মিসেস তালুকদারের আংটি
রবিবারের সকালবেলা। দেরিতে ঘুম থেকে উঠে, চা-জলখাবার খেয়ে, বাড়িতে যে তিনখানা কাগজ দিয়ে যায়, তার হেডলাইনগুলোর উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সদ্য আমার নতুন বইখানার প্রুফ দেখতে বসেছি, এমন সময় সদানন্দবাবুর আবির্ভাব। দরজা পেরিয়ে, ঘরে ঢুকে রোজই যেমন একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে এদিকে-ওদিকে বারকয়েক তাকান, তেমন আজও তাকালেন। অর্থাৎ হাতের লাঠিখানাকে যে ঠিক কোনখানে দাঁড় করিয়ে রাখলে ভাল হয়, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। একটা জায়গাও মনঃপূত না হওয়ায় শেষপর্যন্ত সেটিকে বইয়ের তাকের উপরে শুইয়ে রাখলেন। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বললেন, “এ তো খুব মুশকিল হল, কিরণবাবু।”
ভদ্রলোক আমার প্রতিবেশী। নিরীহ নির্বিরোধ পরোপকারী মানুষ। বয়স সত্তরের উপরে, তবে স্বাস্থ্য এখনও মজবুত। নিয়মিত মর্নিং ওয়াক করেন। দিনে তিন কাপ চা খান। কিন্তু চায়ের সঙ্গে দুধ-চিনি মেশাবার ঘোর বিরোধী। আমার বন্ধু প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর চারুচন্দ্র ভাদুড়ির মস্ত ভক্ত। ভক্তির আসল কারণ আর কিছুই নয়, বছর কয়েক আগে সদানন্দবাবুকে একটা খুনের মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন ভাদুড়িমশাইয়ের সাহায্য না পেলে সেই মিথ্যে মামলা থেকে তাঁকে ছাড়িয়ে আনা যেত না।
কাজের দফা যে রফা, সেটা বুঝতে পেরে গিয়েছিলুম। প্রুফের বান্ডিল সরিয়ে রেখে বললুম, “কী ব্যাপার? মুশকিলটা কী হল?”
ভদ্রলোকের অনেক গুণের মধ্যে একটা দোষ এই যে, কোনও প্রশ্নেরই সরাসরি জবাব দেন না। এটারও দিলেন না। চেয়ার টেনে নিয়ে একেবারে চুপচাপ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কাজ তো করেন খবরের কাগজে। তা আজকের কাগজখানা দেকেচেন?”
“কোন কাগজ?”
“ইস্টার্ন কুরিয়ার।”
“দেখেছি। কিন্তু কই, তেমন কোনও বড় খবর তো চোখে পড়ল না।”
“চোখ থাকলে তো পড়বে!” সদানন্দবাবু বললেন, “তিনের পাতার চারের কলমটা একবার ভাল করে দেকুন।”
ইস্টার্ন কুরিয়ারের তিনের পাতা মানে সিটি পেজ। তার চারের কলমে দেখলুম মোট তিনটে খবর ছাপা হয়েছে। প্রথম খবর এই শহরের পরিবেশদূষণ-সংক্রান্ত এক সেমিনারের, দ্বিতীয় খবর ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের একটা ফ্লাইটের যাত্রীদের হয়রানি নিয়ে আর তৃতীয় খবর একটা ডাকাতির।
বললুম, “চারের কলমের কোন খবরটার কথা বলছেন?”
“তাও বলে দিতে হবে?” সদানন্দবাবু ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “আশ্চর্য লোক মশাই আপনি ভাদুড়িমশাইয়ের আপনি ফ্রেন্ড, অথচ বলে না-দিলে দেকি কিছুই বুজতে পারেন না! তলার খবরটা দেকুন।”
অর্থাৎ ডাকাতির খবর। পড়ে দেখলুম, নতুন কোনও ব্যাপার নয়। জোড়াসাঁকোর ওদিককার এক ফ্ল্যাটবাড়ির ঘটনা। ঘটেছে শনিবার সকাল এগারোটার সময়। বাড়ির কর্তা এক নিঃসন্তান অবাঙালি ব্যবসায়ী। সাততলার ফ্ল্যাটে থাকেন। ফ্ল্যাটে তিনি ও তাঁর স্ত্রী ছাড়া আর কেউ থাকে না। রোজ সকাল সাড়ে ন’টার সময় তিনি কাজে বেরিয়ে যান। গতকালও গিয়েছিলেন। তার ঘণ্টা দেড়েক বাদে কলিং বেল বেজে উঠতে তাঁর স্ত্রী আই-হোলে চোখ রেখে দেখতে পান যে, দরজার বাইরে, হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে, একজন অচেনা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটির পরিচয় জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারেন যে, সে এক ওষুধ কোম্পানির সেল্স প্রোমোশান ডিপার্টমেন্টের কর্মী। তাদের কোম্পানি নাকি গেঁটেবাতের এক আশ্চর্য ওষুধ বার করেছে, রুমালে যার দু-ফোঁটা ফেলে দিনে মাত্র দু-বার শোঁকাই যথেষ্ট, বাতব্যাধির তাবৎ যন্ত্রণা তাতেই কর্পূরের মতন উবে যায়।
পরের ঘটনা কল্পনা করা কঠিন নয়। ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দেন। মেয়েটি ফ্ল্যাটের মধ্যে ঢুকে তাঁর নাকের উপরে একটা রুমাল চেপে ধরে। ভদ্রমহিলা তাতে বেহুঁশ হয়ে যান। হুঁশ ফিরবার পরে দেখতে পান যে, স্টিলের আলমারির পাল্লা খোলা। তার মধ্যে নগদ টাকা ছিল হাজার দশেক। কিছু গয়নাগাটিও ছিল। সব ফাঁক। নাকে যখন রুমাল চেপে ধরা হল, তখনই তিনি চিৎকার করে ওঠেননি কেন, পুলিশ অফিসারের এই প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রমহিলা জানিয়েছেন যে, হ্যাঁ, রুমালে একটা বিচ্ছিরি রকমের গন্ধ ছিল বটে, তবে ওটা যে ক্লোরোফর্মের গন্ধ, তা তিনি বুঝতে পারেননি, তাঁর ধারণা হয়েছিল, ওটা গেঁটেবাতের ওষুধের গন্ধ।
কাগজখানা সরিয়ে রেখে সদানন্দবাবুর দিকে তাকিয়ে বললুম, “এই তো খবর! এর মধ্যে এমন কী পেলেন যে, রোব্বারের সকালের টিভি-সিরিয়াল ফেলে আপনাকে ছুটে আসতে হল? ধন্যি লোক বটে!”
“বাঃ, এত বড় একটা ডাকাতি…আর আপনি বলচেন কিনা…”
“ফ্ল্যাটে ডাকাতি? ও তো আকছার হচ্ছে।”
“কিন্তু মেয়ে-ডাকাত!”
“সেও নতুন-কিছু নয়।” হেসে বললুম, “ছেলেরা যদি ডাকাতি করতে পারে তো মেয়েরাই বা পারবে না কেন? তবে হ্যাঁ, ফুলন দেবীর মতো যদি গলায় কার্তুজের মালা ঝুলিয়ে ওই মেয়েটা এসে ফ্ল্যাটবাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকত আর দনাদ্দন গুলি চালিয়ে দু-পাঁচটা মানুষকে সাবড়ে দিত, তবে সেটা একটা খবরের মতন খবর হত বটে। তার বদলে কী করেছে? না ক্লোরোফর্ম শুঁকিয়ে এক গেঁটেবাতের রুগিকে অজ্ঞান করে দিয়ে হাজার-দশেক টাকা আর গয়না নিয়ে পালিয়েছে! আরে দুর-দূর, ওই যে ছিঁচকে চোর বলে একটা কথা আছে না? এ হচ্ছে সেই রকমের ছিঁচকে ডাকাত। এতে এত ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন?”
“যাব না?” সদানন্দবাবু বললেন, “মেয়েটার গলার আওয়াজ নিয়ে কাগজে যা লিকেছে, সেটা পড়েচেন?”
“পড়ব না কেন? সবটাই তো পড়লুম। ভদ্রমহিলার নাকি মনে হয়েছিল যে, মেয়েটার গলার স্বর একটু মোটা। ওই মানে অনেকটা পুরুষদের গলার মতন। পুলিশকে অন্তত সেই কথাই তিনি বলেছেন।”
“তা এটা কি আপনার সন্দেহজনক বলে মনে হয় না?”
“কোনটা সন্দেহজনক বলে মনে হবে? একটা মেয়ের গলার আওয়াজ মোটা হওয়া, না পুলিশকে সেটা জানানো?”
“গলার আওয়াজ মোটা হওয়া।”
হেসে বললুম, “আরে মশাই, এই কলকাতা শহরেই এমন বিস্তর মেয়ে দেখবেন, যাদের গলার আওয়াজ পুরুষের মতন মোটা, আবার এমন অনেক পুরুষও দেখতে পাবেন, যারা একেবারে মেয়েদের মতন মিহি গলায় কথা বলে। এর মধ্যে আবার সন্দেহের কী আছে?”
সদানন্দবাবু তক্ষুনি আমার প্রশ্নের কোনও জবাব দিলেন না। ঝাড়া একটা মিনিট একেবারে গুম মেরে বসে রইলেন। তারপর বললেন, “আমার কী মনে হয় জানেন?”
“কী মনে হয়?”
“আমার মনে হয়, জোড়াসাঁকোর ফ্ল্যাটে যা হয়েচে, সেটা পুরুষের কাজ। একটা পুরুষ-ডাকাত মেয়ে সেজে এসে ডাকাতি করেচে।”
“বিচিত্র কী,” আমি বললুম, “সবই সম্ভব। তবে একটা কথা ঠিক। সেটা এই যে, মেয়েই হোক আর পুরুষই হোক, ডাকাতিটা যে করেছে, সে খবর নিয়েই এসেছিল। সে জানত যে, এগারোটার সময় এক ওই ভদ্রমহিলা ছাড়া আর কেউ ফ্ল্যাটে থাকবে না। ভদ্রমহিলা যে গেঁটেবাতের রুগি, এটাও সে জানত। তা নইলে সে গেঁটেবাতের ওষুধের কথা বলত না। তাও কী রকমের ওষুধ? না মিরাকল ড্রাগ! অত্যাশ্চর্য ওষুধ! যা দিনে মাত্র দু’বার শুঁকলেই বাতের যন্ত্রণা একেবারে ‘বাপ বাপ’ করে পালিয়ে যায়। এখন বলুন, গেঁটেবাত যাঁকে ভোগাচ্ছে, অমন ওষুধের কথা শুনলে তিনি দরজা না-খুলে পারতেন? আপনার স্ত্রীর তো শুনেছি…ও কী, কী হল আপনার?”
সদানন্দবাবুর মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। এক গেলাশ জল আমার লেখার টেবিলে সব সময়েই ঢাকা দেওয়া থাকে। সেটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললুম, “খেয়ে নিন তো।”
ঢকঢক করে জলটা খেয়ে নিলেন সদানন্দবাবু। তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা মুছে নিয়ে, যেন সাত দিন জ্বরে ভোগার পর আজই প্রথম অন্নপথ্যি করবেন এই রকমের নিস্তেজ গলায় বললেন, “না মশাই, আমার পুরী যাওয়া হচ্চে না।”
আমি তো অবাক। ভাদুড়িমশাই এখন কলকাতায়। পুরী যাওয়ার প্ল্যানটা আসলে তাঁরই। তিনিই বলেন যে, হাতে যখন সময় রয়েছে আর কাজও বিশেষ নেই, তখন ব্যাঙ্গালোরে ফেরার আগে দিন- কয়েকের জন্যে পুরী থেকে ঘুরে এলে মন্দ হত না। সেই অনুযায়ী তাঁর, সদানন্দবাবুর আর আমার রিজার্ভেশনও করে রেখেছি। মঙ্গলবার জগন্নাথ এক্সপ্রেসে রওনা হব। ফিরে আসব রবিবার সকালে। এখন হঠাৎ সদানন্দবাবু বলছেন যে, তাঁর যাওয়া হবে না।
বললুম, “কী ব্যাপার বলুন তো? শরীর খারাপ?”
“না না, সে-সব কিচু নয়। শরীর আমার ভালই আচে।”
“তা হলে? পুরী যাবার কথা শুনে গোড়ায় তো খুব নেচে উঠেছিলেন। তা হলে এখন যেতে চাইছেন না কেন?”
“আমার ওয়াইফের কথা ভাবচি।”
হেসে বললুম, “বুঝেছি। তা আমরা যাচ্ছি তো মাত্র চার-পাঁচ দিনের জন্যে। এই ক’টা দিন তাঁকে ছেড়ে থাকতে পারবেন না?”.
“আরে ধুর মশাই,” ডান হাতের তর্জনী দিয়ে বুকে তিনটে টোকা মেরে সদানন্দবাবু বললেন, “আমি অত হেন-পেক্ক্ড লোক নই। আসলে আমি একটা অন্য কথা ভাবচি।”
“কী কথা ভাবছেন?”
“ভাবচি যে, তিনিও তো গাউটের রুগি। তার উপরে আবার তাঁর গাউটের ব্যথাটা ইদানীং খুব বেড়ে গেচে। তা আমরা যখন কলকাতায় থাকব না, সেই সময়ে একদিন দুপুরবেলায় কেউ যদি আমাদের বাড়িতে এসে কড়া নাড়ে আর বলে যে, গেঁটেবাতের সে এক অত্যাশ্চর্য ওষুধ নিয়ে এসেচে…”
সদানন্দবাবুর চিন্তাটা যে কোন লাইন ধরে এগোচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরে আমি হোহো করে হেসে উঠলুম। ভদ্রলোক তাতে ভারী আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বললেন, “হাসচেন যে?”
বললুম, “হাসব না? আপনি ভাবছেন যে, আপনার স্ত্রীও অমনি গিয়ে দরজা খুলে দেবেন? আরে না মশাই, আপনার স্ত্রীকে আমি চিনি তো, তিনি ওই জোড়াসাঁকোর ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধি ধরেন। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন সদানন্দবাবু, তিনি দরজা খুলবেন না।”
সদানন্দবাবু বললেন, “মুশকিল কী হয়েচে জানেন, খবরটা পড়া ইস্তক ওই দরজা না-খোলার কতাটা আমিও তাঁকে বলচি। কিন্তু আমার ওয়াইফকে তো আপনারা ভালই জানেন, আমার কোনও কতাই তিনি কানে তুলতে চান না, কিছু বলতে গেলেই বলেন, বেশি বকবক কোরো না তো। তাই বলছিলুম যে, আপনার ওয়াইফ যদি একবার…
বললুম, “ঠিক আছে, বাসন্তীকে বলব অখন, সে গিয়ে আপনার স্ত্রীকে সব বুঝিয়ে বলবে, যদিও তার কোনও দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। …কিন্তু আর নয়, এবারে আপনি বাড়ি যান মশাই। এই প্রুফের বান্ডিলগুলো দেখছেন তো, এগুলি দেখে দিয়ে যদি না কালকের মধ্যে আমার পাবলিশারের কাছে পাঠাতে পারি তো আপনার জায়গায় শেষপর্যন্ত হয়তো আমার যাওয়াটাই পণ্ড হবে।”
বইয়ের তাক থেকে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে ঘর থেকে সদানন্দবাবু বেরিয়ে গেলেন। আমিও আবার প্রুফ দেখতে বসে গেলুম।
