দশ
খাওয়াটা বেশ জবরদস্ত হল। সেই কতকাল আগে এমন মৌজ করে লুচি ছোলার ডাল খেয়েছিলুম। সেইসব চরিত্র আমার জীবন ছেড়ে চলে গেছে। স্নেহ করার মতো আর কেউ নেই। বই শেষ, মলাট বন্ধ। আঁকাবাঁকা নদীর মতো। এক বাঁকে দাঁড়ালে আর একটা বাঁক দেখা যায় না। মনে হয়, নদী বুঝি এই বাঁকেই শেষ! তা কি হয়? সাগরে না গেলে শেষ হবে কী করে?
দেবুদা তার সেই বিখ্যাত পাইপ ধরিয়েছেন। বিদঘুটে গন্ধ।
‘ওই বিদিকিচ্ছিরি জিনিসটা ধরালে কেন?’
‘এটা আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী।’
‘সিগারেট খেলে কী হয়?’
‘সিগারেট মেয়েরা খায়। কোনো ব্যক্তিত্ব নেই।’
‘গন্ধটা অসহ্য।’
‘চার্চিল যে চুরুট খেতেন, সেই রকম একটা চুরুট ধরালে কী করতিস? যা, মোড়ের থেকে জর্দা পান কিনে আন। তুই খাবি তো?’
‘আমি পান খাই না।’
‘পান খাবি না, পাইপ খাবি না, আর কতকাল নাবালক হয়ে থাকবি। এই বেলা একটা নেশা ধরে ফেল, ভালো থাকবি। আজ আমার অনুরোধে একটা পান খেয়ে দেখ।’
‘পয়সা দাও, তোমাকে এনে দিচ্ছি। আমাকে অনুরোধ কোরো না।’
রাস্তায় নামতেই অপূর্ব দৃশ্য। শবদেহ নিয়ে একদল মানুষ মিছিল করে শ্মশানে চলেছে। বড়ো বড়ো পদ্ম দিয়ে সাজানো খাট। ধূপের গন্ধ। মৃদু হরিধ্বনি। বেশ বড়ো একজন কেউ মারা গেছেন। মহা আরামে শুয়ে আছেন। শব মিছিল দেখলেই আমার পিছু পিছু যেতে ইচ্ছে করে। ব্যাপারটার মধ্যে ভীষণ একটা পবিত্রতা আছে। চিতাই হল সত্য। নদী যায় সাগরে, মানুষ যায় চিতায়। লকলকে আগুন। শত শত জিভ।
একজনকে জিজ্ঞেস করলুম, ‘কে গেলেন ভাই?’
‘আরে আমাদের বিখ্যাত অভিনেতা মৃণাল চৌধুরী। হার্ট অ্যাটাক।’
‘কে কে আছেন পরিবারে?’
‘কেউ নেই। শিল্পীদের সাধারণত কেউ থাকে না।’
ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে চলেছি। ‘কত বয়েস হয়েছিল?’
‘বেশি না, ফিফটি ফাইভ। নতুন নাটকের রিহার্সাল চলছিল। হঠাৎ হার্টে মারল রক্তের চোট। ডাক্তার ডাকারও সময় পাওয়া গেল না। শিল্পীরা এই ভাবেই যায়। বেপরোয়া জীবন, বেপরোয়া মৃত্যু। মৃণালদার অভিনয় দেখেছো?’
‘আমি তো থিয়েটার দেখি না।’
‘তা কেন দেখবে? হিন্দি সিনেমা দেখবে। আমি মৃণালদার সঙ্গে তিনটে নাটক করেছি। অসাধারণ অভিনেতা, মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে দিতেন। এইবার আমাদের কী হবে। আমরা কোথায় যাবো!’
ভদ্রলোক কাঁদছেন। আমারও কান্না পেয়ে গেল। প্রতিভার মৃত্যু।
মোড়ের দোকান থেকে ঝট করে একটা পান কিনে ছুটতে ছুটতে ফিরে এলুম।
দেবুদা বললেন, ‘কী রে, হাঁপাচ্ছিস কেন?’
‘ছুটতে ছুটতে এলুম, আমাকে এখন শ্মশানে যেতে হবে।’
‘কেন?’
‘বিখ্যাত অভিনেতা মৃণাল চৌধুরী মারা গেছেন।’
‘মৃণাল মারা গেল। নিয়ে যাচ্ছে দেখলি?’
‘হ্যাঁ, অনেক লোক প্রচুর ফুল।’
‘তাহলে চল, আমিও শ্মশানে যাবো। পানটা থাক। এসে খাওয়া যাবে। মৃণাল আর আমি একই ক্লাসে পড়তুম, আমার ক্লাসফ্রেন্ড। কলেজেও পড়েছি একসঙ্গে। ঘোষেদের বাগানে একসঙ্গে কালবৈশাখীর আম কুড়িয়েছি। ওদের বাড়ির বড়ো মেয়ে সুধার সঙ্গে মৃণালের প্রেম হয়েছিল। সুধার বাবা সুধাকে এখান থেকে সরিয়ে দিল। সুধা আত্মহত্যা করল। সুধার বাবা হরেন ঘোষ আধপাগলা হয়ে গেল। ছোটো ভাই নগেন ঘোষ বিষয়সম্পত্তি, ব্যাবসা সব মেরে দিলে। মৃণাল নাটকের লাইনে এসে খুব নাম করলে। আর সুধার বাবা আর মাকে নিজের কাছে রেখে সেবা করতে লাগল। নগেন ঘোষ রটিয়ে দিলে, হরেন ঘোষের বউয়ের সঙ্গে মৃণালের অবৈধ সম্পর্ক হয়েছে, তা না হলে এত আদর করবে কেন? মৃণালের কাছে নিন্দা ও স্তুতি দুটোই ছিল সমান। জীবনে অভিনয় ছাড়া কোনো কিছুকেই পাত্তা দেয়নি মৃণাল। সে বলত, সুধার বাবা—মা আমারও বাবা—মা। মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবেছিল বলেই না এই দুর্যোগ! সত্যিই তো, আমার সঙ্গে বিয়ে হলে সুধা কি সুখী হত? আমি ছিলুম ওদের জীবনের অভিশাপ। আমার জন্যেই সংসার ছারখোর হয়ে গেল। নগেন তো নিমিত্ত মাত্র। মৃণালের স্নেহে ও সেবায় হরেন ঘোষ সুস্থ হয়েছিল। মৃণালের বোলবোলার সময় মৃণালের ম্যানেজার হয়েছিলেন। ভদ্রলোকের দক্ষতার অভাব ছিল না। আবার একটা ব্যাবসা ফাঁদলেন। নগেন ঘোষ জোচ্চরটাকে ব্যাবসার জগৎ থেকে দূর করে দিলেন। সুধার নামে একটা মেয়েদের স্কুল করে দিলেন, কলকাতার হাসপাতালে পাঁচটা বেড। মৃণালের জীবনটা খুব সুখের হয়েছিল।’
‘নিজের মা—বাবা?’
‘গোঁড়া পরিবার। নাটুকে ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। পরিচয় দিতে লজ্জা পেতেন।’
‘নিজের চরিত্র কেমন ছিল?’
‘চরিত্র বলতে তুই কী বুঝিস?’
‘আমার ঠাকুর যা বুঝতেন।’
‘গিরিশ ঘোষকে বলতেন ভক্তের ভক্ত। মদ মেয়েছেলে দুই—ই ছিল।’
‘আবার তাঁর ঠাকুরও ছিল। সেটা ছাড়া গিরিশ কিছুই নয়।’
‘মৃণালের মা ভবতারিণী ছিল। মা কালীর উপাসক। নিজে কালীপুজো করত। শেষটা তো প্রায় সাধকের জীবনই হয়ে গিয়েছিল। যাকে যা বলত তাই ফলে যেত। স্টেজে এসে দাঁড়ালে দর্শকরা স্তব্ধ হয়ে যেত। ঠাকুর কী বলতেন, যার সম্মোহিনী শক্তি আছে, যাকে পাঁচজনে মানে, তার মধ্যেও শক্তির জাগরণ হয়েছে, সে—ও সাধক।’
আমরা শ্মশানের পথ ধরলুম। ফুল ফেলতে ফেলতে চলে গেছেন মৃণাল চৌধুরী। বাঁচা, সাফল্য, যশ, খ্যাতি, প্রতিভা পাঁপড়িতে ঝরে গেছে। দু—পাশের বাড়ির দেয়ালে লেগে আছে ধূপের সৌরভ।