না বলা কথা
আমি অনিমেষ রায়। আমার বাবা ছিলেন কাঠমিস্ত্রি। একটা চটের থলেতে থাকত – বাবার করাত, রাঁদা, বাটালি, স্ক্রু-ড্রাইভার, একটা কৌটোয় ছোট বড় নানা আকারের পেরেক, স্ক্রু ছাড়াও থলেতে থাকত লোহা-ঘষা ও কাঠ-ঘষা শিরিস কগজ এবং নানা টুকিটাকি জিনিষ। থলিটা রাখা থাকত খাটের নীচে।
বাবা সকালে উঠে বাথরুম সেরে, স্নান করে নিতেন। তার আগেই মা বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তেন। মা বাসি কাপড় ছেড়ে বাবার জন্য গুড়ো দুধ দিয়ে একগ্লাস চা করে দিতেন। বাবার চায়ের জন্য বড় একটা কাচের গ্লাস ছিল।
আগের দিন রাতেই মা, আমাদের সকালের টিফিনের জন্য আটার রুটি বানিয়ে রাখতেন। তার থেকে চারখানা রুটি বের করে নিয়ে কোরোসিন স্টোভে তা গরম করে নিতেন।
তার থেকে দু’খানা চায়ের সঙ্গে বাবাকে খেতে দিতেন। আর দু’খানা একটা প্লাস্টিক টিফিন বক্সে ভরে, তার সঙ্গে লঙ্কা পিয়াজ কালোজিরা দিয়ে দু’টো মাঝারি আকারের আলুর চচ্চরি করে তাতে ভরে দিতেন, দুপুরে খাওয়ার জন্য। বাবা সকালের টিফিন সেরে, একটা খাঁটো ধুতি আর ফতুয়া পরে, মার দেওয়া টিফিন বাক্সটা, খাটের নীচ থেকে চটের থলিটা বের করে তা’তে ভরে নিতেন। তারপর ফতুয়াটা গায়ে পরে, ফতুয়ার ডান পকেটে এক বান্ডিল বিড়ি, আর বাঁ পকেটে একটা দেশলাই ভরে নিয়ে, মাকে আসি বলে, কাজে বেরিয়ে যেতেন। বাবার কাজ সেরে ফিরতে ফিরতে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে যেত কোনও কোনও দিন।
বাবা এক ধুতি ফতুয়া পরের দিন পরে যেতেন না। বাবা বাড়ি ফিরে এলে, তাই মাকে সেগুলি নিয়ে বিকেলের মধ্যেই কেঁচে দিতে হতো। ঘরের বাইরে একটা দড়ি টাঙানো ছিল। তাতে সেগুলি মেলে দিতেন। সারা রাত হাওয়া লেগে ধুতি ফতুয়া শুকিয়ে যেত। শীত বর্ষার দিনে একটু অসুবিধা হতো ঠিকই। তবে সে সব দিনগুলির জন্য বাবার আর এক সেট তোলা ফতুয়া ধুতি থাকত। মা সেগুলি টিনের ট্রাঙ্ক খুলে বের করে দিতেন বাবাকে।
বর্ষার বেশির ভাগ দিন বাবা বাইরে কাজে বের হতেন না। কারণ সে সব দিনে কাঠের কাজ তেমন হতো না।
কাজ সেরে ফেরার সময়, ফতুয়ার ডান পকেটের বিড়ির বান্ডিল শেষ হয়ে যেত। সেখানে থাকত বাবার প্রাপ্য মজুরীর টাকা-পয়সা। আর বাঁ পকেটে দেশলাইটা ঠিকই পড়ে থাকত।
যেখানে কাঠের কাজ করতেন, সেখানে কাজ করার পর যে বাড়তি ছোট ছোট কাঠের টুকরোগুলি পড়ে থাকত, তা বাবা তাদের বলে, চটের থলিতে ভরে বাড়ি নিয়ে আসতেন।
রথের মেলার আগে, বাবা বাড়িতে বসে সেগুলি দিয়ে আমার জন্য একটা ছোট সুন্দর রথ তৈরী করে দিতেন। তখন আমার বয়স দশ-বারো বছর হবে। সত্তর সালের কথা।
রথের দিন সেই রথ নিয়ে আমি পাড়ার রাস্তায় বের হতাম। মা তাতে দুটো থালা নিয়ে, একটায় নকুল বাতাসা আর অন্যটায় প্রণামী লিখে রেখে দিতেন। আমার পরের বোন চিনু আমার সঙ্গে যেত। যেতে যেতে সে সকলকে থালা থেকে তুলে নকুল বাতাসা দিত। কেউ কেউ প্রণামীর থালায় সিকি আদুলি দিতেন। নকুল বাতাসার থালা যত খালি হত আর তত ভরে উঠত প্রণামীর থালা।
সেই সব টাকা পয়সা জমিয়ে উল্টো রথের মেলার দিন জগন্নাথকে ভোগ দেওয়া হত। সেই ভোগ নেবার জন্য পাড়ার অনেক লোকই আমাদের বাড়িতে আসত।
এসব অতীত দিনের কথা। তবু আমার স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও তা উজ্জ্বল ঞয়ে আছে।
এখন আমার বয়স সত্তর বছর। বাবা মা কেউই আমার মতো এত বছর বেঁচে ছিলেন না।
রথটা এখনও আমাদের বাড়িতে যত্ন করে রাখা আছে, অমূল্য স্মৃতি স্বরূপ।
বাবা লেখাপড়া জানতেন না। মা তবুও সেই আমলে ক্লাস সেভেন অবধি পড়ে ছিলেন। মূলতঃ মায়ের আগ্রহেই বাবা ওই কাঠের কাজ করেই আমাদের মাধ্যমিক উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে কলেজ পর্যন্ত ভর্তি করিয়ে ছিলেন। আমি সিটি কলেজ থেকে বি কম পাশ করে একটা সরকারি অফিসে কেরানির চাকরি পেয়ে যাই। বোন দু’টির একটি তখন উচ্চ-মাধ্যমিক দেবে, অন্যটি পরের বছর মাধ্যমিক দেবে।
আমি চাকরি পেয়েই বাবাকে কাঠের কাজ ছেড়ে দিতে বলি। বাবা তাতে রাজি হয় না। আমাকে বলে, কাজ-কর্ম না করে ঘরে বসে থাকলে আমি অথর্ব হয়ে পড়ব। তারচেয়ে যতদিন পারি কাজ করি। তার পর না পাড়লে তো ছেড়েই দেব।
দেখতে দেখতে আমার পরের বোনটাও উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে গেল। ভর্তি হল মূরলীধর কলেজে। সে যখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, বাবা তখন এক ঘটক মারফৎ সম্বন্ধ আমায় তার বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলে শ্রীরামপুর থাকে। নাম অমিয় সাহা। পোষ্ট অফিসে চাকরি করে।
মা তখন আমার বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চেনা-শোনা আত্মীয়-স্বজনদের আমার জন্য মেয়ে দেখতে বলেন। দেখা-শুনা চলতে থাকে। কথা-বার্তার আদান প্রদান শুরু হয়। এই করেই দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে যায়।
বাবা একদিন কাঠের কাজ সেরে বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে মাকে বলল, আমার বুকের বাঁদিকটা কেমন ব্যথা করছে। বোধহয় রুটি তরকারী খেয়ে আজ গ্যাস-অম্বল হয়েছে। তুমি একটু সরষের তেল মেখে দাও তো বুকে। মা তার কথা শুনে, তখনই রান্নাঘর থেকে সরষের তেলের বোতল এনে, বাবার বুকে তেল মালিশ করে দিতে থাকে। কিন্তু ব্যথার কমার কোন লক্ষণ দেখা যায় না। বরং ব্যথা আরও বেড়েই চলে। ব্যথাটা বুক থেকে সরে, ঘাড় ছুঁয়ে পিঠের পিছন দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমি তখন অফিসে।
মা বাবার ওই অবস্থা দেখে অসহায় হয়ে আমাকে ফোন করে করেন। ফোন করে বলেন, তুই এখনই বাড়ি চলে আয়। তোর বাবার শরীরটা তেমন ভাল না।
– বাবার আবার কি হলো?
– জানি না। তুই এখনই চলে আয় বাড়ি।
– আচ্ছা, বলতেই মায়ের দিক থেকে ফোন কেটে গেল।
আমি সব ফাইল গুছিয়ে, আলমারিতে ভরে রেখে, অফিস থেকে বেরিয়ে এলাম। চট করে একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ি চলে এলাম। বাড়ি এসে বাবার অবস্থা দেখে, সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে একটা এম্ব্যুলেন্স ডেকে,তা’তে করে বাবাকে নিয়ে বাঙুর হাসপাতাল চলে এলাম। সেখানে বাবাকে দেখে ভর্তি করে নিল। ডাক্তারের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, বাবার হার্টের অবস্থা ভাল নয়।
সেখানেই তিন দিন ভর্তি ছিলেন। চতুর্থ দিন হার্টফেল করে মারা যান বাবা। তিনি আমার বিয়ে দেখে যেতে পারেননি।
বাবা যখন মারা গেল, তখন আমাদের বাঁশের বেড়ার বাড়ি, টালির খোলার চাল ছিল। ছোট বোন সেবারই উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।
এখন আমাদের দোতলা পাকা বাড়ি।
দোতলার উপরে একটা ঠাকুর ঘর আছে। সেখানে, অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে বাবার তৈরী রথটাও স-যত্নে রাখা আছে। উল্টো রথের দিন আজও বাড়িতে জগন্নাথের ভোগের আয়োজন করা হয়। তবে আগের মতো আর রথ নিয়ে পাড়ার রাস্তায় বের হওয়া হয় না।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা কেমন একা হয়ে গেছেল। বেশির ভাগ সময়ই ঠাকুর ঘরে, ঠাকুর-দেবতা নিয়ে কাটাতেন।
বাবা মারা যাওয়ার একবছর পর আমার বিয়ে হয় রমার সাথে। ওদের বাড়ি টালিগঞ্জ করুণাময়ীতে। ওর বাবা ট্রাম কোম্পানীতে চাকরি করে। মা মরা মেয়ে। একাই সংসার সামলাত। মাকে সংসারের কোন কাজ করতে দেয় না রমা। সবই নিজের হাতে একা করে। এমন সংসারী মেয়ে পেয়ে মা খুব খুশি।
ততদিনে ছোট বোনটা আমার উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ করে বাসন্তীদেবী কলেজে ভর্তি হয়ে গেছে।
আমার বিয়েতে অফিসের কয়েকজন কলিগ এসেছিল বউভাতের দিন। তাদের মধ্যে সমীর সরকারও ছিল। আমাদের অফিসের জুনিয়র ক্লার্ক। আমার ছোট বোনকে সেদিন দেখে সে মুগ্ধ হয়ে পড়ে।
বিয়ের কয়েকদিন পর আমি অফিসে জয়েন করি। সেদিন সমীর এসে আমাকে বিনীতভাবে জানায় যে, সে আমার ছোট বোনকে বিয়ে করতে চায়। আমি তাকে বলি, বেশ। আমি তবে এ ব্যাপারে মায়ের সাথে কথা বলে দেখি, মা কি বলে।
সমীর সে কথা শুনে আমাকে বলে, মাকে আপনার রাজী করাতেই হবে, আমি কিছু আর জানি না। বলে সে সেদিন চলে যায়।
বাড়ি ফিরে মাকে খবরটা বলি। মা শুনে বলল, ভাল করে খোঁজ খবর নিয়ে দেখ, ছেলে কেমন, তারপর বিয়ে ঠিক করিস। চিনুর মতো যেন না হয়। চিনু আমার পরের বোনের নাম, ভাল নাম চিন্ময়ী। বাবা যার বিয়ে দিয়ে গেছিলেন, শ্রীরামপুরের বাসিন্দা সেই অমিয় সাহার সঙ্গে। ঘটক মারফৎ সম্বন্ধটা এসেছিল বাবার কাছে। ছেলে পোষ্ট অফিসে কাজ করে মানে সরকারি অফিসে চাকরি করে জেনে, আমার সহজ সরল বাবা আর কোন খোঁজ খবর না নিয়েই চিনুর বিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের অমিয়র সঙ্গে।
আমার ছোট বোনের নাম মিনু। ভাল নাম মৃন্ময়ী। সমীর সরকারের সঙ্গে যার বিয়ের কথা ভাবা হচ্ছে এখন। তার যেন সে রকম অবস্থা না হয়, সে কথাই মা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। আমিই সবার বড়। আমার নাম অনিমেষ। ডাক নাম অনি।
চিনুর কি হয়েছিল বিযের পর?
বিয়ের একমাসের মধ্যেই চিনু জানতে পারে, অমিয় নিয়মিত মদ – গাঁজা খায়। বিয়ের আগেও খেতো। বিয়ের পর কিছুদিন বন্ধ ছিল।
কয়েক বছর আগেই অমিয়র বাবা মা মারা গেছিলেন। তারা থাকতেন একটা ভাড়া বাড়িতে। মা বাবা মারা যাওয়ার পরই অমিয় সেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসে ওঠে ছোটমামার কাছে। মামা তার মায়ের চেয়ে কম করে দশ বছরের ছোট। মামা বিয়ে করেননি। শ্রীরামপুর ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতেন। তার বাড়িতে একজন পরিচারিকা ছিল। যে সারাদিন এখানে থেকে ঘরের সব কাজ করে, সন্ধ্যাবেলা নিজের বাড়ি ফিরতেন।
অমিয় তখনও চাকরি পায়নি।
সারদিন পাড়ার বখাটে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মেরে কাটায়। সন্ধ্যাবেলা তাদের সঙ্গে বসে মদ গাঁজা খায়। আর বাড়ি ফিরে এসে মামার অন্ন ধ্বংস করে। এই ভাবেই মামা বাড়িতে তার আনন্দে কাটছিল। হঠাৎ একবছর পর বিড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো, দু’বছর আগে দেওয়া ‘পোষ্ট এন্ড টেলিগ্রাফ’-য়ে ইন্টারভিউ থেকে তার নামে ডাক আসে জয়েন করার জন্য। অমিয় আর দেরি না করে সেখানে পরের দিনই যায় জয়েন করার জন্য। যে অফিসার জয়েন করাবেন, তিনি অমিয়র কাছে, তার মাধ্যমিক পাশ করার অরিজিনাল সার্টিফিকেট দেখতে চাইলেন। অমিয় সেসব সেদিন সঙ্গে নিয়ে যায়নি। তাই দেখাতে না পারায় তার সেদিন জয়েন করা হল না। পরের দিন রবিবার। তাই অফিসার তাকে সোমবার সেসব নিয়ে আবার আসতে বললেন। অমিয় সেদিন বাড়ি ফিরে এলো।
সব অরিজিনাল সার্টিফিকেট নিয়ে সে সোমবার গিয়ে অফিসে দেখা করল। এবং তা অফিসারকে দেখিয়ে কাজে যোগ দিল। যোগ দিয়ে জানতে পারল, কাজটা স্থায়ী নয়। ইডি স্টাফ। মানে এক্সট্রা ডিপার্মেন্টাল স্টাফ। রোজ তাকে সকাল আটটার মধ্যে পোষ্ট অফিসে গিয়ে দেখা করতে হবে। কেউ কাজে অনুপস্থিত থাকলে, তার জায়গায় এক্সট্রা স্টাফ হয়ে, তার কাজটা সেদিনের মতো সামলাবেন। তার জন্য অমিয় যেদিন ডিউটি করবে, সেইদিন ১৪ টাকা করে পারিশ্রমিক পাবে। এইভাবে যে ক’দিন মাসে তার কাজ হবে, মাসের শেষে সেই ক’দিনই তিনি ১৪ টাকা গুণিতক যা পারিশ্রমিক হয় তাই পাবেন। এই কথাটা ঘটক বাবার কাছে গোপন করে গেছিলেনি। তাই অমিয়কে বাবার সরকারি কর্মী বলে ভুল ধারণা হয়ছিল। এতে বাবার দোষ কোথায় আমি বুঝতে পারি না।
অমিয় মাসের শেষে পোষ্ট-অফিস থেকে যে ক’টা টাকা পেতো। তা তার মদ গাঁজা খেতেই উড়ে যেত।
অমিয়র মামা উপেনবাবু ছিলেন প্রাইভেট বাস কন্ডাকটার। মাঝে মাঝে তার বাসে একজন ঘটক যাতায়াত করত। উপেনবাবু তাকে চিনতেন।
অমিয়কে এইভাবে চলতে দেখে তিনি প্রথমে তাকে শোধরাবার চেষ্টা করলেন তার সঙ্গে কথা বলে। অমিয় তার কথা শুনল। কিন্তু সে কথা কানে নিল না।
কথা বলে কাজ না হওয়ায়, উপেনবাবু বাউন্ডুলে অমিয়ে বাগে আনার জন্য অমিয়র বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবলেন। তিনি ভাবলেন, একবার অমিয়র বিয়ে হয়ে গেলে, সংসারের টানে নিশ্চয়ই অমিয় বদলে যেতে বাধ্য হবে। তাই তিনি সেই ঘটকের সঙ্গে কথা বলে, অমিয়কে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
বিয়ের প্রতি অমিয়র কোনও টান ছিল না। ছোট মামার কথা রাখতেই একপ্রকার বিয়ে করেছিল। বিয়ের পর চিনুর সঙ্গে তার কোনও মনের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। চিনুর প্রতি সে কোনও আকর্ষণ বোধ করেনি। সে যেমন ছিল, তেমনই রয়ে গেছে। বিয়ের পর কিছুদিন মাত্র নেশা ভাঙ গোপনে করত। মিনু টের পায়নি।
কিছুদিনের মধ্যেই মিনু সেটা বুঝতে পারে। জানার পর প্রথম প্রথম কান্নাকাটি করে, অমিয়কে প্রশ্ন করেছিল, তুমি এসব নেশা-ভাঙ কেন করো ? আমাকে কি তোমার পছন্দ হযনি?
অমিয় তার কোনও উত্তর দেয়নি। পাশ ফিরে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে, ঘুমিয়ে পড়েছিল। মিনুর চোখে ঘুম আসেনি। অশ্রুতে চোখের পাতা ভারী হয়ে উঠেছিল।
ঘরেও অমিয় কোন টাকা দিত না। মামার খরচেই সংসার চলত। তাই দেখে মিনু লজ্জায় মরে যেত। কাউকে কিছু বলতে পারত না। একদিন নিরুপায় হয়ে লজ্জা শরম সব ত্যাগ করে চিনু মামাকে বলে, আপনি বাড়ির পরিচারিককে এ মাস থেকে ছাড়িয়ে দিন। আমিই এখন থেকে বাড়ির সব কাজ করব।
মামা শুনে বলেছিলেন, তা কি হয় নাকি?
– হ্যাঁ, সব হয়। আমি থাকতে বাড়িতে পরিচারিকা লাগবে কেন? আমি তো সারাদিন বসেই থাকি।
তাছাড়া, আমার একা ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগে না। তাও ঘরের কাজ নিয়ে থাকলে, কিছুটা সময় ভাল কাটবে আমার।
সেকথা শুনে মামা বুঝতে পেরেছিলেন, অমিয় সঙ্গে মিনুর বিয়ে দেওয়া তার ঠিক হয়নি। অমিয় যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। বিয়ের পর তার কোন পরিবর্তন হয়নি। মিনুর সঙ্গে কোন আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই তিনি আর কোন আপত্তি করেনি। পরের মাস থেকেই পরিচারিকাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
অফিসে অনেকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম। সমীরের তেমন কোন বদগুণ নেই। নেশা-ভাঙ করে না। অফিসের কাজ মন দিয়ে করে। কাউকে কোন কথা দিলে, কথা রাখার চেষ্টা করে। হাতটান স্বভাব নেই। অফিসে সকলের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে চলে। সোনারপুরে নিজেদের বাড়ি আছে তাদের। তার মা বাবা আছে ভাই-বোন নেই। থাকার মধ্যে আছেন এক বিধবা পিসি। তার স্বামী অনেকদিন আগেই মারা গেছেন। তার কোন সন্তান নেই। তাই সোনারপুরের বাড়িতে সমীরের সঙ্গে থাকেন। বলতে গেলে একেবারে নির্ঝঞ্জাট পরিবার।
মা সবটা শুনে নিশ্চিন্ত হলেও, বিধবা পিসির কথা শুনে, মনটা তার খচখচ করতে লাগল। তিনি জানেন, এই ধরণের পিসি-মাসিরা বাড়িতে থাকলে, বাড়ির বউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। একট না একটা ঝামেলা বাজিয়ে, বাড়িতে তাদের গুরুত্ব প্রমাণ করতে চায়। ফলে সংসারে অশান্তি লেগেই থাকে। মা তাই আমাকে বলল, তুই একবার মিনুকে সবকথা খুলে বলে, মিনুর কি মত জেনে নে। আমি মাকে বললাম, এ ব্যাপারে মিনুর সঙ্গে আমার কথা বলার চেয়ে, তোমার কথা বলাটা সঠিক হবে। মা আমার কথা শুনে বলল, বেশ তবে আমিই মিনুর সঙ্গে কথা বলে দেখব।
কয়েকদিন পরে আবার সমীর এলো আমার কাছে। জানতে চাইল, মা রাজী হয়েছে কিনা?
আমি বললাম, শুধু মা রাজী হলেই তো হবে না।
মিনুর সঙ্গে কথা বলে, তার মতটাও জানতে হবে।
সমীর বলল, বেশ তবে তার মতটাও জেনে নিন।
আমি আবার পরের সপ্তাহে আসব। এই কথা বলে সমীর চলে গেল।
প্রায়ই মায়ের ঘরে চা দিতে যেত মিনু। একদিন মায়ের ঘরে মিনু চা দিতে গেলে, মা বললেন, মিনুমা একটু বস আমার কাছে। তোর সঙ্গে আমার কথা আছে একটা।
মিনু শুনে কৌতূহলী হয়ে মায়ের পাশে বসে, জানতে চাইল। কি কথা মা?
মা বললেন, অনির অফিসের একটা ছেলে অনির বিয়েতে এসে, তোকে দেখে গেছে। তার খুব পছন্দ হয়েছে। সে তোকে বিয়ে করতে চায়, অনিকে জানিয়েছে। তোর কি মত?
শুনে মিনু উঠে দাঁড়ায়। বলে, মা আমি পড়া শেষ না করে, এখন বিয়ে করব না।
তুমি দাদাকে জানিয়ে দিয়ো। বলে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়, মাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে।
অফিসে বসে কাজ করছি, এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। হাতের কাজ ফেলে রেখে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখি চিনুর ফোন। ফোন ধরে বললাম, হ্যাঁ, চিনু বল।
– অমিয় খুব অসুস্থ দাদা, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তুমি একবার আসতে পারবে?
– আচ্ছা। আমি এখন অফিসে আছি। কাল তোদের বাড়ি যাব।
– বেশ। তোমরা কেমন আছো?
– আছি একরকম।
– আচ্ছা রাখছি। বলে চিনু ফোন কেটে দিল।
আমি অফিস থেকে তিনদিন ছুটি নিয়ে, পরদিন
সকালে শ্রীরামপুর চলে গেলাম। দেখলাম অমিয়র অবস্থা ভাল নয়। মদ খেয়ে লিভারটা নষ্ট করে ফেলেছে। ওকে বাঁচানো মুশকিল। তবুও চিনুকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, চিন্তা করিস না। অমিয় ভাল হয়ে যাবে। সেখানে আরও একদিন থেকে, পরদিন কলকাতা ফিরে এলাম।
কলেজে এসে মিনুর খুব মজায় কাটে। প্রফেসরদের লেকচার শোনা। নোট নেওয়া। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া কলেজ ক্যান্টিনে। সেখানে নানা রকম গল্প হয়। কলেজে ঢুকে মিনুর কয়েকজন বন্ধু জুটেছে। তার মধ্যে দু’জন প্রেম করে। তাদের কাছে প্রেমের গল্প শুনে, সেও প্রেমের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। কিন্তু কোন ছেলেকে বিশ্বাস করে সে মন দিতে পারে না। তাদের চাহনি দেখে মনেহয়ে ছেলেগুলি যেন মিনুর সঙ্গে নয়, বরং তার শরীরের সঙ্গে প্রেম করতে চায়। তার মনেহয় যদি কেউ তাকে প্রেমের ভান করে, শরীর ভোগ করে , তাকে আখের ছিবড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেয়, তাহলে তার কি হবে? তাই তার কাছে প্রেম আকর্ষণীয় হলেও ভরসাযোগ্য নয়। তাই সে এ ব্যাপারে এগোতে সাহস পায় না। দু’একজন ছেলেকে যে তার ভাল লাগে না, তা নয়। ভাল লাগে অবশ্যই। কিন্তু তাদের চোখের নজরের প্রতি সে আস্থা রাখতে পারে না।
আজ খুব সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে মিনু। হালকা কচি কলাপাতা রংয়ের সবুজ সুতির শাড়ি। স্নান করে শাড়ি পরার জন্য সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে।
ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে খুব খুশি হল মিনু। চুল তার অন্ধকার বিদিশার নিশা।
হালকা করে গাঢ় সে গোলাপী রংয়ের লিপস্টিক লাগাল ঠোঁটে, মিষ্টি একটা পারফিউম স্প্রে করল সারা গায়ে। পারফিউমের গন্ধে তার শরীর এবং মন দুটোই ভরে উঠল। ড্রেসিংটেবিলের আয়নার দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে বলল, এই সাজ মুখপুড়ি কাকে দেখাবি আজ?
মনে পড়ল একজনের কথা তার। কয়েকদিন ধরে মিনুর পিছু নিয়েছে ছেলেটা। মিনু যখনই কলেজে ঢুকতে যায়, দেখে কলেজ গেটের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থেকে সে তাকে দেখে। কলেজ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বের হবার সময়ও তাকে দেখতে পায়, কলেজের উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে সে সিগ্রেট টানছে। ছেলেটা হয়তো সাড়ে পাঁচ ফিট লম্বা হবে। কিশোর বয়সের তাপস পালের মতো মুখখানা। মন ভোলানো মায়াবী দু’টি চোখ। ব্যাক ব্রাশ করা মাথার চুল। শরীর ও স্বাস্থ্য মোটামুটি ভাল। পরনে ফেডড নীল রঙের টাইট জিনসের প্যান্ট। গায়ে চক্রাবক্রা একটা টি শার্ট।
আজ দুদিন হলো মিনু খেয়াল করছে দূর থেকে ছেলোটা তাকে ফলো করছে।
কিন্তু এখনও পর্যন্ত ছেলেটার কথা মিনু কাউকে বলেনি। ক্লাশের বন্ধুবান্ধব কাউকে না। ছেলোটা যেমনি তাকে দেখেছে সেও যেন তেমনি করেই দেখেছে তাকে। এরপর হয়তো কোনও একদিন গিয়ে তার সামনে দাড়াবে। চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করবে, আপনার ব্যাপারটা কী বলুন তো? আমার পিছু নিয়েছেন কেন? কী চান? আজ কি তাহলে সেই ছেলেটার কথা ভেবেই মিনু সুন্দর করে সাজল !
– ধুৎ!
মিনু মনে মনে লজা পেল! সে আমার কে যে তার জন্য আমি সাজব। আমি সেজেছি আমার জন্য। এই বলে মিনু আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই চোখ টিপল।
ঘর থেকে বেরোতে গিয়েই বৌদির সঙ্গে দেখা। মিনু বলল, দেখতো কেমন দেখাচ্ছে?
রমা মিনুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, কার মাথা ঘুরিয়ে দিতে যাচ্ছো মিনু?
ধুর ! তুমি বলো না কেমন লাগছে।
রমা বুড়ো আঙুল আর তর্জনী জুড়ে একটা ভঙ্গি দেখিয়ে বলল, সুপার ফাইন। তা কোথায় যাচ্ছো।
আজকে কলেজে ফ্রেসার্স ফাংশন আছে।
– তুমি সেখানে কী কিছু করবে?
– না। আমি ভলেন্টিয়ার।
বলে মিনু কাঁধে তার ব্যাগ নিয়ে বেরতে গিয়ে দেখল। একজন সৌম সুপুরুষ ভদ্রলোক তাদের বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে, মিনুকে দেখে জানতে চাইল, অনিমেষ বাড়ি আছে?
– না, দাদা তো বাড়িতে নেই। আপনার নাম কি?
কোথা থেকে আসছেন?
– সোনারপুর থেকে আসছি, আমার নাম সমীর সরকার। কয়েকদিন ধরে অনিমেষ অফিস যাচ্ছে না। তাই খোঁজ নিতে এসেছিলাম, ওর শরীর-টরীর খারাপ হল কিনা?
– ওহ্, আচ্ছা। আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন, বৌদি বাড়ি আছেন।
– না, আমি বসব না এখন। অনিমেষ এলে বলবেন, আমি এসেছিলাম দেখা করতে।
– আচ্ছা। বলে মিনু হাঁটতে শুরু করল, দেরি হয়ে
যাচ্ছে তার।
– আপনি কি বড় রাস্তার দিকেই যাবেন? তবে চলুন, আমিও যাব। বলে, সমীর তার পাশে হাঁটতে শুরু করল।
– বেশ চলুন। বলে মিনু অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করল তার সঙ্গে একসাথে হাঁটতে।
– আপনি কোন কলেজে পড়েন?
– বাসন্তীদেবী কলেজে।
– কোথায় কলেজটা?
– গড়িয়াহাটে।
মিনুরও অনেক কথা জানতে ইচ্ছে করছে তার সম্পর্কে। কিন্তু জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা হচ্ছে, জড়তা তার কন্ঠ রোধ করে রাখছে।
হাঁটতে হাঁটতে তারা বড় রাস্তায় এসে পৌঁছালে, মিনু বলল, আমি উল্টো দিক থেকে বাসে উঠব।
সমীর বলল, চলুন রাস্তা পার হই। আমিও বালিগঞ্জ ফাঁড়ি যাব।
রাস্তা পেরিয়ে এসে তারা পদ্মশ্রী স্টপেজ থেকে গড়িয়া – বিবাদী মিনিবাসে উঠল। বাসে খুব একটা ভিড় ছিল না। দু’জনেই পাশাপাশি বসার জায়গা পেল। মিনু জানলার ধারে বসল। মিনু বেশির ভাগ সময়টাই জানলার বাইরে তাকিয় রইল।
সমীর পাশে বসে তার দিকে বাববার তাকিয়ে দেখছিল মিনু সেটা অনুভূতি দিয়ে টের পাচ্ছিল।
তাই সে ফিরে তার দিকে তাকাবার কোন অবকাশ পায়নি।
কন্ডাকটার কাছে আসতেই সমীর দু’খানা কেটেে নিল।
মিনু আপত্তি করে বলল, আপনি আমার টিকিট কাটছেন কেন?
সমীর তার কোন উত্তর না দিয়ে বলল, আমি অনিমেশের বৌ-ভাতে এসেছিলাম।
– তাই নাকি?
– আপনি আমায় চিনতে পারেননি?
– না তো।
– কি করে চিনবেন, অতো লোকের ভিড়ের মধ্যে
– আমি কিন্তু আপনাকে চিনতে পেরেছি অনিমেশের বোন বলে।
– তাই নাই? কি করে?
– একদম। একবার দেখেই।
– হাউ ইন্টারেস্টিং
কথা শেষ হতে না হতেই গড়িয়াহাট চলে এলো।
মিনু মুখে খুশির হাসির বিজ্ঞাপন ছড়িয়ে বলল,
আমার কলেজ এসে গেছে, চলি তাহলে?
সমীরের মনে ইচ্ছে না থাকলেও মাথা কাৎ করে সম্মতি জানাতে হল।
মিনু বাস থেকে নেমে স্বস্থি বোধ করল।
কিছুদিন ধরে মায়ের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না। কিছু খেতে পারছেন না। তার মনে হচ্ছে পেটের ভিতর যেন কেউ নারকেল কুরুনি দিয়ে কেউ আঁচড়াচ্ছে।
পাড়ার নিবারণ ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে গেলাম। তিনি মায়ের সব উপসর্গের কথা শুনে কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে রিপোর্ট নিয়ে দেখা করতে বললেন। খাওয়ার জন্য কয়েকটা ওষুধ লিখে দিলেন।
পরদিন চিনু ফোন করে জানাল , দাদা অমিয় আর নেই
– নেই মানে?
– হসপিটালেই মারা গেছে। অতিরিক্ত মদ খাওযার জন্য অমিয়র লিভার পঁচে গেছিল। ওকে বাঁচানো যায়নি। ওর লিভার ফেঁটে মারা গেছে।
সেখানে আবার ছুটে যেতে হল আমাকে।
অমিয়র দাহ কার্য সেরে পরদিন বাড়িতে ফিরে এলাম। আসার আগে মিনুর হাতে দু’হাজার টাকা দিয়ে এলাম। মিনু কিছুতেই নিতে চাইছিল না। আমি জোর করে তার হাতে টাকাটা গুঁজে দিয়ে বললাম। এসময় টাকার খুব দরকার হবে। তুই রাখ।
পরদিন মায়ের সব রিপোর্টগুলি সংগ্রহ করে নিয়ে নিবারণ বাবুর ডাক্তারখানায় গেলাম।
সব রিপোর্টগুলি তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে আমাকে বললেন, ওনাকে চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হসপিটালে নিয়ে গিয়ে সেখানে দেখান।
– ডাক্তার বাবু, মার কি ক্যানসার হয়েছে?
– মনে তো হয় তাই।
শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
চিত্তরঞ্জস ক্যানসার হসপিটালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করা হল। আমার অফিস থাকায় প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হত না। মিনি যেত মার সঙ্গে দেখা করতে। একদিন অফিস থেকে আগে বেরিয়ে মার সঙ্গে দেখা করতে যাব ভাবছি। এমন সময় সমীর এল। বলল, আপনি কোথাও বের হচ্ছেন?
– হ্যাঁ, হসপিটালে যাব।
– কেন? কি হয়েছে কার?
– মার ক্যানসার ধরা পড়েছে, চিত্তরঞ্জন ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
– তাই নাকি? চলুন আমিও আপনার সঙ্গে যাব।
– তার কি দরকার?
– আপনার কোন আপত্তি না থাকলে, আমি যেতে চাই।
– বেশ, তবে চলুন।
সমীরকে নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরে হসপিটালে এলাম।
সেখানে মিনু আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। আমার যাওয়ার কথা ছিল না বলে। হসপিটালে ঢুকতেই মিনুর সঙ্গে সমীরের দেখা হয়ে গেল। মিনু তাকে দেখতে পেয়েই চিনতে পারল। কিন্তু নিজে থেকে তার সঙ্গে কোন কথা বলল না। এমনকি, সে যে চিনতে পেরেছে, তারও কোন লক্ষণ দেখাল না, তার চোখে মুখে কিংবা তার আচরণে।
সমীর মিনুকে দেখে বলল, কি চিনতে পারছন?
– হ্যাঁ
– কেমন আছেন?
– আর কেমন থাকব? মা অসুস্থ থাকলে যেমন থাকা যায়, তেমনই আছি।
– এখন আর তা হলে কলেজে যাওয়া হয় না?
– না।
এরপর আর কথা বেশিদূর এগোল না।
সমীর মাকে দেখতে গেল বেডে।
– এখন, কেমন আছেন মাসিমা?
– তুমি কে বাছা? তোমায় তো চিনতে পারলাম না।
আমি মাকে বললাম, মা ওর নাম সমীর সরকার। আমার অফিসেই কাজ করে।
মা শুনে বললেন, ও আচ্ছা।
তারপর সমীরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাল নেই বাছা। পেটের ভিতর যেন কেউ সব সময় আঁচড়ায় কুুরুনি দিয়ে।
– তাই নাকি?
– হুম।
সমীর মাকে বলল, আপনি কোন চিন্তা করবেন না, সুস্থ হয়ে যাবেন। আমি আবার আসব আপনাকে দেখতে।
মা সন্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।
সমীর সেদিনের মতো চলে গেল।
আমি চিনুকে কিছু জানাইনি, মায়ের অসুস্থতা সম্পর্কে। কারণ, অমিয়কে হারিয়ে সে এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। তার উপর মায়ের ক্যানসার হয়েছে শুনে সে একেবারে ভেঙে পড়তে পারে। সে কথা ভেবেই আমি তাকে কিছু জানাইনি।
চিনু ফোন করেছিল মিনুকে। সে তাকে সব কথা খুলে বলেছে। মায়ের অসুস্থতার সংবাদ শুনেই সে অস্থির হয়ে পড়ল, এখানে আসবার জন্য। সে পরদিন একাই চলে এলো এখানে মাকে দেখবার জন্য।
চিনুকে দেখে আমি বললাম, তুই খবর পেলি কি কি করে?
– কাল, মিনুকে ফোন করেছিলাম, ওর কাছেই জানতে পারলাম, মা হসপিটালে ভর্তি। তাই সেখবর শুনে থাকতে না পেরে চলে এসেছি।
– ভাল করেছিস।
– তুমি জানাওনি কেন যে মা খুব অসুস্থ।
– ওর উপর দিয়ে যে বিপদ গেল, তারপর তোকে জানিয়ে আর বিব্রত করতে চাইনি।
– তা বলে, মা হসপিটালে ভর্তি তুমি আমাকে জানাবে না।
– আমার ভুল হয়েছে চিনু, আমি তার হাতটা ধরে বললাম।
বিকেলবেলা ওরা দুই বোন মাকে চিক্তরঞ্জন হসপিটালে দেখতে গেল। মিনুকে দেখে মা বেডে উঠে বসলেন। বললেন, তুই কবে এলি।
– এই তো আজই।
মায়ের মনে পড়ে গেল, ছোটবেলা চিনু নিজের হাতে ভাত মেখে খেতে পারত না। তাকে খায়েয়ে দিতে হত। সে নিজে একা খেতে বসলে, থালার পাশে একরাশ ভাত ছড়িয়ে ফেলত, মুখে ভাত তুলতে গেলে। না মাখা ভাত মুঠো করে মুখে তুলে দিত। ফলে ভাত ছড়িয়ে পড়ত। ভাত মেখে গুছিয়ে খেতে পারত না। আর আজ সে কেমন গুছিয়ে সংসার করছে। এইসব ভাবতে ভাবতে মায়ের চোখে জল চলে এল। চিনু বলল, তুমি কাঁদছ কেন? বলে সে তার কাপড়ের আচল দিয়ে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিল।
সমীরও সেদিন সেই সময় মাকে দেখতে হসপিটালে গেছিল। হসপিটালে ঢুকেই চিনুকে দেখে বলল, এইদিকে এসেছিলাম একটা কাজে, তাই ভাবলাম একবার দেখানকরে যাই। মিনু শুনে বলল, ভালই করেছেন। চিনু মিনুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার । চিনুকে দেখিয়ে ইশারায় মিনুর কাছে জানতে চাইল, উনি কে?
মিনু সমীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, ইনি আমার দিদি হন।
– ওহ্, আচ্ছা বলে, সমীর চিনুর পাযে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই চিনু দু- পা সরে গিয়ে মিনুর কাছে জানতে চাইল, ইনি কে হন? চিনতে পারছি না তো।
মিনু বলল, ইনি দাদার অফিসে কাজ করেন। নাম – সমীর বাবু। দাদাকে খুঁজতে একদিন আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তখনই ওনার সঙ্গে আমার আলাপ হয়।
– ওহ্, আচ্ছা বলে চিনু থেমে যায়। কিছু একটা ভাবে মনে মনে। তারপর সমীরের মাথায় হাত রেখে বলে, আশীর্বাদ করি, ভাল থেকো ভাই। পায়ে হাত দিয়ে আমাকে প্রণাম করতে হবে না।
এর দু’মাস পর আষাঢ় মাসের এক সকালে ঘুম থেকে উঠে, জানলার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আকাশটা সেদিন দেখি ঘোলাটে মেঘলা। বৃষ্টি এখনও নামেনি,তবে নামবে নামবে অবস্থায়।
সামনেই বাতাবি লেবু গাছে, দুটো শালিক বসে কথা বলছে। আর কি আশ্চর্য আজ আমি তাদের সব কথা শুনে বুঝতে পারছি।
একটা শালিক আর একটাকে বলছে,
– দ্যাখ আজ আকাশটা তেমন ম্যাড়মেড়ে ছাঁইয়ের মতো। মন খারাপ করা দিন একটা
– আর বলিস না। আকশটা দুঃখে কেঁদে ফেলবে তাহলে বোধহয় এবার।
– তাই নকি? তা হলে থাক!
এমন সময় একটা চড়ুই লাফাতে লাফাতে এসে আমার জানলার গ্রিলে বসল। মুখ তুলে আমায় দেখে, একগাল হেসে আমায় বলল,
– কেমন আছ সুজন?
– কে গো তুমি?
– চিনতে পারলে না তো, আমি জানতাম।
-বল না, কে তুমি?
– থাক আর চিনতে হবে না
– গলাটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে, অথচ মনে করতে পারছি না
– মনে করার চেষ্টা কর, ঠিক মনে পড়বে।
আমি ভাবতে থাকি, কার কন্ঠস্বর, চেনা চেনা, অথচ?
– আর ভাবতে হবে না, ওদিকে তোমার গিন্নি তোমায় ডাকতে শুরু করছে।
বলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল চড়ুইটা।
ওদিকে একি!
দেখি গিন্নি কিচির মিচির শুরু করেছে।
কিছুতেই আমি তার কোন কথা বুঝতে পারছি না।
তার এই আমূল পরিবর্তনে আমি বিচলিত বোধ করতে শুরু করলাম।
একটা শালিক তা বুঝতে পেরে বলল,
– বেশ হয়েছে
অন্য শালিকটা বলল,
– কাল দেখো, তোমার হাত দুটো ডানা হয়ে যাবে।
তদের কথা শুনে আমি মুষড়ে পড়লাম। তবুও তাদের ধমকে বললাম, দূর হ আপদ যত সব।
আমার মুখ দিয়ে বের হল শুধু, কিচ্ কিচ্, কিচ্ কিচ্ কিচ্ …
বিদ্যুৎ চমকের সাথে সারাটা রাত, দামাল হাতির মতো দৌড়াত্ব চালাল ঝড় বৃষ্টি শহরের উপর দিয়ে। নাজেহাল অবস্থা করে ছাড়ল। প্রকৃতির রোষানল যেন আছড়ে পড়ল পৃথিবীর বুকে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আমার বেশ দেরী করে।
উঠে দেখি, একটা চড়ুই মরে পড়ে আছে রাস্তার উপরে। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এটাই কি সেই কালকের চড়ুইটা?
ও কি আমার গত জন্মের প্রিয় কেউ ছিল?
ভাবতে ভাবতে মনটা বিষণ্ণতায় ভরে উঠল।
সেদিনই হসপিটাল থেকে মায়ের মৃত্যুর খবর এলো। সেটা ছিল আষাঢ়ের কুড়ি তারিখ, রথের মেলার দু’দিন আগে।
মায়ের প্রয়াণে প্রতিবারের মতো এবার আর উল্টো রথের মেলার দিন জগন্নাথকে ভোগ দেওয়া হল না। তার বদলে মায়ের শ্রাদ্ধর কাজ সুষ্ঠ ভাবে সম্পন্ন হল। শ্রাদ্ধর দিন সমীরও বাড়িতে এসেছিল। অতি ব্যস্ততার মধ্যেও চিনু সেখানে মিনুর প্রতি সমীরের আকর্ষণ লক্ষ্য করেছিল। শ্রাদ্ধ শান্তির কাজ সম্পন্ন হলে পরে একদিন চিনু, মিনুকে কাছে ডেকে বলল, একটা কথা বলল তোকে, কিছু মনে করবি না তো?
– কি কথা বলবে বলো না, মনে করব কেন?
– সমীরকে তোর কেমন লাগে?
– কেন বলতো, হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– সমীরের তোর প্রতি আকর্ষণ আছে।
– তাই নাকি? আমি টের পেলাম না। আর তুমি টের পেলে?
– হ্যাঁ, টের পেয়ছি। কারণ আমি তোর মতো চোখ বুজে চলি না।
– আমার সমীরের প্রতি কোন ইন্টারেষ্ট নেই।
– কেন? অন্য কারও প্রতি ইন্টারেষ্টটেড?
– যদি বলি, হ্যাঁ।
– বেশ তো, বল তার নাম ঠিকানা, আমরা খোঁজ খবর নিয়ে দেখি।
– সে সময় হলেই বলব। আগে আমার পড়শুনা শেষ হোক।
– সে ঠিক আছে। তবুও নাম ঠিকানাটা জানিয়ে রাখ আমাদের।
– এখন আর বিরক্ত করো নাতো। বলে মিনু সরে পড়েছিল।
মায়ের কাজকর্ম সম্পন্ন হওয়ার কয়েকদিন পর চিনু তার মামাশ্বশুর বাড়ি শ্রীরাম পরে চলে যায়। বাড়িটা যদিও উপেনবাবুর (মামাশ্বশুর) নিজের নয়। ভাড়া বাড়ি। ভাড়া বাড়ি। অনেকদিন ধরেই আছেন সেখানে। বাড়ির মালিক মিলন তফাদার শিলিগুড়িতে থাকেন স্ত্রী ও এক পুত্রসন্তান নিয়ে। ছেলেটি এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। মিলনবাবুর শিলিগুড়ি বিধান মার্কেটে বড় একটা জামা-কাপড়ের দোকান আছে। সেখানে ছেলে-মেয়েদের সব রকমের পোষাক পাওয়া যায়।
উপেনবাবু খুব ভোরে উঠে গ্যারেজে বেরিয়ে যেতেন। সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন রুটে চালাতে। গ্যারেজের পাশেই চায়ের দোকান থেকে চা-বিস্কুট খেয়ে নিতেন।
চিনু একটু বেলায় ঘুম থেকে উঠে রান্না বসাত। সেদিনও ভাত বসিয়ে দিয়ে নিজের জীবনের কথা ভাবছিল। ভাবছিল অমিয়র সঙ্গে তার বিয়ের কথা। অমিয়র দুর্ব্যবহারের কথা। ভাতের ফ্যান পড়ছে দেখে, অন্যমনস্কভাবে হাড়ির গরম ঢাকনা হাত দিয়ে নামাতে গিয়ে হাতে ছ্যাঁকা খেল। এমন সময় মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল তার। চিনু গ্যাসর নভটা বন্ধ করে দিয়ে ফোনটা ধরল।
– হ্যালো কে বলছেন?
– থানা থেকে বলছি, উপেনবাবুর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। শ্রীরামপুর ওয়ালস হসপিটালে ভর্তি আছে, এক্ষুনি চলে আসুন।
খবরটা শুনে চিনুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।
এই পরিস্থিতিতে দিশেহারা হলেতম চলবে না, ভাবল চিনু।
ভাতের হাড়ি গ্যাস ওভেনেই পড়ে রইল। আলমারিতে যা টাকা ছিল তা নিয়ে, সে ঘরে তালা লাগিয়ে, একটা ট্যাক্সি ধরে ছুটল হসপিটালে। সেখানে পৌঁছে জানতে পারল, লড়ির সঙ্গে মুখেমুখি সংঘর্ষ হওয়ায় উপেনবাবুর মাথায় আঘাত লেগেছে, এখনও তার জ্ঞান ফেরেনি। সারাদিন সেখানে কেটে গেল চিনুর। উপেনবাবুর জ্ঞান ফিরল। মিনু সারারাত হসপিটালে কাটাবে ভেবে বিকেলে বাড়ি চলে এলো। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। বাড়িতে ঘি ছিল। মিনু সকালে গ্যাসে বসানো সেই ভাত গরম করে নিয়ে, ফ্যান গেলে সেই ভাত, ঘি আর কাঁচা লঙ্কা ও লবন দিয়ে খেল তৃপ্তু করে। তারপর মেঝেতে পাতার মতো একটা সতরঞ্জি ও গরম চাদর নিয়ে, ঘরে তালা দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হল।
সারারাত দুশ্চিন্তায় কেটে গেল তার। ভোরের দিকে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, এমন সময় কোলের কাছে হ্যান্ডব্যাগে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে, হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে উত্তর এলো, উপেনবাবুর জ্ঞান ফিরেছে, আপনি একবার এসে দেখা, করুন।
চিনু, আচ্ছা বলে ফোনটা ব্যাগে রেখে, উপেনবাবুর বেডের দিকে ছুটল।
চিনু তার কাছে পৌঁছে দেখল উপেনবাবু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। দৃষ্টিতে স্বাভাবিকতা নেই, যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছেন তিনি। চিনুকে দেখে ইশারায় তাকে কাছে ডাকলেন। চিনু কাছে গিয়ে টুলে বসতেই, মিনুর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিলেন। তারপর কিছু বলতে গিয়ে কাশির দমকে কিছু বলতে না পেরে থেমে গেলেন, তার হাতটা শিথিল হয়ে চিনুর হাত থেকে পড়ে গেল। উপেনবাবু মথা কাত করে একপাশে ঢলে পড়লেন। তা দেখে চিনু হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তার কান্নার আওয়াজ শুনে ডাক্তার নার্স ছুটে এলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন, ব্রেনের অর্গান ফেল করেছে। ব্রেন ফেল করলে, হার্টও কাজ বন্ধ করে দেয়। উপেনবাবুর দেহে প্রাণ সেই।
উপেনবাবু আর বেঁচে নেই শুনে চিনু পড়ল অকুল পাথারে। এখন যে সে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। দাদার কথা মনে হতেই দাদাকে ফোন করল।
অনিমেষ তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। চিনুর ফোনটা পেয়ে চমকে উঠল।
– হ্যাঁ, বল কি হয়েছে।
– দাদা উপেনবাবু আর নেই। বলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ল।
– নেই মানে?
– গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছেন। আমি শ্রীরামপুর ওয়ালস হসপিটালে আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। তুমি একবার আসতে পারবে?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমি এক্ষুনি বের হচ্ছি।
রমা কিংবা মিনু তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। অনিমেষ প্যান্ট শার্ট পরে, আলমারিতে থাকা পাঁচ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে, রমাকে জাগিয়ে, দুঃসংবাদটা জানিয়ে ঘর ছেড়ে বেরলো। বড় রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা শ্রীরামপুর চলে গেল। শ্রীরামপুর ওয়ালস হসপিটালে গিয়ে, হসপিটালের ফর্মালিটি পূরণ করে উপেনবাবুর বডি ছাড়া পাওয়ার পর, সেখান থেকে ‘পীচ হেভেন’ গাড়ি ঠিক করে, শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করার ব্যবস্থা করলেন। পরে চিনুর হাতে কিছু টাকা দিয়ে, সেদিনই রাতে বাড়ি ফিরল অনিমেশ।
অমিয় মারা যাবার সময়ও চিনুর খুব দুঃখ হয়েছিল, কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু এমনটা অসহায় মনে হয়নি তার নিজেকে। তখন উপেনবাবু একটা আশ্রয় ভরসার জায়গা ছিল তার। তিনিও চিনুকে আগলে রেখেছেন বরাবর। তার কোনও অভাব রাখেননি। চিনুর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মনেহয়, উপেনবাবু তার হাতটা ধরে, কি কথা বলতে চেয়েছিলেন? এমন কোনও কথা কি, যা তিনি সারা জীবন ধরে বলতে চেয়েও বলতে পারেননি?
ছিঃ ছিঃ ! এসব কি ভাবছে সে। নিজে লজ্জিত হয়ে জিব কাটল চিনু।
উপেনবাবু লোকটা খুব সহজ সরল মানবিক মানুষ ছিলেন। কি কারণে সংসার করলেন না, কে জানে? উৎশৃঙ্খল ভাগ্নে অমিয়কে টানলেন, তাকে সমাজের মূল স্রোতে ফেরাবার জন্য বিয়ে দিলেন। কিন্তু তার মনোবাসনা পূরণ হল না। অমিয় উৎশৃঙ্খল জীবন যাপন করেই মারা গেল। সে মারা যাওয়ার পর তার বউকে আপন করে আগলে রাখলেন এতদিন, অথচ কোন দিন একবারও কোন দুর্বল মুহূর্তে চিনুর আকর্ষণ বোধ করলেন না তিনি। তাকে সে রকম কোনও ইঙ্গিত পর্যন্ত করোনি কোনও সময়। মানুষটা কি তাহলে, ধ্বজভঙ্গ ছিল?
অমিয়র দ্বারা তার যৌন ইচ্ছে পূরণ হয়নি। ফলে, মনে চাহিদা ছিল না তা নয়। সে চাহিদা অমিয়র অভাবে চিনুর যে মনে কখনও, যৌন ইচ্ছের তাগিদ অনুভব করেনি, তা নয়। তবে তা পূরণ করার জন্য কখনও উপেনবাবুর কথা মনে তার আসেনি। অথচ হাতের কাছেই সুস্থ সবল সৎ একটা মানুষ ছিল। চিনু তার চাহিদা পূরণের জন্য তাকে সন্মোহিত করতে পারত। কিন্তু কে জানে কেন তার এমনটা ইচ্ছে হয়নি মনে? ইচ্ছা পূরণ করার কোনও সুযোগ না থাকায়, ইচ্ছা পূরণ না করতে করতে ইচ্ছেটা কখন তার ভিতরে ভিতরে মরে গেছে, চিনু টের পায়নি। আসলে এই সমাজে পুরুষদের যৌন স্বাধীনতার মতো নারীদের সে স্বাধীনতা নেই। চিনু শুনেছে বৈদিক যুগে নারীদের যৌন স্বাধীনতা ছিল। পুরুষ যৌন অক্ষম হলে, নারীরা যে কেন পুরুষকে কামনা করতে পারতেন। তাতে কোন বাধা ছিল না। চিনুর তাই সে সময় একবার মনে হয়েছিল, ছেলেদের যৌন ইচ্ছা পূরণের মতো মেয়েদের জন্যও যদি কোনও পুরুষ যৌনালয়ের ব্যবস্থা থাকত তবে মন্দ হত না।
উপেনবাবু তাহলে মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তার হাত ধরে, এমন কি কথা বলতে চেয়েছিলেন? তা কি কোনও গূঢ় কথা? সেই না বলা কথাটা কী? এই ভাবনাটা চিনুকে অস্থির করে তুলল। সারা রাত ধরে এসব ভাবতে ভাবতে উপনবাবুর সঙ্গে ঘটা টুকরো টুকরো ঘটনার স্মৃতিগুলি তার চোখের সামনে দিয়ে ভেসে যেতে লাগল। একদিনের কথা খুব মনে পড়ল। চিনুর প্রচন্ড জ্বর। ১০২/১০৩ ডিগ্রি। কিছুতেই কমছে না। উপেনবাবু তার পাশে বসে, সারা রাত জেগে তার মাথায় জলপট্টি দিয়েছে। জ্বর একটু কমলে, চিনু ঘুমিয়ে পড়লে, তারপর ঘর ছেড়ে নিজে গিয়ে ঘুমিয়েছেন। সেদিন আর গাড়ি চালাতে বের হননি। উপেনবাবু আজ আর বেঁচে নেই, সেটা ভাবতেই তার বুকের ভিতরটা একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেল। উপেনবাবুর জন্য তার বুক নিঙড়ে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। ভেজা বালিশের উপর চিনু কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, টের পায়নি।
উপেনবাবু মারা যাওয়ার পর, একটা টেলারিং শপে জামা-প্যান্টের বোমাত সেলাইয়ে কাজ নেয় চিনু। সেগুলি বাড়িতে এনে সেলাই করে দোকানে দিলে এলে, ওরা তার প্রাপ্য মজুরী বুঝিয়ে দেয়। তাই দিয়েই চাল-ডাল কিনে এনে সংসার চালায় সে। উপেনবাবু কোন টাকা জমিয়ে রেখে যাননি। তার উপর আছে ঘর ভাড়ার টাকা। যা মিলনবাবুর কাছে শিলিগুড়িতে পাঠানো দরকার। চিনু এসব একা একা সমলাতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছিল। কি করে সামলাবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তিন মাস ধরে ঘরের ভাড়া মিলনবাবুর কাছে পাঠানো হচ্ছে না। তিন মাসের ভাড়া অ্যাডভান্স দেওয়া আছে বলে, হয়তো তিনি ভাড়ার জন্য তাগাদা করছেন না। এরপরেই করবেন।
সন্দীপ মজুমদার কশবার রথতলায় ভাড়া থাকে। বাবা নেই। মা আর এক দিদি আছে। দিদির প্রেম করে বিয়ে হয়েছে ঢাকুরিয়ার মিলন সাহার সঙ্গে। গড়িয়াহাটার একটা কাপড়ের দোকানে মিলন কাজ করে।
বাবা মারা যাওয়ার ফলে, মাধ্যমিক পাশ করার পর সন্দীপ আর পড়াশুনা করেনি।
পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে গুলতানি মেরে দিনদিন বখাটে হয়ে যাচ্ছিল দেখে তার দিদি মিলনকে বলল, সন্দীপের জন্য একটা কাজ-কর্মের ব্যবস্থা করতে।
এখন কোন দোকানে নতুন লোকজন নিচ্ছে না। অফ সিজিন। পুজোর সময় হলে না হয় টেম্পোরারি লোকজন নেয়। তাই মিলন ভাবল, তাদের দোকানে ঢুকতে গিয়ে বাঁ-দিকে যে ফাঁকা জায়গাটা আছে, সেখানে একটা কসমেটিকের দোকান দিয়ে সন্দীপকে বসিয়ে দেওয়া গেলে, একটা সুরাহার ব্যবস্থা হতে পারে। এই ভেবে দোকানের মালিকের সুসময় মিলন তার কাছে প্রস্তাবটা রাখে। আরও বলে দোকানের উপর নজর রাখতে পারবে সেই কসমেটিকের দোকানদার।
মালিকের মন সেই সময় সু-প্রশন্ন থাকায় সে রাজী হয়ে যায়। তারপর থেকেই সেই কসমেটিকের দোকানটা চালায় সন্দীপ। সন্দীপের বয়স পঁচিশ। দেখতে স্মার্ট। সুন্দর কথা বলে। হাসিটিও ভারি মিষ্টি। তাই তার দোকানে কলেজের মেয়েদের ভিড় লেগেই থাকে। সারাদিনে বিক্রিও মন্দ হয় না। কলেজের বান্ধবীদের সঙ্গে মিনুও সেখানে জিনিষ কিনতে যেত। ধীরে ধীরে সন্দীপের সঙ্গে তার আলাপ পরিচয়, মেলা-মেশা শুরু হয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। চুম্বক-আকর্ষণ বাড়ে। এই বয়সের ছেলে মেয়েরা যে ভুলটা করে ফেলে, তারুণ্যের তীব্র যৌন আকর্ষণের মোহে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। সেই ভুলটাই ওরাও করে ফেলল। একদিন তারা গোপনে নির্জনে মিলিত হল। সেই কারণ মিনু পেগনেন্ট হয়ে পড়ল। সে কথা সন্দীপকে জানাতে, সে মিনুকে সেটা অ্যবরেশন করে ফেলতে বলে। মিনু তাতে রাজী হয় না। তাকে বিয়ে করতে বলে। সন্দীপ শুনে বলে, অসম্ভব।
তারপরই মিনু আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। দিনে একটা একটা করে অনেকগুলি ঘুমের ওষুধ কিনে ঘরে জমা করে। একদিন রাতে সেগুলি জল দিয়ে গিলে ফেলে।
বাথরুম করতে উঠে রমা, মিনুর ঘর থেকে গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে শুনতে পেয়ে, ঘরে ঢুকে দেখে, মিনুর মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বের হচ্ছে। সে সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষ কে ঘুম থেকে ডেকে তোলে। অনিমেষ অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করে। এম্বুলেন্সে করে হসপিটালে নিয়ে যায়। দাদা বৌদির তৎপরতায় দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ফলে, স্টমাক ওয়াশ করে সে যাত্রায় মিনুকে সুস্থ করে বাঁচিয়ে তোলা সম্ভব হয়।
সকালবেলা চিনু রমাকে ফোন করে জানতে চাইল, কেমন আছ তুমি? দাদা মিনু কেমন আছে?
রমা চিনুকে বিস্তারিত ভাবে মিনুর ঘটনাটা বলল।
– অ্যাবরেশন করিয়েছো?
– না মিনু করতে চাইছে না।
– তা হলে ও কি চাইছে?
– বাঁচতে হলে, ওকে নিয়ে বাঁচতে, না হলে মরতে।
– আচ্ছা, আমি কাল যাচ্ছি। দাদাকে বোলো।
– বেশ।
পরদিন সকালেই এসে চিনু হাজির হয়। এসে প্রথমে মিনুর ঘরে গিয়ে ঢোকে। দেখে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। তাকে ডাকে –
– এই মিনু।
তার ডাক শুনে মিনু বিছানায় উঠে বসে। মুখটা বিষণ্ণ। একরাশ দুশ্চিন্তার ছাপ মুখে লেগে আছে।
চিনু তার পাশে গিয়ে বসে, তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, পরম মমতায়। ছোট বেলার কথা মনে পড়ল চিনুর। কী অবুঝ ছিল মিনুটা। আজও তাই আছে। বয়স বেড়েছে শুধু।
মিনু এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে, চিনুকে জড়িয়ে ধরল। চিনুও তাকে বুকে টেনে নিল। কেঁদে বুকের ভার নামিয়ে, তাকে একটু হাল্কা হতে সময় দিল।
চিনু তারপর মিনুর চোখের জল শাড়ির আচল দিয়ে মুছে দিয়ে, তার চিবুকটা তুলে ধরে, তার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই এমন ভুলটা করলি কি করে?
মিনু চোখ নামিয়ে নিল। কোন উত্তর দিল না।
চিনু আবার বলল, বল।
– আমি কোন ভুল করিনি, সন্দীপ বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিল বলে, আমি নির্দিধায় তার কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছিলাম। সে এমন বেইমানি করবে আমি ভাবতে পারিনি।
– এখন তাহলে কি করবি?
– আমার প্রথম সন্তান আমি নষ্ট করব না। বাঁচতে হলে, তাকে নিয়েই আমি বাঁচব। ওর কি দোষ?
– সমাজ কি কোনও কুমারী মেয়ের সন্তান মেনে নেবে?
– সমাজ কি ভাবল, তাতে আমার কিছু আসে যায় না।
– তা বললে কি চলে? এই সমাজেই তোকে তাহলে বাঁচতে হবে তবে ‘কুলটা’ নামধারী হয়ে।
– হলে, তা হয়েই আমি বাঁচব।
– এই জেদ তুই ছাড়। সন্তান সহ তোকে কে বিয়ে করতে চাইবে বল?
– না চাইলে করবে না। আমি একাই বাঁচব আমার সন্তান নিয়ে।
– তোর চিন্তা ভাবনা প্রগতিশীল, আমি স্বীকার করি। কিন্তু আমাদের এ সমাজ এখনও এতটা প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পারেনি।
মিনু শুনে চুপ করে থাকে। চিনুও তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
তারপর দাদার কাছে গিয়ে চিনু বলে, তুমি একবার সমীরকে আমাদের বাড়িতে আসতে বল।
– কেন?
– সমীর মিনুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। আজও যদি তার মিনুর প্রতি কোনও আকর্ষণ থাকে, তবে আমি তার সঙ্গে কথা বলে দেখব।
– তা’তে কি হবে?
– তা’কে সব খুলে বলব। তা’তে সে মিনুকে বিয়ে করতে রাজী কিনা জানতে চাইব।
– সে কি সন্তান সহ মিনুকে বিয়ে করতে রাজী হবে?
– মিনুর প্রতি তেমন টান থাকলে, রাজীও হতে পারে। কথা বলে দেখতে দোষ কি?
– বেশ। তবে সমীরকে আসতে বলব আমাদের বাড়িতে।
– হুম। চিনু বলল।
পরদিনই সমীর অফিসের পর, সন্ধ্যার সময় অনিমেষের সঙ্গে বাড়িতে এলো। অনিমেষ তাকে একটু বসতে বলে, ফ্রেস হতে বাথরুমে ঢুকলো।
সীমা তাকে চা-বিস্কুট দিয়ে চলে যাওয়ার একটু পরে, চিনু ঘরে ঢুকে, সমীরকে বলল, কেমন আছো?
সমীর তখন চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। চিনুকে দেখে, চায়ের কাপ সেন্টার টেবিলে রেখে, তাকে প্রণাম করতে উঠলে, চিনু তাকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিয়ে, বসতে বলল।
সমীর বসে বলল, ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?
– আমি তো ভাল আছি, কিন্তু মিনু একটা বিপদ বাজিয়ে বসেছে।
– কি বিপদ? কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, সমীর।
– সে কথা বলতেই তোমাকে ডাকা।
– বেশ বলুন
– তুমি তো মিনুকে চেয়েছিলে?
– হুম।
– এখনও রাজী আছে?
– হ্যাঁ
– তবে শোন। মিনু একজনকে ভালবেসে, দু’জনের সন্মতিক্রমে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি মতো, ঘনিষ্ঠভাবে মিলিত হয়েছিল। তা’তে মিনু পেগনেন্ট হয়ে পড়ে। সে কথা জেনে, তখনই তার পক্ষে মিনুকে বিয়ে করা সম্ভব নয় জানিয়ে দিয়ে ছেলেটি সন্তানটাকে নষ্ট করে দিতে বলে। মিনু কিছুতেই তা’তে রাজী হয়নি। সে তার সন্তান নষ্ট করতে চায় না। সে বলে, যে আসতে চাইছে, তার দোষ কি? কোন অধিকারে আমি তাকে এই পৃথিবীর মুখ দেখানো থেকে বঞ্চিত করব?
চিনুর এইসব কথা শুনে সমীর বিচলিত বোধ করে। সে কি বলবে বুঝে পায় না।
চিনু তার এই বিচলিত ভাব দেখে বলে, এই কারণে মিনু ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু দাদা বৌদির তৎপরতায় সে এ যাত্রা বেঁচে গেছে। এরপর ওর কি হবে তুমি বল?
– আমাকে কি করতে বলেন?
– একমাত্র তুমিই ওকে বাঁচাতে পার, ওর সন্তান সহ ওকে বিয়ে করে।
– তা, কি করে সম্ভব? আমার পিসি প্রচীনপন্থি কুসংস্কার আচ্ছন্ন মানুষ। তিনি কি এসব কখনও মেনে নেবেন?
– তুমি একবার তার সাথে কথা বলেই দেখো না।কাছে সব ঘটনা বল, মিনুের দুর্দশার কথা তার কাছে খুলে বল। দেখো তিনি শুনে কি অভিমত ন
দেন।
– বেশ, আমি তার সাথে এ ব্যপারে কথা বলে দেখব। তারপর সিদ্ধান্তের কথা আপনাদের জানাব ।
– আচ্ছা। আমরা তোমার মতামতের জন্য অপেক্ষায় থাকব।
সমীরের মুখে সব ঘটনার কথা শুনে, পিসিমা মেয়েটার দুর্দশার কথা মনে মনে ভাবলেন। তারপর ভাবলেন, আমি আর ক’দিন আছি এ সংসারে। সমীর যদি মেয়েটাকে বিয়ে করে সুখি হয়, তবে আমি আর কেন পুরনো সংস্কারের বশে, ওদের সুখের পথে কাঁটা হয়ে, এই বিয়েতে বাধা দেব? আজকাল তো শহরে এমন বিয়ে হচ্ছে।
তাই তিনি সমীরকে বলল, তুই কি তাকে বিয়ে করতে চাস?
সমীর সন্মতিসূচক মাথা নাড়ল। তা দেখে পিসিমা বললেন, তবে তুই বিয়ে কর। আমি মত দিলাম।
তবে সামাজিক কোন অনুষ্ঠান করতে যাস না।
মন্দিরে নিয়ে গিয়ে, সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে এনে তোল।
পিসিমার কথা শুনে, সমীর খুশি হয়ে বলল আচ্ছা।
পরদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে সমীর চিনুদের বাড়িতে এসে জানালো, পিসিমা রাজী হয়েছেন, এই বিয়েতে। তবে তিনি কোন সামাজিক অনুষ্ঠান করতে নিষেধ করেছেন। তাতে নানা কথা উঠতে পারে। তাই তিনি মন্দিরে নিয়ে গিয়ে সিঁদুর পরিয়ে ঘরে তুলতে বলেছেন।
শুনে চিনু বলল, বেশ তো ভাল কথা। তবে মিনুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে, বিয়েটা রেজিষ্ট্রি করে হবে। মাসখানেক আগে নোটিশ দিয়ে, বিয়েটা রেজিষ্ট্রি করে করতে হবে।
– বেশ, তবে তাই হবে। আমার কোনও আপত্তি নেই।
একটু থেমে, সমীর আবার বলল, আমি একবার মিনুর সঙ্গে দেখা করে, কথা বলে, তার কাছ থেকে জেনে নিতে চাই, তার এই বিয়েতে কোন আপত্তি সেই তো।
– বেশ তো যাও। পাশের ঘরে মিনু আছে।
চিনু, মিনু মিনু করে দু’বার ডাকল। বলল, সমীর তোর সঙ্গে একবার কথা বলতে চায়।
সমীর গলা খাকড়ি দিয়ে তার ঘরে ঢুকল।
দেখল মিনু শুয়ে আছে। তাকে দেখে, নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় উঠে বসল।
মিনুর দিকে তাকিয়ে সমীরের বুকট ধক্ করে উঠল। এই ক’দিনে কী চেহারা হয়েছে তার। যেন বিষণ্ণতার পোড়া মূর্তি।
সমীর বলল, আপনি তো সব শুনেছেন। আমাকে বিয়ে করতে, আপনার কোন আপত্তি নেই।
– আমার কথা ছাড়ুন। আপনি কি আমার এই করুণ পরিস্থিতির কথা ভেবে, আমাকে উদ্ধার করার জন্য আমায় দয়া দেখিয়ে বিয়ে করতে রাজী হয়েছেন।
মিনুর এই কথা শুনে, সমীর আবেগমথিত হয়ে, মিনুর হাতটা ধরে ফেলে বলল, না না, একদম না। আমি আপনাকে ভালবাসি। সমীরের স্পর্শে মিনু একবার কেঁপে উঠল ভিতরে ভিতরে। তারপর বলল, হাতটা ছাড়ুন এবার, দিদি ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। শুনে, সমীর হাতটা ছেড়ে দিল তার।
পরদির চিনু শ্রীরামপুর ফিরে গেল, রেজিষ্ট্রির দিন আবার আসবে বলে।
মিলনবাবুর ইচ্ছে ছেলে উচ্চমাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করলে তাকে টেক্সটাইল নিয়ে পড়াবেন। শ্রীরামপুরে টেক্সটাইল কলেজ আছে। সেখানে তিনি স্ত্রী ও পাঠিয়ে দেবেন। নিজে সপ্তাহে একদিন করে যাবেন সেখানে। একদিন থেকে পরদিন শিলিগুড়ি ফিরবেন।
মিলনবাবুর ছেলে টুকাই পরীক্ষায় ভাল ফল করেছে। এজন্য তিনি শ্রীরামপুর এসে চিনুর সঙ্গে দেখা করে, তাকে সব কথা খুলে জানালেন। বললেন, আপনাকে এবার আমাদের ঘরটা ছেড় দিতে হবে। কারণ, ছেলে এখানে থেকে শ্রীরামপুর টেক্সটাইল কলেজে পড়বে। আমার ওয়াই তার সঙ্গে থাকবে। সপ্তাহে একদিন করে আমি এখানে আসব।
তিন মাস ভাড়া দেওয়া হয়নি। অ্যডভান্স দেওয়া টাকাও শেষ হয়ে গেছে। তাছাড়া এরকম পরিস্থিতিতে তার আর এখানে থাকা চলে না। আর এখানে থাকবেনই বা কেন?
যেখানে অমিয় , উপেনবাবু কেউই আর বেঁচে নেই। তাই চিনু মিলনবাবুকে বলল, আচ্ছা এমাস শেষ হলেই আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।
মিলনবাবু চলে যাবার পর চিনু দাদাকে ফোন করে সব জানাল। সব শুনে অনিমেষ বলল, বেশ তুই সব মাত্র নিয়ে কবে আসবি বল, আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব।
– এ মাসের শেষে।
– আচ্ছা আমি যাব, তোকে নিয়ে আসতে। যেদিন আসতে চাস, তার আগের দিন আমাকে ফোন করিস।
– আচ্ছা করব।
একমাস পর রেজিষ্ট্রি করে মিনুর সঙ্গে সমীরের বিয়ে হয়ে যায়। মিনু সমীরের সঙ্গে ওদের বাড়ি সোনারপুরে চলে যায়।
চিনু শ্রীরামপুর ছেড়ে এসে, এখানে মিনুর ঘরেই থাকতে শুরু করে।
মাতৃ বিয়োগের শোক মানুষ সহজে ভোলে না, তবুও সময়ের চাপে সেই শোক একসময় ফিঁকে হয়ে আসে। বাস্তব ঘটনার দৈনন্দিন আবর্তে পড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে তা থিতিয়ে আসে। মাতৃ বিয়গের পরের, মনের ভিতরের শূন্যতাটা, ঘটনার প্রলেপে ধীরে ধীরে ভরে উঠতে থাকে। শোকটা আর তখন ভারি হয়ে বুকে চেপে থাকে না। মাঝে মাঝে মনে পড়লে, মনটা বিষাদে ভার হয়ে ওঠে সময়িক।
মিনু সমীরের সঙ্গে সুখেই আছে। মিনুর ছেলে হয়েছে। সেই ছেলেকে নিয়ে সমীরের পিসির এখন আনন্দেই সময় কাটে। মিনুকেও তিনি নিজের মেয়ের মতো ভালবাসেন।
মিনুও পিসির খুব যত্ন-আত্যি করে। তার পরামর্শ মতো সংসার চালায়। সংসারে কোন অশান্তি নেই। সবসময় শান্তি বিরাজ করে সোনারপুরে সমীরদের সংসারে।
এদিকে বাঙুর হসপিটালে বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় রমা। তার কন্যা সন্তানটি বেঁচে যায়। রমার মৃত্যুতে অনিমেষ ভীষণ মুষড়ে পড়ে। মেয়েটির দায়-দায়িত্ব সব এসে পড়ে, চিনুর উপর। সে পরম যত্নে মেয়েটিকে মানুষ করতে থাকে, নিজের সন্তানের মতো।
মাঝরাতে চিনুর ঘুম ভেঙে গেলে, হঠাৎ মনেহয়, উপেনবাবু তার হাত ধরে, কি বলতে চেয়েছিল, মৃত্যুর আগের মুহূর্তে। সেই না বলা কথা তো আর কোনও দিনও জানা হবে না তার। এরকম না বলা কথা বোধহয় প্রত্যেকেরই মনের ভিতর কিছু না কিছু থেকে যায়। রাতটা অস্থিরভাবে কাটে চিনুর। কিছুতেই আর ঘুম আসে না তার দু’চোখে। বিনিদ্র রাত কেটে য়ায়।
রাতটা চিনুর অস্থিরভাবে কাটে। ঘুম আসে না আর তার চোখে। বিনিদ্র রাত কেটে য়ায়।
ধীরে ধীরে রমার স্মৃতি ম্লান হযে আসে মন থেকে। মায়ের স্মৃতিও তাই। বাবার স্মৃতি তো অনেকদিন আগেই হারিয়েছে। সময় নির্মমভাবে সব স্মৃতি মুছে দেয়। ধরে রাখে মাত্র কয়েকটি বিশেষ মুহূর্তের ছবি।
এবার বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাট হবে।তিন ভাই বোনের মধ্যে ভাগ হবে ঠিক হয়েছে। ফ্ল্যাট করবে এক প্রোমোটার। সে মোট ছটি ফ্ল্যাট করবে। তিনটি আমাদের দেবে। সে নেবে তিনটি। আঠারো মাসে কাজ শেষ হবে। যতদিন না কাজ শেষ হয়, ততদিন প্রোমোটার আমাদের থাকার জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করে, তার জন্য ভাড়া প্রোমোটার নিজেই বহন করবে। আমাদের দিতে হবে না।
এই শর্তে কোর্টে চুক্তিপত্র উভয় পক্ষের স্বাক্ষর হওয়ার পর বাড়ির কাজ শুরু হয়েছে, কিছুদিন হলো। একদিন সেখানে গিয়ে দেখি, আমাদের পুরনো বাড়িটা ভাঙা হচ্ছে। মিস্ত্রিদের বাড়ি ভাঙার শব্দ বুকে এসে বাজছিল।মনে হল যেন বাড়িটা নয়, ওরা আমার হৃদয়টাই ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। বুকের ভিতরটা তেমন করে উঠেছে। সেখানে আর বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারিনি। ফিরে এসেছিলাম। মনে পড়ছিল, অনেক দিনের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য টাকা জমিয়ে, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বাড়িটা তৈরি করেছিলাম। সব চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তার ছবির মতো।
পুরনো বাড়ি ভাঙার কাজ শেষ করে, নতুন ফ্ল্যাটটা সবে উঠতে শুরু করেছে। একদিন সেখানে গিয়ে দেখি, বাবার হাতে গড়া রথটা, ভাঙাচুরা অবস্থায় রাস্তার একপাশে পড়ে আছে অযত্নে, অবহেলায়। দেখে বুকের ভিতর দিয়ে কষ্টের হিমস্রোত বয়ে গেল। যা ছিল আমাদের কাছে গর্বের, সম্মানের বস্তু। আজ তার এই করুণ মর্মান্তিক অবস্থা নিজের চোখে দেখে, বুকের ভিতর কষ্টের পাহাড় চেপে বসল। আচমকা মাথাটা ঘুরে, টাল খেয়ে গেল। আর সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। রাস্তার ধুলোর উপর, রথের পাশেই বসে পড়লাম।
আমার এই মানসিক কষ্টের কথাটা, আমি কোনদিন কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারব না। সেটা না বলা কথা হয়ে আমার বুকের ভিতর হেমলক বিষের মতো জমে থাকবে।