বলল।

-না–মান্যবর চার্লসের ধনসম্পদের ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। রাজা পিটারের নির্দেশেই আমাকে খোঁজাখুঁজি করতে হয়েছিল। রাজা পিটার বলেছিলেন মান্যবর চার্লসের গ্রন্থাগারের গ্রন্থগুলো সব পড়ে যদি কোনো সূত্র আমি পাই সে জন্যেই আমাকে খুঁজতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

–আপনি কোনো সূত্রই পান নি। হ্যারি বলল।

–না–কিচ্ছু না। সাজ্জিও বললেন।

কথা বলতে বলতে তিনজনে চার্লসের গ্রন্থাগারে এলো। পাথরে তৈরি গ্রন্থাগারটি বেশি বড় না। গ্রন্থাগারের প্রহরী সাজ্জিওকে দেখে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল।

গ্রন্থাগারে ঢুকল তিনজনে। প্রহরী একটা মোটা হলুদ রঙের মোমবাতি জ্বেলে দিয়ে গেল। ফ্রান্সিসরা দেখলকাঠের পাটাতনের ওপর চামড়া বাঁধানো গ্রন্থ রাখা। গ্রন্থ বেশি নেই। সব মিলিয়ে আট-দশটা হবে।

হ্যারি বলল–সাজ্জিওগ্রন্থগুলো সবই কি গ্রীক ভাষায় লেখা।

–না– আরবী ভাষায়ও আছে। লাতিন ভাষায়ও আছে। সাজ্জিও বললেন।

–গ্রন্থগুলো কী বিষয় নিয়ে লেখা? হ্যারি বলল।

নানা বিষয়ে–অঙ্ক জ্যোতিষ মানুষের জীবনমৃত্যু এরকম বিভিন্ন বিষয়ে লেখা। সাজ্জিও বললেন। হ্যারি কয়েকটা গ্রন্থের পাতা উল্টে দেখল। আরবী আর গ্রীক ভাষায় লেখা।

হ্যারি বলল–গ্রন্থগুলো থেকে চার্লসের ধনসম্পদের কোনো হদিশ পান নি?

না–তবে পুরোনো গ্রীক ভাষায় লেখা একটা বাইবেল পেয়েছি। গ্রন্থটার নানা রকম জায়গায় দাগ দেওয়া। বোঝা যায় যে মান্যবর চার্লস খুব মনোযোগ দিয়ে ঐ বাইবেলটা পড়তেন। সাজ্জিও বললেন। ফ্রান্সিস গ্রন্থাগারটা ঘুরে দেখল। সাধারণ পাথরের ঘর। মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে এমন কিছু নেই।

–চলুন–গীর্জাটা দেখবেন। সাজ্জিও বললেন।

গীর্জাটা একটু দূরে। গীর্জাটা পাথরের। তবে চূড়োটা কাঠের। তাতে ফুল পাতার কাজ।

তিনজনে গীর্জায় ঢুকল। ঢুকেই ফ্রান্সিস আর হ্যারি অবাক হয়ে গেল। দেখল মানুষের মতোই যীশুর মূর্তি। এত বড়ো ধীশুর মূর্তি ওরা কখনো দেখেনি। ওক কাঠ কুঁদে কুঁদে মূর্তিটা তৈরি করা হয়েছে। ক্রুশে বিদ্ধ যীশুর মূর্তি। এত সজীব মূর্তি বড়ো একটা দেখা যায় না। ক্রুশের গায়ে হাত পা পেরেকে বিদ্ধ। মাথায় কাঁটার মুকুট।

মুখটা একটু ঝুঁকে পড়েছে। ফ্রান্সিস আর হ্যারি দু’জনেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।

সাজ্জিও বললেন–মূর্তিটা দেখে একটু অবাক হয়েছেন–তাই না।

–হ্যাঁ–সত্যি এত বড়ো আর এত সজীব মূর্তি আমরা কখনো দেখিনি। হ্যারি বলল।

–মান্যবর চার্লসের নির্দেশেই এই মূর্তি নির্মিত হয়েছে। তিনি শুধু খ্রীস্ট ভক্তই ছিলেন না। তার শিল্পবোধেরও প্রশংসা করতে হয়। সাজ্জিও বললেন।

তিনজনে বেদীর সামনে এসে দাঁড়াল। সাজ্জিও বললেন–কাঠের বেদীতে কত কারুকাজ দেখুন। সত্যিইফ্রান্সিসরা দেখে অবাক হল কত সূক্ষ্ম কাজ কাঠের বেদীটাতে। কাঠ কুঁদে কুঁদে তোলা হয়েছে নকশা। ফুল লতাপাতা দেখি। কাঠের মধ্যে এমন সূক্ষ্ম কাজ খুব কমই দেখা যায়।

হঠাই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল–ফুল পাখি লতাপাতা যেখানে শেষ হয়েছে তার নীচে বাঁদিকে আর ডানদিকে কিছু যেন কথা কুঁদে তোলা। ফ্রান্সিস বলল–সাজ্জিও লক্ষ্য করেছেন বোধহয় নীচের দিকে কিছু লেখা আছে।

আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা বাইবেলের ‘নিউ টেস্টামেন্ট থেকে দুটো উদ্ধৃতি। সাজ্জিও বললেন।

–উদ্ধৃতি দুটো কী? হ্যারি জানতে চাইল।

সাজ্জিও বললেন–

-বাঁ দিকের উদ্ধৃতিটি হচ্ছে–”দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনারূপে ক্রুশ বহন যে না করে সে আমার অনুগামী হতে পারে না।”

ডানদিকে আছে–”জীবনটা কেবল খাওয়াপরা নয় তার থেকে আরো অনেক বেশি।”

ফ্রান্সিসরা বুঝল বড়ো গভীর অর্থময় উদ্ধৃতি দুটি। চার্লস সত্যিই একজন চিন্তাশীল মানুষ ছিলেন। শুধু খ্রীস্টভক্তই ছিলেন না।

ওদিকে দুর্গের চত্বরে বন্দি শাঙ্কো বিস্কোরা ভাবছে কী করে ওখান থেকে পালানো যায়। পালিয়ে ওদের জাহাজে যাবে। বরং জাহাজেই বন্দি হয়ে থাকবে। এখানে এই উন্মুক্ত আকাশের নীচে এভাবে দিনের পর দিন থাকা চলে না। কিন্তু পালাবে ভাবলেই তো হবে না। কীভাবে পালাবে সেটাই আগে ভাবতে হবে। শাঙ্কো বিস্কোর সঙ্গে এই নিয়ে মৃদুস্বরে কথা বলছিল। শাঙ্কো বিপদ আঁচ করলেই যা করে এবারও তাই করেছে। কোমর থেকে বড়ো ছুরিটা বের করে ঢোলা জামার মধ্যে ছুরিটা ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে। প্রয়োজনের সময় বের করবে।

শাঙ্কো তাই বলল–দেখো হাতে দড়ি কেটে ফেলা যাবে। কিন্তু দুর্গের দেয়াল ডিঙোবে কী করে? পাহারাদার সৈন্যরা তো ঘোরাফেরা করছে। ওদের একটাকে ঘায়েল করে তলোয়ার ছিনিয়ে আনা যায়। কিন্তু এত সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই–অসম্ভব।

–দেখা যাক–রাতের খাবার দেবার সময় কতজন সৈন্য থাকে। বিস্কো বলল।

রাত হয়েছে তখন। চারজন পাহারাদার সৈন্য বন্দিদের খাবারদাবার জল নিয়ে এলো। হাত খোলা হবে না। সবার সামনে লম্বাটে পাতা পেতে দেওয়া হল। তাতে আধপোড়া। রুটি আর সবরকম আনাজপত্রের ঝোলমতো দেওয়া হল। সঙ্গে একটা করে মুরগির সেদ্ধ ডিম। হাত বাঁধা অবস্থাতেই সবাই খেতে লাগল। শাঙ্কো বিস্কো দু’জনেরই মনে পড়ল এরকম বন্দি অবস্থায় ফ্রান্সিসের উপদেশ–পেট পুরে খাও–খেতে ভালো না লাগলেও খাও। দুজনেই পেট পুরে খেল। একজন পাহারাদার কাঠের জালামতো জায়গায় জল নিয়ে এসেছিল। সে সবাইকে জল খাওয়াতে লাগল। শাঙ্কো সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখল। মশালের আলোয় দেখল বেশ কিছুটা দূরে সদর দেউড়িতে এখন সৈন্য সংখ্যা কম। যারা খাবার দিতে এসেছিল তারা খাবারের বড়ো বড়ো কাঠের এঁটো পাত্রগুলো নিয়ে চলে গেল। রইল শুধু যে পাহারাদারটি জল দিচ্ছিল–সে একা।

শাঙ্কো ফিস ফিস করে ডাকল–বিস্কো। বিস্কো ওর দিকে তাকাল। শাঙ্কো মাথা নিচু করে বলল–আমার পোশাকের মধ্যে থেকে ছোরাটা বের করো। বিস্কো সঙ্গে সঙ্গে শাঙ্কোর ঢোলা গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছোরাটা তুলে আনল। তারপর নিজের দড়িবাঁধা দু’হাত দিয়ে ছোরাটা ধরে শাঙ্কোর হাতের দড়ি কাটতে লাগল। ছোরার খোঁচা লেগে শাঙ্কোর হাতের কয়েকটা জায়গা কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। জ্বালা করতে লাগল। শাঙ্কো মুখ বুজে সহ্য করল। ছোরার ঘষা লেগে একসময় দড়িটা কেটে গেল। খোলা হাতে শাঙ্কো ছোরাটা নিয়ে বিস্কোর হাতের দড়ি কেটে ফেলল। এবার বিস্কো বাকি বন্ধুদে হাতের দড়ি কাটতে লাগল। জল দিচ্ছিল যে পাহাদারটা সে তখন জলের পাত্র নিয়ে চলে যাচ্ছে।

শাঙ্কো তখন বিস্কোকে ছোরাটা দিল। তখন সৈন্যটি ওদের সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। বিস্কো অন্ধকারে এক লাফে সৈন্যটার কাঁধে ঝুলে পড়ল। পেছন থেকে ছেঁড়া দড়িটা দিয়ে সৈন্যটার গলায় ফাঁসমতো পরাল। তারপর দড়ি টানল। পাহারাদারটি টাল খেয়ে পাথর বাঁধানো চত্বরে পড়ে গেল। অজ্ঞান হয়ে গেল। শাঙ্কো কিছুক্ষণ চাপাগলায় বলল ছোরাটা দাও। আমার সঙ্গে এসো।

দু’জনে হামাগুলি দিয়ে পাথরের দেওয়ালের দিকে চলল। সদর দেউড়ির মশালের নি আলো এত দূর আসে নি। দেয়ালের নানা জায়গায় খোঁদলে মশাল জ্বলছে। শাঙ্কো হামাগুড়ি দিয়ে অমনি একটা জ্বলন্ত মশালের কাছে এলো। বিস্কোও এলো। দুজনেই ভীষণ হাঁপাচ্ছে তখন। শাঙ্কো একবার দুর্গের দেউড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে মশালটা নিয়েই দেওয়ালের গায়ে চেপে ধরল। ধোঁয়া বেরোল। মশালটা নিভেও গেল, এবার শাঙ্কো ফিস ফিস করে বিস্কোকে ডেকে বলল–বিস্কো এসোতোমার কাঁধে উঠে আমি দেয়াল ডিঙোবো।

–পারবে? বিস্কো বলল।

–পিরবো। মশাল রাখার আর একটা খোঁদল রয়েছে ওপরে। শিগগিরি এসো। শাঙ্কো বলল। বিস্কো এগিয়ে এসে দেয়াল ঘেঁষে বসল। শাঙ্কো ওর দুকাঁধে দু’পা রেখে দাঁড়াল। দেয়াল ধরে ধরে বিস্কো আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দেয়ালের মাথায় শাঙ্কো পৌঁছাতে পারল না। তখনও হাত তিনেক বাকি। শাঙ্কো অন্ধকারে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল মশাল রাখার খোদলটা একটু উঁচুতে ডানদিকে রয়েছে। শাঙ্কো দেয়ালে শরীর চেপে খোঁদলটায় ডান পা-টা রাখল। তখন শাঙ্কো ভীষণ হাঁপাচ্ছে। নাক মুখ দিয়ে একসঙ্গে শ্বাস টানছে। দেয়ালে শরীর চেপে খোঁদলে পায়ের চাপ দিয়ে আস্তে আস্তে শাঙ্কো চেপে দেয়ালের মাথায় উঠে বসল। বিস্কো চাপা গলায় বলল-সাবাস্ শাঙ্কো। হাঁপানির ঠ্যালায় তখন শাঙ্কো কথাও বলতে পারছে না। অবশ্য এখন কথা বলার সময়ও নয়। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–বিস্কো–দেয়ালের ওপাশে এটা ন্যাড়াগাছ দেখেছি আমি। আমি ঐ গাছ বেয়ে বেয়ে নেমে যাবো। আমাদের জাহাজে যাবো। মোটা দড়ি নিয়ে আসবো। ঐ গাছটায় বেঁধে দেয়ালের এপাশে দড়ির অন্য মাথাটা ফেলে দেবো। তোমরা দড়ি বেয়ে বেয়ে দেয়াল ডিঙোবে। তোমরা একজন একজন করে যখন এপাশে দড়ি ধরে নামতে থাকবে তখন দেয়ালের ওপাশে অন্যেরা দড়িটা টান ধরে ধরে রাখবে। তাহলেই এপারে সহজে নেমে যাবে।

শাঙ্কো এবার অন্ধকারে পা বাড়িয়ে ন্যাড়া গাছটার মগডালে শরীরের ভর রাখলো। তারপর শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাছটার কাণ্ড জড়িয়ে ধরল। দেখল–দুর্গের দেউড়িতে অনেক মশাল জ্বলছে কিন্তু সৈনসংখ্যা কম।

শাঙ্কো আস্তে আস্তে গাছটার ডাল ধরে ধরে কাণ্ড বেয়ে মাটিতে নেমে এলো। তারপর অন্ধকারেই পাথর ভরা পথটায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। হাঁপানি তখন ছেড়ে গেছে।

কিছুক্ষণ এমনি করে শুয়ে থাকায় হাঁপানি একটু কমল। এবার শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। ঐ হাঁপধরা অবস্থায় যতটা দ্রুত সম্ভব চলল ওদের জাহাজ যেখানে আছে সেই তীরভূমির দিকে।

যেখানে জাহাজটা ছিল সেখানে শাঙ্কো এলো। জাহাজের কাছাকাছি আসতেই দেখল জাহাজ থেকে তীরভূমিতে পাতা কাঠের পাটাতনটা তুলে ফেলা হয়েছে। জাহাজের ডেক-এ একদল সশস্ত্র সৈন্য। দেখেই বুঝল ওরা রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্য। মুস্কিল হল। সোজা পথে দড়ি জোগাড় করা যাবে না। শাঙ্কো তাই ঠিক করল নোঙরের দড়িটাই নেবে।

শাঙ্কো জলের ধারে এলো। আস্তে আস্তে জলে নেমে নিঃশব্দে জল ঠেলে চলল। জাহাজের সামনের দিকে অন্ধকারে এগিয়ে এবার নোঙরের কাছিটা ধরে ডুব দিল। অনেকটা নীচে নেমে ছোরাটা কোমর থেকে খুলল। তারপর ছোরা চেপে ধরে কাছিটা পোচ দিয়ে কেটে ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে জলের ওপর ভেসে উঠল। এরপর জলের ওপরে কাছিটা কেটে ফেলল। এবার কাছিটা বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে নিঃশব্দে সাঁতরাতে সাঁতরাতে তীরে উঠে এলো। পেছনে তাকিয়ে দেখল ওদের জাহাজটা তো এখন নোঙরহীন। হাওয়ার ধাক্কায় আস্তে আস্তে ভেসে চলেছে। জাহাজে বাড়তি নোঙর থেকে যে বন্ধুরা জাহাজে বন্দি আছে তারাই নতুন নোঙর লাগাবে। এখন দুর্গ থেকে বন্ধুদের মুক্ত করাই আসল কাজ। নোঙর থেকে কাটা কাছিটা গোল করে পেঁচিয়ে নিয়ে শাঙ্কো অন্ধকারে চলল দুর্গের দিকে।

দুর্গের দেয়ালের কাছাকাছি গাছটার ওপর উঠল। গাছটার মাঝামাঝি কাণ্ডটার সঙ্গে কাছির একটা মুখ ভালো করে গেরো দিয়ে বাঁধল। গাছ থেকে নেমে এলো। কাছির অন্য মুখটায় একটা পাথর বাঁধল। এবার সেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়ালের ওপর দিয়ে দুর্গের ভেতরে ছুঁড়ে দিল। শাঙ্কোর ভাগ্য ভাল। পাথরটা ভেতরের চত্বরে বন্দি কারো মাথায় পড়ল না। পড়ল চত্বরের ওপর। শব্দ হল। তবে খুব জোর শব্দ নয়। বিস্কো অন্ধকারে শব্দটা লক্ষ্য করে এগিয়ে এলো। পাথর বাঁধা কাছিটা দেখল। বুঝল শাঙ্কোই ছুঁড়েছে দড়ির মুখটা। বিস্কো বন্ধুদের ফিস ফিস করে বলল–শাঙ্কো কাছি ঝুলিয়ে দিয়েছে। একে একে পালাও। বন্ধুদের একজন কাছিটার কাছে এলো। কাছিটা টেনে দেখে বুঝল কাছিটা দেয়ালের ওপাশের গাছটার সঙ্গে বেশ শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। বন্ধু যখন দেয়ালের কাছে গিয়ে কাছি দিয়ে বেয়ে উঠছে নীচে বিস্কো ওরা কয়েকজন কাছিটা টান টান করে টেনে ধরে রাখল। বন্ধুটি দেয়ালের মাথায় বসল। তারপর টান টান কাছিটা ধরে ধরে এগিয়ে গেল। শাঙ্কো এসে বন্ধুটিকে জড়িয়ে ধরল। মুক্তি।

এবার বিস্কো সব বন্ধুকে একে একে দেয়ালের ওপাশে পার করে দিল। তারপর আনগেভিনের সৈন্যরা কাছি টেনে ধরে বিস্কোকে পার করাল। এরপর নিজেরা দেয়ালে উঠে পার হতে লাগল।

বিস্কো দেয়ালের ওপর উঠে দেখেছিল দেউড়ির দিকে তাকিয়ে। সৈন্যরা দু’তিনজন জেগে আছে। তবে পাহারা দিচ্ছে না। গল্পগুজব করছে। মশাল জ্বলছে। এদিকে কারো দৃষ্টি নেই।

বিস্কো পার হতেই ভাইকিংরা এবার ছুটল জাহাজ যে দিকে বাঁধা আছে সেদিকে। অন্ধকারে ছুটে চলল সবাই।

সমুদ্রতীরে পৌঁছে দেখল নোঙরহীন ওদের জাহাজটা বেশ দূরে ভেসে গেছে।শাঙ্কো বলে উঠল–সবাই সাঁতরে চলো। সমুদ্রের সঙ্গে ভাইকিংদের নাড়ির টান। ওদের কাছে এই দূরত্বটুকু সাঁতরে যাওয়া কিছুই না।

আস্তে আস্তে জলে নামল সবাই। শাঙ্কোর হুঁশিয়ারি শোনা গেল–কোনো শব্দ নয়। ভাইকিংরা নিঃশব্দে সাঁতরে চলল ওদের জাহাজের দিকে।

জাহাজের কাছাকাছি এসে বিস্কো একটু গলা চড়িয়ে বলল–আমরা রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করবো। না। ওদের ধরে ধরে জলে ফেলে দেব।

জাহাজের হালের কাছে এসে জড়ো হল সবাই। হালের খাঁজে খাঁজে পা রেখে রেখে প্রথমে শাঙ্কো উঠল। ডেক-এ নেমে এলো না। হালের পাশে অপেক্ষা করতে লাগল। আস্তে আস্তে প্রায় সবাই উঠে এল। দেখল ডেক-এ চার পাঁচজন রাজা পিটারের সৈন্য ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। তবে তলোয়ার কোমরে গোঁজা।

মুহূর্তে শাঙ্কো ছুটে এসে একজন পাহারাদার সৈন্যকে রেঙিলের দিকে ঠেলে নিয়ে এক ধাক্কায় জলে ফেলে দিল। শাঙ্কোর দেখাদেখি আর সবাইও তখন। ছুটে এসে বাকি পাহারাদার সৈন্যদের ঠেলে জলে ফেলে দিল।

এতে একটু হৈ চৈ হল। নীচের কেবিনঘরের অস্ত্রঘরের পাহারাদার সৈন্যরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরের ডেক-এ উঠে এলো। তাদেরও একই দশা হল। শুধু একজন পাহারাদার সৈন্য তলোয়ার চালিয়ে শাঙ্কোর কাঁধে ঘা মারতে পেরেছিল। শাঙ্কো আঘাতের কষ্টের মধ্যেও বলে উঠল–ওকে মেরো নাজলে ফেলে দাও। সবাই তাই করল। ওকে দোলাতে দোলাতে জলে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

এ সময় নীচের কেবিনঘর থেকে বাকি বন্ধুরা উঠে এলো ডেক-এ। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। মারিয়া ডেক-এ উঠে এলো। ওর আশা ছিল হয় তো ফ্রান্সিস হ্যারিও মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু দেখল মুক্ত ভাইকিংদের মধ্যে ফ্রান্সিস আর হ্যারি নেই।

ওদিন ভেন শাঙ্কোর চিকিৎসা করতে লাগল। মারিয়াও শাঙ্কোর শুশ্রূষায় লেগে পড়ল। বিস্কো শাঙ্কোর কেবিনঘরে এলো। দেখল–শাঙ্কোর কাঁধ থেকে রক্ত পড়া বন্ধ। হয়েছে। শাঙ্কো এখন অনেকটা ভালো। ভেন আর মারিয়া শাঙ্কোর পাশে বসে আছে।

বিস্কো বলল–শাঙ্কো তুমি যেভাবে আমাদের মুক্ত করলে তা প্রশংসনীয়। শাঙ্কো হেসে বলল–এসবই আমার ফ্রান্সিসের কাছ থেকে শেখা। ফ্রান্সিস বলে–বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হয়। কার্যকরী কোনো পন্থা বের করতে হয়, তারপর সেটা কাজে লাগাও।

–ঠিক তাই–বিস্কো বলল–কিন্তু আমি ভাবছি পালিয়ে তো এলাম এবার ফ্রান্সিস আর হ্যারির না কোনো বিপদ হয়। মারিয়া বলল–বিপদ আর কী হতে পারে। বড়ো জোর ওদের দুজনকে বন্দি করে রাখতে পারে। তবে দু’জন তো, ফ্রান্সিস ঠিক হ্যারিকে নিয়ে পালাতে পারবে। ওদের জন্য ভেবো না। এখন আমরা কী করবো সেকথা ভাবো। শাঙ্কো বলল–আমি নোঙরের কাছি কেটে নিয়ে গেছি। আমাদের জাহাজ এখন নোঙরহীন। বিস্কো বলল–নতুন নোঙর কাছির ব্যবস্থা করা যাবে। কিন্তু আমাদের জাহাজটা কোথায় রাখবো? শাঙ্কো বলল–বেশ কিছুটা পুবে সমুদ্রতীরে চলো। দেখা যাক–জাহাজ লুকিয়ে রাখার কোনো জায়গা পাই কিনা।

বিস্কো বলল–ভোর হবার আগেই আমাদের এই তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে। রাজা পিটারের জাহাজগুলো থেকে বেশ দূরে। আমাদের জাহাজ যেন ওরা দেখতে না পায়। ওরা সকালেই জেনে যাবে যে আমরা পালিয়েছি। আমরা যেসব পাহারাদারকে জলে ফেলে দিয়েছি তাদের কাছেও আমাদের জাহাজের খবর পাবে তখন আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করে কামানের গোলা ছুঁড়লেই আমরা বিপদে পড়ে যাবো। কাজেই এক্ষুণি এই তল্লাট ছেড়ে পালাতে হবে। বন্ধুদেরও এই কথা বলেছি। বিস্কো এবার ডেক-এ উঠে এলো। বন্ধুদের ডেকে-এর কাছে আসতে বলল। তারপর বলল–এক্ষুণি একদল দাঁড়ঘরে চলে যাও। আমাদের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা ছেড়ে পালাতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে একদল ভাইকিং দাঁড়ঘরে চলে গেল। অন্যদল পাল খুলে দিতে চলল। এবার বিস্কো জাহাজচালক ফ্লেজারকে বলল–জাহাজ পূর্বদিকে চালাও। ফ্লেজার হুইল ঘোরাল। বিস্কো পেড্রোকে বলল–তোমার জায়গায় উঠে যাও। লক্ষ্য রাখো তীরে কোনো ঘন জঙ্গলঘেরা জায়গা পাও কিনা। পেলেই বলবে। পেড্রো মাস্তুল বেয়ে নিজের নজরদারির জায়গায় চলে গেল।

জাহাজ পুবমুখো চলল। বেশ দ্রুতই চলল।

রাত শেষ হয়ে এলো। পুবদিকের আকাশ লাল হয়ে উঠল। সূর্য উঠতে দেরি নেই। পেড্রে মাস্তুলের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলল–তীরে একটা জংলা জায়গা দেখা যাচ্ছে। রেলিং ধরে বিস্কো আর মারিয়া দাঁড়িয়ে আছে। বিস্কো দেখল ওখানে একটা খাঁড়ি মতো। অনায়াসে জাহাজ খাঁড়িতে ঢোকানো যাবে।খাঁড়ির দুপাশে গভীর জঙ্গল। বাইরে থেকে জাহাজটাকে দেখা যাবে না।

বিস্কো গিয়ে ফ্লেজারকে বলল–জাহাজ খাঁড়িটায় ঢুকিয়ে দাও। ওখানেই থাকবে জাহাজটা। ওখানেই আমরা ফ্রান্সিস আর হ্যারির জন্যে অপেক্ষা করবো।

জাহাজটা বেশ দ্রুতই খাঁড়িটায় ঢুকে পড়ল। তখনই সূর্য উঠল। ভোরের নিস্তেজ আলো ছড়ালো সমুদ্রের জলে। জঙ্গলটার মাথায়।

শাঙ্কোরা সারাদিন শুয়ে বসে কাটাল।

বিকেলে শাঙ্কো ভাবল–কোথায় এলাম একটু দেখে আসি।

শাঙ্কো জাহাজের পাটাতন দুটোর কাছে এলো।একভাইকিং বন্ধুকে বলল-পাটাতনটা পাতবো চলো।

বন্ধুটি বলল–এসব জাংলা জায়গা। জাহাজ থেকে নামা কি ঠিক হবে?

–আরে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে আসবো। এখন তো আমাদের ফ্রান্সিস আর হ্যারির জন্যে প্রতীক্ষা করা ছাড়া কোনো কাজ নেই। এসো। শাঙ্কো বলল।

শাঙ্কো আর বন্ধুটি মিলে জাহাজ থেকে দুটো পাটাতন ফেলল। পাটাতন দুটো পড়ল তীরের ঝোঁপঝাড়ের ওপর। বন্ধুটি বলল–তোমার একা নামা ঠিক হবে না। চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাই।

শাঙ্কো আর বন্ধুটি পাতা পাটাতন দিয়ে তীরে ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে নামল। শাঙ্কো ঝোঁপঝাড় দু’হাতে সরিয়ে হেঁটে চলল। পেছনে বন্ধুটিও শাঙ্কোর দেখাদেখি ঝোঁপজঙ্গল দু’হাতে সরিয়ে সরিয়ে চলল।

কিছুক্ষণ হেঁটে এগোতেই দেখল এখানে ঝোঁপজঙ্গল কম। বিরাট বিরাট সব গাছ।

শাঙ্কো চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে তখনই নজরে পড়ল একটা পায়ে চলা পথ উত্তরদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেছে। শাঙ্কো আশ্চর্য হল। এরকম জায়গায় তাহলে লোকজন যাওয়া-আসা করে। শাঙ্কোর বন্ধুটিও তখন অবাক। বলল–শাঙ্কো, মনে হচ্ছে এখানে লোকবসতি আছে।

–ভাবছি রাস্তাটা ধরে যাবো কিনা। শাঙ্কো বলল। বন্ধুটি চারদিকেতাকিয়ে বলল শাঙ্কো–দেখো অন্ধকার নেমে আসছে। আর না এগিয়ে চলো জাহাজে ফিরে যাই।

“তুই একটা ভীতুর ডিম। তুই চলে যা। আমি একাই যাবো। শাঙ্কো বলল।

না-না। বন্ধুটি বলল-শাঙ্কো জীবনের ঝুঁকিনিও না। ফিরে চললা। বন্ধুটি শাঙ্কোকে বারবার সাবধান হতে বলল। কিন্তু শাঙ্কো কথা শুনলো না। পায়েচলা পথটা ধরে এগোতে লাগল। অগত্যা বন্ধুটিও শাঙ্কোর পেছনে পেছনে চলল। একটু এগোতেই জঙ্গল শুরু হল। জঙ্গল খুব ঘন নয়। ছাড়া ছাড়া গাছপালা।

সন্ধে হতে দেরি নেই।পাখপাখালি বাসায় ফিরেছে। পাখির ডাকে এলাকাটা ভরে উঠেছে।

কিছুটা এগিয়ে গেল দু’জনে। হঠাৎ শাঙ্কো দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েকটা গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল একটা পাথরের বাড়ি। বন্ধুটি বলল–শাঙ্কো কী হল? শাঙ্কো নিঃশব্দে আঙ্গুল তুলে পাথরের বাড়িটা দেখাল। বন্ধুটিও অবাক হল। এই জঙ্গলে পাথরের বাড়ি? শাঙ্কো বলল–তুমি এখানে থাকো। আমি আড়াল থেকে দেখে আসি এটা পোড়ো বাড়ি না লোকজন থাকে। বন্ধুটি দাঁড়িয়ে রইল।

শাঙ্কো গাছপালার আড়ালে আড়ালে বাড়িটার কাছে গেল। কান পাতল। অস্পষ্ট কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। শাঙ্কো বুঝল বাড়িটায় লোজন আছে। এরা কারা? বাড়িটা পাথরের। মাথায় পাথরের ছাদ। দরজা জানালা ভাঙা। পাথরের কালচে দেয়াল এখানে ওখানে ধসে পড়েছে। একটা জানালা দিয়ে মশালের আলো দেখা যাচ্ছে।

আর একবার ভালো করে চারদিক দেখে নিয়ে শাঙ্কো বন্ধুর কাছে ফিরে এলো। বলল–যতটা পারলাম দেখলাম। এখানে কিছু লোক রয়েছে। তারা কারা বুঝতে পারলাম না। চলো–আর কিছু দেখার নেই।

দু’জনে ফিরে চলল। কিছুটা গিয়ে ওরা পায়েচলা পথ ছেড়ে ডানদিকের ঝোঁপঝাড়ে ঢুকল। গাছ ঝোঁপঝাড় পার হয়ে ওরা খাঁড়ির ধারে এলো। দেখল ওদের জাহাজটা বেশ কিছুটা উত্তরদিকে জলে ভাসছে।

দু’জনে তির ধরে ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তীরে এলো যেখানে ওদের জাহাজটা রয়েছে।

পাতা পাটাতনে দিয়ে দু’জনে যখন জাহাজে উঠল তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।

বিস্কো আর কয়েকজন ভাইকিং ছুটে এলো। বিস্কো বলল–শাঙ্কো তোমাদের জন্যে আমাদের খুব ভাবনা হয়েছিল। কোথায় গিয়েছিলে?

জাহাজ থেকে নেমে একটু ঘুরেফিরে দেখছিলাম। শাঙ্কো বলল।

কী দেখলে? শুধু ঝোঁপজঙ্গল? বিস্কো বলল।

–হ্যাঁ ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে একটা পাথরের বাড়ি। শাঙ্কো বলল।

-বলো কি? এই ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে বাড়ি? তবে পোড়ো বাড়ি থাকতেও পারে। বিস্কো বলল।

পোড়ো বাড়ি নয়। লোকজনও রয়েছে। শাঙ্কো বলল।

আশ্চর্য! কারা থাকে ওখানে? বিস্কো বলল।

–সেটাই তো বুঝতে পারলাম না। শাঙ্কো বলল।

বোধহয় চোর ডাকাতের দল। বিস্কো বলল।

“উঁহু-চোর ডাকাতরা অত গলা তুলে খোশগল্প করে না। শাঙ্কো বলল।

–কোন্ ভাষায় ওরা কথা বলছিল? একজন ভাইকিং জানতে চাইল?

–ওরা এখানে প্রচলিত গ্রীক ভাষাতেই কথা বলছিল। শাঙ্কো বলল।

–ভাগ্যিস তোমাদের ওরা দেখতে পায় নি। বিস্কো বলল।

–হ্যাঁ আমরা গাছের আড়াল থেকে সব দেখেশুনে দ্রুত চলে এসেছি।শাঙ্কো বলল।

–তাহলে ওরা কারা তা তো বোঝা গেল না।

–ওরা এই দেশেরই নোক এটা বোঝা গেল। এখন এরা আমাদের সম্পর্কে বা আমাদের জাহাজ সম্পর্কে কিছু জানে কিনা জানি না। এরা আমাদের শত্রু বা মিত্র তাও জানার উপায় নেই। শাঙ্কো বলল।

–ঠিক আছে। আমরা কিন্তু এই জায়গা ছেড়ে যাবো না। বিস্কো বলল।

দেখা যাক–আমাদের আবার কোনো বিপদ হয় কি না। শাঙ্কো বলল।

ভাইকিংদের রাতের খাওয়া শেষ হল। সবাই জাহাজের ডেক-এ কেবিনঘরে ঘুমিয়ে পড়ল। শাঙ্কো, জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি। লোকজন থাকে–ওখানে যারা থাকে তারা কারা। এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে শাঙ্কোর দু’চোখ ঘুমে জড়িয়ে এলো।

তখন শেষ রাত। চাঁদের ম্লান আলোয় দেখা গেল একদল সৈন্য তীরের ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াল। তারপর পাতা কাঠের পাটাতন দিয়ে হেঁটে ফ্রান্সিসদের জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। কোনোরকম শব্দ না করে চারজন সৈন্য সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে অস্ত্রঘরের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল যাতে ভাইকিংরা কেউ অস্ত্র হাতে না পায়।

এবার সৈন্যদের সর্দার ডেক-এ ঘুমিয়ে থাকা ভাইকিংদের ঘুম ভাঙাতে বলল। সৈন্যরা ভাইকিংদের একে একে তলোয়ারের খোঁচা দিয়ে জাগাতে লাগল। এই ভাইকিংদের মধ্যে শাঙ্কো ঘুমিয়ে ছিল। তরোয়ালের খোঁচায় ঘুম ভেঙে সৈন্যদের দেখল। সৈন্যদের মধ্যে সৈন্যদের সর্দারকেও দেখল। গালে চিবুকে সামান্য দাড়িওয়ালা সর্দারকে দেখেই চিনল। বুঝল এরা আনগেভিনের সৈন্য। এরাই যুদ্ধে হেরে এসে জঙ্গলের মধ্যে পাথরের বাড়িটায় আশ্রয় নিয়েছে।

শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। সর্দারের কাছে গেল। বলল–তুমিই তো আলগেভিনের সৈন্যদের সর্দার?

–তাহলে চিনতে পেরেছো। সদার হেসে বলল।

–হ্যাঁ–কিন্তু আমাদের এভাবে বন্দি করা হচ্ছে কেন? শাঙ্কো জানতে চাইল।

–কারণ আমরা তোমাদের সাহায্য চাই। সর্দার বলল।

–একবার তো লড়াইয়ের সময় সাহায্য করেছি। আবার কীসের সাহায্য? শাঙ্কো বলল।

–আমরা আমাদের জাহাজটা পিটারের সৈন্যদের হাত থেকে মুক্তি করে নিয়ে আসবো। সদার বলল।

–আমরা আর তোমাদের সাহায্য করবো না। এসব তোমাদের সমস্যা। তোমরা নিজেরাই মিটিয়ে নাও। আমরা এখন দেশের দিকে জাহাজ চালাবো। শাঙ্কো ক্রুদ্ধস্বরে বলে উঠল।

–না–আমাদের সঙ্গে যোগ দিন জাহাজ উদ্ধার করতে সাহায্য করতে। তারপর দেশে ফিরে যাবেন তার আগে নয়।

–আমরা তোমাদের সাহায্য করবো না। শাঙ্কো বলল।

–এটাই তোমাদের শেষ কথা? সর্দার বলল।

–হ্যাঁ–শাঙ্কো বলল।

–তাহলে তোমাদের বন্দি করে নিয়ে যাবো। আমাদের আস্তানায় তোমরা বন্দি থাকবে। সর্দার বলল।

–ঠিক আছে–আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে নিই।

বেশ। কথা বলো।

ততক্ষণে যারা জাহাজের কেবিনঘরে ছিল তাদেরও বন্দি করে আনা হয়েছে। সবাই ডেক-এর ধারে ধারে দাঁড়িয়ে আছে। সর্দারের সৈন্যরা সবাইকে খোলা তলোয়ার হাতে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। শুধু মারিয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।

শাঙ্কো বিস্কোকে ডাকল। বিস্কো কাছে এলো। শাঙ্কো সর্দারের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছে সব বলল। তারপর বলল–এখন কী করা যায়?

–আনগেভিনের জন্যে আমরা যুদ্ধ করতে যাবো কেন? বিস্কো বলল।

–তাহলে কি আমরা বন্দি হয়েই থাকবো? শাঙ্কো বলল।

–তাই থাকবো। বিস্কো বলল।

শাঙ্কো সর্দারের কাছে ফিরে এলো। বলল–আমরা বন্দি থাকবো।

–বেশ। সর্দার গলা চড়িয়ে বলল–সবাইকে হাত বেঁধে আমাদের আস্তানায় নিয়ে চলো।

–সবাইকে নয়। আমাদের দেশের রাজকুমারীকে এই জাহাজেই রাখতে হবে। বিস্কো বলল।

–না–সর্দার গলা চড়িয়ে বলল–সবাইকে আমাদের আস্তানায় বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

মারিয়া শাঙ্কোর কাছে এলো। বলল–আমাকে নিয়ে ভেবো না। আমি অনায়াসেই ওখানে থাকতে পারবো।

–বেশ। শাঙ্কো বলল।

তখন ভোর হয়েছে। জঙ্গলের পাখিগুলো ডাকতে শুরু করেছে। রোদ পড়ল সমুদ্রে জঙ্গলের মাথায়।

সর্দারের সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের জাহাজের মালখানা থেকে দড়ি জোগাড় করল। ছোটো ছোটো করে দড়ি কেটে নিয়ে ভাইকিংদের হাত বাঁধলো। শুধু মারিয়ার হাত বাঁধা হল না।

সবাইকে তক্তার ওপর দিয়ে হাঁটিয়ে তীরে আনা হল। ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সবাই চলল। সর্দারে সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিয়ে ভাইকিংদের নিয়ে চলল।

কিছুদূর এসে পায়েচলা পথটা দেখা গেল। সেই পথ দিয়ে উত্তরমুখে চলল সবাই।

যেতে যেতে শাঙ্কো বলল–ঐ পাথরের বাড়িটায় দরজা জানালা নেই। ওদের হাত বেঁধে রাখা হবে। ভাববার কিছু নেই। ছোরা দিয়ে দড়ি কেটে মুক্ত হওয়া যাবে। তারপর ভাঙা দরজা দিয়ে পালানো যাবে। নিজেদের জাহাজে ফিরে আসা যাবে। কারণ তখন কোনো পাহারাদার থাকবে না। আনগেভিনের সব সৈন্যই জাহাজ তখল করতে যাবে।

সবাই ভাঙা পাথরের বাড়ির সামনে এলো। বাড়িতে ঢুকল সবাই। শাঙ্কো তখন বুঝল ও বাড়িটা ছোটো ভেবেছিল। আসল বাড়িটা বেশ বড়ো।

সর্দার শাঙ্কোদের নিয়ে এলো একটা বেশ বড়ো ঘরের কাছে। শাঙ্কো দেখল ঘরটার কাঠের দরজা অটুট আছে। সর্দার দরজাটা খুলে দিল। শাঙ্কোদের ঢোকানো হল সেই ঘরটায়।

ঘরের ভেতর ঢুকে শাঙ্কো দেখল–ঘরটার কোনো জানালা নেই। ওপরে ঘুলঘুলিমতো। ওটা দিয়েই আলো হাওয়া আসছে।

শাঙ্কো হতাশ হল। এখান থেকে কী করে পালাবো? শাঙ্কো এবার বুঝতে পারল ফ্রান্সিস আর হ্যারি কাছে না থাকলে ওরা কতটা অসহায়।

বিছানা বলতে শুনো ঘাসপাতা মেঝেটায় বিছোনো। ভাইকিংরা কেউ বসল কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। রাতের ঘুমটা হয় নি। এখন ঘুমোনো যাবে।

কিছুক্ষণ পরে ঘরটার দরজা খুলে গেল। সর্দার ঢুকল। হেসে বলল–এখানকার এক মস্তবড়ো জমিদারের প্রাসাদ ছিল এটা। কোনো প্রজা জমিদারের বিরুদ্ধে গেলে খাজনা না দিতে পারলে এই ঘরে তাদের বন্দি করে রাখা হত। এটাকে কয়েদঘরও বলতে পারো।

–এসব শুনে আমাদের লাভ? বিস্কো বলল।

লাভ এই যে তোমরা এমন একটা ঘর থেকে কোনোদিনই পালাতে পারবে না–এটা জানানোর জন্যেই এত কথা বলা। সর্দার বলল।

-ঠিক আছে। আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করো। শাঙ্কো বলল।

-হা-হা সকালের খাবার তৈরি হচ্ছে। তোমাদের জাহাজ থেকে আটা ময়দা এসব আনা হয়েছে। একটু পরেই খেতে দেওয়া হবে। সর্দার বলল।

সর্দার এবার বলল–আমাদের জাহাজ উদ্ধারের কাজে তোমরা সাহায্য করতে পারতে। এই বন্দি দশা তোমরা ইচ্ছে করেই মেনে নিলে।

–ঠিক তাই–তোমাদের আমরা কোনোমতেই সাহায্য করবো না। তোমাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে গিয়ে আমরা বন্ধুকে হারিয়েছি। আর না। শাঙ্কো বলল।

সর্দার আর কোনো কথা না বলে চলে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সকালের খাবার দেওয়া হল। পোড়া পোড়া রুটি আর আনাজের ঝোল। শাঙ্কোরা তাই খেতে লাগল।

দু’জন সৈন্য একটা জলের পীপে এনে ঘরের কোণায় রাখল। খাবার খেয়ে জল খেল সবাই। সৈন্যরা চলে গেল। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

মারিয়া ঘরের এক কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছিল। এবার একটু গলা চড়িয়ে ডাকশাঙ্কো।শাঙ্কো তাড়াতাড়ি মারিয়ার কাছে এলো। বলল রাজকুমারী আপনার কি কষ্ট হচ্ছে।

না–আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না–মারিয়া বলল–আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না।

–কিছু বলবেন? শাঙ্কো জিজ্ঞেস করল।

–হ্যাঁ মারিয়া বলতে লাগল–এই আনগেভিনের সৈন্যদের সঙ্গে জাহাজ উদ্ধারে। সাহায্য করার জন্যে তুমি যেতে রাজি হলো না কেন?

–এই সৈন্যদের সর্দারকে বিশ্বাস করলে আমাদের বিপদই বাড়তে শুধু। ওদের যুদ্ধ জাহাজ দখল হলে ওরা প্রথমেই আমাদের হত্যা করতো। কারণ ওদের কাছে তখন আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। শাঙ্কো বলল।

–সেটা আমিও ভেবেছি। সেক্ষেত্রে লড়াই শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে সমুদ্রের পারে উঠবে। তারপর হেঁটে আমাদের জাহাজে গিয়ে উঠবে।মারিয়া বলল। একটু ভেবে নিয়ে শাঙ্কো বলল–আমরা লড়াইয়ে নামলে আবার হয়তো বন্ধুদের কাউকে না কাউকে হারাবো।

–জানি সেটা হতে পারে। কিন্তু যদি তোমরা আত্মরক্ষমূলক লড়াই করো তাহলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা কম। ওদিকে রাজা পিটারের পাহারাদার সৈন্য বেশি থাকবে না। জাহাজ পাহারার কাজে অল্প সৈন্যই থাকবে। তাদের হারিয়ে দেওয়া খুবই সহজ হবে। আনগেভিনের সৈন্যরা থাকবে তোমরা থাকবে লড়াইয়ে জেতা কঠিন হবে না। মারিয়া বলল।

–তাহলে এখন আমরা কী করবো? বিস্কো বলল।

–সর্দারকে ডেকে বল–আমরা তোমাদের সাহায্য করতে রাজি আছি।

–ঠিক আছে। শাঙ্কো উঠে দাঁড়াল। একটু গলা চড়িয়ে বলল–ভাইসব– আনগেভিনের সর্দার আমাদের সাহায্য চেয়েছে–আমরা সর্দারকে সাহায্য করবো। ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল। একজন ভাইকিং বলল–শাঙ্কো হঠাৎ মত পাল্টালে কেন?

–অনেক ভেবে চিন্তে দেখলাম–এখন এটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। শাঙ্কো বলল।

রাজকুমারী এই প্রস্তাবটা দিয়েছেন। বিস্কো বলল।

গুঞ্জন থেমে গেল। রাজকুমারী বলেছেন। কাজেই মেনে নিতেই হবে। আর কেউ কোনো কথা বলল না।

শাঙ্কো উঠে দরজার কাছে এলো। আঙ্গুল ঠুকে দরজায় শব্দ করল। শাঙ্কো বলল, তোমাদের সর্দারকে একবার আসতে বললো। খুব দরকার। দরজা বন্ধ হল।

কিছুক্ষণ পরেই সর্দার দরজা দিয়ে ঢুকল। শাঙ্কোদের কাছে এসে দাঁড়াল। হেসে বলল তোমরা কী বলতে চাও?

–আমরা আমাদের আগেকার মতো পাল্টেছি। আমরা জাহাজ উদ্ধারের কাজে তোমাদের সাহায্য করবো। শাঙ্কো বলল।

–এই তো একটা কাজের মত কাজ। তোমরা দুঃসাহসী তোমরা সঙ্গে থাকলে আমরা লড়াইয়ে জিতবই। সর্দার বলল।

কিন্তু শর্ত রইল লড়াই শেষ হলেই আমরা আমাদের জাহাজে ফিরে আসবো। শাঙ্কো বলল।

–বেশ। এতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সদার বলল।

–তোমরা জাহাজ উদ্ধার করতে কবে যাবে? বিস্কো জানতে চাইল।

–আজ রাতেই। সময়মতো তোমাদের ডেকে নিয়ে যাওয়া হবে।

–কিন্তু আমাদের অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে আমাদের জাহাজে। শাঙ্কো বলল।

“ঠিক আছে। তোমাদের মধ্যে কয়েকজন যাও। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এসো।

–তোমরা কীভাবে জাহাজ দখল করতে চাও? শাঙ্কো বলল।

–তোমাদের জাহাজটা নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু ভেবে দেখলাম জাহাজ নিয়ে গেলে ওরা সাবধান হয়ে যাবে। আমরা সমুদ্রের জলে সাঁতার কেটে যাবো। সর্দার বলল।

– তাহলে শিরস্ত্রাণ বর্ম পরে যাওয়া যাবে না। শাঙ্কো বলল।

–কেন বলো তো? সর্দার বলল।

–জলে অত ভারী জিনিস পরে সাঁতার কাটতে অসুবিধে হবে। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পরিশ্রান্ত হয় পড়বো।শত্রুপক্ষের জাহাজে উঠে লড়াই করবো কী করে? কাজেই শুধু তলোয়ার নিয়ে আমরা যাবো। শাঙ্কো বলল।

–ঠিকই বলেছো। একটুক্ষণ ভেবে সর্দার বলল।

–আমরা তৈরি থাকবো। তুমি ডাকলেই রওনা হবে। তার আগে আমাদের রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে পৌঁছে দাও। দু’জন বন্ধু সঙ্গে যাবে। তারা তিনজনেই আমাদের জাহাজে থাকবে। শাঙ্কো বলল।

–বেশ। তাহলে তৈরি থেকো। সর্দার বলল। তারপর একজন পাহারাওয়ালাকে হাতের ইশারায় ডেকে বলল–এদের ভালো ঘরটায় নিয়ে যাও। তারপর রাজকুমারী আর দু’জন বন্ধুকে তাদের জাহাজে রেখে এসো।

–বেশ। পাহারাদার শাঙ্কোদের দিকে এসে দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–সবাই ওঠো। তোমাদের অন্য ঘরে যেতে হবে। সর্দার তখন চলে গেছে।

ভাইকিংরা আস্তে আস্তে উঠেদাঁড়াল। পাহারাদার বলল-রাজকুমারী, এদিকে আসুন। মারিয়া এগিয়ে এলো। পাহারাদার বলল–যে দু’জন রাজকুমারীর সঙ্গে জাহাজে যাবে সেই দু’জনও এগিয়ে এসো। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–বিস্কো আর পেড্রো এগিয়ে এসো।

বিস্কো এগিয়ে এসে বলল–না শাঙ্কো–আমি লড়াইয়ে যাবো।

–পাগলামি করো না বিস্কো। তুমি রাজকুমারীর কাছে আমাদের জাহাজে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত মনে লড়াইয়ে যেতে পারবো। বিস্কো ভুলে যেও না আমরা এখনও বন্দি। বিস্কো আর কোনো কথা বলল না। পেড্রো এগিয়ে এলো। বিস্কোকে বলল–বিস্কো– রাজকুমারীকে ডাকো।

মারিয়াকে আর ডাকতে হল না। মারিয়া বিস্কোর কাছে এসে বলল–চলো।

বিস্কো মারিয়া আর পেড্রোকে নিয়ে কয়েদঘরের বাইরে এলো। সেই পাহারাদারটি দাঁড়িয়ে ছিল। পাহারাদার ওদের দেখে হাঁটতে শুরু করল। মারিয়া বিস্কো পেড্রো পাহারাদারদের পেছনে পেছনে চলল।

তখন দুপুর হয়েছে। পাহারাদার মারিয়াদের নিয়ে পায়েচলা পথটা ধরল। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে চলল।

একসময় পাহারাদার ডানদিকে ঘুরল। এখানে সেই পায়েচলা পথটা নেই। ঝোঁপঝাড় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ওরা চলল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা খাঁড়িটার সামনে এলো। দেখল ওদের জাহাজটা শান্ত ঢেউয়ের ধাক্কায় দুলছে।

পাটাতন পাতাই ছিল। মারিয়ারা পাটাতনের ওপর দিয়ে গিয়ে জাহাজে উঠল। পাহারাদারটি চলে গেল। ঝোঁপঝাড় গাছের মধ্যে ওকে আর দেখা গেল না।

মারিয়া জাহাজে উঠেই বলল–বিস্কো–আগে খাবারদাবারের ব্যবস্থা করো। খিদেয় পেট জ্বলছে। পেড্রো বলল–রাজকুমারী আপনি শুয়ে বসে বিশ্রাম করুন। আমিই রান্না চাপাচ্ছি।

–তুমি পারবে? মারিয়া বলল।

–আমার বেশিরভাগ সময়ই তো কাটে মাস্তুলের মাথায়। তবু একবার গন্ধ পেলে আমি ঠিক বলে দেব আজকে কী রান্না হচ্ছে। পেড্রো বলল।

তাই নাকি? মারিয়া এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও পেড্রোর এই গুণ শুনে হেসে ফেলল। পেড্রো হেসে বলল রাজকুমারী আপনি খুশির হাসি হাসলে আমরা যে কী খুশি হই তা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আপনার বিষণ্ণ চিন্তাকুল মুখ দেখলে আমরা সবচেয়ে বেশি দুঃখ পাই। কথাটা শুনে মারিয়া আবার হাসল।

–আপনি আপনার কেবিনঘরে গিয়ে বিশ্রাম করুন। কথাটা বলে পেড্রো চলল রসুইঘরের দিকে।

ওদিকে ভালো ঘরটায় এসে শাঙ্কোরা দেখল ঘরে শুকনো ঘাসপাতা দড়ি দিয়ে নিপুণভাবে বেঁধে বিছানামতো করা হয়েছে। তাতেই সৈন্যরা শুয়ে বসে আছে। ঘরটা বেশ বড়ো। ওপরে ছাদটা এখনও ভেঙে পড়েনি। অনেক খোলামেলা ঘর।

শাঙ্কোরা জায়গা করে নিয়ে বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল।

এখন কিছুই করার নেই। শুধু রাতের জন্যে প্রতীক্ষা।

রাত হল। রাতের খাওয়া তাড়াতাড়িই দেওয়া হল। এঘরে আসার সময় দু’জন পাহারাদার শাঙ্কোদের হাতে বাঁধা দড়ি কেটে দিয়েছিল। খোলা হাতেই শাঙ্কোরা রাতে খাবার খেয়ে নিল। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল। সর্দারের সৈন্যরা শাঙ্কোরা সবাই একে একে শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমুলো না কেউ।

রাত গম্ভীর হল।

তখনই সর্দার এলো। সবাই উঠে দাঁড়াল। সবাই সর্দারের নির্দেশে অস্ত্রঘরে চলল। সবাই তলোয়ার নিয়ে কোমরে গুজল। কাউকে বর্ম শিরস্ত্রাণ পরতে দেওয়া হল না। পাথরের বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এলো সবাই। পায়েচলা পথটা ধরে চলল।

চাঁদের আলো উজ্জ্বল নয়। বনজঙ্গলের মাথার ফাঁক দিয়ে জোছনা পড়েছে এখানে ওখানে। সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া আসছে। হাঁটতে হাঁটতে শাঙ্কো ওদের দেশীয় ভাষায় গলা চড়িয়ে বলল-এ লড়াই আমাদের লড়াই নয়। পাকেচক্রে এই লড়াইয়ে আমরা জড়িয়ে গেছি। আমরা কাউকে আগ বাড়িয়ে হত্যা করবো না। তবে জীবন বিপন্ন হলে আত্মরক্ষার জন্যে হত্যা করতেই হবে। আমরা যথাসাধ্য সাবধানে লড়াই করবো যাতে আমরা অক্ষত থাকতে পারি। অপরপক্ষ আমাদের শত্রু নয়। কাজেই জীবন বিপন্ন করে আমরা লড়তে যাবো কেন? আমাদের প্রথম এবং শেষ কথা আত্মরক্ষা। শাঙ্কোর কথা বুঝতে না পেরে সর্দার বলল তোমার বন্ধুদের কী বললে?

–এই কীভাবে লড়তে হবে। শত্রুপক্ষ বর্ম শিরস্ত্রাণ পরে লড়াই করবে। কাজেই সাবধানে লড়াই করতে হবে। এসব শাঙ্কো বলল।

–সে তো ঠিকই। সর্দার বলল।

সর্দারের সঙ্গে কথা হল না আর। সবাই নিশ্চুপ হেঁটে চলেছে ঝোঁপঝাড় জঙ্গলের মধ্য দিয়ে।

সমুদ্রের দিক থেকে জোর হাওয়া বইছে। সমুদ্রের শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল।

একসময় সমুদ্রের তীরে পৌঁছল সবাই। অল্প জোছনায় দেখল আনগেভিনের জাহাজটা বেশ দূরে সমুদ্রের জলে ভাসছে। কখনও কখনও কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে জাহাজটা।

সর্দার বলল–আমরা সমুদ্রের ধারে ধারে আরো কিছুদূর যাবো। যতটা সম্ভব জাহাজটার কাছাকাছি যাবো। তারপর জলে নেমে সাঁতরে গিয়ে জাহাজে উঠব।

এখানে সমুদ্রের সৈকতে ছোটো মাপের বালিয়াড়ি অনেক দূর চলে গেছে। সবাই উঁচু তির থেকে বালিয়াড়িতে নেমে এলো। চলল বালিয়াড়ি দিয়ে।

কারো মুখে কথা নেই। একটানা সমুদ্রের বাতাস শোঁ শোঁ শব্দ তুলে ছুটে আসছে।

একসময় ওরা জাহাজটার কাছাকাছি এলো।–সাঁতরে গিয়ে জাহাজে উঠতে হবে। সর্দার বলল–কোনো শব্দ যেন না হয়।

সর্দারের সৈন্যরা ভাইকিংরা জলে নামল। জলে কোনোরকম শব্দ না তুলে সবাই সাঁতরে চলল জাহাজটার দিকে।

দূরত্বটা খুব কম নয়। সর্দারের সৈন্যরা হাঁপিয়ে গেল। ভাইকিংরা সমুদ্রের সঙ্গে আজন্ম পরিচিত। সমুদ্রের জলে সাঁতার কাটা ওদের ছোটোবেলা থেকে অভ্যেস।

কয়েকটা নীলচে কুয়াশার আস্তরণ পার হয়ে শাঙ্কোরা সবার আগে জাহাজের কাছে পৌঁছল। দেখল–কেবিনে জানলার সিঁড়ির মাথায় একটা কাঁচে ঢাকা লণ্ঠন। জাহাজের আর কোথাও আলো নেই।

এবার জাহাজে উঠল। শাঙ্কো জাহাজের হালের কাছে এলো। দেখল কিছু দড়িদড়া ঝুলছে। শাঙ্কো হালের খাঁজে পা রেখে উঠে পড়ল। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় শাঙ্কো হাত দিয়ে ঝুলন্ত দড়িদড়া দেখাল।

এবার সবাই দড়ি ধরে ধরে জাহাজে উঠে পড়তে লাগল। হালের দিক থেকে সবাই ভেক-এর কাছে এলো। দেখল পনেরো কুড়িজন রাজা পিটারের সৈন্য ডেক-এ ঘুমিয়ে আছে।

সর্দার দু’তিনজন সৈন্যকে কানের কাছে বলল–সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামো। অস্ত্রঘরের সামনে গিয়ে পাহারা দাও যাতে কেউ অস্ত্র আনতে না পারে। সৈন্য ক’জন চলে গেল।

বোঝা গেল–এই জাহাজে বেশি পাহারাদার সৈন্য রাখা হয় নি।

সর্দার হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে বলে উঠল–সব কটাকে হত্যা করো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে ওদের দেশীয় ভাষায় বলে উঠল-কাউকে হত্যা করো না। জলে ছুঁড়ে ফেল।

রাজা পিটারের সৈন্যদের ঘুম ভেঙে গেল। ডেক-এ যারা ঘুমিয়েছিল তারা ঘুম ভেঙে উঠেদাঁড়াল। নিরস্ত্র তাদের ওপর সর্দারের সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যরা অসহায় অবস্থায় মারা যেতে লাগল। আর্ত চিৎকার গোঙানি শোনা যেতে লাগল।

শাঙ্কোরা ধরে ধরে কয়েকজন সৈন্যকে জলে ছুঁড়ে ফেলল।

রাজা পিটারের সৈন্যদের কয়েকজন সিঁড়ি বেয়ে অস্ত্রঘরের কাছে ছুটে এলো। দেখল সর্দারের সৈন্যরা অস্ত্রাগার পাহারা দিচ্ছে খোলা তলোয়ার হাতে। ওরা বুঝল যে প্রাণ সংশয়। তাড়াতাড়ি ওপরে ডেক-এ উঠে এলো। ততক্ষণে কেবিনঘর থেকে রাজা পিটারের সৈন্যরা ডেক-এ উঠে এলো। উঠেই পড়ল আক্রমণের মুখে। সর্দারের সৈন্যরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এলোপাথারি তলোয়ার চালাতে লাগল। রাজা পিটারের সৈন্যরা অসহায় অবস্থায় মারা যেতে লাগল।

ওদিকে ভাইকিংরা রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যদের ধরে ধরে জলে নিক্ষেপ করতে লাগল। যুদ্ধটা হল এক তরফা। নিরস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে সশস্ত্র সৈন্যদের লড়াই।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজা পিটারের সৈন্যরা হার স্বীকার করল। ওরা দু’হাত ওপরে তুলে ডেক-এর একপাশে দাঁড়াল।

সর্দার চিৎকার করে বলে উঠল–এইক’টাকে হত্যা করো। রাজা পিটারের সৈন্যদের মুখ শুকিয়ে গেল। ওরা বুঝল–আর বাঁচার আশা নেই।

তখনই শাঙ্কো এক লাফে রাজা পিটারের সৈন্যদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের নিষ্ঠুরতার নমুনা দেখেছি। এখন এই সৈন্যরা যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের হত্যা করতে চাও। আমরা তা হতে দেব না। যদি রাজা পিটারের নিরস্ত্র সৈন্যদের আক্রমণ করো তবে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবো। সাহস থাকে এগিয়ে এসো।

সর্দার বুঝল–আবার এক লড়াইয়ে নামতে হবে। তাতে বিপদই বাড়বে। জাহাজ দখল করতেই ওরা এসেছিল সেটা তো হয়ে গেছে। সর্দার বলল ঠিক আছে এদের কয়েদঘরে নিয়ে রাখো।

সর্দারের সৈন্যরা এগিয়ে এলো। রাজা পিটারের সৈন্যদের ঘিরে দাঁড়াল। তারপর নিয়ে চলল নীচে নামার সিঁড়ির দিকে। রাজা পিটারের যে সৈন্যরা বেঁচেছিল তাদের সবাইকে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হল।

এবার সর্দার আস্তে আস্তে শাঙ্কোদের কাছে এলো। দেখে বলল-তোমরা এই জাহাজেই থাকবে। আরো কিছু লোক জোগাড় করে সৈন্যসংখ্যা বাড়াবো। তারপর সেন্ট অ্যাঞ্জেলা দুর্গ অধিকার করবো। আনগেভিনকে মুক্ত করবো। তোমরা আমাদের হয়ে লড়াই করবে।

–যদি লড়াই না করি? শাঙ্কো বলল।

–তাহলে তোমাদের কয়েদঘরে আটকে রাখা হবে। সর্দার বলল।

শাঙ্কো, সঙ্গে সঙ্গে গলা চড়িয়ে ওদের দেশের ভাষায় বলে উঠল–ভাইসব জলে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জলদি।

ভাইকিংরা সঙ্গে সঙ্গে কোমরে তলোয়ার খুঁজে রেলিঙ ডিঙিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল। সবশেষে দলে শাঙ্কো ছিল। সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ল।

শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–তীরের দিকে চলল। জাহাজের সর্দার আর সৈন্যরা বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

শাঙ্কো সাঁতার কাটতে লাগল। তখনই সূর্য উঠল। গাঢ় কমলা রং সূর্যের। সমুদ্রের ঢেউ-ওঠা জলে সূর্য প্রথমেই সবটা উঠল না। নীচের দিকে একটা ফোঁটামতো জলের মধ্যে আটকে রইল। একটু পরে সেটা ওপরে উঠে সূর্যের সঙ্গে মিশে গেল।

শাঙ্কোরা সাঁতারে চলল তীরের দিকে।

সমুদ্রতীরে যখন শাঙ্কোরা পৌঁছল তখন সবাই হাঁপাচ্ছে। জল থেকে উঠে অপরিসর সৈকতে এসে দাঁড়াল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে বলল–এবার আমাদের জাহাজের দিকে চললো।

অপরিসর সৈকতভূমি দিয়ে শাঙ্কোরা হেঁটে চলল। কিছুটা গেল। আর সৈকতভূমি নেই। শাঙ্কোরা তীরে উঠল। ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ওরা ওদের জাহাজের দিকে লক্ষ্য রেখে চলল।

একসময় শাঙ্কোরা ঝোঁপজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ওদের জাহাজের কাছে এল। পাতা পাটাতন দিয়ে হেঁটে গিয়ে জাহাজে উঠল।

মারিয়া আর বিস্কো ছুটে এলো। পেছনে পেড্রো। সবাই ধ্বনি তুলল-ও-হো-হো।

শাঙ্কোরা কেবিনঘরে চলে গেল। ভেজা পোশাক ছাড়তে।

শুকনো পোশাক পরে শাঙ্কো ডেক-এ উঠে এলো। মারিয়া এগিয়ে এলো। বলল– এখন কী করবে?

–আমরা জাহাজটা চালিয়ে খাঁড়ির আরো ভেতরে চলে যাব। জাহাজ লুকিয়ে রাখবো। তারপর ফ্রান্সিসদের জন্যে অপেক্ষা করবো।

শাঙ্কো সবার দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বলল–সবাই হাত লাগাও। পাল তুলে দাও দাঁড়ঘরে দাঁড় টানতে যাও আমরা এই খাঁড়ির আরো ভেতরে চলে যাবো যাতে আমাদের জাহাজ কারো নজরে না পড়ে।

পাল তোলা হল। দাঁড় বাওয়া চলল। জাহাজ খাঁড়ির আরো ভেতরে ভেসে চলল।

একসময় খাঁড়ির দু’ধারের গভীর বনের গাছপালা দু’পাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছে দেখা গেল। শাঙ্কো গলা চড়িয়ে পেট্রোকে বলল-পেড্রো মাস্তুলে উঠে দেখো তো জাহাজটা বনজঙ্গলের আড়ালে পড়েছে কি না।

পেড্রো দ্রুত মাস্তুল বেয়ে একেবারে মাথায় উঠে গেল। চারপাশ দেখে নেমে এলো। একটু হাঁপিয়ে বলল–আমাদের জাহাজটা দুপাশের জঙ্গলে একেবারে ঢাকা পড়ে গেছে কারো নজরে পড়বে না।

জাহাজটা ওখানেই নোঙর ফেলল। এবার ফ্রান্সিসদের জন্যে প্রতীক্ষা।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি ফিরে এলেই জাহাজ ছাড়া হবে ওদের দেশের দিকে।

এখন শুধুই প্রতীক্ষা। এখন আলগেভিন আর রাজা পিটারের সৈন্যরা ওদের খোঁজ পাবে না।

.

ওদিকে গীর্জাটা ভালো করে দেখে ফ্রান্সিস হ্যারি সাজ্জিও গীর্জার বাইরে এলো। সাজ্জিও বললেন–রাজা পিটার আমাদের চার্লসের প্রাসাদেই থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।

–ভালোই হয়েছে। এতে আমাদের খোঁজাখুঁজির কাজ ভালোভাবেই চলবে।ফ্রান্সিস বলল।

তিনদিন কেটে গেল। ফ্রান্সিসরা চার্লসের প্রাসাদেই রইল। অঢেল সুস্বাদু খাবার। বড়ো পালকের শয্যায় শোয়া।ফ্রান্সিসদেরসময় ভালোভাবেই কাটতে লাগল। কিন্তু ফ্রান্সিসের নজর নেই এইসব বিলাসবহুল জীবনের প্রতি। ও সর্বক্ষণ নিজের চিন্তায় বিভোর। ওর দৃঢ় বিশ্বাস চার্লস কোথাও না কোথাও গুপ্ত ধনসম্পদের সূত্র রেখে গেছেন। ওরা সেই সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না। ফ্রান্সিস প্রাসাদের সর্বত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। কিন্তু সূত্র হিসেবে কাজে লাগে এমন কিছুই খুঁজে পেল না।

গ্রন্থাগারের প্রাচীন গ্রন্থগুলো শুধু–পাতা উল্টে-ই দেখল ফ্রান্সিস। গ্রীক আরবী ভাষায় লেখা সেসব গ্রন্থ ও কী বুঝবে। শুধু প্রাচীন গ্রীক ভাষায় লেখা বাইবেলটার পাতা উল্টে ভালো করে দেখেছে–অনেক জায়গায় দাগ দেওয়া। বোঝাই যাচ্ছে–চার্লস খুব মনোযোগ দিয়ে বাইবেল পড়েছেন। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে অনেকে মনে শান্তি পান। হয়তো চার্লসও মনের শান্তি পেয়েছেন। সাজ্জিও চার্লসের শেষ দিককার জীবনের কথা বলেছেন। গীর্জায় প্রার্থনা করেই সময় কাটতো তার। নিশ্চয়ই যীশুর বাণীর মধ্যে তিনি সান্ত্বনা পেয়েছিলেন সন্দেহ নেই। পালিতা কন্যার মৃত্যুর পর তার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল।

গীর্জাটায় ফ্রান্সিস হ্যারি ঘুরে বেড়িয়ে দেখছিল। গীর্জাটার পাথুরে দেওয়ালে কোথাও কোথাও কুঁদে কুঁদে ফুল পাতা পাখির ছবি তোলা হয়েছে। সবচেয়ে জমকালো সুন্দর কাঠের বেদীটা। ঐ বেদীতেই বসানো যীশুর মূর্তি। বেদীতে সূক্ষ্ম নকশার কাজ।

ফ্রান্সিস কাঠ কুঁদে তোলা বেদীর নক্‌শাগুলো ভালো করে দেখছিল। সাধারণ নশা যেমন হয়। ফুল পাতা পাখি লতাগাছ। দেখতে দেখতে সেই লেখাটায় চোখ পড়ল। বাইবেল থেকে উদ্ধৃতি। সাজ্জিও পড়ে অর্থটা বলেছিলেন। বড়ো গভীর অর্থ উপদেশটির। ডানদিকেও আর একটি উদ্ধৃতি। উদ্ধৃতি দুটো দেখতে দেখতে হঠাৎ ফ্রান্সিসের মনে হল উদ্ধৃতি দু’টোর মাঝখানে লতাফুল পাতা দিয়ে যেন দুটো চোখ খোদাই করা হয়েছে। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে কাছে গিয়ে দেখল সত্যিই একজোড়া চোখ। ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে জায়গাটা দেখাল। হ্যারিও মুখ নিচু করে কাছ থেকে ভালো করে দেখে বলল– ফ্রান্সিস তোমার অনুমান ঠিক। একজোড়া চোখ খোদাই করা হয়েছে। এমনিতে দেখলে ফুল লতাপাতা মনে হবে। ভালো করে দেখলে তবেই বোঝা যাবে।

ফ্রান্সিস বলল-দাঁড়াও সাজ্জিওকে ডেকে আনি। ফ্রান্সিস চলে গেল। একটু পরে সাজ্জিওকে নিয়ে ফিরে এলো।

সাজ্জিও বেদীর কাছে আসতে আসতে বলল–

–আপনারা ভুল দেখেছেন। আমি অনেকদিন এইনকশাগুলো দেখেছি। একজোড়া চোখ আমি কোনোদিন দেখিনি।

–তবু–আজকে এই জায়গাটা ভালো করে দেখুন। বলে ফ্রান্সিস আঙ্গুল দিয়ে সেই জায়গাটা দেখাল। সাজ্জিও খুব কাছে গিয়ে দেখতে দেখতে বলল–আশ্চর্য! সত্যিই একজোড়া চোখ খোদাই করা হয়েছে। কিন্তু এই চোখের সঙ্গে চার্লসের ধনসম্পদের কি সম্বন্ধ।

–নিশ্চয়ই কোনো সম্বন্ধ আছে–ফ্রান্সিস বলল–এবার আপনি বলুন তো এই সব কিছুই কি চার্লসের নির্দেশেই তৈরি হয়েছে?

–হ্যাঁ–চার্লসের তত্ত্বাবধানেই এই গীর্জার সব কিছু নির্মিত হয়েছে। সাজ্জিও বললেন। ফ্রান্সিস বলল–এবার বলুন তো এই চোখ জোড়াকে কেন্দ্র করে কি কোনো উদ্ধৃতি লেখা আছে। সাজ্জিও ভালো করে চোখ জোড়াটা দেখলেন। বললেন–না– কিছু লেখা নেই।

–ঠিক আছে ফ্রান্সিস বলল–মানুষের চোখ নিয়ে বাইবেলে কোনো বাণী আছে?

–থাকতে পারে বৈ কি। সাজ্জিও বললেন।

–তেমন কোনো বাণী কি আপনার মনে আসছে? ফ্রান্সিস বলল। সাজ্জিও চোখ। ঝুঁজে কিছুক্ষণ চুপ করে বলে উঠলেন–একটি বাণী আছে।

–সেটা কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। সাজ্জিও বললেন–বাণীটির অর্থ হল– “তোমার চোখই হল অন্তর আত্মার প্রদীপ। তোমার চোখের দৃষ্টি যদি নির্মল হয় তবে তোমার সমস্ত সত্তা দীপ্তিময় হবে।” সাজ্জিওর কথাটা শেষ হতেই ফ্রান্সিস চিৎকার করে বলে উঠল–সাজ্জিও হ্যারি–এই বেদীর মধ্যেই আছে চার্লসের গুপ্ত ধনসম্পদ।

সাজ্জিও বলে উঠলেন–এটা আপনার কেন মনে হল?

–দেখুন সাজ্জিও ফ্রান্সিস বলতে লাগল–আমার প্রথম থেকেই নিশ্চিত ধারণা হয়েছিল–চার্স প্রতিষ্ঠিত এই গীর্জা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চার্লস তার ধনসম্পদ গোপনে রেখেছেন। তিনি তার জন্যে এই গীর্জাকেই বেছে নিয়েছেন। সূত্র রেখেছেন বাইবেলের তৃতীয় উদ্ধৃতির মধ্যে। সেটা তিনি এখানে লেখান নি। যাঁরা প্রকৃত যীশুভক্ত তাদের কারো না কারো নজরে এই চোখ দুটো পড়বেই। সঙ্গে সঙ্গে যীশুর উপদেশবাণীও মনে পড়বে। খোদাই করা জোড়া চোখের গুরুত্ব তিনি বুঝতে পারবেন। এতদিন সেটা কেউ বোঝেন নি। আজ আমরা বুঝলাম।

–তাহলে তো বেদী ভেঙে দেখতে হয়। সেটা সম্ভব নয়। রাজা পিটারও রাজি হবেন না। সাজ্জিও বললেন।

–বেদি ভাঙা হোক এটা চার্লসও চান নি। কাজেই তিনি সহজ পথটাই রেখেছেন। –এই খোদাই করা চোখ জোড়া। ফ্রান্সিস বলল। তার পর দুটো আঙ্গুল চোখ জোড়ায় রেখে একটু চাপ দিল। চোখ জোড়া খসে পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ভাঙা চোখের ফাঁক দিয়ে ভেতরে তাকাল। অন্ধকার। কিছুই নজরে পড়ছে না।

–কিছু দেখতে পাচ্ছেন? সাজ্জিও বললেন।

–অন্ধকারটা একটু সয়ে আসার সময় দিন। ফ্রান্সিস বলল।

সময় বয়ে চলল।ফ্রান্সিস তাকিয়েই আছে। আস্তে আস্তে ভেতরের অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে ফ্রান্সিস আবছা একটা সোনার রত্নখচিত হারের অংশ দেখতে পেল। চোখ সরিয়ে ফ্রান্সিস বলে উঠল-সাজ্জিও–আমার অনুমান নির্ভুল। আপনি তাকিয়ে দেখুন। সাজ্জিও চোখের মত ফোকরটায় চোখ রাখলেন। অন্ধকারটা সয়ে আসতে তিনিও সেই রত্নখচিত হারের একাংশ দেখতে পেলেন। চোখ সরিয়ে এনে সাজ্জিও বললেন ঠিক। রত্নখচিত সোনার হার। কিন্তু শুধু একটা হারই কি চার্লসের সব ধনসম্পদ।

–না–আরো আছে। এই কথা বলে ফ্রান্সিস দুটো চোখের ফোকরে আঙ্গুল ঢুকিয়ে একটু টান দিতেই একটা লম্বাটে কাঠের অংশ উঠে এলো। লম্বাটে ফোকর দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মনিমুক্তোখচিত সোনার অলঙ্কার সোনার চাকতি বেরিয়ে এসে গীর্জার মেঝেয় পড়তে লাগল। সাজ্জিও এই দেখে হতবাক হয়ে সেই অলঙ্কার সোনার চাকতির দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটু পরে সম্বিত ফিরে পেয়ে ফ্রান্সিসকে বললেন–ফ্রন্সিস আপনার অসাধারণ অনুমানশক্তির কী বলে প্রশংসা করবো বুঝতে পারছি না।

–ওসবের প্রয়োজন নেই। আপনি এখন এখানে পাহারায় থাকুন। আমরা যাচ্ছি। গাইদাকে দিয়ে রাজা পিটারের কাছে চার্লসের গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধারের কথা জানাচ্ছি। ফ্রান্সিস বলল।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি আস্তে আস্তে গীর্জার দরজার দিকে চলল। ওরাতো এরকম ধনসম্পদ উদ্ধার আগেও করেছে। ওরা অভ্যস্ত। তাই সাজ্জিওর মতো ওরা আশ্চর্য হয়ে যায় নি।

চার্লসের প্রাসাদে এলো দু’জনে। গাইদার ঘরে ঢুকে দেখল গাইদা কী লিখছে। হ্যারি বলল–গাইদা এখন সব কাজ রেখে একটা অত্যন্ত দরকারি কথা শুনুন। চার্লসের ধনসম্পদ উদ্ধার করা হয়েছে। কথাটা গাইদা হাঁ মুখ করে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস হেসে বলল কী? বিশ্বাস হচ্ছে না?

আঁ-না- না মানে–গাইদা আর কথা বলতে পারল না।

গীর্জায় যান। নিজের চোখেই সব দেখুন। তারপর রাজাপিটারকে সংবাদ পাঠান। এখন এটাই আপনার কাজ। হ্যারি বলল।

গাইদা আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে ছুটল ঘরের বাইরে। তারপর গীর্জাটার দিকে।

গীর্জায় ঢুকে দেখল বেদীর কাছে সাজ্জিও বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তার সামনে মেঝেয় পড়ে আছে বহু মূল্যবান কিছু অলঙ্কার সোনার চাকতি স্বর্ণমুদ্রা গাইদা হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে রইল। সাজ্জিও এবার বললেন–আপনি যান। প্রথমে কয়েকজন পাহারাদার সৈন্যকে এখানে পাঠান। তারপর মহামান্য রাজা পিটারকে সংবাদ পাঠান যে চার্লসের ধনসম্পদ ফ্রান্সিস আবিষ্কার করেছেন। তিনি যেন যত শীঘ্র সম্ভব এখানে চলে আসেন।

তখন বিকেল। রাজা পিটার আর সেনাপতি মান্দো ঘোড়া ছুটিয়ে এসে হাজির হলেন। সাজ্জিও গীর্জার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাজাপিটার আর মান্দো ঘোড়া থেকে নামলেন। সাজ্জিও তাঁদের গীর্জার মধ্যে নিয়ে এলেন। সাজ্জিওর নির্দেশে পাহারাদার সৈন্যরা বেদীর ফোকর থেকে সব হীরে মুক্তো বসানো বহু মূল্যবান গয়নাগাটি, সোনার মুদ্রা আর চাকতি বের করে বেদীর ওপর সাজিয়ে রেখেছিল।

রাজা পিটার বেদীর ওপর রাখা সব স্বর্ণসম্পদ অবাক চোখে দেখতে লাগলেন। তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি চার্লসের স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করা যাবে।

সাজ্জিও তখন মৃদুস্বরে রাজা পিটারকে বুঝিয়ে বললেন–কী করে যীশুর একটা উপদেশকে ভিত্তি করে ফ্রান্সিস গুপ্ত স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করেছে। রাজা পিটার সেনাপতি মান্দোকে বললেন–যান ফ্রান্সিসকে ডেকে আনুন।

একটু পরে হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে ফ্রান্সিস এলো। রাজা পিটার হেসে ফ্রান্সিসের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। ফ্রান্সিস হেসে রাজা পিটারের হাত ধরলেন। রাজাপিটার বললেন– তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। কী বলে আমি কৃতজ্ঞতা জানাবো ভেবে পাচ্ছি না।

–তার দরকার নেই মহামান্য রাজা–হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এর আগেও অনেক গুপ্ত ধনভাণ্ডার উদ্ধার করেছে।

–তোমরা চিন্তা করে পরিশ্রম করে এই স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করেছে। গুপ্ত ধনভাণ্ডারের কিছু অংশ তো তোমাদের প্রাপ্য হয়। রাজা পিটার বললেন।

একটি স্বর্ণমুদ্রাও আমরা নেব না। এই ধনসম্পদ আপনার দেশের মানুষের। ফ্রান্সিস বলল।

তবু বলো–তোমরা কী চাও? রাজা পিটার বললেন। আমি আমার বন্ধুদের মুক্তি চাই! ফ্রান্সিস বলল। রাজা হেসে বললেন তোমার অনুরোধের আগেই তোমার বন্ধুরা নিজেরাই দুর্গের দেয়াল ডিঙিয়ে পালিয়েছে।

–সে কি। কেউ মারা যায় নি তো? হ্যারি বলল। রাজা পিটার সেনাপতি মান্দোকে বললেন–আর সব খবর মান্দো বলবেন। মান্দো বলল–আপনার বন্ধুরা গভীর রাতে দুর্গ থেকে পালিয়েছে। এই সংবাদ আমরা ভোরবেলা পেয়েছিলাম। ধরেই নিয়েছিলাম সবাই নিশ্চয়ই আপনাদের জাহাজেই আশ্রয় নিয়েছে। আমরা সমুদ্রতীরে ছুটে গেলাম। কিন্তু কোথাও আপনাদের জাহাজের চিহ্নমাত্র নেই। আপনার বন্ধুরা আমাদের পাহারাদারদের সঙ্গে লড়াই করে নি। সবাইকে জল ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কাজেই তাদের মারা যাওয়া বা আহত হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

ফ্রান্সিস নিশ্চিন্ত হল যে শাঙ্কোরা পালিয়েছে। বুদ্ধিমানের মতো কোনো লড়াইয়ে নামে নি।

ফ্রান্সিস বলল–মাননীয় রাজা–আমরা ঠিক জানি আমাদের বন্ধুরা সমুদ্রের কাছাকাছি কোথাও আছে। ওরা অপেক্ষা করছে আমি চার্লসের স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করতে পেরেছে কিনা এটা জানতে।

হতে পারে। রাজা বললেন।

ফ্রান্সিস বলল–আপনাদের সম্পদ তো উদ্ধার হল। আমরা এবার সেন্ট অ্যাঞ্জেলো দুর্গের দিকে যাবো। সমুদ্রতীরে খোঁজাখুঁজি করতে হবে।

হ্যারি বলল–মাননীয় রাজা আমাদের জন্যে যদি একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে দেন। তাহলে খুবই উপকার হয়।

রাজা পিটার সেনাপতি মান্দোকে বললেন গাড়ির কথা।

ফ্রান্সিস আর হ্যারি গীর্জার দরজার দিকে চলল। সাজ্জিও ওদের পেছনে পেছনে এলেন। দরজার বাইরে আস্তে এগিয়ে এসে ফ্রন্সিসের হাত দুটো ধরলেন। বললেন– এত মূল্যবান সম্পদ উদ্ধার করলেন অথচ সম্পদের কিছুই দাবি করলেন না–এতে আমি অবাক হয়ে গেছি। মানুষ যখন যেভাবে হোক ধনী হতে চায় আপনি তখন এত নির্লিপ্ত। এরকম মানুষ আমি দেখিনি। ফ্রান্সিস হেসে বলল–সাজ্জিও–আমি মুখখুসুখখু মানুষ। বাইবেল পড়ি নি। তবে কখনো-সখনো বাইবেল পড়া শুনেছি। প্রভু যীশুর

একটা উপদেশ আমার খুব ভালো লাগে।

–কোনো উপদেশটা? সাজ্জিও বললেন।

সেই উপদেশটা–সূচের ফুটো দিয়ে বরং উট চলে যাবে তবু ধনীরা স্বর্গে ঈশ্বরের রাজ্যে যেতে পারবে না।

–সাবাস ফ্রান্সিস সাজ্জিও বলে উঠলেন–আপনি যীশুর উপদেশ নিজের জীবনেও মেনেছেন ঠিক চার্লসের মতো।

–ঠিক। তাই আমার বরাবর মনে হয়েছে–চার্লসের স্বর্ণসম্পদ রয়েছে তাঁরই প্রতিষ্ঠিত এই গীর্জার কোথাও। ফ্রান্সিস বলল। তারপর সাজ্জিওর হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।

বেশ জমকালো একটা দু-ঘোড়ায় টানা গাড়ি এসে দাঁড়াল। বোঝাই যাচ্ছে– রাজপরিবারের গাড়ি।

গাড়িতে চড়ে ফ্রান্সিস আর হ্যারি অ্যাঞ্জেলো দুর্গে যখন এসে পৌঁছল তখন বেশ রাত।

ওরা সেই রাতটা দুর্গেই কাটাল। দুর্গাধ্যক্ষ ওদের খুব আদর যত্ন করল। ততক্ষণে সারা মাল্টাই জেনে গেছে চার্লসের স্বর্ণসম্পদ উদ্ধারের কাহিনী আর ফ্রান্সিসের কথা।

পরদিন। নিজেদের ঘরেই তখন ফ্রান্সিস আর হ্যারি সকালের খাবার খাচ্ছে। গোল রুটি আর সজির ঝোল। তখনই একজন খ্রীস্টান সাধু দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। মুখে দাড়ি গোঁফ। সাধু বলল, আর্ত ক্ষুধার্ত। হ্যারি বলল”নিশ্চয়ই আসুন। যারা খাবার দিয়েছিল সেই সৈন্যদের হ্যারি আরো খাবার দিতে বলল।

তিনজনেই খেতে লাগল।

খাওয়া শেষ হলে ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বলল–হ্যারি এখন আমাদের জাহাজের খোঁজ পাবো কী করে।

–চলো–সমুদ্রতীরে যাই। খোঁজখবর করি। হ্যারি বলল।

–তাই চলো৷ ফ্রান্সিস উঠে বসে বলল। সাধুটি তখনও বসে আছে। ফ্রন্সিস বলল– তা সাধুবাবা আপনার খাওয়া তো হয়েছে। এবার কী করবেন?

–আপনাদের নিয়ে যাবো। সাধু গম্ভীর মুখে বলল।

–কোথায়? হ্যারি বলল।

–আপনাদের জাহাজে। সাধু বলল একই ভঙ্গীতে।

–এ্যা? হ্যারি তো চমকে উঠল। ফ্রান্সিসও। সাধুবাবা বলছে কি।

–আপনি কী করে আমাদের জাহাজের কথা জানলেন। হ্যারি জিজ্ঞেস করল।

–সেটা পরে জানবেন–সাধু বলল–যদি নিজেদের জাহাজে যেতে চান তাহলে এক্ষুণি আমার সঙ্গে চলুন।

–বেশ চলুন। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। হ্যারিও তৈরি। –ঠিক তখনই দুর্গাধ্যক্ষ ঘরে ঢুকল। হেসে বলল

–আপনাদের ঘুমুতে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?

–না না। ফ্রান্সিস বলল।

সকালের খাবার খেয়েছেন তো? দুর্গাধ্যক্ষ বলল।

–হ্যাঁ। হ্যারি বলল।

–হ্যাঁ একটু বেড়াবোটেরাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–এখন বাইরে যাবেন? দুর্গাধ্যক্ষ বলল।

সঙ্গে লোক দেব? দুর্গাধ্যক্ষ বলল।

-না-না। ফ্রান্সিস বলল। তারপর হ্যারি বলল চলো। এবার সাধুকে দেখিয়ে হ্যারি দুর্গাধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করল

ইনি কে?

–তা তো জানি না। উনি গত কয়েকদিন ধরেই এখানে সকালে সন্ধেয় আসছেন। খেয়েটেয়ে চলে যান। দুর্গাধ্যক্ষ বলল।

ফ্রান্সিস হ্যারি আর কোনো কথা বলল না। দুর্গের বাইরে চলে এলো। পেছনে সেই সাধু। সাধুকে হ্যারি জিজ্ঞেস করল এবার কোন্ দিকে যাবো? সাধু হঠাৎ হো-হো করে হেসে উঠল। আরে? এতো বিস্কোর গলা। বিস্কো নিজেই আবার গোঁফ দাড়ি-টান দিয়ে খুলে ফেলল। ফ্রান্সিসকে হ্যারিকে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিস হাসতে হাসতে বলল–এই সাধুর বেশ নিয়েছিলে কেন? বিস্কো বলল–প্রতিদিন দুবেলা দুর্গে আসতাম তোমাদের খোঁজ নিতে। খোঁজ মানে তোমাদের কথা কাউকে জিজ্ঞেস করতাম না। শুধু দুর্গের ভিতের ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম। সাধুর বেশে। কাজেই কেউ কিছু বলতো না।

–আর আমাদের ভয় নেই। ফ্রান্সিস চার্লসের স্বর্ণসম্পদ উদ্ধার করেছে। হ্যারি বলল।

–তাই দুর্গাধ্যক্ষের এত আদর আপ্যায়নের ঘটা। বিস্কো বলল।

–কেন? তোমরা এই খবর পাও নি? ফ্রান্সিস বলল।

না তো এই বেশ ধরে আসতাম। বিস্কো বলল।

এবার বিস্কো ফ্রান্সিস আর হ্যারিকে নিয়ে একটা বনভূমিতে ঢুকল। বেশ ঘন বন। গাছগাছালির জটলা। তারই মধ্যে দিয়ে ওরা চলল।

বনের শেষে দেখল সমুদ্রের খাড়ি। ওদের জাহাজে সেই খাঁড়িতে ভাসছে। তির থেকেই বিস্কো চিৎকার করতে লাগল–ভাইসব–ফ্রান্সিস, হ্যারি ফিরে এসেছে। ফ্রান্সিস চার্লসের গুপ্ত স্বর্ণভাণ্ডার উদ্ধার করেছে। রাজা পিটার আর আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।

বিস্কোর চিৎকার করে কথা বলা জাহাজের বন্ধুরা শুনল। সবাই এসে ভিড় করে দাঁড়াল রেলিঙ ধরে। তার মধ্যে মারিয়াও আছে।

জাহাজ থেকে একটা নৌকা জলে ভাসানো হল। দাঁড় বাইতে বাইতে নৌকা পারের কাছে নিয়ে এলো শাঙ্কো। ফ্রান্সিসরা নৌকায় উঠল। নৌকো গিয়ে জাহাজে লাগল। দড়ির মই ফেলা হল। ফ্রান্সিসরা মই বেয়ে ডেক-এ উঠে এলো। জাহাজে ফ্রান্সিসকে নিয়ে হৈ হৈ পড়ে গেল। ধ্বনি উঠল—ও হো হো–।

মারিয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো ফ্রান্সিসের দিকে। ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়ার চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া তোমার শরীর ভালো আছে তো?

বেশ ভালো। আমার জন্যে ভেবো না মারিয়া হেসে বলল।

না–মারিয়া–তোমারশরীর ভালো নেই। তুমি যদি বলো তাহলে আর কোথাও আমরা নামবো না। জাহাজ চালিয়ে সোজা দেশে ফিরে যাবো। ফ্রান্সিস বলল।

–ওসব পরে ভেবো। এখন খাবে চলো। মারিয়া বলল।

রাজকুমারী–আমরা আনজুতে রাজার হালে ছিলাম। আমাদের কোনো কষ্ট হয় নি। হ্যারি হেসে বলল।

ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া এবারও আমার হাত খালি। মূল্যবান কিছুই আনতে পারিনি।

–তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। মারিয়া বলল। জাহাজে আবার ধ্বনি উঠল—ও হো হো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *