মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট
মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে আজ খুব ভিড়। ভারতের রাষ্ট্রপতি শেষ দিনের সভায় যোগ দিতে এসেছেন, সেইজন্যই চতুর্দিকে পুলিশ আর লোজনও বেড়েছে তিন-চার গুণ। এত ভিড় সন্তুর ভাল লাগে না।
ইনস্টিটিউটের প্রাঙ্গণে ম্যারাপ বেঁধে বিশাল অডিটোরিয়াম তৈরি হয়েছে। মঞ্চের কাছাকাছি একটা চেয়ার দখল করে বসে রইল সন্তু। বক্তৃতার পর বক্তৃতা চলেছে। সন্তু অধীরভাবে অপেক্ষা করছে কখন কাকাবাবুর বক্তৃতা হবে। এক-একজন বক্তা সময় নিচ্ছেন বড্ড বেশি।
অন্যদের তুলনায় কাকাবাবু বললেন খুব সংক্ষেপে। তিনি বললেন, এখানে কয়েকটি বিষয়ই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার বলা হচ্ছে, তাই আমি বেশি সময় নষ্ট করব না। আমি শুধু দুটি পয়েন্ট যোগ করতে চাই। এক নম্বর হল, মানুষ আজ সব পাহাড়ই জয় করেছে। এভারেস্টের চুড়াতেও মানুষ পা দিয়েছে বারবার। পৃথিবীর অনেক দেশের অভিযাত্রীরাই এভারেস্ট জয় করেছে, কেউ-কেউ সেখানে দুবারও উঠেছে। এর পর মানুষ নিশ্চয়ই একদিন এভারেস্টের চেয়েও উঁচু পাহাড় জয় করবে। কিন্তু জয় করাটাই বড় কথা নয়। শুধু দল বেঁধে কোনও একটা পাহাড়ের শিখরে উঠে দাঁড়ানোর মধ্যেই এমন-কিছু কৃতিত্ব নেই। পাহাড়কে যে ভালবাসতে শেখে, পাহাড়ের মহিমা যে অন্তর দিয়ে বোঝে, সে-ই আসল অভিযাত্রী। পাহাড়ের একটা আলাদা গন্ধ আছে, পাহাড়ি জঙ্গল, নদী, বরফের মধ্যে কত নতুন-নতুন রং আছে, বাতাসের শব্দ, জলের শব্দ, পাখির ডাক এইসব মিলিয়ে কত নতুন-নতুন সুরের সৃষ্টি হয়। চোখ-কান-মন ভোলা রেখে এইসব রূপ-রং-গন্ধ অনুভব করতে না পারলে পাহাড়ে যাওয়ার কোনও মানেই হয় না।
একটু থেমে কাকাবাবু আবার বললেন, আমার শেষ কথাটি সকলের প্রতি অনুরোধ। আপনারা সবাই জানেন, আজকাল এত বেশি দল পাহাড় অভিযানে যাচ্ছে যে, তার ফলে অনেক পাহাড় নোংরা হয়ে যাচ্ছে। এমনকী, এভারেস্টে ওঠার পথেও জমে যাচ্ছে অনেক আবর্জনা। তাই প্রত্যেক অভিযাত্রীকে এখন থেকে শপথ নিতে হবে যে, কিছুতেই পাহাড় নোংরা করা চলবে না। খাবারের খালি টিন, পলিথিন বা কাগজের প্যাকেট, হেঁড়া জুতোমোজা কিংবা অন্য সমস্ত বাতিল জিনিস কিছুই না ফেলে সঙ্গে করে ফেরত আনতে হবে। প্রকৃতির সৌন্দর্যের মধ্যে এইসব নোংরা ফেলে অপবিত্র করা একটা চরম পাপ! চরম অন্যায়!
কাকাবাবুর এই কথা শুনে সবাই একসঙ্গে খুব জোরে হাততালি দিয়ে উঠল। কাকাবাবুর পাশে বসা রাষ্ট্রপতিও মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক, ঠিক!
কাকাবাবুর বলা শেষ হতেই সন্তু উঠে পড়ল। আর তার বক্তৃতা শোনার ধৈর্য নেই।
রাষ্ট্রপতি যতক্ষণ থাকবেন ততক্ষণ কাকাবাবুকেও মঞ্চে বসে থাকতে হবে। সন্তু একাই লোকজনদের ভিড় কাটিয়ে একটু ফাঁকা জায়গায় যেতে চাইল।
পর্বত-অভিযাত্রীদের ব্যবহার করা জিনিসপত্রের যে মিউজিয়ামটা আছে, সেটা এখন ভিড়ে ঠাসাঠাসি। সন্তু ওই মিউজিয়াম আগেই দেখে নিয়েছে। সে ওর পেছন দিকটায় গিয়ে দাঁড়াল। এখান থেকে একটা চমৎকার উপত্যকা দেখতে পাওয়া যায়। এখানেও অবশ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কিছু লোক রয়েছে।
সন্তু দেখতে পেল, একটা বড় পাথরের ওপর বসে ফিলিপ তামাং দুজন সাহেবকে হাত-পা নেড়ে কী যেন বোঝাচ্ছে।
এর আগে সন্তু ফিলিপ তামাংকে দূর থেকে দেখেছে কয়েকবার। একবার চোখাচোখিও হয়েছিল, কিন্তু ফিলিপ তামাং কাছে এসে কথা বলার চেষ্টা করেনি। কাল রাতে, শেষের দিকে কাকাবাবু ওকে প্রায় তাড়িয়েই দিয়েছেন, ও নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করেছে। রেগেও যেতে পারে।
হঠাৎ যেন আকাশ থেকে একটা অলৌকিক পর্দা সরে গেল। সন্তু চোখ তুলে দেখল, সামনের দিগন্ত জুড়ে ফুটে উঠেছে কাঞ্চনজঙ্। তার সারা গায়ে ঝকঝক করছে রোদ। এত সুন্দর যে, সন্তুর যেন দম বন্ধ হয়ে এল! সত্যিই, নিশ্বাস ফেলার কথাও তার মনে রইল না।
কিন্তু ঠিক দু মিনিট বা তিন মিনিট, তারপরেই কোথা থেকে এসে গেল মেঘ। সেই মেঘ এসে এমনভারে ঢেকে দিল, তার আড়ালে যে অত বিশাল একটা পাহাড় আছে, তা আর বোঝাই যায় না। এসব আকাশের ম্যাজিক!
অনেকদিন আগে কাকাবাবু বলেছিলেন, আকাশ কখনও পুরনো হয় না। কথাটা খুব সত্যি।
পেছন থেকে একজন কেউ সন্তুর পিঠে চাপড় মারতেই সে চমকে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে সে দেখতে পেল নরেন্দ্র ভার্মাকে। দিল্লির এই বড় অফিসারটি কাকাবাবুর খুব বন্ধু।
নরেন্দ্র ভার্মা হাসতে-হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, কী সোন্টুবাবু, এখানে একা-একা আকাশের দিকে চেয়ে কী দেখছ? তুমি পোয়েট্রি লেখো নাকি?
সন্তু বলল, আপনি কবে দার্জিলিং এলেন? আগে তো দেখিনি?
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এসেছি আজই সকালে। হেলিকপ্টারের আওয়াজ শোনোনি? রাজার বক্তৃতা বেশ ভাল হয়েছে। এইসব জায়গায় ছোট বক্তৃতাই শুনতে ভাল লাগে, তাই না?
সন্তু বলল, কাকাবাবু সকলের চেয়ে ভাল বলেছেন।
নরেন্দ্র ভার্মা হেসে বললেন, খুব যে নিজের কাকার জন্য গর্ব! তোমরা কোন হোটেলে উঠেছ? আজ সন্ধেবেলা তোমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাব।
সন্তু বলল, আমরা আছি মাউন্টেন টপ হোটেলে, তার টপ ফ্লোরে।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, হ্যাঁ, চিনি ওই হোটেল। আরে, ওই তো হিলারি-সাহেব বেরিয়ে আসছেন। মিটিং শেষ হয়ে গেল নাকি? সন্তু, তুমি সার এডমান্ড হিলারিকে চেনো? উনি আর তেনজিং-ই মানুষের ইতিহাসে প্রথম এভারেস্টের চূড়ায় পা দিয়েছিলেন।
সন্তু বলল, একথা কে না জানে?
নরেন্দ্র ভাম বললেন, না, মানে, অনেকদিন হয়ে গেল তো। তোমাদের বয়েসী ছেলেরা…চলল, হিলারি-সাহেবের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।
সন্তু লাজুকভাবে বলল, না, না, থাক। অত বড় একজন লোকের সঙ্গে আমি কী কথা বলব? আপনি যান।
নরেন্দ্র ভার্মা তবু সন্তুকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলেন। হিলারি-সাহেব এত নামকরা তোক হলেও ব্যবহারে খুব ভদ্র। ছিপছিপে লম্বা মানুষটি, মুখে বেশ একটা সৌম্য ভাব। চোখের মণি দুটো একেবারে নীল। সন্তুর কাঁধে হাত রেখে তিনি বললেন, ও, তুমি রাজা রায়চৌধুরীর ভাইয়ের ছেলে? ওঁকে তো আমি ভালই চিনি। ওঁর একটা পা ভাঙা বলে উনি কোনও উঁচু পাহাড়ে ওঠেননি, কিন্তু পাহাড় সম্পর্কে উনি অনেকের চেয়ে ভাল জানেন। তুমি কি ঠিক করেছ, তুমি মাউন্টেনিয়ার হবে?
সন্তু মুখ নিচু করে বলল, আমার সাঁতার কাটতে বেশি ভাল লাগে। আমার ইচ্ছে আছে, একবার ইংলিশ চ্যানেল ক্রস করব।
হিলারি-সাহেব খুশি হয়ে বললেন, বাঃ, খুব ভাল কথা। একবার তা হলে ক্যালকাটা থেকে সাঁতার কেটে অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যান্ড চলে এসো।
হঠাৎ কথা থামিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে হিলারি-সাহেব নরেন্দ্র ভার্মাকে জিজ্ঞেস করলেন, মিঃ ভার্মা, ওই লোকটি কে? চেনেন?
সন্তু দেখল, একজন বিদেশির সঙ্গে কথা বলতে বলতে ডান পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে ফিলিপ তামাং।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, উনি তো মিস্টার স্ট্রিন্ডবার্গ। সুইডেন থেকে এসেছেন!
হিলারি বললেন, না, না, স্ট্রিন্ডবার্গকে তো আমি ভালই চিনি। তার সঙ্গে ওই ভারতীয়টি?
না, ওকে চিনি না। স্থানীয় কেউ হবে মনে হচ্ছে।
ওই লোকটি আজ খুব ভোরে আমার হোটেলে দেখা করতে এসেছিল। কী যে অদ্ভুত, অনেক কথা বলল, তা বুঝতেই পারলাম না। এইটুকু বুঝলাম, আমাকে একটা চাবাগানে নিয়ে যেতে চায়। আমি হঠাৎ সেখানে যাব কেন?
না, না, এরকম কেউ ডাকলেই আপনি যাবেন কেন? মোটেই যাবেন না। আমি খোঁজ-খবর নিচ্ছি লোকটি সম্পর্কে।
ওই ফিলিপ তামাং যে কাকাবাবুর সঙ্গেও দেখা করতে এসেছিল, সেকথা আর সন্তু বলল না।
এর পর নরেন্দ্র ভার্মা সন্তুকে নিয়ে গেলেন চায়ের ক্যান্টিনে। কাকাবাবুও এর মধ্যে এসে গেছেন সেখানে। সকালের মিটিং শেষ হয়ে গেছে, লাঞ্চের পর আরও কিছু বক্তৃতা আছে। একটা টেবিলে বসে বেশ আড্ডা জমে গেল। তাতে যোগ দিলেন দেশ-বিদেশের কয়েকজন পর্বতারোহী।
কথায় কথায় উঠল ইয়েতির কথা। কেউ-কেউ ইয়েতির অস্তিত্বে কিছুটা বিশ্বাস করেন, কেউ-কেউ একেবারেই করেন না। এদের মধ্যে দু-তিনজন বরফের ওপর ইয়েতির পায়ের ছাপ দেখেছেন নিজের চোখে।
ফরাসি-অভিযাত্রী মসিয়ে জাকোতে বললেন, সবচেয়ে কী আশ্চর্য ব্যাপার জানো? একবার আমি হিমালয়ে তেরো ফিট ওপরে বরফের ওপর ইয়েতির টাটকা দুটো পায়ের ছাপ দেখে সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে নিয়েছিলাম। কিন্তু সেই ফিল্ম ডেভেলাপ করার পর দেখা গেল, অন্য সব ছবি উঠেছে, কিন্তু শুধু ওই পায়ের ছাপের ছবিটাই ওঠেনি। ট্রেই ব্যাপার।
অনেকেই হেসে উঠল।
একজন কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, মিঃ রায়চৌধুরী, তুমি একবার কালাপাথরে কয়েকটা জ্যান্ত ইয়েতি দেখেছিলে না?
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, দেখেছিলাম?
সন্তু বলল, নকল।
কাকাবাবু বললেন, প্রথমে মনে হয়েছিল সত্যি। একটা নয়, তিন-চারটে, হেলেদুলে হাঁটছে। আসলে সেসব হল কেইন শিপটনের কারসাজি। ভাল্লুকের চামড়া দিয়ে পোশাক বানিয়ে কয়েকটা লোককে ইয়েতি সাজিয়েছিল। লোকজনদের ভয় দেখাত।
অন্য একজন বলল, এই কেইন শিপটন অনেক কুকীর্তি করেছে। কিন্তু লোকটা এমন ধুরন্ধর যে, কিছুতেই ধরা পড়ে না।
এই সময় সুইডিশ অভিযাত্রী ম্যাক্স ডিবার্গ সেখানে এসে বলল, কী নিয়ে কথা হচ্ছে? ইয়েতি? হ্যাঁ হ্যাঁ আছে, নিশ্চয়ই আছে। এই ইন্ডিয়াতে যে কত কী রহস্যময় ব্যাপার এখনও আছে, তার অনেকটাই আমরা জানি না।
সঁসিয়ে জাকোতে জিজ্ঞেস করল, তুমি কখনও ইয়েতি দেখেছ নাকি? তুমি কখনও প্রমাণ পেয়েছ? তুমি তো দুবার হিমালয়ে এক্সপিডিশানে গেছ।
স্ট্রিন্ডবার্গ বলল, ইন্ডিয়াতে অনেক কিছুই প্রমাণ করা শক্ত। প্রমাণ না পেয়েও তো অনেক লোকে বিশ্বাস করে। সেটাও কি কম কথা? এই তো একটু আগে একজন লোক আমাকে বলল, এখানে কাছাকাছি কোনও মনাস্টারিতে নাকি চার-পাঁচজন লোক এখনও বেঁচে আছে, যাদের বয়েস তিনশো বছর?
কয়েকজন একসঙ্গে বলে উঠল, যাঃ, গাঁজাখুরি কথা। তিনশো বছর কোনও মানুষ বাঁচে?
স্ট্রিন্ডবার্গ দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলল, ভাবছ আমি বানাচ্ছি? এখানেই ফিলিপ তামাং নামে একজন লোক বলল, সে নিজের চোখে ওই তিনশো বছরের বুড়োদের দেখেছে। আমাকেও নিয়ে গিয়ে দেখাতে পারে।
একজন বলল, দেখলেই বা তুমি কী করে বুঝবে যে, তাদের বয়েস তিনশো বছর? বয়েস মাপার কোনও ইয়ার্ড স্টিক আছে নাকি?
ফ্রিল্ডবার্গ বলল, দেখলে একটা কিছু বোঝা যাবে নিশ্চয়ই। একশো বছরের বৃদ্ধ আর তিনশো বছরের বৃদ্ধদের চেহারা তো এক হতে পারে না।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, উজবেকিস্তানে একশো চল্লিশ বছর বয়স্ক একজন বুড়োর কথা একবার শোনা গিয়েছিল। তারচেয়ে বেশিদিন কোনও মানুষ বাঁচেনি। তিনশো বছর! হুঁঃ! তা হলে এর মধ্যে কতবার সেই বুড়োদের নাম উঠে যেত গিনেস বুক অফ রেকর্ডসে!
কাকাবাবু স্ট্রিন্ডবার্গকে জিজ্ঞেস করলেন, ম্যাক্স, তুমি ফিলিপ তামাং-এর সঙ্গে সেই বুড়োদের দেখতে যাচ্ছ?
স্ট্রিন্ডবার্গ চওড়াভাবে হেসে বলল, খুবই ইচ্ছে ছিল যাওয়ার। কিন্তু পরশুর মধ্যেই আমাকে স্টকলম ফিরতে হবে, জরুরি কাজ আছে। উপায় নেই। ইন্ডিয়ায় এলে আমার যেতে ইচ্ছে করে না। ফেরার তাড়া না থাকলে আমি কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকেও যেতাম একবার!
মঁসিয়ে জাকোতে বলল, এই তিনদিনের মধ্যে দার্জিলিং থেকে একবারও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা গেল না! কাঞ্চনজঙ্ঘার মহান, সুন্দর রূপ একবার অন্তত না দেখলে মন খারাপ লাগে। যাই বলল, উচ্চতায় তৃতীয় হলেও কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ এভারেস্টের চেয়েও বেশি সুন্দর।
স্ট্রিন্ডবার্গ বলল, তা ঠিক?
বড়দের মধ্যে কথা বলা উচিত নয় বলে সন্তু চুপ করে শুনছিল এতক্ষণ। এবার সে ফস করে বলে ফেলল, আমি আজ সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেছি।
সকলেই মুখ ফিরিয়ে তাকাল সন্তুর দিকে।
জাকোতে জিজ্ঞেস করল, আজ সকালে? কখন?
সন্তু বলল, এই তো, মাত্র আধ ঘন্টা আগে। আমি মিউজিয়ামের পেছন দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।
জাকোতে বলল, আমি অনেকবার বাইরে বেরিয়ে উকিঝুঁকি মেরেছি। দেখতে পাইনি তো?
ল্ডিবার্গ বলল, আধ ঘন্টা আগে আমিও ওইখানেই ছিলাম। আমিও দেখিনি। এখানে আর কেউ দেখেছে?
অন্য সবাই দুদিকে মাথা নাড়ল। নরেন্দ্র ভার্মা সত্তর পিঠে একটা চাপড় মেরে হাসতে হাসতে বলল, ও নিশ্চয়ই কল্পনায় দেখেছে। আমাদের এই ছোট বন্ধুটি অনেক কিছু বানিয়ে বলতে ভালবাসে। আজকের মতন মেঘলা দিনে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা অসম্ভব।
সবাই হেসে উঠল। সবাই ভাবল, সন্তু গুল মেরেছে।
সন্তুর মুখখানা লজ্জায় লাল হয়ে গেল। সে যে সত্যিই কাঞ্চনজঙ্ঘা একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট দেখেছে, তা তো আর প্রমাণ করা যাবে না। অন্য কেউ আর দেখেনি? সন্তু কি তবে কল্পনায় দেখেছে? তা মোটেই না!
হঠাৎ সন্তুর সারা গায়ে রোমাঞ্চ হল। তবে কি কাঞ্চনজঙ্ঘা শুধু সন্তুর জন্যই একটুক্ষণের জন্য মেঘের আড়াল সরিয়েছিল? আজকের আকাশ শুধু সন্তুর জন্যই এমন একটা উপহার দিল? নিশ্চয়ই তাই।
লজ্জার বদলে এবার অদ্ভুত এক আনন্দ হল সত্তর।
এখানকার আড্ডা চলল আরও কিছুক্ষণ। তারপর লাঞ্চ খাওয়ার ডাক পড়ল। বিশিষ্ট অতিথিদের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি লাঞ্চ খাবেন, কাকাবাবুও সেখানে আমন্ত্রিত। কিন্তু সন্তুর তো আর নেমন্তন্ন নেই, সে ফিরে গেল হোটেলের দিকে।
হোটেলে পৌঁছবার আগেই বৃষ্টি নামল খুব জোরে। এখানে সকলের কাছেই ছাতা থাকে। সন্তু ছাতা কিংবা রেনকোট কিছুই আনেনি। গাছতলায় দাঁড়িয়েও কিছু সুবিধে হল না, সে ভিজে গেল পুরোপুরি।
দৌড়ে দৌড়ে শপশপে ভিজে জামা-প্যান্ট নিয়ে পৌঁছল হোটেলে। এখানে তো ভিজে জামাকাপড় রোদুরে শুকোবার উপায় নেই। সন্তু তার কোটটা একটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল বাথরুমে। মোজা-জুতো সব খুলে ফেলার পর তার পরপর সাতবার হাঁচি হল।
খেয়েদেয়ে দুপুরে একঘুম দিল সন্তু। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে, আর বাইরে বেরোবার উপায় নেই। ঘুম থেকে ওঠার পরই সন্তু টের পেল, তার জ্বর এসে গেছে। নিশ্বাস পড়ছে গরম-গরম, জ্বালা করছে দুই চোখের কোণ।
বাইরে এসে সন্তুর কখনও অসুখ-বিসুখ হয় না। কাকাবাবু জানতে পারলেই ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। কাকাবাবুকে কিছুতেই জানানো চলবে না। একটু জ্বর হলে কী-ই বা আসে যায়!
জানলার কাছে দাঁড়িয়ে সন্তু দেখল, বাইরেটা অন্ধকার হয়ে এসেছে। যদিও মোটে সাড়ে চারটে বাজে, কিন্তু আজ আর রোদ ওঠার আশা নেই। বৃষ্টি পড়েই চলেছে। এরকম বৃষ্টি হলে দার্জিলিং-এ যখন-তখন ধস নামে। হিল কার্ট রোড বন্ধ হয়ে গেলে সন্তুরা কাল ফিরবে কী করে? সন্তুর অবশ্য ফেরার জন্য ব্যস্ততা নেই কিছু, তার কলেজ খুলতে এখনও সাতদিন বাকি আছে। কিন্তু কালকের প্লেনের টিকিট কাটা আছে।
কিছুই করার নেই, তাই সন্তু বই নিয়ে বসল। মহাভারত, না শার্লক হোসের গল্প, কোনটা এখন পড়া যায়? এই দুখানা বই-ই সন্তুর আগে একবার পড়া হয়ে গেছে। তবু আবার পড়তে ভাল লাগে। সে ইংরেজি বইটাই খুলল বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে।
দুপাতা শেষ করতে না করতেই আবার ঘুম এসে গেল সন্তুর। ক্রমেই তার জ্বর বাড়ছে।
সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল জোর শব্দে। কে যেন দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। সন্তু ধড়মড় করে উঠে দরজা খুলতে গেল। কোনও বেয়ারা এলে সাধারণত আস্তে টুকটুক করে শব্দ করে। এত জোরে দুম দুম করছে কে?
দরজা না খুলে সন্তু জিজ্ঞেস করল, হু ইজ ইট? বাইরে কাকাবাবুর গলা শোনা গেল। ৪৮৮
ভেতরে এসে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, কুম্ভকর্ণের মতন ঘুমোচ্ছিলি বুঝি? আমরা কতক্ষণ ধরে ডাকছি!
সন্তু তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গেল। কাকাবাবুর সঙ্গে তার গায়ের ছোঁয়া লাগলেই কাকাবাবু তার জ্বর বুঝে ফেলবেন।
কাকাবাবুর সঙ্গে এসেছেন নরেন্দ্র ভার্মা আর-একজন অচেনা লোক। নরেন্দ্র ভার্মা আলাপ করিয়ে দিল, ভদ্রলোকের নাম বীরেন্দ্র সিং, এখানকার একজন ব্যবসায়ী।
কাকাবাবু টেলিফোনে চা দিতে বললেন, একটু পরেই বেয়ারা এসে চা দিয়ে গেল। নরেন্দ্র ভামা নানারকম গল্প শুরু করলেন।সন্তুর কপালের দুটো পাশ দপদপ করছে, মাথাটা ভারী লাগছে, এখন তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। সে তার বিছানায় বসে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বই পড়ার চেষ্টা করল। তবে মাঝে-মাঝেই তার কান চলে যাচ্ছে কাকাবাবুদের কথাবাতার দিকে।
এক সময় বীরেন্দ্র সিং কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন, আপনার ভাঙা পা-টা সারিয়ে ফেলেন না কেন? আজকাল তো অনেক রকম চিকিৎসা বেরিয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, এর আর কোনও চিকিৎসা নেই। এখন আমার তেমন অসুবিধেও হয় না।
বীরেন্দ্র সিং বললেন, আপনার জুতোটা একটু খুলুন তো, আমি দেখি কী অবস্থা।
সন্তু চোখ তুলে কাকাবাবুর দিকে তাকাল। সে জানে, কাকাবাবু নিজের ওই ভাঙা পা বিষয়ে বেশি কথা বলা একেবারে পছন্দ করেন না। কাকাবাবুর বাঁ পায়ের পাতাটা একেবারে গুড়িয়ে গেছে, হাড় বলে কিছুই নেই। কোনও রকমে জুতো পরতে পারেন শুধু। দু পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন প্রায় বছরদশেক আগে।
কাকাবাবু বললেন, ও আর দেখে কী করবেন।
বীরেন্দ্র সিং তবু ঝুঁকে পড়ে যেন নিজেই হাত দিয়ে কাকাবাবুর জুতো খোলার চেষ্টা করলেন।
কাকাবাবু এবার পা সরিয়ে নিয়ে কড়া গলায় বললেন, ও ব্যাপারটা থাক। আপনি অন্য কথা বলুন।
বীরেন্দ্র সিং আবার সোজা হয়ে হাসি মুখে বললেন, একটা অদ্ভুত ব্যাপার দেখবেন?
যদিও শীত খুব বেশি নয়, তবু ভদ্রলোকটি পরে আছে একটা লম্বা ওভারকোট। ঘরের মধ্যে এসেও সেটা খোলেননি। বাঁ হাতটা এতক্ষণ একটা পকেটেই ছিল। এবার সেই হাতটা বার করলেন।
বীরেন্দ্র সিং-এর ডান হাতটা খালি কিন্তু বাঁ হাতে একটা পুরু ধরনের চামড়ার দস্তানা পরানো। সেই দস্তানাটা খুলতে-খুলতে তিনি বললেন, একবার আমার ফ্যামিলির সব লোকজনদের নিয়ে সিচল লেকের কাছে পিকনিক করতে গিয়েছিলাম, বুঝলেন। আমার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট ছেলেটা খুবই চঞ্চল আর দুষ্ট। একটা বড় পাথরের চাঁইয়ের ওপর উঠে সে নাচানাচি করছিল। আমরা অনেক বারণ করলেও সে শোনোনি। হঠাৎ দেখি কী, সেই পাথরটা গড়াতে শুরু করেছে। কোনও কারণে তলার জায়গাটা নিশ্চয়ই আলগা ছিল। সেই পাথরসুন্ধু আমার ছেলে গড়িয়ে পড়ে যেত পাশের খাদে। আমি ছুটে গেলাম ছেলেকে বাঁচাতে। ছেলে বাঁচল, কিন্তু বেকায়দায় আমার এই হাতটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। মটমট করে আঙুলের হাড়গুলো ভাঙার শব্দ আমি নিজে শুনেছি। শুনতে-শুনতেই যন্ত্রণার চোটে অজ্ঞান হয়ে গেছি।
গ্লাভসটা সম্পূর্ণ খুলে ফেলে তিনি বললেন, এখন দেখুন, সেই হাতটার কী অবস্থা।
বীভৎস দৃশ্য! সন্তু সেদিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল।
বীরেন্দ্র সিং-এর বাঁ হাতে শুধু বুড়ো আঙুল ছাড়া আর একটাও আঙুল নেই।
বীরেন্দ্র সিং বললেন, আঙুল চারটে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়ার পর পচতে শুরু করে। গ্যাংগ্রিন হয়ে গেল। অপারেশন করে চারটে আঙুলই বাদ দিতে হল। তবু ঘা সারে না। কলকাতায় গিয়ে অনেক চিকিৎসা করিয়েছি। সব ডাক্তারই বলেছে, এই হাতটার কবজি পর্যন্ত কেটে ফেলা উচিত। ভাগ্যিস, আমি ডাক্তারদের কথা শুনিনি। ভগবান তামাকে বাঁচিয়েছেন। রিমবিক বলে একটা জায়গা আছে জানেন তো, তার কাছাকাছি একটা মনাস্টারিতে আমি এক তিব্বতি তান্ত্রিকের সন্ধান পাই। তিনি অনেক কঠিন কঠিন রোগ সারিয়ে দিতে পারেন শুনেছিলাম। তাঁর পায়ে পড়তেই তিনি আমায় অভয় দিয়ে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। তিনিই আমাকে এই দস্তানাটা পরিয়ে দিলেন।
বীরেন্দ্র সিং বাঁ হাতে আবার দস্তানাটা লাগালেন। এই অবস্থায় দেখলে মনে হয়, ওর পাঁচটা আঙুলই আছে।
বীরেন্দ্র সিং বললেন,সেই তান্ত্রিক লামা আমাকে কোনও ওষুধ দেননি, শুধু এই হাতের ওপর মন্ত্র পড়ে দিয়েছেন। ব্যস, ঘা শুকিয়ে গেল। এখন আমি এই হাত দিয়ে পাঁচটা আঙ্গুলের কাজই করতে পারি। একদম নর্মাল।
নরেন্দ্র ভাম জিজ্ঞেস করলেন, এই হাত দিয়ে আপনি সব কাজ করতে পারেন?
বীরেন্দ্র সিং মুচকি হেসে বললেন, খালি হাতে পারি না, কিন্তু গ্লাভস পরা থাকলে কোনও অসুবিধে হয় না। এটা মন্ত্র-পড়া গ্লাভস। দেখবেন, এই গেলাসটা তুলে ধরব?
বীরেন্দ্র সিং সত্যিই একটা কাচের গেলাস তুলে ধরলেন বাঁ হাতে।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আশ্চর্য! এরকম আশ্চর্য ব্যাপার কখনও দেখিনি। দস্তানার আঙুলগুলোকে মনে হচ্ছে সত্যিকারের আঙুল। নইলে উনি গেলাসটা ধরে আছেন কী করে? কী রাজা, এটা আশ্চর্য ব্যাপার নয়?
কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, সত্যি খুব আশ্চর্য ব্যাপার।
বীরেন্দ্র সিং বললেন, আমাকে অবশ্য প্রতি দশদিন অন্তর রিমবিকের সেই তান্ত্রিক লামার কাছে যেতে হয়। তিনি নতুন করে মন্ত্র পড়ে দেন। কখনও ব্যবসার কাজে কলকাতা কিংবা দিল্লি গিয়ে যদি আটকে পড়ি, দশদিনের মধ্যে ফিরতে না পারি, অমনি হাতটা আবার দুর্বল হতে শুরু করে। আবার সেই লামাজির কাছে ছুটে গেলেই তিনি সব ঠিক করে দেন।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এরকম ঘটনা কখনও শুনিনি। সেই লামাজি আপনার কাছ থেকে টাকাপয়সা নেন কিছু? চিকিৎসার ফি?
বীরেন্দ্র সিং বললেন, কিছু না! উনি কিছুই চান না। আমি শুধু প্রত্যেকবার ওঁর জন্য এক ঝুড়ি ফল নিয়ে যাই। যে সিজনের যে ফল পাওয়া যায়।
নরেন্দ্র ভার্মা কাকাবাবুকে বললেন, রাজা, তুমি একবার ওই তান্ত্রিক লামার কাছে তোমার পা-টা দেখাও না! উনি যদি সারিয়ে দিতে পারেন…
কাকাবাবু বিশেষ আগ্রহ না দেখিয়ে বললেন, এবারে তো আর হবে না। আমরা কালকেই ফিরে যাচ্ছি।
বীরেন্দ্র সিং বললেন, কালকের ফেরা ক্যানসেল করুন। আমি আপনাকে রিমবিক নিয়ে যাব। আমার দু-একদিনের মধ্যেই যাওয়ার কথা। আমি ডেফিনিট যে উনি আপনার পা ঠিক করে দেবেন।
কাকাবাবু বললেন, আমার পা ঠিক হয়ে গেলেও তো মুশকিল। তারপর আমাকে প্রত্যেক দশদিন অন্তর দার্জিলিং আসতে হবে? নাকি দার্জিলিং-এ এসেই পাকাপাকি থাকব?
বীরেন্দ্র সিং বললেন, তখন দার্জিলিং-এ এসেই পাকাপাকি থাকবেন। এটা কত সুন্দর জায়গা। কলকাতা ঘিঞ্জি, ময়লা! আমার তো কলকাতা গিয়ে একদিন দুদিনের বেশি থাকতে ইচ্ছে করে না।
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার তবু কলকাতাই ভাল লাগে। কলকাতা ছেড়ে বেশিদিন দূরে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব। তা ছাড়া, কাচ নিয়ে হাঁটাচলা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন আর কোনও অসুবিধে হয় না। শুধু পাহাড়ি রাস্তায় উঠতে কষ্ট হয়। সেইজন্যই আর পাহাড়ে বেশি আসি না।
নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা, তবু একবার ট্রাই নিয়ে দেখলে পারতে! বীরেন্দ্র সিং যা বললেন, তাতে তো মনে হচ্ছে মিরাকুলাস কিওর। ওই তান্ত্রিক লামার নিশ্চয়ই কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে।
কাকাবাবু বললেন, আমি অলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার থেকে দূরেই থাকতে চাই।
আচ্ছা ভাঙল রাত নটায়। ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু আর নীচের ডাইনিং রুমে না গিয়ে ঘরেই রাত্তিরের খাবারের অর্ডার দিলেন। সন্তুর মাথায় এত যন্ত্রণা হচ্ছে যে, খাবার ইচ্ছে একটুও নেই। কিন্তু কিছু না খেলে কাকাবাবু সন্দেহ করবেন। সন্তুর কপালে হাত দেবেন। তাই সে খেতে বসল। কিছুটা খেয়েও নিল।
এর পর কাকাবাবু ডায়েরি লিখতে বসলেন টেবিলে। বড়বড় বৃষ্টির ফোঁটার চটপট শব্দ হচ্ছে কাচের জানলায়। সন্তু শুয়ে পড়ল লেপ মুড়ি দিয়ে। জ্বরের চোটে তার সারা শরীরে কাঁপুনি ধরে গেছে। কিছু একটা ওষুধ খাওয়া উচিত ছিল বোধ হয়। যাক, কাল দুপুরের মধ্যেই তো কলকাতার বাড়িতে পৌঁছে যাচ্ছে ওরা। তখন ডাক্তার দেখালেই হবে।
এত জ্বরের মধ্যে ভাল ঘুম আসে না। নানারকম দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল সন্তু। বৃষ্টিতে ধস নেমেছে, রাস্তা ভেঙে পড়েছে অনেকখানি, তিন-চারদিনের মধ্যে কলকাতায় ফেরা হবে না…একটা বিরাট পাথরের চাঁই গড়িয়ে আসছে উঁচু পাহাড় থেকে, এই হোটেলটাকেও ভেঙে চুরমার করে দেবে.কেইন শিপটন হাসছে হা-হা করে, তার গলার লকেটে দুলছে একটা মস্ত বড় মানুষের দাঁত, সে একটা মাছধরা জালের মতন স্টিলের জাল ছুঁড়ে কাকাবাবুকে আর তাকে বন্দী করে ফেলল, তারপর অট্টহাসি দিয়ে বলল, এবার সন্তু আর রাজা রায়চৌধুরী। এবার তোমরা কোথায় পালাবে?…একটা হাত এগিয়ে আসছে সন্তুর মুখের দিকে, সেই হাতের পাঞ্জায় শুধু বুড়ো আঙুল ছাড়া আর অন্য আঙুল নেই, তবু সেই হাতটাই সন্তুর গলা টিপে ধরছে…