Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গুণ করা || Lila Majumdar

গুণ করা || Lila Majumdar

বুঝলে, আমার মামাবাড়িতে ফাগু বলে একটা চাকর ছিল। বাঙালি নয়; ওই গারো পাহাড় অঞ্চলে ওর বাড়ি। আশা করি গারো পাহাড় কোথায় সেকথা আর তোমাদের বলে দিতে হবে না। ফাগু যে বাঙালি নয় সে ওকে দেখলেই বোঝা যেত। বেঁটে, মোটা, একমাথা কাটা কাটা চুল, দারুণ ফর্সা, আর খেত যে, আরে বাপ, দেখলে তোমাদের তাক লেগে যেত। রোজ দু-টি বেলা এক-গন্ধমাদন পর্বত ভাত আর একগঙ্গা জল তার চাই। তাই দেখে আমরা হাসাহাসি করলে আবার সে কী রাগ!

– অত হাসবার কী আছে দিদি? জান, আমরা হলাম গিয়ে পরিদের বংশ। আমরা নানারকম তুকতাক ভেলকি মন্তর জানি, একটু না খেলে আমাদের চলবে কেন?

একদিন আমার মামাতো ভাই নগা বলল, দ্যুৎ? পরি আবার হয় নাকি? যত সব বানানো গল্প। চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি। তাই শুনে ফাগু এমনি চটে গেল যে আরেকটু হলেই থালায় একপাহাড় ভাত ফেলেই উঠে যাচ্ছিল। নেহাত অত ভাত খেলে বেড়ালটার অসুখ। করতে পারে বলেই গেল না। কোনো কথা না বলে পাহাড়টিকে শেষ করে, এক কলসি জল গিলে, তারপর আবার বলল, তোমরা জানই-বা কী আর বোঝই-বা কী? ইস্কুলে গিয়ে কয়েকটা বই মুখস্থ করে নিজেদের সব মস্ত পণ্ডিত মনে কর। বলি, একটা তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পার?

নগা বলল, হ্যাঁ, তুমি পার না তো আরও কিছু! একটা থালা মাজতে পার না, পিসিমার কাছে তাড়া খাও, তুমি আবার বাঘ বানাবে! ফাগু ব্যস্ত হয়ে বলল, আস্তে, খোকাবাবু, আস্তে। বড়োরা শুনতে পেলে আমাকে আস্ত রাখবে না। নগা বললে, কেন, আস্ত রাখবে না কেন?

–আরে আমার ঠাকুরদা শুধু যে তেঁতুল পাতাকে বাঘ বানিয়ে দিতে পারত তা নয়, তার উপর সুতো বেঁধে মানুষকে ছুঁচো বানিয়ে দিতে পারত। মানুষকে ছুঁচো বানাত বললেই হল! কক্ষনও মানুষকে ছুঁচো বানাত না।

ফাগু বলল, আহা, ছুঁচো বানাত তো আর বলিনি, বানাতে পারত। খুব দয়ালু ছিল তাই বড়ো-একটা বানাত না। তবে মানুষকে হঁদুর ব্যাং কাচপোকা বানিয়ে দিতে আমি নিজের চোখে দেখেছি।

শুনে আমরা সবাই একেবারে থ মেরে গেলাম। ফাগু আরও বললে, আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমাদের পাহাড়ের নীচেকার গায়ের চমরু মোড়ল ঠাকুরদার কাছে টাকা ধার করে শোধ দিচ্ছিল না বলে, ঠাকুরদা প্রথমে সর্টে পুড়িয়ে তাকে আমাদের বাড়িতে এনে, তারপর তার চারদিকে সুতো বেঁধে মন্ত্র পড়ে, তাকে একটা ব্যাং বানিয়ে, একটা মাটির হাঁড়িতে সরা চাপা দিয়ে রেখে দিলেন। তারপর চমরুর বউ হাউমাউ করে কেঁদেকেটে এসে টাকা শোধ করে দিয়ে গেলে, তবে ঠাকুরদা আবার চমরুকে মাথায় ঘুঁটের ছাই মাখিয়ে মানুষ করে দিলেন। ওইজন্যই বার বার বলি, খোকাবাবু, আমার পিছনে লেগ না।

