Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সেই অদ্ভুত লোকটা || Sunil Gangopadhyay

সেই অদ্ভুত লোকটা || Sunil Gangopadhyay

সেই অদ্ভুত লোকটা

এক-একটা মানুষের কিছুতেই বয়েসটা ঠিক বোঝা যায় না। চল্লিশও হতে পারে, পঁয়ষট্টিও হতে পারে। ঠিক এই রকমই একটা লোক বসে থাকে পার্ক সার্কাস ময়দানে। প্রত্যেক শনিবার। লোকটি পরে থাকে একটা সরু পাজামা আর একটা রঙ-চঙে জোব্বা। মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। চোখে চশমা, মাথায় একটা চ্যাপ্টা টুপি।

গনগনে রোদের মধ্যেও লোকটি পার্কের বেঞ্চে দুপুরবেলা বসে থাকে। এক দৃষ্টে চেয়ে থাকে ঘাসের দিকে।

স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় দীপু মাঝে-মাঝে পার্ক সার্কাস ময়দানের ভেতর দিয়ে শর্টকাট করে। লোকটিকে দেখে কেমন যেন অদ্ভুত লাগে। একই রকম পোশাক, প্রত্যেক শনিবার ঠিক একই জায়গায় বসে কেন এই মানুষটা? সব সময় ও একলা থাকে, কেউ ওর পাশে বসে না।

একদিন ছুটির পর বৃষ্টির মধ্যে স্কুল থেকে বেরিয়েছে দীপু। পার্কের রেলিং টপকে দৌড় লাগাতে গিয়েই আছাড় খেয়ে পড়ল। তাড়াতাড়ি উঠে ছড়িয়ে পড়া বইপত্রগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে, এমনসময় দেখল, একটু দূরের বেঞ্চে সেই দাড়িওয়ালা, কালো চশমা পরা লোকটা তাকিয়ে আছে তার দিকে।

দীপুর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটা হাতছানি দিয়ে তাকে কাছে ডাকল।

দীপুর এখন মোটেই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লোকটার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। কিন্তু এই লোকটাই বা শুধু-শুধু এখানে বসে বৃষ্টিতে ভিজছে কেন?

দীপুর কৌতূহল হল। সে এগিয়ে গেল লোকটার কাছে। লোকটি বলল, ইসটুম, কিসটুম, দ্রুখ-দ্রুখ?

এ আবার কীরকম ভাষা? এই লোকটা কি কাবুলিওয়ালা নাকি? চেহারা দেখে তো তা মনে হয় না। লোকটির রোগা-পাতলা চেহারা। দীপু কখনও রোগা কাবুলিওয়ালা দেখেনি।

দীপু বলল, কেয়া? হাম নেই জানতা!

লোকটা এবারে দুটো আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলো, হিন্দি? বাংলা?

দীপু বলল, বাংলা।

এবারে লোকটা ভাঙাভাঙা উচ্চারণে বলল, বেশ কথা! আমি বাংলা জানে। এই লিজিয়ে খোকাবাবু, চকলেট খাও!

লোকটা তার জোব্বার পকেট থেকে একটা আধভাঙা চকলেটের টুকরো বার করে দীপুর দিকে এগিয়ে দিল।

দীপুর হাসি পেল। লোকটা কি তাকে ক্লাস সিক্স সেভেনের ছেলেদের মতন বাচ্চা ছেলে পেয়েছে? ভুলিয়ে-ভালিয়ে ঘুমের ওষুধ মেশানো চকলেট খাইয়ে তারপর চুরি করে নিয়ে যাবে? দীপু এখন ক্লাস নাইনে পড়ে। সে ইচ্ছে করলে এই রোগা লোকটাকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতে পারে।

দীপু বলল, আমি চকলেট খাবো না। আপনি আমায় ডাকলেন কেন?

লোকটা চকলেটটা নিজের মুখে ভরে দিয়ে বলল, তুমহার নাম তো দীপক মিত্রা আছে, তাই না?

দীপু একটু অবাক হল। লোকটা তার নাম জানল কী করে? লোকটা তার সঙ্গে ভাব জমাতেই বা চাইছে কেন?

তবু সে বলল, মিত্রা নয়, মিত্র। আমি আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারছি না। কী বলতে চান চটপট বলুন!

লোকটা হঠাৎ সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে ফেলল। তারপর বলল, তুম্হাকে আমার খুব ভালো লাগল। তুমি আমার বাড়িতে যাবে? বেশি দেরি হবে না। স্রেফ আধা ঘন্টা থাকবে?

দীপুর মনে হল, এ লোকটা তো তাহলে সত্যিই ছেলেধরা। স্কুলের কাছে বসে থাকে। ভুলিয়ে-ভালিয়ে ছেলেদের নিয়ে যেতে চায়।

দীপুদের স্কুলের ক্লাস এইটের ছেলে অর্ণব সরকার গত মাসে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তাকেও কি এই লোকটা ধরে নিয়ে গেছে নাকি?

দীপুর কিন্তু একটুও ভয় হল না। সে বলল, আমাকে আপনার বাড়ি নিয়ে যাবেন? কেন? আমি মাছ খাই না, শুধু মাংস খাই। আলু সেদ্ধ আর ডিম সেদ্ধ একসঙ্গে মেখে খাই। দুধ আর কোকো মিশিয়ে খাই। এসব খাওয়াতে পারবেন?

লোকটা হা-হা করে হেসে উঠে বলল, বেশ তো, আমি তুমাকে মুরগ-মশল্লাম খাওয়াব। ঠান্ডা লস্যি খাওয়াব। যদি তুমি একঠো কাম করতে পার!

ধ্যাৎ? বলে দীপু আবার চলতে শুরু করল। লোকটা তখনও হাসতে লাগল জোরে জোরে।

দীপু আর পেছন ফিরে তাকাল না।

একটুখানি যেতে না যেতেই কোথা থেকে একটা মস্তবড় কুকুর তেড়ে এল দীপুর দিকে। গলায় বেল্ট বাঁধা একটা অ্যালসেশিয়ান। কারুর বাড়ির পোষা কুকুর, হঠাৎ বেরিয়ে এসেছে।

দীপু এমনিতে কুকুরকে দেখে ভয় পায় না। কিন্তু এই কুকুরটা তেড়ে আসছে। তার দিকেই। পার্কে আর কোনও লোকজন নেই। কুকুরের সঙ্গে ছুটেও পারা যায় না। দীপু তাড়াতাড়ি আর একটা বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়াল।

কুকুরটাও সেখানে এসে যেই দীপুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাবে, অমনি একটা লাল রঙের দড়ির ফাঁস এসে পড়ল কুকরটার গলায়।

দীপু দেখল সেই কালো চশমা পরা লোকটাই দড়ি খুঁড়ে কুকুরটাকে বেঁধে ফেলেছে। তারপর কুকুরটাকে টানতে-টানতে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে লোকটা তার গলা থেকে ফাঁস খুলে দিল, তারপর কুকুরটার মাথায় একটা চাপড় মেরে বলল, যা, ভাগ!

অতবড় কুকুরটা এখন দারুণ ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে পালিয়ে গেল।

লোকটা আবার দীপুর দিকে হাতছানি দিয়ে বলল, ইধারে এসো, দীপকবাবু! দীপু বলল, থ্যাঙ্ক ইউ! আমার বাড়ি ফেরার দেরি হয়ে যাচ্ছে।

লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ভয় নেই, দীপকবাবু! এক মিনিট ঠারো! একটা কথা বলি না। তোমাকে একঠো চীজ দিতে চাই। বহুত দামি চীজ।

দামি চীজ, মানে দামি জিনিস? সেটা আমাকে দেবেন কেন?

দেব, তুমাকে আমার পছন্দ হয়েছে সেইজন্য। তার বদলে তুমাকেও একটা কাজ করতে হোবে। যাবে, আমার বাড়িতে?

না। স্কুল থেকে ঠিক সময়ে বাড়ি না ফিরলে আমার মা চিন্তা করবেন। তা ছাড়া আমি বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছি। সামনেই আমার পরীক্ষা–

ঠিক আছে, বৃষ্টি হামি থামিয়ে দিচ্ছি। এই দেখো–এক, দো, তিন–।

হাতের সেই লাল রঙের দড়িটা শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে লোকটা পাঁচ পর্যন্ত গুনে বলল, এই দেখো, বৃষ্টিতে বেঁধে ফেলেছি আমি, এবারে রোদ উঠবে।

বৃষ্টি সত্যিই থেমে গেল। যদিও আগে থেকেই একটু কমে আসছিল।

দীপু হেসে বলল, আপনি বুঝি কুকুরের মতন বৃষ্টির গলাতেও দড়ি বাঁধতে পারেন? হে-হে-হে! আপনি-আপনিই বৃষ্টি কমে গেছে!

লোকটা বলল, তুমাকে আমি আর একটো চীজ দেখাচ্ছি। তুমি এই দড়িটাতে হাত দাও!

দীপু সাবধান হয়ে গিয়ে বলল; না, আমি পড়িতে হাত দেব না।

ঠিক আছে। ওই গাছটায় হাত দাও!

কেন? তাতে কী হবে?

দিয়ে দেখো না।

লোকটা তার হাতের দড়িটা দিয়ে গাছটার গায়ে একবার মারল। তারপর দীপু সেই গাছটার গায়ে হাত ছোঁয়াতেই দারুণ চমকে উঠল। দীপুর সারা শরীরটা ঝন্‌ঝন্‌ করে উঠেছে। ঠিক কারেন্ট লাগলে যেমন হয়।

গাছের গায়ে তো কখনও কারেন্ট থাকতে পারে না! এই লোকটা তাহলে ম্যাজিক দেখাচ্ছে দীপুকে!

ঠিক দীপুর মনের কথাটা বুঝতে পেরেই লোকটা বলল, এসব ম্যাজিক নেহি, ম্যাজিক নেহি! আসল জিনিস আছে। আর একটা দেখবে? ওই দেখো, আশমান দিয়ে একঠো এরোপ্লেন যাচ্ছে। যাচ্ছে তো?

দীপু ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, প্রায় তাদের মাথার ওপর দিয়েই একটা প্লেন উড়ে যাচ্ছে।

সেই লোকটা লাল দড়িটা ছুঁড়ে দিল শূন্যের দিকে, তারপর বলল, যাঃ! প্লেনটা অমনি অদৃশ্য হয়ে গেল।

এবারে গা ছমছম করে উঠল দীপুর। এ কার পাল্লায় পড়ল সে! এই সময় পার্কটা এত ফাঁকাই বা কেন? লোকটা যদি দীপুকেও ওই দড়িতে বেঁধে ফেলে?

দীপু শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হল প্লেনটার? ধ্বংস হয়ে গেল?

না-না, ধ্বংস হবে কেন? তা হলে তো ভিতরের আদমিগুলোও মরে যাবে। আমি তো কোনও মানুষ মারি না। আমি শুধু তোমার আঁখ থেকে মুছে দিলাম এরোপ্লেনটাকে। শোনো দীপকবাবু, আমি তুমাকে যে চীজ দেব বলছিলাম, তা কোনও আনসা চীজ নয়। তুমাকে দেব আসলি চীজ, তা হল জ্ঞান। তুমি আমার কাছ থেকে এই জ্ঞান যদি নাও, তবে তুমি আন্ধারেও দেখতে পাবে, আগুন লাগলে হাত পুড়বে না, তিনদিন কিছু না খেলেও ভুখা লাগবে না, আরও অনেক কিছু পারবে।

ঠিক আছে, শিখিয়ে দিন।

আভি তো হবে না। দু-এক ঘন্টা টাইম লেগে যাবে। তার আগে যে তুমাকে একঠো কাম করতে হবে।

কী কাজ বলুন?

তুমি আমাকে একটা দাওয়াই খাওয়াবে।

দাওয়াই, মানে ওষুধ?

হাঁ-হাঁ। আমার বাড়িতে সেই ওষুধ আছে। খুব দামি হেকিমি ওষুধ। পাঁচ ফোঁটা তাজা রক্ত মিশিয়ে সেই ওষুধ তৈয়ার করতে হয়। চৌদ্দ-পনের বছরের বুকের রক্ত। তুমি সেইটুকু রক্ত আমাকে দেবে?

রক্ত?

হাঁ, মাত্র পাঁচ ফোঁটা! আসলে হয়েছে কি জানো, আমি তো শুধু রোদ্দুর খাই। রোদ্র না থাকলেই আমি দুলা হয়ে যাই। তখন ওই দাওয়াই খেতে হয়।

আপনি রোদ্দুর খান?

হাঁ, দীপকবাবু! আমি কিছু খাবার খাই না। রোদ্দুর খেলেই আমার শরীর খুব তাজা থাকে। মুশকিল হয় এই বর্ষাকালে। এক-একদিন রোদ্রই থাকে না, শুধু মেঘ। শুধু বৃষ্টি! তখন আমি দুলা হয়ে যাই।

আপনি তো ইচ্ছে করলেই বৃষ্টি থামিয়ে দিতে পারেন। বৃষ্টি বন্ধ করে দিয়ে রোদ খাবেন!

আরে বাপ রে বাপ! সে কী কখনো হয়। বর্ষাকালে যদি বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়, তবে কত ক্ষতি হবে। চাষবাস হবে না। ধান-গম হবে না। কত লোক না খেয়ে মরবে। আমার একেলার সুখের জন্য কি আমি বৃষ্টি বন্ধ করতে পারি? তুমি আমায় একটু দাওয়াই খাইয়ে দাও! স্রেফ পাঁচ ফোঁটা রক্ত!

দীপু খানিকক্ষণ হাঁ করে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, এখন আপনার বাড়ি যাব, অনেক দেরি হয়ে যাবে, আমার মা খুব চিন্তা করবেন! আমি কাল যদি আপনার বাড়ি যাই? কাল মাকে বলে আসব যে একটু দেরি হবে।

কাল? ঠিক আসবে?

হ্যাঁ, আসব! আপনি ভাববেন না যে, আমি পাঁচ ফোঁটা রক্ত দিতে ভয় পাই। আমি আজকে এখন বাড়ি যাব।

তা হলে এসো কালকে!

দীপু বারবার পেছনে তাকাতে-তাকাতে চলে গেল পার্কটা পেরিয়ে। লোকটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি নেমে গেল আবার।

দীপু অবশ্য এই ঘটনাটা বাড়িতে কারুকে বলল না। কিন্তু লোকটা তাকে দারুণ দারুণ ম্যাজিক শিখিয়ে দেবে ভেবে সে খুব উত্তেজিত হয়ে রইল। পাঁচ ফোঁটা রক্ত তো অতি সামান্য ব্যাপার।

সেদিন বিকেল থেকে সারা রাত বৃষ্টি হল। পরের দিনও সেই রকম বৃষ্টি। সেদিন রবিবার, দীপুর ইস্কুল বন্ধ। তবু বিকেলের দিকে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করার নাম করে সে চলে এল সেই পার্কে। সেই লোক্টা নেই। এত বৃষ্টির মধ্যে কেউই পার্কে আসেনি। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে চলে এল দীপু।

এরপর পর-পর কয়েকদিন চলল খুব বৃষ্টি। আকাশে রোদই ওঠে না। দীপুর খালি মনে হয়, সেই লোকটা কিছু না খেয়ে আছে। আরও দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওষুধ খাবে কী করে। অন্য কোনও ছেলে কি পাঁচ ফোঁটা রক্ত দেবে?

বৃষ্টির জন্য ইস্কুল বন্ধ রইল দুদিন। তার পরের শনিবার দীপু ছুটির পরেই দৌড়ে এল পার্কে। লোকটা আজও বসে নেই তার সেই নিজের জায়গাটায়। কিন্তু সেই বেঞ্চটার ওপরে একটা লাল রঙের দড়ি পড়ে আছে।

এটা কি সেই ম্যাজিকের দড়ি? লোকটা দীপুর জন্য রেখে গেছে? কিন্তু দীপু সেই দড়িটা ছুঁয়ে কিছুই করতে পারল না। লোকটা তো তাকে তার সেই জ্ঞান কিংবা ম্যাজিক শিখিয়ে যায়নি!

লোকটিকে আর কোনওদিন দেখতে পায়নি দীপু।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *