নিশিকন্যা : আয়না
রূপা বলল, “আব্বু, আম্মু মারা যাবার পর তোমার আরেকটা বিয়ে করা উচিত ছিল।”
রূপা আর তার বাবা শাহেদ ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছে, রূপার কথা শুনে শাহেদ একটা বিষম খেলো। কাশতে কাশতে বলল, “কী বললি? আমার বিয়ে করা উচিত ছিল?
“হ্যাঁ,” রূপা মাথা নাড়ল, “অবশ্যই বিয়ে করা উচিত ছিল?
“কেন?”
“তাহলে আমার একটা কথা বলার মানুষ থাকতো, কোনো কিছু সমস্যা হলে তার সাথে কথা বলতে পারতাম।”
শাহেদ হাসি হাসি মুখ করে বলল, “তুই কেমন করে জানিস সেই মহিলা তোর কথা শুনতো? যদি ডাইনি টাইপের একটা মহিলা হতো?
রূপা মাথা নেড়ে বলল, “তুমি কেন ডাইনি টাইপের একটা মেয়ে বিয়ে করবে? তোমার সুইট টাইপের একটা মেয়ে বিয়ে করা উচিত ছিল। হাসি-খুশি মাই ডিয়ার টাইপের।”
শাহেদ প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল, “মাই ডিয়ার টাইপের একজন মাই ফিয়ার টাইপের হয়ে যেতে কতক্ষণ? ঠাকুরমার ঝুলি পড়িস নি?”
“আব্বু ওগুলো পুরনো দিনের বই। রিয়েল লাইফে এগুলো হয় না। খামোখা কেন একজন মানুষ ডাইনি টাইপের হবে?
শাহেদ এবারে মুখে একটা হতাশার ভাব ফুটিয়ে বলল, “তুই এই কথাটা সাত বছর আগে কেন বললি না? আমি তোর কথা ভেবে বিয়ে করলাম না-আর এখন তুই-ই আমাকে সেজন্যে দোষ দিচ্ছিস?
“এখন তাহলে করে ফেলো।”
“এখন?”
“হ্যাঁ।”
শাহেদ তার কঁচা-পাকা চুল দেখিয়ে বললো, “সব চুল পেকে যাচ্ছে, এখন আমাকে কে বিয়ে করবে? আফসোস-যখন সময় ছিল তখন কেউ আমাকে বলল না।”
আসলে কথাটি সত্যি নয়। রূপার এখন বয়স পনেরো, তার বয়স যখন আট তখন রূপার মা মালা খারাপ ধরনের একটা ব্লাড ক্যান্সারে মারা গিয়েছিল। শোকের প্রথম ধাক্কাটা কেটে যাবার পর শাহেদের মা বা ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই তাকে একটা বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছিল। সবাই তখন রূপার কথাই বলেছিল, মেয়েটা তা না হলে একেবারে একলা হয়ে যাবে। শাহেদ রাজি হয়নি-রূপার মায়ের জায়গায় সে কিছুতেই অন্য একটা মহিলার কথা চিন্তা করতে পারেনি।
সেই আট বৎসর থেকে শাহেদ রূপাকে মানুষ করে এনেছে। সকালে ঘুম থেকে তুলেছে, নাস্তা করিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছে। নিজে স্কুল থেকে আনতে না পারলে কাউকে দিয়ে আনিয়েছে। রাত্রে ঘুম পাড়িয়েছে, ঘুমিয়ে যাবার পর রাত জেগে নিজের কাজ করেছে! রূপার অসুখ হলে বুকে চেপে ধরে হেঁটেছে, মাথায় পানি ঢেলেছে, ঘণ্টায় ঘণ্টায় থার্মোমিটার দেখেছে! মালা বেঁচে থাকলে যা যা করতো শাহেদ তার সবকিছুই করেছে। তবুও কখনোই তার জায়গাটা পূরণ করতে পারেনি। মা দিয়ে কখনো কখনো বাবার অভাব পূরণ করা যায় কিন্তু বাবা দিয়ে কখনো মায়ের অভাব পূরণ হয় না।
রূপা নিজের প্লেটের খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “ তুমি বিয়ে করলে আরো একটা জিনিস হতো!”
“কী জিনিস?”
“আমার আরো কয়টা ভাইবোন থাকতো! আমাকে সব সময় একলা থাকতে হতো না।”
শাহেদ একটু অবাক হয়ে বলল, “তোকে সব সময় একলা থাকতে হয় কে বলেছে? স্কুলে এত বন্ধুবান্ধব–”
“স্কুলের বন্ধুবান্ধুব এক রকম আর ভাইবোন অন্যরকম।
তুই কেমন করে জানিস?”
“না জানার কী আছে? আমি দেখি না?”
শাহেদ তার মেয়েটির জন্যে একধরনের বেদনা অনুভব করে। সত্যিই এই মেয়েটি একা। আগে কখনো সেটি নিয়ে কখনো অভিযোগ করে নি, ইদানীং মাঝে মাঝেই এটা বলছে। আজকাল শাহেদ নিজেও অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, বাসায় আসতে প্রায়ই বেশ রাত হয়। রূপার মায়ের নাম দিয়ে সে মালা ইলেকট্রনিকস নামে যে ফ্যাক্টরিটা শুরু করেছে বছরখানেক হলো সেটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, গতবার মাত্র প্রথমবার সেটা বাইরে কিছু যন্ত্রপাতি এক্সপোর্ট করেছে। কাজকর্ম নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে-মনে মনে ভেবেছিল রূপা বড় হয়েছে, ছোট থাকতে তাকে যত সময় দিয়েছে এখন আর তত সময় না দিলেও চলবে। কিন্তু সেটা মনে হয় সত্যি নয়। পনেরো-ষোলো বছরের মেয়ের সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগৎ থাকে, সেখানে হঠাৎ করে ঢোকা যায় না, কিন্তু সেই জগতের কাছাকাছি থাকতে হয়-তা না হলে হঠাৎ করে মাঝখানে বিশাল দূরত্ব হয়ে যায়।
শাহেদ তার খাওয়া শেষ করে এক গ্লাস পানি খেয়ে রূপার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল জিজ্ঞেস করলো, “তুই সত্যি সত্যি খুব
একা?”
রূপা এবারে কেমন যেন লজ্জা পেয়ে যায়, জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, আব্বু! আমি এমনি এমনি ঢং করছিলাম!”
“ঢং?”
“হ্যাঁ।” রূপা হেসে বলল, “আমি তো টিনএজার-টিনএজাররা হচ্ছে ঢঙের মাঝে সবচেয়ে বড় এক্সপার্ট!”
শাহেদ একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “উঁহু, তুই আসলে সত্যি কথাই বলেছিস। আসলেই তুই খানিকটা লোনলি।”
“না আব্বু। আমি ঠিকই আছি–”
“উঁহু। তুই ঠিক নাই।” তোর বয়সী বাচ্চা-কাচ্চারা যখন বাসায় আসে তখন সেখানে মা থাকে, ভাইবোন থাকে-তোর বেলায় কেউ থাকে না। তুই একা।”
“ময়না খালা আছে! ইদরিস চাচা আছে।”
ময়না খালা কাজের বুয়া, ইদরিস চাচা বহুদিনের পুরনো ড্রাইভার। তারা আর যাই করুক পনেরো-ষোলো বছরের একটা মেয়ের নিঃসঙ্গতা যে দূর করতে পারে না, সেটা রূপা আর শাহেদ দুজনেই জানে। তাই দুজনের কেউই কোনো কথা বলল না, দুজনেই একটু হাসির ভান করল।
শাহেদ পানির গ্লাসটায় আরো খানিকটা পানি ঢালতে ঢালতে বলল, ‘একটা কাজ করা যাক!”
“কী কাজ?”
“একটা বড় ভ্যাকেশন নেওয়া যাক।”
ভ্যাকেশন?” রূপা অবাক হবার ভান করে বলল, “তুমি ভ্যাকেশন নেবে?”
“কেন? আমি ভ্যাকেশন নিতে পারি না?”
“আগে একবার নাও, তারপর দেখি।”
শাহেদ গলায় উৎসাহ ঢেলে বলল, “তুই আর আমি কোনো একটা জায়গায়, একসাথে-কী বলিস?”
রূপা একটু একটু হাসতে হাসতে বলল, “কোথায় যাবে শুনি?
“চিটাগাং হিল ট্র্যাক্টস যেতে পারি। তা না হলে সুন্দরবন। জ্যোৎস্না রাতে সুন্দরবন যা চমৎকার নাকি দেখায়!”
রূপা খিলখিল করে হেসে বলল, “আন্ধু তুমি শুধু শুধু এত প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছ। তুমি তোমার মালা ইলেকট্রনিকস ছেড়ে একদিনও থাকতে পারবে না। একদিন কেন একবেলাও থাকতে পারবে না! একবেলা কেন এক ঘণ্টাও থাকতে পারবে না।”
শাহেদ গম্ভীর গলায় বলল, “তুই বাজি ধরতে চাস?”
“ঠিক আছে।”
“কী বাজি ধরবি?”
“তুমিই বলো।”
“যদি সত্যি সত্যি তোকে নিয়ে লম্বা একটা ভ্যাকেশনে যাই তাহলে তোর যত হাউকাউ মার্কা সিডি আছে সব নালায় ফেলে দিয়ে আসবি।”
রূপা আঁতকে উঠে বলল, “ ইশ! আব্রু তুমি এসব কী বলছ? এত কষ্ট করে সিডিগুলো কালেক্ট করেছি আর সেগুলো তুমি ফেলে দেবে?”
শাহেদ চেয়ারে হেলান দিয়ে মাথা নাড়তে বলল, “কী যে তোরা মজা পাস এই চেঁচামেচি শুনে। না আছে কোনো লিরিক, না
আছে কোনো সুর–”
রূপা গলা উঁচিয়ে বলল, “আব্বু, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি যখন ছোট ছিলে তখন তোমার আব্বুও তোমাকে বলেছেন-কী সব হাউকাউ মার্কা গান শুনিস, না আছে সুর না আছে তাল!”
শাহেদ হেসে ফেলল, রূপা ঠিকই বলেছে। সে যখন কলেজে পড়তো তখন বিটলস নিয়ে খুব হৈ চৈ না। একদিন কোথায় জানি বিটলসের গান হচ্ছে তখন হঠাৎ করে তার বাবা এসে গেলেন, গান শুনে চোখ কপালে তুলে বললেন, “এই লোককে কী কুকুরে কামড়েছে? এইভাবে চিৎকার করছে কেন?
রূপা ঠিক বিশ্বাস করেনি কিন্তু শাহেদ সত্যি সত্যি পুরো দুই সপ্তাহের জন্যে ছুটিতে যাবার প্রস্তুতি নিয়ে নিল। প্রথমে রাঙ্গামাটি, সেখান থেকে কক্সবাজার। কক্সবাজার থেকে সুন্দরবন। রাঙ্গামাটিতে তার পরিচিত এক বন্ধুর বাসায় কক্সবাজারে পর্যটনের হোটেলে, সুন্দরবনে একটা রেস্ট হাউসে। এই দুই সপ্তাহের ছুটিতে শাহেদ কিছুই করবে না, শুধু বিছানায় আধশোয়া হয়ে গল্পের বই পড়বে বলে ঠিক করল। সেটা শুনে রূপা খিলখিল করে হেসে বলল, “আন্ধু তুমি যদি পুরো দুই সপ্তাহ বিছানাতে শুয়েই থাকবে, তাহলে এত কষ্ট করে রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার আর সুন্দরবন কেন যাচ্ছ? তুমি তোমার ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো না কেন?”
শাহেদ অপ্রস্তুতের মতো হেসে বলল, “ধুর বোকা! সবকিছুর জন্যে একটা এটমস্ফিয়ার লাগে না? এই ঘরে শুয়ে থাকা আর সুন্দরবনের রেস্ট হাউসে শুয়ে থাকা এক ব্যাপার হলো?”
কাজেই বেশ করে ভ্রমণের প্রস্তুতি শুরু হলো। রূপার ক্লাসের মেয়েরা চোখ কপালে তুলে রূপাকে বলল, “দুই সপ্তাহ জঙ্গলে থাকবি?”
রূপা বলল, “দুই সপ্তাহ জঙ্গলে না। এক সপ্তাহ জঙ্গলে। বাকি এক সপ্তাহ রাঙ্গামাটি আর কক্সবাজারে!”
“ওই একই কথা।”
“মোটেও এক কথা না।”
“তোর রাঙ্গামাটিতে টেলিভিশন আছে? স্টার ওয়ার্ল্ড আছে? এমটিভি আছে?”
রূপা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি কী টেলিভিশন দেখার জন্যে যাচ্ছি? আমি আমার আব্বুর সাথে ভ্যাকেশানে
রূপার বান্ধবী সোনিয়া বলল, “সেটাই তো আমার প্রশ্ন : মানুষ তার বাবার সাথে ভ্যাকেশানে যায় কেমন করে? আমি আর আব্বু একসাথে থাকলে কোনো কথাই বলতে পারি না।”
আরো দুজন এ বিষয়ে একমত হয়ে গেল, একজন জিজ্ঞেস করল, “রূপা তুই তোর আব্বুর সাথে এই দুই সপ্তাহ কী নিয়ে কথা বলবি?”
“কি নিয়ে কথা বলব মানে! তোদের সাথে কী নিয়ে কথা বলি?”
“আমাদের সাথে যা নিয়ে কথা বলিস, তাই নিয়ে তুই তোর আব্বুর সাথে কথা বলিস?” রূপা হাতে কিল দিয়ে বলল, “হ্যাঁ! একশবার বলি।”
রূপার বান্ধবীরা খানিকটা বিস্ময় এবং অনেকটা অবিশ্বাস নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
শাহেদ রূপাকে নিয়ে ঢাকা থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে রওনা দিল। প্রথমে ভেবেছিল প্লেনে চলে যাবে, কিন্তু পরে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দিল। ভ্রমণের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে ধীরেসুস্থে উপভোগ করে করে যাওয়া, প্লেনে সেটা হয় না, সেখানে সারাক্ষণই এক ধরনের তাড়া থাকে।
ট্রেনে চট্টগ্রাম পৌঁছে একটা গাড়ি করে শাহেদ আর রূপা।
যখন তার বন্ধুর ঠিক করে রাখা বাসায় পৌঁছাল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। বাসার সামনে শাহেদের বন্ধু অপেক্ষা করছিল, গাড়ি থামতেই ঘর থেকে বের হয়ে এলো। রূপা গাড়ি থেকে নেমে অবাক হয়ে বাসাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, হ্রদের তীরে, গাছগাছালি ঢাকা একটা ঢিলার ওপরে একবারে ছবির মতো একটা বাসা। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি ক্যালেন্ডার থেকে কেটে এনে লাগিয়েছে!
শাহেদ তার পুরনো বন্ধুর সাথে দেখা হওয়ার পর প্রাথমিক উচ্ছ্বাস শেষ করে রূপার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “রূপা, মা, এই হচ্ছে আমার বন্ধু মতিন। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন এর মতো পাজি একটা ছেলে ছিল না!”
রূপা তার আব্বুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আর তুমি নিজে কী রকম মানুষ ছিলে সেটা বলবে না? শাহেদের বন্ধু মতিন হা হা করে হেসে বলল, “ইয়াং লেডি! তুমি ঠিকই ধরেছ। তোমার বাবা বিখ্যাত ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট শাহেদ রহমান ছেলেবেলায় মোটেই ধোয়া তুলসী পাতা ছিলেন না। ভেরি ফ্র্যাংকলি যদি কোনো পাতার সাথে তুলনা করতে হয় সেটি হবে বিছুটি পাতা!’ ছেলেবেলার কথা মনে করে দুই বন্ধু আবার খানিকক্ষণ হাসাহাসি করল। হাসাহাসি একটু কমে আসতেই রূপা বলল, “চাচ্চু, আপনার এই বাসাটা খুব সুন্দর।” মতিন মাথা নেড়ে বলল, “এটা আমার বাসা না। এটা আমার পরিচিত একজনের বাসা। তার ছেলে একটু আধাপাগলা ধরনের ছিল।
ছেলেটা মারা যাবার পর পুরো ফ্যামিলি আমেরিকা চলে গেছে। আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে বিক্রি করে দেবার জন্যে!”
রূপা তার আব্বু শাহেদের হাত ধরে বলল, “আব্বু তুমি এটা কিনে ফেলো!”
মতিন শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা মন্দ আইডিয়া না। কিনে ফেল। ঢাকার বাইরে রিলাক্স করার একটা জায়গা পাবি।”
শাহেদ ভুরু কুঁচকে বলল, “তোর ধারণা আমি কচকচে টাকার ওপরে শুয়ে থাকি? তুই জানিস আমার ব্যাংক লোন কত?”
“ব্যাংক লোন না হয় আরো কিছু বাড়িয়ে নিলি–”
শাহেদ বাসাটার দিকে খানিকক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “তবে বাসাটা অপূর্ব। হ্রদের ধারে টিলার ওপরে এত সুন্দর সেটিং যে অবিশ্বাস্য ব্যাপার!”
মতিন বলল, “ডিসিশন নিয়ে নে, আমি তোকে পানির দরে কিনিয়ে দেব!”
রূপা শাহেদের হাত টেনে বলল, “কিনে ফেল আব্বু।”
শাহেদ রূপার ঘাড় ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বাসা কিনে ফেলা বাজার থেকে ইলিশ মাছ কেনার মতো, ইচ্ছে হলেই কিনে ফেলা যায়!”
মতিন চোখ মটকে বলল, “বাসার বাইরে থেকে দেখেই তোরা মুগ্ধ হয়েছিস। ভেতরে গেলে একেবারে পাগল হয়ে যাবি! এত সুন্দর ডিজাইন দেখা যায় না। অনেক সুন্দর বাসা আছে যেগুলো কেমন জানি বেশি সাজানো মনে হয়–এটা সেরকম নয়। এটা ভেরি ওয়ার্ম অ্যান্ড কোজি।”
শাহেদ ভুরু কুঁচকে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই কবে থেকে বাসার দালাল হয়ে গেলি? একেবারে রিয়েল এস্টেট এজেন্টের মতো কথা বলতে শুরু করেছিস!”
মতিন হা হা করে হেসে বলল, “পুরোপুরি এজেন্ট এখনো হতে পারি নি তাই বাসার দুটো বড় ঝামেলার কথাও বলে দিই।”
রূপা চোখ বড় বড় করে বলল, “ঝামেলা?”
“হ্যাঁ। একটা কাল্পনিক আরেকটা বাস্তব।” মতিন রূপার দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল্পনিকটা শুনে তুমি ভয় পাবে না তো?”
রূপা শঙ্কিত চোখে মতিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “না চাচ্চু, মনে হয় ভয় পাব না।”
“গুড। বাসার প্রথম ঝামেলা হচ্ছে এর সুনাম নিয়ে। এর কোনো সুনাম নেই, ভৌতিক বাসা হিসেবে এর দুর্নাম আছে!”
“ভৌতিক বাসা?”
“হ্যাঁ। এখানে যে মানুষটি থাকতো নাম ছিল সেলিম। সে হঠাৎ করে মারা যায়-মৃত্যুটা মোটামুটি অস্বাভাবিক মৃত্যু ছিল। তাই সবাই এ বাসাটাকে হন্টেড হাউস বলে ভাবতে ভালোবাসে।”
রূপা ভয়ে ভয়ে বলল, “কী রকম হন্টেড হাউস, চাচ্চু? রাত্রিবেলা কেউ হাঁটাহাঁটি করে? হাসে?”
“সেটা তো আমি জানি না! আমি বহু রাত এখানে থেকেছি, বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম! ভূত হটে নাকি হাসে সেটা তো আমি জানি না।”
শাহেদ জিজ্ঞেস করল, “আর দ্বিতীয় ঝামেলাটা কী?”
দ্বিতীয় ঝামেলা হচ্ছে এখানে যাওয়া-আসা নিয়ে। বাসাটা একেবারে শহরের বাইরে, নির্জন একটা জায়গায়। ধারেকাছে কোনো মানুষ থাকে না। হঠাৎ করে কোনো ইমার্জেন্সি হলে কোনো সাহায্য আসার কোনো সুযোগ নেই।”
শাহেদ ভুরু কুঁচকে বলল, “তুই এরকম জায়গায় আমাকে তুলে দিচ্ছিস?”
মতিন শাহেদের পিঠে থাবা দিয়ে হা হা করে হেসে বলল, “ তোর ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। তোরা যে কয়দিন থাকবি সেই কয়দিন বাসায় পাহারার জন্যে আলাদা লোক থাকবে। সর্বক্ষণ তোদের জন্যে একটা গাড়ি আর ড্রাইভার থাকবে। রান্না করার জন্যে একটা বাবুর্চি, কাজকর্মে সাহায্য করার জন্যে দুজন বয়। তুই যদি চাস তাহলে থানা থেকে পুলিশও নিয়ে এসে রাখতে পারি।”
শাহেদ বলল, “থাক! এখানে এসেছি নিরিবিলি কয়েক দিন থাকার জন্যে তুই যদি পুলিশ আর বিডিআর দিয়ে বাসা বোঝাই করে ফেলিস তাহলে তো মুশকিল!”
“আসলে পুরো এলাকাটা অসম্ভব সেফ। তোরা তো ঢাকা থেকে এসেছিস সেজন্যে বলছি। ঢাকার মানুষ হচ্ছে প্যারানয়েড, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে যে কেউ বুঝি ডাকাতি করে ফেলল, খুন করে ফেলল, ছিনতাই করে ফেলল।”
রূপা বলল, “আব্বু চলো বাসার ভেতরে যাই! তোমরা বাইরে থেকেই মনে হচ্ছে সব গল্প শেষ করে ফেলবে!”
মতিন বলল, “হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। চলো ভেতরে যাই।”
বাসার ভেতর থেকে দুজন লোক এসে শাহেদ আর রূপার সুটকেস-ব্যাগ এসব নিয়ে বাসার ভেতরে যেতে থাকে। মতিন শাহেদ আর রূপাকে নিয়ে তাদের পেছনে পেছনে বাসার ভেতরে এসে ঢুকল।
ঘরের ভেতরে পা দিতেই রূপার খুব বিচিত্র একটা অনুভূতি হয়, হঠাৎ করে মনে হলো ঘরটা খুব ঠাণ্ডা, তার সারা শরীর কেমন যেন কাটা দিয়ে ওঠে। শুধু তাই না, রূপার হঠাৎ করে মনে হলো কেউ একজন তার দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাল, কেউ তার দিকে তাকিয়ে নেই কিন্তু তারপরেও কী ভয়ংকর বাস্তব অনুভূতি!
বাসাটি খুব সুন্দর করে সাজানো। দামি সেগুন কাঠের ফার্নিচার, দেয়ালে তেলরঙের ছবি। শাহেদ একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা কার পোর্ট্রেট?”
মতিন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে শাহেদের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “সেলিমের। এই বাসার যে মানুষটি মারা গিয়েছিল সেই সেলিম।”
শাহেদ বলল, “কী সুন্দর পোর্ট্রেট!”
“হ্যাঁ প্যারিসে করিয়েছিল। অসম্ভব ভালো কাজ।”
রূপা শাহেদ আর মতিনের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পোর্ট্রেটের দিকে তাকাতেই কেমন যেন চমকে উঠল। পোর্ট্রেটে তেইশ-চব্বিশ বছরের একটা ছেলের ছবি, মাথায় এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল, অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ চোখ এবং মুখে এক ধরনের ক্রুর হাসি। রূপা কেমন জানি সম্মোহিতের মতো ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে এলোমেলো চুলের এই নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি বুঝি ছবি নয়, এটি যেন একটা জীবন্ত মানুষ, যেন সত্যি সত্যি ক্রুর একটা হাসি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রূপা কেমন জানি শিউরে উঠে একপাশে সরে গেল, তার মনে হতে থাকে মানুষটি বুঝি হঠাৎ করে ছবির ভিতর থেকে বের হয়ে আসবে। রূপা সরে যাবার পরেও ছবির মানুষটি তার দিকে তাকিয়ে রইল-ঘরের কোথাও গিয়ে এ মানুষটির দৃষ্টি থেকে সরে যাবার উপায় নাই। রূপা হঠাৎ করে বিচিত্র এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে।
মতিন রূপার কাছে এগিয়ে এসে বলল, “এসো মা, তোমাকে তোমার ঘর দেখিয়ে দিই।”
“চলেন।” রূপা এই ঘর থেকে সরে যাবার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়ে উঠল।
মতিনের কথা সত্যি-এই বাসার ভেতরটুকু বাইরের থেকেও সুন্দর। যিনি থাকতেন তার রুচি চমৎকার সবকিছুতেই সেটা বোঝা যায়। হঠাৎ করে সে চলে গেছে কিন্তু তার দৈনন্দিন জীবনের সবকিছু এখানে রেখে গেছে।
রূপার ঘরটি বড়, জানালা দিয়ে বাইরে বিস্তৃত হ্রদ দেখা যায়। ঘরের মেঝেতে রঙিন ছোট ছোট কার্পেট বিছানো রয়েছে। বড় খাট, মাথার কাছে তাকে বই সাজানো, শুয়ে শুয়ে বই পড়া যাবে। একপাশে ছোট ড্রেসিং টেবিল। লেখাপড়া করার জন্যে একপাশে একটা ডেস্ক আর একটা সুদৃশ্য চেয়ার। ঘরে ঢুকলেই মন ভালো হয়ে যায়। তবে ঘরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দেয়ালে লাগানো বিশাল আয়না, এত সুন্দর আয়না রূপা আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। রূপা মুগ্ধ দৃষ্টিতে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। মতিন বলল, “ঘর পছন্দ হয়েছে মা।”
“হ্যাঁ, চাচ্চু পছন্দ হয়েছে। আয়নাটা কী সুন্দর।”
“বেলজিয়াম থেকে এনেছে। এত বড় আয়না আনা কী সোজা কাজ? বড়লোকের শখ বলে কথা।
শাহেদ বলল, “দামি আয়না কোনো সন্দেহ নেই। আমাকে দেখতেও এখানে ভালো লাগছে।”
“হ্যাঁ।” মতিন হা হা করে হেসে বলল, “এই আয়নায় সবাইকে ভালো দেখায়।”
শাহেদ জানতে চাইল, “আমার ঘর কোনটা?”
“সব মিলিয়ে এখানে চারটা বেডরুম-তুই বেছে নে কোথায় থাকবি! আয় তোকে বেডরুমগুলো দেখাই।”
সব ঘর দেখে শাহেদ ঠিক রূপার বেডরুমের পাশের বেডরুমটি বেছে নিল। এ ঘরটি থেকেও আদিগন্ত বিস্তৃত হ্রদটিকে দেখা যায়, জানালা খুললেই ঘরের ভেতরে উথালপাথাল বাতাস হুটোপুটি খেতে থাকে।
রাতের খাবারটি হলো চমৎকার। বড় ডাইনিং টেবিলে সুন্দর করে সব সাজিয়ে দিয়েছে। শাহেদ রূপাকে মানুষ করতে গিয়ে যে কাজে ব্যর্থ হয়েছে সেটি হচ্ছে তাকে মাছ খেতে শেখানো। খাবার টেবিলে কোনো মাছ নেই তাই রূপার মুখে হাসি। খাওয়া শেষ হবার পর মতিন বিদায় নিয়ে চলে গেল, ভোরবেলা সে আবার খোঁজ নিতে আসবে।
রূপা আর শাহেদ মিলে তাদের কয়েকদিনের বাসাটি ঘুরে ঘুরে দেখল। তাদের সবচেয়ে পছন্দ হলো লাইব্রেরি ঘরটি, ঘরের ছাদ থেকে নিচ পর্যন্ত শুধু বই আর বই। রূপা বইগুলো দেখল, বেশির ভাগই কটমটে প্রবন্ধের বই, বেশির ভাগই ইংরেজি। এক
কোনায় একটা দামি সাউন্ড সিস্টেম, সুইচ টিপে দিতেই পাশ্চাত্য একটি ক্লাসিক্যাল মিউজিক বাজতে থাকে। এখানে যে মানুষটি ছিল তার রুচির ছাপ এখানেও রয়ে গেছে। লাইব্রেরির মাঝামাঝি খুব আরামদায়ক একটা চেয়ার, আধশোয়া হয়ে পা তুলে দেবার একটা ব্যবস্থা আছে। রূপা চেয়ারটিতে বসে পা তুলে দিয়ে বলল, “আব্বু এই চেয়ারটা আমার। আগে থেকে রিজার্ভ করে রাখলাম।”
শাহেদ মাথা নেড়ে বলল, “ওসব চলবে না। যে আগে আসবে তার।”
“তাহলে কেমন করে হবে? তুমি ঘুম থেকে উঠো শেষরাতে-তোমার সাথে কে পারবে।”
“তুইও ওঠ। তোকে নিষেধ করেছে কে?”
“পৃথিবীর মাঝে যেসব ভালো জিনিস আছে তার একটা হচ্ছে ঘুম। আমি সেটা ছেড়ে দেব?”
“যত ভালোই হোক বেশি কোনটাই ভালো না। রসমালাই খেতে ভালো একদিন দুই কেজি রসমালাই খেয়ে দেখিস তোর কী অবস্থা হয়!”
রূপা তার আব্বুকে ছোট একটা ধাক্কা দিল বলল, “ইশ আব্বু! তুমি যে কী বাজে কথা বলতে পারো! কেমন করে তুমি অফিসে কাজকর্ম করো বুঝতেই পারি না।”
শাহেদ চোখ পাকিয়ে বলল, “আমরা এখন ভ্যাকেশনে। খবরদার অফিসের কথা মুখে আনবি না। ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
রাত্রিবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে রূপা তার মাথার কাছে রাখা বইগুলো থেকে একটা বই টেনে নেয়, ইংরেজি বই, নাম প্রাচীন প্রেতচর্চা। বইয়ে নানা ধরনের ছবি, এই রাত্রিবেলা সেগুলো দেখে রূপার কেমন জানি গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। সে তাড়াতাড়ি বইটা রেখে দিয়ে তার নিজের একটা বই টেনে নিল। এটা রোমান্টিক উপন্যাস, নায়ক এবং নায়িকা কী করবে সেটা আগে থেকে অনুমান করা যায় তাই পড়তে বেশ লাগে।
শোয়ার আগে শাহেদ রূপাকে দেখতে এলো, জিজ্ঞেস করল, “রাত্রে ভয় পাবি না তো?”
“যদি ভূত-টুত না আসে ভয় পাব না।”
“এলেও ভয় পাস নে-আমি পাশের ঘরে, দরজা খোলা। ডাক দিলেই চলে আসব। ভূতের বাবার বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেব।”
“ঠিক আছে আব্বু। একলা থেকে আমার অভ্যাস আছে।”
গভীর রাতে রূপার ঘুম ভেঙে গেল, ঘরের ভেতর মনে হচ্ছে। কনকনে শীত। কিন্তু রূপার সেজন্যে ঘুম ভাঙেনি-তার ঘুম ভেঙেছে অন্য কোনো কারণে কিন্তু কারণটা কী সে ধরতে পারছে না। তার কেন জানি মনে হতে থাকে খুব অশুভ একটা ব্যাপার ঘটেছে, কোনো একটা ভয়ংকর, মন খারাপ করা ব্যাপার কিন্তু সেটা কী সে ধরতে পারছে না। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে অকারণে সে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে, একবার তার ইচ্ছে করে আব্বুকে ডাকে কিন্তু তার সাহস হলো না। কম্বলের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাল,
ঘরের ভেতর আবছা অন্ধকার শুধু আয়নাটায় এক ধরনের ঔজ্জ্বল্য। মনে হয় এটি বুঝি আয়না নয়, এটি একটি অশরীরী জগতের দরজা-এর অন্যপাশে অন্য একটি অশুভ জগৎ। অসংখ্য অশরীরী প্রাণী যেন এ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে-ঘরের দরজা ভেঙে এই পৃথিবীতে প্রবেশ করার জন্যে অপেক্ষা করছে। রূপা কম্বল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে শুয়ে রইল, তার মনে হতে লাগল ঘরের ভেতরে কেউ একজন দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। অতৃপ্ত কোনো একজন মানুষের দীর্ঘশ্বাস। বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস। রূপা তার ভেতরে কম্বল দিয়ে নিজেকে আপাদমস্তক ঢেকে থরথর করে কাঁপতে লাগল।
নাস্তার টেবিলে শাহেদ জিজ্ঞেস করল, “রূপা, রাতে ভালো ঘুম হয়েছিল?”
“হ্যাঁ।” রূপা তার টোস্টে মাখন লাগাতে লাগাতে বলল, তবে”
“তবে কী?”
“রাত্রে যখন ঘরে ভূত এসেছিল তখন একবার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল।”
শাহেদ হাসি হাসি মুখে বলল, “এসেছিল নাকি ভূত? কেন এসেছিল-ভোট চাইতে? ভূতদের ওয়ার্ড কমিশনারের ইলেকশন হচ্ছে নাকি?”
রূপা গম্ভীর মুখে বলল, “না, আব্বু, মোটেও ঠাট্টা না। গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, ঘরের মাঝে তখন নিঃশ্বাসের শব্দ। আয়নাটা থেকে আলো বের হচ্ছে
শাহেদ হা হা করে হাসল তখন রূপারও পুরো ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হতে থাকে। তারপরও সে চেষ্টা করল, “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?”
“কে বলেছে করছি না?”
“তাহলে?”
“তাহলে কী?”
“তোমার মেয়ের ঘরে ভূত হাঁটাহাঁটি করে লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সেটা শুনে তোমার দুশ্চিন্তা লাগছে না?”
“লম্বা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দুঃখী ভূতেরা। এদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যদি খ্যাপা কিংবা বদরাগী ভূত আসে তখন দেখা যাবে!”
এরকম সময় গেটে গাড়ির শব্দ হলো, শাহেদের বন্ধু মতিন চলে এসেছে, ভূতের আলোচনাটা আপাতত বন্ধ হয়ে গেল।
শাহেদ যদিও বলেছিল সে দিনরাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প বই পড়বে, কিন্তু দেখা গেল হ্রদ এবং পুরনো বন্ধুকে পেয়ে তার নানারকম শখ চাগিয়ে উঠেছে। মাছ ধরার নানা ধরনের সরঞ্জাম কোথায় পাওয়া যায় সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো এবং দুপুরবেলার দিকে দুই বন্ধুকে গভীর মনোযোগ দিয়ে ছিপ পেতে মাছ ধরতে দেখা গেল। রূপা এর আগে কখনো কাউকে ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে দেখেনি-ব্যাপারটা কীভাবে করা হয় দেখার জন্যে সে প্রথমে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করল পৃথিবীতে এর চাইতে নিরুত্তেজক কোনো ব্যাপার হতে পারে না। দুজন বয়স্ক মানুষ একটি কথাও না বলে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনার দিকে তাকিয়ে ধৈর্য ধরে বসে থাকতে পারে, রূপা সেটা ভেবেই পেল না। খানিকক্ষণ গাছের ছায়ায় বসে থেকে শেষ পর্যন্ত রূপা বাসার ভেতরে ফিরে যায়। বিছানায় আধশোয়া হয়ে তার আব্বুর যে জিনিসটা করার কথা ছিল রূপা সেটাই করতে শুরু করে, একটা বই খুলে বসে। বইটি খানিকটা ঢিলেঢালা প্রকৃতির। পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে পড়ল তার মনে নেই।
তার ঘুম ভাঙল ঝুম দুপুরে, যখন কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছু কেমন যেন মন্থর হয়ে আসে। রূপা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখল আব্বুর বাল্যবন্ধু মতিন নেই, আব্বু একা গভীর মনোযোগ দিয়ে ফানার দিকে তাকিয়ে আছেন তবে আগের মতো শিরদাঁড়া সোজা নয়, খানিকটা হেলিয়ে পড়েছেন। রূপা বাইরে যাবে কী না চিন্তা করল, কিন্তু তার কেমন যেন আলস্য লাগল। এটা আসলেই পোড়োবাড়ি কী না কে জানে, কিন্তু পুরো বাসাটায় কেমন জানি একটি ছমছমে ভাব আছে, রাতের বেলা ঠিক বোঝা যায়নি, কিন্তু ভরদুপুরে সেটা কেমন জানি স্পষ্ট হয়ে এসেছে। রূপা বিছানায় হেলান দিয়ে মাথার কাছে তাক দেখে গতরাতের বইটা টেনে নেয়। প্রাচীন প্রেতচর্চার ওপরে বই, রাত্রিবেলা দেখতে ভয় ভয় করছিল, ভরদুপুরে দেখতে কোনো অসুবিধে নেই। বইটা খুলতেই হঠাৎ টুক করে একটা কাগজ নিচে পড়ল। রূপা নিচু হয়ে কাগজটা তুলে নেয়। রুল টানা একটা ভাজ করা কাগজ। ভাঁজ খুলতেই দেখা গেল একজনের কঁচা হাতে লেখা। রূপা কৌতূহল নিয়ে পড়ে :
দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, ডান হাতের ওপর বাম হাত বুকের ওপর ক্রস করে।
চেপে রাখ। চোখ বন্ধ করে সাঁইত্রিশবার মৃত মানুষের নাম উচ্চারণ
করো। চোখ খুলে আয়নার দিকে তাকাও, দৃষ্টি নিবদ্ধ করো বহু দূরে।
পেছনের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে মিলিয় যাবে। তখন আয়নায় নিজের মুখের দিকে তাকাও, মৃত মানুষের মুখ। দেখতে পাবে। নিশিরাত্রিতে অনুজ্জ্বল আলো সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি।
রূপা খানিকটা বিস্ময় নিয়ে হাতে লেখা কাগজটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কে লিখেছে এটা? কেন লিখেছে? একজন মৃত মানুষের নাম সাঁইত্রিশবার উচ্চারণ করলেই তাকে দেখা যাবে? চেষ্টা করে দেখবে?
রূপা বড় বেলজিয়াম কাঁচের তৈরি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দুই হাত বুকের ওপর চেপে ধরে চোখ বন্ধ করল। এখন একজন মৃত মানুষের নাম সাঁইত্রিশবার উচ্চারণ করতে হবে? কে আছে পরিচিত মৃত মানুষ? এ বাসায় থাকতো যে মানুষটি তাকে ডাকলে কেমন হয়? রূপা মনে মনে উচ্চারণ করল, “সেলিম সেলিম সেলিম–” করে আঙুলে হিসাব করে সাঁইত্রিশবার ডেকে রূপা চোখ খুলে তাকাল, আয়নার সামনে সে দাঁড়িয়ে আছে। না, কোনো মৃত মানুষের মুখ নয় আয়নায় তার নিজের মুখই দেখা যাচ্ছে। রূপা নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চমকে ওঠে, তার নিজেকে হঠাৎ করে অপরিচিত মানুষের মতো লাগছে কেন? সে বিস্ফারিত চোখে নিজের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, মুখের আদল বদলে যাচ্ছে তার, এলোমেলো চুল বাতাসে উড়ছে। ধীরে ধীরে তার মুখমণ্ডল পালটে যাচ্ছে কঠিন একটা মুখে। চোখের দৃষ্টি তীব্র, মনে হয় শুধু দৃষ্টি দিয়েই বুকের ভেতর ছিন্নভিন্ন করে দেবে। মুখের কোনায় নিষ্ঠুর ক্রুর একটা হাসি। কে এই মানুষটি? কোথা থেকে এসেছে?
হঠাৎ করে অমানুষিক একটা আতঙ্ক এসে ভর করে রূপার ওপরে। চাপা একটা আর্তচিৎকার করে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল সে, তার নিজের মুখের দিকে তাকানোর সাহস নেই আর। কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে, ফিসফিস করে নিজেকে বলল, ভুল দেখছি আমি। ভুল। ভুল। আবার চোখ খুলে তাকালে দেখবে কেউ নেই। পরিষ্কার দিনের বেলা, বাইরে ঝকঝকে রোদ এর মাঝে ভয়ের কিছু নেই। ভয়ের কিছু থাকতে পারে না। রূপা আবার চোখ খুলে নিজের দিকে তাকাল, সত্যি কেউ নেই, সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ভীত এবং আতঙ্কিত।
রূপা কাগজটা বইয়ের নিচে চাপা দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো, তার শরীর তখনো থরথর করে কাঁপছে।
রূপা যখন হ্রদের তীরে পৌঁছাল তখন সেখানে তুলকালাম কাণ্ড ঘটছে। শাহেদের ছিপে একটা বিশাল মাছ আটকা পড়েছে, সুতো টেনে সেই মাছ হ্রদের ভেতরে ছুটে যাচ্ছে, কড় কড় শব্দ করে হুইল ঘুরছে। শক্ত করে ছিপ ধরে রেখে শাহেদ হুইল ঘুরিয়ে খেলিয়ে মাছটাকে কাছে আনার চেষ্টা করছে। কাজটি নিশ্চয়ই সহজ নয়, একটু অসতর্ক হলেই সুতো ছিঁড়ে মাছ ছুটে পালিয়ে যাবে। প্রায় মিনিট দশেক খেলিয়ে শাহেদ শেষ পর্যন্ত মাছটাকে তুলে আনে, বিশাল একটা মৃগেল মাছ, খাবি খেতে খেতে ছটফট করছে! শাহেদ রাজ্য জয় করার ভঙ্গি করে মাছটির কানকো ধরে উঁচু করে রূপাকে বলল, “দেখলি? দেখলি কীভাবে ধরেছি?” রূপা এসেছিল তার নিজের কথা বলতে, কিন্তু এখন মাছ ধরার উত্তেজনায় সেটা বলার সুযোগ পেল না। ক্যামেরা আনা হলো এবং মাছটিকে নানা ভঙ্গিতে ধরে ছবি তোলা হলো। ছিপ দিয়ে এত বড় একটা মাছ ধরার পর সেটা নিশ্চয়ই সবাইকে দেখানোর ইচ্ছে করে, কাজেই কিছুক্ষণের মাঝেই শাহেদ রূপাকে এবং সেই বিশাল মৃগেল মাছ নিয়ে তার বন্ধু মতিনের বাসায় রওনা হলো।
মৃগেল মাছটিকে দেখিয়ে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে শাহেদ যখন রূপাকে নিয়ে তার বাসায় ফিরে এলো, তখন গভীর রাত। ঘরে ঢুকে শাহেদ হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “রূপা মা তুই আজকে হঠাৎ এত চুপচাপ কেন?”
রূপা দুর্বলভাবে মাথা নেড়ে বলল, না কিছু না।”
“কিছু না মানে কী?” শাহেদ ভুরু কুঁচকে বলল, “তোর শরীর খারাপ নাকি?”
“না। শরীর ঠিকই আছে।”
“তাহলে?”
“না, মানে ইয়ে–” ইতস্তত করে সে বলেই ফেলল, “দুপুরবেলা আজকে হঠাৎ ভয় পেয়েছিলাম।”
শাহেদ অবাক হয়ে বলল, “কী দেখে ভয় পেয়েছিলি?”
“আয়নায় একটা মানুষ—”
“আয়নায় মানুষ?” শাহেদ কিছু বুঝতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, “কোন আয়নায়? কী মানুষ?”
রূপা একটু বিষণ্ণ মুখে বলল, “একটা বইয়ের ভেতরে হাতে লেখা কাগজ ছিল। সেই কাগজে লেখা ছিল—”
“কী লেখা ছিল?”
“লেখা ছিল কোনো মৃত মানুষের নাম সাঁইত্রিশবার বললে তাকে আয়নায় দেখা যাবে।”
শাহেদ কঠিন মুখে বলল, “আর তুই সাঁইত্রিশবার কারো নাম বলে সেই মানুষটিকে দেখেছিস?
রূপা মাথা নাড়ল। শাহেদ হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, “তুই আমাকে এই কথাটা বিশ্বাস করতে বলিস?”
রূপা কাতর গলায় বলল, “আব্বু, তুমি বিশ্বাস করো, আমি সত্যি দেখেছি।”
“কাকে দেখেছিস?”
“এই বাসায় যে মানুষটি মারা গিয়েছিল তাকে, নাম মনে হয় সেলিম।”
শাহেদ কী বলবে বুঝতে পারল না, এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে সে রূপার দিকে তাকিয়ে রইল। রূপা করুণু মুখে বলল, “আব্বু, হতে পারে পুরো জিনিসটা ভুল। কিন্তু আন্ধু তুমি বিশ্বাস করো
আমার ভয়টা ভুল না। আমার ভয়টা সত্যি।”
শাহেদ এগিয়ে গিয়ে রূপাকে শক্ত করে ধরে বলল, “ধুর পাগলি মেয়ে, ভয় পাবার কী আছে? আমি আছি না?”
রূপা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, “আমার ভয় করছে, আব্বু। আমি আজকে তোমার সাথে ঘুমাব।”
“ঠিক আছে।”
“আমি আর এই ঘরে থাকব না–তোমার ঘরে থাকব।”
শাহেদ হেসে বলল, “তুই যদি চাস তাহলে তাই করিস। কিন্তু আমি একটা কথা বলি।”
“কী কথা?”
“কখনো কোনো কিছু নিয়ে ভয় পেলে সেটাকে পাশ কাটিয়ে যেতে হয় না, তার মুখোমুখি হতে হয়। নিজের কাছে প্রমাণ করতে হয় ব্যাপারটি মিথ্যা। তুই যদি এখন এই ঘরে না ঘুমিয়ে আমার ঘরে ঘুমাস তাহলে সারা জীবনের জন্যে ভীতু হয়ে যাবি!” না।
রূপা প্রশ্নের ভঙ্গিতে শাহেদের দিকে তাকাল, জিজ্ঞেস করল “তার মানে কী?”
“তোকে আজকে এই ঘরেই ঘুমাতে হবে।” রূপা ভয় পেয়ে মাথা নাড়ল, “না।”
“তোর কোনো ভয় নেই, তোকে একা থাকতে হবে না। আমি তোর সাথে থাকব।”
“রাত্রে আমার সাথে ঘুমাবে তো?”
“হ্যাঁ। রাত্রে তোর সাথে ঘুমাব।”
“সব সময় আমার সাথে থাকবে তো?”
“সব সময় তোর সাথে থাকব।” রূপার মুখে একটু হাসি ফুটল, বলল, “ঠিক আছে তাহলে।”
রূপা বিছানায় শুয়েছে, শাহেদ তার পাশে বালিশে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছে। বেশ রাত হয়েছে, খুব সহজে রূপার চোখে ঘুম আসে নি, অনেকক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছটফট করে শেষ পর্যন্ত শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে। শাহেদ এক ধরনের স্নেহ নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল, দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেছে। পনেরো বছরের বাড়ন্ত মেয়ে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথায় জানি এখনো একটা বাচ্চার মতো। এই ভয় পাওয়ার ব্যাপারটিই ধরা যাক–এত বড় একজন মানুষ কী দিনদুপুরে এরকম ভয় পেতে পারে? শাহেদ আপন মনে একটু হেসে আবার তার বইয়ে মন দিল।
রূপা ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বলে বিছানায় পাশ ফিরে শুলো, শাহেদ কম্বলটা দিয়ে তাকে ভালো করে ঢেকে দেয়-শাহেদ হঠাৎ লক্ষ করে ঘরটা কেমন জানি অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা শুধু যে ঠাণ্ডা তাই নয়, ঘরটায় কেমন জানি বিচিত্র এক ধরনের নিস্তব্ধতা। শাহেদ এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করে। হঠাৎ করে তার কেমন জানি অস্থির লাগছে। ভেতরে ভেতরে একটা চাপা ভয় আর আতঙ্ক এসে ভর করতে শুরু করেছে। শাহেদ জোর করে মাথা থেকে সবকিছু সরিয়ে দিয়ে তার বইয়ে মন দিল আর ঠিক তখন খুব কাছে কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল। শাহেদ চমকে উঠে মাথা তুলে তাকাল তার স্পষ্ট মনে হলো কেউ একজন সামনে থেকে সরে গেছে! কিন্তু এখানে সরে যাবার কোনো জায়গা নেই, পুরোটাই তার মনের ভুল। শাহেদ জোর করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। রূপার মতো সেও যদি ভয় পেতে শুরু করে তাহলে তো মুশকিল!
ঠিক তখন দূরে কোনো একটা ঘরে দরজা খোলার শব্দ হলো। শাহেদ চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে?”
কোনো উত্তর নেই, কিন্তু সে স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনল। এত রাত্রে কে আসবে এখানে? বাসার বয়, বাবুর্চি এবং ড্রাইভার নিচের ঘরে থাকে। ওপরে ওঠার সিঁড়িটা সে নিজের হাতে বন্ধ করে এসেছে। শাহেদ আবার অন্য একটা দরজা খোলার শব্দ শুনল, এবারে ঠিক পাশের ঘরে। কাঁচ কাঁচ শব্দ করে দীর্ঘ সময় নিয়ে দরজাটি খুলল আবার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ করে দরজাটি বন্ধ হলো।
শাহেদ রূপার দিকে তাকাল, শান্ত হয়ে গুটিশুটি মেরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটি। সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, পাশের ঘরে কে এসেছে দেখা দরকার। শাহেদ ঘরের দরজা খুলে পাশের ঘরে গেল, ঘরটি খালি, কেউ কোথাও নেই। কী আশ্চর্য, সে কী স্পষ্ট শুনতে পেল কেউ একজন দরজা খুলে এসে ঢুকেছে। শাহেদ খানিকটা হতচকিত হয়ে আরো কয়েক পা অগ্রসর হয়ে ঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়াল এবং তখন হঠাৎ করে রূপার ঘরের দরজাটি শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। স্পষ্ট মনে হলো কেউ একজন টেনে দরজাটি ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে।
শাহেদ ছুটে গিয়ে দরজার পাল্লা ধরে টেনে খোলার চেষ্টা করল কিন্তু সেটা শক্ত করে বন্ধ। ভেতরে রূপা একা। শাহেদ দরজায় হাত দিয়ে শব্দ করে চিৎকার করে ডাকতে থাকে, “রূপা, রূপা।”
ভেতরে হুটোপুটির মতো এক ধরনের শব্দ হলো, মনে হলো ফিসফিস করে চাপা গলায় কেউ কথা বলছে। শাহেদ আবার দরজায় ধাক্কা দিল এবং ঠিক তখন ভেতরে রূপার ভয়ংকর আর্তচিৎকার শুনতে পেল।
শাহেদ ভয়ে-আতঙ্কে পাগলের মতো হয়ে গেল, সমস্ত শক্তি দিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে চিৎকার করতে থাকে, “রূপা, রূপা, মা, দরজা খুলে দে–”
শাহেদ শুনতে পেল ভেতরে রূপা আকুল হয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “পারব না আব্বু।”
“কেন পারবি না?”
“দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে যেতে দেবে না।” ভয়ংকর আতঙ্কে রূপা চিৎকার করতে থাকে। অমানুষিক চিৎকার।
শাহেদ দরজায় আবার ধাক্কা দিল, শক্ত কাঠের দরজা সে ভাঙতে পারবে না। এটা ভাঙার জন্যে শাবল, কুড়াল কিছু একটা লাগবে। শাহেদ ছুটে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে চিৎকার করতে করতে নিচে নামতে থাকে, বাবুর্চির ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিতেই ভীত মুখে সে দরজা খুলে দিল, কঁপা গলায় বলল, “কী হয়েছে সাহেব?”
“একটা কুড়াল না হলে শাবল। তাড়াতাড়ি।”
“কেন সাহেব?”
“দরজা ভাঙতে হবে”–শাহেদ অধৈর্য হয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি। আমার মেয়ে আটকা পড়েছে।”
বাবুর্চি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “লা ইলাহা ইল্লাল্লা—”
শাহেদ চিৎকার করে বলল, “তাড়াতাড়ি দাও। কোথায় আছে?”
“দানো এসেছে সাহেব। এই বাড়িতে দানো থাকে। আমি জানি। ছাড়বে না–কাউকে ছাড়বে না–”
শাহেদ বাবুর্চির কাধ আঁকড়ে ঝাঁকুনি দিতে দিতে হিংস্র গলায় বলল, “এক্ষুনি দাও আমাকে না হলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।”
“দেই সাহেব, দেই–” বাবুর্চি কাঁপতে কাঁপতে স্টোর রুম থেকে একটা লাকড়ি কাটার কুড়াল এনে দিল।
শাহেদ কুড়াল নিয়ে আবার ছুটতে ছুটতে ওপরে উঠে গেল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, “রূপা মা, কোনো ভয় নেই মা। আমি আসছি।”
ভেতর থেকে শুধু একটা চাপা গোঙানির মতো শুনতে পেল শাহেদ। কুড়াল হাতে নিয়ে সে দরজাটা কোপাতে শুরু করল। কিছুক্ষণেই ছিটকিনি ভেঙে সে ভেতরে ঢুকে যায়। ঘরের ভেতর ভয়ংকর ঠাণ্ডা, শাহেদের সমস্ত শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। বিছানার এক কোনায় রূপা গুটিশুটি মেরে বসে আছে, তার চোখে-মুখে অবর্ণনীয় আতঙ্ক, অপ্রকৃতিস্থের মতো সে থরথর করে কাঁপছে। শাহেদ একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ করে পুরো বিছানাটি থরথর করে কাঁপতে থাকে, রূপা কাতর গলায় চিৎকার করে বলল, “ আমার ভয় করছে আব্বু! ভয় করছে।”
“তোর কোন ভয় নেই। আমি এসে গেছি।” শাহেদ বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আয় মা আমার কাছে।”
রূপা মাথা নাড়ল, “আমি আসতে পারছি না আব্বু।”
“কেন আসতে পারছিস না?”
“আমাকে আসতে দিচ্ছে না! আমাকে ধরে ফেলেছে আব্বু-ধরে ফেলেছে!” রূপা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে।
রূপা হঠাৎ থরথর করে কাঁপতে থাকে, তার সারা শরীরে খিচুনি হতে থাকে, হাত-পায়ের আঙুলগুলো বাঁকা হয়ে আসে, মুখ থেকে ফেনা বের হয়ে আসে, সে বিছানায় লম্বা হয়ে পড়ে যায়। সারা শরীর মোচড় দিতে থাকে, দেখে মনে হয় কেউ যেন তার পলকা শরীরটাকে ধরে মুচড়ে দিচ্ছে। ভয়ংকর যন্ত্রণায় সে আর্তনাদ করতে থাকে। শাহেদ রূপার কাছে যেতে চাইল কিন্তু হঠাৎ করে বইয়ের তাক থেকে একটা ভারি বই ছুটে এসে তার মুখে আঘাত করল, এক মুহূর্তের জন্যে শাহেদ চোখে অন্ধকার দেখল। শাহেদ শক্ত হাতে কুড়ালটা ধরে চারিদিকে তাকাল, ঘরে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যায় কেউ একজন আছে। শাহেদ ফিসফিস করে বলল, “আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও। ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে।
চাপা একটা হাসির শব্দ শুনতে পেল শাহেদ এবং হঠাৎ করে টেবিল ল্যাম্পটা ছিটকে নিচে পড়ে মুহূর্তে ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত কিছু দেখতে পায় না শাহেদ, অন্ধকারে চোখ অভ্যস্ত হবার পর আবছা আবছাভাবে আবার সবকিছু দেখতে পেল। বিছানায় শুয়ে থরথর করে কাঁপছে রূপা। দেয়ালে বড় আয়না-এবং ঘরের মাঝামাঝি জমাটবাঁধা অন্ধকারের মাঝে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।
শাহেদ আবার ফিসফিস করে বলল, “ছেড়ে দাও আমার মেয়েকে। আল্লাহর কসম লাগে—”
ঘরের ভেতরে হঠাৎ যেন বাতাসের একটা হলকা ছুটে গেল, দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে কেউ যেন টানা গলায় বলল, “না-না-না।”
ঘরের মাঝামাঝি জমাটবাঁধা অন্ধকারটি হঠাৎ করে নড়ে ওঠে। শাহেদ দেখতে পেল সেটি রূপার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রূপার সমস্ত শরীরটি থরথর করে কাঁপছে। আবছা অন্ধকারে দেখা যায় শরীরটি বিছানা থেকে খানিকটা ওপরে উঠে এসেছে, মনে হয় বাতাসে ভাসছে।
শাহেদ আবার রূপার কাছে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই বইয়ের তাক থেকে বইগুলো তার দিকে ছুটে আসে, প্রচণ্ড আঘাতে তার মুখ কেটে যায়, সে ছিটকে নিচে গিয়ে পড়ল। কোনোমতে সে উঠে দাঁড়াল টলতে টলতে আবার সে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু একটা চেয়ার হঠাৎ সশব্দে প্রায় উড়ে এসে তাকে প্রচণ্ড আঘাত করে ফেলে দিল। ওঠার চেষ্টা করল শাহেদ কিন্তু উঠতে পারল না।
একটা ভয়ংকর হতাশা এসে হঠাৎ করে শাহেদকে গ্রাস করে। ভয় নয়, আতঙ্ক নয় একটি গভীর বেদনা-তার আদরের মেয়েটাকে কী তাহলে সে বাঁচাতে পারবে না?
একটা বিদেহী দানব এসে তার মেয়েকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেবে?
শাহেদ আয়নার সামনে উবু হয়ে পড়ে আছে, কোনোমতে আয়নাটা ধরে ওঠার চেষ্টা করল! রূপা বলেছিল এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো মৃত মানুষের নাম সাঁইত্রিশবার বললেই সে নাকি দেখা দেয়-তার কথা তখন সে বিশ্বাস করেনি। এখন কী সে বিশ্বাস করবে?
হঠাৎ করে তার মালার কথা মনে পড়ল। তার ভালোবাসার স্ত্রী, রূপার জন্মদাত্রী মা!
মালা কী তার মেয়েকে বাঁচাতে পারবে না? মালাকে কী সে ডেকে আনতে পারে না? সাঁইত্রিশবার তার নাম উচ্চারণ করে?
শাহেদ দুই হাত বুকের ওপর চেপে ধরে ফিসফিস করে ডাকল, “মালা, মালা, মালা-তুমি এসো তোমার মেয়ের আজ খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ—”
শাহেদ চোখ বন্ধ করে, মালাকে ডাকল তারপর চোখ খুলে তাকাল। আবছা অন্ধকারে আয়নার মাঝে একজন মহিলার ছবি, কী আশ্চর্য! সত্যি মালা এসেছে? শাহেদ ফিসফিস করে বলল “ মালা? তুমি এসেছ?”
“হ্যাঁ শাহেদ!”
“তোমার মেয়ের খুব বিপদ মালা। খুব বিপদ।”
জানি। আমি জানি।”
“তুমি তাকে বাঁচাও মালা। দোহাই তোমার–”
“এই আয়নাটা তুমি ভেঙে দাও।”
“ভেঙে দেব?”
“হ্যাঁ। ভেঙে টুকরো টুকরো করে দাও।”
“টুকরো টুকরো করে দেব?”
“হ্যাঁ। এই আয়নাই হচ্ছে তার শক্তি। ভাঙো-দেরি করো না শাহেদ। তাড়াতাড়ি ভাঙো।”
শাহেদ হাতড়ে হাতড়ে কুড়ালটা হাতে নিয়ে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, তারপর টলতে টলতে প্রচণ্ড আঘাতে ছাদ সমান উঁচু বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নাটি ভেঙে দিল।
ঝনঝন শব্দ করে কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে নিচে পড়ল আর সাথে সাথে একটা অমানুষিক আর্তনাদ বাতাসের মাঝে পাক খেতে থাকে। আর্তনাদটি ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাসের মতো হয়ে আসে, ঘরের মাঝে বার কয়েক প্রতিধ্বনিত হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে ঘরের মাঝে সুনসান নীরবতা-কোথাও এতটুকু শব্দ নেই, এই ঘরে কোনো জীবিত প্রাণী আছে বলে মনে হয় না।
ঠিক তখন রূপা যন্ত্রণার মতো একটা শব্দ করল, শাহেদ সাথে সাথে সম্বিত ফিরে।
পায়, টেবিল ল্যাম্পটা তুলে জ্বালিয়ে দিয়ে সে রূপার কাছে ছুটে গেল। রূপা বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে, শাহেদ সোজা করে নিজের কাছে টেনে আনে, মুখে হাত বুলিয়ে ডাকে, রূপা, মা আমার!”
রূপা চোখ খুলে তাকাল, মাথা ঘুরিয়ে চারপাশ তাকিয়ে সে দুই হাতে শাহেদকে
জড়িয়ে ধরে হঠাৎ আকুল হয়ে কেঁদে ফেলল। শাহেদ রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আর কোনো ভয় নেই মা কোনো ভয় নেই।”
রূপা কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি কেন আমাকে একা ছেড়ে গিয়েছিলে?”
“আর যাব না মা, কখনো যাব না।”
রূপা চোখ মুছে বলল, “তোমার কপালে রক্ত।”
“ও কিছু না। একটু কেটে গেছে। তুই ঠিক আছিস তো?”
“হা আব্বু। আমি ঠিক আছি।”
“তোর কী এখনো ভয় করছে?”
“না আব্বু আর ভয় করছে না। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “শুধু খুব টায়ার্ড লাগছে।”
“ঠিক আছে, তাহলে তুই ঘুমিয়ে যা। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যা। আমি
তোকে পাশের ঘরে নিয়ে যাই।
“ঠিক আছে আব্বু।” বলে রূপা হঠাৎ গভীর ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল।
শাহেদ ফিসফিস করে বলল, “শুধু একবার চোখ খুলে তাকা।”
“রূপা চোখ খুলে বলল, কেন আব্বু?”
“এই ঘরে তোর আম্মু এসেছে।”
রূপার চোখ বড় বড় হয়ে গেল, সোজা হয়ে বসে বলল, “তুমি কেমন করে জানো?”
“আমি ডেকে এনেছিলাম!”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ। কিছু বলবি না তোর আম্মুকে?
“বলব আব্বু।” রূপা এদিক-সেদিক তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু বলতে
পারল না, সে ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মু, তুমি
আমাদের ছেড়ে চলে গেলে কেন, কেন চলে গেলে?”
আম্মু কী বলেছে শাহেদ আর রূপা শুনতে পেল না। কিন্তু তারা দুজনেই জানে আম্মু বলছে সে তাদের ছেড়ে যায় নি।
সে তাদের সাথেই আছে।
সব সময়েই থাকবে।