Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মৃত্যু বিভীষিকা || Romena Afaz

মৃত্যু বিভীষিকা || Romena Afaz

ইরানীর সংজ্ঞা ফিরে এলো এক সময়। চোখ মেলে তাকাতেই সে অবাক হলো, দেখলো একটি নৌকার মধ্যে সুন্দর একটা শয্যায় শায়িতা সে। তাকে চোখ মেলতে দেখে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন, ইরানীর পাশে বসে বললেন- এখন কেমন লাগছে তোমার?

ইরানী অবাক হয়ে তাকালো ভদ্রলোকটির মুখের দিকে। তাকে কোথাও দেখেছে কিনা ভাবতে লাগলো, আরও ভাবছে সে ঐ নৌকায় এলো কি করে! সব কথা মনে পড়লো ইরানীর ধীরে ধীরে। দস্যু বনহুরকে সে ছোরা নিক্ষেপ করেছিলো, সঙ্গে সঙ্গে সে পড়ে গিয়েছিলো কোন অতল গহ্বরে। এরপর আর কিছু মনে নেই ইরানীর।

তবে কি সে এখন মুক্ত? সেই নির্জন বাংলোর অভ্যন্তর থেকে সেকি তবে উদ্ধার পেয়েছে? কি করে সে এ নৌকায় এলো, কিছুতেই স্মরণ করতে পারছে না।

ইরানীকে নিস্তব্ধ হয়ে ভাবতে দেখে বললেন বয়স্ক ভদ্রলোক কি ভাবছো মা তুমি? সুস্থ হও, সব বলবো তোমাকে।

ইরানী বললো এবার আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। আপনি কে এবং আমিই বা আপনার নৌকায় এলাম কি করে বলুন?

বয়স্ক ভদ্রলোক দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন– আমি হিজল দ্বীপের অধিবাসী। কান্দাই-এ আমার কারবার আছে। কোনো কাজে আমি কয়েকদিন পূর্বে কান্দাই গিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে কান্দাই থেকে ফিরছি। গত রাতে কান্দাই ফুলগ্রাম ঘাটে নৌকা রেখে আমার মাঝিরা বিশ্রাম। করেছিলো, কারণ ফুলগ্রাম ঘাটে পৌঁছে আমাদের সন্ধ্যা হয়। সন্ধ্যা হওয়ায় মাঝিরা আর এগুতে চায় না, কারণ চারিদিকে দস্যু বনহুরের আতঙ্ক। সেজন্যই আমিও রাজি হলাম ফুলগ্রাম ঘাটে রাত কাটাতে।

ইরানী ব্যাকুল কণ্ঠে বললো- আমি কি করে আপনার নৌকায় এলাম সে কথা বলুন?

হাঁ, সেই কথাই বলছি। রাত ভোর হলো এক সময়। আমি উঠে পড়লাম, মাঝিদের ডেকে নৌকা ছাড়বার আদেশ দিলাম। মাঝিরা উঠে মুখ-হাত ধুয়ে নিচ্ছিলো। আমি নৌকার বাইরে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। পূর্ব আকাশ উজ্জ্বল করে সূর্যের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে। আমি সেই দৃশ্য দেখছি, হঠাৎ আমার নজরে পড়লো, আমারই নৌকার পাশে পানির মধ্যে একটি অর্ধ নিমজ্জিত নারীদেহ।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো ইরানী– তারপর?

আমি মাঝিদের ডেকে দেখলাম এবং নিমজ্জিত নারীকে তুলে আনার জন্যে আদেশ দিলাম। মাঝিরা আমার আদেশ পালন করলো। সেই নিমজ্জিত নারীটিই তুমি।

আমি……আমি পানিতে পড়েছিলাম।

হাঁ, তুমি পানিতে পড়েছিলে। তোমার সংজ্ঞা ছিলো না, অনেক চেষ্টায় তোমার জ্ঞান ফিরে এসেছে।

ইরানী ধীরে ধীরে আনমনা হয়ে যায়। তার চোখের সম্মুখে ভাসতে থাকে সেই রাতের ঘটনা…… দস্যু বনহুর তাকে ধরতে যাচ্ছিলো, সেই মুহূর্তে সে একখানা ছোরা নিক্ষেপ করেছিলো তাকে লক্ষ্য করে, কিন্তু ছোরাখানা দস্যু বনহুরের দেহে বিদ্ধ না হয়ে বিদ্ধ হয়েছিলো পিছনের দেয়ালে, সঙ্গে সঙ্গে পড়ে গিয়েছিলো সে নিচে, কিন্তু কোথায় পড়লো আর তার স্মরণ নেই।

ইরানীকে ভাবতে দেখে বললেন বয়স্ক ভদ্রলোকটি তুমি কিছু ভেবো না মা। এখন কোথায় তুমি যেতে চাও, আমি তোমাকে সেখানেই পৌঁছে দেবো!

ইরানী চট করে কোনো জবাব দিতে পারলো না, এখন কোথায় যাবে সে। তার বাবা এখন হাঙ্গেরী কারাগারে বন্দী। তবু ফিরে যাবে ইরানী তাদের আস্তানায়। ইরানী বললো- আপনি আমাকে উদ্ধার করেছেন, আমার জীবন রক্ষা করেছেন, কাজেই আমি আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমার পিতৃস্থানীয় আপনি। আমাকে যদি কান্দাই-এর যে-কোন ঘাটে নামিয়ে দেন, আমি যারপরনাই খুশি হবো।

বেশ, আমি তোমাকে পৌঁছে দেবো যেখানে তুমি যেতে চাও।

ইরানীকে ঠিকভাবে পৌঁছে দিয়েছো তো? রহমানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর।

রহমান মাথা নিচু করে জবাব দিলো- হ সর্দার, ইরানীকে ঠিক তার কথামত পৌঁছে দিয়েছি।

তোমাকে চিনে ফেলেনি তো?

না, আমাকে সে চিনতে পারেনি, কারণ আমার ছদ্মবেশ অত্যন্ত নিখুঁত হয়েছিলো।

হ্যাঁ, আমিই তোমাকে প্রথম নজরে চিনতে পারিনি। ঠিক একজন বয়স্ক ভদ্রলোক বলেই তোমাকে মনে হচ্ছিলো। ইরানীর জ্ঞান ফেরার পর সে কি কোনো প্রশ্ন করেছিলো?

করেছিলো।

কি জিজ্ঞেস করেছিলো সে?

ইরানী নিজেকে একটি নৌকার মধ্যে দেখে প্রথমে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলো। আমাকে সে জিজ্ঞেস করেছিলো– এ নৌকায় আমি কেমন করে এলাম?

তুমি কি জবাব দিয়েছিলে?

রহমান ইরানীকে যা বলেছিলো সব কথা গুছিয়ে বলে গেলো সর্দারের কাছে।

সব শুনে বনহুর মৃদু হেসে বললো— চমৎকার জবাব দিয়েছিলে রহমান। যাক, একটা দিক নিশ্চিন্ত হলাম।

সর্দার, ইরানীকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হলো? ডাকুর কন্যা, সেও তার পিতার মতই হিংস্র।

কিন্তু তুমি তো জানো, তোমাদের সর্দার কোনোদিন কোনো অসহায় নারীর প্রতি জঘন্য আচরণ করেনি। তবু ইরানীর সঙ্গে আমাকে কিছুটা অভিনয় করতে হয়েছিলো। ইরানীর কাছে আমার একটা অমানুষিক রূপ তুলে ধরেছিলাম। তাকে জানাতে চাই, দস্যু বনহুর তার বাবার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এবং সে কারণেই আমি তাকে পুলিশ অফিস প্রাঙ্গণের উৎসব থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম। রহমান?

বলুন সর্দার?

এবার আর একটা কাজ আমাকে সমাধা করতে হচ্ছে। মাহমুদার বিয়ে দিবার ব্যবস্থা করতে হবে।

হাঁ সর্দার, আমিও এ কথা আপনাকে বলবো বলবো ভাবছি। মাহমুদার বয়স হয়েছে।

তাছাড়া তাকে এভাবে আমাদের আস্তানায় রাখাও ঠিক নয়। তার তো একটা বিবেক আছে। সে সভ্য সমাজের মানুষ আর আমরা…….. যাক্, তুমি সবকিছু আয়োজন করো। আমি মনিরাকে বলেছি একটা ভাল পাত্র খুঁজে বের করতে।

আচ্ছা সর্দার।

সেদিনের পর থেকে রহমান মাহমুদার বিয়ের আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

এখানে রহমান যেমন বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত তেমনি মনিরাও ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মাহমুদার জন্য একটি সৎ পাত্রের সন্ধানে। মনিরার বান্ধবীর ভাই আহসানকে তার খুব পছন্দ। ছেলেটি উচ্চশিক্ষিত, সুন্দর, নম্র ও ভদ্র।

মনিরা একদিন বান্ধবী ইশরাৎ জাহানের বাড়ি বেড়াতে গেলো। সেদিন সে কথায় কথায় বললো–ইশরাৎ, আমার একটি ছোট বোন আছে- খালার মেয়ে তোর ভাই আহসানের সঙ্গে বেশ মানাতো কিন্তু।

ইশরাৎ জাহান তো খুশিতে আত্মহারা, মনিরার বোন হবে তার ভাবী–কম কথা নয়! উৎক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো ইশরাৎ জাহান তোর বোন তো তোর মত হবে?

যদিও মনিরা মাহমুদাকে দেখেনি তবু বললো সে হাঁ, আমার চেয়েও সুন্দরী। যেমন রূপ। তেমনি গুণ– সব দিকেই আছে।

ইশরাৎ জাহান আনন্দভরা কণ্ঠে বললো– তাহলে তো কথাই নেই।

মনিরা বান্ধবীর কাছে আশ্বাসবাণী পেয়ে ফিরে এলো বাড়িতে। স্বামীর জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলো সে বিপুল আগ্রহ নিয়ে!

একদিন বনহুর এলো কিন্তু মাহমুদাকে সঙ্গে আনা তার হয়নি।

মনিরা রাগতভাবে বললো– কই, তোমার সেই বোনটিকে আজও আনলে না?

তুমি পাত্র ঠিক করে নাও, আমি তাকে আনবো। মনিরার চিবুকে মৃদু নাড়া দিয়ে বললো বনহুর।

মনিরা বললো– পাত্র ঠিক হয়ে গেছে।

বনহুর আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনিরাকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠলো- লক্ষ্মীটি আমার, সত্যি তুমি কাজের মেয়ে…

মনিরা দরজার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো- আঃ ছেড়ে দাও, কেউ এসে পড়তে পারে।

এলেই বা, ক্ষতি কি?

সত্যি তোমার লজ্জাও নেই।

না, লজ্জা আমি মানি না, করি না, জানি না……. বনহুর মনিরার মুখখানা তুলে ধরে।

এমন সময় দরজার বাইরে শোনা যায় নূরের কণ্ঠস্বর– আম্মি, আম্মি…..

বনহুরের হাত দু’খানা জোর করে ছাড়িয়ে সরে দাঁড়ায় মনিরা, বলে- কি বলছো নূর, আমি এখানে।

নূর কক্ষে প্রবেশ করে বনহুরকে দেখতে পেয়ে আনন্দধ্বনি করে উঠে— আব্দু…. ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সে পিতাকে।

বনহুর দু’হাতে তুলে নিলো নূরকে, উঁচু করে ধরে বললো কোথায় গিয়েছিলে আব্বু? আমি অনেকক্ষণ তোমাকে খুঁজছি।

আমি সরকার দাদুর সঙ্গে বাইরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। এই দেখো আব্বু, দস্যু বনহুরের কাজ দেখো। নূর হাতের পত্রিকাখানা পিতার সম্মুখে মেলে ধরলো।

মনিরা বললো তোমার আব্বু তোমার পূর্বেই দেখেছে। নিয়ে যাও নূর।

না, আমি আব্বুকে দেখাবো। এই দেখো, দস্যু বনহুর আবার একজন লোককে খুন করেছে। এই দেখো কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য ……….

বনহুর কিন্তু গম্ভীর হয়ে পড়েছে মুহূর্তে। পুত্রের হস্তস্থিত পত্রিকায় নজর বুলিয়ে বললো– হয়তো এই লোকটা কোনো অন্যায় কাজ করেছিলো তাই তাকে দস্যু বনহুর এভাবে হত্যা করেছে, মানে তাকে উপযুক্ত সাজা দিয়েছে।

বনহুর দেখলো, ঔষধের ব্যবসায়ী ইউসুফ কোরেশীর নিহত অবস্থার ছবিখানাই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার শোভাবর্ধন করছে। বড় বড় অক্ষরে লিখা রয়েছে “মৃত্যু বিভীষিকা”। “দস্যু বনহুরের আর একটি শিকার”। কাগজখানা ভাজ করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বনহুর, তারপর নূরকে আদর করে বললো ওসব দেখতে নেই আক। এসো আমার গল্প করি।

নূর কিন্তু সহজে ভোলার ছেলে নয়, সে বললো- আব্বু, দস্যু বনহুরের কি এতটুকু মায়া নেই?

বনহুর নূরের কথায় চট করে জবাব দিতে পারলো না।

মনিরা বললো– চুপ করে আছো কেন, জবাব দাও? নূর তোমাকে কি প্রশ্ন করছে, শুনতে পাচ্ছো না?

ঊ, কি বললে বাপু?

বলছি দস্যু বনহুরের কি মায়া-দয়া কিছু নেই? কি নিষ্ঠুর সেই দস্যুটা! আব্বু, তুমি না বলেছিলে তাকে দেখেছো?

হা দেখেছি।

ভয়ঙ্কর দেখতে বুঝি?

একদিন তো তোমাকে বলেছি, খুব ভয়ঙ্কর দেখতে। মস্ত বড় মাথা, হেঁইয়া বড় চোখ, মূলোর মত দাঁত…..

যেমন দেখতে তেমনি নিষ্ঠুর, তাই বুঝি এত মানুষকে হত্যা করে সে?

আব্বু, দস্যু বনহুর আমার বন্ধু।

ঐ ভয়ঙ্কর কুৎসিত দস্যু তোমার বন্ধু?

হাঁ।

তোমাকে যদি খুন করে সে?

আমি আমার বন্ধুকে চিনি— সে বিনা অপরাধে কাউকে স্পর্শ করে না, খুন করা তো দূরের কথা। তুমি তাকে যত নিষ্ঠুর ভাবছো তত নয়।

তোমাকে সে কিছু বলে না?

আমি তো কারো অন্যায় করি না, তবে কেন সে আমাকে কিছু বলবে?

দস্যু বনহুরকে একবার আমায় দেখাবে আব্বু? তোমার যদি বন্ধু হয় সে, তবে আমাকেও কিছু বলবে না।

আচ্ছা দেখাবো, এত যখন সখ তোমার!

আব্বু?

বলো?

আমি চুপি চুপি দেখবো, সামনে যাবো না কিন্তু।

আচ্ছা, তুমি তোমার আম্মির কোলে চুপটি করে বসে থাকবে আর আমি দস্যু বনহুরকে ধরে আনবব…. কি বলো মনিরা, সেটাই সবচেয়ে ভাল হবে।

মনিরা ক্রুব্ধকণ্ঠে বলে– তোমরা বাপ-বেটা যা খুশি করো, আমি চললাম।

মনিরা বেরিয়ে গেলো।

বনহুর নূরকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করে বললো- নূর, এবার তোমার এক খালাকে নিয়ে আসবো।

খালা?

হাঁ, তোমার খালা। খুব ভাল মেয়ে, এলে তোমাকে অনেক আদর করবে।

সত্যি বলছো আব্বু?

হাঁ, সত্যি।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর একদিন বনহুর মাহমুদাকে নিয়ে হাজির হলো চৌধুরী বাড়িতে।

মরিয়ম বেগমকে ডেকে বললো বনহুর মা, তোমার কোনো মেয়ে ছিলো না, তাই মেয়ে এনে দিলাম, নাও।

মাহমুদা মরিয়ম বেগমকে সালাম করতেই মরিয়ম বেগম বুকে টেনে নিলেন ওকে, স্নেহভরা কণ্ঠে বললেন- তোমার কথা সব শুনেছি মা। তুমি এখন থেকে আমার মেয়ে হলে।

মনিরা এগিয়ে এলো।

বনহুর বললো- এ আমার স্ত্রী মনিরা!

মাহমুদা অস্ফুট কণ্ঠে ডাকলো- ভাবী!

মনিরা জড়িয়ে ধরলো মাহমুদাকে বুকে, বললো- ভাবী নয়, আপা!

নূর দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছিলো, বনহুর নূরকে দেখতে পেয়ে ধরে ফেললো–

এসো, তোমার খালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। মাহমুদার কাছে নিয়ে এলো বনহুর নূরকে।

মাহমুদা নূরকে কোলে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগলো।

নূরও তার নতুন খালাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হলো।

মাহমুদা যখন নূরকে কোলের মধ্যে টেনে আদর করছিলো তখন বনহুরের মন এক অপূর্ব ভাবের আবেশে দীপ্ত হয়ে উঠছিলো।

মা ও স্ত্রীর হাতে মাহমুদাকে তুলে দিয়ে বনহুর ভোর রাতে সকলের অজ্ঞাতে সরে পড়লো চৌধুরী বাড়ি থেকে।

মনিরা নিজের বোনের মত মাহমুদাকে আপন করে নিলো। সব সময় নিজের পাশে পাশে ওকে রাখে, নিজ হাতে সাজিয়ে দেয়।

মাহমুদাও গভীরভাবে ভালবেসে ফেললো মরিয়ম বেগম মনিরা আর নূরকে। নূরের পড়াশোনা থেকে নূরের গোসল খাওয়া-দাওয়া সব মাহমুদা করে।

নূর মাহমুদাকে খালা আম্মি বলে ডাকে।

মাহমুদা এ বাড়িরই একজন বনে গেছে।

মনিরা একদিন মাহমুদাকে সুন্দর করে সাজালো, বললো— মাহমুদা আজ এক জায়গায় বেড়াতে যাবো, তুমিও যাবে আমার সঙ্গে।

মাহমুদা মনিরার কথায় অমত করতে পারলো না।

মনিরা মাহমুদাসহ তার বান্দবী ইশরাৎ জাহানের বাড়ি বেড়াতে এলো।

ইশরাৎ জাহান তো মাহমুদাকে দেখে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠলো। সত্যি, এত সুন্দরী মেয়ে তার নজরে খুব কমই পড়েছে। বললো ইশরাৎ জাহান– তোর বোন ঠিক তোর মতই কিন্তু, ভারী সুন্দরী…..

কি, পছন্দ হয়েছে তাহলে?

খুব।

কিন্তু তোর ভাইয়ার পছন্দ হলে তবেই হয়।

নিশ্চয়ই ভাইয়ার পছন্দ হবে, বললো ইশরাৎ জাহান। আরও বললো সে ভাইয়াকে ধরে আনছি, তারপর ছুটে পালাতে যাচ্ছিলো ইশরাৎ জাহান।

মনিরা বললো- শোন আমি তোকে একটা বুদ্ধি বাতলে দিই।

মাহমুদা লজ্জায় আরষ্ট হয়ে বললো– তোমরা এসব কি আরম্ভ করলে আপা, আমি কিন্তু চলে যাবো।

চলে যাবো বললেই হলো আর কি! বিয়ে যেন করতেই হবে না তোমাকে। কথাগুলো বলে ইশরাৎ জাহান মনিরার গায়ে টিপ দিলো।

মনিরা ইশরাৎ জাহানের কানে কানে কি যেন বললো।

হাসলো ইশরাৎ জাহান। তারপর বললো– চলো আমরা বাগানে যাই।

মনিরা বললো– তাই চল, বাগানে মুক্ত হাওয়ায় বসে গল্প করা যাবে।

মাহমুদা বুঝতে পারলো, তারা কোনো যুক্তি এটেছে। একটু হেসে বললো– চলো আপা।

বাগানে এসে বসলো ওরা তিনজন।

এ গল্প সে গল্পে মেতে উঠলো তারা।

ইশরাৎ জাহান বললো– এই যা, তোমাদের জন্য নাস্তা আনতে বলবো, তা ভুলেই গেছি। ইশরাৎ জাহান দ্রুত চলে গেলো।

একটু পরে ফিরে এলো- সঙ্গে বয়ের হাতে প্রচুর নাস্তা।

ঠিক তার সঙ্গে আর একজনকে দেখা গেলো, সে হলো ইশরাৎ জাহানের ভাই আহসান। ওকে ফাঁকি দিয়ে ডেকে এনেছে ইশরাৎ জাহান। আহসান বোনের ডাকে বাগানে এসে প্রথমে একটু হকচকিয়ে গেলো। সে ভাবতে পারেনি, বাগানে আরও দুঃজন মহিলা আছে।

ইশরাৎ জাহান বললো– ভাইয়া, এরা আমার বান্ধবী! এর নাম মনিরা আর এর নাম। মাহমুদা। তবে মনিরার সঙ্গে তোমার অনেক দিন আগে দেখা হয়েছিলো হয়তো বিদেশে গিয়ে সব ভুলে বসে আছে।

হঠাৎ আহসানের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, মনিরাকে লক্ষ্য করে বললো– মাফ করবেন, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি।

থাক, অত মাফ চাইতে হবে না। আমার বান্ধবী সে জন্য মোটেই দুঃখিত নয়।

আর ইনি আমার বান্ধবীর ছোট বোন মাহমুদা, আমার বান্ধবী বলতে পারো।

আহসান মাহমুদার দিকে তাকিয়ে হাসলো, বললো— তোর বান্ধবীরা দেখছি বড্ড লাজুক মেয়ে।

বাঙ্গালি মেয়েদের লজ্জাই ভূষণ তাকি জানো না ভাইয়া?

কিন্তু এত লজ্জা ভাল দেখায় না। বিদেশী মেয়েরা কেমন পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে তাকি তোমরা জানো না?

জানি। তা তুমি মনে করছে আমার বান্ধবী বুঝি বড় লাজুক? আসলে যা মনে করছে তা নয়, কিছুক্ষণ আলাপ করলেই বুঝতে পারবে। তা বসো আলাপ ও হবে এখন।

কই, তোর বান্ধবীরা তো আমায় বসতে বলছে না?

মনিরা বললো এবার– বসুন!

বাগানের মধ্যে সাজানো ছিলো কতকগুলো হালকা সোফা সেট। আহসান একটা সোফায় বসে পড়লো।

ইশরাৎ জাহান মনিরা আর মাহমুদাকে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। মাঝখানে ছোট টেবিলটায় নাস্তা সাজানো। ইশরাৎ জাহান এগিয়ে দিলো বান্ধবীদের দিকে নাস্তার প্লেটগুলো। আহসানের সম্মুখে একটি প্লেট এগিয়ে দিয়ে বললো— তুমিও খাও।

আহসান কিন্তু বারবার তাকাচ্ছিলো মনিরার দিকে। একদিন এই মনিরাকে কেন্দ্র করে সে কত কল্পনার রঙিন স্বপ্ন দেখতো। মনিরা তখন কলেজের ছাত্রী, ইশরাৎ জাহানের সঙ্গে সে মাঝে মাঝে আসতো তাদের বাড়িতে। তখন আহসান মনিরাকে ভালবেসে ফেলেছিলো কিন্তু তাকে কোনোদিন সে নাগালের মধ্যে পায়নি, তাই তার ব্যাকুল ভালবাসার কথাও জানাতে পারেনি। আজ সেই কল্পনার রাণী এসেছে তার সম্মুখে। আহসান যেন নতুন এক উন্মাদনায় আত্মহারা হয়ে উঠেছে। বিদেশে গিয়ে বহু মেয়ের সঙ্গে সে মিশেছে, বহু মেয়েকে সে উপভোগ করেছে, তবু তার পিপাসা মেটেনি, মনিরাকে সে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

আহসানের আসল রূপ জানে না মনি— সে জানে, ইশরাৎ জাহানের ভাই বোনের মতই স্বচ্ছমনা স্বাভাবিক ছেলে। চেহারা সুন্দর, উচ্চ ডিগ্রীধারী, বংশমর্যাদা ভাল, সেই কারণেই মনিরা আহসানকে পছন্দ করেছে মাহমুদার জন্য।

ইশরাৎ জাহানের কাছেও আহসানের আসল রূপ ধরা পড়েনি তেমন করে, কারণ সে জানে, তার ভাই একজন মহৎ ব্যক্তি। আহসান গোপনে মদ পান করতো, ক্লাবে যেতো, মাঝে মাঝে কান্দাই নাচঘরেও দেখা যেতো তাকে।

আহসান তার আসল চেহারা লুকিয়ে নিজকে অতি ভদ্র বেশে তুলে ধরলো মনিরা আর মাহমুদার সম্মুখে।

এ কথা সে কথা নিয়ে অল্পক্ষণেই আলাপ জমিয়ে নিলো আহসান মনিরার আর মাহমুদার

মনিরাও চেয়েছিলো আহসানের সামনে মাহমুদা যেন স্বাভাবিক হয়ে আসে। তাই এক সময় ছলনা করে দু’বান্ধবী সরে পড়লো সেখান থেকে।

মাহমুদা আর আহসান ওরা দু’জনা রইলো একা।

ইশরাৎ জাহান আর মনিরা সরে গেলে মাহমুদা বেশ অস্বস্তি বোধ করছিলো, লজ্জায় যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিলো সে।

আহসান মৃদু হেসে বলে– বান্ধবীদের সঙ্গে পালাতে না পেরে খুব বুঝি ঘাবড়ে যাচ্ছেন?

এবার মাহমুদা কথা না বলে পারলো না, বললো সে– না, ওসব কিছু না।

তবে সোজা হয়ে বসুন, তাকান আমার দিকে।

মাহমুদা চোখ না তুলে পারলো না। সে লজ্জানত দৃষ্টি তুলে ধরলো আহসানের মুখে।

আহসান বললো— এবার দেখুন দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা কত সহজ হয়ে এলাম। আচ্ছা মিস মাহমুদা, আপনি কি বরাবরই এখানে মানে চৌধুরী বাড়িতে থাকেন?

না, আমি দেশে ছিলাম, অল্পদিন হলো এসেছি।

সত্যি, আপনার কণ্ঠস্বর অতি মধুর। নিশ্চয়ই আপনি গান জানেন?

মাহমুদা চট করে জবাব দিলো না, যদিও সে পূর্বে ভাল গাইতে পারতো, এখন বহুদিন অভ্যাস নেই! বললো মাহমুদা—আগে গাইতাম কিন্তু এখন গাই না।

আজ না হয় একটা গান আমাকে শোনালেন।

আজ নয়, আর একদিন গাইবো।

সত্যি, কথা দিলেন তো?

হাঁ দিলাম।

এমন সময় ফিরে এলো মনিরা আর ইশরাৎ জাহান। ইশরাৎ জাহান হেসে বললো- কিসের এমন কথা দেওয়া নেওয়া হয়ে গেলো এরি মধ্যে?

লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো যেন মাহমুদা, হঠাৎ ওরা এসে পড়ায় বিব্রত হয়ে পড়লো সে।

আহসান বললো– কথা দিলেন, একদিন নাকি উনি গান শোনাবেন।

ইশরাৎ জাহান আনন্দধ্বনি করে উঠলো। হুররে ভাইয়া, তুমি শুধু গান শুনবে আর আমরা বাদ পড়বো, তা হচ্ছে না। গান আমাদেরও শোনাতে হবে।

মনিরা হেসে বললো– মাহমুদা, ওকে একা যেন গান গেয়ে শুনিও না। আমার বান্ধবী ইশরাৎ যেন বাদ না পড়ে।

মাহমুদা বললো– আচ্ছা, মনে থাকবে।

একসময় ইশরাৎ জাহান আর আহসানের কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো মনিরা আর মাহমুদ।

মনিরা বললো কেমন লাগলো আহসান সাহেবকে?

ছোট্ট করে জবাব দিলো মাহমুদা তোমার যেমন লেগেছে আমারও তেমনি।

মনিরা বললো— আমার খুব ভাল লাগলো। বেশ ভদ্রলোক। মাহমুদা, একটা কথা বলবো!

বলো?

আহসান সাহেবকে পেলে তুমি সুখী হবে তো?

মাহমুদা কথা বললো না, লজ্জায় মুখ নিচু করলো।

মনিরা বুঝতে পারলো মাহমুদার কোনো আপত্তি নেই।

পরদিন মনিরা ইশরাৎ জাহানসহ আহসানকে দাওয়াত করলো। মরিয়ম বেগম নিজ হাতে রান্না করলেন। অনেক রকম জিনিস তৈরি করলেন।

সন্ধ্যার পর ইশরাৎ জাহান ও আহসান এলো চৌধুরী বাড়িতে।

মনিরা আনন্দে আত্মহারা, এত সহজে এমন একটা পাত্র পাওয়া কম কথা নয়। বিশেষ করে বনহুকে তাক লাগিয়ে দেবে মনিরা ভাল একটা পাত্ৰ মাহমুদার জনা সগ্রহ করে।

গাড়ি-বারান্দায় গাড়ি থামতেই মনিরা বান্ধবী এবং আহসানকে অভ্যর্থনা জানালো।

মনিরাকে দেখে খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠলো ইশরাৎ জাহান।

আহসান ড্রাইভিং আসন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে মনিরাকে লক্ষ্য করে বললো–হ্যালো মনিরা, কেমন আছেন? হাত বাড়ালো সে মনিরার দিকে।

মনিরা হাত না বাড়িয়ে হাত তুলে আদাব করলো।

আহসান মনে মনে একটু ক্ষুণ্ণ হলেও মুখে কোনো কথা প্রকাশ করলো না। এগিয়ে চললো তারা মনিরার সঙ্গে।

মরিয়ম বেগম সিঁড়ির মুখে তাদের এগিয়ে নিলেন।

মনিরা পরিচয় করিয়ে দিলো মামীমার সঙ্গে ইশরাৎ জাহান এবং আহসানের।

আহসানের ব্যবহারে মরিয়ম বেগম মুগ্ধ হলেন।

একসঙ্গে টেবিলে বসে খাবার খেলো সবাই মিলে। মাহমুদাও বসলো সবার সঙ্গে।

মরিয়ম বেগম নিজে পরিবেশন করে খাওয়ালেন।

হাসি-গল্পের মধ্যে খাওয়া-পর্ব শেষ হলো।

নূর সবচেয়ে বেশি আনন্দমুখর হয়ে উঠেছে। এক সময় চুপি চুপি বলেছিলো মনিরা নূরের কানে মুখ নিয়ে—এই লোকটি তোমার খালু হবে।

কথাটা শুনে নূর তো উচ্ছল হয়ে উঠেছিলো, তার মনে কত রং ঝরে পড়তে লাগলো। তার মাহমুদা খালার বর হবে এই ভদ্রলোক, কম কথা নয়!

কিছু সময়ের মধ্যে আপন করে নিলো নুর আহসানকে।

সেদিনের পর থেকে প্রায়ই আসা-যাওয়া শুরু করলো আহসান আর ইশরাৎ জাহান। বিকেলটা মেতে থাকতো ওরা নানারকম হাসি-গল্পে। কখনও হলঘরে বসে আলাপ-আলোচনা চলতে, কখনও বাগানে বসে মেতে উঠতো, কখনও গাড়ি নিয়ে যেতো ওরা লেকের ধারে।

মাঝে মাঝে পার্কেও যেতে মনিরা, মাহমুদা, ইশরাৎ জাহান আর তাদের সঙ্গে থাকতো আহসান।

মনিরা আর ইশরাৎ জাহান একথা সেকথায় সরে থাকতো ওদের দুজনাকে মিশবার সুযোগ দিয়ে। মনিরা যা চেয়েছিলো তাই হলো। একদিন ইশরাৎ জাহান প্রস্তাব দিলে মনিরার কাছে— ভাইয়া মাহমুদাকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেছে।

মনিরার সেদিন আনন্দ আর ধরে না। তার বাসনা পূর্ণ হলো তাহলে? মাহমুদার বিয়েতে মনিরা প্রচুর ধুমধাম করবে। বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতীক্ষা করতে লাগলো মনিরা স্বামীর।

সেদিন বিকেলে এলো আহসান আর ইশরাৎ জাহান।

মনিরা আর মাহমুদা প্রস্তুত ছিলো, বেরিয়ে পড়লো ওরা সবাই মিলে। আজ পার্কে বা লোকের ধারে নয়; আজ ওরা যাবে সমুদ্রের তীরে!

আহসান ড্রাইভ করছিলো।

ওরা তিন বান্ধবী মিলে পিছন আসনে বসে হাসি-গল্পে মেতে রইলো। আহসান ড্রাইভিং আসন থেকেই মাঝে মাঝে ওদের কথায় এবং হাসিতে যোগ দিচ্ছিলো।

এক সময় পৌঁছে গেলো তাদের গাড়ি সমুদ্রতীরে।

আহসান নেমে গাড়ির দরজা খুলে ধরে বললো- আসুন। ইশরাৎ জাহান, মনিরা আর মাহমুদা নেমে পড়লো।

সমুদ্রের তীর ধরে এগুতে লাগলো ওরা।

এক-একজনের খুশি যেন ধরছে না।

মাহমুদা আর ইশরাৎ জাহান অনেকটা এগিয়ে যায়।

মনিরা বেশ একটু পিছিয়ে পড়েছিলো।

আহসান ইচ্ছা করেই পিছিয়ে পড়ে, মনিরার পাশে পাশে চলতে চলতে বলে–আজকের দিনটা বড় সুন্দর, তাই না?

হাঁ, ভারি সুন্দর!

আসুন না আমরা দু’জনা ওদের মত হাতে হাত রেখে ছুটি?

ধন্যবাদ, আমি ছুটতে পারি না।

দেখুন ওরা কতদূর এগিয়ে গেছে।

তাইতো দেখছি।

তবে বসুন, এখানে বসে গল্প করা যাক।

ঐ তো ওরা বসে পড়েছে, চলুন এক সঙ্গে বসে গল্প করা যাবে। মনিরা এগিয়ে চললো।

আহসান তাকে অনুসরণ করলো।

সমুদ্রতীরে বসে ওরা চারজন একথা সেকথা নিয়ে মেতে উঠলো।

অল্পক্ষণ পর একটা নৌকা এগিয়ে এলো। মাঝি ডেকে বললো– সাহেব, আপনারা সমুদ্র ভ্রমণে যাবেন?

খুশি হয়ে উঠলো ইশরাৎ জাহান, বললো— ভাইয়া, আমরা সমুদ্র ভ্রমণে যাবো।

আহসান মনিরার মুখে তাকিয়ে বললো– আপনি রাজি?

হা, অনেকদিন সমুদ্র ভ্রমণে যাইনি– কিরে মাহমুদা, রাজি তো?

আহসান বললো- আপনি রাজি হলে ওদের আর কারো আপত্তি থাকবে না। এই মাঝি এসো!

মাঝি ধীরে ধীরে নৌকাখানা তীরে আনলো।

সমুদ্র আজ শান্ত।

বহু জেলে ছিপ নৌকা নিয়ে সমুদ্র বুকে মাছ শিকার করছে।

ইশরাৎ জাহান আর মাহমুদা নৌকায় উঠে পড়লো।

আহসান নৌকায় উঠে পড়েই হাত বাড়ালো– আসুন মিসেস মনিরা, আমার হাত ধরে উঠে আসুন।

আমি নিজেই উঠে পড়তে পারবো আহসান সাহেব। মনিরা উঠে পড়লো কথাটা বলতে বলতে।

সবাই নৌকায় ঠিক ঠিক জায়গায় বসে পড়লো।

মাঝি বললো– নৌকা ছাড়বো সাহেব?

আহসান বললো—হ, ছাড়ো,

মাঝি নৌকা ভাসিয়ে দিলো সমুদ্রবুকে।

নৌকা নিয়ে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়, কাজেই তীর ধরে কিছুদূর অগ্রসর হলো।

মাহমুদা, ইশরাৎ জাহান ও মনিরাকে নিয়ে আনন্দে মেতে উঠলো আহসান।

মাঝির মাথায় গামছা বাঁধা। গায়ে চাদর, চাদরের আঁচল দিয়ে মুখের খানিকটা অংশ ঢাকা। পরনে একটা ধুতি আঁটসাট করে পরা।

মাঝি নৌকা বাইছিলো আর লক্ষ্য করছিলো আহসান এবং তিনজন মহিলাকে। তাদের কথাবার্তার দিকে কান পেতে যেন শুনছিলো সে।

আহসান বললো– মাঝি, হাত নেড়ে নৌকা চালাও।

মাঝি বললো- সাহেব, এটা তো নদী হয়– সমুদ্র।

তা আমরা জানি না, তুমি আরো গভীর জলে নিয়ে চলো।

আপনারা যদি হুকুম দেন তাহলে আরো গভীর জলে নিতে পারি। কিন্তু হঠাৎ যদি ডুবে যায়……সাহেব, আপনারা সাঁতার জানেন তো?

আহসান বলে উঠলো– আমরা কি তোমাদের মত ছোটলোক যে সাঁতার জানবো? সাঁতার কাটে যতসব ছোটলোক। ভদ্রলোক সাঁতার জানে না, বুঝলে?

তাহলে যে গভীর জলে নৌকা নিতে বলেন?

তা যা হয় তবে, তুমি গভীর জলে চলল। অল্প জলে আনন্দ নেই। কি বলেন মিসেস মনিরা?

মনিরা বললো–আমার কিন্তু বড্ড ভয় করে।

মিস মাহমুদা, আপনারও কি ভয় হয়?

মাহমুদা পূর্বের চেয়ে অনেক স্বচ্ছ হয়ে গেছে আহসানের কাছে। বললো আপনার মত অত ভয় আমার নেই।

চমৎকার কথা!

ইশরাৎ জাহান বলে উঠলো–তোমরা দু’জন যাও। আমরা কিন্তু বেশি জলে যাবে! না।

মাঝি তখন নৌকাখানাকে বেশ গভীর পানিতে নিয়ে এসেছে। চারিদিকে সমুদ্রের উচ্ছল জলরাশি ছলছল করে বয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ঢেউগুলো আছাড় খেয়ে পড়ছে নৌকার গায়ে।

আহসান এপাশ থেকে উঠে মনিরার পাশে এসে বসলো। মনিরা সরে বসার চেষ্টা করলো কিন্তু ওদিকে জায়গা না থাকায় সরে বসতে পারলো না সে। আহসান বললো- মিসেস মনিরা, হঠাৎ যদি নৌকাখানা তলিয়ে যায়…

না না, ও কথা আপনি বলবেন না মিঃ আহসান।

ইশরাৎ জাহান বললো– ভাইয়া, তুমি সাঁতার জানো না অথচ নৌকা তলিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছো?

সত্যি ইশরাৎ, আজকের দিনটা আমার কাছে স্মরণীয় দিন হয়ে থাক, এই আমি চাই।

মাহমুদা বললো আমার কিন্তু বড্ড ভয় করেছে কি ভয়ঙ্কর ঢেউগুলো!

আহসান মিছামিছি দোল দিলো নৌকায়।

সবাই পড়তে গিয়ে এ-ওকে জড়িয়ে ধরলো।

আহসান পট করে ধরে ফেলে মনিরাকে।

মনিরা তাড়াতাড়ি সংযত হয়ে বসে বলে– মাফ করবেন।

আহসান হেসে বলে– দোষটা আমারই, কাজেই আপনি আমাকে মাফ করবেন মিসেস মনিরা।

ক্রমে সন্ধ্যা হয়ে আসে।

মাঝি বলে সাহেব, এবার নৌকা ফেরাব?

আহসান বলে উঠে না না, আরও কিছুক্ষণ থাকো।

মনিরা বলে– না, আর দেরী করা উচিত নয়। হঠাৎ কোনো বিপদ আপদ ঘটতে পারে।

ইশরাৎ বলে- হাঁ ভাইয়া, এবার ফেরা যাক।

মাহমুদাও বলে আমারও কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করছে না।

কারো যখন মন নেই তখন আহসান বললো– মাঝি, নৌকা ফেরাও।

সমুদ্রতীরে নৌকা ভিড়লো।

অন্ধকার ক্রমেই জমাট বেঁধে উঠছে।

আহসান একজন একজন করে সবাইকে হাত ধরে নামিয়ে নিলো।

মনিরা কিন্তু ইতস্ততঃ করছিলো।

আহসান বললো– আসুন আমি আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।

অগত্যা মনিরা আহসানের হাতে হাত রেখে নেমে পড়লো।

আহসান মনে মনে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো।

মাঝি দাঁড়িয়ে ছিলো নৌকার এক পাশে। গায়ের চাদরখানা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিলো।

আহসান পকেটে থেকে মানিব্যাগ বের করে বলে মাঝি, তোমাকে কত দিতে হবে?

মাঝি মাথার গামছাটা ঠিক করে নিয়ে বলে– যা ভাল মনে করেন তাই দেন সাহেব। আমরা গরিব মানুষ…….

কঘণ্টা নৌকা বেয়েছো মাঝি?

আমাদের তো ঘড়ি নেই সাহেব।

ইশরাৎ বললো– আন্দাজ তিন ঘন্টা আমরা ওর নৌকায় ছিলাম।

মানিব্যাগ থেকে আহসান দশ টাকার একখানা নোট বের করে মাঝির দিকে বাড়িয়ে ধরলো- নাও।

মাঝি আহসানের হাত থেকে টাকাটা নিয়ে সেলাম করলো — সাহেব আবার আসবেন তো!

আহসান খুশি হয়ে বললো- এরা যদি রাজি হন আমিও আসবো এদের সঙ্গে। বললো ইশরাৎ রাজি আছো?

ইশরাৎ তাকালো মনিরার দিকে–কিরে, আসবি নাকি আবার?

মনিরা জবাব দেবার পূর্বেই আহসান বলে উঠে– মাঝির যখন এত সখ তখন আসতে হবেই মিসেস মনিরা, বলুন রাজি?

মনিরা হঠাৎ বলে বসলো– রাজি।

থ্যাঙ্ক ইউ……….. আনন্দ ধ্বনি করে উঠে আহসান।

আহসান ওদের নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।

মাঝির মুখে ফুটে উঠে একটা অদ্ভুত হাসির রেখা। এগিয়ে যায় ওদিকের ছোট নৌকাখানার দিকে, ও নৌকার বেচারী মাঝিটা বসে আছে, হয়তো সারাটা দিন কোনো ভাড়া তার ভাগ্যে জোটেনি। মাঝি ওর হাতে দশ টাকার নোটখানা খুঁজে দেয়–নে, বাড়ি যা।

ছোট নৌকার মাঝি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বড় নৌকার মাঝিটার দিকে।

দরবার কক্ষে সুউচ্চ আসনে উপবিষ্ট স্বয়ং দস্যু বনহুর। তার পাশে দণ্ডায়মান রহমান। অন্যান্য অনুচর দু’পাশে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকের হাতে অস্ত্র ঝকমক করছে। দেহে জমকালো পোশাক, এক একজনকে অতি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে।

বনহুর আদেশ করলো– কোথায় সেই নর শয়তানের দল?

রহমান একনজকে ইংগিত করলো— ওদের উপস্থিত করো।

কয়েকজন অনুচর কয়েকজন লোককে হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় সেখানে হাজির করলো।

বনহুর তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বন্দী লোকগুলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করে দেখলো। দেহে মূল্যবান স্যুট, সবাই প্রায় বয়স্ক। এক-এক জনকে জীবন্ত শয়তান বলে মনে হচ্ছে যেন।

বনহুরের নির্দেশে বন্দীদের হাত এবং মুখের বাধন খুলে দেওয়া হলো।

বন্ধনমুক্ত হওয়ায় লোকগুলো যেন হাঁফ ছেড়ে বাচলো কিন্তু তাদের মুখমণ্ডলে ভীতির ভাব ফুটে উঠেছে। বনহুরের দিকে তাকাচ্ছে তারা ভয়াতুর দৃষ্টি মেলে।

বনহুর রহমানকে লক্ষ্য করে বললো- এদের পরিচয়?

রহমান এগিয়ে এলো, প্রথম ব্যক্তিকে সম্মুখে টেনে এনে বললো- সর্দার, ইনি রায়হান বন্দরের মালবাহী একশ’ জাহাজের মালিক হোসেন কিবরিয়া। ইনার জাহাজগুলো সবসময় চোরামাল বোঝাই হয়ে দেশ-বিদেশে চালান যায়। চোরামাল বিদেশে রপ্তানি করে তার মাসিক আয় প্রায় তিন কোটি টাকা।

বনহুর একটু হেসে বললো–একশ’ জাহাজের মালিক, মাসিক মাত্র তিন কোটি টাকা আয়? এই সামান্য আয়ে উনার চলে কি করে? রহমান, উনার আরও কিছু বেশি আয়ের ব্যবস্থা করে দাও। হাঁ তারপর?

রহমান আর একনজকে টেনে আনলো সম্মুখে ইনি একজন সরকারি কন্ট্রাক্টর। সরকারের বহু দালান-কোঠা এবং সেতু তৈরির কাজ ইনি গ্রহণ করে থাকেন। সরকারের বহু অর্থ উনি পান, ব্যয় করেন তার সিকি। সর্দার, হিন্দ নদীর সেতু তৈরিও ইনিই করেছিলেন।

বনহুর বললো– হিন্দ নদীর সেতু এই মহাত্মার দ্বারা তৈরি হয়েছিলো? চমৎকার রহমান?

বলুন সর্দার।

হিন্দ নদীর সেতু ধসে পড়ে গত বছর কত লোক প্রাণ হারিয়েছিলো?

প্রায় নয়’শ।

তারা কোনো এক উৎসব সেতুবক্ষে পালন করতে গিয়ে সেতু ধসে পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলো, তাই নয় কি?

হা সর্দার।

বনহুর এবার কন্ট্রাক্টরকে লক্ষ্য করে বললো- এই সেতু তৈরি ব্যাপারে আপনি কয় লাখ আত্মসাৎ করেছিলেন কন্ট্রাক্টর সাহেব?।

ভয় বিবর্ণমুখে মাথা নিচু করে রইলো কন্ট্রাক্টর হানিফ চিশতী? এতদিন তিনি কন্ট্রাক্টরীতে কোটি কোটি টাকা লাভ করেছেন। গাড়ি-বাড়ি-ঐশ্বর্য করেছেন। আজ তাকে স্বয়ং দস্যু বনহুরের নিকটে জবাবদিহি করতে হবে, কোনদিন ভাবেননি।

কয়েকদিন পূর্বে পত্রিকায় তাঁরা দস্যু বনহুরের মৃত্যু বিভীষিকার নির্মম অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন এবং সংবাদ পড়েছিলেন, তবু তাঁরা সাবধান হননি। ভেবেছিলেন, দস্যু বনহুর তাদের সন্ধান পাবে না। গোপনে নিজেদের কাজ ঠিকমতই চালিয়ে চলেছিলেন।

কিন্তু তাদের অসাধু, অসৎ ব্যবসা যে এমনভাবে দস্যু বনহুরের কাছে প্রকাশ হবে এবং তারা বন্দী হয়ে হাজির হবেন দস্যু বনহুরের দরবারে এ কথা তাদের কল্পনাও আসেনি কোনোদিন।

আজ একেবারে নাজেহাল-পেরেশান হয়ে পড়েছেন তারা। বনহুরের কথায় কি জবাব দেবেন। ভেবে পান না কন্ট্রাক্টর হানিফ চিশতী।

ততক্ষণে রহমান আর একজনকে সম্মুখে টেনে নিয়ে আসে – সর্দার, এই লোক ছেলেধাদের দলপতি, আমরা বহু দিন ধরে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে একে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি।

দস্যু বনহুর দাঁতে দাঁত পিষে বললোএই সেই মহান ব্যক্তি? ইসমাইল সিরাজী?

হাঁ সর্দার, এর নামই ইসমাইল সিরাজী। দেশের বহু বাবা মাকে অশ্রুসাগরে ভাসিয়ে বহু শিশুকে এই নর-শয়তান উধাও করেছে।

ঠিকই বলেছো রহমান, আজকাল রেডিওতে প্রায়ই শোনা যায় ছেলে নিখোঁজ সংবাদ, পত্রিকায় দেখা যায়, কিন্তু কোনো সময় তাদের ফিরে পেলো কিনা জানা যায় না। আমি পাকিস্তানের একদল ছেলেধরাকে আবিষ্কার করেছিলাম এবং তাদের সমুচিত শাস্তিও দিয়েছিলাম, কিন্তু আমি সম্পূর্ণ স্বস্তি পাইনি। কারণ, নিজ হাতে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হয়নি। রহমান, ঐ ব্যক্তির পরিচয় কি জানাও? বনহুর শেষ ব্যক্তিটিকে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বললো।

রহমান বললো– সর্দার, এ ব্যক্তি হীরাঝিল নাচঘরের মালিক। এই নাচঘরে প্রতিরাতে বহু লোক নিজেদের সর্বনাশ করে থাকেন।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো-হীরাঝিল?

হাঁ সর্দার।

কি নাম এর?

রতন দেওয়ান সিং।

বাস্……. বনহুর আসন ত্যাগ করে নেমে এলো বন্দীদের সম্মুখে, বজ্রকঠিন কণ্ঠে বললো আপনারা আমার কাছে কি রকম শাস্তি গ্রহণে মৃত্যু কামনা করেন?

বনহুরের কথা শুনে বন্দীদের মুখ মড়ার মুখের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো, ভয়-কাতর চোখে তাকাতে লাগলেন তারা দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।

বনহুর রহমানকে বললো– এদের শাস্তি অন্ধকূপে নিক্ষেপ করে হত্যা করা। তার পূর্বে প্রত্যেকের চোখ অন্ধ করে দেবে।

বনহুরের আদেশমাত্র সূতীক্ষ্ম ধার সরু ছোরা হাতে এগিয়ে এলো দু’জন অনুচর।

শিউরে উঠলেন বন্দীরা।

কেউ কেউ কাঁদতে শুরু করলেন।

বনহুর বললো– সবার চোখ অন্ধ করে দেবার পূর্বে মহাত্মা ইসমাইল সিরাজীর হাত দু’খানা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললো।

সঙ্গে সঙ্গে একজন একটি বিরাট তীক্ষ্ম খৰ্গ হাতে এগিয়ে এলো।

আর্তনাদ করে উঠলো ইসমাইল সিরাজী ওরে বাবা, বাঁচাও বাঁচাও আমাকে……….

হাঃ হাঃ হাঃ, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বনহুর, দাঁতে দাঁত পিষে বললো–কে বাঁচাবে? যাদের ছেলে চুরি করে ব্যবসা চালিয়েছিলে, তারা? ঐ হাত দুখানা দিয়ে কত নিঃসহায় শিশুকে তুমি বিদেশে চালান করেছে, কত নিষ্পাপ শিশুকে অন্ধ, পঙ্গু করেছে, কত শিশুকে হত্যা করেছে! শয়তান, আজ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও কেউ আসবে না তোমাকে বাঁচাতে। মঙ্গলা, এবার তোমার কাজ শেষ করো।

মঙ্গলা তীক্ষ্মধার খর্গ নিয়ে এগিয়ে এলো।

বনহুর আর দু’জনকে আদেশ করলো ইসমাইল সিরাজীর হাত দুখানা টেনে ধরতে।

বনহুরের অনুচরগণ আদেশ পালনে উদ্যত হতেই সিরাজী বনহুরের পায়ে বসে পড়লো।

বনহুর পা সরিয়ে নিলো।

এবার সিরাজীর হাত দুখানা কেটে ফেললো অনুচরগণ। রক্তের বন্যা ছুটলো, মেঝেতে পড়ে গেলো ইসমাইল সিরাজী। অন্যান্য বন্দী দু’হাতে চোখ ঢেকে আল্লাহর নাম স্মরণ করতে লাগলেন। একটু পরে তাদের অবস্থাও ইসমাইল সিরাজীর মত হবে। কেন তারা বনহুরের সাবধান বাণীতে নিজেদের সাবধান করেনি, তখন কেন তারা অর্থের মোহে অন্ধ হয়ে দস্যু বনহুরের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন? অনুশোচনায় এক একজন মাথার চুল টেনে ছিঁড়তে লাগলেন।

বনহুর বললো- এবার সিরাজীর সম্মুখে এইসব ভদ্রবেশী শয়তানের চক্ষু অন্ধ করে দাও। সব শেষে অন্ধ করবে সিরাজীকে। কারণ সবার চেয়ে বেশি দোষী ঐ ইসমাইল সিরাজী। দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ যে সব শিশু, এসব শয়তান তাদের নিয়ে ব্যবসা করে। নাও, শুরু করো……..

হোসেন কিবরিয়া মূল্যবান স্যুটসহ বসে পড়েন ভূতলে, বারবার, নাকে খৎ দিয়ে দিয়ে বলতে, লাগলেন– আমাকে মাফ করো বনহুর, আমি তোমার সাবধানবাণী না মেনে ভুল করেছি।

আজ এখানে মৃত্যুর দুয়ারে দাঁড়িয়ে নিজের ভুল বুঝতে পেরে কোনোই ফল হবে না কিবরিয়া সাহেব! কারণ, বিচার তোমাদের শেষ হয়ে গেছে। রহমান?

বলুন সর্দার?

বিলম্ব করো না।

বনহুরের নির্দেশে রহমান তটস্থ হয়ে উঠলো।

এবার এক-একজনকে দু’জন করে অনুচর ধরে ফেললো আর দু’জন তাদের দু’চোখে লৌহশলাকা প্রবেশ করিয়ে দিলো। সে কি প্রাণফাটা তীব্র আর্তচিৎকার তার সঙ্গে বনহুরের অট্টহাসি এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি করলো দরবারকক্ষে।

কঠিন কণ্ঠে বললো বনহুর নিয়ে যাও এদের, অন্ধকূপে নিক্ষেপ করো। মৃত্যুর পর প্রকাশ্য রাজপথে ফেলে দিয়ে আসবে। . বনহুরের অনুচরগণ বন্দীদের টানতে টানতে নিয়ে গেলো। রহমান এবং অন্যান্য অনুচর তাদের ঠিক ঠিক জায়গায় সোজা হয়ে দাঁড়ালো।

বনহুর বললো- তোমরা চারজন প্রস্তুত থেকো। আজ রাতে হীরাঝিল নাচঘরে হানা দেবো। আমি জানি, এখানে বহু যুবতীকে আটক করে রাখা হয়েছে এবং তাদের বাধ্য করা হয়েছে এখানে যারা আসে তাদের মনঃতুষ্টি করতে। এসব যুবতীকে উদ্ধার করা আমার কর্তব্য।

রহমান বলে উঠলো– সর্দার, চারজন কে কে থাকবে?

যাদের তুমি ভাল মনে করো।

আচ্ছা সর্দার।

হাঁ, রাত দুটোর মধ্যে আমাদের সেখানে পৌঁছেতে হবে। পরে পৌঁছলে কোনো কাজ হবে না, কারণ অনেক শয়তান সেখান থেকে সরে পড়বে। আমি এই নাচঘরের অনেককেই জানি, যারা শুধু সমাজের শত্রু নয় দেশের শত্রু। দেশের জনগণের বুকের রক্ত নিঃশেষ করে তারা শরাব পান এবং অসহায়া নারীদের নিয়ে আমোদ-আহ্লাদে মেতে উঠে। তোমাদের সঙ্গে নিচ্ছি এ কারণে যেন কেউ পালাতে না পারে আর অসহায় মেয়েদের কেউ যেন খোয়া না যায়।

আপনার আদেশ ঠিকভাবে পালন করা হবে সর্দার।

বনহুর এবার দরবারকক্ষ ত্যাগ করলো।

বনহুর যখন দরবারকক্ষ থেকে ফিরে এলো তার বিশ্রাম কক্ষে, তখন নূরী দূর থেকে বনহুরকে লক্ষ্য করছিলো। সহসা বনহুরের সম্মুখে আসতে সাহসী হলো না সে। নূরী তার নিজের কক্ষে এসে জাভেদের দোলনা দোলাতে লাগলো। এমনি বহুদিন নূরী বনহুরের সম্মুখে আসতে সাহসী হয়নি। বনহুর যখন দরবার কক্ষ থেকে ফিরে আসতো তখন নূরী দূর থেকে বনহুরকে লক্ষ্য করতো। যেদিন তাকে প্রসন্ন দেখতো সেদিন নুরী উচ্ছল ঝরনার মত ছুটে আসতো তার পাশে। তবে বেশির ভাগ দিন বনহুর দরবারকক্ষ থেকে ফিরতে ভয়ঙ্কর এক রুদ্রমূর্তি নিয়ে, তখন নূরী বহু চেষ্টা করেও তার পাশে এসে দাঁড়াতে পারতো না।

আজ নুরী বনহুরের মুখোভাব লক্ষ্য করে বুঝতে পারে, তার মনোভাব খুব ভাল নয়। সুন্দর মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে, ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘাম উঠেছে। মাঝে মাঝে অধর দংশন করছিলো

নূরী নিজের কক্ষে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর নিজকে ধরে রাখতে পারলো না। জাভেদ ঘুমিয়ে পড়েছে তার ছোট্ট বুড়ো আংগুলটা মুখের মধ্যে পুরে। নূরী জাভেদের ঘুমন্ত মুখে। চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায় নিঃশব্দে।

বনহুরের কক্ষের দরজার আড়ালে এসে দাঁড়ায় নূরী। চুপি চুপি লক্ষ্য করে সে বনহুরকে।

কক্ষমধ্যে কঠিন মেঝেতে ভারী বুটের শব্দ শোনা যায়।

আরও সরে এসে উঁকি দেয় নূরী— এবার দেখতে পায় বনহুর পায়চারী করছে। মুখোভাব তার পূর্বের মতই কঠিন লাগছে। বনহুর, পিছনে হাত রেখে পায়চারী করছিলো আর গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলো।

নূরী বুঝতে পারে, বনহুর আজ নিশ্চয়ই কোনো অসাধ্য সাধনে আত্মনিয়োগ করবে। কারণ সে এর আগে দেখেছে, যেদিন বনহুর কোথাও কোনো দুঃসাধ্য কাজে গিয়েছে বা করেছে, সেদিন তাকে এমনি কঠিন মনে হয়েছে। নূরী মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে উঠে, কিন্তু সম্মুখে এগুতে সাহসী হলো না সে।

হঠাৎ পিছনে পদশব্দে নূরী আড়ালে সরে দাঁড়ালো সে দেখতে পেলো, রহমান হন্তদন্ত হয়ে বনহুরের কক্ষে প্রবেশ করলো।

রহমান কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে কুর্ণিশ জানিয়ে বললো- সর্দার।

পায়চারী বন্ধ করে থমকে দাঁড়ালো বনহুর, ফিরে দাঁড়ালো রহমানের দিকে।

রহমান বললো- সর্দার, আমাদের জম্বু ঘাটি থেকে আশা ওয়্যারলেসে এইমাত্র কথা। বলেছে।

বনহুর অবাক কণ্ঠে উচ্চারণ করলো– আশা!

হ সর্দার, আশা! আশা জম্বু ঘাটি থেকে ওয়্যারলেসে জানিয়ে দিলো, আজ রাতে আপনি যেন হীরাঝিল নাঘরে হানা না দেন।

মুহূর্তে বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কঠিন এবং বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো- আশ্চর্য, এ সংবাদ এত দ্রুত আশার কানে কি করে পৌঁছলো। আর সেই জঘুঘাটিতেই বা আশা কখন পৌঁছে এই সংবাদ ওয়্যারলেসে জানাতে সক্ষম হলো?

সর্দার, আমরাও সেই কথাই ভাবছি। আমাদের দরবার থেকে কি করে একথা বাইরে গেলো আর এই অজ্ঞাত নারীই বা কি করে এত দ্রুত জম্বু আস্তানায় পৌঁছে আমাদের আস্তানায় এ সংবাদ জানলো!

বনহুরের ললাটে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তারেখা। কুঞ্চিত করে বললো তোমাদের আমি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছি, প্রস্তুত হয়েছে?

হাঁ সর্দার, কিন্তু ……….

বলো?

আশা আরও জানিয়েছে, হীরাঝিল নাচঘর আজ আপনার জন্য নিরাপদ নয়।

সে দেখা যাবে। তুমি প্রস্তুত হয়ে নাও।

রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো।

নূরী লক্ষ্য করতে লাগলো বনহুরকে।

রহমান বিদায় গ্রহণ করতেই বনহুর তার দস্যু-ড্রেস পরে নিলো, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে আয়নার সম্মুখে দাঁড়াতেই নূরী তার পিছনে এসে দাঁড়ালো, ডাকলো- হুর!

বনহুর মাথার পাগড়ীটা ঠিক করে নিতে নিতে বললো– উ।

অসময়ে কোথায় যাচ্ছো?

নূরী চেটে গেলো একটু পূর্বে শোনা কথাগুলো সে যেন কিছু জানে না, এমনি ভাব টেনে বললো কথাটা।

বনহুর মাথার পাগড়ী ঠিক করে নিয়ে বললো— দস্যু বনহুরের আবার সময়-অসময় আছে নাকি?

তবু কোথায় যাচ্ছো বলবে না?

হীরাঝিল নাচঘরে।

হীরাঝিল? সে তো বহুদূরে?

হাঁ, কান্দাই শহরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে।

একটা কথা আমায় বলবে হুর? বনহুরকে শান্তভাবে কথা বলতে দেখে নূরী অনেকটা সাহসী হয়ে প্রশ্ন করে বসলো।

বনহুর বললো- এখন বেশি কথা বলার সময় নেই।

বেশি কথা আমি বলবো না, শুধু জানতে চাই আশা মেয়েটি কে?

এবার বনহুরের মুখোভাব গম্ভীর হলো-আশা?

হাঁ, আশা—কে সে?

আমিও জানি না।

এতবড় মিথ্যা কথা তুমি আমার কাছে বললে?

বিশ্বাস করো, আমিও জানি না কে সেই আশা।

হীরাঝিল নাচঘরে তোমার যাওয়ার জন্য আজ সে নাকি নিষেধ করেছে।

অনেক খবর দেখছি জেনে নিয়েছে।

হাঁ, রহমান যখন তোমার কাছে বলছিলো আমি আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শুনেছি।

তাহলে তো সব জেনে নিয়েছো? জানো এর শাস্তি কি?

জানি, মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এখন পারবে না আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে—

কারণ?

জাভেদের মুখের দিকে তাকিয়ে।

নূরী, দস্যু বনহুর কাউকে ক্ষমা করে না যদি তার অপরাধ অমার্জনীয় হয়। তুমিও রেহাই পাবে না আমার দণ্ড থেকে।

জাভেদের মুখ চেয়েও তুমি আমায় ক্ষমা করবে না তখন?

শত জাভেদও রুখতে পারবে না, কাজেই সাবধান থাকবে সর্বক্ষণ। বনহুরের কন্ঠস্বর গম্ভীর কঠিন।

নূরী মুখ নিচু করে রইলো, মনে মনে অভিমান হলেও সে এ মুহূর্তে কিছু বললো না।

সহসা বাইরে শোনা গেলো সাইরেনের শব্দ। নূরী চমকে উঠলো, কারণ সে জানে এ শব্দ কেন করা হয়। দস্যু বনহুরের দল যখন কোনো যুদ্ধে বা কোনো ধ্বংসলীলায় গমন করে তখন সবাইকে একত্র হবার জন্য এই সংকেতসূচক সাইরেন বাজানো হয়।

বনহুর নূরীকে টেনে নিলো কাছে, চিবুকটা তুলে ধরে ওষ্ঠদ্বয়ে গভীর একটা চুম্বনরেখা এঁকে দিয়ে বললো-খোদা হাফেজ।

নূরীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো কিন্তু চোখ দুটো ছলছল হলো তার, অস্ফুট কন্ঠে সেও উচ্চারণ করলো-খোদা হাফেজ।

ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে বনহুর।

হীরাঝিল নাচঘর।

আলোয় আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। হীরাঝিলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা মূল্যবান মোটর গাড়ি। সন্ধ্যায় পথের দু’ধারে ছিলো অগণিত গাড়ি রাত বেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সংখ্যা কমে এসেছে। তবে যারা গভীর রাতের খদ্দের তাদের অবশ্য এটাই সময়।

শহরে ধনী-মানী নামে যারা পরিচিত তাদের সমাগম হয়েছে এখন–এরা শুধু শরাব পান বা হুইস্কি পানে আসেন না, এরা আসেন এখানে যে তরুণীদের রাখা হয়েছে তাদের নিয়ে আমোদ প্রমোদ চালাতে।

হীরাঝিলের ফটকে বিরাট ঘড়ি।

ঘড়ির কাঁটা ঠিক দুটোর ঘরে এসে গেছে।

তখন হীরাঝিলের নাচঘরে এক তরুণী নেচে চলেছে।

তাকিয়ায় ঠেশ দিয়ে চারপাশে বসে আছে কতগুলো গণ্যমান্য বয়সী ব্যক্তি। সবাই শরাব পানে ঢুলু ঢুলু করছে। এরা এক একজন নর-শয়তান, গরীবের ধন-সম্পত্তি শুষে নিয়ে বড় হয়েছে। কেউবা ঘুষখোর, কেউবা সুদখোর কেউ অসৎ ব্যবসায়ী।

নর্তকীর পায়ের তলায় টাকার স্তূপ জমে উঠেছে।

নর্তকীর নাচ হঠাৎ থেমে যায়।

জমকালো পোশাক পরিহিত এক ব্যক্তি এসে দাঁড়ালো, তার দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার।

যারা এতক্ষণ ঢুলু ঢুলু, চোখে নর্তকীর নাচ দেখছিলো, তারা দু’চোখ কপালে তুলে ভয় বিহ্বল চোখে তাকালো জমকালো মূর্তিটার দিকে।

একজন বললো—-কে বাবা তুমি?

আর একজন বললো-আমার মনে হচ্ছে দস্যু বনহুর—

হাঁ চিনেছে! বললো দস্যু বনহুর। কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার রিভলভার গর্জে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো প্রথম ব্যক্তি।

পরমুহূর্তে দ্বিতীয়জন মুখ থুবড়ে পড়লো।

এই দৃশ্য লক্ষ্য করে পালাচ্ছিলো কয়েকজন।

বনহুর পথ আগলে দাঁড়ালো-খবরদার কেউ এক পা দরজার দিকে এগুবে না। আজ তোমাদের শেষ রাত। কথাটা বলার সাথে সাথেই আর একটা গুলী এসে বিদ্ধ হলো তৃতীয় ব্যক্তির

কেউ এতটুকু প্রতিবাদ করতে সাহসী হলো না।

বনহুরের রিভলভার গর্জে উঠতে লাগলো একটি পর একটি করে।

রিভলভারের শব্দে চারিদিক থেকে ছুটে এলো নাচঘরের কর্মচারী এবং বয়-দারওয়ান–কিন্তু আশ্চর্য, ভিতর থেকে দরজা বন্ধ! নাচ ঘরের মধ্য হতে ভেসে আসছে পর পর রিভলভারের শুলীর আওয়াজ তার সঙ্গে শোনা যাচ্ছে তীব্র আর্তনাদ।

প্রচণ্ড ধাক্কা পড়ছে দরজায় কিন্তু দরজা একটুও নড়ছে না, মূল্যবান কাঠের তৈরি দরজা লোহার মতই শক্ত হয়ে রয়েছে।

নাচঘরে যখন বনহুরের হত্যালীলা চলেছে তখন রহমান ও আরও তিনজন অনুচর অন্যান্য কামরায় প্রবেশ করে যে সব তরুণীকে এখানে আটক করে রাখা হয়েছিলো তাদেরকে মুক্ত করে দিয়ে বললো—যাও, তোমরা যে যার পিতামাতার কাছে চলে যাও। বিলম্ব হলে বিপদে পড়বে।

তরুণীরা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিলো, ভয় পেয়েছিলো ওদের দেখে, কিন্তু পরে যখন দেখলো ওরা তাদের উপর কোনো অত্যাচার বা অশোভনীয় কিছু না করে এই নির্মম নরককুণ্ড থেকে রেহাই দিচ্ছে তখন খুশি হলো তারা। কারণ ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের এখানে ধরে রাখা হয়েছে। এরা ইচ্ছা করে এখানে কেউ আসেনি, এদের আনা হয়েছে বহু অর্থের বিনিময়ে।

ছাড়া পেয়ে মুক্ত বিহঙ্গের মত যে যেদিকে পারলো পালাতে লাগলো।

বনহুর যখন হত্যালীলা চালাচ্ছিলো তখন সেই নর্তকী যে একটু পূর্বে নাচ দেখাচ্ছিলো সে ওড়নার আঁচলে মুখের নিচের অংশ ঢেকে একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো।

ইত্যালীলা শেষ করে বনহুর নর্তকীর দিকে ফিরে তাকালো, কিন্তু অবাক হলো বনহুর, যেখানে নর্তকীটি দাঁড়িয়েছিলো সে জায়গাটা শূন্য, দেখলো, একটা ছোরা গাঁথা আছে সেখানে।

মেঝের বিক্ষিপ্ত লাশগুলোর দিকে বনহুর একবার তাকিয়ে দেখে নিলো, তারপর সরে এসে ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে। ছোরায় গাঁথা একখানা ভাঁজ করা কাগজ। বনহুর দ্রুতহস্তে ছোরা থেকে কাগজখানা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো হীরাঝিলের নীলাভো উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলোর নিচে। বিস্ময়ে চমকে উঠলো বনহুর, কাগজখানায় লিখা আছে মাত্র কয়েকটি লাইন

বনহুর, জানতাম তুমি আমার সাবধান বাণী শুনবে না। তাই আমাকে আসতে হয়েছে। আসলে আজ এ কক্ষে নাচ হবার কথা নয়-হীরাঝিলের এক নম্বর নাচঘরে নাচ হবার কথা ছিলো। আজ এক নম্বর ঘরে মারাত্মক গ্যাস ছেড়ে তোমাকে হত্যার প্ল্যান করা হয়েছিলো, কাজেই—তোমার কাজ শেষ হয়েছে, এবার ফিরে যাও।
–“আশা”

বনহুর চিঠিখানা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিপ পাথরের মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে। সব যেন কেমন রহস্যময় বলে মনে হয়, কিন্তু এখন বেশিক্ষণ ভাববার সময় নেই। বন দ্রুত পিছন জানালার শার্সী খুলে পানির পাইপ বেয়ে নিচে নেমে যায়।

শিস দিতেই তাজ এসে দাঁড়ায় নিচে।

বনহুর লাফিয়ে পড়ে তাজের পিঠে।

আরও চারটি অশ্বপৃষ্ঠে বনহুরের চারজন অনুচর এসে দাঁড়ায় তাদের দু’পাশে।

বনহুর অন্ধকারে বলে–কাজ শেষ করতে পেরেছে তোমরা?

সবার হয়ে জবাব দেয় রহমান–হা সর্দার।

বনহুর তাজের তলপেটে পা দিয়ে মৃদু আঘাত করে।

উল্কা বেগে ছুটতে থাকে তাজ।

পিছনে ছুটতে শুরু করে রহমানের অশ্ব দুলকি ও অন্য তিনটি অশ্ব।

এদিকে হীরাঝিলের দুই নম্বর নাচঘরের দরজা তখন ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সবাই একসঙ্গে তীব্র আর্তচিৎকার করে উঠলো, কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে সবাই হতভম্ব, আতঙ্কে শিউরে উঠলো– কেউবা সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়লো। যে দৃশ্য তারা দেখলো তা বর্ণনাতীত। হীরাঝিলের দুই নম্বর নাচঘরের মেঝের গালিচার চাপ চাপ রক্ত জমাট বেঁধে উঠেছে। সে এক বীভৎস নৃশংস দৃশ্য!

সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অফিসে ফোন করা হলো।

কান্দাই-এর হীরা জেলার পুলিশ সুপার ইব্রাহিম লোদী পুলিশ ইন্সপেক্টার হাবিব আহমদসহ ছুটলেন হীরাঝিল নাচঘরের উদ্দ্যেশ্য। সেখানে পৌঁছে যে দৃশ্য তারা দেখলেন তাতে জ্ঞান হারাবার উপক্রম হলেন। হীরাঝিলের দুই নম্বর নাচঘরের মেঝেতে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়ে আছে রক্তাক্ত কতকগুলো দেহ। মেঝেই যেন রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে।

প্রত্যেকটা লাশের বুকে পিঠে পাজরে গুলী বিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন বিদ্যমান। এর পূর্বে কোনোদিন এমন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে কিনা সন্দেহ।

কয়েকদিনপূর্বে হীরাঝিলের মালিক রতন দেওয়ান সিং হঠাৎ উধাও হয়েছে–কোথায় গেছেন কেউ জানে না। কান্দাই শহরে এ খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সবার মনে একটা বিরাট আশঙ্কা দোলা জাগিয়েছে, একটা বিপুল ভয় সবাইকে স্তম্ভিত করে তুলেছে–নিশ্চয়ই এ দস্যু বনহুরের কাজ।

শুধু হীরাঝিলের মালিক নন, রায়হান বন্দরের মালবাহী জাহাজের মালিক হোসেন কিবরিয়া শহরের সবচেয়ে বড় নামকরা কন্ট্রাক্টর হানিফ চিশতী এবং আরও একজন নামকরা লোক ইসমাইল সিরাজী শহর থেকে হঠাৎ উধাও হয়েছেন। পুলিশ মহল অনেক সন্ধান করেও এদের কোনো খোঁজ পায়নি।

এইসব মহাত্মার নিখোঁজ ব্যাপার নিয়ে শহরে যখন দারুণ উকুণ্ঠা দেখা দিয়েছে, তখন হীরাঝিল নাচঘরে হলো এই বীভৎস হত্যাকাণ্ড।

অবশ্য হীরাঝিলের দুষ্ট ম্যানেজার আন্দাজেই ধরে নিয়েছিলো, তাদের মালিককে দস্যু বনহুর ধরে নিয়ে গেছে এবং আজ রাতেই আবার হানা দিতে পারে। সেই কারণেই ম্যানেজার হীরাঝিল নাচঘরের সবচেয়ে সুন্দর-সুসজ্জিত এক নম্বর নাচঘরে বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবস্থা করেছিলো। যে মুহূর্তে দস্যু বনহুর হানা দেবে সেই মুহূর্তে গ্যাস পাইপের মুখ খুলে দেবে, কিন্তু সে আয়োজন ব্যর্থ করে দিয়েছিলো আশা।

আশা জানতে পেরেছিলো হীরাঝিলের ম্যানেজারের গোপন অভিসন্ধির কথা। নারী হলেও তার বিচরণ ছিলো সর্বত্র, বনহুরের দরবারেও সে আত্মগোপন করে বনহুরের সবকিছু জেনে নিয়েছিলো এবং বনহুরের জম্বু ঘাটি থেকে তাকে জানিয়েছিলো। সে যেন আজরাতে হীরাঝিলে হানা না দেয়।

বনহুর যখন রহমানের মুখে জানতে পারলো আশার সংকেত বাণীর কথা তখন বনহুরের জোড়া কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিলো, মনে প্রচণ্ড একটা প্রশ্ন নাড়া দিয়েছিলো তার-কে সেই আশা যে তার দরবারের গোপন আলোচনার কথাও জেনে নিয়েছে?

বনহুরকে তার সংকল্প থেকে কেউ কোনোদিন রুখতে পারেনি, আজও পারেনি আশার সাবধানবাণী তাকে ক্ষান্ত করতে। আশা দূর থেকেই ভালবাসতো বনহুরকে, তার কাছে মনে হতো–এই পৃথিবীর মধ্যে একটি পুরুষই আছে, যার সঙ্গে তুলনা হয় না কোনো পুরুষের।

আশা যখন বুঝতে পারে বনহুর আসবেই, হানা দিবেই হীরা ঝিলে তখন সে নর্তকীর ছদ্মবেশে কক্ষ পরিবর্তন করে দুই নম্বর নাচঘরে সবাইকে আটকে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। আশা আরও জানতো, বনহুর কাদের ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে হীরাঝিলে গমন করবে।

বনহুরের আগমন আশাতেই অপেক্ষা করছিলো আশা। মনোরম ভঙ্গীতে সে নৃত্য পরিবেশন করে সবাইকে আকৃষ্ট করে রেখেছিলো।

বনহুর যখন অসাধু শয়তান ব্যক্তিগণকে একটির পর একটি হত্যা করে চলেছিলো তখন আশা নির্বাক দৃষ্টি মেলে দেখছিলো বনহুরকে–দেখছিলো বনহুরের এক অদ্ভুত রূপ।

বনহুরের নৃশংস হত্যালীলা থেকে হীরাঝিলের ম্যানেজারও বাদ যায়নি, তাকেও বনহুর হত্যা করেছে।

পুলিশ মহল যখন হীরাঝিলের মৃত্যু বিভীষিকা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পড়েছে তখন রাজপথের বুকে একদিন পাওয়া গেলো হীরাঝিলের মালিকের মৃতদেহ।

পরদিন পাওয়া গেলো আর একজনের মৃতদেহ-সে হলো ইসমাইল সিরাজী। এক এক করে প্রত্যেকটা মহাত্মার লাশ বিভিন্ন রাজপথে পাওয়া গেলো।

সবাই বুঝতে পারলো এরা সবাই দস্যু বনহুরের শিকার।

এমন হত্যাকাণ্ড কোনোদিন সংঘটিত হয়নি কান্দাই শহরে। সমস্ত দেশব্যাপী একটা ভীষণ আতঙ্ক সৃষ্টি হলো। এবার সবাই ন্যায়নীতি মেনে চলতে লাগলো। যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করতো তারা নিজ নিজ ব্যবসা ত্যাগ করে সৎপথে অর্থ উপার্জনে আত্মনিয়োগ করতে শুরু করলো।

সব সময় ভয় কখন কে উধাও হবে, পরে পাওয়া যাবে তার বিকৃত লাশ। যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ধনবান ঐশ্বর্যবান হয়েছেন তারা সাধু বনে গরিব ও দুঃখীদের মধ্যে অর্থ এবং ঐশ্বর্য দান করতে লেগে যায়।

প্রত্যেকটা কাজে প্রত্যেকটা ব্যক্তি সর্বক্ষণসজাগভাবে চলাফেরা করতে লাগলো। যারা বড় বড় কোম্পানীর মালিক তারা নিজ নিজ কোম্পানীর কর্মচারী এবং শ্রমিকদের প্রতি খেয়াল রাখলেন কেউ যেন কোনো অসৎ কাজে লিপ্ত না হয়।

কন্ট্রাক্টারগণ এবার ন্যায্যভাবে কাজ করে যেতে লাগলেন। যে সব সরকারি দালান-কোঠা বা পুল-সেতু হসপিটাল অফিস আদালত তৈরি হচ্ছিলো সব খাঁটি সিমেন্ট এবং চুনবালি দ্বারা তৈরি করতে লাগলেন। পয়সার লোভ সামলে নিলো সবাই প্রাণের ভয়ে।

শুধু জনসাধারণ নয়, পুলিশ অফিসার যাদের ঘুষ খাওয়া নেশা তারাও মহৎ হতে বাধ্য হলেন। হঠাৎ কেউ মোটা ঘুষ দিতে এলে শিউরে উঠেন হাতজোড় করে মাফ চেয়ে ঘুষদাতাকে বিমুখ করে ফিরিয়ে দিতে লাগলেন।

একমাত্র দস্যু বনহুরের ভয়ে দেশবাসীর মধ্যে এলো এক বিরাট পরিবর্তন।

সমস্ত কান্দাই শহরে যখন দস্যু বনহুরের মৃত্যু বিভীষিকার এক তাণ্ডবলীলা চলেছে তখন একরাতে দস্যু বনহুর উপস্থিত হলো চৌধুরী বাড়িতে। গভীর রাতে সকলের অজ্ঞাতে সে হাজির হলো মনিরার কক্ষে।

মনিরা-স্বামীকে পেয়ে আনন্দিত না হয়ে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো কিন্তু মনিরার রাগ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। বনহুরের লাস্যোজ্জ্বল মুখ তার মন থেকে ধুয়ে-মুছে নিয়ে গেলো সব অভিমান। এই মুহূর্তে কে বলবে এই সেই বনহুর যার বজ্রকঠিন কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয় নর-শয়তানদের বুকের রক্ত, যার অংগুলি হেলনে শত শত দস্যু মৃত্যুমুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, যার রিভলভারের গুলী বিনা দ্বিধায় বিদ্ধ হয় নরপিশাচদের বুকে, সেই দস্যু বনহুর করজোড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করে মনিরার কাছে বলে–যদি কোনো অপরাধ হয়ে থাকে মোরে ক্ষমা করো দেবী—

বনহুরের বলার ভঙ্গী দেখে মনিরা না হেসে পারে না, বলে–এত শয়তান হয়েছো তুমি?

ভুল করলে মনিরা শয়তান আমি নই—বলো শয়তান দমনকারী। এখন বলো—মাহমুদার জন্য কত দূর কি করলে?

বলব না, এতদিন এলে না কেন?

সবতো পত্রিকায় দেখেছে। দেশের কতকগুলো বিষাক্ত আবর্জনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিলাম, তাই ব্যস্ত ছিলাম অনেক।

তোমার কি এ রক্তের নেশা কোনোদিন মিটবেনা?

নেশা নয়, বলো পিপাসা। যতদিন দেশের বুকে, সমাজের বুকে ন্যায়নীতি মজবুত না হবে ততদিন আমার এ সংগ্রাম চলবে। মনিরা তুমি আমাকে শাসন করো কিন্তু আমার কাজে বাধা দিও না।

মনিরা নীরব থাকে কোনো জবাব দেয় না সে স্বামীর উক্তির।

বনহুর এবার বলে–বলো মনিরা, তোমার এদিকের খবর কি? কোনো বর পেলে?

মনিরা ধীরে ধীরে স্বচ্ছ হয়ে আসে। একটু গম্ভীর হয়ে বলে সে—আমি কি তোমার মত নানা কাজে মেতে থাকি যে বর পাবো না? পেয়েছি-খুব সুন্দর বর।

বাঃ তাহলে তো কথাই নেই। বর দেখাবে না আমাকে?

নিশ্চয়ই দেখাবোর যাবে তুমি আমাদের সঙ্গে?

বনহুর কুঁচকে বলে–কিন্তু জানো তো আমার পক্ষে কি সম্ভব হবে?

কেন হবে না, আমি তোমাকে ঠিক নিয়ে যাবো।

কোথায় নিয়ে যাবে?

ইশরাৎ জাহানদের বাড়িতে।

কে সে?

আমার বান্ধবী। ইশরাৎ জাহানের বড় ভাই আহসানই তো মাহমুদার ভাবী স্বামী।

চমৎকার নাম, আহসান। হাঁ, যাওয়া যায় কিন্তু তোমার বান্ধবীর বাড়ি নয়–

তবে কোথায়? হাঁ ঠিক মনে পড়েছে, এখানে দাওয়াত দিলে কেমন হয়?

ভাল হয় কিন্তু অসুবিধাও আছে, কারণ পুলিশ মহল সর্বক্ষণ আমাকে সন্ধান করে ফিরছে। শুধু পুলিশ মহল নয়, জনসাধারণ সবাই খুঁজে ফিরছে আমাকে, কারণ জানোত এখন আমার মূল্য এক লাখ টাকা। চৌধুরী বাড়ির চারিদিকে সব সময় পুলিশ সতর্ক পাহারা রয়েছে।

তাহলে তুমিই বলো কিভাবে তাকে দেখবে?

এক কাজ করো, আমি হবো তোমার গাড়ির ড্রাইভার।

তারপর?

তারপর তোমার বান্ধবী এবং বান্ধবীর ভাই আহসানকে দাওয়াত করবে পিকনিকে যাবার—

তারপর?

তখন আমাকে চিনলো না কেউ, জানলো না কেউ অথচ আমি তোমার বান্ধবীর সেই আদুরে ভাইজানকে দেখে নিলাম ভাল করে বাস্।

ঠিক বলেছো।

হাঁ, কাল ভোরে তোমার গাড়ির ড্রাইভারকে বিদায় করে দিও অবশ্য কয়েক দিনের ছুটি দিয়ে দিও তাকে।

বেশ, তাই হবে। বললো মনিরা।

মনিরাকে লক্ষ্য করে বললেন মরিয়ম বেগম-ড্রাইভারকে অমন করে ছুটি দিলি কেন মনিরা?

একটু হেসে বললো মনিরা নতুন একটা ড্রাইভার পেয়েছি তাই।

নতুন ড্রাইভার।

হ মামীমা।

দশ বছরের পুরানো ড্রাইভারকে বাদ দিয়ে—

একেবারে তাড়িয়ে দেইনি। বেচারী বহুদিন থেকে ছুটি চায় পায় না, কারণ ভাল ড্রাইভারের অভাবে ওকে ছুটি দেওয়া হয়নি, এবার আর একটি ভাল ড্রাইভার পেয়েছি।

কি জানি বাবা কোথাকার কে! বিশ্বাসী কিনা তাই বা কে জানে।

তুমি কিছু ভেবো না মামীমা, ড্রাইভারটা খুব বিশ্বাসী। তুমি দেখবে?

কই, এসেছে?

হাঁ, না এলে কি আর পুরানো ড্রাইভারকে ছুটি দেই? এবার মনিরা ফুলমিয়াকে ডেকে বললো-ওরে ফুলমিয়া যা তো নতুন ড্রাইভারকে ডেকে আন্।

যাচ্ছি আপামনি।

না থাক, আমিই যাচ্ছি। তুই যা কাজ করগে।

মরিয়ম বেগম বললেন–চল আমিও তোর সঙ্গে যাই, দেখি কেমন ড্রাইভার রাখলি।

মনিরা আমতা আমতা করে বললো–তুমি আবার কষ্ট করে যাবে?

তাতে কি চল। মরিয়ম বেগম পা বাড়ালেন।

মনিরা তখন একটু বিব্রত হলো, ফুলমিয়াকে লক্ষ্য করে বললো—ফুলমিয়া নতুন ড্রাইভার কি করছে?

ফুলমিয়া চলে যাচ্ছিলো, ফিরে দাঁড়িয়ে বললো–নতুন ড্রাইভার গাড়ি পরিষ্কার করছে।

এবার যেন কিছুটা আশ্বস্ত হলো মনিরা, মামীমাকে লক্ষ্য করে বললো—চলো মামীমা, নতুন ড্রাইভারকে দেখবে চলল।

মনিরা আর মরিয়ম বেগম গ্যারেজের দিকে এলো।

মনিরা নিজস্ব গাড়ির গ্যারেজ অন্দরমহল সংলগ্ন নির্দিষ্ট জায়গায় ছিলো, প্রাচীরঘেরা বাগানবাড়ির পাশে সুন্দরভাবে তৈরি এই গ্যারেজ।

মনিরা আর মরিয়ম বেগম এসে দাঁড়ালো–তারা দেখতে পেলো ড্রাইভার মনোযোগ সহকারে গাড়ি পরিষ্কার করে চলেছে। কোনো দিকে তার যেন খেয়াল নেই।

মনিরা মনে মনে হাসছিলো।

মরিয়ম বেগম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে দেখতে লাগলেন, তারপর বললেন– লোকটা বেশ কাজের মনে হচ্ছে।

মনিরা বললো হাঁ, অত্যন্ত কাজের, সেজন্যইতো আমি ওকে পছন্দ করেছি। কিন্তু মামীমা ওর সম্মুখে যেন ওর প্রশংসা করো না, বেশি লাই পেয়ে যাবে।

মরিয়ম বেগম হেসে বললেন-যে কাজের লোক হয় সে কোনো সময় মন্দ হয় না মা। তারপর ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললেন “ড্রাইভার!

ফিরে তাকালো ড্রাইভার, মনিরা আর মরিয়ম বেগমকে দেখতে পেয়ে সালাম জানালো সোজা হয়ে।

মরিয়ম বেগম দেখলেন, মাথায় পাগড়ী বাঁধা মুখে ছাঁটা দাড়ি চোখে কালো চশমা। পরনে পাঞ্জাবীদের মত ঢিলা কুচিদার পাজামা আর লম্বা পাঞ্জাবী।

মরিয়ম বেগম বললেন-ড্রাইভার তোমার কি চোখ খারাপ আছে?

জি?

তোমার কি চোখ খারাপ?

থোরা খোরা খারাব আছে মাইজি।

সর্বনাশ, গাড়ি চালাতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে নাতো

নেহি মাইজি হামি বহু দিন সে গাড়ি চালাতা।

মনিরা মৃদু হেসে বলে-মামীমা, তোমাকে তো বলেছি, এই ড্রাইভার অত্যন্ত পাকা ড্রাইভার।

হাঁ, মাইজি, হামি বহুৎ আচ্ছা ড্রাইভার।

তা দেখা যাবে। কয়েকদিন কাজ করলেই বুঝতে পারবো। আচ্ছা তোমার নাম কি বাবা?

নাম?

হা।

হামারা নাম ফরমান আলী দেওয়ান—

মনিরা হেসে উঠলো খিল খিল করে।

মরিয়ম বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–ছিঃ মা কারো নাম শুনে হাসতে নেই।

ড্রাইভার তখন হাসি চেপে মাথা চুলকাতে চেষ্টা করছিলো কিন্তু মাথায় পাগড়ী থাকায় সে ঘাড় চুলকাতে শুরু করলো।

মরিয়ম বেগম বললেন–তুমি কিছু মনে করোনা ড্রাইভার। বড় ছেলেমানুষ ও চল্ মা মনিরা চল।

মনিরা এবং মরিয়ম বেগম ফিরে চললল।

মনিরা একবার ড্রাইভারের সঙ্গে মুখ চেপে হেসে নিলো তারপর মামীমাকে অনুসরণ করলো।

মরিয়ম বেগম বললেন-মনিরা কারো নাম মন্দ হলে তার সামনে মন্দ বললে বা হাসলে ব্যথা পায় সে বুঝলে? আর যেন হেসো না–

না না, হাসবো না আর। কিন্তু ওর নাম ধরে ডাকবো কেমন করে বলো।

কেন, ফরমান বলে ডেকো।

উ হু একেবারে বাজে নাম।

তবে দেওয়ান বললেই পারো।

না, ও নামটাও আমার ভাল লাগছে না ঠিক মনে পড়েছে আগা পাছা বাদ দিয়ে মাঝেরটুকু—-আলী বলে ডাকলে কেমন হয়?

ঠিক বলেছো মনিরা আলী নামটা কিন্তু সুন্দর। বেচারী যে ক’দিন থাকে ওকে আলী বলেই ডেকো।

তাই হবে। বললো মনিরা।

মনিরা নিজের ঘরে এসে রিসিভার তুলে নিলো হাতে, ইশরাৎ জাহানের কাছে ফোন করে জানালো তারা যেন তৈরি থাকে, কাল ভোরে পিকনিকে যাওয়া হবে।

ইশরাৎ জাহানতে আনন্দে আত্মহারা হলো, সে তখনই ভাইয়ার কাছে মতামত জেনে নিয়ে মনিরাকে জানিয়ে দিলো, কাল সকালে তারা তৈরি হয়ে যাবে।

পরদিন মাহমুদা আর মনিরা সেজেগুজে তৈরি হয়ে নিলো।

ফুলমিয়া পিকনিকের জন্য যে যে জিনিসপত্রের প্রয়োজন সব গুছিয়ে তুলে দিলো গাড়িতে। অবশ্য ড্রাইভারও ফুলমিয়াকে সাহায্য করলো এ ব্যাপারে।

মাহমুদা আর মনিরা যখন গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো তখন মরিয়ম বেগম ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললেন–বাছা তুমি নতুন লোক, এদের দেখেশুনে নিয়ে যাবে। সাবধানে গাড়ি চালাবে বুঝলে?

হ মাইজি হাম সমঝা।

গাড়িতে স্টার্ট দিলো ড্রাইভার।

এই গাড়িতে একমাত্র মনিরা ছাড়া আর দ্বিতীয় প্রাণী কেউ জানে না ড্রাইভারের আসল পরিচয়।

তবে নূর একদিনের মধ্যেই ড্রাইভারকে ভালবেসে ফেলেছে। বড় আদর করে ওকে ড্রাইভার।

নূর প্রথম দিনই ড্রাইভারের আদরে খুশি হয়ে ছুটে গিয়েছিলো মায়ের কাছে-আম্মি, আম্মি, ড্রাইভারটা খুব ভাল লোক। আমাকে বউ আদর করে, কোলে নিয়ে চুমু খায়। আম্মি, কই কিছু বলছো নাতো?

হাঁ বাবা আমাদের নতুন ড্রাইভার খুব ভাল।

আম্মি, আমাকে পাঁচটা টাকা দিও, আমি ওকে বকশিশ দেবো।

বেশ দিও।

নাছোড়বান্দা নূর ধরে বসেছিলো—আজকেই দেওনা, আমি ওকে দেই।

আজ না বাবা, আর একদিন দিও। বলেছিলো মনিরা।

ও কথা হবে না, তুমি আমাকে এক্ষুণি টাকা দাও দাও বলছি নইলে আজ আমি কিছু খাবো না। কথাগুলো বলে মুখ ভার করে বসেছিলো নূর।

মনিরা হেসে বলেছিলোনাও! পাঁচ টাকার একটি নোট নূরের হাতে দিয়ে দিলো মনিরা।

নূর টাকা নিয়েই ছুটে গিয়েছিলো নতুন ড্রাইভারের কাছে।

ড্রাইভার ওকে কোলে টেনে নিয়ে বলেছিলে—কিয়া বাত ছোটা সাহাব?

এই নাও তুমি মিষ্টি কিনে খেয়ো ড্রাইভারের হাতে পাঁচ টাকার নোটখানা খুঁজে দেয় নূর।

ড্রাইভার হেসে বলে-নো নো, হামি টাকা কি করিবো ছোটা সাহাব? মিষ্টি হামি খাই না।

তোমার ছেলে নাই?

আছে, ঠিক তোমারই মত এক লাড়কা আছে হামার।

এ টাকা তুমি রেখে দাও, তোমার ছেলেকে মিষ্টি কিনে দিও।

আর হামি তোমাকে যদি মিষ্টি কিনে দেই খাবে না?

হাঁ খাবো। কিন্তু—

বোলো? বোলো ছোটা সাহেব?

আমাদের অনেক টাকা আছে, তোমার তো অনেক টাকা নেই। তুমি মিছেমিছি আমার জন্য পয়সা নষ্ট করো না।

তুমি মিষ্টি খাইলে হামি বহুৎ খোশ হবো ছোটা সাহাব।

বেশ এনো, খাবো। ড্রাইভার?

বোলো ছোটা সাহাব?

তোমার ছেলে কেমন দেখতে?

ঠিক তুমার মত হবে।

ঠিক আমার মত?

হাঁ ছোটা সাহাব।

তোমার ছেলেকে একদিন আনবে?

হামি গরিব মানুষ, তোমার বাড়ি আনলে তুমি ঘৃণা করবে না তো ছোটা সাহাব?

বহুৎ আচ্ছা তুম্ ছোটা সাহাব। তুম বহুৎ আচ্ছা—কোলে তুলে নিয়ে আদর করেছিলো ওকে ড্রাইভার।

আজ মনিরা ইচ্ছা করেই নূরকে সঙ্গে নেয়নি, সব সময় সে বিরক্ত করবে ড্রাইভারকে তাই ওকে সরকার সাহেবের সঙ্গে বাইরে পাঠিয়ে ওরা গাড়িতে উঠে বসেছিলো।

ইশরাৎদের বাড়ির গেটে গাড়ি পৌঁছতেই ইশরাৎ জাহান এবং আহসান গাড়িতে উঠে পড়লো। তারা তৈরি হয়ে মনিরাদের জন্য প্রতীক্ষা করছিলো।

গাড়িতে বসে শুরু হলো তাদের আলোচনা-কোথায় যাওয়া যায়।

মনিরা বললো সর্বপ্রথম-সমুদ্রের ধারে নির্জন একটা জায়গা বেছে নিলে কেমন হয়?

মাহমুদা সায় দেয়-হাঁ, ঠিক বলেছো আপা, তাই ভাল হবে।

ইশরাৎ জাহান বললো–সেই ভাল, দেশব্যাপী দস্যু বনহুরের যে উপদ্রব চলেছে তাতে দূরে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না।

আহসান চুপ করে ছিলো এতক্ষণ, এবার সে বলে উঠলোরেখে দাও তোমার দস্যু বনহুর। একবার যদি আমার সম্মুখে সে পড়তো তাকে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়তাম।

ভ্রূকুঞ্চিত করে বলে উঠে ইশরাৎ জাহান—কি বললে ভাইয়া দস্যু বনহুরকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছাড়বে?

তা নয় তো কি-সেও মানুষ, আমিও মানুষ। কেন, আমার দেহে কি শক্তি নেই?

চুপ করো ভাইয়া, শুনেছি দ্য বনহুর নাকি অশরীরী আত্মার মত সব শুনতে পারে, দেখতে পারে। বন্ধ কক্ষেও আচম্বিতে প্রবেশ করে হত্যা করতে পারে সে।

এবার আহসান হেসে উঠলো-হঠাৎ এই গাড়ির মধ্যে এসে পড়তে পারে, তাই না?

অসম্ভব কিছুই নয় দস্যু বনহুরের কাছে। বললো ইশরাৎ জাহান।

দুই ভাই-বোন মিলে দস্যু বনহুরকে নিয়ে বেশ কথা কাটাকাটি হচ্ছিলো। ইশরাৎ জাহানের দস্যু বনহুর সম্বন্ধে উচ্চ ধারণা সে জানে, দস্যু বনহুর অসাধ্য সাধন করতে পারে আর আহসান ইশরাৎ জাহানের কথা কিছুতেই মেনে নিতে চায় না, সে বলে দস্যু বনহুরও পুরুষ, আমিও পুরুষ —সে যা পারে কেন আমরা তা পারবো না কেন? আমরা তার কাজে বাধা দিতে পারবো না শুধু আজ নয়, এমনি বহুদিন দু ভাই বোনের মধ্যে নানারকম তর্কবিতর্ক হয়ে থাকে।

মাহমুদাও মাঝেমাঝে যোগ দেয় ইশরাৎ জাহানের সঙ্গে। সেও জানে না কে এই দস্যু বনহুর, তবু তার মন বলে দস্যু বনহুর সাধারণ মানুষ নয়। সে এক অলৌকিক মানুষ, যার সঙ্গে তুলনা করা যায় না একালের এই পুরুষনামী মানুষগুলোর।

মনিরা অবশ্য সব সময় চুপচাপ থাকতো এ ব্যাপারে। যখন তাকে ওরা প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বসতো তখন মনিরা দু’একটা জবাব দিতো।

অন্যান্য দিনের মত আজও মনিরা নিখুপ শুনে যাচ্ছিলো আর মৃদু মৃদু হাসছিলো, কারণ ড্রাইভ আসনে উপবিষ্ট সেই ব্যক্তি, যাকে নিয়ে তাদের এত মাথাব্যথা।

গাড়ি চলেছে।

ড্রাইভার বলে উঠলো–কাঁহা যানে হোগা সাহাব?

হাঁ বলছি– মিসেস মনিরা, আপনিই বলুন কোথায় যাবেন, আপনি যেখানে বলবেন সেখানেই যাওয়া যাবে। কথাগুলো বলে ড্রাইভ আসনের পাশ থেকে পিছন আসনের দিকে ফিরে তাকালো আহসান

মনিরা বললো–দস্যু বনহুরের ভয়ে আমিও কম ভীত নই, কাজেই ইশরাৎ জাহানের সঙ্গে আমার একমত।

উ হু, তাহলে আপনার কথায় আমি রাজি নই মিসেস মনিরা। ড্রাইভার, ইরোবন চলল।

ইরোন! বললো ইশরাৎ জাহান।

হাঁ ইরোবন, কান্দাই-এর একটি সুন্দর মনোরম বন এটা। সুন্দর হালকা বন, কোথাও ঝোঁপঝাড় বা আগাছা নেই। শুধু বড় বড় শাল আর পাইন গাছ। মাঝে মাঝে মেহগনি এবং চন্দন কাঠের গাছ আছে।

ইশরাৎ জাহান বলে উঠলো– তুমি যাই বলল ভাইয়া ইরোবনই বলল বা হীরোবনই বলল, হঠাৎ দস্যু বনহুর যদি এসে পড়ে তখন কি করবে শুনি?

এই দেখো, সে বুদ্ধি আমি এটেই এনেছি। আহসান পকেট থেকে একটা পিস্তল বের করে দেখালো সবাইকে।

ড্রাইভার হাসলো আপন মনে।

মনিরাও অবশ্য হাসলো কিন্তু সে নিজকে অত্যন্ত সর্তকভাবে গভীর রাখলো। মনিরা স্বীকার হলো আহসানের কথায় বললো ইবরাবন দেখা হয়নি কোনোদিন, ওখানেই যাওয়া যাক।

ধন্যবাদ মিসেস মনিরা, আপনাকে আমি আন্তরিক প্রীতি জানাচ্ছি। ইশরাৎ, দেখলি তো মিসেস মনিরা আমার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। আহসান এবার ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো —ড্রাইভার, ইরোবন চলো।

ড্রাইভার গাড়ির সম্মুখে দৃষ্টি রেখে বললো— বহুৎ আচ্ছা।

এবার গাড়িখানা শহরের বিভিন্ন পথ ধরে ইরোবনের দিকে দ্রুত এগিয়ে চললো।

গাড়ির ভিতরে তখন নানারকম গল্পের ফুলঝুরি ঝরে পড়ছে– হাসি-গল্প কত কথা।

একসময় পৌঁছে যায় তারা ইবরাবনে।

ড্রাইভার গাড়িখানাকে একটি সুন্দর জায়গা বেছে নিয়ে রাখলো।

গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সবাই।

ইশরাৎ জাহান, মনিরা, মাহমুদা মিলে গাড়ির জিনিসপত্র নামাচ্ছিলো।

আহসান বলে উঠে— আহা, তোমরা ব্যস্ত হচ্ছে কেন? ড্রাইভার, জিনিসপত্রগুলো সব নামিয়ে দাও।

বহুৎ আচ্ছা সাহাব। ড্রাইভার গাড়ি থেকে খাবারের জিনিসপত্রগুলো নামিয়ে নিতে লাগলো।

মনিরা হাসলো।

আহসান দেখিয়ে দিলো- এইখানে সব গুছিয়ে রাখো। দেখো কোনো জিনিস যেন ক্ষতি না হয়।

ড্রাইভার জিভ কামড়ে বললো– নেহি সাহাব, কোই ক্ষতি হামি নাহি করিবো….

মনিরা বললো– ও খুব ভাল লোক, আমাদের কোনো জিনিস ক্ষতি করবে না।

বলা যায় না, গরিব বয়, বাবুর্চি, দারওয়ান, ড্রাইভার এদের বিশ্বাস কি বলুন?

ইশরাৎ বলে উঠে- ভাইয়া, তুমি বেশি কথা বলছে। মনিরা, এ ড্রাইভারটাকে নতুন মনে হচ্ছে না?

হাঁ, এ নতুন এসেছে। তবে খুব বিশ্বাসী।

ওর মুখ দেখে সে রকমই মনে হয়। কি নাম ওর?

মনিরা ইশরাতের প্রশ্নে জবাব দিলো ফরমান আলী দেওয়ান।

ওরে বাবা, কি বিদঘুঁটে নাম! বললো আহসান।

ইশরাৎ জাহান বললো- কেন মন্দ কি!

মনিরা বললো– আমি ওকে আলী বলে ডাকি।

বাস্ সেই ভাল। বললো আহসান। তারপর বললো— ড্রাইভার, তুমি এদিকে সব গুছিয়ে নাও, আমরা বনের মধ্যে ঘুরেফিরে কতকগুলো ছবি তুলে নিই। আসুন মিসেস মনিরা, আসুন মিস্ মাহমুদা;……

কই, আমাকে তো ডাকলে না ভাইয়া? বললো ইশরাৎ জাহান।

ড্রাইভার তখন গাড়ি থেকে খাবারের জিনিসপত্র এনে গুছিয়ে রাখছিলো। ইচ্ছা করেই সে একটা প্লেট ভেঙ্গে ফেললো।

আহসান খেঁকিয়ে উঠলো- সর্বনাশ করেছে। একেবারে অকেজো একটা লোককে আপনি ড্রাইভারের কাজ দিয়েছেন মিসেস মনিরা।

মনিরা বলে উঠলো– ঠিক আছে, ওর মাইনে থেকে প্লেটটার দাম কেটে নেবো।

হাত জুড়ে বলে ড্রাইভার নেহি আপামনি, হামি বহুৎ গরিব আদমী!

ইশরাৎ জাহান বলে উঠে– মনিরা, তোর কি একটু মায়া নেই? সামান্য দু’টাকার না হয় একটা প্লেট ভেঙ্গেছে, তাই তুই দাম কাটবি?

আহসান বলে উঠলো- কাটাবে নাতো কি? এবার যদি মাফ করে দেয় তবে আবার এমনি করে রোজ এটা নয় সেটা নষ্ট করে বসবে।

মনিরা আহসানের কথায় যোগ দিয়ে বলে উঠে- আপনি ঠিক বলেছেন, একবার ওকে মাফ করলে প্রশ্রয় পেয়ে যাবে। ড্রাইভার, তুমি বড় দুষ্ট হয়েছে।

কি করিবো আপামনি, বুড়া মানুষ, হামার হাতে তাগদ নেই আছে……হাত কচলায় ড্রাইভার।

ইশরাৎ বলে– যাক, এবারের মত মাফ করো। যে প্লেটখানা ভেঙ্গেছে তার দাম আমিই দিয়ে দেবো। চলো! মনিরা আর মাহমুদার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো সে।

তিন বান্ধবী মিলে বনের মধ্যে ছুটাছুটি করে বেড়াতে লাগলো।

আহসান ফটো নিয়ে চললো একটির পর একটি করে।

একসময় মাহমুদা আর ইশরাৎ জাহান সরে গেছে বেশ কিছু দূরে।

মনিরা এগুচ্ছিলো, হঠাৎ তার পায়ে একটা কাঁটা বিঁধে যায়। জুতোর ফাঁকে আংগুলে বিদ্ধ হয়েছিলো কাটাটা। বসে পড়লো মনিরা-উঃ!

দ্রুত সরে আসে আহসান–কি হলো মিসেস মনিরা?

কিছু না, সামান্য একটা কাঁটা বিঁধেছে..

দেখি দেখি আমি উঠিয়ে দিচ্ছি।

না, আমি নিজেই উঠিয়ে ফেলতে পারবো।

ততক্ষণে আহসান মনিরার পাশে বসে পড়ে তার পায়ে হাত রেখেছে। বলে আহসান— মিসেস মনিরা, আমি বুঝতে পারি না, আপনি আমার কাছে এত সঙ্কুচিত থাকেন কেন? আপনি জানেন না আমি আপনাকে কত ভালবাসি!

ছিঃ আপনি ভুল করছেন?

না, আমি ভুল করিনি মিসেস মনিরা। কারণ আমি বিদেশ যাওয়ার পূর্ব হতে আপনাকে ভালবেসে ফেলেছি। যখন আপনি ইশরাতের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে যেতেন তখন থেকে আপনার ছবি গেথে গেছে আমার হৃদয়পটে।

না না, এসব আপনি কি বলছেন মিঃ আহসান। আমি আপনাকে আমার ছোট বোনের ভাবী স্বামী হিসেবেই জানি……

কিন্তু আমি যে তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না মনিরা, আহসান মনিরার হাত চেপে ধরে।

মনিরা এক ঝটকায় আহসানের হাত থেকে নিজের হাতখানাকে ছাড়িয়ে নিতেই পিছনে ড্রাইভারের গলার শব্দ শোনা যায়, একটু কাশীর শব্দ।

চমকে ফিরে তাকায় আহসান, ড্রাইভারকে দেখে রাগত কণ্ঠে বলে উঠে- তুমি আবার এখানে কেন এসেছো?

মনিরা তাকায় ড্রাইভারের দিকে, মুখখানা তার দীপ্ত উজ্জ্বল হয়ে

আহসান বলে— যাও, তুমি ওখানে যাও।

ড্রাইভার চলে গেলো।

ততক্ষণে ইশরাৎ জাহান এবং মাহমুদা এসে পড়েছে।

ওরা এসে পড়তেই আহসান বলে উঠে মিসেস মনিরার পায়ে কাঁটা বিঁধেছিলো।

তাই নাকি মনিরা? বললো ইশরাং জাহান।

মনিরা বললো- বিধেছিলো কিন্তু বেরিয়ে গেছে।

ইশরাৎ জাহান মনিরার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে চিবুকটা তুলে ধরে বললো–ইস, বড্ড লেগেছে বুঝি?

মনিরা কোনো জবাব দিলো না।

আহসান বললো– চলো, কিছু খেয়ে নেয়া যাক।

ইশরাৎ বললো– চলো, অনেক ছুটাছুটি করেছি, বড় ক্ষুধা পেয়ে গেছে।

সবাই মিলে তারা এগিয়ে চললো যেখানে খাবার সরঞ্জাম সাজানো ছিলো।

আহসান চারিদিকে তাকিয়ে বললো– ড্রাইভার গেলো কোথায়?

ইশরাৎ জাহান বলে উঠলো- আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, ওর কি সখ হয় না? বেচারী হয়তো একটু ঘুরেফিরে দেখছে।

মনিরা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে কোনো কথা বললো না।

মাহমুদা আর ইশরাৎ জাহান খাবার জিনিসপত্র ঝুড়ি থেকে বের করে প্লেটে সাজাতে শুরু করলো।

আহসান একখানা প্লেট মনিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো– নিন, খেয়ে নিন মিসেস মনিরা।

মনিরা বললো– ধন্যবাদ, আপনি খান, আমি নিজেই নিয়ে খাচ্ছি। মনিরা একটা প্লেট হাতে তুলে নিলো।

সবাই খেতে শুরু করেছে।

ইশরাৎ খেতে খেতে মনিরাকে লক্ষ্য করে বলে হঠাৎ অমন গম্ভীর হয়ে পড়লি কেন মনিরা! বুঝেছি, হয়তো বন্ধুর কথা মনে পড়েছে?

মনিরা হাসবার চেষ্টা করে কিন্তু কোনো জবাব সে দেয় না। যে আহসানকে সে মাহমুদার জন্য পছন্দ করে এতদূর অগ্রসর হয়েছে সেই কিনা তার কাছে প্রেম নিবেদন করে বসলো! মনিরা যেন মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলো, কত উঁচু মুখ করে সে আহসানকে বেছে নিয়েছিলো, সব যেন নিমিষে ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।

মনিরা ধীরে ধীরে খাচ্ছিলো। অন্য সকলের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, এমন সময় আচম্বিতে তাদের সম্মুখে হাজির হয় অদ্ভুত কালো আলখেল্লা পরা এক লোক, তার দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার, মুখে মুখোস।

বনের মধ্য হতে বেরিয়ে আহসান এবং অন্য সবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললো। আলখেল্লা পরিহিত ব্যক্তি–হ্যান্ডস আপৃ!

আহসান নাস্তা শেষ করে সবে চায়ের কাপে চুমুক দিতে যাচ্ছিলো, সম্মুখে চোখ তুলতেই তার হাত থেকে চায়ের কাপ খসে পড়লো। জামা-কাপড়ে চা ঢলে পড়লো। কাঁপতে কাঁপতে হাত উঠালো সে।

ইশরাৎ জাহান, মাহমুদা এরাও হাত তুলেছে উঁচু করে। এক একজনের মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

আহসান ঢোক গিলে বললো- কে তুমি? কি চাও?

দস্যু বনহুর!

হ্যাঁ তুমি…তুমি দস্যু বনহুর?

হাঁ, বের করে তোমার কাছে কি আছে।

আমার কাছে কিছু নেই– টাকা-পয়সা সামান্য কিছু আছে তা সব দিচ্ছি, প্রাণে মেরো না। কথা বলার ফাঁকে তাকাচ্ছে আহসান চারিদিকে, ভাবছে এ মুহূর্তে ড্রাইভারটা এলেও তবু কিছুটা সাহস হতো।

দস্যু বনহুর পুনরায় গর্জে উঠলো– হাত নিচু করে পকেট থেকে সব বের করে ফেলো। খবরদার চালাকি করতে যেও না, মরবে।

আহসান কম্পিত হস্তে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বাড়িয়ে ধরলো– এই নাও।

ওটা ছাড়া আর কি আছে বের করো।

আর কিছু নেই।

মিথ্যা কথা, তোমার কোটের পকেট উঁচু লাগছে বের করো যা আছে।

এবার আহসান বাধ্য হলো পকেট থেকে তার পিস্তলখানা বের করতে।

বনহুর বললো- ওটা ঐ পাশের ডোবায় ছুঁড়ে ফেলে দাও।

আহসান মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো তার সখের পিস্তলটার দিকে।

বনহুর হেসে উঠলো– হাঃ হাঃ হাঃ, কাপুরুষ, ওটা রেখে তুমি কি করবে? ফেলে দাও, ফেলে দাও বলছি..

এবার আহসান ফেলে দিলো অনুগত দাসের মত তার হাতের পিস্তলটা পাশের ডোবার পানিতে। তখন তাঁর মুখোব বড় অসহায় করুণ লাগছিলো।

মাহমুদা আর ইশরাতের অবস্থাও অত্যন্ত কাহিল, তারা মনে প্রাণে খোদার নাম স্মরণ করছে। এক-একজনের চেহারা রক্তশূন্য হয়ে উঠেছে।

মনিরা মনে মনে হাসছিলো, বনহুর যে সত্যি সত্যি এখানে এভাবে নিজকে প্রকাশ করবে, সে ভাবতে পারেনি।

আহসান রিভলভার ফেলে দিতেই বনহুর বললো– তোমার মানিব্যাগ উঠিয়ে পকেটে রাখো। আর কোনোদিন যেন মেয়েদের নিয়ে বনে-জঙ্গলে তামাশা করতে এসো না। যাও?

বনহুর বনমধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

আহসান যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

ইশরাৎ জাহান তো কান্না শুরু করে দিয়েছে।

মাহমুদার অবস্থাও তাই।

সবাই বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো। তাদের ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে, তারা যে প্রাণে বেঁচে গেলো এটাই তাদের ভাগ্য। আহসান কম্পিত গলায় ডাকতে লাগলো ড্রাইভার……ড্রাইভার

… কিন্তু তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে গেছে, শব্দ বের হচ্ছে না গলা দিয়ে।

হঠাৎ দেখা গেলো ড্রাইভার পাশের একটা গাছের আড়াল থেকে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসছে। সম্মুখে আসতেই আহসান ধমক দিলো কোথায় গিয়েছিলে তুমি?

সাহাব হামি উধার গিয়ে ইরোবন দেখনে কে লিয়ে। আনা লাগা তব দেখা এক কালা আদমী……হাম পিছে হট গিয়ে… সাহাব উ কালা আদমী কাহা?

কালা আদমীর খোঁজ আর নিতে হবে না, শীগগীর গাড়িতে চলে! বলে আহসান ইশরাং জাহানের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো।

মাহমুদা, মনিরাও দ্রুত ছুটলো গাড়ির দিকে।

ড্রাইভার জিনিসপত্রগুলো গুছিয়ে নিতে যাচ্ছিলো, আহসান ধমক দিলো রেখে দাও ওগুলো, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসো। শীগগীর এসো……

ড্রাইভার দু’চারটে জিনিস হাতে নিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে এসে চেপে বসলো। তার দেহটাও কাঁপছে থরথর করে।

বনহুরের হাসি যেন থামতে চায় না।

মনিরা মুখ ভার করে বলে— হাসছো যে বড়?

হাসি থামিয়ে বললো বনহুর-হাসবো না তো কি কাদবো? বেশ, বেশ, বোনের জন্য পাত্র খুঁজতে গিয়ে নিজেই যে পাত্রী বনে বসে আছে।

আমি কি জানতাম আহসান এমন কুৎসিত লোক?

আমি কিন্তু আগেই আহসানের আসল রূপ চিনে নিয়েছি।

এই তো সবে কাল তোমার সঙ্গে দেখা হলো, তা তুমি কি করে অনেক আগেই তার আসল। রূপ চিনে নিতে পারলে?

সমুদ্রতীরে তোমরা রোজ বেড়াতে যেতে, খেয়াল আছে?

আছে।

নৌকায় চেপে সমুদ্রের পানিতে ঘুরে বেড়াতে, মনে রেখেছো?

রেখেছি।

স্মরণ আছে নৌকার মাঝির কথা?

মনিরা এবার হেসে উঠলো-দুষ্ট কোথাকার!

হু, সেই দিনই আমি ওকে চিনে নিয়েছিলাম। মনিরা, এরা তো শুধু মানুষনামী জীব।

আমি মাহমুদার জন্য একটা জীবকে পছন্দ করেছিলাম, সত্যি আমি এজন্য লজ্জিত ও দুঃখিত।

তুমি দুঃখ করো না মনিরা, এবার আমি নিজে মাহমুদার জন্য পাত্র সংগ্রহ করবো।

সেদিনের পর থেকে বনহুর নিজে একটা ভাল পাত্রের সন্ধানে রইলো। শিক্ষিত, দ্র, আর সুন্দর হতে হবে, কারণ মাহমুদার সঙ্গে যেন মানায়।

বনহুর যখন মাহমুদার জন্য একটি পাত্রের সন্ধানে ব্যস্ত তখন একদিন মরিয়ম বেগমের বোনের ছেলে আমিনুর খান কান্দাই শহরের পুলিশ সুপার হয়ে এলো।

অফিসের চার্জ বুঝে নিয়েই আমিনুর খান এলো বড় খালার সঙ্গে দেখা করতে।

আমিনুর খান যুবক, অল্প কিছুদিন হলো সে পুলিশ সুপার হয়ে কান্দাই-এর লাহারায় এসেছে।

মরিয়ম বেগম অনেকদিন পর তার ছোট বোনের ছেলে আমিনুর খানকে দেখে আনন্দে আত্নহারা হলেন। সেই ছোটবেলায় তিনি দেখেছিলেন ওকে। বড় আদরের আমিনুর। আজ কত বড় হয়েছে, মস্তবড় অফিসার হয়েছে সে।

আমিনুর খানও অত্যন্ত আনন্দবোধ করতে লাগলো, কারণ মরিয়ম বেগম তার মায়ের বোন– মায়ের সমান। কদমবুসি করতেই মরিয়ম বেগম ওর মাথায় হাত রেখে দোয়া করলেন, তারপর ডাকাডাকি শুরু করে দিলেন-মনিরা, মা মনিরা, এসো দেখবে কে এসেছে!

মরিয়ম বেগমের আনন্দভরা কণ্ঠস্বর শুনে মনিরা এবং মাহমুদা একসঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। নূরও কোথায় ছিলো ছুটে এলো দাদীমার ডাকে।

মনিরা আর মাহমুদা এসে দাঁড়াতেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো তারা, কারণ মরিয়ম বেগমের সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটি সুপুরুষ যুবক। দামী সুট পরা, চোখেমুখে আভিজাত্যের ছাপ বিদ্যমান।

মনিরা আর মাহমুদা জড়োসডো হয়ে দাঁড়াতেই মরিয়ম বেগম বললেন-মনিরা, একে চিনকে পারছো না? আমার ছোট বোন মাসুমার ছেলে আমিনুর। আর তুমিও হয়তো একে চিনতে পারছে না বাবা! তোমার বড় খালার বোনের মেয়ে মনিরা। আর এ মনিরার বান্ধবী মাহমুদা।

মাহমুদা সালাম জানালো।

আমিনুর খান ওর সালাম গ্রহণ করতে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে গেলো মাহমুদার মুখে। ওর কাছে বড় ভাল লাগলো ওকে।

মাহমুদা দৃষ্টি নত করে নিলো।

মরিয়ম বেগম বললেন— এসো দাদু, তোমার সঙ্গে ওর পরিচয় করিয়ে দেই।

মরিয়ম বেগম নূরকে কাছে টেনে নিতেই নূর বললো– দাদীমা, উনি কে?

বললেন মরিয়ম বেগম তোমার চাচা। তারপর আমিনুরকে লক্ষ্য করে বললেন মনিরার ছেলে নূর। আমার দাদু।

আমিনুর নূরকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে লাগলো।

আমিনুর খান রীতিমত চৌধুরী বাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করলো।

প্রতিদিন একটিবার না এলেই যেন নয়।

মরিয়ম বেগম নিজ পুত্রের স্নেহে আমিনুরকে আদর-যত্ন করতে লাগলেন। মনিরাও ছোট দেওর হিসেবেই গ্রহণ করলো তাকে। কয়েক দিনেই মনিরা বুঝতে পারলো, আমিনুর আর মাহমুদার মধ্যে একটা গভীর ভাব জমে উঠেছে।

মনে মনে খুশি হলো মনিরা, এমন একটা ছেলে মাহমুদার জন্য পেলে তাদের আনন্দের সীমা থাকবে না। একদিন মরিয়ম বেগমকে বলেই বসলো মনিরা মামীমা, আমিনুর ভাইয়ের সঙ্গে মাহমুদাকে কিন্তু বেশ মানায়! তাছাড়া ওদের মধ্যে একটা ভাবও জমে গেছে গভীরভাবে।

মরিয়ম বেগম হেসে বললেন আমি ক’দিন থেকে কথাটা বলবো বলবো ভাবছি। আমিনুরের সঙ্গে মাহমুদাকে অপূর্ব মানায়। আমার মনে হয় বিয়েটা মন্দ হবে না।

তবে তুমি প্রস্তাবটা একদিন পেড়েই বসো না কেন! বললো মনিরা।

মরিয়ম বেগম বললেন– মনির এলে সব বলে দেখো।

আমাদের সবার যদি পছন্দ হয় তাহলে তার অপছন্দ হবে না। তাছাড়া ওদের যখন দু’জনের। দু’জনকে পছন্দ।

কয়েকদিন পর একরাতে এলো বনহুর।

মনিরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বললো- কই, মাহমুদার জন্য পাত্র পেলে?

বনহুর হতাশ কণ্ঠে বললো- মনিরা, হার মানলাম। সব পাওয়া যায় কিন্তু পাত্র পেলাম না। কোথাও।

আমি কিন্তু জিতেছি।

সত্যি।

হ্যাঁ।

কোথায়, কে সে ছেলে?

তোমারই ছোট খালার ছেলে আমিনুর খান।

কই, আমি তো তাকে চিনতে পারছি না?

বেশ, আজ থেকে যাও, কাল তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবো।

তোমাদের যখন পছন্দ হয়েছে তখন আমার সঙ্গে পরিচয় নাইবা হলো। যদি সব ঠিক হয়। তাহলে বিয়েতে নিশ্চয় আসবো।

মামীমার সঙ্গে দেখা করবে না?

না লক্ষীটি, আমার অনেক কাজ আছে।

মনিরা আরও বললো– মাহমুদার সঙ্গে আমিনুরের যা ভাব জমে গেছে, তা বলার ভাষা আমার নেই।

ওরা সুখী হোক, এই আমি চাই। বললো বনহুর।

মনিরা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো।

বনহুর মনিরার মুখোভাব লক্ষ্য করে বললো– কি হলো তোমার?

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আমিনুর তোমার ছোট খালার ছেলে বটে, কিন্তু তার আর একটা পরিচয় এখনও তোমার জানানো হয়নি।

বলো?

আমিনুর খান লাহারার পুলিশ সুপার,…..কথাটা বলে স্বামীর মুখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। মনিরা। কিন্তু আশ্চর্য, বনহুরের মুখে কোনোই পরিবর্তন দেখতে পেলো না সে।

বনহুর হেসে বললো- বেশতো, পুলিশ সুপার হবে মাহমুদার স্বামী, এটা তো আনন্দের কথা। কিন্তু একটা কথা, মাহমুদার সবকথা জানতে পেরে যদি পিছু হটে যায়?

সে ভয় নেই, কারণ আমি তাকে একদিন সব কথা খুলে বলেছি। সব শুনে সে দুঃখ করেছে। আমি লক্ষ্য করেছি, সেদিনের পর থেকে মাহমুদার প্রতি তার অনুরাগ যেন আরও বেড়ে গেছে দ্বিগুণ।

তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

বিয়ের সব কথাবার্তা নিয়ে আলোচনা চললো বনহুর আর মনিরার মধ্যে।

রাত ভোর হবার পূর্বেই চৌধুরী বাড়ি থেকে বিদায় নিলো বনহুর সকলের অলক্ষ্যে।

যাবার সময় একটি মূল্যবান হীরকহার সে মাহমুদার জন্য দিয়ে গেলো, বললো— মনিরা, এ হারছড়া রেখে দাও, হঠাৎ যদি কোনো কারণে মাহমুদার বিয়েতে আসতে না পারি, এটা ওর গলায় আমার আশীর্বাদস্বরূপ পরিয়ে দিও।

মনিরা হারছড়া হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

কখন যে ভোর হয়ে গেছে খেয়াল নেই, পিছনে এসে দাঁড়ায় মাহমুদা–আপা।

কে, মাহমুদা? তাড়াতাড়ি হাতের হারছড়া কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে ফেলে মনিরা।

কিন্তু দৃষ্টি পড়ে যায় মাহমুদার, বলে সে ওটা কি আপা?

না, কিছু না। পরে দেখাবো তোমাকে।

কেন আপা আমার কাছে তোমার এত সঙ্কোচ? তোমার হাতের হারছড়া আমি দেখে ফেলেছি কিন্তু।

দেখে ফেলেছো তাহলে?

হাঁ, ভারী সুন্দর, তোমার গলায় অপূর্ব মানাবে।

না, ওটা আমার জন্য নয়, তোমার জন্য।

সেকি। ওটা আমার জন্য কবে তৈরি করলে?

হঠাৎ মনিরা বলে ফেলে- সে দিয়ে গেছে তোমার বিয়েতে ওটা আশীর্বাদস্বরূপ … হাড়ছড়া বের করে মনিরা।

কে, ভাইয়া?

হাঁ।

কখন এসেছিলেন তিনি?

জানি না।

সেকি আপা, ভাইয়া কখন এসেছিলেন তুমি জানো না বলছো!

ও কথা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো না মাহমুদা।

মাহমুদার মনে একটা সন্দেহের দোলা নাড়া দিয়ে গেলো– মনিরা তার কাছে কোনো কথা গোপন করার চেষ্টা করছে সে বুঝতে পারলো। নীরব রইলো মাহমুদা, সে হারছড়া নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো।

একটা শুভদিন দেখে বিয়ের আয়োজন হলো।

চৌধুরী বাড়িতে মহা ধুম পড়ে গেলো।

মরিয়ম বেগম আনন্দে আত্মহারা, তাঁর বোনের ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে মাহমুদার। মাহমুদাকে এ ক’দিনে তিনি তিনি অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছিলেন। মেয়েটির ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিলো, এমন ধরনের মেয়ে বড় একটা দেখা যায় না।

বিয়ের দিন সকাল থেকে সেকি জোরদোর আয়োজন। লোকজনে ভরে উঠলো চৌধুরী বাড়ি। আলোয় আলোময়! চারিদিক। বাগানবাড়ির মধ্যে গাছে গাছে আলোর বাল্ব জ্বলছে— যেন তারার মেলা।

মনিরার অনেক বান্ধবী এসেছে, ইশরা জাহানও বাদ যায়নি। যদিও আহসানের সঙ্গে মাহমুদার বিয়ে হলো না তবু সে রাগ বা অভিমান করেনি।

মেয়েরা সবাই মিলে সাজাচ্ছে মাহমুদাকে।

বড় হলঘরটায় পাত্র এবং তার বন্ধু-বান্ধব বসেছে।

বিয়ে সমাধা হলো একসময়।

মাহমুদার মন আজ বড় ভাল নেই, কারণ তার ভাইয়া মনির আসেনি এখন পর্যন্ত। মনিরাকে সে কয়েকবার প্রশ্ন করেছে আপা, ভাইয়া তো এখন পর্যন্ত এলেন না?

হয়তো সে কোনো কাজে আটকা পড়ে গেছে। জবাব দিয়েছে মনিরা। কিন্তু তার মনটাও সদা-সর্বদা আনমনা রয়েছে– কই, সে তো এলো না!

নববধু বিদায়কালে মরিয়ম বেগমের দূর সম্পর্কীয় বৃদ্ধ চাচা হামিদুল চৌধুরী এগিয়ে এলেন বর-বধূকে আর্শীবাদ করতে।

আমিনুর খানের হাতে মাহমুদার হাত সঁপে দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হলো তার চোখ দুটো, বললেন তিনি– বোন, সুখী হয় …..

হঠাৎ যেন চমকে উঠলো মাহমুদা, এ কণ্ঠস্বর সে যেন কোথাও শুনেছিলো, কিন্তু কোথায় কবে কখন শুনেছে সে স্মরণ করতে পারে না।

বর-বধু বিদায় হবার পর এক-এক করে আত্নীয়-স্বজন সবাই বিদায় গ্রহণ করেন।

একসময় চৌধুরী বাড়ি নীরব হয়ে আসে।

আজ মনিরাকে বড় ক্লান্ত-অবসন্ন মনে হচ্ছিলো, যদিও সে খেয়ালের বশে সারাটা দিন হই হুল্লোড় করেছে কিন্তু এখন সে একেবারে ঝিমিয়ে পড়ে। সব সময় মনে পড়ছে স্বামীর কথা– কেন আজ এলো না সে?

মরিয়ম বেগম এখনও মহা ব্যস্ত রয়েছেন, বাড়ির চাকর-বাকর এখনও খায়নি— কে কি করছে, কোথায় কি করা বাকি রয়েছে, এসব দেখাশোনা করছেন।

মনিরা নিজের কক্ষে এসে বসলো।

রাত বেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে নূর দাদীমার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে।

সরকার সাহেব বাইরের কাজ শেষ করে নিচ্ছিলো।

অন্য চাকর-বাকরের সঙ্গে ফুলমিয়াও ব্যস্ত রয়েছে।

নির্জন কক্ষে মনিরা নীরবে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। ভাবছে সে, আজ যার বাড়িতে এত ধুমধাম চলেছে, সেই আজ কোথায় কে জানে, কারণ তার উপায় নেই এই উৎসবে স্বাভাবিকভাবে যোগ দিবার।

মনিরা চমকে উঠে কেউ তার চোখ দুটো পিছন থেকে ধরে ফেলেছে। নিশ্চয়ই তার কোনো বান্ধবী কিন্তু তারা তো সবাই চলে গেছে। মাহমুদাও আজ নেই, তবে কে এত রাতে তার চোখ দুটোকে এমন করে বন্দী করলো? মনিরা হাতের উপর হাত রাখলো। হাতে বেশ কয়েকটা পাথরের আংটি উপলব্ধি করে বুঝতে পারলো এটা কোনো পুরুষের হাত। মনিরা হাত দু’খানাকে সরিয়ে দিলো এক ঝটকায়। ফিরে তাকাতেই সে বিস্ময়ে থ’ হলো, দেখলে মরিয়ম বেগমের বৃদ্ধ চাচা দাঁড়িয়ে আছেন তার পিছনে, মৃদু মৃদু হাসছেন তিনি।

মনিরা ক্রুদ্ধ হলো, বুড়োর কি ভীমরতি ধরেছে। কোনো কথা না বলে মনিরা চুপ রইলো।

বৃদ্ধ বসলো মনিরার পাশে বাপু, আমায় তুমি ঘৃণা করছো?

মনিরা রাগত গম্ভীর কণ্ঠে বললো– দাদু, আপনি এসব কি শুরু করলেন বলুন তো?

কেন, বুড়ো বলে আমাকে তোর পছন্দ হচ্ছে না বুঝি?

খুব পছন্দ হয়েছে, এবার ঠাট্টা রেখে যাওতো।

যদি না যাই ……..

তোমার ভাইঝিকে ডাকবো। ও মামীমা, মামীমা……।

বৃদ্ধ মনিরার মুখে হাতচাপা দিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে উঠে– সর্বনাশ করেছে, ঐ মা। এলেন বলে …

তুমি।

হ মনিরা

মনিরা বনহুরের বুকে মাথা রাখে।

বনহুর মনিরাকে গভীর আবেগে বুকে চেপে ধরে বলে বোনের বিয়েতে না এসে পারলাম না মনিরা। সত্যি, মাকে ধোকা দেওয়ার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু কোনো উপায় ছিলো না।

নাও, এবার বুড়োর ড্রেস খুলে ফেলোতো?

কেন, ভাল লাগছে না বুঝি?

উ হুঁ। মনিরা নিজ হাতে বনহুরের ড্রেস খুলে ফেললো।

নীচ থেকে বেরিয়ে পড়লো বনহুরের নিজস্ব ড্রেস।

আহসান যখন জানতে পারলো মাহমুদার বিয়ে সাহারার পুলিশ সুপারের সঙ্গে হয়েছে তখন বুদ্ধি আঁটতে লাগলো কেমন করে মনিরাকে সে জব্দ করবে, কেমন করে সে ক্ষতি সাধন করবে চৌধুরী বাড়ির। আহসান যখন এইসব নিয়ে ভীষণভাবে মাথা ঘামাচ্ছে তখন সে কেমন করে যেন জানতে পারলো মনিরার স্বামীই দস্যু বনহুর! চোখ দুটো তার আনন্দে জ্বলে উঠলো— প্রতিশোধ নেবার সুযোগ তার এসেছে।

আহসান কান্দাই পুলিশ সুপার মিঃ আরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানতে পারলো তার সন্দেহ সত্য। দস্যু বনহুর চৌধুরী বাড়িরই ছেলে এবং মিসেস মনিরা তার স্ত্রী। আরো জানতে পারলো আহসান,দস্যু বনহুরকে যে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে সে এক লাখ টাকা পুরস্কার পাবে।

আহসানের সে কি খুশি! যেমন করে থোক দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে লাখ টাকা গ্রহণ করবেই। এমন একটা সুযোগ সে মোটেই হারাতে রাজি নয়। একদিন সোজা সে হাজির হলো লাহারার পুলিশ অফিসে।

মিঃ আমিনুর খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো।

মিঃ আমিনুর খান তরুণ পুলিশ সুপার, কর্ম দক্ষতায় সে নিজকে আরও উন্নত করতে চায়। সর্বক্ষণ সে ব্যস্ত থাকে কাজ নিয়ে। আহসান নিজের পরিচয় দিয়ে জানালো স্যার, আপনার সঙ্গে অত্যন্ত গোপনীয় একটা কথা আছে।

আমিনুর খান হেসে বললো— বলুন?

আহসান আসন গ্রহণ করেছিলো পূর্বেই, এবার সে বলতে শুরু করলো স্যার, আপনি কান্দাই নতুন এলেও নিশ্চয়ই জানেন, কান্দাই-এর অবস্থা এখন অত্যন্ত উৎকণ্ঠায়।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন খুলে বলুন?

আমি যা বলছি অতি সত্য কথা। দস্যু বনহুর যে ভাবে তার হত্যালীলা চালিয়ে চলেছে তা আপনি জানেন?

জানি এবং আমি ও দস্যু বনহুর গ্রেপ্তারে পুলিশ মহলকে যথাসাধ্য সাহায্য করার আশাতেই কান্দাই এসেছি।

খুশি হলাম আপনার কথা শুনে মিঃ খান। দেখুন, আমি কোনো ভূমিকা না করেই বলতে চাই, অবশ্য আপনি যদি আমাকে ভরসা দেন।

নিশ্চয়ই, বলুন?

চৌধুরী বাড়ির মেয়েকে আপনি বিয়ে করেছেন?

হাঁ। কিন্তু আপনি বললেন কোনো ভূমিকা না করেই বলবেন?

তাই বলছি। কিন্তু বাধ্য হয়ে কয়েকটা কথা আমাকে পূর্বে বলে নিতে হচ্ছে। মিসেস মনিরা আপনার কিছু হন নিশ্চয়ই?

হাঁ, আমার ভাবী হন।

ভাবী। কিন্তু আপনার ভাই মানে মিসেস মনিরার স্বামী কে এবং কি তার পরিচয়, জানেন না বুঝি?

এত কিছু দরকার পড়েনি।

একটা কথা, আপনি আমার সঠিক জবাব দেবেন তো?

নিশ্চয়ই দেবো। কিন্তু আপনি বললেন কোনো ভূমিকা না করেই আপনার কথা ব্যক্ত করবেন অথচ……।

যতটুকু বলেছি এর একটুকুও আমি ভূমিকা করিনি মিঃ খান। আমি এসেছি আপনার কাজে সহায়তা করতে। কর্তব্যের কাছে আপন-পর কিছু না, তাই নয় কি?

হাঁ, কর্তব্যই আমার কাছে সবচেয়ে বড়।

সত্যি বলছেন তো? খুশিতে চোখ দুটো জ্বলে উঠলো আহসানের। সে বললো আবার–শুধু কর্তব্য নয়, এর পিছনে আছে এক লাখ টাকা। তাছাড়াও আছে প্রচুর কৃতিত্ব।

আপনি কি বলতে চাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারছি না? ভ্রু কুঁচকে বললো আমিনুর খান।

আহসান বাঁকা চোখে তাকালো এদিক-সেদিক, তারপর বললো আপনার পরম আত্নীয় মিসেস মনিরার স্বামী আপনার খালাতো ভাই স্বয়ং দস্যু বনহুর!

দস্যু বনহুর!

হা।

কে বললো আপনাকে এ কথা?

আপনি একটু ভাল করে খোঁজ নিলেই সব জানতে পারবেন। অবশ্য আপনার পরম আত্নীয়ই যে মহান দস্যু বনহুর, একথা আপনার পূর্ব হতেই জানা উচিত ছিলো।

বিদেশে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, তারপর চাকরি পেয়ে দেশে আসি-এসব সংবাদ জানার সময় আমার হয়নি। আপনি যা বললেন যদি সত্য হয় তাহলে আপনাকে আমি পুরস্কৃত করবো আর যদি মিথ্যা হয় তাহলে মনে রাখবেন, এর জন্য শাস্তি পেতে হবে আপনাকে।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই……আপনি এক্ষুণি কান্দাই পুলিশ অফিসে যোগাযোগ করে জেনে নিতে পারেন। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবেন, আপনার স্ত্রীকে যেন এ কথা জানাবেন না।

আমিনুর খান গম্ভীর হয়ে পড়লো।

সেদিন আহসান আর বেশি কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লো।

আমিনুর খান ফিরে এলো বাসায়।

প্রতিদিন হাসি-খুশি মুখ নিয়ে ফেরে আমিনুর খান। আজ সম্পূর্ণ বিপরীত, গম্ভীর মুখে বাসায় ফিরলো সে।

মাহমুদা হাসিভরা মুখে উচ্ছলভাবে ছুটে আসে কিন্তু একি, স্বামীকে আজ বড় গম্ভীর মনে হয়! মাহমুদা কেমন যেন দমে যায়, বলে হঠাৎ কি হয়েছে তোমার?

না, কিছু না! নিজকে স্বচ্ছ করার চেষ্টা করে আমিনুর খান। কারণ মাহমুদার দোষ নেই কিছু, সে জানে না মনিরার স্বামী কি……..হঠাৎ একটা বুদ্ধি আসে আমিনুরের মাথায়, মাহমুদার দ্বারাই তাকে জয়ী হতে হবে। যা কেউ পারেনি তাই সমাধা করতে হবে– দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করে এক লাখ টাকার মালিক হতে হবে আর নিতে হবে চরম কৃতিত্ব। ধীরে ধীরে নিজকে স্বচ্ছ করে নিলো আমিনুর খান মাহমুদার কাছে।

মাহমুদা স্বামীকে আজ গম্ভীর দেখে মনে মনে বেশ বিব্রত হয়ে পড়েছিলো, সে নতমুখে বসে ছিলো একপাশে।

আমিনুর খান জামা-কাপড় ছেড়ে স্ত্রীর পাশে এসে বসলো, চিবুকটা উঁচু করে ধরে বললো রাগ করেছো মাহমুদা?

এতক্ষণে স্বামীর আদরভরা কণ্ঠে মাহমুদার মন হালকা হলো, সে বললো না, তোমার উপর রাগ করতে পারি না। হঠাৎ আজ তোমাকে বড় গম্ভীর লাগছিলো, তাই …….

ও কিছু না মাহমুদা, কারণ অফিসের ব্যাপারে আমাদের মনের অবস্থা সব সময় ঠিক থাকে না। চলো, খাবার দেবে চলো।

মাহমুদা উঠে পড়ে।

খাবার টেবিলে বসে বলে আমিনুর খান মাহমুদা, বিয়ের পর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো কিন্তু আজও মনির ভাইয়ার সঙ্গে আমার দেখা হলো না।

মাহমুদারও কি কম দুঃখ। সে বললো– জানি না ভাইয়া হঠাৎ কোথায় উধাও হয়েছেন। বিয়ের সময় তিনি থাকতে পারেননি বলে মনিরা আপার কাছে আমার জন্য এ হারছড়া রেখে গিয়েছিলেন আমাদের আশীর্বাদস্বরূপ। মাহমুদা গলার হারছড়া উঁচু করে ধরলো।

আমিনুর খান জানত ও হার মরিয়ম বেগম দিয়েছেন, যখন সে জানতে পারলো হারছড়া দিয়েছে মনিরার স্বামী তখন সে তীক্ষ্ণ নজরে ভাল করে দেখতে লাগলো।

মাহমুদা বললো— আজ নতুন করে হারছড়া দেখছো কেন? বিয়ের পর থেকে ওটা তো আমার গলাতেই রয়েছে।

আমিনুর খান বললো- এতদিন তেমন করে দেখার সুযোগ হয়নি, আজ তাই নতুন করে দেখছি। হাঁ, হারছড়া অত্যন্ত মূল্যবান বটে। এত মূল্যবান হার যিনি দিলেন তিনি আজও এলেন না আমাদের গরিবালয়ে, সত্যি বড় আফসোস!

তুমি দুঃখ করো না, আমি সব বলবো মনিরা আপাকে। নিশ্চয়ই এতদিন চৌধুরী বাড়ি এসে থাকবেন তিনি।

আচ্ছা মাহমুদা?

বলো?

মনিরার স্বামীর সঙ্গে তোমার কতদিন পরিচয়?

সব তো তোমাকে বলেছি। উনি যদি আমাকে আশ্রয় না দিতেন তাহলে কবে কোথায় হারিয়ে যেতাম, কেউ আমার সন্ধান পেতো না। পরিচয় জাহাজেই প্রথম হয়েছে তার সঙ্গে।

হাঁ, তুমি সব বলেছো। যাক, এবার চৌধুরী বাড়ি গেলে ও বাড়ির সবাইকে দাওয়াত করে আসবে। আমিও যাবো, কারণ মনির ভাইয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকেও আনতে হবে আমাদের বাসায়। বড় সখ আমরা একসঙ্গে মিলিত হই একবার।

বেশ, তোমার যখন এত সখ, তাই হবে।

সমস্ত রাত আমিনুর খানের চোখে ঘুম এলো না, নিজ বিবেকের সঙ্গে যুদ্ধ করে চললো সে। একবার ভাবে, যত বড় অপরাধীই হোক, মনির তার পরম আত্নীয়, তার সম্বন্ধে কিছু না ভাবাই সমীচীন। কিন্তু কি করে তা সম্ভব হয় কর্তব্যের কাছে নিজের পিতা-পুত্রকেও ক্ষমা করা যায় নয়া। তা ছাড়া তার সম্মুখে এটা একটা বিরাট পরীক্ষা, শুধু লাখ টাকাই আসবে না, তার সঙ্গে আসবে এক মহা কৃতিত্ব। দেশময় তার নামের সাড়া পড়ে যাবে, জয় জয়কারে মুখর হয়ে উঠবে চারদিক। যেমন করে হোক তাকে কৃতিত্ব লাভ করতেই হবে। এমন সুযোগ হাতে পেয়ে সে হারাতে পারবে না কিছুতেই।

নানারকম চিন্তা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে আমিনুর খান।

পরদিন অফিসে যাবার সময় আমিনুর খান মাহমুদাকে লক্ষ্য করে বললো তুমি তৈরি থেকো, বিকেলে এসেই চৌধুরী বাড়ি বেড়াতে যাবো।

স্বামীর কথামত মাহমুদা বিকেলে তৈরি হচ্ছিলো, এমন সময় বয় এসে জানালো এক ভদ্রলোক এসেছেন, আপনার আত্নীয় হন।

মাহমুদা বললো— তাকে হলঘরে বসতে দাও, আমি আসছি।

বয় চলে গেলো।

মাহমুদা একটু পরে হলঘরে এসে আনন্দে অশ্রুট ধ্বনি করে উঠলো- ভাইয়া আপনি!

স্বয়ং দস্যু বনহুর এসেছে মাহমুদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। হেসে বললো বনহুর– হাঁ, এলাম তোমাকে দেখতে। কেমন আছো মাহমুদা?

ভাল আছি। কিন্তু একটা কথা, আজও আপনার সঙ্গে ওর দেখা হলো না, এজন্য তিনি দুঃখিত। আজ চৌধুরী বাড়ি যাবার কথা আছে, তা আপনি এসেছেন ভালই হলো।

আমি তো বেশিক্ষণ বিলম্ব করতে পারবো না মাহমুদা। তোমরা দু’জন চৌধুরী বাড়ি যেও। যদি পারি এখন অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করে যাবো।

বনহুর মাহমুদার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়িতে এসে বসতেই একটা তীরফলক এসে বিদ্ধ হলো বনহুরের আসনের পাশে।

বনহুর বিস্মিত হলো, যেদিক থেকে তীরফলকটা এসেছিলো সেদিকে তাকালো কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। তীরফলকটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো তাতে গাঁথা রয়েছে এক টুকরা ভজ করা কাগজ। বনহুর কাগজখানা খুলে নিয়ে পড়লো। মাত্র দু’লাইন লেখা

মিঃ খানের কাছে তোমার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সাবধান!
–“আশা”

বনহুর অস্ফুট শব্দ করে বললো— আশা, কে তুমি? একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের ফাঁকে। গাড়িতে স্টার্ট দিলো বনহুর।

বনহুরের গাড়ি সোজা এসে থামতো লাহারার পুলিশ অফিসে।

একজন পুলিশ এগিয়ে এলো।

বনহুর গাড়ি থেকে নেমে একটা কার্ড দিলো তার হাতে।

কার্ড নিয়ে চলে গেলো পুলিশটি।

একটু পরে ফিরে এলো সে চলুন স্যার।

বনহুর অফিসরুমে প্রবেশ করতেই আমিনুর খান উঠে তাকে অভ্যর্থনা জানালো–হ্যালো মিঃ আলী?

বেশ কিছুদিন হলো এসেছেন অথচ সময় করে উঠতে পারিনি দেখা করার, তাই এলাম পরিচয় করতে।

বেশ করেছেন, এজন্য আমি গৌরব বোধ করছি। আমারই উচিত ছিলো আপনার সঙ্গে দেখা করা। বললো আমিনুর খান। আরও বললো সে—- লাহারায় এসে অবধি আপনার সুনাম শুনে আসছি, আজ পরিচিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি মিঃ আলী।

মিঃ আলী লাহারার একজন গণ্যমান্য ধনবান ব্যক্তি। বনহুর গত রাতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়ে একখানা কার্ড তুলে পকেটে রেখেছিলো, সেই কাৰ্ডখানাই বনহুর ব্যবহার করলো এই মূহুর্তে। বনহুর কথায় কথায় জেনে নিয়েছিলো মিঃ আলীর সঙ্গে এখনও লাহারার পুলিশ সুপার মিঃ আমিনুর খানের সাক্ষাত লাভ ঘটেনি।

বনহুর বেশ কিছুক্ষণ ধরে একথা সে কথা নিয়ে আলাপ করলো আমিনুর খানের সঙ্গে। তারপর একসময় বললো- আপনার কিন্তু দাওয়াত রইলো আমার ওখানে, অবশ্যই যাবেন কিন্তু সন্ধ্যার পর। আপনার প্রতীক্ষায় থাকবো।

লাহারার স্বনামধন্য মিঃ আলী জায়েদীর মত লোক নিজে এসে দাওয়াত করে গেলেন–কম কথা নয়। গর্বে স্ফীত হয়ে উঠে আমিনুর খানের বুক। অফিসের কাজ শেষ করে তাড়াহুড়ো করে বাসায় ফিরলো সে।

মাহমুদা স্বামীর প্রতীক্ষায় ছিলো, বললো— এসেছো?

হাঁ, তোমার হয়েছে?

হয়েছে কিন্তু জানো একটু আগে ভাইয়া এসেছিলো…

ভাইয়া! যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠলো আমিনুর খান।

হাঁ, মনিরা আপার স্বামী। বললো মাহমুদা।

দ্রুত সরে এলো আমিনুর খান স্ত্রীর পাশে, দু’হাতে স্ত্রীকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো কোথায়, কোথায় তিনি মাহমুদা?

একটু আগে চলে গেলেন, অবশ্য তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্যই এসেছিলেন। তাছাড়া ভাইয়া বললেন, তোমার অফিসে গিয়ে দেখা করে তবেই যাবেন তিনি।

কই, আমার অফিসে তো তিনি যাননি। আমার দুর্ভাগ্য যে, তার আগমন হয়েছিলো অথচ দেখা হলো না।

হেসে বলে মাহমুদা– এত হতাশ হচ্ছো কেন, নিশ্চয় দেখা হবে তার সঙ্গে। চলোনা, চৌধুরী বাড়ি যাবে যে বলেছিলে আজ বিকালে?

আমিনুর খান বললো– আজ সেখানে যাওয়া হলো না, কারণ আমার অন্য এক যায়গায় দাওয়াত আছে।

কোথায় তোমর দাওয়াত?

লাহারার স্বনামধন্য ব্যক্তি মিঃ আলী জায়েদী নিজে আমার অফিসে গিয়ে দাওয়াত করে গেছেন। মিঃ আলীকে আজ আমি স্বচক্ষে দেখলাম, সত্যি অদ্ভুত মানুষ তিনি। যেমন অপূর্ব সুন্দর সুপুরুষ তেমনি মহৎ তার ব্যবহার।

কিন্তু আমার যে বড় সখ ছিলো আজ চৌধুরী বাড়ি যাবো।

আজ হলো না, কাল নিশ্চয়ই হবে।

কাল যদি কোথাও আবার দাওয়াত পেয়ে বসো?

রোজ কি এমন সৌভাগ্য হবে……বলে হাসে আমিনুর খান।

মাহমুদা আমিনুর খানকে সাজিয়ে দিলো নিজের হাতে।

আমিনুর খান সন্ধ্যার পর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো মিঃ আলী জায়েদীর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

আমিনুর খান আসেনি কোনোদিন এদিকে, তবে ড্রাইভারের কাছে এ বাড়ি অপরিচিত নয়। বাড়ির ফটকে গাড়ি পৌঁছতেই রাইফেলধারী পাহারাদার ফটক খুলে দিলো।

গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করে এগিয়ে চললো গাড়ি-বারান্দার দিকে। সেকি বিরাট বাড়ি, বিস্ময় জাগলো আমিনুর খানের মনে। বাড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝা যায় মিঃ আলী জায়েদী ধনবান বটে!

গাড়ি থামতেই আমিনুর খান নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। তাকালো সে চারিদিকে–কই, কেউতো তাকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করছে না। দারওয়ানরা যে যেখানে দাঁড়িয়েছিলো তারা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। আমিনুর খান একটা জিনিস লক্ষ্য করলো, সমস্ত বাড়িখানায় একটা শান্তিময় পরিবেশ যেন বিরাজ করছে।

আমিনুর খান হলঘরের টানা সিঁড়ির ধাপ অতিক্রম করে প্রশস্ত বারান্দায় উঠে এলো। পাশাপাশি কয়েকখানা বিরাট বিরাট দরজা। দরজায় ভেলভেটের দামী পুরু পর্দা।

দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভাবে, এমন নিস্তব্ধ বাড়ি তো সে দেখেনি কোনোদিন। কই, মিঃ আলী তো একেবারে গুম হয়ে গেছেন–ব্যাপার কি! ভেলভেটের ভারী পর্দা সরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে আমিনুর খান। সঙ্গে সঙ্গে তার কানে ভেসে আসে গম্ভীর কণ্ঠস্বর- কাকে চান?

আমিনুর খান চোখ তুলে তাকায় সম্মুখে, অবাক হয়ে সে দেখতে পায়–অদূরে একটা আসনে উপবিষ্ট এক অর্ধবয়স্ক ভদ্রলোক, চেহারাটা একনজরে দৃষ্টিতে আটকে যাবার মত। বিরাট বপুর উপরে গোল ফুটবলের মত একটি মাথা। মাথাটা ইলেকট্রিক আলোতে চকচক করছে যেন, কারণ টাকের জন্য একটিও চুল সেখানে অবশিষ্ট নেই। ফুটবলের মাঝখানে জ্বলজ্বল করছে দুটো চোখ। পরনে গেঞ্জি-পাজামা, আর কোনো বস্ত্রের বালাই নেই তাঁর দেহে। গেঞ্জির কিছুটা অংশ বুকের কাছে গুটিয়ে আছে, ভুড়িটা ঝুলে পড়েছে তেলের পিপের মত। লোকটার গায়ের রংয়ের সঙ্গে আলকাতরার জমকালো রংয়ে তুলনা করা যায়।

আমিনুর খান ভূত দেখার মত আরষ্ট হয়ে গেছে, কোনো জবাব দেবার পূর্বে পুনরায় সেই কণ্ঠ- কে আপনি?

এবার আমিনুর খান গলাটা পরিস্কার করে নিয়ে বলে আমি, আমি লাহারার পুলিশ সুপার আমিনুর খান……

পুলিশ সুপারই হন আর পুলিশ কমিশনারই হন, তা আমার এখানে কেন?

আমিনুর খান লোকটার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। লোকটা বলে কি! –তার কাছে পুলিশ সুপার তো দূরের কথা, পুলিশ কমিশনার পর্যন্ত কিছু নয়। অবজ্ঞাভরা কণ্ঠস্বর যেন তাকে তিরস্কার করছে। বললো আমিনুর খান– আমি মিঃ আলী জায়েদীকে চাই। তিনি আমাকে দাওয়াত করে এসেছেন সন্ধ্যার পর যেন আসি……

আমিনুর খানের কথা শেষ হয় না, লোকটা যেন হুঙ্কার ছাড়েন— কি বললেন আপনি?

ঢোক গিলে আমিনুর খান- মিঃ আলী জায়েদী আমাকে দাওয়াত করে এসেছেন।

আপনি কি পাগল না মাতাল?

কই, আমি তো পাগলও নই, মাতালও নই।

তবে কেন এমন আবোল তাবোল বলছেন? আমিই আলী জায়েদী, কবে কখন আপনাকে দাওয়াত করেছি?

হ্যাঁ আপনি…..মানে আপনিই আলী জায়েদী?

হা। বেরিয়ে যান, বেরিয়ে যান বলছি। যত সব জোচ্চোর সাধে আমি পুলিশের লোককে দেখতে পারি না। যেচে এসেছেন দাওয়াত খেতে। ওটি হবে না আমার দ্বারা। যে ভাতটুকু আপনাকে খাওয়াবো সেটুকু একজন গরিবকে খাওয়াবো, তবু সে বাঁচবে। যান, চলে যান বলছি। হাঁ, যদি অপরাধ পান মানে আমি যদি কোনো মন্দ কাজ করি তখন আসবেন, মাথা পেতে গ্রহণ করবো আপনাদের দেওয়া শাস্তি কিন্তু সাবধান, বিনা দোষে কাউকে যেন শাস্তি দিতে আসবেন নয়া। যান, দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন, বেরিয়ে যান।

আমিনুর খান যেন মাটিতে মিশে যাচ্ছিলো, কান দুটো যেন আগুনের মত গরম হয়ে উঠেছে তার। ছিঃ ছিঃ, কি লজ্জার কথা। পা দু’খানা যেন টলছে, রাগে-ক্ষোভে অধর দংশন করতে থাকে, কিন্তু সাহস হলো না সেখানে দাঁড়িয়ে কোনোরকম উচ্চারণ করার। লাহারার পুলিশ সুপার সে–কম কথা নয়, অথচ এ মুহর্তে একেবারে যেন বোবা বনে যায়।

কি করে পালাবে সে ভেবে অস্থির হয়, কোনোরকমে পিছু হটে বেরিয়ে আসে কক্ষমধ্যে হতে। গাড়ির পাশে এসে বলে–চলো ড্রাইভার।

ডাইভার কোনো কিছু ভেবে পায় না; সে লক্ষ্য করে, মালিককে যেন বেশ উদভ্রান্ত বলে মনে হচ্ছে। বলে ড্রাইভার স্যার, বাসায় যাবো?

নয়া। রূপম রোডে চলো।

গাড়ি ছুটলো রূপম রোডের দিকে।

ড্রাইভার ভেবে পায় না হঠাৎ সাহেব রূপম রোড়ে যাবেন কেন? সে তো শহরের আর এক প্রান্তে।

গাড়ি চলেছে।

আমিনুর খান সিগারেটের পর সিগারেট নিঃশেষ করে চলেছে। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তার জাল জট পাকাচ্ছে। কে সেই অদ্ভুত যুবক যে তাকে আজ বিকেলে মিঃ আলী জায়েদীর বেশে দাওয়াত করে এসেছিলো? যে নেম-কার্ড খানা তাকে দিয়ে এসেছিলো সে তো আলী জায়েদীরই নেম কার্ড। ছিঃ ছিঃ কি ভয়ানক অপমান, কি লজ্জার কথা! মিঃ আলী জায়েদীই বা কেমন লোক তিনি তাকে এভাবে অপমান করলেন? এর প্রতিশোধ নিতে হবে। লাহারার পুলিশ সুপার সে, ইচ্ছা করলে সে তাকে বিপদে ফেলতে পারে। দেখে নেবে সে আলী জায়েদীকে– হোন তিনি ধনবান-ঐশ্বর্যবান, এ অপমানের প্রায়শ্চিত্ত তাকে করতেই হবে। কিন্তু সবচেয়ে বড় লজ্জার কথা, মাহমুদার কাছে বড় মুখ করে বলে এসেছে, সে দাওয়াত খেতে যাচ্ছে, বাসায় আজ খাবে না। নিশ্চয়ই মাহমুদা খেয়ে নিয়েছে, চাকর-বাবুর্চিও সব খেয়ে নিয়েছে। এখন বাসায় ফিরে খাবার চেয়ে খাওয়াও কম লজ্জার কথা নয়। মাহমুদা হাসবে, তার চেয়ে না খেয়ে থাকাই শ্রেয়।

রূপম রোডে পৌঁছে ড্রাইভার বললো– কোথায় যাবো স্যার?

আমিনুর খান বললো– বাসায় ফিরে চলো।

ড্রাইভার অবাক হলো, হঠাৎ রূপম রোডেই বা এলেন কেন আবার ফিরেই বা যাবেন কেন, ভেবে পায় না সে। মালিকের হুকুম মতই তাকে কাজ করতে হবে।

রূপম বহুদূর, কাজেই রাত অনেক হয়ে গেলো বাসায় ফিরতে।

মাহমুদা ঘুমায়নি, সে শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিলো। স্বামী আসতেই বই রেখে এগিয়ে যায়, হেসে বলে- এত দেরী হলো? খুব খেয়েছো বুঝি?

আমিনুর খান মুখোভাব যতই প্রসন্ন রাখার চেষ্টা করুক না কেন, তাকে কেমন যেন বিষণ্ণ, গম্ভীর মনে হয়। মাহমুদার কথায় মুখে হাসি টেনে বলে– খেয়েছি, অনেক খেয়েছি……

আমিনুর খান মুখে বলছে খৈয়েছি, অনেক খেয়েছি কিন্তু পেটে তার আগুন জ্বলছে, কারণ সেই বেলা.এগারোটায় নাকেমুখে চারটি গুঁজে অফিসে গিয়েছিলো। জরুরী একটা কেস ছিলো তাই আরামে খাওয়াটাও আজ হয়নি। বিকেলে মাহমুদার দেওয়া নাস্তাও সে খায়নি দাওয়াত আছে বলে। হায়, কি বেকুবই না সে বনে গেছে আজ।

মাহমুদা বলে আবার কি কি খেলে বল না একটু?

সে অনেক খেয়েছি, কত বলবো। এক গেলাস পানি দাও তো?

কেন, পানি খাওনি সেখানে?

খেয়েছি, কিন্তু বড় গরম পানি।

গরম পানি!

হাঁ, যেন আগুন……

সে আবার কি রকম?

ও তুমি বুঝবে না। কথাটা বলে মাহমুদার হাত থেকে পানির গেলাসটা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে চোখেমুখে চাদর টেনে শুয়ে পড়ে।

কিন্তু গোটা রাত তার চোখে ঘুম আসে না। ক্ষুধায় পেটের নাড়িভুড়ি হজম হবার যোগাড় হয়েছে তার। লজ্জায় বলতেও পারে না সে ঘরে খাবার আছে কিনা।

কোনো রকমে রাত ভোর হয়।

সকাল সকাল শয্যা ত্যাগ করে বলে আমিনুর খান মাহমুদা, শীগগীর নাস্তা দাও, অফিসে একটা জরুরী কাজ আছে।

মাহমুদা স্বামীর জন্য অল্প কিছু হাল্কা ধরনের নাস্তা এনে টেবিলে রাখলো।

আমিনুর খান নাস্তার পরিমাণ দেখে মনে মনে চটে গেলো খুব করে, বললো ওসব ছাড়া আর কিছু ছিলো না?

এই সামান্য একটু নাস্তা তাও খাবে না তুমি? কাল রাতে এত কি খেয়ে এসেছো বলতো? আচ্ছা আরও একটু কমিয়ে নিচ্ছি। মাহমুদা নাস্তার পরিমাণ আরও কমিয়ে দেয়।

আমিনুর খান অগত্যা বলেই বসে সরিয়ে নিতে হবে না, রাখো।

মাহমুদা নাস্তা যা উঠিয়ে নিয়েছিলো আবার প্লেটে সাজিয়ে রাখে।

আমিনুর খান গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো।

মাহমুদা অবাক হয়ে যায়।

স্বামীর খাওয়া শেষ হলে বলে মাহমুদা-ওগো, আজ চৌধুরী বাড়ি যাবে না?

যাবো, তুমি তৈরি থেকো, কেমন?

নিশ্চয়ই থাকবো। আজ আবার কোথাও দাওয়াত নিয়ে বসোনা যেন।

না, আজ আর দাওয়াত পেলেও যাচ্ছি না। জামা পরতে পরতে বললো আমিনুর খান।

রহমান, আজও সেই আশা সাবধানবাণী জানিয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়েছে। সত্যিই আশ্চর্য, এই নারী যে আমার চোখে ধুলো দিয়ে আমার পিছনে ছায়ার মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি সে আমার দরবারকক্ষে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিলো। কথাগুলো বলে থামলো বনহুর।

রহমান বললো- সর্দার, বহু সন্ধান করেও এর কোনো সমাধান আমরা খুঁজে পাইনি। নতুন কোনো লোককে আমরা উপস্থিত আমাদের দলে গ্রহণ করিনি।

কিন্তু একথা সত্য, কেই আমাদের দরবারকক্ষে প্রবেশ করে আমার সেদিনের নির্দেশগুলো শুনে নিয়েছিলো।

সেদিনের আশার উক্তিতে ঐ রকমই ঝা যায়।

রহমানের কথা শেষ হয় না, কক্ষে প্রবেশ করে একজন অনুচর, বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে বলে—-সর্দার, একটা জরুরী সংবাদ আছে।

বলো?

রহমান উদ্বিগ্ন হয়ে তাকালো অনুচর হাসিমের মুখের দিকে। হাসিমও বনহুরের কান্দাই শহরের আস্তানার অনুচর, না জানি কি সংবাদ সে বহন করে এনেছে।

বললো হাসিম— সর্দার, মনসুর ডাকু কারাগার থেকে পালিয়েছে।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো রহমান মনসুর ডাকু কারাগার থেকে পালিয়েছে, বলো কি?

বনহুর একটু হেসে বললো– এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই রহমান। আমি জানতাম, মনসুর ডাকুকে পুলিশ সায়েস্তা করতে পারবে না।

সর্দার, মনসুর ডাকু নিশ্চয়ই ফিরে এসেছে তার আস্তানায়।

হাঁ, সে ফিরে এসেছে তাতে কোনো ভুল নেই। ভেবেছিলাম অন্ততঃ কিছুদিন মনসুর ডাকুর অত্যাচার থেকে দেশবাসী পরিত্রাণ পাবে, কিন্তু তা হলো না। রহমান, এবার আর ক্ষমা নয়, আমি নিজে তাকে শাস্তি দেবো। হাসিম, তুমি জানো শুধু মনসুর ডাকু পালাতে সক্ষম হয়েছে, আর গোমেশ কি আটকা রয়েছে?

মনসুর ডাকু গোমেশসহ পালাতে সক্ষম হয়েছে সর্দার। পুলিশ মহলে সাড়া পড়ে গেছে। চারদিকে সন্ধান চলেছে তন্ন তন্ন করে।

তা তো হবেই।

দস্যু বনহুরের আস্তানায় যখন মনসুর ডাকুকে নিয়ে কথাবার্তা চলছিলো তখন মনসুর ড়াকু তার গোপন আড়ায় ভয়ানক জন্তুর মত গর্জে উঠছিলো। তার সহচর গোমেশকে লক্ষ্য করে বলে উঠে সে— বনহুর আমাকে এই ভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়ালো, এর প্রতিশোধ আমি নেবোই।

গোমেশ বলে উঠলো- আমি শপথ করলাম, দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করে এনে এবার জীবন্ত মাটিতে পুঁতে হত্যা করবো।

ইরানীর চোখে একটা উজ্জ্বল আনন্দভাব খেলে গেলো, খুশিভরা কণ্ঠে বললো গোমেশ, তুমি যদি দস্যু বনহুরকে জীবন্ত পাকড়াও করে এনে মাটিতে পুঁতে হত্যা করতে পারো তাহলে আমি তোমার গলায় জয়মাল্য পরিয়ে দেবো।

মনসুর ডাকুর চোখ দুটো আগুনের গোলার মত জ্বলছিলো, এই মুহূর্তে সে দস্যু বনহুরকে পেলে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলবে। বললো মনসুর ডাকু- যে ফাঁদ আমি পেতেছিলাম তাতে ব্যর্থ হয়েছি। এবার আমি যে ফাঁদ পাতবো তাতে বনহুরকে আটকাতেই হবে।

গোমেশ বললো এবার আমাদের নতুন ভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করতে হবে।

ইরানী বলে উঠলো–যে বুদ্ধি-কৌশল দ্বারা তোমরা দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করবে তা অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে করবে। দস্যু বনহুর শুধু শক্তিশালী নয়, অত্যন্ত চতুর। গোমেশ, আমি তোমাকে তার গোপন আস্তানার পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবো।

গোমেশ খুশি হয়ে উঠলো–সত্যি পারবে আমাকে দস্যু বনহুরের আস্তানার পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে?

পারবো, কারণ আমাকেও দস্যু বনহুর কম নাকানি-চুবানি খাওয়ায়নি। আমাকে সে প্রথমে এক নির্জন বাংলোয় আটকে রেখেছিলো। তারপর আমি আবিষ্কার করি এক গোপন সুড়ঙ্গপথ।

ইরানীর কথা শুনে উল্লসিত হয়ে উঠে মনসুর ভাকু, বলে সে–মা ইরানী, তুই আমাদের মুখ রাখবি। দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে আমি তাকে এমন শাস্তি দেবো যা কেউ কোনোদিন কল্পনা করতে পারে না।

গোপনে আরও কিছুক্ষণ তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হলো।

পরদিন।

ইরানী গোমেশসহ বেরিয়ে পড়লো দস্যু বনহুরের নির্জন বাংলোর উদ্দেশ্যে।

গোমেশ সন্ন্যাসী বেশে সজ্জিত হয়েছে আর ইরানী এক তরুণী যোগিনীর বেশে। কপালে চন্দনের তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। চুলগুলো ঝুটি করে মাথার উপরে বাঁধা।

নির্জন বাংলোর পথ ধরে এগুচ্ছে ওরা।

গোমেশ মাঝে মাঝে বলছে– ইরানী, আর কতদূর?

ইরানী হেসে বলে— এরি মধ্যে হাঁপিয়ে পড়লো গোমেশ?

না না, হাঁপিয়ে পড়বো কেন? তবে বলছি আর কতদূর?

এলেই দেখতে পাবে, চলো।

ইরানী আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলে–ঐ যে দূরে একটা বন দেখছো ওর ওপারে।

সর্বনাশ, অত দূর হাঁটতে পারবে তুমি?

ইরানী বললো– বারে, এটুকু পথ হাঁটতে পারবো না। তবে ডাকুর মেয়ে হলাম কেন? চলো, পা চালিয়ে চলো।

এক সময় নির্জন বাংলোর নিকটে পৌঁছে গেলো গোমেশ আর ইরানী। ইরানী বললো এই সেই নির্জন বাংলো। এর অভ্যন্তরে আছে এক গোপন সুড়ঙ্গপথ। সে সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে তুমি যদি ঠিক জায়গায় যেতে পারে তবে তুমি জয়ী হবে। সেখানে তুমি পাবে দস্যু বনহুরকে। কিন্তু মনে রেখো, তাকে জীবিত অবস্থায় মনসুর ডাকুর দরবারে হাজির করতে হবে, তবেই আমি তোমায় মালা দেবো– জয়মাল্য বুঝলে? কারণ, তাকে আমি নিজ হাতে জীবন্ত সমাধিস্থ করবো। আমার বাপুকে সে অপদস্থ করেছে, আমাকে সে নাজেহাল করেছে, তোমাকেও……

ইরানীর কথা শেষ হয় না, পিছনে এসে দাঁড়ায় স্বয়ং দস্যু বনহুর আর রহমান। সম্মুখে একটা সন্ন্যাসী এবং একটি যোগিনী তরুণী দেখে সরে আসে।

বনহুর আর রহমানের শরীরে স্বাভাবিক ড্রেস।

বনহুর বলে সন্ন্যাসী, কি দেখছো ওদিকে তাকিয়ে?

বৃদ্ধ সন্ন্যাসী বেশে গোমেশ কাঁপা কণ্ঠে বলে– সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তাই ওখানে একটু আশ্রয় পাবো কিনা তাই ভাবছি। বাবা, তোমরা বলতে পারো ওখানে কে থাকেন?

আমরা থাকি। বললো বনহুর।

সন্ন্যাসী বললো আমাদের একটু জায়গা দেবে বাবা ওখানে?

দেবো, এসো আমার সঙ্গে।

ইরানী বনহুরকে দেখেই চিনতে পেরেছিলো, গোমেশকে লক্ষ্য করে মৃদু কণ্ঠে বলে চিনতে পেরেছে এরা কে?

গোমেশও কম ঘুঘু নয়, সে ফিসফিস্ করে বললো–তুমি চিনবার পূর্বে আমি চিনে ফেলেছি।

চুপ করো, ওরা শুনে ফেলবে- তাহলে বিপদ!

বনহুর আর রহমানের পিছু পিছু এগিয়ে চললো গোমেশ আর ইরানী।

নির্জন বাংলোর মধ্যে প্রবেশ করে মোমবাতি জ্বালালো বনহুর। বাংলোর মধ্যে তখন বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে। আলো জ্বেলে টেবিলে রাখলো বললো– রহমান, আমার অতিথিদ্বয়ের এবং খাবার ব্যবস্থা করো।

আচ্ছা জনাব! বললো রহমান, তারপর বেরিয়ে গেলো। বনহুর গোমেশকে লক্ষ্য করে বললো– সন্ন্যাসী বাবা, এ যোগিনী কে……

বনহুরের কথা শেষ না হতেই বলে উঠে ইরানী– সন্ন্যাসী আমার পিতা!

বেশ বেশ, পিতা-পুত্রী আজ আমার অতিথি। আজ আমার পরম সৌভাগ্য। সন্ন্যাসী বাবা, তুমি এক কক্ষে শয়ন করো, তোমার কন্যা পাশের কক্ষে শয়ন করুক। কোনো অসুবিধা হবে না, কারণ এই দেখো শয্যা পাতা রয়েছে।

ইরানী আর গোমেশ নিজেরা একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিলো। তারপর ইরানী বাধ্য হলো বনহুরকে অনুসরণ করতে।

পাশের কক্ষে প্রবেশ করে বললো বনহুর– এই কক্ষ তোমার জন্য। ঐ যে শয্যা ওখানে শয়ন করবে। আংগুল দিয়ে পাশের একটি খাটে শয্যা পাতা ছিলো দেখিয়ে দিলো সে। সরে এলো বনহুর আরও কাছে, তারপর বললো- ইরানী, আমার চোখে ধূলো দেবোর জন্য তুমি যোগেনীবেশ ধারণ করেছে?

বনহুরের কথায় চমকে উঠে ইরানী, চোখেমুখে তার ভীতি ভাব ফুটে উঠে। বনহুর তাকে চিনে ফেলেছে– সর্বনাশ, এবার উপায়?

ইরানীর মুখোভাব লক্ষ্য করে বলে বনহুর–তুমি যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে তা আমি জানি। তোমার সঙ্গীটি কে?

ইরানী ঢোক গিলে বলে- ইরানী কে, আমি তাকে চিনি না। আমার সঙ্গী আমার পিতা হন।

বনহুর হেসে বলে চেনো না, ইরানী কে জানো না তুমি?

না, জানি না।

তোমার সঙ্গী তোমার পিতা নয় তোমার বাবার সহচর গোমেশ। তার কণ্ঠস্বর আমাকে পরিচয় বলে দিয়েছে।

ইরানী এবার সত্যি বিহ্বল হয়ে পড়ে। সে ভাবতে পারেনি তাদের ছদ্মবেশ বনহুরের কাছে ধরা পড়ে যাবে।

বনহুর বলে-দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে এসে নিজেরাই বন্দী হলে। হাতে তালি দিলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে দু’জন জমকালো পোশাক পরা লোক প্রবেশ করলো, তারা কুর্ণিশ জানালো বনহুরকে। বনহুর লোক দুটিকে লক্ষ্য করে বললো–পাশের কক্ষে এক সন্ন্যাসী আছে, তাকে বন্দী করে নিয়ে চলো আমার বিচারকক্ষে। লোক দুটি বেরিয়ে যায় পুনরায় বনহুরকে কুর্ণিশ জানিয়ে।

লোক দুজন যেতেই বনহুর বললো—ইরানী, এসো আমার সঙ্গে।

ইরানী বাধ্য হলো বনহুরকে অনুসরণ করতে। মনের যত সাহস তার উবে গেছে কর্পূরের মত।

এ পথ সেপথ করে বহুপথ চলে এক সুড়ঙ্গমুখে এসে দাঁড়ালো বনহুর। সুড়ঙ্গমুখের দরজা লৌহকপাটে বন্ধ ছিলো। বনহুর পাশের দেওয়ালে একটা সুইচে চাপ দিতেই খুলে গেলো লৌহকপাট।

বনহুর ভিতরে প্রবেশ করে বললো-এসো।

ইরানী বন্দিনীর মত অনুসরণ করলো বনহুরকে।

কিছুক্ষণ চলার পর সেই কক্ষে এসে পৌঁছলো বনহুর আর ইরানী, যে কক্ষে একদিন ইরানী বনহুকে এক ভয়ঙ্কর মূর্তিতে দেখেছিলো।

কক্ষমধ্যে দৃষ্টি পড়তেই চমকে উঠলো ইরানী, দেখলো একটা থামের সঙ্গে পিছমোড়া করে বাধা রয়েছে তার পিতা মনসুর ডাকুর প্রধান সহচর গোমেশ। তার দেহে এখনও সন্ন্যাসীর পোশাক পরা রয়েছে, শুধু মুখের দাড়ি এবং জটা জুট খসে পড়েছে।

গোমেশ ইরানীকে দেখামাত্র কটমট করে তাকালো, সে মনে করেছে ইরানীর জন্য তার এ অবস্থা হলো। চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।

বনহুর এসে দাঁড়ালো গোমেশের সম্মুখে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত লক্ষ্য করে বললো—গোমেশ, মনে পড়ে একদিন তোমরা আমাকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করতে চেয়েছিলে? মনে পড়ে আমার শিশুপুত্রকে এক ফোঁটা পানির জন্য তিল তিল করে শুকিয়ে মেরেছিলে?

গোমেশ বলে উঠলো– সে আমি নই, আমাদের মালিকের আদেশ……

হাঁ, মালিকের আদেশেই বটে। তোমাদের মালিককেও এখানে হাজির করা হবে। বললো বনহুর।

ইরানী শিউরে উঠলো।

বনহুর বললো–গোমেশ, জানতে না সিংহের গহ্বরে প্রবেশ করলে আর বের হওয়া যায় না?

গোমেশ তাকালো ইরানীর দিকে।

ইরানীও তাকিয়েছিলো গোমেশের দিকে, সেও রাগে ফুলছিলো ভিতরে ভিতরে।

গোমেশকে যে থামটার সঙ্গে মজবুত শিকল দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধে রাখা হয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন অনুচর আর রহমান।

বনহুর বলে এবার রহমান?

বলুন সর্দার।

মনসুর ডাকুকে নিয়ে এসো।

চমকে উঠলো ইরানী আবার, ভীত দৃষ্টিতে তাকালো সে বনহুরের মুখের দিকে।

রহমান এবং অনুচরদ্বয় বেরিয়ে গেলো।

বনহুর বললো- ইরানী, অপেক্ষা করো তোমার পিতাকেও তুমি দেখতে পাবে।

একটু পরে রহমান এবং দুজন অনুচর মনসুর ডাকুকে হাত-পা লৌহশিকলে আবদ্ধ অবস্থায় নিয়ে এলো সেই কক্ষে। যেমন বন্দী হিংস্র জানোয়ারকে নিয়ে আসা হয়, তেমনি টেনে নিয়ে আসা হলো।

ইরানী আর্তনাদ করে উঠলো- বাপু।

মনসুর ডাকুর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে।

বনহুর তার অনুচরদের আদেশ দিলো– মনসুরকেও তার সহচরের পাশে লৌহশিকলে আবদ্ধ করো।

বনহুরের অনুচরদ্বয় মনসুরু ডাকুকে টেনে-হিঁচড়ে গোমেশের পাশে আর একটা খামের সঙ্গে বেঁধে ফেললো মজবুত করে।

ইরানী রোদন করে চললো।

গোমশের চোখেমুখে বিস্ময়, সে না হয় ভুল করে সিংহের গহ্বরে প্রবেশ করে আটকা পড়েছে কিন্তু তাদের সর্দারকে কিভাবে বন্দী করলো।

মসুর ডাকুকে পিছমোড়া করে বেধে ফেলা হলো।

পাশাপাশি মনসুর ডাকু আর গোমেশ-দু’জনকে ঠিক জীবন্ত নরপিশাচের মত দেখাচ্ছে।

বনহুর হেসে উঠলো, তারপর বললো পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে হাঙ্গেরী কারাগার থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছে, কিন্তু আমার এই ভূগর্ভকারাগার থেকে পালাতে পারবে না আর কোনোদিন। গোমেশ, তুমি খুব আশ্চর্য হয়ে গেছো সর্দারকে বন্দী অবস্থায় দেখে, না? ইরানী, তুমিও অবাক হয়েছে। মিথ্যা পিতা সাজিয়ে গোমেশকে নিয়ে হাজির হয়েছিলে আমার গোপন বাংলোয়। সব ফাঁস হয়ে গেলো, আটকাও পড়লে। এবার রহমানকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর– রহমান, মনসুর আর গোমেশকে এইভাবে এক সপ্তাহ বন্দী করে রাখবে, তারপর বিচার হবে এদের। ইরানী, তুমি যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কিন্তু তুমি নারী, তাই তোমাকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে আমার ভূগর্ত পাতালপুরীর কারাকক্ষে বন্দী করে রাখা হবে, অবশ্য যতদিন তোমার পিতা এবং গোমেশের বিচার শেষ না হবে।

বনহুর কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলো সেখানে থেকে।

রহমান এবার ইঙ্গিত করলো অনুচরদ্বয়কে।

অনুচরদ্বয় ইরানীকে ধরে টেনে নিয়ে চললো।

রহমান একপাশে সরে গেলো, দেওয়ালে হাত দিয়ে একটা বোতামে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে গোমেশ আর মনসুর ডাকর চারপাশে উঁচু হয়ে উঠে এলো একটা গোলাকার লৌহ প্রাচীর। মনসুর। ডাকু আর গোমেশের চোখের সম্মুখে সব অন্ধকার হয়ে গেলো।

খাবার টেবিলে সব গুছিয়ে রাখছিলো মাহমুদা। আজ তার বড় আনন্দ চৌধুরী বাড়ি থেকে সবাই আসবে তাদের বাসায়। মরিয়ম বেগম, মনিরা, নূর, সরকার সাহেব, এমনকি মনির ভাইয়াও আসবে দাওয়াত খেতে। সেদিন আমিনুর খান আর মাহমুদা নিয়ে গিয়ে দাওয়াত করে এসেছে। যদিও মনির ভাইয়া সেদিন ছিলো না তবু মনিরা কথা দিয়েছে তাকে না নিয়ে আসবে না সে।

আজ সকালে মনিরা ফোন করেছিলো রাতে তারা আসবে, মনিরও আসবে জানিয়েছে সে। চাকর-বাকর আর বাবুর্চিকে নিয়ে সমস্ত দিন ধরে মাহমুদা খাবারের আয়োজন করেছে। অনেক রকম রান্নাবান্না করেছে- পোলাও কোরমা, কোপৃতা, কাটলেট, পায়েস, বরফি, জরদা বহু কিছু। সন্ধ্যার পূর্বে রান্না শেষ করে ফেলেছে মাহমুদা।

বাবুর্চি এবং চাকর-বাকরের সাহায্যে এবার খাবারগুলো টেবিলে সাজিয়ে নিচ্ছিলো মাহমুদা, কারণ ওরা এলে সে যেন ওদের সঙ্গে বসে গল্পসল্প করতে পারে, কোনো অসুবিধা যেন না হয়।

মাহমুদা সব গুছিয়ে কোনো কাজে হলঘরের পাশ কেটে তাদের শয়নকক্ষের দিকে যাচ্ছিলো, হঠাৎ তার কানে এলো তার স্বামীর চাপা কণ্ঠস্বর- ইন্সপেক্টার, আপনি এবং মিঃ ফরিদ হোসেন পাশের কামরায় থাকবেন। মিঃ জরিফ পুলিশ ফোর্স সহ বাসার চারপাশে আত্মগোপন করে থাকবেন।

মাহমুদা আরও সজাগ হয়ে কান পাতলো–তার স্বামী এসব কি বলছে, কাকেই বা বলছে আর কেনই বা বলছে! ভাল করে শুনতে চেষ্টা করলো মাহমুদা। এবার তার কানে এলো আর একটি কণ্ঠ-স্যার, দস্যু বনহুর কি এত সোজা লোক যে, এভাবে স্ত্রী-পুত্র-মাকে নিয়ে দাওয়াত খেতে আসবে।

আপনি জানেন না ইন্সপেক্টার, স্বয়ং দস্যু বনহুর আমার পরম আত্মীয়–যদিও বলতে আমার লজ্জা হচ্ছে তবু বলছি।

স্যার, দস্যু বনহুর আপনার আত্মীয়–এ লজ্জার কথা নয় বরং আপনার গর্বের কথা। কারণ, দস্যু বনহুরকে দেশবাসী ঘৃণা করে না-শ্রদ্ধা করে।

ইন্সপেক্টার, আপনি সত্য কথাই বলছেন, কিন্তু কর্তব্যের কাছে সব কিছু বিসর্জন দিতে হচ্ছে আমাকে। আমি পূর্বে জানতাম না, আমারই খালার একমাত্র সন্তান মনির চৌধুরীই দস্যু বনহুর–

এরপর মাহমুদা আর দাঁড়াতে পারে না, তার পা দুখানা যেন মাতালের মত টলছে। কোনোরকমে দেয়াল ধরে চলে এলো শোবার ঘরে। ধপ করে বসে পড়লো মেঝেতে তারপর আবার উঠে দাঁড়ালো, কোনো রকমে খাটে বসে আঁকড়ে ধরলো খাটের হাতলটা। সব কথা আজ স্পষ্ট হয়ে মনে পড়তে লাগলো তার। কত দিনের স্মৃতি আজ একটির পর একটি ভেসে উঠতে লাগলো তার মনে। যত দিনের যত কথা মাহমুদার মনে উদয় হলো–সে মনিরা চৌধুরীকে এক দেবমূর্তি সদৃশই দেখতে পেলো, কোথাও সে খুঁজে পেলো না তার মাঝে জঘন্য কোনো মনোবৃত্তির পরিচয়।

কতক্ষণ বসে ছিলো খেয়াল নেই, হঠাৎ আমিনুর খানের ডাকে চমক ভাঙ্গে তার, চমকে উঠে সে।

আমিনুর খান বলে–এখানে অমন করে বসে আছো কেন, চলল। ওরা যে এসে পড়বে!

মাহমুদা উঠে দাঁড়ায়, পা দু’খানা তার কাঁপছে, ভয়ে নয়–দুর্ভাবনায়। তার বাড়িতে আসবে মনিরা তার স্বামীকে নিয়ে দাওয়াত খেতে-কত আশা আর উদ্দীপনা নিয়ে কিন্তু পরিণাম সে এক ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। তার বাসার চারপাশে আত্মগোপন করে আছে সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স। পাশের কক্ষে উদ্যত রিভলভার হস্তে প্রতীক্ষা করছেন দুজন পুলিশ অফিসার। না না, এ হতে পারে না জেনেশুনে সে কিছুতেই এমন একটা কাণ্ড হতে দেবে না।

আমিনুর খান স্ত্রীকে কেমন যেন বিবর্ণ আর আনমনা দেখে বললো হঠাৎ কি হলো তোমার? কোনো অসুখ করেনি তো?

না।

তবে অমন চুপচাপ এ ঘরে বসেছিলে কেন?

মাথাটা হঠাৎ বড় ধরেছে কিনা—

এইতো একটু আগে বললে কোনো অসুখ করেনি।

তেমন ধরেনি–সামান্য।

চলো, এখন ওরা এসে পড়বে।

মাহমুদা মৃতের ন্যায় ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, কোনো কথা না বলে স্বামীকে অনুসরণ করলো।

ঠিক সেই মুহূর্তে গাড়ি-বারান্দায় চৌধুরী বাড়ির গাড়ি এসে থামলো।

আমিনুর খান বলে উঠলো–মাহমুদা, ওরা এসেছেন, চলো ওদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে আসি।

মাহমুদার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবার উপক্রম হলো, আজ সে বুঝতে পারছে আমিনুর খান– তার ভাইয়া এবং মনিরাকে দাওয়াত জানিয়ে এ বাড়িতে আনার জন্য কেন এত আগ্রহী ছিলো। তবু স্থবিরের মত আমিনুর খানের সঙ্গে এগিয়ে চললো সে। মনে মনে খোদাকে স্মরণ করছে হে। খোদা ভাইয়া যেন না আসেন।

গাড়ি-বারান্দায় পৌঁছে মাহমুদা প্রথমেই লক্ষ্য করলো ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে এসেছে, মনিরা মরিয়ম বেগম আর নূর পিছন আসনে। ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন বৃদ্ধ সরকার সাহেব।

এতক্ষণে মাহমুদা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেলো, আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠলো সে।

কিন্তু আমিনুর খানের মুখ গম্ভীর কালো হয়ে উঠেছে। তবু মুখোভাব যতদূর সম্ভব প্রসন্ন রেখে অভ্যর্থনা জানালো সে মরিয়ম বেগম আর মনিরাকে। ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো মনির ভাইয়া আসেনি কেন?

মরিয়ম বেগমই জবাব দিলেন–ওর কথার কোনো ঠিক নেই বাবা। কথা দিয়ে গিয়েছিলো আসবে কিন্তু কই এলো।

মনিরা বললো-তার জন্য প্রতীক্ষা করতে করতেই এত বিলম্ব হয়ে গেলো।

ড্রাইভার গাড়ির দরজা খুলে ধরলো।

গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো সবাই।

আমিনুর খান আর মাহমুদা তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে চললো।

সরকার সাহেবও মরিয়ম বেগম এবং মনিরার সঙ্গে বাসার ভিতরে গেলেন।

ড্রাইভার গাড়িতে ঠেশ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চারিদিকে তাকিয়ে নিয়ে সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো সে।

মাহমুদা পূর্বের চেয়ে এখন অনেকটা স্বচ্ছ-প্রসন্ন হয়ে এসেছে, একটা বিরাট দুশ্চিন্তার হাত থেকে উপস্থিত সে যেন রেহাই পেয়েছে। কিন্তু মন তার সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি হতেও পারে না কারণ সে আজ এমন একটা কথা জানতে পেরেছে যা তার মনে বিপুলভাবে আলোড়ন জাগিয়েছে। মনিরা আপার স্বামী স্বয়ং দস্যু বনহুর এ যেন তার কল্পনার বাইরে। মাহমুদাকে কিছুটা চিন্তাযুক্ত মনে হলেও আমিনুর খানকে পূর্বের চেয়ে বেশ গম্ভীর মনে হচ্ছিলো। কদিন থেকে আমিনুর খান সর্বক্ষণ একটা উত্তেজনাপূর্ণ মনোভাব নিয়ে কাটাচ্ছিলো, আজ নিমিশে তার সে বিপুল উত্তেজনা যেন দপ্ করে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। কথাবার্তা বলছে বটে কিন্তু সে কথায় যেন কোনো উদ্দীপনা নেই।

খাবার টেবিলে সবাই যখন খেতে খেতে হাসি-গল্প নিয়ে মেতে উঠছে তখন আমিনুর খান সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে। হলঘরের দরজা দিয়ে পাশের ছোট কামরায় প্রবেশ করে।

ড্রাইভারের দৃষ্টি আমিনুর খানকে লক্ষ্য করে। সে গাড়িতে বসে তাকিয়ে ছিলো বাইরের। দিকে, অবশ্য তার খেয়াল ছিলো হলঘরের অভ্যন্তরে।

দু’জন পুলিশ অফিসারসহ বেরিয়ে এলো আমিনুর খান। হলঘরের দাওয়ায় এসে দাঁড়ালো আমিনুর খান এবং পুলিশ অফিসারদ্বয়।

ড্রাইভার শুনতে পেলো আমিনুর খান পুলিশ অফিসারদ্বয়কে লক্ষ্য করে বলছে-সব চেষ্টা আমার ব্যর্থ হয়ে গেলো ইন্সপেক্টার।

স্যার, আমি পূর্বেই বলেছিলাম দস্যু বনহুরকে এত সহজে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়।

কিন্তু আমি শপথ করছি, আজ যা পারলাম না দুদিন পর পারবোই পারবো। আমার আত্মীয় হলেও আমি তাকে রেহাই দিবো না।

ড্রাইভার লক্ষ্য করলো একটা গাড়ি এসে থামলো অদূরে পুলিশ অফিসারদ্বয় আমিনুর খানের সহিত করমর্দন করে বিদায় গ্রহণ করলো।

পরক্ষণেই একটা পুলিশ ভ্যান এসে থামলো।

সঙ্গে সঙ্গে বাগান হতে ঝোঁপঝাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো কতকগুলো রাইফেলধারী পুলিশ, আমিনুর খানকে সেলুট ঠুকে সবাই ভ্যানে চেপে বসলো।

বিমর্ষ মুখে আমিনুর খান তাকিয়ে রইলো সেইদিকে।

ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এলো, আমিনুর খানকে সালাম জানিয়ে বললো–সাহাব, এতনা পুলিশ কাহেকা আয়া থা?

রাগতভাবে বললো আমিনুর খান-ও তুমি বুঝবে না ড্রাইভার।

সালাম সাহাব! বললো ড্রাইভার।

যাও। জবাবে বললো আমিনুর খান।

পুলিশ ভ্যান তখন বেরিয়ে গেছে।

ড্রাইভার ফিরে এলো তার গাড়িতে।

আমিনুর খান বিমর্ষ মুখে অন্দরবাড়ির দিকে পা বাড়ালো।

মরিয়ম বেগম অবাক হয়ে বললেন–ড্রাইভার তুমি যে বড় বেয়াড়া দেখছি একেবারে দোতলায় এসে পড়লে? সাহস তো কম নয় তোমার!

ড্রাইভার দাড়ি-গোঁফ খুলে ফেললো একটানে মাথার ক্যাপটা খুলে হেসে উঠলো-হাঃ হাঃ

অবাক হয়ে যান মরিয়ম বেগম, মুখ দিয়ে তাঁর কথা বের হচ্ছে না।

মনিরা মৃদু মৃদু হাসছে।

সরকার সাহেব আর নূর নিচেই রয়ে গেছে।

বনহুর হাসি থামিয়ে বলে-মাগো, তুমিও আমাকে চিনতে পারোনি। জানো মা, তোমার বোনের ছেলের আজকের আয়োজন সব ব্যর্থ হয়ে গেছে। হাঃ হাঃ হাঃ—হাঃ হাঃ হাঃ—সব আয়োজন ব্যর্থ হয়ে গেছে।

মনির, তুই কি বলছিস বাবা?

তুমি জানো না মা, আমিনুর খান কেন তোমাদের দাওয়াত করে খাওয়াতে গেলো। তোমার ছেলেকে সে গ্রেপ্তার করার উদ্দেশ্যেই এই আয়োজন করেছিলো।

বলিস কি বাবা?

হাঁ মা। তোমরা যখন ভিতর বাড়িতে খাবার টেবিলে খাচ্ছিলে তখন তোমার বোনের ছেলে বেরিয়ে এসেছিলো বাইরে, তোমরা হয়তো লক্ষ্যই করোনি। জানো সে কেন সকলের অলক্ষ্যে বাইরে এসেছিলো? জানো না। বাইরে হলঘরের মধ্যে দুজন পুলিশ অফিসার লুকিয়ে ছিলো আর বাসার সম্মুখস্থ বাগানে আত্মগোপন করে ছিলো অগণিত সশস্ত্র পুলিশ ফোর্স।

এসব কি বলছিস্ মনির?

সব সত্য মা, সব সত্য। তোমার বোনের ছেলে আমাকে তোমাদের সঙ্গে না দেখতে পেয়ে। কেমন গম্ভীর হয়ে পড়ে ছিলো, মুখখানা তার অমাবস্যার মত কালো হয়ে গিয়েছিলো; খেয়াল করোনি তোমরা।

এসব জানলে আমি কিছুতেই যেতাম না। কি সর্বনেশে কথা। আমিনুর তোকে—

হাঁ, আমাকে সে গ্রেপ্তার করে পুলিশ মহলে স্বনামধন্য হতে চায়। আর পেতে চায় লাখ টাকা

আমিনুর আমার নিজের বোনের ছেলে হয়ে–

মা, তুমি এ দুনিয়াকে আজও চিনতে পারোনি। যাক ও সব কথা। চলো মা, আমাকে কিছু খেতে দেবে চলো।

হা, এ কি বলছিস বাবা? আমাদের সঙ্গেই ছিলি অথচ তুই না খেয়ে রইলি আর আমরা পেট পুরে খেলাম।

দুঃখ করোনা মা, তোমার হাতের খাবার না খেয়ে যে তৃপ্তিই হবে না।

মরিয়ম বেগম হাস্যোজ্জ্বল মুখে চলে গেলেন।

বনহুর মনিরার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল কক্ষের দিকে।

এক সপ্তাহ আমি পানি পান করিনি বনহুর। আঃ মরে গেলাম— একফোঁটা পানি দাও এক ফোঁটা পানি দাও—-মনসুর ডাকু জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট দু’খানা চাটতে লাগলো।

হাঃ হাঃ হাঃ—পানি পানি পান করবে? মনে পড়ে মনসুর সেদিনের কথা, যেদিন আমার শিশুপুত্র নূরকে তুমি এক ফোঁটা পানি না দিয়ে তিল তিল করে শুকিয়ে মেরে ছিলে? মনে পড়ে তাকে পানি পান করতে দিয়ে লাথি মেরে পানির পাত্র ভেঙ্গে ফেলেছিলে? দাঁতে দাঁত পিষে বলে বনহুর কথাগুলো।

গোমেশের অবস্থা আরও কাহিল, তার চোখ দুটো বসে গেছে। দেহটা ঝুলে পড়েছে একেবারে। বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট দু’খানা চাটছে মাঝে মাঝে তার মুখ দিয়ে অস্ফুট গোঙ্গানির শব্দ বের হচ্ছে।

ইরানী কেঁদে কেঁদে রাঙা হয়ে উঠেছে, সে হাত জুড়ে বললো–বনহুর, আমার বাপুকে তুমি ক্ষমা করে দাও।

ক্ষমা! ক্ষমা করবো তোমার বাপুকে?

হাঁ, একটিবারের জন্য আমার বাপুকে তুমি ক্ষমা করো।

তোমার বাপু আমার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছে তাতে আমার এতটুকু ক্ষোভ নেই। আমার কচি পুত্রের প্রতি তার অবিচার আমাকে আজও দগ্ধীভূত করে চলেছে। কি নিষ্ঠুর পৈশাচিক আচরণ সে করেছিলো একরত্তি শিশুর উপর।

পানি—পানি—আমি জানতাম না বনহুর, পানির পিপাসা এত কঠিন। আমাকে মাফ করো বনহুর, আমাকে মাফ করো। এক ফোঁটা পানি দাও—মনসুর ডাকু অসহায়ভাবে বনহুরের কাছে পানি ভিক্ষা করতে লাগলো।

বনহুর বললো–আজ তুমি উপলব্ধি করছে পানির পিপাসা কত কঠিন। যেদিন আমার শিশুপুত্রকে এমনি করে পানি পান থেকে বিরত রেখেছিলে সে দিনের কথা স্মরণ করো বন্ধু। রহমান, ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসো।

রহমান ও পাশের সোরাহী থেকে একমাত্র পানি ঢেলে নিয়ে এলো।

মনসুর ডাকুর দু’চোখে আকুলতা, লোলুপ তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি নিয়ে রহমানের হাতের পানির পাত্রের দিকে তাকাতে লাগলো সে-পানি দাও, পানি দাও—-আঃ আঃ মলাম—আঃ—-

বনহুর বললো–রহমান, গোমেশকে পানি পান করাও।

কথাটা শুনে গোমেশের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো, মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনলো সে সমুখে-জল, জল দাও আমাকে–ভাই জল দাও—শপথ করছি, আর তোমার বিরুদ্ধে আমি কাজ করবো না বনহুর—আর তোমার বিরুদ্ধে কাজ করবো না। জল—জল—দা–ও—

রহমান গোমেশের মুখে পানির পাত্র তুলে ধরলো।

ঢক ঢক করে একনিঃশ্বাসে পানির পাত্র শূন্য করে ফেললো গোমেশ।

মনসুর ডাকু তখন সেদিকে তাকিয়ে আকুতি কাকুতি করছিলো। সে মনে করেছিলো। গোমেশকে পানি পান করিয়ে এবার তাকে পানি পান করাবে। কিন্তু সে আশা ব্যর্থ হলো।

বনহুর বললো-গোমেশ, যেদিন আমাকে আর আমার শিশুপুত্র নূরকে পানি পান থেকে বিরত রাখা হয়েছিলো, সেদিন তুমি ছিলে না। তাই তোমাকে পানি পান করতে দেওয়া হলো। মৃত্যুর পূর্বে পিপাসা নিয়ে মরবে এ আমি চাই না।

গোমেশের চোখ দুটোতে একটা ভীষণ ভীতিভাব ফুটে উঠলো, বলে উঠলো সে—আমাকে তুমি হত্যা করোনা, আমাকে তুমি হত্যা করোনা বনহুর—-

হত্যা করবো না? তবে যমালয়ে যাবে কি করে?

ভগবানের শপথ করে বলছি, আমি আর দস্যুতা করবে না, কাউকে আমি হত্যা করবো না—–

হাঃ হাঃ হাঃ, অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বনহুর।

শিউরে উঠ ইরানী।

গোমেশের দু’চোখ কপালে উঠেছে।

মনসুর ডাকুরও সমগ্র দেহ যেন পাথরের চাপের মত শক্ত হয়ে উঠে।

বনহুর কোমরের বেল্ট থেকে খুলে নিলো সূতী ধার ছোরাখানা এগিয়ে গেলো গোমেশের দিকে। এক মুহূর্তে বিলম্ব না করে ছোরাখানা সমূলে বসিয়ে দিলো বনহুর গোমেশের বুকে।

একটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠলো গোমেশ।

বনহুর একটানে ছোরাখানা তুলে নিলো গোমেশের বুক থেকে।

সঙ্গে সঙ্গে ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরে পড়লো তার বুকের উপর

ইরানী দুহাতে চোখ ঢেকে ফেলেছে।

মনসুর ডাকুর মুখোব করুণ হয়ে উঠেছে, বলে উঠে মনসুর ডাকু-বনহুর এবারের মত আমাকে মাফ করো, আমি তোমার গোলাম হয়ে থাকবো।

গোলাম গোলাম হয়ে থাকবে। কিন্তু সে সময় আর কই মনসুর? দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে বনহুর মনসুর ডাকুর দিকে। হাতে তার সূতীক্ষ্ম ধার রক্তমাখা উদ্যত ছোরা।

ইরানী ছুটে এসে মনসুর ডাকুর সামনে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে–না না, আমার বাপুকে তুমি হত্যা করোনা, হত্যা করোনা বনহর—-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *