Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar » Page 14

অগ্নিরথ || Samaresh Majumdar

রায়বাড়ির সবাই উত্তেজিত

রায়বাড়ির সবাই যতটা উত্তেজিত ছিল পরিস্থিতি ততটা অনুকুলে গেল না। যারা ভেবেছিল প্রমোটারের সঙ্গে দ্রুত চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যাবে, এবং পরিবিহীন মাঠে ভিত খোঁড়া হবে তারা জানল কাজটা অত সহজ নয়। প্রথম কথা যে প্রমোটারকে ঠিক করা হয়েছিল তিনি নানান ফ্যাকড়া তুলতে শুরু করলেন। ফ্ল্যাট এবং সেই সঙ্গে দেয় টাকার পরিমাণ তাঁর কাছে বেশি বলে মনে হল।

রায়বাড়ির পুরুষরা একটু কর্মবিমুখ। একমাত্র সদানন্দ ছোটাছুটি করে আরও কয়েকজন প্রোমোটারের সঙ্গে যোগাযোগ করল। খবরটা কলকাতায় চাউর হতেই মারোয়াড়ি ব্যবসাদাররা এগিয়ে এল। তাদের কারও কারও প্রস্তাব হল, ফ্ল্যাট-টল্যাট নয়, থোক টাকা ধরে দেওয়া হচ্ছে, মোটা টাকা, রায়বাড়ির শরিকরা সেই টাকা নিয়ে এই বাড়ি খালি করে চলে যাক। টাকার পরিমাণ শুনে কেউ কেউ আগ্রহ দেখালেন। সমস্যা হল ব্যাঘ্রবাহিনী দেবীকে নিয়ে। এই দেবীমূর্তিকে ফেলে দেওয়া যায় না। আবার কেউ একজন প্রোমোটারের কাছ থেকে পাওয়া টাকায় ফ্ল্যাট কিনে সেখানে দেবীমূর্তিকে নিয়ে গিয়ে পুজো করতে নারাজ। কারণ স্থানাভাব এবং খরচ।

রায়বাড়ির শরিকরা ঘন ঘন আলোচনায় বসলেন। সেখানে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বদলে মতান্তর এবং চেঁচামেচি বাড়তে লাগল। শেষ পর্যন্ত ন’বাবু প্রস্তাব রাখলেন, বড়মায়ের কাছে যাওয়া হোক। তাঁর কোনও পিছুটান নেই। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গিয়েছে নাতি তার বউকে নিয়ে আমেরিকায় চলে যাবে। তিনি থাকবেন একা আতরবালাকে নিয়ে। তাঁর ঝামেলা কম। অতএব তিনি যদি মা ব্যাঘ্রবাহিনীর দায়িত্ব নেন তাহলে সব দিক রক্ষা হয়। সেই আলোচনায় নাতি ছিল না। সে গিয়েছে তার স্ত্রীকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে। কথা হল, তার মতামত না জেনে যাওয়া ঠিক নয়। নাতি যদি এই প্রস্তাব সমর্থন করে তাহলে বড়মা আপত্তি করতে পারবেন না।

বাদল খবর এনেছিল ছেষট্টি সালের একটা অ্যাম্বাসাডার বিক্রির জন্যে আছে। আজকাল বেশি পুরনো গাড়ি কিনে লাভ নেই, খদ্দের পাওয়া মুশকিল। কিন্তু বি জি এবং বি জে নাম্বারের গাড়ির বডি এবং ইঞ্জিন আম্বাসাডারের অন্য বছরের গাড়ির তুলনায় অনেক বেশি মজবুত হয় বলে সদানন্দ দেখতে যেতে রাজি হল। তারপর যখন বাদল জানাল গাড়িটি জনৈক ডাক্তারের এবং তিনি শো-রুম থেকে ডেলিভারি নেওয়ার পর এই এত বছরে হাত বদল করেননি তখন তার আগ্রহ বাড়ল।

ভদ্রলোকের বাড়ি মানিকতলার রামানন্দ চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। ডাক্তার অসুস্থ, একবার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। প্র্যাকটিস করা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর মেয়ে গ্যারাজ খুলিয়ে গাড়ি দেখালেন। ইঞ্জিন চালু করলেই আওয়াজে তার স্বাস্থ্য টের পায় সদানন্দ। সেটা ঠিকই আছে। গিয়ারের কাজ আছে আর রং করতে হবে। ডাক্তারের মেয়ে বললেন, বাবা মাত্র একবারই রং করিয়েছিলেন।

সদানন্দ জিজ্ঞাসা করল, আপনারা গাড়িটা বিক্রি করছেন কেন?

বাবা তো বের হন না, আমারও গাড়ির দরকার নেই। গ্যারাজে পড়ে থেকে নষ্ট করে কী লাভ।

কত দাম ধরেছেন?

কত পাওয়া যেতে পারে?

দেখুন, এত পুরনো গাড়ি, শখ করে কেউ কিনবে না। মনে হচ্ছে ইঞ্জিন কখনও করাতে হয়নি। এখন যে অবস্থা তাতে কয়েক মাসের মধ্যে ডাউন হতে পারে। তখন আর একটা বড় খরচ। সত্যি বলছি, কুড়ি হাজারের বেশি দাম হওয়া উচিত নয়, তবে ফার্স্টহ্যান্ড বলে আমি আরও পাঁচ বেশি দিতে পারি। সদানন্দ বলল।

পঁচিশ হাজার? এই দামে আজকাল গাড়ি পাওয়া যায়?

আরও পনেরো খরচ হবেই। চল্লিশ বিয়াল্লিশে দশ বছর আগের গাড়ি বিক্রি হচ্ছে। আমি কম দিচ্ছি মনে হলে বিক্রি করবেন না। আমার কার্ড রাখুন, যদি আমার দামে রাজি হন তা হলে যোগাযোগ করবেন। পার্স থেকে কার্ড বের করল সদানন্দ।

কার্ড হাতে নিয়ে নাম ঠিকানা পড়ে মেয়েটির মুখের রং আচমকা বদলে গেল। এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, আপনারা একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি।

মেয়েটি চলে যেতেই বাদল বলল, কী মডেল গুরু!

হ্যাঁ, এই মডেলের অ্যাম্বাসাডারের বডি খুব সলিড হয়। এরপর থেকেই পাত পাতলা হয়ে গিয়েছে। সামান্য ধাক্কা লাগলেই তুবড়ে যায়। সদানন্দ বলল।

বাদল প্রবলভাবে মাথা নাড়ল, দুর। আমি ব্যাক গিয়ার দিয়েছি আর তুই সামনে তাকিয়ে আছিস। গাড়ির কথা কে বলেছে? যে গাড়ি দেখাচ্ছিল তার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস?

তুই গাড়ি কিনতে এসেছিস না মেয়ে দেখতে? সদানন্দ রেগে গেল।

ঠাকুর বলতেন যা দেখার জিনিস তা প্রাণভরে দেখে নে।

কোন ঠাকুর?

নাম মনে নেই। ভারতবর্ষে কত ঠাকুর আছেন, ছিলেন। তাঁদের কেউ নিশ্চয়ই এমন কথা বলে থাকবেন। সত্যি গুরু, দেখে মন ভরে গেল।

বাদলের কথা শেষ হতেই একটি কাজের মেয়ে এসে বলল, আপনাদের ডাকছে।

বাদল বলল, গাড়িটা বিক্রি করবে। আমাদের কপাল ভাল।

কোনও কোনও মানুষকে অসুস্থতার কারণে বয়েস হওয়ার আগে বৃদ্ধ দেখায়। ওরা দেখল লাঠি হাতে যে ভদ্রলোক বসে আছেন তিনি এই ধরনের। মুখের একটা দিক ঈষৎ বেঁকে যাওয়ায় তাঁকে আরও অসুস্থ দেখাচ্ছে। ঘরে আর কেউ নেই।

এসো এসো। ভদ্রলোকের উচ্চারণ অস্পষ্ট, বোসো।

ওরা বসল। বাদল জিজ্ঞাসা করল, আপনি রাজি?

হ্যাঁ?

আপনি গাড়িটা কি বিক্রি করবেন?

হ্যাঁ, হ্যাঁ। তোমরা রায়বাড়ির ছেলে? কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।

বাদল বলল, হ্যাঁ। আমি নই, এ।

তোমার নাম সদানন্দ রায়?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তোমার পিতার নাম ঈশ্বর উপানন্দ রায়?

হ্যাঁ।

শুনেছিলাম তুমি ব্যবসা কর। গাড়ির ব্যবসা। তোমাদের পরিবারে এখন পর্যন্ত কেউ চাকরি করে না। তা তোমার ব্যবসা কি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাড়ি কেনা?

মন্দ কী? আপনি যদি গাড়িটাকে বিক্রি করেন আমি তার ওপর কিছু খরচ করে চেহারা বদলে যদি বেশি টাকায় বিক্রি করতে পারি সেটা তো আমারই কৃতিত্ব, তাই না?

তা অবশ্য। যে কোনও ব্যবসাই এই ধরনের। তবে ওই যে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে গাড়ি কেনে– শুনতে কীরকম খারাপ লাগে। যে-লোকটা পুরনো খবরের কাগজ বাড়ি থেকে কিনে নিয়ে গিয়ে আর একটু বেশি দামে আড়তদারের কাছে বিক্রি করে দেয় সে-ও তো ব্যবসা করে। তাই না?

বাদল বলল, আমি একজনকে জানি যার বাবা গড়ের মাঠের সমস্ত ঘাস কেনার ইজারা নিয়েছিলেন। লোক দিয়ে সেই ঘাস বিক্রি করে কলকাতায় তিন-চারটে পাঁচতলা বাড়ি তৈরি করেছেন তিনি।

সদানন্দ বলল, আপনি কী জন্যে ডেকেছেন?

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, আমি ডাক্তার ছিলাম। অসুখ আচমকা আমাকে পঙ্গু করে ফেলেছে। তুমি বাড়িতে ফিরে গিয়ে তোমার মাকে আমার কথা বলবে। তিনি বোধহয় নাম বললে আমাকে চিনতে পারবেন। অথবা তোমার বাড়িতে যাঁকে সবাই বড়মা বলে ডাকে তিনি আমাদের খবর রাখেন। এইটুকুই।

সদানন্দ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলুন তো?

তেমন কিছু নয়। তোমার কার্ড দেখে পরিচয় জানতে পারলাম। তা এই ব্যবসা করে তোমার মাসে কীরকম আয় হয়?

কোনও ঠিক নেই। গত মাসে আমরা তিরিশ হাজার রোজগার করেছিলাম। আবার এ মাসে এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি। সদানন্দ হাসল, হয়ে যাবে।

আমরা মানে?

আমরা দুজন পার্টনার।

ও! তার মানে অর্ধেক, অর্ধেক?

বাদল বলল, সেটা আমাদের ভিতরকার ব্যাপার।

তোমাদের বাড়ি তো ভেঙে ফেলা হবে। প্রমোটারের সঙ্গে বন্দোবস্ত হয়ে গেছে!

আপনি দেখছি আমাদের সম্পর্কে অনেক খবর রাখেন।

আমি অসুস্থ। বাড়ির বাইরে যেতে পারি না। অনেক খবর রাখব কী করে?

কাজের কথায় আসুন। গাড়িটা বিক্রি করবেন? সদানন্দ পাঁচ হাজার বেশি বলেছে। ওই দামে কেউ আপনার গাড়ি কিনবে না।

বেশ তো! ভেবে দেখি। ভদ্রলোক সদানন্দকে বললেন, ফোন কোরো।

ওরা বেরিয়ে এসে বাইকে উঠতে যাচ্ছে, বাদল বলল, ফোন নাম্বার জানিস?

না তো।

তাহলে ফোন করবি কাকে?

এইসময় কাজের মেয়েটিকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তার হাতে একটা চিরকুট। তাতে সুন্দর হস্তাক্ষরে টেলিফোন নাম্বার লেখা।

বাদল বলল, আই বাপ! বাপের জন্মে এমন লেখা বের হবে না আমার।

দু-একটা কাজ সেরে বাদলকে ওর বাড়িতে নামিয়ে ফিরে আসছিল সদানন্দ। বড় রাস্তা ছেড়ে বাড়ির দিকে এগোতেই দেখল গোটা চারেক ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দেখিয়ে একজন তাকে থামতে বলছে। এদের চেনে সদানন্দ।

বাইক থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার?

একটু চলো, বদুদা কথা বলবে।

বদুদা এ পাড়ার একজন রাজনৈতিক নেতা। ভদ্রলোককে কখনও কোনও কাজকর্ম করতে দেখেনি সদানন্দ। আগে ময়লা পাজামা হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি পরত এখন আন্দির পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে, অ্যাম্বাসাডারে ঘোরে।

উনি কোথায়? সামনের সেলুনে।

চল যাচ্ছি। বাইক ঘুরিয়ে বড় রাস্তার একপাশে সেলুনের সামনে পৌঁছাবার আগে ছেলেগুলো পৌঁছে গেল। সদানন্দ বুঝতে পারছিল গতিক সুবিধের নয়। কিন্তু বদুদার সঙ্গে দেখা না করাটা বোকামি হবে।

বদুদার দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছিল ছোটকা। সেলুনে আর কেউ নেই। যে ছেলেটা তাকে আসতে বলেছিল সে বদুদাকে চাপা গলায় বলল, এসেছে।

বোসা, বোসো। বসতে দাও ওকে। কী যেন নাম?

সদানন্দ বসল না, বলল, সদানন্দ।

শুনেছি গাড়ি কেনাবেচার ব্যবসা কর। তাই তো?

হ্যাঁ।

বাড়িতে তো কোনও গ্যারাজ করোনি?

না।

করবে কী করে। শরিকদের বাড়ি। এখানকার কোন কোন গ্যারাজে তোমার কাজ হয়? অসুবিধা হলে বলো, লজ্জা করো না। বাঙালির ছেলে কেরানিগিরি না করে খেটে রোজগার করছে, শুনলেই আনন্দ হয়। উল্টো চালা।

নির্দেশটা ছোটকাকে। ছোটকা মিনমিন করল, দাড়ি পেকে যাবে।

চুল পেকে গেছে দাড়ি কাঁচা রেখে কি লাভ? যা বলছি তাই কর। যা বলছিলাম, তোমরা নাকি বাড়িটাকে প্রমোটারের হাতে তুলে দিচ্ছ?

দিয়ে কোনও উপায় নেই।

খুব দুঃখজনক ব্যাপার। এইভাবে কলকাতা প্রমোটারদের গ্রাসে চলে যাচ্ছে। এরপর একদিন শুনব মুক্তারামবাবুর রাজেন মল্লিকের বাড়ি ভেঙে প্রমোটার ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। কী রফা হল?

আমি ঠিক জানি না।

সেকী তোমার বাপ নেই, ব্যবসা কর, তুমিও একজন শরিক অথচ তোমাকে না জানিয়ে প্রমোটারের সঙ্গে রফা করে কী করে? মাঝে মাঝে কথা বলার জন্যে ছোটকা বদুদার গাল ছেড়ে দিচ্ছিল।

এখনও কারও সঙ্গে ফাইনাল হয়নি।

তাই বলো। ভালই হল, শুরুর আগেই কথা বলা ভাল। শোনো, আমি আবার বেশি ধানাইপানাই করতে ভালবাসি না। এই এলাকায় যারা সিনসিয়ারলি সমাজসেবা করে, রাজনীতি করে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তারা বিনিময়ে কী পায়? কিস্যু না। এদের জন্যে কিছু কাজ দরকার। না, আমি কোনও জোরজবরদস্তি পছন্দ করি না। শুনলাম আগে নতুন বাড়ি হবে। তারপর পুরনো বাড়ি ভাঙা হবে। তা নতুন বাড়ি করতে ইট দরকার, বালি দরকার। এ দুটো এরা সাপ্লাই দেবে। যে প্রমোটারের সঙ্গে তোমরা ফাইনাল করবে তাকে এই শর্ত মানতে হবে। আরে লোকটাকে তো বাজার থেকে কিনতেই হত। তাই না? বাজারে যে দাম তাই দেবে। তবে হ্যাঁ ওরা মাল কেনার টাকা কোথায় পাবে? বলবে অ্যাডভান্স দিতে। পেমেন্ট তো করতেই হবে, আগে আর পরে। এতে হবে কী তোমাদের বাড়িটাকে, যেটা নতুন হবে, এদের কাছে পরের বাড়ি বলে মনে হবে না। ভাববে আমাদেরও দান আছে। ফলে গোলমাল হবে না। এ গেল ছেলে-ছোকরাদের কথা। তুমি তো ব্যবসা কর। কলকাতা, কলকাতা কেন, এখন যেখানেই বাড়ি হচ্ছে, প্রমোটাররা বানাচ্ছে, সেখানেই একটা পার্সেন্ট তারা সরিয়ে রাখে পুলিশের জন্যে। নইলে আজ মিস্ত্রিকে ধরে নিয়ে যাবে কাল সিমেন্টের লরি আটকাবে। অ্যান্টিসোশ্যালদের আড্ডা বলে কাজ বন্ধ করে দেবে। তা পুলিশের জন্যে যেমন রাখে তেমনই পাড়ায় যাতে অশান্তি না হয়, পিসফুলি বাড়িটা যাতে তৈরি হয় সেইজন্যে ঠিক ঠিক জায়গায় প্রণামী দিতে হয়। আলতুফালতু লোক গিয়ে চাপ দেবে আর ওদের টাকা গলে যাবে এটা ঠিক নয়। তুমি বলবে আমার সঙ্গে দেখা করতে। রোজ সকালে আমি এই ছোটকার দোকানে আসি। আমি আধঘণ্টা না বসলে নাকি ছোটকার বিক্রিবাটা মন্দ হয়। মোছ।

সাবান মুছে ক্রিম লাগিয়ে বদুদা ঘুরে বসলেন, সব কথা হয়ে গেল। বুঝতে কোনও সমস্যা হচ্ছে?

নীরবে মাথা নেড়ে না বলল সদানন্দ।

গুড, বুদ্ধিমান লোকের সঙ্গে কথা বলেও সুখ হয়।

কিন্তু প্রমোটার যদি আমার কথা শুনতে না চায়?

তাহলে কাজ করতে পারবে না। আমি বলে দেব। কিন্তু সমস্যা হবে আর কোনও দল একই প্রস্তাব নিয়ে এলে।

কোনও দল মানে?

বিরোধীদল।

আরে সেই জন্যেই তো তোমাকে বলা। তুমি যদি প্রথমেই কথা বলে নাও প্রমোটারের সঙ্গে তাহলে পরে যে আসবে সে তো চান্স হারাবেই।

তখন যদি ওরা ঝামেলা করে?

দেখা যাবে। আগে করুক। তোমার কাছে ওরা ওরকম প্রস্তাব দেয়নি তো?

আমার কাছে দেয়নি। তবে আমাদের তো অনেকগুলো শরিক। অন্য কারও কাছে দিয়েছে কিনা জানি না। আচ্ছা, চলি।

সদানন্দ সেলুন থেকে বেরিয়ে তার বাইকে উঠল। বদুদা তার যাওয়া দেখল, এ মাল আমাকে চমকাবার চেষ্টা করবে রে, যদি করে কপালে দুঃখ আছে!

.

আতরবালা পায়ে হাতে বুলিয়ে দিচ্ছিল। ইজিচেয়ারে পা ছড়িয়ে শুয়েছিলেন বড়মা। অনেকক্ষণ থেকেই তিনি কথা বলছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আতরবালা না বলে পারল না, তুমি কি আমার সর্বনাশ করতে চাও?

কী হল? বিরক্ত হলেন বড়মা।

কথা বলছ না, কেবলই ভাবছ। গুম হয়ে আছ। যার যা স্বভাব সে যদি এই বয়সে না করে তাহলে বুকের রোগ হতে বাধ্য। তোমার যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার কী হবে? কোথায় যাব আমি?

কেন? এখানেই থাকবি।

থাকতে দেবে? নাতি নাতবউকে নিয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছ, তুমিও যদি মরণ ডেকে আনো তাহলে ওরা আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।

আমি তো চিরকাল বাঁচব না, এই যে এতকাল বেঁচে আছি তাতেই অনেকের চোখ টাটাচ্ছে। গায়ে শ্যাওলা জমে যাচ্ছে।

আতরবালা হাত বোলানো বন্ধ করল, তুমি নাতির সঙ্গে চলে যাও।

অবান্তর কথা বলিস না।

তোমার খুব সাহস।

বয়স যখন কম ছিল তখন সাহসের অভাব ছিল। এই তুই নিজেই দেখিস, শরীর যখন ব্যাটাছেলে না মেয়েছেলে বোঝা যাবে না তখন তুই নিজেই সাহসী হয়ে যাবি। বড়মা হাত নাড়লেন, একবার সদুর মাকে ডেকে নিয়ে আয়। বলবি, কথা খুব জরুরি।

এখনই? আতরবালা শরীর মোচড়াল।

কানে কম শুনছিস নাকি? ন্যাকামি করলে দূর করে দেব।

অগত্যা আতরবালা উঠল। নিজের ঘরে গিয়ে চুল আঁচড়ে কাপড় ঠিক করে দরজা খুলল। এখন তাদের ফ্ল্যাটে কেউ নেই। বড়মাকেই দরজা খুলে দিতে আসতে হবে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে এক সেকেন্ড থমকাল আতরবালা। গন্ধ বের হচ্ছে। গন্ধরাজ এই দুপুরবেলাতেও সেবন করছেন। বছর পনেরো, তার বেশি হবে, কথাবার্তা নেই। বড়মা বলেছিলেন, আর যদি যাস জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব।

লোকটার যে চরিত্রদোষ আছে তা সবাই যেমন জানে তেমনই জানত আতরবালা। কোনও ঝি বেশিদিন ওখানে কাজ করত না। একা থাকা একজন মানুষের সংসারে কাজ আর কী! তবু থাকত না। যারা থাকতে চাইত তাদের যে কোনও অছিলায় বের করে দিত। ঝি-দের সঙ্গে আতরবালার দুরত্ব অনেক। সে বড়মার কাজের লোক হলেও আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। সে কারণেই অন্য কাজের লোকদের ওপর হুকুম চালাতে সে সক্ষম। তারাও ওকে সমীহ করে। ফলে গন্ধরাজের ইদানীংকার অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানা নেই।

সদানন্দের মা খবরটা পাওয়ামাত্র বলে উঠলেন, সর্বনাশ।

কেন গো? কী হল?

উনি এর মধ্যেই খবর পেয়ে গেছেন?

কী খবর?

কোনও ফোন এসেছিল।

মনে করতে পারছি না। চারধারে এত ফোন বাজে যে গুলিয়ে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সদানন্দর মা বড়মায়ের সামনে উপস্থিত।

বড়মা মুখ তুললেন, তোমার ছেলের বিয়ের কী করলে?

এখনও তেমন কিছু এগোয়নি।

একটু আগে শুনলাম পাত্রীর বাড়িতে সে বন্ধুকে নিয়ে হাজির হয়েছিল। গিয়েছিল গাড়ি কিনতে। পাত্রীর বাবা বললেন বিয়ে হলে গাড়িটা এমনি যৌতুক দেবেন। বিক্রি করবেন না। বলে দিও। যা করার তাড়াতাড়ি করো। এ আমার শেষ কাজ, আমি থাকতে থাকতে করে যেতে চাই। এরপর থেকে বাড়ি ভাঙবে, মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবে।

এই ভাঙাভাঙি বন্ধ করা যায় না?

কেন?

আমার ভাল লাগছে না।

তুমি আর সদু, এই তো দুটো মানুষ, তুমি তো এ কথা বলবেই। কিন্তু যাদের জায়গা কুলাচ্ছে না, ঘরের চেয়ে লোক বেশি হয়ে গিয়েছে তারা তো চাইবে বড় ফ্ল্যাটে উঠে যেতে। তুমি পাত্রীর বাপের ফোন নম্বর জানো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তাহলে ফোন করে কথা বলো। আজকাল ছেলেমেয়ের মাকেও কথা বলতে জানতে হয়। তোমার তো স্বামী নেই, সমস্যার সমাধান তোমাকেই করতে হবে। পাড়াপ্রতিবেশীদের ওপর নির্ভর করবে কেন? যাও।

সদানন্দর মা চলে গেলে তিনি আতরবালাকে বললেন, তুই ঝটপট ন’বাবুকে ডেকে নিয়ে আয়।

এখনই?

কানের মাথা খেয়েছিস নাকি পোড়ারমুখী!

অগত্যা যেতে হল। আবার সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সেই গন্ধ। পনেরো বছর আগে ওই গন্ধটা তার শরীরে ঢুকেছিল।

ন’বাবু ছুটে এলেন, হাতজোড় করে দাঁড়ালেন।

বড়মা বললেন, তোমার মেয়ের নাম যেন কী? টুকটুকি না?

আজ্ঞে, আপনার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর।

আর তো কোনও শক্তি নেই, স্মৃতিই সম্বল। বড়মা হাসলেন, যাক গে, ওর কী ব্যবস্থা করলে? শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে রাজি করাতে পারলে?

না। জামাই কিছুতেই রাজি হচ্ছে না।

রাজি হচ্ছে না মানে কী?

সে কিছুতেই ঘর করতে চাইছে না।

তাহলে বিয়ে করেছিল কেন? বাজারে গিয়ে আমি রুই মাছ কাটিয়ে নিয়ে এলাম। রান্নার আগে ইচ্ছে হল ইলিশ খাব, রুইওয়ালা মাছ ফেরত নেবে? আমাদের এক জ্ঞাতি আছেন বড় ব্যারিস্টার, তাঁর কাছে যাও।

আসলে, হাত কচলালেন ন’বাবু, মামলা মোকদমা করলে জানাজানি হয়ে যাবে, পাঁচজনে পাঁচকথা বলবে, তাই

তাহলে কী করবে? সারাজীবন মেয়েটাকে বুকে পাথর বইতে বলবে?

তা নয়। আমি চেষ্টা করছি। একজন তান্ত্রিক আছেন। আত্মা চালান করতে পারেন। সামনের অমাবস্যার রাত্রে টুকটুকিকে নিয়ে পূজোয় বসবেন।

কোথায়?

আমার ওখানে তো এমনিই জায়গা কম হচ্ছে। ফ্ল্যাট না হওয়া পর্যন্ত। তা ওই ভাঁড়ারঘরটাকে পরিষ্কার করে রেখেছি।

বড়মা সোজা হয়ে বসলেন, এ বাড়িতে ওসব চলবে না।

মানে? হকচকিয়ে গেলেন ন’বাবু।

এই বাড়িতে মা ব্যাঘ্রবাহিনী আছেন। তাঁর মাথার ওপর তুমি তান্ত্রিককে দিয়ে মেয়ের ইজ্জত নষ্ট করবে? চিৎকার করে উঠলেন বড়মা।

এ কী বলছেন?

তুমি বুঝতে পারছ না? তোমাদের পাঁচজনের সামনে তান্ত্রিক আত্মা নামাবে না। দরজা বন্ধ রাখবে। লজ্জায় মেয়ে কিছু বলতে পারবে না। তারপর যদি পেটে সন্তান আসে তাহলে তান্ত্রিক পরামর্শ দেবে জামাইকে খবর দিতে। তোমার মেয়ে মা হতে চলেছে। এসব গপ্পো আমি অনেক শুনেছি। বাপ হয়ে মেয়ের জীবনটাকে নষ্ট করে দিতে চাও কারণ পাঁচজনে কি বলবে সেই ভয়ে। তার চেয়ে ডাক্তার দেখাও। শরীরে যদি কোনও গোলমাল থাকে তাহলে ডাক্তার সারিয়ে দেবে। তাতেও যদি জামাই না মানে তখন মামলা করবে। তান্ত্রিক যেন এ বাড়িতে ঢুকতে না পারে।

আপনি যদি জামাইয়ের মায়ের সঙ্গে কথা বলেন।

বলেছি। আমার একটা দায়িত্ব আছে। আগে ডাক্তার দেখিয়ে আমার কাছে এসো। ডাক্তার কী বলছে তা আগে শুনতে চাই। এরপর তো সব আলাদা হয়ে যাবে। আমার কথা শোনার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যতক্ষণ তা না হচ্ছে ততক্ষণ! যাও। মাথা নাড়লেন বড়মা।

ন’বাবু একটু ইতস্তত করলেন, একটা কথা বলতে পারি?

কী কথা?

আপনি বলেছেন মা ব্যাঘ্রবাহিনীকে সম্মান দিয়ে রাখতে পারলে বাড়ি বিক্রিতে আপনার কোনও আপত্তি নেই। তাই তো?

উপায় কী?

আপনি তো নাতির সঙ্গে বিদেশে চলে যাচ্ছেন, আর ফিরবেন না।

কে বলল?

সেদিন আপনার নাতির মুখে শুনলাম। তাই একটা প্রার্থনা আছে। আমার তো জায়গায় কুলোচ্ছে। আপনি যদ্দিন না থাকবেন তদ্দিন আমি না হয় আপনার অংশ দেখাশোনা করব। মানে, কেয়ারটেকারের কাজ করব। নতুন ফ্ল্যাট তো এখনই উঠছে না। উঠতে উঠতেও বছর দেড়-দুই চলে যাবে। ততদিন–!

ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে গেলে?

তখনও কেয়ারটেকার হিসেবে থাকব। আপনার নাতি যখন বেড়াতে আসবে কলকাতায় তখন পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ফ্ল্যাট পাবে। সতৃষ্ণ চোখে তাকালেন ন’বাবু।

নাতিকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। আমার সম্মতি ছাড়া সে বলে কী করে?

তার মানে? আপনি যাচ্ছেন না?

কক্ষনও নয়। এই বাড়িতে আমার শ্বশুর, তাঁর পিতা, আমার স্বামী বাস করে গিয়েছেন। এই বাড়িতে আমার ছেলে মারা গিয়েছে। মৃত্যুর কাছাকাছি এসে এই বাড়ি ছেড়ে আমি কেন বিদেশে যাব? চোখ বড় হল বড়মায়ের।

ন’বাবু নমস্কার জানিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, পেছনে ডাকলেন বড়মা, শোনো, পরিগুলোর বিক্রির টাকা কীভাবে খরচ হবে আমাকে জানিয়ে দিও।

.

সদানন্দের মুখে বদুদার বক্তব্য শুনে হইচই পড়ে গেল। সমরেন্দ্রনাথ বললেন, এ অত্যন্ত খারাপ ব্যাপার। মগের মুলুক নাকি।

কমলেন্দু মাথা নাড়ল, এটা নতুন হয়েছে। কেউ বাড়ি বানালেই হামলা করা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই।

কী রকম? ন’বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

আপনি আমি পারব না, কিন্তু এখন যে প্রমোটারের সঙ্গে কথা বলেছি সে পারবে। ভদ্রলোক আমাদের শর্তে রাজি আছেন। মা ব্যাঘ্রবাহিনীর জন্যেও মন্দির করে দেবেন।

সদানন্দ বলল, তাঁকে ব্যাপারটা বলা দরকার।

বলব। আগামীকাল উনি ড্রাফট পাঠাবেন। প্রত্যেককে এক কপি দেব, পড়ে কারও যদি আপত্তি থাকলে জানিয়ে দেবেন। এই প্রমোটার এক বছরের মধ্যে আমাদের নতুন ফ্ল্যাট দিয়ে দেবেন। কমলেন্দু জানাল।

হাত তুলে তাকে থামাল কমলেন্দু, আমি যাঁর কথা বলছি তাঁর কাছে এইসব বদু-টদু ঘামাচির মতো। মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের সঙ্গে ওঁর অনেকদিনের বন্ধুত্ব। অতএব বুঝতেই পারছ!

সদানন্দ বলল, তা হলে বদুদা যদি আমাকে ফের ধরে তা হলে বলে দেব প্রমোটারকে জানিয়ে দিয়েছি।

ন’বাবু বললেন, এ গেল একটা সমস্যা। তুমি যখন বলছ মুখ্যমন্ত্রীর ছেলের বন্ধু তখন আমাদের কোনও চিন্তা নেই। আচ্ছা, বড়মা জানতে চেয়েছেন পরি বিক্রির টাকা কীভাবে খরচ হবে?

সমরেন্দ্রনাথ বললেন, এখন তো এ বাড়ি মেরামত বা রং করার মানে হয় না।

ঠিকই।

তাহলে?

টাকাটা ভাগ করে শরিকদের দিয়ে দিলেই হয়।

কমলেন্দু মন্তব্যগুলো শুনে মাথা নাড়ল, তার চেয়ে এই টাকার সুদে মা ব্যাঘ্রবাহিনীর পূজা হোক। ফ্ল্যাট তৈরি হয়ে গেলে তা হলে কারও ওপর চাপ পড়বে না। এ বাড়ির টাকায় এ বাড়ির মায়ের চলে যাবে।

প্রস্তাবটা সবাই মেনে নিল।

.

নাতি আর নাতবউ ফিরে এল সন্ধের পরে। হাতমুখ ধুয়ে নাতি যখন বড়মায়ের পাশে এসে বসল তখন তিনি রাতের আহার শেষ করেছেন।

তোমরা খেয়ে এসেছ?

হ্যাঁ।

শোনো, তোমার বাবা যা কখনও করেননি তুমি তা করতে যেও না।

বুঝলাম না, বাবা কখনও বিদেশে যাননি, আমি গিয়েছি।

তোমার বাবা কখনও তাঁর ইচ্ছের কথা আমার মুখে বসিয়ে পাঁচজনকে বলেননি। তোমার সঙ্গে আমি বিদেশে যেতে রাজি হয়েছি?

হননি, হবেন।

কক্ষনও নয়। আমি কোথাও যাচ্ছি না। তুমি স্বচ্ছন্দে বউ নিয়ে চলে যেতে পারো। আমি তো তোমাকে বলেই দিয়েছি।

ও যদি চলে যায় তাহলে আপনি কার কাছে থাকবেন?

মা ব্র্যাঘ্রবাহিনীর কাছে।

এটা কোনও কাজের কথা হল না।

ওষুধ খাওয়ানো ছাড়া তোমার বউ আমার কোন উপকারে আসছে। এই যে আজ সারাদিন সে বাপের বাড়িতে কাটিয়ে এল, আমার কোন অসুবিধে হয়েছে?

একটা দিন আর বাকি জীবন এক নয়।

আমার আর বাকি জীবন বলতে কী আছে। এ বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হচ্ছে। তদ্দিন বেঁচে থাকি তা হলে সেখানে চলে যাব। টাকাপয়সা বাড়িঘর সব তোমার নামে থাকবে। আমি মরে গেছি খবর পেলে এখানে এসে বিলিব্যবস্থা করে যেও। বড়মা বললেন, যাও, এখন ঘুমোতে দাও।

আড়ালে দাঁড়িয়ে আতরবালা কথাগুলো শুনল। সে আশা করেছিল বড়মা নাতিকে তার কথা বলবেন। এত বছর যে সেবা করেছে তাকে নিশ্চয়ই বঞ্চিত করবেন না। কিন্তু বুড়ি সে পথে গেল না। দুপুরে যখন ন’বাবুকে মুখের ওপর না বলে দিয়েছিল তখন খুব খুশি হয়েছিল আতরবালা। এখন কী করা যায়? অত্যন্ত দুঃখ পেল সে।

রাত নামলে আতরবালাকে নিয়মিত একটা কাজ করতে হয়। মা ব্যাঘ্রবাহিনীর প্রদীপে তেল দিয়ে নমস্কার করে আসার দায়িত্ব বড়মা তাকে দিয়েছেন কয়েক বছর আগে। এতকাল কাজটা বড়মা-ই করতেন।

আজ বড়মা ঘুমিয়ে পড়ার পর চাবি নিয়ে নীচে নামল আতরবালা। সিঁড়ির বাঁক ঘুরতেই তার পা অবশ হল। গন্ধটা এখন জোরালো। সে নীচে নামল। তেল দিয়ে আলো নিবিয়ে প্রণাম করে আবার ওপরে উঠতে যেতেই পাশ দিয়ে কেউ দ্রুত বেরিয়ে গেল। জায়গাটা প্রায়-অন্ধকার বলে মুখ দেখতে পায়নি আতরবালা। কিন্তু এই মেয়েছেলের শরীর বেশ ভারী। এ বাড়ির শরিকদের ঘরে যে সব মেয়ে কাজ করে তাদের একজন হবে। এত দ্রুত চলে গেল কেন? আতরবালা সন্দিগ্ধ মন নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে বাঁকটায় গেল। গন্ধরাজের সদর দরজা আধখোলা। আলো আসছে ভেতর থেকে, সেই সঙ্গে গন্ধ। পনেরো বছর বাদে পা বাড়াল আতরবালা।

বাইরের ঘরে কেউ নেই। গন্ধটা যেন তার রক্তের প্রতিটি কণায় ছোবল মারছে। দ্বিতীয় ঘরের খাটে শুয়ে নলে তামাক টানছে গন্ধরাজ।

কে এসেছিল?

প্রশ্নটা শুনে তড়াক করে উঠে বসল গন্ধরাজ। ধীরে ধীরে হাসি ফুটল, কী সৌভাগ্য। সত্যি দেখছি না স্বপ্ন?

কে এসেছিল?

কেউ না। কেউ আর আসে না। বয়স হয়ে গেছে, এক কোণে পড়ে আছি।

বিশ্বাস করি না।

ওইটে আমার ওপর ঈশ্বরের অভিশাপ। কাউকে বিশ্বাস করাতে পারি না। হাসল গন্ধরাজ, এ বাড়ির মাস্টারনি হুকুম দিয়েছিল এখানে না আসতে, তা এতকাল বাদে সেই হুকুম বদলাল নাকি?

না। বদলায়নি। সত্যি কেউ আসেনি?

আচ্ছা, কেউ না এলে অবস্থার কোনও পরিবর্তন হবে?

কেউ এলে কথাটা বলতাম না।

কী কথা?

যেটা বলতে এসেছিলাম।

গন্ধরাজ উঠে দাঁড়াল, না গো, কেউ আসেনি।

আতরবালা তাকাল। তারপর কিন্তু কিন্তু করে বলল, আমার বয়স হয়েছে, চুলে পাক ধরেছে। বড়মা চলে গেলে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমার কী হবে?

ও বুড়ি নাকি আমেরিকায় চলে যাচ্ছে?

জানি না। সবাইকে বলে মা ব্যাঘ্রবাহিনীর সেবার দায়িত্ব আমাকে দেবে?

মা ব্যাঘ্রবাহিনী কেন? খাপ করে আতরবালার নিতম্বে পাঁচ আঙুল রাখল গন্ধরাজ, আমি তো আছি।

আঃ। কী হচ্ছে? আমার বয়স হয়েছে। বিড় বিড় করল আতরবালা।

এই বয়সে আর জল মেশানো দুধ খেতে ভাল লাগে না। এখন চাই জমাট দুধ। কনডেন্সড মিল্ক। মরে যায়নি কিছু, শুধু ঘুমিয়ে পড়েছে। তুমি রাজি থাকলে আমি ঘুম ভাঙিয়ে দেব।

.

সেই রাত্রে রায়বাড়ির লোক প্রচণ্ড শব্দে জেগে উঠল ঘন ঘন বোমা ফাটছে। কারা খিস্তি করে বোমা ফাটাচ্ছে। রায়বাড়ির কেউ দরজা খুলল না। শুধু পাঁড়েজি একটা লাঠি মাথার ওপর উচিয়ে বেরিয়ে এল বাইরে। তার শীর্ণ জরাগ্রস্ত শরীর থেকে গালাগালি ছিটকে বের হচ্ছিল। মাঝে মাঝেই সে চিৎকার করছিল, জয় মা ব্যাঘ্রবাহিনী কি! ।

যারা এসেছিল তারা হায়েনার মতো হাসতে হাসতে ফিরে গেল।

.

২৮.

বিষ্ণুপ্রসাদের সঙ্গে চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল সায়নের। যে কথাগুলো সে কখনও ভাবেনি, শোনেনি, তা নতুন করে ভাবতে শুরু করল। পাঙ্খাবাড়ির রাস্তা থেকে রোজ দুপুরের পরে বিষ্ণুপ্ৰসাদ চলে আসত নিরাময়ে। রাস্তার ওপাশে খাদের ধারে পাথরের ওপর বসে গল্প করত ওরা।

আলোচনার বিষয়বস্তু অনেকটা এইরকম। তিনশো বছর আগেও এখানে বাঙালিরা আসেনি। প্রথম থেকেই যেসব পাহাড়ের মানুষ এই অঞ্চলে বাস করত তাদের বলা হয়েছে লেপচা অথবা ভোট। নেপালিরা এসেছে ব্রিটিশদের হাত ধরে। বাঙালিরা তারও পরে। কিন্তু এসব ইতিহাস। বর্তমানে এই পাহাড় ভারতবর্ষের একটা অংশ। এই সত্য এখন মেনে নিতে পারছে না কিছু মানুষ।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলেছিল, এক হাজার বছর আগে বাঙালি বলে কোনও জাত ছিল না। বাঙালিদের নিজেরই অস্তিত্ব যখন মেলানো মেশানো তখন তাদের সঙ্গে পাহাড়কে জুড়ে দেওয়া হল কেন?

সায়ন জিজ্ঞাসা করেছিল, ওয়েস্টবেঙ্গল মানে বাঙালির রাজ্য এ কথা ভাবছ কেন? বাঙালি ছাড়াও অনেক ভাষাভাষী মানুষ এখানে আছে।

তারা মাইনরিটি। এ কথা অস্বীকার করতে পারো?

অস্বীকার করা যায় না। সায়ন মাথা নাড়ল।

বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল, প্রথমে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ধর্মঘটের আন্দোলন, বনধ-এর আন্দোলন। তারপর শুরু হল বোমাগুলির লড়াই। দাবিটার পেছনে যুক্তি ছিল বলে আজ চেয়ারম্যানের হাতে এত ক্ষমতা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছে ইন্ডিয়া এবং ওয়েস্টবেঙ্গল গভর্নমেন্ট। কিন্তু আমার আপত্তি এই গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন নিয়ে। গোখা মানে কী? ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীতে নেপালের কিছু মানুষ চাকরি নিয়েছিল। ওদের গোখা বলা হত। তাদের নামে এত বড় একটা আন্দোলনের নাম হতে পারে না। মজার কথা হল এই আন্দোলন সিকিমে হয়নি, ভুটানে হয়নি। কিন্তু মেঘালয়, মণিপুরে যেসব নেপালি আছেন তাঁদের কাছে আবেদন করা হয়েছে। পাহাড়ের নীচে ডুয়ার্সের নেপালিরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু ক্রমশ সব যেন থিতিয়ে আসছে। পাহাড়ের মানুষ এখন কিছুটা বিভ্রান্ত। কোনও এক বিশেষ নাম ব্যবহার না করে যদি স্লোগান দেওয়া হত পাহাড় পাহাড়িদের জন্যে তাহলে মানুষ অনেক বেশি একাত্ম অনুভব করত।

সায়ন হাসল, তাতে কী লাভ হত?

বিষ্ণুপ্ৰসাদ অবাক হল, তার মানে? আমাদের মনে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে, আমরা পরাধীন। যারা আমাদের ভাষা বলে না, আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের সম্পর্ক নেই তারা আমাদের শাসন করছে।

কিন্তু এই ভাবনা কি বিচ্ছিন্নতাবাদী ভাবনা নয়?

যুক্ত হলে তবে বিচ্ছিন্ন শব্দটা ব্যবহার করা যায়। সাউথ ইন্ডিয়ায় যাও, সেখানে হিন্দি ঢুকতে দেওয়া হয়নি। হিন্দি ছবি, হিন্দি সিরিয়াল সেখানে পাত্তা পাচ্ছে না। আমাকে একজন বলেছে একটা বড় কোম্পানি তাদের জিনিসের বিজ্ঞাপন টিভিতে দেখায় বোষের স্টারকে মডেল করে হিন্দিতে। কিন্তু সাউথে সেই বিজ্ঞাপনে থাকে তামিল তেলুগু স্টার, ভাষা থাকে ওখানকার। এটা বিচ্ছিন্নতাবাদ নয়?

তাহলে তুমি চেয়ারম্যানকে সমর্থন করছ না কেন?

কারণ ক্রমশ মনে হচ্ছে এই ভদ্রলোক তাঁর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে পারেননি। দলের লোকদের মন রাখতে সমঝোতা করে চলেছেন। এখন শুনছি এই ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিক আদালতে নিয়ে যাচ্ছেন উনি। তার মানে আরও বেশি দিনের জন্যে ঝুলে যাবে ব্যাপারটা।

তোমরা স্বাধীনতা চাও?

হ্যাঁ। যে রকম স্বাধীনতা আমেরিকার রাজ্যগুলি পেয়েছে।

ও, হ্যাঁ। ইউনাইটেড স্টেটস অফ ইন্ডিয়া।

এ ছাড়া কোনও উপায় নেই।

ঘরে বসে কথাগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছে সায়ন। স্বাধীনতার পর যখন সংবিধান তৈরি করা হয়েছিল তখন মানুষের মনে দেশপ্রেম ছিল। ভারত আমার মা, আমরা সবাই ভারতবর্ষের মানুষ এই ভাবনা উত্তেজনা সৃষ্টি করত। আমাদের মধ্যে যত পার্থক্য থাকুক না কেন ভারতবাসী হিসেবে আমরা এক এই ভাবনাটাই প্রবল ছিল। যাঁরা সংবিধান তৈরি করেছিলেন তাঁরা দেশপ্রেমিক ছিলেন, কিন্তু নগ্ন বাস্তবটাকে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনপুরুষ আগে তাদের রায়বাড়ির বড়কর্তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি পরবর্তী প্রজন্ম আর একান্নবর্তী থাকবে না। তিনি বাড়ি তৈরি করেছিলেন সবাই যাতে মিলেমিশে একসঙ্গে থাকতে পারে সেইভাবে। কিন্তু বাস্তব যখন পরবর্তী প্রজন্মকে বাধ্য করল আলাদা হতে তখন বাড়িটার গঠন ব্যবহারের পক্ষে সাহায্য করছিল না। প্রত্যেকটা শরিকের জন্য আলাদা বাথরুম রান্নাঘর তৈরি করতে হল গোঁজামিল দিয়ে। জায়গায় কুলোচ্ছিল না আর।

সংবিধান যাঁরা তৈরি করেছিলেন তাঁরা এ কথা ভাবেননি। ভারতবর্ষকে একত্রিত করতে যে আবেগের উপর নির্ভর করেছিলেন তা এখন বাসি হয়ে গিয়েছে। এখনও যদি নতুন সংবিধান লেখা যেত যাতে ভাষাভিত্তিক রাজ্যগুলোকে প্রচুর স্বাধীনতা দিয়ে প্রতিরক্ষা এবং অর্থের অর্ধাংশ কেন্দ্রের হাতে রাখা হত তাহলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যেত।

মায়ের চিঠি এসেছে। মা লিখেছে রায়বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাড়ির সামনের লনে নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠবে। সেখানে প্রত্যেক শরিক ফ্ল্যাট পাবে। সেখানে উঠে যাওয়ার পর পুরনো বাড়িটাকে ভেঙে ফেলে নতুন বহুতল বাড়ি তৈরি করবে প্রমোটার। এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। এই বাড়ি ভেঙে ফেলা হবে, সকলের মন খুব খারাপ হয়ে আছে। সামনের মাসে যখন সায়ন আসবে তখন নিজের চোখে এসব দেখতে পাবে। সদানন্দর সঙ্গে কথা হয়েছে। ও প্রথমে পাহাড়ে যেতে চাইছিল না কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। সদানন্দ গিয়ে সায়নকে নিয়ে আসবে।

চিঠি পড়ার পরেই বিষ্ণুপ্ৰসাদের মুখ মনে পড়ল। রায়বাড়ির মানুষজন যে সমাধানের পথ বেছে নিয়েছে তা দুঃখজনক হলেও মেনে না নিয়ে উপায় নেই। কথাটা ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারছেন না কেন?

শেষ পরীক্ষার রিপোর্ট খুব ভাল কঙ্কাবতীর। হিমোগ্লোবিন কয়েক দিন ধরে এক জায়গায় স্থির হয়ে আছে যা বিপদসীমার নীচে। মিসেস অ্যান্টনি ওঁকে নীচে নামিয়ে আনলেন। বললেন, এখন হাঁটাচলা করো। চারপাশে ঘুরে বেড়াও। তবে কষ্ট হবে এমন কাজ কখনও কোরো না।

কঙ্কাবতী লজ্জা পাচ্ছিল। সে যে সুস্থ হয়ে উঠছে এটা নিজের শরীর থেকেই বুঝতে পারছিল। মিসেস অ্যান্টনিকে জিজ্ঞাসা করল, কবে বাড়ি যেতে পারব?

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, সেটা ডাক্তার বলবেন।

এখন তো আমার কোনও অসুখ নেই!

মিসেন অ্যান্টনি হাসলেন।

ডাক্তার অফিস থেকে বেরিয়ে আসতেই ওঁদের দেখতে পেলেন। মিসেস অ্যান্টনি তাঁকে কঙ্কাবতীর প্রশ্নটা জানালেন।

ডাক্তার বললেন, ভাল হয়ে গেলে এখানে কেউ থাকতে চায় না, বুঝলেন মিসেস অ্যান্টনি। এখানকার রান্না এত খারাপ, থাকবে কেন?

কঙ্কাবতী মাথা নাড়ল, না, না। আমার স্কুল কামাই হচ্ছে।

সে তো নিশ্চয়ই। আমি ভাবছি এক সপ্তাহ তুমি এখান থেকে স্কুলে যাতায়াত করবে। যদি দ্যাখো কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তখন বাড়ি চলে যেও। কি, রাজি আছ?

এখান থেকে স্কুল অনেক দূরে।

জানি। আমি তোমার কারলিফটের ব্যবস্থা করে দেব। হাঁটতে হবে না।

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। মুখ নামাল কঙ্কাবতী।

ডাক্তার তাকালেন। তাঁর বুক টনটন করে উঠল। এগিয়ে এসে কঙ্কাবতীর মাথায় হাত রাখলেন, বাপ-মাকে ধন্যবাদ জানাতে নেই। তুমি কোনও ভাল কাজ করলে আমি সবচেয়ে আনন্দ পাব।

হাই ডক্টর।

চিৎকার শুনে গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন ডাক্তার। সিমি দাঁড়িয়ে আছে। তার দু হাতে দুটো বাজারের থলে।

কেমন আছ সিমি?

ভাল, খুব ভাল। সায়ন কোথায়?

ওর ঘরে আছে বোধহয়।

ঠিক আছে, ওকে জানিয়ে দেবেন আমি আর এখানে নেই।

এখানে নেই মানে? কোথায় গিয়েছ?

ওপরে মিসেস ডিসুজা ছিলেন, মনে আছে? হ্যাঁ, তাঁর খালি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছেন এলিজাবেথ। আমি ওঁর সঙ্গে আছি। সিমি হাসল। তারপর বাজারের ব্যাগ দুটো হাত বদল করল।

তাই? এলিজাবেথ তাহলে ওখানেই আছেন?

হ্যাঁ। আপনার কাছে এর মধ্যেই আসবেন। শি ইজ ফ্যান্টাস্টিক। আজ দুপুর থেকে আমরা কাজ শুরু করব।

কী কাজ?

এলিজাবেথ ঠিক করেছেন এই পাহাড়ের পাঁচটা গ্রাম বেছে নেবেন। আজ থেকে আমরা সার্ভে শুরু করব। প্রত্যেক গ্রামের প্রতিটি পরিবারের মান্থলি ইনকাম কত, কজন মেম্বার এইসব তথ্য নেব। আপনি তো জানেন এরা খুব গরিব। অর্ধেক দিন স্কোয়াশ খেয়ে কাটায়। এলিজাবেথ এদের বিবরণ দিয়ে আমেরিকার বড়লোকদের কাছে আবেদন করবে। তাঁদের ডোনেশন নিয়ে একটা ফান্ড তৈরি করা হবে। সেই ফান্ড থেকে গ্রামের লোকদের দিয়ে নানা রকম ব্যবসা করানো হবে যাতে কেউ আর গরিব না থাকে। ওঃ অনেক কথা বলে ফেললাম। তাহলে চলি! আরে! ওই তো সায়ন। ওপরের দিকে মুখ তুলল সিমি, সব শুনলে তো! একদিন চলে এসো আমাদের ওখানে। সকাল নটা পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে পাবে। বাই! হাত নেড়ে সিমি চলে গেল।

ডাক্তার মাথা নাড়লেন। কঙ্কাবতী তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, কী ভাল!

হ্যাঁ। কোথাকার এক মহিলা, যিনি অভাব কী তা কখনও জানতেন না, স্রেফ কৌতূহলে মিস্টার ব্রাউনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেললেন। এই জন্যে বলে সত্যি ঘটনা উপন্যাসের চেয়েও বিস্ময়কর। কিন্তু এই মেয়েটা, অনেকেই ওর চালচলনের জন্যে পছন্দ করত না, হঠাৎ কীরকম বাঁক নিয়ে নিল। ডাক্তার মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন।

কঙ্কাবতী বাইরে বেরিয়ে এল। ঠাণ্ডা আছে। তার গায়েও যথেষ্ট গরম জামা। ভাল লাগছিল কঙ্কাবতীর। এই নীল আকাশ, দূরের পাহাড় আর সবুজ গাছপালার দিকে তাকিয়ে তার বলতে ইচ্ছা করছিল, আমি ভাল হয়ে গেছি। তোমরা এখন থেকে আমাকে ভাল রেখো।

একরাশ মেঘ উড়ে এল ওপর থেকে। ধীরে ধীরে তারা কঙ্কাবতীর চুল ছুঁয়ে চলে গেল ওপাশে। কঙ্কাবতী দেখল সায়ন বেরিয়ে আসছে নিরাময় থেকে। সে চাদরটাকে আরও ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে হাসল।

তোমাকে খুব ভাল দেখাচ্ছে আজ।

কঙ্কাবতী নতুন করে হাসল, ডাক্তারবাবু আমাকে স্কুলে যেতে দেবেন।

তাই? বাঃ! খুব ভাল হল।

তুমি কেমন আছ?

একদম ভাল। ভাবছি আজ এলিজাবেথের বাড়িতে যাব।

সেটা কত দূরে?

অনেকটা ওপরে, চার্চের কাছে। হাত তুলে ওপরের পাহাড় দেখাল সায়ন।

সেদিকে তাকাল কঙ্কাবতী, শরীর খারাপ হবে না তো?

দুর। ওসব নিয়ে ভাবি না।

কেন?

পৃথিবীতে সবাই কত কী ভাল কাজ করছে। অসুখ-অসুখ বলে যদি হাত গুটিয়ে বসে থাকি তাহলে বেঁচে থাকার কোনও মানে আছে?

তুমি ভাল কাজ করতে চাও?

নিশ্চয়ই।

কিন্তু অসুস্থ হয়ে গেলে সেই কাজটা শেষ করবে কী করে?

হেসে ফেলল সায়ন, আমার যে-অসুখ হয়েছে সেটা কখন ফিরে আসবে তা ডাক্তার আঙ্কলও বলতে পারেন না। তাই ভয়ে ঘরে বসে থাকার কোনও যুক্তি নেই। তোমার মায়ের কী খবর?

কঙ্কাবতীর মুখে ছায়া ঘনাল, মায়ের খুব বিপদ।

কেন?

স্কুলের চাকরিটা চলে গিয়েছে। কোথাও কাজ পাচ্ছে না মা।

তাহলে কী হবে?

আমি ভাবছি বাড়ি ফিরে গিয়ে বাচ্চাদের পড়াব।

সায়নের চোখের সামনে মিস্টার ব্রাউনের মুখ ভেসে উঠল। অনেকদিন ওই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়নি। মিস্টার ব্রাউনকে যদি কঙ্কাবতীর মায়ের জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে বলা যায় তাহলে তিনি কি চেষ্টা করবেন না? সে জিজ্ঞাসা করল, তোমার মা কখন আসবেন?

বিকেলে।

তুমি তোমার মাকে খুব ভালবাস, না?

কঙ্কাবতী আকাশের দিকে তাকাল, ভালবাসি, তবে

তবে কী? বাবাকে ভালবাসতে?

হ্যাঁ। বাবার কথা খুব মনে পড়ে। আমার বাবা মাকে খুব যন্ত্রণা দিত। মদ খেয়ে ঝামেলা করত মায়ের সঙ্গে। কিন্তু আমাকে দেখলেই চুপ করে যেত। বাবা আমাকে একটা পারফিউম দিয়েছিল।

তাহলে বাবাকেই তুমি খুব ভালবাস?

কী জানি। তবে আর একজন ছিলেন—

আর একজন? কে হন তোমার?

তিনি আমার চোখ খুলে দিলেছিলেন। নবজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তাহলে তিনি আমাকে তাই দিয়েছেন। তিনি একজন বাঙালি।

ও! কোথায় থাকেন তিনি?

এই পাহাড়েই ছিলেন। কিন্তু ওরা ওঁকে বাধ্য করেছিল পাহাড় ছেড়ে চলে যেতে। ওঁর জন্যে আমার খুব কষ্ট হয়। তিনি আমার চেয়ে অনেক বড়, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, বয়সে। আমার বাবার চেয়েও বড়। কিন্তু আমাকে খুব ভালবাসতেন। আমিও। মাথা নামাল কঙ্কাবতী।

উনি কোথায় গিয়েছেন জানো না?

না। একটা ঠিকানা দিয়ে গিয়েছিলেন। কলকাতার। বলেছিলেন সেখানে চিঠি লিখলে উনি খবর পাবেন।

তুমি লেখোনি?

না।

এই অসুখের কথা লেখা উচিত ছিল।

না। যাকে ভালবাসি তাকে কষ্ট দিতে ইচ্ছে করে না।

সায়ন অবাক হয়ে গেল। এতদিন সে জানত মানুষ যাকে ভালবাসে তার কাছেই সব সুখ এবং দুঃখের কথা বলে। কিন্তু কঙ্কাবতীর কথা শুনে মনে হল এই কথাটাই ঠিক। যাকে ভালবাসি, তাকে কেন দুঃখ দেব? আমার কষ্টের কথা জানলে সে-ও তো কষ্ট পাবে।

কঙ্কাবতী বলল, আমি যাই।

শরীর খারাপ লাগছে?

না।

বুঝেছি। এসব কথা তুলে তোমার মন খারাপ করে দিয়েছি।

না, না।

একটা কথা, এই বাঙালি ভদ্রলোক তোমাকে বাংলা শিখিয়েছিলেন?

হ্যাঁ। ভাবতেও শিখিয়েছিলেন।

যেমন?

গাছ থেকে যে পাতা পড়ে তার শব্দ কেমন? বিকেলবেলায় ঘাসে ভোরের শিশিরের দাগ খোঁজা উচিত কি না। এসব নিয়ে কখনও ভাবতাম না। যখন কেউ খুব প্রিয় হয়ে যায় তার মধ্যে ঈশ্বর এসে যান।

কী রকম?

তুমি গীতবিতান পড়েছ?

গীতবিতান? দেখেছি। ভাল করে পড়িনি।

দেখবে গীতবিতানের কতগুলো পর্ব আছে। তার মধ্যে পূজা আর প্রেম দুটো পর্ব। ভালবাসলে এই দুটো এক হয়ে যায়। পূজায় ঈশ্বরকে উদ্দেশ করে যা গাওয়া তা বিশেষ মানুষের উদ্দেশেও গাওয়া যেতে পারে। আবার প্রেম পর্বে বিশেষ মানুষকে যা বলা তা ঈশ্বরকেও বলা যেতে পারে। এইসব। কঙ্কাবতী হাসল।

সায়নের চোখ বিস্ফারিত, একটি নেপালি মেয়ের মুখে এইসব কথা সে শুনবে কল্পনাও করেনি। সে জিজ্ঞাসা করল, তুমি গান জান?

না, না। মাথা ঝাঁকাল কঙ্কাবতী।

তোমাকে বন্ধু বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে। তুমি একটা গান গাইবে?

আমি ভাল গাইতে পারি না।

তবু।

কঙ্কাবতী খাদের দিকে তাকাল। হাওয়ায় তার খুচরো চুলগুলো উড়ছিল। সে মৃদু গলায় গান ধরল, সব যে হয়ে গেল কালো/ নিভে গেল দীপের আলো/আকাশপানে হাত বাড়ালেম কাহার তরে। এই অবধি গেয়ে আচমকা থেমে গেল সে। কঙ্কাবতীর মুখ দেখতে পাচ্ছিল না সায়ন। পেছন থেকে ওর মাথা ঝোঁকানো শরীর, দলা পাকানো কুয়াশা, আকাশে ছাপ মেরে থাকা পাহাড় যেন একটা একটা ফ্রেমে দেখতে পেল সে। এই গান সে অনেকবার শুনেছে। মায়ের মুখে, দেবব্রত বিশ্বাসের ক্যাসেটে। সে গাইবার চেষ্টা করল, সকালবেলায় চেয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছ তুমি একি/ ঘর ভরা মোর শূন্যতারি বুকের পরে।

গাইতে গাইতে সায়ন শুনতে পেল কঙ্কাবতী গলা মিলিয়েছে। গান শেষ হতেই ঘুরে দাঁড়াল কঙ্কাবতী। ওঁর ঠোঁটে হাসি, চোখে জল।

সায়ন অপরাধীর মতো মুখ করে বলল, আমি গাইতে জানি না।

কঙ্কাবতী কথা বলল না। ধীরে ধীরে নিরাময়ের দিকে চলে গেল। ভাল লাগল সায়নের। এ এক অদ্ভুত ভাল লাগা। বুকের ভেতরটা কী রকম টান টান হয়ে গেল। যেন হাজার হাজার সেতার বেজে ওঠার জন্যে তৈরি। সে ঘাড় ঘোরাল, কঙ্কাবতীকে আর দেখা গেল না।

চড়াই ভেঙে এগোতেই ভুটো ডেকে উঠল। ভুটো আজ একা, ওর বান্ধবী নেই। দূরে গাছের ধারে বাঁধানো দেওয়ালের ওপর ম্যাথুজ বসে আছে। হাত নাড়ল তাকে দেখে। তারপর নিজেই নেমে এল, কেমন আছ?

ভাল। তুমি?

আমি এতদিন ভাল ছিলাম না, এখন ভাল আছি।

কী রকম?

গলা নামাল ম্যাথুজ। এলিজাবেথ মেমসাহেবের সঙ্গে আমার আলাপ হয়ে গেছে। মিস্টার ব্রাউনই আলাপ করিয়ে দিয়েছেন।

তার সঙ্গে ভাল থাকার কী সম্পর্ক?

উনি গ্রামের মানুষের উপকার করতে চান। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। পাহাড়ে যারা বিফ খায় আমি তাদের সস্তায় বিফ দেব। উনি টাকা দেবেন, আমি কোনও লাভ রাখব না।

তাহলে তোমার পরিশ্রম বৃথা যাবে!

দুর। তুমি বুঝতে পারছ না। লাভ করে আমার কী হবে? মনের শান্তি পাব! একটা মানুষ সেই আমেরিকা থেকে এসে এখানে আমাদের উপকার করছেন আর আমি তাঁকে সাহায্য করব না? সেটাই তো আমার শান্তি।

সিমিও ওঁর সঙ্গে কাজ করছে।

আমার তো সেটাই ভয় ছিল। সিমি যদি আপত্তি করে আর মেমসাহেব সেটা মেনে নেন তাহলে তো আমি কাজটা করতে পারব না। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে গিয়েছি, বুঝলে!

কেন?

সিমি আপত্তি করেনি।

বরং যেসব গ্রামের মানুষদের ওরা চেনে না সেইসব গ্রামে আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য মেমসাহেব সিমিকে নির্দেশ দিয়েছেন, ও মেনে নিয়েছে।

তার মানে তুমি আর সিমি একসঙ্গে কাজ করবে?

ম্যাথুজ হাসল। পরিতৃপ্ত হাসি, আর কী চাই বলো?

এইসময় মিস্টার ব্রাউন বেরিয়ে এলেন, হ্যালো সায়ন, হ্যালো ম্যাথুজ, যিশু তোমাদের মঙ্গল করুন।

ম্যাথুজ বলল, আমার মনে হল আপনি ঘুমোচ্ছন তাই এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আপনাকে আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

কী জন্য?

এলিজাবেথ মেমসাহেব আমাকে তাঁর কাজে যোগ দিতে বলেছেন।

খুব ভাল কথা।

এবং সিমি সেটা মেনে নিয়েছে।

বাঃ, আরও ভাল কথা। যিশু তোমাদের উপকার করবেন।

থ্যাঙ্কু। আচ্ছা চলি।

যাচ্ছ যাও। কিন্তু এই দোকানটা কি আর খুলবে না?

কী করে খুলব বলুন। গ্রামের গরিব মানুষদের জন্যে মাংস দিতে হবে। আপনি তো ইচ্ছে করলে চিকেন মটন খেতে পারেন। তাই না? হেসে হাত নেড়ে বিদায় নিল মাথুজ।

কী খবর বলো? মিস্টার ব্রাউন গেট খুলে দিলেন।

ভাল। আমি সামনের মাসে কলকাতা যাচ্ছি।

খুব ভাল খবর।

আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?

নিশ্চয়ই। বলো কী করতে পারি তোমার জন্যে?

আমার জন্যে নয়। আমাদের ওখানে একটি মেয়ে আছে, কঙ্কাবতী। মেয়েটি খুব ভাল। ওর অসুখ এখন অনেকটা ভাল। ওর মা চাকরি করত একটা স্কুলে। সেখানে পার্টির নেতার ইচ্ছে পূর্ণ না করার জন্যে বেচারার চাকরি গিয়েছে। ওঁর জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন?

কী ধরনের চাকরি?

আমার মনে হয় স্কুলে উনি টিচার ছিলেন না। সাধারণ হেল্পার ধরনের কাজ করতেন।

দ্যাখো, আমি তো বাড়ি থেকে বের হই না বললেই চলে। তবু তুমি যখন বলছ–। পার্টি নেতার জন্য চাকরি চলে গেছে?

হ্যাঁ। মিসেস অ্যান্টনি সেইরকমই বললেন।

কী অন্যায় কথা। একটি ছেলে, কী নাম যেন, হ্যাঁ, গণেশ, খারাপ ব্যবহার করেছিল ডক্টরের সঙ্গে। ডক্টর চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করে ঘটনাটা বলেছিলেন। সে এসেছিল তো ওই মেয়েটিকে ভর্তি করাতে। তাই না?

হ্যাঁ। কিন্তু এদের সঙ্গে সেই ছেলের কোনও সম্পর্ক নেই।

আমি দেখছি। তাহলে কাল শহরে যেতে হয়।

আপনি ওদের অনেক উপকার করবেন।

আমি তো কিছুই করতে পারি না। যিশু যদি ইচ্ছে করেন তাহলে সব হয়ে যাবে।

সায়ন হাসল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন মিস্টার ব্রাউন। হঠাৎ তাঁর ঠোঁট কাঁপতে লাগল। সায়ন জিজ্ঞাসা করল, মিস্টার ব্রাউন, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

মিস্টার ব্রাউন চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলেন। তাঁর শরীর টলছিল। সায়ন এগিয়ে গিয়ে তাঁকে

জড়িয়ে ধরল, মিস্টার ব্রাউন!

বৃদ্ধের কপালে ঘাম ফুটে উঠছে। ডান হাতে বুক আঁকড়ে ধরেছেন তিনি কিন্তু চোখের দৃষ্টি সরাচ্ছেন না। সায়ন কোনওমতে ওঁকে ভেতরের ঘরে নিয়ে গেল। ইশারায় মিস্টার ব্রাউন যিশুর ঘর দেখিয়ে দিলেন। সেখানে নিয়ে যেতে কার্পেটের ওপর শুয়ে পড়লেন মিস্টার ব্রাউন।

সায়ন বলল, আপনি একটু একা থাকুন, আমি এখনই ডাক্তার আঙ্কলকে খবর দিচ্ছি।

সায়ন উঠে দাঁড়াতে যেতেই তার হাত চেপে ধরলেন মিস্টার ব্রাউন। বিড় বিড় করে বললেন, আমি জানি তুমি কে! আমাকে একটু দয়া করো। আমি যদি কারও ক্ষতি করে থাকি তাহলে তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

অবাক হয়ে গেল সায়ন, এসব আপনি কী বলছেন?

ঠিক বলছি। উঃ, কী কষ্ট! ওখানে যার মূর্তি সে কখনও কথা বলে না। কিন্তু তোমার মধ্যে তাঁকে একটু আগে দেখতে পেলাম। তুমি আমার ভগবান, তুমি আর আমায় চোখে ধুলো দিতে পারবে না যেশাস। কথা বলতে বলতে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল মিস্টার ব্রাউনের। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেটের কাছে যেতেই দেখতে পেল বিষ্ণুপ্ৰসাদ নীচ থেকে উঠে আসছে। সে চেঁচিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি ডাক্তার আঙ্কলকে ডেকে আনো। মিস্টার ব্রাউন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি। কয়েক সেকেন্ড বুঝতে সময় নিল বিষ্ণুপ্রসাদ, তারপর দৌড়ে নীচে নেমে গেল।

যিশুর ঘরে ফিরে এল সায়ন। কার্পেটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে আছেন মিস্টার ব্রাউন। চোখ বন্ধ কিন্তু বুক ওঠানামা করছে। পাশে হাঁটু মুড়ে বসে সায়ন বুকে হাত রাখল, মিস্টার ব্রাউন!

কোনও সাড়া নেই। সায়ন কী করবে বুঝতে পারছিল না। একটি মানুষ হঠাৎ পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এই অবস্থায় কী করা যেতে পারে? ওর অনুমান হল মিস্টার ব্রাউনের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ভদ্রলোক যদি মরে যান? সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল সায়নের। সে যিশুর দিকে তাকাল। মোমবাতির আলো এসে পড়েছে যিশুর মুখে। হঠাৎই, যা কোনওদিন সে করেনি, এমনকী মা ব্যাঘ্রবাহিনীর সামনেও নয়, তাই করল সায়ন। চোখ বন্ধ করে বলল, যিশু, ওঁকে বাঁচিয়ে দাও।

ডাক্তার এসে গেলেন, পেছনে বিষ্ণুপ্রসাদ। প্রথমে পালস পরে স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। তারপর ব্যাগ খুলে একটা ইনজেকশন বের করে ওষুধটা মিস্টার ব্রাউনের শরীরে ঢুকিয়ে দিলেন। মিস্টার ব্রাউনের চোখ একটু কেঁপে উঠল। ডাক্তার বললেন, না, হার্ট অ্যাটাক নয়। কিন্তু ওঁকে এখনই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। আমি গাড়ি বের করছি, তোমরা একটু হেল্প করো।

এইসময় মিস্টার ব্রাউন চোখ খুললেন।

ডাক্তার জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন লাগছে?

ফাইন! খসখসে গলায় বললেন মিস্টার প্রধান। তারপর উঠে বসার চেষ্টা করলেন। ডাক্তার বাধা দিলেন, না। আপনি এখন উঠবেন না। আমি আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।

হাত নেড়ে না বললেন মিস্টার ব্রাউন, তারপর চোখ ঘুরিয়ে সায়নকে দেখতে পেলেন। হাসি ফুটে উঠল তাঁর মুখে, থ্যাঙ্ক ইউ।

ধন্যবাদ কী কারণে বুঝতে পারল না সায়ন।

ডাক্তার আবার পরীক্ষা করলেন, আপনার একটা ই সি জি করা দরকার। এখনই। কি খেয়েছিলেন?

কিছু খাওয়া হয়নি। শুধু আমার কোটাটা শেষ করেছিলাম।

এম্পটি স্টমাকে থাকায় উইন্ড ফর্ম করেছে। তবু সাবধান হওয়া দরকার মিস্টার ব্রাউন। হাসপাতালে চলুন, ওখানকার ডাক্তাররা যদি বলেন তাহলে না হয় ফিরে আসবেন।

এবার খানিকটা জোর করেই উঠে বসলেন মিস্টার ব্রাউন, আমার আর কোনও আফসোস নেই। যা পাওয়ার তা আমি পেয়ে গেছি ডক্টর। আমাকে আমার খাটে নিয়ে চলুন।

অগত্যা তাই করা হল। ডাক্তার বিষ্ণুপ্ৰসাদকে বললেন, তুমি যদি একটা কাজ করো তাহলে ভাল হয়।

বলুন। বিষ্ণুপ্ৰসাদ বলল।

ডক্টর তামাংকে এখানে আসতে বলো। মিস্টার ব্রাউনের নাম শুনলে উনি নিশ্চয়ই চলে আসবেন। ওঁর চেম্বার কোথায় জানো? বিষ্ণুপ্ৰসাদ মাথা নাড়ল।

ডাক্তার বললেন, বাড়িতে রাখা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু জোর করে নিয়ে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তুমি এক কাজ করো, বড়বাহাদুরকে বলল, স্ট্রেচার নিয়ে এখানে চলে আসতে।

আমাদের ওখানে নিয়ে যাবেন?

হ্যাঁ। এখানকার থেকে ভাল থাকবেন।

মিস্টার ব্রাউনকে নিরাময়ে নিয়ে আসা হল। একতলার একটি খালি ঘরের বেডে শুইয়ে দেওয়া হল তাঁকে। ডাক্তার একটা ওষুধ জলে গুলে খাইয়ে দিলেন। মিস্টার ব্রাউন বালিশে মাথা রেখে বললেন, তাহলে আমরা এখন একই বাড়িতে আছি, কী বলো?

ডাক্তার তামাং এসে গেলেন কয়েক মিনিটের মধ্যেই। ঘরে ঢোকার আগে তিনি ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বললেন। তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, হ্যালো, ওল্ড বয়। মতলবটা কী? আমি ভাবছিলাম বিকেলবেলায় আপনার কাছে এসে দু পাত্র খেয়ে যাব আর আপনি এখানে শুয়ে আছেন?

আমার কিছু হয়নি। ওরা জোর করে ধরে নিয়ে এসেছে ডাক্তার।

খুব অন্যায় কথা। এখন কিছুক্ষণ কথা বন্ধ।

ডাক্তার তামাং বাক্স খুলে মেসিনপত্র বের করলেন। মিস্টার ব্রাউনের হাত-পায়ে তার লাগানো হল। ওঁর হৃৎপিণ্ডের আওয়াজের ছবি উঠল কাগজে। সেটা দেখে মুখ গম্ভীর হয়ে গেল ভদ্রলোকের। কাগজটা ছিঁড়ে এগিয়ে দিলেন ডাক্তারবাবুর দিকে।

কী দেখলে ডাক্তার। আমার আজকের কোটা এখনও শেষ হয়নি।

ওটা কাল খাবেন। মিস্টার ব্রাউন, আমার কথা শুনুন, আপনি হাসপাতালে চলুন। জাস্ট ফর এ চেক আপ।

আজ নয়, কাল যাব ডাক্তার।

ডাক্তার তামাং বেরিয়ে এলেন। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে তাঁর কথা হল। সায়ন শুনল, একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। ই সি জি ভাল নয়। এখন নড়াচড়া করাও ঠিক হবে না। ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা ছাড়া কোনও উপায় নেই। বরং হসপিটাল থেকে একজন নার্স আর অক্সিজেন আনিয়ে নেওয়া দরকার। ডাক্তারবাবু একমত হলেন।

ডাক্তার তামাং আবার ঘরে ঢুকলেন।

কী হয়েছে আমার?

নাথিং, কিছু হয়নি মিস্টার ব্রাউন। কিন্তু কোনও কথা নয়।

তাহলে আমি যিশুকে দেখলাম কেন?

যিশুকে দেখেছেন আপনি? ডাক্তার তামাং হতভম্ব।

ইয়েস। আমার ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা এগিয়ে এলেন। কাছে এলেন, অদ্ভুত ঘটনা। দেখে আমি অবাক। কিন্তু কিছু বলার আগেই তিনি সায়নের শরীরের সঙ্গে মিশে গেলেন। আর তখন, তোমাকে কী বলব, সায়নের মুখখানা কী রকম উজ্জ্বল, পবিত্র হয়ে গেল। আই হ্যাভ সিন হিম ডক্টর। সায়ন যে সাধারণ মানুষ নয় এই অনুভূতি আমার অনেক দিন থেকেই হচ্ছিল। আমার মন ভরে গেছে আজ।

মিস্টার ব্রাউন যখন কথা বলছিলেন তখন ডাক্তার তামাং তাঁকে ঘুমের ইনজেকশন দিলেন। ধীরে ধীরে কথা জড়িয়ে গেল বৃদ্ধের। ঘুমিয়ে পড়লেন মিস্টার ব্রাউন।

হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার এসে গেল। নার্সদের ইউনিয়নে খবর দেওয়া হয়েছে, তারা এখনই একজনকে পাঠাবে। নিরাময়ের যেসব মানুষ হাঁটাচলা করতে পারে তারা নেমে এসে জড়ো হয়েছে বারান্দায়।

ডাক্তার তামাং বললেন, আমি ভরসা পাচ্ছি না। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু হার্টের যা অবস্থা নাড়াচাড়া করা ঠিক হবে না।

ডাক্তার আঙ্কলকে জিজ্ঞাসা করতে শুনল সায়ন। উনি কী বলছিলেন?

ডাক্তার তামাং সায়নের দিকে তাকালেন, তোমাকে উনি খুব ভালবাসেন। ওঁর কোনও আত্মীয়স্বজন কী এই শহরে আছেন?

মাথা নাড়ল সায়ন, না বোধহয়। সিমি বলতে পারে।

সিমিকে বলো তাদের খবর দিতে।

সিমি তো মিসেস ডিসুজার বাড়িতে এলিজাবেথের সঙ্গে আছে। কাউকে সেখানে পাঠাব? এলিজাবেথ মিস্টার ব্রাউনের বন্ধু, ওঁকেও বলা উচিত। সায়ন ছোটবাহাদুরকে ডেকে কী করবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। মিসেস অ্যান্টনি সবাইকে নিজের কাজে চলে যেতে বলছিলেন।

ডাক্তার তামাং ফিরে গেলেন মিস্টার ব্রাউনের পাশে। হঠাৎ সন্দেহ হওয়ায় পালস দেখলেন। স্টেথো দিয়ে বুক পরীক্ষা করলেন। তারপর দ্রুত বুক মালিশ করতে লাগলেন। তারপর কয়েকটা ঘুষি মেরে বুকে কান পাতলেন। ডাক্তার আঙ্কলকে এগিয়ে যেতে দেখল সায়ন। তিনিও পরীক্ষা করলেন। তারপর মাথা নাড়লেন।

ডাক্তার তামাং সোজা হয়ে দাঁড়ালেন, গুড বাই মাই ফ্রেন্ড।

মিসেস অ্যান্টনি কেঁদে উঠলেন। সায়ন দেখছিল। কী প্রশান্ত মুখে শুয়ে আছেন মিস্টার ব্রাউন। এখনই হেসে বলবেন, হ্যালো মাই বয়, কেমন আছ?

হঠাৎ কাঁধে হাত পড়তেই মুখ ফেরাল সায়ন। ডাক্তার তামাং তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু যিনি বিশ্বাস নিয়ে চলে গেলেন তিনি আর পেছন ফিরে তাকাবেন না। তাই তুমি ওর জন্যে প্রার্থনা করো।

সায়ন কেঁদে ফেলল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *