কলকাতায় ফিরিয়ে আনার পর
কলকাতায় ফিরিয়ে আনার পরও অতনু পুরোপুরি সুস্থ হল না। ট্রেনে যখন রবি তাকে ফিরিয়ে আনে, তখন সে প্রায় অর্ধ-উন্মাদ। কিছুতেই আশ্রমের হাসপাতাল ছেড়ে আসতে চায় না। বার বার বলতে লাগল, আমি কোথায় যাচ্ছি? কলকাতায় আমার কে আছে?
নিজের বাড়িতে এসেও সে কোন দিকে সিঁড়ি, বাথরুমের দরজা ভুলে গেছে। চন্দনা তখনও ফেরেনি।
দো-তলা বাড়ি, এক পিসি আর পিসতুতো ভাই থাকে। পিসিই সংসার চালান। চন্দনা অতনুর ব্যবসার সক্রিয় অংশীদার, নিয়মিত অফিস করে, কাজের জন্য তাকে বাইরেও যেতে হয়। ব্যবসার মালিকানা তাদের দুজনের সমান সমান। চন্দনার এক ভাই বসন্তকে ম্যানেজার করা হয়েছে, সে অবশ্য বেতনভোগী।
বুলেটের আঘাতজনিত ক্ষত অংশটা সেরে গেছে। কিন্তু মানসিক বিষয়টা সে কিছুতেই সামলাতে পারছে না। মাঝে মাঝেই সে দেখতে পায়, দরজার কাছে দাঁড়ানো একটা লম্বা লোক রিভলবার তাক করে সোজাসুজি গুলি করছে তাকে। সে মরে যাচ্ছে। এই ছবিটা দেখার পরই তার চিন্তার জগৎ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। আবার দু-তিন দিন পর সে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে, ঠিকঠাক কথা বলে।
চন্দনা ফেরার আগেই রবি অতনুকে নিয়ে গেল এক জন বিশিষ্ট মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি অতনুকে পরীক্ষা করলেন তিন দিন ধরে। তারপর রায় দিলেন যে এটা একটা সাইকো সোমাটিক ব্যাপার, তার কোনও চিকিৎসা নেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা। মাঝে মাঝে সে সুস্থ হয়ে ওঠে, সেটাই আশার লক্ষণ।
মহুলডেরার কথা একেবারেই ভুলে গেছে অতনু। সেখানকার বাড়িটার প্রসঙ্গ উঠলেই সে চোখ কুঁচকে থাকে। মহুলডেরা কী, কোথায়, কেন সেখানে বাড়ি কেনা হয়েছিল।
চেকসই করতে বললে, সে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। বার বার তাকে তার নামটা মনে করিয়ে দিতে হয়। দেখানো হয় তার আগেকার সই। তারপর অবশ্য সে ঠিকঠাক সই করে দেয়, তবে আগেকার মতো সে টাকা তোলার কারণটা খুঁটিয়ে জানতে চায় না।
চন্দনা এসে পৌঁছবে সামনের শনিবার। গিয়েছিল এক মাসের জন্য, বিয়েবাড়ি ছাড়াও সে ও-দিককার প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে অফিসের প্রচারের কিছু কাজ করে আসবে। অতনুকে গুলি করার ব্যাপারটা তাকে জানানো হয়নি, বলা হয়েছিল গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট, তা-ও মারাত্মক কিছুনয়।
চন্দনা সম্পর্কেও অতনুর স্মৃতি খুব দুর্বল, তা বুঝতে পেরে রবি চন্দনার অনেকগুলি ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে নানা গল্প বলতে লাগল। ওদের বিয়ের সময় কত মজা হয়েছিল, বিয়েবাড়িতে শর্ট সার্কিট, হঠাৎ অন্ধকার। তারপর একবার দল বেঁধে সবাই মিলে যাওয়া হয়েছিল কালিম্পং, অক্টোবর মাস, আচমকা একদিন বরফ পড়তে শুরু করল। এ-রকম কখনও হয় না। অভাবনীয় সেইদৃশ্য, সব সাদা, তার কত ছবি রয়েছে অ্যালবামে। ঘোড়ায় চড়া অতনু আর চন্দনা পাশাপাশি।
চন্দনাকে এয়ারপোর্ট থেকে আনতে গেল রবি আর বসন্ত। অতনুকে আর সেখানে নেওয়া হল না।
বাড়িতে এসে চন্দনা যখন দেখল, অতনু শয্যাশায়ী নয়, গাড়ির শব্দ শুনে নেমে এসেছে নিচে, তাতেই সে আশ্বস্ত হল। এর আগে পর্যন্ত সে দুর্ঘটনার গভীরতাটা কতখানি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।
ঘণ্টা খানেক পর, চা-টা খেয়ে, শয়নকক্ষে এসে স্বামীর সঙ্গে নিভৃতে মুখোমুখি হয়ে সে জানাল তার নিজেরই একটা দুর্ঘটনার কথা।
এই দম্পতির এখনও সন্তান হয়নি। বিয়ে হয়েছে আট বছর। এর মধ্যে মিসক্যারেজ হয়ে গেছে দু’বার। এবারে বার্লিন যাত্রার সময়ও চন্দনা গর্ভবতী ছিল চারমাসের, দু’জন ডাক্তার ভরসা দিয়েছিলেন, এবারে গণ্ডগোলের কোনও সম্ভাবনাই নেই। দুই ডাক্তারই বলেছিলেন, তার বিদেশে ঘুরে আসারও কোনও বাধা নেই। এরকম অনেকেই যায়।
তবু এবারেও গর্ভপাত হয়ে গেল ওখানে থাকার সময়েই। বলতে বলতে কান্না এসে গেল চন্দনার। অতনুর হাত জড়িয়ে ধরে সে বলল, তোমাকে ওখান থেকে এ খবর জানাইনি। একেই তো তুমি নিজে অসুস্থ, এটা শুনলে আঘাত পাবে, আমাদের কী হল বলো তো? এরপর কি আর কখনও…
অতনুর আঘাত পাবার কথা, কিন্তু তার মুখ ভাবলেশহীন। অবশ্য শোকে-দুঃখে তো মানুষ পাথরও হয়ে যায়। নীরবে বসে থাকে।
অতনুর কোলে মুখ গুঁজে চন্দনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল, অতনু হাত বুলিয়ে দিল তার মাথায়।
জার্মানিতে রক্তক্ষরণের পর চন্দনাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল মাত্র দু’দিন। তারপর স্বাভাবিক ভাবে ঘোরাফেরা করেছে। কিন্তু ফিরে এসে বেশ দুর্বল হয়ে পড়ল, নিজেই সে শয্যাশায়ী রইল চার দিন।
অতনুর ব্যবহার যে স্বাভাবিক নয়, তা বুঝতে চন্দনার এক দিনও সময় লাগেনি। সে চলাফেরা করতে পারে, ঠিকমতো খায়-দায়, অথচ বাড়ি থেকে বেরোয় না। অফিসেও যায় না। সারা দিনই প্রায় চুপ করে থাকে।
দুজনেই অফিসে না গেলে ব্যবসা চলবে কী করে? ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসায় যেমন প্রতিযোগিতা, তেমনি একটি দিনের জন্যও রাশ আলগা করা যায় না। একটু সুযোগ পেলেই অন্য কোম্পানি তাদের ক্লায়েন্ট ভাঙিয়ে নেবে।
চার দিনের মধ্যে জেট ল্যাগ ও বিষাদ কাটিয়ে উঠে নিজেকে তৈরি করে নিল চন্দনা।
পঞ্চম দিন সকালে উঠেই সে অতনুকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সঙ্গে আজ অফিস যাবে?
অতনু মাথা নেড়ে বলল, না। আমার জ্বর হয়েছে।
চন্দনা কাছে এসে তার কপালে হাত দিয়ে দেখল, কোনও তাপ নেই।
সে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। একটা অ্যাসপিরিন খেয়ে নিয়ো।
সে-দিন সে যথাসময়ে অফিসে গিয়ে ফিরল সাতটার পর।
দো-তলার বারান্দায় আলো না জ্বেলে একটা ইজি চেয়ারে চুপ করে বসে আছে অতনু। শীত পড়ে গেছে, তবু গায়ের চাদরটা লুটোচ্ছে মাটিতে।
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার মুখোমুখি বসে পড়ে চন্দনা জিজ্ঞেস করল, তোমার গাড়ির অ্যাকসিডেন্টের গল্পটা বানানো, তাই না?
অতনু আলগা ভাবে বলল, গাড়ির অ্যাকসিডেন্ট?
চন্দনা বলল, তোমাকে উগ্রপন্থীরা গুলি করেছিল?
অতনু এবার বেশ খানিকটা গলা চড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে লম্বামতো এক জন আমাকে সোজাসুজি গুলি করেছে। আমি মরে গিয়েছিলাম, আবার বেঁচে উঠেছি।
চন্দনার গায়েই যেন গুলি লেগেছে, এইভাবেই সে বলল, ও, ও, কী সাংঘাতিক ব্যাপার। তোমার ওই বন্ধুটা, রবি, গাদা গাদা মিথ্যে কথা বলে। আমাকে কিছু জানায়নি। আমি ভেবেছিলাম, গাড়ির অ্যাকসিডেন্টে তোমার মাথায় চোট লেগেছিল। তাই এ-রকম হয়েছে। এ তো আরও সিরিয়াস। কোথায় গুলি লেগেছিল? স্পাইনাল কর্ডে?
না। বুকে।
বুকে? ও মা, এখনও ব্যথা আছে?
ব্যথা আছে।
পরদিনই চন্দনা দু’জন স্পেশালিস্ট ডাক্তারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ফেলল। সে বিয়ের আগে থেকেই স্বাবলম্বিনী ধরনের নারী। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও অতনু ছিল বুদ্ধিজীবী, সে যতটা বাক্যবাগীশ, অতটা কার্যে উদ্যোগী নয়। চন্দনা একা সব কাজের ভার নিতে পারে, নিজেই যে কোনও ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। অনেক খরচ করে ডাক্তার দেখিয়েও উপকার হল না বিশেষ কিছুই। তবু এই ধরনের পরিবারে চিকিৎসার জন্য টাকা খরচ করা একটা বড় ব্যাপার। আত্মীয়-বন্ধুরা বুঝবে যে, অবহেলা করা হয়নি।
চন্দনা একদিন বলল, আমার একটা কথা শুনবে, অতনু?
বলো।
তুমি আমার সঙ্গে এক দিন বেলুড় মঠে যাবে? ওষুধপত্রে অনেক সময় কাজ হয় না। কিন্তু উচ্চমার্গের সাধকদের আশীর্বাদ পেলে অনেক সময় কাজ হয়। এটাকে ফেইথ হিলিং বলো কিংবা যা-ই বলো, কিন্তু কাজ হয়। সত্যি হয়, আমি দু-একজনের ব্যাপার জানি। মাধবানন্দ মহারাজের সঙ্গে আমার চেনা আছে।
অতনু বলল, ফেইথ হিলিং! যার ফেইথ নেই? মঠ, মন্দির, আশ্রম, না-না, ওইসব জায়গায় যেতে আমার ভয় হয়।
ভয় হয়? কেন, ভয় হবে কেন?
যদি আমি গেলে ওই সব জায়গা অপবিত্র হয়ে যায়? আমি একটা খারাপ লোক। চন্দনা, ও-সব জায়গায় আমার মতো মানুষদের যেতে নেই।
চন্দনা হেসে বলল, তুমি খারাপ লোক হবে কেন? আজ তো তুমি বেশ ভালই কথা বলছ। তোমাকে গুলি করার পর তো মহুলডেরার একটা আশ্রমের হাসপাতালেই তোমার চিকিৎসা হয়েছে।
কী জানি। মনে নেই। একটা হাসপাতাল ছিল নিশ্চয়ই।
আমাদের অফিসের সবাই জানে, শুধু আমিই জানতাম না। ওই রবি আমাকে কিছু বলে না।
রবি কোথায়? সে আর আসে না কেন?
কী জানি! যা বাউণ্ডুলে স্বভাব! কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে! লক্ষ্মীটি, আমার সঙ্গে একবার চলো বেলুড় মঠে। তোমাকে কিছু করতে হবে না, তুমি চুপ করে বসে থাকবে।
না।
ঠিক আছে, আমি একলাই যাব। তোমার হয়ে আমি আশীর্বাদ নিয়ে আসব। শোনো, আর একটা কথা। মহুলডেরার বাড়িটা নিয়ে কী করা যায় বলো তো? শুধু শুধু বাড়িটা পড়ে থাকবে?
বাড়ি? বিশ্বাস করো, সে-বাড়ির কথা আমার একেবারেই মনে নেই।
অথচ সেই বাড়িতেই তোমাকে গুলি করা হয়েছিল। আশ্চর্য! মনে পড়বে, ঠিক আস্তে আস্তে মনে পড়বে। ডক্টর দেব বলেছেন। ছ’মাস, এক বছরও লাগতে পারে। আজকে ট্রেড উইন্ডের মালহোত্রা আমাকে কী বললেন জানো? বললেন, মিসেস হালদার, আপনাদের মাথা খারাপ হয়েছে? ওইরকম জায়গায় অতগুলো টাকা ইনভেস্ট করতে গেছেন। বিহার-বাংলা বর্ডারে উগ্রপন্থীদের হানা দিন দিন বাড়ছে। ওখানে গেস্টহাউস বানালে এখন কে যাবে? লোকে গাড়ি নিয়ে ওই সব জায়গা দিয়ে পাস করতেই ভয় পায়। এখন একমাত্র ভরসা সাউথ বেঙ্গল। মোটামুটি পিসফুল। আমি বললাম, কিন্তু সাউথ বেঙ্গলে তো পাহাড় নেই, বাঙালিরা পাহাড় ভালবাসে। উনি বললেন, পাহাড় নেই, কিন্তু সুন্দরবন আছে, সমুদ্র আছে। এমনকী শান্তিনিকেতনেও একটা কিছু করা যায়। ওখানে এখন অনেক লোক যাচ্ছে। সত্যি, মহুলডেরায় আমাদের সাড়ে চার লাখ টাকা ইনভেস্টমেন্ট কি জলে যাবে? এতগুলো টাকা, সামলাব কী করে?
এতগুলো কথা বোধহয় মন দিয়ে শুনলই না অতনু। সে বলল, ডাক্তাররা আমাকে ড্রিঙ্ক করতে বারণ করেছেন। তা কি মানতেই হবে? বাড়িতে কিছু রাখোনি?
চন্দনা বলল, অন্তত ছ’মাস বন্ধ। অ্যালকোহলে উলটো এফেক্ট হতে পারে। বাড়িতে কিছু রাখিনি, দেখছ না, আমিও কিছু খাচ্ছি না।
চন্দনা মাঝে মাঝে অতনুকে সঙ্গ দেবার জন্য ভদকা কিংবা বিয়ার খেয়েছে প্রায় নিয়মিতই। এখন সে-ও সংযম দেখাচ্ছে।
টানা আড়াই মাস অতনুর সেবা-যত্ন এবং মানসিক পরিচর্যা করার পর ধৈর্য হারিয়ে ফেলল চন্দনা।
এক জন মানসিক রোগীর সঙ্গে ঘর করা খুবই শক্ত। একটা মানুষ মাঝে মাঝে দু-তিন ঘণ্টা বেশ ভাল ও স্বাভাবিক থাকে, আবার হঠাৎ হঠাৎ এ-রকম দিনের পর দিন সহ্য করা যায় না। এক সময় মনে হয়, পুরোটাই বুঝি অতনুর ভান কিংবা অভিনয়। দায়িত্ব এড়াবার চেষ্টা।
এখন তো আবার সে অনেক বই-টই পড়ছে। পাগলরা কি বই পড়ে? পড়লেও বোঝে?
সংসার আর অফিস, দুটোই সামলাবে চন্দনা? সে আর পারছে না। শুরু হয়ে গেল খিটিমিটি।
সে এখন জোর করে অতনুকে অফিসে নিয়ে যায়।
দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিটে অফিস। মোটামুটি বড়ই, তেইশ জন কর্মচারী। স্বামী ও স্ত্রীর আলাদা চেম্বার। অতনু এত দিন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ও প্ল্যানিং দেখেছে। বাকি পড়ে গেছে অনেক কাজ। কিন্তু অদ্ভুত এক ক্লান্তি পেয়ে বসেছে অতনুকে। সে শুধু বসে বসে সিগারেট টানে, আর চুপ করে চেয়ে থাকে সামনের দিকে।
মাঝে মাঝে তার মনোজগতে বিরাট তোলপাড় চলে। কী যেন একটা চাপা পড়ে যাচ্ছে ভেতরে, কিছুতেই উপরের দিকে আসছে না। সে তার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকুনি দেয়।
আগে অন্য সব কর্মচারীর সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল বন্ধুর মতো। যে কেউ যখন তখন আসত তার চেম্বারে। এখন তারা কী যেন বুঝে গেছে, না ডাকলে আসে না কেউ। একমাত্র তার শ্যালক এবং ম্যানেজার বসন্ত ছাড়া। বসন্ত কী সব তাকে বোঝায়, সে হাঁ-হাঁ করে বলে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যা ভাল বোঝো, করো।
বাড়িতে এখন প্রত্যেক দিন ঝগড়া হয় চন্দনার সঙ্গে। অনেকটা একতরফা, চন্দনাই বেশি অভিযোগ করে, সে একটা-আধটা উত্তর দেয়। চন্দনার অভিযোগের তালিকা সুদীর্ঘ। আসল কারণ কিন্তু একটাই, দাম্পত্যের মূল সম্পর্ক। একই শয্যায় দু’জনে রাত্রিবাস করে বটে, কিন্তু শরীর বিচ্ছিন্নই থাকে।
অতনুর দিক থেকে কোনও সাড়া নেই।
তিন-তিনবার গর্ভনষ্ট হয়ে গেছে চন্দনার, কিন্তু সন্তান কামনায় একটা চাপা কান্না রয়ে গেছে তার বুকের মধ্যে। সেই কান্না কখনও-কখনও আর্তনাদ হয়ে ওঠে।
তিনবার এ-রকম হবার পরেও কি আর সন্তান-সম্ভাবনা থাকে! কারওর কি দোষ আছে! এক সঙ্গে গিয়ে ডাক্তারের পরামর্শও নেয়া হয়েছে, কারওরই কোনও খুঁত নেই। এবং আবার সন্তান সম্ভাবনা তো হতেই পারে!
তবু চন্দনার ধারণা, দোষটা অতনুর। শুধু তো জৈবিক ব্যাপার নয়। একটা ইচ্ছাশক্তি থাকা দরকার। অতনুর যে সেটাই নেই। সন্তান না হওয়াটাও যেন সাধারণ ব্যাপার। আর এখন তো শরীরও জাগে না।
এক দিন চন্দনাই জিজ্ঞেস করল, তোমার আর ইচ্ছে করে না?
অতনু বলল, হ্যাঁ, ইচ্ছে করে।
তারপর সে যা করল, তা একেবারে হাস্যকর।
সে চন্দনাকে জোরে আঁকড়ে ধরল। তারপর সেইভাবেই নিস্পন্দ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। চন্দনা গায়ে একটা খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করল, এই, কী হল? হু-হু করে কেঁদে ফেলল অতনু।
এই কান্নায় সহানুভূতি হয় না, মায়া হয় না, রাগ হয়। বিছানা ছেড়ে উঠে গেল চন্দনা। পরদিন থেকে সে অন্য ঘরে শোয়।
ঠিক দু’মাস পরে, এক ছুটির দিনে চা-টা খাবার পর চন্দনা বলল, শোনো, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আজ মাথার ঠিক আছে তো? যা যা বলব, বুঝতে পারবে?
অতনু মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
চন্দনা বলল, সামনের সপ্তাহে আমি আবার জার্মানি চলে যাচ্ছি।
জার্মানি? কেন?
ওখানে আমি একটা চাকরি পেয়েছি। আমি আর এ-দেশে থাকব না, আমাদের কোম্পানিটা তো ডুবতে বসেছে, এটাকেও আর সামলানোর ক্ষমতা আমার নেই। আমার শেয়ারটা আমি বিক্রি করে দিতে চাই। এখনই দিচ্ছি না, পরে সেই রকমই একটা কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি চেষ্টা করে দেখো, যদি চালাতে পারো।
অতনু আলতো গলায় বলল, তুমি চলে যাবে?
চন্দনা বলল, হ্যাঁ। আমার এখানে অসহ্য লাগছে। আমি হাঁপিয়ে উঠছি। তুমি বিশ্বাস করো, অতনু। আমি অ্যাডজাস্ট করার অনেক চেষ্টা করেছি। এখন বুঝেছি, তা আর সম্ভব নয়। নাউ আই অ্যাম ফেড আপ। আমাদের কনজুগাল লাইফ শেষ হয়ে গেছে।
অতনু বলল, আমি জানি না, কেন আমি একটা জলে আধডোবা জাহাজের মতো, কিছুতেই ঠিক হচ্ছে না। গুলিতেই আমার পুরোপুরি মরে যাওয়া উচিত ছিল।
চন্দনা বলল, আমি তোমাকে একটা সাজেশন দেব, অতনু কোম্পানি তুমি বিক্রি করে দাও, আমার শেয়ারের টাকাটা তুমি পরে দিয়ে দিয়ো। আপাতত তুমি কোনও একটা নার্সিংহোমে গিয়ে থাকো। যত দিন না তুমি পুরোপুরি সুস্থ হও। এখানে কে তোমার যত্ন করবে?
অতনু বলল, বিক্রি? দেখি।
চন্দনা চলে যাবার পর সত্যিকারের বিপদে পড়ে গেল অতনু।
একটা লোকসানে চলা কোম্পানি বিক্রি করতে চাইলেই তো হুট করে বিক্রি হয় না। একটা অফিস ইচ্ছে করলে হঠাৎ বন্ধ করা যায় না। আরও লোকসান দিয়েও চালিয়ে যেতে হয়। এতগুলো কর্মচারীকেও বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া যায় না।
অতীত স্মৃতি ফিরে না এলেও বর্তমান সম্পর্কে অনেকটা সজাগ হয়ে গেল অতনু। সে সচ্ছল পরিবারের সন্তান, কখনও টাকা-পয়সার অভাব বোধ করেনি। ব্যবসাটাও এক সময় বেশ ভালই দাঁড় করিয়েছিল। এখন প্রতি দিন অর্থচিন্তা। পেটের ভাতে টান পড়লে পাগলামিও ঘুচে যায়।
এর মধ্যে এক দিন রবি এসে উপস্থিত। আর্ত মানুষের মতো তাকে প্রায় আঁকড়ে ধরল অতনু। তার আর বিশেষ কোনও বন্ধু নেই, যে দু-এক জন ছিল, তারাও দূরে গেছে।
আহত অভিমানে অতনু জিজ্ঞেস করল, তুই কোথায় ছিলি এত দিন? এই অবস্থায় আমাকে ফেলে চলে গেলি?
সরাসরি উত্তর না দিয়ে রবি বলল, এই ঘুরে ঘুরে বেড়ালাম উত্তর ভারতে। দেশের অবস্থা বোঝার জন্য। আমার উপর দেশ চালানোর ভার নেই। তবু জানতে ইচ্ছে করে।
আসলে, রবি জানে, চন্দনা তাকে একেবারেই পছন্দ করেনা। চন্দনার ধারণা, রবির প্রভাবে, রবির দেওয়া বই-টই পড়েই অতনু এমন গোঁয়ার ধরনের নাস্তিক হয়েছে। কাজের বদলে তর্কাতর্কিতেই বেশি সময় নষ্ট করে।
চন্দনার এরকম মনোভাবের জন্যই রবি দূরে সরে গেছে, তবে মোটামুটি সব খবরই সে রেখেছে।
অতনু বলল, রবি, আমি এই কোম্পানিটা চালাতে পারছি না। তুই আমাকে সাহায্য করবি না? তুই একটা কিছুর ভার নে।
রবি বলল, আমি তো ভাই কোনও দায়িত্ব নিয়ে আটকা পড়তে পারব না। তা আমার ধাতে নেই। তবে, বাইরের বিজনেস মহলে যা শুনছি, তোর ওই শ্যালকটি, বসন্ত, সেই নাকি তলায় তলায় কোম্পানিটাকে ফাঁক করে দিচ্ছে। এখন চন্দনা নেই, তুই ওকে স্যাক কর।
অতনু বলল, বসন্ত? সে ম্যানেজার। হঠাৎ এককথায় কি তাকে তাড়িয়ে দেওয়া যায়?
তাহলে প্রত্যেকদিন ওকে ডেকে কাজের ফিরিস্তি নে। ব্যাঙ্কে ওভারড্রাফট দিয়েছে। তার জবাবদিহি চা। তোকে শক্ত হতে হবে অতনু। আমি একটা ব্যাপার দেখে অবাক হচ্ছি, গুলি লাগবার পর যখন তুই হাসপাতালটায় ছিলি, তখন তোর বুকে অত বড় ব্যান্ডেজ, তবু তোর কথাবার্তায় যথেষ্ট তেজ ছিল। মাঝে মাঝে খানিকটা অসংলগ্ন হলেও জোর দিয়ে, যুক্তি দিয়ে বলতিস। কিন্তু কলকাতা আসার পর থেকেই তুই কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছিস, আরও বেশি করে সব কিছু ভুলে যাচ্ছিস, এমন হচ্ছে কেন?
কী জানি। সব সময় মাথাটা অবশ অবশ লাগে।
ওষুধগুলো যে খাচ্ছিস, তার জন্য হতে পারে। এই সব বেশির ভাগ ওষুধই মাথাটাকে ঝিম পাড়িয়ে রাখে। সব ওষুধ কিছু দিন বন্ধ করে দিয়ে দেখ তো। সাইকো সেমাটিক প্রবলেম নিজের মনের জোরে সারাতে হয়। অফিসের ব্যাপারটা খানিকটা সামলে নে, তারপর তোকে আমি একবার মহুলডেরায় নিয়ে যাব। তাতে কিছু উপকার হতে পারে। হ্যাঁ, ভাল কথা, সেখানকার বাড়িটার কথা এখন মনে পড়েছে তো?
রবি, তুই বলেছিস, চন্দনাও বলেছে, ওখানে একটা বাড়ি কেনা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বাস কর, সে-বাড়িটার কথা বিন্দুবিসর্গ মনে পড়ে না। আমি শুধু দেখতে পাই একটা দরজা, সেখানে তিন জন লোক, তাদের একজনের হাতে রিভলবার…।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। বাড়িটা কেনা হয়েছে এই কোম্পানির নামে। অফিসের কাগজপত্রেই দেখতে পাবি। আমি এর মধ্যে মহুলডেরায় একবার গিয়েছিলাম।
কেন?
এমনিই, কৌতূহল। বাড়িটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। উগ্রপন্থীরা দখল নিতে পারেনি, ওখানে পুলিশের আনাগোনা বেড়েছে। ওসমান সাহেবও বলেছেন, নজর রাখছেন। কিন্তু বাড়িটা নিয়ে এখন কী হবে? বিক্রির কোনও চান্স নেই। ওসমান সাহেবও ন্যাচারালি ফিরিয়ে নেবেন না, টাকাটা তিনি অন্য জায়গায় অলরেডি ইনভেস্ট করে ফেলেছেন। আমাকে খুব খাতির-যত্ন করলেন অবশ্য। যাই হোক, এ বাড়ির এখন কোনও রি-সেল ভ্যালু নেই। একটা মাত্র উপায় আছে, সেই কথাটাই তোকে বলতে এলাম।
কী?
ওই অঞ্চলে সেন্ট্রাল পুলিশের একটা বড় ফাঁড়ি হবে শুনেছি। তাদের কাছে বাড়িটা ভাড়া দিতে পারিস। তাতে মাসে মাসে তোদের ভাল আয় হবে।
ঠিক তো, ঠিক তো।
ও-রকম ঠিক তো, ঠিক তো বললেই হবে না। এখন সব ব্যাপারে উমেদারি করতে হয়। ওদের অফিসে গিয়ে ধরাধরি করতে হবে। যদি টেন্ডার ডাকে, দু-একখানা ফলস্ টেন্ডার দিবি। এবং শুভস্য শীঘ্রম।
কে করবে এ-সব?
আশ্চর্য ব্যাপার। তোর অফিসে অতগুলো লোক থাকে কী করতে? ওদের বললেই বুঝবে।
রবি, তুই আমার পাশে এসে রোজ একটু বসবি?
না, রোজ বসবনা। মাঝে মাঝে আসতে পারি। কিন্তু তোকে আর ম্যাদা মেরে থাকলে চলবে না। উত্তিষ্ঠিত, জাগ্রত, ইয়ং ম্যান। যুদ্ধক্ষেত্রে গুলি খেয়েও অনেকে স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকে।
এর দুদিন পরে যে-ঘটনাটি ঘটল, সে-দিন রবি আসেনি।
সে-দিন অতনুর মেজাজ খুবই খারাপ।
নিজের চেম্বারেই মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে অতনু। একটু আগে বসন্ত এসে বলে গেছে, বাইরের থেকে অনেক টাকা জোগাড় করতে না পারলে এ মাসে কর্মচারীদের মাইনে দেওয়া যাবে না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট শূন্য।
এ নিয়ে বসন্তর সঙ্গে খানিকটা রাগারাগিও হয়ে গেছে।
রাগের সময় সমস্ত অনুভূতি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সে ভাবছে, নিজের বসতবাড়িটাই বেচে দেবে।
এই সময় নিচ থেকে রিসেপশনিস্ট জানাল, এক জন মহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে চান।
অতনুর আগের অভ্যেস ছিল, কেউ দেখা করতে চাইলে সে ফেরাত না। তবু জিজ্ঞেস করল, আমার নাম করেই দেখা করতে চান, অথবা কোনও কাজে? যদি কাজের জন্য হয়, সেই ডিপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দাও।
না, তিনি অতনুর সঙ্গেই দেখা করতে চান, ব্যক্তিগত ভাবে।
একটু পরেই সুইং ডোর ঠেলে ঢুকলেন এক জন মহিলা, সালোয়ার কামিজ পরা, চুল খোলা, রঙ ফরসা হলেও চোখের নিচে কালো দাগ, শরীরের গড়নও খানিকটা বেঢপ ধরনের। অতনু একে আগে কখনও দেখেনি।
অতনু মুখ তুলে তাকাল, মহিলাটি একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। তারপর নিচু গলায় বলল, তুমি কেমন আছ?
প্রশ্নটা অতনুর কাছে ধাক্কা দিল। তুমি?
সেই নিস্পৃহ গলায় বলল, আই থিংক উই আর নট প্রপারলি ইনট্রোডিউসড। আমার নাম অতনু হালদার। আপনি?
সে বলল, চিনতে পারছ না। পোশাক অন্য রকম। আমি দীধিতি।
অতনু বলল, ডিডিটি? হোয়াট কাইন্ড অফ আ নেইম ইজ দিস? আগে কখনও শুনিনি।
আমি এত দিন যোগাযোগ করিনি তোমার সঙ্গে, ভেবেছিলাম, তুমিই আসবে। আমি আর আশ্রমে থাকি না। শুধু তোমাকে একবার দেখতে এসেছি।
আমি তো এ-সব কিছুই বুঝতে পারছি না। আশ্রম? আমার সঙ্গে কোনও আশ্রমের সম্পর্ক নেই? আপনি কী চান আমার কাছে?
আমি কিছুই চাইতে আসিনি। তুমি কি আমাকে সত্যিই চিনতে পারছ না, না ইচ্ছে করে চিনতে চাইছ না?
এবার অতনু দপ করে জ্বলে উঠল। এই সময় তার ভাষার ঠিক থাকে না।
সে বলল, ইচ্ছে করে চিনতে চাইব না মানে? বাজার থেকে যে-কোনও মেয়ে এসে আমার সঙ্গে তুমি তুমি করে কথা বললেই তাকে চিনতে হবে? আমি আজ খুবই ব্যস্ত আছি, যদি সত্যি কোনও দরকার না থাকে, প্লিজ।
না, কোনও দরকার নেই।
ভেতরে এসে একবার বসেওনি, তাড়াতাড়ি মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে গেল দীধিতি।
.
০৬.
একটা অন্ধকার ঘরের দরজা-জানালা হঠাৎ খুলে গেল, বাইরে থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল বিশুদ্ধ আলো। অনেকটা সেই রকম হল অতনুর।
অবশ্য একেবারে হঠাৎ হয়নি।
অফিসের অবস্থাটা সামলে নেবার পর রবিই তাকে নিয়ে গেল ব্যাঙ্গালোরে। সেখানে নতুন ধরনের চিকিৎসার কথা শোনা যাচ্ছিল কিছুদিন ধরে। অ্যাসপিরিনের মতো সামান্য একটা ওষুধকে ভিত্তি করে নতুন একটা ওষুধ বেরিয়েছে, সেই ওষুধেই আশ্চর্য কাজ হল অতনুর। চোদ্দো দিনের মধ্যে সে পরিপূর্ণ স্মৃতি ফিরে পেল। ডাক্তারের সামনে সে গড় গড় করে মুখস্ত বলল টি.এস.এলিয়টের একটি সম্পূর্ণ কবিতা। ধাঁধার উত্তরের মতন সে টকাটক বলে দিতে লাগল, ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতির নাম, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কোন দেশ সবচেয়ে শেষে আত্মসমর্পণ করে। রামধনুর সাতটা রঙ, তার বাবার মৃত্যুর তারিখ, শিল্পী হুসেনের পুরো নাম। এ সেই আগেকার বুদ্ধিদীপ্ত, সপ্রতিভ অতনু।
ফেরার পথে ট্রেনে অতনু বলল, প্রথমেই যেতে হবে মহুলডেরায়, দীধিতির সঙ্গে দেখা করতে হবে, আমি তার কাছে খুবই অপরাধী।
রবি বলল, সে তোর কাছে একবার এসেছিল, তুই তাকে অপমান করে ফিরিয়ে দিয়েছিস।
হ্যাঁ। তা-ও মনে পড়েছে। কিন্তু তখন আমার মাথা তো দুর্বল ছিলই, তা ছাড়া ওর সাজপোশাক অন্য রকম। তা ছাড়া সেই রূপও ছিল না। ঠিক চিনতে পারিনি।
খুব বেশি মানসিক যন্ত্রণা হলে রূপের উপর তো তার ছায়া পড়বেই।
কিন্তু অত তাড়াতাড়ি, মাত্র কয়েক মাসে তার ফিগারটাও নষ্ট হয়ে যাবে?
তোর কাছে যখন সে এসেছিল, তখন সে সাত মাসের প্রেগন্যান্ট। সেই সময় কোনও মেয়ের ফিগার ঠিক থাকে?
প্রেগন্যান্ট? যাঃ তুই কী বলছিস! তুই কী করে জানলি?
আমার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। তোর সঙ্গে যে-দিন দেখা করতে আসে, সে-দিন আমাকে জানালে আমি উপস্থিত থাকতে পারতাম। তাহলে হয়তো ব্যাপারটা অন্য রকম হত।
জানায়নি কেন?
বোধহয় ও আমার সাহায্য নিতে চায়নি। আমি তোর অসুস্থতার কথা ওকে জানিয়েছি আগে। ও ঠিক বিশ্বাস করেনি। ও নিজের চোখে দেখতে চেয়েছিল। তোকে দেখে তো কিছু বোঝা যেত না।
অতনু বিহ্বল ভাবে বলল, প্রেগন্যান্ট? কী করে হল?
রবি বলল, সেটা তুই-ই ভালো জানিস!
অতনু জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।
রবি বলল, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নই নেই। এটা একটা বাস্তব ঘটনা। ওর একটি মেয়ে আছে। অতনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বাইরে। এখানকার প্রকৃতি বাংলার মতো সজল নয়। রুক্ষ, পাহাড়ি।
এটা একটা ফার্স্ট ক্লাস কুপ, শুধুদু’জনের জন্য। দরজা বন্ধ করে এখানে মদ্যপানে কোনও বাধা নেই। রবি সব ব্যবস্থা করে এনেছে।
দু’টি গেলাসে ঢালার পর রবি বলল, নে। তুই এখন চন্দনার সঙ্গেও মিটিয়ে নিতে পারিস। ওর কাছে ক্ষমা-টমা চেয়ে নে। কিছুদিন জার্মানিতে ঘুরেও আসতে পারিস।
অতনু শিশুর মতো সরল ভাবে জিজ্ঞেস করল, চন্দনার কাছে আমি কী অপরাধ করেছি?
কিছু একটা হয়েছে নিশ্চয়ই। স্বামী-স্ত্রীর ভেতরকার ব্যাপার তো, বাইরের লোক সব জানতে পারে না।
আমাকে অসুস্থ জেনেও চন্দনা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমার অসুস্থতাটাই ও সহ্য করতে পারছিল না। রোগের জন্য কি রোগীরা দোষী হয়?
তোর রোগটা ছিল বড় পিকুলিয়ার ধরনের। বাইরের থেকে বোঝা শক্ত ছিল। দীধিতিও এই ধারণা নিয়ে গেছে যে, তুই তাকে ইচ্ছে করে চিনতে চাসনি।
চন্দনার কাছে ক্ষমা চাইবার কিছু নেই। কিন্তু দীধিতির কাছে…আমার কোনও খারাপ মতলব ছিল না, ব্যাপারটা হয়ে গেল, আমি আগে থেকে কিছু ভাবিনি, কিন্তু, ওর বাচ্চাটা বেঁচে আছে?
হ্যাঁ। বেঁচে আছে। আমি যত দূর জানি।
আশ্রমে ওর নিশ্চয়ই খুব অসুবিধে হয়েছে?
ও তো আর ওই আশ্রমে নেই।
নেই? কোথায় গেছে?
আশ্রমকন্যা হয়ে একটি অবৈধ সন্তানের মা হয়েও কিআর সেখানে থাকা যায়? কখনও কখনও এ-রকম ঘটে বটে। তখন গোপনে গোপনে বাচ্চাটাকে নষ্ট করে ফেলতে হয়।
অতনু চিৎকার করে বলে উঠল, না।
সে এখন ক্রুদ্ধভাবে রবির দিকে চেয়ে রইল, যেন এ-সব কথা উচ্চারণ করার জন্য সে রবিকেই শাস্তি দেবে।
খানিক বাদে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সে শান্তভাবে বলল, ওই আশ্রমে নেই, তাহলে কোথায় থাকে এখন?
জানি না।
জানিস না? তুই জানিস না? কেন জানিস না?
কী মুশকিল, তোর অফিস থেকে ফিরে সে তো আর আমার সঙ্গে দেখা করেনি। শুধু ফোন করেছিল। কোনও অভিযোগ করেনি, কিছু না। শুধু বলেছিল, আপনারা ভাল থাকবেন। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করারও সুযোগ দেয়নি।
তবু কলকাতার ফেরার এক সপ্তাহ পরেই দুই বন্ধুতে গেল মহুলডেরায়। সেখানকার আশ্রমে গিয়েও দেখা করল পুরোনো পরিচিতদের সঙ্গে।
প্রায় ছ’মাস আগে দীধিতি কোনও রকম কারণ না জানিয়েই এই আশ্রম ছেড়ে চলে গেছে। খুব সম্ভবত ফিরে গেছে সংসারধর্মে। এ-রকম তো কেউ কেউ যায়। একটা ঝোঁকের মাথায় বাড়ি ছেড়ে এসে আশ্রমে যোগ দিয়ে কঠোর আত্মনিগ্রহের জীবন ধারণ করে। বেশি দিন সহ্য করতে পারে না, বিশেষত শিক্ষিত মেয়েদেরই এটা বেশি হয়।
দীধিতির বাড়ির ঠিকানা কেউ বলতে চায় না। তা জানাবার নিয়ম নেই। অনেক অনুরোধ করার পর অনুপমা নামে একজন সেবিকা আভাস দিল, দীধিতি জামসেদপুরের মেয়ে, ওর পদবি চক্রবর্তী। বাবা-মায়ের তুমুল ঝগড়া, মায়ের প্রতি বাবার অত্যাচার দেখেই ও বাড়ি ছেড়েছিল।
অনুপমা বলল, এই জায়গাটা ওর খুব ভাল লেগেছিল, আশ্রমের কাজ, হাসপাতালের কাজ করত মনপ্রাণ দিয়ে, বাইরে যেতেই চাইত না। তবু চলে গেল। যাবার কয়েক দিন আগেও খুব কেঁদেছিল। সারাক্ষণ কাঁদত।
অনুপমা হয়তো আরও কিছু জানে। সে অতনুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, আমার বন্ধুটা খুব ভাল মেয়ে। খুব খাঁটি মেয়ে, খুব ইমোশনাল!
জামসেদপুরে প্রচুর বাঙালি। তাদের মধ্যে একটি চক্রবর্তী দম্পতি খুঁজে বার করা সহজ নয়। চক্রবর্তীও কম নয়। তবু সেখানে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করতে একটি চক্রবর্তী পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেল, দীধিতির মতো একটি রূপসি মেয়ের কথা অনেকে মনে রেখেছে। তার মা আত্মহত্যা করেছেন।
বলাই বাহুল্য, দীধিতি সেখানে ফিরে আসেনি। তার সন্ধান কেউ জানে না।
তার ডাকনাম পরি। সে যেন পরিদেরই মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। এত বড় দেশে কোথায় পাওয়া যাবে তাকে? খড়ের মধ্যে আলপিন খোঁজাও এর চেয়ে সহজ।
অসুখ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠার পরেও লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল তার জীবন।
চন্দনার সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগার আর কোনও সম্ভাবনাই রইল না।
তিন-তিনবারেও সে চন্দনাকে মা হবার সুযোগ দিতে পারেনি। আর মাত্র এক দিনের মিলনেই অন্য একটি নারী তার সন্তানের জননী হয়ে রয়েছে কোথাও। তাকে ভুলে গিয়েও চন্দনার কাছে ফিরে যাবে, এমন বিবেকহীন মানুষ তো সে নয়। দীধিতির দেখা না পেলেও তার স্মৃতি উজ্জ্বল হচ্ছে দিন দিন।
চন্দনা মনে করেছিল, তার পিতৃত্বের ক্ষমতাই নেই। অসুখের সময় সে অতনুকে ছেড়ে চলে গেছে। অতনু জানিয়ে দিল, চন্দনাকে বিবাহ-বিচ্ছেদ দিতে তার আপত্তি নেই। সে চন্দনার অযোগ্য।
ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসাটা সে শেষ পর্যন্ত বিক্রি করেই দিল। চন্দনার অংশের টাকা জমা রেখে ছিল ব্যাঙ্কে। পিসতুতো ভাইটি এর মধ্যে একটি চাকরি করে বিয়েও করে ফেলেছে। এ বাড়িতেই ভাড়া থাকে। তাদেরই সংসারে যেন অতনু অতিথি। তবে দো-তলাটা তার নিজস্ব।
এর মধ্যে এক বছর কেটে গেছে, তবু আশা ছাড়েনি রবি। সে এখনও দীধিতির খোঁজ করে চলেছে। বিচিত্র তার মনস্তত্ত্ব, সে নিজের জন্য কোনও নারীকে খোঁজে না। কোনও নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় না। তবু বন্ধুর জীবনে বিশেষ এক নারীকে সে হারাতে দিতে চায় না। সেজন্য সে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে।
কিংবা সে হয়তো দীধিতির জীবনটাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তার বন্ধুটি নাস্তিক, সিনিক হতে পারে, নারী-পুরুষের মুক্ত সম্পর্কে বিশ্বাসী। কিন্তু লম্পট তো সে নয়। একটি মেয়েকে ভুলিয়ে ভালিয়ে গর্ভবতী করে পালিয়ে যাবে, এমন মানুষ নয় অতনু। দীধিতির কাছে এটা প্রকাশ করা যেন বিশেষ প্রয়োজনীয়।
রবি ধরে নিয়েছে, দীধিতি আত্মহত্যা করতে পারে না। এরকম অপমানজনক অবস্থায় পড়লে কোনও কোনও মেয়ে আত্মহত্যা করে ফেলে ঠিকই, কিন্তু যে সদ্য জননী হয়েছে, সে তার সন্তানের জন্য সব রকম দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারে।
বেঁচে থাকলে দীধিতি জীবিকার জন্য একটা কিছু কাজ নেবে নিশ্চয়ই। আর কোনও আশ্রমে যোগ দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে লেখাপড়া জানে, খানিকটা নার্সিং-এর ট্রেনিং নিলেও পুরোপুরি নার্স নয়, হাসপাতালে ভাল কাজ পাবে না। খুব সম্ভবত সে কোনও বড় শহরেও থাকতে চাইবে না।
এই সব মেয়ের পক্ষে কোনও স্কুলে কাজ নেওয়াই স্বাভাবিক। তা-ও রবি ভেবে দেখল, কোনও সাধারণ স্কুলে সে বোধহয় যাবে না। তার সঙ্গে রয়েছে একটি পিতৃপরিচয়হীন সন্তান। অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা তার ব্যক্তিগত জীবনে উঁকিঝুঁকি করবে। কন্যাসন্তানটির পিতৃপরিচয় নিয়ে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা বলতে পারবে দীধিতি? মিথ্যে কথা ওর মুখে মানায় না।
একমাত্র ক্রিশ্চান মিশনারির স্কুলগুলোতেই এই সমস্যা কম। বিদেশে কুমারী মা অনেক হয়। ওরা মেনে নেয়।
রবির দৃঢ় ধারণা হল, কোনও ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুল কিংবা অনাথ আশ্রমেই কাজ নিয়েছে দীধিতি।
কিন্তু তাতেও তো কিছু সুরাহা হয় না।
সারা দেশে এরকম হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। ক্রিশ্চানদের মধ্যেও কত রকম ডিনোমিনেশান। একে অপরের থেকে দূরত্ব রক্ষা করে।
রবি থাকে তার দাদাদের সংসারে। অবশ্য বাড়িতে থাকে খুব কম, সারা বছরই টো-টো করে বেড়ায়। মস্ত বড় পৈতৃক বাড়ি, অনেকগুলো দোকানঘর ভাড়া আছে। রবি তার একটা অংশ পায়। সেই টাকা সে উড়িয়ে দেয় ভ্রমণে।
মাঝে মাঝে সে আসে অতনুর কাছে। অতনু এখন আর তার সঙ্গে বাইরে ঘোরাঘুরি করতে উৎসাহী নয়। সে আজকাল বইপত্রের মধ্যেই ডুবে থাকে। সে লেখক নয়, এত জ্ঞান সে কোন কাজে লাগাবে? সে পড়াশোনা করে নিজের আনন্দের জন্য।
এর মধ্যে বাংলা ও বিহারের সমস্ত ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুল ঘুরে দেখে এসেছে রবি। এবার তার ধারণা হয়েছে, কেউ যাতে খুঁজে না পায়, তাই দীধিতি নিশ্চিত চলে গেছে অনেক দূরে। কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর, কয়েক হাজার মাইলের ব্যবধান। সে কোথায় থাকে?
তবু শেষ পর্যন্ত রবির উদ্যম সার্থক হল।
দীধিতিকে শেষ পর্যন্ত সে দেখতে পেল হিমাচল প্রদেশের মানালিতে। কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নানা রকম হিংসাত্মক আক্রমণের জন্য এখন অনেক ভ্রমণকারীই সেখানে যেতে ভয় পায়। কাশ্মীরের বদলে প্রায় অনুরূপ একটা জায়গার খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেছে মানালি, প্রায় একই রকম, হিমালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য, তুষারপাত, সাধারণ মানুষের আতিথেয়তাবোধ, তাই এখানে কয়েক বছরের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি পাঁচতারা হোটেল, তৈরি হয়েছে রাস্তা, সেই সঙ্গে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল।
রবির ধারণাই ঠিক প্রমাণিত হয়েছে, অনাথ শিশুদের জন্য ক্রিশ্চান মিশনারিদের একটা স্কুলের সঙ্গে যুক্ত আছে দীধিতি।
রবি তাকে আবিষ্কার করলেও দেখা দেয়নি।
যদি দীধিতি তাকে দেখলেই আবার সেখান থেকে উধাও হয়ে যায়। তাছাড়া রবি তো একা তার সঙ্গে দেখা করে কোনও কথাও বলতে পারবে না।
কলকাতায় ফিরে এসে সে অতনুকে প্রথমে কিছু বলল না। সে দিল্লির প্লেনের টিকিট নিজেই এনেছে, সে অতনুকে জানায় দিল্লি নিয়ে যাবেই।
অতনু প্রথমে রাজি হল না। বাড়ি থেকে না বেরোনোটাই তার অভ্যেস হয়ে গেছে। আলস্যের একটা নেশা আছে। দীধিতির সঙ্গে আর কখনও দেখা হবে না ধরে নিয়ে সে এখন ওর সম্পর্কে কল্পনা করেই মশগুল হয়ে থাকে। প্রেমিক-প্রবর অতনু এখন আর কোনও নারী সম্পর্কেও আগ্রহী নয়। আর, আশ্চর্যের ব্যাপার, সে এখন আর মদ্যপান করে না।
রবির পীড়াপীড়িতে তাকে দিল্লি যেতেই হল। এখানে কী আছে? কিছু নেই। এখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে যেতে হবে পাহাড় প্রদেশে। প্রায় দশ ঘণ্টার যাত্রা। হরিয়ানা, পাঞ্জাব ছাড়িয়ে পাহাড়ের রাস্তাই অর্ধেকটা।
অতনু জিজ্ঞেস করল, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বল তো?
রবি বলল, তোর মেয়ের মুখ দেখবি। ইচ্ছে করে না?
মাণ্ডি থেকে কুলু। তারপর মানালি। এমনই পথের দৃশ্য যে সমতলের মানুষেরা মুগ্ধ, বিভোর হতে বাধ্য। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিপাশা নদী। শত পৌরাণিক কাহিনি এর সঙ্গে জড়িত, নাম শুনলেই রোমাঞ্চ হয়।
স্কুলটি খুবই ফাঁকা ও নিরিবিলি জায়গায়। চতুর্দিকে পাহাড়। শীতকালে এখানে বরফ পড়ে, তবু গাছপালাও প্রচুর। একটা সাদা রঙের বাংলোর সামনে অনেকখানি সবুজ প্রান্তর।
বারান্দায় একটা রকিং চেয়ারে বসে আছে দীধিতি। হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে, একটা ঘি রঙের শাল গায়ে জড়ানো। সে উল বুনছে। আর সদ্য হাঁটতে শেখা একটি মেয়ে খেলা করছে তিনটে কুকুরের সঙ্গে। শীতের দেশের ঘন লোমভর্তি বাচ্চা কুকুর, দেখতে খেলনার পুতুলের মতো।
গাড়ি থেকে নেমে, খানিকটা বাগান পেরিয়ে দু’জন পুরুষ এসে দাঁড়াল দীধিতির সামনে। নিশ্চয়ই দূর থেকে ওদের আসতে দেখেছে দীধিতি, তবু ওরা কাছে এলেও সে কিছুক্ষণ উল বুনল, তারপর গলা তুলল, লছমি বাচ্চিকো ভিতর লে যানা।
এক জন আয়াজাতীয় স্ত্রীলোক এসে খুকিটিকে নিয়ে গেল ভেতরে। সে আপত্তি করল না। কুকুর তিনটেও লাফাতে লাফাতে গেল ওদের সঙ্গে।
দীধিতি বলল, আপনারা বসুন।
অতনু বলল, চিনতে পেরেছ?
দীধিতি মৃদু হেসে বলল, এ আবার কী কথা? আমার তো মানসিক অসুখ নেই, চিনতে পারব না কেন?
অনেকটা রূপ ফিরে এসেছে দীধিতির। শরীরের গড়নেও চমৎকার সৌষ্ঠব। তবে মুখের মধ্যে একেবারে অকৃত্রিম সরল ভাবটা নেই, অনেক কিছুর ছাপ পড়েছে। এসেছে ব্যক্তিত্বের জোর।
একটুক্ষণ তিন জনেই নিঃশব্দ। ঠিক কী বলবে, ভেবে না পেয়ে অতনু বলল, মেয়েটাকে ভিতরে পাঠিয়ে দিলে? ওকে একটু দেখতে পারি না?
দু’দিকে মাথা নেড়ে, হাসিমুখে দীধিতি বলল, না। আমি বাইরের লোকদের সামনে ওকে আনি না।
পাংশু মুখে অতনু বলল, বাইরের লোক! পরি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
খুব স্বাভাবিক কৌতূহলে দীধিতি বলল, ক্ষমা, কীসের জন্য।
অতনু বলল, সব কিছুর জন্য। পরি, আমি যা কিছু করেছি, সব তো সজ্ঞানে নয়, আমার মাথার ঠিক ছিল না, বিশ্বাস করো। আমি কি আমার মেয়ের মুখটা দেখতে পারব না।
দীধিতি বলল, আপনার মেয়ে? এ আপনি কী বলছেন! ছিঃ, এ-সব কথা বলতে নেই। ও একটা বাজারের মেয়ের সন্তান। ওর বাবার ঠিক নেই।
এগিয়ে এসে, দীধিতির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে অতনু একেবারে নিঃস্ব মানুষের মতো বলল, এ-রকম কথা যখন আমি বলেছি, তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না, বিশ্বাস করো! তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে, আমি মিথ্যে কথা বলছি না, সেজন্য আমি ক্ষমা পেতে পারি না?
দীধিতি বলল, ক্ষমার কথা বলছেন কেন, আপনি তো ঠিকই বলেছেন! সন্তানের বাবা কে, তা কে ঠিকঠাক বলতে পারে? বাবারা বললেই কি ঠিক হয়? অন্য যে-কেউ তো হতেই পারে, তাই না? মায়েরাই শুধু জানে। আমি জানি, ও বাজারের মেয়ে।
তুমি এটা রাগের কথা বলছ। আমি তোমাকে ভুলতে চাইনি। আমি তোমাকে এই কথাটি জানাতে এসেছি তোমাকে পেয়ে সেই রাতে আমি যে যে মাধুর্য পেয়েছি, তা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। কী করে যেন সেটা হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে ছাড়া, পৃথিবীর আর কোনও মেয়েকে ভালবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
দীধিতি একটু ঝুঁকে, অতনুর চুলে হাত দিয়ে খুব কোমল ভাবে বলল, অতনু, আমার সেই অভিজ্ঞতাও কোনও দিন ভুলব না। কিন্তু তারপর আমি ভাল শিক্ষাও নিয়েছি। পুরুষরা ইচ্ছে করলে ভালবাসা দেখাবে, ইচ্ছে করলে ভুলে যাবে। দূরে সরে যাবে। তা তো আমরাও করতে পারি, তাই না? মেয়েরা সন্তান চায়, আমি চেয়েছি। এখন আমার ইচ্ছে করলে, যদি প্রয়োজন হয়, যদি শরীর তেমন জাগে, তখন তো আমি যে-কোনও পুরুষকেই ডাকতে পারি। কোনও পুরুষের সঙ্গে পাকাপাকি সম্পর্কে আমি বিশ্বাস করি না। আমি স্বাধীন থাকতে চাই।
অতনু বলল, পরি, তুমি অবশ্যই স্বাধীন থাকতে পারো। কিন্তু আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমি তোমার কাছে থাকতে চাই।
দীধিতি বলল, না, তা সম্ভব নয়। ও বোধহয় তা পছন্দ করবে না।
দীধিতি আঙুল দিয়ে এক দিকে দেখাল। একগাদা কাঠের বোঝা কাঁধে নিয়ে বাগান পেরিয়ে আসছে এক জন পাহাড়ি মানুষ।
দীধিতি বলল, ওর নাম প্রীতম সিং। আপাতত প্রীতমই রাত্তিরে আমার শয্যাসঙ্গী। একসেলেন্ট পার্টনার। আমি অবশ্য ওর কাছ থেকে সন্তান চাই না, এখন শিখে গেছি, কন্ট্রাসেপটিভ ব্যবহার করি। ও কিন্তু আপনাদের পছন্দ করবে না। আপনারা বরং এবার উঠে পড়ুন।
তারপর রবির দিকে তাকিয়ে সে বলল, আপনি তো এ পর্যন্ত একটাও কথা বলেননি। তাতেই আমি সব বুঝেছি, আপনি আপনার বন্ধুকে এবার নিয়ে যান।
কাঁধে বোঝা নিয়ে পাহাড়ি মানুষটি প্রায় কাছে এসে পড়েছে। রবি আর অতনু উঠে পড়ল।
গাড়ির কাছে এসে অতনু বলল, রবি, তুই কিছু বললি না কেন রে? তুই আমাকে একটুও সাহায্য করলি না!
রবি বলল, আমি দেখলাম, শেষ পর্যন্ত মিলল না।
অতনু বলল, কী মিলল না?
রবি বলল, তোর মনে আছে, প্রথম দিন ওই মেয়েটিকে দেখে বলেছিলাম ওর নাম শকুন্তলা?
হ্যাঁ, মনে আছে। তুই কালিদাসের নাটকের সঙ্গে তুলনা দিচ্ছিলি, তাই না?
আমার আশা ছিল, শকুন্তলার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হলে হয়তো ওই নাটকের মতোই কিছু হবে। কিন্তু দীধিতি শেষকালে যা বলল, তা কালিদাসের বাবাও কল্পনা করতে পারত না। ইচ্ছেমতো যে-কোনও পুরুষের সঙ্গে রাত কাটানো? বাপ রে বাপ! আমার পক্ষেও হজম করা শক্ত!
অতনু একটা লম্বা নিশ্বাস টেনে বলল, সে-যুগ, আর এ-যুগ! কিন্তু দীধিতি কি সত্যি কথা বলছিল? ওই লোকটির সঙ্গে…।
রবি বলল, তা আমি জানি না। কিন্তু ও যে আমাদের তাড়াতে ব্যস্ত ছিল, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই।
অতনু বলল, এত দিন আমি ওর স্মৃতি নিয়ে ছিলাম। এখন কী করব বল তো? কী নিয়ে বাঁচব? রবি হাসতে হাসতে বলল, খুঁজে দেখ! তবে, তোর মতো নাস্তিকদের নিয়তি হচ্ছে একাকিত্ব! নাস্তিকরা কাউকেই আঁকড়ে ধরতে পারে না। তারা নিজেকেই খুঁজে বেড়ায়।