নগা মাঝে মাঝে ফাগুর মাথার টিকি ধরে টানত কি না, তাই ফাগু ও-রকম বলল। নগা যদিও মুখে বলল, হাঃ! উনি সবকিছু করতে পারেন, অথচ দশ টাকা মাইনেতে বাড়িঘর ছেড়ে আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এসেছেন! মুখে একটু চাল দিল বটে কিন্তু টিকিতে হাত দিল না।

ফাগু আস্তে আস্তে উঠে থালা-ঘটি নিয়ে আঁচাতে গেল; যাবার সময় শুধু বলল, টাকাপয়সা তৈরি করতে পারি একথা তো বলিনি, খোকাবাবু। সে আমার ঠাকুরদাদাও পারত না। আর সে যা পারত, আমার বাবা অতটা পারত না। আবার আমি পারি আরও কম। তবে একেবারে যে কিছুই পারি না তাও নয়। দেখাব এখন একদিন। এখন তোমরা কেটে পড়ো দিকিনি। চাকর-বাকরদের সঙ্গে অত দহরম-মহরম মোটই ভালো নয়।

বুঝতেই তো পারছ এসব কথা বড়োদের কাছে মোটেই বলবার মতো নয়। তার পরদিন সন্ধ্যে বেলা ফাগু মুঠোর মধ্যে করে কী একটা ছোট্ট লাল বিচি আর একটা তামার আংটি দেখাল। কী রে ফাগু, ও দিয়ে কী হবে? ফাগু বলল, আংটি পরে ওটা খেলে, তারপর যদি আমার জানা একটা মন্তুর মনে মনে বলা যায় তাহলে যখনই ইচ্ছা হবে তখুনি আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারব। এর অনেক বিপদও আছে, কাজেই তোমরা যেন আবার খেতে-টেতে চেয়ো না। এই-না বলে আমাদের সামনেই টপ করে সেটাকে গিলে ফেলল। আরেকদিন, দেখি পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা তামার মাদুলি বাঁধা। বলে কি না, ওটা যতক্ষণ আমার পায়ে পরা থাকবে, ততক্ষণ সব জন্তু-জানোয়ারদের কথা আমি বুঝতে পারি, দিদি। নগা বিরক্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই বই কী, এদিকে ক খ পড়তে পারেন না, বাড়িতে চিঠি লিখতে হলে আমাকে এসে খোশামুদি করেন, উনি বুঝবেন জন্তু-জানোয়ারদের ভাষা!

আমার ছোটো মামাতো বোন টিনা বলল, সsপ্যাকে বলেন নগজ পানা, রেফ্রিজারেটরকে বলেন ক্যাবেন্ডিস, ইলেট্রিককে বলেন লিকটিস, উনি বাঘা পুষিদের কথা বুঝবেন। ফাগু একটু কাষ্ঠহেসে বলল, দেখো দিদি, পরিদের ইংজিরি শিখবার দরকার হয় না, ওই যে কাল মাস্টারবাবু তোমাদের বকতেছিলেন বাঁশ বেয়ে বাঁদর ওঠে বুঝতে পারছিলে না বলে, ও সবও আমাদের শিখতে হয় না। আমাদের দেশে আমি নিজের চোখে দেখেছি বাঁদররা বাঁশ বেয়ে বেয়ে ওঠানামা করতেছে। একটুখানি ওঠে আবার একটুখানি করে পিছলে পড়ে যায়, আর রেগেমেগে সে যা বলাবলি করতেছে, সে আর তোমাদেরকে না বলাই ভালো, কোন ফাঁকে কী শিখে নেবে। হ্যাঁ, কী বলছিলাম, জন্তুদের কথা বুঝি বই কী। এই তো একটু আগে পুষি বলছিল, খোকাবাবু হাত ধুয়েই পিসিমার বাটি থেকে দুধ চুরি করে ওকে খাইয়ে দিয়েছে। অত হাসছ কী দিদি? কাল বাঘাকে কে ওই পুজোর সময় ছেড়ে দিয়েছিল সেকথাও বাঘার কাছে শুনেছি।

এর পর ফাগুকে আমরা খুব বেশি ঘাঁটাতাম না। কিন্তু সত্যি ব্যাটার খাওয়ার আর ঘুমের বহর দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। মাঝে মাঝে আমাদের বলত, দেখো, দাদা দিদি, তোমরা যদি আমাকে খুশি করতে পার তোমাদের আমি ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মন্তরটা শিখিয়ে দেব। আমরা তখুনি ওকে আমাদের পয়সা-কড়ি যার যা হাতে ছিল দান করে বসলাম। এবার খুশি হয়েছ তো ফাগু, এবার শিখিয়ে দাও। ফাগু বলত, হ্যাঁ, হা, শিখিয়ে দেব বই কী। তবে একটা কালো প্যাঁচার চোখের মণি লাগবে। সেটা আনতে পারবে তো? আমরা সবাই অপ্রস্তুত হয়ে এ ওর দিকে চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। শেষে নগা বললে, কী যে বল ফাগু, প্যাঁচার চোখ কোথায় পাব? আচ্ছা এই কালো মার্বেলটাতে হবে না? ফাগু একটু ভেবে বলল, তা হতে পারে, পরিদের ছেলে আমি, ওটা শক্ত হলেও আমার পক্ষে অসম্ভব নয়, কিন্তু তাহলে যে আবার জ্যাঠামশাইএর ওই ভালো তামাকটার এক দলা লাগবে। আর দেখ খোকাবাবু, কাউকে যদি এসব কথা বল তো মন্তর তো হবেই না, বরং পড়া-টড়া যা একটু-আধটু জান তাও সব ভুলে যাবে। নগা বলল, পাগল, পাগল, এসব কথা কাউকে বলি কখনো!

তামাক পেয়ে ফাগু বলল, আজ তো হবে না, খোকাবাবু, আজ সকালে পশ্চিম দিকে ছাগল ডেকেছিল, আজ হবার নয়। কাল বিদ্যুৎবার, কাল বাদ দিতে হবে; পরশু একাদশী, পরশু মন্তর-তন্তর করলে ম্যালেরিয়া হয়, সেই গিয়ে একেবারে শনিবার করতে হবে। তা একদিক দিয়ে ভালো হল, সেদিন ছোটোকাকিমাও বাপের বাড়ি থেকে আসবেন, ওনার সঙ্গে সেই দুষ্টু বিজুও আসবে, ওকেও তা হলে শিখিয়ে দিতে পারব। আচার-টাচার চুরি করতে ভারি সুবিধে হবে।

তাই হল। কোনোরকমে বিস্যুৎ শুক্কুরটা পার করে শনিবার সকালে যেই ছোটোকাকিমার সঙ্গে বিজু এসে উপস্থিত হয়েছে, ধরলাম গিয়ে ফাগুকে। নগা বললে, আর চালাকি চলবে না, ফাগু, বলে রাখলাম। যা যা বলেছিলে সব হয়েছে। এবার না শিখিয়ে দিলে কিন্তু বাবাকে বলে-টলে একাকার করব, সে পড়াই ভুলি আর যাই করি। আমি বললাম, হ্যাঁ রে, সত্যিই তাই। তা ছাড়া এমনিতেই তো প্রায় সব ভুলে গেছিস, মাস্টারমশাই বলছিলেন-না? খুশি হওয়া দূরে থাকুক নগা আমাকে এক ধমক দিল, চুপ। আমি তোর চেয়ে বড়ো-না! বিজু বললে, আহা, তোরা থাম-না। দেখ ফাগু, পড়া-টড়ার জন্য আমি কেয়ারই করি না। জানিই না কিছু, ভুলব কী ছাই! তবে এটুকু বলে রাখি চালাকি করবি তো পিটিয়ে ছাতু করে দেব। তোর চেয়ে ঢের ঢের ভালো লোকদের একেবারে আমচুর বানিয়েছি তা জানিস? যখন শেষটা ছেড়ে দিয়েছি পানের মশলার সঙ্গে তাদের কোনো তফাত থাকেনি। কঁদতে কাঁদতে সব বাছাধনরা বাড়ি গেছে!

ফাগু বলল, আরে না, না। অত অবিশ্বাস করলে কি চলে, দাদা? আজ সন্ধ্যা বেলায় সুয্যি ডুববার এক ঘণ্টা পরে খুব ভালো সময়। তোরা চার জনে একটা নতুন কাঁসার ঘড়ায় পঞ্চাশটা সন্দেশ, একটা নতুন ধুতি, একটা নতুন গামছা, আংটিটা তো আমার পকেটেই আছে– বলে ফাগু এ-পকেট সে-পকেট হাতড়াতে লাগল। সব্বনাশ আংটি তো নেই! তার কী হবে! এমনি আংটিতে তো হবে না, ওটা যে মন্ত্রপূত ছিল।

–অ্যাঁ ফাণ্ড! শেষ কালটা সব পণ্ড! বিজু ঘুসি পাকিয়ে বলল, দেখ, চালাকি রাখ, আংটি যখন তুই হারিয়েছিস তোকেই ব্যবস্থা করতে হবে। এক মিনিট সময় দিলাম। ফাগু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, লাল পাথর-বসানো বড়ো সোনার আংটি একটা হলেও চলে যায়। তা সে আমি কোথায় পাব? বিজু একটু হেসে বলল, আচ্ছা, সে আমি দেবখন। কিন্তু অদৃশ্য হতে শেখাতে হবে।

ফাগু বলল, সে আর বলতে। ঠিক সাড়ে ছটার সময় ওই জিনিসগুলো নিয়ে, গোয়াল ঘরের পিছনে ওই খালি গুদোম ঘরটাতে তোমরা এসো। আগে আমি নিজে অদৃশ্য হয়ে দেখব পারি কি না, আংটিটার জন্যই একটু ভাবছি। তারপর তোমাদের শিখিয়ে দেব। তবে কী জানেন দাদাবাবু, এসব বড়ো শক্ত খেলা, এইটুকু ভুল করেছি তো সর্বনাশ! হয়তো চিরটা কালের মতোই উবে যাব, হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যাব। বিজু বললে, ন্যাকামো রাখ! সাড়ে ছ-টাই ঠিক রইল।

সন্ধ্যে বেলা বড়োরা সিনেমা দেখতে গেলে, বিজু ছোটোকাকিমার সঙ্গে এসেছিল ওঁর বিয়ের ঘড়া, তত্ত্বর সন্দেশ, ধুতি, গামছা আর নিজের নতুন লাল পাথরের আংটি, এইসব নিয়ে আমাদের সঙ্গে গুদোম ঘরে গেল। সেখানে ফাগু অপেক্ষা করছিল। কাউকে বলিসনি তো তোরা? তাহলে কিন্তু মন্তর ফলবে না। আরে না, না, এবার শুরু কর। ফাগু ঘরে ঢুকে বলল, তোমরা একটু বাইরে দাঁড়াও, গোপনে মন্তরটা সড়োগড়ো করতে হয়। বলে জিনিস নিয়ে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বাইরে আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। আধ ঘণ্টা গেল, এক ঘণ্টা গেল, চার দিক দিয়ে এমনি অন্ধকার হয়ে এল যে আর কী বলব। তারপর বড়োরা তো সাড়ে আটটার পর এসে হাজির হবে, তখন তো আর কিছু হবার জো নেই। এত দেরি করলে মন্তর শিখব কখন! শেষটা বিজু কাঁধ দিয়ে দরজা ঠেলে খুলে ফেলে দিল। গিয়ে দেখি সব ভোঁ ভোঁ! ফাগু ও জিনিসপত্র সব ডিস্যাপিয়ার্ড!

ভেবেই পেলাম না কী হল। ব্যাটা মন্তরই ভুল করে চিরকালের মতো হাওয়াই হয়ে গেল, না কি আমরা সবাই গুদোম ঘরের দেয়ালের ছোটো জানলাটার দিকে একবার তাকালাম। খালি বিজু একটু মাথা চুলকে বলল, আমি আবার আমার বন্ধু জগাইয়ের কাছে খানিকটা খানিকটা বলেছিলাম, সেইজন্যই কি বেচারা শেষটা হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেল নাকি?

পরে গোলমাল হয়েছিল বই কী, আংটির কথা কেউ না জানলেও ঘড়া নেই, সন্দেশ নেই, কাপড় নেই, ফাগু নেই। গোলমাল হবে না? তবে ফাগুকে পাওয়া যায়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *