Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

কিঙ্করকে পতি অন্বেষণে প্রেরণ করিয়া, চন্দ্রপ্রভা স্বীয় সহোদরাকে সম্ভাষণ করিয়া কহিতে লাগিলেন, বিলাসিনি! দেখ, প্রায় চারি দণ্ড হইল, কিঙ্করকে তাঁহার অনুসন্ধানে পাঠাইয়াছি; না এ পর্যন্ত তিনিই আসিলেন, না কিঙ্করই ফিরিয়া আসিল; ইহার কারণ কি, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। বিলাসিনি কহিলেন, আমার বোধ হইতেছে, কোনও স্থানে নিমন্ত্রণ হইয়াছিল, অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া, তথায় আহার করিয়াছেন। অতএব, আর তাঁহার প্রতীক্ষায় থাকিবার প্রয়োজন নাই; চল, আমরা আহার করি। বেলা অতিরিক্ত হইয়াছে, আর বিলম্ব করা উচিত নয়। আর, তোমায় একটি কথা বলি, তাঁহার আসিতে বিলম্ব হইলে, তুমি এত বিষন্ন হও কেন এবং কি জন্যেই বা এত আক্ষেপ কর। পুরুষেরা সকল বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রেচ্ছ, স্ত্রীজাতিকে তাহাদের অনুবর্ত্তিনী হইয়া চলিতে হয়। পুরুষজাতির রোষ বা অসন্তোষ ভয়ে স্ত্রীজাতিকে যত সঙ্কুচিত ও সাবধান হইয়া সংসারধর্ম্ম করিতে হয়; পুরুষজাতিকে যদি সেরূপে চলিতে হইত, তাহা হইলে স্ত্রীজাতির সৌভাগ্যের সীমা থাকিত না। স্ত্রীজাতি নিতান্ত পরাধীন, সুতরাং তাহাদিগকে অনেক সহ্য করিয়া কালহরণ করিতে হয়। তাহাদের অভিমান করা বৃথা। শুনিয়া, সাতিশয় রোষবশী হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, স্ত্রীজাতি অপেক্ষা পুরুষজাতির স্বাতন্ত্র্য অধিক হইবেক কেন, আমি তাহা বুঝিতে পারি না, বিবেচনা করিয়া দেখিলে, স্ত্রী পুরুষ উভয় জাতিরই সমান স্বাতন্ত্র্য আছে; সে বিষয়ে ইতরবিশেষ হইবার কোনও কারণ নাই। তিনি আপন ইচ্ছামতে চলিবেন, আমি আপন ইচ্ছামতে চলিতে পারিব না, কেন। বিলাসিনী কহিলেন, কারণ, তাহার ইচ্ছা তোমার ইচ্ছার বন্ধনশৃঙ্খলাস্বরূপ। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, গো গর্দভ ব্যতিরিক্ত কে ওরূপ শৃঙ্খলাবন্ধন সহ করিবেক। বিলাসিনী কহিলেন, দিদি! তুমি না বুঝিয়। এরূপ উদ্ধত ভাবে কথা কহিতেছ। স্ত্রীজাতির অসদৃশ স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন পরিণামে নিরতিশয় ক্লেশের কারণ হইয়া উঠে। জলে, স্থলে, নভোমণ্ডলে, যেখানে দৃষ্টিপাত কর, স্ত্রী জাতির স্বাতন্ত্র্য দেখিতে পাইবে না; কি জলচর, কি স্থলচর, কি নভশ্চর, জীবমাত্রেই এই নিয়ম অনুসরণ করিয়া চলিয়া থাকে।

এই সকল কথা শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা কিয়ৎ ক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়। রহিলেন; অনন্তর, সম্মিত বদনে পরিহাসবচনে কহিলেন, এই পরাধীনতার ভয়েই বুঝি তুমি বিবাহ করিতে চাও ন॥ বিলাসিনীও হাস্যমুখে উত্তর দিলেন, হা, ও এক কারণ বটে; তদ্ভিন্ন, বিবাহিত অবস্থায় অন্যবিধ নানা অসুবিধা আছে। চন্দ্র প্রভ কহিলেন, আমার বোধ হয়, তুমি, বিবাহিত হইলে, পুরুষের আধিপত্য ও অত্যাচার অনায়াসে সহ করিতে পারিবে। বিলাসিনী কহিলেন, পুরুষের অভিপ্রায় বুঝিয়া চলা  বিলক্ষণ রূপে অভ্যাস না করিয়া, আমি বিবাহ করিব না। চন্দ্রপ্রভা শুনিয়া হাস্যমুখে কহিলেন, ভগিনি। যত অভ্যাস কর না কেন, কখনই অবিরক্ত চিত্তে সংসারধর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতে পারবে না। পুরুষের পদে পদে অত্যাচার; কত সহ্য করিবে, বল। তুমি পুরুষের আচরণের বিষয় সবিশেষ জান না, এজন্য ওরূপ কহিতেছ; যখন ঠেকিবে, তখন শিখিবে; এখন মুখে ওরূপ বলিলে কি হইবে। বিশেষতঃ, পরের বেলায় আমরা উপদেশ দিতে বিলক্ষণ পটু, আপনার বেলায় বুদ্ধিভ্রংশ ঘটে; তখন বিবেচনাও থাকে না, সহিষ্ণুতাও থাকে না। তুমি এখন আমায় ধৈর্য্য অবলম্বন করিতে বলিতেছ; কিন্তু যদি কখনও বিবাহ কর, আমার মত অবস্থায় কত ধৈর্য্য অবলম্বন করিয়া চল, দেখিব।

উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, এমন সময়ে কিঙ্কর, বিষন্ন বদনে তাঁহাদের সম্মুখবর্তী হইল। চন্দ্রপ্রভা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিঙ্কর! তুমি যে একাকী আসিলে; তোমার প্রভু কোথায়; তাহার দেখা পাইয়াছ কি না; কত ক্ষণে গৃহে আসিবেন, বলিলেন। কিঙ্কর কহিল, মা ঠাকুরাণি! আমার বলিতে শঙ্কা হইতেছে; কিন্তু না বলিলে নয়, এজন্য বলিতেছি। আমি তাহাকে যেরূপ দেখিলাম, তাহাতে আমার স্পষ্ট বোধ হইল, তাঁহার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাঁহাতে উন্মাদের সম্পূর্ণ লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে। আমি কহিলাম, কর্ত্রী ঠাকুরাণীর আদেশে, আমি আপনাকে ডাকিতে আসিয়াছি, ত্বরায় গৃহে চলুন, আহারের সময় বহিয়া যাইতেছে। তিনি আমার দেখিয়া, বিরক্তি প্রকাশ করিয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিয়া আসিলে। পরে, আমি যত গৃহে আসিতে বলি, তিনি ততই বিরক্ত হইতে লাগিলেন এবং আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায়, বারংবার কেবল এই কথা বলিতে লাগিলেন। আমি কহিলাম, আপনি এ পর্য্যন্ত গৃহে না যাওয়াতে, কর্ত্রী ঠাকুরাণী অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছেন। তিনি সাতিশয় কুপিত হইয়। কহিলেন, তুই কর্ত্রী ঠাকুরাণী কোথায় পাইলি; আমি তোর কর্ত্রী ঠাকুরাণীকে চিনি না; আমার স্বর্ণমুদ্রা কোথায় রাখিলি, বল।

এই কথা শুনিয়া, চকিত হইয়া, বিলাসিনী জিজ্ঞাসিলেন, কিঙ্কর। এ কথা কে বলিল। কিঙ্কর কহিল, কেন, আমার প্রভু বলিলেন; তিনি কহিলেন, আমার বাটী কোথায়, আমার স্ত্রী কোথায়, আমি কবে কাহাকে বিবাহ করিয়াছি যে কথায় কথায় আমার স্ত্রীর উল্লেখ করিতেছিস্। অবশেষে, কি কারণে বলিতে পারি না, ক্রোধে অন্ধ হইয়া, আমায় প্রহার করিলেন। এই বলিয়া, সে স্বীয় কর্ণমূলে মুষ্টিপ্রহারের চিহ্ন দেখাইতে লাগিল। চন্দ্র প্রভা কহিলেন, তুমি পুনরায় যাও, এবং যেরূপে পার, তাঁহারে অবিলম্বে গৃহে লইয়া আইস। সে কহিল, আমি পুনরায় যাইব এবং পুনরায় মার খাইয়া গৃহে আসিব। বলিতে কি, আমি আর মার খাইতে পারিব না; আপনি আর কাহাকেও পাঠাইয় দেন। শুনিয়া, সাতিশয় কুপিত হইয়া, চন্দ্র প্রভা কহিলেন, যদি তুমি না যাও, আমি তোমায় বিলক্ষণ শিক্ষা দিব; যদি ভাল চাও, এখনই চলিয়া যাও। কিঙ্কর কহিল, আপনি প্রহার করিয়া এখান হইতে তাড়াইবেন, তিনি প্রহার করিয়া সেখান হইতে তাড়াইবেন; আমার উভয় সঙ্কট, কোনও দিকেই নিস্তার নাই।

এই বলিয়া সে চলিয়া গেলে পর, চন্দ্রপ্রভা ঈর্য্যাকষায়িত লোচনে সরোষ বচনে কহিতে লাগিলেন, বিলাসিনি! তোমার ভগিনীপতির কথা শুনিলে। এত ক্ষণ আমায় কত বুঝাইতেছিলে, এখন কি বল। শুনিলে ত, তাঁহার বাটী নাই, তাঁহার স্ত্রী নাই, তিনি বিবাহ করেন নাই। আমি কিঙ্করকে পাঠাইয়াছিলাম, অকারণে তাহাকে প্রহার করা আমার উপর অবজ্ঞা প্রদর্শন মাত্র। আমি ইদানীং তাহার চক্ষের শূল হইয়াছি। আমরা তাঁহার প্রতীক্ষায় এত বেলা পর্য্যন্ত অনাহারে রহিয়াছি, তিনি অন্যত্র আমোদ আহ্বাদে কাল কাটাইতেছেন। তুমি যা বল, এখন তাঁর উপর আমার বিলক্ষণ সন্দেহ হয়। আমি তার নিকট কি অপরাধে অপরাধিনী হইয়াছি, বলিতে পারি না। আমি কিছু তত রূপহীন বা গুণহীন নই যে, তিনি আমায় এত ঘৃণা করিতে পারেন। অথবা কার দোষ দিব, সকলই আমার অদৃষ্ট্রের দোষ।

ভগিনীর ভাব দর্শন করিয়া, বিলাসিনী কহিলেন, দিদি! ঈর্ষ্যা স্ত্রীলোকের অতি বিষম শত্রু; ঈর্ষ্যার বশবর্ত্তিনী হইলে, স্ত্রীজাতিকে যাবজ্জীবন দুঃখভাগিনী হইতে হয়; অতএব এরূপ শক্রকে অন্তঃকরণ হইতে একবারে অপসারিত কর। এই কথা শুনিয়া, যার পর নাই বিরক্ত হইয়া, চন্দ্র প্রভা কহিলেন, বিলাসিনি! ক্ষমা কর, আর তোমার আমায় বুঝাইতে হইবেক না; এত অত্যাচার সহ করা আমার কর্ম্ম নয়। আমি তত নিরভিমান হইতে পারিব না যে, তাহার এরূপ আচরণ দেখিয়াও, আমার মনে অসুখ জন্মিবেক ন। ভাল, বল দেখি; যদি আমার প্রতি পূর্ব্বের মত অনুরাগ থাকিত, তিনি কি এত ক্ষণ গৃহে আসিতেন না; না, অকারণে কিঙ্করকে প্রহার করিয়া বিদায় করিতেন। তুমি ত জান, আজ কত দিন হইল, আমায় এক ছড়া হার গড়াইয়া দিবেন, বলিয়াছিলেন; সেই অবধি আর কখনও তাঁহার মুখে হারের কথা শুনিয়াছ। বলিতে কি, এত হতাদর হইয়া বাঁচা অপেক্ষা মরা ভাল। যেরূপ হইয়াছে, এবং উত্তরোত্তর যেরূপ হইবেক, তাহাতে আমার অদৃষ্টে কত কষ্টভোগ আছে, বলিতে পারি না।

হেমকুটের চিরঞ্জীব, আকুল হৃদয়ে পান্থনিবাসে উপস্থিত হইয়া, তথাকার অধ্যক্ষকে কিঙ্করের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন, তিনি কহিলেন, প্রায় চরি দণ্ড হইল, সে এখানে আসিয়াছে। এবং আপনি তাহার হস্তে যে স্বর্ণমুদ্রা দিয়াছিলেন, তাহা সিন্ধুকে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে। পরে, অনেক ক্ষণ প্রতীক্ষা করিয়া, বিলম্ব দেখিয়া, সে এইমাত্র আপনকার অন্বেষণে গেল। এই কথা শুনিয়া, সংশয়ারূঢ় হইয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, অধ্যক্ষ যেরূপ বলিলেন, তাহাতে আমি স্বর্ণমুদ্রা সহিত কিঙ্করকে আপণ হইতে বিদায় করিলে পর, তাহার সহিত আমার আর সাক্ষাৎ বা কথোপকথন হওয়া সম্ভব নহে। কিন্তু আমি তাহার সহিত কথোপকথন করিয়াছি, এবং অবশেষে প্রহার পর্য্যন্ত করিয়া তাড়াইয়া দিয়াছি। অধ্যক্ষ বলিতেছেন, সে এইমাত্র পান্থনিবাস হইতে নির্গত হইয়াছে; এ কিরূপ হইল, কিছুই বুঝিতে পারিতেছি ন। মনোমধ্যে এই আন্দোলন করিতেছেন, এমন সময়ে হেমকুটের কিঙ্কর তাঁহার সন্নিহিত হইল।

তাহাকে দেখিতে পাইবামাত্র, চিরঞ্জীব জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন কিঙ্কর! তোমার পরিহাসপ্রবৃত্তি নিবৃত্তি পাইয়াছে, অথবা সেইরূপই রহিয়াছে। তুমি মার খাইতে বড় ভাল বাস, অতএব আমার ইচ্ছা, তুমি আর খানিক আমার সঙ্গে পরিহাস কর। কেমন, আজ আমি তোমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দি নাই, তোমার কর্ত্রী ঠাকুরাণী আমায় লইয়া যাইবার জন্য পাঠাইয়াছেন, জয়স্থলে আমার বাস। তোমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে; নতুবা, পাগলের মত আমার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে না। কিঙ্কর শুনিয়া চকিত হইয়া কহিল, সে কি মহাশয়! আমি কখন আপনকার নিকট ও সকল কথা বলিলাম। চিরঞ্জীব কহিলেন, কিছু পূর্ব্বে, বোধ হয় এখনও আধ ঘণ্টা হয় নাই। কিঙ্কর বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া কহিল, আপনি স্বর্ণমুদ্রার থলী আমার হস্তে দিয়া এখানে পাঠাইলে পর, কই আপনকার সঙ্গে ত আর আমার দেখা হয় নাই। চিরঞ্জীব অত্যন্ত কুপিত হইয়া কহিলেন,দুরাত্মন‌! আর আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই, বটে; তুমি বারংবার বলিতে লাগিলে, আপনি আমার হস্তে স্বর্ণমুদ্রা দেন নাই, কর্ত্রী ঠাকুরাণী আপনাকে লইয়া যাইতে পাঠাইয়াছেন, তিনি ও তাহার ভগিনী আপনকার অপেক্ষায় আহার করিতে পারিতেছেন না। পরিশেষে, সাতিশয় রোষাক্রান্ত হইয়া আমি তোমায় প্রহার করিলাম।

এই সমস্ত কথা শুনিয়া, হতবুদ্ধি হইয়া, কিঙ্কর কিয়ং ক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; অবশেষে, চিরঞ্জীব কৌতুক করিতেছেন বিবেচনা করিয়া কহিল, মহাশয়! এত দিনের পর, আপনকার যে পরিহাসে প্রবৃত্তি হইয়াছে, ইহাতে আমি অত্যন্ত আহ্লাদিত হইলাম; কিন্তু, এ সময়ে এরূপ পরিহাস করিতেছেন কেন, তাহার মর্ম্ম বুঝিতে পারিতেছি না; অনুগ্রহ করিয়া তাহার কারণ বলিলে, আমার সন্দেহ দূর হয়। চিরঞ্জীব কহিলেন, আমি পরিহাস করিতেছি, না তুমি পরিহাস করিতেছ; আজ তোমার দুর্ম্মতি ঘটিয়াছে; তখন যৎপরোনাস্তি বিরক্ত করিয়াছ, এখন আবার বলিতেছ, আমি পরিহাস করিতেছি। এই তোমার দুর্ম্মতির ফল ভোগ কর। এই বলিয়া, তিনি তাহাকে ক্রোধভরে বিলক্ষণ প্রহার করিলেন।

এইরূপে প্রহার প্রাপ্ত হইয়া, কিঙ্কর কহিল, আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে আপনি আমায় এত প্রহার করিলেন। চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার কোনও অপরাধ নাই; সকল অপরাধ আমার। ভূত্যের সহিত প্রভুর যেরূপ ব্যবহার করা উচিত, তাহা না করিয়া, আমি যে তোমার সঙ্গে সৌহৃদ্যভাবে কথা কই, এবং সময়ে সময়ে তোমার পরিহাস শুনিতে ভাল বাসি, তাহাতেই তোমার এত আস্পর্দ্ধা বাড়িয়াছে। তোমার সময় অসময় বিবেচনা নাই। যদি আমার নিকট পরিহাস করিবার ইচ্ছা থাকে, আমি কখন কি ভাবে থাকি, তাহা জান ও তদনুসারে চলিতে আরম্ভ কর, নতুবা প্রহার দ্বারা তোমার পরিহাসরোগের শান্তি করিব। কিঙ্কর কহিল, আপনি প্রভু, প্রহার করিলেন, করুন; আমি দাস, অনায়াসে সহ করিলাম; কিন্তু কি কারণে প্রহার করিলেন, তাহা না বলিলে, কিছুতেই ছাড়িব নাই। চিরঞ্জীব, এই সময়ে, দুটি ভদ্র স্ত্রীলোককে তাঁহার দিকে আসিতে দেখিয়া, কহিলেন, আরে নির্ব্বোধ! স্থির হও, এখন আর ও সকল কথা কহিও না; দুটি ভদ্রবংশের স্ত্রীলোক, বোধ হয়, আমার নিকটেই আসিতেছেন।

জয়স্থলের কিঙ্কর সত্বর প্রতিগমন না করাতে, চন্দ্রপ্রভা, নিতান্ত অধৈর্য্য হইয়া, ভগিনীকে সমভিব্যাহারে লইয়া, স্বীয় পতি চিরঞ্জীবের অন্বেষণে নির্গত হইয়াছিলেন। ইতস্ততঃ অনেক অনুসন্ধান করিয়া, পরিশেষে পান্থনিবাসে উপস্থিত হইয়া, তিনি হেমকুটের চিরঞ্জীব ও কিঙ্করকে দেখিতে পাইলেন, এবং তাহাদিগকে জয়স্থলের চিরঞ্জীব ও কিঙ্কর স্থির করিয়া, নিকটবর্ত্তিনী হইলেন। হেমকুটের চিরঞ্জীব, ইতিপূর্ব্বেই, স্বীয় ভূত্য কিঙ্করের উপর অত্যন্ত কোপান্বিত হইয়াছিলেন; এক্ষণে বিলক্ষণ যত্ন পাইলেন, তথাপি তদীয় উগ্রভাবের একবারে তিরোভাব হইল না। চন্দ্রপ্রভা, তাঁহার মুখের দিকে দৃষ্টি সঞ্চারণ করিয়া, অভিমানভরে কহিতে লাগিলেন, নাথ! আমায় দেখিলেই তোমার ভাবান্তর উপস্থিত হয়; তোমার বদনে রোষ ও অসন্তোষ বিলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে। যাহারে দেখিলে সুখোদয় হয়, তাহার নিকটে কিছু এ ভাব অবলম্বন কর না। আমি এখন আর সে চন্দ্রপ্রভা নই; তোমার পরিণীতা বনিতাও নই। পূর্ব্বে, আমি কথা কহিলে, তোমার কর্ণে অমৃতবর্ষণ হইত; আমি দৃষ্টিপাত করিলে, তোমার নয়নযুগল প্রীতিরসে পরিপূর্ণ হইত; আমি স্পর্শ করিলে, তোমার সর্ব্ব শরীর পুলকিত হইত; আমি হস্তে করিয়া না দিলে, উপাদেয় আহারসামগ্রীও তোমার সুস্বাদ বোধ হইত না। তখন আমা বই আর জানিতে না। আমি ক্ষণ কাল নয়নের অন্তরাল হইলে, দশ দিক শূন্য দেখিতে। এখন সে সব দিন গত হইয়াছে। কি কারণে এই বিসদৃশ ভাবান্তর উপস্থিত হইল, বল। আমার নিতান্ত তোমাগত প্রাণ; তুমি বই এ সংসারে আমার আর কে আছে। তুমি এত নিদয় হইলে, আমি কেমন করিয়া প্রাণ ধারণ করিব। বিলাসিনীকে জিজ্ঞাসা কর, ইদানীং আমি কেমন মনের সুখে আছি। দুর্ভাবনায় শরীর শীর্ণ হইয়া যাইতেছে। আমি স্পষ্ট দেখিতেছি, আমার উপর তোমার আর সে অনুরাগ নাই। যাহার ভাগ্য ভাল, এখন সে তোমার অনুরাগভাজন হইয়াছে। আমি দেখিয়া শুনিয়া জীবন্মৃত হইয়া আছি। দেখ, আর নিদয় হইও না, আমায় মর্ম্মান্তিক যাতনা দিও না। বিবেচনা কর, কেবল আমিই যে যন্ত্রণা ভোগ করিব, এরূপ নহে; এ সকল কথা ব্যক্ত হইলে, তুমিও ভদ্রসমাজে হেয় হইবে। চন্দ্রপ্রভার আক্ষেপ ও অনুযোগ শ্রবণ করিয়া, হেমকুট বাসী চিরঞ্জীব হতবুদ্ধি হইলেন, এবং কি কারণে অপরিচিত ব্যক্তিকে পতি সম্ভাষণ, ও পতিকৃত অনুচিত আচরণের আরোপণ পূর্ব্বক ভৎসন, করিতেছে, কিছুই নির্ণয় করিতে না পারিয়া, স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, কিছু বলা আবশ্বক, নিতান্ত মৌনাবলম্বন করিয়া থাকা বিধেয় নহে, এই বিবেচনা করিয়া, তিনি বিস্ময়াকুল লোচনে মৃদু বচনে কহিলেন, অয়ি বরবর্ণিনি! আমি বৈদেশিক ব্যক্তি, জয়স্থলে আমার বাস নয়; এই সর্ব্বপ্রথম এ স্থানে আসিয়াছি, তাহাও চারি পাঁচ দণ্ডের অধিক নহে। ইহার পূর্ব্বে, আমি আর কখনও তোমায় দেখি নাই। তুমি আমায় লক্ষ্য করিয়া যে সকল কথা বলিলে, তাহার এক বর্ণও বুঝিতে পারিলাম না। বিলাসিনী শুনিয়া, আশ্চর্য্য জ্ঞান করিয়া, কহিলেন, ও কি হে, তুমি যে আমায় একবারে অবাক করিয়া দিলে; হঠাৎ তোমার মনের ভাব এত, বিপরীত হইল কেন। যা হউক ভাই! ইতিপূর্ব্বে, আর কখনও দিদির উপর তোমার এ ভাব দেখি নাই। দিদির অপরাধ কি, আহারের সময় বহিয়া যায়, এজন্য কিঙ্করকে তোমায় ডাকিতে পাঠাইয়াছিলেন।

এই কথা বলিবামাত্র, চিরঞ্জীব কহিলেন, কিঙ্করকে! কিঙ্করও চকিত হইয়া কহিল, কি আমাকে! তখন চন্দ্রপ্রভা কোপাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, হাঁ তোমাকে। তুমি উহার নিকট হইতে ফিরিয়া গিয়া বলিলে, তিনি প্রহার করিলেন; বলিলেন, আমার বাটী নাই, আমার স্ত্রী নাই। এখন আবার, যেন কিছুই জান না, এইরূপ ভান করিতেছ। চিরঞ্জীব শুনিয়া, ঈষৎ কুপিত হইয়া, কিঙ্করকে জিজ্ঞাসিলেন, তুমি কি এই স্ত্রীলোকের সহিত কথোপকথন করিয়াছিলে। সে কহিল, না মহাশয়! আমি উহার সঙ্গে কখন কথা কহিলাম; কথা কহা দূরে থাকুক, ইহার পূর্ব্বে আমি উহারে কখনও দেখি নাই। চিরঞ্জীব কহিলেন, দুরাত্মন্‌! তুমি মিথ্যা বলিতেছ; উনি যে সকল কথা বলিতেছেন, তুমি আপণে গিয়া আমার নিকট অবিকল ঐ কথাগুলি বলিয়াছিলে। সে কহিল, না মহাশয়। আমি কখনও বলি নাই; জন্মাবচ্ছিন্নে আমি উঁহার সহিত কথা কই নাই। চিরঞ্জীব কহিলেন, তোমার সঙ্গে যদি দেখা ও কথা না হইবে, উনি কেমন করিয়া আমাদের নাম জানিলেন।

হেমকূটবাসী চিরঞ্জীবের ও কিঙ্করের কথোপকথন শুনিয়া, চন্দ্রপ্রভা যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ হইলেন, এবং চিরঞ্জীবকে, স্বীয় পতি জয়স্থলবাসী চিরঞ্জীব জ্ঞানে সম্ভাষণ করিয়া, আক্ষেপ বচনে কহিতে লাগিলেন, নাথ! যদিই আমার উপর বিরাগ জন্মিয়া থাকে, চাকরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করিয়া, এরূপে অপমান করা উচিত নহে। আমি কি অপরাধ করিয়াছি যে এরূপ ছল করিয়া আমার এত লাঞ্ছনা করিতেছ। তুমি কখনই আমায় পরিত্যাগ করিতে পারিবে না। তুমি যা ভাব না কেন, আমি তোম। বই আর জানি না; যাবৎ এ দেহে প্রাণ থাকিবেক, তাবৎ আমি তোমার বই আর কারও নই। আমি জীবিত থাকিতে, তুমি কখনও অন্যের হইতে পারিবে না। তুমি দিবাকর, আমি কমলিনী; তুমি শশধর, আমি কুমুদিনী; তুমি জলধর, আমি সৌদামিনী। তুমি পরিত্যাগ করিতে চাহিলেও, আমি তোমায় ছাড়িব না। অতএব, আর কেন, গৃহে চল; কেন অনর্থক লোক হাসাইবে, বল।

এই সকল কথা শুনিয়া, চিরঞ্জীব মনে মনে কহিতে লাগিলেন, এ কি দায় উপস্থিত! কেহ কখনও এমন বিপদে পড়ে না। এ ত পতিজ্ঞানে আমায় সম্ভাষণ করিতেছে। যেরূপ ভাবভঙ্গী দেখিতেছি, তাহাতে বৈদেশিক লোক পাইয়। পরিহাস করিতেছে, সেরূপও প্রতীতি হইতেছে না। আকার প্রকার দেখিয়া স্পষ্ট বোধ হইতেছে, এ সম্ভ্রান্ত লোকের কন্যা, সামান্যা কামিনী নহে। আমি নিতান্ত অপরিচিত বৈদেশিক ব্যক্তি, আমাকে পতিজ্ঞানে সম্ভাষণ করে কেন। আমি কি নিদ্রিত অবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছি; অথবা, ভূতাবেশ বশতঃ আমার বুদ্ধিভ্রংশ ঘটিয়াছে, তাহাতেই এরূপ দেখিতেছি ও শুনিতেছি। যাহা হউক, কোনও অনির্ণীত হেতু বশতঃ, আমার দর্শনশক্তির ও শ্রবণশক্তির সম্পূর্ণ বৈলক্ষণ্য ঘটিয়াছে, তাহার কিছুমাত্র সংশয় নাই। এখন কি উপায়ে এ দায় হইতে নিষ্কৃতি পাই।

এই সময়ে বিলাসিনী কিঙ্করকে কহিলেন, তুমি সত্বর বাটীতে গিয়া ভূত্যদিগকে সমস্ত প্রস্তুত করিতে বল, আমরা যাইবামাত্র আহার করিতে বসিব। তখন কিঙ্কর, চিরঞ্জীবের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া, অস্থির লোচনে আকুল বচনে কহিতে লাগিল, মহাশয়। আপনি সবিশেষ না জানিয়া কোথায় আসিয়াছেন। এ বড় সহজ স্থান নহে। এখানকার সকলই মায়া, সকলই ইন্দ্রজাল। আমরা সহজে নিষ্কৃতি পাইব, বোধ হয় না। যে রঙ্গ দেখিতেছি, প্রাণ বাচাইয়া দেশে যাইব, আমার আর সে আশা নাই। এই মানবরূপিণী ঠাকুরাণীরা যেরূপ মায়াবিনী, তাহাতে ইহাদের হস্ত হইতে সহজে নিস্তার পাইব, মনে করিবেন না। কি অশুভ ক্ষণেই এ দেশে পদাপর্ণ করিয়াছিলেন। যেরূপ দেখিতেছি, ইঁহাদের মতের অনুবর্ত্তী হইয়া না চলিলে, নিঃসংশয় প্রাণসংশয় ঘটিবেক। অতএব যাহা কর্ত্তব্য হয়, বিবেচনা করুন। কিঙ্করের এই সকল কথা শুনিয়া, অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া, বিলাসিনী কহিলেন, অহে কিঙ্কর! তোমায় পরিহাসের অনেক কৌশল আইসে, তা আমরা বহু দিন অবধি জানি; আর তোমার সে বিষয়ে নৈপুণ্য দেখাইতে হইবেক না; আমরা বড় আপ্যাষিত হইয়াছি। এক্ষণে ক্ষান্ত হও; যা বলি, তা শুন। শুনিয়া সাতিশয় শঙ্কিত হইয়া, কিঙ্কর চিরঞ্জীবকে কহিল, মহাশয়। আমার বুদ্ধিলোপ হইরাছে, এখন কি করিবেন, করুন। চিরঞ্জীব কহিলেন, কেবল তোমার নয়, আমিও দেখিয়া শুনিয়া, তোমার মত, হতবুদ্ধি হইয়াছি। তখন চন্দ্রপ্রভা, চিরঞ্জীবের হস্তে ধরিয়া, আর কেন, গৃহে চল; চাকর মনিবে মন্ত্রণা করিয়া, আজ আমার যথেষ্ট লাঞ্ছনা করিলে। সময় অতীত হইয়া গিয়াছে, আর বিলম্বে কাজ নাই। তিনি তাঁহাকে এই বলিয়া বলপূর্ব্বক গৃহে লইয়া চলিলেন। চিরঞ্জীব, অয়স্কান্তে আকৃষ্ট লৌহের ন্যায়, নিতান্ত অনায়ত্ত হইয়া, আপত্তি বা অনিচ্ছাপ্রদর্শন করিতে পারিলেন না। কিয়ৎ ক্ষণ পরে, বাটীতে উপস্থিত হইয়া, চন্দ্রপ্রভা কিরুকে কহিলেন, দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখ, যদি কেহ তোমার প্রভুর অনুসন্ধান করে, বলিবে, আজ তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে না; এবং যে কেন হউক না, কাহাকেও কোনও কারণে বাটীতে প্রবেশ করিতে দিবে না। অনন্তর, চিরঞ্জীবকে কহিলেন, নাথ! আজ আমি তোমায় আর বাড়ীর বাহির হইতে দিব না; তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। চিরঞ্জীব, দেখিয়া শুনিয়া হতবুদ্ধি হইয়া, মনে মনে কহিতে লাগিলেন, আজ আমার অদৃষ্টে এ কি ঘটিল। আমি পৃথিবীতে আছি, কি স্বর্গে রহিয়াছি; নিদ্রিত আছি, কি জাগরিত রহিয়াছি; প্রকৃতিস্থ আছি, কি উন্মাদগ্রস্ত হইয়াছি; কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এক্ষণে কি করি; অথবা ইহাদের অভিপ্রায়ের অনুবর্ত্তী হইয়া চলি, ভাগ্য যাহা আছে, তাহাই ঘটিবেক। তাহাকে বাটীর অভ্যন্তরে যাইতে দেখিয়া, কিঙ্কর কহিল, মহাশয়! আমি কি দ্বারদেশে বসিয়া থাকিব। চিরঞ্জীব কোনও উত্তর দিলেন না। চন্দ্রপ্রভা কহিলেন, দেখিও যেন কেহ বাটীতে প্রবেশ করিতে না পায়। ইহার অন্যথা হইলে, আমি তোমার যৎপরোনাস্তি শাস্তি করিব। এই বলিয়া, চিরঞ্জীবকে লইয়া তিনি অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন।

Pages: 1 2 3 4 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *