সোলমেট: জীবনের আয়না
কথা হচ্ছে পায়েলের। সে কলেজের একজন শিক্ষক। তার জীবন যতটা গোছানো দেখায়, ভেতরে ততটাই এলোমেলো। দিনের পর দিন ক্লাস নেওয়া, ছাত্রদের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা, আর রাত হলে নিজের নিঃসঙ্গতার সঙ্গে লড়াই করা—এটাই তার প্রতিদিনের জীবন। পায়েলের একসময় মনে হতো, তার জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। কিন্তু একটা অদ্ভুত শূন্যতা তার ভেতরে বাসা বেঁধেছিল, যা সে কখনো কাউকে বোঝাতে পারেনি।
একদিন কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানে পায়েলের সঙ্গে দেখা হয় নীলের। নীল ছিল একজন অতিথি বক্তা, একজন সমাজকর্মী। মঞ্চে নীলের কথা বলার ভঙ্গি, তার চিন্তা-ভাবনা, আর মানুষের প্রতি তার গভীর দৃষ্টিভঙ্গি পায়েলকে মুগ্ধ করে। অনুষ্ঠান শেষে পায়েল নিজেই এগিয়ে যায় নীলের সঙ্গে কথা বলতে। কথোপকথনের শুরুটা ছিল সাধারণ, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আলোচনা গভীর হতে থাকে। পায়েল বুঝতে পারে, নীল শুধু একজন মানুষ নয়, তার ভেতরে এমন কিছু আছে যা তার মনের গভীরে আঘাত করছে।
নীলের সঙ্গে পায়েলের বন্ধুত্ব হতে সময় লাগেনি। তারা প্রায়ই দেখা করত, আলোচনা করত জীবনের নানা বিষয় নিয়ে। কিন্তু যতবারই নীল পায়েলের সঙ্গে কথা বলত, ততবারই সে পায়েলের ভেতরের ভাঙা কোণগুলোকে আলো দেখাতে চেষ্টা করত। নীল তাকে বলত, “তুমি তোমার জীবনে যা চাও, তার জন্য কি সত্যিই নিজের ভেতরে তাকিয়েছ? তুমি কি ভেবেছ, কেন তোমার এই শূন্যতা?”
পায়েল প্রথমে বিরক্ত হতো। নীল কেন তার এতকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলে? কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পায়েল বুঝতে পারে, নীলের এই প্রশ্নগুলোই তাকে নিজের জীবনের দিকে গভীরভাবে তাকানোর সুযোগ দিচ্ছে। নীল শুধু তার সুখ-দুঃখ শোনেনি, বরং তাকে তার সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাগুলো চিনতে সাহায্য করেছে।
একদিন নীল বলল, “পায়েল, তুমি জানো কি, জীবন কখনো কখনো আমাদের এমন লোক পাঠায় যারা আমাদের ভেতরের সবকিছু ওলটপালট করে দেয়? কিন্তু সেই পরিবর্তনটা যতই কষ্টদায়ক হোক, সেটা আমাদের জীবনে প্রয়োজনীয়। আমি হয়তো তোমার জীবনে সেভাবে চিরকাল থাকতে পারব না, কিন্তু আমি চাই তুমি তোমার সত্যিকারের সম্ভাবনা উপলব্ধি করো।”
নীলের কথা পায়েলের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। সে ভাবতে বসে—নীল কি তার সোলমেট? নীল কি তাকে তার জীবনের সত্যিকারের দিকগুলো দেখাতে এসেছে? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নীলের সঙ্গে পায়েলের যোগাযোগ কমতে থাকে। একদিন নীল জানায়, সে অন্য শহরে যাচ্ছে, তার নতুন প্রকল্প নিয়ে।
নীলের চলে যাওয়া পায়েলের জীবনে এক গভীর শূন্যতা তৈরি করে। সে ভেঙে পড়ে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, নীল তাকে কেবল একা ফেলে যায়নি। নীল তাকে এমন কিছু শিখিয়েছে, যা সে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। নীল তাকে নিজের জীবনের দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে।
নীলের বিদায়ের পর পায়েল নিজের জীবনের দিকে নতুন করে তাকায়। সে উপলব্ধি করে, নীল তার জীবনে এক ধরনের আয়না হয়ে এসেছিল, যা তার সব দিক দেখিয়েছে—ভালোমন্দ, শক্তি-দুর্বলতা সব। নীলের উপস্থিতি পায়েলের ভেতরের আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে, যা তাকে জীবনের নতুন পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
সত্যিকারের সোলমেট ঠিক এমনই। তারা আপনার জীবনে আসে, আপনাকে পরিবর্তনের পথে ঠেলে দেয় এবং তারপর চলে যায়। তাদের প্রভাব হয়তো সাময়িক মনে হয়, কিন্তু তাদের শিক্ষা আপনার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সঙ্গী হয়ে থাকে।