বন্ধ্যা জঙ্গলে দস্যু বনহুর
সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
বন্ধ্যা জঙ্গল এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দানবীর মত ভীষণ হয়ে উঠলো। চারদিকে নানারকম হিংস্র জীবজন্তুর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।
বনহুর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে সেখানে বসে পড়লো, কিছু খেয়ে নিয়ে কোনো গছের ডালে আশ্রয় নেবে। কিন্তু বনহুরের খাওয়া আর হলো না, একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে এলো তার কানে—ঘণ্টাধ্বনির মত শব্দটা। বনহুর জানতো, এইরকম আওয়াজ করে এক ধরনের উড়ন্ত সাপ। সে সাপগুলো মাটিতে চলে কম। উড়ে উড়ে পথ চলে ওরা। অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বিষাক্ত সাপ এগুলো। বনহুর মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো, তাকালো সে সামনের দিকে যেদিক থেকে শব্দটা আসছিলো।
বনহুর উঠে দাঁড়াবার একটু পরেই দূরে জঙ্গলের ফাঁকে দেখা গেলো একটা উড়ন্ত সাপ আঁকাবাঁকা হয়ে উড়তে উড়তে এগিয়ে আসছে। একটা মোটা খাটো গাছের খণ্ডের মত দেখা যাচ্ছে। দূর থেকেই বনহুর শিউরে উঠলো, বহুরকম সাপ বনহু দেখেছে কিন্তু এমন ধরনের সাপ সে কোনদিন দেখেনি। সাপটার চোখ দুটো সন্ধ্যার অন্ধকারে টর্চের আলোর মত জ্বলছে।
কি করবে ভেবে পায় না বনহুর। সে বেশ বুঝতে পেরেছে, এই অদ্ভুত সাপটা তার রক্তের গন্ধ পেয়েছে। ওরা নাকি বহুদূর থেকে মানুষের রক্তের গন্ধ পায়।
বনহুর মনে সাহস সঞ্চয় করে নিলো, মরতে হয় মরবে তবু বাঁচার চেষ্টা করবে সে। ক্ষিপ্রতার সঙ্গে বনহুর ছোরাটা খুলে নিলো হাতে। একমাত্র সম্বল তার ছোরাখানার দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিলো সে। অন্ধকারেও চকচক করে উঠলো ছোরাটা বিদ্যুতের মত।
বনহুর ছোরাখানা বাগিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো, পায়ের কাছে পড়ে রইলো তার খাবারগুলো।
উড়ন্ত সাপটা তার চ্যাপ্টা মুখখানা মাঝে মাঝে ফাঁক করে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ধারালো সাদা দাঁতগুলো এক একটা ছুরির মত মনে হচ্ছে।
বনহুরের আয়ত্তের মধ্যে সাপটা এসে পড়তেই বনহুর মরিয়া হয়ে ছোরাখানা নিক্ষেপ করলো সাপটার মাথা লক্ষ্য করে। সঙ্গে সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো।
ছোরাখানা সাপটার চোখে গিয়ে বিদ্ধ হয়েছে। ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেলো সাপটা একটা ঝোঁপের মধ্যে ঝপাৎ করে। ঝোঁপটা ছোটোখাটো নয়, বেশ বড় তাই বনহুর আর দেখতে পেলো না সাপটাকে, শুধু ঘণ্টাধ্বনির মত একটা তীব্র আওয়াজ তার কানে আসতে লাগলো। সাপটার চোখে ছোরাবিদ্ধ হওয়ায় সে আর আকাশে উড়ে উঠতে পারলো না বটে কিন্তু বনহুর হারালো তার ছোরাখানা।
বনহুর এবার কতকটা আশ্বস্ত হলেও ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লো, ছোরাখানাই যে ছিলো তার শেষ সহায়ক, এখন কোনো একটা বিপদ এলে কি করবে সে।
অত্যন্ত ক্ষুধা বোধ হওয়ায় এবার বনহুর গোগ্রাসে কিছু খেয়ে নিলো, পানি পান করলো সে বেশ কিছুটা।
তারপর একটা গাছে উঠে পড়লো বিলম্ব না করে।
গাছে কোনো বিপদ ওঁৎ পেতে আছে কি না কে জানে!
গাছটা উঁচু হলেও ডালপালাগুলো মোটা এবং ঝাকড়া ছিলো, কাজেই বনহুর অনায়াসে একটা ডাল বেছে নিলো রাত কাটাবার জন্য।
বনহুরের কাছে এখন কোনো অস্ত্র নেই, সে সম্পূর্ণ শূন্যহস্ত। মৃত্যুর জন্য সে প্রস্তুত হয়েই রইলো, কারণ অস্ত্রহীন অবস্থায় এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে কতক্ষণ সে বাঁচতে পারবে কে জানে!
যে ডালটায় বনহুর বিশ্রামের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলো সে ডালটা বেশ চওড়া থাকায় আরামে বসতে পারলো সে। অল্পক্ষণেই দু’চোখ তার মুদে এলো, ক্লান্তি আর অবসাদে ভরে উঠেছিলো তার দেহটা।
হঠাৎ ঘুম ভাংতে চমকে উঠলো বনহুর–কখন ভোর হয়ে গেছে, গহন জঙ্গলেও সূর্যের আলোকরশ্মি এক অপূর্ব ভাবের সৃষ্টি করেছে। গাছে গাছে পাখির কলরব, তার সঙ্গে ভেসে আসছে নানারকম জীবজন্তুর আওয়াজ।
বনহুর চোখ রগড়ে হাই তুলে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। সে যেন নবজীবন লাভ করেছে আজ, দেহ-মন বেশ সুস্থ লাগছে। রাতে কোনো বিপদ আসেনি সেজন্য বনহুর খোদার কাছে শুকরিয়া জানালো অন্তর ভরে।
বনহুর এবার গাছ থেকে নেমে এলো।
গাছের নিচে নেমে আসতেই হঠাৎ তার নজর পড়লো একটা কালসাপ মৃত অবস্থায় পড়ে আছে গাছটার তলদেশে। সাপটার ঠিক গলায় একটা তীরফলক বিদ্ধ হয়ে আছে। তীরফলকটা সাপটার কণ্ঠ ভেদ করে এপার-ওপার হয়ে গেছে।
বনহুর অবাক হয়ে গেলো, রাতে নিশ্চয়ই এ সাপটা তাকে দংশন করতে গিয়েছিলো, আর কেউ তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কে যে তাকে বারবার রক্ষা করছে। বনহুর অবাক হয়ে ভাবে, এই গহন জঙ্গলে কে আছে তার হিতাকাক্ষী? সে যখন রাতে অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো তখন সে জেগে ছিলো তার প্রহরীর মত।
বনহুর চারদিকে তাকায় কিন্তু কাউকেই নজরে পড়ে না। আবার চলতে শুরু করে সে।
মাঝে মাঝে সে ম্যাপ বা সংকেতপূর্ণ কাগজখানা খুলে দেখছিলো ঠিক পথে সে চলছে কিনা।
হঠাৎ এক জায়গায় এসে বনহুর থমকে দাঁড়ালো, সে দেখতে পেলো তার ছোরাখানা পড়ে আছে একটা পাথরের পাশে। ছোরাখানা কাল সেই উড়ন্ত সাপটার চোখে বিদ্ধ করেছিলো এবং সাপটা তার ছোরা নিয়েই ঝোঁপটার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলো, তারপর কোথায় গেলো আর তাকে দেখা যায়নি।
বনহুর বুঝতে পারলো, সাপটা চোখে ছোরাবিদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে এতদূর চলে এসেছিলো এবং পাথরখণ্ডটার সঙ্গে মাথা আছড়ে বা চোখ ঘসে ঘসে ছোরাটা খুলে ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
এগিয়ে এসে বনহুর ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে। ছোরাখানায় তখনও রক্তের শুকনো দাগ লেগে আছে। ছোরাখানা নিয়ে আবার সে কোমরের বেল্টে খাপের মধ্যে রেখে দিলো।
আবার এগুতে লাগলো সে।
পদে পদে বিপদ, এ মুহূর্তে ছোরাখানা তার একমাত্র সঙ্গী। হঠাৎ মনে পড়ে বনহুরের, আরও একজন কেউ আছে যে আড়লে আত্নগোপন করে তার জীবন রক্ষা করে চলেছে।
কিন্তু কে সে?
বনহুর চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পথ চলতে থাকে। এদিকে জঙ্গল ক্রমেই হাল্কা মনে হচ্ছিলো, মাঝে মাঝে সূর্যের রশ্মি দুর্ভেদ্য বৃক্ষরাজির পল্লবায়িত শাখার ফাঁকে কিঞ্চিৎ আলো ছড়াতে সক্ষম হচ্ছে।
মনটা আজ অনেকখানি হাল্কা মনে হচ্ছে বনহুরের। কারণ আজ দুদিন হলো সে একরকম প্রায় সূর্যের আলো দেখতেই পায়নি। তা ছাড়া ছোরাখানা আবার সে ফিরে পেয়েছে। সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অবস্থায় এই বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। বনহুর যদিও অত্যন্ত শক্তিশালী তবুও রিক্ত হস্তে হিংস্র জীবজন্তুর সঙ্গে পেরে উঠা মুশকিল।
সমস্ত চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে দেয় আর একটি চিন্তা–সেটা হলো কে ঐ তীর নিক্ষেপকারী যে তার অজ্ঞাতে তাকে অনুসরণ করে চলেছে।
বনহুর আপন মনে এগুচ্ছিলো, হঠাৎ আবার সেই শব্দ শুনতে পায়। বনহুর বুঝতে পারে এ শব্দ কিসের–রক্তপায়ী বাদুড়ের ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ এটা।
থমকে দাঁড়ালো বনহুর।
এবার রক্তপায়ী বাদুড়টা ঠিক তার পিছন দিক থেকে তাকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে–ভীষণ আকার চেহারার বাদুড় যেন একটা উড়ন্ত রাক্ষস।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে একটা পাথর তুলে নিলো হাতে। জঙ্গলটার মধ্যে বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে ছিলো ছেটোবড়ো অনেকগুলো পাথর। কাজেই ছোরাখানা ছাড়াও পাথরগুলো বনহুরের আর এক অস্ত্র।
বাদুড়টা তার বিরাট ডানা মেলে এগুচ্ছে।
বনহুর একটা পাথরখণ্ড ছুঁড়ে মারলো।
পাথরখণ্ডটা বাদুড়টার দেহ স্পর্শ না করেই মাটিতে পড়ে গেলো। বনহুর দ্রুতহস্তে আরও একটি পাথর তুলে নিলো, সঙ্গে সঙ্গে পাথরটা ক্ষিপ্র বেগে ছুঁড়ে মারলো বাদুড়টার মাথা লক্ষ্য করে। এবারের লক্ষ্য ব্যর্থ হলো না, বনহুরের নিক্ষিপ্ত পাথরখণ্ড গিয়ে বাদুড়টার মাথার সম্মুখে প্রচণ্ড আঘাত করলো। সঙ্গে সঙ্গে বাদুড়টা মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।
এত সহজে বনহুর বাদুড়টাকে ঘায়েল করতে পারবে ভাবতে পারেনি। মনে মনে খুশি হলো সে, চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলো-আপাততঃ বিপদমুক্ত সে।
আবার চলতে শুরু করার পূর্বে বনহুর মৃত বাদুড়টির পাশে এগিয়ে গেলো, দেখলো বাদুড়টার প্রাণ এখনও দেহ ত্যাগ করেনি। পাখা দুটো ঝটপট করছে, পা দু’খানার সঙ্গে মাথাটাও কাঁপছে থরথর করে। আর বেশিক্ষণ বিলম্ব নেই বাদুড়টার জীবনাবসান ঘটবে। বাদুড়টার মাথায় যে স্থানে পাথরটার আঘাত লেগেছিলো সে জায়গা থেতলে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে একেবারে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে কিছুটা জায়গা।
বনহুর আর বিলম্ব না করে চলতে শুরু করলো। যত বিপদ আসুক সে পরিহার করে চলবে। ছোরাখানায় একবার হাত বুলিয়ে নিলো বনহুর তারপর দ্রুতগতিতে অগ্রসর হলো।
এদিকে যতই এগুচ্ছে ততই দূরে বহুদূরে আকাশের কোল ঘেঁষে একটা জমাট মেঘ দেখা যাচ্ছে। অল্পক্ষণেই বনহুর বুঝতে পারে, ওটা মেঘ নয়, ওটাই কোরা পর্বত। ঐ পর্বতের কোনো এক গুহায় আছে তার আকাঙ্ক্ষিত নাগরাণী এবং তার মাথায় আছে নীলমনি-নীলপাথর।
বনহুরের মনে নতুন এক উন্মাদনা জেগে উঠে। ভুলে যায় পথের এই দুর্বিষহ কষ্টের কথা।
সম্মুখে দৃষ্টি রেখে সাবধানে এগুচ্ছে। সেদিন আর তেমন কোন বিপদ আসে না। ছোটোখাটো বিপদ-আপদ বনহুর গ্রাহ্যই করে না, কয়েকটা সাপ এসেছিলো তাকে তাড়া করে, সেগুলোকে সে পাথরের কিংবা গাছের ডালের আঘাতে খতম করেছে। এ ছাড়াও কয়েকটা হিংস্র জন্তু তাকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছিলো-তাদেরকেও পরাজিত করেছে বনহুর।
বহু পথ চলার পর একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে নিয়ে বসে পড়লো বনহুর বিশ্রামের জন্য। সঙ্গের খাবার থেকে কিছু খাবার সে বের করে নিলো, কিন্তু যেমনি সে ঐ খাবার মুখে দিতে গেছে অমনি একটা অদ্ভুত জীব তার মাথাটা বাড়িয়ে দিলো। ভয়ঙ্কর সে মাথাটা, ঠিক যেন একটা ঘোড়া ফড়িংয়ের মাথা! দুটো গোল গোল চোখ, যেন এক একটা ফুটবল।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে মাটিতে উবু হয়ে পড়লো, তারপর দ্রুতগতিতে হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোঁপের মধ্যে প্রবেশ করলো। সেখানেও যে একটা বিপদ তার জন্য ওঁৎ পেতে আছে কে জানতো। বনহুর ঝোঁপের মধ্যে প্রবেশ করতেই একটা বিষধর সাপ তার পায়ে কামড়ে দিলো।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলো– উঃ……মা…..মাগো……মা……পড়ে গেলো সে মাটির মধ্যে, চোখের সম্মুখে সব কিছু অন্ধকার হয়ে এলো। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো বনহুর।
বনহুর যখন যন্ত্রণায় আর্তচিৎকার করে উঠেছিলো তখন দূর থেকে এক ছায়ামূর্তি শুনতে পায় সে শব্দ। দ্রুত এসে পৌঁছানোর পর দেখতে পায় বনহুরের সংজ্ঞাহীন দেহটা পড়ে আছে ঝোঁপের মধ্যে।
ছায়ামূর্তি তার হাতের তীরধনু মাটিতে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো বনহুরের পাশে, ক্ষিপ্রতার সঙ্গে প্যান্টের পকেট থেকে একটা তাবিজ বের করে বনহুরের পায়ে যে জায়গাটায় সাপ কামড়ে দিয়েছিলো সেই জায়গায় তাবিজ খুলে লাগিয়ে দিলো। আশ্চর্য তাবিজটা–ক্ষতস্থানে তাবিজ লাগিয়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাবিজ আটকে গেলো আঠার মত শক্ত হয়ে।
ছায়ামূর্তি বনহুরের মাথাটা তুলে নিলো কোলে। সযত্নে চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে দিয়ে ডাকলোবনহুর, চোখ মেলো বনহুর, এই দেখো আমি এসেছি।
বনহুরের সুন্দর মুখখানায় কে যেন এক পোচ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। ঠোঁট দুখানার ফাঁকে একটু ফেনা জমা হয়ে উঠলো।
ছায়ামূর্তির মুখ বিষণ্ণ, ভাবাপন্ন হয়ে পড়লো। ললাটে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তারেখা। বারবার সে ওর চোখেমুখে ফুঁ দিতে লাগলো। পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ঠোঁটের ফাঁকে ফেনাগুলো মুছে দিয়ে আবার ডাকলো–বনহুর! … বাষ্পরুদ্ধ ওর কণ্ঠ স্বর।
অল্পক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো ছায়ামূর্তি, কখনও কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, কখনও পায়ের। ক্ষতস্থানে তাবিজটা লক্ষ্য করছে।
কয়েক মিনিট কেটে গেলো।
এখানে বনহুর যখন সাপের বিষে জ্ঞানহারা তখন কান্দাই শহরে চৌধুরীবাড়িতে হঠাৎ মরিয়ম বেগমের হাত থেকে খসে পড়লো একটি কাঁচপাত্র। কাঁচপাত্রটি ভেংগে খান খান হয়ে গেলো, ঠিক ঐ মুহূর্তে হঠাৎ মনে পড়লো তার সন্তানের কথা। মরিয়ম বেগম পুত্রের অমঙ্গল আশঙ্কায় শিউরে উঠলেন। এমন তো তার কোনোদিন হয় না, আজ কেন এমন হলো! হাত থেকে কাঁচপাত্রটি পড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার কানে যেন ভেসে এলো পুত্রের করুণ আর্ত কণ্ঠস্বর…মা…মাগো……
মরিয়ম বেগম ছুটে গেলেন কক্ষমধ্যে, আলমারীর তাক থেকে কোরান শরীফখানা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরলেন, আকুলভাবে ডাকতে লাগলেন তিনি খোদাকে।
কোরআন শরীফ নিয়ে বসলেন তিনি, অন্তর দিয়ে সূরা ইয়াসীন পাঠ করতে লাগলেন আর পুত্রের মঙ্গল কামনা করতে লাগলেন।
মায়ের দোয়ায় পুত্রের সব অমঙ্গল দূর হয়ে যায়।
মরিয়ম বেগম যখন কোরআন শরীফ পাঠ করে জায়নামাজে বসে অশ্রুবিসর্জন করতে করতে মোনাজাত করছিলেন তখন বন্ধ্যা জঙ্গলের এক ঝোঁপের মধ্যে দস্যু বনহুর মৃতের ন্যায় পড়ে আছে।
ব্যাকুল দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে ছায়ামূর্তি ওর মুখের দিকে। আতঙ্ক আর দুশ্চিন্তায় তার মুখোভাব করুণ হয়ে উঠেছে।
কতক্ষণ ধরে নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে সে। একরকম গাছের পাতার রস এনে তাবিজসহ ক্ষতস্থানটার উপরে লাগিয়ে দিচ্ছে আর ব্যাকুল নয়নে তাকাচ্ছে সে বনহুরের মুখের দিকে।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়।
অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ছায়ামূর্তি। হতাশায় ভরে উঠে তার মন, আর বুঝি রক্ষা পেলো না বনহুর। যতই সময় যাচ্ছে ততই বেশি চিন্তিত হয়ে পড়ছে সে।
ছায়ামূর্তির মুখ যখন হতাশার কালিমায় কালো হয়ে উঠেছে তখন হঠাৎ বনহুর একটু নড়ে উঠলো। পা থেকে তাবিজটা খসে পড়লো আপনা আপনি?
ছায়ামূর্তির চোখ দুটে খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। একটা আশার আলো জাগলো তার মনে। তাবিজটা এবার হাতে তুলে নিয়ে বেঁধে দিলো সে বনহুরের বাজুতে।
একসময় বনহুরের সংজ্ঞা ফিরে এলো।
শরীরটা অত্যন্ত ক্লান্ত ও অবসন্ন মনে হচ্ছিলো, হঠাৎ সে স্মরণ করতে পারছে না কি হয়েছে তার। কিছুক্ষণ নিশূপ হয়ে ভাবতে লাগলো, ধীরে ধীরে মনে পড়লো সেই অসহ্য যন্ত্রণার কথা মনে পড়লো তার পায়ে একটি সাপ কামড়ে দিয়েছিলো—সে কি ভীষণ জ্বালা! সব স্মরণ হলো তার, কিন্তু কি করে বাঁচলো সে? হঠাৎ বনহুরের নজর পড়লে তার হাতের বাজুতে একটি তাবিজ বাধা।
বিস্ময়ে স্তম্ভিত হলো, এ তাবিজ এলো কি করে! তবে কি কেউ তাকে সর্পবিষ থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। মনে পড়লো সেই অজ্ঞাত তীর নিক্ষেপকারীর কথা। কেউ যে তাকে প্রথম থেকে অনুসরণ করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু কে সে, তবে কি আশাই তাকে পরপর এমনি করে সহায়তা করে চলেছে? বনহুরের মনে প্রশ্ন জাগে।
একটা অভূতপূর্ব আনন্দ বনহুরের হৃদয়কে পুলকিত করে তোলে। আশা…আশার মুখখানা তার চোখের সামনে ভেসে উঠে নতুন করে। এই নির্জন স্থানে সে তাহলে একা নয়, আরও একজন আছে তার সঙ্গে।
মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে বনহুরের ঠোঁটের কোণে। আবার সে উঠে দাঁড়ায়, মাথাটা তখনও কেমন ঝিমঝিম করছে তার।
ঝোঁপটার বাইরে বেরিয়ে আসে বনহুর, তাকায় সম্মুখে। আর বেশি দূর নয়, ঐ তো কোরা পর্বত। বনহুর একবার তাকিয়ে দেখে নেয় তার চারদিকে, তখনও তার ঠোঁটের ফাঁকে ক্ষীণ হাসির আভাস লেগে রয়েছে। নতুন জীবন লাভ করে, নতুন পথে পা বাড়ায় বনহুর।
বনহুর এগুতে লাগলো।
যত এগুচ্ছে বনহুর ততই নিজকে অনেক সুস্থ বলে মনে হচ্ছে। সব ক্লান্তি আর অবসাদ যেন তার দেহ-মন থেকে নিঃশেষ হয়ে গেছে।
বনহুর অবাক হলো, সামনে যতই হিংস্র জীবজন্তু তাকে দেখতে পাচ্ছে, তারা তার পদশব্দে মুখ ফিরিয়ে বিপরীত দিকে চলে যাচ্ছে।
আরও অবাক কাণ্ড, বনহুর কিছুদূর এগুতেই দেখতে পেলো ভীষণ আকার একটা জীব এগিয়ে আসছে। বনহুর কোনোদিন এমন ধরনের জীব দেখেনি, কি নাম এ জীবের তাও সে জানে না।
বনহুর ভীত না হলেও আতঙ্কিত হলো, দাঁতগুলো যেন করাতের কাটা। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বনহুর। জীবটা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। বনহুর বুঝতে পারলো এবার তার রক্ষা নেই। দ্রুতহস্তে কোমরের বেল্ট থেকে ছোরাখানা খুলে নিলো। কিন্তু অবাক কাণ্ড, জীবটা কয়েক গজ এগিয়ে এসেই আবার ফিরে চললো বিপরীত দিকে।
এমন আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করে অবাক হলো সে। জীবটা অন্য দিকে চলে যেতেই বনহুর আবার চলতে শুরু করলো। সে বুঝতে পারলো, তার হাতের বাজুতে যে তাবিজটি বাঁধা রয়েছে। তারই গুণে কোনো হিংস্র জীব তাকে আক্রমণ করতে সাহসী হচ্ছে না।
বনহুর কোনোদিন এসব বিশ্বাস করতো না, আজ কিন্তু সে মনেপ্রাণে উপলব্ধি করলো সত্যিই তাবিজেরও গুণ আছে।
আরও কিছু এগুতেই দেখলো অসংখ্য সাপ কোরা পর্বতের গা বেয়ে নিচে নামছে। নানা বর্ণের নানা জাতের সাপ! হতবাক হয়ে দেখতে লাগলো সাপের রাজ্য কোরা পর্বতটাকে।
কিন্তু বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখার অবসর ছিলো না বনহুরের, অসীম সাহসে সে পা বাড়ালো কোরা পর্বতের দিকে।
মাত্র কয়েক গজ দূরে পর্বতটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অসংখ্য সাপ পর্বতের গা বেয়ে উঠানামা করছে, ছোটবড় নানা রকমের।
বনহুর বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে দেখলো, কতকগুলো সাপের মাথায় মোরগের লাল জটার মত জটা রয়েছে, কতকগুলো সাপের দেহের মাঝখানে মাছের পিঠের কাঁটার মত খাড়া কাটা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কতকগুলো পর্বতের উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে আপন মনে। বনহুর কম অবাক হলো না, এখানেও সাপগুলো তাকে দেখে কোনোরকম আক্রমণ করতে এগিয়ে এলো না।
বনহুর একবার নিজের হাতের বাজুতে তাকিয়ে দেখে নেয়, এখানে দেহের শক্তি পরাজিত হয় কারণ সাপের রাজ্য দেহের শক্তি বা বুদ্ধি কোনো কাজেই আসে না। তাবিজটাই তাকে এই বিপদে রক্ষা করে চলেছে।
তাবিজটার উপর হাত বুলায় বনহুর।
একবার সে স্মরণ করে নেয় সেই সর্বশক্তিমান খোদাকে, সব তারই দয়া।
নব উদ্যমে বনহুর পা রাখলো কোরা পর্বতের পাদমূলে।
সম্মুখে এগিয়ে চলার পূর্বেই আর একবার বনহুর সেই সংকেতপর্ণ কাগজখানা বের করে দেখে নিলো। একটু দক্ষিণ দিকে এগুতেই একটা পথ নজরে পড়লো তার। ঠিক যেন মানুষচলা পায়ের পথ।
বনহুর অবাক হলো, এই জনমানবশূন্য নির্জন পর্বতে মানুষ আসবে কোথা হতে! তাছাড়া এ যে সাপের রাজ্য।
বনহুরের ভাবার সময় নেই, সে পথ বেয়ে কোরা পর্বতের উপরে উঠতে লাগলো। পথের দু’পাশে অসংখ্য সাপ যেন গিজগিজ করছে, কিন্তু কেউ তাকে দেখে তেড়ে এলো না বা কোনোরকম আক্রমণ চালালো না।
বনহুর খুশি মনে কোরা পর্বতের বিস্ময়কর দৃশ্য লক্ষ্য করে এগুতে লাগলো। এক অভূতপূর্ব অনুভূতিতে হৃদয় ভরে উঠছে তার সব কষ্ট সার্থক হবে এবার, লাভ করবে সে নীল পাথর।
পাথের দু’পাশে অগণিত সাপ তাকে দেখে সরে যাচ্ছে— আশ্চর্য, কেউ মাথা তুলে এগিয়ে আসছে না, বরং তাকে দেখে মাথা নিচু করে নিচ্ছে।
পথটা ক্রমান্বয়ে উঠে গেছে উপরের দিকে।
কোথাও বা বেশি ঘন জঙ্গল, কোথাও হাল্কা। পথটা কোথাও মিশে গেছে আবার কিছুদূর গিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বনহুর কোনো রকম দ্বিধা না করে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে।
বহু পথ সে চলে এসেছে।
একসময় ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যার অন্ধকার।
কোরা পর্বতের গায়ে পথটা ঝাপসা হয়ে আসে ধীরে ধীরে। বনহুর একটা আশ্রয় বেছে নেয় রাত কাটানোর জন্য। যদিও আশেপাশে অগণিত সাপ তবুও বনহুর এতটুকু ঘাবড়ে যায় না।
একটা গাছের গোড়ায় কতকগুলো শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বালে বনহুর। কোরো পর্বতের গায়ে আলোকরশ্মি দেখে হিংস্র জীবজন্তুগুলো ভয়ে পালাতে লাগলো।
বনহুর কতক্ষণ জেগে রইলো তারপর একসময় গাছে ঠেশ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো যখন তখন পূর্বাকাশ ফর্সা হয়ে গেছে। কোথা দিয়ে রাতটা কেটে গেছে জানে না বনহুর। চোখ মেলতেই দেখলো তার সম্মুখস্থ অগ্নিকুণ্ডটা তখনও ধীরে ধীরে জ্বলছে। অবাক হলো বনহুর, সে যে অগ্নিকুন্ড জ্বেলেছিলো তা এতক্ষণ থাকার নয়, অর্ধরাতের মধ্যেই নিভে যাবে কিন্তু তা যায়নি। হঠাৎ বনহুরের নজরে পড়লো অগ্নিকুন্ডটার পাশে পড়ে আছে একটা ছোট্ট রুমাল।
বনহুর উঠে গিয়ে রুমালখানা হাতে তুলে নিতেই চমকে উঠলো, রুমালখানায় রক্তের ছাপ বিদ্যমান। এ রুমাল কার এবং তাতে রক্তের ছাপ এলো কি করে!
রুমালখানা উল্টেপাল্টে দেখতেই বনহুর বুঝতে পারলো কেই অগ্নিকুণ্ডে কাঠ নিক্ষেপ করতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছে, তারই রক্তে রুমালখানা সিক্ত হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কি আশার এই কাণ্ড? ওর জন্য মায়া হয় বনহুরের—হায়রে নারী জাতি, সত্যি তোমরা বড় মায়াময়ী। বনহুর জানে, আশা তার কাছে কোনোদিন প্রতিদান পাবে না, তবু সে জীবন দিয়ে তাকে ভালবেসে যাবে……অদ্ভুত নারী। অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করে বনহুর, তারপর আবার পথ। চলতে শুরু করে।
খাড়া পর্বতের গা বেয়ে উঠছে বনহুর, কোথাও বা সমতল আবার কোথাও বেশ ঘন ঝোঁপঝাড়। বনহুর নব উদ্যমে চলছে। কোনো বাধাই তার পথ রোধ করতে পারবে না আর।
মাঝে মাঝে সংকেতপূর্ণ কাগজখানা মেলে দেখে নিচ্ছে সে, আবার পথ চলছে। দুর্গম পথ, চারদিকে অসংখ্য সাপ কিলবিল করছে।
এত সাপের মধ্যেও বনহুরের মনে এক দুর্জয় সাহস মাথা উঁচু করে আছে। মৃত্যুকে জয় করেছে সে।
আঁকাবাঁকাকে নানা উঁচুনীচু পথ অতিক্রম করে একসময় বনহুর কোরা পর্বতের উঁচু এক স্থানে পৌঁছে গেলো। সত্যি, এবার বনহুরের গা ছম ছম করে উঠলো। একটা শব্দ আসছে তার কানে। কোনো মানুষের গলার আওয়াজ বলে মনে হলো। কেউ যেন কোনো মন্ত্র উচ্চারণ করছে।
বনহুর এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে সে নিচে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছে। অসংখ্য সাপ পর্বতের গায়ে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। জীবনে সে এত সাপ দেখেনি কোনোদিন।
কতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলো সে এই বিস্ময়কর সাপের রাজ্যটাকে; কিন্তু বেশিক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই তার। সেই মানুষের মন্ত্র উচ্চারণ শব্দটা লক্ষ্য করে বনহুর আবার এগুতে লাগলো।
শব্দটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
আরও কিছুটা এগুতেই বনহুর দেখলো, দূরে একটা গুহার মধ্য থেকে শব্দটা আসছে। আরও আশ্চর্য হলো, পথটা সেই গুহার মুখে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। বনহুর আর মুহূর্ত বিলম্ব না করে দ্রুত গুহার দিকে অগ্রসর হলো।
এবার বনহুর ছোরাখানা হাতে খুলে নিলো, চোখেমুখে তার বিপুল উন্মাদনা।
বেশিক্ষণ লাগলো না বনহুরের গুহাটার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। এই পথটুকু আরও দুর্গম ছিলো। গুহার মুখে এসে দাঁড়াতেই তার নজরে পড়লো গুহার ভিতরের সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এক। বৃদ্ধা গুহার মধ্যে একটা আসনে বসে আছে, তার চারপাশে ঘিরে অসংখ্য সাপ গিজগিজ করছে। আরও আশ্চর্য হলো সাপগুলো একটুও নড়াচড়া করছে না, স্থিরভাবে রয়েছে তারা।
বৃদ্ধা একরকম অদ্ভুত মন্ত্র পাঠ করে চলেছে।
এতক্ষণ বনহুর সেই বৃদ্ধার কণ্ঠই শুনতে পাচ্ছিলো। কয়েক মুহূর্ত বনহুর অবাক হয়ে দেখলো, তারপর কি করবে ভাবছে ঐ দণ্ডে বৃদ্ধা আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো।
|বনহুর মুহূর্তে একটা পাথরের আড়ালে আত্নগোপন করলো কিন্তু তার দৃষ্টি রইলো সেই গুহার মধ্যে বৃদ্ধার দিকে।
বৃদ্ধা উঠে একটা বড় বাটিতে কিছু ঢেলে দিলো। বনহুর অনুমানে বুঝতে পারলো দুধ হবে। অবাক হয়ে বৃদ্ধার কাণ্ড দেখছে বনহুর……বৃদ্ধা বড় বাটিতে দুধ ঢেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে অসংখ্য সাপ মাথা উঁচু করে বাটির মধ্যে মুখ নামিয়ে দিলো।
অল্পক্ষণেই সব দুধ নিঃশেষ করে ফেললো সাপগুলো। তারপর বেরিয়ে গেলো সাপগুলো গুহার মধ্য থেকে। বনহুর অসীম ধৈর্য নিয়ে দেখছে এই বিস্ময়কর অদ্ভুত দৃশ্য।
সাপগুলো বেরিয়ে যেতেই বৃদ্ধা পুনরায় আসন গ্রহণ করলো, তারপর আবার চললো তার মন্ত্র পাঠ। সেই অদ্ভুত কণ্ঠস্বর।
এবার বনহুর লক্ষ্য করছে এরপর কি ঘটে। বনহুরের হাতে তখনও ধরা আছে সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা।
বৃদ্ধা অনরবত মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। পূর্বের চেয়ে আরও দ্রুত মন্ত্র পাঠ করছে বৃদ্ধা। বনহুর স্তব্দনিশ্বাসে তাকিয়ে দেখছে।
কয়েক মিনিট কেটে গেলো, বনহুর দেখলো হঠাৎ একটা উজ্জ্বল নীলাভো আলোতে ভরে উঠলো গুহার ভিতরটা। সে কি অপূর্ব আলোর ছটা!
বনহুরের দু’চোখে বিস্ময় যেন উপচে পড়ছে। সে দেখতে পেলো একটা বিরাট সাপ ধীরে ধীরে কোনো এক গর্ত থেকে গুহার মধ্যে বেরিয়ে আসছে। সাপটার মাথায় সেই নীলাভ আলোর ছটা। বনহুর বুঝতে পারলো এটাই নাগরাণী। যে নাগরাণীর মাথায় আছে নীল পাথর।
বনহুরের দু’চোখ যেন ঝলসে যাচ্ছে সে এক অদ্ভুত আলোকছটা। গুহার বাইরেও এসে পড়েছে সেই নীল আলো।
বনহুর দেখলো, নাগরাণী বেরিয়ে আসতেই বৃদ্ধার চোখমুখ উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠলো। সে পুনরায় আসন ত্যাগ করে বাটিতে দুধ ঢালতে লাগলো।
নাগরাণী এগিয়ে আসছে।
বনহুরের চোখ দুটো জ্বলছে, এখন কি তার করার আছে। এই নীল পাথরের জন্যই সে এত সংগ্রাম করে এই ভয়ঙ্কর স্থানে এসেছে। মৃত্যুকে জয় করেছে সে।
বনহুর দেখলো, সাপটা এবার বাটিতে মুখ প্রবেশ করিয়ে দুধ পান করছে। ওর মাথায় নীল পাথরটা অদ্ভুত নীলাভো আলো ছড়াচ্ছে।
সাপটা যখন দুধ পান করছিলো তখন বৃদ্ধা সাপের মাথায় অতি স্নেহে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো, যেমন মা সন্তানের মাথায় হাত বুলায়।
নাগরাণী দুধ পান শেষ করে ফণা উঁচু করে দাঁড়ালো।
নীল পাথরের উজ্জ্বল আলোতে বনহুর সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বৃদ্ধা এবার নতজানু হয়ে সাপটার সম্মুখে মাথা রাখলো।
বৃদ্ধা যখন মাথা নিচু করলো তখন বৃদ্ধার মস্তকের জটাগুলো তার কাঁধের দু’পাশ হতে গড়িয়ে পড়লো মাটিতে।
বৃদ্ধা নাগরাণীকে প্রণাম করলো, ঠিক সেই মুহূর্তে নাগরাণী ছোবল মারলো বৃদ্ধার মাথায়।
আড়ালে দাঁড়িয়ে চমকে উঠলো বনহুর, চোখে যেন তার পলক পড়ছে না। বৃদ্ধার মাথায় নাগরাণী দংশন করার সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে বৃদ্ধা গড়িয়ে পড়লো গুহার মেঝেতে। একটু নড়লো না, শুধু চোখ দুটো মুদে এলো ওর ধীরে ধীরে।
বনহুর বুঝতে পারলো, নাগরাণীকে সে পূজা করে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছিলো কিন্তু নাগরাণী; তার পূজায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি, তাই তাকে দংশন করে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটালো।
নাগরাণী এবার ফিরে যাচ্ছে তার গহ্বরে।
বনহুর আর কালবিলম্ব না করে সূতীক্ষ ধার ছোরা হাতে গুহার মধ্যে প্রবেশ করলো। নাগরাণীকে আঘাত করলো বনহুর ছোরা দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে নাগরাণীর মাথাটা তার দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এবার বনহুর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নাগরাণীর ছিন্ন মস্ত থেকে নীল পাথরটা তুলে নিলো।
নাগরাণীর দেহটা তখন আঁকাবাঁকা হয়ে ছটফট করছে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো গুহার মেঝেটা।
নীল পাথর নিয়ে বনহুর বেরিয়ে এলো গুহার বাইরে। চোখেমুখে তার আনন্দোচ্ছাস, সে জয়ী হয়েছে। তার স্বপ্ন সফল হয়েছে।
এই নীল পাথরের কাহিনী সে শুনেছিলো এক সাপুড়ে সর্দারের কাছে। তারপর থেকে সব সময় খেয়াল ছিলো নীল পাথরের কথা। তারপর একদিন সুযোগও এসে গেলো, অদ্ভুত উপায়ে পেলো সে এই নীল পাথরের সন্ধান।
আজ সেই নীল পাথর তার হাতে। বনহুর-পাথরটা অপলক নয়নে প্রাণ ভরে দেখে নিলো। যেমনি সে পাথরটা তার পকেটে রাখতে যাবে অমনি তার পিছনে কেউ আর্তনাদ করে উঠলো।
চমকে ফিরে তাকালো বনহুর—একি, আশা ঢলে পড়েছে ভূতলে, বুকে তার বিদ্ধ হয়ে আছে। একটি সূতীক্ষ্ণধার ছোরা। বনহুরের হাত থেকে খসে পড়লো নীল পাথর। বনহুর ক্ষিপ্রতার সঙ্গে আশাকে তুলে ধরলো। অস্ফুট কণ্ঠে বললো–আশা একি হয়েছে? কে তোমার বুকে ছোরা বিদ্ধ করলো?
আশার বুকের রক্তে রাঙ্গা হয়ে উঠলো বনহুরের হাত দু’খানা।
আশা বললো—আমাকে মাটিতে শুইয়ে দাও বনহুর, শীঘ্র তুলে নাও নীল পাথর……শয়তান মতিলাল……তোমাকে হত্যা……করতে চেয়েছিলো……
এবার বনহুর বুঝতে পারে মতিলাল এখানে এসে পড়েছে এবং সে-ই তাকে হত্যা করে নীল পাথর আত্নসাৎ করতে চেয়েছিলো কিন্তু আশা তা হতে দেয়নি-তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিলো, মতিলালের নিক্ষিপ্ত ছোরা এসে বিদ্ধ হয়েছে আশার বুকে।
বনহুর আশাকে মাটিতে শুইয়ে দেবার পূর্বেই মতিলাল লাফিয়ে পড়ে বনহুরের উপর।
বনহুর আশাকে কোনোরকমে মাটিতে শুইয়ে দেয় কিন্তু ফিরে তাকাতে পারে না, মাথায় কোনো একটা শক্ত বস্তুর আঘাত খেয়ে টলে পড়ে আশার রক্তাক্ত দেহের পাশে।
সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে বনহুর।
তারপর যখন জ্ঞান ফিরে আসে তখন বনহুর দেখতে পায় তার চারপাশে কেউ নেই। এমন কি আশার প্রাণহীন দেহটাও নেই সেখানে। নীল পাথরের কথা মনে হতেই পাশে তাকায় যেখানে তার হাত থেকে খসে পড়েছিলো পাথরটা। কিন্তু কোথায় নীল পাথর, কতকগুলো সাপ শুধু কিলবিল করছে তার চারপাশে। বনহুর উঠে বসলো–ভাল করে লক্ষ্য করলো সাপগুলো তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বনহুর তার দক্ষিণ বাজুতে হাত বুলিয়ে দেখলো তাবিজটা এখনও তার হাতে বাঁধা আছে। জামার নিচে থাকায় মতিলাল ওটা খুলে নিতে পারেনি এবং সে কারণেই বিষধর সাপগুলো তাকে এতক্ষণ আক্রমণ করেনি।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো, মাথায় হাত দিতেই বুঝতে পারলো তার মাথার এক অংশ কেটে গিয়ে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। পাশেই পড়ে রয়েছে একটা বিরাট পাথর। বনহুর বুঝতে পারে, ঐ পাথরটা দিয়েই তার মাথায় আঘাত করেছিলো সেই নর শয়তান।
আশার কথা স্মরণ হতেই মনটা বেদনায় ভরে উঠলো, তাকে রক্ষা করতে গিয়েই আশা নিজকে বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়াতে পারে না, পুনরায় ফিরে চলে বনহুর।
মতিলালের হাসির শব্দে গোটা জাহাজখানা যেন দুলে উঠে। সম্মুখস্থ টেবিলে নীল পাথর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। নীল পাথরের নীলাভো আলোতে ক্যাবিনটা আলোকিত হয়ে উঠেছে।
চারপাশে গোলাকার হয়ে বসে আছে মতিলালের অনুচরগণ। সকলের চোখেমুখেই আনন্দের হাসি। তারা অবাক হয়ে নীল পাথরটা দেখছে।
সকলের হাতেই এক-একটা কাঁচপাত্র, সবাই মনের আনন্দে শরাব পান করে চলেছে। সমস্ত জাহাজে খুশির জোয়ার। মতিলালের আশা পূর্ণ হয়েছে, নীল পাথর লাভ করেছে সে। আরও একটা আনন্দ তাদের মনে, তাদের রাণী ইরানীকে মতিলাল আহত অবস্থায় বন্দী করেছে।
মতিলাল ও তার সঙ্গীরা শরাব পান করে উঠে দাঁড়ায়। কম্পিত পা দু’খানার উপর টলছে ওদের দেহগুলো।
মতিলাল এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে নীল পাথরটা তুলে নিলো।
সঙ্গে সঙ্গে ক্যাবিনে একটা বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর শোনা গেলো–খবরদার, কেউ একটুও নড়বে না।
একসঙ্গে ফিরে তাকলো মতিলাল ও তার সঙ্গীরা। বিস্ময়ে চমকে উঠলো মতিলাল, যতমূত দেখার মত আঁতকে উঠলো, অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলো সে-তুমি?
হা
তুমি বেঁচে আছো?
দেখতেই পাচ্ছো।
হ্যাঁ এ্যা……
চুপ করে দাঁড়াও, কেউ এক পা নড়বে না।
জোতিলাল তুমি……তুমি……কথার ফাঁকে মতিলাল নীল পাথরটা পকেটে রাখতে যাচ্ছিলো। কিন্তু সে সুযোগ পায় না, জোতিলাল খপ করে ধরে ফেললো নীল পাথরসহ মতিলালের হাতখানা। বজ্রমুষ্ঠিতে ওর হাতের মুঠা থেকে পাথরটা খুলে নিলো।
মতিলাল আশ্চর্য হলো, জোতিলালের শক্তির কাছে এভাবে তার পরাজয় হবে ভাবতে পারেনি। জোতিলাল মতিলালের হাত থেকে নীল পাথরটা অতি সহজে খসে নিলো, তারপর পকেটে রাখলো।
ততক্ষণে যেন হুশ হলো মতিলালের সঙ্গীদের। তারা জোতিলালকে আক্রমণ করলো।
জোতিলাল এক-একটা প্রচণ্ড আঘাতে ধরাশায়ী করতে লাগলো এক-একজনকে।
মতিলাল স্তম্ভিত হয়ে গেছে, জোতিলালের দেহে এত শক্তি এটা তাদের জানা ছিলো না।
জোতিলালের কাছে পরাজিত হয়ে পালাতে যাচ্ছিলো মতিলালের সাঙ্গপাঙ্গ, মতিলাল ও টলতে টলতে পালাতে যাচ্ছিলো, জোতিলাল বললো–ও পথ বন্ধ। তোমরা এ ক্যাবিন থেকে কেউ এক পা নড়তে পারবে না।
মতিলাল ও তার দলবল থেমে পড়লো। ওরা বুঝতে পারলো, তাদের বের হবার পথ জোতিলাল বন্ধ করে দিয়েছে।
মতিলাল রীতিমত হাঁপাচ্ছিলো, কোনো অস্ত্র হাতে না থাকায় বন্দী হিংস্র পশুর মত ফুলছিলো ও। নীল পাথর হাতছাড়া হবে, এ যেন তার কল্পনার বাইরে। মতিলাল কোনোক্রমে এ ক্যাবিন থেকে বের হতে পারলে জোতিলালকে একবার দেখে নেবে কিন্তু সে সুযোগ মতিলাল পাচ্ছে না।
এবার মতিলাল সরে আসে–জোতিলাল, আমি পূর্বে তোমাকে যা বলেছিলাম তাই দেব, প্রচুর অর্থ আর আমদের রাণীজীকে……তুমি আমাকে নীল পাথর দিয়ে দাও।
মতিলালের কথায় জোতিলাল হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলো, সে হাসির শব্দে চমকে উঠলো মতিলাল ও তার দলবল। দু’চোখে বিস্ময় নিয়ে তাকায় ওরা জোতিলালের দিকে।
মতিলাল অবাক হয়ে গেছে এমন ধরনের হাসি সে তো কোনোদিন শোনেনি, তা ছাড়া জোতিলাল যে এমনভাবে হাসতে পারবে, এটা সে কল্পনা করতে পারে না। এবার সে বলে উঠে-জোতিলাল, বলো কে তুমি?
জোতিলাল হাসি থামিয়ে বললো-তুমি কি চোখে কম দেখো? জোতিলাল আমি……
না, তোমার আরও কোনো পরিচয় আছে?
যার ভয়ে তুমি ভীত আমি তোমার সেই বন্ধু।
তুমি-তুমিই তাহলে…..
হাঁ, দস্যু বনহুর।
দস্যু বনহুর! মতিলাল আপন মনে ভয়ার্ত কণ্ঠে নামটা উচ্চারণ করলো।
মতিলালের সাঙ্গপাঙ্গ সকলের মুখমণ্ডলে একটা ভীতিকর ভাব ফুটে ওঠে। যার ভয়ে তারা। এত আতঙ্কিত তাকেই কিনা তার নীল পাথর সংগ্রহে পাঠিয়েছিলো। সবাই ঢোঁক গিলছে, এতদিন তারা দূর-দূরান্ত থেকে দস্যু বনহুরের নামই শুনে এসেছিলো, আজ সেই দস্যু বনহুর তাদের সম্মুখে।
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওরা দস্যু বনহুরের নাম শুনে ওদের দেহের সমস্ত রক্ত যেন জমে বরফ হবার জোগাড়।
বনহুর মতিলালকে লক্ষ্য করে বললো-নীল পাথর পাওয়া দুঃসাধ্য জেনেও তুমি নীল পাথরের লোভ করেছিলে, এবার তোমার সে লোভ মিটিয়ে দেবো। দস্যু বনহুরকে হত্যা করে তুমি নীল পাথর আত্নসাৎ করবে-হাঃ হাঃ হাঃ, আপন মনে হেসে উঠলো বনহুর, সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে বের করে নিলো একটা আগ্নেয়াস্ত্র।
মতিলাল তাকিয়ে দেখলো বনহুরের হাতে উদ্যত রিভলভার, তার কণ্ঠতালু শুকিয়ে গেলো মুহূর্তে। বনহুর জাহাজের কোনো এক ক্যাবিন থেকে একটি রিভলভার সংগ্রহ করে নিয়েছিলো। এ দণ্ডে রিভলভারটা বড় উপকারে এলো তার। বনহুরের হাতে রিভলভার দেখে সবাই হকচকিয়ে গেলো।
বনহুর ক্যাবিনের একপাশে সরে গিয়ে দেয়ালে একটা সুইচে চাপ দিলো, সঙ্গে সঙ্গে একটা পথ বেরিয়ে এলো।
মতিলাল একদিন বনহুরকে এ পথেই জাহাজের তলদেশে নিয়ে গিয়েছিলো, আজ বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো-এক এক করে সবাই এদিকে এসো।
মতিলাল ও তার দল শিউরে উঠলো, তারা জানে ওপাশে কি ভয়ঙ্কর স্থান!
বনহুর ওদের লক্ষ্য করে আবার গর্জে উঠলো–এক মুহূর্ত বিলম্ব করলে আমি এক একজনকে গুলী করে হত্যা করবো।
মতিলাল ও সঙ্গীদের মুখে কে যেন একপোচ কালি মাখিয়ে দিয়েছে। মতিলাল ভাবছে, এই চলন্ত জাহাজে জোতিলাল নামক দস্যু বনহুর এলো কি করে–তাকে তো কোরা পর্বতে সে রেখে এসেছিলো, হত্যা করেছিলো পাথরের আঘাতে কিন্তু…তার ভাবনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, বনহুরের হুঙ্কারে পিলে চমকে যায় তার। সঙ্গীদের নিয়ে এগিয়ে যায় বনহুরের নির্দেশ অনুযায়ী সেই ভয়ঙ্কর পথটার দিকে।
বনহুর এমন একস্থানে দাঁড়িয়ে ছিলো যেখানে দাঁড়িয়ে সে মতিলাল ও তার সাথীদের সম্পূর্ণ দেখতে পাচ্ছিলো। কেউ যেন তার দৃষ্টির আড়ালে সরে যেতে না পারে। বনহুরের হাতের রিভলভার একবারও নিচে নামেনি, পূর্বের মতই উদ্যত।
মতিলাল দলবল নিয়ে এগিয়ে এলো।
বনহুর মতিলালকে লক্ষ্য করে বললো–একদিন তুমি বলেছিলে নীল পাথর ব্যাপারে কোনোরকম চালাকি করতে যেও না, কোনোরকম শয়তানি যদি করো তবে ঐ পথে তোমাকে ফেলে দেওয়া হবে…মনে আছে নিশ্চয়ই এ কথা তোমার?
মতিলাল ঢোঁক গিললো।
তার সঙ্গীরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো একবার।
বনহুর মতিলালকে বললো-তোমার সঙ্গীদের তোমার প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই না। তুমি তোমার সঙ্গীদেরকে এক এক করে ওপাশে নিক্ষেপ করো।
মতিলাল ও তার দলবল অসহায় চোখে তাকালো তার দিকে। বনহুর সুইচ টিপে আটকে দিয়েছে, কাজেই দরজাটা বন্ধ হয়নি। ওপাশে নিচে জাহাজের দাঁতওয়ালা চাকাটা বনবন করে ঘুরছে,. বরফের চাপগুলো কেটে পড়ছে টুকরো টুকরো হয়ে। সে কি ভয়ঙ্কর শব্দ হচ্ছে ওপাশে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যও বটে।
বনহুর পুনরায় বললো–মতিলাল….
মতিলাল বনহুরের দিকে তাকালো।
বনহুরের চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। আজ মতিলাল বুঝতে পারছে, জোতিলাল ভেবে সে কাকে তুলে নিয়েছেলে হিমসাগর থেকে। সেদিন যদি বুঝতে পারতো এই ব্যক্তিই দস্যু বনহুর তাহলে সেই দণ্ডে সে তাকে হত্যা না করে ছাড়তো না। বনহুরের অগ্নিমূর্তি মতিলালের মনে দারুণ ভীতির সঞ্চার করে।
এবার মতিলাল তার দলের একজনকে টেনে নিয়ে ফেলে দেয় ওপাশের সেই ভয়ঙ্কর পথে।
বনহুর পুনরায় আর একজনকে নিক্ষেপ করার আদেশ দেয়।
মতিলাল বনহুরের আদেশ অবহেলা করতে পারে না তার সঙ্গীদেরকে এক এক করে সেই ভয়ঙ্কর ভীষণ চক্ৰাধারে নিক্ষেপ করলো।
বনহুরের উদ্যত রিভলভারের দিকে তাকিয়ে কেউ টু শব্দ করতে পারে না, কারণ মৃত্যু তাদের হবেই। বনহুর কাউকে ক্ষমা করবে না, এটা তারা আন্দাজ করে নিয়েছে।
মতিলাল তার অনুচরদের হিমসাগরের বুকে নিক্ষেপ শেষ করে ফিরে তাকায় বনহুরের দিকে। সারা মুখখানা তার ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।
বনহুর এবার মতিলালকে বললো–বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি মৃত্যু। তুমি কিভাবে মৃত্যু চাও মতিলাল-তোমার হিমসাগরের চক্রাধারে, না আমার হাতের রিভলভারের গুলীতে তোমার যেভাবে ইচ্ছা…….
হঠাৎ মতিলাল মরিয়া হয়ে উঠলো, হিতাহিত জ্ঞানশুন্যের মত আক্রমণ করে বসলো সে বনহুরকে।
বনহুর সঙ্গে সঙ্গে সরে দাঁড়ালো।
মতিলাল পড়ে গেলো ভূতলে।
বনহুর একটু হেসে বললো-মতিলাল, অহেতুক শক্তি ক্ষয় করে লাভ হবে না, সোজা হয়ে দাঁড়াও।
মতিলাল জাহাজের মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালো। ভীষণভাবে মাথাটা তার ঠুকে গিয়েছে। অসহায়ের মত মাথার আঘাত প্রাপ্ত জায়গায় হাত দিয়ে নাড়তে লাগলো।
বনহুর বললো–মতিলাল, মৃত্যু ছাড়া তোমার কোনো গত্যন্তর নেই। মৃত্যুর পূর্বে একটি কথা তোমাকে বলতে হবে—বলো তোমাদের রাণীজী আশা কোথায়?
মতিলাল চমকে তাকালো বনহুরের দিকে।
বনহুর কঠিন কণ্ঠে বললো–সত্যি করে বললো সে কোথায়?
মতিলালের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, সে বললো-আমাকে মেরো না, আমি তোমাকে সব বলবো, সব দেবো। রাণীজী মরেনি, সে বেঁচে আছে।
আশা বেঁচে আছে! আপন মনে বললো বনহুর।
মতিলাল সুযোগ পেলো, সে বললো এবার আমাকে নীল পাথর দাও, তাহলেই আমি আশার সন্ধান জানাবো সে কোথায় আছে।
নাহলে?
নাহলে মরবো তবু বলবো না। কোনোদিন তুমি তাকে খুঁজে পাবে না বনহুর।
এ জাহাজেই আশা আছে অথচ আমি তাকে খুঁজে পাবো না-হাঃ হাঃ হাঃ, কাকে তুমি ধোকা দিতে চাও মতিলাল!
কোনোদিন তুমি তাকে খুঁজে বের করতে পারবে না, যদিও সে এই জাহাজেই আছে। জানো, আমি তাকে এমন এক জায়গায় রেখেছি যেখানে কারো সাধ্য নেই পৌঁছার। যদি নীল পাথর দাও তবেই……
নীল পাথর যদি না দেই?
রাণীজীর সন্ধান তাহলে জানাবো না।
সত্যি?
হা
নীল পাথরের লোভ তোমার এখনও দেখছি প্রবল আছে। বেশ না বললে, যাও তোমার পথ তুমি বেছে নাও। বনহুর মতিলালকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়লো।
সঙ্গে সঙ্গে মতিলাল গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে।
বনহুর প্রচণ্ড এক লাথি দিয়ে ওর দেহটা ঠেলে দিলো সেই ভয়ঙ্কর চক্রাধারে। তারপর সুইচ টিপে দরজা বন্ধ করে দিলো।
বনহুর এবার পকেট থেকে নীল পাথরটা বের করে দেখে নিলো, উজ্জ্বল নীলাভো আলোতে ক্যাবিনটা দীপ্ত হয়ে উঠলো।
পুনরায় নীল পাথরটা যথাস্থানে রেখে বনহুর বেরিয়ে এলো বাইরে; যে ক্যাবিনে সে এতক্ষণ যুদ্ধ চালিয়ে চলেছিলো সে ক্যাবিনটা ছিলো জাহাজের তলদেশে। বনহুর এতগুলো দুর্দান্ত শয়তানকে পরপারে পাঠিয়ে কতকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলো, এবার বনহুর জাহাজের ক্যাপ্টেনের কক্ষে প্রবেশ করে।
ক্যাপ্টেন জাহাজ চালকদিগকে পথের নির্দেশ দিচ্ছিলো।
বনহুর পিছনে এসে দাঁড়ালো, উদ্যত রিভলভার চেপে ধরলো ক্যাপ্টেনের পিঠে।
চমকে ফিরে তাকালো ক্যাপ্টেন। পিছনে তার দাঁড়িয়ে জাতিলাল, হাতে তার উদ্যত রিভলভার। কিছু বুঝতে পারে না ক্যাপ্টেন, জোতিলালের হাতে উদ্যত রিভলভার তার শরীরের রক্ত জল করে দেয়। হিমসাগরের হিমেল ঠাণ্ডায় ক্যাপ্টেন জমে যাবার উপক্রম হয়। বলে উঠে ক্যাপ্টেন–তুমি জীবিত আছো জোতিলাল?
বনহুর বললোনা, আমি জ্যোতিলালের প্রেতাত্না দস্যু বনহুর…….
তুমি…..তুমি দস্যু বনহুর?
হাঁ। এবার শোন, এ জাহাজ এখন আমার। মতিলাল ও তার দলবল কেউ নেই, শুধু জীবনে বেঁচে আছো তুমি আর এই জাহাজের কয়েকজন চালক। আমার নির্দেশমত তোমাদের কাজ করতে হবে।
ক্যাপ্টেনের চোখেমুখে ভীতিভাব ফুটে উঠে, মতিলাল ও তার সঙ্গীদের জীবননাশের কথা শুনে আঁতকে উঠে সে। কথাটা বিশ্বাস না করার উপায় ছিলো না, কারণ দস্যু বনহুরের চোখ ও মুখোভাব তখন অত্যন্ত কঠিন আকার ধারণ করেছে।
ক্যাপ্টেনকে লক্ষ্য করে বলে বনহুর–কোনোরকম চালাকি বা শয়তানি করতে যেও না, তাহলে মতিলাল ও তার দলবলের মত তোমার অবস্থাও হবে। আর একটি কথা, বলো তোমাদের রাণীজী কোথায়?
রাণীজী। অস্ফুট কণ্ঠে বলে ক্যাপ্টেন।
বনহুর বলে-হাঁ, বলো কোথায় আছে সে?
ক্যাপ্টেন ঢোক গিলে বললো–রাণীজীর মৃত্যু ঘটেছে।
বনহুর গর্জন করে উঠলো মিথ্যা কথা! যদি বাঁচতে চাও তোমাদের রাণীজীর সন্ধান বললো, কোথায় আছে সে? রিভলভার চেপে ধরে বনহুর ক্যাপ্টেনের বুকে।
ক্যাপ্টেন এবার ফ্যাকাশে মুখে কম্পিত কণ্ঠে বলে-শপথ করে বলছি আমি জানি না। রাণীজীর মৃত্যু হয়েছে আমি এই জানতাম।
বনহুর বুঝতে পারে, ক্যাপ্টেন আশার সন্ধান জানে না। মতিলাল সকলের অজ্ঞাতে আশাকে কোনো গোপন স্থানে লুকিয়ে রেখেছে। বনহুর ক্যাপ্টেনকে বললো–বেশ, আমি নিজেই তাকে খুঁজে বের করছি। তুমি জাহাজখানাকে দক্ষিণ দিকে চালাবার নির্দেশ দাও। পুনরায় সাবধান করে দিচ্ছি, কোনোরকম চালাকি করতে যেও না।
ক্যাপ্টেন ভয়বিহ্বল কণ্ঠে বললো–আমি কোনোরকম চালাকি করবো না।
বনহুর বেরিয়ে গেলো ক্যাপ্টেনের ক্যাবিন থেকে।
সন্ধান চালালো বনহুর কোথায় কোন ক্যাবিনে মতিলাল আশাকে লুকিয়ে রেখেছে। প্রত্যেকটা ক্যাবিন তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলেছে বনহুর, চোখেমুখে ওর বিপুল উন্মাদনা। আশা সেদিন ছোরাবিদ্ধ হয়ে মরেনি, নিশ্চয়ই সে জীবিত ছিলো এবং সে কারণেই মতিলাল তাকে ত্যাগ করে আসেনি।
আশার প্রতি মতিলালের যে একটা মোহ ছিলো সে কথা জানতো বনহুর। প্রথম দিকে আশাকে চিনতে না পারলেও পরে আশাকে চিনে নিয়েছিলো মতিলাল। বনহু যেদিন জাহাজ থেকে কোরা পর্বতের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলো সেদিন আশাকে অনেক খুঁজেও পায়নি সে। ঐদিন আশাও যে গোপনে তাকে অনুসরণ করেছিলো তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হঠাৎ একটা ক্যাবিনে এসে থমকে দাঁড়ায় বনহুর। ক্যাবিনের মেঝেতে অনেক রক্ত দেখতে পায়। রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। বনহুর প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরই বুঝতে পারে, সে রক্ত আশার ছাড়া কারও নয়, কারণ সেখানে আশার চুলের একটি ফিতা পড়ে ছিলো।
বনহুর উবু হয়ে ফিতাটা তুলে নিলো হাতে, ঠিক ঐ মুহূর্তে একটা শব্দ কানে এলো, মৃদু আর্তকণ্ঠের ক্ষীণ আওয়াজ। বনহুর কান পেতে শুনতে চেষ্টা করলো শব্দটা কোন দিক থেকে এলো। মাত্র এক মুহূর্ত, তারপরেই শব্দটা থেমে যাওয়ায় বনহুর ঠিক বুঝতে পারে না কোন দিক থেকে এসেছিলো শব্দটা। তবে এটুকু বুঝতে পারে, এ ক্যাবিনের আশেপাশে কোনো গোপন স্থানে বা গোপন ক্যাবিনে আছে আশা। আর যে ক্ষীণ আর্তকণ্ঠ সে এই দণ্ডে শুনতে পেলো তাও আশার কণ্ঠস্বর ছাড়া কারও নয়।
বনহুর এবার ক্যাবিটার মধ্যে খোঁজাখুঁজি শুরু করলো। ক্যাবিনের দেয়ালে কান লাগিয়ে শুনতে চেষ্টা করলো কোনো শব্দ তার কানে আসে কিনা। এদিক ওদিক সন্ধান চালিয়ে একসময় হতাশ হয়ে পড়লো বনহুর।
বনহুর এ ক্যাবিন ত্যাগ করার জন্য দরজার দিকে পা বাড়াবে, ঠিক ঐ সময় আবার সেই শব্দ। বনহুর এবার লক্ষ্য করলো কোন্ দিক থেকে শব্দটা এলো। বুঝতে পারলো সেই ক্যাবিনের পূর্বদিক থেকে শব্দটা এসেছে। বনহুর তাড়াতাড়ি ক্যাবিনের দেয়ালে কান রাখলো…হাঁ, ওপাশ থেকে শব্দটা আসছে।
বনহুর ক্যাবিনের দেয়ালে আঘাত করে দেখলে কেমন শক্ত তক্তাগুলো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই দেয়ালের একখানা তক্তা খসে পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে বনহুর প্রবেশ করলো সেই তক্তাবিহীন ফোকড় দিয়ে ওদিকে। বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে দেখলো ওপাশেও একটা ছোট্ট ক্যাবিন আছে। ক্যাবিনটা আধো অন্ধকারে আচ্ছন্ন। ভালভাবে লক্ষ্য করে বনহুর আরও দেখলো, ক্যাবিনের মধ্যে ছোট্ট একটি খাটিয়ায় শোয়ান রয়েছে আশা। বুকের বাম পাশে জমাট রক্ত চাপ ধরে আছে। এখনও জ্ঞানশূন্য সে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বনহুর খাটিয়ায় ঝুঁকে পড়ে ডাকলো—-আশা, আশা……কিন্তু কোনো জবাব পেলো না সে।
বনহুর চিন্তিত হয়ে পড়লো, আশা জীবিত কিনা মনে সন্দেহ জাগলো। কারণ আশাকে তখন মৃতের ন্যায় মনে হচ্ছিলো। বনহুর আশার শয্যার পাশে বসে ওর হাতখানা তুলে নিলো হাতে। পালস্ পরীক্ষা করে বুঝতে পারলো সে মৃতের ন্যায় মনে হলেও মরেনি তখনও। বনহুরের চোখ দুটো দীপ্ত হয়ে উঠলো। একটা ক্ষীণ আশা জাগলো তার মনে। যা হোক, আশা হয়তো বাঁচতেও পারে।
কিন্তু আশার শরীর থেকে প্রচুর রক্তপাত হয়েছে, সে একেবারে রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা হলে তবু বাঁচানো সম্ভব হতো।
বনহুর কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ভাবলো, এ ক্যাবিনে বেশিক্ষণ ওকে রাখাও উচিত নয়। তাছাড়া এ ক্যাবিনটা জাহাজের নিকৃষ্ট একটি ক্যাবিন। মতিলাল সর্বপ্রথম তাদের জন্য যে ক্যাবিনে জায়গা করে দিয়েছিলো সে ক্যাবিনটাই আপাততঃ শ্রেয় মনে হলো তার কাছে। ঐ ক্যাবিনে আশাকে নিয়ে যেতে পারলে ভাল হয়।
বনহুর আশার সংজ্ঞাহীন দেহটা হাতের উপর তুলে নিলো। অতি সন্তর্পণে ওকে নিয়ে এগিয়ে চললো সে। নিচের ক্যাবিন থেকে উঠে এলো উপরে, পূর্বের সেই ক্যাবিনে এসে পৌঁছলো।
জাহাজ প্রায় জনশূন্য, কাজেই বনহুর আশাকে নিয়ে যখন তার ক্যাবিনে পৌঁছলো তখন কেউ তাকে দেখতে পায়নি। বনহুর আশাকে শয্যায় শুইয়ে দিলো, তাকালো আশার রক্তশূন্য ফ্যাকাশে মুখখানার দিকে। বড় মায়া হলো বনহুরের, এই মেয়েটি তার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করেছে, কত বিপদইনা মাথা পেতে হাসিমুখে বরণ করেছে। ওর মুদিত আঁখি দুটির দিকে তাকিয়ে বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠলো। বনহুর তার দক্ষিণ হাতখানা রাখলো আশার হিমশীতল ললাটে। কি ঠাণ্ডা ওর কপাল আর চোখ দুটো। বনহুর ওর কপালে-গণ্ডে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। বুকের একপাশে ছোরা বিদ্ধ হয়েছিলো, যদিও ছোরাখানা ওর বুক থেকে তুলে ফেলা হয়েছে তবুও ক্ষত স্থান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো। বনহুর কি করবে এখন, এ মুহূর্তে ভেবে পায় না। সে পুরুষ, এজন্যই এখনও আশার দেহ থেকে জামাটা খুলে ক্ষতস্থানে কোনো ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বনহুর যখন আশার সংজ্ঞাহীন দেহটার পাশে গভীর চিন্তায় মগ্ন, সে সময় ক্যাপ্টেন এসে হাজির।
বনহুর এবং শয্যায় শায়িত একজনকে লক্ষ্য করে চমকে উঠে ক্যাপ্টেন।
বনহুর উঠে এলো ক্যাপ্টেনের পাশে, বললো-ক্যাপ্টেন, তোমাদের রাণীজীকে খুঁজে পেয়েছি কিন্তু তার অবস্থা বড় শোচনীয়। ক্যাপ্টেন, ওকে বাঁচাতে হবে, যেমন করে হোক ওকে বাঁচাতে হবে।
ক্যাপ্টেন বনহুরের ব্যাকুল কণ্ঠে এগিয়ে এলো, ঝুঁকে পড়ে আশাকে লক্ষ্য করে উদ্বিগ্নভাবে বললো-রাণীজীর এ অবস্থা কেন?
বনহুর বললো–তোমাদের মতিলাল ওকে হত্যা করতে চেয়েছিলো কিন্তু সে প্রাণে বেঁচে গেছে। তবে আশা কম, বাঁচবে কিনা সন্দেহ।
ক্যাপ্টেন একটু ভাবলো, তারপর বললো–রাণীজীকে এ অবস্থায় দেখবো ভাবতে পারেনি। সত্যি আমি এজন্য বড় দুঃখ পাচ্ছি। রাণীজী একদিন আমাকে এক বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। তা ছাড়া আমাদের রাণীজীর বড় দয়া, তিনি কোনোদিন আমাদের সাথে অসৎ ব্যবহার করেননি…
বনহুর বললো–থাক, ওসব কথা পরে শুনবো। এখন একে বাঁচানোর জন্য কোনো উপায় আছে কিনা বলল।
ক্যাপ্টেন বলে উঠলো-আমাদের জাহাজে সব আছে–ঔষধও আছে। তাছাড়া আমি নিজেও একটু-আধটু ডাক্তারী জানি।
বনহুরের মুখখানা খুশিতে ভরে উঠলো, বললো-তাহলে তো কোনো কথাই নেই, তুমি ঔষধ নিয়ে এসো ক্যাপ্টেন।
ক্যাপ্টেন আর বনহুর মিলে আশাকে বাঁচানোর চললো আপ্রাণ চেষ্টা। ক্যাপ্টেনের সাহায্যে আশার ক্ষতস্থানে ঔষধের প্রলেপ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো বনহুর। ওষুধ খাওয়ানো দরকার। কিন্তু এখনও আশার জ্ঞান ফিরে আসেনি।
ক্যাপ্টেন বললো–এই ওষুধ রেখে দাও, রাণীজীর জ্ঞান ফিরলে তাকে খাইয়ে দিও।
ক্যাপ্টেন চলে গেলো। বনহুর আশার পাশে এসে বসলো–নানারকম চিন্তু তার মনে উদয় হচ্ছে..আশার এ অবস্থার জন্য সেই দায়ী। নীলপাথর আজ তারই জন্য লাভ করেছে সে, কাজেই বনহুর আশার কাছে কৃতজ্ঞ।
বনহুর আর ক্যাপ্টেন লুথ কয়েকদিন অবিরাম চেষ্টা চালিয়েও আশাকে সুস্থ করে তুলতে সক্ষম হলো না। বনহুর বুঝতে পারলো, অত্যধিক রক্তক্ষয়ে আশা একেবারে রক্তশূন্য হয়ে পড়েছে। ওর শরীরে রক্ত না দিলে ওকে বাঁচানো সম্ভব নয় কিন্তু জাহাজে এর কোনো উপায় হবে না।
বনহুর আশার জন্য বড় দুশ্চিন্তায় পড়লো। আর দু’এক দিনের মধ্যে তাকে কোনো শহরে নিতে না পারলে ওর জীবনের আশা করা ভুল হবে। বনহুর ক্যাপ্টেনকে নির্দেশ দিলো অচিরে কোনো শহরে জাহাজখানা নেওয়ার জন্য।
ক্যাপ্টেন লুথ বনহুরের আদেশ পালন করবে বলে কথা দিলো। বললো ক্যাপ্টেন—আমাদের জাহাজ এখন ভুয়াংহু বন্দরের নিকটবর্তী হয়েছে, ইচ্ছা করলে আমরা এখানে জাহাজখানাকে নোঙ্গর করতে পারি।
বনহুর বললো–ভুয়াংহু শহরে আশার চিকিৎসা হবে বলে মনে করো?
লুথ জবাব দিলো–হাঁ। কারণ ভুয়াংহু বেশ বড় শহর এবং এখানে হসপিটাল, ডাক্তার সব আছে। হিমসাগরের তীরে হিমদেশ এই ভুয়াংহু।
বনহুর খুশি হলো, ভুয়াংহু বন্দরে জাহাজখানাকে নোঙ্গর করার জন্য বলে দিলো।
বনহুর লক্ষ্য করছে–মতিলাল যতই দুষ্ট এবং শয়তান তোক তার অনুচর ক্যাপ্টেন লুথ কিন্তু অনেক ভাল। সে রাণীজীকে যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। ক্যাপ্টেন লুথ বনহুরকে রাণীজীর আরোগ্য লাভের জন্য যথাসাধ্য সহযোগিতা করে চললো।
বনহুরের মনে আর একটা দুশ্চিন্তা সর্বক্ষণ উঁকি দিচ্ছে তার অনুচরগণসহ তার জাহাজখানা এখন কোথায় আছে কে জানে। হিমসাগরের কোথাও এখন তারা অবস্থান করছে, না কান্দাই ফিরে গেছে তাই বা কে জানে।
বনহুর বুঝতে পারছে, তার জাহাজ হিমসাগরে তাকে রেখে ফিরে যেতে পারে না, হয়তো তারই খোঁজে হিমসাগরে সন্ধান চালিয়ে চলেছে। যতদিন তাকে না পাবে ততদিন ওরা এভাবে খোঁজাখুঁজি করবে। কাজেই বনহুর কান্দাই ফিরে যাবে কি করে। এদিকে আশার চিকিৎসার একান্ত। প্রয়োজন। আপাততঃ ভুয়াংহুতেই জাহাজ নোঙ্গর করতে হবে। আশাকে সুস্থ করে তুলে তারপর তার জাহাজের সন্ধান চালাবে বনহুর। আশা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাকে ধৈর্য ধরতে হবে।
ভুয়াংহুতে পৌঁছাতে মাত্র একদিন লাগলো।
জাহাজখানা ভুয়াংহু বন্দরে নোঙ্গর করার সঙ্গে সঙ্গে বনহুর জাহাজ ত্যাগ করে নেমে পড়লো। অবশ্য ক্যাপ্টেন লুথকে সঙ্গে নিলো বনহুর। ওকে জাহাজে রেখে গেলেও পারতো কিন্তু বনহুর তা করলো না, কারণ লুথের মনে কোনো দুষ্ট মতলব আছে কিনা কে জানে?
বনহুর লুথসহ একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে নিয়ে ফিরে এলো জাহাজে।
ডাক্তার আশাকে পরীক্ষা করে মুখ গম্ভীর করে ফেললেন।
বনহুর যা সন্দেহ করেছিলো তাই হলো। ডাক্তার বললেন-আরও পূর্বে ওর শরীরে রক্ত দেওয়া দরকার ছিলো, এখন ওকে বাঁচানো কঠিন হবে।
বনহুর ব্যাকুল কণ্ঠে বললো–ডাক্তার, যেমন করে হোক ওকে বাঁচাতে হবে। আপনি যত টাকা চান দেবো।
কিন্তু কোনো উপায় দেখছি না।
আপনি চেষ্টা করুন ডাক্তার।
দেখুন, যে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না তাকে চিকিৎসা করে বদনাম নেওয়া আমি ভাল মনে করি না।
ডাক্তার!
না, আমার দ্বারা এর চিকিৎসা হবে না। আপনি আমাকে লাখ টাকা দিলেও এ রোগী আমি হাতে নিতে পারি না।
ডাক্তারের কথা শেষ হতে না হতে বনহুর বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরলো ডাক্তারের টাইসহ জামার কলার। প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়ে বললো-বদনাম হবে সেই ভয়ে আপনি চিকিৎসা করবেন না?
আঃ ছেড়ে দিন, একি করছেন?
বলুন চিকিৎসা করবেন কিনা?
আগে ছেড়ে দিন………….
না, আগে বলুন ভালভাবে ওর চিকিৎসা করবেন?
হা করবো। আঃ ছাড়ুন……ছাড়ুন……
বনহুর এবার ডাক্তারকে মুক্ত করে দেয়।
ডাক্তার ভয়বিহ্বল চোখে তাকান বনহুরের মুখের দিকে। তিনি এই বয়স পর্যন্ত বহু রোগীর চিকিৎসা করেছেন কিন্তু এমন ব্যাপারে পড়েননি কোনোদিন। একি কাণ্ড, তার ইচ্ছা হলো রোগী দেখলেন, ইচ্ছা হলো না তিনি রোগী দেখলেন না–এটা তার নিজের ইচ্ছা। এ যে তাকে বাধ্য হয়ে চিকিৎসা করতে হবে!
ডাক্তারকে মুক্ত করে দিয়ে বলে বনহুর—আপনি একে ভালভাবে চিকিৎসা করুন। যেমনভাবে চেষ্টা করলে এর জীবন রক্ষা পাবে তাই করুন।
এ যেন বনহুরের অনুরোধ নয়–আদেশ। ডাক্তার বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন, এবার তিনি বলেন–রোগীর জন্য অনেক রক্ত লাগবে, দেবেন রক্ত?
বনহুর এবার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো–যত রক্তই লাগুক দেবো, আপনি মনোযোগ দিয়ে কাজ করুন।
ডাক্তার বনহুরের আদেশমত আশার চিকিৎসা শুরু করলেন।
আশার জন্য বনহুরকে প্রচুর রক্ত দিতে হলো।
প্রথম দিন বনহুর একটু অসুস্থ বোধ করলেও পরে আর কোনো অসুবিধা হলো না তার।
কয়েকদিন ধরে ডাক্তার মাইনহুং আশার চিকিৎসা চালিয়ে চললেন। বনহুরকে আশার জন্য অনেক রক্ত দিতে হলো। একদিন ডাক্তার বললেন-রোগী জীবন লাভ করলো।
বনহুর খুশি হয়ে সেদিন তার হাতের আংগুল থেকে মূল্যবান আংটিটা খুলে দিলো ডাক্তারকে–এই নিন ডাক্তার, আপনার পুরস্কার। লাখ টাকা এর মূল্য।
ডাক্তারের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠলো। সারা জীবন ডাক্তারী করেও তিনি লাখ টাকা রোজগার করতে পারেননি—আর এক রোগীতেই তাঁর লাখ টাকা। ডাক্তার আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।
ভুয়াংহু থেকে জাহাজ যেদিন ছাড়লো সেদিন আশা বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছে। মনে তার নতুন বাঁচার স্বপ্ন, নতুন পথ চলার আশা।
আশা বিছানায় শুয়ে আছে, রাশি রাশি চিন্তাধারা তার মনের আকাশে হাল্কা মেঘের মত ভেসে বেড়াচ্ছে। সে ক্যাপ্টেন লুথের মুখে শুনেছে তার জীবন রক্ষার জন্য বনহুরের আপ্রাণ প্রচেষ্টার কথা। প্রচুর রক্ত দিয়েছে বনহুর তার জন্য। আশা যত ভাবে ততই তার মুখ দীপ্ত, উজ্জ্বল হয়ে উঠে…তার জীবন আজ সার্থক হয়েছে।
এমন সময় বনহুর প্রবেশ করে সেই ক্যাবিনে।
আশা দ্রুত উঠে তাকে অভিনন্দন জানাতে যায়।
বনহুর বলে উঠে—থাক, থাক, উঠতে হবে না। বনহুর আশার পাশে এসে বসে, বলে সে— আজ কেমন আছো আশা?
খুব ভাল। সত্যি তুমি আমার জন্য যা করেছে তা কেউ কারও জন্য করে না।
থাক, বেশি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে না। তুমি আমার জন্য যা করছো আমি শুধু সেই ঋণ। শোধ করতে চেষ্টা করছি মাত্র।
তুমি বড় বাড়িয়ে বলছো বনহুর।
বনহুর আশার কথায় হেসে উঠলো।
আশা বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বনহুরের মুখের দিকে। আজ নতুন নয়, আশা। বনহুরকে এমনি করে আরও হাসতে দেখছে। বনহুর যখন এমনি করে হাসে, বড় ভাল লাগে ওর।
আশা বনহুরের মুখ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নত হয়ে বসে।
বনহুর বলে—-আশা, বাড়িয়ে বলার অভ্যাস আমার কোনো কালে নেই। যাক সে সব কথা, এখন বলো শরীর তো সম্পূর্ণ সুস্থ মনে করছো?
হাঁ, সম্পূর্ণ সুস্থ। একটু থেমে বললো আশাবনহুর, আমাকে বাঁচানোর জন্য কেন তুমি নিজকে এমন করে নিঃশেষ করেছো?
তার মানে?
ক্যাপ্টেন লুথের মুখে আমি সব শুনেছি। আমার দেহে এক ফোঁটা রক্ত ছিলো না, তুমি নিজকে নিঃশেষ করে রক্ত দিয়েছো আমার জন্য।
বনহুরের চোখ দুটো এবার স্থির হলো আশার মুখে। একটু হেসে বললো–নিঃশেষ করে দিলাম আর কই! দিলে তো নিজে নিঃশেষ হয়ে যেতাম। কাজেই তোমার কৃতজ্ঞতা জানাবার কোনো প্রয়োজন নেই। হাঁ, একটা কথার জন্য এলাম।
আশা প্রশ্নভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকালো বনহুরের মুখের দিকে।
বনহুর গম্ভীর হয়ে কিছু ভাবলো, তারপর বললো-আশা, আমাকে আবার হিমসাগরে ফিরে যেতে হবে। ক্যান্টিন লুথের সঙ্গে তুমি ফিরে যাও নিজের দেশে।
মুহূর্তে আশার মুখখানা ম্লান, নিষ্প্রভ হয়ে উঠলো, জ কুঞ্চিত করে বললো-হিমসাগরে আবার যাবে?
হাঁ।
নীল পাথর পেয়েও হিমসাগরে..
আশাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে বনহুর—আমার জাহাজ এখনও হিমসাগরে আটকা পড়ে আছে কিনা জানি না, কাজেই আমাকে এর সন্ধান নিতে হবে।
আশা জানে, বনহুরকে কিছুতেই তার সিদ্ধান্ত থেকে ফেরানো যাবে না। আরও জানে আশা, সেই জাহাজে আছে বনহুরের বিশ্বস্ত অনুচর রহমান ও আরও অনেকে, যাদের ত্যাগ করে সে কিছুতেই ফিরে যেতে পারে না।
আশাকে চিন্তিত দেখে বলে বনহুর–ভাবছো হিমসাগরে আবার আমিও যদি আটকা পড়ি তাহলে কোনোদিন আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না?
না, সে কথা ভাবছি না
তবে কি ভাবছো?
আমি তোমাকে একা হিমসাগরে রেখে ফিরে যাবো, এ কথা আমি নিজেই ভাবতে পারি না। ক্যাপ্টেন লুথ তোমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করবে। তুমি কোন্ পথে হিমসাগরে ফিরে যেতে চাও ওকে জানাবে। আমিও থাকবো তোমার সঙ্গে।
তা হয় না আশা। আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ ভোগ করতে হয়েছে। আমাকে একাই যেতে দাও। তাছাড়া আমি চাই না এতবড় একটা জাহাজ নিয়ে বরফের রাজ্যে পুনরায় প্রবেশ করি। একটা স্পীড বোট হলেই আমার চলবে।
আশা কোনো জবাব দেয় না।
বনহুর বলে আবার—–স্পীড বোট নিয়ে আমি অনায়াসে হিমসাগরে বরফের রাজ্যে আমার জাহাজখানার সন্ধান চালাবো।
কিন্তু….
না, এর মধ্যে কোনো কিন্তু নেই আশা। আপাততঃ নীল পাথর তোমার কাছেই থাকবে। ফিরে এসে ওটা নেবো তোমার কাছ থেকে।
এমন সময় ক্যাপ্টেন লুথ প্রায় হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে–মহাশয়…মহাশয়, দূরে একটি জাহাজ দেখা যাচ্ছে।
মুহূর্তে বনহুরের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠে, সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে—জাহাজ দেখা যাচ্ছে। কোন দিকে?
আমাদের জাহাজের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ধরে জাহাজটাকে দেখা গেছে।
বনহুর বলে–চলো দেখি। কথাটা বলেই বেরিয়ে যায় সে।
লুথ তাকে অনুসরণ করে।
বনহুর ডেকে এসে দাঁড়ায়।
লুথ বাইনোকুলারটা এনে হাতে দেয়–দেখুন ঠিক দক্ষিণ-পশ্চিম কোণ ধরে।
বনহুর ক্যাপ্টেন লুথের হাত থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে চোখে লাগিয়ে তাকায়, সঙ্গে সঙ্গে আনন্দধ্বনি করে উঠে-ক্যাপ্টেন, ক্যাপ্টেন, এটাই আমার জাহাজ; দেখছে না ওর আকারটা কচ্ছপের মত?
বনহুরের কথায় লুথ বাইনোকুলার চোখে দিয়ে দেখতে থাকে। ততক্ষণে বনহুর দ্রুত চলে যায় আশার ক্যাবিনে।
বনহুর ক্যাবিনে প্রবেশ করে আশাকে একরকম আঁকড়ে ধরে ফেলে আনন্দ উচ্ছ্বাসে-আশা, আশা হিমসাগরে আর আমাকে যেতে হবে না, আমার হারানো জাহাজখানাকে পেয়েছি।
আশার চোখেমুখেও খুশির উচ্ছ্বাস ফুটে উঠে। বনহুর যখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে আশাকে ধরে ফেলে আশাও তখন ভুলে যায় আপন সত্তা, বনহুরের বুকে মাথা রাখে গভীর আবেগে।
বনহুর পরমুহূর্তে নিজকে সংযত করে নিয়ে সরে দাঁড়ায়–এসো আশা, দেখবে এসো, আমি তোমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছি।
আশাকে ধরে নিয়ে চলে বনহুর বাইরের মুক্ত আকাশের তলায়। ডেকে দাঁড়িয়ে বনহুর নিজের হাতে আশার চোখে বাইনোকুলার ধরে বলে-দেখো।
আশাকে বনহুর বাম হাতে বেষ্টনী করে ধরে রেখেছিলো, ডান হাতে ছিলো তার বাইনোকুলারটা।
আশার হৃদয়ে এক অভূতপূর্ব আনন্দদ্যুতি খেলে যাচ্ছিলো, বনহুরের বাহুবন্ধনে নিজকে সে হারিয়ে ফেলেছিলো যেন। দৃষ্টি তার বাইনোকুলারে থাকলেও পা দু’খানা তার টলছিলো।
বনহুর বললো–দেখতে পেয়েছো আশা?
আশা বললো-হ।
বনহুর উচ্ছল আনন্দে বলে উঠলো–আমার বড় আনন্দ লাগছে। আশা, তুমিও খুশি। হয়েছে না?
আশার মুখ ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে পড়ে, বলে—না, আমি খুশি হইনি।
অবাক হয়ে তাকায় বনহুর আশার মুখের দিকে, কুঞ্চিত করে বলে–আমার আনন্দে তুমি খুশি হতে পারলে না আশা?
না।
কেন?
আশা বলে উঠে–আমাকে ক্যাবিনে নিয়ে চল।
অসুস্থ বোধ করছো?
হাঁ।
হঠাৎ কি হলো তোমার?
জানি না। চলো বনহুর, আমাকে ক্যাবিনে নিয়ে চলল।
বনহুর আশাকে ধরে ধরে ফিরে আসে ক্যাবিনে। আশাকে তার বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে–কি হলো, হঠাৎ অসুস্থ বোধ করছো কেন?
আশা মুখখানা বিপরীত দিকে ফিরিয়ে রাখে।
বনহুর ওর চিবুকে হাত দিয়ে মুখটাকে এদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে–একি, তোমার চোখে পানি কেন!
আশা বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা উপরে নিজের হাতখানা রেখে বলে—ও কিছু না বনহুর।
না, তোমার কি হয়েছে বলো? আশা, আমি জানতাম নারী হলেও তুমি অন্যান্য নারীর চেয়ে সম্পূর্ণ পৃথক। কিন্তু তুমিও দেখছি…..
বনহুর, জানি না তোমার পাশে এলে আমি কেন যেন নিজকে হারিয়ে ফেলি।
তাই বুঝি তোমার চোখে পানি এসে পড়ে।
হাঁ, সে কথা মিথ্যা নয়।
আশার কথায় বনহুর পূর্বের মত হেসে উঠে-নারী রহস্যময়ী, একথা এত সত্যি তা জানতাম না আশা। মনে করতাম নারীদের সবাই রহস্যময়ী নয়। আজ আমার সে ভুল ভেংগে গেলো। জানো আশা, মানুষ বলে আমি নাকি একটা বিস্ময়। আমি মনে করতাম আমার চেয়েও তুমি বেশি আশ্চর্য, কিন্তু……
বনহুর!
বলতে দাও আশা। কিন্তু তুমি একটি অতি সাধারণ মেয়ের মত।
বনহুর, তুমি কি বলতে চাও আমার মধ্যে প্রাণ নেই? প্রেমে-ভালবাসা এসব কি আমার জন্য দোষণীয়?
আমি ঠিক তা বলছি না আশা। আমি বলছি তুমি আমার চেয়েও কঠিন, আমার চেয়েও……
জানি তুমি কি বলতে চাচ্ছো বনহুর। কিন্তু আমি তোমার কাছে হেরে গেছি……আশা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে এবার।
বনহুর আশার চুলে হাত বুলিয়ে বলে–তুমি হেরে যাওনি আশা, হেরে গেছি আমি। সত্যি আশা, তোমার সাহায্য না পেলে……
আশা বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়।
বনহুর আশার হাতখানা মুঠায় ধরে বলে–সেজন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
ক্রমেই জাহাজখানা আরও স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে আসছে। বনহুর ডেকে দাঁড়িয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখছে। পাশে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন লুথ। বনহুরের নির্দেশমত জাহাজখানাকে পশ্চিম-দক্ষিণ দিক ধরে এগুবার জন্য লুথ চালককে বলে দিয়েছে। জাহাজখানা সেইভাবে চলছে।
প্রায় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জাহাজখানা অতি নিকটে এসে পড়লো। বনহুরের সুন্দর মুখমণ্ডলে একটা আনন্দদ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাহাজখানার সম্মুখ ডেকে রহমান ও অন্যান্য অনুচরকে দেখতে পেলো।
রহমান ও তার দলবল তাদের সর্দারকে দেখে চিনতে পেরে আনন্দধ্বনি করে উঠলো।
অল্পক্ষণেই বনহুর তার নিজের অনুচরদের সঙ্গে মিলিত হলো।
রহমানকে বনহুর বুকে জড়িয়ে ধরলো। রহমান যেন তার অনুচর নয়–তার বন্ধু সে। প্রত্যেকটা অনুচরের সঙ্গে খুশি মুখে হাতে হাত মিলাতে লাগলো বনহুর।
বনহুর যখন তার অনুচরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে আনন্দ প্রকাশ করছিলো তখন আশা তার ক্যাবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে নীরবে তাকিয়ে ছিলো। গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিলো অশ্রুধারা।
বনহুর একসময় নিজ অনুচরদের কাছ থেকে ফিরে আসে আশার ক্যাবিনে, হাস্যোজ্জ্বল দীপ্ত মুখে কিন্তু আশার গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ায়। আশার কাছে বনহুর ঘনিষ্ঠ হয়ে সরে আসে, শান্ত কণ্ঠে বলে—আমার হারানো সম্পদ, আমার জাহাজ, আমার অনুচরদের ফিরে পেলাম। আকস্মিকভাবে ফিরে পেয়েছি। আজ আমার আনন্দমুখর দিনে তুমি হঠাৎ এমন গম্ভীর ভাবাপন্ন হয়ে পড়বে ভাবিনি। ওকি, তোমার চোখে পানি!
না, ও কিছু না। তোমার আনন্দে আমার চোখে আনন্দ অশ্রু এসে গেছে।
খুশি হলাম আশা।
বনহুর, জানি তুমি এবার বিদায় চাইবে, কারণ আমাদের দুজনার পথ দু’দিকে।
বনহুর তার অভ্যাসমত হেসে উঠলো, তারপর হাসি থামিয়ে বললো–এবার বুঝেছি তোমার মুখোভাব এমন গম্ভীর কেন। তোমার চোখে অশ্রুই বা কেন। আশা, তোমাকে তোমার গন্তব্য স্থানে পৌঁছে না দিয়ে আমি আস্তানায় ফিরে যাবো না।
চমকে মুখ তুলে তাকায় আশা। বনহুরের কথাটা শুনে সে আশ্চর্য না হয়ে পারে না। আশা জানতো, বনহুর তার জাহাজখানাকে পেয়ে গেলে সে তখনই বিদায় নেবে তার জাহাজ থেকে। বনহুর তাকে তার গন্তব্যস্থানে পৌচ্ছ দিয়ে তারপর তার আস্তানায় ফিরে যাবে, কথাটা শুনে খুশি হলো আশা।
বনহুর আশার মুখোভাব লক্ষ্য করে মনে মনে হাসলো, আশার মনের ভিতরটা যেন সে। দেখতে পাচ্ছে। সে তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না শুনে কত খুশি হয়েছে আশা, অন্তর দিয়ে তা উপলব্ধি করে বনহুর।
বনহুর একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে। ক্যাপ্টেন লুথের সাহায্য সিগারেটের অভাব মোচন হয়েছে বনহুরের। তার অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিপত্রের আর কোনো অসুবিধা নেই। পোশাক পরিচ্ছদ, সেভ করার সরঞ্জাম, খাবার দ্রব্যাদি–এ রকম অনেক কিছুই লুথ বনহুরকে দিয়েছিলো এ জাহাজে তার সঙ্গে পরিচিত হবার পর। এসব কারণে লুথের সঙ্গে একটা বন্ধুত্বভাব গড়ে উঠেছিলো বনহুরের।
বনহুর সিগারেট থেকে কয়েক মুখ ধোয়া ছুঁড়ে দিয়ে বললো–আমার জাহাজটিকে এত সহজে ফিরে পাবো এ আমি ভাবতে পারিনি। বিশেষ করে আমার অনুচরগণ কোনো বিপদে পড়েনি এজন্য আমি অত্যন্ত আনন্দ বোধ করছি।
তোমার আনন্দে আমিও আনন্দিত বনহুর।
জানি আশা, তুমি সব সময় আমার মঙ্গলই কামনা করো। একটু থেমে বললো বনহুর তুমি আমার জন্য যথেষ্ট করেছে আশা, আমি তোমার জন্য কিছুই করতে পারলাম না, এ জন্য আমি দুঃখিত।
আশার গও রক্তিম হয়ে উঠে, অভিমানভরা কণ্ঠে বলে-বনহুর, তুমি বারবার এ কথা বলে আমাকে লজ্জিত করো কেন বলো তো?
বেশ, আর কোনোদিন বলবো না। তুমি বিশ্রাম করো আশা, আমি যাই।
না, আর একটু বসো বনহুর।
একটু বসলে তুমি যদি খুশি হও বেশ বসছি।
আশা মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলো, তারপর বললো-একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, সঠিক জবাব দেবে বনহুর?
নিশ্চয়ই দেবো। বলো?
আচ্ছা ধরো একটা সুন্দর গোলাপ আছে। সেই গোলাপটি তুমিও চাও আমিও চাই। শেষ পর্যন্ত গোলাপটি আমাদের দুজনারই হাতে এসে গেলো, মানে আমরা দু’জনাই পেলাম। একান্ত নিজের করে পেলাম। বলো একটি গোলাপ কি দু’জনার হতে পারে?
বনহুরের ভ্রূকুঞ্চিত হয়ে আসে, মৃদু হেসে বলে—-চমৎকার প্রশ্ন করেছ?
জানি তুমি আমার এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবে না…
কারণ?
কারণ একটা গোলাপ কোনোদিন……
দু’জনার হতে পারে না, এই তো?
হাঁ, কারণ একটি ফুল একজনকেই শোভা পায়।
হু। গম্ভীর কণ্ঠে শব্দটা উচ্চারণ করে বনহুর, তারপর বলে–ফুলের চেয়ে ফুলের সুবাসের কদর অনেক বেশি, কাজেই উভয়েরই ফুলের সুবাসে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। ফুলের কি প্রয়োজন?
আশা বনহুরের উত্তর শুনে খুশি হতে পারলো না, বললো–গন্ধে সন্তুষ্ট আমি নই, ফুলটাই আমার……।
প্রয়োজন, এই তো?
জানি তুমি আমার প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারবে না। কারণ একটা জিনিস কোনোদিন। দু’জনার হয় না, হতে পারে না। বনহুর, তোমার একটি হৃদয় কি করে তুমি দু’জনাকে দিয়েছো?
তার মানে? সোজা হয়ে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বনহুর আশার মুখে।
আশা মুখমণ্ডলে একটা গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব টেনে বললো-মনিরা আর নূরী–এরা দুজনই তোমার স্ত্রী, তোমার সহধর্মিনী। বলল সত্যি কিনা?
হাঁ সত্যি।
এক সিংহাসনে দুটি রাণী কি করে সম্ভব হয় বলো?
তোমার প্রশ্ন বড় জটিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই কিন্তু তুমি যা বলছে তা সত্য নয় আশা। রাজসিংহাসন আর হৃদয় সিংহাসন এক নয়। রাজসিংহাসনের অধিকারী যেমন একজন হয়, হৃদয় সিংহাসনের অধিকারী একজন দু’জনে সীমাবদ্ধ থাকে না। কারণ একটি হৃদয়কে জয় করতে পারে শত শত মানুষ তাদের মহৎ গুণাগুণ দিয়ে। আশা আমার হৃদয় শুধু একজন বা দু’জনের জন্য নয়, লাখ লাখ অসহায় মানুষ আমার হৃদয়ের অধিকারী। আমি তো তাদের জন্য যাদের মুখে অন্ন নেই, যাদের শরীরে বস্ত্র নেই, যাদের আশ্রয় নেই। পৃথিবীর নিঃস্ব মানুষের জন্য আমার এ তুচ্ছ জীবন। আশা, কারো কথা গভীর করে ভাবার সময় আমার নেই, কারো জন্য আমি……
থাক, এবার বেশ বুঝতে পেরেছি মনিরা-নূরী এরা তোমার…….
অন্যান্য আর দশজনের মতই! বনহুর আশার কথাটা তার মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে শেষ করে।
তবে ওদের বিয়ে করার কি প্রয়োজন ছিলো তোমার?
এবার বনহুর হেসে উঠলো ভীষণ জোরে, তারপর বললো–বিয়ে? আশা, বিশ্বাস করো বিয়ে আমি করিনি।
আশার চোখেমুখে বিস্ময় ফুটে উঠে, অবাক কণ্ঠে বলে–এ তুমি কি বলছো?
হাঁ, সত্যি আমি ইচ্ছা করে কাউকে ফাঁস পরাতে চাইনি। আমার মা দেয়ালে মাথা ঠুকে আত্নহত্যা করতে গিয়েছিলেন–মাকে বাঁচানোর জন্যই, মাকে খুশি করার জন্যই আমি মনিরাকে গ্রহণ করেছি। আর……
আর নূরী, নূরীকে তুমি……
সহকারী হলেও রহমান আমার পরম বন্ধুর মত। ওর অনুরোধ আমাকে বাধ্য করেছিলো…হা বাধ্য হয়েছিলাম সেদিন আমি, বাধ্য হয়েছিলাম……একটু থেমে বলে বনহুর–তা ছাড়া নূরীর ভালবাসা ছিলো অতি পবিত্র! যে ভালবাসাকে আমি উপেক্ষা করতে পারিনি!…..
আশা লক্ষ্য করলো, বনহুরের মুখমণ্ডলে একটা আনমনা ভাব ফুটে উঠেছে।
ঠিক ঐ মুহূর্তে রহমানের গলা শোনা যায়–সর্দার!
বনহুর ক্যাবিন ত্যাগ করে বাইরে বেরিয়ে আসে।
রহমান কুর্ণিশ জানিয়ে বলে–আমরা কান্দাই চলে যাই সর্দার?
কান্দাই যাবে?
হাঁ, আমরা জাহাজ নিয়ে চলে যাই, আপনি আপনার কাজ শেষ করে চলে আসবেন।
তা অবশ্য ঠিকই বলেছো রহমান, কারণ বেশ কিছুদিন হলো আমরা আস্তানা ছেড়ে চলে এসেছি, ওদিকের সংবাদ কিছু জানা সম্ভব হয়নি।
আপনার আদেশ হলে আজই আমরা রওনা দেবো সর্দার।
বেশ, তাই দাও।
সর্দার, আপনার জন্য আমরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন থাকবে।
যত শীঘ্র পারি ফিরে যাবো রহমান। আশা আমার জন্য অনেক করেছে, তাকে এ মুহূর্তে একা নিঃসহায় অবস্থায় রেখে যাওয়াটা সমীচীন হবে না।
এ কথা সত্য সর্দার।
হাঁ, আশার সাহায্য না পেলে নীল পাথর পাওয়া আমার দুঃসাধ্য ছিলো, এজন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। নারী হলেও সে আমাকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে।
সর্দারের কাছে বিদায় নিয়ে রহমান তার দলবলসহ ফিরে যায় কান্দাই-এর পথে।
রহমান বিদায় নেবার দুদিন পর আশাসহ বনহুরের জাহাজখানা তাদের গন্তব্যস্থানে পৌঁছানোর কথা। কিন্তু কে জানতো আর একটা বিপদ ওঁৎ পেতে ছিলো তাদের জন্য।
লুথের নির্দেশমত জাহাজখানা এগিয়ে চলেছে। তাদের জাহাজ হিমসাগর ত্যাগ করে এখন নীলনদ অতিক্রম করে এগুচ্ছে।
গভীর রাত।
বনহুর সবেমাত্র শয্যা গ্রহণ করেছে। এতক্ষণ সে জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে লুথের সঙ্গে নানারকম ব্যাপার নিয়ে আলাপ করছিলো।
শুয়ে শুয়ে ভাবছে এভাবে সময় নষ্ট করা তার পক্ষে মোটেই সমীচীন নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আস্তানায় ফিরে যাওয়া দরকার। রহমান তার জাহাজ নিয়ে হয়তো পৌঁছে গেছে এ দুদিনে কান্দাই বন্দরে। তার মনিরা ও নূরী কেমন আছে। বিশেষ করে মায়ের শরীর আজকাল মোটেই ভাল যাচ্ছে না। নূর, জাবেদ এরা কেমন আছে তাই বা কে জানাবে! হঠাৎ একটা শব্দে বনহুরের চিন্তাজাল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কোনো একটা বস্তুর সঙ্গে জাহাজখানা প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে থেমে গেছে।
পাশের ক্যাবিনে আশা শুয়ে ছিলো, প্রথমেই বনহুরের মনে হলো আশার কথা। বনহুর দ্রুত ক্যাবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, তাকালো আশার ক্যাবিনের দরজার দিকে। ততক্ষণে আশাও দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। জাহাজের ঝাঁকুনিটা প্রচণ্ড লেগেছিলো, কাজেই সঙ্গে সঙ্গে ঘুম ছুটে গিয়েছিলো আশার।
আশাও ক্যাবিন থেকে বেরিয়ে বনহুরকে সম্মুখে দেখে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে–হঠাৎ জাহাজ এভাবে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেলো কেন?
বনহুর কিছু বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় একদল জংলী ঘিরে ফেললো বনহুর আর আশাকে।
বনহুর এবার বুঝতে পারলো তাদের জাহাজ জংলীদের কবলে পড়েছে। তার অনুমান মিথ্যা নয়, সে দেখলো কয়েকজন জংলী ক্যাপ্টেন লুথ এবং জাহাজের চালকদের হাত পিছমোড়া করে। বেঁধে, মাজায় দড়ি লাগিয়ে টেনে এদিকে নিয়ে আসছে।
বনহুর আর আশার চার পাশে কমপক্ষে বিশজন জংলী বল্লম হাতে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। তাদের সেকি ভীষণ চেহারা দেহের রঙ জমকালো মেঘের মত। মোষের মত মোটা এবং বলিষ্ঠ শরীর। চোখগুলো অত্যন্ত ক্ষুদ্র কিন্তু চোখগুলো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে।
জংলীদের দলপতি হবে হয়তো সেই বিরাট আকার ভয়ঙ্কর লোকটা নির্দেশ দিলো বনহুরকে বেঁধে ফেলতে। হঠাৎ আশাকে দেখে ওর চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। দলপতি আশাকে ধরার জন্য হাত বাড়ালো।
এদিকে কয়েকজন বনহুরকে ধরে ফেললো।
দুজন রশি নিয়ে এগুলো বনহুরকে বাঁধবে বলে।
রশিগুলো ছিলো গাছের ছাল দিয়ে তৈরি শক্ত মজবুত।
লোকগুলো যেমন বনহুরকে রশি দিয়ে বাঁধতে গেলো অমনি বনহুর এক ঝটকায় নিজকে মুক্ত করে নিলো, সঙ্গে সঙ্গে একজনের হাত থেকে একটা বল্লম কেড়ে নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণে এক একজন জংলী বীর পুরুষকে ধরাশায়ী করতে লাগলো।
জংলী সর্দার ততক্ষণে আশাকে কাঁধে তুলে নিয়ে সরে পড়েছে। আশার আর্ত কণ্ঠস্বর শোনা, যাচ্ছে, জাহাজের পিছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জংলী দলপতি বেশ বুঝতে পারে বনহুর। কারণ শব্দটা ঐ দিক দিয়েই আসছিলো।
বনহুর তার হস্তস্থিত বল্লম খানা দিয়ে দ্রুত কাজ করে চলেছে। নিজকে অন্যান্য জংলীদের অস্ত্র থেকে বাঁচিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
লুথ আর তার সঙ্গীদের যারা বন্দী করে ধরে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো তাদের কয়েকজনকে বনহুর বল্লম বিদ্ধ করে হত্যা করে ফেললো আর কয়েকজন ওদের ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে গেলো।
বনহুর একা আর জংলী প্রায় পঞ্চাশ জন তবু বেশিক্ষণ জংলীদল টিকে উঠতে পারলো না। জংলীদের দলপতি আশাকে নিয়ে সরে পড়তেই তার দলবল বনহুরের কাছে মার খেয়ে পালাতে লাগলো আর যারা পালাবার সুয়োগ পেলোনা তারা মারা পড়লো।
অল্পক্ষণেই জাহাজ শূন্য হয়ে পড়লো।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছুটে গেলো পিছন ডেকে তখনও জংলীদল পতি আশাকে নিয়ে জাহাজ থেকে তাদের ডিঙ্গিয়ে পৌঁছাতে পারেনি। কারণ আশা দাঁত নখ দিয়ে দলপতিকে অস্থির করে তুলেছে। দলপতি আশাকে কাঁদে নিয়ে ডেকের রেলিং বেয়ে নামার চেষ্টা করছিলো বনহুর পিছন থেকে ঘাড় চেপে ধরে সঙ্গে সঙ্গে জংলী দলপতি আশাকে নামিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।
বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে প্রচণ্ড একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো জংলী দলপতির চোয়ালে।
চিৎ হয়ে রেলিংএ ধাক্কা খেয়ে ওর দেহটা, সোজা হয়ে দাঁড়াবার পূর্বেই বনহুর ঝাঁপিয়ে পড়লো টুটি টিপে ধরলো বজ্ৰ মুষ্টিতে।
জংলী দলপতির গরিলার মত দেহটা ডেকের মেঝেতে ধপ করে পড়ে গেলো। বনহুর ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিলো তারপর আবার এক প্রচণ্ড ঘুষি।
জংলী দলপতির অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছিলো। সে যত সবলই হোক না কেননা বনহুরের কঠিন হাতের প্রচণ্ড ঘুষি খেয়ে ঘুরপাক খেয়ে পড়ে গেলো, আবার তুলে দাঁড় করিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি।
সঙ্গে সঙ্গে জংলী দলপতির সংজ্ঞাহীন দেহটা ঝপ করে গিয়ে পড়লো সাগরের বুকে।
বনহুর ঝুঁকে একবার তাকালো সাগরের বুকে। ততক্ষণে দলপতির বিশাল দেহটা তলিয়ে গেছে কিন্তু বিস্মিত হলো সে দেখলো কয়েকটা বড় বড় ডিঙ্গি তরতর করে চলে যাচ্ছে।
বনহুর ফিরে তাকালো এবার আশার দিকে।
আশা বিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে তাকিয়ে আছে, বনহুরের বলিষ্ঠ দীপ্ত চেহারার দিকে। অবাক হয়ে গিয়েছিলো আশা তার বীরত্ব লক্ষ্য করে। এতোগুলো জংলীর সঙ্গে বনহুর একা লড়াই করে জয়ী হলো শুধু তাই নয় তাকেও জংলী দলপতির কবল থেকে উদ্ধার করে নিলো। আশার ডাগর ডাগর চোখ দুটো কৃতজ্ঞতায় ছলছল করে উঠলো।
বনহুর আশাকে নিয়ে ফিরে এলো সম্মুখ ডেকে যেখানে হাত মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে ক্যাপ্টেন লুথ এবং জাহাজের অন্যান্য কর্মচারীগণ। কয়েকটি জংলীর রক্তাক্ত প্রাণহীন দেহও হাড় আছে সেইখানে।
বনহুর দ্রুত হস্তে ক্যাপ্টেন লুথ এবং তার দলবলের হাত মুখের বাধন মুক্ত করে দিলো।
ক্যাপ্টেন লুথ মুক্ত হয়েই বনহুরকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছিলো, সহসা কিছু বলতে পারছিলো না সে। বনহুর লক্ষ্য করলো লুথ কাঁপছে তখনও থর থর করে।
বনহুর সান্ত্বনা দিয়ে বললো—ভয় নেই ক্যাপ্টেন ওরা পালিয়ে গেছে! আপনি বরং লাশগুলো সাগরে ফেলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
ক্যাপ্টেন লুথের যেন হুস হলো, সে বনহুরকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে তাকালো ডেকের মেঝেতে জংলীদের রক্তাক্ত মৃতদেহ গুলোর দিকে। বেশ কয়েকজন বনহুরের বল্লমের আঘাতে প্রাণ হারিয়ে ছিলো। ক্যাপ্টেন খালাসীদের আদেশ দিলো লাশ গুলোকে সাগর বক্ষে নিক্ষেপ করার জন্য।
এবার বনহুর জিজ্ঞেস করলো-ক্যাপ্টেন জাহাজখানা কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেয়ে ছিলো বলে মনে হয়েছিলো পর পরই জংলীদের আক্রমণ ঠিক বুঝতে পারছি না?
ক্যাপ্টেন এতোক্ষণে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, সে বললো—আসলে জংলীদের চক্রান্তেই আমাদের জাহাজ আচমকা থেমে পড়েছিলো। জংলীরা বহুদূর থেকে আমাদের জাহাজটিকে লক্ষ্য করে এবং তারা জাহাজের গতি রোধ করার জন্য বরফের চাপের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জাহাজ থেমে যায়। ঐ সুযোগে জংলীদল জাহাজে উঠে পড়ে।
আশা বলে উঠলো–এসব জংলী জলদস্যু প্রায়ই জাহাজে এভাবে হানা দিয়ে খাবার এবং লোকজনদের ধরে নিয়ে যায়। আমি সম্পূর্ণভাবে ভুলেই গিয়েছিলাম এদের কথা। একটু থেমে আবার বললো-বনহুর আজ যদি তুমি আমাদের জাহাজে না থাকতে তাহলে জংলীগণ আমাদের নিঃশ্চিহ্ন করে ফেলতো।
ক্যাপ্টেন লুথও আশার কথায় যোগ দিয়ে বললো–তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ। তোমার কাছে আমরা চির কৃতজ্ঞ। ক্যাপ্টেনের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো।
বনহুর বললো—-থাক এতো বেশি কিছু করিনি যার জন্য এতো করে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। জংলীগণ পালিয়েছে, আমরা এই মুহূর্তে ও স্থান ত্যাগ করতে চাই। কারণ জংলীগণ যদি জানতে পারে তাদের দলপতি নিহত হয়েছে তাহলে ওরা আবার বিপুল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ চালাবে।
হা একথা সত্য বললো ক্যাপ্টেন লুথ।
আশা বললো—ওরা নিশ্চিয়ই দলপতির শেষ অবস্থা লক্ষ্য করেছিলো কাজেই দলবল বাড়িয়ে ফিরে আসবে বলে সন্দেহ হচ্ছে।
বনহুর বললো-ক্যাপ্টেন আপনি যত শীঘ্ন পারেন জাহাজ এখান থেকে সরিয়ে নিতে চেষ্টা করুন।
ক্যাপ্টেন লুথ বললো–তখন যে সুযোগ পেয়ে ওরা আমাদের জাহাজখানাকে আটক করেছিলো এখন আর সে সুযোগ পাবেনা।
ক্যাপ্টেন লুথ জাহাজের চালক ও তার অন্যান্য খালাসীদের নিয়ে জাহাজের ইঞ্জিনের দিকে চলে যায়।
বনহুর আশাকে লক্ষ্য করে বলে-এসো আশা তোমাকে ক্যাবিনে পৌঁছে দিয়ে আসি।
আশা আর বনহুর ক্যাবিনের দিকে এগুলো।
আশাকে তার গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিয়ে ফিরে এলো বনহুর তার অনুচরদের নিয়ে কান্দাই আস্তানায়। একটা অনাবিল আনন্দস্রোত বয়ে গেলো গোটা আস্তানা জুড়ে।
নূরী জাভেদকে নিয়ে অভিনন্দন জানালো বনহুরকে। বনহুর শুধু ফিরে আসেনি ফিরে এসেছে সে নীল পাথর নিয়ে। ফিরে এসেছে বনহুরের অনুচরগণ।
কান্দাই আস্তানায় বনহুর ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের বিভিন্ন আস্তানায় বনহুরের ফিরে আসার সংবাদ জানিয়ে দেওয়া হলো।
সর্দার জয়যুক্ত হয়ে ফিরে এসেছে জেনে সবগুলো আস্তানায় আনন্দ উৎসব শুরু হলো।
বনহুরকে ঘিরে আনন্দ উৎসব চললো।
আনন্দ উৎসব মঞ্চে গোলটেবিলে নীল পাথর রাখা হলো, পাশেই বসিয়ে দেওয়া হলো জাভেদকে।
উৎসব মঞ্চেই বনহুর ঘোষণা করলো নীল পাথর খচিত একটি মুকুট তৈরি হবে এবং সে মুকুটটি থাকবে নূরীর মাথায়। কথাটা শুনে সবাই আনন্দ ধ্বনি করে উঠলো। কারণ বনহুরের অনুচরগণ সবাই ভালবাসতো নূরীকে।
বনহুরের কান্দাই আস্তানায় যখন আনন্দ উৎসব চলেছে, তখন বনহুরের জম্বু আস্তানা থেকে সংবাদ আসে বাংলাদেশের বুকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নরহত্যা যজ্ঞের কথা।
বনহুর সঙ্গে সঙ্গে আনন্দ উৎসব বন্ধ করে দেবার নির্দেশ দেয়। নিজে ছুটে যায় ওয়্যারলেস কক্ষে। জম্বু আস্তানার সাউন্ড বক্সের বোতাম টিপতেই নীলাভ আলো জ্বলে উঠে। অম্বু আস্তানা থেকে ভেসে আসে বনহুরের জম্বু আস্তানার প্রধান অনুচর সাধন সিং এর কন্ঠ……সর্দার সমস্ত বাংলাদেশে আজ বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীদের শাসন আর তারা মানতে রাজি নয়। বাংলার মানুষ চায় স্বাধীনতা কিন্তু পাকিস্তানীগণ আগ্নেয় অস্ত্রের সাহায্যে এদের ঠাণ্ডা করতে তৎপর হয়ে উঠেছে। লাখ লাখ মানুষকে এরা নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করেছে……।
বনহুর নিশ্চুপ শুনে যায়।
সাধন সিংএর কণ্ঠ তখনও ভেসে আসছে……বৃদ্ধা যুবক শিশু কাউকে ওরা রেহাই দিচ্ছে। না। বাংলাদেশে রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে। ওরা শুধু হত্যালীলা চালিয়েই ক্ষান্ত হচ্ছে না, শয়তান নর পশুর দল বাংলার মা বোনদের ইজ্জৎ লুটে নিচ্ছে, বাংলার……
বনহুরের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠে, ঐ জোড়া কুঞ্চিত হয় তার, অধর দংশন করে বলে……থাক আর শুনতে চাই না। আমি সবকিছু আঁচ করে নিয়েছি। যেদিন রেডিওতে শুনতে পেয়েছিলাম জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠে শেখ মুজিবর রহমান জয়যুক্ত হয়েছেন। আমি জানতাম পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী এতো সহজে তাকে স্বীকৃতি দেবে না। এবং সেই কারণেই তারা বাংগালীদের উপর হায়নার মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে……একটু থেমে বলে……সাধন সিং তুমি চলে এসো আমার সঙ্গে তোমাদের যেতে হবে।
…….আচ্ছা সর্দার আমি ঠিক সময় পৌঁছে যাবো……।
বনহুর জম্বু আস্তানায় সুইচ্ অফ করে দিয়ে আঁম আস্তানার সুইচ অন করে দিতেই একটি নীলাভ বল জ্বলে উঠলো, ওপাশ থেকে শোনা গেলো আঁম আস্তানার প্রধান অনুচর আলী হায়দারের গলা……আমি আলী হায়দার……
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠে……তুমি যত শীঘ্র কান্দাই আস্তানায় চলে এসো……
…..আচ্ছা সর্দার….
এরপর বনহুর তার সিন্ধি আস্তানায়, মন্থনাদ্বীপে, রায়হান বন্দর, যনরহা সবগুলো আস্তানায় সে নিজে জানিয়ে দিলো। প্রত্যেকটা আস্তানার প্রধান অনুচরকে ডেকে পাঠালো বনহুর।
বনহুরের আদেশ পাওয়া মাত্র ছুটে এলো বিছিন্ন আস্তানা থেকে তার বিশ্বস্ত অনুচরগণ। এক সপ্তাহের মধ্যেই পৌঁছে গেলো সবাই।
বনহুর তার দরবার কক্ষে অনুচরদের নিয়ে একটা আলোচনা সভা করলো।
সুউচ্চ আসনের পাশে বনহুর দন্ডায়মান। চোখে মুখে তার উত্তেজনার ছাপ। সম্মুখে বেশ কয়েকটা আসনে উপবিষ্ট বনহুরের প্রধান প্রধান অনুচর বৃন্দ। আজকার দরবারে বনহুরের সাধারণ অনুচরগণ একজনও নেই।
দরবার কক্ষের দেয়ালে কয়েকটা মশাল দপ দপ করে জ্বলছে।
মশালের আলোতে বনহুরের চোখ দুটো জ্বলছে যেন। মুখ মণ্ডল কঠিন, শরীরের মাংস পেশীগুলো শক্ত হয়ে উঠেছে তার, দেহের জমকালো পোশাক তাকে আজ অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
বনহুর তার অনুচরদের লক্ষ্য করে বললো–এবার তোমাদের একটি নতুন পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হবে। তোমরা শুনেছে বাংলাদেশ আজ এক ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের নিরীহ জনগণের উপর চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার। শুধু মানুষ হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হচ্ছে না বাংলার নারী জাতির উপর চালিয়ে চলেছে পাশবিক অত্যাচার…কথাগুলো দাতে দাঁত পিষে বললো–বাংলার অগ্নি পুরুষ শেখ মুজিবর রহমানকে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী কৌশলে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন এক গোপন লৌহ কারাগারে বন্দী করে রেখেছে।
রহমান এবং অনুচরগণ নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে সর্দারের মুখের দিকে। বিস্ময় নিয়ে শুনে যাচ্ছে সর্দারের কথাগুলো।
বনহুর বলে চলেছে বাংলার অসহায় মানুষের দরদী বন্ধু শেখ মুজিবরকে বন্দী করে বাংলার মানুষের উপর যে নৃশংস অত্যাচার চলেছে তা কল্পনাতীত। থামলো বনহুর, আনমনে সে তাকালো সম্মুখে তার দৃষ্টি যেন চলে গেছে সেই সুদুর বাংলাদেশের বুকে। যেখানে পাক হানাদারগণ বাংলার মানুষের রক্তে হোলি খেলছে।
বনহুরের অনুচরগণ লক্ষ্য করলো তাদের সর্দারের চোখ দুটো ছল ছল করে উঠেছে। সুদূর বাংলার মানুষের জন্য সর্দারের হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে। একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নেয় বনহুর তারপর বললো–বাংলার নির্যাতীত মানুষের পাশে তোমাদের যেতে হবে। তাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বর্বর পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠীদের বিরুদ্ধে সগ্রাম চালাতে হবে। শুধু কান্দাই এবং কান্দাই এর আশে পাশের জনগণই তোমাদের ভাই বা আপন জন একথা মনে করো না। সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জন্য তোমরা রয়েছে। কান্দাই, ঝাম, রায়হান, মন্থনা, যনরহার মানুষ যেমন তেমনি বাংলাদেশের মানুষ। তোমরা শুনে রাখো বাংলার মানুষের স্বাধীনতার জন্য তোমাদের সংগ্রাম চালাতে হবে এবং তার জন্য তোমাদের অনেকেই জীবন উৎসর্গ করতে হবে। জানি তোমরা এ ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে।
সবাই এক সঙ্গে বলে উঠলোসর্দার কর্তব্যের ডাকে আমরা অগ্নিকুণ্ডেও ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। সেই শিক্ষাই পেয়েছি আমরা আপনার কাছে..
সাবাস। তোমাদের কথা শুনে আমি খুশি হলাম। এবার তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও আগামী কালকেই আমরা রওনা দেবো।
আবার একসঙ্গে সবাই বলে উঠলো—সর্দার আমরা প্রস্তুত আছি।
বনহুর এবার রহমানকে লক্ষ্য করে বললো-রহমান, প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্র সঙ্গে নেওয়া সম্ভবপর নয়। কাজেই তুমি এমন কিছু হাল্কা অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সঙ্গে নেবে যা মারাত্বক কিন্তু আকারে ক্ষুদ্র। লোকচক্ষু এড়িয়ে এসব অস্ত্র যাতে নেওয়া যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। ক্ষুদে ওয়্যারলেস, বাইনোকুলার তোমরা প্রত্যেকে একটি করে সঙ্গে রাখবে। কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে কাজ করতে হবে তোমাদের। হাঁ, সেখানে না পৌঁছানো পর্যন্ত আমি তোমাদের কোনো নির্দেশ দিতে পারছি না। সেখানে পৌঁছে আমরা বুঝতে পারবো কিভাবে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
সেদিনের মত দরবার শেষ হলো বনহুরের।
বনহুর বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করলো। হিমসাগর থেকে ফিরে আসার পর মাত্র একটি দিন বনহুর নিশ্চিন্ত ছিলো, তারপরই তাকে উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছিলো বাংলাদেশের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী। এই কদিন বনহুর একটি মুহূর্ত স্থির হয়ে বিশ্রাম করেনি, সদা-সর্বদা অনুচরদের নিয়ে পরামর্শ চালিয়েছে কিভাবে তাদের কাজ শুরু করবে। শুধু কাজ করলেই চলবে না, বাংলার অসহায় নিরীহ জনগণকে কিভাবে পাক হানাদারের কবল থেকে উদ্ধার করা যাবে, এটাই হলো তার বড় চিন্তা।
আজ বনহুরের সমস্ত আস্তানা থেকে প্রধান প্রধান অনুচরগণ সবাই কান্দাই আস্তানায় এসে পৌঁছে গেছে। বনহুর এবার বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার আয়োজন করে চলেছে।
কর্মক্লান্ত শরীরে বনহুর বিশ্রামকক্ষে প্রবেশ করে দেখলো নূরী গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুর এ কদিন নূরীকে লক্ষ্য করার অবসর পায়নি। আজ সে ওর দিকে ভাল করে তাকালো, নূরীর গম্ভীর মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো, শান্ত কণ্ঠে বললো–আমার বোতামগুলো খুলে দাও নূরী, বড় ক্লান্ত বোধ করছি।
নূরীর হাসি পায় বনহুরের কথা শুনে, যে এক মুহূর্ত বিশ্রাম কাকে বলে জানে না, জানে না ক্লান্তি কাকে বলে, আজ সেই বনহুর কিনা বড় ক্লান্ত বোধ করছে। তাও সে নিজের মুখে স্বীকার করে নিচ্ছে। নূরী হাত দুখানা বাড়িয়ে বনহুরের জামার বোতাম খুলতে শুরু করে।
বনহুর ওর চিবুকটা তুলে ধরে বলে–এত শীঘ্র আবার দূরে চলে যেতে হবে ভাবতে পারিনি নূরী। জানি তুমি আমার উপর অভিমান করেছে কিন্তু……
নূরী গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো—চুপ করো, আমি শুনতে চাই না কোনো কথা। বাংলাদেশের মানুষের জন্য তোমার মনে আজ দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে, আর……
হেসে বলে বনহুর–আর তোমার জন্য আমার মনে একটুও দুঃখ হয় না বা ব্যথা জাগে না তাই না?
নূরী নীরবে ওর জামার বোতাম খোলা শেষ করে খাটের পাশে গিয়ে বসে।
বনহুর জামাটা খুলে বিছানার একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নূরীর কোলে মাথা রেখে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে। তখনও বনহুরের ঠোঁটে হাসির রেখা লেগে রয়েছে, বলে বনহুর নূরী, অভিমান করো না-হাসো…হাসো বলছি……।
নূরী কোনোদিন পারেনি বনহুরের উপর রাগ অভিমান করতে, আজও সে পারলো না, হেসে ফেললো ফিক্ করে। বনহুর ওকে নিবিড় করে টেনে নিলো।
বনহুরের বুকে মুখ লুকালো নূরী। অনাবিল আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরে উঠলো তার হৃদয়।
বনহুর ওর মুখখানা তুলে ধরলো নিজের মুখের কাছে, আশ্চর্য হয়ে দেখলো নূরীর চোখে অশ্রু। বনহুর গম্ভীর ব্যথাভরা কণ্ঠে বললো–তোমার চোখে পানি দেখবো এটা আমি পছন্দ করি না নূরী। আমি চাই তোমার হাসিভরা মুখ দেখতে, কিন্তু……
নূরী বনহুরের মুখে হাতচাপা দেয়–চুপ করো। কোনো কিন্তু শুনতে চাই না। বাংলাদেশে আমি তোমায় যেতে দেবো না বনহুর!
বনহুর দ্রুত উঠে বসে বলে–কেন?
আমি শুনেছি পাক সেনাদের প্রচুর অস্ত্র আছে। ভারী ভারী কামান, গোলা বারুদ…..না, না। তোমাকে আমি যেতে দেবো না বনহুর….নূরী বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে, সারা মুখে তার ছড়িয়ে পড়ে একটা ভয়ার্ত ভাব।
বনহুর হেসে বলে–শুধু কামান, গোলা-বারুদ নয় নূরী, ট্যাঙ্ক-মটার-মেশিন গান, রাইফেল আরও অনেক অস্ত্র আছে তাদের..
তবু, তবু যাবে তুমি সেখানে? আছে তোমার কামান, ট্যাঙ্ক-মর্টার মেশিন গান।
বনহুর হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে, তারপর হাসি থামিয়ে বলে-ওসব আমার না থাকতে পারে নূরী কিন্তু যে অস্ত্র আমার আছে সে হলো আমার মনোবল। বাংলার মানুষের এ সগ্রাম ন্যায়ের, আমি যাচ্ছি ন্যায় আর সত্যকে সাহায্য করতে। কাজেই তুমি আমায় বাধা দিও না নূরী।
বনহুর নূরীকে গভীর আবেগে কাছে টেনে নিলো।
নূরী বনহুরের বাহু বন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে বললো–হুঁর, জানি তুমি আমার বারণ শুনবে না, তবে যাবার আগে মনিরা আপার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারবে না। কথা দাও যাবে তুমি তার কাছে?
বনহুর নুরীর চিবুকে মৃদু টোকা দিয়ে বলে-যাবো, নিশ্চয়ই যাবো, কিন্তু……
না কোনো কিন্তু নয়, আজ এই মুহূর্তে তোমাকে যেতে হবে সেখানে। হুর, আমার ভয় হয় মনিরা আপার অভিশাপ আমাকে যদি নিঃস্ব করে দেয়–যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি……
এ সব কি বলছো নূরী?
সত্যি মনিরা আপার কাছ থেকে তোমাকে আমি ছিনিয়ে নেইনি। তুমি যে আমারই তবু কেন এমন ভয় হয় জানি না হুর, কেন আমার মনে এমন দুর্বলতা। সব সময় মনে হয় আমি বুঝি তোমাকে মনিরা আপার কাছ থেকে চুরি করেছি, কেড়ে নিয়েছি তোমাকে……
বড় ছেলেমানুষ তুমি নূরী। অযথা যা তা ভাবে।
কথা দাও যাবে তুমি?
নূরী, তুমি না বললেও আমি যেতাম সেখানে, কারণ তোমরা দু’জনই আমার কাছে সমান। দু’জনই আমার স্বপ্নের রাণী……কথাটা বলে হাসে বনহুর।
গভীর রাতে নিজের হাতে বনহুকে সাজিয়ে দিয়ে নূরী। এগিয়ে দিলে সে আস্তানার বাইরে পর্যন্ত।
বনহুরের অশ্বপদ শব্দ গহন বনে মিশে যেতেই নূরী ফিরে এলো নিজের কক্ষে। জাভেদ তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছিলো। নূরী ঘুমন্ত জাভেদকে কোলে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো।
নূর পড়াশোনা করছিলো। সম্মুখে তার বার্ষিক পরীক্ষা। তাই রাত জেগে পড়ছিলো সে। পাশের বিছানায় দাদীমা অঘোরে ঘুমাচ্ছেন, মৃদু নাসিকাধ্বনি হচ্ছে তার। দেয়াল ঘড়িটা টিক্ টিক্ করে বেজে চলেছে।
নূর বারবার হাই তুলছে, হঠাৎ মায়ের ঘরে শব্দ হলো।
সজাগ হয়ে কান পাতলো নূর, কেই যেন মায়ের ঘরে পিছন জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেতে লাফিয়ে পড়লো বলে মনে হলো তার।
নূর যখন শব্দটা শুনতে পেলো তখন মনিরার কক্ষে প্রবেশ করছে বনহুর। মনিরাও জেগে উঠেছে সঙ্গে সঙ্গে, দ্রুত বিছানায় উঠে বসতেই স্বামীকে দেখে নিদ্রাজড়িত চোখ দুটো তার উজ্জ্বল দীপ্ত হয়ে উঠে।
বনহুর মনিরার পাশে এসে বসে।
অনেক দিন পর স্বামীকে পাশে পেয়ে মনিরা ভাষা হারিয়ে ফেলে যেন, স্বামীর বুকে মুখ গুঁজে বলে—নিষ্ঠুর এলে কেন? আমি তোমার কে?
মনিরা, রাগ করো না লক্ষীটি আমার। সত্যি আমি বড় নিষ্ঠুর……বনহুর মনিরাকে টেনে নিলো গভীরভাবে।
এমন সময় দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকে নূর–আম্মি, আম্মি দরজা খোল, তোমার ঘরে কিসের শব্দ হলো…আম্মি…আম্মি…
নূরের কণ্ঠস্বরে মনিরা এবং বনহুর সজাগ হয়ে উঠে।
মনিরা চাপাকণ্ঠে বলে–এমনি করে চোরের মত আর কতদিন তুমি……ছাড়ো। নূর ডাকছে, ছাড়ো বলছি। মনিরা স্বামীর বলিষ্ঠ বাহু দুটি থেকে নিজকে মুক্ত করে নিয়ে বলে—চলে যাও, চলে যাও নূর সন্দেহ করবে। যাও দরজা খুলে দেবো।
ওদিকে তখন নূরের ব্যস্তকণ্ঠ–আম্মি-আম্মি দরজা খোলো, দরজা খোল…..
বনহুর পিছন জানালার দিকে এগিয়ে যায়, মনিরা এগিয়ে যায় দরজার দিকে। বনহুর জানালা দিয়ে পার হতে না হতেই মনিরা দরজা খুলে ফেলে।
সঙ্গে সঙ্গে দূর কক্ষে প্রবেশ করে, হঠাৎ তার দৃষ্টি চলে যায় পিছনের খোলা জানালাটার দিকে। জানালার দরজাটা তখনও দুলছে।
নূর ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠে—-আম্মি, আম্মি তোমার ঘরে কিসের শব্দ হলো? কেউ যেন প্রবেশ করেছিলো বলে মনে হচ্ছে……
মনিরা নিশ্চুপ, তার মুখে কোনো কথা নেই।
নূর আবার বলে উঠে–আম্মি, কথা বলছো না কেন? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? কথা বলো আম্মি…..হঠাৎ নূরের দৃষ্টি চলে যায় খাটের পাশে মেঝেতে। এগিয়ে যায় নুর উবু হয়ে একটা রুমাল হাতে তুলে নেয়। জমকালো সিল্কের একটি রুমাল।
মনিরার মুখমণ্ডল মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। কখন বনহুরের কালো রুমালখানা পড়ে গেছে জানে না তারা কেউ। লজ্জায় বিবর্ণ হয়ে উঠে মনিরা।
নূর রুমালখানা মেলে ধরে তাকায় মায়ের মুখের দিকে তারপর বলে–আম্মি এ রুমাল কার?
মনিরা কি জবাব দেবে ভেবে পায় না, মাথা নিচু করে নেয়। নূর ছোট্ট হলে এটা সেটা বলে ভুলাতে পারতো কিন্তু নূর এখন সব বুঝতে শিখেছে। যা তা বলে ওকে এখন ভুলানো সম্ভব নয়।
নূর মাকে এমনভাবে মাথা নিচু করতে দেখে বলে উঠে–আম্মি, এ রুমাল কার তুমি জানো নিশ্চয়ই। বলল আম্মি কে এসেছিলো?
জানি না।
না, তুমি জানো। বলো কে এসেছিলো তোমার ঘরে? যার এ রুমাল সে ঐ জানালা দিয়ে প্রবেশ করেছিলো আবার ঐদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
এবার মনিরা রাগতভাবে বলে উঠেনূর, তুই চলে যা। ঘুমোবি যা, আমাকে বিরক্ত করিস না
আম্মি!
যা, আমি জানি না কোনো কথা। তুই যা…….
নূর ধীরে বেরিয়ে যায়, মনে তার নানা প্রশ্ন উদয় হতে থাকে মায়ের ঘরে সে একটা শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলো। নিশ্চয়ই কেউ প্রবেশ করেছিলো মায়ের ঘরে কিন্তু কে সে? তার আম্মির মুখোভাব দেখে মনে হলো তিনি জানেন কে এসেছিলো এবং রুমালখানাও তারই। নূরের ছোট্ট মনে সন্দেহের ছোঁয়া লাগে।
নূর বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে, কিছুতেই ঘুম আসে না তার চোখে। কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে নূর নিজের মনে।
হঠাৎ নূর শুনতে পায় মায়ের ঘরে চাপা পুরুষ কণ্ঠস্বর। নূর মুহূর্তে শয্যা ত্যাগ করে উঠে আসে, মায়ের দরজায় কান পাততেই শুনতে পায় মায়ের গলার আওয়াজ-ছিঃ ছিঃ ছিঃ নূর কি ভাবলো বলো তো? রুমালখানা ফেলে গিয়েছিলে কেন? পরক্ষণেই পুরুষ কণ্ঠ…..আমি নূরকে বলে দেবো……
চমকে উঠে নূর-এ যে তার পিতার কণ্ঠস্বর! আরও ভাল করে কান পাতে সে, শুনতে পায় তার আব্বু বলছে……তুমি কিছু ভেবো না মনিরা, নূর তোমাকে কোনদিন ভুল বুঝবে না কারণ সে আমার ছেলে……আমার রুমালখানা ওর কাছেই থাক……
নূরের চোখ দুটো খুশিতে ভরে উঠলো–এ রুমালখানা তার আব্বুর! ফিরে আসে নূর নিজের কক্ষে, রুমালখানা হাতে তুলে নিয়ে বার বার চুমু দেয় সে রুমালে।
পরদিন মনিরা সঙ্কোচিতভাবে পুত্রের কক্ষে প্রবেশ করে দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে। না জানি নূর কি মনে করেছে। হয়তো বা সে গম্ভীর হয়ে থাকবে, কথাই বলবে না তার সঙ্গে। লজ্জায় মনিরা জড়সড় হয়ে আসছে যেন। মাথা নিচু করে কক্ষে প্রবেশ করতেই নূর হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসে, মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে-জানি, কাল রাতে আব্বু এসেছেন চুপি চুপি……এ রুমালখানা আব্দুর তাও জানি……
মনিরার মুখমণ্ডল দীপ্ত হয়ে উঠলো, সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিমিষে মুছে গেলো তার মন থেকে। আল্লাহ তাকে অগ্নিপরীক্ষা থেকে রক্ষা করেছে। ছেলের কাছে আজ সে স্বচ্ছভাবে এগুতে সাহস পাচ্ছিলো না। একটা অহেতুক দ্বিধা তাকে সঙ্কোচিত করে তুলেছিলো। যা হোক, নূর তাহলে তার আব্দুর কথা জানতে পেরেছে।
মনিরার চিন্তাস্রোতে বাধা দিয়ে বলে উঠে নূর–আম্মি, আব্বু বুঝি ঘুমাচ্ছেন, আমি গিয়ে, ডেকে তুলবো……
মনিরাকে কথাটা বলে ছুটে চলে গেলো নূর মায়ের ঘরের দিকে।
মনিরা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু ততক্ষণে নূর চলে গেছে। মনিরার মুখমণ্ডল ব্যথাকরুণ হয়ে উঠলো।
একটু পরে বিষণ্ণ মুখে নূর ফিরে এলো, প্রশ্ন করে বসলো–আম্মি, আব্বু কোথায়?
ছোট্ট করে জবাব দিলো মনিরা–চলে গেছে।
আব্বু চলে গেছে! নূরের কণ্ঠ যেন কান্নায় ভরে উঠে। একটু থেমে অভিমানভরা কণ্ঠে বলে– আব্বু –চলে গেলো। বলো, কেন চলে গেলো? তুমি বকেছিলে বুঝি?
মনিরা কোনো জবাব দেয় না বা দিতে পারে না।
মাকে নিশুপ থাকতে দেখে নূরের অভিমান বেড়ে যায়। সে চলে যায় সেখান থেকে।
মনিরার মনে দারুণ একটা ব্যথা মোচড় দিয়ে উঠে, পুত্রের কাছে আজ তাকে কত মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে, কতরকম ছলনা করতে হচ্ছে! না জানি কতদিন তাকে এমনি করে ছেলের সঙ্গে মিথ্যা অভিনয় করতে হবে।
বর্বর পাক-সেনারা এদিকে এগিয়ে আসছে। তাদের সঙ্গে আছে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র! কথাগুলো হাঁপাতে হাঁপাতে বললো একজন মুক্তিযোদ্ধা।
বনহুর সবেমাত্র ভাবুর মধ্যে একটা মাদুরে বসে পড়ে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিয়েছে। এইমাত্র সে সীমান্ত এলাকায় কিছুসংখ্যক পাক-সেনাকে খতম করে এসেছে। সমস্ত রাত ধরে তাকে দলবল নিয়ে যুদ্ধ চালাতে হয়েছিলো। বিরাট একটি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেছিলো মাত্র বিশজন মুক্তিযোদ্ধা। বেশ কিছুসংখ্যক পাক সেনাকে খতম করতে সক্ষম হয়েছিলো তারা, অবশ্য তাদের তিনজন মুক্তিসেনাও শহীদ হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাটির কথায় বনহুর চায়ের কাপ নামিয়ে রাখে মাটিতে, উঠে দাঁড়িয়ে বলে-পাক সেনারা এদিকে এগিয়ে আসছে?
মুক্তিযোদ্ধা যুবকটি বলে হাঁ, প্রত্যেক হানাদারের হাতে আছে রাইফেল, মেশিনগান, মটার……সংখ্যায় প্রায় দুশত হবে।
ঐ মুহূর্তে আর একজন মুক্তিযোদ্ধা তাবুতে প্রবেশ করে ব্যস্তকণ্ঠে বলে উঠে–ওরা আমাদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে আসছে। আর কয়েক মিনিটেই পৌঁছে যাবে।
বনহুর মুহূর্তে মেশিনগানের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, দলবলকে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বলে।
সঙ্গে সঙ্গে দলবল যার যা অস্ত্র হাতে তুলে নিলো।
বনহুর সবাইকে তাবুর আশেপাশে আত্মগোপন করে লড়াইর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে বলে।
বনহুরের আদেশ পালনে বিলম্ব হয় না, মুক্তিযোদ্ধাগণ যার যার অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে তাঁবুর আশেপাশে প্রস্তুত হয়ে থাকে।
বনহুর তাঁবুর সম্মুখে মেশিনগানের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে তাকায় বাইরের দিকে। বনহুর দেখতে পায়, একদল পাক-সেনা উদ্যত রাইফেল আর মেশিনগান হাতে তাদের ভাবুর দিকে এগিয়ে আসছে।
বনহুরের তাবুটি ছিলো ঠিক এমন এক জায়গায় যেখানে পাকসেনাদের পৌঁছতে হলে বেশ কিছু উঁচুনিচু স্থান অতিক্রম করে এগুতে হবে।
বনহুর পাক-হানাদারদের স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। প্রতীক্ষা করছে আয়ত্তের মধ্যে এলেই গুলি ছুঁড়বে।
পাক-সেনাদের লক্ষ্য তাঁবু। তাই ওরা তাবুর দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। বনহুর সেই কারণেই দলবলকে সরিয়ে দিয়েছে তাঁবুর বাইরে। আশেপাশে উঁচু নিচু টিলার পাশে আত্মগোপন করে পজিশন নেবার নির্দেশ দিয়েছে বনহুর। নিজে সে তাঁবুর সম্মুখে থেকে ওদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে।
গর্জে উঠলো বনহুরের মেশিনগান।
সঙ্গে সঙ্গে পাক-বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো, কয়েকজন লুটিয়ে পড়লো ভূতলে। পাক-হানাদারগণ এবার তাদের আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করে চললো তাঁবু লক্ষ্য করে।
তুমুল লড়াই শুরু হলো।
বনহুরের মেশিনগান মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে। অন্যান্য মুক্তি যোদ্ধাও রাইফেল থেকে অবিরাম গুলি নিক্ষেপ করে চলেছে। বনহুরের সঙ্গী সাথীরা ছিলো গেরিলা বাহিনী। বনহুরের নির্দেশে তারা আত্মগোপন করে পাক-বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ওরা গুলি চালাতে লাগলো তাবু লক্ষ্য করে কিন্তু তাঁবুর মধ্যে একমাত্র বনহুর ছাড়া আর কেউ ছিলো না। বনহুরের উদ্দেশ্য তাঁবুর দিক থেকে গোলাগুলি এলে ওরা তাবু লক্ষ্য করেই অস্ত্র চালাবে এবং সেই সময় তার গেরিলা মুক্তিযোদ্ধগণ ওদের উপর আক্রমণ চালাতে সক্ষম হবে।
বনহুর তাঁবুর মধ্যে পজিশন নিয়ে মেশিনগান থেকে গুলি ছুঁড়ে পাক বাহিনীকে অতিষ্ঠ করে তুলছিলো।
ঠিক সেই সময় গেরিলা আক্রমণ।
মুক্তিযোদ্ধাগণ চারদিক থেকে ঘিরে ফেললো। কোনদিক থেকে গুলি আসছে ওরা ঠাওর করার আগেই খতম হলো বেশ কিছুসংখ্যক পাক সেনা। আর কয়েকজন পিছু হটে পালিয়ে গেলো।
চরম পরাজয় হলো পাকবাহিনী দলটির।
বনহুরের দলের একজনের বুকে গুলি বিদ্ধ হওয়ায় সে মৃত্যুবরণ করে।
বনহুর নিহত মুক্তিযোদ্ধাটিকে হাতের উপর তুলে নিয়ে ফিরে আসে তাঁবুর মধ্যে।
ততক্ষণে অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সবাই এসে বনহুরকে ঘিরে দাঁড়ায়। তাদের একজন বন্ধুকে শহীদ অবস্থায় দেখে বিস্মিত হয়।
বনহুর সবাইকে লক্ষ্য করে বলে আমার মুক্তিপাগল বীর যোদ্ধা ভাইগণ, তোমরা আজ যে অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়েছো তা কল্পনাতীত তোমাদের একজন আজ শহীদ হয়েছে কিন্তু তোমরা হত্যা করেছে প্রায় পঞ্চাশজনের বেশি হানাদারকে। তোমাদের আমি মোবারকবাদ জানাচ্ছি। অন্যান্য ঘাঁটি থেকেও এ রকম সংবাদ আসছে। ইনশাআল্লা জয় আমাদের সুনিশ্চয়। সবখানে পাক বর্বর বাহিনী চরমভাবে মার খাচ্ছে। তোমাদের এ সংগ্রাম ন্যায়ের, সত্যের সংগ্রাম।
বনহুর থামলো, কারণ ওয়্যারলেস থেকে তখন ভেসে আসছে আলী হায়দারের কণ্ঠ……শিমলার দিকে পাক হানাদারদের একটি বিরাট বাহিনী এগিয়ে যাচ্ছে……আমরা পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধা এই বাহিনীটিকে বাধা দেবার জন্য শিমলা ঘাঁটি অভিমুখে রওনা দিচ্ছি …..
বনহুর ওয়্যারলেসে মুখ রেখে দ্রুত কণ্ঠে বললো-হায়দার, তুমি মুহূর্ত বিলম্ব করো না, এই দণ্ডে রওনা দাও এবং আমি জানতে চাই তোমার দল এই বর্বর শয়তানদের গতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে…..
ভেসে আসে হায়দারের কণ্ঠ……চেষ্টার ত্রুটি হবে না…
ঠিক ঐ মুহূর্তে এক মুক্তিযোদ্ধা যুবক তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করে, দেহের কয়েক স্থানে ক্ষত চিহ্ন, রক্তে ভিজে উঠেছে তার দেহের জামাকাপড়।
বনহুর ওয়্যারলেস রেখে ছেলেটিকে ধরে ফেলে, আর একটু হলে সে পড়ে যাচ্ছিলো।
ছেলেটি বলে–পানি!
তাড়াতাড়ি বনহুর একজনকে বললো–মাসুদ, পানি দাও।
যুবকটির মাথা কোলে নিয়ে বনহুর মাটির মধ্যে বসে পড়লো।
যুবকটি তখন তাঁবুর মেঝেতে শুয়ে পড়েছে।
মাসুদ ফিরে আসে-হাসান ভাই, পানির পাত্র গোলাগুলীর আঘাতে বিনষ্ট হয়ে গেছে…..
বনহুরকে সবাই ক্যাপ্টেন হাসান বলে ডাকতো। বনহুর বলেছিলো, তোমরা আমাকে হাসান ভাই বলে ডেকো। শুধু তার দলবলই নয়, বাংলার অনেক মুক্তিযোদ্ধাই তাদের ক্যাপ্টেন হাসানকে ভালবাসতো, শ্রদ্ধা করতো। তারা জানে না, তাদের হাসান ভাই কে এবং সে কোথাকার মানুষ কি তার আসল পরিচয়। বাংলার লাখ লাখ মানুষকে যখন বর্বর পাক সেনারা নৃশংসভাবে হত্যা করে চলেছে, নারীদের উপর যখন চালিয়েছে পাশবিক অত্যাচার, শিশু, বৃদ্ধ কাউকেই তারা রেহাই দিচ্ছে না, যুবকদের নিধন করতে বদ্ধপরিকর, বাংলার মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য–মুক্তির জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে, তার জীবন উৎসর্গ করে পাক বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন সংগ্রাম চালিয়ে চলেছে, বনহুর তখন কয়েকজন সঙ্গীসহ ছুটে আসে বাংলাদেশে। বাংলার মানুষের করুণ মর্মস্পর্শী অবস্থা তাকে বিচলিত করে তোলে। সে গোপনে যোগ দেয় মুক্তি বাহিনীর দলে। তার সঙ্গী কয়েকজনকে বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দেয়। কেউ বা রাজাকার ও বদর বাহিনীতে যোগ দিয়ে পাক বাহিনীদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে বনহুরকে জানাতে থাকে।
বাংলার সংগ্রামী মানুষদের মধ্যে বনহুর ক্যাপ্টেন হাসান নামে পরিচিত হয়ে উঠে।
মাসুদের কথা শুনে বনহুরের মুখখানা বিষণ্ণ করুণ হয়ে উঠলো, দাঁত নিয়ে অধর দংশন। করলো।
আহত যুবকটি অতি কষ্টে বললো-হাসান ভাই, পাক সেনারা হরিপুর গ্রামে গিয়ে সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে……আমার বাবা-মাকে হত্যা করেছে……আমার বোনকে ওরা ধরে নিয়ে…… আঃ…… আঃ…… পানি…পা…কথা শেষ করতে পারে না সে, মৃত্যু হয় তার।
আহত যুবকটির মাথাটা একপাশে কাৎ হয়ে যায়।
বনহুর বাম হাতের বাজুতে নিজের চোখ ঢেকে ফেলে। দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার গণ্ড বেয়ে। একটু পরে সংযত করে নিয়ে বলে–এই মুহূর্তে আমরা হরিপুর রওনা দেবো। নীরুর বাবা-মা হত্যার প্রতিশোধ নিতে হবে আর নীরুর বোনকে পাক হানাদারদের কবল থেকে উদ্ধার করে আনতে হবে। নীরুর রক্ত বৃথা যাবে না, বৃথা যেতে দেবো না আমরা। একে যারা হত্যা করলো তাদের আমরা শায়েস্তা করবোই।
বনহুর অতি যত্নে নীরুর মাথাটা নামিয়ে রাখলো তারপর উঠে দাঁড়ালো; কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে নীরুর মৃতদেহের সকারে রেখে অন্যদের নিয়ে রওনা দিলো।
সেদিন আর কারও মুখে খাবার উঠলো না।
হরিপুর পৌঁছতে রাত হয়ে এলো। অন্ধকারে আত্নগোপন করে বনহুরের দল গ্রামের মধ্যে প্রবেশ করলো। যে দৃশ্য তাদের নজরে পড়লে তা অতি মর্মস্পর্শীসমস্ত গ্রামখানা ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। চারদিকে লেলিহান অগ্নিশিখা তখনও দপদপ করে জ্বলছে। কোথাও বা স্তূপাকার হয়ে আছে নারী-পুরুষের মৃতদেহ। যারা জীবনে বেঁচেছে তারা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। চারিদিকে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। মহাপ্রলয়ের পর যেন শ্মশানভূমি।
বনহুর কিছুক্ষণ বাকহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, এ দৃশ্য তার মনে দারুণ আঘাত করলো। বহু নরহত্যা সে দেখেছে, বহু নর হত্যা সে নিজে করেছে কিন্তু এমন নিরীহ, নিষ্পাপ মানুষ হত্যা সে কোনোদিন দেখেনি। পাকিস্তানী বর্বর হানাদারগণ এমনভাবে অসহায় মানুষদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে, এ যেন কল্পনা করা যায় না।
বেশিক্ষণ ভাবার সময় নেই বনহুরের, তার দলবলকে লক্ষ্য করে বলে উঠে—বন্ধুগণ, তোমরা এই মুহূর্তে হরিপুর গ্রামের অদূরে পলাশবাড়ী রওনা দেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নাও। পাক বাহিনীগণ পলাশ বাড়িতে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। আমার মনে হয় নীরুর বোনকে তারা সেখানেই নিয়ে গেছে।
বনহুরের কথায় বাংলার দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধাগণের ধমনির রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠে, মুষ্ঠি বদ্ধ করে একসঙ্গে বলে উঠে সবাই—আমরা প্রস্তুত, পাকবর্বর হানাদারদের আমরা খতম করবোই।
সাবাস! জয় তোমাদের হবেই। বাংলার মুক্তিপাগল দামাল ছেলে তোমরা, তোমাদের গতি কেউ রুখতে পারবে না। চলো এবার…..বলিষ্ঠ হতে রাইফেলটা চেপে ধরে সর্ব প্রথম পা বাড়ালো বনহুর।
অন্যান্য ছেলে তাকে অনুসরণ করলো।
রাতের অন্ধকারে মার্চ করে এগিয়ে চলেছে সবাই। মাথার উপর তারাখচিত আকাশটাকে জরির বুটিদার জমকালো শামিয়ানা বলে মনে হচ্ছিলো। চারিদিকে একটা থমথমে ভাব। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে।
পা চালিয়ে চলেছে বনহুরের দল।
উঁচুনিচু আইল পথ, মাঝে কোনো কোনো সময় হোঁচট খাচ্ছিলো ওরা। স্থানে স্থানে জলাশয়, বর্ষার পানি জমে আছে হাঁটু অবধি, কোথাও বা কিছু কম। দুদিন বৃষ্টি না থাকায় বর্ষার পানি অনেক কমে গেছে কিন্তু পথঘাট কাদায় কাদাময়।
বনহুর পথ চলতে চলতে বললো—তোমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন বলে উঠলো—সব কষ্ট সহ্য করার জন্য আমরা প্রস্তুত হয়ে নিয়েছি, কাজেই এ কষ্ট আমাদের কিছু নয়।
বনহুর খুশিভরা কণ্ঠে বললো–সত্যি তোমরা বাংলাদেশের বীর সেনা। কোনো শক্তিই তোমাদের ধ্বংস করতে পারবে না কোনোদিন।
তারপর আবার নীরবতা।
পথ চলছে ওরা।
একসময় তারা পৌঁছে গেলো পলাশবাড়ীর সীমানায় দূর থেকে অতি সতর্কভাবে লক্ষ্য করতে লাগলো বনহুর পাক সেনাদের লোক পাহারা দিচ্ছে কিনা। অদূরে পাক সেনাদের ঘাটি।
বনহুর অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাকে পাটক্ষেতের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতে বলে নিজে অগ্রসর হলো। যাবার সময় বলে গেলো, তোমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পজিশন মত প্রস্তুত হয়ে থেকো আমি শিস্ দেবার সঙ্গে সঙ্গে তোমরা অগ্রসর হবে।
বনহুর চলে গেলো।
তার দলবল মুহূর্ত বিলম্ব না করে ছড়িয়ে পড়লো আশে পাশের পাটক্ষেতের মধ্যে। কান পেতে রইলো সবাই, কোন সময় তারা ক্যাপ্টেন হাসানের শিসের শব্দ শুনতে পাবে।
অন্ধকারে বনহুর এগিয়ে চলেছে। অতি সর্তকতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখছে চারদিকে। সম্মুখে কয়েক শ’ গজ দূরে পাক হানাদারদের ঘাটি। তাঁবু গেড়েছে ওরা। তাঁবুর মধ্য থেকে আলোকরশি দেখা যাচ্ছে।
বনহুর লক্ষ্য করলো, দূরে দু’জন সৈন্য রাইফেল কাঁধে সজাগ পাহারা দিচ্ছে। এবার বনহুরের কানে এলো তাঁবুর মধ্য থেকে পাক সেনাদের উল্লাসভরা কণ্ঠস্বর। হাসছে ওরা যেন পৈশাচিক হাসি। তার সঙ্গে ভেসে এলো একটা নারী কণ্ঠের করুণ চিৎকার।
বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা আপনা আপনি মুষ্টিবদ্ধ হলো। সে বুঝতে পারলো, এ করুণ আর্তনাদ নীরুর বোনের ছাড়া কারও নয়। শয়তান নর পিশাচের দল ঐ বালিকার উপর নিশ্চয়ই পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে চলেছে অন্ধকারে অধরদংশন করে বনহুর, দ্রুত সে সরে আসে একটা টিলার পাশে, তারপর খুব জোরে শিস দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে তার দলবল পাট ক্ষেতের মধ্যে থেকে বেরিয়ে ছুটে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে পাক বাহিনীদের রাইফেল গর্জে উঠে। পাহারারত সৈনিক দুজনের কানে হয়তো পৌঁছে গিয়েছিলো বনহুরের শিসের আওয়াজ তাই তারা সজাগ হয়ে উঠেছিলো।
সাঁ সাঁ করে কয়েকটা গুলি চলে গেলো বনহুর ও তার দলবলের মাথার উপর দিয়ে।
বনহুর ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলোমাটিতে শুয়ে পড়ো মাটিতে শুয়ে পড়ো……নিজেও উপর। হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লো। এবার ললোহামা গুঁড়ি দিয়ে কিংবা বুকে ভরদিয়ে দ্রুত পাক বাহিনীর ঘাটির দিকে এগিয়ে চলো…….
বনহুর নিজেও এগিয়ে চললো বুকে ভর দিয়ে।
তার সঙ্গী মুক্তি যোদ্ধাগণ বনহুরের নির্দেশ মত কাজ করলো, তারাও বুকে ভর দিয়ে পাটক্ষেত-ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে দ্রুত এগুতে লাগলো। প্রত্যেকের পিঠে বাঁধা রয়েছে রাইফেল। হাতবোম, ডিনামাইট মটার এসবও সঙ্গে আছে তাদের।
অতি সাবধানে এগুচ্ছে ওরা।
আরও কয়েক ঝাক গোলাগুলি চলে গেলো তাদের মাথার উপর দিয়ে।
বনহুর ও তার দলবল খুব সন্তর্পণে এগুতে লাগলো। যেন ওরা আর কোন রকম আন্দাজ না পায়। শিসের শব্দটা ওরা শুনতে পেয়েছিলো এবং সন্দেহ করে গোলাগুলি ছুঁড়ে ছিলো। এবার গোলাগুলি থেমে গেলো বটে কিন্তু ওরা যে সতর্ক হয়ে উঠেছে তাতে কোন ভুল নেই।
বনহুর বললো–তোমাদের খুব-কষ্ট হচ্ছে জানি কিন্তু কোন উপায় নেই। তোমাদের বুকে ভর দিয়ে পাটক্ষেত এবং ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে একেবারে তাবুর নিকটে পৌঁছতে হবে। আমরা আজ ওদের সব কটাকে ঘায়েল করতে চাই।
মুক্তিযোদ্ধাগণ সবাই সবল কণ্ঠে নিজেদের সেজন্য প্রস্তুত বলে জানালো।
ধানের গাছগুলো খুব বড় নয় তাই রা অনায়াসে এগুতে সক্ষম হচ্ছিলো কিন্তু পাটক্ষেতের মধ্যে হামাগুড়ি দেওয়া বা বুকে দিয়ে চলা খুব কঠিন ছিলো। কারো কারো বুক, হাটু কেটে রক্ত ঝরছিলো, কারো বা জামা কাপড় সব ছিঁড়ে যাচ্ছে তবু কোনদিকে লক্ষ্য নেই, তাদের লক্ষ্য; পাক হানাদারদের ঘাটি। আজ সমস্ত দিন তারা কিছু মুখে দেয়নি সামান্য মুড়ি; আর চা সকালে একটু পেটে পড়েছিলো। এ মুহূর্তে কারো খাবার বা ক্ষুধার কথা মনে নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বনহুরের দল পাক বাহিনীর ঘাঁটির প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। তারা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে একটি নারী কন্ঠে গোঙ্গানীর আওয়াজ।
বনহুরের চোখ দুটো আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠে, অস্ফুট কণ্ঠে বলে–নর পিশাচ জল্লাদ……কথাটা উচ্চারণ করে একটু থামলো তারপর বললো–তোমরা থেমে পড়ো। আমি পাহারারত শয়তান দুটোকে শেষ করে নেই……বনহুর মাটিতে শুয়ে শুয়ে অন্ধকারে তাক করে নিলো, পরক্ষণেই গর্জে উঠলো তার রাইফেল।
একটি নয় দুটো গুলির আওয়াজ–সঙ্গে সঙ্গে আর্তনাদের শব্দ।
বনহুর বললো–দুটো খতম হলো। বন্ধুগণ তোমরা ছড়িয়ে পড়ো। সাবধান কেউ মাথা উঁচু করবে না বা উঠে দাঁড়াবে না। প্রত্যেকে তাবু লক্ষ্য করে গুলি চালাও।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুরের নির্দেশ পালন করলো তার দলবল। বনহুর নিজেও রাইফেল জাগিয়ে প্রস্তুত হয়ে পড়লো।
ততক্ষণে তাবুর মধ্য থেকে পাকবাহিনীর দল অস্ত্র হাতে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। চারদিকে ঘিরে এলো-পাথারি গুলি ছুড়ছে ওরা। কারণ অন্ধকারে ঠিক ঠাওর করতে পারছে না কোনদিক থেকে গোলাগুলি আসছে।
বনহুর তার দলবল অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে গুলি ছুড়ছে, একটি গুলি যেন তাদের ব্যর্থ না হয়। ওদিকে পাক সেনাদের বেশ কয়েকজন ধরাশায়ী হলো, সেটা টের পায় বনহুর ও তার দলবল।
এবার বনহুর তাবু লক্ষ্য করে আরও কিছুটা এগোয়। তার দলবলকে হামাগুড়ি দিয়ে এগুতে বলে, এবং একসঙ্গে পর পর গুলি ছুঁড়তে নির্দেশ দেয়।
বনহুর লক্ষ্য করলো তার পাশের একটি যুবকের মাথায় এসে একটি গুলি বিদ্ধ হলো। আশ্চর্য, একটু শব্দ করলো না সে বা আর্তনাদ করলো না শুধু একটি কথা বললো-হাসান ভাই আমি পারলাম না, নীরুর বোনকে উদ্ধার……কথা শেষ করতে পারলো না সে, মুখ থুবড়ে পড়লো মাটির মধ্যে।
যে বাংলা জননীর মুক্তির জন্য তার এ সংগ্রাম সেই জননীর বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো তরুণ মুক্তিযোদ্ধা মানু। কিন্তু তখন কিছু ভাবার সময় নেই কারো, অবিরত শত্রুদের বুলেট সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে তাদের মাথার উপর দিয়ে।
বনহুর আর তার দলবল মানুকে পিছনে ফেলে এগুলো। যেমন করে তোক পাক বাহিনীদের নিঃশেষ করতে হবে এবং উদ্ধার করতে হবে নীরুর বোনকে।
উভয় পক্ষের গোলাগুলি চলেছে।
এবার শুরু হলো মেশিনগানের পালা। পাকসেনারা অবিরাম মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়ছে।
বনহুরের দল বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে পড়েছে।
একজন বনহুরের পাশেই ছিলো, সে তাবু লক্ষ্য করে হাতবোমা ছুঁড়তে গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর ওর হাত চেপে ধরলো-তাবুর মধ্যে নীরুর বোন আছে……
যুবকটি বোমাসহ হাতখানা সংযত করে নিলো।
এবার বনহুর দলবলসহ পাকসেনাদের সামনা সামনি ঝাঁপিয়ে পড়লো। বর্বর পাক সেনারা ভাবতেও পারেনি মুক্তিযোদ্ধা বিচ্ছুর বাচ্চারা আচমকা এতো কাছাকাছি এসে পড়বে। ওরা প্রচুর অস্ত্র নিয়েও শেষ অবধি-বাংলার দামাল ছেলেদের কাছে পরাজয় বরণ করলো। প্রায় আশিজনের মত নিহত হলো আর বন্দী হলো বিশ জন।
বনহুর বন্দীদের ভালভাবে আটক করে হাত পা বেঁধে মাটিতে ফেলে রাখলো তারপর তাবুর মধ্যে প্রবেশ করলো। তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করলো বনহুর বড় আশা নিয়ে, যা হোক নীরুর বোনকে উদ্ধার করতে পারলো কিন্তু তাবুতে প্রবেশ করতে বর্বর পাক সেনাদের নৃশংস বর্বতার নিদর্শন দেখতে পেলো। তাবুর মেঝেতে পড়ে আছে একটি যুবতী, তার দেহ সম্পূর্ণ উলঙ্গ, দেহের বহুস্থানে ক্ষতের দাগ, ছোপ ছোপ রক্তের ছাপ লেগে আছে ক্ষতস্থানে। বনহুর ডান হাতের বাজুতে চোখ ঢেকে ফেললো, নিজের দেহের জামাটা খুলে আলগোছে পিছন থেকে চাপা দিলো বালিকার দেহে। ভাল করে তাকাল বনহুর, বালিকা নীরবে ঘুমিয়ে আছে যেন। চোখ দুটো মুদিত, চুল গুলো এলো মেলো বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে আছে ওর চোখে মুখে বুকে। ঠিক বুকের বামপাশে একটি বিরাট ক্ষত, যে ক্ষত দিয়ে রক্তের বন্যা বয়ে চলেছে। ওকে বেয়োনটের আঘাতে হত্যা করা হয়েছে।
বনহুর হাতের পিঠে চোখ মুছে ফিরে তাকালো, কখন যে তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে তার দলবল মুক্তি যোদ্ধাগণ দেখেনি সে। বনহুর এবার বললোনীরুর বোনকে উদ্ধার করতে পারলাম না। বাংলা জননীর মুক্তির জন্য সে নিজকে উৎসর্গ করে দিয়েছে।
বিশ জন পাক-সেনাকে বন্দী করে ফিরে এলো তারা নিজেদের ঘাটিতে।
মুক্তিযোদ্ধাগণ তখনই পাক সেনাদের খতম করতে চেয়েছিলো, বনহুর তা করতে দেয়নি, বলেছিলো সে, এরা যে পাপ করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত এতো সহজ নয়। হরিপুরের সমস্ত বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে, হত্যা করেছে গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে। আর নারীদের ইজ্জৎ লুটে নিয়েছে, তার প্রমাণ নীরুর নিরপরাধ বালিকা বোনটি……যে কথা মুখে আনাও পাপ।
সমস্ত দিন আজ কারো বিশ্রাম হয়নি, বনহুর সবাইকে বিশ্রামের জন্য নির্দেশ দেয়। সেই সময় কিছু খাবার খেয়ে নিতে বলে সে সবাইকে।
বনহুর নিজেও তাবুর বাইরে শিশির-সিক্ত শ্যামল ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ে। যদিও বেশ ঠাণ্ডা তবু আজ বনহুর বড় গরম বোধ করছিলো কারণ তার শরীরের রক্তে তখন আগুন ধরে গেছে। বিশ জন বর্বর জল্লাদকে তারা বন্দী করে এনেছে, তাদের সায়েস্তা না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।
ভোর হওয়ার আর বেশি বিলম্ব নাই।
বনহুর মাত্র কয়েক মিনিট বিশ্রাম করে নেবার পর উঠে পড়লো, তার দল বলকে চলে আসার জন্য আদেশ দিলো। সবাই একটু বিশ্রাম করে নিয়ে অনেকটা সুস্থ বোধ করছে।
বনহুর বন্দী পাক সেনাদের কাছে এসে দাঁড়ালো।
পাক সেনাগণ মাটির মধ্যে কাৎ হয়ে, কেউ বা চিৎ হয়ে পড়েছিলো। কারণ তাদের হাত পা বাধা থাকায় নড়বার কোন উপায় ছিলনা। কয়েক ঘণ্টা পূর্বেই যারা ছিলো পিশাচের মত নিষ্ঠুর সেই সব পাক সেনারা এই মুহূর্তে যেন এক একটা নির্জীব অসহায় হয়ে পড়েছে।
বনহুরের চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ধক করে।
তার দলবল বন্দী পাক-সেনাদের ঘিরে দাঁড়ালো।
বনহুর বললো–এদের পায়ের বাধন খুলে দাও তোমরা।
সবাই বিস্মিত হলো তবু তাদের হাসান ভাই এর আদেশ পালন না করে পারলো না। দুজন মুক্তিযোদ্ধা পাক বন্দীদের পায়ের বাধন একে একে খুলে দিলো।
বনহুরের হাতে ছিলো তখন মেশিনগান।
পাক সেনারা বার বার বনহুরের হস্তস্থিত মেশিন গানের দিকে তাকাচ্ছিলো।
বনহুর খাটি উর্দুতে বললো–এটা দিয়ে আমি তোমাদের হত্যা করবো না কাজেই এটা দেখে ভয় পাবার কিছু নেই।
সবাইকে পায়ের বাঁধন মুক্ত করে দেবার পর বনহুর বললো—এদের সম্মুখে একটি অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে দাও।
অল্পক্ষণে একটা অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো। তাদের তাবুর আশেপাশে অনেক শুকনো কাঠ ছিলো, কাজেই আগুন জ্বালতে বেশি বিলম্ব হলো না।
সেকি ভীষণ অগ্নিকুণ্ড!
লেলিহান অগ্নিশিক্ষা আকাশ স্পর্শ করলো যেন।
পাক সেনাদের মুখমণ্ডল ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।
বনহুর এবার দাতে দাঁত পিষে বললো—যাও, এবার তোমরা তোমাদের সু কাজের জন্য পুরস্কার গ্রহণ করো। তোমরা প্রবেশ করো।
বনহুরের কথা শুনে শিউরে উঠলো পাক-সেনারা। অগ্নিকুণ্ডে পুড়ে মরার চেয়ে রাইফেল বা মেশিন গানের শুলীতে মৃত্যু অনেক ভাল ছিলো।
বনহুর কঠিনভাবে গর্জে উঠলো-যাও, এক এক করে অগ্নিকুন্ডে প্রবেশ করো, তোমাদের পথ মুক্ত…যাও…যাও বলছি…বনহুর মেশিনগান রেখে কোমরের বেল্ট থেকে রিভলভার খুলে নিলো হাতে।
এবার বনহুর রিভলভার চেপে ধরলো একজন পাক-সেনার পিঠে-অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করে। বনহুরের কণ্ঠে কঠিন আদেশের সুর।
খানসেনা কেঁদে পড়লো–মা কিজিয়ে। আউর কভি উ ওকাম নাহি করেগা..
বনহুর তখন ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করেছে। তার চোখ দুটো দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো–মাফি নেহি মিলেগা। যা কাম কিয়া ওহি মজুরী মিলেগা…প্রচণ্ড এক ধাক্কায় ঠেলে দেয় বনহুর পাক সেনাদের এক এক জনকে অগ্নিকুন্ড মধ্যে। তারপর অট্টহাসিতে ভেংগে পড়লো যেন—-ভাই, তুম লোগ বহুৎ ভালা কাম কিয়া উছিছে বেহেস্ত মিলা। জিন্দেগী ভর উছিমে রহো……এক একজন খানসেনাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দেয় তারপর আপন মনে হেসে উঠে, যেন উন্মাদের হাসি হাসছে সে।
সবাইকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে হত্যা করে বনহুর তারপর দলবলকে লক্ষ্য করে বলে– ওরা যে পাপ করেছিলো তার উপযুক্ত শাস্তি দিলাম। গুলি করে হত্যা করলে অতি সহজে মরতে, নীরুর বোনের ইজ্জতের প্রতিশোধ নেওয়া হতো না।
মুক্তিযোদ্ধার দল অবাক হয়ে বনহুরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলো।
বনহুর বলে চলেছে–এসব নর পিচাশের দল বাংলার মানুষকে শুধু হত্যাই করছে না, তাদের ওরা এমন নৃশংসভাবে হত্যা করছে যার কোনো নজির নেই; নেই কোনো ইতিহাস। তোমরা স্বচক্ষে দেখেছো নীরুর বোনের অবস্থা। এমন কোন পশু নেই যে, পশুদের আচরণও এতো জঘন্য হতে পারে না। নর হত্যাকেও ক্ষমা করা যায় কিন্তু নারীদের উপর পাশবিক অত্যাচারের ক্ষমা নেই……আমি এদের সে জন্যই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে তিল তিল করে হত্যা করলাম।
বনহুরের আদেশে সবাই এবার প্রস্তুত হয়ে নিলো।
যেতে হবে তাদেরকে দূরে শিমুল পাড়ার দিকে। হায়দারের বাহিনী কতটুকু কি করতে সক্ষম হয়েছে জানা দরকার। বনহুর হায়দারের কণ্ঠ শোনার জন্য ওয়্যারলেস খুলে বসলো। কয়েক মিনিট কেটে গেলো, ক্রমেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলো বনহুর। তার দলবল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে তার চার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগে তাদের মধ্য থেকে মানু শহীদ হয়েছে, তবু তাদের মনে এতটুকু হতাশা আসেনি বা ভয় জাগেনি। তারা স্বাধীনতার জন্য, মুক্তির জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছে। চোখেমুখে। তাদের দৃঢ় শপথের দীপ্ত ভাব, যেমন করে হোক বাংলাকে পাক হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করতেই হবে। বুকের রক্ত দিতে তারা ভয় পায় না।
বনহুর যখন ওয়্যারলেসে আলী হায়দারের কণ্ঠ শোনার জন্য প্রতীক্ষা করছে তখন হঠাৎ রহমানের কণ্ঠ ভেসে এলো…সর্দার, এখন মাখিয়াচরের অদূরে যমনার বুকে রয়েছি…মাথিয়াচর আক্রমণে এলে আমরা একশ জন খান সেনাকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছি……এদের একটি নৌকায় আটক রেখেছি……বহু অস্ত্রশস্ত্র আমরা হাতে পেয়েছি কিন্তু বন্দীদের নিয়ে এখন সমস্যা……।
বনহুরের ললাটে কয়েকটা রেখা ফুটে উঠে, পর মুহূর্তেই বলে সেবন্দী জল্লাদদের নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই, ওদের যমুনার বুকে ডুবিয়ে দাও……হাত-পা বেঁধে পানিতে নিক্ষেপ করবে, যেন একজনও সাতরিয়ে পালাতে না পারে। হাঁ, একটি গুলীও যেন অযথা নষ্ট করো না……কত জন পাক সেনা নিহত হয়েছে বলে জেনো…..
রহমানের গলা……প্রায় পঞ্চাশ জন হবে……এরা যখন মাথিয়াচরের দিকে নৌকা নিয়ে আক্রমণ চালিয়ে কিছুসংখ্যক পাক সেনাকে হত্যা করতে সক্ষম হই আর জীবন্ত বন্দী করি……অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হাতে এসেছে……।
বনহুর বললো এবার তোমরা খুব হুঁশিয়ারির সঙ্গে কাজ করবে……মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের দিকে ভালভাবে লক্ষ্য রাখবে, কারো যেন অহেতুক প্রাণ বিনাশ না হয়। আমরা এখন ফুলমারির দিকে রওনা দিচ্ছি……রহমান, কাল আমরা সবাই হলুদখালিতে আমাদের গোপন ঘাঁটিতে মিলিত হবো……
……আচ্ছা সর্দার……এখন আমি আমার নৌকায় একা আছি…..আমাদের ছেলেরা অন্যান্য নৌকায় বিশ্রাম করছে……
ঠিক সেই মুহূর্তে দু’জন মুক্তিযোদ্ধা এসে দাঁড়ায় তার সামনে। তাদের দেহে মজুরের ড্রেস, পিঠে একটি লুঙ্গিতে ছেঁড়া কাঁথা আর একটি থালা। হাতে কাঁচি আর খুরপাই। ওদের দেখলে ঠিক কামলা বা কৃষাণ বলে মনে হয়। হাঁটু অবধি কাদা মাখা।
বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো একজন হাসান ভাই, আমরা শিমলা থেকে মাধুই যাওয়ার পথে কয়েকটা মাইন পুঁতে রেখেছিলাম, এতে দুটো মিলেটারী ভ্যান বিনষ্ট হয়েছে, আর একটি গরু গাড়ি……
বনহুর ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকালো–গরু গাড়ি?
হাঁ, একটা গরু গাড়ি বিনষ্ট হয়েছে হাসান ভাই।
তোমরা এত ভুল করলে কি করে! যখনই পথে মাইন বা বোমা পুঁতবে তখনই পথে সাধারণ লোকজন এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো সময় অবহেলা করবে না। গরুর গাড়িই নষ্ট হয়েছে, তার চালক কি ভাল আছে?
মাথা নিচু করে বলে একজন–চালক এবং গরু দুটি মারা গেছে।
আর মিলিটারী ভ্যান দুটিতে কতজন পাকসেনা ছিল?
একটিতে প্রায় তের-চৌদ্দ জন ছিলো, আর একটিতে তিন জন। দুটো গাড়িই বিনষ্ট হয়েছে, প্রথম গাড়িখানার আটজন আর দ্বিতীয় গাড়ির তিনজনই নিহত হয়েছে কিন্তু……থামলো ছেলেটা।
বনহুর বললো–কিন্তু কি বল?
গরু গাড়ির চালক আর গরু দুটোর জন্য আমরা দুঃখিত হাসান ভাই…….
বনহুর মুক্তিযোদ্ধা তরুণটির পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো—এতে দুঃখিত হবার কি আছে! শত্রু ধ্বংস করতে গেলে অনেক প্রাণ বিনষ্ট হবেই। তোমরা নিজেরা ও তো জীবন দিচ্ছো হাসি মুখে……তোমাদের এ ত্যাগ ইতিহাসে রচনা করবে এক চরম অধ্যায়……একটু আনমনা হয়ে যায় বনহুর।
এক মুক্তিযোদ্ধা তরুণ বলে উঠে–হাসান ভাই, আমাদের এবার রওনা দিতে হবে।
হাঁ, রওনা দেবার সময় হয়ে এসেছে। কথাটা বলে বনহুর মজুরবেশী তরুণ মুক্তিযোদ্ধা দু’জনকে লক্ষ্য করে পুনরায় বললো–তোমরাও চলো, হলুদখালিতে আমাদের জরুী একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ করে যার যা কাজ করা যাবে। যাও, তোমরা একটু বিশ্রাম করে নাও। প্রথমে আমরা অবশ্য ফুলবাড়ী যাবো। সেই গ্রামে নাকি পাক-হানাদারগণ ভীষণ ক্ষতি করেছে, একবার স্বচক্ষে দেখবো।
হলুদখালি ঘাঁটি।
মুক্তিবাহিনীর কয়েকটা দল একত্রিত হয়েছে। আজ প্রত্যেকের চোখেমুখে একটা কঠিন। দৃঢ়তার ভাব ছড়িয়ে আছে।
বাংলা জননীর বীর সন্তান, প্রাণ দিয়ে বাংলা জননীকে মুক্ত করবে তারা।
তাদের হাসান ভাইও উপস্থিত আছেন তাদের মধ্যে।
একটু উঁচু জায়গায় একটি রেডিও ট্রাঞ্জিস্টার চালু রয়েছে, তখন বঙ্গ বন্ধুর বজ্রকণ্ঠে অগ্নিঝরা বাণী শোনা যাচ্ছে……–
……আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয় তোমাদের কাছে আমার শপথ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো……তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রু মোকাবিলা করতে হবে……রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ……আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি তোমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাবে…… এবারের সগ্রাম মুক্তির সগ্রাম……এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম……শেখ মুজিবরের বজ্রকণ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের শরীরের রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। উল্কার মত তারা ছুটে যায় পাক হানাদারদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য। যদিও তাদের তেমন কোনো অস্ত্র নেই তবু আছে তাদের মনোবল, আছে তাদের অসীম সাহস। এ সংগ্রাম তাদের ন্যায়ের ও সত্যের।
বনহুর উঠে দাঁড়ায়, বলে–আমার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুগণ! আজ আমরা এক সপ্তাহ পর এই হলুদখালি ঘটিতে একত্রিত হয়েছি। এই এক সপ্তাহ আমাদের জীবনে এনেছে অনেক পরিবর্তন। আমাদের মধ্যে অনেকেই যারা সেদিন ছিলো আজ তারা নেই। বুকের রক্ত দিয়ে জননী জন্মভূমির মুক্তির পথ সিক্ত করে দিয়ে গেছে। আজ সেসব শহীদ ভাইয়ের রক্তে শপথ গ্রহণ করে আমরা পাক বর্বর বাহিনীদের বাংলাদেশ থেকে তাড়াবোই।
বনহুরের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধাগণ বলে উঠে-আমরা শপথ গ্রহণ করছি, বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করবোই, জীবন উৎসর্গ করবো তবু স্বাধীনতা চাই, মুক্তি চাই……
সাবাস! আমার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা, তোমাদের বীরত্ব, তোমাদের আত্নত্যাগ পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়। লোকে বলে, পাক সেনারা বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সেনাবাহিনী। তাদের বল অন্যান্য দেশের জোয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি। অস্ত্র শস্ত্রেও তারা সবল ও শক্তিশালী কিন্তু বাংলার দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে তারা বারবার নাকানি-চুবানি খাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত মুখে চুনকালি মাখিয়ে পালাতে বাধ্য হবে এটা সুনিশ্চিত। জয় তোমাদের হবেই, জয় সুনিশ্চিত জেনে চুপ থাকলে চলবে না। সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে। যে-কোন ত্যাগের বিনিময়ে বাংলা জননীর মুক্তি চাই..
এবার বনহুর একজন মুক্তিযোদ্ধার পিঠ চাপড়ে বলে–ফারুক, আজ তুমি ফুলমারী ব্রিজ উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। পাক হানাদারগণ তাই ফুলমারী পৌঁছতে সক্ষম হয়নি। তোমাকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারছি না, ফুলমারীর জনগণকে তুমিই আজ বাঁচালে। হাঁ, এবার ফুলমারীর জনগণ তাদের গ্রাম থেকে সরে পড়তে সক্ষম হবে। দ্বিতীয় আর একটি ছেলেকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর–কাওসার, তুমি দলবল নিয়ে হাফসা গ্রামে যাও। ঐ গ্রামের প্রবেশপথে যে ফেরী নৌকাগুলো আছে তা সরিয়ে ফেলবে। পাক বাহিনী যেন নদী সাঁতরিয়ে হাসা গ্রামে প্রবেশ করতে না পারে।
কাওসার বলে উঠলো-হাসান ভাই, আপনার পূর্ব নির্দেশ মত হাফসা গ্রামের নদীপথে পারাপারের ফেরী নৌকাগুলো আমরা ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি।
খুশিভরা কণ্ঠে বলে উঠে বনহুর-সাবাস, এই তো চাই। সাধে কি বলি বাংলা মায়ের দামাল ছেলে তোমরা, তোমাদের অসাধ্য কিছু নেই। পিঠ চাপড়ে দেয় বনহুর কাওসারের।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন সম্মুখে এগিয়ে আসে-হাসান ভাই!
বলো?
মাধাই নগরে পাক হানাদারগণ গত রাতে প্রবেশ করে গ্রামের বহু লোককে হত্যা করেছে, বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। গ্রাম থেকে প্রায় বিশ-পঁচিশজন মহিলাকে তারা ধরে নিয়ে গেছে……
বলো কি হারুন!
হা হাসান ভাই।
তোমরা এ সংবাদ আমাকে আগে জানাওনি কেন?
ঘাঁটিতে পৌঁছতে আমাদের বিলম্ব হয়ে গিয়েছিলো। তাছাড়া আমরা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাক-হানাদারদের কাজে বাধা দিতে গেলে আমাদের তিনজন নিহত হয়েছে।
আর সকলে?
পাঁচজন ওদের হাতে বন্দী হয়েছে। আমি এবং আমার দু’জন সঙ্গী সরে পড়তে সক্ষম হয়েছি।
এতক্ষণ তোমরা নিশ্চুপ রয়েছে? অধর দংশন করে বনহুর। আর একজন মুক্তিযোদ্ধা বয়স্ক লোক এগিয়ে আসে–গত পরশু হরিপুরে তারা হামলা চালিয়ে গ্রামটা ধ্বংস করে ফেলেছে।
বনহুর বলে উঠলো–জানি, হরিপুরের সব সংবাদ আমি জানি। শুধু হরিপুর আর মাদাই নগর নয়, বাংলার প্রত্যেকটা গ্রামে পাক জল্লাদ হানারগণ বর্বর জঘন্য হামলা চালিয়ে যে ধ্বংসলীলার সৃষ্টি করে চলেছে ইতিহাসে তার নজির নেই। লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষকে তারা অবিচারে নৃশংসভাবে হত্যা করে চলেছে। হাজার হাজার গ্রাম ভস্মীভূত করে দিচ্ছে। অগণিত মা বোনের ইজ্জৎ লুটে নিচ্ছে……বনহুরের কণ্ঠ ক্রোধে রুদ্ধ হয়ে আসে, দাঁতে দাঁত পিষে বলে— জল্লাদ ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী যে নারকীয় অত্যাচার বাংলার মানুষের উপর চালাচ্ছে তার কোনো ক্ষমা নেই…..বাংলার মানুষ কোনোদিন তাদের রেহাই দেবে না। হাঁ, একটা কথা, শুধু পাক বাহিনীদের শায়েস্তা করলেই চলবে না। যেসব বাঙ্গালী আর অবাঙ্গালী দালাল গোষ্ঠী পাক বাহিনীকে সাহায্য করে চলেছে তাদেরকেও শায়েস্তা করতে হবে। এই দালালদের সহায়তাই পাক বাহিনীর কুকুর্মের প্রধান অঙ্গ।
একজন মুক্তিবাহিনী বলে উঠলো–মাথাই নগরের ফয়েজ আলী মোল্লা পাক বাহিনীকে মাধাই নগর নিয়ে গেছে বলে আমরা জেনেছি।
বনহুর বললো–ফয়েজ আলী মোল্লা!
হাঁ, সে মাধাই নগরের তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান।
হুঁ, লোকটাকে একবার দেখে নেবো। শুধু ফয়েজ আলী মোল্লাই নয়, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেই এমন অনেক মোল্লাই আছে যারা দেশের হিতাকাক্ষী সেজে দেশের সর্বনাশ করছে। এসব দালালকে দমন করতে না পারলে পাক-বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে তাড়ানো কষ্টকর হবে। আমি জানি, বহু জায়গায় মুক্তিযোদ্ধাগণ এসব দালালকে খতম করার কাজ শুরু করেছে। শুধু দালাল নয় রাজাকার এবং আল-বদর বাহিনীও পাক বাহিনীদের হত্যাযজ্ঞের সহায়ক। এবার বনহুর তাকায় তার বাম পাশে উপবিষ্ট আলী হায়দারের দিকে, তাকে লক্ষ্য করে বলে–হায়দার, তুমি যেসব কাজ করেছে তার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার দিকে লক্ষ্য করে বলে–তোমরা সবাই নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে যাবে। বাংলার বীর সন্ধান তোমরা, তোমাদের জয় শুনিশ্চিত। রহমান, সাধনসিং, তোমরাও যা করেছে বা করছে বাংলার মানুষের জন্য, তা প্রশংসনীয়। তোমরা প্রত্যেকে যার যার বাহিনী নিয়ে কাজ করে যাবে। আজ আমি হায়দার আলীকে রোশনপুর যাবার জন্য নির্দেশ দিচ্ছি, সেখানে পাক হানাদারদের বিরাট একটা বাহিনী ঘাঁটি ফেলেছে। তারা যেন রোশনপুরের জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালাতে না পারে সেজন্য তোমরা পূর্ণ সতর্কতা বলবৎ রাখবে। রহমান, তুমি তোমার দল নিয়ে মধুগাঁও সেতুটি ধ্বংস করার জন্য রওনা দাও। কাবণ মধুগাঁও সেতুটিই হলো পাক বাহিনীর একটা সোজা পথ। সাধনসিং, তুমি থাকবে হলুদখালি ঘাটিতে, কারণ কখন কোথায় কত অস্ত্র-শস্ত্র গোলা বারুদ প্রয়োজন, তোমাকে সেটা পূরণ করতে হবে।
সাধনসিং বললো–যা অস্ত্র এবং গোলাবারুদ আমাদের হলুদখালি ঘাঁটিতে আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত কম……
বনহুর এবার তাকালো তার প্রধান অনুচর রহমানের দিকে-রহমান মাথুয়াচরে পাক হানাদারদের কাছ থেকে যে অস্ত্র-শস্ত্র উদ্ধার করেছিলো সেগুলো কি হলুদখালিতে আনা হয়নি?
না সে অস্ত্র-শস্ত্র হলুদখালি ঘাটিতে আনা সম্ভব নয় তাই আমরা যমুনায় নৌকার মধ্যে মজুত রেখেছি, দরকারমত সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাগণ নিয়ে যাবে এবং যাচ্ছে। বললো রহমান।
বনহুর বললো–বেশ, সেই ভাল। নদীচর এলাকার জন্য ঐসব অস্ত্র প্রয়োজন।
সাধনসিং বললো-হলুদখালি ঘাঁটিতে আরও অস্ত্রের প্রয়োজন আছে কিন্তু..
কোনো কিন্তুর দরকার নেই। আমি অস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেবো। হাঁ তোমরা শুনে রাখো, আমাদের ঘাটি এখন শুধু হলুদখালি বা ফুলমারী নয়। যখন যেখানে পাক সেনাদের আগমন সংবাদ পাবে, সেখানেই ছুটে যাবে তোমরা এবং সেখানেই কোনো গোপন স্থানে ঘাঁটি করে নেবে আর সেই ঘাঁটি থেকে তোমরা কাজ করবে। কথাগুলো এক নিশ্বাসে বললো বনহুর। একটু থেমে আবার বললো–তোমরা শুনে খুশি হবে তোমাদেরই কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ভাই ঢাকার নিকটে কোন এক জায়গায় প্রায় তিনশ’ খান সেনাকে নিহত করেছে। তা ছাড়া বাংলার প্রতিটি জায়গায় পাক সেনারা বাংলার দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে চরমভাবে মার খাচ্ছে। পরাজয় ওদের সুনিশ্চিত জেনে রেখো। হাঁ, এখন তোমাদের কাজের কথা বলি। রুস্তম, তুমি তোমার গেরিলা বাহিনী নিয়ে নগরবাড়ীর দিকে চলে যাও। পাক-বাহিনীরা ঐ পথে পালাবে। একজনও যেন না পালাতে পারে সেদিকে তোমরা লক্ষ্য রাখবে। আর একজনকে লক্ষ্য করে বলে–হীরা ভাই।
একজন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জবাব দেয়–বলুন হাসান ভাই।
হীরা, তোমার দলবল নিয়ে তুমি নীলদিঘীতে চলে যাও। নীলদিঘী ক্যান্টনমেন্টে পাক বাহিনীদের কয়েকজন প্রধান আছে। তোমরা এই ঘাঁটি আক্রমণ করার চেষ্টা করবে। আমিও তোমাদের সঙ্গে আছি। মাহবুব, তুমি যাবে পলাশবাড়ী, পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী এ গ্রামে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালাতে হবে। তাদের সহায়তায় কাজ করবে তোমরা। এ গ্রাম ছাড়াও অন্যান্য যে সব গ্রামে পাক বাহিনী নির্যাতন চালিয়ে তছনছ করে দিয়েছে সে সব গ্রামে তোমাদের সাহায্য একান্ত প্রয়োজন। আজ আমরা যার যা কাজ নিয়ে চলে যাচ্ছি, আবার আমরা মিলিত হবো এক সপ্তাহ পর। আমার তরুণ মুক্তিযোদ্ধা ভাইরা, তোমরা সব সময় দৃঢ় মনোবল নিয়ে অগ্রসর হবে। সবসময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের বজ্রকণ্ঠের বাণী স্মরণ রাখবে–এবারের সংগ্রাম মুক্তির সগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
সেদিনের মত যে যার গন্তব্যস্থানে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে নেয়।
কে কে…..আচমকা বিছানায় উঠে বসে ফয়েজ মোল্লা। দেখতে পায় সে সম্মুখে দাঁড়িয়ে একটা জমকালো পোশাক পরা লোক। ঢোক গিলে বলে–কে তুমি?
আমি আজরাইল, তোমার জান নিতে এসেছি।
ভয়ে ফয়েজ আলীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠে, বলে–না না, তুমি আজরাইল নও।
তবে মনে করো তোমার বন্ধু। মাধাই নগরে পাক-দুশমনদের সাহায্যে যাদের তুমি হত্যা করিয়েছিলে আমি তাদেরই আত্না। …
এ্যাঃ এ্যা…..
ছায়ামূর্তি নিমিশে কাপড়ের তলা হতে একখানা সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা বের করে।
ফয়েজ আলী চিৎকার করতে যায় কিন্তু ছায়ামূর্তি তাকে চিৎকার করার সুযোগ দেয় না, ছোরাখানা আমূলে বিদ্ধ হয় তার বুকে।
একটা গোঙ্গানির শব্দ ছড়িয়ে পড়ে রাতের জমাট অন্ধকারে। চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে আসে। পাশের কক্ষ থেকে স্ত্রী-পুত্র, কন্যা ছুটে আসে, তারা দেখতে পায় শয্যার নিচে ফয়েজ আলীর রক্তাক্ত দেহটা চীৎ হয়ে পড়ে আছে।
কে তাকে হত্যা করলো কেউ ভেবে পেলো না। সবাই বললো এটা মুক্তিবাহিনী ছেলেদের কাজ, কয়েকদিন আগে পাশের গ্রামে দু’জন দালালকে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে। তার কয়েকদিন আগে নিহত হয়েছে পাশের গ্রামের একজন জামাতে ইসলামের লোক।
তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং রাজাকার ও বদর বাহিনীর লোকরা সব গ্রাম ছেড়ে, বাড়িঘর ছেড়ে শহরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। সেখানে পাক-বাহিনীদের সাহসে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইচ্ছামত কাজ করছে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে। তবু রেহাই পাচ্ছে না দালালগণ! যখনই তারা গ্রামাঞ্চলে যাচ্ছে তখনই তাদের পাকড়াও করছে মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা, হত্যা করছে তাদের কাজের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ।
ক্রমেই মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা দুর্দান্ত হয়ে উঠছে। অসীম সাহসে তারা পাক-বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, রক্ত দিচ্ছে আর নিচ্ছে।
ফয়েজ আলী মোল্লা নিহত হবার পরদিন নিহত হলো পাশের গ্রামের ধনবান ইয়াসিন মিয়া। প্রায়ই সে পাক-বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হতো এবং তাদের খুশি করার জন্য বহু গ্রাম্য যুবতীকে ধরে নিয়ে গিয়ে শিবিরে পৌঁছে দিতে।
ইয়াসিন মিয়া সেদিন পাক-শিবির থেকে ফিরছিলো হঠাৎ পথের মধ্যে আচমকা একটা জমকালো পোশাক পরা তোক তার সম্মুখে এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো।
থমকে দাঁড়ালো ইয়াসিন মিয়া, এতক্ষণ মনে ছিলো তার প্রচুর সাহস আর আনন্দ। পাক বাহিনীর লোকেরা তার আপনজনের মত। সদা-সর্বদা তার সঙ্গে রয়েছে ওদের যোগাযোগ কাজেই ভয় বলে তার কিছু ছিলো না। আচমকা তার পথে একজন জমকালো পোশাক পরা লোককে দেখে। ভড়কে গেলো, ইয়াসিন মিয়াকে তুমি?
ছায়ামূর্তি অট্টহাসি হেসে বললো–তোমার বন্ধু।
কি চাও?
তোমার জান।
জান! আমাকে হত্যা করতে চাও তুমি?
না। তুমি এই দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে পাক-হানাদারদের যে উপকার করেছ তার পুরস্কার দেবো। ছায়ামূর্তির হাতে অন্ধকারে চক্ চক করে উঠে একখানা ছোরা।
ইয়াসিন মিয়ার চোখ দুটো ভয়ে গোলাকার হয়ে উঠে।
পরদিন দেখা যায় ইয়াসিন মিয়ার রক্তাক্ত দেহটা পড়ে আছে পথের পাশে। কে তাকে হত্যা করেছে কেউ জানে না।
আজ এখানে, কাল সেখানে পাক-সেনাবাহিনীর পরম বন্ধু ও সহায়ক দালাল গোষ্ঠীর লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেলো। ওরা যত সাবধানতাই অবলম্বন করুন না কেন, তবু মৃত্যুর কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অবশ্য যারা শহরে পাক-বাহিনীর কাছে আত্মগোপন করে পাক-বাহিনীকে সহায়তা করে চলেছে তাদের পরমায়ু অবশ্য বেড়ে গেছে কয়েকদিন। যে কদিন পাকশোষক গোষ্ঠীর শাসন আছে সে কদিন তারা রক্ষা পাবে, তারপর পাক বাহিনীর অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অবস্থা কাহিল হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পাক বাহিনীর শিবিরে আক্রমণ চললো।
দু’পক্ষের লড়াই হলো। মুক্তিবাহিনী আর পাক বাহিনী সে কি ভীষণ যুদ্ধ! শেষ পর্যন্ত পরাজয় বরণ করলো পাক বাহিনী। কয়েকজন সেনা অধিনায়ক বন্দী হলো মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
পরদিন সেসব সেনা অধিনায়কের মৃতদেহ পাওয়া গেলো যমুনার পানিতে। প্রত্যেকটা পাক সেনা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় যমুনার বুকে ভাসছে।
পাক-বাহিনী যেমন বাংলার জনসাধারণ নিরীহ মানুষদের ধরে নিয়ে যায় এবং হাত-পা বেঁধে তাদের পানিতে নিক্ষেপ করে হত্যা করে। একটি দুটো নয়, শত শত, হাজার হাজার নিষ্পাপ মানুষকে তারা নানাভাবে নির্যাতিত করে, পরে তাদের নানাভাবে হত্যা করছে। তাই এসব পাক অধিনায়কেরও পরিণতি এমন হয়েছে। এদেরকেও কিঞ্চিৎ অনুভব করানো হয়েছে এভাবে মৃত্যু স্বাদ কেমন।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধাগণের কাছে পাকসেনারা চরমভাবে মার খাচ্ছে। মিত্রবাহিনী এসে যোগ দিয়েছে মুক্তিবাহিনী ছেলেদের সঙ্গে। ক্রমান্বয়ে রাজধানী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে তারা। ঢাকা শহরে তখন পাক-বাহিনী এবং তার অধিনায়কদের অবস্থা সঙ্কটাপূর্ণ।
শুধু ঢাকা শহরে নয়, বাংলার সবগুলো শহরে পাক-সেনাদের অবস্থা কাহিল। ওরা এতদিন বাংলার মানুষের উপর যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিলো তার শেষ মুহূর্ত উপস্থিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তোমরা আমাদের ভাই, তোমরা ব্যারাকে ফিরে যাও। বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি চালাতে চেষ্টা করো না। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো……
ভাতে আর পানিতে ওদের মরা শুরু হলো। কাঁচা বেগুন, কাঁচা পিয়াজ খেতে শুরু করলো পাক-বাহিনী। লুকাবে কোথায় সব জায়গায় বিচ্ছর পোলা।
মিত্রবাহিনী আর মুক্তিবাহিনী যখন শহরের দিকে এগিয়ে আসছে, পাক বাহিনীর পরাজয় যখন অবশ্যম্ভাবী তখন পাক অধিনায়কের মাথায় আর একটি নতুন পরিকল্পনা জাগলো। তারা দিনের বেলায় কারফিউ রাতে ব্ল্যাক আউট দিয়ে বাংলার অমূল্য রত্ন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা শুরু করলো। বাংলার নিরীহ মানুষ হত্যা করেও তাদের রক্তের তৃষ্ণা কমেনি বরং চরমভাবে বেড়ে গেছে। যে সব সামরিক, বেসামরিক অফিসার ছিলেন তাদের সবাইকে সমূলে নির্মূল করলো ওরা। হত্যালীলা চরম আকার ধারণ করেছে। ওদিকে ভারতের বিমান বাংলার আকাশে ঘন ঘন উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে বোমা নিক্ষেপ করে চলেছে। যেখানেই পাক বাহিনীর শিবির সেখানেই বোমা পড়েছে।
নিচে মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী, আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান। পাকসেনা অধিনায়কদের মাথা বন বন করে ঘুরছে, রেডিও বারবার তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছে। দিশেহারা এখন পাক বাহিনী। তবু তারা হত্যালীলা বন্ধ করেনি। আত্নসমর্পণের পালা যতই এগিয়ে আসছে ততই তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে চরমভাবে।
বাংলার মানুষ বিপুল আগ্রহে প্রতীক্ষা করছে, জয় তাদের সুনিশ্চয় জেনে একটা আলোড়ন তারা অনুভব করছে নিজেদের বুকের মধ্যে। তারা প্রতি মুহূর্তে জয় কামনা করছে, এবার নিশ্চয়ই আত্নসমর্পণ করবে পাক-অধিনায়কগণ। কিন্তু সে সময়টি কখন আসবে।
১৬ই ডিসেম্বর। পাক-সেনা অধিনায়কগণ বাধ্য হলো মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্নসমর্পণ করতে।
বাংলার আকাশে স্বাধীনতার সূর্য উদয় হলো। পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর নির্মম নিষ্পেষণ থেকে মুক্ত হলো দেশ। বাংলার ঘরে ঘরে বিজয় উৎসব শুরু হলো।
হলুদখালি ঘাটি।
বিপুল আগ্রহ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা অপেক্ষা করছে। তাদের হাসান ভাইয়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলো। তাকে ওরা পায়নি, শুধু তার নির্দেশ মত কাজ করে গেছে তারা। হাসান ভাই বলেছিলো, তোমরা বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের বাণী স্মরণ রেখে কাজ করে যাবে ইনশাল্লাহ তোমরা জয়ী হবে। আজ জয়ী হয়েছে তারা, বাংলার মানুষ আজ পেয়েছে মানুষের অধিকার কিন্তু হাসান ভাই কই!
এখানে যখন মুক্তিবাহিনীর জোয়ানরা তাদের হাসান ভাইয়ের জন্য প্রতিক্ষা করছে তখন ভারতের বিমানঘাঁটিতে ক্যাপ্টেন হাসানকে ঘিরে মিত্রবাহিনীর জোয়ানরা এবং সেনা— অধিনায়কগণ তাকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত। ভারতীয় বোমারু বিমান নিয়ে ভারতীয় পাইলটদের সঙ্গে মিশে সে পাক-সেনাদের বহু ঘাঁটি এবং শিবির ধ্বংস করেছে। ধ্বংস করেছে বহু পাক সেনাকে। ক্যাপ্টেন হাসানের কর্মদক্ষতায় ভারতীয় বিমান অধিনায়কগণ স্তম্ভিত হয়ে গেছেন, তারা শুধু আনন্দিতই নয়, গর্বিতও বটে।
ক্যাপ্টেন হাসান একরাশ ফুলের মালা গলায় নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলো। হাত নাড়ছে তার সহকর্মী পাইলটগণ। অসংখ্য ক্যামেরা ছবি নিচ্ছে।
হাত নাড়ছে ক্যাপ্টেন হাসান, মুখে তার স্মিত হাসির রেখা।