Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » লেটার বক্স || Nimai Bhattacharya

লেটার বক্স || Nimai Bhattacharya

মানুষ মনে মনে কত কথাই বলে

মানুষ মনে মনে কত কথাই বলে। বলবেই। কখনো নিজেকে, কখনো অন্যকে। মানুষের সেই অনুচ্চারিত ভাষা কখনো কখনো ছায়া মূর্তি ত্যাগ করে জীবন্ত রূপ নেয়-কথায় বা চিঠিতে।

আশেপাশে হাতের কাছে যাদের পাওয়া যায়, শুধু তাদের সঙ্গেই আমরা কথা বলি। বলতে পারি। কিন্তু কজন মানুষকে হাতের কাছে পাওয়া যায়? নাকি সম্ভব? কত আত্মীয়-বন্ধু প্রিয়জনই তো দূরের বাসিন্দা। দূরের প্রবাসের এইসব মানুষদের সঙ্গেই তো বেশী কথা বলতে মন চায় কিন্তু তা কী সম্ভব?

এই দূরের মানুষদের সঙ্গে কথা বলার লোভেই আমরা চিঠি লিখি। হাজার হোক চিঠি তো শুধু অক্ষর দিয়ে গড়া দু চারটে বাক্যের সমাবেশ নয়। চিঠি হচ্ছে মানুষের মনের দর্পণ প্রাণের প্রতিবিম্ব।

রথের মেলায় কিছু মানুষ হারিয়ে যায়। সমবেদনশীল মানুষের সাহায্যে কিছু কিছু পথভ্রষ্ট মানুষ আবার আপন ঘরে ফিরে আসেন। কাউকে আবার থানা-পুলিসের শরণাপন্ন হতে হয়। তবুও কী সবাই ঘরে ফেরার সৌভাগ্য লাভ করে?

না। সম্ভব নয়। কেউ কেউ চিরদিনের জন্য, চিরকালের জন্য হারিয়ে যান। যাবেই।

মানুষের মত চিঠিপত্র ও যে পথভ্রষ্ট হয়, ঘরে ফেরার পথ খুঁজে পায় না এবং তাদের নিয়েও যে এত কাণ্ড হয়, তা কী আগে জানতাম? সেদিনের সে অঘটন না ঘটলে হয়তো কিছুই জানতে পারতাম না। অনেক দিন আগেকার কথা। আমি তখন পঁচিশ টাকা মাইনের রিপোর্টার। তবু সব রকম খবর সংগ্রহে আমার উৎসাহের সীমা নেই। রবীন্দ্রজয়ন্তী, মনুমেন্টের পাদদেশের বিশাল জনসমাবেশ থেকে লালবাজার-রাইটার্স বিল্ডিং সব-কিছু কভার করি। আরও কত কি।

সেদিন ছিল বিরোধী দলগুলির রাইটার্স অভিযান। তখন ষোল আনায় এক টাকা হতো বলেই বোধ হয় রাজনৈতিক দলের সংখ্যাও কম ছিল। এখন একশটি আণ্ডা-বাচ্চা নিয়ে এক টাকায় সংসার বলেই বোধ হয় সব রাজনৈতিক দলগুলিই অনেক ছানা প্রসব করেছে। তাইতো তখন তিন-চারটে বিরোধী দল-হুঁঙ্কার দিলে সাড়ে ছফুট লম্বা চীফ মিনিস্টারেরও হৃদকম্প হতো। তাছাড়া তখন গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের ফুলঝুরি এত ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েনি বলেই বোধ হয় বিরোধী দলগুলির অভিযানকে রাজভবন অতিক্রম করে রাইটার্স বিল্ডিং এর অনেক কাছে আসতে দেওয়া হতো।

সেদিন এই রকমই এক সরকার-বিরোধী অভিযানকে পুলিস বাধা দিল ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের প্রায় উত্তর সীমান্তে মিশন রোর কাছাকাছি, লালদীঘির একটু দূরে। তখন ঐ ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীটই ছিল কলকাতার রাজনৈতিক কুরুক্ষেত্র। কখনও দুচারটে জ্বালাময়ী ভাষণ ও সরকারের দরবারে স্মারকলিপি পেশ করেই বিক্ষোভের পরিসমাপ্তি ঘটত। কখনও আবার শুরু হতো দক্ষদজ্ঞ।

চোখের নিমেষেই দপ করে জ্বলে উঠল আগুন। প্রথমে এলো পাথাড়ি কাঁদানে গ্যাস কয়েক মুহূর্ত পরেই গুলী। পর পর কয়েক রাউণ্ড। হাজার হাজার লোকের দৌড়াদৌড়ি হুড়োহুড়ির মাঝখানে আমিও চোখে একটু জল দেবার জন্য পাগলের মত এদিক ওদিক করছি। হঠাৎ খেয়াল হল ডি-এল-ও অফিসের সিঁড়ির একপাশে এক ফলওয়ালার পরিত্যক্ত জলের পাত্র পড়ে আছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি, কে বা কারা সে জলের পাত্র আগেই নিঃশেষ করেছে। সমস্ত পৃথিবীটা অন্ধকার দেখছি। ঠিক সেই চরম মুহূর্তে হঠাৎ চিৎকার, এই খোকা, গুলী খেয়ে মরবে। শীগগির ভিতরে এসো। এর পরেই কে যেন আমাকে একটানে অফিস ঘরের ভিতরে টেনে নিয়েই বকুনি, পলিটিক্স করতে গিয়ে কী মরবে?

আমি পলিটিক্স করি না। আমি রিপোর্টার।

রিপোর্টার?

হ্যাঁ।

ব্যস! সেই সেদিন থেকে উনি আমার শৈলেনদা। আমার তখন কতই বা বয়স! বড় জোর উনিশ-কুড়ি। আর শৈলেনদা তখন পঞ্চাশের ঘরে তবু কেমন একটা প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠল। রাইটার্স লালবাজারে বেশী কাজ না থাকলে মাঝেমাঝেই চলে যাই ঐ ডি-এল-ও অফিসে শৈলেনদার কাছে চা টোস্ট খাই গল্প করি। আস্তে আস্তে ওর গোয়বাগানের বাড়িতেও যাতায়াত শুরু হল।

বুঝলে বাচ্চু, মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। কী ভেবেছিলাম আর কী হল!

ছাদে বসে চা-মুড়ি খেতে খেতে শৈলেনদা একবার বহু দূরের আকাশের কোলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে বললেন, খুব ইচ্ছে ছিল অধ্যাপক হব কিন্তু সারাটা জীবনই এই ডি-এল-৪ অফিসে কাটিয়ে দিলাম।

রথের মেলায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের মত পথভ্রষ্ট দিশাহারা চিঠি পত্রকে তার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে দেবার জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ও কুড়ি বছর আগে জন্ম নেয় ডি-এল-ও ডেড লেটার অফিস। যুদ্ধের বাজারের কণ্টক্টর অ্যালবার্ট ঘোষ যেমন আবার অঘোরনাথ ঘোষ হয়েছেন, ডি-এল-ও অফিসেরও নতুন নামকরণ হয়েছে। এখন এর সরকারী নাম অর-এল-ও। বিটান লেটার অফিস! তবে শৈলেন দাদাদের মত পুরানো আমলের সবাই বলেন ডি-এল-ও।

শৈলেনদা চায়ের কাপে এক চুমুক দিয়ে একটু ম্লান হেসে বললেন, ন্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে রচি বেড়াতে গিয়েই সব গড়বড় হয়ে গেল।

কেন?

আমার মেজ জ্যেঠু রাঁচী হেড পোস্ট অফিসের পোস্টমাস্টার ছিলেন। বিরাট কোয়াটার্স। চারদিকে কত খোলামেলা জায়গা। কলকাতায় তো বিশেষ খেলাধুলা করতে পারতাম না, রাচী আমার খুব ভাল লাগত।

শৈলেনদা একটু থেমে এক গাল মুড়ি আর এক চুমুক চা খেয়ে আবার বলেন, জেঠুর দু ছেলেই তখন কলেজে পড়ে। ওরা কলেজে গেলে আমি রোজ পোস্ট অফিসেই বেশ কিছু সময় কাটাতাম।

সেদিনও শৈলেনদা পোস্ট অফিসের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ সটিং-এর ওখানে যেতেই একজন সটার ওর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, দেখতে খোকাবাবু এই ঠিকানাটা পড়তে পারে। কিনা।

চিঠিটার উপর দিয়ে বেশ কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে উনি আস্তে আস্তে বললেন, মো-বাবা-দু…

ওর মুখের কথা শেষ হবার আগেই দুজন সটার প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, হা, হা, মোরাবাদীই হোগা।

বাস! এই অপাঠ্য ঠিকানা উদ্ধারের খ্যাতির কৃপায় শৈলেনদাকে বেজেই দু পাঁচটে ঠিকানা পড়ে দিতে হয়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শৈলেনদা সটিং সেক্সনের সবার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। ওঁর দু-এক ঘণ্টা সময় এখানে বেশ কেটে যায়।

দু ইজ দিস বয়?

বিনা মেঘে বজ্রঘাতও এর চাইতে ভাল। স্বয়ং পারিটেনডেন্ট বঅ পোস্ট অফিস লিভিংস্টোন সাহেবের কথা শুনেই সটিং সেক্সনের সবার মুখ শুকিয়ে গেল।

পোস্টমাস্টার কৃপাসিন্ধু চৌধুরী খুব ভালভাবেই জানতেন, পোস্ট অফিসের মধ্যে এবং বিশেষ করে সটিং সেক্সনে ভ্রাতুস্পুত্রের আগমন ঠিক হয়নি। তবু তিনি সাহস সঞ্চয় করে বললেন, স্যার, ও আমার ভাইপো। এ কদিনের মধ্যেই অপাঠ্য ঠিকানা উদ্ধারের একজন এক্সপার্ট হয়ে গেছে।

ইজ ইট! মিঃ লিভিংস্টন হাসতে হাসতে সর্টারদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস কবলেন, টুমাদের মত করে?

সব সর্টাররা এক সঙ্গে ঘাড় কাত করে বলল, জী হুজুর!

ব্যাস! আর এক-মুহূর্ত দেরি না। মিঃ লিভিংস্টোন সঙ্গে সঙ্গে পোষ্টমাষ্টার সাহেবকে বললেন, ভাইপোকে নিয়ে তুমি কলকাতায় মিঃ মুর-এর সঙ্গে দেখা করবে। আমি ওকে আগে থেকে বলে রাখব। হি মাস্ট জয়েন ডি-এল-ও।

সেদিন কৃপাসিন্ধু চৌধুরীর সেকি আনন্দ! উল্লাস! ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে কোয়ার্টার্সে ফিরেই চিৎকার করে গিন্নীকে বললেন, শুনছ! স্বয়ং লিভিংস্টোন সাহেব বাদলের চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। এই সব সাহেবদের অধীনে চাকরি করেও আনন্দ।

চৌধুরী গিন্নী পান-দোক্তা লাঞ্ছিত দন্ত বিকশিত করে বললেন, বল কি গো!

ওরে বাপু হ্যাঁ! এ হচ্ছে ইংরেজের বাচ্চা! পাকা জহুরী। এরা এক মিনিটে ধরতে পারে কাকে দিয়ে কি হবে। কৃপাসিন্ধুবাবু একটু চাপা হাসি হেসে বললেন, এই ক্ষমতা না থাকলে ওরা পৃথিবী ব্যাপী সাম্রাজ্য চালাচ্ছে কী করে?

চৌধুরী গিন্নী শৈলেনদার মাথায়-মুখে হাত দিয়ে বললেন, সুখে থাক বাবা! বাবা-মাকে সুখী কর।

এবার কৃপাসিন্ধুবাবু শৈলেনদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর মত ভাগ্যবান লাখে একজন হয় না। সাহেবের মান রাখিস বাবা! তা না হলে আমি মুখ দেখাতে পারব না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 1 of 7 ): 1 23 ... 7পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *