Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যশোমতী || Rajshekhar Basu

যশোমতী || Rajshekhar Basu

মেজর পুরঞ্জয় ভঞ্জ এম. ডি, আই. এম. এস অনেক কাল হল অবসর নিয়েছেন, রোগী দেখাও এখন ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর বয়স পচাত্তর পেরিয়েছে। কলকাতায় নিজের বাড়ি আছে, কিন্তু স্থির হয়ে সেখানে থাকতে পারেন না, বছরের মধ্যে আট-ন মাস বাইরে ঘুরে বেড়ান।

শীত কাল। পুরঞ্জয় দেরাদুনে এসেছেন, আট-দশ দিন এখানে থাকবেন। রাজপুর রোডে শিবালিক হোটেলে উঠেছেন, সঙ্গে আছে তাঁর পুরনো চাকর বন্দাবন। রাত প্রায় আটটা, পুরঞ্জয় তাঁর ঘরে ইজি চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছেন। বৃন্দাবন এসে জানাল, এক বড়ী গিন্নীমা দেখা করতে চান। পুরঞ্জয় বললেন, আসতে বল তাঁকে।

যিনি এলেন তিনি খুব ফরসা, একটু মোটা, গাল আর তনিতে বলি পড়েছে। মাথায় প্রচুর চুল, কিন্তু প্রায় সবই পেকে গেছে। পরনে সাদা গরদ, সাদা ফ্লানেলের জাম্য, তার উপর সাদা আলোয়ান। গলবস্ত্র হয়ে প্রণাম করে পরেঞ্জয়ের দিকে একদষ্টে চেয়ে রইলেন।

পুরঞ্জয় বললেন, কোথা থেকে আসা হচ্ছে? চিনতে পারছি না তো।

আগন্তুকা বললেন, আমি যশো, আলীপুরের যশোমতী।

–সেকি! তুমি যশো, যশোমতী গাঙ্গুলী, কি আশ্চর্য!

—গাঙ্গুলী আগে ছিলুম, এখন মুখুজ্যে।

—ও, তোমার স্বামী মুখুজ্যে। তোমাকে দেখে চমকে গেছি, পঞ্চান্ন বছর পরে আবার দেখা হল, চিনব কি করে? তোমার এক মাথা কালো চুল ছিল, সাদা হয়ে গেছে। ছিপছিপে গড়ন ছিল, এখন মোটা হয়ে পড়েছ। মুখের চামড়া ঢিলে হয়ে গেছে, গাল কুঁচকে গেছে। তুমি অতি সুন্দরী তন্বী কিশোরী ছিলে, হাসলে গালে টোল পড়ত, দাঁত ঝিকমিক করে উঠত।

যশোমতী ম্লান মুখে হাসলেন।

-ওই ওই! এখনও গালে টোল পড়েছে, দাঁত ঝিকমিক করেছে।

–বাঁধানো দাঁত।

–তা হক, আগের মতনই সুন্দর ঝিকমিকে। আমাদের শারীর শাস্ত্রে বলে, দাঁত নখ চুল আর শিঙ জীবন্ত অঙ্গ নয়, এদের সাড় নেই। আসল আর নকলে প্রায় সমানই কাজ চলে।

–সব কাজ চলে না। ছোলা ভাজা চিবুতে পারি না।

—ভাল ডেন্টিস্টকে দিয়ে বাঁধালে পারবে। যশো, তুমি এখনও কোকিলকণ্ঠী, তবে গলার স্বর একটু মোটা হয়েছে। আমাকে দেখেই চিনতে পেরেছ?

–না পারব কেন। তোমার চুল পেকেছে, টাক পড়েছে, কিন্তু মুখের ছাঁদ বদলায় নি, গালও বেশী বেড়ায় নি, গলার স্বরও আগের মতন আছে।

-দেরাদনে কবে এলে? আমার সন্ধান পেলে কি করে?

–পরশু এখানে পৌঁছেছি। আমার নাতি ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার হয়ে এসেছে, তার কাছেই আছি। আজ সকালে এই হোটেলে দূর সম্পর্কের এক বোনপোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলুম। অতিথিদের লিস্টে তোমার নাম দেখলুম।

–নাতিকে নিয়ে এলে না কেন?

—আজ এত কাল পরে তোমার সন্ধান পেলম, তাই একাই দেখা করতে ইচ্ছে হল। নাতি নাতবউকে কাল দেখো। এখন তোমার পরিবারের কথা বল। সঙ্গে আন নি?

–পরিবার কোথা, বিয়েই করি নি। অবাক হলে কেন, অবিবাহিত বড়ো তো কত শত আছে। তোমার খবর বল। স্বামী আর শ্বশুরবাড়ি ভাল পেয়েছিলে তো?

মাথা নত করে যশোমতী বললেন, স্বামী শুধু সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। আমি তোমার সঙ্গে মিশতুম এই অপরাধে শ্বশুর বাড়ির সকলে আমাকে কলঙ্কিনী মনে করতেন। আমি বাবার এক মাত্র সন্তান, ভবিষ্যতে তাঁর সম্পত্তি পাব, শুধু এই কারণেই তাঁরা আমাকে পুত্রবধু করেছিলেন। বিয়ের দু বছর পরেই স্বামী মারা যান। একটি ছেলে ছিল, আমার সব দুঃখ দূর করেছিল, সেও জোয়ান বয়সে চলে গেল। পুত্রবধূও প্রসবের পরে মারা গেল। এখন একমাত্র সম্বল নাতি ধ্রুব, আর তার বউ রাকা।

–উঃ, অনেক শোক পেয়েছ। ললাটের লিখন আমি মানি না, তব, কি মনে হচ্ছে জান? তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে, আমি অব্রাহণ। তোমার বাপ মা মনে করতেন আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিলে গোহত্যা রহমহত্যার সমান পাপ হবে। তাঁরা যদি গোঁড়া না হতেন, আমাদের বিয়েতে যদি মত দিতেন, তবে তুমি এখনও সধবা থাকতে, দু-চারটে ছেলেমেয়েও হয়তো বেচে থাকত। কথাটা মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেল, কিছু মনে করো না।

–মনে করব কেন। ছোট বেলায় তুমি রেখে ডেকে কথা বলতে, এখনও দেখছি তোমার মনের আর মুখের তফাত নেই। তুমি কেন বিয়ে কর নি তা বল।

–করি নি তার কারণ, তোমাকে প্রচণ্ড ভালবেসেছিলাম, সহজে ভুলতে পারি নি। আমার বিয়ে দেবার জন্যে বাপ-মা অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমার মন তোমাকেই আঁকড়ে ছিল। তোমার বিয়ে যখন অন্যের সঙ্গে হল তখন অত্যন্ত ঘা খেয়েছিলাম, দেহ মন প্রাণ যেন কেউ পিষে ফেলেছিল। পরে অবশ্য একটু একটু করে সামলে উঠেছিলুম, তোমাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু বিয়ের ইচ্ছে আর হয় নি।

–কোনও মেয়ের সঙ্গে মেলামেশা কর নি?

–তোমার কাছে মিথ্যা বলব না। আমি শুকদেব বা রামকৃষ্ণ পরমহংস নই, পতন হয়েছিল, কিন্তু অল্প কালের জন্যে। একদিন স্বপ্ন দেখলাম, তোমার মতদেহ যেন আমি পা দিয়ে মাড়িয়ে চলছি। আতনাদ করে জেগে উঠলম, ধিককারে মন ভরে গেল। হিন্দুর মেয়ে ছেলেবেলা থেকে সতীত্বের সংস্কার পায়, তাই তারা সহজেই শুচি থাকে। কিন্তু পুরুষের কোনও শিক্ষা পায় না। মেয়েদের বলা হয় সীতা সাবিত্রী হৈমবতীর মতন সতী হও, কিন্তু পুরুষদের কেউ বলে না–রামচন্দ্রের মতন একনিষ্ঠ হও।

–কি নিয়ে এত কাল কাটালে?

–চাকরি, রোগীর চিকিৎসা, অজস্র বই পড়া, আর ঘুরে বেড়ানো। তোমার স্মৃতি ক্রমশ মুছে গেলেও যেন মনে ছেকা দিয়ে স্টেরাইল করে দিয়েছিল, সেখানে আর কেউ স্থান পায় নি। ওকি, কাঁদছ নাকি? বড় বড় দুঃখের ভোগ তো তোমার চুকে গেছে, এখন আমার তুচ্ছ কথায় কাতর হচ্ছ কেন? শোন যশো, তোমাকে অনিচ্ছায় বিয়ে করতে হয়েছিল, আর আমি এখনও কুমার আছি, এর জন্যে নিজেকে ছোট ভেবো না। তোমার বয়স ছিল মোটে পনরো, এখনকার হিসেবে প্রায় খুকী। তুমি আমাকে খুব ভাল বাসতে তা ঠিক, কিন্তু বাল্য কালের সে ভালবাসা হচ্ছে কাফ লভ, ছেলেমানুষী ব্যাপার, তা চিরস্থায়ী হতে পারে না।

–তুমি কিছুই বোঝ না।

—কিছ, কিছু বুঝি। তুমি ছিলে সেকেলে গোবেচারী শান্ত মেয়ে, বাপ-মা যখন বিয়ে দিলেন তখন আপত্তি জানাবার শক্তিই তোমার ছিল না, আমাকে ছাড়া আর কাকেও বিয়ে করবে না এ কথা মুখ ফুটে বলা তোমার অসাধ্য ছিল। আর আমি ছিলাম তোমার চাইতে পাঁচ বছরের বড়, প্রায় সাবালক, বাপ-মা আমাকে নিজের মতে চলতে দিতেন। তুমি ছিলে নিতান্তই পরাধীন, আর আমি ছিলাম প্রায় স্বাধীন। আইবড়ো থাকা তোমার পক্ষে অসম্ভব ছিল, কিন্তু আমার পক্ষে ছিল না। যশো, একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, দোষ নিও না। মনে কর সেই পঞ্চান্ন বছর আগে তুমি যেন ছিলে একালের মেয়ে, বালিকা নয়, কিশোরী নয়, একুশ-বাইশ বছরের সাবালিকা। যদি আমি তোমাকে বলতুম, যশো, তোমার বাপ-মা নাই বা মত দিলেন, তাঁদের অমতেই আমাদের বিয়ে হক, তোমার ভার নেবার সামর্থ্য আমার আছে, তা হলে তুমি রাজী হতে?

—নিশ্চয় হতুম।

–যাঁরা তোমাকে আজন্ম পালন করেছেন সেই বাপ-মার মনে নিদারুণ কষ্ট দিয়ে তাদের ত্যাগ করতে পারতে? যার সঙ্গে তোমার পরিচয় খুব বেশী নয়, যে তোমার আপন শ্রেণীর নয়, সেই আমাকেই বরণ করতে?

–নিশ্চয় করতুম।

–থ্যাংক ইউ যশো, তোমার উত্তর শুনে আমি ধন্য হয়েছি। স্ত্রী পুরুষের আকর্ষণ একটা প্রাকৃতিক বিধান, কিন্তু তার সময় আছে, তখন বাপ মা ভাই বোনের চাইতে প্রেমাস্পদ বড় হয়ে ওঠে। তবে বিবাহের পর স্বামীরও প্রতিদ্বন্দ্বী আসে—সন্তান। কিশোর বয়সে তোমার যা অসাধ্য ছিল, সমাজের দৃষ্টিতে যা অন্যায়ও গণ্য হত, যৌবনকালে বিনা দ্বিধায় তা তুমি পারতে, তোমার এই কথা শুনে আমি কৃতার্থ হয়েছি।

–কি যে বল তার ঠিক নেই। পনরো বছরের সশ্রী যশো যে-কথা বলতে পারে নি বলে তোমার মন ভেঙে গিয়েছিল, সেই কথা সত্তর বছরের বড় বিশ্রী যশো তোমাকে আজ মুখ ফুটে বলতে পেরেছে এতে তোমার লাভটা কি হল, তুমি কৃতার্থই বা হবে কেন? যা ঘটেছিল তার বদলে যদি অন্য রকম ঘটত—এ রকম চিন্তা তো আকাশকুসুম রচনা, বড়োবড়েীর পক্ষে নিছক পাগলামি।

-পাগলামি নয়, মনের পটে ছবি আঁকা। যে অতীত কাল চলে গেছে তার ধংস হয় নি, তাকে আবার কল্পনার জগতে ফিরিয়ে আনা যায়, তাতে নতুন করে রঙ দেওয়া চলে।

যাক গে ওসব বাজে কথা। শোন, কাল তুমি আমার ওখানে খাবে। টপকেশ্বর রোড, জিম-কর্বেট লজ। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ এসো। আসবে তো? নাতিকে পাঠাতে পারি, সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।

–না না, পাঠাতে হবে না, আমি একাই যেতে পারব, ওদিকটা আমার জানা আছে। কিন্তু রাত্রে আমি দুধ-মুড়ি কি চিড়ে-দই খাই।

-বেশ তো, ফলারেরই ব্যবস্থা করব।

যশোমতী চলে গেলেন।

পরদিন সন্ধ্যাবেলা পরয় ভঞ্জ জিম-কর্বেট লজে উপস্থিত হলেন। যশোমতী স্মিতমখে নমস্কার করলেন, তাঁর নাতি ধ্রুব আর নাতবউ রাকা দুদিক থেকে পুরঞ্জয়ের দুই পা জড়িয়ে ধরে কলধ্বনি করে উঠল।

পুরঞ্জয় বললেন, যশোমতী, এরা তো আমাকে চেনে না, তুমি ইনট্রোডিউস করে দাও।

যশোমতী বললেন, পঞ্চান্ন বছর পরে কাল তোমাকে দেখেছি। আমি তোমার কতটুকু জানি? তুমিই নিজের পরিচয় দাও না।

পুরঞ্জয় বললেন, বেশ। শোন দাদাভাই ধ্রুব, আর কি নাম তোমার রাকা। আমি হচ্ছি ডাক্তার পুরঞ্জয় ভঞ্জ, মেজর, আই. এম, এস, রিটায়াড়। চিকিৎসা বিদ্যা এখন প্রায় ভুলে গেছি। বহু, কাল আগে তোমাদের এই ঠাকুমার ছেলেবেলার সঙ্গী ছিলাম, আলীপুরে আমাদের বাড়ি পাশাপাশি ছিল। ওঁকে খেপাবার জন্যে আমি বলতুম, যশোটা থসথসোটা। উনি আমাকে বলতেন, পরোটা ঘুরঘরোটা। আমরা যেন ভাই বোন ছিলম।

ধ্রুব বলল, শুধুই ভাই বোন?

–তার চাইতে বরং বেশী। একদিন দেখা না হলে অস্থির হতুম।

হিহি করে হেসে রাকা চলল, দাদ, শুনেছি আপনি স্পষ্টবক্তা লোক, রেখে ঢেকে কিছু বলতে পারেন না। কেন কষ্ট করে বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলবেন? মন খোলসা করে বলে ফেলুন। আমরা সব জানি, আমাদের জেরার চোটে ঠাকুমা সব কবুল করেছেন।

পুরঞ্জয় বললেন, যশো, তুমি দিব্যি একজোড়া শুক-সারী টিয়া পাখি পুষেছ। এরা আমাকে ফ্যাসাদে ফেলবে না তো?

হাত নেড়ে রাকা বলল, না না, আপনার কোনও চিন্তা নেই, নিভয়ে সত্যি কথা বলুন। ঠাকুমা আর আমরা সবাই খুব উদার, আমাদের কোনও সেকেলে অন্ধ সংস্কার নেই।

–বেশ বেশ। তা হলে নিশ্চয় শুনেছ যে যশোর সঙ্গে আমার প্রচণ্ড প্রেম হয়েছিল। তার পর ওর বিয়ে হয়ে যেতেই আমাদের ছাড়াছাড়ি হল, মনের দুঃখে আমি বোম্বাইএ গিয়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হলাম, তার পর বিলাত গেলুম। কাল পঞ্চান্ন বছর পরে আবার ওঁর সঙ্গে দেখা হল। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু দেখে হঠাৎ মনের মধ্যে একটা তোলপাড় উঠল, যাকে বলে আলোড়ন, বিক্ষোভ, আকুলিবিকুলি।

ধ্রুব বলল, অবাক করলেন দাদ। বুড়ীকে হঠাৎ দেখে বড়োর ওল্ড ফ্লেম দপ করে জলে উঠল, আগেকার প্রেম উথলে উঠল।

–ঠিক আগেকার প্রেম নয়, অন্য রকম আশ্চর্য অনুভূতি। তোমাদের তা উপলব্ধি করবার বয়স হয় নি। যথাসম্ভব বুঝিয়ে দিচ্ছি শোন। নিশ্চয়ই জান, তোমাদের এই ঠাকুমা অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন।

রাকা বলল, আমার চাইতেও?

-মাই ডিয়ার ইয়ং লেডি, তুমি সুন্দরী বট, কিন্তু তোমার সেকালের দিদিশাশুড়ীর তুলনায় তুমি একটি পেচী। যদি দৈবক্রমে ওঁর সঙ্গে আমার বিয়ে হত তা হলে গত পঞ্চান্ন বছরে আমার চোখের সামনেই উনি ক্রমশ বাড়ী হতেন। ধাপে ধাপে নয়, একটানা ক্রমিক পরিবর্তন, কিশোরী থেকে যুবতী, তার পর মধ্যবয়স্কা প্রৌঢ়া, তার পর বদ্ধা। সবই সইয়ে সইয়ে তিল তিল করে ঘটত, আমার আশ্চর্য হবার কোনও কারণ থাকত না। কবে উনি মোটাতে শুরু করলেন, কবে চশমা নিলেন, কবে দাঁত পড়ল, কবে চুলে পাক ধরল, প্রেমালাপ ঘুচে গিয়ে কবে সাংসারিক নীরস বিষয় একমাত্র আলোচ্য হয়ে উঠল, এ সব আমি লক্ষাই করতুম না। বক্ষলতার যৌবন বার বার ফিরে আসে, কিন্তু মানুষের ভাগ্যে তেমন হয় না, বাল্য যৌবন জরা আমাদের অবশ্যম্ভাবী, তার জন্যে আমরা প্রস্তুত থাকি। কিন্তু সেকালের সেই পরমা সুন্দরী কিশোরী যশো, আর পঞ্চান্ন বৎসর পরে যাকে দেখলুম, সেই বৃদ্ধা যশো-এই দইএর আকাশপাতাল প্রভেদ, তাই হঠাৎ একটা প্রবল ধাক্কা খেয়েছিলাম।

রাকা বলল, হায় রে পুরুষের মনু রূপ ছাড়া আর কিছুই বোঝে। আমি এখনই তো পেচী, বড়ো হলে কি যে গতি হবে জানি না।

–ভয় নেই দিদি। তোমার ক্রমিক রপান্তর ধ্রুবর চোখের সামনে একটু একটু করে হবে, ও টেরই পাবে না, ডায়ারিতেও নোট করবে না। শেষ বয়সে যদি হাড়গিলে কি শকুনি গৃধিনী হয়ে পড় তাতেও ধ্রুব শকড হবে না। প্রেমের দুই অল্প, একটা দেহাশ্রিত, আর একটা দেহাতীত। তোমাদের মনে এখন এক সঙ্গে দুটো মিশে আছে। কিন্তু যতই বয়স বাড়বে ততই প্রথমটা লোপ পাবে, শুধু দ্বিতীয়টাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে।

রাকা বলল, পঞ্চান্ন বছর পরে ঠাকুমাকে হঠাৎ দেখে আপনার মনে একটা ধাক্কা লেগেছিল তা বুঝলুম, কিন্তু তার ফলে আপনার হদয়ের অবস্থা অর্থাৎ ঠাকুমার প্রতি আপনার মনোভাব কি রকম দাঁড়াল?

–পর পর দুটো অনুভূতি হল, যশোমতীর দুই রূপে দেখলুম। ওঁকে ভুলেই গিয়েছিলাম, কিন্তু ওঁর হাসি দেখে আর গলার স্বর শনে পঞ্চান্ন বছর আগেকার সেই তন্বী কিশোরী মতি মনের মধ্যে ফটে উঠল। তার কিছুমাত্র বিকার হয় নি, একবারে যথাযথ অক্ষয় হয়ে আছে। তার যে পরিবর্তন পরে ঘটেছে তা তো আমি দেখি নি, সেজন্যে তার কোনও প্রভাবই আমার চিত্তস্থিত মুতির ওপর পড়ে নি। তার পরেই যশোর অন্য এক রুপ দেখলুম, দেহের নয়, আত্মার। আমার বুদ্ধিতে মন আর আত্মা একই বস্তু, বয়সের সঙ্গে তার পরিবর্তন হয়, কিন্তু ধারা বজায় থাকে সেজন্য চিনতে পারা যায়। যেমন, নদীর জলপ্রবাহ নিত্য নতন, কিন্তু প্রবাহিণী একই। যশোমতীর কথায় বুঝলম, উনি সেই আগের মতন সংস্কারের দাসী গরজনের আজ্ঞাপালিকা ভীর মেয়ে নন, ওঁর স্বাধীন বিচারের শক্তি হয়েছে, মনের কথা বলবার সাহস হয়েছে। উনি যদি সেকালের কিশোরী না হয়ে একুশ-বাইশ বছরের আধুনিকী হতেন তবে সমস্ত বাধা অগ্রাহ্য করে আমাকেই বরণ করতেন।

যশোমতী বললেন, এই, তোরা চুপ কর, কেন ওঁকে অত বকাচ্ছিস, খেতে দিবি না?

রাকা বলল, বা রে, উনি নিজেই তো বকবক করছেন, আমরা শুধ; একটু উসকে দিচ্ছি। আসন দাদ, এইবার খেতে বসুন।

যশোমতী বললেন, টেবিলে খাবার দেব কি, না আসন পেতে দেব?

পুরঞ্জয় বললেন, খাওয়াবে তো ফলার। টেবিলে তা মানায় না, আসনই ভাল। মেজেতেই বসব।

খাদ্যের আয়োজন দেখে পুরঞ্জয় বললেন, বাঃ, কি সুন্দর! সাত্ত্বিক ভোজন একেই বলে। সাদা কম্বলের আসন, সাদা পাথরের থালায় ধপধপে সাদা চিড়ে, সাদা কলা, সাদা সন্দেশ, সাদা বরফি, সাদা নারকেল কোরা, সাদা পাথরবাটিতে সাদা দই। আবার, সামনে একটি সাদা বেরাল বসে আছে। যশো, তোমার রুচির তুলনা নেই।

রাকা বলল, আসল জিনিসেরই তো বর্ণনা করলেন না। এই পবিত্র শুভ্র খাদ্যসম্ভার পরিবেশন করেছেন কে? একজন শুভ্রবসনা শুভ্রকেশা শুভ্রকান্তি শুচিস্মিতা সুন্দরী, যাঁর দুটো মতি আপনার চিত্তপটে পার্মানেন্ট হয়ে আছে।

পুরঞ্জয় বললেন, সাধু, সাধু চমৎকার, বহুত আচ্ছা, ওআহ, খুব, একসেলেন্ট।

রাকা বলল, দাদ, একটি কথা নিবেদন করি। আমাদের দুজনকে যশোমতী তো আপনি শুকসারী বলেছেন। আমি বলি কি, আপনিও আমাদের এই নীড়ে ঢুকে পড়ন, ঠাঁই আছে। যশোমতী দেবীর পাণিগ্রহণ করুন। দুটিতে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর মতন আমাদের কাছে থাকবেন, সবাই মিলে পরমানন্দে দিন যাপন করব।

যশোমতী বললেন, যা যাঃ, বেশী জেঠামি করিস নি।

পুরঞ্জয় বললেন, শোন রাকা দিদি। বড়ো বড়েীর বিয়ে বিলাতে খুব চলে, ভবিষ্যতে হয়তো এদেশেও চলবে, যেমন স্মোকড হ্যাম আর সার্ডিন চলছে। কিন্তু আপাতত এদেশের রচিতে তা বিকট। তার দরকারও কিছু নেই। যশোমতীর পবরপের ছাপ আমার মনে পাকা হয়ে আছে, ওঁর আত্মার স্বরুপও আমি উপলব্ধি করেছি, উনিও আমাকে ভাল করেই বুঝেছেন। এর চাইতে বেশী উনিও চান না, আমিও চাই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *