Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাংলা ভাষার জন্য লড়াই || Sankar Brahma

বাংলা ভাষার জন্য লড়াই || Sankar Brahma

ক্লাস নাইন থেকেই ছেলেটির প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি টান। প্রোগ্রামিংয়ের বিভিন্ন বই কিনে ঘরে বসে পড়েই সে প্রোগ্রামিং শিখত।
১৯৮৬ সালের ২৩শে জুলাই ঢাকায় জন্ম তার। বাংলাকে নিয়ে নতুন করে সে স্বপ্ন দেখেছে। বাংলাকে দিয়েছেন নতুন এক অনন্য রূপ। কিন্তু সে এটার বাণিজ্যিকরণ করেনি। বাংলাকে ভালবেসে তৈরি করেছেন।
ইন্টারনেট দুনিয়ায় প্রবেশের শুরুর দিকের কথা। সে সময় ওয়েবে বাংলা লেখা বা বাংলায় কোনও ওয়েবসাইট তৈরি করা খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল। তখন ওয়েবসাইটে বাংলা লিখতে ছবি কিংবা পিডিএফ করে দিতে হত। ইমেল করার ক্ষেত্রে সহজে ইংরেজি লেখা সম্ভব হলেও বাংলা লেখা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার ছিল। ঠিক সেই সময় ভার্চুয়াল জগতে বাংলা ভাষার প্রসারে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে ‘অভ্র’ বাংলা কী-বোর্ড। ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ এই স্লোগানে আঠারো বছরের এক হাত ধরে বাংলা ভাষা পরিচিতি লাভ করেছে এক নতুন আঙ্গিকে। তরুণের নাম ডা. মেহদী হাসান খান। নামের আগে তখনও ডাক্তার উপাধি যুক্ত হয়নি তাঁর। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সহজসরল হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল ছেলেটি তখন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাংলা ভাষাকে সারা বিশ্বের কাছে খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়ার। কিভাবে সম্ভব এই অসাধ্য কাজ?
মেহেদী হাসান খান তখন ভাবলেন যদি এমন একটি সফটওয়্যার বানানো যায় যেটি ইংরেজি অক্ষর টাইপ করেই বাংলা লেখা সম্ভব। তাহলে বাংলা ভাষাকে সারা পৃথিবীর কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হবে।
খুব একটা সহজ ছিল না কাজটা, বিশেষ করে মেডিকেলে পড়া অবস্থায়। শিক্ষকরাও একসময় বলে দিয়েছিলেন এই ছেলের দ্বারা ডাক্তারি পড়া হবে না। ডাক্তার হওয়া হবে না তার। কিন্তু হাল ছাড়েনি সে। সত্যি করেছে তাঁর স্বপ্নকে আর সম্মানের সাথে এমবিবিএস পাশ করেছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সরকারি সমস্ত কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ‘অভ্র’ সফটওয়্যার। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ অভ্র ব্যবহার করে এবং করছে।

মেহেদী হাসান খান ২০০১ সালে ভর্তি হয় নটরডেম কলেজে। ২০০৩ সালে মেডিকেলে। সে বছর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় গেলেন তিনি। সেখানে দেখলেন বাংলা ইনোভেশন থ্রু ওপেন সোর্স বায়োসের স্টল। ‘ওই স্টলে প্রথম ‘খাটি’ বাংলা ওয়েবসাইট দেখলেন। ইউনিকোডে বাংলা লেখাও দেখলেন। ইউনিবাংলা নামে ওদের পুরো একটা অপারেটিং সিস্টেমও দেখা হলো। তবে এটা লিনাক্সের জন্য।’ বাসায় এসে ওদের ওপেন টাইপ ফন্ট নামালেন। কিন্তু এ বাংলা লিনাক্সের জন্য। ক্যারেক্টার চার্টে মাউস দিয়ে ক্লিক করে করে বাংলা লিখতে হয়। জনপ্রিয় অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের জন্য নেই।
কিন্তু প্রোগ্রামিংয়ে আসক্ত ছেলেটির মনে এই ব্যাপারটি গভীর এক কৌতূহলের সৃষ্টি করেছিল। তাই তিনি বাংলা লিনাক্সের ঐ ফন্টটি ইনস্টল করেন। আর এ সময়ই তার চোখে পড়লো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা মেহদী হাসানকে ইউনিকোড বাংলা সফটওয়্যার তৈরির অনুপ্রেরণা যোগায়। ভাবনার ফলসরূপ একটি ফনেটিক পদ্ধতিও তৈরি করে ফেলেন, কিন্তু তখনও জানানোর মত কিছু হয়নি।

মেডিকেল কলেজের প্রচন্ড পড়াশোনার চাপ মাথায় নিয়ে সে তার হোষ্টেলের রূমে বসে দরজা বন্ধ করে ঐ ইউনিকোড ভিত্তিক কিবোর্ড বানানোর কাজে লেগে পড়ে। রাত দিন খেটে সে কাজ চালানোর মতো একটা প্রোটোটাইপ দাঁড় করিয়ে ফেলে। এটা করতে গিয়ে তার কত নির্ঘুম রাত কাটে গেছে তার ঠিক নেই। মেডিসিন ক্লাবে যাওয়ার বদলে ছেলেটা রুমের দরজা বন্ধ করে প্রোগ্রামিং এর কাজ করছে। অনেকের কাছেই ব্যাপারটা অদ্ভুত বোধ হতো। এভাবে পড়াশুনা ক্ষতি করে অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ করাটা কলেজও ভাল চোখে দেখত না।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়ছিলেন মেহদী হাসান খান। কিন্তু শিক্ষকরা বলেছিলেন, এই ছেলে ডাক্তার হওয়ার অযোগ্য। মেডিকেল কলেজ ছেড়ে দেওয়া উচিত মেহদীর। কারণ ডাক্তারি পড়াশুনা বাদ দিয়ে, দিন-রাত এক করে, খাওয়া-ঘুম ভুলে হস্টেলের ঘরেই একটা ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে মেহদী তখন লড়ছিলেন অন্য লড়াই। বাংলা ভাষার জন্য লড়াই। বন্ধুরা মেহদীকে বলে পাগল, ডাক্তারি পড়তে এসে কেউ সময় নষ্ট করে! তাও আবার নাকি বাংলা লেখার সুবিধার্থে! কিন্তু মেহদী হাসান পিছু হাঁটেনি। বাংলা ভাষার জন্য তাঁর দেশের মানুষ প্রাণ দিতে পারেন, আর সেই বাংলাকে লেখার দিক থেকে সহজ করতে ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতেও রাজি মেহদী হাসান।
অবশেষে ২০০৩ সালে সফল হন মেহদী হাসান। বাংলাকে বিশ্বায়নের দিকে এক ধাপ এগিয়ে নিতে তৈরী করে ফেলেন ইউনিকোডে বাংলা সফটওয়্যার ‘অভ্র’। কে জানত তার পড়ার ল্যাব একদিন হয়ে উঠবে ওমিক্রনল্যাব, তার স্বপ্নের আকাশ বাস্তবে ধরা দিবে ‘অভ্র’ হয়ে।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসের এক জায়গায় বসে কথা হচ্ছিল ক্যাম্পাসেরই দুই পড়ুয়া (জুনিয়র-সিনিয়র) ছাত্রের মধ্যে কথা হচ্ছিল। সিনিয়র পড়ুয়া বলল, জুনিয়র পড়ুয়াকে, কত করে নিবি? জুনিয়র পড়ুয়া উত্তরে বলে, মানে? কিসের কত করে নিবো? সিনিয়র পড়ুয়া তখন পরিস্কার করে বলে আরে, তোর সফটওয়্যারের দাম কত করে রাখবি? জুনিয়র পড়ুয়া তাকে জানিয়ে ‍দিল, দাম রাখবো কেন? ওটা তো ফ্রি। কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না।
জুনিয়রের কথা শুনে সিনিয়র এবার যারপরনাই অবাক। বলিস কীরে? ওদিকে জুনিয়রের বরাবরের মতোই স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?’
সেদিন রফিক, সালাম, বরকত আর জব্বারদের সাথে মেহদী হাসানের কোথাও যেন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। এই ছেলেটির তাদের মতো করেই ভাষাটাকে ভালবেসেছিলেন। ভাষার জন্য তাদের ঠিক এতটাই মমত্ববোধ ছিল বুকের বাঁ পাশে। বহুদিন পর বাংলা আরেকজন ভালবাসার মানুষ খুঁজে পেল। স্বার্থের এই জগতে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসার মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দুস্কর।

মেডিকেল চত্বরে কথোপকথনরত সেদিনের ওই জুনিয়র ছেলেটির নাম মেহদী হাসান খান। তখন রাতদিন এক করে সফটয়্যারটি দাঁড় করানোর জন্য মত্ত ছিল সে। অবশেষে মাত্র আঠারো বছর বয়সে সফল হয় মেহদী হাসান খান। দিনটি ছিল ২৬শে মার্চ আমাদের স্বাধীনতা দিবস। আর ২০০৩ সালের সেই দিনেই, স্বাধীনতার বাণী নিয়ে আগমন হয় এক আগন্তুকের। যার নাম ‘অভ্র’। অভ্রের অর্থ আকাশ। মানে পুরো এক উন্মুক্ত আকাশ। অভিধান ঘেটে এই শব্দটিই নির্বাচন করেছিলেন অভ্রের কারিগর মেহদী হাসান খান। কারণ তার ইচ্ছে ছিল বাংলা ভাষার চর্চা হবে উন্মুক্ত। তাই অভ্রের স্লোগান হল, ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’।

বাংলা লেখার এই সফটওয়্যারটিই আজ বাংলা টাইপিস্টদের নিকট অতি পরিচিত নাম অভ্র। যার জন্য আলাদা কিবোর্ড লাগে না, আলাদা করে টাইপিংও শিখতে হয় না। ব্যবহারকারীরা শুধু ইংরেজি অক্ষরে মনের কথাটি লিখছেন আর তা অভ্রের যাদুতে বাংলায় রুপান্তর হচ্ছে। তবে যে অভ্রর সাহায্যে আপনি আজ এত সহজে, এক নিমিষে বাংলা লিখতে পারছেন। সেই অভ্রর জনক মেহদী হাসান কিন্তু তত সহজে কিংবা এক নিমিষে অভ্রকে তৈরি করতে পারেননি। এই সৃষ্টি সাধারণ কোনো সৃষ্টি নয়, তার এই সৃষ্টি দশ বছর ধরে রচিত একটি গল্পের নাম।
মেহদী তখনকার জনপ্রিয় মাইক্রোসফটের ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে উইন্ডোজ ওএসের জন্য এপ্লিকেশন বানিয়ে ফেললেন। পরে ভারতের একটা বাংলা ফন্ট প্রতিযোগীতায় ইমেইল করে নিজের বানানো প্রোটোটাইপটা পাঠানোর পর তারা জানালো, ‘এইটা তো ঘন ঘন ক্র্যাশ করছে।’
তারপর আবার রাত জেগে প্রোটোটাইপের বাগ সারান। তার আগে ডটনেট বাদ দিয়ে ক্লাসিক ভিজুয়াল বেসিকে সবগুলো কোড নতুন করে আবার লিখলেন মেহদী হাসান। (যদিও পরবর্তীতে আবারো একেবারে নতুন করে কোড লেখা হয় Delphi/Object Pascal-এ।) বর্তমানে অভ্র এই ফ্রেমওয়ার্কেই আছে। ক্র্যাশের ঝামেলা কমলো।
এরপর কাজ শুরু অভ্রর অফিসিয়াল সাইট বানানোর। মেহদী তার সাইটে ফোরাম সেটাপ করলো, এটা অভ্রর জীবনে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ছিল। ফোরামে অভ্র’র ইউজাররা ফিডব্যাক দিত, বাগ রিপোর্ট করত, প্রশ্নত্তোর চলতো। মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওমিক্রনিক রূপান্তর বই পড়েই তখন মেহদীর মুগ্ধতা। ওখান থেকেই আসলো ওমিক্রন। আর ল্যাব শব্দ যুক্ত হল একটু সিরিয়াস ভাব আনতে।
মেহদীর উদ্দেশ্য সফল হল। সে সময়ের জনপ্রিয় প্রযুক্তি বিষয়ক মাসিক ম্যাগাজিন ‘কম্পিউটার টুমোরো’ একদিন ফিচার প্রতিবেদন করল মেহদীর ‘অভ্র’-কে নিয়ে। শুধু তাই না, সেই ম্যাগাজিনের সাথে অভ্রের সিডির একটা করে কপি ফ্রি দেয়া হয়েছিলো। ‘সে মাসে নিউ মার্কেটের দোকানে দোকানে সিডিসহ ম্যাগাজিন, কি যে দারুণ অনুভূতি!’
২০০৭ সালে ‘অভ্র কীবোর্ড পোর্টেবল এডিশন’ বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। উল্লেখ্য, ভার্সন ৫ এরপর থেকে অভ্রকে ফ্রিওয়্যার থেকে ওপেনসোর্সে রূপান্তর করা হয় এবং এটি ‘মজিলা পাবলিক লাইসেন্স’এর অধীনে লাইসেন্সকৃত।
‘অভ্র’ সফটপিডিয়াতে শতভাগ স্পাইওয়্যার/অ্যাডওয়্যার/ভাইরাস মুক্ত সফটওয়্যার হিসেবে স্বীকৃত। মাইক্রোসফটের অনলাইন সংগ্রহশালায় ইন্ডিক ভাষাসমূহের সমাধানের তালিকায় ‘অভ্র’ কীবোর্ডকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আজ কিন্তু ডা. মেহদী হাসান খান হাজার তাচ্ছিল্য সত্ত্বেও তিনি ‘অভ্র’ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে কৃতিত্বের সঙ্গে এমবিবিএসও পাশ করেছেন। ২০১০ সালে ইন্টার্ন করেন, বিয়েও করেন সহপাঠী সুমাইয়া নাজমুনকে। স্ত্রীর কাছ থেকে মতামত নিয়ে ডাক্তারি ছেড়ে প্রোগ্রামিং নিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন মেহদী। এখন প্রোগ্রামিং নিয়েই মেহদীর যত ব্যস্ততা। অবসর সময় কাটে ছেলে অর্ক হাসান খানের সাথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *