হারিয়ে যাওয়া গান (Hariye Jaoar Gaan)
আমাদের সংসারে আজ একটা বিশেষ দিন। আনন্দের দিনও বলা যেতে পারত, কেমন জানি বাধোবাধো ঠেকছে। দীর্ঘদিনের নাছোড় এক সংকট থেকে মুক্তি পেতে চলেছি আমরা। সকালে হাসিখুশি মুখ নিয়ে বাজার থেকে ফিরল বাবা। দামি দামি সবজি, মাছ কিনেছে। পাটভাঙা শাড়ি পরে ফুরফুরে মেজাজে সেসব রান্না করতে বসেছে মা। চন্দনা, মানে আমার বউ, ক’দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। যদি থাকত, ওর চেহারা থেকেও এক পরত বিষাদ সরে যেতে দেখতাম। আমার হাবেভাবেও নিশ্চয়ই কিছু পরিবর্তন এসেছে। নিজে থেকে সেটা ঠাহর করা মুশকিল। আয়নার সামনে গিয়েও লাভ হবে না। আমি আয়না-আড়ষ্ট মানুষ। এক্সপ্রেশন অটোমেটিক্যালি গম্ভীর হয়ে যায়। তবে শরীরের ওজনটা আজ হঠাৎ বেশ হালকা ঠেকছে। দৃশ্যত আমি রোগা পাতলা হলেও, নিজেকে বইতে যথেষ্ট শ্রম হয়। এখন হচ্ছে না। ফ্রিজের ডালা, আলমারি খুলে ফেলছি হুড়ুম-দাড়ুম করে। কাজের ব্যাগ গোছাচ্ছি অন্য দিনের তুলনায় দ্রুত। এ-ঘর, ও-ঘর, বাথরুম চলে যাচ্ছি নিমেষে।
আমাদের ফ্ল্যাটে এমত খুশির হাওয়া নিয়ে এসেছে আমার ভাইপো। বংশের পরবর্তী প্রজন্ম। কাঁধে তুলে নিচ্ছে জগদ্দল পাথরের মতো সংসারের ওপর চেপে বসে থাকা এত দিনের একটা ভার।
ভাইপো অর্পণ থাকে ওর মামার বাড়িতে, গুয়াহাটি। আজ সকালের ফ্লাইটে এসেছে। কত লম্বা হয়ে গেছে তাতাই, নামটা এ-বাড়ির আদরের নাম। গালে কচি ঘাসের মতো দাড়ি গোঁফ। গজানোর পর থেকে কাটেনি মনে হয়। চেহারাটা আমাদের বাড়ির ঘরানার। আট বছর বয়স অবধি ছিল এই সংসারে। দাদার দৌরাত্ম্যে সেই যে বউদি চলে গেল বাপের বাড়ি, আর ফেরেনি। এত দিন পর তাতাই ফিরল। ভাইপো আমার ন্যাওটা ছিল খুব। মাতাল স্বামীর কোলে ছেলেকে ভরসা করে দিতে পারত না বউদি। আমি তাতাইকে কোলে, সাইকেলে বসিয়ে ইছাপুরের রাস্তা, মাঠ, গঙ্গার ঘাট, গাছপালা চেনাতাম। ছেলেকে কাছে টানার ব্যাপারে দাদার কোনও আগ্রহও ছিল না। একবার এমন হয়েছে, তাতাই আমার কোলে, রাস্তায় মুখোমুখি হয়েছি দাদার। তাতাইয়ের গাল টিপে দাদা বলল, বেশ মিষ্টি দেখতে হচ্ছে কিন্তু। আমার ছেলে বললে, লোকে বিশ্বাসই করবে না। তোর বলেই চালিয়ে দিস।
ফাজলামির হাসি দাদার মুখে। আমি লজ্জায়, রাগে দিশাহারা। ভাগ্যিস কথাগুলো বোঝার বয়স তাতাইয়ের হয়নি। নিজেকে সংযত রেখে দাদাকে বলেছিলাম, রাস্তায় আর ঘুরো না। এবার বাড়ি যাও।
রাতের আগে দাদা তখন বাড়ি ফিরত না। সকাল-সন্ধে টোটো কোম্পানি। বড় বড় পা ফেলে এমনভাবে হাঁটত, যেন চারদিকে কত জরুরি কাজ সব তার জন্যই থেমে আছে।
পাজামা পাঞ্জাবিতে ধুলো-কাদা লাগিয়ে রাতে টলোমলো পায়ে বাড়ির সামনে এসে গেট খুঁজে পেত না। মুখে অশ্রাব্য গালাগাল, দুনিয়াসুদ্ধু মানুষের উদ্দেশে।
বড়ছেলের ওই কাণ্ড দেখে গুটিয়ে যেত আমার নিরীহ বাবা-মা। বউদির চোখেমুখে গাঢ় হত হতাশা। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম দাদাকে।
এমনটা কিন্তু হওয়ার কথা ছিল না। আমাদের পরম শত্রুও দাদার এই পরিণতি কল্পনা করেনি। সে ছিল অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল, সদালাপী। পাড়ায়, বে-পাড়ায় সকলের খুব প্রিয়। দাদার পরিচয়ে আমরা পরিচিত হতাম। ওই যে অর্কর বাবা-মা। এ হচ্ছে সূর্য, অর্কর ভাই।
আমার নাম ‘চন্দ্র’ রাখতেও পারত বাড়ির লোক। বরাবরই আমি মুখচোরা। লুকিয়ে চুরিয়ে দেদার বদমাইশি করেছি। স্কুল-কাট মেরে সিনেমা, মেয়েদের স্কুলের সামনে ধর্না দেওয়া, বেপাড়ায় নির্জন গলিতে বন্ধুদের সঙ্গে বিড়ি ফোঁকা। হামেশাই অচেনা কোনও লোক ওই সব জায়গায় ধরত আমাকে, অ্যাই, তুই অর্কর ভাই না? দাঁড়া তোর দাদাকে বলছি, স্কুল পালিয়ে…
লোকগুলো নিশ্চিত ভাবে দাদার কানে তুলত খবরটা। সন্ধেবেলা যখন পড়া করছি, দাদা এসে চাপা গলায় (বাবা-মা যেন শুনতে না পায়) বলত, বাজে ছেলে হয়ে যাচ্ছিস ভাই। আমাদের ফ্যামিলিতে এ সব মানায় না। আর যদি কোনওদিন শুনি বাবাকে বলতে বাধ্য হব।
আবারও বখামো করেছি। দাদা কোনও দিনই বাবাকে বলেনি। পরিবারের যে মর্যাদার কথা দাদা আমায় স্মরণ করাত, তা কিন্তু কোনও মহৎ সামাজিক সম্মান নয়। পাড়ায় আমাদের আলিশান বাড়িটাই ছিল পরিপ্রেক্ষিত। দাদার কারণে সে বাড়ি বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমরা এখন ফ্ল্যাট কিনে চলে এসেছি।
আগের বাড়ির সামনের লনে শীতের রাতে ব্যাডমিন্টন খেলা হত। অ্যালসেশিয়ান ছিল আমাদের। গেটে ‘কুকুর হইতে সাবধান’ বোর্ড। সব মিলিয়ে পাড়ার লোকের ধারণা ছিল, আমরা বংশধারায় বড়লোক। আসলে তা নয়। শহরতলিতে বড় একটা বাড়ির শখ বাবার বহুদিনের। চাকরি অবশ্য খারাপ করত না। ব্যাঙ্কের ম্যানেজার হয়ে রিটায়ার করেছিল। কিন্তু মাইনের একের চার অংশ চলে যেত দেশের বাড়ি কাটোয়ায়। যেখানে বাবার ছাত্রবেলা কেটেছে বড় অভাবে। ও বাড়ির একমাত্র কৃতী সন্তান ভাল চাকরি পেয়ে অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছে ক্রমাগত। তার ওপর ইছাপুরের বাড়ির বিরাট লোন শোধ করতে করতে চাকরি-জীবন প্রায় শেষ। রিটায়ারমেন্টের আগের পাঁচ বছর ধরে বাবা দাদাকে বলে যাচ্ছিল, চাকরির পরীক্ষাগুলো দে। রোজগারপাতির চেষ্টা কর। এরপর তো তোকেই সংসারের ভার নিতে হবে।
কথা কানে নেয়নি দাদা। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে বলেছে, ও তুমি অত ভেবো না। কিছু একটা হয়ে যাবে।
দাদার গ্র্যাজুয়েশনে রেজাল্ট খারাপ ছিল না। কমপিটেটিভ পরীক্ষায় বসলে চাকরি পেয়েও যেত হয়তো। সময় পেল না ওসব নিয়ে ভাবতে। দাতব্য-চিকিৎসালয়, অবৈতনিক নাইট স্কুল, ব্লাড ডোনেশান ক্যাম্প, পাড়ায় বে-পাড়ায় গিয়ে লাগাতার আড্ডা। বেশির ভাগ কালচারাল ফিল্ডে। শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে ব্যুৎপত্তি ছিল অগাধ। স্বীকৃত জ্ঞানীগুণী মানুষের সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিত বেমালুম। গানের গলা ছিল খুব সুন্দর।
এসব গুণ আমার ছিল না। লেখাপড়াতেও টেনেটুনে হল ম্যানেজ করে বি এ পাশ। বন্ধুর সোর্স ধরে ঢুকে গিয়েছিলাম কলকাতার একটা ছোট প্রাইভেট ফার্মে। স্যালারি এতই কম, যাতায়াতে অর্ধেক টাকা ফিনিশ। এরপর আছে সিগারেট খরচা, প্রেমিকার সঙ্গে একটু আধটু ঘোরা, সিনেমা দেখা। বাড়িতে দেওয়ার মতো কিছুই থাকত না।
প্রভিডেন্ট ফান্ডে যথাসময়ে রিটায়ার করল বাবা, দাদা চাকরির চেষ্টা করছে না দেখে, পড়ে থাকা সামান্য টাকাটুকু দিয়ে দোকানঘর নিল। আরও কিছু এপাশ ওপাশ থেকে জোগাড় করে দেওয়া হল ওষুধের দোকান। সংসারের প্রয়োজন অনুভব করে ব্যবসায়ী হয়ে যেতে আপত্তি করল না দাদা। ওর চেনাজানার ব্যাপ্তির কারণে শুরু থেকেই ভিড় হতে থাকল দোকানে। নিজের সঠিক সিদ্ধান্তে খুশি হল বাবা। আরও একটু গৃহী করে তুলতে এবং নাতি-নাতনির মুখ দেখতে দাদার বিয়েও দিল বাবা-মা। ওই দু’বছর আমাদের খারাপ কাটেনি। যদিও আমি একটু সংশয়ে ছিলাম। আমার বন্ধুবান্ধব, চন্দনা, সে তখন প্রেমিকা, আমায় খবর দিত, দোকান থেকে মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যায় দাদা। ওর কোনও না কোনও বন্ধু তখন কাউন্টার চালায়। আমি সময়-সুযোগ করে ব্যাপারটা ধরতে দোকানে পৌঁছোতে পারছিলাম না। চাকরির কারণে সকাল-সন্ধে কাটে কলকাতায়। যা শুনছি, দাদাকে বললাম। উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ধুস, ওই হয়তো বাথরুমে বা ছোট কোনও কাজে আশপাশে গিয়েছিলাম, তখনই ওরা দেখেছে।
ক’দিন পর বাবা দুশ্চিন্তা মাখা মুখ নিয়ে এসে বলল, তোর দাদা তো বিজনেসে আরও টাকা চাইছে। সংসার খরচাও ঠিকঠাক দিয়ে উঠতে পারছে না। এদিকে আমি যে দোকানের পিছন শেষ সম্বল ঢেলে ফেলেছি। কী ঘটনা একটু দেখ তো। তোর বউদি আবার বলছে, অর্ক নাকি ইদানীং মদ খেয়ে বাড়ি ঢুকছে। এরকম তো সে কখনও করেনি। ওর সমস্যাটা কোথায়?
গোলমালটা আন্দাজ করা কঠিন নয় মোটেই। একটা আপাদমস্তক বাউন্ডুলেকে খাঁচায় পুরে দিলে যা হয়… অফিস থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দোকানে বসলাম। অচিরেই টের পেলাম সমস্যার গুরুভার। আধ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা অন্তর পাওনাদার আসছে, যে সব সাপ্লায়ারের থেকে ওষুধ নিয়েছে দাদা। আমাকে কাউন্টারে রেখে টুক করে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে সে। একসময় ছেড়েই দিল দোকানে আসা। রাতের আগে আড্ডা মারার জন্য বন্ধুদের পেত না। যে যার চাকরিতে, ব্যবসায় ব্যস্ত। অকর্মণ্য, নেশাডুদের ঠেক তখন দাদার আস্তানা।
বাবাকে দোকানের প্রকৃত অবস্থার কথা জানালাম। শুধু সাপ্লায়ার নয়, দু’জনের থেকে হাই পার্সেন্টেজ ইন্টারেস্টে লোন নিয়েছে দাদা। দোকানটা সে প্রথম থেকেই মন দিয়ে চালায়নি। মহৎ কাজে দানধ্যান চালিয়ে গেছে। মাস গেলে সংসারের টাকাটা পুঁজি ভেঙেই দিত।
বাবা বলল, দেখ শেষ চেষ্টা করে। দোকানটা বাঁচলে আমরা বাঁচব।
ছেড়ে দিতে হল চাকরি। তেল, মশলা কমে গিয়ে বিস্বাদ হল মা-বউদির রান্না। বাড়তি ফ্যান, আলো চলতে দেখলেই সুইচ অফ করে যাচ্ছে বাবা। পাড়ার সবচেয়ে উজ্জ্বল বাড়িটা রাতের নিঝুম বাজপাখির মতো হয়ে গেল। কুকুর মরে ছিল আগেই। রং-চটা বোর্ড উপহাসের মতো লেগে ছিল গেটে। খেয়াল পড়তে বাবা একদিন সেটা খুলে দিল।
ব্যাবসার পিছনে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চললাম। লোকাল সাপ্লায়ার থেকে মাল নিই না। দাম বেশি পড়ে। দুপুরে দোকান থেকে ফিরে, দু’মুঠো খেয়ে চলে যাই কলকাতায় ওষুধের হোলসেল মার্কেটে। সাপ্লায়ারের পড়ে থাকা টাকা একটু একটু করে শোধ দিই। প্রাইভেট লোনের ফাঁস থেকে কিছুতেই আর বেরোতে পারি না। আমার ক্রমশ ওজন কমে যাওয়া, চুল পাতলা হওয়া শরীরের দিকে সমবেদনার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকত চন্দনা। তাড়া দিত না বিয়ের জন্য। বিয়ে ছাড়া ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে আমার। গরিব ঘরের মেয়ে তো, আর কিছু না থাকুক, বিশ্বাস আর অপেক্ষার শক্তিটুকু সর্বদা মজুত।
দোকান তখন আমার কাছে বিভীষিকা। মনে হত গোটা ইছাপুরের মধ্যে আমার
দোকানটাতেই আছে চোরাবালি। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে চমকে উঠতাম। দাদার অবস্থার ক্রমাবনতি হচ্ছিল। মাতলামির পাশাপাশি কখন যেন পাগলামিও ধরে নিয়েছিল হাত। দোকানে চড়াও হয়ে দশ-কুড়ি টাকা ছিনিয়ে নিত আমার থেকে। চোলাই
খেয়ে বেহেড হয়ে পড়ে থাকত রাস্তায়, নর্দমার পাশে। খবর পেয়ে তুলে নিয়ে আসতাম। বউদি তাতাইকে নিয়ে চলে গেল বাপের বাড়ি। সে আর কত সহ্য করবে! বড়লোক ঘরের মেয়ে। আমাদের বাড়ি, দোকান দেখে মনোনীত করেছিল পাত্রকে। ঘটনাটা দুঃখজনক হলেও খানিকটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। দুটো পেটের দায় তো কমল। বাস্তবে তা হল না। দিনের পর দিন অশান্তি, অভাব সয়ে মায়ের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়েছিল। রান্নাবাড়া, গৃহস্থালি একার হাতে সামলানোর ক্ষমতা ছিল না। বাবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল বেশ। বউদির স্থান পূরণ করতে চন্দনাকে নিয়ে এলাম বাড়িতে। বিয়ে হল নমো নমো করে।
বউদি চলে যাওয়াতে দাদার পাগলামিতে নতুন মাত্রা যোগ হল। বিবাহিত মহিলাদের সহ্য করতে পারত না। চন্দনাকেও নয়। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে, তাদের স্ত্রীদের নিয়ে অকথা কুকথা বলত। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল বন্ধুদের। এত দিন ওরা দাদার পাগলামি সহ্য করেছে সহানুভূতির সঙ্গে, আহা, ছেলেটা এখনও দারুণ গান গায়। শোনার কেউ নেই, একা একা। কখনও নির্জন রকে, সন্ধেবেলা রেলের প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন থেকে নামা অফিস ফেরত বন্ধুর সঙ্গে দিব্বি সিরিয়াস আলোচনা শুরু করে দেয়। বিনিময়ে চা, সিগারেট পেলেই খুশি। কিন্তু দাদা যদি বন্ধুর বউকে এক রাতে তৃপ্ত করার বায়না ধরে, কী করে তার মাথার ঠিক থাকবে! বন্ধুদের হাতে মারধর খেল বেশ ক’বার। তবু শিক্ষা হয়নি। বিষয়টা প্রায় যৌনবিকারে দাঁড়িয়ে গেল। বন্ধ দরজার ওপারে বউদির সঙ্গে দাদার রিলেশানটা কেমন ছিল জানি না। দাম্পত্যের ওই অংশটা তৃতীয় ব্যক্তির জানা সম্ভবও নয়। বুঝলাম, দাদাকে আর উন্মুক্ত সভ্য সমাজে ঘুরতে দেওয়া যাবে না। বাধ্য হয়ে অ্যাসাইলামে পাঠাতে হল।
সেখানকার খরচ জোগান দিতে দোকান বিক্রি করে দিলাম। আমি নেমে এলাম পথে।
কিছুদিনের ব্যাবসার অভিজ্ঞতা থেকে হোলসেল মার্কেটের আটঘাট জানা হয়ে গিয়েছিল। মার্কেট থেকে ওষুধ তুলে ইছাপুর এবং তার আশপাশের শহরের দোকানগুলোয় ওষুধ সাপ্লাই করতে লাগলাম। সাইকেল চালিয়ে ঘেমে নেয়ে আমাদের দোকানেও যাই। আমার বন্ধুই কিনেছে। এখন সে দোকানকে বড়লোক ঘরে পালিয়ে আসা বউ মনে হয়। আলো ঝলমল করছে, স্টক প্রচুর, কাউন্টারে সব সময় কাস্টমারের ভিড়।
ইতিমধ্যে একটি কন্যা সন্তান হয়েছে আমার। বড় হচ্ছে। ভরতি হয়েছে স্কুলে। বাড়ছে খরচ। টানাটানি অবস্থা থেকে আমি আর বেরোতে পারছি না। গত তিন মাস আগে বাবা একদিন ডেকে বলল, বুঝলি সূর্য, বাড়িটা চল বেচে দিই। এত বড় বাড়ি এখন তো দরকারও নেই আমাদের। ফ্ল্যাটে চলে যাব। এটা বিক্রি করে যত টাকা পাব, অর্ধেক টাকায় ফ্ল্যাট হয়ে যাবে। বাকিটা রেখে দেব ব্যাঙ্কে, মান্থলি ইন্টারেস্ট স্কিমে। তোর ওপর চাপ একটু কমবে। সুসার হবে সংসারেও।
বাবার সিদ্ধান্ত আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। এত অভাব, কষ্টের মাঝে আমি কখনই ভাবিনি পরিত্রাণের এই রাস্তা। কেননা জানতাম, বাবার জীবনে সার্থকতা বলতে শুধু এই বাড়িটাই। এটার প্রতি কী গভীর মমতা, বারে বারে প্রত্যক্ষ করেছি। বাইরে থেকে ফিরলে থমকে দাঁড়ায় গেটের অনেক আগেই, দু’পলক মুগ্ধ চোখে তাকায় বাড়ির দিকে। নিভৃতে দেওয়ালে হাত বোলাতে দেখেছি। কোথাও একটু চলটা উঠে গেলে বেদনাহত হয়েছে মুখ। মিস্ত্রি না ডেকে নিজেই সারিয়ে নিয়েছে। বাড়ি যেন বাবার শরীরের একটা অঙ্গ।
বলেছিলাম, বিক্রি করে দেবে শেষমেশ? তোমার এত শখের বাড়ি!
প্রয়োজনের চেয়ে শখ কি বড়? বেচতাম আগেই, তখন এখনকার মতো দাম পেতাম না। এটাই হাইটাইম। এর পর আর এসব বাড়ি কেনার লোক পাওয়া যাবে না।
তলে তলে পার্টি দেখে রেখেছিল বাবা। বিক্রি হয়ে গেল বাড়ি। ফ্ল্যাটে চলে এলাম আমরা। এরপর বাবা আমাকে যে দায়িত্বটা দিল, শুনতে সামান্য মনে হলেও, এ তাবৎ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন। বলল, বাড়িটা যে বিক্রি হয়েছে, অর্ককে একবার জানিয়ে রাখা উচিত। তুই গিয়ে বলে আয়।
আমি কেন?
আমার খারাপ লাগবে বলতে। খবরটা তো সুখের নয়।
বুঝেছিলাম, বাবা মুখোমুখি হতে চাইছে না দাদার। যদি দু’-চারটে খারাপ কথা শুনিয়ে দেয়। ওর মুখে কিছুই আটকায় না। বলতেই পারে, আমাকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে বাড়ি বিক্রির টাকায় বেশ স্ফূর্তিতেই আছ! ধাক্কাটা হজম করতে কষ্ট হবে বাবার। তাই আমাকে পাঠাতে চাইছে। দাদার ওই হোমে গেছি সেই প্রথম দিকে, দু’-চারবার। পরে বাবা ব্যাপারটা দেখভাল করতে থাকে। প্রতি মাসে টাকা দিয়ে আসে ওদের অফিসে। দেখা করে দাদার সঙ্গে। আগে আমি জিজ্ঞেস করতাম, কেমন আছে? এখন ভুলে যাই। আবার দেখা করার পালা আসছে দেখে জানতে চাইলাম, সে কি আমার কথা শোনার অবস্থায় আছে?
আছে। আগের চেয়ে অনেক ভাল।
কাজের চাপ কম আছে, এমন একটা দিন বেছে গেলাম সিঁথিতে, দাদার অ্যাসাইলামে। বাড়িটা বাইরে থেকে একইরকম লাগল, আট বছর আগে যেমন ছিল। সেই হলুদ রং, দেড় মানুষ উঁচু লোহার কালো গেট। রিসেপশনও প্রায় এক, বদল বলতে কাউন্টারে পুরুষের জায়গায় একজন মহিলা, টেবিলে কম্পিউটার।
ভদ্রমহিলার কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে দাদার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম। সংশয় প্রকাশ করে বললেন, আজ কি ওঁকে পাওয়া যাবে। যে হারে ব্যস্ত! আমি তো অবাক! একজন পেশেন্টের আবার কীসের এত ব্যস্ততা?
প্রশ্নটা আমার মুখ থেকে পড়ে নিয়ে মহিলা বলেছিলেন, আজ আমাদের এখানে ফাংশান। রবীন্দ্র জয়ন্তী। অর্কবাবুর উদ্যোগে সব হচ্ছে। সন্ধেবেলা অনারেবল গেস্টরা আসবেন।
খেয়াল পড়েছিল, আজ পঁচিশে বৈশাখ। সকালে কাগজে দেখেছি। পাড়ায় তার কোনও হাওয়া নেই। আমাদের কিশোরবেলায় থাকত, দু’দিন আগেই ম্যারাপ বাঁধা হত মাঠে মাঠে।
এদিকে আমি ভেবে পাচ্ছি না কোনও রুগির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, নাকি উদ্যোক্তার! উৎসবের মেজাজ বলেই হয়তো সেদিন প্রতিষ্ঠানের নিয়ম একটু শিথিল হয়ে পড়েছিল। রিসেপশনের মহিলা বললেন, আপনি ভিতরে চলে যান। মনে হচ্ছে মাঠে পেয়ে যাবেন।
সারি সারি ঘর বারান্দা পেরিয়ে মাঠে পৌঁছেছিলাম। মঞ্চ বাঁধার কাজ তখনও চলছে। বিশাল ফ্রেমে বাঁধানো রবীন্দ্রনাথ এসে গেছেন মাঠে। ঠেসান দিয়ে রাখা হয়েছে প্যান্ডেলের গায়ে। উনি যেন দেখছেন খ্যাপাদের কাণ্ডকারখানা।
সাদা পোশাকের মধ্যে থেকে দাদাকে শনাক্ত করলাম সহজেই। চেঁচিয়ে কাকে যেন কী একটা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। পাশে গিয়ে নিচু গলায় ডাকলাম। ঘুরে তাকাল। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না নিজের চোখকে, এ কাকে দেখছি! এ তো আমার সেই পনেরো বছর আগের সেই দাদা। মাঝের সময়টা কি তা হলে দুঃস্বপ্ন ছিল? একটু রোগা হয়েছে, অল্প পাক ধরেছে কোঁকড়া চুলে। মুখের উদ্ভ্রান্ত ভাবটা পুরোপুরি উধাও!
আমাকে দেখে দাদা কিন্তু ক্ষণিকের জন্যও থমকাল না। যেন এক সপ্তাহ আগেই এসেছিলাম, এই সুরে জানতে চাইল, কখন এলি? বললাম, কিছুক্ষণ হল।
এমন দিনে এলি, দুটো কথা বলব, সে উপায় নেই। দেখছিস তো অবস্থা। আমি দাঁড়িয়ে না থাকলে সন্ধের আগে কাজ উঠবে না। রবীন্দ্রনাথের ‘গুপ্তধন’ গল্পটা নাটক করছি। একটা স্টেজ রিহার্সাল দেওয়াতে পারলে ভাল হত।
দাদার গলায় পুরনো দিনের ব্যস্ততা। ও যে এতটাই সুস্থ হয়ে গেছে, বাবা তো বলেনি। এই ইমপ্রুভমেন্ট একদিনে হওয়ার নয়। বাবা স্বার্থপরের মতো সাক্ষী থেকেছে ওর ভাল হয়ে ওঠার। ভেবেছে, আমাদের কাছে দাদার ব্যাপারটা গৌণ হয়ে গেছে।
সে যাই হোক, অভিমানের সময় নয় এখন। যে কাজে পাঠানো হয়েছে, সুষ্ঠুভাবে সারতে হবে। দাদাকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে দুটো মিনিট টাইম দাও।
রাজি হল, বলল, চ, বারান্দাটায় বসি।
অনেকদিন পর বসলাম পাশাপাশি। দূরে থামের গায়ে হেলান দিয়ে সাদা পোশাক পরা একজন খাতা দেখে বিড়বিড় করছে, পার্ট মুখস্থ করছে সম্ভবত। আমার দিকে দাদার মনও নেই, দৃষ্টিও ফেরানো অসমাপ্ত প্যান্ডেলের ওপর। গলা ঝেড়ে নিয়ে বললাম, বাড়িটা বিক্রি করে দিতে হল।
চমকে মুখ ফেরাল। চোখে স্পষ্ট বেদনা।
বললাম, ডিসিশনটা বাবার। আমিও আর পারছিলাম না সংসার টানতে। তোমার এখানে এত খরচ…
কত নেয় এরা? জানতে চেয়েছিল দাদা।
অ্যামাউন্টটা বললাম। শুনে ভীষণ অবাক হল। বলেছিল, তাই নাকি, সাড়ে চার হাজার নেয়? এত নেবে কেন! আমি এদের অনেক কাজ করে দিই। গানটান শেখাই পেশেন্টদের, বই পড়ে শোনাই। বেশ ক’টা রুগি ভায়োলেন্ট হয়ে উঠলে, এরা আমাকেই পাঠায় সামলাতে। দাঁড়া, এদের বলছি, আমার জন্য এত টাকা নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। বরং আমারই পাওনা হওয়া উচিত। এই যে আজ বড় বড় এন জি ও, আমলারা আসবে, নিশ্চয়ই কিছু এড পাবে এরা। সে তো আজকের এই অনুষ্ঠানের জন্যই…
দাদাকে থামিয়ে বলেছিলাম, তুমি যখন ভাল হয়ে গেছ, চলো না বাড়ি ফিরে। টাকাটাও বাঁচে, একসঙ্গে থাকতে পারি। ফ্ল্যাটে তোমার জন্য একটা ঘরও আছে।
মুহূর্তের মধ্যে নিভে গিয়েছিল দাদা। বলেছিল, না রে, আমার পক্ষে পেশেন্টদের ছেড়ে যাওয়া মুশকিল। নিজে রুগি তো, এদের দুঃখকষ্টটা সবচেয়ে ভাল বুঝি।
এরপর আর কোনও কথা হয় না। গলায় দলা পাকানো কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। মা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চেয়েছিল, কী রে! কী বলল সে?
মাকে ওখানকার বৃত্তান্ত দিলাম। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাবা শুনল সব কথা। মা বলেছিল, নিজের লোকেদের দুঃখ যন্ত্রণাটা কোনওদিন গ্রাহ্য করল না। বাইরের রুগিগুলো ওর আপন হয়ে গেল!
মায়ের ওই অভিমানের গভীরে আমি নিশ্চিত ভাবে খানিকটা গর্বেরও সুর শুনেছিলাম।
কিন্তু হাওয়া ঘুরে গেল পনেরো দিনের মধ্যেই। অ্যাসাইলাম থেকে দাদার একটা চিঠি এল। বাবাকে লেখা। শ্রীচরণেষু বাবা, সূর্যর থেকে জানলাম বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। জানি, এর জন্য আমিই দায়ী। ক’দিন আগে তোমার বউমা গুয়াহাটি থেকে ফোন করেছিল। সে চায় আমি ওর ওখানে গিয়ে থাকি। তাতাই আমাকে নিতে আসবে। বাড়ি বিক্রি থেকে যদি আমায় কিছু দেবে বলে স্থির করো, তাতাইয়ের হাতে দিয়ো। কপর্দকশূন্য হয়ে শ্বশুরবাড়িতে উঠতে সম্মানে লাগছে। আমি এখান থেকেই তাতাইয়ের সঙ্গে গুয়াহাটি চলে যাব। ইছাপুরের লোকেদের মুখ দেখাতে কুণ্ঠা হচ্ছে আমার। যদি সম্ভব হয় আমার চলে যাওয়ার আগে মাকে একবার পাঠিয়ো। কত দিন দেখিনি! ইতি তোমার অপদার্থ সন্তান, অর্ক।
বাবা আমাকে বলল, তুই গিয়ে ওকে বোঝা। আমরা তো আর আগের পাড়ায় নেই। তা ছাড়া এখন এলাকার মানুষ অনেক বদলে গেছে। কেউ কারও ব্যাপারে এত মাথা ঘামায় না। সুযোগ বুঝে দায় এড়ালাম আমি। বললাম, মাকে তো দেখতে চেয়েছে। মা গিয়ে বলুক।
মা, বাবা একদিন গিয়ে দেখে এসেছে। কী কথা হয়েছে, আমি ডিটেলে শুনতে চাইনি।
বাবা নিজের থেকে শুধু বলেছিল, শুক্রবার তাতাই আসছে, তার বাবাকে নিতে। কথাটাকে খবর হিসেবে নিয়েছিলাম। বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবতে চাইনি। দাদার কারণে প্রচুর হ্যাপা পোহাতে হয়েছে জীবনে। চন্দনাকে ফোনে জানালাম, দাদা চলে যাচ্ছে গুয়াহাটি।
জিজ্ঞেস করল, তাতাইকে দেখতে আসবে কি না!
বলেছিলাম, কী দরকার।
এখন মনে হচ্ছে, চন্দনাকে আসতে বললেই হত। তাতাইকে চোখ ভরে দেখার মতোই হয়েছে। আমাদের বংশের উজ্জ্বলতম উত্তরপুরুষ। স্বভাবটাও সুন্দর। দাদু ঠাকুমাকে এসে প্রণাম করল। আমাকেও করতে এসেছিল। আটকে দিয়েছি। মনে মনে বলেছি, আমি মোটেই শ্রদ্ধার উপযুক্ত নই। নয়তো আট বছর বয়সে তোকে মামার বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়!
তাতাই বাড়ির সবার জন্য কিছু না কিছু এনেছে। মা, চন্দনার জন্য অসম সিল্কের শাড়ি, বাবার ধুতি, আমার পাঞ্জাবি, ওর বোনের জন্য খেলনা। দাদু ঠাকুমার সঙ্গে সেই থেকে বকবক করছে। শুনছে ওর ছোটবেলার গল্প। আমি তাতাইয়ের মুখোমুখি হতে চাইছি না। জলখাবার খেয়েছি একসঙ্গে। খাবার টেবিলে বাবা তখন তাতাইকে বলল, আজ এসে আজই চলে যাবি! একটা রাত থাকতে পারলি না।
তাতাই বলেছে, কী করব দাদু। পরশু আমার ফাস্ট সেমিস্টারের পরীক্ষা। মা জোর করে পাঠাল, তাই চলে এলাম।
দাদার জন্য প্লেনের টিকিট নিয়ে এসেছে তাতাই। প্রথমবার প্লেন চড়বে দাদা। অ্যাসাইলাম থেকে বেরিয়ে ওরা সোজা এয়ারপোর্ট যাবে।
বাবা আমায় বলল, তুই ওদের সি অফ করে আয়।
বললাম, হবে না গো। আজ কাজের হেভি প্রেশার।
আসলে দাদার এই বিদায়বেলাটা এড়াতে চাইছিলাম। বাবা দাদার নামে বেয়ারার চেক কেটে রেখেছে। আমাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, কত দেওয়া যায় বল তো? বলেছিলাম, তোমার যা ইচ্ছে।
তিন লাখের বিনিময়ে দাদা আজীবনের জন্য আমাদের ঘাড় থেকে নেমে যাচ্ছে। দিনটা আনন্দের কি না, এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। কাজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছি। ড্রেস করে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। তাতাই এখনও খাবার টেবিলে। জুতো পরতে পরতে বললাম, চলি রে, ছুটিছাটায় চলে আসিস।
ও বলল, তুমিও সময় করে এসো গুয়াহাটি।
যাব। বলে, দরজা খোলার আগে মাকে জানান দিলাম, মা, এগোলাম।
সারাদিন ঘুরে ঘুরে অনেক কাজ করলাম। ভুলে থাকতে চাইছিলাম দাদার চলে যাওয়াটা। লাভ হল না। বুকটা খালি খালি হয়ে রইল। নিজেকে বোঝালাম, দাদা তো বাইরেই ছিল। এখন দূরত্বটা বাড়ছে এই যা। তবু মনখারাপটা গেল না। সন্ধের মুখে ফিরে এলাম বাড়ি। দেখলাম, ফ্ল্যাটের আবহাওয়া আমার মনেরই মতো।
জুতো ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ডাইনিং-এ বসলাম। বাবা আগে থেকেই বসে ছিল। দু’জনকে চা দিল মা। জিজ্ঞেস করলাম, তাতাই ফোন করেছিল?
মা ‘না’ সূচক মাথা নাড়ল। বাবাকে বললাম, ফ্লাইট তো চারটেয়, তুমি তিনটে-সাড়ে তিনটে নাগাদ একটা ফোন করলে পারতে। এয়ারপোর্টে ঠিকঠাক পৌঁছোল কি না।
বাবা চুপ করে বসে রইল। যার একটা অর্থ হয়, তুই তো করতে পারতিস। এমন সময় বেজে উঠল আমাদের ল্যান্ডফোন। উঠে গিয়ে ধরলাম। ‘হ্যালো’ বলতেই ওপার থেকে তাতাইয়ের গলা, কাকুন?
হ্যাঁ।
একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়েছে। বাবা আবার পালিয়েছে।
ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলাম, কী করে?
আর বোলো না, মাথায় যে এখনও এত ছিট আছে বুঝিনি। ডানলপ ব্রিজের কাছে জ্যাম ছিল। আমাকে বলল, দাঁড়া, ঝপ করে একটা সিগারেট কিনে আনি। আমি আটকানোর আগেই ট্যাক্সি থেকে নেমে গেল। সেই যে পালাল, আর খুঁজে পেলাম না। কী করলি তারপর?
কী আর করব, বাবার ওই হোমে ফোন করে খবরটা জানালাম। তোমার মোবাইলে দু’চারবার ট্রাই করলাম, পেলাম না। দাদু ঠাম্মাকে ফোন করতেও ভয় লাগছিল, শকড় হবে। এখন করলাম এই ভেবে, তুমি নিশ্চয়ই কাজ থেকে বাড়ি ফিরে এসেছ। তুই এখন কোথায়?
গুয়াহাটি। বলছিলাম না পরশু থেকে এগজ্যাম। প্লেনের টিকিটও কাটা ছিল। তুমি একটু বাবার ব্যাপারটা দেখো না কাকুন। মা এখানে আমাকে খুব বকাবকি করছে।
আমার আর কিছু বিশেষ জানার নেই। একটা দরকারি জিনিস মনে পড়ল। জিজ্ঞেস করলাম, হ্যাঁরে, চেকটা কোথায়?
সে তো হোম থেকে বেরিয়ে বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম, ক্যাশ করে নিয়েছি। টাকা মায়ের হাতে দিয়েছি এখানে এসে।
দাদা তো ব্যাঙ্কে ঢোকার মুখেও পালাতে পারত। প্রশ্নটা না তুলে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম। পকেট থেকে মোবাইল সেটটা বার করে দেখলাম, কোনও মিসড কল নেই। বাবা-মা’র দিকে তাকালাম। দু’জনের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ফোনের এ প্রান্তের কথা শুনে ওরা গোটা ব্যাপারটাই ধরে নিয়েছে। কাজ থেকে ফিরে জামা-প্যান্ট ছাড়া হয়নি। চটি গলাতে এগিয়ে গেলাম।
মা জিজ্ঞেস করল, কোথায় চললি।
দরজা খুলে বেরোনোর আগে বললাম, দেখি, কোথায় পালাল আবার।
কথাটা এমনভাবে বললাম, যেন আশেপাশে কোথাও পাওয়া যাবে দাদাকে। কিন্তু আমি তো জানি, এবার ও হারিয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। হারিয়েছে, না হারিয়ে ফেলা হল? যাই হোক তাড়াতাড়ি খুঁজে পেতে হবে। চোখে চোখে না রাখলে আবার নষ্ট হয়ে যাবে দাদা। আপনারাও একটু পথেঘাটে লক্ষ রাখবেন তো। লম্বায় পাঁচ-দশ, কোঁকড়া চুল, কিছু পাক ধরেছে, খাড়াই নাক, দোহারা চেহারা, স্পষ্ট উচ্চারণ। জ্ঞানগর্ভ কথা বলে। দাদার জন্যই দেখুন না, আমার মতো স্টুডেন্টের ভাষাজ্ঞান পোক্ত হয়ে গেছে। অচেনা লোকের সঙ্গে যেচে আলোচনা শুরু করে দেয়, হেমন্ত, দেবব্রত বিশ্বাস নিয়ে। তুলনা টানে শম্ভু মিত্র উৎপল দত্তর মধ্যে। সত্যজিৎ ঋত্বিকের ফিল্ম ফিলোজফির তফাতটা কোথায়। সোমনাথ হোর, গণেশ পাইন… কী জানে না! যখন লোক পায় না আলোচনা করার, একা একা গান গায়। মাঠে, নির্জন রকে, প্ল্যাটফর্মে। জানবেন, তখনই পাগলামিটা চাগাড় দিচ্ছে। দাদার একটা প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত আছে। সেটাই গায় জেনারেলি। কী যেন গানটা? দূর ছাই, এই টেনশনের মাথায় মনেও পড়ছে না।