০১-১০ অধ্যায়
প্রণাম করা উচিত নারায়ণ, নরোত্তম নর এবং দেবী সরস্বতাঁকে। ওঁদের জয়কীর্তন করা উচিত।
দেবতা ঈশানকে প্রণাম করা উচিত। তিনি নিখিল জগতের পতি, তিনি ধ্রুব, শাশ্বত এবং অবিনাশী। তিনিই মহাত্মা মহেশ্বর।
প্রণাম জানানো উচিত ব্রহ্মাকে। তিনিই সর্বজ্ঞ তিনি অপরাজিত লোকস্রষ্টা। তিনি সাধুশ্রেষ্ঠ, ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমানের নিয়ন্তা।
কেবলমাত্র সেই জ্ঞানবানই পুরাণ আখ্যান বিবৃত করতে পারেন যার মধ্যে নিম্নলিখিত সকল গুণের সমাহার ঘটে গেছে। যাঁর জ্ঞান ও বৈরাগ্য অতুলনীয়। যিনি স্থৈর্য সত্য করুণা ও ঐশ্বর্যের অধিকারী। যিনি লোকস্রষ্টা এবং লোকতত্ত্বজ্ঞ। এই বিশ্বের সকল প্রাণীকে যিনি সৃষ্টি করেন, যিনি এই নিখিল বিশ্বের সদাত্মক ও অসদাত্মক উভয় ভাবপদার্থেই সতত অবলোকন করেন, যাঁর মনে কখনও কোনো অবসাদ অসে না, যিনি যোগাবলম্বী এবং যোগী। সেই মতে আমি পুরাণ আখ্যান জানতে ইচ্ছুক। আমি জগৎপতি লোকসাক্ষী অজ এবং বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলাম।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ, ঋষিশ্রেষ্ঠ মহাত্মা বশিষ্ঠ, তাঁর পৌত্র অতি যশস্বী ঋষি জতুকর্ণ, পুণ্যাত্মা কৃষ্ণ-দ্বৈপায়নকে স্মরণ করে আমি বেদ সম্মত ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ কীর্তন করছি। এই পুরাণ শব্দ, অর্থ যুক্তি সমন্বিত এবং বিবিধ শাস্ত্রবাক্য ভূষিত।
একসময় অতুলতি ভূপতিশ্রেষ্ঠ রাজণ্যবৃন্দ এই ভূমণ্ডল শাসন করতেন। তখন সংযত আত্মা, সত্যব্রত পরায়ণ ঋষিরা বিশিষ্ট ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে পবিত্র দৃষদ্বতী নদীর তীরে দীর্ঘকাল ব্যাপী এক যজ্ঞ করেন। এই যজ্ঞে অংশ গ্রহণকারী ঋষিরা সবাই ছিলেন সরল, রজঃগুণ শূন্য এবং মাৎসর্য্য দোষ বর্জিত।
সেই ঋষিরা ছিলেন যথাশাস্ত্র দীক্ষিত নৈমিষারণ্যবাসী। তাদের দেখবার জন্য পৌরাণিক প্রবর মহাবুদ্ধি সূত ওই স্থানে সমাগত হয়ে অশ্রুতপূর্ব বক্তৃতার দ্বারা শ্রোতাদের রোমরাজি হর্ষিত করেছিলেন।
এই কাজের জন্যই পরবর্তীকালে ‘রোমহর্ষণ’ নামে তিনি এই পৃথিবীতে প্রশংসিত হন।
রোমহর্ষণ ছিলেন ধীমান বেদব্যাসের শিষ্য। তিনি তপস্যশ্রুতি, সদাচারনিমি ও মেধাবী রূপে ত্রিলোক বিখ্যাত ছিলেন। নিখিল পুরাণ ও বেদ তার অধিগত ছিল। ভূতলে উগত ওষধির মতোই তাঁর পরিভাষা।
সেই ন্যায়বিদ সুত কুরুক্ষেত্র প্রান্তে যজ্ঞাসীন ন্যায়-বুদ্ধি সম্পন্ন সেইসব মুনি পুঙ্গবদের কাছে গেলেন। করজোড়ে তাঁদের প্রণাম করলেন। এইভাবেই তিনি ঐ ঋষিশ্রেষ্ঠদের যথাযোগ্য আপ্যায়িত করার চেষ্টা করলেন। প্রত্যুত্তরে যজ্ঞদীক্ষিত ঋষিবৃন্দরাও মহাত্মা সূতের প্রতি প্রীত হয়ে তাঁকে যথাবিহিত শ্রদ্ধা ও পূজা নিবেদন করলেন।
সমীপে অতি বিশ্বস্ত বিদ্বান ও সত্যনিষ্ঠা সূতকে দেখে সেই ঋষিদের অন্তর পুরাণ কথা শ্রবণের ইচ্ছায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সেই সময় ঐ দীর্ঘকালব্যাপী যজ্ঞস্থলে উপস্থিত ছিলেন সর্বশাস্ত্র শৌনক। তিনি ইঙ্গিত দ্বারা মুনিবৃন্দের অভিপ্রায় বুঝতে পারলেন। এবং সূতকে পুরাণ ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত করতে সচেষ্ট হলেন। বিনয় সহকারে সূতকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, সূত তুমি ইতিহাস পুরাণে কৌতূহলী হয়ে মহাবুদ্ধি ব্রহ্মাণ্ড শ্রেষ্ঠ ভগবান শ্রীশ্রীব্যাসদেবকে উত্তমরূপে উপাসনা করেছিলেন। অতীতেও তুমি তাঁর পুরাণ আশ্রয়ী মতিকে দোহন করেছিলে। এই মুহূর্তে তোমার থেকে অধিক পূরাণ ব্যাখ্যা কেউ জানে না। হে মহাবুদ্ধি সূত, এই ধীমান ঋষি প্রবরেরা তোমার কণ্ঠে পুরাণ শুনতে অভিলাষ করছেন। অতএব হে মহৎ প্রাণ, তোমার উচিত এঁদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে সেই পুরাণ অখ্যান শোনানো।
আজ এই পবিত্র প্রান্তরে এইসব বিভিন্ন গোত্রীয় ব্রহ্মবাদী মহাত্মারা সপুত্র সমাগত হয়েছেন, তুমি এঁদের পুরাণ কথা শ্রবণ করাও। এঁরা পুরাণের মাধ্যমে নিজ নিজ বংশাবলি শ্রবণ করুন। বিশেষত এই কারণেই এই দীর্ঘকালব্যাপী সত্ৰ যজ্ঞ সমাপ্ত হবার আগেই আমরা তোমাকে স্মরণ করেছি।
শৌনকের মুখে এই প্রশংসাবাক্য শুনে সূত বিশেষ প্রীত হলেন। সত্যব্রত পরায়ণ পুরাণজ্ঞ ঋষিদের সমীপে পুরাণ ব্যাখ্যায় প্রেরণা পেলেন। শৌনকের আহ্বানের উত্তরে শুভ ভাষণে সূত বললেন, হে দেবগণ, ঋষিগণ, অমিততেজা রাজন্যবৃন্দ, শ্রুতি নির্দিষ্ট মহাত্মাবৃন্দ এবং ইতিহাস পুরাণে যাঁরা ব্রহ্মবাদী ঋষি বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন, তাঁদের সকলকে আমি প্রণাম জানাই। এঁদের সমীপে পুরাণ ব্যাখায় আমি গর্বিত। কারণ এঁদের বংশাবলি স্মরণে রাখা সজ্জন নির্দিষ্ট স্বধর্ম।
আপনারা নিশ্চয়ই অবহিত যে, বেদে সূতের কোন অধিকার নেই।
এক সময় বেনপুত্র মহাত্মা পৃথু যখন যজ্ঞ করছিলেন তখন সেই যজ্ঞে সূত জাতীয় রমণীর গর্ভে প্রথম বর্ণবিকৃত সূতের আবির্ভাব ঘটে। ভ্রমবশত সেই যজ্ঞে ইন্দ্রের হবির সাথে বৃহস্পতির হবির মিশ্রণ ঘটে যায় আর সেই মিশ্রিত হবি দেবেন্দ্রের উদ্দেশ্যে আহুত হয়, এর পরেই সূত জন্মলাভ করে।
শিষ্যের হবির সাথে গুরুর হবি মিশ্রিত হয়েছিল। অর্থাৎ উত্তম-অধমের মিশ্রণ ঘটেছিল। সেই কারণেই বর্ণ-বিকৃত সূতের উদ্ভব হয়। যদিও এই গর্হিত কর্মের প্রায়শ্চিত্ত বিধান করা হয়েছিল।
ক্ষত্রিয়ের ঔরসে ব্রাহ্মণনিকৃষ্ট যোনিতে সূতের জন্ম হয়। তাই পূর্বের স্বধর্মে সূতের তুল্য ধর্মই উল্লিখিত হয়েছে। সেই কারণেই ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যার মাধ্যমেই সূত তাঁর জীবিকা অর্জন করে থাকেন। এছাড়া রথ, হস্তী, অশ্বাদি চালনাও সূতের নিকৃষ্ট ধর্ম রূপে নির্ধারিত হয়েছে।
সুতরাং এক্ষণে আমি আমার স্বধর্মে পুরাণ পাঠ করব। আপনাদের মতো ব্রহ্মবাদিদের নির্দেশে ঋষিস্তুত পুরাণ পাঠ অমার অবশ্য কর্তব্য।
পিতৃগণের বাসবী নামে এক মানসী কন্যা ছিল। একবার ক্রোধবশত সেই কন্যাকে পিতৃগণ মৎস্যযোনিতে জন্মাবার জন্য অভিশাপ দেন। অরণী যেমন অগ্নির জন্মের কারণ, তেমনভাবে এই ঘটনাও একটি হিতকারী কাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণ হল। মহাযোগী বেদজ্ঞ শ্রেষ্ঠ ব্যাস সেই মৎস্যযযানিগতা বাসবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করলেন। আমি এক্ষণে সেই বিধাতৃরূপ ভগবান ব্যাসদেবকে প্রণাম করি। তিনি পুরাণ পুরুষ। বাহ্য এবং অভ্যন্তরে উভয় স্থলে তার নিবাস। তিনি মনুষ্যরূপে বিষ্ণুরূপধারী প্রভু বিষ্ণু। তার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মসহ সাঙ্গবেদ জাতুকর্ণের কাছ থেকে তার কাছে উপস্থিত হয়েছিল। শ্রুতির সাগর থেকে মতির মন্থন চালিত করে মনুষ্যলোকে মহাভারত চন্দ্রমাকে তিনিই প্রকাশ করেছিলেন। ভূমিগুণ এবং কালগুণ লাভ করে বৃক্ষ যেমন বহু শাখায় বিস্তৃত হয়, তেমন ভাবেই বেদবৃক্ষ তাকে লাভ করে বহু শাখায় বিকশিত হয়েছিল।
আমি সেই সর্বজ্ঞ, সর্ববেদপূজিত, দীপ্ততেজা, ব্রহ্মবাদী ব্যাসদেবের কাছ থেকেই পুরাণ কথা শ্রবণ করেছিলাম। এক্ষণে সেই শ্রুত বাণীই আপনাদের কাছে কীর্তন করব। পূর্বকালে নৈমিষারণ্যবাসী মুনিগণের আহ্বানে মহাপ্রাণ বায়ু তাদেরকেও এই পুরাণকথা বলেছিলেন।
এই পুরাণে নিশ্চিত হয়েছে যে মহেশ্বর হলেন স্বয়ম্ভু, পরম অব্যক্ত, চতুবাহু, চতুর্মুখ অচিন্ত্য, অপ্রমেয় এবং হেতু ভূত। যিনি ঈশ্বর তার থেকে মহেদাদি বিশেষ পর্যন্ত অব্যক্ত নিত্য সদাসদাত্মক কারণের সৃষ্টি ঘটেছে। আর এর ফলে হে হিরন্ময় বস্তুটি আবির্ভূত হয়েছিল, তার আবরণ হল জল, জলের আবরণ তেজ, তেজের আবরণ বায়ু এবং বায়ু আকাশে আবৃত। এইভাবে আকাশ ভূতাদিতে আবৃত, ভূতাদি মহতে এবং মহান অব্যক্তে আবৃত বলে পুরাণে বর্ণিত হয়েছে। এরপর এতে ঋষিগণ নদী ও পর্বত সমূহের প্রাদুর্ভাব বর্ণিত হয়েছে। তারপর সমস্ত মন্বন্তর ও কল্পের বর্ণনা এবং ব্রহ্মক্ষত্র ও ব্রহ্মজন্মের কীর্তন করা হয়েছে।
তারপর বিবৃত করা হয়েছে কল্পসমূহের বৎসর বিভাগ, জগতের স্থাপন, হরির শয়ন, পৃথিবীর উদ্ধার, বর্ণাশ্রম বিভাগ অনুসারে নগরাদির সন্নিবেশ, বৃক্ষ ও গৃহস্থিত সিদ্ধদের বিনাশ, যোজন পরিমিত পথের বহু বিস্তৃত সঞ্চার, স্বর্গস্থানের বিভাজন, মর্ত্যলোকের ভূবিচরণশীল জীব, ওষধি, লতাদির কীর্তন এবং মর্ত্য লোকের অধিবাসীদের বৃক্ষ ও নারকীয় কীটত্ব প্রাপ্তির বর্ণনা করা হয়েছে। দেবতা ও ঋষিদের দুই প্রকার পথের নির্দেশ, অঙ্গাদি তনু প্রভৃতির সৃষ্টি ও ত্যাগ, এইসব কথাও পুরাণে কীর্তিত হয়েছে।
সব শাস্ত্রের মধ্যে ব্রহ্মা প্রথমে পুরাণ কথা ধারণ করেন। তার পর তার মুখগহ্বর থেকে বেদ, বেদাঙ্গ, ধর্মশাস্ত্র ও ব্রত নিয়মাদি নিঃসৃত হয়।
পুরাণে বর্ণিত হয়েছে পশু ও পুরুষনিচয়ের উদ্ভব ও বিনাশ কল্প পরিগ্রহ, ব্রহ্মা কর্তৃক নয়টি মানস সৃষ্টি, অতঃপর আরও তিনটি মানস সৃষ্টি, তার লোক-কল্পনা, তার অবয়ব সমূহ থেকে ধর্মাদির সমুদ্ভব প্রভৃতি কল্পারম্ভে বারবার দ্বাদশ প্রজা সৃষ্টির কথা, দুইটি কল্পের মধ্যবর্তী সময় ও তার প্রতি সন্ধি, তমোগুণের আবরণবশত ব্রহ্মা থেকে অধর্মের উদ্ভব, সেই ভাবে শতরূপার জন্ম, তারপর নিষ্পাপ, প্রিয়ব্রত, উত্তানপাদ, প্রসূতি এবং আকৃতি–যাঁদের ওপর লোক প্রতিষ্ঠা নির্ভর করছে। প্রজাপতি রুচির সংসর্গে আকৃতিতে মিথুন-উদ্ভব, প্রসূতির গর্ভে দক্ষের কন্যাদের জন্ম, অতঃপর শ্রদ্ধা প্রভৃতি দক্ষকন্যাদের গর্ভে মহাত্মাদের উৎপত্তি, সাত্বিক ধর্মের সুখপ্রদ সৃষ্টি–এসবের কীর্তন করা হয়েছে।
এছাড়াও অধর্মের সংসর্গে হিংসাতে অশুভ লক্ষণ, তামস সৃষ্টি, মহেশ্বর ও সতীর মিলনে প্রজা সৃষ্টি–এই দুটি বিষয়ও বর্ণিত হয়েছে। সেগুলি হল–মুক্তিকাক্ষী দ্বিজদের কাছে যোগনিধির যোগের বিষয়ে বলা, রুদ্রের প্রাদুর্ভাব, মহাভাগ্য ত্রিবৈদ্য কথা, এবং ব্রহ্মা ও নারায়ণের প্রকীর্তিত স্তোত্র। কথিত আছে, ব্রহ্মা ও নারায়ণের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবেশ ভগবান মহাত্মা ব্রহ্মার অঙ্গে আবির্ভূত হন। কিন্তু মহামনা রোদন করছিলেন বলে তিনি রুদ্র’ নামে পরিচিত হন। স্বয়ম্ভু যেভাবে রুদ্র প্রভৃতি আটটি নাম লাভ করেছিলেন আর সেই আটটি নামের দ্বারা যেভাবে চরাচরে পরিব্যপ্ত হয়েছিলেন, সেই সব বর্ণনাও এই গ্রন্থে আছে।
কীর্তিত হয়েছে ভৃগু প্রভৃতি ঋষিদের প্রজাসৃষ্টি বর্ণনা, ব্রহ্মজ্ঞানী বশিষ্টের গোত্রবর্ণন, অগ্নির থেকে স্বাহাগর্ভে প্রজা সৃষ্টি প্রভৃতি। এরপরে পিতৃবংশ প্রসঙ্গক্রমে মহেশ্বর ও স্বধা থেকে দ্বিবিধ পিতৃগণের উদ্ভব, সতীর জন্য দক্ষের প্রতি ধীসম্পন্ন ভৃগু প্রভৃতির অভিশাপ, রুদ্রের উদ্দেশ্যে অদ্ভুতকর্ম দক্ষের অভিশাপ, দোষদর্শনে বৈরিতা রোধ, বৈরপ্রতিষেধ এসবও কীর্তিত হয়েছে। এছাড়াও মন্বন্তর প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে। কালজ্ঞান, প্রজাপতি কদমের কন্যার গর্ভে প্রিয়ব্রতের পুত্রদের আগমন, ভিন্ন ভিন্ন দেশ ও দ্বীপাদিতে তাদের বাসনিয়োগ, তার স্বয়ম্ভুব সৃষ্টির অনুকীর্তন, মহাত্মা নাভি ও রজের সৃষ্টি, দ্বীপ সমুদ্র পর্বত সৃষ্টি প্রভৃতি। বর্ষ ও নদী ও তার সর্বপ্রকার বিভাজন, সহস্রবিধ দ্বীপ ভেদের মধ্যে সপ্ত প্রকার অন্তর্ভেদ, মণ্ডল ক্রমে জম্বুদ্বীপ ও সমুদ্রের বিস্তার, যোজন অনুসারে পর্বত বিভাজন এসবও কীর্তিত হয়েছে। এখানে হিমবান, হেমকূট, নিষধ, মেরু, নীল, শ্বেত ও শৃঙ্গবান–এই ধরনের কয়েকটি বর্ষ পর্বতের বর্ণনা আছে। এঁদের মধ্যে যাঁরা বিষ্কম্ভ, উচ্ছায়, আয়াম, বিস্তার এবং যোজনাগ্রে বাস করে থাকেন তাদের বিবরণও আছে। বিবরণ আছে নদী, পর্বত, ভূত, গতিশীল ধ্রুব প্রভৃতির সাথে উপনিবিষ্ট ভারতাদি বর্ষ, সপ্ত সমুদ্র পরিবৃত জম্বু প্রভৃতি দ্বীপ, জলমগ্ন দ্বীপ, লোকালোক প্রভৃতি বিষয়গুলিরও। অন্ত-অভ্যন্তরবর্তী এইসব লোক, সপ্তদ্বীপা পৃথিবী, প্রাকৃত আবরণসহ ভূরাদি লোক, তার পাশাপাশি সকলের একদেশিক পরিমাণ এবং ব্যাস পরিমাণ–এসবের কথাও বলা হয়েছে।
সূর্য, চন্দ্র, সমগ্র পৃথিবী, অত্যুন্নত পর্বত সমূহের যোজন প্রমাণ মানসশিখরের পুণ্য মহেন্দ্রাদি আবার এদেরও ওপরে অলাতচক্রতুল্য গতি, নাগবীথি অজবীথির লক্ষণ দুটি কাটা ও দুটি লেখা, মণ্ডল, যোজনা, লোকালোক, সন্ধ্যা, বিষয়ানুসারে দিন, ঊর্ধ্বস্থিত ও চতুর্দিকস্থিত লোকপাল, পিতৃলোক, দেবলোক, গৃহস্থ ও সন্ন্যাসীদের রজঃ ও সত্ত্বগুণাশ্রয় বশতঃ যথাক্রমে দক্ষিণপথ ও উত্তরপথে প্রাপ্তি, ধর্মাদি দ্বারা অবীষ্ঠিত বিষ্ণুপদ, ধ্রুব সামর্থ্যবলে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ ও জ্যোতিষ্ক পদার্থের সঞ্চার এবং তদনুসারে প্রজাদের শুভাশুভ, প্রয়োজন, বংশে স্বয়ং ব্রহ্মার নির্মিত সৌররথ–যার সাহায্যে স্বয়ং ভগবান স্বর্গে গমন করেন, আর যে রথে অধিষ্ঠান করেন দেবগণ, আদিত্যগণ ও ঋষিগণ–এসব কিছুর বর্ণনাও আছে।
এই একইভাবে একটি জলরথের কথাও উল্লিখিত হয়েছে। বলা হয়েছে ওই রথে থাকেন গন্ধর্ব, অপ্সরা, গ্রামণি, সর্প ও রাক্ষস। সূর্য হল চন্দ্রের হ্রাস-বৃদ্ধির কারণ, এমন কথাও বলা হয়েছে। সূর্যাদির স্যন্দন সমূহের ধ্রুব থেকে কীর্তন প্রসঙ্গেও আলোচনা আছে। আর আছে সেই শিশুমারের কথা, যার পুচ্ছে ধ্রুবের অবস্থান, গ্রহগণ সহ তারা-রূপী নক্ষত্ররাজি, পুণ্যকর্মা দেবগণের যেখানে নিবাস।
সূর্যের সহস্র রশ্মিতে বর্ষা, শীত ও উষ্ণের প্রস্রবণ, নাম ও অর্থভেদে রশ্মিসমূহের প্রবিভাগ এবং সূর্যের আশ্রয়ে গ্রহদের পরিমাণ ও গতিও ব্যক্ত হয়েছে।
বিষের প্রভাবে অচিরে মহাদেবের নীলত্ব প্রাপ্তি, ব্রহ্মা কর্তৃক প্রসাদিত শূলপানিশম্ভুর বিষাদ। দেবগণের দ্বারা স্তুিত হয়ে বিষ্ণু যেভাবে দেব মহেশ্বরের স্তব করেছিলেন, যার পুণ্য প্রভাবে সর্বপাপনাশী লিঙ্গের উৎপত্তি ঘটেছিল, সেই পুণ্যকথাও এখানে কীর্তিত হয়েছে।
বিশ্বরূপ থেকে যেভাবে প্রধানের অপূর্ব পরিমাণ ঘটে, ইলার পুত্র পরুরবার মাহাত্ম্য বর্ণন, দুই প্রকার পিতৃদেবের শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মহান অনুগ্রহ বিবৃত হয়েছে। যুগসংখ্যা ও কৃতযুগের প্রমাণ অপকর্য হেতু ত্রেতা যুগে বার্তা প্রবর্তন ধর্মানুসারে বর্ণ ও আশ্রমের সংস্থান, যজ্ঞ প্রবর্তনা, বসুর সাথে ঋষিদের কথোপকথন, বসুর পুনর্বার অধোগতি–এসবও কীর্তিত হয়েছে। স্বয়ম্ভ মনু সম্পর্কিত প্রশ্ন ভিন্ন অন্যান্য প্রশ্নের নিকৃষ্টতা, যাবতীয় যুগাবস্থা, দ্বাপর ও কলিযুগের বর্ণনাও আছে।
তবে যুগে যুগে দেব, তির্যক ও মনুষ্য প্রভৃতির প্রমাণ যুগ সামর্থ্য অনুসারে। নিণীত হয়েছে আয়ুর দীর্ঘতা ও উন্নতি, শিষ্ট ব্যক্তিদের আবির্ভাব, বেদ ও বেদজাত মন্ত্ররাজির কীর্তন, বেদব্যাস কথিত বেদের শাখা সমূহের পরিমাণ সমস্ত মন্বন্তরের সংহার এবং সংহার অন্তে আবার তাদের আবির্ভাব, দেবতা, ঋষি, মনু ও পিতৃগণের উদ্ভব এসব বিস্তারিতভাবে সাধ্যাতীত বলে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
মানুষ যে মন্বন্তরের সংখ্যা ও লক্ষণ নির্দেশ করেছে সকল মন্বন্তরের সেই লক্ষণ বর্তমানের সাথে অতীত ও অনাগত মন্বন্তরের লক্ষণ কীর্তন, মন্বন্তর সমূহের প্রতিপূরক লক্ষণ এবং স্বয়ম্ভুব মন্বন্তরের অতীত ও অনাগত মন্বন্তরের লক্ষণও বর্ণিত হয়েছে। মন্বন্তরক্ৰম কালজ্ঞান মন্বন্তরগুলিতে দেবগণ প্রজাধিপতিদের কীর্তন, ধীমান দক্ষের দ্বারা দৌহিত্র অর্থাৎ দক্ষের প্রিয় দুহিতার সন্ততিগণ এবং যাদের জনক ব্রহ্মাদি তাদের এবং মরুবাসী সাবন্যাদি মনুদের কীর্তনও এতে আছে।
উত্তানপাদের পুত্র ধ্রুবের প্রজাসৃষ্টি বর্ণন, বেনুপুত্র পৃথুর ভূমিদোহন প্রবর্তন, পাত্র দুগ্ধ ও বৎসগণের বর্ণনা, পুর্বে ব্রহ্মাদিরা যেভাবে এই বসুন্ধরাকে দোহন করেছিলেন তার বিবরণ আছে। আছে দশ প্রচেতা থেকে চন্দ্রের অংশে ধীমান প্রজাপতি দক্ষের জন্মবর্ণনা, মহেন্দ্রদের ভূত-ভবিষ্যৎ বর্তমানকালীন শক্তিকীর্তন। যেভাবে মনু প্রমুখরা বহুবিধ আখ্যানে পরিবৃত হবেন সে বিষয়ে কীর্তনও আছে। বৈবস্বত মনুর সৃষ্টিবিস্তার, যজ্ঞে ব্রহ্মশত্রু থেকে বারুণী মূর্তি ধরে মহাদেবের আবির্ভাব, ভৃগু প্রভৃতির উৎপত্তির কীৰ্ত্তন করা হয়েছে।
চাক্ষুষ মনুর শুভ প্রজা সৃষ্টি শেষ হলে বৈবস্বত মনুর সময়ে দক্ষ ধ্যান করে প্রজাসৃষ্টি করেছিলেন। ব্রহ্মার প্রিয় পুত্র প্রিয়সংবাদী নারদ সেই সব মহাবল দক্ষপুত্রকে অভিশাপ দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। এরপর দক্ষ বারণীর গর্ভে বিখ্যাত একাধিক কন্যা সৃষ্টি করেছিলেন, এসব কিছুর বর্ণনাই আছে।
ধীমান কাশ্যপের ধর্মসৃষ্টি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবের একত্ব, পৃথকত্ব ও বিশেষত্ব কীর্তিত হয়েছে। ঈশ্বর অর্থাৎ সব বিষয়ে সামর্থ্য থাকায় স্বায়ম্ভব কর্তৃক সপ্তদেবতার সৃষ্টি, মরুৎদের প্রতি দেবতাদের অনুগ্রহ, দেবতাদের অংশে দিতির সন্তানদের উদ্ভব, পিতৃগণের বাক্য অনুসারে এদের দেবত্ব এবং বায়ুস্কন্ধে আশ্রয় আবার দৈত্য দানব গন্ধর্ব, সর্প, রাক্ষস, সমস্ত ভূত-পিশাচ, পশুপক্ষী, লতা এবং অপ্সরাদের বহু বিস্তৃত উৎপত্তি বর্ণনা করা হয়েছে। সমুদ্রের সাথে সংযোগের ফলে কেমন করে ঐরাবত হস্তীর জন্ম হল, সেকথাও বলা হয়েছে। গরুড়ের উৎপত্তি ও অভিষেক, ভৃগু, অঙ্গিরাগণ, কশ্যপ, পুলস্ত্য, মহাত্মা, অত্রি, পরাশর মুনি প্রমুখের বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। তারপরেও দেবতা ও ঋষিদের প্রজাসৃষ্টি বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও কীর্তিত হয়েছে সেই তিন কন্যার কথা যাঁদের ওপরে লোকসমূহ প্রতিষ্ঠিত আছে। বর্ণিত আছে পিতৃদৌহিত্রে নির্দেশ এবং দেবতাদের জন্মকথা। এই পুরাণে কীর্তিত হয়েছে ভগবান পঞ্চ-এর সুমাহাত্ম্য, আদিত্যের বিস্তারিত বিবরণ, বিকুক্ষি চরিত্র, ধুন্ধুবিনাশ, ইক্ষবাকু প্রভৃতির সংক্ষিপ্ত চরিত্র কীর্তন, নিমি থেকে জহ্নগণ পর্যন্ত ক্ষিতিপতিদের বিবরণ। এছাড়া ভূপতি যযাতি, চরিত, যদু বংশ নির্দেশ, হৈহয় এবং ক্রোট রাজবংশের বর্ণনা, বিষ্ণুর দিব্যকথা, ধীমান বিবস্বানের মনিরথ, পুনর্জন্ম ও জীবনী, কংসের উৎপত্তি ও তার দৌরাত্ম্য, বসুদেব থেকে দেবকী গর্ভে প্রজাপতি বিষ্ণুর জন্ম থেকে শুরু করে বিষ্ণুর অভিশাপ লাভ সবই বিস্তারিত ভাবে কীর্তিত হয়েছে।
দৈত্যদের কাছ থেকে ভৃগু কীভাবে শত্ৰুজননীকে উদ্ধার করেছিলেন, দেব-অসুর কী প্রকারে দ্বাদশযুতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, সব কথাই এখানে বর্ণিত হয়েছে।
এছাড়া নরসিংহ প্রভৃতি প্রাণনাশক অবতার, ঘোর তপস্যার দ্বারা শক্রের মহাদেব আরাধনা, বর পাওয়ার লোভে শক্র কর্তৃক মহাদেবের স্তবকীর্তন, দেব-অসুরদের ক্রিয়াকলাপ, এ সবেরও বর্ণনা আছে।
বলা হয়ে থাকে মহাত্মা শত্রু যখন জয়ন্তীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন তখন বুদ্ধিমান বৃহস্পতি শক্রের রূপ ধারণ করে অসুরদের মোহিত করে তাদের বশীভূত করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে মহাদ্যুতি শত্রু তাকে অভিশাপ দেন। এই সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণও পুরাণে আছে। তারপর বিষ্ণুর মহাত্ম্য, বিষ্ণুর জন্মদি, শক্রের দৌহিত্র, দেবযানী যদুর পুত্র তুর্যস, আবার অনু, দ্রুহ্য, পুরু, যযাতি তনয়ের রাজকাজ এবং তাদের বংশে যেসব মহাপ্রাণ দীর্ঘ যশস্বী প্রচুর অর্থ তেজে তেজস্বী, শ্রেষ্ঠ তাঁদের কথা, এমনকি সেই শ্রেষ্ঠ রাজা বিপ্রঋষি কুশিকের সম্যক ধর্মাচরণ যার দ্বারা তিনি সুরভি বৃহস্পতির শাপ অপমোদন করেছিলেন সে-সবের বিবরণও আছে এই গ্রন্থে।
এই পুরাণে সন্নিবেশিত হয়েছে জহ্বংশের কীর্তন,শান্তনুর বীরত্ব,ভবিষ্যৎ রাজাদের বর্ণনা, অনাগত সপ্ত মনুর বর্ণনা, কলিযুগ অন্তে সকল সৃষ্টির সংহার প্রভৃতি। এরপর পরার্ধ ও পরের লক্ষণ, ব্রহ্মকর্তৃক সৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ডের যোজন অনুসারে পরিমাণ নির্দেশ,সকল প্রাণীর নৈমিত্তিক, প্রাকৃতিক ও আত্যন্তিক এই ত্রিবিযী প্রতি-সঞ্চার ভাস্কর থেকে অনাবৃষ্টি, ঘোর সম্বর্তক অগ্নি, মেঘ, একার্ণব, বায়ু, রাত্রি মহাত্মাদের ও ব্রহ্মার সংখ্যা এবং লক্ষণ, ভূপ্রকৃতি, সপ্তলোক প্রভৃতি ভীষণভাবে উপবর্ণিত হয়েছে।
এই গ্রন্থে আরও কীর্তিত হয়েছে বিভিন্ন পাপের জন্য নির্দিষ্ট রৌরবাদি নরক, ব্রহ্মলোকের ওপরে যে উত্তম শিবলোকের অধিষ্ঠান, যেখানে সমস্ত প্রাণী বিনাশের পর সংহার লাভ করে সেই সমস্ত প্রাণীর পরিমাণ নির্ণয়, ব্রহ্মার প্রতিটি সৃষ্টি ও বিনাশের বর্ণনা, অষ্ট প্রাণের অষ্ট রূপ বর্ণনা, ধর্ম ও অধর্মের আশ্রয়ে ঊর্ধ্বগতি এবং অধোগতি বর্ণনা, কল্পে কল্পে মহাভূতবৃন্দের সংহার, দুঃখের স্বরূপ বর্ণনা, ব্রহ্মার অনিত্যতা, ভোগ প্রবাহের দৌরাত্ম্য ও তার পরিমাণ নির্ণয়। মোক্ষের দুর্লভতা, বৈরাগ্যের ফলে সংসারের দোষ-দর্শন, নানা তত্ত্ব দর্শনের ফলে যে ব্রহ্মানিষ্ট সত্ত্ব পরিশুদ্ধি লাভ করেছে, ব্যক্ত ও অব্যক্ত পরিহার করে সেই ব্রহ্মানিষ্ট সত্ত্বে অধিষ্ঠান, ত্রিবিধ তাপের অতীত রূপহীন নিরঞ্জন অকুতোভয় ব্রহ্মানন্দ প্রভৃতি।
এই পুরাণ কীর্তিত হয়েছে ব্রহ্মার আগের মতো আবার ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি, সর্বাপাপনাশী ঋষিবংশ সম্পর্কিত আলোচনা, পুরাণের উদ্দেশ্যে, নিখিল জগতের প্রলয় বিকার, আর প্রাণীদের প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তির ফল।
এখানে বশিষ্টের প্রাদুর্ভাব, শক্তির জন্ম, বিশ্বামিত্রের প্ররোচনায় সৌদাসের কাছ থেকে তার নিগ্রহ পরাশরের উৎপত্তি, বিভুর অদৃশ্যত্ব পিতৃগণের কন্যার গর্ভে ব্যাসমুনির জন্ম, ধীমান শুঁকের জন্ম, বিশ্বামিত্রের সপুত্র পরাশরের প্রতি দ্বেষ, বিশ্বামিত্রকে হত্যা করার ইচ্ছেয় বশিষ্টের অগ্নি উৎপাদন, বিশ্বামিত্রের মঙ্গল কামনায় সন্তানের জন্য শ্রীমান স্কন্দের তপস্যা প্রভৃতি। এছাড়াও এখানে বর্ণিত হয়েছে ভগবান নিজের বুদ্ধি-বলে এক বেদকে চারভাগে বিভক্ত করেছিলেন। তার কীভাবে পরবর্তী সময়ে তার শিষ্য এবং প্রশিষ্যরা সেই বেদকে যে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করেছিলেন তার বর্ণনা।
একবার ধর্মাকাঙ্ক্ষী মুনিরা পুণ্যদেশে যাবার অভিলাষী হয়ে উঠলেন। তারা ব্রহ্মার কাছে পবিত্র দেশের নির্দেশ জানতে চাইলেন। ভু ব্রহ্মা ছিলেন সততই মুনিদের হিতাকাঙ্ক্ষী। তিনি মুনিদের বললেন, এই ধর্মচক্রটি সুনাভ, সত্যঙ্গ, শুভবিক্রম এবং অনুপম। তোমরা আগ্রহী হয়ে ধর্মচক্রের অনুবর্তন কর। তাহলে তোমাদের অভীষ্ট অবশ্যই সিদ্ধ হবে। যেতে যেতে যেখানে গিয়ে এই ধর্মচক্রটির নেমি বিলীন হয়ে যাবে, নিশ্চিত জানবে সেই দেশই পুণ্যদেশ। তোমরা সানন্দে সেখানে অধিষ্ঠান করতে পার। বিভু ব্রহ্মা এই কথা বলে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মুনিরা যাত্রা শুরু করলেন। গঙ্গাগর্ভের কাছে নৈমিষারণ্যে এসে তারা একটি সত্র যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞ চলাকালীন তাদের মধ্যে শরদ্বান নামে এক ঋষির মৃত্যু হল। ঋষিরা নিজ নিজ পুণ্য তেজে তাকে আবার জীবিত করে তুললেন। নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা পরম শ্রদ্ধাভরে ঋষি শরদ্বানকে এই সমগ্র সীমাহীন পৃথিবীর অধীশ্বর রূপে ঘোষণা করলেন। যথাবিধি ও যথাশাস্ত্র অনুসারে তার অতিথি সৎকার করলেন। রাজা অতিথি-সকারে প্রীত হতে দেখে ক্রর স্বভাব রাহু অন্তরাল থেকেই তাকে হরণ করলেন। মুনিরা দেখতে পেলেন, ঐ নৃপ গন্ধর্বদেব সাথে কলাপ গ্রামে বাস করছেন। মহাত্মা ঋষিরা রাজাকে পুনরায় যজ্ঞস্থলে নিয়ে এলেন। কিন্তু নৈমিষারণ্যবাসী মুনিদের দ্বাদশবর্ষব্যাপী সত্রযজ্ঞে সমস্ত যজ্ঞীয় বস্তুকে সুবর্ণময় দেখে ঐ রাজা তাদের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। ফলস্বরূপ তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। ইতিমধ্যে, অরণ্যপ্রান্তে রাজার পুত্র আব্দুর জন্ম হল। তাকে যজ্ঞস্থলে নিয়ে আসা হল। মহাত্মা মুনিরা তাঁর উপাসনা শুরু করলেন।
সূত বললেন, হে দ্বিজবরগণ, ঘটনাক্রম সমস্ত কিছুই আমি আপনাদের কাছে ব্যাখ্যা করলাম। লোকতত্ত্ব ব্রহ্মা যেমন পুরাকালে পরমশ্রেষ্ঠ ঋষিদের কাছে প্রাচীনকালের উত্তম জ্ঞানযোগের কথা বলেছিলেন কিংবা ব্রহ্মবাদী বায়ু ব্রাহ্মণদের কাছে তার অনুগ্রহ দেখাবার জন্য রুদ্রাবতার পাশুপতযোগ বিভিন্ন পুণ্য স্থানের বিবরণ, মহাদেবের লিঙ্গোদ্ভব ও তাঁর নীলকণ্ঠত্ব প্রাপ্তি প্রভৃতি বর্ণনা করেছিলেন, আমিও তেমনি আনুপূর্বিক সবকিছু আপনাদের কাছে বিবৃত করছি।
এই পুরাণ কথা যদি উত্তমরূপে ও বিশদভাবে শ্রবণ, কীর্তন বা ধারণ করা যায় তবে ধন, মান প্রতিপত্তি, দীর্ঘ আয়ু বা আয়ু বৃদ্ধি, পাপনাশী পুণ্যলাভ করা যায়।
এই রকম ক্রম অনুসারেই এই পুরাণ কীর্তিত হয়ে থাকে। পুরাণের বিষয়গুলি যদি সংক্ষেপে জানা থাকে, তবে বিশাল হলেও অনায়াসেই এর অর্থ উপলব্ধি করা যাবে। এই উদ্দেশ্যে প্রথমে সংক্ষেপে বলে পরে বিশদে এর বিস্তৃত কীর্তন করা হয়। যে জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি এর আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করেন তাঁর সমগ্র পুরাণই নিঃসংশয়ে অধ্যায়ন করা হয়ে যায়।
যে ব্রাহ্মণ ছয়টি বেদাঙ্ক ও উপনিষদ সহ চারটি বেদ জানেন অথচ পুরাণ জানেন না, তিনি কখনোই বিচক্ষণ নন। ইতিহাস এবং পুরাণের দ্বারাই বেদজ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটে। বিশেষ করে দেখা গেছে, এই ব্যক্তি আমাকে প্রহার করবে এই বিবেচনায় বেদ অল্পজ্ঞ ব্যক্তি তাকে সর্বদাই ভয় করে থাকেন। এই অন্যায়ের বক্তা সাক্ষাৎ স্বয়ম্ভু সুতরাং যিনি এই অন্যায় অভ্যাস করেন তিনি উপস্থিত সকল আপদ থেকে মুক্ত হন এবং অবশেষে সদগতি লাভ করেন। এটি অতি পুরাতন এবং সমস্ত শাস্ত্রের পূরক। এই কারণেই একে পুরাণ বলা হয়। পুরাণের এই ব্যুৎপত্তি যিনি জানেন তিনি সর্বপাপ মুক্ত হন। মনে রাখতে হবে নারায়ণ এই নিখিল বিশ্বব্যাপ্ত করে বিরাজ করছেন। আবার সেই জগৎস্রষ্টারও স্রষ্টা হলেন দেব মহেশ্বর। তিনি সৃষ্টিকালে সব কিছু সৃষ্টি করেন এবং প্রলয়ে সব কিছু পুনরায় গ্রহণ করে থাকেন।
.
০২.
সেই নৈমিষারণ্য তপোবনবাসী ঋষিরা সূতের কাছে জানতে চাইলেন, সেই অদ্ভুতকর্মা মহাত্মা ঋষিদের সত্রযজ্ঞ কোথায় হয়েছিল? যজ্ঞ সম্পূর্ণ হতে কতদিন সময় লেগেছিল? আর কিভাবেই বা তা অনুষ্ঠিত হল? তারা আরও জানতে চাইলেন, আর বায়ুই বা কীভাবে তাদের কাছে পুরাণ কথা বলেছিলেন? বৎস সূত, আমাদের অত্যন্ত কৌতূহল হচ্ছে, তুমি আমাদের কাছে সবকিছু বিস্তারিত ভাবে বল।
ঋষিবর্গের এই আন্তরিক আগ্রহ দেখে সূত তাঁর স্বভাবসিদ্ধ শুভ ভাষণে বললেন, হে বীরবৃন্দ, সেই নৈমিষারাণ্যবাসী ঋষিরা যে স্থানে সেই উত্তম সত্রযজ্ঞটির অনুষ্ঠান করেছিলেন, ঐ পবিত্র যজ্ঞটি যতকাল চলেছিল এবং যেভাবে চলেছিল সবই আপনাদের সমীপে আনুপূর্বিক বিবৃত করছি। আপনারা মন দিয়ে শুনুন।
পুরাকালে যে স্থলে বিশ্বসৃষ্টির কামনায় বহু বৎসর ধরে বিশ্বস্রষ্টারা পুণ্য সযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন, যে স্থলে ইলার পত্নীত্ব ও স্বামীত্ব লাভ হয়েছিল, যে স্থলে বুদ্ধিমান মহাতেজা যমসত্র যজ্ঞানুষ্ঠান করেছিলেন, ভ্রমণরত ধর্মচক্রের নেমি বিশীর্ণ সেই স্থানটি সর্বমুনিপূজিত নৈমিষ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
এই স্থলের মহিমা শেষ হবার নয়। এই স্থলের ওপর দিয়েই সিদ্ধচরণসেবিকা পুণ্য গোমতী প্রবাহিত হয়েছে। রোহিণী, এখানেই মহাত্মা বশিষ্টের জ্যেষ্ঠ পুত্র সৌমাকৃতি শকত্রি-কে প্রসব করেছিলেন। এখানেই অরুন্ধতীর গর্ভ থেকে বশিষ্টের মহাতেজস্বী একশত পুত্রের জন্ম হয়েছিল। এখানে দাঁড়িয়েই বশিষ্ট তনয় শকত্রি রাজা কল্মষপাদকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। এখানেই বিশ্বামিত্র এবং বশিষ্টের চরম বিরোধ উপস্থিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, এখানেই অদৃশ্যম্ভীর গর্ভে পরাশর মুনি জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর জন্মের ফলে বশিষ্টের পরাভব অপগত হয়েছিল। হে ঋষিবৃন্দ, পুরাকালে সেই অঞ্চলটি ব্রহ্মবাদী ‘নৈমিষেয়’ নামে পরিচিত লাভ করেন। ঐ স্থানে সেই সকল ধীমান ঋষিদের যজ্ঞ দ্বাদশ বর্ষ ধরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
ঐ সময় প্রবল পরাক্রান্ত রাজা পুরুরবা বসুন্ধরা শাসন করেছিলেন। তার ধনতৃষ্ণা ছিল অত্যন্ত বেশি। তিনি অষ্টাদশ দ্বীপ ভোগ করেও ধনরত্নের প্রতি লোভ সংবরণ করতে পারেন নি। এই লোভবশত তিনি বিন্দুমাত্র পরিতৃপ্ত হতে পারেন নি। অবশেষে দেবহুতি দ্বারা প্রেরিত হয়ে উর্বশী তাঁকে পতিত্বে বরণ করেন। এইভাবেই তাকেই ধনলিপ্সার কবল থেকে মুক্ত করার প্রচেষ্টা করা হয়। পুরুরবা উর্বশীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সাথে মিলিত হলেন। সাময়িকভাবে তাঁর লক্ষ্য পরিবর্তিত হল। বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করে পুরুরবা একটি সত্রযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন।
কথিত আছে, পাবকের সংসর্গে গঙ্গা সেই মহাবলশালী দীপ্ততেজা পুরুরবাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন। এই গর্ভ পর্বতে ন্যস্ত হয়ে সুবর্ণ আকার লাভ করে। পরবর্তীকালে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা যখন তাঁরই শাসনকালে সযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন, তখন স্বয়ং বিশ্বকর্মা ও বৃহস্পতি ঐ সুবর্ণের দ্বারা অমিততেজা হয়ে মহাত্মা ঋষিদের যজ্ঞস্থল সুবর্ণময় করে তুলেছিলেন।
রাজা পুরুরবা এই বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল না। একদিন রাজা পুরুরবা মৃগয়ার উদ্দেশ্য ইতস্তত বিচরণ করতে লাগলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি সেই যজ্ঞস্থলে এসে উপস্থিত হলেন। অতি আশ্চর্য, সেই হিরন্ময় যজ্ঞভূমি দেখে তাঁর মধ্যে লোভের প্রাবল্য দেখা দিল। তিনি লোভ বশত হতবুদ্ধি হয়ে তৎক্ষণাৎ সেই সুবর্ণ গ্রহণে উদ্যত হলেন। তার এহেন আচরণ দেখে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিরা তার প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। পুরুরবার পাপবৃত্ত এই কাজে সম্পূর্ণ হল। তখন রাত্রিশেষে এক দৈববাণী হল। সেই দৈববাণীর অনুপ্রেরণায় সেই মহাত্মা মুনিরা কুশময় বজের দ্বারা রাজন পুরুরবাকে প্রহার করলেন, সেই প্রহারে এখানে উর্বশীর পুত্র আয়ুর জন্ম হয়। নিষ্পেষিত হয়ে পুরুরবা হতোদ্যম হয়ে যান।
মহীপতি আয়ু তপোবনবাসী মুনিদের দ্বারা পরিবৃত হয়ে উত্তমভাবে ধর্ম আচরণ করতে লাগলেন। এই ব্রহ্মবাদী ঋষিরা তাঁর প্রতি প্রীত হন। তাঁরা পুরুরবার প্রিয় পুত্র নর আয়ুকে রাজপদে স্থাপন করে ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য পুনরায় যথাবিধি যজ্ঞ আরম্ভ করলেন।
সেইসব মহাত্মা অদ্ভুতকর্মা ঋষিদের সত্রযজ্ঞটি বিশ্বসৃষ্টিতে ইচ্ছুক বিশ্বস্রষ্টাদের অনুরূপ বিস্ময়কর হয়ে উঠেছিল। ঐ যজ্ঞস্থল মহৎ ব্যক্তিগণের উপস্থিতিতে ধন্য হয়ে উঠল। সেই যজ্ঞস্থলে অগ্নি প্রভাবিশিষ্ট মুনিগণ, পিতৃগণ, দেবগণ, গন্ধর্বগণ, অপ্সরা ও সিদ্ধগণ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রিয়সম বৈমানিকগণ, বালখিল্যগণ, মরীচিগণ, উত্তগগণ এবং চারণগণ। নানাবিধ মাঙ্গলিক দ্রব্যসম্ভারে এ যজ্ঞস্থল ইন্দ্রিপুরীর মতো শোভা পেতে লাগল।
এরপর যজ্ঞকারী মুনিরা আরাধনায় ইচ্ছুক হয়ে সত্রযজ্ঞের দ্বারা দেবগণকে, পিতৃকর্মের দ্বারা পিতৃগণকে এবং অন্যান্য ক্রিয়ার দ্বারা গন্ধর্ব প্রভৃতিকে যথাবিধি জাতিভেদ অনুসারে আপ্যায়িত করলেন। ঐ যজ্ঞভূমির কোথাও হতে লাগল গন্ধর্বদের সামগান, কোথাও অপ্সরাদের নৃত্য, কোথাও মুনিঋষিদের বিচিত্র অক্ষরপদযুক্ত শুভ বচন অথবা মন্ত্রাদিতত্ত্ব ও বিদ্বানদের পারস্পরিক বিচার। কোথাও দেখা গেল সাংখ্য, ন্যায় প্রভৃতি দর্শনতত্ত্বজ্ঞ বিদ্বানগণ বিতণ্ডাবাদের দ্বারা তাদের প্রতিবাদীদের আঘাত করছেন। সেখানে ব্রহ্ম রাক্ষসগণ, যজ্ঞঘাতী দৈত্যগণ অথবা যজ্ঞোপহারী অসুরগণ–কেউই কোনো বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারল না। কোনোপ্রকার দুরভিসন্ধি, প্রায়শ্চিত্ত সেখানে জন্মাতে পারল না। মহর্ষিদের শক্তি, প্রজ্ঞা ও ক্রিয়াযোগে সেই যজ্ঞবিধি সুন্দরভাবে সুসম্পন্ন হয়েছিল।
এইভাবে ভৃগু প্রভৃতি মনীষী ঋষিগণ দ্বাদশবর্ষ পর্যন্ত ঐ যজ্ঞ অনুষ্ঠান করলেন। এরই সাথে সাথে জ্যোতিষ্টোম যোগসমূহও পৃথক পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হল।
এই যজ্ঞে অংশগ্রহণকারী যাজ্ঞিকগণ প্রত্যেকে অযুত পরিমাণ দক্ষিণা লাভ করলেন।
হে দ্বিজগণ, যজ্ঞ সমাপ্ত হওয়ায় আপনারা যেমন আমাকে বংশকীর্তনের জন্য নির্দেশ দিলেন, সেই রকম ভাবে সেই ব্রহ্মবাদী ঋষিরাও অমিতাত্মা বায়ুকে বংশ বর্ণনার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রফুল্ল চিত্ত বায়ু তখন পুরাণ বিষয়ক সমধুর বাক্য দ্বারা মুনিদের আহ্লাদিত করতে লাগলেন। সেই বায়ুদেবতা অসীম গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন স্বায়ম্ভবের শিষ্য।
তিনি ছিলেন বশেন্দ্রিয় সর্বপ্রত্যক্ষদর্শী। অষ্ট ঐশ্বর্যে ভূষিত। তিনি ধর্ম দ্বারা তির্যগযোনি প্রভৃতি নিখিল বিশ্ব পালন করতেন। তার সপ্তস্কন্দাদি জগৎ নিয়ত প্লাবিত হত। তার সপ্তগণ নিয়ত বিষয়সমূহে অবস্থান করত। তার বৃত্তি হল প্রাণ অপ্রাণ প্রভৃতি। তিনি ইন্দ্রিয়দের বৃত্তি দ্বারা পরিচালিত করে দেহীদের ধারণ করে থাকেন। তার আকাশ হল যোনি। তিনি শব্দ ও স্পর্শগুণমুক্ত। মনীষীরা তাঁকে ‘তৈজস প্রকৃতি’ বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। তিনিই হলেন অত্যন্ত ক্রিয়াত্মক সর্বশাস্ত্র পারদর্শী অভিমানী ভগবান বায়ু।
.
০৩.
সূত বলতে লাগলেন, সৃষ্টিসংহারকর্তা মহেশ্বরকে প্রণাম জানাই। তিনি দেবগণের শ্রেষ্ঠ ও অনলের মত তেজস্বী। তার বুদ্ধি ও প্রভাব অপরিমিত। তাকে প্রণাম জানানো অবশ্য কর্তব্য। লোকনমস্কৃত প্রজাপতিগণ, স্বয়ম্ভু রুদ্র প্রভৃতি মহেশ্বরগণ, ভৃগু, মরীচি, পরমেষ্ঠী, মনু, রজঃ ও তমোগুণ যুক্ত কশ্যাপ, বশিষ্ট, দক্ষ, অত্রি, পুলস্ত্য, কদম, রুচি প্রজাবৃদ্ধির জন্য যাদের ওপর কার্য শাসনভার অর্পিত হয়েছে সেইসব বিশ্রুত চতুর্দশ মনু ছাড়া অন্যান্য বৈধক্রিয়া সম্পন্ন মুনিদের উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে কলিপাপনাশীনী প্রজাপতির অতি উত্তম সৃষ্টিকথা কীর্তন করব।
এই সৃষ্টিকথা শুভ ও অতুলনীয়। এটি দেবর্ষি ও সুরেন্দ্রদের বিবরণে অলংকৃত। যাঁদের বাক্য, বুদ্ধি, শরীর ও তেজ বিশুদ্ধ, সেইসব প্রদীপ্ত প্রভার তপস্বী প্রজাপতি ও ঋষিদের কাছে এই সৃষ্টিতত্ত্ব অত্যন্ত প্রিয়। এই সৃষ্টিকথা ব্রহ্মার দিনের মতোই আদিকালিক। শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রে বিষয়টি দৃষ্টান্তমূলক ভাবে প্রসারলাভ করেছে। বায়ু প্রকৃতিতে এই সৃষ্টিকথাটি সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ত সমাসবন্ধে বিশিষ্ট শব্দবিন্যাসে চিত্তাহর্ষক। এতে আছে সৃষ্টিকারী ঈশ্বরের প্রথম ও প্রধান প্রবৃত্তি। ব্রহ্মা, প্রধান প্রকৃতি, প্রসূতি আত্মা, গুহা, যোনি, চক্ষু, ক্ষেত্র, অমৃত, অক্ষর, শুক্র, তপঃস সত্ত্ব–এইসব নামের দ্বারা অপ্রমের আদি কারণের স্মরণে হয়ে থাকে। সৃষ্টিকালে লোক পিতামহ স্বয়ম্ভু পুরুষের সাথে ঐ অপ্রমেয় পুরুষ সংযুক্ত হয়ে থাকেন। ঐ অপ্রমেয় পুরুষ এবং সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা স্বরূপগতভাবে অভিন্ন হলেও সৃষ্টিকালে পৃথক রূপ প্রকাশ পায়। উৎপাদকত্ব, রজোগুণের বাহুল্য, কালযোগ ও নিয়মাবধিত্ব হেতু মহেশ্বরের সংকল্পমাত্রই অষ্ট প্রকৃতি যা যা প্রসব করেছিল, তা লোকসমূহের বৃদ্ধির কারণ। প্রকৃতির ক্ষেত্রযুক্ত নিয়ত বিকারভূত দেবতা, অসুর, পর্বত, বৃক্ষ, সাগর, মনু, প্রজা, রাজা- ঋষি, পিতৃগণ, দ্বিজ, পিশাচ, যক্ষ, নাগ, রাক্ষস, তারা, গ্রহ, সূর্য, ভল্লুক, নিশাচর, বানর, মাস, ঋতু, বৎসর, রাত্রি, দিন, দিক, কাল, যুগ, বনৌষধি, লতা, জলচর, অপ্সরা, পশু, বিদ্যুৎ, নদী, মেঘ ও আকাশব্যাপী এই যে সৃষ্টি–তার মধ্যে যা কিছু সূক্ষ্ম, যা কিছু স্থাবর পদার্থ দেখা যায়, তারা প্রত্যেকে গতি সম্পন্ন, পরস্পর বিভক্ত। এছাড়া এই সৃষ্টি প্রকরণে ছন্দঃ ঋক্, যজুঃ, সাম প্রভৃতি বেদ, সোমযাগ, জীবসমূহের জীবিকা, প্রজাপতি দেবতার অভীষ্ট বস্তু আর বৈবস্বত মনুর আবির্ভাব আছে। দ্বাপর যুগে বেদব্যাস যেভাবে বেদবিভাগ করেছিলেন, সে সবই এখানে ক্রমিকভাবে নিবদ্ধ হয়েছে।
যেমন সর্বলোকপূজিত পুণ্যকারী ব্যক্তিদের সৃষ্টি, দেবেন্দ্র, দেবর্ষি, মনু, প্রভৃতি দ্বারা পরিপূরিত ও বিভূষিত ত্রিলোক, রুদ্রের অভিশাপে মনুষ্যলোকে দক্ষের পৃথিবীতে বাস, দক্ষ কর্তৃক মহাদেবের প্রতি অভিশাপ লাভ, মন্বন্তরের পরিবর্তন, প্রতি যুগে ভিন্ন ভিন্ন সৃষ্টি কল্পনা, যুগ অনুসারে ঋষিদের ঋষিত্ব বৃদ্ধি প্রভৃতি। আবার কল্পের সংখ্যা, ব্রহ্মার দিনের সংখ্যা, অন্তজ, উদ্ভিজ্জ, স্বেদজ, জরায়ুজ জীবসমূহ, স্বর্গনিবাসী ধর্মাত্মা, যাতনাস্থানগত জীবসমূহ ও তর্কানুসারে তাদের প্রমাণ। অত্যন্তিক, প্রাকৃতিক ও নৈমিত্তিক সৃষ্টিকারণ, বিশেষ করে বন্ধ মোক্ষ পরম সংসারগতি প্রকৃতির অবস্থা অনুসারে বিভিন্ন কারণের মধ্যে যে স্থিতি ও পুনঃপ্রবৃত্তি আছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ধীর ও বুদ্ধিমান ঋষিরা তাদের বুদ্ধিবলে যথাযথ শাস্ত্রযুক্তি প্রদর্শন করে যত্নসহকারে উপরোক্ত বিবিধ বিষয় নির্দেশ দিয়েছিলেন।
হে বিপ্রগণ, আমি তদনুরূপ সবকিছু আপনাদের সামনে বিবৃত করছি। আপনারা শুনুন।
.
০৪.
সূতভাষ্যে এইসব বিষয়ে জানতে পেরে নৈমিষারণ্যবাসী ঋষিগণ আকুল নয়নে সূতের দিকে তাকালেন। তারা সূতকে অনুরোধ করে বললেন, তুমি সূতবংশীয়। তুমি ব্যাসদেবের কাছ থেকে সবকিছুই প্রত্যক্ষভাবে জেনেছ। এক্ষণে তুমি নিখিল ভুবনের লোকচরিত্র বর্ণনা কর। আমরা জানতে ইচ্ছা করি, কোন্ কোন্ ঋষি কোন্ কোন্ বংশের ধারক। জানতে ইচ্ছা করি, প্রজাপতি ব্রহ্মা কীভাবে তার পূর্বতন ঋষিদের সৃষ্টি করেছিলেন। তুমি বিস্তৃতভাবে এসব বিষয়ে বল।
সাধুশ্রেষ্ঠ রোমহর্ষণকে তারা বারবার এইরূপে অনুরোধ করতে থাকায় তিনি আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে সব ঘটনা বর্ণনা করতে লাগলেন।
আপনাদের জিজ্ঞাসিত যে পুরাণের কথা আমি বলব তা দিব্য, সুললিত, পাপনাশক, বিচিত্র, অনেকার্থক ও শ্রুতিসম্মত। যিনি এই পুরাণকথা চিন্তা করেন, বারবার শোনেন, আর বিশেষ করে যিনি স্বয়ং শুচিযুক্ত আত্মাতে তীর্থক্ষেত্র পর্বের দিনগুলোতে বিপ্র, যতি প্রভৃতিকে শুনিয়ে থাকেন–তিনি পুরাণের কীর্তনের ফলে দীর্ঘ আয়ু লাভ করেন এবং নিজের বংশের প্রতিপালন শেষ হয়ে গেলে স্বর্গলোকে পূজিত হয়ে থাকেন। এখন আমি ঠিক যেমনটি শুনেছি তেমন শব্দ প্রয়োগ করে বিস্তারিতভাবে স্থিরকীর্তি সমস্ত পূর্ণর্বান ব্যক্তিদের চরিত্র কীর্তন করব। তাঁদের সেই কীর্তিত চরিত্র সমস্ত শত্রুনাশক, স্বর্গের হেতু, সকলের কীর্তি-যশ-আয়ুবর্ধক। আপনারা মনোযোগ সহকারে আমার মুখনিঃসৃত কথকতা শ্রবণ করুন।
পুরাণের পাঁচটি লক্ষণ। যথা–সৃষ্টি, প্রতিসৃষ্টি, বংশ, মন্বন্তর, বংশানুচরিত। এই পঞ্চ লক্ষণযুক্ত কল্পকাল থেকেও পবিত্র, বেদসম্মত হল ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। আমি তাই কীর্তন করব। ইতিপূর্বে সৃষ্টি, প্রলয়, স্থিতি, উৎপত্তি এবং প্রক্রিয়া নামে প্রথম পাদ ক্রিয়াবস্তু পরিগ্রহ, ধৰ্মৰ্জনক, যশ ও আয়ুবর্ধক ও পাপানাশক অনুষঙ্গ, উপপাদাঘাত ও উপসংহার নামে চারটি পাদ সংক্ষেপে উল্লেখ করেছি। এখন তাই আবার ক্রম অনুসারে বিস্তারিতভাবে বলব। যিনি অজ, আদিভুত, প্রজাদের আত্মস্বরূপ এবং যিনি লোকনিয়া সেই হিরণ্যগর্ভ ঈশ্বর-পুরুষ স্বয়ম্ভু ব্রহ্মাকে প্রণাম জানিয়ে মহৎ থেকে শুরু করে বিশেষ পর্যন্ত সবিকায় সলক্ষণ পঞ্চভৌতিক দেহ ও ভূত সৃষ্টির বিষয়ে সংশয়বিহীন হয়ে বলছি।
প্রধান প্রকৃতি, শব্দ-গন্ধ-স্পর্শ-রূপ অজাত, ধ্রুব, অক্ষয়, নিত্য, আত্মস্থিত, জগৎযোনি মহভূত, পর, ব্রহ্মা, সনাতন, সর্বভূতবিগ্রহ, অব্যক্ত, অনাদি, অনন্ত, অজ, সূক্ষ্ম, ত্রিগুণ, প্রভব, অব্যয়, আসম্প্রত, অবিজ্ঞেয় ও ব্রহ্মারও পূর্বে বর্তমান। এইভাবে তত্ত্ববিদগণ সদসদাত্মক নিত্য অব্যক্ত কারণকেই নানাভাবে অভিহিত করে থাকেন। একদা এর দ্বারাই তমোময় নিখিল বিশ্ব পরিব্যপ্ত ছিল। তারপর এই তমোময় বিশ্বে গুণসাম্যে উপস্থিত হল, ক্ষেত্রাধিষ্ঠিত প্রধানের সৃষ্টিকাল এল। তখনই সর্বপ্রথম তিন গুণের তারতম্য হেতু ‘হেতু’ তত্ত্বের আবির্ভাব ঘটল। এই মহৎ তত্ত্ব সূক্ষ্ম এবং মহান অব্যক্ত দ্বারা সমাদৃত। সত্ত্বগুণ উদ্ৰিক্ত এই মহৎ তত্ত্বকে সত্ত্বগুণ প্রকাশন মন বলেও বিবেচনা করা যেতে পারে। এই মনকে ‘করণ’ও বলা হয়। ক্ষেত্রজ্ঞা অধিষ্ঠিত লিঙ্গমাত্র মহৎ তত্ত্ব থেকে লোকতত্ত্বার্থের হেতু ভূত ধর্মাদির উৎপত্তি হয়। এই সময় সৃষ্টি করবার ইচ্ছায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহৎ তত্ত্বের সৃষ্টিকাজ শুরু হল। মনে রাখবেন, এই মহৎ তত্ত্বই মন, মতি, ব্রহ্মা, পুর, বুদ্ধি, খ্যাতি, ঈশ্বর, প্রজ্ঞা, চিতি, স্মৃতি, সংবিৎ বিপুর এই সব নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
প্রধানত দুটি কারণে ‘বিভু’কে ‘মন’ বলে অভিহিত করা হয়। এটি সমস্ত প্রাণীর চেষ্টার ফল অনুভব করে এবং এটি বৃহৎ বস্তুগুলোর সূক্ষ্মরূপ।
সমস্ত তত্ত্বের অগ্রজাত অবশিষ্ট সমস্ত গুণ অপেক্ষা পরিমাণে ‘মহৎ’ এই কারণে তার নাম বলা হল মহান। পরিমাণ ধারণ, বিভাগ জ্ঞান এবং ভোগ সম্বন্ধ হেতু পুরুষের অনুমান–এই তিনটি কারণে তিনি ‘মতি’ নামেও খ্যাত। বৃহত্ত্ব ও বৃংহনত্ত্ব গুণে তিনি অনুগ্রহ করে সমস্ত দেহের পরিপোষণ করে থাকেন, তাই তার নাম ‘ব্রহ্মা’। আবার অনুগ্রহ করে তিনি সমস্ত তত্ত্বভাবকে পূরণ করেন, তাই তিনি ‘পুর’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকেন।
পুরুষ যাতে প্রতিরুদ্ধ হয় এবং যিনি যাবতীয় হিত-অহিত ও সমগ্র ভাববস্তুকে বোধিত করেন তার নাম ‘বুদ্ধি’। ভোগ জ্ঞাননিষ্ঠ হওয়ায় যাঁর খ্যাতি ও প্রত্যুপভোগের প্রবর্তন ঘটে, কিংবা যাঁর গুণ ও নামাদি বিশেষ বিখ্যাত, সেই মহানই ‘খ্যাতি’ নামে পরিচিত হন।
অন্যদিকে সাক্ষাত্তাবে সবকিছু জানেন, তাই তিনি ঈশ্বর। গ্রহরা তার থেকে উদ্ভব হয়েছে তাই তিনি ‘প্রজ্ঞা’। ‘জ্ঞানাদি’, রূপ, এবং যাগাদি কর্মের ফল তিনি সঞ্চয় করে থাকেন, তাই তিনি ‘চিতি’। আবার বর্তমান, অতীত, ভবিষ্যৎ এবং অনাগত–সবকিছুকেই তিনি স্মরণ রাখেন, তাই তার নাম ‘স্মৃতি’। তিনিই ‘মাহাত্মা’ কারণ তিনি সমস্ত জ্ঞান লাভ করে থাকেন। তিনি সবকিছুতেই বিদ্যমান এবং সবকিছু তার মধ্যে বিদ্যমান। এই কারণে বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সেই মহানকে ‘সংবিৎ’ আখ্যা দিয়ে থাকেন। তিনি জ্ঞানস্বরূপ। জ্ঞানের কাছে তিনি আছেন। তাই তিনি জ্ঞান নামে অভিহিত। আবার দ্বন্দ্ব মাত্রেরই বিপরীতভাব হয়ে থাকে, তাই তাঁর ‘বিপুর’ নাম।
লোকসমূহের সর্বময় কর্তা হলেন ঈশ্বর। তিনি বৃহৎ, তাই তিনি ব্রহ্মা, এই ভাবেই তিনি ভূতত্ত্ব হেতু ‘ভব’, ক্ষেত্র-ক্ষেত্ৰজ্ঞের ‘বিজ্ঞান’ এবং একত্ববশত ‘ক’। আর যেহেতু তিনি পুরি অর্থাৎ দেহে বাস করেন তাই তিনি পুরুষ। আপ পুরুষ যেহেতু স্বয়ং অনুৎপন্ন সমস্ত পদার্থের পূর্ববর্তী–সেহেতু তিনি ‘স্বয়ম্ভু’ নামে পরিচিত।
তত্ত্বভাব এবং সদ্ভাব চিন্তাকারীরা এইসব পর্যায়বাচক শব্দদ্বারা সেই আদ্যশ্রেষ্ঠ মহৎ তত্ত্বের ব্যাখ্যা করে থাকেন। সৃষ্টির ইচ্ছায় অনুপ্রাণিত হয়ে মহান সৃষ্টি করে থাকেন। সংকল্প এবং অধ্যাবসায়–এই দুটি তার বৃত্তি। লোকতত্ত্বার্থের হেতু ভূত-ধর্মাদি তার রূপ। সত্ত্ব, রজঃ, তমো–এই তিনটি তার গুণ। মহত্তত্ত্ব এমনিতেই ত্রিগুণবিশিষ্ট হয়ে থাকে। তবে রজঃগুণের আধিক্যবশত তার থেকে মহৎ পরিবৃত এবং ভূতাদি বিকৃত অহংকারের সৃষ্টি হয়। অহংকারে তমোগুণের আধিক্য থাকে। তমোগুণ-আক্রান্ত ভূতসমূহের আদিকারণ হল ভূত-তন্মাত্র। অহংকার থেকেই তার সৃষ্টি। ভূত-তন্মাত্র থেকে উৎপন্ন হয় শব্দ-তন্মাত্র এবং সচ্ছিদ্র শব্দ লক্ষণ আকাশ। ভূতাদি যখন শব্দ-তন্মাত্রকে আবৃত করে তখন সেই শব্দ তন্মাত্র থেকে জন্মগ্রহণ করে স্পর্শতন্মাত্র ও স্পর্শগুণবিশিষ্ট বলবান বায়ু। শব্দ তন্মাত্র ও আকাশের আবরণে স্পর্শতন্মাত্র ও তার থেকে উৎপন্ন রূপ তন্মাত্র ও তেজের উৎপত্তি। রূপতন্মাত্রের আবরণে রসতন্মাত্রও জল, রসতন্মত্রের আবরণে গন্ধতন্মাত্র এবং গন্ধগুণসম্পন্ন ক্ষিতির আবির্ভাব ঘটে।
যে যে তন্মাত্র থেকে যে যে ভূতের উৎপত্তি ঘটেছে সেই সব ভূতে সেই সেই তন্মত্রের অংশ থাকায় তাদের তন্মাত্র বলা হয়। ভূততন্মাত্রগুলি পরস্পর থেকে সমুৎপন্ন হওয়ায় প্রত্যেকেই অভিন্ন অথবা অশান্ত। ঘোর ও মূঢ়তাদি গুণবেশে তাদের ভিন্ন বলেও নির্দেশ করা হয়।
বৈকারক অহংকারে সত্ত্বগুণের উদ্রেক হলে তা থেকে একই সাথে সত্ত্বাগুণবহুল বৈকারিক সৃষ্টি প্রবর্তিত হয়। পাঁচটি বুদ্ধি ইন্দ্রিয় আর পাঁচটি কর্ম ইন্দ্রিয় এই দশটি ইন্দ্রিয় এবং একাদশ মন, এগুলিকে একত্রে বৈকারিক বলে। যে পাঁচটি ইন্দ্রিয় শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধকে গ্রহণ করে তাদেরকে বুদ্ধিন্দ্রিয় বলে। এগুলি হল–চক্ষু, কর্ণ, জিহ্বা, নাসিকা, ত্বক, অন্যদিকে পাদ, পায়ু, উপস্থ, হস্ত, বাগেন্দ্রিয় এই পাঁচটি ইন্দ্রিয় যথাক্রমে গতি, ত্যাগ, আনন্দ, শিল্প ও বাক্যালাপের সাধক হওয়ায় এদের কর্মেন্দ্রিয় বলা হয়।
শব্দ মাত্রেই আকাশকে স্পর্শ করে প্রবিষ্ট হয়। তাই বায়ুতেই শব্দ ও স্পর্শ এই দুটি গুণই থাকে। শব্দ ও স্পর্শ এই গুণ রূপতন্মত্রে প্রবেশ করে। তাই তেজঃ তিনটি গুণবিশিষ্ট হয়। এই তিনটি গুণ হল–শব্দ, স্পর্শ ও রূপ।
শব্দ, স্পর্শ ও রূপ–এই তিনটি গুণ আবার রসতন্মাত্রে প্রবেশ করে। তাই জল শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস চারটি গুণবিশিষ্ট হয়।
এইভাবে শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস গন্ধতন্মত্রে প্রবেশ করে বলে উপরোক্ত পাঁচটি গুণ পৃথিবীর গুণ বলে অভিহিত হয়। এই কারণেই পঞ্চগুণবিশিষ্ট ক্ষিতি স্থলভূতে দেখা যায়। এই ভূত সমূহ যথাক্রমে শান্ত, ঘোর ও মূঢ় এবং বিশেষরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকে। এরা পরস্পর পরস্পরের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে পরস্পরকে ধরে রাখে। লোকালোক ও পাহাড়, পর্বত দ্বারা পরিবৃত এই পরিদৃশ্যমান জগৎ–সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত। বিশেষগুলি নিয়ত হওয়ায় এরা ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য। উত্তর-উত্তর ভূতসমূহ পূর্ব-পূর্ব ভুতের সমস্ত গুণ গ্রহণ করে। অবশ্য কোনো অনিপুণ ব্যক্তি অগ্নি ও বায়ুর গন্ধ উপলব্ধি করে সেই গন্ধই পৃথিবীতে অশ্রিত বলে নির্দেশ দেন।
মহৎ থেকে আরম্ভ করে বিশেষ পর্যন্ত এই সাত মহাত্মা মহাবীর্যশালী হলেও সম্পূর্ণভাবে পরস্পর মিলিত না হলে সৃষ্টি করতে সমর্থ হন না। যখন এই মহাত্মারা পরস্পর মিলিত হয়ে পুরুষের অধিষ্ঠান লাভ করেন, তখনই অব্যক্তের অনুগ্রহে এঁরা অণ্ড উৎপন্ন করেন। বিশেষ পদার্থগুলি থেকে জল বুদবুদের মতো একই কালে উৎপন্ন। সেই বৃহৎ অণ্ডটি জলেই অবস্থান করে। এই অণ্ডই তখন ব্রহ্মার সৃষ্টিকার্যের করণ রূপে সিদ্ধ হয়। এই প্রাকৃত অণ্ডটি যখন বিবুদ্ধ হয়, তখন ক্ষেত্রজ্ঞ ব্রহ্মসংজ্ঞক, ভূতসমূহের আদিকর্তা–সেই হিরণ্যগর্ভ চতুর্মুখ ব্রহ্মা সর্বপ্রথম প্রাদুর্ভাব হন। তিনিই প্রথম শরীরী এবং পুরুষ নামে উক্ত হন।
সুবর্ণময় সুমেরু শৈলই সেই মহাত্মা হিরণ্যগর্ভের গর্ভ। সমুদ্র তার গর্ভোদক এবং পর্বতরা হল জরায়ু। সপ্তদ্বীপ এই পৃথিবী, সপ্ত সমুদ্র, বিশাল শত সহস্র নদী, এই সব চরাচর, বিশ্বজগৎ, চন্দ্র, আদিত্য, নক্ষত্র, গ্রহ, বায়ু, লোক, আলোক–এইসব কিছুই সেই অণ্ডে প্রতিষ্ঠিত। অণ্ডটির বাইরের দিক দশগুণ জলে পরিবেষ্টিত থাকে। জলবেষ্টিত থাকে দশগুণ তেজে, তেজ আবার দশগুণ বায়ুতে, বায়ু দশগুণ আকাশে আবৃত থাকে। আকাশ বেষ্টিত থাকে ভূতবর্গে, আর ভূতগণ মহতে এবং মহান অব্যক্তে পরিবৃত থাকে। মোট সাতটি প্রাকৃত আবরণ দিয়ে অণ্ডটি আবৃত থাকে। বিকারে সমূহে বিকারের যেমন আধার আধেয়ভাবে হয়ে থাকে, ঠিক তেমনই সৃষ্টিকালে অষ্ট প্রকৃতি পরস্পর পরস্পরকে ঘনিষ্ঠভাবে আবৃত করে অবস্থান করে। আর প্রলয়কালে পরস্পর পরস্পরকে গ্রাস করে। এইভাবেই পরস্পরের সাহায্যে উৎপন্ন হয়ে তারা পরস্পরকে ধারণ করে। এই অব্যক্তই ক্ষেত্র নামে পরিচিত। ব্রহ্মাকে বলা হয় ক্ষেত্রজ্ঞ। ক্ষেত্রজ্ঞের দ্বারা অধিষ্ঠিত এই হল প্রকৃতি সৃষ্টি। এই সৃষ্টি বিদ্যুতের মতো প্রথমে অবুদ্ধিপূর্বক হয়ে থাকে।
হিরণ্যগর্ভের এই জন্ম-বিবরণ যথাযথ বিদিত হলে মানুষ আয়ুষ্মন ও কীর্তিমান হয়। সে ধন এবং পুত্র লাভ করে। আর যাঁর কোনো কামনা নেই এমন শুদ্ধ-আত্মা পুরুষ মুক্তি লাভ করে। পুরাণ শ্রবণের ফলে নিত্য সুখ ও মঙ্গল লাভ হয়।
.
০৫.
রোমহর্ষণ বললেন, যে পুণ্যাত্মা দ্বিজগণ, সৃষ্টিপ্রসঙ্গে আমি যে কালের কথা উল্লেখ করেছি, মনে রাখবেন তা হল পরমেশ্বর দিবারাত্রি। সৃষ্টিকালটি হল তার দিবা এবং প্রলয়কালটি তার রাত্রি। সৃষ্টিকর্তার মধ্যে দিন বা রাত এই ভেদ ধারণা নেই। লোকদের হিতকামনায় যে সকল উপাচার করা হয়ে থাকে, প্রজা, প্রজাপতি, ঋষি, মনু, সনৎকুমার প্রভৃতি ঋষিগণ, ব্রহ্মের সাযুজ্য লাভ করেছে এমন জীবগণ, ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ার্থ, পঞ্চ মহাভূত, পঞ্চতন্মাত্র, কর্মেন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও মন–সকলেই পরম ঈশ্বরের দিবাভাগে বিদ্যমান থাকেন। দিনের শেষে প্রলয় হয় এবং রাত্রির শেষে বিশ্বের উৎপত্তি হয়ে থাকে। বিকার বস্তু অর্থাৎ সৃষ্টি বস্তুর সংহার হয়ে গেলে সত্ত্ব আত্মায় লীন হয়ে যায়। প্রকৃতি ও পুরুষ সমধর্মী হয়ে অবস্থান করে। তমঃ এবং সত্ত্বগুণ সমতা লাভ করে।
সৃষ্টির সময়ে তমঃ সত্ত্বগুণ পরস্পর উদ্ৰিক্ত হয়ে প্রসূত হয়, এই কারণে গুণের সাম্যাবস্থাকে বলা হয় প্রলয় এবং বৈষম্য অবস্থাকে বলে সৃষ্টি। তিলে যেমন তেল, দুধে যেমন ঘি, ঠিক তেমনই তমঃ ও সত্ত্বগুণ অব্যক্তাশ্রিত রজঃগুণ অবস্থিত। মহেশ্বরের সমগ্র প্রলয় রজনী অতিবাহিত হওয়ার পর দিনের কাজ আরম্ভ হয়। প্রকৃতির আবির্ভাব ঘটে। এরপর পরমেশ্বর পরম যোগবলে পুরুষে প্রবেশ করে। তাকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। ক্ষোভের ফলে রজঃগুণের প্রকাশ ঘটে। বীজে জলসেচের মতো রজঃগুণ প্রবর্তিত হলেই সত্ত্ব ও তমোগুণ বৈষম্যপ্রাপ্ত হয় এবং ব্রহ্মাদি অধিষ্ঠিত দেবতা প্রসূত হতে থাকে। যেমন–সত্ত্বাদি গুণগুলি ক্ষুব্ধ হতে থাকলে পরম শাশ্বত সত্য সর্বাত্মা ও শরীরী–এই তিন পরম গুণের আবির্ভাব ঘটে। যেমন–রজঃগুণ থেকে ব্রহ্মা, তমোগুণ থেকে রুদ্র এবং সত্ত্বগুণ থেকে বিষ্ণু উৎপন্ন হন।
রজঃগুণ প্রকাশক ব্রহ্মা সৃষ্টিকাজে, তমোগুণ প্রকাশক রুদ্র সংহার কাজে, এবং সত্ত্বগুণ প্রকাশক বিষ্ণু উদাসীনভাবে অবস্থিত থাকেন। এই তিন দেবতাই তিন বেদ এবং অগ্নি। এঁরা পরস্পর আশ্রিত, পরস্পর অনুগত। পরস্পর মিথুন ও পরস্পর উপজীবি হয়ে পরস্পরকে ধারণ করে অবস্থান করেন। এঁরা ক্ষণকালের জন্যও পরস্পর পরস্পরকে পরিত্যাগ করেন না। এঁদের কখনও বিয়োগ ঘটে না।
মহেশ্বর শ্রেষ্ঠ দেবতা, বিষ্ণু মহান থেকেও শ্রেষ্ঠ এবং ব্রহ্মা রজঃগুণের দ্বারা উদ্ৰিক্ত হয়ে সৃষ্টিকাজে প্রবৃত্ত হন। পুরুষও যেমন পর অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ, প্রকৃতিও তেমন শ্রেষ্ঠরূপে বিবেচিত। মহেশ্বরের দ্বারা অধিষ্ঠিত এই পুরুষ যখন চারদিক আলোড়িত করে সৃষ্টিকাজে প্রবৃত্ত হয়, তখন নিজের নিজের বিষয়ে দীর্ঘকাল ধরে স্থিত ‘মহৎ’ প্রভৃতি তার অনুবর্তন করে।
এই গুণবৈষ্যমের ফলেই প্রকৃতি সৃষ্টিকাজে প্রবৃত্ত হয়। সেই ঈশ্বর-অধিষ্ঠিত সদাসদাত্মক প্রকৃতি থেকে, ব্রহ্মা ও বুদ্ধির মিথুনভাবের যুগপৎ আবির্ভাব ঘটে। এই মিথুন থেকেই তমঃ ও অব্যক্তময় ক্ষেত্রজ্ঞের উৎপত্তি ঘটে থাকে। এই ক্ষেত্ৰজ্ঞের নামই হল ব্রহ্মা।
কার্যকারণ সম্পর্কের দ্বারা সিদ্ধ ব্রহ্মা যেমন আগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন, ধীমান অব্যক্তও তেমন প্রথমেই তেজের দ্বারা আত্মপ্রকাশ লাভ করেন। অতুলনীয় জ্ঞান ও ঐশ্বর্য, ধর্ম ও বৈরাগ্যের সঙ্গে যুক্ত এই অব্যক্তই প্রথম শরীরী ও প্রথমে কারণ। সেই ঈশ্বরের এই বৈরাগ্যলক্ষণজ্ঞান তা এককথায় তুলনাহীন। ধর্মশ্বৈর্যগত অভিমান থেকে ব্রাহ্মীস্থিতি অর্থাৎ ব্রহ্মোস্থিত বুদ্ধির সৃষ্টি হল। মনে মনে যা ইচ্ছা করা হয়েছিল, তা-ই অব্যক্ত থেকে উৎপন্ন হল।
এইভাবে সবকিছু বশীভূত হওয়ায় এবং নিজ গুণাতীত এবং স্বভাবত সুরশ্রেষ্ঠ হওয়ায় চতুর্মুখ দেবতা ব্রহ্মারূপ সৃষ্টি করেন, কাল রূপে সংহার করেন এবং সহস্ৰমূর্ধা পুরুষরূপে অবস্থান করেন। সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রজাপতি ব্রহ্মার তিন অবস্থা ব্রহ্মা রূপে সৃষ্টি, কাল রূপে সংহার এবং পুরুষ রূপে উদাসীনতা।
স্বয়ম্ভু যখন ব্রহ্মারূপে প্রকাশ পান তখন তাঁর মধ্যে সত্ত্বগুণ বিরাজ করে, যখন কাল স্বরূপ হন তখন তার মধ্যে রজঃ ও তমোগুণ বিরাজ করে এবং যখন তিনি পুরুষরূপে প্রকাশিত হন তখন তার মধ্যে পুনরায় সত্ত্বগুণের উন্মোচন ঘটে যায়। এইভাবে স্বয়ম্ভর মধ্যে তিন গুণ অবস্থান করে। অর্থাৎ তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা রূপে লোকসৃষ্টি করেন, কাল রূপে সংহার করেন, এবং পুরুষরূপে উদাসীন থাকেন। প্রজাপতি স্বয়ম্ভর তিন অবস্থা কিন্তু রূপাতীত। অবশ্য পরমাত্মার পূর্বোক্ত তিনটি অবস্থার মধ্যে তিনটি রূপের প্রকাশ ঘটে যায়। যেমন–তিনি যখন ব্রহ্মা, তখন তাঁর পদ্মগর্ভের মতো বর্ণ, তিনি যখন কাল স্বরূপ তখন তার বর্ণ কাজলকৃষ্ণ, এবং যখন তিনি পুরুষ স্বরূপ তখন পুণ্ডরীকাক্ষ রূপ ধারণ করেন।
যোগেশ্বর নিজের লীলা অনুসারে নানা আকৃতি, ক্রিয়ারূপ এবং নাম গ্রহণ করেন, বিভিন্ন বস্তু সৃষ্টি করেন এবং সংহার করেন। বিশ্বচরাচরে তিনি তিনভাবে অবস্থান করেন। তাই তিনি ত্রিগুণ। তিনি চারভাগে বিভক্ত, তাই ‘চতুকূহ’, সর্বদা সব অবস্থাতেই তার প্রাপ্তি ও গ্রহণ ঘটে চলেছে। সব বিষয়েই তিনি বিদ্যমান, তাই তার অপর নাম ‘আত্মা’। এইভাবে বিভিন্ন কারণবশত তিনি বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে থাকেন। যেমন সর্বব্যাপী বলে তিনি ঋষি’, শরীরের আদি কারণ বলে স্বয়ং, যেহেতু একধারে তিনি স্বামী এবং প্রভু, এবং সবকিছুর মধ্যে তিনি বিষ্ণু। আবার যেহেতু তিনি ঐশ্বর্য, বীর্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি ভাগের অধিকারী, তাই তিনি ভগবান। অন্যদিকে তিনি রাগের শাসনকর্তা হওয়ায় ‘রাগ’, প্রকৃতত্বের কারণ হওয়ায় ‘পর’, অবন অর্থাৎ রক্ষাকর্তা হওয়ায় ‘ওম’, সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান হওয়ায় সর্বজ্ঞ। সর্ব পদার্থের উৎপত্তিস্থান হওয়ায় সর্ব, এবং পরসমূহের একমাত্র আশ্রয়স্থল হওয়ায় নারায়ণ’ নামে বিভূষিত হয়ে থাকেন।
এই নারায়ণই নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করে থাকেন। এইভাবে তিনি সংসারের সৃষ্টি, গ্রাস এবং পর্যবেক্ষণ করে থাকেন। এইভাবেই ত্রৈলোেক্যের সৃষ্টি ঘটে। এঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম চতুর্মুখ হিরণ্যগর্ভ আবির্ভূত হন। তিনিই আদি। তাই তিনি ‘আদিদেব’ নামে খ্যাত। তার জন্ম নেই, অর্থাৎ তিনি অজাত। তাই তিনি ‘অজ’। তিনি প্রজাদের পালক তাই তিনি প্রজাপতি। তিনি দেবতাদের মধ্যে মহান, তাই ‘মহাদেব’। তিনি সকলের ঈশ্বর বা প্রভু, তাই তাঁকে ‘সর্বেশ’ও বলা হয়ে থাকে। আবার তিনি কারোর বশ্য নন সে কারণে ‘ঈশ্বর। এর বাইরেও তিনি একাধিক নামে মহিমান্বিত হয়ে আছেন। তিনি বৃহৎ হওয়ার ফলে ব্রহ্ম’, অতীত হওয়ার ফলে, ‘ভূত’, ক্ষেত্রকে জানেন বলে ক্ষেত্রজ্ঞ’ এবং সর্বগত বলে ‘বিভু’ রূপেও পরিচিত। যেহেতু তিনি পুরে অর্থাৎ শরীরে বাস করেন, তাই তিনি পুরুষ। তিনি অনুৎপন্ন এবং পূর্বতন হওয়ায় ‘স্বয়ম্ভু’। যজনীয় হওয়ায় ‘যজ্ঞসংক্রান্তদর্শী’। কবি এবং কমনীয়তার আশ্রয় হওয়ায় ‘কমন’। আবার তিনি বর্ণধর্মের পালন করে থাকেন তাই আদিত্য নামক কপিল। অগ্রে জন্মেছেন বলে তিনি ‘অগ্নি’। তার গর্ভেই হিরণ্যের জন্ম আবার তিনি হিরণ্যের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, এই দুটো কারণে তিনি পুরাণে ‘হিরণ্যগর্ভ’ নামে পরিচিত। শত বৎসর ধরে চেষ্টা করলেও সেই স্বয়ম্ভুর আদিকালের সংখ্যা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
অতএব, ব্রহ্মার কল্পকালের সংখ্যা নিবৃত্তির পরবর্তী কালকেই ‘পর’ নামে নির্দেশ করা হয়ে থাকে। এই কালের অবশিষ্ট যে কাল, সেই কালের শেষে পুনর্বার ‘পর’ নামক কালের সৃষ্টি হয়। এবং এই কালের যে অবশিষ্ট অংশ, তার মধ্যেই কোটি কোটি সহস্র অর্বুদ ও অযুত সংখ্যক কল্পকাল অতীত হয়ে গেছে।
বর্তমান এই ধরনেরই কল্পকাল চলছে, তার নাম বরাহ কল্প।
হে দ্বিজগণ, আপনারা সাম্প্রতিক ওই কালকেই প্রথম কল্প বলে জানবেন। এই কল্পে স্বায়ম্ভুব প্রভৃতি মনুর চতুর্দশ সংখ্যা পর্যন্ত আবির্ভূত হবেন। এর মধ্যে কতগুলি অতীত, কতগুলি বর্তমান ও কতগুলি ভবিষ্যতে উৎপন্ন হবে।
এই সব মনু প্রভৃতি নরনাথেরা পূর্ণ যুগ সহস্র ধরে তপশ্চারণ ও পুত্র উৎপাদন করে এই সপ্তদ্বীপা পৃথিবীকে সব দিক থেকে প্রতিপালন করে থাকেন। এঁদের সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আমি আপনাদের বলব। একটি মন্বন্তরের বিষয় শুনেই অন্যান্য সমস্ত অতীত ও অনাগত এবং ভবিষ্যৎ কল্পের কথা আপনারা বুঝে নিতে পারবেন।
.
০৬.
সূত শুভ ভাষণে বললেন, অগ্নি থেকে বিপুল সলিলরাশি উৎপন্ন হয়েছিল, এর ফলে স্থাবর জঙ্গল সবকিছুই বিনষ্ট হয়ে যায়। পৃথিবী একাৰ্ণবে পরিণত হয়। সেসময় সেই সুনীল অর্ণব সলিলে বাকি কাউকেই দেখা যায়নি। এদিকে সেই সময়েই সহস্রাক্ষ, সহস্ৰপাদ, সহস্ৰশীর্ষ, কনকবর্ণ অতীন্দ্রিয় নারায়ণাখ্য ব্রহ্মা সত্ত্বগুণের উদ্রেক হবার ফলে জেগে ওঠেন। কিন্তু বিশ্বচরাচকে শূন্য জলধিমগ্ন দেখে পুনরায় ঐ সলিল রাশির মধ্যে নিদ্রিত হয়ে পড়লেন।
কেন এই অতীন্দ্রিয় ব্রহ্মা ‘নারায়ণ’ নামে খ্যাত হলেন এই বিষয়ে শ্লোকে নির্দেশ আছে। বলা হয়েছে, অপ, পার ও তনু এই তিনটি শব্দ হল সলিলের নামান্তর। এক্ষেত্রে সত্ত্বাগুণাধিকারী ব্রহ্মা নারা অর্থাৎ জলে শয়ন করেন, তাই তার নাম নারায়ণ। এইভাবে তিনি যুগসহস্র পরিমিত রাত্রিকাল নিদ্রামগ্ন অবস্থায় অতিবাহিত করেন। তারপর রাত্রিশেষে আবার সৃষ্টিকাজে প্রবৃত্ত হলেন। খদ্যোত অর্থাৎ জোনাকি বর্ষাকালের রাত্রে ইতস্তত বিচরণ করে, ঠিক সেইরকমভাবে ব্রহ্মাও সেই অগাধ সলিলে বিচরণ করতে থাকলেন। তিনি অনুমানে বুঝতে পারলেন যে, পৃথিবী জলমগ্ন হয়েছে। বিন্দুমাত্র বিমূঢ় না হয়ে তিনি পূর্ব পূর্ব কল্পের মতো পৃথিবীর উদ্ধারকল্পে অন্য একটি রূপ ধারণ করলেন। সেই মহাত্মা পুরুষ চারদিক জলমগ্ন দেখে মনে মনে একটি দিব্যরূপ চিন্তা করতে থাকলেন। এমন একটি দিব্যরূপের তিনি সন্ধান করছিলেন যাতে বিপুল বেগে পৃথিবীকে উদ্ধার করতে পারবেন। তার স্মরণে এল বরাহের রূপ। আহা, জলকেলিকালে কী সুন্দরই না দেখায়। তিনি বরাহরূপ ধারণ করলেন।
সেই মহাত্মা যে বরাহের রূপ পরিগ্রহণ করলেন– তা ছিল সব প্রাণীরই আক্রমণের অযোগ্য। সে ছিল দশযোজন বিস্তৃত এবং শত যোজন উন্নত, নাম ধর্ম। বরাহটি ছিল বাঙময়। তার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ ছিল বিশেষত্ব যুক্ত। বরাহটি দেখতে যেমন ছিল মেঘের মতো, গর্জনেও ছিল তার মতোই। বিশাল পর্বতের মতো তার দেবাবয়ব থেকে সুতীক্ষ্ণ দুটি শ্বেতদন্ত বেরিয়ে ছিল। বিদ্যুৎ তথা অগ্নির মতোই। জ্বলন্ত তার চোখের দৃষ্টি। আদিত্যের মতো ছিল তার তেজ। বৃহৎ আকৃতির বরাহটির স্কন্দ ছিল দেখার মতো। যেমন সুবন্ত, তেমনই স্থূল আয়তন। বকটি দেশ ছিল পীনোন্নত। এককথায় বলতে গেলে সুন্দর মসৃণ গাত্র সম্পন্ন বরাহটি ছিল সব দিক দিয়ে শুভ লক্ষণযুক্ত। এই ভাবেই হরি বিশালাকার অমিত বলশালী বরাহরূপ ধারণ করে পৃথিবীকে উদ্ধারের জন্য রসাতলে প্রবেশ করলেন।
সেই মহাতাপস বরাহটির অনিন্দ্য বৈশিষ্ট্যের শেষ ছিল না। তার দংস্ট্রা দুটি ছিল বেদবাদী, বক্ষস্থল যেন যজ্ঞস্থল, মুখমণ্ডল যজ্ঞের চিতা, জিহ্বা যেন যজ্ঞের অগ্নি, রোমরাজি যেন যজ্ঞের দর্ভ, শিরোদেশ যেন ব্রহ্মা-তুল্য। তার চক্ষুদুটিতে দিবা ও রাত্রি যেন পর্যায়ক্রমে বিরাজ করত। তার কর্ণভূষণ কেবলমাত্র বেদাঙ্গর সঙ্গে তুলনীয়। ধৃত ও সুবের সাথে তার নাসিকা দণ্ডের মিল ছিল।
বিশালাকৃতি বরাহটি ছিল ঘোর সত্য ধর্মময়। শ্রীমান ধর্মপরাক্রান্ত ও প্রায়শ্চিত্ত রত। তার গর্জন শুনলে মনে হবে বুঝি উচ্চরবে সামবেদ ধ্বনি গুঞ্জিত হচ্ছে। পশু তার জানুস্থানীয়, হোম হল লিঙ্গ, মহৌষধি অন্তরাত্মা, মন্ত্র তার হৃদয়, ঘৃত সমন্বিত সোম হল শোণিত, বেদ হল স্কন্ধদেশ, হবিগন্ধ হব্যকব্য তার প্রবল বেগ, প্রাবংশ শরীর স্বরূপ, দক্ষিণা হৃদয় স্বরূপ, উপকর্মেষ্টির মতো তার শোভা, প্রবর্গ তাঁর ভূষণ, বিবিধ ছন্দ হল গতিপথ, গুহ্য উপনিষদ হল আসন, ছায়া তার পত্নী ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি নানা দীক্ষায় দীক্ষিত। দ্যুতিময়, যজ্ঞময় যোগী, মহাকৃতি ও মণিশৃঙ্গের মতো উন্নত হয়ে বিচরণ করেন।
যখন প্রভু যজ্ঞবরাহ হয়ে জলে প্রবেশ করলেন, প্রজাপতি সেই পৃথিবীকে দেখে কাছে এলেন। শীঘ্রই সেই জলরাশিকে সরিয়ে দিলেন। সমুদ্রের জল সমুদ্রে, নদীর জল নদীতে স্থাপন করে জলাচ্ছাদিত পৃথিবীকে দুই দংষ্ট্রায় তুলে ধরলেন। লোকহিতের উদ্দেশ্যে রসাতলে নিমগ্ন পৃথিবীকে এইভাবে পৃথিবীর স্রষ্টা ধরণীধর প্রভু নারায়ণ পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে তার নিজের স্থানে এনে মুক্ত করলেন। দেবতার অপার অনুগ্রহ পৃথিবী সেই অতলান্ত জলরাশির মধ্যে নিমজ্জিত হল না। বরং একটা বিরাট নৌকার মতো ভাসতে লাগল। পৃথিবী উদ্ধার পেল।
এইভাবে কেলবমাত্র পৃথিবীর ভূমিখণ্ড রক্ষা পেল। পদ্মলোচন এবার পৃথিবীর স্থিতি কামনায় পৃথিবীর বিভিন্ন বিভাগে মন দিলেন। পৃথিবীকে সমান করলেন। সমতল পৃথিবীর স্থানে স্থানে পর্বতরাশি সঞ্চিত হল। পূর্বেই ঐসব পর্বত সম্বর্তক অগ্নি দ্বারা দগ্ধ হয়েছিল। সেই অগ্নি দ্বারা বিশীর্ণ পর্বতের যেসব স্থানে বায়ুস্পর্শে শীতল ঘনীভূত জলরাশি সংযুক্ত হল, সেইসব স্থান অচল হয়ে রইল। অন্যান্য স্থান থেকে গলিত হয়ে এসে সেই স্থানে সঞ্চিত হল, তাই পর্বতের আর এক নাম হল ‘অচল। ইহা শৃঙ্গ প্রভৃতি বিভিন্ন পর্বে বা অংশে বিভক্ত থাকে বলে একে পর্বতও বলা হয়। পর্বতের আরেক নাম গিরি। কারণ পর্বতের অন্তঃ প্রদেশ থেকে নিগীর্ণ অর্থাৎ নিঃসৃত হয় নদী। আবার শিলারাশির উচ্চেয় সঞ্চয় থেকে উৎপন্ন বলে শিলোচ্চয় নামেও ডাকা হয়ে থাকে।
ধীরে ধীরেএই বসুন্ধরা, পৃথিবী ও পর্বত–এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত হল। তখন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা পূর্ব পূর্ব কল্পের মতো তাকে সবসমুদ্রা সপ্তদ্বীপ্তা ও পর্বত শোভিতা করে তুললেন। পৃথিবী বাসযোগ্য হল।
স্বয়ম্ভু ভগবান ব্রহ্মা বিধি প্রজাদের সৃষ্টির কামনায় পূর্ব পূর্ব কল্প অনুসারে সৃষ্টি করে যেতে লাগলেন। প্রথমেই স্রষ্টা ভগবান ভূর্লোক প্রভৃতি চারটি লোকের কল্পনা করলেন। লোককল্পনার পর প্রজা সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টিকাজের প্রাথমিক পর্ব যখন সমাপ্ত হল, তখন তিনি নিশ্চিত মনে অপরাপর সৃষ্টির বিষয়ে ধ্যান করতে লাগলেন।
স্বয়ম্ভু ভগবান যখন ধ্যানমগ্ন, ঠিক সেই সময়ে সেই মহান আত্মা থেকে তমঃ, মোহ, মহামোহ, তমিস্র ও অন্ধ নামক তমোময় এই পঞ্চ অবিদ্যার আবির্ভাব হল। এগুলিই হল ধ্যানরত অভিমানী দেবতার পাঁচ প্রকার সৃষ্টি। এরা সকলেই কুম্ভাবৃত দ্বীপের মতো বাইরে তমো আবরণে আবৃত ও সংজ্ঞাবিহীন কিন্তু অন্তর্দেশে সংজ্ঞাবিশিষ্ট। এই পঞ্চপ্রকার অবিদ্যা দ্বারা বুদ্ধি ও প্রধান প্রধান ইন্দ্রিয় আবৃত হয়। সে কারণে এরা সংবৃতাত্মক এবং মুখ্য নগ বলে নামাঙ্কিত হয়েছে।
প্রথম সৃষ্টিতেই এই ধরনের অবৈধ বৃষ্টি হতে দেখে ব্রহ্মা অত্যন্ত অপ্রসন্ন হয়ে উঠলেন। কী করে এই ত্রুটি সংশোধন করা যায় সে বিষয়ে চিন্তা করছিলেন, তখন যেসকল প্রাণীর উৎপত্তি হল তার ‘তির্যকস্রোতঃ’ নামে পরিচিত হল। তির্যক স্রোতঃদের মধ্যে প্রচুর তমোগুণ লক্ষ্য করা যায়। তাই তারা সকলেই অজ্ঞান বহুল জড়কটপহগ্রাহী, অহংকৃত, অহংমনা, অষ্টাবিংশবিধাত্মক, একাদশ ইন্দ্রিয় বিশিষ্ট, নবধা উদর সম্পন্ন এবং অষ্টবিধ তারকাদি শক্তি সম্পন্ন। এরা সকলেই প্রকাশশীল এবং বহিরাবৃত। তির্যকভাবে প্রবর্তিত হয় বলেই তির্যকস্রোত নামে পরিচিত।
তির্যকস্রোত রূপ দ্বিতীয় বিশ্ব দর্শন করলেন– প্রভু। অবার ধ্যানস্থ হলেন। এই বার ধ্যানকালে সত্ত্বগুণবহুল তৃতীয় উধ্বস্রোতঃগণ ঊর্ধ্বভাবে প্রবাহিত হল। ঊর্ধ্বদিকে প্রবর্তিত হয় বলে তার ঊর্ধ্বস্ৰেতঃ নাম। এগুলি সুখবহুল, প্রীতিবহুল, বহিরাবৃত ও অন্তরাবৃত, তাই ঊর্ধ্বস্রোতঃ থেকে উদ্ভূত দেবতাদির বহিঃপ্রকাশ এবং অন্তঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই ঊর্ধ্বশ্রোতঃ পরমাত্মা ব্রহ্মার তৃতীয় সৃষ্টিরূপে পরিগণিত।
এই ঊর্ধ্বস্রোতরূপ দেবতাদের সৃষ্টি করে প্রভুপ্রজা ব্রহ্মা অত্যন্ত প্রীত হলেন। এবার তিনি হৃষ্টচিত্তে সাধক সৃষ্টির জন্য ধ্যানমগ্ন হলেন।
সেই তৃতীয় সৃষ্টি পরবর্তী অবস্থায় উদ্ভূত সাধকেরা অবাক অর্থাৎ নীচের দিকে প্রবর্তিত হন। তাই এঁরা অবাকস্রোতঃ নামে খ্যাত। অবাকস্রোতরা প্রকাশবহুল। এঁদের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ এবং তমোগুণের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায় তাই এঁদের জীবন দুঃখবহুল। এইসব সাধক ধরনের মনুষ্যদের বহিঃপ্রকাশ অন্তঃপ্রকাশ দুই-ই আছে। এঁরা অষ্টবিধ তারকাদি লক্ষণে চিহ্নিত। আবার এইসব মনুষ্যরা সিদ্ধাত্মা, এঁরা গন্ধর্বধর্মী। এইভাবে যে তেজের সৃষ্টি হল তা অবাকস্রোতঃ নামে নির্দিষ্ট হল। স্রষ্টা এবার তার পঞ্চম সৃষ্টির প্রতি মনোনিবেশ করলেন। পঞ্চম সৃষ্টি অনুগ্রহ। এটি বিপর্যয়, শক্তি, তুষ্টি ও সিদ্ধি–এই চারভাগে বিভক্ত। এই অনুগ্রহ চতুষ্টয় অতীত ও বর্তমান বিষয়ে তত্ত্বতর জানতে পারে।
পঞ্চম সৃষ্টি সম্পন্ন হতেই সহস্রাক্ষ স্রষ্টা পাঞ্চভৌতিক প্রাণীদের সৃষ্টি করলেন। এটি হল তার ষষ্ঠ সৃষ্টি। বিপরীত ক্রমে অসমর্থ ভূতাদির কথাও বলা হয়েছে। প্রথমে মহৎ-এর সৃষ্টি হয়। মহৎ থেকে দ্বিতীয় সৃষ্টি হিসেবে তন্মাত্র সৃষ্টি হয়। তৃতীয় হল ঐন্দ্রিয়ক বৈকারির সৃষ্টি, বুদ্ধিপূর্বক এই সৃষ্টির নাম প্রাকৃত সৃষ্টি। এরপরেই মুখ্য যে স্থাবর সৃষ্টি তা চতুর্থ সৃষ্টি, পঞ্চম সৃষ্টি হল তির্যক যোনি। ঊর্ধ্বস্রোত দেবতাদের সৃষ্টি। আর অবাকস্রোত সাধকের সৃষ্টি। মানুষদের সৃষ্টি সম্পত সৃষ্টি।
এখানেই শেষ নয়, পঞ্চবিধ সৃষ্টি, বৈকৃত সৃষ্টি, আর ত্রিবিধ সৃষ্টিকে একত্রে প্রাকৃত সৃষ্টি বলা হয়। এছাড়া প্রাকৃত ও বৈকৃত এই উভয় লক্ষণযুক্ত যে কৌমার সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় পরমেশ্বরের নবম সৃষ্টি।
প্রাকৃত তিনটি সৃষ্টি এবং বৈকৃত ছয়টি সৃষ্টি-ব্রহ্মার এই সমুদয় সৃষ্টিই বুদ্ধিপূর্বক।
এবার আমি আপনাদের কাছে অনুগ্রহ সৃষ্টি সম্বন্ধে বিস্তারিত বলছি, শুনুন। পূর্বোক্ত অনুগ্রহ-চতুষ্টয় (বিপর্যয়, শক্তি, সিদ্ধি, তুষ্টি) সর্বভূতেই অবস্থান করে। বিশেষ করে স্থাবরে বিপর্যয়, তির্যক যোনিতে শক্তি, মনুষ্যে সিদ্ধি এবং দেবসমূহে তুষ্টি নামক অনুগ্রহ অবস্থান করে থাকে।
এতক্ষণ এই যে নয়টি (প্রাকৃত ও বৈকৃত্য) সৃষ্টির কথা বলা হল, এদের পরস্পর সৃষ্টিও বহু প্রকারের। ব্রহ্মা প্রথমেই নিজের সমান বিদ্বান মানসপুত্রদের সৃষ্টি করেন। তারা হলেন সনন্দ, সনক ও সনাতন। ব্রহ্মার এই তিনজন মহাতেজা পুত্র বৈবর্ত বিজ্ঞানের দ্বারা নিবৃত্তি লাভ করেন। এঁরা সংবুদ্ধ হন। এই কারণেই এরা প্রজাসৃষ্টি না করেই প্রতিসর্গ লাভ করেন। এরপর ব্রহ্মা যাবতীয় স্থানাভিমানী পদার্থকে পর পর সৃষ্টি করলেন। সৃষ্টি হল অপ (জল), অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দিক, স্বর্গ, দিক সমুদ্র, নদ, পর্বত, বনস্পতি,ওষধি, বৃক্ষ, লতা, কাষ্ঠ, কলা, মুহূর্ত, সন্ধি, রাত্রি, দিন, পক্ষ, মাস, ঋতু, বৎসর, যুগ প্রভৃতি। এগুলি সবই প্রলয় কাল না আসা পর্যন্ত স্থায়ী হল।
এবার ব্রহ্মা মানুষ সৃষ্টির প্রতি মন দিলেন। মানব সৃষ্টিকালে ব্রহ্মার মুখ থেকে ব্রাহ্মণ, বক্ষ থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদেশ থকে বৈশ্য এবং পদতল থেকে শুদ্রের প্রাদুর্ভাব ঘটল। এইভাবে সকল বর্ণই ব্রহ্মার শরীর থেকে উৎপন্ন হল।
পুনরায় অব্যক্ত থেকে শ্রেষ্ঠ দেবতা নারায়ণের জন্ম হল। অব্যক্ত থেকে থেকে অণ্ডেরও উৎপত্তি হল। আবার অণ্ড থেকে ব্রহ্মা জন্মালেন। এবং সেই ব্রহ্মাই স্বয়ং সৃষ্টি করলেন– যাবতীয় লোকসমূহকে। এটাই হল তার প্রথম পাদ। বিস্তারিতভাবে না হলেও এর দ্বারা সংক্ষেপে পুরাণকথা কীর্তিত হল।
.
০৭.
প্রক্রিয়াপদ নামে প্রকীর্তিত এই প্রথম পাদটি শুনে পুরাণ শ্রবণে ইচ্ছুক নৈমিষ অরণ্যবাসী ঋষিবৃন্দ যারপরনাই আনন্দিত হলেন। তাঁদের মধ্যে থেকে কশ্যপ নন্দন সনাতন সূতকে সম্বোধন করে বললেন, হে সূতশ্রেষ্ঠ, স্পষ্ট বুঝতে পারছি পুরাণ ব্যাখ্যায় আপনি অত্যন্ত নিপুণ। আপনি কল্পজ্ঞ। আপনি এবার আমাদের অতীত ও বর্তমান কল্পের প্রতিসন্ধির বিষয়ে অবহিত করুন। আমরা সকলেই এ বিষয়ে অধিক জানতে উৎসুক।
রোমহর্ষণ বা লোমহর্ষণ বললেন, যথা অজ্ঞা ধীরবৃন্দ। অতীত ও বর্তমান কল্পের মাঝখানে যে প্রতিসন্ধি, আমি এখন সে বিষয়ে আপনাদের সবিস্তারে বলব। এই দুই কল্পে যেসব মন্বন্তর ঘটেছে সে বিষয়েও আপনাদের জ্ঞাত করব। উপস্থিত যে কল্পটি চলেছে সেটি বরাহ কল্প। এর আগে সনাতন কল্প অতিবাহিত হয়েছে। এই দুই কল্পের মাঝখানে যে কল্প সেই বিষয়েই বর্ণনা করছি, শুনুন।
পূর্বকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর যে কালে পরবর্তী অন্য একটি কল্পের আরম্ভ হয় তাকেই কল্পের প্রতিসন্ধি বলা হয়ে থাকে। এই প্রতিসন্ধিকালে পূর্বকল্পের সমস্ত ক্রিয়া নষ্ট হয়ে যায় এবং ঐ কল্প মধ্যবর্তী মন্বন্তর যুগ প্রভৃতি সন্ধিগুলিও নষ্ট হয়ে যায়। প্রসঙ্গত, মন্বন্তর যুগগুলির স্বার্থেই পূর্বকল্পগুলি পরপর প্রবর্তিত হতে থাকে। এই পূর্ববল্পগুলি সম্বন্ধে প্রক্রিয়াপদে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। এই পরাধ সংখ্যক কল্পগুলির পরবর্তী কল্পই বর্তমান কল্পের পূর্বকল্প এবং এই বর্তমান কল্পই ভবিষ্যৎ কল্পসমূহের প্রথম কল্প বলে জ্ঞান করতে হবে।
পূর্বোক্ত পরাধসংখ্যক কল্পের পরবর্তী এবং ভবিষ্যৎ কল্পের পূর্ববর্তী যে কাল, তাই হল এক একটি কল্পকালের স্থিতিকাল। তার পরেই সেই সেই কল্পের সংহার ঘটে। সেইমতো যুগ শেষে যখন দাহকাল উপস্থিত হল, তখন বর্তমান কল্পের পূর্ববর্তী যে সনাতন কল্প, সেই কল্প জীর্ণ হয়ে এল; আর মন্বন্তরগুলির সাথে অতীত হয়ে গেল। সেই কল্পের এক এক মন্বন্তরে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তারা প্রভৃতি অন্তরীক্ষস্থিত (দেবতাদের আবির্ভাব ঘটে)। এইভাবে এক একটি করে চতুর্দশটি মন্বন্তরে অর্থাৎ সমস্ত কল্পে অন্তরীক্ষস্থিত দেবতাদের সংখ্যা ছিল তিনশত কোটি বিরানব্বই হাজার একশত আট। এইভাবে এক একটি কল্পে দেবতারা অন্তরীক্ষবাসী অর্থাৎ বৈমানিক হয়ে থাকেন। সম্প্রতি যে কল্পটি অতীত হয়ে গেল সেই কল্পে দেবতাদের সংখ্যা হল সাতশো আট হাজার।
চতুর্দশ মন্বন্তরে দেবতা, পিতৃগণ, মুনিগণ ও মনুগণ তাদের অনুচরবর্গ ও মনুপত্রবৃন্দ–এঁরা সকলেই স্বর্গের অধিবাসী ছিলেন। সেই সময়ে মন্বন্তরগুলিতে বর্ণাশ্রম ধর্মপূজ্য যেসব স্বর্গবাসী দেবতারা দেবলোকে বিরাজমান ছিলেন, তাঁরা দেহান্দ্রিয়াদির সংযোজক তন্মাত্র প্রভৃতির সাথে মিলিত হলেন। এঁরা ছিলেন বশীভূত স্বভাবের। তাই কল্পান্তকাল উপস্থিত হওয়া মাত্র এঁরা নিজের নিজের বিপর্যয় অনুভব করলেন। তারা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। শেষ পর্যন্ত সেইসব ত্রৈলোক্যবাসী দেবতারা ঔৎসুক্যপূর্ণ বিষাদে বিমর্ষ হৃদয়ে মর্ত্যলোকে যাবেন বলে স্থির করলেন। এইসব কল্পবাসী ব্রাহ্মণরা ছিলেন তেজোময় শরীরধারী, যোগ্যরূপে বিবেচিত, বিশুদ্ধিবহুল, মানসসিদ্ধিযুক্ত; তবুও তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং তাদের ভক্তজনদের সাথে সেইসব চতুর্দশ দেবসংঘ মহলোক ত্যাগ করে শঙ্কাকুচিত্তে জনলোকে যাবেন বলে সংকল্প করলেন।
সেই জনলোক থেকে সর্বাধিক দশবার তারা স্বর্গলোকে যাতায়াত করলেন। অতঃপর দশকল্পকাল তপোলোকে অবস্থান করে আবার সত্যলোকে গেলেন। এইভাবে কল্পলোক নিবাসীর বিভিন্ন লোকের মধ্যে ক্রমিক যাতায়াত করে থাকেন।
এইভাবে পরের পর সহস্র দেবযুগ অতিক্রান্ত হলে দেবতারা স্থায়ীভাবে ব্রহ্মলোকে চলে যান। সেখান থেকে আর তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হয় না। ব্রহ্মলোকে অধিষ্ঠানকালে একমাত্র ঐশ্বর্য ব্যতীত রূপ ও বিষয়ে ঐশ্বর্য্যে তারা ব্রহ্মার (ব্রহ্ম) তুল্যই হয়ে থাকেন। এখানে তারা ব্রহ্মানন্দ লাভ করে ব্রহ্মেই মুক্তি লাভ করে থাকেন।
মুক্তিপ্রাপ্ত হবার পর প্রকৃতি নিয়মানুসারে তাদের মনে জাগ্রত ব্যক্তির মতো স্বরূপজ্ঞান হয়ে থাকে। অত্যন্ত অবশ্যম্ভাবী ভাবে তাদের মধ্যে সেইরকম জ্ঞানের বিস্তার ঘটে যায়। ভিন্ন এবং সূক্ষ্ম অবস্থায় তাদের মধ্যেকার সব ভেদাভেদ বিলুপ্ত হয়। তখন তাদের সাথে কার্য এবং করণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। পূর্বে এরা সকলেই ছিলেন নানাতত্ত্বদর্শী ব্রহ্মলোকবাসী। নিজের নিজের ক্ষমতা চলে গেছে জেনেও তখন তারা শুদ্ধাত্মা, সিদ্ধ, নিরঞ্জন ও কারণাতীত হয়ে নিজ নিজ প্রতীতিতে অবস্থান করেন। এঁরা পরম পুরুষরূপে স্থিত হন। প্রকৃতিও আর এঁদের প্রতি নিজেকে প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হয় না। কারণ পুরুষ এই প্রকৃতিকে চিনে ফেলেছে।
পুনঃসৃষ্টির সময়ে এইসব পুরুষদের অবস্থা হয় নির্বাপিত তেজের মতো। এই মুক্ত পুরুষদের আর পুনরুৎপত্তি হয় না। এঁরা আর পথপরিক্রমায় প্রবৃত্ত হন না। এইসব সুমহাত্মাদের ত্রৈলোক্য থেকে ঊর্ধ্বলোকে উত্তরণ ঘটে। কিন্তু যাঁরা মহর্লোক থেকে তাদের সাথে যেতে পারলেন না, অবশিষ্ট তারাই কল্পান্তরে দেহ ধারণ করে এখানে অবস্থান করেন। সেই সময়ে গন্ধর্ব শুরু করে পিশাচ পর্যন্ত দেবযোনি, ব্রাহ্মণাদি, মানুষ, পশুপক্ষী, স্থাবর, সরীসৃপ–সব এই পৃথিবীতেই বাস করেন।
সূর্যের সহস্ররশ্মিত সপ্তরশ্মিতে পরিণত হয়ে এক একটি সূর্যে পরিণত হয়। এরা একসঙ্গে উদিত হয়ে তিনলোক দাহ করতে থাকে। দাহ করতে থাকে স্থাবর, জঙ্গল, নদী, পর্বত, সবকিছু। এর আগেই ভীষণ অনাবৃষ্টিতে সমস্ত স্থাবর, জঙ্গল শুকিয়ে যাওয়ায় এক্ষণে সূর্যরশ্মিতে তারা নিঃশেষে দগ্ধীভূত হয়।
এরপর পাপ যুগ অতিবাহিত হলেও সেইসব দগ্ধদেহ প্রাণী পাপপুণ্যফলক যোনি থেকে মুক্ত হতে পারে না। তারা সেখানেই নিজ নিজ কর্মানুসারে ফললাভ করে।
যেসব অতি বিশুদ্ধগণ মানসীসিদ্ধিতে অবস্থিত ছিলেন, তাঁরা অব্যক্তজন্মা ব্রহ্মার প্রলয়রজনী অতিবাহিত করে পুনঃসৃষ্টিতে ব্রহ্মার মানসপ্রজা হলেন।
সপ্তসূর্যের দ্বারা ত্রিলোক দগ্ধ হতে লাগল। তারপর পৃথিবী হল বৃষ্টিপ্লাবিত। জীবের বাসস্থান বিশীর্ণ হয়ে গেল। সমুদ্র, মেঘ, জল সহ যতকিছু পার্থিব পদার্থ ছিল সবই জলমগ্ন হয়ে একার্ণব হয়ে গেল। গমনাগমনশীল সেই জলরাশি অর্ণব আখ্যা লাভ করল। ভূমিতল দৃষ্টির অগোচর হল। কোনো বস্তুই সেই জলাবরণে আভাসিত হতে পারে না। তাই জলরাশিকে ‘অম্ভ’ বলা হয়ে থাকে। আবার পৃথিবীর সব স্থানেই বিস্তৃত হয়ে ছিল বলে বিস্তারার্থক ‘তন’ ধাতুকে অনুসরণ করে জলের অপর নাম দেওয়া হল ‘তনু’। এছাড়া কবিরা শীঘ্র অর্থে ‘অরম’ নিপাত ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু একার্ণবত্ব অবস্থায় জলের এই শীঘ্রতা দেখা যায় না। তাই সেসময়ে জলকে ‘নার’ নামে কথিত হয়।
দেখতে দেখতে ব্রহ্মার যুগসহস্র দিনের অবসান ঘটল। জলময়ী প্রলয়রূপিণী রজনী উপস্থিত হল। পৃথিবী দগ্ধকারী আগুন সেই জলে বিনষ্ট হল। বায়ু প্রশান্ত হল। চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। সেই আলোক বিহীন অবস্থায় জগৎ-অধিষ্ঠাতা প্রভু পরমপুরুষ ব্রহ্মা আবার লোকবিভাগ করতে ইচ্ছা করলেন।
সেইসময় সেই এক-সাগরে পৃথিবীর স্থাবর-জঙ্গম যাবতীয় পদার্থ আচ্ছাদিত হয়ে গেল। পরমপুরুষ ব্রহ্মা ‘সহস্রাক্ষ’ ‘সহস্ৰপাদ’, ‘সহস্ৰশীর্ষ’, ‘সুবর্ণবর্ণ’, এবং অতীন্দ্রিয় নারায়ণ’ নাম ধারণ করে সেই সলিলে নিদ্রা গেলেন। তারপর তার মধ্যে সত্ত্বগুণ উদ্ৰিক্ত হল। তিনি জাগরিত হলেন। চোখ মেলে দেখলেন বিস্তীর্ণ শূন্যলোক।
প্রসঙ্গত ব্রহ্মার এই ‘নারায়ণ’ নামধারণকে ব্যাখ্যা করার জন্য আরও একটি শ্লোকের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। বলা হয়েছে–অপ, নারা ও তনু-জলের এই তিনটি নাম। ব্রহ্মা সেই জলতলে নাভিদেশ পূর্ণ করে অবস্থান করেন, তাই তার নাম নারায়ণ।
এই ‘সহস্ৰশীর্ষ’, ‘সুমনা’, ‘সহস্রপাদ’, ‘সহস্রচক্ষু’, ‘সহস্রবদন’, ‘সহস্রভুক’, ‘সহস্রবাহু’, ‘প্রথম’, ‘আদিত্যবর্ণ’, ‘ভুবনরক্ষক’, ‘এক’, ‘অপূর্ব’, ‘হিরণ্যগর্ভ’, মহাত্মা পুরুষ ব্রহ্মা, যিনি অন্ধকারের পরপারে অবস্থান করেন, সেই প্রজাপতি ব্রহ্মা কল্পের আদিতে রজঃগুণে উদ্ৰিক্ত হয়ে প্রজা সৃষ্টি করলেন। আবার কল্পান্তে তমোগুণে উদ্ৰিক্ত হয়ে আবার সবকিছু গ্রাস করে ফেললেন।
সমুদ্রে সুপ্ত অবস্থায় নারায়ণাখ্য দেবতা ব্রহ্মা সত্ত্বগুণের উদ্রেকবশত নিজেকে তিনভাগে বিভক্ত করে তিনলোকে অবস্থান করেছিলেন। তিনি সেই তিনটি অংশের এক একটি দ্বারা সৃষ্টি, গ্রাস ও দর্শন করতে থাকেন।’
এই যে চতুর্যগ সহস্রের অবসানে সবকিছু সলিলাবৃত হল, সেই সময় নারায়ণ নামধারী কালরূপী ব্রহ্মা চতুর্বিধ প্রজা গ্রাস করে ব্রাহ্মী রাত্রিতে মহার্ণবে সুপ্ত হয়ে রইলেন। মহর্ষিরা মহলোক থেকে তার যাবতীয় কর্মাবলী নিরীক্ষণ করে গেলেন। এইসব মহর্ষিরা বর্তমান কল্পের ভৃগু প্রভৃতি মহর্ষিদের মতোই ছিলেন। তাঁদের মহর্ষি বলা হত। কারণ, ঋ’ ধাতুর অর্থ গমন। এঁরা প্রথমেই গত হন অর্থাৎ নিবৃতি লাভ করেন তাই তাঁদের ঋষি আখ্যা দেওয়া হয়। এঁরা যেহেতু সেইসব ঋষিদের মধ্যে মহান, তাই এঁরা মহর্ষি।
অতীত কল্পে সত্য প্রভৃতি মহর্ষি ছিলেন। তাঁরা মহর্লোক অবস্থানকালে কালরূপী দেবতাকে সুপ্ত অবস্থায় দেখেন। এইভাবে সহস্র সহস্র ব্রহ্মরাত্রি অতিবাহিত হল। প্রত্যেক রাত্রির অবসানেই ঐ সকল মহর্ষিরা সুপ্ত কালরাজী দেবতাকে একই তীক্ষ্ণতায় নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।
সর্বভূতের প্রচেষ্টায় ব্যক্ত-অব্যক্ত মহাদেব ব্রহ্মকল্পের প্রারম্ভে চোদ্দোটি সংস্থার বহুবিধ কল্পনা করেছিলেন। তাই সৃষ্টিকালের নাম দেওয়া হয়েছে ‘কল্প। বর্তমান ও অতীত কল্পের মধ্যস্থিত প্রতিসন্ধি এবং পূর্ববস্থা সংক্ষিপ্তাকারে এতক্ষণ ধরে আপনাদের কাছে কীর্তন করলাম। এবার বর্তমান কল্পের বিষয়ে বর্ণনা করব।
.
০৮.
সূত রোমহর্ষণ বললেন, সহস্ৰযুগ পরিমিত প্রলয়রূপী রাত্রিকাল অতিক্রান্ত হল। রাত্রি অতীত হলে প্রজাপতি অভিমানী ব্রহ্মা বর্তমান কল্পের প্রথম সৃষ্টির প্রয়োজনে ব্রহ্মত্বের অবতারণা করলেন।
তখন সবদিক অন্ধকারে আবৃত। দূর দূর পর্যন্ত স্থাবর জঙ্গমাদি কোনোপ্রকার পার্থিব বস্তুর অস্তিত্ব পর্যন্ত নেই। প্রাণীকুল অবিভক্তভাবে সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। তখন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা বায়ুরূপ ধারণ করে সেই বিস্তীর্ণ জলরাশির ওপর বর্ষাকালের খদ্যোত বা জোনাকির মতো বিচরণ করতে লাগলেন। এইভাবে বিচরণ করতে করতে তিনি পৃথিবীতে সৃষ্টির পুনঃপ্রতিষ্ঠার উপায় অন্বেষণ করতে লাগলেন। অনন্ত জলরাশির মধ্যে পৃথিবী অন্তর্নিহিত হয়ে আছে–এই বাক্যকে সার সত্য বলে ধারণা করে তিনি পুনরায় সৃষ্টিকাজে নিয়োজিত হলেন। নিশ্চিত মনে পূর্ব পূর্ব কল্পের মতো এবারেও তিনি পৃথিবী উদ্ধারের জন্য অন্য রূপ ধারণ করে জলে প্রবেশ করলেন। সমুদ্রের জল সমুদ্রে এবং নদীর জল নদীতে বিন্যস্ত করলেন। এইভাবে তিনি জলে আবৃত পৃথিবীকে উদ্ধার করলেন।
জলবিন্যাসের পর তিনি পৃথিবীতে গিরিচয়ন করলেন। পূর্ব পূর্ব কল্পের যে সমস্ত পর্বত সম্বর্তক অগ্নিতে দগ্ধ হয়েছিল, বায়ুরূপী ব্রহ্মা সেই সমস্ত পর্বতকে শীতল জলময় সমুদ্রে সঞ্চিত করলেন। পর্বতগুলো সেই সেই স্থানে অচল হয়ে যায়। এইভাবে শুষ্ক হয়ে অচলভাবে অবস্থান করেছিল বলেই পর্বতের একটি নাম অচল। আগেই উল্লেখ করেছি এগুলি পর্ব অর্থাৎ ভাগের দ্বারা বিভক্ত বলে ‘পর্বত’, জলরাশি দ্বারা উদগীর্ণ বা প্রকাশিত বলে ‘গিরি’ এবং সঞ্চিত হয়েছে বলে ‘শিলোচ্চয়’ নামেও কথিত হয়।
প্রজাপতি জলমধ্য থেকে নিমজ্জিত ক্ষিতিকে উদ্ধার করে স্বস্থানে স্থাপিত করলেন। সপ্তবর্ষ এবং সপ্তদ্বীপ রূপে বিভক্ত করলেন, এতেও ভূমিভাগে সমতা ফিরল না। তখন অসম স্থানগুলিকে সমান করে অসংখ্য শিল দ্বারা অগনিত পর্বত নির্মাণ করলেন। সপ্তদ্বীপ মধ্যে সপ্তবর্ষ, সপ্তবর্ষের মধ্যে চল্লিশ প্রকার ভাগ, বর্ষান্ত স্থায়ী পর্বতমালা–এরা স্বভাববশেই সৃষ্টি হয়ে থাকে। অন্য উপায়ে নয় এদের মধ্যে আবার সপ্তদ্বীপ ও সমুদ্র বৈশিষ্ট্যের টানেই সন্নিবিষ্ট হয়ে পরস্পরকে আবৃত রেখেছিল। অন্যান্য সৃষ্টির পূর্বেই এইসব পদার্থের আধার স্বরূপ ভূর্লোক প্রভৃতি চারটি লোক এবং গ্রহগণের সাথে চন্দ্র এবং সূর্যকে নির্মাণ করলেন। উদাহরণ হিসেবে এই কল্পের পূর্বে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা জল, অগ্নি, পৃথিবী, বায়ু, অন্তরীক্ষ, স্বর্গ, দিক সমুদ্র, নদী, পর্বত, ওষধি, বৃক্ষলতাদির আত্মা, লব, কাষ্ঠা, কলা, মুহূর্ত, সন্ধি, রাত্রি, দিন, পক্ষ, মাস, অয়ন, বৎসর, যুগ, স্থানাভিমানী এবং স্থান প্রভৃতি পৃথক পৃথক পার্থিব দ্রব্যসম্ভার সৃষ্টি করে যুগসৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থা নির্মাণ করেছিলেন।
সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর, কলি–এই চারটি যুগ আছে। কল্পারম্ভে প্রজাপতি প্রথমেই সত্যযুগের প্রজা সৃষ্টি করেছিলেন। পূর্বে যেসকল প্রজার বিষয়ে বলা হয়েছে, তারাও সত্যযুগের প্রজা। ঐ সত্য যুগে যাঁরা তপোলোকে না যেতে পেরে জনলোকেই অবস্থান করেছিলেন, তারাই সম্বর্তক অগ্নিতে দগ্ধ হয়ে বীজের জন্য আবার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
এইভাবে সৃষ্টির কারণে বীজের প্রয়োজনে তারা সেখানেই অবস্থান করেন। তারপর তাঁরা সন্তান অর্থাৎ বংশ বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হন। দেববৃন্দ, পিতৃগণ, ঋষি এবং মনুগণ এই মর্ত্যলোকে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষের সাধকরূপে অভিহিত হয়ে থাকেন। তারপর তারা তপস্যায় নিমগ্ন হন। তপস্যার উপযুক্ত স্থান পূরণ করেন। তাঁরা ব্রহ্মার মানস পুত্র, তারা সিদ্ধাত্মা।
অপরদিকে যে সমস্ত প্রজা দ্বেষমুক্ত কর্মের দ্বারা স্বর্গে গেছেন, তারা যুগে যুগে জন্ম লাভ করে ফিরে আসেন। নিজের নিজের কর্মফল অনুসারে খ্যাত হয়ে থাকেন। একটি জগৎ থেকে অন্য জগতে লোকের জন্ম হয়। তা প্রধানত কৰ্মাশয়ের বন্ধনবশত। কর্মের সংস্কারকেই জন্মান্তরের কারণরূপে গণ্য করা হয়। শুভ-অশুভ সেইসব কর্মানুসারে লোকেরা এক জগৎ থেকে অন্য জগতে জন্ম লাভ করেন। দেবতা থেকে স্থাবর পর্যন্ত নানাবিধ শরীর পরিগ্রহ করেন। তারা সৃষ্টির পূর্বে যে যে প্রকার কর্ম সম্পাদন করেছিলেন, বারবার জন্ম লাভ করে, সেই সেই কর্মেরই ফলভোগ করেন। হিংস্র, অহিংস্র, মৃদু, কুর, ধর্ম, অধর্ম, সত্য, অসত্য–এই সমস্ত সংস্কার অনুসারে জন্মলাভের পর জীবেরা ঐ সমস্ত কর্মের প্রতিই আকৃষ্ট হয়। পূর্ব পূর্ব অতীত কল্পে লোকদের যেসব নাম রূপ নির্দিষ্ট লক্ষ্য করা গেছে, পরবর্তী কল্পে তাঁরা সেইসব নাম রূপই পরিগ্রহ করেন।
সৃষ্টির নেশায় আচ্ছন্ন ব্রহ্মার সৃষ্টিকর্ম যখন স্তব্ধ হয়ে এল, তখন তিনি আবার নতুন করে প্রজাসৃষ্টির কথা ভাবতে লাগলেন। সেই সত্যধানী দেবতার মুখমণ্ডল থেকে আবির্ভূত সত্য গুণ–উদ্ৰিক্ত পবিত্র আত্মা সহস্র মিথুন, বক্ষস্থল থেকে রজঃগুণসম্পন্ন তেজস্বী সহস্র মিথুন, উরুদেশ থেকে রজঃ ও তমোগুণ–উদ্ৰিক্ত চেষ্টাশীল সহস্র মিথুন এবং পদযুগল থেকে তমোগুণ সম্পন্ন হীনশ্রী অল্পতেজা সহস্র মিথুন।
এইসব মিথুন প্রাণীরা উৎপন্ন হওয়া মাত্র পরস্পর হৃষ্টচিত্তে মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়েছিল। এই কল্পে সেই বিশেষ সময় মিথুনোৎপত্তি উক্তিটির প্রচলন শুরু হয়। কিন্তু সেই সময় রমণী দেহে মাসে মাসে ঋতু হবার নিয়মনীতি ছিল না। তাই মৈথুন করা সত্ত্বেও তাদের সন্তান উৎপত্তি হল না। তখন জীবনের শেষভাগে একবারই মাত্র তাদের মিথুন-প্রসব হত। এই জন্যই কুটক ও কুবিক মুমূর্য অবস্থায় জন্ম লাভ করেছিল। এই সংস্কার আজও বজায় আছে। সেই থেকেই বর্তমান কল্পে মিথুনের উৎপত্তি হয়ে আসছে।
এরপর ব্রহ্মা মনে মনে ধ্যানে নিমগ্ন হলেন। ধ্যানারম্ভ তাদের প্রত্যেকে শব্দাদি পঞ্চলক্ষণ সহ প্রাদুর্ভূত হল। সুমনাঃ প্রজাপতি মনে যাদের সৃষ্টি করেছিলেন বর্তমান কালের প্রজারা তাদেরই বংশে সস্তৃত হল এঁদের দ্বারাই জগৎ পরিপূর্ণ হয়ে উঠল।
সত্য যুগে উৎপন্ন এইসব প্রজারা যথেচ্ছভাবে এই পৃথিবীর নদী, সরোবর, সমুদ্র ও পর্বত ভোগ করলেন। গ্রহণ করলেন– পৃথিবীর রসে উদ্ভূত রসাহার এবং অতঃপর সেই সকল নাতিশীতোষ্ণশালী মানস প্রজারা সিদ্ধিলাভ করলেন। বৈশিষ্ট্যগত ভাবে এইসব প্রজারা ছিলেন নির্বিশেষ অর্থাৎ তাদের নিজস্ব কোনো বিভিন্নতা ছিল না। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সমান আয় সম্পন্ন, সমান সুখ ও সমান রূপ বিশিষ্ট। এই সত্যযুগে তাদের জন্য কোনোপ্রকার ধর্ম-অধর্ম নির্দিষ্ট ছিল না। তা সত্ত্বেও তারা যা খুশি তাই করবার স্বাধীনতাও পেতেন না। তারা নিজ নিজ অধিকারে যুক্ত থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন।
দৈববর্ষ পরিমাণে চার হাজার বছর হল প্রথম সত্যযুগের অবস্থিতি কাল। আর তার সন্ধিকাল হল দৈববর্য পরিমাণে চারশো বছর।
এই যুগের নাতিশীতোষ্ণশালী প্রজাদের মধ্যে কোনোরকম ঘাত-প্রতিঘাত, শতোষ্ণাদি জনিত দুঃখ বা অন্য কোনো ক্রম কিছুই ছিল না। তাদের কোনো গৃহ আশ্রয় ছিল না। তারা শৈল উপত্যকায় অথবা সমুদ্র উপকূলে বাস করতেন। তারা সকলেই ছিলেন শোকবিহীন, তত্ত্বজ্ঞানসম্পন্ন এবং একান্ত সুখী। তারা ছিলেন নিঃশ্বাসচারী। তাদের চিত্ত সর্বদাই আনন্দিত থাকত। সেই সময়ে অধর্মের সংস্রব ছিল না বললেই চলে। তাই অধর্ম প্রসূত পশু, পক্ষী, সরীসৃপ, উদ্ভিজ্জ প্রভৃতি এবং ফলমূল পুষ্প, ঋতু প্রভৃতিরও উৎপত্তি হয়নি। সেই সময়ে সুখপ্রদ নাতিশীতোষ্ণ কালই একমাত্র বর্তমান ছিল। সে সময়ে সর্বত্র এবং সর্বদা তাদের অভিলাষিত বস্তু মাত্রই পরিব্যপ্ত ছিল।
সেই সময়ে চিন্তা করা মাত্রই পৃথিবী থেকে একপ্রকার রস উখিত হত। এই রস ছিল একপ্রকার রোগনাশক পানীয় যা সেই সত্য যুগোৎপন্ন নাতিশীতোষ্ণশালী মানস প্রজাদের বর্ণ তথা বর্ণের কারণ ছিল। এই পানীয় ছিল তাদের কাছে সিদ্ধি স্বরূপ। এর প্রভাবেই তার অসংস্কৃত শরীরেও চির যৌবনশালী ছিলেন। তাদের বিশুদ্ধ সংকল্প থেকে মিথুন প্রজার জন্ম হত। তাদের সকলেরই জন্মবৃত্তান্ত ও রূপ সমান ছিল। সকলেরই সমানভাবে মৃত্যু হত। সত্য, লোভহীনতা, ক্ষমা, তুষ্টি, সুখ, আয়ু, শীলতা ও চেষ্টা–এইসব গুণে তাদের মধ্যে কোনোই প্রভেদ ছিল না। সব থেকে বড়ো কথা, গুণগুলো নিজে নিজেই উদ্ভূত হয়েছিল। এইসব গুণের পিছনে কোনো বুদ্ধির প্রেরণা ছিল না।
সত্যযুগে কর্মের পাপ-পুণ্য বিভাগ ছিল না। বর্ণাশ্রম বা বর্ণসংস্কার ব্যবস্থা ছিল না। প্রজাদের পারস্পরিক ব্যবহার ছিল সৌজন্যমূলক ও বিদ্বেষবর্জিত। প্রজাদের রূপ ও আয়ু সমান ছিল বলে তাদের মধ্যে উত্তম-অধম ভেদাভেদ ছিল না। সত্যযুগবাসী প্রজারা সকলেই ছিলেন সুখবহুল, শোকবিহীন সর্বদা হৃষ্ঠচিত্ত। তারা সকলেই ছিলেন মহাসত্ত্ব ও মহাবল।
সত্যযুগের সেই সকল সরল প্রজাদের মধ্যে লাভ-অলাভ, মিত্র-অমিত্র, প্রিয়-অপ্রিয় ভেদজ্ঞান ছিল না। তাদের মনে অন্যের সুখ-সমৃদ্ধির প্রতি বিন্দুমাত্র লিপ্সা বা অনুগ্রহ ছিল না। এর একটি জোরালো কারণও ছিল। তারা সংকল্প মাত্রই সব কিছু পেয়ে যেতেন।
সত্যযুগে ধ্যানই ছিল একমাত্র ধর্ম। এইভবে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। যেমন–ত্রেতা যুগে জ্ঞান, দ্বাপরে যজ্ঞ এবং কলিযুগে দান শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে বিবেচিত হত। এছাড়াও সত্যযুগে সত্ত্বগুণ, ত্রেতা যুগে রজঃগুণ, দ্বাপরে রজঃ ও তমোগুণ এবং কলিযুগে তমোগুণের বাহুল্য দেখা যায়।
এইবার সেইসব যুগের সময় সংখ্যা সম্পর্কে আপনাদের বিস্তারিত বলছি শুনুন। সত্য যুগের অবস্থিতি কাল ছিল দেববর্ষ পরিমাণে চারসহস্র বৎসর। সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশের অবস্থিতিকাল চারশো বৎসর। মানুষের পরিমাণে সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশের কাল চল্লিশ সহস্র বৎসর। এরপর সত্যযুগের সন্ধ্যাংশ সময়টুকুও বিগত হয়। এই অবস্থায় সমস্ত ধর্ম বিনষ্ট হয়ে যায় মাত্র এক পাদ যুগসন্ধিতে অবশিষ্ট থাকে এবং সন্ধিশেষেও এই রকম মাত্র সন্ধিধর্মই অবশিষ্ট থাকে।
এইভাবে সত্যযুগ নিঃশেষিত হয়। তার সাথে সাথে সিদ্ধিও অন্তর্হিত হয়। এইভাবে প্রজাপতি ব্রহ্মার সেই মানসী সৃষ্টি নষ্ট হলে ত্রেতাযুগের মধ্যবর্তী সময়ে পূর্বোক্ত প্রথম কল্প সময়ের অষ্টসিদ্ধির মতো অন্য অষ্টসিদ্ধির উৎপত্তি হয়। যথানিয়মে ঐসব সিদ্ধিও আবার ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। আদিকল্পের ঐ অষ্টসিদ্ধিই সত্য যুগের সিদ্ধি। মন্বন্তরগুলিতে চারটি যুগের বিভাগ অনুসারে বর্ণাচার এবং আশ্ৰমাচার জনিত কৰ্মসিদ্ধির উদ্ভব হয়ে থাকে। সত্যযুগ সন্ধ্যা ও সন্ধ্যাংশ–এদের যুগধর্ম স্বরূপ তপঃত বল ও আয়ুর তিনপাদ অংশ জীর্ণ হয়ে আসতে থাকে। সেই অবশিষ্ট সত্যযুগের অংশ থেকেই অন্য যুগ অর্থাৎ ত্রেতাযুগের আবির্ভাব ঘটে যায়। সত্যযুগের নাশের সাথে সাথে সত্যযুগের সিদ্ধি সমূহেরও নাশ ঘটে যায় এবং অন্য সিদ্ধির উৎপত্তি ঘটে।
ত্রেতাযুগের উৎপত্তিকালে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম জলকণা মেঘকণায় পরিণত হয়। অবশেষে সেই ভাসমান মেঘকণা জমাট বেঁধে গভীর গর্জনকারী ঘনঘটায় পরিণত হয়। ক্রমে তা থেকে বর্ষণ শুরু হয়। এইভাবে পৃথিবীতল অর্থাৎ উখিত ভূমিভাগ বৃষ্টির সাথে সংযুক্ত হয়। একবার সংযুক্ত হওয়ার পর থেকেই সেখানে নানাবিধ বৃক্ষ জন্মাতে শুরু করে। সেইসব বৃক্ষরাজি থেকে ত্রেতাযুগের প্রজাবৃন্দ উপভোগ্য পদার্থ সমূহের জোগান পেতে থাকে। প্রজারা এইসব পদার্থের সাহায্যেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। এভাবে বহুকাল নির্বাহ করার পর বিপর্যয় দেখা দিল। সেই আকস্মিক বিপর্যয়ের পর থেকেই রাগ, লোভ, প্রভৃতি ভাবসমূহের প্রাদুর্ভাব হল। স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও দেখা দিল পরিবর্তন। যেমন–পূর্বকালে স্ত্রীদের জীবনান্তে একবার মাত্র ঋতু হত, কিন্তু এবার তার অন্যথা হল। রমণীদের প্রতি মাসে ঋতু হতে লাগল। সুতরাং অকালেই সকলের গর্ভ উৎপত্তি হল। পরবর্তীকালেও নারীদের এই বিপর্যয় অব্যাহত থাকায় গৃহপালিত পশু ও সমস্ত বৃক্ষ একে একে নষ্ট হল। এইভাবে একের পর এক সবকিছু নষ্ট হতে থাকায় সত্যধ্যানী প্রজারা ব্যাকুল হয়ে সিদ্ধি চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন। আবার তাদের থেকে পাওয়া যেতে লাগল বস্ত্র, ফল, আভরণ। আবার এগুলির মধ্যে থেকে উৎপন্ন হতে লাগল গন্ধ-বর্ণ-রস সমন্বিত মহাবীর্য মক্ষিকাবিহীন মধু।
সেই যুগপ্রারম্ভে প্রজাসকল সেই মধু দ্বারাই বিকল্পভাবে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সেই সিদ্ধি দ্বারা তারা হৃষ্ট, তুষ্ট এবং রোগশূণ্য ছিলেন। কিন্তু কালান্তরে আবার একদিন তারা লোভাভিভূত হয়ে পড়লেন। লোভের বশে বলপ্রয়োগ করে সেইসব কল্পবৃক্ষ থেকে মক্ষিকা বিহীন মধু অবাধে চয়ন করতে লাগলেন। তাদের সেই লোভজনিতঅনাচারের ফলে কোথাও কোথাও মধুসহ কল্পবৃক্ষগুলি নষ্ট হয়ে যেতে লাগল। সিদ্ধির অল্প মাত্র অংশ অবশিষ্ট রইল। এই অবস্থায় সন্ধ্যা কালবশত শীত-উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বের আবির্ভাব ঘটে গেল। এইসব তীব্র দ্বন্দ্বরূপ শীত-তাপ-বায়ু দ্বারা পীড়িত হতে হতে তারা শরীরের আবরণ প্রস্তুত করলেন। সেই সঙ্গে এইসব দ্বন্দ্বের প্রতিকারের লক্ষ্যে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করলেন। অতএব পূর্বে যাঁরা ছিলেন নিতান্তই কামাচারী এবং গৃহ আশ্রয়হীন, এখন তারাই যোগ্যতা অনুসারে সুখপ্রদ বাসস্থান নির্মাণ করতে প্রবৃত্ত হলেন। মরুপ্রান্তরে, পর্বতের সানুদেশে ও নদী অববাহিকায় তাঁরা আশ্রয় নিলেন। মরুদেশের ক্ষেত্রেও তারা এমন স্থানগুলিকেই কেবল নির্বাচন করতেন, যেখানে জল পাওয়া যাবে সর্বদা, অর্থাৎ মরুদ্যানগুলিই তাদের পছন্দের তালিকায় ছিল। এইভাবে অনেকাংশে যোগ্যতা অনুসারে কোনো কোনো ক্ষেত্রে যথেচ্ছ অনুসারে তারা সমান ও অসমান স্থানে শীতোষ্ণনিবারক বাসগৃহ নির্মাণ করতে লাগলেন।
সেই যুগ প্রারম্ভিক পর্বের প্রজাদের সেইসব আরাম আলয় ক্রমে পুর, অন্তঃপুর, গ্রাম, নগর, পল্লি, প্রদেশ প্রভৃতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এইসব সন্নিবেশে যোজন পরিমাণ ছিল এইরকম– অনুষ্ট থেকে তর্জনীর অগ্রভাগ পর্যন্ত যে পরিমাণ তার নাম ‘প্রদেশ’ বা ‘ব্যাস’, অনুষ্ট থেকে মধ্যমার অগ্রভাগ পর্যন্ত যে পরিমাণ তার নাম ‘তাল’, অঙ্গষ্ট থেকে অনামিকার অগ্রভাগ পর্যন্ত যে পরিমাণ তার নাম ‘গোকর্ণ’। এবং অনুষ্ট থেকে কনিষ্ঠা পর্যন্ত পরিমাণ ‘বিতস্তি’। এই বিতস্তি আঙ্গুল পরিমাণে বারোটি আঙ্গুল থাকে। একুশটি আঙ্গুলে এক ‘রঙ্গি’ বা ‘অরত্নি’ গণ্য করা হয়, এইভাবে কুড়িটি রত্নিতে এক ‘ধনু’ কুড়িটি আঙ্গুলে এক ‘হস্ত’ বা ‘কিস্কু’, ছিয়ানব্বই আঙ্গুলে এক ‘দ্বিরঙ্গি’, হিসাব করা হত, এই দ্বিররি ‘চতুর্হস্ত’, চতুর্দণ্ড ‘নালিকা’ ও ‘যুগ’ নামে পরিচিত ছিল। দুই হাজার ধনুতে এক ‘গব্যুতি’ এবং আট হাজার ধনুতে এক যোজন গণনা করা হত।
ত্রেতাযুগের প্রজারা যে ধরনের দ্বন্দ্ব নিবারকে নিকেতন প্রস্তুত করেছিলেন তারও একটা বিশেষ গঠন ছিল। তাদের নির্দিষ্ট চারটি দুর্গের মধ্যে তিনটি দুর্গ ছিল স্বাভাবিক এবং একটি কৃত্রিম। কৃত্রিম দুর্গটি অতি উচ্চ প্রাকারবেষ্টিত ভাবে তৈরি করা হত। এতে থাকত চতুঃশালা গৃহ, বহির্ধার, ও অন্তঃপুর। এর চতুর্দিকে পরিখা কাটা ছিল। এই দুর্গের আটটি দ্বার ছিল। এই দুর্গের দ্বার আট, নয় বা দশ হাত পরিমাণ পর্যন্ত হত। এই দুর্গের মধ্যবর্তী স্থানে গ্রাম ও নগর, পল্লি গঠন করা হত।
স্বাভাবিক দুর্গগুলিও পর্বত ও জলবেষ্টিত স্থানেই নির্মাণ করা হয়েছিল। তাদের আয়তনের পরিমাপ ছিল দৈর্ঘ্যে আট যোজন এবং বিস্তারে চার যোজন। নগরের অর্ধেক ভাগ দৈর্ঘ্য বিস্তৃতি এবং পূর্বদিকে ক্রমশ নিম্নগামী ছিল। তবে এগুলি কোনো ভাবেই ছিন্নকর্ণ, বিকর্ণ, ব্যাঞ্জনস, কৃশ, বৃত্তিহীনতা বা দীর্ঘাদি দোষে দুষ্ট ছিল না। চব্বিশ থেকে শুরু করে আটশো হাত পর্যন্ত যে পরিমাণ, তার মধ্যবর্তী স্থানে চতুষ্কোণ বিশিষ্ট ও সরলভাবে সেইসব নগর নির্মিত হয়েছিল। প্রজাদের প্রধান আবাসস্থলের পরিমাপ ছিল আটশো হাত। নগরের আয়তন অনুসারে তার নামকরণ করার রীতি ছিল। পরিমিত স্থান নিয়ে গঠিত নগরের নাম ‘মেট’, তার চেয়ে বেশি পরিমাপ হলে তাঁর নাম ‘গ্রাম’, অথবা নগর অপেক্ষা বেশি যোজন হলে সে স্থানের নাম ‘মেট’, মেট অপেক্ষা অর্ধযোজন পরিমিত স্থানকে ‘গ্রাম’ বলা হত। এসবের চরম সীমা দুই ক্রোশ এবং ক্ষেত্রসীমা চারি ধনু ধার্য করা হয়েছিল। এইসব নগরীতে বিংশতি, অর্থাৎ কুড়িটি। ধনু বিস্তৃত হল ‘দিকমার্গ। কুড়ি ধনু হল ‘গ্রাম মার্গ। দশ ধনু হল ‘সীমা মার্গ। রাজপথ দশ ধনু পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। অশ্ব, রথ ও হস্তীদের যাতে অবাধ সঞ্চরণ হতে পারে তা সুনিশ্চিত করা হয়। এছাড়া চার ধনু বিস্তৃত শাখাপথ, গৃহপথ, উপপথ, অর্ধপদ, বৃত্তিমার্গ, প্রাথংশ পদসাত্র অবস্কার, এবং চারদিকের জলজপ্রাণী প্রভৃতি ও পৃথক পৃথকভাবে নির্দেশ করা হয়েছিল।
এই নগরাদি স্থানসমূহ যথাভাবে সন্নিবেশিত হল। পূর্বে গৃহস্থিত বৃক্ষগুলি যেমনভাবে ছিল ঠিক তেমন ভাবেই রক্ষিত করার কথা তারা বারবার চিন্তা করতে লাগলেন। গৃহাদি নির্মাণের ক্ষেত্রেও তারা একই বিষয়ে চিন্তা করলেন। বৃক্ষের শাখাসমূহ যেমন ঊর্ধ্ব ও তির্যকভাবে বিস্তৃত ছিল, তাদের গৃহগুলিকেও সেই ভাবে নির্মাণ করা হল। এই জন্য গৃহের অপর নাম হল শালা। আবার এই শালাগুলির প্রতি নিরীক্ষণে মন প্রসাদ লাভ করে অর্থাৎ এই গৃহ বা শালাগুলি মনকে প্রসাদ দান করে। তাই গৃহগুলির অপর নাম প্রাসাদ।
এইভাবে যথাক্রমে নগর এবং শীতোষ্ণাদি নিবারক গৃহের নির্মাণ সম্পূর্ণ হল। এদিকে মক্ষিকা বিহীন মধুর দুষ্প্রাপ্যতা বুদ্ধির সাথে কল্পবৃক্ষগুলিও অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় প্রজারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়লেন। তারা বিষাদ ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।
ত্রেতাযুগে তাদের সুবিধার জন্য বার্তা সাধিকা নামক অন্য একপ্রকার মানস সিদ্ধির প্রাদুর্ভাব ঘটল। তাদের ইচ্ছামাত্র জল-বৃষ্টি হতে লাগল এবং তা থেকে নদীনালা প্রভৃতির উৎপত্তি হল। দ্বিতীয় বৃষ্টির ফলে জল ও ভূমির সংযোগ হল। পুষ্প ফল-মূল বিশিষ্ট ওষধি বৃক্ষ, চতুর্দশ প্রকার অকাল সৃষ্ট, অনুপ্ত গ্রাম ও অরণ্যজাত ঋতু, পুষ্প, ফল, বৃক্ষ ও গুল্মের জন্ম হল। ইতিমধ্যে ত্রেতা যুগীয় প্রভাবের অবশ্যম্ভাবী পরিণাম বশত আবার তাদের মধ্যে রাগ লোভ প্রভৃতি চেতনা উপস্থিত হল। তারা তখন নিজ নিজ বল অনুসারে নদী, ক্ষেত্রে পর্বত, বৃক্ষ গুল্ম ওষধি প্রভৃতি অধিকার করতে লাগলেন। পূর্বে যেসব সিদ্ধাত্মাদের কথা বলা হয়েছে সেইসব ব্রাহ্মণ মানুষদের আবার উৎপত্তি হল। যাঁরা শান্ত চিত্ত ও তেজস্বী ছিলেন তাদেরও উৎপত্তি হল। কিন্তু তারা জন্মালেন কমী ও দুঃখী মানুষরূপে অর্থাৎ তাঁরা। ত্রেতাযুগে আবার জন্মগ্রহণ করলেন। পূর্বজন্মে শুভ-অশুভ, পাপ-পুণ্য যে প্রকারের কর্ম তিনি করেছিলেন সেই কর্মফল ভোগের জন্য ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য অথবা শুদ্র জাতিভুক্ত হয়ে জন্মলাভ করলেন। এঁদের কিছু কিছু ধর্মাদ্রোহী প্রজাও জন্ম নিলেন। এঁরা তৎকালীন সামাজিক বিন্যাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলেন। দেখা গেল, এই সমস্ত ধর্মদ্রোহী প্রজারা যাঁরা অপেক্ষাকৃত অধিক বলবান কিংবা অল্প বলবান অথচ যারা সত্যশীল অহিংসক, নির্লোভ ও জিতেন্দ্রিয় তাদেরকে পরাভূত করে তাদের অধিকার বাড়াতে শুরু করেছেন। এইভাবে তারা যখন পরস্পর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন, তখন তাঁদের কৃত সেই পাপে মুষ্টি সংগৃহীত বালুকণার মতো ফল ও পুষ্পপ্রদ চতুর্দশ প্রকার গ্রাম্য ও আরণ্যক ওষধি প্রভৃতি সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়ে যায়। এইসব মূল্যবান দ্রব্যসম্ভার নষ্ট হলে প্রজারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। শেষ পর্যন্ত ক্ষুধাতুর হয়ে তারা স্বয়ম্ভু প্রজাপতির কাছে যেতে বাধ্য হলেন।
স্বয়ম্ভু প্রজাপতি সহস্রাক্ষী অন্তর্যামী। তিনি প্রজাদের মনের ইচ্ছা প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে জানতে পারলেন। এইভাবে ত্রেতাযুগের আদিতে প্রজাদের জীবিকা নির্বাহের উপায় অন্বেষণ পূর্বক ওষধি প্রভৃতি বৃক্ষের আবার যাতে উদগম হয় তার জন্য সুমেরু বৎসরূপে কল্পনা করে এই পৃথিবী দোহনে প্রবৃত্ত হলেন। এর ফলে কতগুলি গ্রাম্য বীজ, আরণ্যক বীজ এবং ফল পাকার সাথে সাথে নষ্ট হয়ে যায় এমন কতগুলি ওষধির জন্ম হল। ধান্য, যব, গোধুম, অনু, তিল, প্রিয়ঙ্গু, কারূষ, বার্ণক, যাষ, মুদগ, মসুর নিস্রাব, কুলদ্ম, আরক ও চনক–এই সমস্ত ওষধিকে বলা হয় গ্রাম্য ওষধি, আবার ধান্য, যব, মাষ, গোধূম, অনু, তিল, প্রিয়ঙ্গ, কলন্থ এই আট রকমের গ্রাম্য ওষধি ছাড়াও শ্যামক, নীবার, জর্তিল বেধূক কুরুবিন্দ, বেনুব, মর্কটক–এই ছয় প্রকার অরণ্য জাতীয় ওষুধ বহুল প্রচলিত ছিল। ত্রেতাযুগের আদিতে এই চতুর্দশ প্রকার ওষধি সর্বপ্রথম উৎপন্ন হয়েছিল। প্রথমে পৃথিবীতলের কিছু অকৃষ্টভূমিতে এইসব গ্রাম্য ও আরণ্য জাতীয় ওষধি। বৃক্ষ, গুল্মলতা, বল্পী, বীরুষ, তৃণ, ফল-মূল, পুষ্প এমনকি স্বয়ম্ভু প্রজাপতি পৃথিবী দোহনকালে যেসব বীজ পেয়েছিলেন সেইসব বীজ ইত্যাদি উৎপন্ন হল। এই সকল বৃক্ষাদি ঋতু অনুসারে ফল-মূল পুষ্পদি দ্বারা পরিশোভিত হত। কিন্তু পরে এইসব ওষধি বন্ধ হয়ে গেল তখন ব্রহ্মা সেই সময়কার প্রজাদের কর্মজন্য সিদ্ধি দেখে তাদের জীবিকার অন্য উপায় স্থির করলেন। সেই থেকে ওষধি প্রভৃতি বৃক্ষ বৃষ্টপচ্যরূপে সৃষ্টি হল। সুনির্দিষ্টভাবে প্রজাদের বৃত্তির উপায় স্থির হল।
ত্রেতাযুগীয় প্রজাদের দুর্ভাবনা প্রশমিত হলে সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতি তাদের মধ্যে পারস্পরিক মর্যাদা স্থাপন করলেন। প্রজাদের মধ্যে যাঁরা পরিগৃহীত এবং অপর প্রজার রক্ষক তাদের ক্ষত্রিয় বলে স্থির করলেন। যাঁরা “সর্বভূতেই ব্রহ্মা বিদ্যমান”–এই শাস্ত্রবাক্যকে শিরোধার্য করে ক্ষত্রিয়দের আশ্রয় নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করতেন তাঁদের ব্রাহ্মণ বলে চিহ্নিত করা হল। যাঁরা কৃষিকার্যের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করতেন তাঁরা হলেন বৈশ্য। পরিশেষে শুদ্রদের জন্য একটি সুচিন্তিত মাপকাঠি নিবারণ করলেন, বলা হল শোক বা দুঃখে বিগলিত হয়ে যাওয়া যাঁদের স্বভাব, যাঁরা নিস্তেজ অল্পবীর্য ও অপর তিন জাতির পরিচর্যায় রত তারাই শুদ্র বলে প্রতিষ্ঠিত হবেন। চতুর্বর্ণ নির্দিষ্ট করে ব্রহ্মা অসলে ধর্ম কত্তরের বিধিবিহিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর উদ্দেশ্য সফল হল না। প্রজারা অচিরেই মোহবশত সেইসব ধর্ম কর্ম অতিক্রম করতে লাগলেন। বর্ণধর্ম পালন না করে পরস্পরের সঙ্গে বিরোধ শুরু করে দিলেন। তখন ব্রহ্মা অন্য উপায় চিন্তা করে অন্যরকম কর্মের বিধান দিলেন যেমন–বর্ণ অনুসারে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল–বল, দণ্ড ও যুদ্ধ। ব্রাহ্মণের জন্য নির্দিষ্ট ধর্ম হল–যাজন, অধ্যাপনা ও পতিগ্রহ। পশুপালন, বাণিজ্য ও কৃষি বৈশ্যের ধর্ম। আর শিল্প ও দাসত্ব শুদ্রদের জীবিকা হিসেবে নির্দিষ্ট করা হল। এছাড়া অভিমানী ব্রহ্মা অতিরিক্ত কর্তব্য হিসেবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য-কে সৃজন, অধ্যয়ন ও দান–এই তিনটি কর্মের সমান অধিকার দিলেন।
এইভাবে পৃথিবীবাসী ত্রেতাযুগীয় প্রজাদের প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী কর্ম জীবিকার ব্যবস্থা করা হল। এরপর লোকান্তরেও তাদের জন্য সিদ্ধিনুসারে পৃথক পৃথক স্থান নির্দিষ্ট হল। এক একটি বর্ণের জন্য এক একটি লোক স্থির করা হল। উদাহরণ হিসাবে ক্রিয়াবান ব্রাহ্মণদের জন্য ব্রহ্মলোক, যুদ্ধস্থলে যে সব ক্ষত্রিয় পলায়ন না করে বীরের মতো প্রয়াণ প্রাপ্ত হন, তাদের জন্য ইন্দ্রলোক, স্বধর্ম প্রতিপালক বৈশ্যদের জন্য বায়ুলোক এবং পরিচর্যা পরায়ণ শুদ্রদের জন্য গন্ধর্বলোক নির্দিষ্ট করা হল। চতুর্বর্ণের মধ্যে যাঁরা যথাযথ বর্ণ ধর্ম পালন করবেন কেবল তারাই নির্দেশিকা অনুযায়ী স্থান লাভ করবেন।
এইভাবে লোকান্তরে চতুর্বর্ণের জন স্থান নির্দিষ্ট করার পরে স্বয়ম্ভু ভুবন রক্ষক ব্রহ্মা তাদের জন্য চারটি আশ্রম স্থাপন করলেন। যথা–গার্হস্থ্য, ব্রহ্মচর্য, বাণপ্রস্থ, সন্ন্যাস। তখনকার সমাজ ব্যবস্থায় যেসব আশ্রমবাসী বর্ণকর্মের অনুষ্ঠান করতেন না তারা ধর্মের পথে ক্ষতিকারক বলে গণ্য হতেন। তাই ব্রহ্মা সেই চতুঃআশ্রমবাসীদের সম-নিয়মাত্মক বর্ণের নির্দেশ দিলেন। এই চারটি আশ্রমের মধ্যে প্রথম যে গাৰ্হস্থ আশ্রম তাতে ব্রাহ্মণাদি চারটি বর্ণেরই অধিকার রইল। অবশিষ্ট তিনটি আশ্রমের মূল এবং প্রতিষ্ঠা হল এই গৃহস্থ আশ্রম, এই পর্যায়ে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। এখন আপনাদেরকে সেই চারটি আশ্রমের সম-নিয়ম ইত্যাদি যথাক্রমে বলছি।
গৃহস্থ আশ্রমের ধর্ম হল দারপরিগ্রহ, অগ্নিস্থাপন, অতিথি সৎকার, যজ্ঞ, শ্রাদ্ধ ও প্রজা উৎপাদন। এগুলি গৃহস্থবাসীর পরম ধর্ম। দণ্ড মেঘলা জটাধারণ, ভূমিতে শয়ন, গুরুশুশ্রূষা, ভিক্ষা প্রভৃতি হল ব্রহ্মচারীর ধর্ম, পরবর্তী পর্যায়ে কৃচ্ছসাধনের ওপরেই জোর দেওয়া হয়েছে। জীর্ণ বস্ত্র কিংবা পত্র বা মৃগচর্ম পরিধান, ধান্য এবং ফল-মূল ও ওষধি আহার, উভয় সন্ধ্যায় অবগাহন ও হোম, অরণ্যবাসীদের অনুরূপ স্বস্তিকাদি আসন অভ্যাস, বস্ত্রে ভিক্ষা গ্রহণ, অচৌর্য, শুচিতা, অপ্রমাদগুলি; অব্যভিচার, জীবে দয়া ও ক্ষমা, ক্রোধহীনতা, গুরু শুশ্রূষা ও সত্যকথন–এই গুলি ভিক্ষুর ধর্ম। এইগুলিকে ভিক্ষুব্রত বলা হয়। এ ছাড়া আচার শুদ্ধি, নিয়ম, শৌচ,প্রতিকর্ম ও সম্যদর্শন–এই পাঁচটি উপব্রতও তাদের পালনীয় ছিল। পরিব্রাজক অর্থাৎ সন্ন্যাস পর্যায়ে সব রকমের বাহুল্য বর্জিত হয়ে মুক্তির কামনায় ব্রতী হতে হত। ইন্দ্রিয় ও মনের সমাধি গনে অগ্রসর হয়ে ভিক্ষা করা, মৌনতা, পবিত্রতা ও মুক্তি আকাঙ্ক্ষা এগুলি হল পরিব্রাজকদের ধর্ম। এই সমস্ত নিয়মনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি কথাই বিবেচনা করা হয়েছিল। যে ব্যক্তির চিত্ত অশুদ্ধ, তার পক্ষে সত্য, সরলতা যোগ যজ্ঞ, দম, বেদ, অধ্যয়ন, ব্রত নিয়ম প্রভৃতি কোনো বাহ্যকর্মেই সুসম্পন্ন হতে পারে না। যে ব্যক্তির অন্তঃকরণ কলুষিত, সেই ব্যক্তি যদি পরাক্রমবশে কোনো জনহিতকর কাজ করেন তবেও তার ধর্মাচরণ হয় না। কারণ চিত্তশুদ্ধিই হল ধর্মের তপশ্চর্যা একমাত্র ভিত্তি। এর অন্যথা গ্রহণীয় হবে না।
এইসব বর্ণাশ্রমের অনুষ্ঠান অনুসারে পরলোকেও স্থান বিশেষ করা আছে। দেবতাগণ, পিতৃগণ, ঋষিগণ, মনুগণ প্রমুখ যে স্থানে অবস্থান করেন ঊর্ধ্বোরেতা ও গুরুগৃহবাসী মুনিদের জন্য সেইসব অষ্টআশি হাজার সংখ্যক স্থান নির্দিষ্ট হয়ে আছে। স্বর্গবাসীরা সপ্তর্ষিদের স্থান লাভ করেন। একইভাবে গৃহস্থরা যদি স্বধর্ম পালন করেন তাহলে পরলোকে প্রজাপত্যস্থান লাভ করেন। যোগীরা অমৃতস্থান লাভ করেন। আর সন্ন্যাসীরা লাভ করেন অক্ষয় ব্রহ্মলোক। কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে যদি মনের চাঞ্চল্য থাকে তবে কেউ কোনো স্থান পান না। কারণ যাঁরা নিজ নিজ আশ্রমধর্ম প্রতিপালন করেন কেবলমাত্র তাদের জন্যই এই সকল স্থান নির্দিষ্ট করা হয়েছে।
প্রথম মন্বন্তরে লোকনিয়ন্ত্ৰা ব্ৰহ্মা এই চারটি আশ্রমকেই দেবযান নামক পথরূপে সৃষ্টি করেন। রবি হল সেই দেবযানের দ্বার স্বরূপ। একইভাবে চন্দ্র হল পিতৃযানের দ্বার।
ব্রহ্মা কর্তৃক একইভাবে বর্ণাশ্রম বিভাগের পর যখন দেখা গেল বর্ণাশ্রমবলম্বী প্রজারা আর জন্মলাভ করছেন না, তখন ত্রেতাযুগের মধ্যসময়ে আত্মা ও নিজের শরীর থেকে আত্মতুল্য কতকগুলি সত্ত্ব ও রজঃ গুণসম্পন্ন মানসপ্রজার সৃষ্টি করলেন। আত্মা সৃষ্টি মানসপ্রজারা ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ ও কর্তার সম্পাদক।
তখন সেই প্রজাধর্ম উপস্থিত হলে স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা নানাপ্রকার মানসপ্রজার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। তাঁর সেই ঐকান্তিক কামনার ফলে জললোক আশ্রিত প্রজারা যুগ অনুরূপ ধর্মযুক্ত হয়ে দেব, পিতৃ ঋষি, মনু প্রভৃতি রূপে পৃথিবীতে আবির্ভূত হলেন। ফলস্বরূপ পরবর্তী মন্বন্তরে প্রথমেই এই সমস্ত প্রজারা তাঁদের কৃত শুভ বা অশুভ কর্মফল অনুসারে দেবতা, অসুর পিতৃলোক পশুপক্ষী, সরীসৃপ, বৃক্ষ, নারকী ও কীট প্রভৃতি ভাব পরিগ্রহ করে প্রজাপতির প্রজাসংখ্যার বৃদ্ধি ঘটাতে লাগলেন।
.
০৯.
সৃষ্টি রহস্য ব্যাখায় প্রবৃত্ত হয়ে সূত বললেন, অনন্তর ব্রহ্মা পুনরায় ধ্যানস্থ হলেন। তার সেই ধ্যানমগ্ন জ্যোতির্ময় দেহ থেকে উৎপন্ন হলেন কার্যকরণ সমন্বিত ক্ষেত্রজ্ঞ দেব অসুর, পিতৃগণ ও চতুর্বিধ মানব। বায়ুকতক এই সকল মানসী প্রজার সৃষ্টিকথা বর্ণিত হয়েছিল।
স্বয়ম্ভু যখন মানসী প্রজা সৃষ্টির কামনায় অতলান্ত জলরাশির মধ্যে তমোগুণের মধ্যে নিমজ্জিত হলেন তখন, তার মধ্যে তমোগুণের আবির্ভাব ঘটল। সেই তমোগুণঋদ্ধ অবস্থায় সৃষ্টির কথা চিন্তা করার সময়ে তাঁর জঙ্দেশ থেকে যে প্রজার উৎপন্ন হলেন তাদের নাম অসুর। ‘অসুর’ শব্দের অর্থ প্রাণ। প্রাণ থেকে উৎপন্ন হওয়ায় এঁদের নাম হল অসুর।
অসুর সৃষ্টি করার পরে পরেই প্রজাপতি তনু পরিত্যাগ করেছিলেন। তাঁর সেই পরিত্যক্ত তনু ছিল তমোবহুল। তাই তার সেই পরিত্যক্ত তনু তমাবৃত ত্রিযামা রাত্রিতে পরিণত হল। এরপর তিনি সম্মুখে অসুরদের দেহে অন্য এক শরীর ধারণ করলেন। তার সেই শরীর ছিল অব্যক্ত ও সত্ত্ববহুল। এইপ্রকার রূপ পরিগ্রহ করে অতীব প্রীত হলেন। সেই প্রসন্ন হৃদয়ে ক্রীড়ারত অবস্থায় তার মুখে দেবতারা উৎপন্ন হলেন। ’দেব’ ধাতুর অর্থ ক্রীড়া করা। ক্রীড়া মুখর অবস্থায় সৃষ্টিকর্তা প্রজাপতির দিব্য তনু থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন বলেই তারা ‘দেবতা’ বলে পরিচিত হলেন।
দেবতাদের দেখে দেবেশ ব্রহ্মা আবার অন্য তনু ধারণ করলেন। তার এই নব পরিগৃহীত তনু ছিল সত্ত্বগুণ বহুল। এই সাত্ত্বিক তনু থেকে পিতৃগণের আবির্ভাব হল। এঁদের প্রতি ব্রহ্মার মনোভাব ছিল অন্য প্রজাদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। এই পিতৃগণ স্বয়ম্ভর মানস সন্তান হলেও স্বয়ম্ভ এদের পিতার মতো জ্ঞান করতেন। রাত্রি ও দিন এবং কৃষ্ণ ও শুক্লপক্ষের সন্ধিক্ষণে পিতৃগণ জন্ম নিয়েছিলেন। তাই পিতৃগণের মধ্যে দেবত্ব ও পিতৃত্ব উভয় গুণই বিদ্যমান ছিল। পিতৃ সৃষ্টির পর ব্রহ্মবাদী ব্রহ্মা সেই তনুও পরিত্যাগ করলেন। তার সেই পরিত্যক্ত তনু সন্ধ্যা রূপে পরিণত হল।
এই ভাবে দিবা দেবতাদের, রাত্রি অসুরদের এবং সন্ধ্যা পিতৃগণের জন্য নির্দিষ্ট হল। এঁদের মধ্যে পিতৃ তনু সন্ধ্যারই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। দেব, অসুর, ঋষি, মনু প্রমুখরা ব্রহ্মার মধ্যমা মূর্তি সন্ধ্যার উপাসনা করে থাকেন।
এরপর ব্রহ্মা অপর একটি মূর্তি ধারণ করে কতকগুলি অতিরিক্ত মানসপ্রজা সৃষ্টি করলেন। তার এই মূর্তিটি ছিল রজঃগুণ সমৃদ্ধ। এবার তার মন থেকে মানসী প্রজারা সৃষ্টি হলেন। এইসব প্রজাদের দেখার পর শেষ পর্যন্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই তনুও ত্যাগ করলেন। তা থেকে জ্যোৎস্নার আবির্ভাব ঘটল। জ্যোৎস্নার আগমনে প্রজাসকল হৃষ্ট হলেন।
এইভাবে একের পর এক তনু ধারণ করে সৃষ্টিকর্তা পরমপুরুষ প্রজাপতি ব্রহ্মা দিবা, রাত্রি, সন্ধ্যা ও জ্যোৎস্নার সৃষ্টি করেছিলেন। এর মধ্যে জ্যোৎস্না ও দিবা হল সত্ত্ব গুণাত্মক এবং রাত্রি তমোগুণাত্মক। রাত্রিতে তমোগুণের বাহুল্য থাকায় এর একটি নাম ‘ত্রিযামা। এছাড়া দেবতারা দিবাভাগে আবির্ভূত, তাই এরা দিব্যতজ্ঞ। হৃষ্ট এবং দিনমানে বিশেষ বলশালী হয়ে থাকেন। অপরদিকে অসুররা প্রাণের সাহায্যে ব্রহ্মার জঙ্ঘা থেকে রাত্রিকালে জন্মলাভ করেছিলেন বলে তারা রাত্রিকালেই অধিক বলবান হয়ে ওঠে।
একটা কথা সবসময়ে স্মরণে রাখবেন, জন্ম সময়ের পার্থক্যই দেবতা ও অসুরদের মধ্যে বিবাদের কারণ। সুদূর অতীত বা অনাগত মন্বন্তরেও দেবতা, পিতৃ, মানব ও অসুরদের উৎপত্তির কারণ এই ভাবেই বিশ্লেষণ করতে হবে।
ব্যাপ্তি ও দীপ্তি অর্থে ‘ভা’ শব্দটি প্রযুক্ত হয়। দিবা, রাত্রি, সন্ধ্যা বা জ্যোৎস্না–সময়কাল যা-ই হোক না কেন এরা ব্যাপ্তি ও দীপ্তিতে প্রতিভাত হয় বলে এদের ‘আভাসিত’ বলা হয়।
এইভাবে ক্রমান্বয়ে প্রজাপতি জলরাশি, দেব, দানব, মানব, সৃষ্টি করতে লাগলেন। সৃষ্টিকাজ সম্পূর্ণ হলেই তিনি সেই তনু পরিত্যাগ করেছিলেন। শেষে আবার যখন রজঃ ও তমো গুণ সমৃদ্ধ তনুবাহার ধারণ করলেন তা থেকেও কিছুসংখ্যক প্রজা জন্মলাভ করল। এই পর্যায়ে সৃষ্ট প্রজাদের মধ্যে কতকগুলি প্রজা সেই অন্ধকারের মধ্যে উৎপন্ন হয়েই ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলেন। তারা আর কিছু না পেয়ে জলরাশি পান করতে উদ্যত হলেন। অপর প্রজারা একই সময়ে উৎপন্ন হওয়া সত্ত্বেও সেই অনন্ত জলরাশিকে রক্ষা করেছিলেন। তাই এরা ‘রাক্ষস’ নামে পরিচিত। যারা দাবি করছিলেন যে, আমরা অচিরেই এই জলরাশি পান করে তার ক্ষয় করব, সেই ক্রুরকর্মা প্রজারা জ্ঞহ্যক ও যক্ষ নামে পরিচিত হলেন। মনে রাখতে হবে, ‘রক্ষ’ ধাতু যেমন রক্ষা তথা পালনার্থে ব্যবহৃত হয়, তেমনিই ‘ক্ষয়’ ধাতু ক্ষয়র্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই সকল প্রিয় দুষ্টমতি প্রজাদের দেখার সাথে সাথে পরমপিতা ধীমান প্রজাপতির কেশরাশি বিশীর্ণ হতে লাগল। তা থেকে উৎপন্ন হতে লাগল শীত ও উষ্ণ অর্থাৎ সুখ ও দুঃখপ্রদ সর্পাদি প্রাণীর। মস্তক থেকে চ্যুত হওয়ায় সর্পসমূহের অপর নামগুলি হল ‘অহি’ ‘পতন’ ‘হেতু’ ‘পন্নগ’। এরা সৰ্পন বা সরীসৃপের মতো গমন করে বলে এদের নাম সর্প। পৃথিবীতে এদের নিবাস সূর্য চন্দ্রের নীচে। ক্রোধের কারণে ব্রহ্মার শরীরে যে নিদারুণ অগ্নির উদ্ভব হয়েছিল, তাই বিষরূপে সর্পকুলের শরীরে প্রবেশ করেছিল। কিন্তু দেখা গেল, সর্পদের দেখে ব্রহ্মা আবার ক্রোধিত হলেন, সেই ক্রোধ থেকে এবার যাদের জন্ম হল তারা হলেন কপিশবর্ণস উগ্র, মাংসাশী ভূতবিশেষ। ভূতত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন বলে তাঁরা ‘ভূত’ আবার পিশিত অর্থাৎ মাংস ভক্ষণ করেন বলে এদের নাম ‘পিশাচ’।
তখনও পর্যন্ত আর একটি সৃষ্টি অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল। ব্রহ্মা যখন সংগীত বিষয়ে চিন্তা করেছিলেন তখন তাদেরও জন্ম হয়ে গেল। এঁরা হলেন গন্ধর্ব। দেখা গেল এই অষ্টযোনি সৃষ্টি হবার পরেও পৃথিবীর বহু স্থান শূন্য পড়ে আছে। তখন ব্রহ্মা নিজের ইচ্ছা অনুসারে বয়স অর্থাৎ আয়ু থেকে বায়স অর্থাৎ পক্ষী সৃষ্টি করলেন। এই ভাবে তিনি মুখ থেকে সৃষ্টি করলেন অজ, বক্ষঃস্থল বা আয়ু। থেকে পক্ষী, উদরদেশ ও পার্শ্বদ্বয় থেকে লক্ষ্য, পাদদ্বয় থেকে অশ্ব, হস্তী, শরভ, গবম, মৃগ, উষ্ট্র, অশ্বেতর এবং অন্যান্য পশু আর সেইসঙ্গে জন্মলাভ করল ওষধি ও ফলমূল।
কল্পের আদিতে ত্রেতাযুগের প্রারম্ভে স্রষ্টা ব্রহ্মা পশু, ওষধি প্রভৃতি সৃষ্টি করলেন। এগুলিকে যজ্ঞে ব্যবহার করা হতে লাগল। এইসব প্রাণীদের মধ্যে ছাগ, মনুষ্য, মেষ, অশ্ব, শ্বাপদ, হস্তী, বানর, পক্ষী–এই প্রকার জীব এবং উন্দক ও সরীসৃপ প্রভৃতিকে অরণ্যজীব বলা হয়।
চতুর্মুখ ব্রহ্মার চারটি মুখ থেকে চার প্রকারের জীবের সৃষ্টি হল–অথর্ব, অমান, অনুষ্ঠুভ ও বৈরাজ। দক্ষিণ মুখ থেকে পাঁচ প্রকারের ছন্দ–ত্ৰৈষ্ঠুভ, কর্ম, স্তোত্র, বৃহৎ সাম ও উবয্য, পূর্ব মুখ থেকে যজ্ঞ। যজ্ঞীয় দ্রব্যের মধ্যে গায়ত্রী, বরুণ, ত্রিবৃত ও রথন্তর সাম, এবং পশ্চিম মুখে থেকে সৃষ্টি করলেন জগতী ছন্দঃ। সাম, পশ্ব দশ প্রকার ছন্দোস্তোম বৈরূপ্য ও অতিরাত্র প্রভৃতি। ভগবান প্রজাপতি স্থাবর-জঙ্গম সৃষ্ঠির পূর্বেই কিনৃত, বজ্র, মেঘ, রোহিত, ইন্দ্রধনু ইত্যাদি সৃষ্টি করলেন।
এইভাবে চতুরানন ব্রহ্মার সুবর্ণ বর্ণ শরীর থেকে যে বিবিধ ভূতগ্রাম সৃষ্টি হল, এবার তাকে আমরা ক্রম অনুসারে সাজাতে পারি। সর্বপ্রথমে দেবতা, অসুর, পিতৃলোক ও মানস প্রজার সৃষ্টি হল। তারপর তিনি যক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, নর, কিন্নর, রাক্ষস, পশু, পক্ষী, মৃগ, সর্প এবং অপরাপর স্থাবর জঙ্গমাদি সৃষ্টি করেন। পূর্ব পূর্ব সৃষ্টিতে প্রজাদের জন্য যে যে কর্ম নির্দিষ্ট ছিল পরবর্তীকালে তাদের বারবার সৃষ্টিতেও সেই সেই কর্ম অর্থাৎ কর্মফল তারা লাভ করেছিলেন। যেমন–পূর্ব পূর্ব জন্মের সংস্কার অনুসারে মানসী প্রজাদের মধ্যে হিংস্র-অহিংস্র, মৃদু-কঠোর, ধর্ম-অধর্ম, সত্য-মিথ্যা প্রভৃতি কর্ম সামূহে প্রবৃত্তি জন্মায়। অবশ্য এর বাইরে মহাভূত, ইন্দ্রিয়ার্থ ও মূর্তি সমূহের অনেকত্ব কিংবা ভূতসমূহের বিনিয়োগ হওয়া এইসব বিধাতার বিধান। আবার কারো কারো মতে, পুরুষকার কর্ম দেব অথবা স্বভাবই এর কারণ। বৈশিষ্ট্যগত বিচারে পুরুষকার, কর্ম, দৈব ও স্বভাব এক না হলেও পরস্পর পৃথকও নয়। আবার এই তিনের অতিরিক্ত কোনো কারণও নেই। কিন্তু সমদর্শী সাত্ত্বিক পুরুষগণ এদের একটিকেও আলাদা ভাবে কারণ বলেন না, কিন্তু তিনটিকে একত্রে কারণ বলেন।
পূর্বকালে সৃষ্টি-ইচ্ছুক ব্রহ্মা ‘বেদ’ শব্দ থেকেই মহাভূত সমূহের নাম রূপ বিভাগ এবং সৃষ্টি পদার্থের বিস্তার সাধন করেছিলেন। প্রলয় অবসানে প্রথম যে দেবতাগণ ও ঋষিগণ উদ্ভূত হয়েছিলেন তাদের নামাবলিও তাঁর নির্দেশেই হয়েছিল। দেখা গেছে যে, প্রত্যেক ঋতুবিপর্যয় ঘটার পর ঋতুচিহ্ন স্বরূপ যে বিবিধ রূপ তারও বিপর্যয় ঘটে। আরও দেখা গেছে যে, রাত্রিশেষে অব্যক্ত জন্মা ব্রহ্মা যখনই মানসসিদ্ধি অবলম্বন করেন তখনই নানা বিধ চরাচর সৃষ্টি হতে থাকে। ধীমান প্রজাপতি কর্তৃক সৃষ্ট মানসপ্রজা যখন যথাযথভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল না। তখন সেই চতুরানন ব্রহ্মা নিজ সদৃশ আর অনেক মানসপুত্র সৃষ্টি করতে লাগলেন, তারা হলেন ভৃগু, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, আঙ্গিরস, মরীচি, দক্ষ, অত্রি ও বশিষ্ট। এই নয়জন ব্রহ্মবাদী পুরুষই পুরাণে ‘নব ব্রহ্মা’ নামে কীর্তিত হয়ে থাকেন। এর পর ব্রহ্ম তার রোষানল একীভূত করে রুদ্র দেবতাকে সৃষ্টি করলেন। পূর্বপন্থা অবলম্বন করে সৃষ্টি করলেন সংকল্প এবং ধর্মকে।
ব্রহ্মা সর্বপ্রথম যে সকল বিদ্বান এবং সনাতন মানসপুত্রদের সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁরা হলেন সনন্দ, সনক, বিদ্বান, সনাতন। তাঁরা কেউই লৌকিক বিষয়ে মগ্ন হবার প্রতি সামান্য আগ্রহটুকু দেখালেন না। তাঁরা সনাতন উদাসীন, তত্ত্বজ্ঞানী, বীতরাগ মাৎসর্য্য দোষহীন হয়েই রইলেন।
ব্রহ্মা যখন দেখলেন তাঁর বিদগ্ধ মানসপুত্রেরা লৌকিক আচরণের অনুকরণের প্রতি উদাসীন, তখন তিনি পরমেষ্ঠী হিরণ্য গর্ভের কথা চিন্তা করতে লাগলেন। তার রোষ থেকে আবির্ভূত হলেন সূর্যের সমান দ্যুতি বিশিষ্ট এক তেজস্বী পুরুষ। তিনি হলেন অগ্নিতুল্য তেজশালী এবং অর্ধনারী নর-রূপধারী রুদ্র। অর্ধনারীশ্বর পুরুষটিকে দেখামাত্র নিজেকে বিভক্তকর এই নির্দেশ দিয়ে ব্রহ্মা অন্তর্হিত হলেন। ব্রহ্মার এই আদেশ শোনার পর সূর্যসমতেজা পুরুষটি স্ত্রী ও পুরুষরূপে পৃথক পৃথক ভাবে নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন। তার এই পৃথক পুরুষরূপটি আবার একাদশ ভাগে বিভক্ত হল। তার এই একাদশ মূর্তি জগতের হিতাকাঙ্ক্ষী রূপে প্রতীয়মান হল।
প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই তেজস্বী পুরুষটির অর্ধ নরদেহের একাদশ মূর্তিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, লোকবৃত্তান্ত হেতু এবং বিশ্বলোকের স্থাপনা ও হিতের প্রয়োজনে অতিন্দ্রত হয়ে জগতের প্রতি যত্নশীল হও এরকম আদেশ শুনে একাদশ মূর্তি ইতস্তত রোরুদ্যমান অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একই সঙ্গে রোদন এবং ভ্রমণ অর্থাৎ ছোটাছুটি করেছিলেন বলেই হয়তো সেই একাদশ মূর্তি রুদ্র নামে খ্যাত হন। যে সকল সর্বলোকপরায়ণ অযুতসংখ্যক নাগশক্তি সম্পন্ন বিক্রমশীল অন্বেশ্বরগণ ত্রৈলোক্যকে ব্যাপ্ত করে রেখেছেন তারা ঐ একাদশ রুদ্রেরই অনুচর। এবার তেজস্বী পুরুষটি অর্ধনারীদেহের কথা বলি। সূর্যসমতেজা শংকরের যে পৃথক নারীদেহের কথা এখানে বলা হয়েছে স্বয়ম্ভর মুখোদগত সেই নারীদেহের দক্ষিণ অংশ ছিল শুক্ল এবং উত্তর অংশ ছিল কৃষ্ণ। স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা সেই দেবীকেও দেহ বিভক্ত করতে বলেছিলেন। পৃথক পুরুষদেহের মতো রুদ্রের এই পৃথক নারী দেহটিও নিয়ে দেহকে বিভক্ত করে একাধিক রূপ পরিগ্রহ করলেন। এই বিভাজিত রূপগুলি হল–স্বাহা, স্বধা, মহাবিদ্যা, মেধা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অপর্ণা, একপর্ণা, পাটলা, উমা, হেমবতী, ষষ্ঠী, কল্যাণী, খ্যাতি, প্রজ্ঞা, গৌরী, মহাভাগা ইত্যাদি। বিশ্বরূপা এই দেবী আরও যেসব নামে প্রসিদ্ধ হলেন সেগুলি আনুপূর্বিকভাবে বর্ণনা করছি, শুনুন—’প্রকৃতি’ ‘নিয়তা, ‘ভদ্রা’, ‘রৌদ্রী’, ‘দুর্গা’, ‘প্রশমিনী’, ‘কালরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘রেবতী’, ‘ভূতনামিকা’। দ্বাপর যুগের শেষে সেই দেবীর নামগুলি হল—’গৌতমী’, ‘কৌশিকী’, ‘আর্যা’, ‘চণ্ডী’, ‘কাত্যায়নী’, ‘সতী’, ‘কুমারী’, ‘কৃষ্ণপিঙ্গলা’, ‘বরদা’, ‘দেবী’, ‘যাদব’, ‘বরা’, ‘বহিধ্বজা’, ‘পরমব্রহ্মচারিণী’, ‘মাহেন্দ্রী’, ‘ইন্দ্রিভগিনী’, ‘একবাসকী’, ‘অপরাজিতা’, ‘বৃষকন্যা’, ‘বহুভূজা, ‘প্রগলভা’, ‘একানসা’, ‘মায়া’, ‘সিংহাবাহিনী’, ‘দৈত্যহনী’, ‘আমোষা’, ‘মহিষমর্দিনী’, ‘বিন্ধ্যনিলয়া’, ‘বিক্ৰান্তা’, ‘গণনায়িকা’ ইত্যাদি।
হে পুরাণকথা শ্রবণেচ্ছুক নৈমিষারণ্যবাসী দ্বিজগণ, এতক্ষণ আমি আপনাদের কাছে রুদ্রের অর্ধনারীদেহের প্রবর্ধিত নামসমূহ কীর্তন করলাম। দেবীর এই নামাবলী যাঁরা কীর্তন করেন, যারা শ্রবণ করেন বা স্মরণ করেন তাদের অরণ্য, প্রান্তর, মরু বা গৃহ কোনোস্থানেই কোনো ভাবে পরাভূত হতে হয় না। জলে-স্থলে কোনো বিপদ তাদের স্পর্শ করতে পারে না। হিংস্র জন্তু-জানোয়ার বা কুকর্মী মানুষের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিশেষ করে প্রেতস্থানে এমনকি দুরারোগ্য রোগ ব্যাধিতে দেবীর নাম কীর্তন করা উচিত। বালগুহ ভূত প্রেতাদি ও প্রতনা মাতুদের দ্বারা নিগৃহীত, পীড়িত বালকেরা এই নাম কীর্তন করে রক্ষা পায়।
পূর্বোক্ত দেবীর উভয়ভাগে প্রজ্ঞা ও শ্রী নামে দুই মহাদেবী কীর্তিতা হয়ে আছেন। এই দুই দেবী থেকে সহস্র সহস্র দেবী আবির্ভূত হয়ে সমগ্র ধরণীকে পরিব্যাপ্ত করেন। এই মহাদেবীই সমস্ত ভূত-প্রাণীর সুখবহ ধর্ম সৃষ্টি করেছিলেন। কল্পের আদিতে ভূতসমূহের সংকল্প ও সেই অব্যক্ত যোনি থেকে উৎপন্ন হয়েছিল।
ব্রহ্মার মানসপুত্ররা তার ব্রহ্মবাদী তেজোময় দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে তার মন থেকে রুচি, প্রাণবায়ু থেকে দক্ষ, চক্ষুযুগল থেকে মরীচি, হৃদয় থেকে ভৃগু, জিহ্বা থেকে ঋষি, মস্তক থেকে অঙ্গিরা, কর্ণ থেকে অত্রি, উদানবায়ু থেকে পুলস্ত্য, ধ্যানবায়ু থেকে পুলহ, সমান বায়ু থেকে বশিষ্ঠ, আপন বায়ু থেকে ক্রেতু, এবং অভিযান থেকে নীললোহিত ভদ্র উৎপন্ন হয়েছিলেন। ব্রহ্মার এই দ্বাদশ সংখ্যক মানস পুত্রদের প্রত্যেকই ছিলেন, সৃহমেধী ও পুরাণ পুরুষ। এঁরা কেউই পূর্বেকার মানসপুত্রদের মতো ব্রহ্মবাদী ছিলেন না। এরাই ধর্ম প্রবর্তন করেন এবং রুদ্রের সাথে সমুৎপন্ন হন। প্রথম কল্পকালে তারা অর্থাৎ ব্রহ্মার এই দ্বাদশ মানস কুমার যখন জন্মগ্রহণ করেননি তখন ঋভু ও সনৎকুমার নামে ব্রহ্মার অন্য দুই মানসপুত্র আবির্ভূত হয়েছিলেন। তারা দুজনেই ছিলেন ঊর্ধরেতা ও যোগধর্মী। তারা আত্মায় আত্মাকে আরোপিত করে তেজ সংকোচ করে অবস্থান করেছিলেন। তারাও মহাতেজের সঙ্গে প্রজাধর্ম এবং কাম প্রবর্তিত করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সনৎকুমার আজীবন ব্রহ্মচারী ছিলেন। অর্থাৎ জন্ম সময় থেকে শুরু করে শেষ জীবন পর্যন্ত কুমার ছিলেন। তাই তিনি সনৎকুমার নামে প্রসিদ্ধ।
ব্রহ্মার ভৃগু প্রমুখ দ্বাদশ মানসপুত্র হতে দ্বাদশটি বংশ প্রবর্তিত হয়। প্রত্যেকটি বংশ দিব্য দেবগুণান্বিত, ক্রিয়াবান, প্রজাবান, মহর্ষিদের দ্বারা অলংকৃত ছিল। মহৎ থেকে শুরু করে বিশেষ পর্যন্ত যত প্রকৃতির বিকার এবং যা কিছু ইন্দ্রিয় থেকে উদ্ভূত হতে পারে স্বয়ম্ভ প্রজাপতি ব্রহ্মা সেসব কিছুই সৃষ্টি করলেন। এরা ছিলেন চন্দ্র সূর্যের জ্যোতিতে আলোকিত। গ্রহ-নক্ষত্রে মণ্ডিত এবং নদী, সমুদ্র, পর্বত, বিবিধাবৃতি পুর ও সমৃদ্ধ জনপদের দ্বারা সমাবৃত। এমতাবস্থায় ব্রহ্ম সেই অব্যক্তরূপে বনমধ্যে রাত্রিযাপন করেন।
প্রথমে ব্রহ্মারই অনুগ্রহে অব্যক্ত রূপ বীজের উৎপত্তি হল। তারপর বুদ্ধিরূপ স্কন্দ, ইন্দ্রিয় রূপ অঙ্কুর, মহাভূতরূপ শাখা, বিশেষ রূপ পত্র, ধর্মাধর্মরূপ পুষ্প, সুখ-দুঃখ রূপ ফল ইত্যাদি সুশোভিত সর্ব ভূতে জীবন স্বরূপ একটি সনাতন বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। সদাসদাত্মক নিত্য অব্যক্ত, ব্রহ্মবলই এই ব্রহ্মবৃক্ষের একমাত্র কারণ। পরমেশ্বর মহাতেজোশালী ব্রহ্মার এই প্রাকৃত সৃষ্টি অনুগ্রহ সৃষ্টি বলে কীর্তিত হয়।
অভিমানী ব্রহ্মার প্রজাবলে প্রধান প্রধান যে ছয় রকম বিবৃত সৃষ্টি প্রাদুর্ভূত হয়েছিল, তা তিনকাল ধরে প্রবর্তিত হয়। ইহাই সৃষ্টি পরম্পরার কারণ বলে পণ্ডিতেরা মনে করে থাবেন। আবার এই যে দুই প্রকার সৃষ্টি এ যেন দিব্য সুপর্ণ, সহযুক্ত শাখা যুক্ত দুটি বৃক্ষ আকাশ যার শীর্ষ স্বরূপ, স্বলোক যার নাভি, চন্দ্র-সূর্য যার দুই নেত্র, দিক সকল যার বর্ণ, ভূমি যার চরণ, তিনিই তো অচিন্ত আত্মা। নিখিল ভূতের তিনিই উৎস। তাঁর মুখ থেকে সনপ্রসূত ব্রাহ্মণ, বক্ষঃস্থল থেকে ক্ষত্রিয়, উরুদ্বয় থেকে বৈশ্য, চরণ থেকে শূদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। বিদ্যমান সমস্ত বর্ণই একইভাবে তার শরীরের কোনো না কোনো অংশ থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
অব্যক্ত সম্ভুত এই যে অন্ত এর থেকেই আবার নিখিল প্রজার স্রষ্টা ব্রহ্মার জন্ম।
.
১০.
পুরাণ কথক সূত বললেন, লোক স্রষ্টা ব্রহ্মার একান্ত ইচ্ছা ছিল যে, তাঁর মানস প্রজারা সৃষ্টিকার্যে প্রবৃত্ত হোন। কিন্তু কিছু কারণবশত প্রজারা যখন আর সৃষ্টি কাজে প্রবৃত্ত হলেন না তখন তমোভাবাক্রান্ত ব্রহ্মা নিতান্ত দুঃখিত হলেন। তিনি এর প্রতিকারের উপায় চিন্তা করতে লাগলেন। এই গভীর দুঃখ থেকে তীব্র শোকের সৃষ্টি হল। এরপর তিনি নিজদেহে বর্তমান রজঃগুণের পরাভব ঘটিয়ে তমোগুণকে উদ্ৰিক্ত করলেন। তমঃ ও রজঃ এই দুইয়ের মিলনে মিথুনের উৎপত্তি হল। এবং তা থেকে শোকের অধার্মিক আচরণবশত ক্রমশ হিংসার জন্ম হল। ভগবান প্রজাপতি ব্রহ্মা এই মিথুন দর্শনে অধিক প্রীতি লাভ করলেন। তিনি তমোগুণ যুক্ত সেই অভাস্বর তনুকে দ্বিধাবিভক্ত করলেন। তার অর্ধাংশ থেকে পুরুষ এবং অপর অর্ধাংশ থেকে ভূতদাত্রী শতরূপা প্রাকৃত নারী আবির্ভূত হলেন। এই নারী স্বর্গ ও পৃথিবীকে একই সঙ্গে নিজের মহিমায় আচ্ছন্ন করলেন। দ্যুলোক, ভূর্লোক ব্যাপ্ত এই প্রাকৃত নারী পূর্ব আকাশে অবস্থান করতে লাগলেন।
ব্ৰহ্মপুরুষের তমোদ্রিক্ত তনু থেকে এই শতরূপা নারী অর্ধ সৃষ্ট অবস্থায় জন্মগ্রহণ করলেন। তিনি নিযুত বৎসর দুষ্কর তপঃসাধন করে অর্ধদেহজাত দীপ্তযশা পুরুষকে নিজের পতিরূপে লাভ করলেন। সেই বিশেষ পুরুষই স্বয়ম্ভুব মনু নামে খ্যাত হয়ে আছেন।
এই মনুর মন্বন্তরকাল এক সুপ্তিতি যুগরূপ জ্ঞেয়। এই পুরুষ অযোনিজা শতরূপাকে পত্নী রূপে লাভ করে তার সাথে রমণ করতে লাগলেন। তাই শতরূপার আরেকটি নাম হল রতি। প্রথম কল্পাদিতে এর প্রথম প্রয়োগ ঘটল।
ব্রহ্মা এবার সৃষ্টি করলেন বিরাট পুরুষ বিরাজকে। ব্রহ্মার মানসলোক থেকে উৎপন্ন মনু। বীর বৈরাজ মনু। বীর বৈরাজ এবং শতরূপার মিলনে জন্মগ্রহণ করলেন প্রিয়ব্রত ও উত্থানপাদ নামে দুই পুত্ররত্ন। এবং প্রসূতি ও আকৃতি নামে দুই কন্যা। শতরূপার গর্ভে জন্ম নেওয়া এই কন্যাদ্বয় হলেন যাবতীয় প্রজার জননী। প্রভু স্বয়ম্ভুব স্বয়ং দক্ষের কাছে প্রসূতিকে এবং রুচির কাছে আকৃতিকে সম্প্রদান করেন। প্রসঙ্গত সৃষ্টিকর্তার প্রাণবায়ু থেকে দক্ষ এবং মন রুচি উদ্ভূত হয়েছিলেন। রুচি আকৃতির সংযোগে আকৃতির গর্ভে যজ্ঞ ও দক্ষিণা নামে যমজ সন্তান জন্ম নিল। পরবর্তীকালে যজ্ঞ ও দক্ষিণার দ্বাদশ পুত্র জন্ম নেয়। এই দ্বাদশ পুত্রই হলেন স্বয়ম্ভব মন্বন্তর মধ্যবর্তী যাম নামক দেবগণ। এদের নামকরণের পিছনে দুটি কারণের সন্ধান পাওয়া যায়। যজ্ঞের আর এক নাম যম। তাই যজ্ঞের পুত্রদের নাম যাম। অথবা দ্বিতীয় মত অনুসারে, অজিত ও শূক নামে ব্রহ্মার দুই গণের দ্বারা পরিক্রান্ত হয়েছিলেন বলে এঁদের নাম রাখা হয়েছিল যাম। অপরদিকে প্রাণবায়ুজাত দক্ষও স্বায়ম্ভব কন্যা প্রসূতির গর্ভে চতুর্বিংশতি কন্যাসন্তান উৎপাদন করেন। এই সকল কন্যারা সকলেই লোকমাতা, কমললোচনা, মহাভাগা, যোগপত্নী ও যোগমাতা। এঁদের নামগুলি হল শ্রদ্ধা, লক্ষ্মী, ধৃতি, তুষ্টি, পুষ্টি, মেধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা, বপুঃ, শান্তি, সিদ্ধি, কীর্তি। স্বয়ম্ভর বিধান অনুসারে দক্ষ এই তেরোজন কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। পরবর্তী এগারো জন সুলোচনা কন্যা খ্যাতি, সতী, সস্তৃতি, স্মৃতি, প্রীতি, ক্ষমা, সন্নতি, অনুসূয়া, উজ্জা, স্বাহা, এবং স্বধা। দ্বাদশ মানসপুত্রের অন্যান্য মহর্ষিরা এঁদের গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা হলেন–ভৃগু, ক্রতু, রুদ্র, মরীচি, আঙ্গিরা, পুলহ, পুলস্ত্য, অত্রি, বশিষ্ট, পিতৃগণ ও অগ্নি, অর্থাৎ সতাঁকে সমর্পণ করা হয়েছিল রুদ্র মহাদেবের হাতে। খ্যাতিকে সমর্পণ করা হয়েছিল মহর্ষি ভৃগুর হাতে। এইভাবে সভৃতিকে মরীচির হাতে। স্মৃতিকে আঙ্গিরার হাতে, প্রীতিকে পুলস্ত্যর হাতে, ক্ষমাকে পুলহের হাতে, সন্নতিকে ক্রতুর হাতে, অনুসূয়াকে অত্রির হাতে, উজ্জাকে বশিষ্ঠের হাতে, স্বাহাকে অগ্নির হাতে, এবং স্বধাকে পিতৃগণের হাতে সমর্পিত করা হয়েছিল। দক্ষ এবং প্রসূতির মিলনের ফলে জাত এই চতুর্বিংশতি কন্যার গর্ভে ও অসংখ্য পরাক্রমশালী পুত্রসন্তান জন্ম নিয়েছিলেন। তারা সকলেই ছিলেন প্রাজ্ঞ, মহাভাগ এবং আপন আপন অনুষ্ঠানস্থিত, তাঁদের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হল তারা সকলেই প্রতি মন্বন্তরে প্রলয়ান্ত কাল পর্যন্ত অবস্থান করতেন।
ঐসব কন্যাদের গর্ভজাত পুত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্রদ্ধাপুত্র কাম, লক্ষ্মীপুত্র দর্প, ধৃতিপুত্র নিয়ম, তুষ্টিপুত্র সন্তোষ, পুষ্টিপুত্র লাভ, মেধাপুত্র সূত, ক্রিয়াপুত্র নম, দণ্ড ও সময়, বুদ্ধিপুত্র বোধ ও অপ্রমাদ, লজ্জাপুত্র বিনয়, বপুপুত্র ব্যবসায়, শান্তিপুত্ৰ ক্ষেম, সিদ্ধিপুত্র সুখ ও কীর্তিপুত্র যশঃ। এরা প্রত্যেকেই ধর্মপুত্র বলে মহীতে খ্যাতিলাভ করেছেন।
আবার রতিদেবীর গর্ভে কামের ঔরসে হর্ষ নামক এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। এইভাবে ধর্মের ঔরসে যত সন্তান উৎপাদিত হয় তাদের প্রত্যেকেরই পরিণতি সুখ। অধর্ম ও হিংসা থেকে নিবৃতি ও অনৃন্নেতর উৎপত্তি হয়। নিকৃত ও অনৃত থেকে ভয় ও মায়া এবং নরক ও বেদনা এই দুই মিথুনের উৎপত্তি হয়েছিল। ভয় ও মায়া এই মিথুন থেকে ভূত বিনাশক মৃত্যু এবং নরক ও বেদনা এই মিথুন থেকে দুঃখ জন্মলাভ করে। ভয় ও মায়াজাত এই মৃত্যু থেকে ব্যাধি, জরা, শোক এবং নরক ও বেদনাজাত দুঃখ থেকে ক্রোধ ও অসূয়ার আবির্ভাব। অধর্ম থেকে কোনো না কোনো ভাবে সম্পর্কযুক্ত বলে এঁরা সকলেই অধর্ম পরায়ণ, অধার্মিক লক্ষণাক্রান্ত হলেও এঁদের পুত্ররা সকলে নিধন নামে খ্যাত। পুরাণে এই অধর্ম নিয়ামক সৃষ্টি পরম্পরাকে তামস সৃষ্টি নামে অভিহত করা হয়।
ব্রহ্মা নীললোহিত ভদ্রকে প্রজা সৃষ্টি করার আদেশ দিয়েছিলেন। নীললোহিত তখন মনে রুদ্রদেব ভার্যা সতীদেবীকে কামনা করলেন– মনে। এই মিলনের ফলে তার আত্মসম্মান সহস্র সহস্র পুত্র জন্মলাভ করল। এঁরা যেমন অত্যধিক উৎকৃষ্ট ছিলেন না। তেমনি নিকৃষ্টও বলা যাবে না। এবং তাঁরা প্রত্যেকেই নীললোহিতের মতো রূপ ও বল সম্পন্ন ছিলেন। এইসব অহস্রধিক পুত্ররা প্রত্যেকেই ছিলেন পিঙ্গল বর্ণ, জটাজুট-তুণীর এবং কপাল ধারী, বিলোহিত, বিবস্ত্র, হরিৎবেশ, দৃষ্টিগ্ন, বহুরূপ, বিরূপ, বিশ্বরূপ, রূপী, রথি, বর্মী, ধার্মিক, বরাহধারী, সহস্ৰশত বাহু, শত দিব্য, ভূমি ও অন্তরীক্ষচারী স্থলশীর্ষ, দংস্রাবিহীন, দ্বিজিহ্বা ও ত্রিলোচন–সর্ববিধ গুণের সমাহার ঘটে গিয়েছিল তাদের মধ্যে। তারা অন্ন মাংস ভক্ষণ করতেন। পানীয় হিসবে ঘৃত, সোমরস ও মেদ গ্রহণ করতেন। এঁরা অতিশয় উগ্র ক্রোধ, উপাসঙ্গ, উপধর্মী, শিতিবস আসীন জ্বম্ভনকারী, অধ্যায়ন ও অধ্যাপনশীল, ধাবমান, জপশীল, জ্বলন ও বর্ষণকারী, প্রধূজিৎ, সুতিমান, ব্রহ্মিষ্ঠ, শুভদর্শন, বুদ্ধ, বুদ্ধতম, নীলগ্রীব, সহস্রাক্ষ, ক্ষপাঁচর সর্বভূতের অদৃশ্য। মহাযোগাচারী, মহাতেজসম্পন্ন, রোদন ও দ্রবণশীল ছিলেন।
নীললোহিতের এই রুদ্ররূপী সুরোত্তম রুদ্রপুত্রদের দেখে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাঁকে এইপ্রকার বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট প্রজা সৃষ্টি করতে বারণ করলেন। তিনি তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আর এরকম আত্মতুল্য প্রজা সৃষ্টি কোরো না। অন্যবিধ প্রজা উদ্ভূত করো।
রুদ্রদেব প্রত্যুত্তরে বললেন, ব্রহ্মা আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য, আমি উৎপাদনে বিরত হলাম। এবার আপনি আপনার মনোমতো প্রজা সৃষ্টি করুন।
প্রজাপতি সৃষ্টিকর্তা স্বয়ম্ভু নীললোহিতের এই মনোভাবে তুষ্ট হলেন। তাঁকে প্রীত হতে দেখে রুদ্রদেব আবার বলতে লাগলেন, তবে আমার একটি অনুরোধ আছে। আমি নিজসদৃশ সহস্র সহস্র বিরূপ বলশালী নীললোহিত প্রজা উৎপন্ন করলাম, এঁরা পৃথিবী ও অন্তরীক্ষে যেন ‘রুদ্র’ নামে বিখ্যাত হন। যুগ-যুগান্ত ধরে প্রতি মন্বন্তরে যেসকল দেবতা আবির্ভূত হবেন, এঁরা যেন তাদের সাথে সমমর্যাদার সঙ্গে পূজিত হন। এবং এঁরা যাতে যজ্ঞভাগের অধিকারী হন, আপনি সেই আশীর্বাদ করুন।
মহাদেবের এই বাণী শুনে ধীমান প্রজাপতি অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি তুষ্ট চিত্তে বললেন, প্রভু তবে তাই হোক। তোমার আত্মতুল্য এইসব শত শত রুদ্রসংজ্ঞক দেবতারা তোমার ইচ্ছানুসারেই জগতে বিখ্যাত হবে এবং যজ্ঞ ভাগেরও অধিকারী হবে। ব্রহ্মার আশীর্বাদে তখন থেকেই সবকিছু সেই অনুসারেই চলতে লাগল। রুদ্রদেব নীললোহিত আর প্রজা সৃষ্টি করলেন– না। প্রলয়কাল আসা পর্যন্ত। ঊর্ধেরেতা হয়ে স্থাণুর মতো অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মার আদেশ বচন শুনে ‘স্থিতোহস্মি’ অর্থাৎ ‘আমি বিরত হলাম’–এই কথা উচ্চারণ করেছিলেন বলে রুদ্রদেব শংকরের অরেক নাম স্থানু। জ্ঞান, বৈরাগ্য ঐশ্বর্য, তপঃ, সত্য, ক্ষমতা, ধৃতি, সৃষ্টত্ব, আত্মসম্বোধ ও আধিষ্ঠাতৃত্ব–এই দশটি গুণ শংকর শরীরে সর্বদাই অবস্থান করে। তেজের দ্বারা তিনি সমস্ত দেবতাকে, ঋষিকে ও অসুরকে অতিক্রম করেছিলেন। তাই তার নাম মহাদেব। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে তিনি ঐশ্বর্য দ্বারা দেবগণকে, বল দ্বারা মহাসুরগণকে আর যোগদ্বারা ভূত গ্রামকে অতিক্রম করেছিলেন।
নৈমিষারণ্যবাসী সেইসব অদ্ভুতকর্মা ঋষিবৃন্দ পুরাণ কথক বায়ুকে বললেন–হে মহামুনি, এক্ষণে আমরা মহেশ্বরের যোগ, তপঃ, সত্য, ধর্ম ও জ্ঞানসাধন এই কটি বিষয়ে শুনতে ইচ্ছা করি। সেইসব ধর্ম সম্পর্কেও শুনতে ইচ্ছা করি, যে ধর্ম আচরণ করলে ব্রাহ্মণরা সদগতি লাভ করবে। হে প্রভো, বিশেষভাবে মহেশ্বরের যোগ বিষয়ে সবকিছু শুনতে চাই।
বায়ু বললেন, মুনিগণ, অক্লিষ্টকর্মা রুদ্ররা এ পঞ্চধর্মের বিষয়ে বলেছেন এবং পঞ্চধর্মের বিষয় পুরাণেও উল্লিখিত হয়েছে। অধিকাংশ আদিত্য, বসু, সাধ্য, মরুৎগণ, অশ্বিনী কুমারদ্বয়, ভৃগু, যম, শুক্র, পুরোগ, পিতৃগণ, কালান্তক, প্রমুখ দেবতা এবং অন্যান্য দেবতারাও পুর্বোক্ত ধর্মের উপাসনা করেছেন। তাদের কর্মবন্ধন ক্ষীণ হয়ে গেছে। তারা শরৎ আকাশের মতো নির্মল দেহে বিরাজ করতে যাবেন। তারা সন্ধ্যায় আত্মস্থিত হয়ে আত্মোপসানয় মগ্ন থাকবেন। তারা গুরুর প্রিয় ও হিত কর্মে রত থাকেন বলে গুরুর প্রিয়কাঙ্ক্ষী। তারা মনুষ্যজন্ম ত্যাগ করে দেবতাদের মতো বিহার করেন। মহেশ্বর কথিত সেন সনাতন পঞ্চধর্ম বিষয়ে এখন আমি যথাক্রমে কীর্তন করছি শুনুন।
প্রাণায়াম, ধ্যান, প্রত্যাহার ও স্মরণ–এই চারটিকে যোগধর্ম বলে। মহাদেব এই যোগধর্ম বিষয়ে যে সমস্ত উক্তি করেছেন আমি সেই লক্ষণ ও কারণগুলি আপনাদের বলছি।
প্রাণের আয়াম অর্থাৎ যা দ্বারা প্রাণের গতি রক্ষিত হয়, তাই হল প্রাণায়াম। প্রাণায়াম তিন প্রকার–মন্দ, মধ্য, উত্তম। প্রাণসমূহ নিরোধের নামও প্রাণায়াম। প্রাণায়াম প্রমাণ দ্বাদশমাত্রারূপে নির্দিষ্ট। এই দ্বাদশ মাত্রার উন্নতি প্রাণায়াম হল মন্দ। মন্দের দ্বিগণ অর্থাৎ চতুর্বিংশতি অর্থাৎ চব্বিশ মাত্রার প্রাণায়াম হল মধ্য। আর ত্রিগুণ অর্থাৎ ষটত্রিংশত বা ছত্রিশ মাত্রার উদ্ধত প্রাণায়ামকে উত্তম প্রাণায়াম বলা হয়। উত্তম প্রাণায়ামের সময়ে স্বেদ, কল্প ও বিষাদের উৎপত্তি হয়। এই তিনটি হল প্রাণায়ামের লক্ষণ।
এখন আমি সংক্ষিপ্তাকারে প্রাণায়ামের প্রণামের বিষয়ে বলছি।
সিংহ হোক, হাতি হোক, অথবা অন্য কোনো বন্য জন্তু হোক, এদের যেমন সেবা দ্বারা বশীভূত করা যায়, সেইরকম যোগাভ্যাস দ্বারা সমস্ত অসংযত ব্যক্তিদের দূর্বিনীত প্রাণকেও বশীভূত করা যায়। দীর্ঘকালের যোগাভ্যাসের ফলে পরিমর্দিত প্ৰাণবায়ুও দুর্বল সিংহ বা হাতির মতো বশীভূত হয়ে পড়ে। মুখ্যত মনকে অবলম্বন করেই সেই প্রাণবায়ু বশীভূত হয় এবং মনকে বশীভূত করেই উজ্জীবিত থাকে।
যোগাভ্যাস দ্বারা বশীভূত প্রাণবায়ুকে স্বচ্ছন্দে ইচ্ছেমতো চালিত করা যায়। এর প্রভাবে সিংহ, হাতি যেমন বশীভূত হয়ে মানুষ প্রমুখের প্রতি অভয়ের কারণ হয়, সেইরকম বিশ্বতোমুখ এই প্রাণবায়ু ধ্যানবস্থায় অন্তঃনিরুদ্ধ হয়ে শরীরের পাপরাশি দহন করে।
প্রাণায়ামকারী সংযত আত্মা, বিশ্বের সব দোষ একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়, ফলে সে যোগীপুরুষ সত্ত্বেও অধিষ্ঠান লাভ করে।
তপস্যা, ব্রত, নিয়ম ও সমস্ত যজ্ঞের যা ফল, প্রাণয়ামেরও সেই ফল। প্রতি মাসান্তরে কুশাগ্র পরিমাণ জল পান করে শত শত বৎসর তপস্যা করে যে ফল পাওয়া যায়, প্রাণায়ামের নিয়মিত অভ্যাসে সেই একই ফল লাভ করা যায়। প্রাণায়ামের দ্বারা দোষসমূহ, ধারণ দ্বারা পাপারাশি, প্রত্যাহারের বিষয় আসক্তি, এবং ধ্যান দ্বারা ঈশ্বরেও প্রাপ্ত নয় এমন গুণগুলিকে দগ্ধ করা যায়, অতএব মুক্ত যোগীমাত্রেই প্রাণায়ামপর হবেন এবং সর্ব পাপ থেকে পরিশুদ্ধ হয়ে পরমব্রহ্মে লীন হয়ে যাবেন।
বায়ু পাশুপাত যোগ কীর্তন করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, তপঃস্থিত মহাত্মা ঋষিরা একদিন থেকে আরম্ভ করে যথাক্রমে অহোরাত্র, অর্ধমাস, মাস, অয়ন, বৎসর, যুগ, সহস্র মহাযুগ পর্যন্ত দিব্যচক্ষু দ্বারা প্রাণের উপাসনা করে থাকেন।
এরপর তিনি মহাদেবের মতোই প্রাণায়ামের প্রয়োজন ও ফল বিশেষভাবে বর্ণনা করতে শুরু করলেন।
শান্তি, প্রশান্তি, দীপ্তি ও প্রসাদকে প্রাণায়ামের চারটি ফল বলে বর্ণনা করা হয়। দুই ধরনের বিনাশকে শান্তি বলে গৃহীরা ইহলোকে ও পারলোকে নিজেরা যেসব ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় কর্ম করে থাকেন, সেই সব কর্মফলের বিনাশ, এবং দুই। পিতা, মাতা, জ্ঞাতি, সম্বন্ধী এবং সংকর বর্ণজাত আত্মীয়রা যেসব পাপ করে থাকেন, সেইসব পাপের বিনাশ। ইহলোকে ও পরলোকের হিতের জন্য লোভ ও অভিমান জাত পাপের সংযমের নাম প্রশান্তি। যার দ্বারা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারার মতো তেজস্বী হওয়া যায়। জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পন্ন প্রসিদ্ধি লাভ করা যায়। অতীত ও অনাগত ঋষিদের দর্শন লাভ হয় ও বর্তমান বুদ্ধির সমতা আছে, তার নাম দীপ্তি। যার দ্বারা ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ার্থ, মন ও পঞ্চ বায়ু প্রসন্নতা লাভ করে, তাকে বলা হয় প্রসাদ। এই প্রত্যক্ষ ফলদায়ী এবং কালপ্রসাদ থেকে সদ্যোজাত এই চার প্রকার প্রাণায়ামই প্রথম ধর্ম বলে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
এবার আমরা প্রাণায়ামের লক্ষণ, আসন তত্ত্ব ও যোগাভ্যাস যোগের বিষয় আলোচনা করব।
যোগারম্ভের প্রথমে ওঁকার উচ্চারণ করতে হবে। বারবার ওঁকার উচ্চারণের ফলে মনের একাগ্রতা বৃদ্ধি পাবে। তারপর স্বস্তি বচন ও চন্দ্র সূর্যকে নমস্কার করে অর্ধপদ্মাসনে বসতে হবে। অথবা, সমজানু, একজানু বা উত্তানভাবে থেকে দৃঢ়মত অবলম্বন করে চরণদ্বয় সংহত করতে হবে। তারপর মুখ ও চক্ষুর নিমীলন, সম্মুখের বক্ষদেশের বিস্তৃতি, চরণের পশ্চাৎ অংশ দ্বারা বৃষণের আচ্ছাদন, মস্তক ও গ্রীবাকে উন্নত করে অপর কোনোদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে কেবলমাত্র নাসিকার অগ্রভাবে স্থিরভাবে দৃষ্টি নিবন্ধ রাখতে হবে। এই ধরনের প্রক্রিয়ার ফলে রজঃগুণ দ্বারা তমোগুণ আচ্ছাদিত হবে। এই ভাবেই সমাহিত যোগী যোগাভ্যাস করতে থাকবেন। এই অবস্থায় পৌঁছে গেলে ইন্দ্রিয়, ইন্দ্রিয়ার্থ, মন ও পঞ্চ বায়ু একসাথে নিগৃহীত করে প্রত্যাহার করার চেষ্টা করে যেতে হবে। কচ্ছপ যেমন সবদিক থেকে নিজের অঙ্গ সংকোচন করতে পারে, তেমনি যে ব্যক্তি সমস্ত কামনাকে সংকোচিত করে আত্মরতিতে মগ্ন হন, এবং এক তত্ত্বস্থ হতে পারেন, সেই ব্যক্তিই আত্মার আত্মদর্শন লাভে সমর্থ হন। এইভাবে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দিক দিয়ে শুচি ব্যক্তি নিঃশ্বাসবায়ু দিয়ে আকণ্ঠ নাভি পর্যন্ত শরীর পরিপূর্ণ করে শ্বাস প্রত্যাহারের উপক্রম করবেন। নিমেষ উন্মেষের পালা কণামাত্র। দ্বাদশ নিমেষ উন্মেষে প্রাণায়াম, দ্বাদশ প্রাণায়ামে ধারণা, ধরণদ্বয়ে যোগ সাধিত হয়ে থাকে। এইভাবে যোগাভ্যাস ঋদ্ধ ব্যক্তি ষড় ঐশ্বর্যের অধিকারী হয়ে স্বতেজে দীপ্যমান পারমাত্মার সাক্ষাৎকার লাভ করে থাকেন। প্রাণায়ামে যুক্ত নিয়তাত্মা বিপ্রের সর্ব দোষের বিনাশ ঘটায় এবং যোগী পুরুষও উৎকৃষ্ট সত্ত্বগুণে অবস্থান করেন।
এইভাবে নিয়তাহার প্রাণায়ামপরায়ণ ব্যক্তি যোগবিরুদ্ধ অবস্থাকে পরাভূত করতে করতে ক্রমে যোগভূমিতে আরোহণ করেন। এই মহান যোগভূমিতে বিজয় লাভ না করলে বহু দোষ উৎপন্ন হয়। পরিণামে মোহ বর্ধিত হতে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বলবান ধনবান ব্যক্তি যেমন বহু অর্থব্যয়ে ও পরিশ্রমে নানামন্ত্রের ব্যবস্থা করে তার দ্বারা জলপান করে থাকেন, তেমনভাবেই বহু যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করে প্রাণবায়ুকে লাভ করতে হয়। এইভাবে প্রাণবায়ু নিয়ন্ত্রিত হলে নাভি, হৃদয়, কণ্ঠ, বক্ষ, মুখ, নাসা, নেত্র, ভ্রুযুগল ও বিন্দুর ঊর্ধ্বে মূর্ধাদেশে পরতত্ত্বে ধারণা করতে হয়। যেমন করে প্রাণ আপনাদি বায়ুর সংবোধের ফলে প্রাণায়াম সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়, তেমন করে মনের ধারণার জন্যই ধারণা সংজ্ঞার অবতারণা।
সংক্ষেপে বিষয়ের নিবৃত্তিকে প্রত্যাহার প্রাণায়াম বলা হয়। ধারণাও প্রত্যাহারের সম্মেলনে যে সিদ্ধি, তাকে বলে যোগ এবং ধারণার অনুসারী সিদ্ধি বিশেষকে বলা হয় ধ্যান। ধ্যান যুক্ত পুরুষ সর্বদা চন্দ্র-সূর্যের মতো প্রদীপ্ত পরমাত্মার দর্শন লাভ করে থাকেন। সত্ত্বগুণের উৎপত্তি না হলে কিংবা অকালে যোগ উৎপন্ন হলে আত্মদর্শন সম্ভব হয় না।
যোগাভ্যাসের স্থান নির্ধারণের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। যে-কোনো স্থানে যখন তখন যোগবিদ্যার অনুশীলন করা উচিৎ নয়। শুষ্ক পত্ৰারাশি দ্বারা আচ্ছাদিত বনাঞ্চল, শ্বাপদাকীর্ণ শ্মশান, জীর্ণ গোষ্ঠ, অগ্নির সমীপবর্তী স্থান, শব্দ যুত্ত বা ভয়াবহ চৈত্য, বল্মীক ক্ষেত্র, উদপাদন ও নদীতট প্রভৃতি স্থান সমূহ যোগের পক্ষে নিতান্তই নিন্দনীয় স্থান। এক্ষেত্রে এগুলি বাধাকর স্থান রূপেই পরিগণিত হবে। একইভাবে ক্ষুধা, অসন্তোষ, মানসিক ব্যাকুলতা জাতীয় অস্থির মুহূর্ত হল যোগের অপ্রশস্ত কাল। এই ধরনের দোষযুক্ত দেশ ও কালে যোগীপুরুষ কখনোই যোগনিমগ্ন হবেন না। আর যদি কোনো ক্ষেত্রে প্রমাদবশত কেউ এসব দোষের কথা জেনেও সেই ধরনের দেশ বা কালে যোগযুক্ত হন, তাহলে তার শরীরে যোগবিঘ্ন শারীরিক দোষগুলি প্রকটিত হয়ে ওঠে। দেখা দেয় জড়তা, বধিরতা, মূঢ়তা, অন্ধত্ব, স্মৃতিলোপ প্রভৃতি রোগ ও জরা। উপরিউক্ত অজ্ঞান অবস্থায় যোগাভ্যাস করলে এ ধরনের দোষের প্রকোপ কোনো ভাবেই এড়ানো সম্ভব নয়। তাই যোগীর উচিত শুদ্ধ জ্ঞানে, দোষবর্জিত স্থানে যোগসমাহিত হওয়া। অপ্রমত্তভাবে নিয়মিত যোগাভ্যাস করলে যোগীপুরুষের কোনো দোষোৎপত্তি ঘটে না।
এবার ক্রম অনুসরণ করে প্রাণায়াম থেকে যেসব রোগের উৎপত্তি হয়, তার চিকিৎসার কথা বলা দরকার। অনিচ্ছাকৃতভাবে যোগাভ্যাসকালে দোষাৰ্জন করলে এই চিকিৎসার ফলে সেই প্রাণায়ামজাত দোষগুলো চলে যায়।
অতি উষ্ণ খাদ্য ঘৃত দ্বারা স্নিগ্ধ করে ভোজন করলে ও গুল্মস্থান ধারণ করলে বাতগুল্ম প্রশমিত হয়। উদাবর্ত পীড়ার চিকিৎসায় দধি ভক্ষণ করে বায়ুকে ঊদিকে চালনা করতে হবে। তারপর বায়ুকে বায়ুগ্রন্থি ভেদ করে বায়ুদেশে প্রয়োগ বা প্রেরণ করতে হবে। এই প্রয়োগে কোনো উপকার না পেলে ঐ বায়ুকে মস্তকে ধারণ করতে হবে। সত্ত্বসম্পন্ন পুরুষ যদি যোগাভ্যাসরত অবস্থায় উদাবর্ত রোগের পীড়ায় আচ্ছন্ন হন তবে তার প্রতিকারের জন্য এই চিকিৎসা করা দরকার। উদাবৃর্ত রোগের জন্য যে চিকিৎসা গাত্রকম্পন রোগেও সেই একই চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে, এবং উভয় ক্ষেত্রেই এই চিকিৎসার দ্বারা রোগী শান্তিলাভ করে থাকেন।
শুধু উদাবর্ত বা গাত্র কম্পন রোগে নয়, দধি মিশ্রিত স্নিগ্ধ তরলের সূত্র দ্বারা সেবনে অপরাপর কয়েকটি রোগেও দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়। যেমন, উৎকট ধ্যানের ফলে বক্ষঃস্থলে আঘাত লাগলে বক্ষঃস্থলে, কণ্ঠদেশে, বাগিন্দ্রিয়ের অভিঘাত হলে দুই কর্ণে, এবং তৃষ্ণা রোগে জিহ্বায় এই স্নিগ্ধ তরল ধারণ করালে অচিরেই যোগী এসবের হাত থেকে পরিত্রাণ লাভ করেন। ক্ষয়, কুষ্ঠ ও কীলাস রোগে ভিন্ন প্রকার আহারের বিধি আছে, এসব ক্ষেত্রে সর্বোত্তম সাত্ত্বিক আহার আরোগ্য এনে দেয়।
যোগাবিপ্রের আরও বহুবিধ সমস্যা এবং তজনিত বিবিধ চিকিৎসার আয়োজন আছে। যোগকালে যদি কেউ ভয় বা দুর্বলতাবশত সংজ্ঞা হারান, তাহলে তার মাথায় এক খণ্ড বাঁশ ধরে অন্য একটি কাষ্ঠখণ্ড দিয়ে তার মাথাটি চেপে ধরে থাকতে হবে। এভাবে কিছুক্ষণ অতিবাহিত হলে সেই ব্যক্তি কিছুটা সুস্থ বোধ করলে বা তাঁর সংজ্ঞা ফিরে এলে ধারণা’কে মাথায় ধারণ করতে হবে। তারপর তাকে স্নিগ্ধ ও অল্প ভোজন দিতে হবে। এই প্রকারে চিকিৎসা করলে যোগী অবশ্যই সুস্থতা লাভ করবেন।
মানুষ ভিন্ন অন্য কোনো জন্তু দ্বারা পীড়িত হলে যোগী প্রথমেই পৃথিবী, বায়ু, অগ্নি ও আকাশকে চিন্তা করবেন। ক্ষতিকারক যে প্রকারেরই হোক না কেন প্রথমে প্রাণায়াম দ্বারা তাকে বিনষ্ট করা উচিত। প্রাণায়ামাগ্নি দ্বারা দগ্ধ করলে সবকিছুই নষ্ট হয়ে যায়। অবশ্য এইসব চিকিৎসার পরেও মাথায় যবাগু ধারণ করা অবশ্য কর্তব্য।
যোগাভ্যাসকালে যোগীকে কৃষ্ণসর্প দংশন করলে মহঃ, জ্ঞান, তপ ও সত্যলোককে চিন্তা করে হৃদয়ে ও উদরে ঐ স্নিগ্ধ সবাগ্র ধারণ করতে হবে। বিষফল খেয়ে থাকলে বিশল্যকরণী ধারণ করতে হয়। এটাই প্রথমে করতে হবে। তারপর ভাবতে হবে যাবতীয় দেবতার কথা। ভাবতে হবে প্রকৃতির রূপ ও বৈভবের কথা। এই পৃথিবী পর্বতময়, আর নিখিল পৃথিবীই সমুদ্রময়–এই চেতনার বিস্তার ঘটাতে হবে মনের মধ্যে। তারপর সহস্র ঘট জল দিয়ে রোগীকে স্নান করাতে হবে। যদি অন্যকোনোভাবে রোগীর দেহে বিষের প্রবেশ ঘটে, তাহলে চিকিৎসা পদ্ধতির সামান্য পরিবর্তন করতে হবে। তাকে জলমধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থাকতে হবে, এবং ঐ বিশল্যকরণী মাথায় অথবা সর্বাঙ্গে ধারণ করতে হবে।
যোগাভ্যাস করতে করতে শরীর শীর্ণ হয়ে উঠলে আকন্দ পাতার পুটমধ্যে বল্মীক মৃত্তিকা অর্থাৎ উই ঢিবির মাটি পূর্ণ করে তা ভোজন করতে হবে।
প্রাথমিকভাবে এটাই হল যোগাকালে উৎপন্ন বিবিধ রোগের চিকিৎসা প্রণালীর রূপরেখা।
কোথাও কোথাও কোনো কোনো বিপ্র যোগের প্রবৃত্তির কথা উল্লেখ করে থাকেন। এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত, মোহবশত জ্ঞান লুপ্ত হলে তাকে কোনো অবস্থাতেই যোগপ্রবৃত্তি লক্ষণ বলা উচিত নয়। কয়েকটি লক্ষণ দেখেই যোগপ্রবৃত্তির নির্ধারণ করা সম্ভব। লক্ষণগুলি হল–সত্ত্বগুণের আবির্ভাব, আরোগ্য, লোভহীনতা, বর্ণ, প্রভা, কণ্ঠস্বরের সৌম্যতা, শুভ গন্ধ, মলমূত্রাদির অল্পতা, উপরোক্ত সবগুলিই হল যোগ প্রবৃত্তির শারীরিক লক্ষণ।
যোগাভ্যাসকালে যদি এমন উপলব্ধি হয় যে প্রদীপ্ত পৃথিবী মধ্যে জ্যোতির্ময় আত্মা প্রবেশ লাভ করেছে তাহলে বুঝতে হবে যে যোগসিদ্ধি সমুপস্থিত হয়েছে।