Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ম্যানুফ্যাকচ্যারাল ডিফেক্ট || Subhra Saha Shelley

ম্যানুফ্যাকচ্যারাল ডিফেক্ট || Subhra Saha Shelley

ম্যানুফ্যাকচ্যারাল ডিফেক্ট

কলাবতীদেবী সন্তানসম্ভবা শোনামাত্র স্বামী পরাণবাবুর আব্দার তার একখানি নিখুঁত পুত্রসন্তান চাই।

কলাবতীদেবী ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে কলাবেনী নাড়িয়ে সম্মতি তো দিয়ে ফেললেন কিন্তু নিখুঁত ব্যাপারটা নিয়ে বড় খুঁতখুঁতে হয়ে পড়লেন।

শেষে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন ” হে প্রাণনাথ ,এই নিখুঁত পুত্রসন্তান ব্যাপারখানা একটু বুঝিয়ে বলবেন।”

পরাণবাবু তার পরাণের সমস্ত মাধুরী ঢেলে জানালেন “নিখুঁত পুত্র সন্তান মানে হচ্ছে গিয়ে যার কোন খুঁত মানে দোষ থাকবে না।মানে যেমন ধর ছ’টা আঙ্গুল বা ঠোঁট কাটা ইত্যাদি গোছের আর কি —“
কলাবতীদেবী পুনরায় কলাবেনী খানি দুলিয়ে মনের খুঁতখুঁতে ব্যাপারটি বুঝে নিয়ে মানসিকভাবে ভগবানের কাছে হত্যে দিলেন। যেন তার একখানা নিখুঁত পুত্রসন্তানই হয়।
ভগবান ভক্তের এ হেন প্রার্থনায় গদগদ হয়ে কলাবতীর দেবীকে নিখুঁত পুত্রসন্তানই দিলেন।

প্রথম সন্তান লাভের খবর পেয়ে ব্যবসায়ী পরাণবাবু মুখ দেখবার জন্য আনা সোনার মালাটি দেবার আগে উল্টেপাল্টে খুঁত বা দোষ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পুত্রের গলায় সোনার মালাটি গলিয়ে দিয়েই ছেলের নাম রাখলেন “নির্দোষ”।

পরাণ গুণের প্রথম পুত্র “নির্দোষ গুণ” নাম নিয়েই বড় হতে লাগলো।

যখন সে সবে বছরদুয়েকের হবে একদিন রাতে কান্নাকাটি করে অস্থির ।কিছুতেই ঘুমোয় না। মা বাবা প্রাণের ধনের কাছে গিয়ে বলেন ” বাপধন , কি হয়েছে ? কাঁদছো কেনো? কিসের কষ্ট?”

নির্দোষ ঠোঁট ফুলিয়ে বলে “বিছানায় দোষ আছে “
কলাবতীদেবী তো অবাক। তিনি নিজে হাতে বিছানা ঝেড়ে পরিষ্কার করে তবেই মশারি লাগিয়েছেন সেখানে দোষ?

“কোথায় দোষ সোনা ? কিসের দোষ ?” কাতরকন্ঠে মায়ের প্রশ্ন।

চোখ কচলে কাজল লেপ্টে কালো চোখে শিশু নির্দোষ বলে তোষকে একটা শক্ত জিনিষ পিঠে লাগছে। তাতেই তার ঘুমের ব্যাঘাত।

পুত্রবৎসল পরাণবাবুর পরাণ জ্বলিয়া যাবার উপক্রম।

মাঝরাতে উঠে তোষকের শক্তজিনিষ খুঁজতে বসেন। পঞ্চাশকিলো তুলোর তোষক হাতড়ে তোষকের একজায়গায় সত্যি একটা কিছু পান তিনি।খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বের করে দেখেন সেটা আর কিছু নয় তুলোর বীজমাত্র।তাতে ছেলের ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে বা শিশু নির্দোষ তোষকের এমন একটি দোষকে অণুধাবন করবার ক্ষমতা রাখে ভেবে পরাণবাবুর পিতৃহৃদয় গর্বে ভরে ওঠে। যাইহোক সেই তুলোর বীজকে সরিয়ে সেইরাতের পুত্রের সুনিদ্রার বন্দোবস্ত করে দেন পরাণ বাবু।

সূত্রপাত সেখান থেকেই। নিদোর্ষ গুণ এখন বালক।স্কুলে যাতাযাত করে।

পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী। তবে স্কুলের মাষ্টারমশাইদেরও দোষ ধরতেও নির্দোষের জুড়ি নেই।

এ নিয়ে শিক্ষক মহলে প্রচলিত আলোচনা “ছেলেটি বড় ভালো তবে ভীষণ অভদ্র, অহঙ্কারী গোছের।সম্মান করতে জানে না কাউকে। সবার সামনে শিক্ষকদের ভুল ধরে ?”

ওদিকে স্কুলের কারো সাথে বন্ধুত্ব হলেও সেটা দুদিনের বেশী টেকে না। পাড়ার রামু নির্দোষের সহপাঠী।

পাড়ার সবাই খুব ভালোবাসে দামাল পরোপকারী রামুকে। রামুর সাথে নির্দোষের বন্ধুত্ব হলেও সেখানেও নির্দোষ দোষ খুঁজে পায় রামুর
রামু ভালো মানুষি দেখাতে এগুলো করে।

যাইহোক বিবাহযোগ্যপুত্রের বিবাহ দিতে শহরের নামীদামী সমস্ত ঘটকদের নিয়ে এসে হাজির করেন পরাণ গুণ।

একের পর এক মেয়ে দেখে আর তাদের দোষ বের করতে গিয়ে নির্দোষের নিজেরই ছাদনাতলা যাবার বয়সপ্রায় পেরিয়ে যায়। একশো ঊনচল্লিশ নম্বর পাত্রীর দোষবিচার করে দোষ কিছুটা ছাড় দিয়ে বিবাহপর্বটা সেরে ফেলেন।

পরাণবাবু ও কলাবতীদেবী ছেলের দোষবিচারের পারদর্শীতায় সর্বক্ষণ তটস্থ।এইবুঝি ছেলে কোন দোষ খুঁজে পেলো। এবার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে কিছুটা নিশ্চিন্ত।কারন ছেলে নিজেই পাত্রীর দোষবিচার করে তবেই ঘরে এনেছে।এ তো কম কথা নয়।

ছেলে বিয়ের পরপর ভীষণ খুশি।সে তো বৌকে মাথায় করে রাখে।

কয়েকমাস যেতে না যেতেই বৌ’য়ের বেনারসীতে দোষ ,সম্প্রদানের আংটিতে দোষ ,প্রনামী শাড়ীতে দোষ নিদোর্ষ গুণের নজরে আসে। তার হাঁটাতে দোষ ,কথা বলাতে দোষ ,খাওয়ারসময় শব্দ হয় —তাতে দোষ।একথায় স্ত্রীর দোষের ভাণ্ডার উন্মোচিত হতে থাকে নির্দোষের চোখে।অতএব বিচারসভায় নতুনবৌকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান।

মেধাবীছাত্র হিসেবে সরকারী চাকুরি পেলেও তার সহজাত ব্যবসা দোষবিচারের ব‌্যবসাতেই তিনি বেশী আনন্দ পান।

নির্দোষবাবুর স্ত্রী পাপপুণ্যে বিশ্বাসী। তিনি একদিন দুরুদুরু বুকে স্বামীকে বললেন “তুমি এমন করে সকলের দোষ ধরো— জানো ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কি বলে গেছেন।বলেছেন মানুষের দোষকে ছোট করে দেখো আর গুণীর গুণের প্রশংসা করো “

একথা শুনে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে নির্দোষবাবু “আরে রাখো তো তোমার ঐ ঠাকুর বুড়োকে। যার নিজেরই কোন ঠিক নেই।ও ব্যাটা জানেটা কি ক’টা বই পড়েছে ?কি কি পাশ করেছে। সারা জীবন শুধু টাকা মাটি মাটি টাকা বলেই চালিয়ে দিলো “

একথা শোনামাত্র নির্দোষবাবুর স্ত্রী কানে হাত চাপা দিয়ে একমনে স্বামীর মঙ্গলে প্রার্থনা করেন “দোষ নিও না প্রভু “।

দোষবিচারে পারদর্শী নির্দোষ গুণের নাম গোটা বিশ্বজুড়ে। এক কথায় তিনি জগৎবিখ্যাত। কন্যাদায় গ্রস্থ পিতারা এসে হাজির হবু জামাইয়ের দোষবিচার করাতে আবার পুত্রের পিতামাতারাও এসে লাইন দিয়ে বসে থাকেন হবু পুত্রবধূটি সম্পর্কে দোষগুলো পরখ করে নিতে।

নির্দোষ গুণের নিখুঁত দোষবিচারের ফলে আজকাল বিবাহ ব্যাপারটি বিশ্বে পুরোপুরি স্থগিত। কারণ কোন মা বাবা’ই তাদের ছেলেমেয়েদের এমন দোষযুক্ত বৌমা বা জামাইকে ঘরে আনতে চান না।

বিবাহ স্থগিত হবার ফলে স্বাভাবিকভাবে বিশ্বে মনুষ্যসৃষ্টিও আটকে।আর তাতেই টনক নড়ে সৃষ্টিকর্তার।

তিনি ভেবে আকুল।আজকাল তার পসার এভাবে কেন প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। তার চিন্তায় দেবর্ষি নারদ এসে জিজ্ঞেস করে “হে প্রভু , আপনাকে এত চিন্তান্বিত কেন দেখাচ্ছে ?”

সৃষ্টিকর্তা নারদের কথায় ভরসা পেয়ে মনের কথা খুলে বলেন। নারদ তৎক্ষনাৎ জবাব দেয় “আপনি ভাববেন না প্রভু আমি মর্ত্যে একটা চক্কর লাগিয়ে এসেই আপনাকে জানাচ্ছি।”

মর্ত্য ফেরৎ নারদের মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে অনেক মাথা খাঁটিয়ে একটা বুদ্ধি বের করেন। তিনি বলেন “আচ্ছা দেবর্ষি এই বিষয়ে স্বর্গ মর্ত্যের মিলিত প্রচেষ্টায় একটা সম্মেলন করলে কেমন হয়। যেখানে উভয়পক্ষের বক্তারাই নিজেদের বক্তব্য পেশ করতে পারবে আর একটা মেল বন্ধনও তৈরী হবে।”

দেবর্ষি নারদ “নারায়ণ নারায়ণ ,উত্তম প্রস্তাব”।

শুরু হয় মহা জাঁকজমকপূর্ণ স্বর্গ মর্ত্য মহাসম্মেলনের প্রস্তূতি পর্ব।

ওদিকে মর্ত্যের তাবড় তাবড় ব্যাক্তিবর্গের থরহরি কম্প। স্বর্গের দেবতাদের বিট করতে পারে এমন মানুষ মর্ত্যে বিরল।শেষে মর্ত্যের তথ্যবিভাগ সমস্ত তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে মিষ্টার নির্দোষ গুণকেই যথাযথ বলে মনে করেন।

এমন একখানা সুযোগ পেয়ে নির্দোষবাবুর জোশ আরো বেড়ে যায়।উনি আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দোষ বিচার করে নিজেকে প্রস্তূত করতে থাকেন।

শুভদিনে স্বর্গের মহামান্য তিন ভি.আই.পি মর্ত্যে এসে হাজির হয়েছেন।সেই সভায় নির্দোষ গুণই একমাত্র বক্তা মর্ত্যের তরফ থেকে।

নির্দোষ গুণ সভায় হাজির হয়েই নাক কুঁচকে বলেন “কি বিশ্রী বোঁটকা একটা গন্ধ পাচ্ছি।বলেই গন্ধের খোঁজ করে পৌঁছে যান বাঘছাল পরিহিত ভি.আই.পির দিকে।

“আপনি কি বলুন তো মশাই। কতদিন স্নান করেন না।সারাগায়ে ছাইমাখা।মাথার চুল তো জন্মে আঁচড়ান বলে মনে হয় না। কত যে উঁকুন বাসা বেঁধেছে “

অর্তকিত এমন আক্রমণে ভি.আই.পি একটু আমতা আমতা করে বলেন ” হ্যাঁ স্নান করি তো। তবে হেঁ হেঁ হেঁ সপ্তাহে একদিন।মানে ঐ সোমবারেই। আর তাছাড়া বছরে আমার একদিন আমার ভক্তরা আমাকে মহাস্নান করা—“।মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে ” আরে রাখুন মশাই আপনার ভক্তদের কথা—যত্তসব ভুলেভরা মানুষজন।”

এবার পদ্মাসন ছেড়ে দ্বিতীয় ভি.আই.পি সবে বলেছেন “ভুলেভরা মানুষজন মানে ? ভুল তো থাকবেই—“

খেঁকিয়ে উঠে নির্দোষ গুণ “এই যে মিষ্টার লেজি ।আপনি আর কথা বলবেন না।বছরের পর বছর তো ঐ আধশোয়া কণ্ডিশনেই কাটিয়ে দিলেন “

তৃতীয় ভি.আই.পি ভাবগতিক ঠাওর করতে পেরে সুরসুর করে সভা থেকে বেড়িয়ে তার নিজস্ব শক্তি প্রযোগ করে নির্দোষ গুণকে একবার স্ক্যান করে দেখতে যান। স্ক্যানিং রিপোর্ট দেখে তো তার চক্ষু ছানাবড়া। ভাল করে সমস্ত জায়গা খুঁজেও তার হদিশ তিনি পেলেন না যা তিনি খুঁজছিলেন।

এবার তিনি তৎক্ষনাৎ জরুরী ভিত্তিতে বিশ্বকর্মাকে ডেকে পাঠান।এক্সপার্ট বিশ্বকর্মা পর্যবেক্ষণ করে বলে “প্রভু হাইলি মিসটেক। ম্যানুফেকচ্যারাল ডিফেক্ট! হ্যাঁ প্রভু এই প্রোডাক্টটির মানসচক্ষুর দুটোর জায়গায় একটা বসিয়েই ছাড়া হয়েছে। শুধুমাত্র দোষ দেখবার চোখটি দেওয়া হয়েছে গুণ দেখবার চোখটি তো ইনস্টল করাই হয় নি।”

বিশ্বকর্মার প্রভু তো এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছেন “তোমার কাছে এমনটা আশা করি নি বিশু।তবে এখন উপায়। “

নিজের কৃতকর্মের ফলকে কিছুটা লাঘব করতে তিনি কিছুটা ভেবে আদেশ দেন ” শোন ঐ ডিফেক্ট কিয়োর করতে ওর হৃদয়ের স্পেসটা একটু বাড়িয়ে দাও।আর ঐ বড় হৃদয়ে গুণ দেখার চোখটিও ইনস্টল করো এক্ষুনি।”

সৃষ্টিকর্তার আদেশে বিশ্বকর্মা তড়িৎগতিতে ম্যানুফেচ্যারাল ডিফেক্ট কিয়োর করে ফেলেন অনলাইন।

ফলস্বরূপ নির্দোষ গুণ করজোরে ভি.আই.পি দের সামনে দাঁড়িয়ে “হে প্রভু ,আপনারাই জগতপিতা।আপনারাই পারেন একমাত্র মানুষের দোষগুণ বিচার করতে।আমি তো নিমিত্ত মাত্র।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *