Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলসে || Buddhadeb Guha

ঋজুদার সঙ্গে স্যেশেলসে || Buddhadeb Guha

স্কুল থেকে ফিরতেই মা বললেন, ঋজু ফোন করেছিল। তোদের সকলকে যেতে বলেছে আগামীকাল সন্ধেবেলা। রাতে ওখানেই খেয়ে আসতে বলেছে।

সন্ধেবেলা?

হ্যাঁ। সিক্স-ও-ক্লক শার্প।

সেটা না বললেও হত।

মনে মনে বললাম।

ঋজুদার সঙ্গে এতদিন ঘুরছি আর সময়জ্ঞান হয়নি কি আর! পারলে, পাঁচ মিনিট আগেই পৌঁছব। পরে যাইনি কখনই। কিন্তু সকলকে মানে?

জিজ্ঞেস করলাম মা-কে। জুতো খুলতে খুলতেই জিজ্ঞেস করলাম।

তার মানে আমি কী করে জানব? তোদের পুরো দলই হবে।

মানে, তিতির কি ফিরেছে নাকি?

আমি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

আশ্চর্য তো! তা আমি কী করে জানব? সে গেছে কোথায়?

মা বিরক্তির গলাতে বললেন।

বাঃ, সে তো কবেই দিল্লি চলে গেছে। জে এন ইউ-তে পড়ে তো এখন।

তা কেন পড়বে না? পড়াশুনোতে তো সে তোমাদের মতো নয়। ভাল মেয়ে, ভাল করছে। আর তোমরা তো বনে-বাদাড়ে ঘুরে ঘুরেই দিন কাটাচ্ছ। তোমাদের ঋজুদাই তো তোমাদের তার সব সম্পত্তি দিয়ে যাবে। তাই ভাঙিয়েই চলবে। আর চিন্তা কী? ভাবছ তাই।

আমি বললাম। হাঃ! ঋজুদা বলে, লেখাপড়া করে যে, গাড়ি চাপা পড়ে সে। তা ছাড়া, জীবনে স্কোয়ার হতে হয়। শুধু বুক-ওয়ার্ম হলেই হয় না। তুমিই না বলো যে, আমাকে পূর্ণ মানুষ হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যেমন মানুষ হওয়ার কথা বলতেন।

হ্যাঁ। তা তো বলিই। কিন্তু এমন করে ঋজুর সঙ্গে বনে বনে ঘুরে বেড়ালে আর পূর্ণ মানুষ হতে হবে না। বনমানুষ হবে। পূর্ণ বনমানুষ!

মা বললেন।

তারপরই বললেন, এবারে দয়া করে খেয়ে নিয়ে আমাকে ধন্য করো। বড়মামা দুপুরে আম পাঠিয়েছেন নবীনকে দিয়ে, বহরমপুর থেকে। আর মাখনদি পাটিসাপটাও দিয়ে গেছেন।

আমি বললাম, বাঃ। ফারস্ট ক্লাস। কিন্তু নোনতা কিছুই নেই?

সত্যি! ঋজু বোসের যোগ্য চেলা হয়েছিস বটে। খাদ্যরসিক!

তারপরেই বললেন, আছে। ডালপুরি।

ডালপুরি খাব কী দিয়ে? আলুরদম?

তারপর স্বগতোক্তি করলাম, আমার একটাই চিন্তা। ঋজুদা আবার না ভটকাইকে সঙ্গে নেয় এবারেও। নিনিকুমারীর বাঘ মারতে গিয়ে কী কেলোটাই না করেছিল! ঋজুদার লাই পেয়ে পেয়ে ও দিনে দিনে একেবারে আনম্যানেজেবল হয়ে উঠছে। নাগাল্যান্ডের কাঙ্গপোকপি’-তে গিয়েও কি কম ঝামেলা করেছিল?

সে সব তুমি আর তোমার ঋজুদাই বুঝে। এখন মুখ হাত পা ধুয়ে দয়া করে খেয়ে নাও। আলুরদমটা মাখোমাখোই করেছি, তুই যেমন ভালবাসিস।

আমি আমার মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, এই নইলে আমার মা। ইউ আর গ্রেট। মা-আ-আ।

.

যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। বিশপ লেফ্রয় রোডে পৌঁছে দেখি, তিনি আমার আগেই গিয়ে পৌঁছে গেছেন। আর ঋজুদা, যথারীতি বাড়ি নেই। তবে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলাম দশ মিনিট দেরি আছে। আর ঋজুদা ঠিক সময়েই এসে যাবে। কারণ, ঋজু বোস কথা দিলে বা সময় দিলে, তার ‘ডেড বডিও কথা এবং সময় রাখবে।

গদাধরদা বলল, তিনি এই এইলেন বইলে। তোমরা কী খাবেন তাই বল। এটু লেমন স্কোয়াশ কইরে দেব কি? আর চারটে কইরে কে. সি. দাসের রসগোল্লা?

সে প্রশ্নের জবাব না দিয়েই বললাম, রাতে কি না-খাওয়াবার মতলব করেছ। নাকি? তোমার বাবু কি এতই গরিব হয়ে গেলেন?

আরে না না। সে কী কতা গো! আমার বাবু কোন শত্তুরের অভিশাপে গরিব হবেন! তুমি নোক মোটেই ভাল লয় গো রোদদুর দাদা। আজ অবধি একদিনও কি এমন হইয়েচে যে ঋজু বোসের বাড়ি এইয়ে পেটপুরে না খেইয়ে গেছ তোমরা কেউ?

আমি রোদদুর বাবু নই। আমার নাম রুদ্র। তোমার কি ভীমরতি ধরেছে?

ওই হল। আমি তোমাকে আজ থেকে রোদদুর বলেই ডাকব।

সে আবার কী কথা?

হ্যাঁ। আমার ওই নামটাই একনে পছন্দ।

ভটকাই বলল, রোদদুর না বলে ওকে বরং অন্ধকার বলো।

তারপরই বলল, তোমার বয়স ক’কুড়ি হল গো গদাধর দাদা?

তা তিন-চার কুড়ি হবে বইকী!

তবু বুদ্ধি পাকল না? তোমার রোদদুরবাবু যে লোক খারাপ তা বুঝতে তোমার এত বছর লাগল?

এমন সময়ে ডোর-বেলটা বাজল।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে ভটকাই মালিককে তেল-মারা ডোবারম্যান কুকুরের মতো লেজ নাড়াতে-নাড়াতে দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলল। খুলেই, সঙ্গে সঙ্গে অ্যাবাউটটার্ন করেই ঘরের ভেতরে সেঁধিয়ে গিয়ে আমার দিকে ফিরে প্রায়। কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, এক সায়েব এয়েচে।

সাহেব দেখলেই ভটকাইয়ের অবস্থা মুখে নুন-পড়া জোঁকের মতো হয়ে যায়।

বাইরে না দেখালেও, মনে মনে খুবই খুশি হলাম আমি।

এগিয়ে গিয়ে দেখি, এক সাহেব দরজায় দাঁড়িয়ে। চেহারা দেখে মনে হল না ইংরেজ বলে। তবে কোথাকার মানুষ আমি ঠিক বুঝলামও না। আমি অবশ্য কতটুকুই বা বুঝি।

সাহেব তাঁর হাতের পাতেক ফিলিপ’ ঘড়িটার দিকে এক ঝলক চেয়ে বললেন, অ্যাম আই আর্লি? ইজ নট মিস্টার বোস ইন?

বললাম, প্লিজ কাম অন ইন। হি উইল বি হিয়ার এনি মোমেন্ট। প্লিজ বি সিটেড।

তারপরে সাহেবকে আমার আর ভটকাইয়ের পরিচয় দিয়ে, আমরাও বসলাম। সাহেব কিন্তু নিজের পরিচয় দিলেন না আমাদের।

আগন্তুক সাহেব মাঝবয়সী, ছিপছিপে। পরনে একটি নীল জিনসের ট্রাউজার, এবং ওপরে লালরঙা গেঞ্জি। ব্যাঙ্গলনের। চোখে রিমলেস চশমা। প্লাস্টিক লেন্সের। তার রং, হালকা হলুদ। পায়ে নীল মোজা এবং হালকা খয়েরি-রঙা মোকাসিন। চেহারাটা ধূর্ত-ধূর্ত। সাহেব তিনি বিলক্ষণ। কিন্তু ইংরেজ নন। কোন দেশি তা বুঝলাম না। তবু বুঝলাম যে, আমাদের চেহারা-ছবি সাহেবের বিশেষ পছন্দ হল না। আমাদের দুজনের দিকেই সন্দিগ্ধ চোখে তাকাতে লাগলেন উনি বারবার।

ভাবলাম, বয়েই গেল! আমরা ওর জামাই থোড়াই হতে যাচ্ছি।

ভটকাই আবার আজকে ডান পায়ে লাল আর বাঁ পায়ে নীল মোজা পরে। এসেছিল ভুল করেই। সম্ভবত আমার চেয়ে আগে ঋজুদার বাড়িতে পৌঁছনোর তাগিদেই এমন ভুলটা করেছিল। আমার অ্যাডিডাসের হলুদ গেঞ্জির ডান কাঁধের কাছে ঘেঁড়া ছিল কিছুটা। সাহেব সবই লক্ষ করলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। সাহেব মাঝে মাঝেই বুনো শুয়োরের মতো একটা ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজ করছিলেন নাক দিয়ে। তবে খুবই আস্তে। আর তারই সঙ্গে নিকার-বোকারের লাল-রঙা ইলাস্টিকটাকে টেনে টেনে বারবার ওপরে তুলছিলেন।

আমি ভাবলাম, সাহেব বাতিকগ্রস্ত। ভটকাইয়ের দিকে তাকালাম। ভটকাই তার বেগুনচেরা চোখের নীরব দৃষ্টি দিয়ে আমার ভাবনাকে সমর্থন করল।

এমন সময়ে ডোর-বেলটা আবারও বাজল। ভটকাই-ই গিয়ে খুলল আবার।

ঋজুদা ঘরে ঢুকেই বলল, হাই! মঁসিয়ে পঁপাদু। আই অ্যাম অ-ফুলি সরি।

তারপরেই বলল, হাউ লং?

ওনলি আ কাপল অফ মিনিটস।

মঁসিয়ে পঁপাদু বললেন। ঋজুদা মঁসিয়ে পঁপাদুর চোখমুখ দেখেই বুঝেছিল যে, আমাদের তাঁর বিশেষ পছন্দ হয়নি। তাই হুড়হুড়িয়ে আমাদের গুণপনার কথা সবিস্তারে বলতে লাগল মঁসিয়ে পঁপাদুকে।

লজ্জাই করতে লাগল আমার। এমনকী নির্লজ্জ ভটকাইয়ের মুখ দেখে মনে হল, তারও লজ্জা করছে। ঋজুদাই যেন আমাদের ভিজিটিং কার্ড। এমন সব ভাল ভাল কথা বলছে আমাদের সম্বন্ধে ওই বুনো শুয়োর-মার্কা পাদুকে যে, কাছাকাছি কোনও মেয়ের বাবা থাকলে আমাদের দুজনের একজনকে জামাই না করেই ছাড়তেন না।

পঁপাদু সাহেব বড় ঘন ঘন ঘড়ি দেখেন। এও যেন নাক ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করারই মতন আরেক বাতিক।

এবারে মঁসিয়ে পঁপাদু তাঁর হাতের ব্রিফকেসটি খুলে একগোছা প্লেনের টিকিট বের করলেন। তারপর একটি প্লাস্টিকের ফোল্ডার। বললেন, এতে পাঁচ হাজার ডলার আছে। আমার সঙ্গে আপনার সেখানে দেখা না হওয়াই ভাল। আমি সেখানে থাকবও না। থাকব মরিশাসে। হয়তো। অথবা পারিতেই। ফোনেই যোগাযোগ রাখব। আমার মোবাইল ফোনের নাম্বারটা রেখেছেন তো ঠিক করে? সেখানে পৌঁছানোমাত্র ওখানের কনটাক্টের নাম ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব দিয়ে দেবে যে আপনাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করবে। আমারই লোক। সে কিন্তু নিয়ে যাবে না আপনাকে সঙ্গে করে। একটা ক্যাব নিয়ে নেবেন। গতবার আপনি যে বাড়িতে উঠেছিলেন মাহে এয়ারপোর্টের একেবারে গায়েই, সেই বাড়িতে নেমে ক্যাব ছেড়ে দেবেন। ক্যাব চলে গেলেই একটি কালো টয়োটা গাড়ি এসে আপনাদের তুলে নেবে। এয়ারপোর্টের দিক থেকেই আসবে। আপনারা ওখানে পৌঁছালে আপনাদের যা কিছুর দরকার, আর্মস-অ্যামুনিশানসুন্ধু, আমার কনটাক্টই জুগিয়ে যাবে। মানে, যদি দরকার হয়। আর ডলারের দরকার হলে তাও সে দেবে।

মঁসিয়ে পঁপাদু হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এবার আমি উঠব। একজনের সঙ্গে দেখা করার আছে। তারপর বললেন, কতদিনের মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারবেন বলে মনে হয়?

ঋজুদা বলল, ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, নো আইডিয়া। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কাজ শেষ করে ফিরে আসার চেষ্টাই করব।

মঁসিয়ে পঁপাদু বললেন, আমার কাজটা কিন্তু হওয়া চাই মিস্টার বোস।

ঋজুদা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, হবে।

তারপর বলল, কাল যাওয়ার আগে একটা ফোন করলে আপনার কনটাক্ট সম্বন্ধে আর একটু বিস্তারিত কথা বলে নেব।

ঠিক আছে।

আমি একটু অবাকই হলাম। কোথায় যাবে, কোন বিদেশে তাও অজানা, কী কাজ তাও জানা নেই, আর্মস-অ্যামুনিশানের প্রশ্ন যখন উঠছে, তখন কাজটা যে। বিপজ্জনক তাতেও সন্দেহ নেই, কিন্তু কাজটা যে হবেই এমন গ্যারান্টি ঋজুদা যে কলকাতার বিশপ লেফ্রয় রোডে বসেই দেয় কী করে তা একটুও বুঝলাম না। তা ছাড়া, ঋজুদা ভদ্রলোককে আর একটু বসতে বলল না, চা-কফি কিছু খেতেও বলল না। অবাক হওয়ারই কথা।

ভটকাই আমার চেয়ে বেশি অবাক হয়ে হাঁ করে চেয়ে রইল ঋজুদার মুখে।

ঋজুদা মঁসিয়ে পঁপাদুকে ল্যান্ডিং অবধি এগিয়ে দিল। সঙ্গে চামচে ভটকাইও গেল। ফিরে এসে ড্রইংরুমে ঢুকেই বলল, গদাধরদা, এই সৈন্যদের কিছু খাইয়েছ।

এই ভাবতে চিনু কী খাওয়াই।

সে কী! তোমার ভাবনা শেষ হতে হতে ওরা যে আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। তুমি কি চেনে না ওদের?

রাতের জন্যে কী রান্না হচ্ছে এখনও তো বললে না গদাধরদা।

ভটকাই বলল, মাঝে পড়ে।

সেই কথাই তো শুরু করেছিলাম কিন্তু শেষ করার সুযোগ আর পেলাম কোতা? কে একটা হলুদ ব্যাঙের মতো দেখতে উটকো লোক এইসে হাজির হল যে। তা আজ রাতে রাঁধতিচি হলুদ পোলাউ…

মিষ্টি তো?

আমি বললাম।

হ্যাঁ গো হ্যাঁ, মিষ্টিই। আমি কি এই পরথম হলুদ…

আর কী? ভটকাই ইন্টারাপ্ট করল।

আর ভাপা-ইলিশ, চিংড়ি মাছের কাটলেট, দই-রুই, রুই মাছের মাথা-দেওয়া মুগের ডাল, আর আর মুড়িঘণ্ট।

ভটকাই বলল, তুমি কি গো গদাধরদা। বলছ যে চার কুড়ি বয়স হল আর এটাও জানো না যে, পোলাউ দিয়ে মুড়িঘণ্ট খাওয়া যায় না?

আঃ। তাও কি জানিনি নাকি। ভাতও করতেছি, গোবিন্দভোগ চালের। জুইফুলের মতন, মুড়িঘণ্ট আর ডাল দিয়ে খাবে বলে।

আর টক? ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে টক করবে না?

করব তালে।

গুড। আর কী? মধুরেণ সমাপয়েৎ নেই? ভটকাই আবার বলল।

সেটা আবার কী মিষ্টি? কখনও তো নামও শুনিনি বাপের জন্মে।

গদাধরদা বলল।

তারপর বলল, না মধুরেণ-টেন নেই। তবে আচে কে সি দাসের রসগোল্লা। রবিদাদা নিজে পাইট্যে দেচেন।

রবিদাদাটা আবার কে?

ঋজুদা বলল, আরে কে সি দাসের রবি দাস। আমাদের নরেনের দাদা রে। আমাদের সকলেরই রবিদাদা।

ও বুঝেছি।

আর নেপালচন্দ্রের রাবড়িও। শর্মার রাবড়িতে তো আবার তোমার পোড়া পোড়া গন্দ লাগে।

গদাধরদা বলল।

এবারে আমার জন্যে এক কাপ লেবু-দেওয়া চায়ের লিকার দাও আর এরা কী খাবে তা জিজ্ঞেস করে নাও তো গদাধরদা। তারপর নিজের কাজ করো গিয়ে। আমাদেরও কাজ আছে। ততক্ষণে আমরা তা সেরে ফেলি।

ঠিক আ।

গদাধরদা আমাদেরও পরের প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মতো শেষ অক্ষর ফেলে দিয়ে শব্দ উচ্চারণ করে।

গদাধরা দিনকে দিন মড, মডার, মডেস্ট হচ্ছে।

ভটকাই বলল।

আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম ভটাকাইয়ের কথাতে।

আমি বললাম, ইংরিজিটা একটু কম বল ভটকাই, নইলে অন্যে ভাবতে পারে খাদ্য হচ্ছে Fodder।

ভটকাই চুপ করে গেল।

.

গদাধরা চলে গেলে ঋজুদা ভটকাইকে বলল, গ্লোবটা বের কর তো কাঁচের আলমারি থেকে।

ভটকাই ল্যাজারাস কোম্পানির কারুকার্য করা কাঁচের আলমারি থেকে মস্তবড় গ্লোবটা বের করে এনে সেন্টার-টেবলের ওপরে রাখল।

ঋজুদা তখন আমাদের দুজনেরই দিকে তাকিয়ে থাকল এক মুহূর্ত। তারপর বলল, আমি চাটা খেয়ে একটু পাইপ খাই, তোরা এই গ্লোবের মধ্যে একটা দেশ খুঁজে বের কর তো দেখি। দেশটা ভারত মহাসাগরের একটি দ্বীপপুঞ্জ। নাম…

বলেই, কী ভেবে বুক পকেট থেকে ম ব্লা কলমটি তুলে নিয়ে স্লিপ প্যাডে ক্যাপিটাল লেটারে লিখল SEYCHELLES. তারপর বলল, একজন পর্তুগিজ ভদ্রলোব এই দেশটার কথা অস্পষ্ট উল্লেখ করেন তাঁর Plainsphere-এ। ভদ্রলোকের নাম ছিল অ্যালবার্টো ক্যানটিনেনা।

Plainsphere মানে কী?

প্লেইনস্ফিয়ার হচ্ছে এই যে গ্লোব দেখছিস, তারই পূর্বসূরি। প্লেইন কাগজের ওপরে বিভিন্ন, Sphere, বৃত্ত এঁকে বোঝানো হতনৰ্থ পোল, সাউ পোল, তারাদের অবস্থান। সেই বৃত্তগুলোকে ওপরে নীচে করে আবার অ্যাডজাস্ট করা যেত। এই Plainsphere সামনে ফেলেই পালতোলা জাহাজের নাবিকেরা সমুদ্রে সমুদ্রে ঘুরত তখন।

ভটকাই বানান করে বলল, SEYCHELLES. এ আবার কী দেশ রে বাবা। দেশের নাম সাইকেল?

সাইকেল হয় নাকি অক্ষরগুলো জুড়লে?

ঋজুদা একটু বিরক্তির গলাতে বলল।

খুব খুশি হলাম ভটকাইয়ের কিঞ্চিৎ হেনস্থা দেখে।

রুদ্র?

বললাম, সিকেলেস।

তাও নয়।

নয়? কেন?

নয়, কারণ, শব্দটা ফরাসি। উচ্চারণ স্যেশেলস।

আমরা বোকা বনে গেলাম।

এবারে খুঁজে বের কর দেশটাকে। গ্লোব-এ ভারত মহাসাগরে। ভারত উপমহাদেশ আর আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে।

তারপর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে, পাইপটা ভরে নিয়ে ধরাল। গোল্ড-ব্লক পাইপ টোব্যাকোর মিষ্টি গন্ধে ঘর ভরে গেল। এদিকে গোলাকৃতি গ্লোবটাকে চাঁটি মেরে মেরে ভটকাই প্রায় ফ্ল্যাট করে আনল। কিন্তু ভটকাইয়ের সাইকেল বা আমার সিকেলেস এবং ঋজুদার স্যেশেলসকে কিছুতেই খুঁজে পাওয়া গেল না।

ঋজুদা কী যেন ভাবছিল, বুদ্ধির গোড়াতে পাইপের ধোঁয়া দিতে দিতে, অন্যমনস্ক হয়ে। হঠাৎই যেন মনে পড়ে যাওয়াতে বলল, কী হল রে? পেলি?

কী আবার হবে? পবননন্দন হনুমানকে বললেও খুঁজে পেতেন না। আমরা তো কোন ছার।

ভটকাই বলল।

মানে?

ঋজুদা অবাক হয়ে বলল।

মানে, গন্ধমাদন পর্বতের মধ্যে যদি বা বিশল্যকরণী খুঁজে পাওয়া যায়, ভারত মহাসাগরে তোমার স্যেশেলস খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।

আমি বললাম।

ইমপসিবল।

ভটকাই জোর দিয়ে বলল।

ইমপসিবল ইজ আ ওয়ার্ড ফাউন্ড ইন দ্যা ডিকশনারি অফ ফুলস।

ঋজুদা বলল।

তারপর ঋজুদা তার ইজিচেয়ারের ওপরে সোজা হয়ে বসে বলল, আন দেখি এদিকে।

গ্লোব নিয়ে আমরা দুজনেই ঋজুদার কাছে গেলাম। যেতেই, ঋজুদা দেখিয়ে দিল আমাদের। তবে চোখে আঙুল দিয়ে না দেখালে দেখা আদৌ যেত না হয়তো। সরষে দানার চেয়েও ছোট ছোট প্রায় অদৃশ্য কতগুলি দ্বীপ, দারুচিনি, লবঙ্গ এবং আরও নানা মশলার দেশ জাঞ্জিবার আর মরিশাসের কাছাকাছি।

আমরা লজ্জিত হয়ে মাথা নিচু করলাম।

ঋজুদা বলল, তোরা কি ভাবিস দেশ মানেই হাজার হাজার মাইল লম্বা-চওড়া হতে হবে? ইয়ারোপে গেলে দেখবি একদিনে গাড়ি করে চারটি দেশ পেরিয়ে গেলি। দেশ তো বড় শুধুমাত্র আয়তন দিয়েই হয় না রে, দেশ বড় হয় সেই দেশের মানুষের চরিত্র দিয়ে, জাত্যাভিমান দিয়ে, দেশপ্রেম দিয়ে।

তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এই স্যেশেলসের রাজধানী যে দ্বীপটিতে, তার নাম মাহে। রাজধানীর নাম অবশ্য ভিক্টোরিয়া। সে দ্বীপ সতেরো মাইল লম্বা আর তিন মাইল চওড়া। অর্থাৎ একান্ন বর্গমাইল। বোঝ তা হলে।

তা এই পুঁচকে দেশ নিয়ে আমরা কী করব? দেশ-দেশ পুতুল খেলব?

হেসে ফেলল ঋজুদা, ভটকাইয়ের ফাজলামিতে।

ওই মঁসিয়ে পঁপাদু মানুষটি কে?

ভটকাই বলল।

ছটফট করছিল ও জানবার জন্যে।

সময়ে সবই জানতে পারবি, মানে, তুই যখন আমাকে আর রুদ্রকে দমদমের এয়ারপোর্টে ছাড়তে যাবি।

ঋজুদা বলল।

ভটকাইয়ের মুখটা একেবারে কালো হয়ে গেল। তুতুলে বলল, তা-তা হলে আ-আ-আ-মি কি যাব না?

না। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট হয় তা কি জানো না? এবারের ব্যাপারটা খুবই ডেঞ্জারাস। তোমাকে এবারে হয়তো নেওয়া সম্ভব হবে না ভটকাই। সরি!

ভটকাই, গরম দুধে-ফেলা মুড়িরই মতন চুপসে গেল। পরক্ষণেই তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘নিনিকুমারীর বাঘ’ মারতে যাওয়া বা ‘কাঙ্গপোকপি’-তে চুরি-যাওয়া হিরে উদ্ধার করতে যাওয়া কি কিছু কম বিপজ্জনক ছিল?

গদাধরদা হাতের ট্রে-তে করে ঋজুদার জন্য এক কাপ চায়ের পাতলা লিকার নিয়ে এসে ঋজুদাকে দিয়ে, আমাদের বলল, দাদাবাবুরা, তোমরা এসো দিকিনি এবার খাবারঘরে। খাবার নাইগ্যে দিচি।

এখানে কী দোষ করল?

মনমরা ভটকাই বলল।

নতুন কার্পেট এইয়েচে দিকতিচো না। রসগোল্লার রস-টস ফেইল্যে তাকে তো দেবে একিরি চিক্কিরি চইটকে। তোমায় নিয়েই তো ভয়টা বেশি আমার। বড় ট্যালা তুমি!

অগত্যা ভটকাই এল আমার পেছন পেছন। আসার আগে আমার সঙ্গে ঋজুদার একটি চকিত দৃষ্টি বিনিময় হয়ে গেল। ভটকাইটা আজকাল এমনই চালু হয়েছে যে সেটুকুও তার দৃষ্টি এড়াল না।

বিড়বিড় করে খাওয়ার ঘরে যেতে যেতে বলল, সে সব দিন চলে গেছে। ভটকাইকে এখন আর তোমাদের লায়াবিলিটি বলে ভেব না। এখন আমি তোমাদের অ্যাসেট। আমাকে না নিয়ে উপায় আছে তোমাদের কোনও?

.

কলকাতা থেকে বম্বের সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে আসতে আসতে ঋজুদা আমাকে আর ভটকাইকে একটু ব্রিফ করল। সান্টাক্রুজে পৌঁছে আমরা শাটল বাস ধরে সাহার-এর ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যাব। তারপর এয়ার-ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ধরে যাব স্যেশেলসের ‘মাহে’-তে।

ঋজুদা বলছিল উনিশশো ঊনআশিতে যখন প্রথমবার স্যেশেলসে আসে, তখন তানজানিয়ার দার-এস-সালাম যাওয়ার পথে নেমেছিল কয়েক ঘণ্টার জন্যে মাত্র। তখন এয়ার ইন্ডিয়ার উড়ানের স্যেশেলস হয়ে দার-এস-সালামে যাওয়ার বাধা ছিল। কেনিয়ার নাইরোবি যেতে পারত অবশ্য।

পরে আরেকবার স্যেশেলশে এসেছিল ঋজুদা, ছুটি কাটাতে। পনেরো দিন ছিল। আফ্রিকা ফেরত।

ঋজুদা আমাদের যা বলল, তার সারাংশ এরকম।

স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থান ম্যাডাগাসকারের উত্তরে বিষুবরেখার চার ডিগ্রি দক্ষিণে। পুরনো দিনে যে সব চালু জলপথ ছিল, সে পথে যেতে-আসতে ওই সর্ষেদানার মতন দ্বীপপুঞ্জ কোনও নাবিকেরই চোখে পড়ত না। পশ্চিমের আরব দেশ, পূর্বের ইন্দোনেশিয়া (আগের সুমাত্রা ও জাভা) থেকে আসা জাহাজের কিছু কিছু নাবিক মিষ্টি জল ও খাবারের খোঁজে ওই দ্বীপপুঞ্জের দু-একটি ছোট দ্বীপে নেমেছিল। তারা যে আদৌ নেমেছিল, তা অনুমান করেন ভৌগোলিকেরা অনেকদিন পরে সেখানে কিছু কবরের খোঁজ পেয়ে। তারপরে পঞ্চদশ খ্রিস্টাব্দের গোড়াতে ভাসকো-দা-গামা তাঁর ভারতযাত্রার পথে এই দ্বীপপুঞ্জের মধ্যের একটি দ্বীপ, যার নাম ‘আমিরান্টেস’, দেখতে পান। সেই কারণে, সেই দ্বীপের আদি নাম বদলে রাখা হয় অ্যাডমিরাল দ্বীপ। কোনও কোনও দ্বীপ পর্তুগিজ নাবিকদেরও চোখে পড়ে। তারা এই দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করে ASSETE IRAMS (সাত বোন) এবং OSIR MAUS (সাত ভায়ারা)।

নানা দেশের জলদস্যুরাই এই নির্জন দ্বীপপুঞ্জে তাদের গোপন আস্তানা গড়ে তোলে। এই দ্বীপপুঞ্জ চালু জলপথের ওপরে নয় বলেই তাদের সুবিধেও হত নানারকম। বহু জলদস্যুর গুপ্তধন এখনও পোঁতা আছে এই স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের নানা দ্বীপে। এমনই শুনতে পাওয়া যায়।

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি অ্যালবার্ট ক্যানটিনো নামের এক মানচিত্রী, যিনি, PLAINSPHERE এর প্রবর্তক, তাঁর আঁকা মানচিত্রে প্রথম স্যেশেলসকে আঁকেন। তার অনেকই পরে, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়াতে, ইংরেজ বণিকদের একটি দল যখন ভারতের পশ্চিম উপকূলের সুরাটের দিকে বাণিজ্য করার উদ্দেশ্যে আসছিলেন, তখন তাঁদের চোখে পড়ে যায় এই স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জ। এক ইংরেজ সাহেব, জন জরডেইনের লেখা, স্যেশেলস সম্বন্ধে বিবরণ প্রথম প্রকাশিত হয় উনিশশো পাঁচ সালে। তারপর ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সোড়শ নয় খ্রিস্টাব্দে ‘Ascension’ এবং ‘Good Hope’ জাহাজে করে কিছু ইংরেজ ব্যবসায়ী স্যেশেলসের মাহে এবং অন্য একটি দ্বীপে নেমেছিলেন। তারও পর, সতেরশো শতাব্দীর মাঝামাঝি ফরাসিরা এসে, বলতে গেলে, স্যেশেলসে রীতিমতো একাধিপত্য জারি করে। জাঞ্জিবার থেকে তারা বারবার আক্রমণ করে পুরো দ্বীপপুঞ্জের মালিক বনে যায়। সবচেয়ে আগে যে দ্বীপটি তারা দখল করে, তার নাম ST. ANNE ISLAND.

এখনও দ্বীপটি ওই নামেই পরিচিত।

তখন ফরাসি রাজত্বের প্রথম ভাগ। ফরাসি দেশের কন্ট্রোলার-জেনারেল যিনি ছিলেন তাঁর নাম ছিল ভাইকাউন্ট মোরে দ্য স্যেশেলস। ওঁরই নামানুকরণে জয় করা নতুন দ্বীপপুঞ্জের নাম রাখেন ফরাসিরা ‘স্যেশেলস’। কিন্তু তখন ওই দ্বীপপুঞ্জে কোনও জনবসতি ছিল না। আদিবাসী বলতেও কেউই ছিল না। ফরাসিরা তাই মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকা, মরিশাস এবং ফরাসি দেশ থেকেও অনেক পরিবারকে এনে ওখানে বসতি করিয়ে দারুচিনি, নারকেল, তামাক, তুলো ইত্যাদি চাষ শুরু করল। কিন্তু হলে কী হয়, তার বছর-পঞ্চাশের মধ্যেই ইংরেজরা এসে ওই দ্বীপপুঞ্জ ফরাসিদের কাছ থেকে কবজা করে নিল। তারও কিছু পরে, কিছু ভারতীয় এবং অবাক কাণ্ড, চীনারাও এসে হাজির হল। তার ফলে কালো, সাদা এবং বাদামি নানা ধরনের মানুষের বাসভুমি হয়ে উঠল স্যেশেলস। তবে যেহেতু আফ্রিকানরাই শ্রমিক হিসেবে বেশি সংখ্যাতে এসেছিল, তাদের প্রভাবই এখনও তাই বেশিই আছে।

কোন ভাষাতে কথা বলে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের মানুষেরা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

ভাষা চলে স্যেশেলসে তিনটি। ফরাসি, ইংরেজি এবং…

এবং সোয়াহিলি?

বাহাদুরি করে বললাম আমি।

ঋজুদা আমার বাহাদুরির মাথাতে জল ঢেলে দিয়ে বলল, না রে! এখানের সেই মিশ্র ভাষার নাম ক্রেওল। তাতে সোয়াহিলির প্রভাব আছে কি না জানি না, কিন্তু ফরাসি ভাষার প্রভাব বেশ আছে। তবে, ইংরেজির প্রভাবও কিছু আছে। ভাষাতত্ত্ববিদেরা সঠিক বলতে পারবেন। ক্রেওল এক খিচুড়ি ভাষা। তবে ওই তিন ভাষাই সরকারিভাবে স্বীকৃত।

বম্বেতে সান্টাক্রুজ এয়ারপোর্টে নেমে, শাটল বাসে উঠে সাহার এয়ারপোর্টের দিকে যখন আমরা যাচ্ছি, তখন ভটকাই প্রায় চিৎকার করে উঠল। অ্যাই রে। ঋজুদা। কেলো হয়েছে। আমাদের স্যুটকেসগুলোই নেওয়া হল না!

আমি বললাম, ওগুলো চলে যাবে আমাদের নতুন প্লেনে। তোর মাথাব্যথা নেই। তোর হ্যান্ডব্যাগটা নিয়েছিস তো?

হ্যাঁ। এই তো।

তা হলেই হবে।

ভটকাই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, স্যেশেলসে যাওয়ার কারণটা কী তার আভাস তো কিছু দেবে? তোমার মিস্টার পাদু কি ভূগোল পড়াতেই নেমন্তন্ন করেছেন? না ইতিহাস?

ঋজুদা ভটকাইয়ের কথাতে হেসে ফেলল।

ঋজুদা হাসে কম, কিন্তু হাসলে দারুণ দেখায়।

আমি বললাম, তোর মুখের ভূগোল পাল্টাবে এবারে মঁসিয়ে পঁপাদু। তাই তো ঋজুদা তোকে নিয়ে এসেছে এবারে।

রহস্য সবে জমাট বাঁধছে। একবার এসেই সেই রহস্যের ফোঁড়া-ফাটানো যাবে কি না তাও বলতে পারছি না। তবে রহস্য অবশ্যই আছে। নইলে মিস্টার পাদু ওখান থেকে পুরো ভারতবর্ষ পেরিয়ে পূর্বপ্রান্তের কলকাতাতে এসে পৌঁছবেন কেন হাঁচোর-পাঁচোর করে এই ঋজু বোসের ডেরাতে?

টার্মিনাল-বিল্ডিংয়ে ঢুকে ঋজুদা বলল, একসঙ্গে থাকব না কিন্তু আমরা। এবার থেকে একটু ছাড়া ছাড়া থাকব। যেন একে অন্যকে চিনি না। অথচ নজর রাখব অন্য দুজনের ওপরে প্রত্যেকেই। পিয়েরের লোকজন এখানেও থাকতে পারে।

বললাম, এবার আমারও হেঁয়ালি-হেঁয়ালি ঠেকছে। যা বলবে তা একটু খুলেই বলো না ঋজুদা। এই পিয়েরটি আবার কোথা থেকে এল? এক পপাদুকে নিয়েই তো ভটকাই হয়রান।

বলব, বলব। সবই বলব যথাসময়ে। তাড়া কীসের? বম্বে থেকে প্লেন ছাড়লেই তো সাড়ে চার ঘণ্টাতে পৌঁছে যাব একেবারে অপারেশনাল এরিয়াতে। তখন সব যদি জানা না থাকে তা হলেই তো কড়াক-পিঙ।

কড়াক-পিঙটা আবার কী জিনিস?

ভটকাই বোকার মতো প্রশ্নটা অত্যন্ত বিজ্ঞর মতো করল।

বললাম, অপার অশিক্ষিত তুই। সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেবের দেশে বিদেশে বইটা পড়ে নিস। অমন বই বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি লেখা হয়নি।

.

বোয়িং প্লেনটা যখন নীচে নামতে লাগল, সমুদ্রকে যখন সমুদ্র বলেই চেনা গেল, তখনই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলাম। প্লেন যখন উঁচু দিয়ে ওড়ে তখন সমুদ্রকে সমুদ্র বলে বোঝাই যায় না। মেঘের নীচেই থাকে। এখন আকাশে মেঘ নেই বলে সমুদ্রকে একটা কালো চাদরের মতো দেখাচ্ছে, যার ওপরে সাদা সাদা অসংখ্য অস্থির রেখা। সেগুলো ফেনা-ভাঙা ঢেউ আর কী! অত ওপর থেকে ওইরকমই মনে হয়।

প্লেনটা ঘুরে ঘুরে নীচে নামতে লাগল। মনে হল, একেই বোধহয় বলে। পরীদের দেশ, স্বর্গের দেশ। সমুদ্রের মধ্যে মধ্যে পাহাড় ঘেরা সব ছোট ছোট দ্বীপ। কোনও দ্বীপকে ঘিরে রয়েছে কমলা-রঙা ছায়া চারদিকে, কোনও দ্বীপকে ফিকে নীল, কাউকে বা গাঢ় গোলাপি। আরও কত যে রং, তা কী বলব! এমন সুন্দর কোনও দেশ যে পৃথিবীতে আছে, তা জানাই ছিল না।

ভটকাই বিস্ময়ে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বলল, এ কী! এমন সব রং কেন?

একেই বলে প্রবাল দ্বীপ! বুঝেছিস। জলের নীচে যে রঙের প্রবাল, সেই রঙেরই আভা ফুটেছে জলে।

ঋজুদা বলল।

প্লেনটা আরও এক চক্কর মারল দ্বীপপুঞ্জের ওপরে, যেন এই স্বপ্নের দেশকে ভাল করে দেখাবারই জন্যে। তারপরই নেমে পড়ল রানওয়েতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল যে, পাইলট বুঝি সামলাতে পারবে না আর, প্লেনসুন্ধু আমাদের অবধারিত সলিল সমাধি কেউই আর ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু যাই হোক, দৈববলে একেবারে জলের কিনারে গিয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে ব্রেক কষে, পাইলট প্লেনের মুখটা ঘোরাল।

ঋজুদা স্বগতোক্তি করল। আরে! এয়ারপোর্টটা তো এখন অনেক লম্বা হয়েছে মনে হচ্ছে। নাকি, চোখেরই ভুল? প্রথমবার যখন এসেছিলাম উনিশশো ঊনআশিতে, তখন সত্যিই মনে হয়েছিল যে, জলেই পড়ে যাবে প্লেনটা। তা করবেটাই বা কী? জায়গা কোথায়? এই হচ্ছে স্যেশেলসের রাজধানী ভিক্টোরিয়া। মাহে দ্বীপে। এই দ্বীপটারই নাম ‘মাহে’। বলেছি তো! এই দ্বীপ লম্বাতে সতেরো মাইল আর চওড়াতে তিন মাইল। তাও আবার শুধুই সমতল জমি নয়, পাহাড়-টাহাড় নিয়ে। আর পাহাড়ও তো এখানে কম নেই। প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় প্রত্যেকটি দ্বীপের আধো-চাঁদা তটরেখার পেছনে পেছনে। স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ওই স্বাধীন দেশের যদি রাজধানী হয় তবে অন্য দ্বীপগুলি যে কত ছোট তা তো অনুমানই করতে পারছিস।

প্লেন থেকে নেমে, টারম্যাকে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখি, সামনেই কাছে-দূরে তিনটি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। দ্বীপপুঞ্জ যখন, তখন দ্বীপ তো থাকবেই অনেক।

ভটকাই বলল, ঋজুদা স্যেশেলসের মানুষদের কী বলে?

আমি বললাম, কী আর বলবে, মানুষই বলে।

বোকার মতো কথা বলিস না। ইন্ডিয়ার মানুষদের যেমন বলে ইন্ডিয়ান, অ্যামেরিকার মানুষদের অ্যামেরিকান তেমনই আর কী?

নারে! স্যেশেলসের মানুষদের বলে স্যোশেলোয়া। ঋজুদা বলল।

স্যেশেলোয়া!

ভটকাই পুলকিত হয়ে পুনরাবৃত্তি করল।

ঋজুদা বলল, এখানে আমি ছাড়া আর কেউই অন্যদের সঙ্গে কথা বলবে না। বুঝেছ। মানে, যখন আমার সঙ্গে থাকবে। যখন আমি সঙ্গে থাকব না, তখন তো অন্যদের সঙ্গে তোমাদের কথা বলতেই হবে। এবং ইংরেজিই বলতে হবে।

অত ইংরেজি! উরি বাবা!

ভটকাই বলল।

আমরা নিজেদের মধ্যে অবশ্য সবসময়েই বাংলাতেই কথা বলব।

তারপর বলল, ‘ক্রেওল’ ভাষাটা এত স্বল্প দিনে আয়ত্ত করা গেল না। তোরা তো আবার ফরাসি জানিস না কেউই। তিতিরটা থাকলে খুবই ভাল হত। সে মেয়েটা তো রীতিমতো একজন ভাষাবিদ। লিঙ্গুইস্ট।

প্রতিভা যাহাকেই স্পর্শ করে, তাহাই…

ভটকাইকে বকাবকি অবশ্যই করি বটে, কিন্তু ও না থাকলে আমাদের এই অভিযানগুলো একটু বেশিই সিরিয়াস হয়ে যেত। ভটকাই সঙ্গে থাকে বলেই কখনওই আমাদের ‘টেন্স’ হয়ে ওঠা হয় না। ও একটা ওরিজিনাল মানুষ।

কাস্টমস আর ইমিগ্রেশন-এর কাউন্টার সহজেই পেরনো গেল। ঋজুদা বলল, এটা ট্যুরিস্ট স্পট। সারা পৃথিবী থেকে পর্যটকরা আসছেন প্রবাল দ্বীপের সৌন্দর্য দেখতে, স্কুবা-ডাইভিং করতে, স্নরকেলিং করতে, সাঁতার কাটতে, সাদা বালুবেলাতে সাঁতরাগাছির ওল-এর মতন সারে সারে শুয়ে থেকে গায়ের সাদা বা লাল রং পুড়িয়ে পোড়ামাটির মতো রাঙা হয়ে উঠতে। যত বেশি বিখ্যাত-স্পট, তত বাতিকগ্রস্ত আর হাফ-পাগল আর পাগল এসে জোটে সেখানে।

স্কুবা-ডাইভিং আর স্নরকেলিং মানে কী? ভটকাই বলল।

অভিধানে দেখে নিবি। পশ্চিমি জগতে কেউ আমাদের মতন সবকিছুই অন্যের কাছ থেকে জেনে নিতে চায় না। নিজেরাই কষ্ট করে জানে। তাই, মনে থাকে। লক্ষ করে দেখিস, ওরা পারতপক্ষে পথঘাটের হদিসও জিজ্ঞেস করে না। নিজেরাই ম্যাপ দেখে বের করে।

ঋজুদা হঠাৎই বলল, শোন, তোরা দুজনে একটু পাগল-পাগল ভাব করবি। আর ভাব করবি, যেন তোরা দুজনেই আমার ছেলে। দুই ন্যালাখ্যাপা। ভুলে যাস না।

ছেলে!

ভটকাই ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলল, বাবা জানলে কিন্তু ভীষণ রাগ করবে। বাবার একমাত্র বংশধরকে তুমি মেরে দেবে?

ঋজুদা বলল, সেটা কোনও কথা নয়। মা জানলে আরও বেশি রাগ করবেন হয়তো। কিন্তু কী করা যাবে। কার্যসিদ্ধি করে এবং প্রত্যেকেরই পৈতৃক প্রাণ বাঁচিয়ে কলকাতায় ফেরার চেষ্টা তো করতে হবে।

আমি বললাম, কাস্টমস আর ইমিগ্রেশনে তো আমাদের দুজনের বাবার নাম পাসপোর্টেই দেখতে পাবেন ওঁরা।

আঃ। ওদের জন্যে তো বলছি না। তুইও আজকাল বড় এঁড়ে-তর্ক করিস।

ভটকাই মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, আমার হেনস্থাটা পুরোপুরি উপভোগ করল।

কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন খুবই ভাল ব্যবহার করল। ছোট এয়ারপোর্ট। সকলেই যেন পর্যটকদের অভ্যর্থনা করতেই উৎসুক হয়ে আছেন। তা ছাড়া, আমরা এসেছিও তত ট্যুরিস্ট-ভিসা নিয়েই।

লাগেজ এসে গেলে, আইডেন্টিফিকেশন ট্যাগ দেখিয়ে আমরা ট্রলিতে লাগেজ চাপিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এলাম। গ্রিন-চ্যানেল রেড-চ্যানেল ও সবের বালাই-ই নেই এখানে।

এখানে ট্যাক্সি ও গাড়িগুলো দেখলাম ছোট ছোট। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। তুতেনীল আকাশ। ঝকঝক করছে রোদ্দুর। সামনেই একটা গাঢ় সবুজ পাহাড়। হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়।

ঋজুদা বলল, প্রথমবার জাপানে গিয়েও আমার এরকমই মনে হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষ, সরু-সরু রাস্তা, ছোট-ছোট গাড়ি, পাঁচ কাঠার ধানখেত, সবই কিম্ভুত। কিন্তু অতটুকু দেশের বাঁটকুলে মানুষগুলো সারা পৃথিবীকে প্রায় কবজাই তো করে ফেলেছিল আর একটু হলে। তাই না? দৈর্ঘ্য-প্রস্থ দিয়ে দেশের মাপও যেমন হয় না, মানুষের মাপও হয় না। আমার মতন লম্বা-চওড়া মানুষেরা বোকাই হয় সচরাচর।

একটা ট্যাক্সিকে দাঁড় করিয়ে ঋজুদা সামনে বসল। আর ঋজুদার দুই ন্যালাখ্যাপা ছেলে, পেছনে। মালপত্র পেছনেই রাখা হয়েছিল। তিনজনেরই একটি করে মাঝারিমাপের স্যুটকেস আর একটি করে হ্যান্ডব্যাগ।

অনেকগুলো ছাদহীন ছোট-ছোট নানা-রঙা গাড়ি দেখলাম। শর্টস-পরা, মাথায়–হ্যাট চড়ানো সাহেব ট্যুরিস্টরা চালিয়ে বেড়াচ্ছে। ঋজুদা বলল, দ্যাখ, দ্যাখ, ওই গাড়িগুলোর নাম ‘মিনিমক। ভাড়া পাওয়া যায় এখানে।

দেশটা ছোট হতে পারে, গাড়িটাও ছোট হতে পারে, কিন্তু গন্তব্যও যে এত সামান্য দূরত্বে হতে পারে, তা জানা ছিল না। বলতে গেলে, ট্যাক্সিতে উঠলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই নামলাম। ঋজুদা কি রসিকতা করছে না কি আমাদের সঙ্গে? করছে কি না, তা বোঝার আগেই ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল ঋজুদা। আমরা স্যুটকেসগুলো নামিয়ে নিলাম। ট্যাক্সিওয়ালা ক্রেওল ভাষাতে বিড়বিড় করে কী সব গালাগালি দিল আমাদের। তারপর বেশ বিরক্ত হয়ে দড়াম করে প্রায়ই ভটকাই-এর কড়ে-আঙুলটা চাপা দিয়েই দরজাটা বন্ধ করে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক জোরে ট্যাক্সি চালিয়ে ভিক্টোরিয়া শহরের দিকে চলে গেল। ওর দোষ কী? ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে তো কোনও ট্যাক্সিওয়ালাই পাঁচশো গজ যাওয়ার জন্যে অপেক্ষা করে না। বেচারি ভেবেছিল দূরে যাব আমরা। বড় হোটেলে উঠব। মোটা ভাড়াও বকশিস পাবে ও।

বকশিস অবশ্য দিল ঋজুদা। তারপর সামনে একটু ঝুঁকে, বাও’ করে বলল, মেরসি।

ড্রাইভার বলল, ইউ আর ওয়েলকাম স্যার।

এমনভাবে বলল যে, শুনে মনে হল বলল, জাহান্নামে যাও।

রাস্তার যেখানে নামলাম, তার সামনেই একটি গেট। একটি একতলা বাংলো বাড়ি। যেন সমুদ্রর মধ্যে থেকেই গেঁথে তোলা হয়েছে। একটা চওড়া প্যাসেজ দিয়ে গিয়ে ঢুকতে হয় সে বাড়িতে। বাড়ির সামনেই একটা চওড়া সমুদ্রমুখী বারান্দা।

ভটকাই বলল, আঃ সারা দিন-রাত সমুদ্র দেখেই দিন কেটে যাবে। কী বল রুদ্র?

তারপর বলল, তাইলে? ‘ইরেই’ কয় ইন্ডিয়ান ওশান?

স্যুটকেসগুলো তুলে নিয়ে গেট খুলে ভিতরে ঢুকতে যাব, এমন সময়ে ভরদুপুরের টুকরো-টাকরা রোদের অগণ্য হলুদ-রঙা প্রজাপতি উড়িয়ে হাওয়াটা বাংলোটার পাশের নারকোল বনের মাথা আঁচড়ে, নানা অদৃশ্য অলিগলি দিয়ে ঝাঁপিয়ে জলে ইলিবিলি কেটে পরক্ষণেই আমাদের চুল এলোমেলো করে দিল।

বাংলোটার ভেতরে কিন্তু আর ঢাকা হল না। ঠিক তখনই এয়ারপোর্টের দিক থেকে একটা কালো কাঁচ-তোলা কালো-রঙা এয়ারকন্ডিশন্ড টোয়োটা গাড়ি জোরে এসে আমাদের সামনে ব্রেক করে থেমে গেল।

তখনই মনে পড়ল মঁসিয়ে পাঁপাদু সেইরকমই বলেছিলেন বটে।

একজন বয়স্ক কিন্তু অত্যন্ত সপ্রতিভ ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমেই স্যুটকেস তিনটে ফটাফট গাড়ির বুটে তুলে নিয়েই আবার স্টিয়ারিং-এ বসল গিয়ে।

ঋজুদার দেখাদেখি ঋজুদার দুই কলকাতার মাখনবাবু ছেলেও সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়ল।

তারপর গাড়ি চলতে লাগল তো লাগলই।

সতেরো মাইল বাই তিন মাইল ইজ ইকুয়ালটু একান্ন বর্গমাইল দ্বীপ এই মাহে। তার মাঝামাঝি ফুড়লেও হয় পঁচিশ মাইল। কিন্তু বেশ জোরে গাড়ি যাওয়া সত্ত্বেও প্রায় আধঘণ্টা এঁকেবেঁকে একবার সমুদ্রতীরে, একবার পাহাড়ের গা, একবার সমতল হয়ে গাড়িটা চলতেই লাগল। কোনও কোনও জায়গাতে পথ চলে গেছে সমুদ্রের কোনা ঘেঁষে ‘কজওয়ের ওপর দিয়ে। ভারী সুন্দর দেখায়। অন্যদিকে ব্যাকওয়াটারের সৃষ্টি হয়েছে। জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল কজওয়ের কংক্রিটের ঢালাইয়ের ইঞ্চি ছয়েক তলা দিয়ে বয়ে যায়। বর্ষা যখন প্রবল হয়, তখন কখনও কখনও পথের ওপর দিয়েই নিশ্চয়ই বয়ে যায় সমুদ্র। নইলে আর CAUSEWAY বানানো কেন?

গাড়ি চলছে তো চলেইছে। বেশ জোরেই চলছে। আরও মিনিট দশেক কেটে গেল, এমন সময়ে ড্রাইভার গাড়ির রিয়ার-ভিউ-মিররে তাকিয়ে ইংরেজিতে স্বগতোক্তি করল, এতক্ষণে পোকাটাকে ঝেড়ে ফেলা গেল। আর ও ফলো করতে পারবে না আমাদের।

পোকা? পোকা কীরে?

ভটকাই বলল।

আমি বললাম, ‘পুকা। মানে টিকটিকি। বোঝলা কিছু?

হ৷ হ।

বলল, ভটকাই। বুঝছি। বুঝছি! পিছু নিয়েছিল।

তখনও গন্তব্যেই পৌঁছনো গেল না। খিদে অবশ্য ছিল না। কারণ, এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে চমৎকার লাঞ্চ দিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসে এসে যেখানে থাকব সেখানে একটু গুছিয়ে বসতে না পারলে কি ভাল লাগে। নামতে না নামতেই এ কী পোকার উপদ্রব!

ড্রাইভারের নাম কার্লোস। সে মুহূর্তের মধ্যে গাড়িটা ব্যাক করে নিয়ে যে পথে আমরা প্রথমেই এগিয়েছিলাম সে পথেই মিনিট পনেরো গিয়ে একটি ছোট পাহাড়ের প্রায় মাথাতে ঘুরে ঘুরে উঠে ছোট্ট কিন্তু ছবির মতন একটি সাদা রং করা ভিলার গেটের সামনে পৌঁছে, গাড়ি দাঁড় করাল। ভিলাটার প্রবেশ পথের এক পাশের পিলারের ওপর কালো পাথরের ওপরে সাদাতে লেখা আছে: ‘দি ঈগলস রুস্ট। আমি বললাম, ঈগলের বাসা!

বাড়ির নাম? অসাধারণ নাম।

ঋজুদা বলল।

তারপরে কার্লোস নিজেই পকেট থেকে চাবি বের করে গেট খুলে প্রধান প্রবেশদ্বারে গাড়ি দাঁড় না-করিয়ে নানারকম গাছের সারির মধ্যে ড্রাইভ দিয়ে চালিয়ে গিয়ে পেছনের প্রবেশদ্বারের সামনে এনে গাড়ি দাঁড় করাল। শুধুই সমুদ্র ভিলাটার পেছন দিকে। ভারত মহাসাগর। সুনীল। আদিগন্ত। কোনও দ্বীপও চোখে পড়ে না এখান থেকে। সম্ভবত এদিকে কোনও দ্বীপ নেইও।

আমরা মালপত্র নামিয়ে নিলে, ঋজুদাকে একগোছা চাবি দিয়ে ঋজুদার সঙ্গে এবারে ফরাসিতে কী সব কথা বলে স্যালুট করে চলে গেল কার্লোস। মাঝেমাঝেই কার্লোস বলছে, পাঁর্দো মঁসিয়ে, পাঁর্দো মঁসিয়ে।

ফরাসিতে পাঁর্দো, ইংরেজিতে পাৰ্ডন। ওইটুকু ফরাসি জানতাম।

এরা সব অতীব ভদ্রলোকের জাত তো। কারও কথা না বুঝতে পারলে, ধমকে কখনওই বলে না, কী বললেন, বোঝা গেল না। ওরা বলে, ক্ষমা করবেন। পার্ডন। পাঁর্দো। আরও একটা কারণ আমার মনে এল। ঋজুদার ফরাসিটা অনভ্যাসের ফোঁটার মতন চড়চড় করছিল বলেই ঋজুদার সব কথা হয়তো কার্লোস বুঝতে পারছিল না। তাই কার্লোস-এর অত পাঁর্দোর তুবড়ি।

এখানে এই বিজাতীয়দের দেশে পৌঁছে দুর্বোধ্য ভাষাভাষী মানুষজনের মধ্যে পড়ে তিতিরের অনুপস্থিতি খুবই অনুভব করছিলাম। ও মেয়ে তো নয়, সাক্ষাৎ দুর্গা, রূপে গুণে। দশপ্রহরণধারিণী।

ভটকাই গলা নামিয়ে আমাকে বলল, আরে ও রোদদুরবাবু! বেয়ারা-বাবুর্চিরা সব গেল কোথায়? একটা ডাবল-ডিমের ওমলেট, মধ্যে একটু চিজ আর চিকেন দিয়ে করে দিলে, সঙ্গে এক গ্লাস ড্রিংকিং-চকোলেট, ইক্কেরে জমে যেত।

বলেই বলল, কী ব্যাপার ঋজুদা? তোমার কি কোনও ইজ্জত নেই? তোমার ছেলে দুটোর এমন হেনস্থা। ন্যালাখ্যাপা বলে কি তারা মানুষ নয়? নো খাতির! অথচ জান-লড়াতে এলাম।

ঋজুদা বলল, এখানে বেয়ারাও নেই, বাবুর্চিও নেই। ঝাড়ুদারও নেই, এমনকী জমাদারও নেই। আজ রাতের রান্না তুমিই করবে ভটকাই। ফ্রিজ খুলে দেখ, মঁসিয়ে পঁপাদুর লোকজন দয়া করে কিছু রেখে গেছে কিনা, হ্যাম, সসেজ, ডিম, মাছ, দুধ ইত্যাদি কিছু নিশ্চয়ই থাকবে।

ভটকাই বিরাট ফ্রিজটা খুলেই চেঁচিয়ে বলল, ফক্কা! এ কী! খাবারদাবার নট কিচ্ছু। গোটা ত্রিশেক ইলেকট্রিক বালব আছে শুধু।

বলিস কীরে! ফ্রিজের মধ্যে ইলেকট্রিক বালব।

ভটকাই বলল, হাঃ। জোক অফ দ্য ইয়ার।

অবাক হলাম আমি। ভটকাইটাও পুরোপুরি সাহেব হয়ে উঠেছে। কোথায় বলবে ‘হায় কপাল’! তা না, বলছে ‘জোক অফ দ্য ইয়ার।

ঋজুদা স্বগতোক্তির মতন বলল, এই ভিলাতে রাতে কোনও আলো জ্বললে তা সমুদ্র থেকে তো বটেই, ভিক্টোরিয়া শহরের অনেক জায়গা থেকেই দেখা যাবে। সে জন্যেই বালবগুলো খুলে রেখেছে। তবে এখন শুক্লপক্ষ। খুব একটা অসুবিধা হবে না। ঘরের মধ্যে ছোট আলো জ্বালিয়ে পরদা ভাল করে টেনে ভেতরে থাকতে হবে।

গরমে সেদ্ধ হয়ে যাব যে! জানালা বন্ধ করে, পরদাও বন্ধ করে?

ভটকাই বলল।

ইডিয়ট। ভিলাটা সেন্ট্রালি-এয়ারকন্ডিশনড। এতক্ষণেও বুঝলি না?

আমি বললাম।

তাই? আরে তাই তো দেখি! বিজবিজ করে ঠাণ্ডা বেরুচ্ছে। বলিস কী রে। এটা কার ভিলা?

ঋজুদা এতক্ষণে পাইপের পোড়া-ছাই খুঁচিয়ে বের করে অ্যাশট্রেতে ফেলে বলল, ভিলাটা আমার বেয়াই-এর।

মানে? বেয়াই কাকে বলে?

মেয়ের শ্বশুরকে।

ভটকাই বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেসে বলল খালি ঠাট্টা। এখন পর্যন্ত কেসটা কী তাই জানালে না। তোমার ন্যালাক্ষ্যাপা ছেলে দুটোকে কি আজীবন এমনি হাবাগোবাই করে রাখবে?

না। এবারে সব বলব। শনৈঃ শনৈঃ বৎস। চলো। এবারে বসবার ঘরে গিয়ে স্থির হয়ে বোসো।

তারপরেই আমার দিকে ফিরে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে বলল, এই চাবিটা নিয়ে গিয়ে বাইরের গেটে তালা মেরে দিয়ে আয় রুদ্র। ভেতর দিয়ে মারবি না কিন্তু। বাইরের দিকে লাগাতে হবে, যাতে বাইরে থেকে মনে হয় যে, ভিলার মালিক থাকেন না এখানে। অথবা এখন নেই। মানে, ভিলাটা আন-অকুপায়েড।

ওক্কে। কিন্তু বাইরে বাইরে দিয়ে তালা লাগিয়ে যদি ভেতরে ঢুকতে না পারি?

হাত বাড়িয়ে থেকেই যদি বাইরে তালা না লাগাতে পারিস, তা হলে বাইরে বেরিয়েই লাগাতে হবে। তারপর সে-গেট ডিঙিয়ে অথবা অন্য যেভাবেই হোক, ভেতরে ঢুকতেও হবে। রুআহা’, ‘গুগুনগুম্বারের দেশে’, ‘অ্যালবিনো’, ‘নিনিকুমারীর বাঘ’, ‘কাঙ্গপোকপি’র-পার্টনার যদি এইটুকুও করতে না পারে, তবে তোকে আমি ত্যাজ্যপুত্ত্বর করব। ভটকাইকেই রাজসিংহাসনে বসাব।

ভটকাই আমাকে কিছু না বলে একবার অপাঙ্গে আমার দিকে তাকাল শুধু।

আর কথা না বাড়িয়ে চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে গেলাম পেছনের দরজা দিয়ে।

.

বাইরে থেকে গেট-এ তালা দিয়ে গেট টপকে পেছন দিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকে দেখি ঋজুদা সেন্টার টেবিলের ওপরে একটি ম্যাপ ছড়িয়ে বসেছে। আর মিস্টার ভটকাই, বড় জাহাজের বুড়ো ক্যাপ্টেনরা যেমন হাফ-আই রিডিং গ্লাস চোখে লাগিয়ে সরু সরু লাল-নীল শিরা-উপশিরায় ভরা শীর্ণ অগণ্য হাতের মতন দেখতে ন্যাভিগেশন ম্যাপের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন, তেমন ভাবেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। তার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, যেন শত্রুপক্ষের ডুবোজাহাজ টর্পেডো ছুঁড়ে এখনই তার নিজের জাহাজের পেট-ফাঁসাবার কু-মতলবে আছে।

ঋজুদা ম্যাপ থেকে মুখ তুলে বলল, এবারে তোদের ব্রিফ করে দেওয়া দরকার। এতক্ষণ তো অনেক ইয়ার্কি-ফাজলামি হল। ভটকাই, এবারে আজেবাজে ইয়ার্কি করলে ভাল হবে না। মঁসিয়ে পঁপাদু আমাদের এত খরচপত্র করে এত দূরে ইয়ার্কি মারার জন্যে নিয়ে আসেননি।

সে তো জানা কথাই। তা আমরাও তো জানতেই চাচ্ছি। তুমিই তো বলছ না।

ভটকাই ঋজুদার কথা কেটে বলল।

আমাদের কাজটা খুবই বিপজ্জনক। তার ওপরে বিদেশ-বিভুই জায়গা। ইয়ার্কি মারাটা একেবারে বন্ধ কর। আরও একটা কথা, তোরা যখনই বাইরে বেরুবি, সঙ্গে নিজের নিজের পাসপোর্টটা নিয়ে বেরুবি।

কেন?

আমি প্রশ্ন করলাম।

যদি খুন হয়ে যাস, তা হলে স্যেশেলস-এর কর্তৃপক্ষের পক্ষে বডি আইডেন্টিফিকেশনে সুবিধা হবে। কারণ আমাদের মধ্যে কেউ খুন হয়ে গেলে অন্য দুজনের কেউই কারও বডি আইডেন্টিফাই করতে যাব না।

মরলেই বে-ওয়ারিশ হয়ে যাব? এ আবার কেমন ব্যাপার?

হ্যাঁ। কারণ, কেউ যদি খুনই হই তো অন্যে, যে, সেই লাশ আইডেন্টিফাই করবে সেও পরে অবশ্যই খুন হয়ে যাবে। লাশ আইডেন্টিফাই করতে এসে নিজেই আইডেন্টিফায়েড হয়ে যাবে।

কেন?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

কমোন সেন্স। সব গাধার সব ‘কেন’র উত্তর দেওয়ার সময় বা ইচ্ছা আমার নেই।

এবারে বলো ঋজুদা খোলসা করে, কেন আমরা এখানে এসেছি। আমাদের কী করতে হবে।

আমি ভটকাইয়ের ওপরে ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললাম।

কাজটা অতি সোজা, আবার অতি কঠিনও। হাসিল করতে পারলে তিনদিনেই হয়ে যাবে। না হলে, তিন বছরেও হবে না। এই দ্যাখ ম্যাপটা। ভাল করে দ্যাখ। যাকে আমাদের খুঁজে বের করতে হবে সে যে মাহেতেই আছে এই মুহূর্তে, তার কোনওই মানে নেই। তার সম্বন্ধে পরে বলছি। আগে জায়গাটা সম্বন্ধে ভাল করে জেনে নে। তোরা দেখি আমেরিকান ট্যুরিস্টদের মতো অধৈর্য হয়ে গেলি।

ঠিক আছে, বলো। আমি বললাম।

ম্যাপটা দ্যাখ, দেশটার ইতিহাস সম্বন্ধে আরও একটু জেনেনে। সুবিধে হবে তোদেরই।

তুমি যে ইতিহাস পড়াবার জন্যে এতো খরচাপাতি করে আমাদের এতদূরে নিয়ে আসবে কে ভেবেছিল? নিজেদের আসল বাবারাও হয়তো করতেন না।

চুপ করবি তুই ভটকাই!

আমি ধমকে বললাম।

সবচেয়ে আগে কিন্তু আরব, ইন্দোনেশিয়া এ সব দেশের নাবিকেরাই জল, খাবারদাবারের খোঁজে স্যেশেলস-এর দু-একটা দ্বীপে নেমেছিল। তার অনেক পরে অন্যরা আসে। এর প্রমাণস্বরূপ শিট দ্বীপে আরব নাবিকদের কবর পাওয়া গেছে। ফরাসিরা এই দ্বীপপুঞ্জের দখল নেওয়ার পরেই মরিশাস আর পুব এবং মধ্য আফ্রিকা থেকে ওরা ক্রীতদাসদের নিয়ে আসে নানারকম চাষবাস করার জন্যে।

কীসের চাষ?

যা কিছুরই চাষ এখানে হতে পারত। তুলো, তামাক, নারকেল, দারচিনি এবং আরও অনেক কিছু।

কতগুলো দ্বীপ আছে এই দ্বীপপুঞ্জে ঋজুদা?

আমি শুধোলাম।

ম্যাপে হয়তো অল্পকটা অস্পষ্ট বিন্দু দেখতে পাবি, কিন্তু দ্বীপ আছে অনেকগুলোই। শুনেছি, এই দ্বীপপুঞ্জের ভূভাগের পরিমাণ চারশো বর্গ মাইল মতন হলেও দ্বীপ আছে নাকি প্রায় শ’খানেক। তার মধ্যে গোটা চল্লিশেক প্রবাল দ্বীপ আর গোটা ষাটেক গ্রানাইট পাথরের।

এখন বলো, আমাদের এখানে কী করতে হবে। আর ধৈর্য ধরা তো সম্ভব হচ্ছে না।

ভটকাই বলল।

কেন? অত অধৈর্য কেন? মনে কর, বেড়ানোর জন্যেই এসেছিস। খারাপ লাগছে কি? কলকাতার ক’জন মানুষ স্যেশেলসে সশরীরে এসেছেন তা হাতে গুনে বলা যায়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপ, সিঙ্গাপুর, ব্যাঙ্কক, হংকং ঘোরা লক্ষ লক্ষ মানুষ পাবি, কিন্তু স্যেশেলস বা সেরেঙ্গেটি বা রুআহা দেখছেন এমন মানুষ ডান হাতের কর গুনেই হয়তো শেষ করতে পারবি।

সেটা ঠিক। কিন্তু মঁসিয়ে পঁপাদুর জন্যেও তো আমাদের কিছু করা দরকার।

নিশ্চয়ই। করব বলেই তো আসা। এখন যা বলি, তা মনোযোগ দিয়ে শোন।

কত শত কোটি টাকার লুণ্ঠিত হিরে জহরত সোনাদানা যে এই সব দ্বীপে লুকোনো আছে, তা সমুদ্রের হাওয়া আর এই গাছেরাই জানে। যা লুকোনো হয়েছিল, তার খুব সামান্য অংশই জলদস্যুরা পরে ফিরে এসে নিয়ে গেছে। কত জলদস্যু আর এদিকে আসতেই পারেনি। কেউ মরে গেছে তিনশো বছর আগে, কারও জাহাজডুবি হয়েছে দুশো বছর আগে, কেউ বা মারা গেছে লুটপাট করার সময়ে বা অন্য জলদস্যুদের সঙ্গে লড়াইয়ে, দেশে ফেরার পথে। তাদের মধ্যে যাঁরা বেঁচেছিল, তাদেরও অনেকেই গুপ্তধনের কথা অন্য কাউকে বলে যেতে পারেনি, পাছে দলের কেউ তা জেনে ফেলে। যারা দলবদ্ধভাবে লুণ্ঠিত জিনিস লুকিয়ে রেখেছিল, তাদের তো উপায়ই ছিল না দলের বাইরের কাউকেই বলার।

ঋজুদা একটু থেমে পাইপটা ধরাতেই ভটকাই বলল, বলো, থামলে কেন?

বলছি।

তারপরই সেন্টার টেবলের ওপরে ছড়ানো ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে, পাইপের স্টেমটা দিয়ে একটি ছোট বিন্দু দেখিয়ে ঋজুদা বলল, দ্যাখ। এই দ্বীপটার নাম হচ্ছে শ্যিলুট। মাহে থেকে মাইল তিরিশ দূরে। এখন এখানের বাসিন্দার সংখ্যা হবে শ’আড়াই৷ হোটেল আছে। তবে মাত্র একটি। এই দ্বীপেই পৃথিবীময় কুখ্যাত জলদস্যু ইদুল মারা যায় আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে। খুব ঘটা করে তার অন্ত্যেষ্টি হয়েছিল এখানে। এখনও স্থানীয় মানুষদের মুখে সেই বেরিয়াল-এর গল্প শোনা যায়। অবশ্য তারাও শুনেছে তাদের পূর্বপুরুষদের মুখ থেকেই।

জলদস্যুর আবার অন্ত্যেষ্টি! তাও ঘটা করে। শুনেছি তো সলিল সমাধি হয় তাদের।

আমি বললাম।

কেন হবে না? সবাই কি আর সমুদ্রের ওপরে চলন্ত জাহাজে মারা যায়? আর যাই হোক, মানুষগুলো তো সাহসী ছিল। ঘুষঘাষ খেত না, ফিসফাস করে। দেশের হয়ে বিদেশ থেকে জিনিস কেনার সময়ে কিক-ব্যাক বা কাট-মানিও নিত না।

তখন দস্যুতা একটি খোলাখুলি জীবিকা ছিল। অপরাধী অবশ্যই ছিল তারা। কিন্তু দেশদ্রোহী ছিল না। দস্যুবৃত্তি ত্যাগ করে অনেকেই তাই ফিরে যেতে পেরেছিল নিজের নিজের দেশে। কেউ কেউ আবার নতুন জীবনের আশায় নোঙর ফেলে থেকেও গেছে নতুন নতুন দেশে।

নামটা কী বললে ঋজুদা? ইঁদুর?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

ঋজুদা হেসে বলল, না রে। ইঁদুল।

কোন দেশি?

জানি না, সম্ভবত ফরাসি, কারণ আমাদের মঁসিয়ে পঁপাদু তো তাঁরই নাতির পুতি। তবে ফরাসি না হয়েও পাঁচ পুরুষ ফরাসি দেশে বাস করলে তো আচারে-আচরণে, ভাষাতে ফরাসিই হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।

তা ঠিক। কিন্তু পুতি মানে? আমি আর ভটকাই একই সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম।

পুতি মানে জানিস না? আরে নাতির ছেলেকে বলে পুতি। তোদের মতো সাহেবদের জন্যেই দেশটা গোল্লায় গেল। নাতি-পুতি’ কথাটাও শুনিসনি?

ভটকাই ও প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল, বাঃ। মঁসিয়ে পঁপাদু তো নিজেই প্রায় ঘাটের মড়া। তিনি আবার কার পুতি?

হাসিরই কথা। হাঁ। তবে পরে হেসো। এখন যা বলছি, তা শোনো।

বলো।

মঁসিয়ে পঁপাদুর পূর্বপুরুষেরা এমনিতেই যথেষ্ট বড়লোক ছিলেন। বুঝতেই পারছিস মঁসিয়ে ইদুল না হয় কিছু গুপ্তধন স্যেশেলসেই পুঁতে রেখে গেছিলেন, কিন্তু সারা জীবন যা লুটপাট করেছিলেন, তার অধিকাংশই তো ফ্রান্সেই নিয়ে গেছিলেন। তা দিয়েই চার-পুরুষের হেসেখেলে ফুটানি করে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল। মঁসিয়ে পঁপাদুর ছেলেবেলাও ভালই কেটেছিল। কিন্তু জালার জল, সে জালা যত বড়ই হোক না কেন, গড়িয়ে খেলে আর কতদিন চলে! মধ্য-যৌবন থেকেই অবস্থা একটু খারাপ তাঁর। তবে এখনও বহু মিলিয়নেয়রকেই চাকর রাখতে পারেন। কিন্তু কষ্ট ব্যাপারটাতো তো আপেক্ষিক ব্যাপার। আমার তোর পক্ষে যে আর্থিক অবস্থা পরম আরামের, তাই অন্যের পক্ষে কষ্টকর বলে গণ্য হতে পারে। পারে না কি?

তা পারে।

আমি বললাম।

মঁসিয়ে পঁপাদু অর্থকষ্টে পড়েন। কিন্তু সেই অর্থকষ্ট মানে ভাবিস না যে আমার মতো মানুষের অর্থকষ্ট। তারপরে শোন! অর্থকষ্টে পড়ার পরে প্যারিসের বি. এন. পি-র একটি শাখার লকারে যে তাঁর দাদু পূর্বপুরুষের কিছু পারিবারিক সম্পত্তি রেখে গেছিলেন, সে কথা হঠাৎই মনে পড়ে যায় মঁসিয়ে পঁপাদুর।

বি. এন. পি-টা কী জিনিস?

আমি বললাম।

নাঃ। তোদের জ্ঞানগম্যি বড় কম। বি.এন. পি-রও নাম শুনিসনি?

ব্যাঙ্কোয়া নাশিওনাল দ্য পারি’র সংক্ষিপ্ত নাম বি.এন. পি। ফ্রান্সের জাতীয় ব্যাঙ্ক। ফ্রেঞ্চ ওপেন টেনিস টুর্নামেন্টের প্রধান স্পনসর। সুইজারল্যান্ডেও প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা।

তাই? জানতাম না তো। আমরা দুজনেই অবাক হয়ে বললাম। আমরা অবশ্য কতটুকুই বা জানি!

তা, সেই বি.এন.পি-এর লকার থেকে একটা ম্যাপ বেরোল স্যেশেলস-এর তিনটি দ্বীপের। মানে, কোন কোন দ্বীপে যে গুপ্তধন পোঁতা ছিল তার মোট হদিস দেওয়া ছিল তাতে। কিন্তু ঠিক কোথায় কোথায় যে গুপ্তধন পোঁতা ছিল, তা তাতে দেখানো ছিল না। সেই তথ্য ছিল অন্য একটি ম্যাপে এবং সেই ম্যাপটি তিনটুকরো করে ইদুল এবং তার দুই সহ-জলদস্যু, ফ্রেদরিক এবং দেনির ব্যাঙ্কের আলাদা আলাদা লকারে রাখা ছিল। এই ম্যাপটির কথা উঁদুল তার বংশধরদের বলে যেতে পেরেছিল। কিন্তু দেনি আর ফ্রেদরিক তা পারেনি। ফ্রেদরিক হঠাৎই মারা গেছিল একদিনের জ্বরে বেহুশ হয়ে। আর দেনি মারা গেছিল জাহাজডুবি হয়ে ম্যাডাগাস্কারের কাছে, খুবই অল্প বয়সে। তার একমাত্র ছেলের বয়স তখন সাত।

তারপর?

বলো বলো, এতক্ষণে রহস্যের গন্ধ একটু একটু পেতে আরম্ভ করলাম।

এতক্ষণ যে কী ভূগোল আর ইতিহাস নিয়ে পড়েছিলে ঋজুদা।

ভটকাই বলল।

যে মঁসিয়ে পঁপাদুকে তোরা দেখলি কলকাতাতে, সে হচ্ছে ইঁদুলের পুতি। দেনির পুতির নাম হচ্ছে মঁসিয়ে ব্লঁদা। আর ফ্রেদরিকের বংশধর একটি মেয়ে। তার নাম জাকলিন পুজে। মাদমোয়াজেল পুজে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তাঁর

প্রপিতামহর বিশাল সম্পত্তি নিয়ে তাঁর পিতামহ ও পিতা পৃথিবীব্যাপী ব্যবসা/ ফেঁদেছিল। ওদের পারিবারিক গ্রুপের নাম এখন এফ. জি. এফ. এস. এ। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। ওরা করে না এমন ব্যবসা নেই। কয়েক লক্ষ কোটি ডলারের মালিক এখন প্লুজেঁ। বিয়ে করেনি এখনও। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। অপরূপ সুন্দরী। ওরই লোক হচ্ছে পিয়ের।

বাবাঃ অতবড় নাম? এফ. জি. এফ. এস. এ।

না, নামটা এফ. জি. এফ। আর এস. এ.’ হচ্ছে সুইস লিমিটেড কোম্পানি। আমাদের যেমন লিমিটেড বা LTD। তারপর একটু থেমে বলল, পাদুর মতো প্লুজেঁও ফ্রেদরিকের লকার থেকে ছেঁড়া ম্যাপের টুকরো পেয়েছে। ম্যাপের টুকরো পেয়েছে মঁসিয়ে ব্লঁদাও। ব্লঁদা আর পাদু মাদমোয়াজেল প্লুজেঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে প্লুজেঁ বলেছে, আমার টুকরো আমি দেব না। তোমরা নিজেরা তো আর অত পয়সা খরচ করে এই বিরাট ঝুঁকি এবং ঝামেলার কাজ সামলে উঠতে পারবে না, তাই তোমরা বরং তোমাদের ম্যাপের টুকরো দুটি আমাকে বিক্রি করে দাও। খুব ভাল দাম দিচ্ছি আমি যাতে তোমাদের লাভ হবে অনেক এবং তা হবে কোনওরকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই।

এ কথা প্লুজেঁ যে বলেছে তা তুমি জানলে কী করে? আমি বললাম।

আমাকে বলেছে, মঁসিয়ে পঁপাদু। তবে এ কথার সত্য সম্বন্ধে আমরা অন্ধ বিশ্বাস নাও রাখতে পারি।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর।

ঋজদা বলল, তারপরে শোন।

এতেই মঁসিয়ে পঁপাদু এবং ব্লঁদার সন্দেহ গম্ভীর হয়েছে যে, ফ্রেদরিকের কাছে যে ম্যাপের টুকরোটি ছিল তাতে গুপ্তধনের পুরো হদিসই প্রায় রয়েছে এবং ইদুল এবং দেনির কাছে যে টুকরো ছিল, সে দুটি অসম্পূর্ণ। ওদের দুজনের ভাগ বিপুল অর্থ দিয়ে কিনতে চাইছে প্লুজেঁ ওদের দুজনকে বুঝিয়েছে যে, যাই পাওয়া যাক না কেন, স্যেশেলস সরকারের ন্যায্য পাওনা ট্যাক্সও তো তাদের দিতে হবে। তা ছাড়া, কী পাওয়া যাবে, তাও তো অনিশ্চিত। ওরা গুপ্তধন সন্ধানের কোটি কোটি ডলার খরচ অনির্দিষ্টকাল ধরে দিতে কি রাজি আছে?

তারপরে?

ভটকাই বলল।

প্লুজেঁর সব শর্ত ব্লঁদা আর মঁসিয়ে পঁপাদু মেনে নেওয়ার পরও প্লুজেঁ বেঁকে বসেছে। বলেছে, ওর অন্যান্য ব্যবসা নিয়ে ও খুবই ব্যস্ত, তাই এখনই ওর পক্ষে ওই ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো, বা ‘ওয়াইল্ড-গুজ চেজ’ সম্ভব নয়।

তাতে মঁসিয়ে পঁপাদু এবং ব্লঁদা না-দমে নিজেদের সামর্থ্য একসঙ্গে করে খুঁজেকে না জানিয়ে নিজেরাই এসে এখানে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছে। দ্বীপগুলির হদিস তো ছিলই, কিন্তু কোন দ্বীপের ঠিক কোন জায়গাতে যে গুপ্তধন পোঁতা আছে, তার হদিস ছিল না।

ওরা কি খোঁড়াখুঁড়িও শুরু করে দিয়েছে?

খোঁড়াখুঁড়ি ওরা শুরু করতে পারেনি, কারণ ওদের ধারণা, বিরাট ধনী প্লুজেঁ তা হলে সঙ্গে সঙ্গে খবর পেয়ে যাবে। কিন্তু খোঁড়াখুঁড়ি না হলেও খোঁজাখুঁজি যে শুরু হয়েছে সে খবরও নাকি ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে প্লুজেঁর কাছে এবং তার ফলে যা ঘটার কথা, তাই ঘটেছে।

কী।

আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম।

প্লুজেঁ মঁসিয়ে ব্লঁদা এবং মঁসিয়ে পঁপাদুকে খতম করার জন্যে স্যেশেলস-এ তার চর পাঠিয়েছে।

তারপর ঋজুদা বলল, যা বললাম এ পর্যন্ত, তাই হল মঁসিয়ে পঁপাদুর ব্রিফ।

ওরা তো ব্ল্যাক-ক্যাটের মতন নিজেদের জন্যে বডিগার্ডের বন্দোবস্তই করতে পারে। ব্ল্যাক ক্যাটের মতো পেশাদারেরা যা পারবে, আমরা কি তা পারব?

আমি আর ভটকাই প্রায় একই সঙ্গে বললাম।

সব পেশারই একই দোষ। পেশার সীমিত ক্ষেত্রের বাইরে তাদের চোখ বা মগজ চলতেই চায় না। স্যেশেলস-এর মতো আন্তর্জাতিক কিন্তু ছোট্ট ট্যুরিস্ট স্পটে গুলি করে কেউ কাউকে মারবার মতন মূর্খ নয়। মারতে চাইলে, একজনকে এখানে কতভাবে মারা যেতে পারে। হোটেলের পাশের ঘরে টুরিস্ট সেজে এসে সমুদ্রে স্নান করতে, বা স্কুবা ডাইভিং বা স্নারকেলিং করতে করতে জলের তলায় লোকের চোখের আড়ালে একজনকে মেরে দেওয়া খুবই সোজা। খাদ্য বা পানীয়র সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে মারাও সোজা। ধর, যে গাড়ি একজন ব্যবহার করছে এই পাহাড় আর সমুদ্র-ঘেরা দ্বীপগুলিতে, সেই গাড়ির ব্রেক-শ্য জ্যাম করে দিয়ে, টাইরড-এর অবস্থা এমনই করে দিয়ে, যাতে পাহাড়ের মাথায় চড়ার পর টাইরড কেটে বা খুলে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়ি সমুদ্রে পড়ে। আরও কতরকম করে মারা যায়। আজকাল তো কারোকে বাঁচানোর চেয়ে মারাটা অনেকই সোজা। গাড়িতে, রেস্তোঁরার খাবার টেবিলের নীচে, টাইমবম্ব রেখে দিয়ে, বহু দূরে বসে ইলেকট্রনিকালি বোমা ফাটিয়েও মানুষকে মারা যায়।

ভটকাই শুনতে শুনতে গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, কী দরকার ছিল এই ঝামেলাতে ফাঁসবার? তার চেয়ে কায়দা করে ওই ঘেঁড়া ম্যাপের তিনটি খণ্ডই কোনওরকমে হাতিয়ে নিয়ে চলো ঋজুদা, আমরা কলকাতাতে ভাগলবা হই। আমাদের নাতিরা এসে পরে কোটিপতি হবে।

তারপরে একটু চুপ করে থেকে বলল, আরও একটা পথ আছে।

কী?

আমি আর ঋজুদা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম।

তুমি প্লুজেঁকে বিয়ে করে নাও।

ওর কথাতে আমি আর ঋজুদা খুব জোরে হেসে উঠলাম।

হাসির কী আছে? তোমার মতো বর সে কোথায় পাবে? যত বড় রাজকন্যাই সে হোক না কেন!

ঋজুদা বলল, অনেক ভাঁড়ামো করেছিস। সিরিয়াস হ। কারণ, মঁসিয়ে পঁপাদু কলকাতাতে আমাকে এই খবরটাই দিতে এসেছিলেন যে, প্লুজেঁ পরশুদিন জিনিভা থেকে মাহেতে এসে পৌঁছচ্ছে। লোকে জানছে ছুটি কাটাতেই আসছে। আসলে নাকি আসছে সরেজমিনে তদন্ত করতে।

ভটকাই বলল, বড্ড তেষ্টা পেয়েছে ঋজুদা। গলা শুকিয়ে কাঠ। এ কোথায় আনলে। চারদিকে হাজার হাজার মাইল সমুদ্র আর এক ফোঁটা খাবার জলও নেই। শেষে কি ইলেকট্রিক বালব খেয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করতে হবে?

ঋজুদা বলল, ভয়ে?

মানে?

গলা শুকিয়ে কাঠ কি তেষ্টাতে হয়েছে? না ভয়ে? আমি বললাম।

তোকে ওই জন্যেই নিয়ে আসতে চাইনি। বিপজ্জনক কাজ তো বটেই। জেনেশুনেই তো এসেছি আমরা।

ঋজুদা বলল।

বিপজ্জনক কি না জানি না, তবে কাজটা যত না রহস্যের, তোমার কাজের ফিরিস্তি আরও বেশি রহস্যের। মোদ্দা কথায় আমাদের যে কী করণীয়, তাই তো এখনও বুঝতে পারলাম না।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা হেসে ফেলল। বলল, সেটা ঠিক। কারণ আমি নিজেই এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, তা তোদের বোঝাব কী করে! চল পেছনের বারান্দাতে গিয়ে বসি। সূর্য ডুববে একটু পরে। পুরীতে, দীঘাতে, গোপালপুরে বা কোভালমে বা গোয়র সূর্যাস্ত দেখা এক আর এখানে আর এক। তবে আন্দামান বা লাক্ষাদ্বীপও কম সুন্দর নয়। আসলে আমাদের দেশের মতো সুন্দর দেশ পৃথিবীতে নেই। যদি আমরা মানুষের মতো মানুষ হতাম তবে এই দেশ নিয়ে কী যে আমরা করতে পারতাম তা ভাবলেও রোমাঞ্চ হয়। কাজ না করলে, সৎ না হলে, জেদ না থাকলে কোনও দেশই কি বড় হতে পারে রে! চালাকির দ্বারা কোনও বড় কাজই হয় না।

এমন সময়ে ফোনটা বাজল।

ভটকাই রিসিভারটা তুলেই ঋজুদাকে দিয়ে বলল, কে রে বাবা! বলছে, সিয়ে বোঁস?

রিসিভারটা ভটকাই-এর হাত থেকে নিয়ে ঋজুদা বলল।

আই অ্যাম কার্লোস সিয়ে। আই অ্যাম কামিং আপ উইথ আ লেডি।

হু ইজ শি?

মাদমোয়াজেল ভৈঁয়সা।

মাদমোয়াজেল ভৈঁয়সা?

ইয়া। শি উইল টেক উ্য ডাউন টু হার হোটেল অ্যাট বো ভাঁলো।

হোয়াই?

পিয়ের হ্যাজ অলরেডি স্পটেড উ্য অল। ইট উডনট বি সেফ ফর উ্য অল টু স্পেন্ড দ্য নাইট অ্যাট দ্য ভিলা।

ওকে। প্লিজ কাম আপ। উই আর থারস্টি।

কার্লোস বলল, আই নো। আই উইল টেক কেয়ার। বলেই, ফোনটা ছেড়ে দিল।

ভঁইষাটা কী ব্যাপার ঋজুদা? এখানে মোষ আছে না কি? মানে, আমাদের হিন্দুস্থানি ভঁইষা?

সদা-ইনকুইজিটিভ ভটকাই বলল।

ঋজুদা খুব জোরে হেসে উঠল ভটকাইয়ের কথাতে।

বলল, উঁইষা না রে। মাদমোয়াজেল ভৈঁয়সা। ভৈঁয়সাটা পদবি। নাম মারিয়েল। Marielle আর ভৈঁয়সা বানান হচ্ছে Vincent।

ভাল জায়গাতেই নিয়ে এলে। পদে পদে নামে-পদবিতে হোঁচট খাব, না নিজের পথ দেখে পা ফেলব। Vincent-এর উচ্চারণ যে ভৈঁয়সা তা কে জানবে বলো!

আমি হাসছিলাম। নিঃশব্দে। ভটকাই যে কথাটা খুব অযৌক্তিক বলেছে এমন নয়।

ঋজুদা বলল, ভাগ্যিস আমরা কিছুই আনপ্যাক করিনি। করলে, ঝামেলা হত। এখন চল দেখি কোথায় নিয়ে গিয়ে ওঠায় কার্লোস আর মারিয়েল ভৈঁয়সা। তবে বোঁ ভালো হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সি-বিচ। আমি তো হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের ওয়াইকিকিতেও গেছি। বোঁভালো ওয়াইকিকির চেয়েও অনেক বেশি লম্বা বিচ এবং অনেক বেশি সুন্দর। পাঁচ মাইল লম্বা।

তুমি কি ভৈয়সাকে আগেই চিনতে নাকি?

চাক্ষুষ আলাপ নেই, তবে চিনি। ফোটো দেখেছি নানা ভঙ্গিমাতে। আসলে, মারিয়েল ভৈঁয়সা, মঁসিয়ে পঁপাদু আর মঁসিয়ে ব্লঁদার সঙ্গে পার্টনারশিপে গেছে। অথচ ওর কিন্তু পয়সার লোভ নেই। অপরূপ সুন্দরী। জাকলিন প্লজেরই মতো। ওর সঙ্গে জাকলিনের একটি ব্যক্তিগত বৈরিতা আছে দীর্ঘদিনের। ওরা দুজনে দুজনকে চেনে। এবং সমবয়সী। কোনও বিশেষ কারণের বৈরিতা। মেয়েদের, এবং বিশেষ করে ওই বয়সী মেয়েদের বৈরিতা নানা কারণে হতে পারে। আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়।

জাকলিনটা আবার কে রে বাবা! উঃ, কী মুশকিলেই ফেললে তুমি ঋজুদা আমাদের।

এবারে, আমিই বললাম।

এ যে স্নেক-ল্যাডার। যতটা উঠছি সঙ্গে সঙ্গে নেমে যাচ্ছি আরও বেশি।

ভটকাই আমাদের অবস্থা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করল।

ঋজুদা বলল, কী আশ্চর্য! একটু আগেই তো বললাম মাদমোয়াজেল প্লুজেঁর পুরো নাম জাকলিন প্লুঁজো। বলিনি?

মারিয়েল ভৈসাঁ নিজে শেষ পর্যন্ত আসতে পারেননি।

শাঁতাল, কার্লোস-এর সঙ্গে আমাদের নিতে এসেছিল দ্য ঈলস রুস্ট’ থেকে। আমাদের দেখাশোনা করার জন্যে তাকে নিযুক্ত করেছেন মারিয়েল ভৈঁয়সা। বয়স আমার বা ভটকাইয়ের থেকে বেশি বোধহয় নয়, কিন্তু সপ্রতিভ আর ব্যক্তিত্বে আমরা ওর কাছাকাছিও নই। ওরই তত্ত্বাবধানে আমাদের রাতের খাওয়াদাওয়া হয়েছে। খেতে গিয়েও দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। না, খাদ্যদ্রব্যের জন্যে নয়, রান্না-খাবারের পদ উচ্চারণ করতে গিয়ে।

আমরা পৌঁছানোর কিছুক্ষণের মধ্যেই মারিয়েল ভৈঁয়সা এসে পৌঁছলেন। আমাদের সকলের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিল শাঁতাল।

মারিয়েল ভৈঁয়সার হোটেলটা একটা পাহাড়ের ওপরে, সামনে সমুদ্র। সেটি এই পৃথিবীর অন্যতম সেরা সমুদ্রতট। বো ভাঁলো। সাদা বালির তটরেখা। এই বালি দেখতে দুধ-সাদা। কারণ, আসলে বালি বলতে যা বোঝাই আমরা, এ তা নয়। প্রবালের গুঁড়ো। ঋজুদা বলছিল। সাধে কি আব পৃথিবীর সব সমুদ্র-পাগল মানুষ স্যেশেলস, স্যেশেলস আর নাচানাচি করে।

রাতের খাওয়া সারলেও মারিয়েল ভৈঁয়সার হোটেলে আমাদের রাত্রিবাস করা হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এখান থেকে চলে যাব। আপাতত আমরা হোটেলের একটি ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে বসে আছি। আমাদের ঘরের আলো নেভানো। কার্লোস আর শাঁতাল একটি ঢাকা ভ্যানে করে আমাদের নিয়ে এসেছে ‘The Eagle’s Roost’ থেকে। মারিয়েল ভৈঁয়সা নিজে যাননি পিয়ের সন্দেহ করতে পারে বলে। জাকলিন প্লুজেঁ এখনও জানে না যে, মঁসিয়ে ব্লঁদা আর মঁসিয়ে পঁপাদুর সঙ্গে মারিয়েল ভৈঁয়সা হাত মিলিয়েছে।

কার্লোস একটা ব্যাগ খুলে স্মল-আর্মস দেখাল। আমি নিয়েছি স্পেইন দেশে তৈরি একটি পয়েন্ট টু টু ব্যারেটা পিস্তল। ভটকাইকে দিয়েছে ঋজুদা একটা থ্রি পয়েন্ট টু ওয়েবলি-স্কট-এর ইংলিশ রিভলভার। আর নিজে নিয়েছে সাইলেন্সর লাগানো থ্রি এইট অ্যামেরিকান কোল্ট পিস্তল। নিজেদের জীবন রক্ষা করা ছাড়া আর কিছুর জন্যেই গুলি ছোঁড়া যে যাবে না, তা বার বার বলে দিয়েছে ঋজুদা। একটি ছুঁড়লে অপরপক্ষ যে অবহেলায় দশটি খুঁড়তে পারে, এই সাধারণ বুদ্ধিটা যেন আমাদের থাকে, সে কথাও বলে দিয়েছে। এগুলো সঙ্গে রাখা ততটা ব্যবহারের জন্যে নয়, যতটা মনের শান্তির জন্যে।

আমরা এখনও স্যুটকেস আনপ্যাক করিনি, কারণ এখান থেকে আবার নাকি আমাদের স্যেশেলসের সেরা হোটেল, এই সি-বিচেরই ওপরে, হোটেল বোঁ ভালো বে-তে গিয়ে উঠতে হবে। মারিয়েল অ্যান্ড কোং অর্থাৎ মারিয়েল, ব্লঁদা আর পাদু ঠিক করেছে আমাদের প্লুজেঁর একেবারে নাকের ডগাতেই রাখবে। প্রদীপের নীচেই যেমন অন্ধকার, তেমন তার অত কাছে থাকাতে আমাদের সন্দেহ করবে না হয়তো। আমরা যে হোটেলে এখন আছি, সাবধানতার কারণেই আমাদের এখানে আনা হয়েছে। বো ভাঁলোতে মারিয়েল এবং কার্লোসের সঙ্গে ঋজুদার এই মিটিং মোটেই সহজ ছিল না। রাত ন’টা নাগাদ আমরা ‘বো ভাঁলো বে হোটেলে যাব। কারণ, ওই সময়েই নাইরোবি থেকে একটা ফ্লাইট আসে। ওই সময়ে চেক-ইন করলে কেউই সন্দেহ করবে না। কালোস, কিনিয়া এয়ারওয়েজের কিছু ব্যাগেজ-ট্যাগও দিয়ে দিয়েছে আমাদের। এয়ার-ইন্ডিয়ার ট্যাগ ছিঁড়ে ফেলে ওগুলো আমাদের ব্যাগেজে লাগিয়ে নিতে হবে, যাতে কারও সন্দেহ না হয়।

সমুদ্র থেকে হু-হু করে হাওয়া আসছে। এখানের নারকেল গাছগুলো ভারী মজার। পাড়ে দাঁড়িয়ে সমুদ্রকে যেন নুয়ে পড়ে প্রণাম করছে এমনভাবে সমুদ্রের ওপরে ঝুঁকে পড়েছে। নারকেলগুলোর রং হলুদ। এখানে কোকো-ডে-মেয়্যার নামের এক ধরনের বিরাট বিরাট কালো আর হলদেটে, সামুদ্রিক নারকেল হয়। নাকি। এই কোকো-ডে-মেয়্যার পৃথিবীর আর কোথাওই নাকি পাওয়া যায় না, বলছিল ঋজুদা। এখনও দেখা হয়নি, দেখতে হবে। আর আছে বিরাট বিরাট দৈত্যকচ্ছপ। অলিভ রিডলের চেয়ে অনেকই বড়। ল্যান্ড টরটয়েজ। আরও কত কী আছে। ক’দিন থাকলেই জানতে পাব।

ঋজুদা বলল, মাদমোয়াজেল প্লজেঁকে নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না। তোরা শুধু পিয়ের কে হতে পারে, সেটা আন্দাজ করার চেষ্টা করবি। কার্লোস এখনও তার ছবি আমাদের হাতে তুলে দিতে পারেনি। সুতরাং কাজটা খুব সহজ হবে না। তবে পিয়ের বা তার লোকজন যে আমাদের কাছাকাছি থাকবেই, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কাজে লাগাতে হবে অনুমানশক্তি। তোদের দুজনকেই অনেক টাকা, মানে লোকাল কারেন্সি, দিয়ে দেব। যাতে অর্থকষ্ট না হয়। জিন-এর ব্যাগ ওরা আনিয়েই রেখেছে। তার মধ্যে ইনফ্রা-রে দূরবীন, অন্ধকারে দেখার জন্যে, আর পিস্তল রিভলভার যার যার, রাখবি। কার্লোস বন্দোবস্ত করে দেবে। পাসপোর্ট আর টাকা থাকবে কোমরে বাঁধা। তেমন বেগতিক দেখলে জিন-এর ব্যাগটা ফেলে নিজের নিজের প্রাণ নিয়ে সটকাবি। তোদের যে হোটেলেই ফিরে আসতে হবে, তার কোনও মানে নেই। কাজের সুবিধার জন্যে যেখানে খুশি থাকতে পারিস। টাকার অকুলান হবে না। কার্লোস মোবাইল-ফোনও দিয়ে দেবে এখুনি একটা করে, যাতে অসুবিধে না হয়। বো ভালো হোটেলের গেট দিয়ে একবার ঢুকে পড়ে ভিতরে চলে এলে সম্পূর্ণ নিরাপদ। এর চারদিকে ক্লোজড-সার্কিট টিভি আছে। ছদ্মবেশে অনেক গার্ড আছে। কেউ ড্রাইভার, কেউ হোটেলের বেল-বয়, কেউ ট্রাভেল সার্ভিসের লোক–এই সব ভেক ধরে। প্রত্যেকে ক্যারাটের ব্ল্যাকবেল্ট। তা ছাড়া তাদের প্রত্যেকেরই সঙ্গে আছে, পিস্তলও, সাইলেন্সার লাগানো। ভিতরে ঢুকে এলে কেউই আর তোদের অনিষ্ট করতে পারবে না। প্রাণ কোনও কারণে বিপন্ন বোধ করলে বো ভাঁলোর চত্বরে ঢুকে পড়বি। তবে কাল আমরা একসঙ্গেই বেরোব। যাব Praslin নামে একটি দ্বীপে।

কী করে যাব?

কেন? প্লেনে। আইল্যান্ডার প্লেন আছে ছোট ছোট। সেই ফ্লিটের কম্যান্ডার আবার একজন ভারতীয়। প্লেন-এ জনা কয়েক বসতে পারে। সিঙ্গল প্রপেলারের প্লেন। সমুদ্র টপকে গিয়ে নারকেল গাছেদের মাথার ওপর দিয়ে নেমে পড়বে প্লেন দ্বীপে।

টিকিট পাব কোথায়?

আহা রে। মাখনবাবুরা।

ঋজুদা বিরক্তির গলায় বলল।

তারপর বলল, এয়ারপোর্টে গেলেই টিকিট পাবি। শাটল-সার্ভিস৷ যায় আর আসে। প্যাসেঞ্জার অনুযায়ী ফ্লাইট যায়। সন্ধের পরে চলাচল করে না। সেই জন্যে খুব ভোরে ব্রেকফাস্ট খেয়েই বেরিয়ে পড়ব আমরা। আমিওতো যাচ্ছি তোদেরই সঙ্গে, না, কি?

.

‘মাহে’ দ্বীপের নাম। তবে স্যেশেলসের রাজধানী যদিও মাহেতেই কিন্তু রাজধানীর নাম হচ্ছে ভিক্টোরিয়া। ঝকঝকে তকতকে ছোট্ট শহর। একবার পাহাড়ে উঠেছে আরেকবার সমুদ্রে নেমেছে। আর সে সমুদ্রের কী মনোহর রূপ। অমন সাদা তটভূমিও কোথাওই দেখিনি আমরা আগে।

ঋজুদার কাছে তো শুনলামই যে ‘বো ভাঁলো বে’ এই সমুদ্রতটের সেরা হোটেল। সে তো হোটেল নয়, মনে হয় একটা আলাদা শহরই। সামনে সে হোটেলের বাঁকা-চাঁদের মতো নিজস্ব তটভূমি, তিন কিলোমিটার লম্বা।

পরিকল্পনামতোই কাল রাতে এখানে এসে উঠেছি আমরা। আমি আর ভটকাই এক ঘরে আছি, আর ঋজুদা অন্য ঘরে। ব্রেকফাস্ট করছিলাম ঋজুদার ঘরেই, ডাইনিংরুমে যাইনি। কারণ, মাদমোয়াজেল পুঁজের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তাঁর বিশাল সুইট নেওয়া আছে এই হোটেলেই। পৌঁছেও গেছেন। ঋজুদারও ঘর নয়, স্যুইট। তবে ছোট স্যুইট। আলাদা বসার ঘর আছে। তাতে ফ্রিজ। ফ্রিজে কোকোকালা, লেমনেড আরও কত কী রাখা আছে। ফ্রিজের ওপরে নানারকম চকোলেট আর নোনতা বিস্কিট। বিরাট ফুট-বোল-এ নানারকম ফল। ফল অবশ্য আমাদের ঘরেও আছে।

ভটকাই মুখভর্তি স্ব্যাম্বল এগস আর বেকন নিয়ে চকোলেটগুলোর দিকে লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল।

ঋজুদা বলল, ইংরেজিতে একটা কথা আছে রে ভটকাই। ডু নট বাইট মোর দ্যান উ ক্যান চু। যতখানি চিবোতে পারবি অনায়াসে, ততখানি খাবার মুখে কখনও পুরিস না।

ভটকাই লজ্জা পেল। ঋজুদা সেটা লক্ষ্য করে বলল, এ কথাটা শুধু খাবার সম্পর্কেই ব্যবহার করা হয় না রে। হাতের কাছে চলে-আসা যে কোনও জিনিস সম্পর্কেই কথাটা খাটে। অনেকই গভীর কথা। ভেবে দেখিস।

.

সকাল আটটার মধ্যে সারাদিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম আমরা।

এয়ারপোর্টে পৌঁছেই কাউন্টারে গিয়ে বললাম, প্রাসলিন-এর তিনটে টিকিট দিন।

কাউন্টারের কালো, কিন্তু সুন্দরী মেয়েটি, হেসেই বাঁচে না। সে দুচোখে দুষ্টুমি নাচিয়ে বলল, উই প্রনাউন্স ইট অ্যাজ প্রালে।

প্রাসলিন হল প্রালে। প্রথমেই ধাক্কা খেলাম একটা।

মিনিট পনেরোরও কম সময়ে গিয়ে নামলাম প্রালেঁতে নারকেল বনের মধ্যের একটি মাঠে। এখানের জমিতে কাদা হয় না। মাটির রং দেখলাম লাল। এয়ার স্ট্রিপ-এর পাশে টার্মিনাল বিল্ডিং। রাডার-টাডার কিছু নেই। নারকেল পাতার ছাউনি দেওয়া একটি ঘর। বৃষ্টি নামলে তার নীচে এসে জড়ো হয় যাত্রীরা। নয়তো বাইরেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। আমরা নামতেই, যারা প্লেনের অপেক্ষাতে ছিল, তারা সেই প্লেনে উঠে পড়ল। মাহেতেই যাবে, না অন্য কোথাও, তা জানতে ইচ্ছে করলেও তাঁদের জিজ্ঞেস করা হল না। অনেক দ্বীপইতো আছে। এখান থেকে অন্য কোনও দ্বীপেও যেতে পারে প্লেনটা।

দু-একটা ট্যাক্সি ছিল। কিন্তু অনেকেই দেখলাম হেঁটে বা সাইকেলেই যাচ্ছে। নারকেল গাছের ছায়ায় ছায়ায় কাঁচা রাস্তা। মাঝে মাঝেই দমক দমক বৃষ্টি আসছে দমকা হাওয়ার সঙ্গে। আফ্রিকাতে যে সময়ে শীতকাল, জুন-জুলাই মাসে, এখানে তখন আমাদেরই মতো বর্ষাকাল। দু কিলোমিটারের মতো হাঁটার পরে দেখা গেল একটি রেস্তোরাঁ। সমুদ্রের ওপরেই। লোকজন কেউই নেই। যাঁরা প্লেন থেকে নামল তাদের মধ্যে অধিকাংশই সম্ভবত স্থানীয় বাসিন্দা।

এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা, লম্বা, কালো কিন্তু খুব মিষ্টি চেহারার, ঋজুদাকে হেসে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, লং টাইম নো সি।

ঋজুদা হেসে বলল, দ্যাটস টু। নাইস টু সি ঊ্য মাদমোয়াজেল ব্লঁশ আফটার আ লং টাইম। হাউ আর থিংগস। হাউ ইজ মঁসিয়ে ব্লঁশ?

উনি চলে গেছেন।

চলে গেছেন মানে?

মানে, স্বর্গে যাননি। তাঁর তো গৃহীর স্বভাব নয়। তোমারই মতো স্বভাব। তোমার গল্প করতেন সপ্তাহে অন্তত একবার। খাবার টেবিলে বসে। তোমাকে খুবই পছন্দ ওঁর।

তা তিনি গেলেন কোথায়? আবারও তানজানিয়াতেই?

হ্যাঁ। আবারও। এবারে মাউন্ট কিলিমানজারোর কাছাকাছিই আছেন। তারপর সেরেঙ্গেটিতে ফোটোগ্রাফিক-সাফারিতে যাবেন কিছু স্যুয়েড পর্যটক নিয়ে।

ততক্ষণে ঋজুদার দেখাদেখি আমরাও বারান্দাতে চেয়ার টেনে বসেছি।

ভদ্রমহিলা আমাদের দিকে তাকিয়ে ঋজুদাকে প্রশ্ন করলেন চোখ দিয়ে।

ঋজুদা বলল, আমি এখন একটি কিশোরদের মাসির পত্রিকার সম্পাদক হয়েছি। এরা দুজনে আমার সহকারী। স্যেশেলসের ওপরে একটি বিশেষ সংখ্যা বেরোবে আমাদের পুজোর সময়ে।

হোয়াট ইজ পুজো?

আমাদের দুর্গাপুজো, তোমাদের ক্রিসমাসেরই মতো। অন্যতম প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান। শরৎকালে হয়।

ও।

তারপর বলল, এরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ছাড়া অন্য কোনও ভাষা জানে না, তাই হয়েছে মুশকিল। আমাকেই সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে।

তা তোমাদের ফোটোগ্রাফারেরা কোথায়?

তারা আজ গেছে ‘লা ডিগ’ আইল্যান্ডে। এদিকেও আসবে। তবে কবে, তা সে তারাই জানে।

কেয়ার ফর সাম কফি?

মাদমোয়াজেল ব্লঁশ বললেন।

একটু পরে।

ঋজুদা বলল।

ভদ্রমহিলা বেশ ঘনঘন সিগারেট খান। যতবারই সিগারেট ধরাচ্ছিলেন, ঋজুদা তার লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিচ্ছিল। আর ভদ্রমহিলা বলছিলেন, ‘মেরসি’।

দাঁতগুলো খুব সুন্দর। মুক্তোর মতো। আরও সুন্দর হাসিটি।

ঋজুদা বলল, বলুন, গল্পসল্প সব শুনি। মঁসিয়ে ব্লঁশ যে গুপ্তধন খোঁড়ার কোম্পানি শুরু করার কথা বলছিলেন, তার কী হল? খুবই তো ভাল আইডিয়া। আমিও তো জয়েন করব বলেছিলাম পার্টনার হিসেবে। তারপর আর কোনও খবর তো দিলেন না।

উনি আর কী করবেন? মাহেতে তো সরকারই একজনকে সাহায্য করছে। ত্রিশ হাজার পাউন্ড স্টারলিং দিয়েছে। কিন্তু খুঁড়ে কিছুই বেরোয়নি। ঠিক হদিস জানা না থাকলে পাওয়া যাবে কী করে? ঠাকুরদা-বাবার কাছ থেকে শুনেছি, সব চেয়ে বেশি গুপ্তধন পোঁতা আছে অ্যাস্টভ দ্বীপে। সেখানে তো এখনও কেউ খোঁড়াখুঁড়ি করছে বলে শুনিনি।

তারপর বললেন, আসলে জাহাজডুবি, গুপ্তধন, নির্বাসিত ও জাহাজডুবির পরে সাঁতরে গিয়ে উঠে বেঁচে থাকা মানুষদের যত লোককাহিনী, যত রূপকথা, সবই তো অ্যাস্টভ দ্বীপ নিয়েই। শুনতে পাচ্ছি, ইদুলের এক বংশধর, মঁসিয়ে পঁপাদু, নাকি গুপ্তধন খুঁজতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। ইঁদুলের দলের আর এক ডাকাত ফ্রেদরিকের পরিবারের মেয়ে প্রচুর ধনী মাদমোয়াজেল প্লুজেঁও ভিক্টোরিয়াতে এসে ‘বো ভাঁলো বে’ হোটেলে উঠেছেন। তাঁরও উদ্দেশ্য নাকি অ্যাস্টভে গোপনে খোঁড়াখুঁড়ি করা।

আপনাকে কে বলল?

ঋজুদা আমাদের দিকে তাকিয়েই মাদাম ব্লঁশকে জিজ্ঞেস করল।

আরে! মঁসিয়ে পিয়ের তো কালই রাতে মোটর বোটে করে এসে আমার হোটেলেই ছিলেন। সারারাত ম্যাপ-ট্যাপ নিয়ে কাজ করার পর প্রায় সকাল চারটে অবধি জেগে তারপর ঘণ্টা দুয়েক শুয়েই সকালের প্রথম ফ্লাইটে মাহেতে ফিরে গেছেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, মাদমোয়াজেল প্লুজেঁর হয়েই কাজ করছেন এখন।

আর উনি যে বোটে এসেছিলেন, সেই বোট?

বোট তো ওঁকে নামিয়ে দিয়েই ফিরে গেছিল রাতারাতি। ঘণ্টাচারেক তো লাগে। বোটে চার ঘণ্টা, প্লেনে পনেরো মিনিট।

তা উনি এলেনই বা কেন, আর গেলেনই বা কেন?

তা বলতে পারব না। প্রালেঁতে একজন খুব বড়লোক থাকেন। মঁসিয়ে দেনো। তিনিও কাল রাতে আমার হোটেলে এসেছিলেন। রাত দুটো অবধি ছিলেন। কী একটা চুপ-চুপ গোপন-গোপন ভাব দেখলাম। তারপর মঁসিয়ে দেনো চলে গেলেন।

তাই?

হ্যাঁ। আমার মনে হচ্ছে, কোনও রহস্য আছে মঁসিয়ে পিয়েরের আসা সম্বন্ধে। আসলে মানুষটার বদনাম তো আছেই।

কীসের বদনাম?

কীসের নয়। ওর বাবাও ওইরকম ছিল।

বাবা খারাপ হলেই যে ছেলে খারাপ হবে, তার কী মানে আছে?

মানে নেই। তবে অনেক সময়েই তো হয়। ও ভাড়াটে খুনিও বটে। বাবা, আমি তো একাই থাকি। ফ্রেঞ্চ মেয়েটি চলে যায় রাত দশটায়, আসে সকাল ছটাতে। কুক, বেয়ারা ওরাও সব আসে ছটাতে। রাতে যদি হুজ্জত করত? তবে সারারাতই দুজনে মিলে মদই খেয়েছে। অন্য ঝামেলা বিশেষ করেনি।

আপনার এখানে বার-এর লাইসেন্স নিয়েছেন নাকি?

না, না। আমি কেন নিতে যাব? ওই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। কোনও গোপন ব্যাপারে এসেছিল বটে কিন্তু মঁসিয়ে পিয়ের কিছু ম্যাপ-ট্যাপ ফেলে গেছে। ভুলে।

কী করবেন এখন আপনি?

তাই ভাবছি। মঁসিয়ে দেনোকে কি ফোন করব?

করা তো উচিত। তবে মঁসিয়ে পিয়েরের কাগজপত্র অন্য কাউকেই দেওয়া উচিত নয়। যদি গুপ্তধনের খোঁজটোজ থেকে থাকে তাতে। দুল আর ফ্রেদরিক তো কুখ্যাত জলদস্যুই ছিল। প্লুজেঁ তো বলছেন সেই ফ্রেদরিকেরই বংশধর।

সেই জন্যেই। মঁসিয়ে দেনোকে বলব কি না ভাবছি।

না বলাই তো ভাল। যার জিনিস তাকেই জানানো উচিত।

ঠিক বলেছ। আমার স্বামী মানুষ চেনেন বলেই তোমার কথা এত বলেন।

তবে…

তবে কী?

ওই ম্যাপ আমি দেখে নিয়েছি।

ঋজুদা কথা বলল না। পাইপ টানতে লাগল। যেন, ওই ম্যাপ সম্বন্ধে তার কোনও ইন্টারেস্টই নেই এমন মুখ করে মনোযোগের সঙ্গে পাইপ টেনে যেতে লাগল। আমাদেরও যেন কোনওই ইন্টারেস্ট নেই এমন ভাবে আমরা বাইরে তাকিয়ে রইলাম। ইদানীং বহুতই স্মার্ট হয়ে-ওঠা ভটকাই আমাকে বাংলায় বলল, এই রোদদুর, এটা কী পাখি রে?

কোথায়?

ওই যে রোদদুরে বসে আছে।

ভটকাই অভিনয়টা ভালই করল। আমরা ইংরেজি জানিই না, তাই ঋজুদার সঙ্গে মিসেস ব্লঁশের কী কথা হচ্ছিল, তা আমাদের বোঝবার কথাই নয়।

আমি পাখিটার দিকে ভাল করে চেয়ে বললাম, মনে হচ্ছে টার্ন।

ঋজুদা বলল নডি-টার্ন। এখানে দুরকমের দেখা যায়। বড় আর ছোট। এ ছাড়া আছে সুটি-টার্ন। সাদাকালো। এ সব পাখি তো সমুদ্রপারেই দেখা যায়। টার্ন, স্যান্ডপাইপার, সোয়ালো, বুবি আরও কত পাখি। এখানে একটা অভয়ারণ্য আছে। লোকে তাকে বলে ‘গার্ডেন অফ ইডেন’। কতরকম গাছ যে আছে সেখানে, কতরকম পাখি, তা বলার নয়।

আমাদের এই কথোপকথন শুনে মাদমোয়াজেল ব্লঁশ বুঝতেই পারলেন যে, মঁসিয়ে পিয়ের বা মঁসিয়ে দেনো বা কারও পুঁতে রাখা গুপ্তধন নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। কিন্তু কিছু মানুষ থাকেন, বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে, যাঁরা পেটে কথা মোটেই রাখতে পারেন না। তা ছাড়া, ভদ্রমহিলা একা থাকেন। স্বামী আবার আফ্রিকাতে চলে গেছেন। হয়তো মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলেন। ছেলেমেয়ে আছে কি না তাও আমাদের জানা নেই। তা ছাড়া, প্রলে দেখছি এমনই জায়গা যে, এখানে খুব বেশি মানুষও পান না উনি কথা বলার, তাই একটু বাঁচালতায় তো পেতেই পারে ওঁকে।

আমাদের কথা শেষ হলে উনি বললেন, গুপ্তধনের ম্যাপগুলো কিন্তু অ্যাস্টভ দ্বীপেরই। পুব দিক দিয়ে পাহাড়ে উঠে তারপর দক্ষিণে পাঁচশো গজ গিয়ে সেখান থেকে উত্তরে…

ঋজুদা বলল, আপনি বিপদে পড়ে যাবেন মাদমোয়াজেল ব্লঁশ। আপনিই বলছেন যে, পিয়ের ভালমানুষ নয়। আপনিই বলছেন মাদমোয়াজেল প্লজেঁ ওকে লাগিয়েছেন ওঁর কাজে, আবার আপনিই সব গোপন খবর জানিয়ে দিচ্ছেন। এতে আপনার প্রাণহানিও হতে পারে।

কেন? বলেছি তো শুধু আপনাকেই। আপনি তো আর গুপ্তধন খুঁজতে যাচ্ছেন না।

না। তা যাচ্ছি না। কিন্তু দেওয়ালেরও কান আছে। আপনার কাজের মেয়েটি, হোটেলের কুক, বেয়ারারা, এত লোক আছে। তা ছাড়া টাকা সম্পত্তি এমনই একটা খারাপ জিনিস যে, যার জন্যে ছেলে বাবাকে খুন করে, জামাই শ্বশুরকে। তা ছাড়া এ সব তো পড়ে-পাওয়া ধন। অন্যের উপার্জিত সম্পত্তিতেই বেশি আঠা থাকে। কী দরকার আপনার?

এমন সময়ে ওঁর অফিসে ফোনটা বাজল। অফিসটা, সমুদ্রের ওপরের প্রকাণ্ড কাঠের উঁচু বারান্দাটা, যেটা ড্রইং কাম-ডাইনিং রুম, তারই এক প্রান্তের একটি ছোট্ট চেম্বারে।

মাদমোয়াজেল ব্লঁশ ফোন ধরতে উঠে গেলেন। আমরা লক্ষ করলাম যে, তিনি খুব উত্তেজিত হয়ে যেন কার সঙ্গে কথা বলছেন। মিনিট দু-তিন কথা বলেই ফোনটা নামিয়ে রাখলেন। আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে জোর করে হেসে বললেন, ন্যাউ, আই থিংক ইটস টাইম ফর আ কাপ অফ কফি।

ঋজুদা বলল, ওকে।

উনি কফির অর্ডার দেওয়ার জন্য টেবিলে রাখা ঘন্টাটা বাজালেন। বললেন, ইটস অন দ্য হাউস।

বেয়ারা এল। একটি স্যেশেলোয়া। মাঝবয়সি। তাকে ক্রেওল ভাষাতেই কফির অর্ডার দিলেন উনি। আমরা শুধু কফি’ শব্দটা বুঝলাম।

বেয়ারা যেতে না যেতেই ফোনটা আবার বাজল।

কর্ডলেসটা তিনি চেম্বার থেকে নিয়ে এসেছিলেন আসবার সময়ে। বললেন, কাফে দ্য প্ৰালে।

তারপরই খুব উত্তেজিত শোনাল তাঁর গলা। বার বার বলছিলেন, মঁসিয়ে পিয়ের!

তারপরই বললেন, মঁসিয়ে বোস ফ্রম কালকুত্তা।

ঋজুদার কান খাড়া হয়ে উঠল।

মঁসিয়ে পিয়ের মনে হল, মাদাম ব্লঁশকে খুব শাসালেন। ভয়ে মুখ কালো হয়ে গেল মহিলার। উনি বার বার বলছিলেন মঁসিয়ে বোস ইজ ফ্রম কালকুত্তা, ইন্দিয়া, হি ইজ আ ন্যাচারালিস্ট, আ রাইটার। নো নো আই অ্যাম শুওর। মাই হাজব্যান্ড ইজ ভেরি চাম্মি উইথ হিম।

তারপর বললেন, আমি সবই রেখে দিয়েছি। লোক পাঠালেই বন্ধ খামে দিয়ে দেব।

তারপর বললেন, কী? কী বলছেন? অ্যাস্টভ দ্বীপের কথা বলেছি কিনা? হ্যাঁ বলেছি। মঁসিয়ে বোস তো আমার সামনেই বসে আছেন। আপনার কোনও ক্ষতি কি আমি করতে পারি? মঁসিয়ে বোসের এতে কী ইন্টারেস্ট থাকতে পারে?

তারপরই ও প্রান্ত থেকে লাইনটা কেটে দেওয়া হল।

উনি স্তব্ধ হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।

ঋজুদা বলল, পৃথিবীতে শান্তির জন্যে, সে ঘরের শান্তিই তোক কি বাইরের শান্তি, দুটো একটা মিথ্যা বললে কোনও দোষ হয় না মাদমোয়াজেল ব্লঁশ।

তা হয় না। কিন্তু আপনাকে তো মঁসিয়ে পিয়ের বা মাদমোয়াজেল খুঁজে চেনেনই না। তবে আপনার সম্বন্ধে মঁসিয়ে পিয়েরের এত ভীতি কেন?

ভীতির কথা কেউ বলতে পারে? কেন যে কার ভীতি? আমাদের দেশে লজ্জাবতী নামের এক রকম লতা হয়। তার কাছাকাছি কেউ হাত নিলেও, কি তাকে ছুঁলেও, অবশ্যই সে কুঁকড়ে যায়। অনেক মানুষও ওইরকমই হয়। লজ্জাবতীরই মতো বাড়াবাড়িরকম অনুভূতিশীল।

ঋজুদা বলল, ওই যে অ্যাস্টভ দ্বীপ, সেটা ঠিক কোথায়? যাঁরা বেড়াতে আসেন তাঁরা তো সেখানে যান না। গতবারে আমি এসে তো মাহে, প্রালে, লা-ডি-এই ছিলাম। ওই দ্বীপের নাম তো শুনিনি।

মাদাম ব্লঁশ বললেন, ওগুলো ইনার আইল্যান্ডস। ওই তিনটে ছাড়াও আরও আছে কাছাকাছি। ফ্রিগেট আর আরিড। আরিডে বার্ড স্যাংচুয়ারি আছে। আরিডের সামান্য উত্তর-পশ্চিমে আছে বার্ড আইল্যান্ড।

দ্বীপের নামই বার্ড আইল্যান্ড?

হ্যাঁ।

আসলে স্যেশেলস বলতে অধিকাংশ মানুষ মাহে, প্রালে বা লা-ডিগই বোঝে। প্রালেঁতে এসেও এখানের যা আসল দ্রষ্টব্য ‘ভ্যালি দ্য মেইতেই বা কজন যায় তোমার মতো? তুমিও আমার স্বামীরই মতো জঙ্গল-পাগল বলেই তো।

তা ঠিক, মঁসিয়ে ব্লঁশ সঙ্গে না থাকলে তো অত ভাল করে দেখতেও পারতাম।

‘মিলিয়নিয়রস স্যালাড’ কাকে বলে জান?

মহিলা বললেন।

আমাদের কান নড়ে উঠল। কুকুরের কান যেমন শব্দ শুনে নড়ে ওঠে। কিন্তু আমরা অনেক কষ্টে কান কন্ট্রোল করলাম পাছে উনি বুঝে ফেলেন যে, আমাদেরও ইংরেজি একটু একটু আসে।

ঋজুদা বলল, লম্বা, পামিস গাছ, তার মাথায় তালের মুকুট। সেই তালেরই শাঁস তো। কোটিপতির রাঁধুনিরা পুরো গাছকে মেরে ওই স্যালাড বের করতেন আগে। এখন অবশ্য এমনি বেঁটে তালের শাঁস নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কোকো-ডে-মেয়ের তো স্যেশেলস ছাড়া অন্য কোথাও দেখাও যায় না।

তা যায় না। আমাদের প্রালের সৌন্দর্যও কম নয়। মানুষে ‘বো ভাঁলো’ ‘বো ভাঁলো’ করে বটে, কিন্তু সে তো পৃথিবীর সব মানুষের ভিড়ে একটা বাজার হয়ে গেছে। এমন শান্তি আর কোথায় আছে? স্যামন মাছের রঙের রুপোলি গ্রানাইটের নানা আকৃতির বড় ছোট চাঙড়, সাদা কোরাল–গুঁড়ো বালির পাশে পাশে। টাকামাকা গাছেরা উজ্জ্বল সবুজ, বড় বড় পাতার ব্রেড-ফ্লুটের গাছের সারি। আর ভিতরে ঘন জঙ্গলের মধ্যে গাঢ়-লাল প্রবাল-রঙা পাহাড় চুড়ো। রাতেরবেলা এখানে জলের নীচে রং-বেরঙের ফুলের মতো প্রবালেরা তারাদের ছায়াতে ঘুমিয়ে থাকে।

বাঃ। আপনি কী সুন্দর বলেন, আপনি আমাদের কাগজের জন্যে একটি লেখা লিখুন না প্রালে সম্বন্ধে।

হাঃ। লেখা-টেখা কি সকলের আসে মঁসিয়ে বোস? লেখক হতে হলে ঈশ্বরের আশীর্বাদ লাগে। এ তো পাহাড়ে চড়া নয় যে, পড়তে পড়তে, উঠতে উঠতে, অধ্যবসায় থাকলে একদিন না একদিন ওঠাই যাবে! লেখক হতে গেলে POTPISTOLA TOSTI ‘Genius is one percent inspiration and ninety nine per cent perspiration.’ এই বাক্যটি লেখালেখির ব্যাপারে প্রযোজ্য নয়। লিখতে গেলে ইন্সপিরেশন দরকার হয় ঢের ঢের বেশি। বলে, একটু থেমে যোগ করলেন, পারলে হয়তো আমার স্বামী পারতেন। উনি যখন আমাকে আফ্রিকার গল্প বলেন কখনও অন্ধকার অথবা চাঁদের রাতে, আমার মনে হয় আমি যেন সেখানেই চলে গেছি। আশ্চর্য ক্ষমতা আছে ওঁর। কিন্তু ওই…

ওই কী?

কুঁড়েমি। ইন্সপিরেশন যথেষ্টই, কিন্তু পারস্পিরেশনের অংশটা শূন্য। লেখার টেবিলে ঘাম ঝরানোর কোনও ইচ্ছেই যে ওঁর নেই। তার চেয়ে ওঁর ঢের বেশি পছন্দ অনাবিষ্কৃত সৌন্দর্য খুঁজে বার করা, নতুন পথে পুরনো জায়গায় যাওয়ার হদিস-এর সন্ধান করা।

তা হলে, কলম চালাতেও perspiration লাগে বলছেন।

হাসতে হাসতে বলল, ঋজুদা।

হেসে উঠলেন মাদাম ব্লঁশ।

কফি এসে গেল। সঙ্গে টিনের কাজুবাদাম আর টাটকা-ধরা ম্যাকারেল মাছের ফ্রাই।

আরে, আমরা তো সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়েছি।

তাতে কী, এখন তো প্রায় এগারোটা বাজে। ওদের নিয়ে ঘুরে-ঘারে ফিরবেন তো সেই সন্ধের মুখে। ভালই হল, লাঞ্চের জন্যে সময় নষ্ট করতে হবে না আর।

তারপরই আমাদের দিকে ফিরে বললেন, ইয়াং ল্যাডস। প্লিজ ক্যারি অন।

তারপর ঋজুদাকে বললেন, এদের নাম তো বললেন না?

ও হ্যাঁ।

ঋজুদা লজ্জিত হয়ে বললেন, প্রথমেই আলাপ করিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। এঁরা হলেন মঁসিয়ে পিপু, আর মঁসিয়ে ফিসু।

কী নাম বললে?

আমরা নিজেদের নাম শুনে নিজেরা হেসে উঠতে গিয়েও জোর ব্রেক কষে থেমে গেলাম। ভটকাই একটা হেঁচকি তুলল, ইন দ্যা প্রসেস।

ঋজুদা কথা ঘুরিয়ে বলল, জানিস তো, যে কোকো-ডে-মেয়ের গাছ প্রালের ‘ভ্যালি দ্য মেই’তে পাওয়া যায়। আগে অনেকের ধারণা ছিল ওই গাছ জন্মায় সমুদ্রের গভীরে।

সত্যি?

আমরা বললাম অবাক হয়ে।

হ্যাঁ। এই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ছাতার মতো গাছগুলো আকাশ ঢেকে রাখে। নানারকম সরীসৃপ ডাকাডাকি করতে করতে এ গাছ থেকে সে গাছে দৌড়ে বেড়ায়। তলায় গভীর রহস্যময় অন্ধকার। তারই মধ্যে মধ্যে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের কালো টিয়ারা শিস দিতে দিতে উড়ে যায়। ওই বনভূমি দেখলে মনে হয় যেন অন্য কোনও যুগের কোনও বনভূমি দৈব-অভিশাপে এই পৃথিবীতে রয়ে গেছে। মানুষের এই বনভূমিতে কিছু করণীয় নেই, ওই সৃষ্টির পেছনে কোনও কেরামতিও নেই। এই বনভূমি, দূর থেকে দেখলেও মনে সম্ভ্রম জাগে। এই বনভূমিতে সব গাছই ঊর্ধ্বমুখী, সূর্যমুখী। নিজের নিজের আকাশটুকুর জন্যে যেন প্রত্যেকেই সংগ্রাম করছে।

এখানে এলে শুধু ওপর দিকেই তাকাতে হয়। মাঝে মাঝে হাওয়া দিলে মস্ত বড় বড় পাতা ছিঁড়ে নীচে পড়লে নিথর বনের মধ্যে যে শব্দ ওঠে, তা প্রতিধ্বনিত হয়। ঝড় উঠলে, ওই আশ্চর্য নারকেল বনের পাতায় পাতায় এক আওয়াজ ওঠে। যে, তা না শুনেছেন, তাঁর পক্ষে অনুমান করাও মুশকিল। তারই মধ্যে ধুপ করে শব্দ করে কোনও একটি কোকো-ডে-মেয়ের হয়তো খসে পড়ে নীচে। রোদ্দুর ভরা দিনের বেলায় ওপরে রোদ ঝলমল করলে কী হয়, নীচে যখন সে আলো নামে, তখন তা সবুজাভ হয়ে যায়।

ভটকাই বলল, ম্যাকারেল মাছের মধ্যে একেবারে কদবেলের মতো মজে গিয়ে, বনজ্যোৎস্নায়, সবুজ অন্ধকারে।

আমি বললাম, জ্যোৎস্না কোথায় পেলি। বল, বনরোদ্দুরে, সবুজ অন্ধকারে।

ওই হল।

কিন্তু বইটা কি পড়েছিস?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

বলল, ভটকাই। মাছভাজার টুকরোটা মুখে পুরে।

কফি, ম্যাকারেল ভাজা আর কাজুবাদাম খাওয়া শেষ হলে ঋজুদা বলল, আপনার কাছে স্যেশেলসের আউটার আইল্যান্ডগুলোর কোনও ম্যাপ আছে? না থাকলে কোথায় পাব?

পাবে হয়তো ট্যুরিস্ট অফিসে, কিন্তু আমার কাছে একটা একস্থা থাকলেও থাকতে পারে।

বলেই, তিনি ভিতরে চলে গেলেন।

কী বুঝছিস?

ঋজুদা বলল।

ভারী ভাল মহিলা। কিন্তু আমাদের শত্রু তো জেনে গেল যে, আমরা অ্যাস্টভ দ্বীপের ম্যাপের হদিস পেয়ে গেলাম ওঁর কাছ থেকে।

তা গেল।

তো কী হবে?

যা হওয়ার তা হবে।

আমরা কি কাল সকালেই বেরিয়ে পড়ব সেদিকে? কী করে যাবে? বোট চার্টার করে? খাবারদাবার এবং পানীয় জলও তো নিয়ে যেতে হবে সঙ্গে। কতদিন থাকতে হবে তার তো ঠিক নেই।

ভটকাই বলল।

দেখি।

কী যেন ভাবতে ভাবতে ঋজুদা বলল।

এমন সময় মাদাম ব্লঁশ একটি ম্যাপ নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে মেলে ধরলেন। ধরে, তাঁর হাতে ধরা একটা রুপোর বলপয়েন্ট পেন দিয়ে দেখালেন…

ঋজুদা বলল, এই কলমটা শারানডাশ নয়?

হ্যাঁ। তুমি চেন?

চিনি। সুইজারল্যান্ডের নামকরা পেন আর বলপয়েন্ট। সোনার হয় আর রুপোর হয়।

তুমি দেখছি পেন-বিশারদ।

আমি যে লেখক। পেনই যে আমার হাতিয়ার। পেন, বলপয়েন্ট, তুলি।

এই দেখ, স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জে কত অসংখ্য দ্বীপ আছে। অগণ্য দ্বীপের এখনও নামকরণ হয়নি। তাদের সার্ভেও করা হয়নি। সেখানে কী কী গাছ বা কী কী প্রাণী থাকে, তারও খোঁজ নেওয়া হয়নি। মিষ্টিজল পাওয়া যায় কি না, তারও না। এই দ্যাখো, ইনার আইল্যান্ডসের কথা তো আগেই বলেছি। আউটার আইল্যান্ডসে চারটে পুঞ্জ আছে। আমিরান্তেস, আলফোঁস, ফারকুহার আর অ্যালডাবরা। এর মধ্যে স্বর্গের মতো সুন্দর অ্যাটলও আছে অনেক।

ঋজুদা মন দিয়ে শুনছিল। মাদাম কুঁশ থামতেই বলল, অনেক ধন্যবাদ। তবে, হাতে সময় তো বেশি নেই, ওদের যতটা সম্ভব ঘুরিয়ে দেখাই। একটা ট্যাক্সি কি ডাকা যাবে ফোনে?

তারপরই ঋজুদা বলল, টেক কেয়ার।

বলে, ওঁর ডান হাতটা ধরে, হাতের পাতার পিঠে আলতো করে চুমু খেল।

উনি বললেন, বাঈ!

বাঈ!

ট্যাক্সিটা এসে গেল। আমরা উঠে হাত নাড়লাম ওঁকে।

উনি হাসছিলেন, খোলা আকাশের পটভূমিতে সাদা রংকরা কাঠের বনবাংলোর মতো বাংলো-হোটেলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। ডান হাতের আঙুল দিয়ে গলার মুক্তোর মালার মুক্তোগুলো নাড়ছিলেন আর বাঁ হাত দিয়ে এলোমেলো-হওয়া চুল ঠিক করছিলেন। একটা ছাই-রঙা সিল্কের স্কার্ট পরেছিলেন উনি আর সাদা সিল্কের ব্লাউজ। সাদা জুতো। স্কার্টটা উড়ছিল জোর সামুদ্রিক হাওয়াতে। খুবই স্নেহময়ী মহিলা। আমার মায়েরই বয়সী হবেন। বেয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ।

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিতেই উনিও হাত নাড়লেন।

.

কোনদিকে যাব এবারে?

ভটকাই-এর বকবকানি শুরু হল।

ঋজুদা যেন কী গভীর ভাবনাতে বুঁদ হয়ে গেল। ভটকাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, জেটি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই জেটিতে পৌঁছে গেলাম। ঋজুদা একটা বোটের সঙ্গে কথা বলে আমাদের নিয়ে উঠল। ট্যাক্সিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল, জেটিতে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে সব সময়ে, না সে-ই ফিরে আসবে আমাদের ফেরার সময়?

সে বলল, আমিই ফিরে আসব। যাবেন কোথায় জেটি থেকে? মাদাম ব্লঁশের হোটেলেই?

আমরা যাব এয়ারপোর্টে। কিন্তু ঋজুদা সে কথা বলল না তাকে। বলল, পৌনে পাঁচটা নাগাদ এসো। বকশিস দেব।

সে বলল, বকশিস লাগবে না। আসব।

বোট ছেড়ে দিল। সাদারঙা বোট। খুব শক্তিশালী ইঞ্জিন। মাথায় ছাদ আছে। নীচে আট-দশজনের বসার চেয়ার। সামনে-পেছনে ডেক। ইঞ্জিনরুম পেছনে।

একে ইঞ্জিনের শব্দ, তার ওপরে সমুদ্রের শব্দ আর হাওয়ায় কথাগুলো উড়ে যাচ্ছিল মুখ থেকে।

ভটকাই চিৎকার করে উঠল, ওটা কী পাখি ঋজুদা? লাল ঠোঁট, লাল লেজ।

ঋজুদা দেখে বলল, ওর নাম টুপিক বার্ড। কী সুন্দর-মসৃণ সাদা দেখেছিস। মনে হয়, পিঠে হাত বুলিয়ে দিই। সামুদ্রিক পাখি। এদিকে কম দেখা যায়। আলডাবরাতে অনেক আছে।

আর ওই যে! পাড়ের খয়েরি-রঙা পাখিটা?

সেটাও দেখনি। ব্রাউন নডি-টার্ন। আমাদের দেশের ধনেশ পাখির যেমন গ্রেটার আর লেসার হয়, এই ব্লাউন-নডিদেরও দুটো ভ্যারাইটি। ছোটটাকে বলে লেসার। আর ওই দ্যাখ স্যুটি টার্ন। ওদের আরেকটা নাম হচ্ছে ওয়াইড-অ্যাওয়েক টার্ন।

কেন? ওরকম নাম কেন?

সবসময়েই তীক্ষ্ণ নজর। আর কিছু দেখলেই চিল-চিৎকার জুড়ে দেয়, তাই। অনেকটা আমাদের টিটি পাখি, মানে ল্যাপউইঙের মতো বলছ? হ্যাঁ। অনেকটা, তবে ওয়াইড-অ্যাওয়েক টার্ন-এর আওয়াজ শুনলে আঁতকে উঠতে হয়।

ল্যাপউইঙের ডাকেও তো আমার গা ছমছম করে। বিশেষ করে রাতে। হুটিটি হুট। হুট। হুট। হুট।

ভটকাই বলল।

সাদাকালো। আরও একরকমের টার্ন দেখা যায় এখানে, তাদের নাম ফেরারি টার্ন। পুরো সাদা ঠোঁট, পা আর চোখ কালো। পাখি দেখতে গেলে আরিড আইল্যান্ডে যেতে হয়।

ওখানে একরকমের Ibis আছে, যা শুধুমাত্র ওখানেই পাওয়া যায়।

Ibis মানে?

ভটকাই বলল।

আঃ! একরকমের পাখি।

আমি বললাম।

তারপর ঋজুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ওখানে মানে?

আলডাবরা দ্বীপপুঞ্জে। ওদের নামই, আলডাবরা স্যাক্রেড আইবিস।

স্যাক্রেড? তা পবিত্র কেন?

পবিত্র বলে, বোধহয় ওদের চোখের জন্যে। আশ্চর্য নীল চোখ ওদের। চায়না-ব্লু। আলডাবরাতে আরেকরকম পাখি দেখতে পাওয়া যায়, ছোট পাখি, হোয়াইট-থ্রোটেড রেইল। ও পাখিগুলো উড়তে পারে না। কত পাখিই তো উড়তে পারে না। তবে সেইসব পাখির প্রজাতি অবশ্য খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য। এই সামুদ্রিক দ্বীপগুলোতেই কিন্তু এই সব পাখি বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

কীরকম?

হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে একরকমের উড়তে না-পারা পাখি একসময়ে অনেক ছিল। এখন প্রায় দুষ্প্রাপ্য হয়ে গেছে। নাম ‘নেনে। আমাদের নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে আছে মেগাপড। ডোডো পাখি আছে মরিশাসে। স্যেশেলসের কাছেই। মরিশাস হয়েই আমাদের ফিরতে হবে মুম্বাইতে, যদি এয়ার ইন্ডিয়াতেই ফিরি।

যদি আদৌ ফিরি বলো। তোমার প্লুজেঁ আর পিয়ের যে কী খেলা খেলবে আর খেলাবে তা তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

আমি বললাম।

একেবারেই কি বোঝা যাচ্ছে না?

ঋজুদা বলল, রহস্যময় গলাতে, আমাদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে।

তারপর বলল, নামগুলো অন্যদের সামনে না বলাই ভাল। অন্য নাম দে ওদের।

ভটকাই বলল, মাছের নাম দেব?

দে।

ল্যাটা আর পোটকা।

কে কোন জন?

প্লুজেঁ ল্যাটা আর পিয়ের পোটকা।

ওক্কে।

আমি বললাম, ওকথা বললে কেন ঋজুদা?

কী কথা?

কিছুই কি বোঝা যাচ্ছে না?

ঋজুদা পাইপটাকে নিজের ডানদিকের জুলপির কাছে একবার চুঁইয়ে বলল, ভাব। ভাব। ঈশ্বর মস্তিষ্ক দিয়েছেন, সেটাকে যতই কাজে লাগাবি ততই সেটা উর্বর হবে।

আমি আর ভটকাই অবাক হয়ে গেলাম। সকাল থেকে যা কিছুই ঘটেছে, তার সঙ্গে আমাদের রহস্য সম্বন্ধে বোঝাবুঝির সম্পর্ক কী যে তা কিছুই বুঝলাম না।

ঋজুদা বলল, ওই দ্যাখ টাকামাকা বে৷ টাকামাকা গাছগুলো দেখছিস। কী সুন্দর তটভূমি, দেখেছিস? পাউডারের মতো সাদা। বালিও প্রবালের গুঁড়ো।

ভটকাই বলল, যেখানে সৌন্দর্য সেখানেই ভয়। ফুল থাকলেই কাঁটা থাকবে। রামকুমারবাবুর গান শুনিসনি?

বিরক্ত হয়ে বললাম, কী গান?

যেমনি শুধোনো, অমনি ভটকাই চোখ-মুখ ভেটকে টপ্পা ধরে দিল:

গেলাম ফুল তুলিবারে, যত্নে মালা গাঁথিবারে
অমনি কাল ভুজঙ্গ দংশিল আমায়
এখন বাঁচি কি না বাঁচি, বল প্রাণে-এ-এ-এ-এ…

ঋজুদা বলল, টপ্পার দানা আর বেশি দিস না। বোট এবারে উল্টোবে। উল্টোলেই জলে পড়বি। আর জলে পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে হাঙর ক্যাচ করবে। এত গভীরে তো কেউ সাঁতার কাটে না!

হাঙর আসে না কি?

আসে বইকী! কম আসে। তবে ভটকাইয়ের টপ্পা শুনে আসতেও পারে।

কী হাঙর?

খুব সুন্দর দেখতে। ইস্পাতের মতো ছাই-ছাই রং আর গায়ে কালো ফুটি-ফুটি দাগ।

নাম কী?

হোয়েল শার্ক। তবে ওরা কিন্তু মাড়োয়ারি, গুজরাটিদের মতোই নিরামিষাশী। প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে থাকে। বুঝলি তো। তবে মাড়োয়ারি-গুজরাটিরা যেমন মাঝেমধ্যে নিরামিষ-গণ্য করে ডিম খান, তেমন প্ল্যাঙ্কটনের মধ্যেও অনেক সময়ে তোর আমার মতো মানুষের পো আমিষও খেয়ে থাকে। অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। কী বল?

প্ল্যাঙ্কটনটা আবার কী জিনিস?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

প্ল্যাঙ্কটন-এর মানে, আমি বলতে গেলাম ভটকাইকে। কিন্তু ঋজুদা বলল, বলবি না।

তারপর ভটকাইকে বলল, একটা Webster-এর ডিকশনারি আজই কিনে নিবি, আর Roget-এর Thesarus of English Words and Phrases। অন্যে বলে দিলে, শেখা হয় না। যে-কোনও ইংরেজি শব্দর মানে তুই না জানলে বানানটা শুধু ঠিক করে জেনে নিবি তারপরে ডিকশনারি দেখবি। বাংলার ব্যাপারেও তাই করবি। সংসদের একটা অভিধান এবং এক সেট বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য আকাঁদেমির, হাতের কাছে রাখবি কলকাতাতে সব সময়। বাংলা তোর মাতৃভাষা বলেই তুই যে সে কারণেই সে ভাষাতে পণ্ডিত, এমন ভাবিস না। আমরা কেউই ইংরেজি তো ভাল জানিই না, বাংলাও জানি না। সব সময় নতুন নতুন শব্দ শেখার চেষ্টা করবি। শিখতে তো কোনও লজ্জা নেই। আমি তো চিতাতে ওঠার আগের মুহূর্ত অবধিও শিখতে রাজি আছি।

বোটটা যখন প্রালেঁর জেটির দিকে মুখ ফেরাল, তখন আমি বললাম, স্যেশেলসের পাহাড়গুলো দেখলে ভয় করে। কত বড় বড় পাথর। পূর্ব-আফ্রিকার সেরেঙ্গেটির Kopjeগুলো তো এদের কাছে পিঁপড়ে।

রুআহাতে তো Kopje ছিল না।

ভটকাই বলল।

কে বলল, ছিল না? সেখানেও ছিল। তুইতো আর রুআহা বা গুগুনোঞ্চম্বারের দেশেতে যাসনি। তবে সেরেঙ্গেটির Kopje অন্যরকম। রুদ্রর ‘গুগুনোগুম্বারের দেশে’তে আছে তার বর্ণনা। বানান Kopje, উচ্চারণ কিন্তু কোপি।

ঋজুদা বলল।

হায়। হায়। সোয়াহিলি ভাষাও দেখি কম যায় না ধাঁধায়।

ভটকাই বলল।

ঋজুদা বলল, এই সব দ্বীপেই গ্রানাইট পাথরের পাহাড়। কালোটাই বেশি। সাদা ও খয়েরিও আছে। হাজার বছরের জলের আর বরফের চাপে, হাওয়ার ফুৎকারে এরা ক্ষয়ে গেছে। কত বিচিত্র সব আকার নিয়েছে। মনে হয়, কোনও স্থপতিই বুঝি বানিয়েছেন অথবা ভাস্কর, বিশাল মাপের হাতুড়ি আর ছেনি দিয়ে। তা ছাড়া, যেহেতু অধিকাংশ তটভূমিই জনহীন, সে জন্যেও গা ছমছম করে।

তারপর বলল, জানিসতো, স্যেশেলসেও একজন নামকরা ভাস্কর আছেন। দারুণ কাজ করেন। যদি বেশিদিন থাকা হয়, তবে তাঁর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব তোদের। তাঁর স্টুডিয়োতেও নিয়ে যাব। তাঁর খ্যাতি পৃথিবীজোড়া।

নাম কী?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

মাহেতেই থাকেন তিনি। নাম Tom Bowers..

এখানের পাহাড়গুলো ফিল্ম-এ দেখা Guns of Navarone পাহাড়ের মতো। তাই না? এমন খাড়া যে, কেউই বোধহয় উঠতে পারে না।

ঋজুদা হেসে বলল, ঠিকই বলেছিস।

এইসব দ্বীপে কী কী গাছ আছে ঋজুদা?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

গাছ তো আছে অনেকরকম। আমি কি আর সর্বজ্ঞ? তবে যে কটি গাছ নিজের চোখে দেখেছি, তাদের কথাই বলতে পারি। যেমন ধর মাহগনি। এখানে Sangdragon নামের একরকমের বড় বড় গাছ হয়, তাদের নীচে নীচে চলে-যাওয়া ছায়াশীতল বনপথে চলতে ভারী আরাম। আরও কত গাছ আছে।

আর ফুল?

ফুলের কি শেষ আছে? লাল জবা। দারুণ দেখতে। কিন্তু জানিস তো, মাত্র একদিন থাকে গাছে, ফোঁটার পরে। হলুদ জবাও হয়, ডাবল। হাল্কা। গোলাপিরঙাও হয়। আর সাদা সাদা ছোট-ছোট ফ্যাঙ্গিপ্যানি ফুল যখন ফোটে, তখন সারা দ্বীপকে সুগন্ধে ভরে দেয় ছোটাছুটি করা হাওয়া।

আমি বললাম, জবা ফুলের ইংরেজি কী? জানিস?

অদম্য ভটকাই বলল, ‘জাভাপ্যানি’ তো!

আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম ওর কথাতে।

ঋজুদা বলল, সত্যি! তোকে চিড়িয়াখানাতেই রাখা উচিত।

তা বলো। এখানে কি ডিকশনারি আছে সঙ্গে? আমার তো ইংলিশ-বেঙ্গলি নয়, বেঙ্গলি-ইংলিশ ডিকশনারি দরকার।

তাই কিনে নিয়ো একটা কলকাতা ফিরে।

বল না রুদ্র, জবা ফুলের ইংরেজি কী?

হাইবিসকাস।

শিখলাম।

এখানে এই নীল স্বচ্ছ জলের তলায় তলায় যে কতরঙা প্রবালের বাগান আছে, তা কী বলব। তোদের নিয়ে যাব গ্লাস-বটম বোটে করে অ্যান ম্যারিন ন্যাশনাল পার্ক দেখাতে। সেই বোটগুলোর একতলাটা থাকে জলের নীচে। দু’পাশে বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা। কত রকমের মাছ, কত রকমের আর রঙের প্রবালের ফুল যে দেখতে পাবি। ওইখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করবে, সারাজীবন।

একটা প্রাসাদ আর রাজকন্যা থাকলে, থেকেই যেতাম।

খুঁজতে তো হবে। না খুঁজলে, পাবি কী করে? ওই জন্যই তো স্কুবা-ডাইভিং আর স্নারকেলিং শেখা দরকার, যাতে অক্সিজেন সিলিন্ডার পিঠে বেঁধে বহুক্ষণ জলের তলাতে পায়ে ব্যাঙের পায়ের মতো রাবারের-পা লাগিয়ে সাঁতরে বেড়িয়ে সমুদ্রের বুকে আঁতিপাতি করে খুঁজতে পারিস।

নাঃ। হত্যিই দেখতাছি শিখন লাগব। শিইখ্যা লমু অনে। কী কও মিস্টার রুদ্র?

তুমি শিখবানা? তুমি শিখলে আমিও শিখুম।

ভাল করে শিখলে Frogman হয়ে গিয়ে ব্যাঙের মতো জলের নীচে সাঁতরে গিয়ে শত্রুপক্ষের নোঙর করা জাহাজের তলপেটে ডিনামাইটের চার্জ বেঁধে দিয়ে এসে দূর থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস-এ ফাটাতে পারিস। ফ্রগমেনদের কাজ খুবই দুঃসাহসিক কাজ এবং তাদের মাইনেপত্তরও খুবই ভাল।

ভটকাই বলল, তা হউক গা। মানুষ হইয়া জন্মাইয়া ব্যাঙ হইতে যামু কোন দুঃখে! হাঃ। ছাড়ান দাও। যত্ত বাজে কথা তোমার।

টাকামাকা পেরিয়ে এলাম, এবার দ্যাখ Anselazion বিচ। এই বিচকে শুধু আমিই নই, অনেকেই বো ভাঁলোর চেয়েও সুন্দর বলেন।

লাল লাল ওই ফুলগুলো কী বলো তো? পাহাড়ে ফুটেছে, মাঝারি সাইজের গাছে? কৃষ্ণচুড়া?

ভটকাই শুধোল।

কী গাছ রুদ্র?

ঋজুদা উল্টে আমাকে জিজ্ঞেস করল।

কৃষ্ণচূড়া নয়, তবে কী গাছ বলতে পারব না। কৃষ্ণচূড়ার মতো নয়। অন্যরকম। এবং অনেক বেশি লাল।

এক্কেবারে হল্লা-গুল্লা লাল।

ভটকাই বলল।

নামটাও হল্লাগুল্লার। নাম শুনলে অজ্ঞান হয়ে যাবি।

কী? বলো না বাবা।

ফ্ল্যামবয়ান্ট।

অ্যাঁ? ফুলের নাম Flamboyant?

ইয়েস স্যার।

ওই যে দ্যাখ দ্যাখ রুদ্র, বোগেনভিলিয়া।

কই?

ওই যে রে।

হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে। আমাদের বোগেনভিলিয়াই।

কই?

বোগেনভিলিয়া কি তোমার মাতুল কেঠো মিত্তিরের সম্পত্তি? আমাদের মানে কী?

ভটকাই বলল।

মানে, ভারতের। ইডিয়ট।

আমি বললাম।

বোগেনভিলিয়া ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর। যতদূর জানি, এগুলো আমেরিকান ট্রপিকাল লতা। শুধু এই গাছই কেন, তোদের কলমি শাক, লাউ, কুমড়ো, বেগুনও এখানে পাবি। প্রত্যেক বাড়িতেই হয়তো একটা করে সজনে গাছও দেখতে পাবি কিন্তু সজনে ডাঁটা খেতে এরা জানে না। বাজারেও কিনতে পাবি না।

আহা! ইহারা কী হারাইতেছে, ইহারা জানে না। এখান থেকে সজনে-ডাঁটা এক্সপোর্ট করার একটা ব্যবসা ফাঁদলে মন্দ হত না!

ওরিজিনাল ভটকাই বলল।

এখানে জামরুলও হয়, কিন্তু তাদের রং লাল। এখানের চড়াই পাখি লক্ষ করেছিস? পিঠ লাল। যখন লাফালাফি করে তখন ভারী সুন্দর দেখায়।

আম হয়?

হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, কখনও কখনও দেখা যায় গাছের ডালে বড় আম ফলে রয়েছে আর তার পাশেই আমের নবমুকুল।

তাই? তবে তো কলকাতা ফিরেই কথাটা চালু করতে হবে।

কী কথা?

‘এঁচড়ে পাকাই’ হয় না শুধু ‘মুকুলে পাকাও হয়।

এক, আদি এবং অকৃত্রিম ভটকাই বলল।

আমরা হাসলাম।

কলাও পাওয়া যায়?

যায় বইকী। কাল তোদের বাজারে নিয়ে যাব। তবে এখানের মানুষেরা তো ভটকাইয়ের মতো বাঁদর নয়, তাই কলা চেনে না।

মানে?

চেনে, কিন্তু চাঁপা কলা, কাঁঠালি কলা, আর মর্তমান কলার মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, তা জানে না। ছোট কলাগুলো এখানে লাল লাল হয়। মর্তমান কলারও যা দাম, কাঁঠালি আর চাঁপা কলারও তাই দাম।

বাবা। সবই দেখছি হড়েগড়ে এক।

জ্যাঠামশাই ভটকাই বলল।

আচ্ছা, প্রালেঁতে কি হোটেল নেই ভাল?

অনেকই আছে।

সমুদ্র থেকে তো দেখা যাচ্ছে না একটাও।

লুকিয়ে আছে নারকেল বনের মধ্যে।

মানে?

মানে, পুরো স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের নিয়ম হল, কোনও বাড়িই নারকেল গাছের চেয়ে উঁচু হতে পারবে না, সে ফাইভ স্টার হোটেলই হোক আর যাই হোক।

বাঃ! এমন আইন সব দেশেই করা উচিত। এখানের মানুষগুলোর বুদ্ধি তো আছেই, সৌন্দর্যবোধও আছে।

ভটকাই বলল।

কথাটা ঠিকই।

ঋজুদা বোট ঘুরোতে বলল। গল্পে গল্পে অনেকই দূরে এসে গেছি। আহা কী সুন্দর জলের রং। নীলের আর সবুজের যে কতরকম। আর জল একেবারে স্বচ্ছ। সাদা বালি, নীল স্বচ্ছ জল আর ঢেউয়ের সাদা ফেনা, পাড়ের ঝকঝকে সবুজ আর লাল মিলে চোখ ফেরানো যায় না।

জেটিতে ফিরতেই পাওয়া গেল সকালের সেই ট্যাক্সিকে। কথা রাখতে জানা ভদ্রলোকের মতোই অপেক্ষা করছিল সে। প্রাঁলে এয়ারস্ট্রিপে জেটি থেকে যাওয়ার সময়ে ঋজুদা মাদার ব্লঁশের হোটেলে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে বলল, ট্যাক্সিতে বোস, আমি এক সেকেন্ড আসছি।

কিছুক্ষণ পরেই মাদাম ব্লঁশ আর ঋজুদা বেরিয়ে এলেন। ঋজুদার হাতে একটা খাম ছিল। উনি হাত নাড়লেন। আমরাও। তারপর ঋজুদা উঠতেই ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।

.

আমরা যখন প্রাঁলে এয়ারস্ট্রিপ থেকে আইল্যান্ডার প্লেনে করে এসে মাহে এয়ারপোর্টে নামলাম, তখন নীল সমুদ্রকে সোনার পাত দিয়ে মুড়ে দিয়ে সূর্যটা পশ্চিমে ডুবে যাচ্ছে।

গতকাল দুপুরে এখানে পৌঁছে এয়ারপোর্টের কাছেই যে বাড়িতে আমরা প্রথম নেমেছিলাম কার্লোস আসার আগে, সেই বাড়ির সামনে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ঋজুদা ভিতরে ঢুকে গেল। একটু পরেই একজন মোটাসোটা, বয়স্কা মহিলার সঙ্গে ঋজুদা বেরিয়ে এল। আসতে আসতে যে-খামটা মাদাম ব্লঁশের কাছ থেকে এনেছিল, তার ওপরেই কী যেন লিখল ঋজুদা। ট্যাক্সিতে উঠে ঋজুদা বলল, থ্যাঙ্ক ঊ্য মিসেস মেক্যাঞ্জি।

মেক্যাঞ্জি নাম শুনেই বুঝলাম, স্কটল্যান্ডের মানুষ। কোন দেশের মানুষ যে এখানে এসে থিতু হয়নি! কালো, সাদা, হলুদ সব রকমের মানুষই আছে, এখানের পাখি আর ফুলেরই মতো।

‘বো ভাঁলো বে’ হোটেলে ঢোকার আগেই ঋজুদা পথে নেমে গেল। বলল, তোরা চলে যা। নিজেদের ঘরের চাবি নিয়ে ঘরে যা। আমার চাবি তোরা নিবি না। আমি পৌঁছে তোদের আমার ঘরে ডেকে নেব। কথা আছে।

আমরা রাতেও কি তোমার ঘরেই ডিনার খাব?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

ওঃ। সত্যি ভটকাই!

ঋজুদা বলল। তারপর বলল, না। আজ আমরা ইন্ডিপেন্ডন্স অ্যাভেনুতে ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁ ‘পাইরেট আর্মস’-এ ডিনার খাব। তবে তার অনেক দেরি আছে। তোর পেটে কি দানো ঢুকেছে? এত ক্ষিদে আসে কী করে!

ঋজুদাকে নামিয়ে দিয়ে আমরা চলে গেলাম। রিসেপশন থেকে আমাদের ঘরের চাবি নেওয়ার সময়ে কাউন্টারে একটি মেয়ে বলল, তোমরা কি মিস্টার বোসের পার্টির?

আমি বললাম, না না, আমরা কারও পার্টির নই। কিন্তু কেন?

একটা মেসেজ আছে ওঁর নামে।

তা হবে। ওঁকেই দেবেন।

উনি কোথায়?

তা আমরা কী করে জানব?

ঘরে ঢুকে, ভটকাই বেশ কিছুক্ষণ চিৎপটাং হয়ে খাটের ওপর শুয়ে থাকল। তারপর বলল, ওঃ। সারাটা দিন যা ধকল গেল না শরীরের উপরে। ঋজু বোস ছেলেমানুষ, বুড়োর কষ্ট কী বুঝবে! যাই চানটা করেই নিই, নইলে ‘পাইরেট আর্মস’-এ ডিনারটা জমবে না।

আমি বিরক্ত হয়েই ছিলাম ওর ওপরে। কিছু না বলে, জানালার কাছে এসে দাঁড়ালাম। সমুদ্র আর তটভূমি তো দেখা যায়ই এখান থেকে, হোটেলের এনট্রান্সটাও দেখা যায়। ঋজুদা বলছিল, আগের বার যখন এসেছিল একবার আফ্রিকা ফেরত, তখন গাড়ি খুব কমই ছিল। কিন্তু এখন গাড়ি অনেক। এনট্রান্সটা দেখা যায় বটে কিন্তু গাড়ি থেকে যেখানে মানুষে বিরাট লবির সামনে নামে, সেখানটা দেখা যায় না। প্রকাণ্ড গোল ছাতার মতো ছাদ আছে প্রবেশদ্বারের ওপরে রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য, যে-কোনও ফাইভস্টার হোটেলেই যেমন থাকে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গাড়ির আসা-যাওয়া দেখতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরে দেখি, ঋজুদা হেঁটে হেঁটে আসছে। কিন্তু গেটে না ঢুকে গেট পেরিয়ে আরও সামনে চলে গেল। সমুদ্রতটের পাশ দিয়ে পথ চলে গেছে পিচ-বাঁধানো। অনেক নারী পুরুষই তখন চান করছেন, অথবা তটে শুয়ে-বসে আছেন। তটের পাশাপাশি পথ ধরে ঋজুদা হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেল। একটু পরে তাকে আর দেখা গেল না।

ভটকাইয়ের স্নান হয়ে গেল। কিছুই করার নেই। তাই আমিও চলে গেলাম।

বাথরুমে ঢুকে, শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলাম ঋজুদার সেই কথাটার মানে। সেই যে বোটে বলল না? কিছুই কি বোঝা যাচ্ছে না? ঈশ্বর মাথা দিয়েছেন, মাথাটা খাটা।

‘কী যে বোঝা যাচ্ছে না’ তা মাথা অনেকক্ষণ শাওয়ারের ঠাণ্ডা জলের নীচে স্থির রেখেও বোঝা গেল না। কে জানে! আমার হয়তো মাথাই নেই। অথবা ভটকাই-এর সঙ্গদোষে, থেকেও কাজ করছে না।

এমন সময় ভটকাই দুমদাম করে দরজাতে ধাক্কা দিতে লাগল।

ছেলেটাকে নিয়ে, কেতাদুরস্ত জায়গাতে ওঠাই মুশকিল। ওইরকম শব্দ শুনে এক্ষুনি হয়তো সিকিউরিটির লোকেরা ছুটে আসবে ঘরে।

দরজাটা একটু ফাঁক করে বললাম, হলটা কী?

ও বলল, বস ইজ কলিং।

তাড়াতাড়ি গা-মাথা মুছে জামাকাপড় পরে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। তারপর ঋজুদার ঘরে গেলাম নিজেদের ঘর লক করে। যার যার পিস্তল, রিভলবার কোমরের হেলিস্টারে ঠিকই ছিল আর একটা করে গুলিভরা একস্ট্রা-ম্যাগাজিন জিনসের প্যান্টের হিপ পকেটে ঢুকে গেল।

বেল দিতেই ঋজুদা দরজা খুলল এসে।

বলল, বোস।

ঋজুদা মাদাম ব্লঁশের কাছ থেকে নিয়ে-আসা খামটা খুলে আমাদের একটা ফোটো দেখাল। একজন লম্বা ছিপছিপে সাহেবের ফোটো, মাদমোয়াজেল ব্লঁশের হোটেলের সামনে একটি অল্পবয়সী স্যেশেলোয়া মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে, তার কাঁধে হাত দিয়ে। একটি লাল গেঞ্জি এবং নীল জিনস পরে আছে মেয়েটি আর ওই সাহেব হলুদ গেঞ্জি আর বহুরঙা স্টাইপসের বারমুডা পরে। পায়ে রাবারের চটি।

ভাল করে চিনে রাখ চেহারাটা। এই হচ্ছে পিয়ের। যেদিন ছবিটা তোলা, সেদিনই মেয়েটা প্রালেঁতে জলে ডুবে মারা যায়।

অ্যাকসিডেন্ট না মার্ডার?

কী করে বলব!

ফোটোটাকে ও বাঁ হাতে নিয়ে নিজের চোখ থেকে দূরে প্রসারিত করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ভটকাই বলল, লোকটাকে আমি দেখেছি ঋজুদা।

আমি আর ঋজুদা অবাক হয়ে ভটকাইয়ের দিকে চেয়ে থাকলাম।

ঋজুদা জেরা করল। বলল, কোথায় দেখেছিস?

প্লেনে।

কোন প্লেনে?

আরে, প্রাঁলে থেকে আমরা যে প্লেনে ফিরে আসি, সেই প্লেনে। একটা ছাই-রঙা স্যুট পরেছিল, তার সঙ্গে ক্যাটক্যাটে লাল টাই। ওই বিচ্ছিরি টাইটার জন্যই আমার নজর পড়ে ওর দিকে। লোকটার বাঁদিকের কব্জিতে একটা কিম্ভুতকিমাকার ঘড়ি ছিল। সেই ঘড়িটা দেখতে গিয়েই দেখতে পেলাম যে, তার বাঁ-হাতের কব্জিতে নীল-রঙা টাটু করা। কী সব সাপ-ব্যাঙ আঁকা। আর এই দ্যাখো, এই ফোটেতেও বাঁ-কব্জির টাটু স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে।

প্লেনের কোথায় বসেছিল লোকটা?

আমাদের পেছনে। তাই তোমরা দেখনি।

তা, তুই দেখলি কী করে?

আমার চোখ আছে তাই। ও যখন প্লেনের জন্য অপেক্ষা করছিল, তখনই ওকে লক্ষ করেছি।

ও কি আমাদের দেখছিল?

ঋজুদা সামান্য উদ্বিগ্ন গলায় বলল।

তা লক্ষ করিনি। তবে আমরা যেমন ওর ফোটো দেখছি, তখন ও-ও কিন্তু নারকেল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে একটা ফোটো বের করে একবার ফোটোটার দিকে আর একবার তোমার দিকে দেখছিল।

ঠিক দেখেছিস?

আমি ঠিকই দেখি ঋজুদা।

হুঁ।

ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, তা হলে পিয়ের প্রালেঁতেই ছিল। বোটে করে ফিরে যায়নি সকালে। যা আশঙ্কা করেছিলাম, তাই।

কী ব্যাপার! খুলেই বলো না আমাদের।

গতরাতে মঁসিয়ে পঁপাদুকে আমি মরিশাস-এ ফোন করেছিলাম। তখনই ও জানাল যে প্লুজেঁ ‘বো ভাঁলো বে’ হোটেলে পৌঁছে গেছে জিনিভা থেকে তিনদিন আগেই। পিয়ের তো আগেই পৌঁছেছে।

আর কী বলল মঁসিয়ে পঁপাদু?

জিজ্ঞেস করল আগামীকালের প্রোগ্রাম কী?

তুমি কী বলেছিলে?

বলেছিলাম, প্রালে যাব সকাল সকাল। মাদাম ব্লঁশের কথাও বললাম। কারণ, তিনি আমার বহুদিনের পরিচিত। আমি আর ওঁর স্বামী জাক ব্লঁশ আফ্রিকার অনেক জায়গাতে শিকার করেছি একসময়ে একসঙ্গে। তখনও ও স্পোর্টসম্যান ছিল পেশাদার শিকারি হয়নি। এও বলেছিলাম যে, মহিলার কাছে যাব খবরাখবরের জন্যে। গুপ্তধন তো প্রালেতেও পোঁতা থাকতে পারে! আমার তো ধারণা, হয় প্রালে নয়, লা ডিগ আইল্যান্ডেই পোঁতা আছে। মাহেতেই থাকাটা আশ্চর্য নয়। সেভেন সিস্টার্স-এর কোনও আইল্যান্ডেও থাকতে পারে।

মঁসিয়ে পঁপাদু কী বলল তাতে?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কিছুই বলল না।

ঋজুদা বলল।

তুমি কটা নাগাদ ফোন করেছিলে?

ছটা নাগাদ হবে। দ্য ইগলস্ রুস্ট থেকে ওই হোটেলে পৌঁছবার পরেই।

প্রালেঁতে মাদাম ব্লঁশের হোটেলে পিয়ের কখন পৌঁছেছিল?

তোরাও তো ছিলি। শুনলি না! উনি তো বললেন যে, রাত দশটা নাগাদ।

মাহে থেকে, ফেরি বোট নয়, প্রাইভেট বোটে প্রালে যেতে কতক্ষণ লাগে?

ভটকাই জিজ্ঞেস করল।

নির্ভর করে, কীরকম বোট তার উপর। আমরা যে ইঞ্জিন লাগানো বোটে প্রালের চারপাশে ঘুরলাম, অমন বোটে করে রাতে কেউই যায় না। বড় ও শক্তিশালী স্পিডবোট করে এলে ঘণ্টা তিনেক লাগার কথা।

তাহলে তোমার সঙ্গে মঁসিয়ে পঁপাদু যখন কথা বলল, সেই সময়ে পিয়ের যদি বেরিয়ে পড়ে থাকে, তবে তার পক্ষে রাত দশটাতে পারে এই হোটেলে পৌঁছনো অসম্ভব নয়। তুমি কী বলো?

আমি বললাম।

নয়।

ঋজুদা বলল!

আমি বললাম, ভটকাই, তুই গোড়াতেই একটা গলদ করছিস। বেসিক ফ্যাক্ট সব গোলমাল হয়ে গেছে তোর।

দ্যাখ রুদ্র, গোয়েন্দাগিরিতে ‘বেসিক ফ্যাক্ট’ বলে কিছু নেই। স্ট্যাটিক ফ্যাক্ট’-ও নয়। এখানে সবকিছুই বদলে যেতে পারে। ইকনমিক্সে একটা কথা আছে। ‘আনস্টেবল ইকুলিব্রায়াম। শুনেছিস কি? এই ক্ষেত্রেও সবই ‘আনস্টেবল’।

ভটকাই বলল, ইকনমিক্স-এর প্রফেসার-এরই মতো।

ঋজুদা ভটকাইয়ের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিল। বলল, পিয়ের, মাদমোয়াজেল প্লজেঁর লোক, পাদুর লোক নয়। এটাকেই রুদ্র বলছে বেসিক ফ্যাক্ট। তুই বলতে চাস, ব্যাপারটা আনস্টেবল। এই তো?

হ্যাঁ।

ভটকাই বলল।

পুরো ব্যাপারটাকেই মিছিমিছি কমপ্লিকেটেড করছিস তুই ভটকাই।

ভটকাই বলল, তুমি কি মঁসিয়ে পঁপাদুকে প্রথমবারেই পেয়েছিলে? ফোনে?

না। যে নাম্বার পাদু দিয়েছিল সেই নাম্বারে করাতে একটি মেয়ে বলল, উনি বাইরে গেছেন, ফিরলেই মেসেজ দেবে।

তারপরে পাদুই তোমাকে রিংব্যাক করেছিল?

হ্যাঁ।

ঋজুদা বলল।

তুমিই ভৈঁসার হোটেলের নাম্বার দিয়েছিলে ওঁকে?

হ্যাঁ।

যখন মরিশাস থেকে পঁপাদুর কলটা এসেছিল তখন কি হোটেলের অপারেটর কি তোমাকে বলেছিল যে, কলটা ওভারসিজ কল?

ভটকাই বলল।

না। তা বলেনি।

তবে? তুমি জানলে কী করে যে মরিশাস থেকেই পপাদু তোমাকে ফোন করেছিল?

না, তা জানি না কিন্তু সেইরকমই কথা। তারপর বলল, তুই কী বলতে চাইছিস?

পঁপাদু মাহেতেই আছে। সে তোমাকে মিথ্যে বলেছিল।

ভটকাই বলল।

আমি বললাম, কী যা তা বলছিস ভটকাই। গোয়েন্দা তুই, না ঋজুদা? তুই দেখি সর্বজ্ঞ হয়ে গেছিস।

আমি ভটকাইকে চোখ দিয়ে ইশারা করে সংযত হতে বললাম।

ঋজুদা একটুও না রেগে বলল, আই থিঙ্ক ভটকাই হ্যাঁজ আ পয়েন্ট রুদ্র। হি ইজ শেপিং ইনটু আ ফাইন ডিটেকটিভ। এবার থেকে ভাবছি, বনে-জঙ্গলে তোকে নেব আর শহরে ওকে।

আমি একটু অভিমানের সঙ্গে বললাম, ভালই তো।

ভটকাই বলল, তাই কি হয় ঋজুদা? রুদ্র আমাকে হাত ধরে নিয়ে এল তোমার কাছে আর ওকে ছাড়া কি আমি এক পাও যেতে পারি? উঁহু, পাদমেকং ন গচ্ছামি। সবে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।

বাঃ। ফাইন।

বলল, ঋজুদা।

পরক্ষণেই ভটকাই আরেকটা বোমা ফাটাল। হঠাৎ বলল, মঁসিয়ে পঁপাদুকে আমি এখানেও দেখেছি।

ঋজুদা মুখ থেকে তাড়াতাড়ি পাইপ নামিয়ে বলল, কোথায় দেখেছিস?

এই হোটেলেই।

কীরকম?

আমার চোখ কপালে উঠে গেল।

মানে, স্পষ্ট দেখিনি। ও লবিতে আমার হাত দশেক আগে আগে হেঁটে যাচ্ছিল, তারপর বাঁ দিকের করিডরে ঘুরে গেল। আমি ছুটে গিয়েও আর দেখতে পেলাম না। ওখানে অনেকগুলো লিফট। আবার একটা থাই রেস্টুরেন্টে ঢোকারও দরজা আছে।

তারপরই ভটকাই ঋজুদাকে বলল, তোমাকে আমি দেখাচ্ছি কী করে সে হাঁটছিল।

বলেই, ভটকাই উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড়টা বাঁ দিকে একটু কাত করে শরীরটাও বাঁ দিকে হেলিয়ে দুটো পা অসমানভাবে ফেলতে ফেলতে ঋজুদার স্যুইটের ড্রইং রুমের কার্পেটের ওপরে হেঁটে দেখাল।

ঋজুদা বলল, সন্দেহ নেই যে, মঁসিয়ে পঁপাদুর হাঁটার ঋতি ঠিক এরকমই।

ঋতি? ঋতি কী?

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, সবিনয় নিবেদন পত্রোপন্যাসের নায়িকা। জানিস না?

সবিনয় নিবেদন আমি পড়িনি।

ভটকাই বলল, অন্যায় করেছ। কলকাতাতে ফিরেই পড়ে ফেলো।

ঋজুদা বলল, GAIT! তোরা এমনই সাহেব হয়েছিস রুদ্র যে, ইংরেজি শব্দ দিয়ে তোদের বাংলা শব্দের মানে বোঝাতে হয়। সত্যি!

তারপরই বলল, তুই ওর গেইট কোথায় লক্ষ করলি ভটকাই?

কেন? তোমার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে যখন এসেছিল।

মানে? ফ্ল্যাটের মধ্যে ও আর কতটুকু হেঁটেছিল?

ওই লিফট পর্যন্ত তো হেঁটেছিল। তাতেই দেখে নিয়েছি।

তারপরে বলল, ঋজুদা, রুদ্র আমাকে যতই আওয়াজ দিক না কেন, তোমার কাছে আসার আগে, আমি শার্লক হোমস আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় গুলে খেয়ে এসেছি।

হু। তাই তো দেখছি।

হেসে বলল, ঋজুদা!

তারপরে বলল, থ্যাঙ্ক ঊ্য ভটকাই। এখন ‘পাইরেট আর্মস’-এ ডিনার খেতে যাওয়ার আগে আমার কতগুলো কাজ করার আছে। সেগুলো যতক্ষণ করছি একটাও কথা বলবি না।

ঠিক আছে।

ঋজুদা ফোনটা তুলে একটা নাম্বার ডায়াল করল। করে, ফোনের অ্যামপ্লিফায়ারের সুইচটা দিয়ে দিল যাতে কথোপকথন আমরাও শুনতে পারি।

ওদিক থেকে রিসিভার ওঠাতেই ঋজুদা বলল, শুভ ইভনিং মাদাম ব্লঁশ। আমি বোস বলছি। আপনি আজকে তো অবশ্যই, এবং এরপরেও কয়েকদিন রাতে হোটেলে থাকবেন না। আমার অনুরোধ। অন্য কোথাও চলেও যেতে পারেন, যদি পারেন। আফ্রিকাতে, জাক-এর কাছে।

ওপাশ থেকে উনি বললেন, কেন?

আপনার বিপদ হতে পারে। আপনি রাতে একেবারেই একা থাকেন, সব লোকজনই তো চলে যায়, তাই না?

তা যায়। কিন্তু প্রালে বড় শান্তির জায়গা। এখানে কীসের ভয়?

পিয়ের ওই ম্যাপগুলো লোক পাঠিয়ে কি আপনার কাছ থেকে নিয়ে গেছে?

না তো। এখনও কেউ আসেনি।

মাদমোয়াজেল ব্লঁশ, দয়া করে শুনুন যা বলছি। পিয়ের আজ সকালে বোটে করে মাহেতে ফিরে যায়নি। সে প্রালেঁতেই ছিল। আপনাকে সে মিথ্যা কথা বলেছে। তাতেই আমার চিন্তা হচ্ছে। পিয়ের আজ আমাদের সঙ্গেই শেষ প্লেনে ফিরেছে। পরে যখন দেখা হবে তখন সব আপনাকে বুঝিয়ে বলব। অনেক কথাই বলার আছে। কিন্তু আমার একটা দায়িত্ব আছে, তাই অনুরোধ করছি আপনাকে। প্লিজ, অন্য কোনও বন্ধুর বাড়িতে, জেটির কাছে, বা অন্য কোনও হোটেলে গিয়েই থাকুন রাতটা, কটা রাত। আপনার হোটেলটা বড় নির্জন। যদি জাক-এর কাছে তানজানিয়াতে চলে যেতে পারেন তবে তো ভালই! এখান থেকে ডার-এস-সালাম হয়ে আরুশার ফ্লাইট তো রোজই আছে।

তা তো জানিই। নির্জনতা ভালবাসি বলেই তো প্রালের এই নির্জনে জায়গা কিনে হোটেলটা বানাই। আমি কোথাওই যাব না।

আমার কথাটা আরেকবার ভেবে দেখবেন মাদাম ব্লঁশ। প্লিজ।

ওও! উ মাস্ট হ্যাভ গন ক্রেজি মিস্টার হ্যান্ডসাম। হু অন আর্থ উইল হার্ম মি? আই হ্যাভন্ট হার্মড এনি বডি। নো, নেভার।

কথাটা এত জোরে জোরেই বললেন যে, আমাদের কানেও ধাক্কা লাগল।

শেষে বললেন, নেভারদিলেস, থ্যাঙ্ক ঊ্য ভেরি ভেরি মাচ ঋজু, ফর দ্য কনসার্ন উ্য হ্যাভ শোন ফর মি। নাউ, গুড নাইট মিস্টার হ্যান্ডসাম। মে গড ব্লেস উ্য।

ঋজুদার মুখটা কালো হয়ে গেল।

বলল, মে গড ব্লেস উ্য ট্যু।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে থাকলাম।

আমি বললাম, ব্যাপারটা কী?

ঋজুদা বলল, পরে বলব। বলেছি না এখন কথা না বলতে।

আমি অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে গেলাম।

তারপর ঋজুদা আর একটা নাম্বার ডায়াল করল।

হাই কার্লোস।

বলল, ঋজুদা।

কার্লোস বলল, ইয়েস মঁসিয়ে বোস। প্লিজ অর্ডার।

কাউকে এখানে পাঠিয়ে তুমি আর্মসগুলো ফেরত নিয়ে নাও।

সেকী! কেন? ইওর মিশান ইজ ডেঞ্জারাস। ওরকম পাগলামি কোরো না।

ঋজুদা বলল, না, না। আমার মনে হয় না এ সবের কোনও প্রয়োজন আছে।, না বলেছি তো। বিপদের কিছুই এতে আমি দেখছি না। মিছিমিছি। বিদেশ-বিভুঁইয়ে আনলাইসেন্সড পিস্তল-রিভলভার সঙ্গে রেখে কি মারা পড়ব নাকি। পুলিশে ধরলে কত বছরের জন্যে জেলে পুরে দেবে? আর না, না। বলছিই তো। কখন পাঠাবে তোমার লোক? না না, আমরা ডিনার খেতে যাব বাইরে…না, কোথায় যাব তা এখনও ঠিক করিনি…

তারপর বলল, তোমার লোককে চিনব কী করে?

কী করবে? তোমার ওই গাড়িটা নিয়েই আসবে, যে আসবে? ও। সে দেখতে কেমন? স্যেশোলোয়া? বেঁটে? মোটা? টাক আছে? ও কে। না, না আমার ঘরেই পাঠাবে। সব আমার কাছেই আছে।

বাইই। গুডনাইট।

ভটকাই বলল, ওর সেই গাড়ি মানে, সেই ভ্যানটা?

হ্যাঁ।

আমি বললাম, কী যে করছ ঋজুদা বুঝতে পারছি না। খালি হাতে ওই দোর্দণ্ড ক্ষমতাবানদের সঙ্গে আমরা লড়ব কী করে?

সব বোঝার দরকার নেই। নাইলনের কালো দাড়িগুলো এনেছিস তো? ফাঁসগুলো ঠিক মতো লাগানো আছে?

সব ঠিকঠাক।

ক্লোরোফর্মের শিশিগুলো?

আমি বললাম, তাও ঠিকঠাক।

ঠি। আ।

ভটকাই বলল। মানে, ঠিক আছে।

উত্তেজিত হলে, ও কোনও শব্দেরই শেষ অক্ষর উচ্চারণ করে না।

আমাদের হাতিয়ার হারানোর দুঃখটা সামলে নিয়ে ভটকাই বলল, খালি হাতে আবার কী? এসেছ ন্যাংটো, যাইবে ন্যাংটো মাঝখানে কেন গণ্ডগোল?

ঋজুদা বলল, তোদের ব্যাগগুলো আমার ঘরে পৌঁছে দিয়ে তোরা তোদের ঘরে গিয়ে বোস। কার্লোসের লোক চলে গেলে তোদের ডেকে নেব।

ঠি। আ।

বলে, ভটকাই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

ঋজুদা আমার দিকে চেয়ে হাসল। বলল, ডাকামাত্রই ফিরে আসবি। জরুরি কথা আছে।

একা আসব?

না রে। যা দেখছি, তাতে এখন তো আর তাকে বাদ দেওয়া যাবে না। সেই তো নেতা হয়ে গেছে। নারে রুদ্র, ভটকাই অনেকই উন্নতি করেছে। ওকে আমাদের দলে রিক্রুট করার কৃতিত্ব কিন্তু সবটাই তোর।

আমার কী কৃতিত্ব। তোমার ট্রেইনিং পেয়েই তো হয়েছে। তা ছাড়া সত্যিই ও খুব বুদ্ধিমান। ভাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ার সুযোগ পেলে ও আরও..

হাঃ। একটা পূর্ণ বাঁদর হত। খুব সম্ভবত… ঋজুদা বলল।

তারপর বলল, যার ভাল হওয়ার সে নিজের গুণেই ভাল হয়, পারিবারিক পটভূমির, পরিবেশের, প্রতিবেশের এবং ঐতিহ্যের গুণে। স্কুলের গুণেই যদি সকলেই ভাল হয়ে যেত তবে ঘুষখোর, ঘুষের দালাল, কাট-মানি মাস্টার, ওষুধে আর খাবারে ভেজাল-দেওয়া ব্যবসায়ীদের ছেলেরা আর সব রাজনীতিকদের ছেলেরাই সমাজের মাথা হত! তা তো হয় না। হয় কি?

না, তা অবশ্য সব সময়ে হয় না।

সব সময়ে কী রে? খুব কম সময়েই হয়। বড়লোক হওয়াই তো মানুষের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য নয় রে রুদ্র। ভটকাইয়ের মতো বাংলা-মিডিয়াম স্কুলে পড়া ভারতীয় ছেলেরা যদি মানুষ হয়ে উঠতে পারে, তা হলেই জীবন সার্থক হবে। এই হতভাগা দেশেরও প্রকৃত উন্নতি হবে।

একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঋজুদা বলল, মীর-সাহেবের সেই একটা শায়েরি আছে না? ইহাঁ আদম নেহি হ্যায়, সুরত এ আদম বহত হ্যায়।

মানে?

মানে, এখানে মানুষ নেই। মানুষের মতো দেখতে অনেক প্রাণী আছে।

ঋজুদার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আমি চলে এলাম।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বো ভাঁলো সমুদ্রতট আলোতে আলোময় হয়ে রয়েছে। সমুদ্রের হাওয়ায় গাছপালা উথাল-পাথাল করছে। কালো ছায়ার প্রবালের সাদা বালির ওপরে এক্কা-দোক্কা খেলছে। তটের ও পাশে ছুঁতে-নীল সমুদ্রকে এখন কালো দেখাচ্ছে। আলোর বৃত্তর বাইরে অন্ধকারকে সবসময়েই ঘোরা বলে মনেই হয়।

পনেরো মিনিট পরে ফোনটা বাজল। ঋজুদার ফোন। বলল, আমি যাচ্ছি। তোদের ঘরে।

আমি উঠে দরজা খুললাম। ঋজুদার ঘর আমাদের ঘর থেকে চার-পাঁচটা ঘর পরে। ঋজুদা ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পরে বলল, হঠাৎ মনে হল, আমার ঘর বাগডও হতে পারে। তাই তোদের ঘরেই এলাম।

‘বাগড’ মানে?

ভটকাই বলল।

মানে। কথাবার্তা টেপ করার জন্যে, ফোনের কথাও টেপ করার জন্যে যন্ত্রপাতি রাখা থাকতে পারে।

আমি বললাম।

এত বড় হোটেল অ্যালাও করবে?

টাকা রে ভটকাই, টাকা। আগেকার দিনে গুণে আর স্বভাবে জগৎ বশ হত, এখন হয় টাকাতে। শুধুই টাকাতে।

তারপর বলল, ইংরেজি শব্দ যত কম ব্যবহার করা যায় ততই ভাল। এখানে বাংলা বলনেওয়ালা কেউ আছে বলে তো মনে হয় না।

আ মরি বাংলা ভাষা!

ভটকাই বলল।

তুমি মাদাম ব্লঁশকে সাবধান করলে কেন?

আমরা দুজনে একই সঙ্গে বললাম।

ভদ্রমহিলাকে খুন করতে পারে।

কে?

পিয়ের।

কেন?

অকারণেই। সম্পূর্ণ মিছিমিছি।

তারপর ভটকাইকে বলল, কিছু বুঝলি ভটকাই?

না।

অ্যাস্টভ আইল্যান্ডে গুপ্তধন আদৌ পোঁতা নেই। মাদাম ব্লঁশ যা বলেছেন সবই আদ্যিকালের গপ্পো, লোকের এরকম ধারণা আগে ছিল। পিয়েরই আগের দিন মাদামকে এ সব গল্প আরেকদফা শুনিয়ে গেছে। মহিলা সরল, কিছুই বুঝতে পারেননি। আসলে, আমাদের সেখানে পাঠাতে পারলে ওদের কাজ হাসিল করতে সুবিধে হবে। আমার দৃঢ় ধারণা, মাহের দক্ষিণ দিকের প্রায় পরিত্যক্ত নির্জন তটে অথবা লা-ডিগ আইল্যান্ডে এমনকী প্রালেঁতেও গুপ্তধন থাকতে পারে। প্রালেঁতে সবসুদ্ধ আঠারোটি তটভূমি আছে, যার অনেকগুলিই পরিত্যক্ত। পিয়ের, আমাদের ভাঁওতা দেওয়ার জন্যেই গেছিল মহিলার হোটেলে। ও ভেবেছিল, ও খুব চালাক। সত্যিই যদি অ্যাস্টভ আইল্যান্ডেই গুপ্তধন পোঁতা থাকত, তা হলে সেই ম্যাপ সে অমনভাবে কাছা-খোলার মতো ফেলে যেত না। সম্পত্তিও তার বাবার নয়। অন্য মানুষদের। বাবার হলেও কেউ অমন করত না। আমি যে মঁসিয়ে ব্লঁশকে চিনি এবং ওদের ওখানে গতবারে এসে সাতদিন কাটিয়েও ছিলাম, তা ও জানে। মাদাম ব্লঁশ ম্যাপের কথা ও তার নির্দেশও আমাকে দিয়েছেন এ কথাও সে জেনে গেছে। তোরা তো শুনলিই মহিলা বললেন, ফোনে। এখন ও ভদ্রমহিলাকে খুন করলে, ও নিশ্চিত হতে পারে যে, আমি অবশ্যই ভাবব যে, ম্যাপটা সত্যি। এবং গুপ্তধনও অ্যাস্টভ আইল্যান্ডেই আছে।

তোমাকে সে কথা বিশ্বাস করবার চেষ্টাতে ভদ্রমহিলাকে খুন করবে পিয়ের? বলো কী?

আমি বললাম।

আমার মনে হচ্ছে করবে এবং এই নাটকের যবনিকা এখনই টানা যেতে পারে, যদি আমরা পিয়ের অথবা যারা নিয়োগ করেছে তাদের, হাতেনাতে ধরতে পারি। তাতে মাদাম ব্লঁশের প্রাণটাও বাঁচবে এবং আমাদের কাজও হাসিল হবে।

কী করে?

পিয়ের বা তার অনুচরকে পুলিশ জেরা করলেই ওদের পেছনে কারা আছে তা বেরিয়ে পড়বে। বেরিয়ে পড়বে গুপ্তধনেরও হদিস। হয়তো।

কিছুই বুঝলাম না। আমি বললাম। আমরা তো জানি যে পিয়েরের পিছনে আছে জাকলিন প্লুজেঁ। তাঁর হয়েই কাজ করছে পিয়ের।

ঋজুদা একটু চুপ করে থেকে বলল, না। ভটকাই ঠিকই সন্দেহ করেছিল। জলদস্যু ইঁদুলের পুতি মঁসিয়ে পঁপাদু, ডাবল-ক্রশ করেছে আরেক ডাকাত দেনির পুতি মঁসিয়ে ব্লঁদাকে এবং ভিলেন বানিয়েছে ম্যাপের তৃতীয় টুকরো যার কাছে ছিল, সেই ফ্রেদরিকের বংশধর মাদমোয়াজেল জাকলিন প্লুজেঁকে। পিয়ের, মাদমোয়াজেল প্লুজেঁর নয়, মঁসিয়ে পঁপাদুরই লোক। প্লুজেঁর সঙ্গে ভৈঁয়সার পুরনো ঝগড়াকে কাজে লাগিয়ে দুজনের কাছেই মিথ্যে বলে ও নিজেই মঁসিয়ে ব্লঁদা ও মাদমোয়াজেল ভৈঁয়সাকে মিছিমিছি জড়িয়েছে এতে। ওঁদের কাছ থেকে আমাদের নাম করে মোটা টাকাও নিশ্চয়ই নিয়েছে। ওদের দুজনকে খুনও করতে পারে ও। প্লুজেঁকেও করতে পারে খুন। যাদের নিজেদের অর্থোপার্জনের যোগ্যতা নেই, অথচ টাকার প্রয়োজন এবং লোভ আছে প্রচণ্ড, তারা টাকার জন্য সব কিছুই করতে পারে। তাদের অসাধ্য কিছু নেই। আসলে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে গতরাতে আমি অনেকই চিন্তা করেছি। আমার ধারণা, গুপ্তধনের আসল ম্যাপটির সবচেয়ে জরুরি টুকরোটি ইদুলের লকারেই ছিল, মানে যিনি মঁসিয়ে পঁপাদুর পূর্বপুরুষ। প্লুজেঁ এবং ব্লদাঁকে ঠকাবার জন্যেই সে আমাদের কাছে এই সব গল্প বানিয়ে বলেছে। যাই হোক, আজ রাতেই আমরা সত্যি-মিথ্যা সবই জেনে যাব। পাইরেট আর্মস’-এ ডিনার খাওয়ার জন্যে আমি ওঁকে নেমন্তন্ন করেছি।

কাকে? পিয়েরকে না মঁসিয়ে পঁপাদুকে?

না রে। মাদমোয়াজেল প্লুজেঁকে। মিসেস মেক্যাঞ্জিকেও নেমন্তন্নও করেছি। খুঁজে এই হোটেলে আদৌ ওঠেননি। তবে এখানে এসেছেন ঠিকই। উঠেছেন এখানকার আর এক দারুণ হোটেল প্ল্যান্টেশন ক্লাব’-এ।

সে হোটেলটা কোথায়?

বো ভাঁলো বিচ-এই।

মাদমোয়াজেল প্লজেঁর মতো অতি-ধনী মহিলা ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউতে ওই সাধারণ ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁ পাইরেট আর্মস-এ আসবেন?

ভটকাই সন্দেহ প্রকাশ করে বলল।

ঋজুদা বলল, বুদ্ধিমতী বলেই আসবেন। পাদু বা ব্লঁদা কেউই সন্দেহই করবে না যে মাদমোয়াজেল প্লুজেঁর মতন বহু লক্ষ কোটিপতি তরুণী ভাড়ার ট্যাক্সি করে ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউর ওপরে ওইরকম একটা জনগণের রেস্তোরাঁতে গিয়ে ডিনার খাবেন।

তা মিসেস মেক্যাঞ্জিকে ডাকলে কেন?

ভটকাই বলল।

আছে, কারণ আছে। প্লুজেঁর কেনিয়া এবং তানজানিয়াতে যে ট্যুর অ্যান্ড সাফারি কোম্পানি আছে, তারই ম্যানেজার ছিলেন মিসেস মেক্যাঞ্জির স্বামী ডনাল্ড। তিনি মারা গেছেন দুবছর আগে। আর মাদাম ব্লঁশের স্বামী জাক এখন ম্যানেজার ওই কোম্পানিরই। মাদমোয়াজেল প্লুজেঁ তো আমাকে চেনেন না। মাদাম ব্লঁশ এবং মিসেস মেক্যাঞ্জি তাঁদের স্বামীদের সূত্রেই আমাকে ভাল করে চেনেন। আমি তো একাধিকবার ওঁদের দুজনের কাছে থেকেও গেছি এখানে। এবং প্রালেঁতেও। প্রয়োজনে, মাদমোয়াজেল প্লুজেঁ মিসেস ব্লঁশের সঙ্গেও কথা বলে নেবেন আমাকে বিশ্বাস করার আগে। তা ছাড়া, আমরা তো ওঁর বন্ধুই। শত্রু তো নই। তবুও ওঁর যাতে কোনও সন্দেহই না হয়, তাই ওঁকে ডেকেছি।

আমি আর ভটকাই চুপ করে রইলাম।

প্ল্যানটা বুঝতে কি খুবই অসুবিধে হচ্ছে তোদের?

না, তা নয়। তবে এই প্ল্যান কি তুমি কলকাতাতে বসেই করেছিলে?

আমি বললাম।

নিশ্চয়ই। নইলে এত দূরের বিদেশি শহরে কেউ একটা কাজের দায়িত্ব নিয়ে আসতে রাজি হয়? এ তো আর আদিগন্ত বিশ্বটাঁড় জঙ্গুলে আফ্রিকা নয়। জঙ্গল আমার নিজের জায়গা। সে, যে জঙ্গলই হোক। মেক্যাঞ্জি এবং ব্লঁশ দুজনেই যে জ্যাকলিন প্লুজেঁর বাবার আমল থেকেই ওঁদের সঙ্গে যুক্ত তা তো আমি আগেই জানতাম। এবং খুব সম্ভবত মঁসিয়ে পঁপাদু সে খবর রাখত না। তাই সাহস পেয়েছিলাম এই গুরুদায়িত্ব নিতে। তবে মঁসিয়ে পঁপাদু যে ওদের ডাবল-ক্রস করবে, সেটা ভাবতে পারিনি। আর পিয়েরটা যে একটা দাগি খুনি, তাও নয়। এখন দেখা যাক।

মনে হয় মাদমোয়াজেল প্লুজেঁ বন্ধু হিসেবে অত্যন্তই ক্ষমতাবান হবেন।

ভটকাই বলল।

ওঁর মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশের সাহায্যও পাওয়া যাবে। কিন্তু আমি আসলে জাকলিন প্লুজেঁর শত্রু হিসেবে আসিনি। ওঁকেও আমি একবার তানজানিয়াতে দেখেছিলাম। নিজস্ব ছোট্ট প্লেন থেকে নেমে সেরেঙ্গেটিতে ‘সেরোনারা লজে’র দিকে যাচ্ছিলেন। একটি সাদা ভোক্সওয়াগন কম্বি গাড়ি করে। জাক তখন ওঁকে দেখিয়ে আমাকে বলেছিল, দ্যাখ ঋজু! উনিই আমার মালকিন। ওই পঁচিশ বছর বয়সী মেয়েটিই পৃথিবীব্যাপী এতবড় সাম্রাজ্যের মালিক। অথচ খুবই বিনয়ী, ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী। তখনই ওঁর প্রতি এক বিশেষ দুর্বলতা জন্মে গেছিল আমার। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্যই ছিল যে, ব্যাপারটা আমি মিটমাট করে দিতে পারব। মানে, আর্বিট্রেটররা যেমন করেন। যাতে, খুনোখুনি পর্যন্ত না গড়ায়। প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতা এনে দেব। কিন্তু এসে দেখছি ইঁদুলের পুতি এই মঁসিয়ে পঁপাদুই হচ্ছে যত নষ্টের গোড়া। এবং এখন তো আমার মনে হচ্ছে যে আমাকে যা কিছু সে বলেছে, এ পর্যন্ত তার সবই। বানানো। মঁসিয়ে ব্লঁদারও চেহারা পর্যন্ত দেখলাম না এখনও। সেও কিছু জানে কি না আদৌ কে জানে!

এখন কী করতে বলো আমাদের তুমি?

ভটকাই বলল।

দেখি ডিনার খেতে গিয়ে জাকলিন প্লুজেঁকে বলে যদি একটা দ্রুতগামী বোট জোগাড় করতে পারি, তবে আমরা রাতারাতিই প্রালেঁতে পৌঁছে গিয়ে মাদাম ব্লঁশের হোটেলের তিন পাশে পাহারা দিতে পারি।

পিস্তল, রিভলভারগুলো তো সব ফেরত দিয়ে দিলে কার্লোসকে। তা পাহারাটা দেবে কী দিয়ে? শুধু হাতে?

ভটকাই বিরক্ত গলায় বলল।

তোর বুদ্ধি তো একটু আগে বেশ ছিল, এখন কমে গেল কেন?

ঋজুদা বলল।

মানে?

আমরা নিরস্ত্রীকরণ কেন করলাম নিজেদের? যাতে, পিয়ের এবং পাদুও নিজেদের সশস্ত্র রাখার প্রয়োজন না বোধ করে। তা ছাড়া, আমরা যে কোনওরকম এনকাউন্টারেরই আশঙ্কা করছি না, সে কথাও ওদের কাছে স্পষ্ট হবে আমাদের ব্যবহারে। তাই, যদি ওদের সঙ্গে কোনওরকম লড়াইয়ে যেতেই হয়, তা হবে খুবই সামান্য। বুদ্ধিই আমাদের অস্ত্র। বুঝেছ?

বুঝেছি।

তেমন মনে করলে, জাকলিনকে বলব অস্ত্র জোগাড় করে দিতে। পপাদু যদি ওই সব দিতে পারে, তবে জাকলিন ইচ্ছে করলে জাহাজসুদ্ধ অস্ত্রশস্ত্র দিতে পারে। তার অতখানি ক্ষমতা।

তা ঠিক।

আমরা দুজনেই বললাম। তবু আমার মনে হতে লাগল ঋজুদা বড় বেশি কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠেছে। এতগুলো যদি’র উপরে ভরসা করা কি ঠিক? কতগুলো যদি যে নদীতে যাবে তা আগে থাকতে কে বলতে পারে!

ঋজুদা নাকি সকলকেই বলে দিয়েছিল ট্যাক্সি নিয়ে আসতে এবং দামি গয়নাগাটি না পরতে। জাকলিন প্লুজেঁকে এমনিতেই অনেকেই চেনেন। তাই তাঁকে বিশেষ করে বলেছিল সাদামাঠা হয়ে যেতে। তবে তাঁকে চেনেন বড় বড় হোটেলে যাতায়াতকারীরা, ‘পাইরেট আর্মস’-এর মতো সাধারণ জায়গাতে কারওই তাঁকে। চেনার কথা নয়।

মিসেস মেক্যাঞ্জি আগেই পৌঁছে গেছিলেন। টেবিলও ওঁর নামেই বুক করা ছিল। বয়স্কা এবং মোটা হলেও মুখের মধ্যে এক ভারী আলগা সৌন্দর্য ছিল। ঠাকুমা-ঠাকুমা ভাব। আমরা তিনজনে যেতেই দাঁড়িয়ে উঠে উনি আমাদের অভ্যর্থনা করলেন।

ওপেন-এয়ার এবং খোলামেলা রেস্তোরাঁর এই সুবিধে যে, এখানে কারও কথা গোপন থাকে না বলেই কেউ কারও কথাকে গোপন ভাবেই না। যে সব ইটিংহাউসের নাম খুব বেশি, দামি, হোটেলের মধ্যে বা অন্যত্রও, সেখানে রীতিনীতি মানা, খুব আস্তে কথা বলা, এসব জরুরি। পথের ওপরের খোলা রেস্তোরাঁর আবহাওয়াই আলাদা। তা দেখে এবং জেনে, ভটকাই-এর খুবই ফুর্তি হল।

এমন সময় দেখা গেল, একটি ফেডেড-জিনস আর হালকা নীল রঙা একটা হাতকাটা সিল্কের গেঞ্জি পরে, সুন্দরী ছিপছিপে একটি মেয়ে ট্যাক্সি থেকে নামল। তার পায়ে ছিল নীল-রঙা গল্ক শু। তাঁকে দেখেই মিসেস মেক্যাঞ্জি দাঁড়িয়ে উঠে অভ্যর্থনা করলেন। মেয়েটির চুল ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা। হাতে একটা হালকা নীলরঙা চামড়ার ব্যাগ।

মিসেস মেক্যাঞ্জি, তাঁর ফার্স্ট নাম হচ্ছে জাঁ, ঋজুদার সঙ্গে জাকলিনের আলাপ করিয়ে দিয়ে বললেন, মিট মিস্টার ঋজু বোস, ফ্রম কালকুত্তা, ইন্ডিয়া। মাই হাব্বি কলস হিম ‘মিস্টার হ্যান্ডসাম।

সার্টেনলি হি ইজ হ্যান্ডসাম।

‘ইজ’ শব্দটির ওপরে বেশি জোর দিলেন জাকলিন।

ঋজুদা দাঁড়িয়ে উঠে ওঁর হাত ধরে হ্যান্ডশেক করল।

ঋজুদা বলল, হোয়াটস ইওর ড্রিঙ্ক?

আই ডোন্ট ড্রিঙ্ক, থ্যাঙ্ক ঊ্য।

মিসেস মেক্যাঞ্জি বললেন, মিস্টার হ্যান্ডসাম ইজ নট সাজেস্টিং দ্যাট উ্য হ্যাভ আ হার্ড ড্রিঙ্ক। হি ডাজ নট ড্রিঙ্ক আইদার। বাট আই অ্যাম কোয়াইট শ্যওর দ্যাট উই উড লাইক টু স্লিট আ বটল অফ গুড ফ্রেঞ্চ হোয়াইটওয়াইন উইথ মি। মিঃ হ্যান্ডসাম ইজ দ্য হোস্ট।

জাকলিন বললেন, না, না সে কী! আমি তো হোস্টেস।

ঋজুদা হেসে বলল, ওয়েল ম্যাম, আই মে বী আ পুওর ইন্ডিয়ান বাট আই অ্যাম নট দ্যাট পুওর নট টু আফর্ড আ মিল ফর উ্য টু।

জাকলিন দুটি হাতে একটি শব্দহীন তালি বাজিয়ে বলল, ওয়েল, আই ন্যু সিন্স মাই চাইল্ডহুড দ্যাট হ্যান্ডসাম ইজ হোয়াট হ্যান্ডসাম ডাজ। বাট, ইটস ওনলি অন দিস ইভিনিং দ্যাট আই রিয়্যালাইজ হাউ ইজ দ্যাট প্রভাব।

তারপর হেসে বললেন, ওক্কে ফাইন। আই উইল শেয়ার আ বটল অফ হোয়াইট ওয়াইন উইথ মিসেস মেক্যাঞ্জি। বাট হাউ বাউট, মিস্টার বোস?

আই অ্যাম আ টিটোটালার লাইক উ্য।

সার্টেনলি নট টু নাইট। ড্য মাস্ট কিপ আস কোম্পানি।

ঋজুদা আবার হাসল।

ভটকাই গলা নামিয়ে আমার কানে কানে বলল, ঋজুদার এই হাসি দেইখ্যা আমরাই মনে মনে প্রেমে পড়তাছি তো এই সুন্দরী কন্যা! কী করে তুই রোদদুর?

আমি আর কী বলি, গলা আরও নামিয়ে বললাম, ঠিকই কইছস তুই।

ঋজুদা হাসি থামিয়ে বলল, ওক্কে। প্রেটি ইজ হোয়াট প্রেটি ডাজ।

আমি ভেবে দেখলাম, আমার আর ভটকাইয়ের এবারে কেটে পড়াই ভাল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ভটকাই হঠাৎই ঘোষণা করল, ঋজুদা আমরা হোটেলে যাচ্ছি।

সে কী? কেন?

হোটেলের খাওয়া এরচেয়ে অনেক ভাল হবে। তা ছাড়া এখানে তোমরা যা ইংরেজির তুবড়ি ফুটোচ্ছে, আমরা মন খুলে পেট পুরে খেতে পারব না।

তারপরই বলল, কিন্তু আমরা সাইন করলে হোটেলে খেতে দেবে তো?

নিশ্চয়ই।

জাকলিন বলল, হু আর দিজ ইয়াংস্টারস?

দে আর নট স্টারস জাকলিন। দে আর প্ল্যানেটস। আই অ্যাম আ টুইঙ্কলিং স্টার। গ্রেট গাইজ। দে হ্যাভ বিন উইথ মি ইন আলমোস্ট অল পার্টস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড, টু শুট ম্যান ইটিং টাইগারস, টু সলভ মিসট্রিজ অফ থেফট অ্যান্ড ডেথ অ্যান্ড অলসো টু হেল্প ঊ্য গেট দ্য ট্রেজারস।

জাকলিন দুটি মৃণাল-ভুজ ওপরে ছুঁড়ে বলল, ওঃ দ্যাটস প্লেনডিড।

আমি বললাম, থ্যাঙ্ক ট্য। কিন্তু এবার আমরা হোটেলেই ফিরে যেতে চাই। আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে।

আমরা চেয়ার ছেড়ে উঠতেই ওঁরা সকলেই চেয়ার ছেড়ে উঠলেন।

ভটকাই বলল, দ্যাখ, ভদ্রতা কাকে বলে দ্যাখ।

তুই দ্যাখ। কিন্তু মেয়েদের ওঠার নিয়ম নয়।

তাই?

হ্যাঁ। তোকে স্পেশ্যাল খাতির দেখাল।

ঋজুদা বলল, ‘জিঞ্জার এল’ একরকমের লেমনেড, আদার রস দিয়ে তৈরি। লালচে দেখতে। হোটেলে গিয়ে খাওয়ার আগে অবশ্যই অর্ডার করিস। আমি এখানে অর্ডার ক্যানসেল করে দিচ্ছি।

ঠিক আছে।

আমি বললাম।

ভটকাই বলল, ঋজুদা শোনো। বলেই বলল, আরে এঁদের বসতে বলো না। এ কী!

ঋজুদা হেসে, ওঁদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, দে ফিল এমবারাসড। প্লিজ বি সিটেড।

ঋজুদা টেবিল ছেড়ে এগিয়ে এসে বলল, কী হল?

ভটকাই বলল, আমার কথাটা মনে আছে তো?

কোন কথা? ঋজুদা চিন্তিতমুখে বলল।

আঃ। সেই কথাটা

ভটকাই বলল।

এবার ঋজুদা বিরক্ত গলাতে বলল, কোন কথাটা বলবি তো?

সেই বিয়ের কথাটা। করবে তো বিয়ে?

কাকে?

আকাশ থেকে পড়ে, বলল, ঋজুদা।

তুমি বড্ডই ভুলে যাও। মিস্টার হ্যান্ডসামের সঙ্গে মিস প্রেটির বিয়ে না হলে কার সঙ্গে হবে?

ঋজুদার দু’কান লজ্জাতে লাল হয়ে গেল। জাকলিন হয়তো শুনে থাকবে কথাটা।

ঋজুদা বলল, আমি যাওয়া অবধি জেগে থাকবি। কথা থাকবে। কাজও থাকতে পারে।

ঠি। ছে।

ভটকাই বলল।

.

হোটেলের রিসেপশনে ঢুকতেই দেখি আঁসিয়ে পাদু সামনের সোফাতে বসে আছেন।

আমরা দুজনেই ওঁকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, মরিশাস থেকে কবে এলেন। উনি মিথ্যা কথা বললেন। বললেন, একটু আগে। আমাদের সঙ্গে ঋজুদাকে না-দেখে বিরক্ত মুখে আমাদের কাছে ডাকলেন হাতের ইশারা করে।

বিরক্ত মুখে বললেন, মঁসিয়ে বোস কোথায়?

ভটকাই সঙ্গে সঙ্গে বলল, মিসেস মেক্যাঞ্জির কাছে।

সেখান থেকেই তো আমি আসছি। উনি তো একা বেরিয়ে গেছেন প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে।

কে বলল?

কে আবার! তাঁর মেইড।

তাই?

অবাক হওয়ার ভান করলাম আমি।

তোমরা কোথা থেকে আসছ?

আমরা গেছিলাম পাইরেট আর্মস-এ ডিনার খেতে।

কেন এত ভাল হোটেলে না খেয়ে সেখানে কেন?

আপনার পয়সা বাঁচাতে। মঁসিয়ে বোস বললেন, আপনি মানুষ ভাল বলেই আপনার দিকটাও আমাদের দেখা উচিত।

পিয়েরের সঙ্গে তোমাদের দেখা হয়েছে?

না তো। তিনি দেখতে কেমন? কিন্তু দেখা না হলেও তাঁকে খুঁজতে চারজন লোক গাড়ি করে সেখানে গেছিল।

সেখানে মানে?

মানে, পাইরেট আর্মস’-এ লোকগুলোর সঙ্গে পিস্তল ছিল প্রত্যেকেরই। তারাই তো মঁসিয়ে বোসকে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল। হোটেলের মালিক পুলিশেও ফোন করেছেন। আপনি যান না, খুঁজে দেখুন মঁসিয়ে বোসকে। এদিকে আমাদের সব পিস্তল, রিভলভারগুলো মঁসিয়ে বোস কার্লোসকে ফেরত দিয়ে দিতে বলেছেন। ওগুলো সঙ্গে থাকলে কি আমাদের সামনে থেকে মঁসিয়ে বোসকে তুলে নিয়ে যেতে পারে?

তোমাদের মোবাইল ফোন কোথায়?

আমাদের এবং মঁসিয়ে বোসের মোবাইল ফোনও তারা কেড়ে নিয়েছে। আপনি এখন ফোন করলে ওই লোকগুলোই ধরবে। করে দেখুন না একবার।

ভটকাই চিন্তিত মুখে বলল, কী যে করি আমরা!

পঁপাদু বলল, জেন্টস রুমে চলো। বলেই, লবির জেন্টস টয়েলেটের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমরাও গেলাম পেছন পেছন। ভিতরে কেউ ছিল না। উনি কোমর থেকে একটা গুলিভরা মাউজার পিস্তল দিলেন আমাকে। আর একটা গুলিভরা ম্যাগাজিন। তারপর ভটকাইকে বললেন, আমার ঘরে চলো, তোমাকে একটা দেব।

তারপর একটু চুপ করে কী ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু সে লোকগুলো কার লোক বলে ধারণা তোমাদের?

ভটকাই ফট করে বলল, পিয়েরের।

পঁপাদু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, পিয়েরের? মাই গুডনেস। রাসকেলটা। প্লুজেঁর দলে ভিড়ে গেছে।

তারপরই বললেন, তোমাদের মনে হওয়ার কারণ?

কী মনে হওয়ার?

ওই যে! ওরা পিয়েরের লোক?

আমি বললাম, পিয়ের কেমন দেখতে বলুন তো? ওদের মধ্যেই তো একজন ছিল যার নাম পিয়ের! সেই তো অন্যদের অর্ডার দিচ্ছিল। সেই লোকটা খুব লম্বা, রোগা, বাঁ হাতের কব্জির কাছে টাটু করা আছে সাপ-ব্যাঙের।

তাই নাকি? তা তারা কোনদিকে গেল?

গেল তো উল্টোদিকে। কিন্তু বলছিল তো যে ঋজু বোসকে খতম করে বো ভাঁলো বে হোটেলেই আসবে। আপনি যে এখানে আছেন তা কি ওরা জানে?

মঁসিয়ে পঁপাদুর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। বললেন, চলো, তোমরা আমার ঘরে। তোমাদের ঘরের চাবিটাও নিয়ে নাও।

ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের মনেই বললেন, এই জন্যেই খারাপ চরিত্রের মানুষদের কখনও বিশ্বাস করতে নেই। এরা টাকার জন্যে কখন যে কাকে ডাবল-ক্রস করবে তার কোনও ঠিক নেই।

ভটকাই বিশুদ্ধ বাংলায় বলল, ওরে ধোয়া তুলসী পাতা, তুই নিজে কী?

মঁসিয়ে পঁপাদু চমকে উঠে বললেন, হোয়াট?

ও বলল, ঠিকই বলেছেন আপনি।

আই সি।

মঁসিয়ে পঁপাদুকে খুবই নার্ভাস দেখাচ্ছিল। ওঁর ঘরে ঢুকেই উনি ড্রয়ার খুলে দুটো বড়ি খেলেন। বললেন, আমি হাইপারটেনশনের রোগী। তারপর সেই ড্রয়ার থেকেই একটি রুপোর-বাটের ছোট পিস্তল বের করে দিলেন গুলিভরা। সম্ভবত পয়েন্ট টু টু বোরের। গুলিভরা একটা ম্যাগাজিনও দিলেন। ভটকাই সসম্মানে বাও করে সেটা নিল।

তারপরই উনি খাটের ওপরে জুতোসুদ্ধ শুয়ে পড়ে টাইটা একটানে খুলে ফেলে দিলেন খাটের একপাশে। পরক্ষণেই উঠে, জল খেলেন জাগ থেকে সোজা। ঢকঢকিয়ে। তারপরই ফ্রিজ খুলে একটা লাল রঙের পানীয়ভর্তি বোতল বের করলেন। করে, বললেন, চলো এবার তোমাদের ঘরে।

আমরা আমাদের ঘরে গিয়ে দরজা খুললাম। উনি ঘরে ঢুকেই জানালার পাশে রাখা রকিং-চেয়ারটাতে বসে বোতলটা খুলে ঢকঢক করে কিছুটা খেলেন, তারপর জানলার পর্দা সরিয়ে রাস্তার দিকে দেখতে লাগলেন। ওঁর মুখ আতঙ্কে ফ্যাকাসে হয়ে গেল।

আমি ভটকাইয়ের বুদ্ধির তারিফ করার ভাষা খুঁজে পেলাম না কোনও।

ভটকাই বলল, আপনার কাছে একটা অটোমেটিক রাইফেল ছিল না? ইসরায়েলি উজি অথবা চাইনিজ এ কে ফর্টিসেভেন?

না, না। শুধু দুটোই ছিল। তোমাদের দিলাম। তোমরাই আমার বডিগার্ড। পিস্তল চালাতে জান তো?

আমি বললাম, চালিয়ে দেখাব?

আপনার হাতের বোতলটার গলাটা উড়িয়ে দেব?

বলেই, ভটকাই তার পিস্তলটা সেদিকে তাক করল।

উনি হাঁ হাঁ করে উঠলেন। আরে! কর কী? কর কী?

আমি বললাম, আপনাকে প্লুজেঁর লোক বা পিয়ের মারতে যাবে কেন? ঋজুদাকেও কি ওরা মেরে ফেলবে?

না না, মঁসিয়ে বোসকে মারতে যাবে কেন? তবে তাকে কোথাও আটকে রাখবে বোধহয়, যতক্ষণ না তাদের কার্যসিদ্ধি হয়।

কার্যটা কী?

আমি বললাম।

কার্যটা…

না। তোমাদের না বলেও উপায় নেই।

কী?

ভটকাই বলল।

উনি ওঁর কোটের বুকপেকেট থেকে পলিথিনে মোড়া একটি ছোট জিনিস বের করলেন। বললেন, আমি যদি মরেও যাই, তবু প্লুজেঁকে আমি দেব না এটা।

মাদমোয়াজেল মারিয়েল ভৈঁয়সাকেও দেবেন না?

না না, সে কে? নেপো। মেয়েরা ওরকম চুলোচুলি করেই। করে মরুকগে। তারা। বলেই আবারও খেলেন বোতল থেকে ঢকঢক করে।

আমি বললাম, জিনিসটা কী?

একটা ম্যাপের মাইক্রোফিল্ম।

কোন দ্বীপের?

আরিন্ডের। এখন সেখানে বার্ড স্যাংচুয়ারি। পাখি সে দ্বীপে চিরদিনই ছিল। অনেক ভেবেচিন্তেই ইদুল, ফ্রেদরিক আর দেনি ওই দ্বীপে গুপ্তধন পুঁতে রেখেছিল।

আপনার কাছে ম্যাপ আছে, তো এতদিন বসে রইলেন কেন? আমাদেরই বা মিথ্যে বললেন কেন? বলে, এই হয়রানি করালেন মিছিমিছি। এখন মিঃ বোস মানে মানে প্রাণ নিয়ে ফিরলে হয়।

ওই বার্ড স্যাংচুয়ারিতে লক্ষ কোটি ডলারের ট্রেজার থাকলেও প্রেসিডেন্ট রেনে ওখানে খোঁড়াখুঁড়ি করতে দেবেন না। ওই স্যাংচুয়ারির পাখি দেখতে এসে প্রতি বছর সারা পৃথিবীর ট্যুরিস্ট আর অরনিথলজিস্টরা কোটি কোটি ডলার দিয়ে যায় সরকারকে।

রেনে কে?

আরে! এই স্যেশেলস সোস্যালিস্ট-রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

অরনিথলজিস্টটা কী জিনিস রে?

ভটকাই আমাকে জিজ্ঞেস করল।

পক্ষীবিশারদ।

ও।

মঁসিয়ে ঋজু বোসের সঙ্গে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড ফান্ডের জানাশোনা আছে, তিনি একজন পৃথিবীবিখ্যাত ন্যাচারালিস্ট, তাই ভেবেছিলাম, ওঁকে এরমধ্যে টেনে এনে কোনওক্রমে যদি পারমিশনটা বের করা যায়।

ওঁর কী ইন্টারেস্ট?

ওঁকে অর্ধেক দিয়ে দিতাম।

ভটকাই আবার বাংলাতে বলল, অর্ধেক রাজত্ব দিতে বৎস, রাজকন্যা কি দিতে পারতে? সে তো এদিকে স্বয়ম্বর হয়ে বসে আছে। লেহ লকা।

মঁসিয়ে পঁপাদু চেয়ারে উঠে বসে রেগে বললেন ভটকাইয়ের দিকে চেয়ে, ছোকরা বলছে কী?

যা বলছে, সে আর বলবেন না। মঁসিয়ে ঋজু বোস এত বড়লোক হয়ে গেলে ও হার্টফেল করে মরে যাবে আনন্দে।

আমি বললাম।

তোমরা কি ভাবছ ঋজু বোস ট্রিলিয়নীয়র হলে তোমাদের কিছু দেবে? সে আশা দুরাশা। টাকার আঠা বড় আঠা। একবার পকেটে ঢুকলে আর বেরোতে চায় না। আরে আমার যত অসুখ সব তো সেই জন্যেই। সে কথা ভেবে ভেবেই।

ভটকাই বলল, হক কথা কইছেন কর্তা! বিষয়ই হইতেছে বিষ। এক্কেরে বিষ। আর বিষয়ের আশা হইতেছে বিষফোঁড়া। আঙুল বুলাইলে, সুড়সুড়ি লাগে।

মাইক্রোফিল্মটাকে দেখিয়ে আমি বললাম, এইটার জন্যেই আপনার প্রাণ বিপন্ন বলছেন আপনি?

তা ছাড়া কী? এইটা তোমাদের জিম্মায় রাখো। এইটা বাঁচাতে যদি দশজনকে গুলি করতে হয় কোরো। তারপর তোমার বাবা তো…

ভটকাই বলল, আমাদের একমাত্র বাবা ঋজু বোস। মরে গেলে আমরা অনাথ হয়ে যাব। আমরা দেড় বছরের ছোট-বড়।

তারপরে বলল, আপনার কাছেও একটা অন্তত অস্ত্র থাকা দরকার। আপনার ঘরে কি আর কিছুই নেই?

ভটকাইটা মহা ধূর্ত। এমনি ভাবে জেনে নিচ্ছে পঁপাদুর শক্তি আছে কি নেই, আমাদের প্রতিরোধ করবার।

নেই রে বাবা। পিস্তল-ফিস্তল ছোঁড়া আমার আসে না। ও দিয়ে…

বলেই আবারও খেলেন ঢকঢুকিয়ে। বোতল প্রায় শেষ।

আমি বললাম, ওটা কী খাচ্ছেন? আরেকটা আনাই? ওটা তো শেষ হয়ে গেল। আনাও। তবে, এ ঘর থেকে নয়। হোটেলের লোক জেনে যাবে আমি এখানে আছি। ওরাও হয়তো জেনে যাবে।

ওরা মানে?

মানে, পিয়ের এবং…

না, ও ঘর থেকেই অর্ডার করছি। চাবিটা দিন। আর ওই মাইক্রোফিল্মটা আপনার কাছে না-রাখাই ভাল। ওটাই তো খুঁজবে ওরা। আর যতক্ষণ না পাবে, আপনাকে মারবে না। কারণ, আপনি মরেই যদি যাবেন তা হলে গুপ্তধনের হদিস কে দেবে? তাই ওটা আমার কাছেই থাক। ওরা স্বপ্নেও ভাববে না যে, ওই অমূল্যরতন আপনি আমার মতো একজন ছোঁড়ার কাছে সাহস করে এবং বিশ্বাস করে রেখেছেন।

সেটা ঠিক। ছোঁড়ারা। তোমরা খুবই বুদ্ধিমান। ছেলের মতো ছেলে হয়েছে ঋজু বোস-এর।

Like father like sons

বোতল থেকে নামটা দেখে, লিখে নিল ভটকাই। তারপর মঁসিয়ে পঁপাদুর ঘরের দিকে চলে গেল।

একটু পরে, ফোনটা বাজল।

মঁসিয়ে পঁপাদু ধরতে যেতেই আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম। বললাম, ওরা জেনে যাবে আপনি এখানে আছেন।

উনি বললেন, ঠিক বলেছ। ঠিক।

তারপরই বললেন, ওঃ পিয়ের! পিয়ের। তার এতক্ষণে প্রালেঁতে পৌঁছে যাওয়ার কথা, আর সে কি না প্লুজেঁর সঙ্গে হাত মিলিয়ে…

প্রালেঁতে কী?

সে একটা কাজ আছে। রাতেই সেরে ফিরে আসার কথা। অবশ্য যা ঘটে গেল, তারপর সেই কাজটা নিরর্থকই হত। নাঃ, সবই গোলমাল হয়ে গেল।

সে গেছে কীসে করে?

প্রাইভেট বোটে। পৌঁছতে পৌঁছতে রাত একটা হবে। তারপরই বলল, আরে সে গেল আর কোথায়? সে তো উঁসিয়ে বোসকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। এখন ভয় হচ্ছে মঁসিয়ে বোসকেও না মেরে দেয়। যা ট্রিগার-হ্যাপি ও।

ও পাপ্পা। মাই পাপ্পা। বলে, আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।

অভিনয় আর এ সব ফিচলেমি আমার আসে না। এ সব পারে ভটকাই। রিয়্যাল গ্রেট গাই। তবুও নিজের প্রতিভাতে নিজেই চমকে গেলাম।

ভটকাই একটু পরেই ফিরে এল বোতলটা নিয়ে। বলল, আপনার নামই সই করে দিয়েছি।

বেশ করেছ। মে গড ব্লেস উ।

বোতলটা পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে আবার ঢকঢক।

ভটকাই আমাকে বলল, বাবা আর মাকে খবর দিয়েছি।

কী করে?

কেন মো-ফো-তে।

বুঝলাম, মোবাইল ফোনের কথা বলছে।

বললাম, বাঃ।

কী বলছ তোমরা?

নাঃ, ভাইয়ের খিদে পেয়েছে তাই বলছে।

তা খাওনা তোমরা। অক্টোপাস আর কাঁকড়া খাও। এ হোটেলের খুব নাম আছে ওই দুই ডিশে।

আর আপনি?

আমি বিষ খাব।

আমি বললাম, অত কড়া জিনিস খাচ্ছেন একটু জল মিশিয়ে খেলে হত না।

নো। নেভার। জল আমি কখনও মেশাইনি। না দুধে, না হুইস্কিতে, না জীবনে। আমি নিট বেঁচেছি জীবনে। মরবও নিট। কেন যে মরতে বেশি লোভ করতে গেলাম।

ভটকাই বলল, ওরে নরাধম! ওরই জন্যে তো আমাগো শাস্ত্রে কইছে, লুভে পাপ, আর পাপে মৃত্যু। হঃ।

.

আমরা এয়ারপোর্টের ভিতরে অপেক্ষা করছি। প্লেনটা মরিশাস থেকে আসবে। এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন। ফেরার পথে আবারও মরিশাস হয়ে যাবে। যখন আসি, তখন মুম্বই থেকে সোজাই মাহেতে এসেছিল।

কোনও কারণে প্লেনটা আজ দেরি করছে। তাতে আমাদের কোনও ক্ষতি হয়নি। ভালই হয়েছে। এয়ারপোর্ট ফুল আর মালাতে ছেয়ে গেছে। অপেক্ষারত অন্য প্যাসেঞ্জারেরা ভাবছে হয়তো যে, আমরা কোনও রাজনৈতিক নেতা-টেতা।

ঋজুদা ভটকাই-এর মো-ফো পাবার পরই জাকলিন প্লুজেঁকে মাদাম ব্লঁশের প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কার কথা বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে জাকলিন স্যেশেলসের ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশকে মোবাইল ফোনে বলে দিয়েছিলেন। জেটিতে প্রালের পুলিশ থাকবে প্লেইন ড্রেসে একটা প্রাইভেট গাড়িতে এবং পিয়ের পৌঁছনোর পর থেকেই তার উপরে নজর রাখবে। মাদাম ব্লঁশের হোটেলের চারপাশে প্লেইন ড্রেসে পুলিশ থাকবে নারকেল বনে লুকিয়ে। অত রাতে পিয়ের মাদামের কম্পাউন্ডে ঢোকামাত্র তাকে ট্রেসপাসিং-এর অপরাধে গ্রেপ্তার করে মাহেতে নিয়ে আসবে এবং চার্জ যা দেওয়ার তা তো দেবেই মঁসিয়ে পঁপাদুর জবানবন্দি অনুযায়ী। সে জবানবন্দি পুলিশ নিয়েও এসেছে। মঁসিয়ে পঁপাদু পুলিশের গাড়িতে ওঠার আগে ঋজুদার মুখে থুথু ছিটিয়ে গেছেন ‘ডাবলসার’ বলে।

ঋজুদা খুবই অপ্রস্তুতে পড়ে ছিল। তারপর হেসে বলেছিল, ইউ আর রং মঁসিয়ে। ইউ আর আ ডাবলসার অ্যান্ড আই অ্যাম এ কোয়াড্রপল ক্রসার। মঁসিয়ে ব্লাঁ, এখন মার্সেইতে আছেন। জাকলিনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ঋজুদাকে একটি দশ হাজার ডলারের চেক পাঠিয়েছেন আর অনেক গোলাপ। ফ্রেঞ্চ গোলাপ।

জাকলিনের কাছ থেকে টাকা নেয়নি ঋজুদা। জাকলিন আমাদের সকলকে পুজোর সময়ে পনেরদিনের জন্যে জিনিভাতে নেমন্তন্ন করেছেন। সেখান থেকে কসমস কোম্পানির সবচেয়ে ভাল ট্যুর বুক করে পুরো ইউরোপ দেখিয়ে দেবেন আমাকে আর ভটকাইকে। তারপর বেলজিয়ামের অস্টেন্ড থেকে জাহাজে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ডের ডোভার (সেই হোয়াইট রকস অফ ডোভারের বিখ্যাত ডোভার) হয়ে লন্ডন। সেখানে তিনদিন কাটিয়ে সেখান থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফ্লাইট ধরে সোজা কলকাতা। ভাবলেও রোমাঞ্চ হচ্ছে।

আজ সকালে জাকলিন একটা সাদা সিল্কের ড্রেস পরে এয়ারপোর্টে এসেছেন। রুবির মালা, রুবির ইয়ারটপ, রুবির ব্রেসলেট। পায়ে একটা লাল জুতো। ইটালির গুচ্চির কি? মাথাতে লাল স্কার্ফ। হাতে লাল গোলাপের গুচ্ছ। গোলাপের গন্ধই ভাল, না জাকলিনের সারা শরীর থেকে যে পারফিউমের গন্ধ উঠছে তার গন্ধ ভাল, তা বুঝে উঠতে পারিনি আমি।

মঁসিয়ে পঁপাদু এবং পিয়েরকে অনেকই অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। চিটিং, মাদাম ব্লঁশকে পিয়েরকে দিয়ে খুন করবার চক্রান্ত, বিনা লাইসেন্সে অতগুলো পিস্তল, গুলি, ইনফ্রারেড দূরবীন রাখা। ইনফ্রারেড দূরবীন শুধু গোয়েন্দা, পুলিশ আর আর্মি রাখতে পারে। ব্যানড আইটেম, এ কে ফর্টিসেভেন রাইফেলেরই মতো। সঙ্গে থাকলে বম্বের ফিল্মস্টার সঞ্জয় দত্তর মতো জেলে পচতে হবে।

ভটকাই বলছিল যে, সঞ্জয় দত্তর না হয় সুনীল দত্ত বাবা ছিল, মঁসিয়ে পঁপাদুর তো বাবা নেই।

কার্লোসকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মারিয়েল ভৈঁয়সা এবং শাঁতাল এই সব চক্রান্তর কিছুমাত্র জানত না। ভৈয়সা অনেক টাকা দিয়ে সত্যি সত্যিই পার্টনারশিপে ব্যবসা করবে ও গুপ্তধন পাওয়া গেলে তার ভাগ পাবে, এ জন্যই পঁপাদুর সঙ্গে একটি বোঝাঁপড়াতে এসেছিল। জাকলিনের সঙ্গে ওর কোনও ঝগড়া নেই বরং মস্কোয় একটি স্কুলে একসময় ওরা দুজনে একসঙ্গে ব্যালে শিখত, তাই দুজনে দুজনকে চেনে এবং পছন্দও করে। পাদু ঋজুদাকে ও সব মিথ্যে করে লাগিয়েছিল।

মিসেস মেক্যাঞ্জি একটি লাইলাক-রঙা ড্রেস পরে এসেছেন আর হলুদরঙা ড্রেস পরে এসেছেন মাদাম ব্লঁশ, প্রালে থেকে। হাতে তাঁর অতি সুন্দর করে সাজানো একটি তোড়া। আমান্ডা-ক্রিশ্চিন-আলবো অর্কিডের। পাতাগুলো সাদা। মধ্যে লাল ফুটকি। আর ফুলটা লাল। নিশ্চয়ই ভিক্টোরিয়ার কোনও নামী ফুলের দোকান থেকে কিনেছেন।

সকলেই খুব খুশি। আমরাও। ঋজুদার উচিত ছিল জাকলিনের কাছ থেকে মোটা ফিজ নেওয়া। কিন্তু কিছুই নেয়নি। কেন কে জানে! টাকার চেয়েও দামি হয়তো কিছু আছে, তাই নিয়েছে বদলে। অথবা নেবে। যে কথা ঋজুদা বলতে চায় না, সেই কথা স্যেশেলসের অতিকায় কচ্ছপের মুখেরই মতো সে নিজে বের না করলে কারোরই সাধ্য নেই যে, টেনে বের করে।

জাকলিন এবং ওঁরা প্রত্যেকেই ‘মিস্টার হ্যান্ডসাম’ এবং তার দুই আসলি চেলা আর চামুণ্ডাকে ক’দিন মাহেতে থেকে যেতে বলেছিলেন, বেড়িয়ে-টেড়িয়ে যেতে।

আমরা তো খুশিই হতাম। কিন্তু গতকাল সকালেই ঋজুদার সেক্রেটারি ই-মেইলে খবর পাঠিয়েছে যে দিল্লি থেকে ডি. জি. টাইগার প্রোজেক্টস লম্বা ফ্যাক্স পাঠিয়েছেন। কলকাতা থেকে চিফ ওয়াইল্ড লাইফ ওয়ার্ডেনও তিনবার ফোন করেছেন। খুবই নাকি জরুরি দরকার।

ঋজুদা বলেছে, নিশ্চয়ই কোনও সিরিয়াস ব্যাপার। দেরি করা চলবে না।

অতএব……

এবারের আসল হিরো তো ভটকাই। সকলেই তাকে আদর করছে আর সে লজ্জাতে লাল হয়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো সুইস-চকোলেটের বাক্স এবং নানা বিস্কিটের টিন আমরা উপহার পেয়েছি। এতই উপহার পেয়েছি যে, একস্ট্রা লাগেজ হয়ে গেছে। তবে, সে সবের দায়িত্ব নিয়েছেন জাকলিনের প্রাইভেট সেক্রেটারি।

সবই ভাল, ভটকাই শুধু আজ সকালে একটু কেলো করেছিল।

বলেছিল, কী টেনশান! কী টেনশান! স্যেশেলসে এসেও একদিন সুইমিং করতে পারলাম না।

তুই কি সাঁতার শিখেছিস? তোকে বলেছিলাম না যে আমার সঙ্গে আসতে হলে সাঁতার ইজ আ মাস্ট।

হেদোতে সাতদিন শিখেছিলাম তো। যে সাইকেল চালাতে জানে সে সাঁতারও জানে।

তার মানে?

তারপরই বলেছিল, ওই তো! জলের মধ্যে স্টিয়ারিং ঘোরানো আর পা দুটো ছোঁড়া। চলো চলো আজ একটু বো ভাঁলো সি বিচে সাঁতার কেটে যাই। স্যেশেলস-এর বো ভাঁলো সমুদ্রতটে এলাম অথচ সাঁতার কাটলাম না তা লোকে জানলে কী বলবে! ফিরে গিয়ে রক-এ বসে মিন্টে আর গদাদের চোখ কপালে তুলে দেব। ব্রেকফাস্টের আগে খিদেটাও চনমনে হবে। প্লেন তো প্রায় দুপুরে। চলো ঋজুদা, প্লিজ।

ঋজুদার মুড খুবই ভাল ছিল কাল রাত থেকেই। বলল, স্যুইমস্যুট এনেছিস?

আমার তো নেই। তাতে কী? তোমার একটা পাজামা পরে নেব।

পাজামা পরে পারবি সাঁতার কাটতে?

হুঃ। তোমার মঁসিয়ে পঁপাদুকে বিনাযুদ্ধে শুধু মুখের কথাতে কাত করে দিলাম আর শান্ত নীল সমুদ্রে প্রবালের বালির ওপরে সাঁতার কাটতে পারব না। এ তো সমুদ্র বলেই মনে হয় না। এ সব সাহেব-মেমদের পুরীতে আসতে বলো না। ঢেউয়ের রদ্দা খেয়ে হাড়গোড় ভেঙে যাবে। কায়দা সব বোঝা যাবে। আমি পুরীর চ্যাম্পিয়ন।

প্রায়ই যাস বুঝি?

না। একবার গিয়েছিলাম দেড়দিনের জন্যে। শোনো ঋজুদা। বেশিদিন থাকার দরকার হয় না। আমি মাহেতেই বা কদিন ছিলাম। রহস্য তো ভেদ করলাম! কী করিনি?

ঋজুদা বলল, একশোবার। তা হলে চলো সাঁতার কেটেই আসি। কী বলিস, রুদ্র?

আমারও স্যুইমস্যুট ছিল না। তবে ছোট শর্টস ছিল। ঋজুদার একটা ফিকে কমলা রঙের সুইমস্যুট ছিল। চেঞ্জ করে যখন সাদা সমুদ্রতটে সে দাঁড়াল না, নীল সমুদ্রের পটভূমিকাতে, তখন তাকে ওই পোশাকে দেখে আমরাই প্রেমে পড়ে গেলাম।

ভটকাই গলা নামিয়ে আমাকে বলল, হায় হায়! মাইয়া! তুমে এহনে কোথায় গ্যেলা গিয়া? একবার আইস্য দেইখ্যা যাও। মণি! দেইখ্যা যাও।

আমি বললাম, কার কথা বলছিস?

ইডিয়ট! আর কার কথা কম? জাকলিন, জাকলিন। আমার এহনে জাকলিনময় ভুবন। আমার নূতন-বৌদি।

ঋজুদা ছ’ফিট এক ইঞ্চি লম্বা। সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্যে অতটা লম্বা দেখায় না। রোগাপটকা হলে তালধিড়িঙ্গি হয়ে যেত। ঋজুদার চোস্ত পাজামাও ভটকাইয়ের প্যাংলা শরীরে মেয়েদের সায়ার মতো ঢলঢল করছিল।

পারে দাঁড়িয়ে আমি মিচকি হাসি হাসতেই ও ডানহাতের দেড়খানা আঙুল তুলে বলল, পাকালাম। পাকালাম! অর্থাৎ, Wait and see! তামিলনাড়ুর কামরাজ নাদার স্টাইলে। তারপর, অতি সযত্নে পাজামার পা গুটোতে লাগল। গুটোতে গুটোতে দুটি পা-ই এমন উচ্চতাতে এল যে, মনে হতে লাগল ওটা পাজামা নয়, আমাদের পাড়ার ধুতি-পরে অফিস-যাওয়া ভবতারণবাবুর সাদা লং-ক্লথের আন্ডারওয়্যার।

ভটকাই অত্যন্ত স্মার্টলি একটা গান গাইতে গাইতে ‘এই কুমির তোর হলে নেমেছি’! বলে ছেলেবেলাতে আমরা যেমন কুমির কুমির’ খেলতাম, তেমনি করে জলে নামল। যে গানটা ও গাইছিল, সেটা একটা রবীন্দ্রসংগীত।

‘ওগো জলের রানী,
ঢেউ দিয়ো না, দিয়ো না ঢেউ, দিয়ো না গো
আমি যে ভয় মানি।
ওগো জলের রানী।

জলের মধ্যে ঋজুদা অনেক দূর চলে গেছে। আমি মাঝামাঝি জায়গাতে সাঁতার কাটছি। কী একটা হাঙরের নাম বলেছিল ঋজুদা যেন! সে প্ল্যাঙ্কটন খায়। তা ভাল কথা! কিন্তু মুখ বদলাবার জন্যে হঠাৎ যদি আমার একটা পা খেতে ইচ্ছে হয়? যাই হোক। দারুণ লাগছে কিন্তু। মাথার ওপরে স্যুটি-টার্নরা ডাকাডাকি করছে। দূরের জেটিতে কোনও স্টিম-বোট ভোঁ দিল। ঝকঝক করছে রোদ্দুর। ধীরে বইছে। সকালের শান্ত হাওয়া। ভারী চমৎকার লাগছে।

একবার পেছন ফিরে চেয়ে দেখি, ভটকাই নেই। নেই তো নেই। পরক্ষণেই মনে হল, কেন নেই? আড়াআড়ি তীরের দিকে সাঁতরে যেতে যেতে দেখলাম, ভটকাই একবার উঠছে আর একবার ডুবছে। তবে ভয়ের কিছু নেই, কারণ সেখানে জল এক কোমরও নয়। আমি ওর কাছে যেতেই ও চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি ওর হাত ধরে হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে বালিতে টেনে তুলে ওর অবস্থা দেখে কাঁদব কী হেসে কুটিপাটি হতে লাগলাম।

ভটকাই, রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত সৈনিকের মতো বালির ওপরে শুয়েছিল। সামনে পা ছড়িয়ে। আর তার পায়ের দৈর্ঘ্যের দেড়গুণ লম্বা ভেজা পাজামাটা নেতিয়ে লেপ্টে ছিল বালিতে। আসলে প্রথম ঢেউ লাগামাত্রই ভবতারণবাবুর অ্যামবিশাস আন্ডারওয়্যার লম্বা হতে আরম্ভ করেছিল। ঢেউয়ের আঘাতে ঋজুদার পাজামাও লম্বা হতে হতে যেই ভটকাইয়ের পা ছাড়িয়ে গেল, তখনি ভটকাই ধাঁই ধাঁই করে আছাড় খেতে লাগল। জলে দাঁড়িয়ে যতই আবার গোটাতে যায়, ততই আরও নেমে যায়। তারপরে ভিজে যাওয়াতে ভারী হয়ে গেল। আর গোটাতে, গেলেই সেই পাজির-পাঝাড়া পাদুর মন্ত্র-পড়া পাজামা আপত্তি করে সোজা হয়ে পড়ে যায়। এমনি করতে করতে পুরোটাই গেল খুলে। আর ধাঁই-ধপাধপ! ধাঁই-ধপাধপ! ধাঁই-ধপাধপ!

আমি কাছে যেতেই, ভটকাই বলল, তোরা কি স্পোর্টসম্যান নাকি? সেমসাইড গোল দিস, সাবোটাজ করিস, কুনোই টিম স্পিরিট নাই তগো। যা, গিয়া বল তোর ঋজুদাকে। হঃ।

.

একসময়ে প্লেন এল। আমরা উঠলাম। অনেক হ্যান্ডশেক, অনেক হাত নাড়া এবং…।

ঋজুদা জাকলিন প্লুজেঁর দু-চোখে দুটো চুমু খেল।

ঋজুদার সবই অদ্ভুত। চুমু খাওয়ার এত জায়গা থাকতে চোখে আবার কেউ চুমু খায় নাকি? ভটকাই বলল।

সিঁড়ি দিয়ে আমরা যখন প্লেনে উঠছি, আমি পেছনে আর ভটকাই আগে আগে, ঋজুদা আমার পেছনে পেছনে, ভটকাই নিচুস্বরে গাইতে লাগল–

চোখ গেল।
চোখ গেল।
চোখ গেল পাখি রে,
চোখ গেল পাখি।

প্লেনটা টেক-অফফ করার পরেই আসবার সময়ে যে অপূর্ব দৃশ্য দেখেছিলাম, তেমন দৃশ্যই আবার ফুটে উঠল। নীল, সবুজ, সাদা, লাল, কালো, কতরকমের ছায়া যে জলে, আর কত রঙের যে পাহাড় আর জঙ্গল। মনটা সত্যিই খারাপ হয়ে গেল।

ঋজুদা বলল, তোদের নিয়ে এখানে একবার শুধুই বেড়াতে আসব। আরিন্ড আইল্যান্ড যাওয়া হল না, যেখানে বার্ড স্যাংচুয়ারি, ‘ভ্যালি দ্য মেইতেও যাওয়া হল না, মাহেতে বো ভাঁপোর একটি জায়গাতে, যেখানে গুপ্তধন খোঁজাখুঁজি করছে। একটি কোম্পানি, সেই সব গুহা তোদের দেখানো হল না। খুব ভাল ক্রেওল খাবার পাওয়া যায় একটি ছোট্ট ঘরোয়া রেস্তোরাঁতে, নাম, মারি আঁতোয়ানেতে’, সেখানে তোদের নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো হল না। সেখান থেকে ভিক্টোরিয়া শহরটা কী সুন্দর যে দেখায়! বেঁস্তোরাটা একটা পাহাড়ের ওপরে। ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাভিনিউতে মস্ত বড় স্যুভেনির মার্কেট আছে, সেখানে নানা রঙবেরঙা শাঁখ, প্রবাল, নারকোলের তৈরি জিনিস, জামাকাপড় ইত্যাদি পাওয়া যায়। তোরা তো স্যুভেনির বলতে কিছুই নিতে পারলি না।

ভটকাই বলল, ধাঁই ধাঁই করে আছড়ে পড়ে সারা শরীর ছড়ে গেছে, আমার এই একমাত্র স্যুভেনির। আর কী! আর তোমরা কে কী নিলে তা তোমরাই জানো।

আমরা হেসে উঠলাম।

আমি বললাম, আরিন্ড আইল্যান্ডে গিয়ে সামুদ্রিক পাখি দেখা হল না, এইটাই সবচেয়ে দুঃখের।

ভটকাই বলল, মাদমোয়াজেল প্লুজেঁকে বলল যে এখানে একটা দ্বীপ কিনে নিতে। শুনলাম তো যে কত দ্বীপ আনচার্টেড আছে। মাহেতে হেলিকপ্টার থাকবে। নিজের দ্বীপে হেলিকপ্টার করে গিয়ে নেমে নিজের বাংলোতে জম্পেশ করে অক্টোপাস আর কাঁকড়া খাবে, চিংড়ি মাছের মালাইকারি।

শুধু কি তাই? আরও কত্ত মাছ পাওয়া যায় এখানে। ম্যাকারেল তো খেলিই প্রাসেঁতে, তা ছাড়া আছে স্যামন, জব, টুনা এবং হাঙর। বুরজুয়া মাছ আছে। তা এখানের লোকে খুব তৃপ্তি করে খায়। বুর্জোয়ারা জানলে দুঃখ পেতে পারে।

প্লেনটা স্যেশেলস আইল্যান্ডসের দ্বীপমালার ওপরে রোদ-ঝকঝক দুপুরে একটা মস্ত বড় পাক মেরে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পরেই মেঘের ওপরে উঠে যাবে, তখন মেঘের গালচের ওপর দিয়ে চলবে প্লেন, নীচের সুন্দর পৃথিবীর কিছুই দেখা যাবে না। যা দেখা যাবে, তাও চেনা যাবে না পরিচিত নদী বা পাহাড় বলে।

ভটকাই বলল, আরিন্ড দ্বীপে কী কী পাখি দেখা যায় ঋজুদা?

অনেক পাখি। ব্রাউন নডি-টার্ন তো দেখলিই, লেসার-নডিও দেখলি। স্যুটি-টার্ন দেখলি, সাদাকালো।

স্যুটি বানান কী?

Sooty! ফেয়ারি-টার্ন বলে একরকম সুন্দর দুধসাদা উজ্জ্বল কালো চোখের টার্ন দেখা যায় এখানে, তবে স্যেশেলস দ্বীপপুঞ্জের মাঝামাঝি যে সব দ্বীপ আছে, সেখানেই শুধু দেখা যায় ওদের। জানিস তো, সুটি টার্ন-এর ডিম আবার সেশোলোয়াদের প্রিয় খাদ্য। ডিমের মধ্যে লাল ছিট ছিট থাকে। ফল-খাওয়া বাদুড়ও এদের প্রিয় খাদ্য।

এ মা! বাদুর!

ভটকাই মুখ ভ্যাটকাল।

হ্যাঁ রে! বাদুর, মেঠো ইঁদুর, বুনো শুয়োর, খরগোশ এ সবেরই মাংস তো খুবই ভাল। কম্যান্ডোদের এসবের মাংস খেতে শেখানো হয়। তারা তো মাটন বা চিকেন পায় না।

তাই?

হ্যাঁ।

পাখির মধ্যে আরও আছে–হোয়াইট-টেইলড ট্রপিক বার্ড। তাদের অবশ্য দেখা যায় আরিন্ড ছাড়াও কাজিন আইল্যান্ডে। ম্যাগপাই রবিন দেখা যেত কমবেশি সব গ্রানাইট দ্বীপেই। কিন্তু আজকাল প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশটা ভ্যারাইটি দেখা যায় ফ্রিগেট আইল্যান্ডে। স্যেশেলসের আরেক রকম পাখি হচ্ছে নীল-পায়রা। তাদের ঝুঁটিটা আবার লাল আর বুকের কাছে সাদা চিহ্ন। ঘাড়ের কাছটাও সাদা অবশ্য।

তারপরে ঋজুদা বলল, এখানের এক রহস্যময় পাখির কথা যে নাবিকেরা প্রথম দিকে এইসব দ্বীপে নেমেছিল, তারা উল্লেখ করে গেছে।

কী পাখি?

নীল-মুরগি।

তাই?

হ্যাঁ। হয়তো কায়মা বা আমাদের কাম পাখি, যার ইংরেজি নাম Moor hen দেখেছিল।

কিন্তু Moor hen তো জলা জায়গাতে, বিলে থাকে, সমুদ্র পারের পাখি তো তারা নয়।

কে জানে! পক্ষীবিশারদেরাই বলতে পারবেন।

তুমি পক্ষীবিশারদ নও?

আমি কিছুই নই। আমি মিস্টার গুলেড়উ।

ঋজুদা বলল।

মানে!

মানে আবার কী, যে গুল মারে।

তুমি কি গুল বাঘ?

ভটকাই বলল, হাসতে হাসতে।

তারপর ঋজুদা বলল, এ সব কথা থাক, এখন বল তো দেখি এ যাত্রায় তোদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা কী হল?

কী?

ভেবে বল।

অনেক ভেবেছি এ ক’দিন। আর ভাবতে পারছি না। ভেবে ভেবে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে। তুমিই বলো।

মদের মতো খারাপ জিনিস নেই। দেখলি তো! মঁসিয়ে পঁপাদুর মতো ধূর্ত মানুষ মদের নেশাতে কীভাবে নিজের সর্বনাশ করল। জীবনে কখনও ও সব ছুঁবি না। বুঝেছিস।

হুঁ।

আমরা দুজনে একসঙ্গে বললাম।

জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি উদাস হয়ে গেলাম। ঋজুদা টয়লেটে গেল সিটবেল্ট সাইন অফফ হয়ে যাওয়ার পরে।

জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আমি উদাস হয়ে গেলাম। ভটকাই আমাকে লক্ষ করছিল।

বলল, কী রে! রোদ্র! মন খারাপ করছে এমন একটা স্বপ্নের দেশের মতো জায়গা ভাল করে না-দেখেই চলে যেতে হচ্ছে বলে!

না রে। সে জন্যে নয়।

তবে?

ঋজুদা যদি সত্যিই বিয়ে করে জাকলিনকে, তবে আমাদের দল ভেঙে যাবে।

তাই মনে হয় তোর?

মনে হবে না? নাটকের দল, যাত্রার দল, মাছ-ধরার দল, পর্বতারোহীর দল, শিকারির দল, সবই ভেঙে যায় দলের অধিকারী যদি বিয়ে করে।

কী করবি বল? আমাদের তো এ বিষয়ে কোনও হাত নেই। তবে হলে খারাপই বা কী? আরে ভাবী হো তো অ্যায়সা।

তোর কিন্তু ইংরেজিটা ভাল করে শিখতে হবে।

আরে রাইখ্যা দে তোর ছাতার ইংরাজি। আমি ফ্রেঞ্চও শিইখ্যা ফেলাইমু অমন একখান বৌদি যদি পাই।

এমন সময় ঋজুদাকে আসতে দেখা গেল।

কী আলোচনা হচ্ছিল রে?

হাসি হাসি মুখে ঋজুদা বলল।

ভটকাই বলল, এই বলছিলাম তুমি অধিকারী আর আমরা অনধিকারী।

তার মানে?

মানে কিছু নয়। আমাদের লাঞ্চ দেবে তো ঋজুদা এখন? সকাল থেকে হোটেলে এত লোক, এত ফুল, এত মালা একটু নিরিবিলিতে বসে যে ব্রেকফাস্টটা জমিয়ে খাব তার সুযোগ হল কই?

দেবে দেবে। এয়ারক্র্যাফট-এর পাইলট, কো-পাইলট এবং স্টুয়ার্ডরা কি দেখেনি যে আমরা কেমন ভি আই পি? অর্ধেক ফুল তো এয়ার হোস্টেসদেরই দিয়ে দিলাম। স্যেশেলস-এর ফুল আর অর্কিডের কদরই আলাদা। যারা রসিক, তাদের কাছে। দেখিসই না! আমাদের স্পেশাল খাতির করবে।

ভটকাই বলল, দেখাই যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *