Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নদী দুটি || Sukanta Gangopadhyay

নদী দুটি || Sukanta Gangopadhyay

সকালের রোদ এখনও তেজালো হয়নি। চাবির গোছা হাতে দোকানের দালানে উঠে এল শিলাদ। চাতালে শুয়ে থাকা সাদা-খয়েরি কুকুরটা আড়মোড়া ভেঙে নেমে গেল রাস্তায়।

বন্ধ শাটারে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করে চারটে তালা একে একে খুলে ফেলল শিলাদ। এক হ্যাঁচকায় তুলে দেয় বিশাল শাটারটা। খুলে গেল চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর। শাটারের তলা দিয়ে খবরের কাগজ গলিয়ে দিয়ে গেছে কাগজওয়ালা। সেটা তুলে কাউন্টারের ওপর রাখে শিলাদ। দোকানের ভিতরে ঢুকে ঝাঁটা নিয়ে আসে। সামনের স্ল্যাবটা ঝাঁট দিতে যাবে, পাশের কনফেকশনারি দোকানের বিশু এসে বলল, খবর শুনেছ?

নিশ্চয়ই সিরিয়াস কোনও ব্যাপার, নয়তো দোকান ছেড়ে বলতে আসত না বিশু। শিলাদ জানতে চায়, কী হয়েছে?

সুইসাইড করেছে সন্তু। গলায় দড়ি।

সামনে যেন বাজ পড়ল শিলাদের। চমকাতেও ভুলে গেছে। ঝিনঝিন করছে সারা শরীর। কোনওক্রমে জিজ্ঞেস করে, কখন করল?

পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশু বলে, তা ঠিক বলতে পারব না। দোকান খুলতে এসে দেখি, সন্তুদের বাড়ির সামনে ভিড়। পুলিশের গাড়িও দেখলাম। ভাবলাম, সন্তুর বোন বুঝি কোনও কেস করেছে। গিয়ে শুনি এই কাণ্ড! ভিতরে আর ঢুকিনি, ওসব সিন আমি সহ্য করতে পারি না।

কথা শেষ করে নিজের দোকানে ফিরে গেল বিশু। শিলাদের চেহারাটা ভাল করে খেয়াল করেনি। করলে দেখত, শিলাদ একেবারে ফ্যাকাশে মেরে গেছে। নিজের এই বৈলক্ষণ্য শিলাদও টের পায়। প্রতিক্রিয়াটা লোকজনকে বুঝতে দিলে চলবে না। অসাড় হাতে ঝাঁটা বোলাতে থাকে চাতালে। দৃষ্টি নিজের থেকেই চলে যায় সন্তুদের বাড়ির সামনে, জমাট ভিড়। খানিক দূরে পুলিশের গাড়িটাও দেখা যাচ্ছে।

বুকের ভিতর ঢিবঢিবানি শুরু হয় শিলাদের। ঝাঁটা নিয়ে ঢুকে পড়ে দোকানে।

‘গুপ্তভিলা’র নীচের তলায় তিনটে দোকানঘর। একটা বন্ধ থাকে, বাকি দুটো শিলাদ আর বিশুর। শিলাদের দোকানের বাঁহাতি একতলা বাড়ির পরেই সন্তুদের পাঁচিল ঘেরা টালির চালের ঘর। এ পাড়ায় টালির বাড়ি ওই একটাই। শিলাদের দোকানটা বেশ বড়। দুটো দোকানঘরের স্পেস নিয়ে একটা। শিলাদের বাবা রিটায়ারমেন্টের পর সঞ্চিত সমস্ত টাকা দিয়ে পাস-গ্র্যাজুয়েট বেকার ছেলেকে ওষুধের দোকানটা করে দিয়েছে। কাঠ-বেকার অবশ্য ছিল না শিলাদ, কলকাতার ওষুধের দোকানে কাজ করত। শিলাদের পরে এক

বোন, দিদির বিয়ে হয়েছে অনেক আগেই। বাবার পেনশনের সামান্য টাকা আর যৌথ পরিবারের সাপোর্ট আছে বলেই শিলাদকে সংসার খরচ নিয়ে ভাবতে হয় না। ভাবতে হলে সমস্যায় পড়ে যেত। দোকানটা বড় হলেও, পাড়াটা গরিব! দোকান খোলার পর থেকে অনেক চেষ্টা করেও বিক্রি বাড়াতে পারেনি শিলাদ। চলে যাচ্ছে গয়ংগচ্ছভাবে। বাইরে থেকে লোকে এসব বুঝবে না, তারা শিলাদকে দেখবে শিমুলতলার চৌধুরীবাড়ির ছেলে আর বড় দোকানের মালিক হিসেবে। কোথাকার কোন গরিব ঘরের ছেলের আত্মহত্যা নিয়ে বিচলিত হওয়াটা তার পক্ষে মোটেই স্বাভাবিক নয়।

যেমন হয়নি বিশু। শিলাদের থেকে ওর ব্যাবসা অনেক ছোট। খবরটা দিয়ে সেই যে দোকানে ঢুকেছে, আর বেরোয়নি। সন্তুর মৃত্যুটা বিশুর কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কিন্তু শিলাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। সে জানে সন্তুর সুইসাইড তাদের চৌধুরীবাড়ির মর্যাদাকে ধুলোয় মেশাতে পারে। এই আশঙ্কায় ক্রমশ অবশ হয়ে যাচ্ছে শিলাদ। ঝাঁটার হাত ধুয়ে চারটে দেশলাই কাঠি নষ্ট করে ধূপ জ্বালিয়েছে। রেখেছে দেওয়ালে ঝোলানো ঠাকুরের সিংহাসনের ওপর।

আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগছে ধূপের গন্ধটা! ভয় আর ভীষণ মনখারাপ মেশানো গন্ধ। মনখারাপটা সন্তুর জন্য। দোকান করার পর বাড়িওয়ালাকে বাদ দিলে এ পাড়ায় প্রথম যার সঙ্গে আলাপ হয়, সে হল সন্তু। বয়স উনিশ-কুড়ি। শিলাদের থেকে অন্তত বছর সাতআটেকের ছোট। আর্থিক অবস্থা ওদের বেশ খারাপ। সামাজিক সম্মান বলতেও প্রায় কিছুই নেই। তবু সন্তুর সঙ্গে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল শিলাদের। বিশ্বাসের সম্পর্ক।

দোকানের উঁচু টুলটায় এখন জড়ভরত হয়ে বসে আছে শিলাদ। একবার মনে হচ্ছে সন্তুদের বাড়িতে যায়, সরেজমিনে দেখে সমগ্র পরিস্থিতিটা। পরক্ষণেই হাত-পা সেঁধিয়ে যাচ্ছে তার। এই মুহূর্তে শিলাদের সবচেয়ে আগে যেটা জানা দরকার, সন্তু কোনও সুইসাইডাল নোট লিখে গেছে কিনা? লিখে থাকলে, সেখানে শিলাদের নাম উল্লেখ আছে কি? বিশুর দেওয়া খবরে সেটা জানা গেল না। আর একবার জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? অতিরিক্ত কৌতূহল দেখানো হয়ে যাবে না তো? এমনিতেই একটা ভুল করে বসে আছে শিলাদ। বিশু যখন আত্মহত্যার খবরটা দিল, শিলাদ জানতে চেয়েছিল, কখন করল? যেন সন্তু সুইসাইড করবে, তা শিলাদ জানত। সে সময় শিলাদের জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, কেন করল অমন কাজ? বিশুর গোলা মাথায় এই বিচ্যুতি ধরা পড়বে না। বুদ্ধিমান লোকের সামনে পড়লে মুশকিলে পড়ে যেত শিলাদ। এখন কীভাবে জানা যায় সুইসাইডাল নোটের ব্যাপারটা?

ঘটনার এত পরেও বাজার কলোনির দুটো-চারটে করে বাচ্চা দৌড়ে যাচ্ছে সন্তুদের বাড়ির দিকে। দেরি করে ঘুম ভাঙা পাড়ার পুরুষরাও যাচ্ছে টি-শার্ট, পাঞ্জাবি গলিয়ে নিতে নিতে। সমস্ত লোক জমা হচ্ছে সন্তুদের বাড়ির দোরগোড়ায়। এক-দু’জন ঘটনা বুঝে নিয়ে ফিরেও আসছে। তারা কেউই শিলাদের তেমন পরিচিত নয়, যে ডেকে জিজ্ঞেস করা যায়, সন্তু কিছু লিখে গেছে কিনা! তবে সামান্য একটা আশার কথা মাথায় আসছে, সন্তু যদি সত্যিই শিলাদের নাম লিখে যেত চিঠিতে, পুলিশ এতক্ষণ বসে থাকত না। জিজ্ঞাসাবাদ করতে চলে আসত দোকানে।

কিন্তু গোটা ব্যাপারটা জানা অবধি স্বস্তি পাচ্ছে না শিলাদ। সন্তুর মৃত্যুর কারণ সে হতেই পারে, আবার নাও পারে। যে-মনের অবস্থা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিল সন্তু, আত্মহত্যা খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সমস্যা হল, গত পরশু শিলাদ এমন একটা কাণ্ড করেছে, যা জানার পর সন্তু আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করবে না। যদিও জেনে ফেলার কথা নয়, ঘটনার সময় সন্তু এলাকায় ছিল না। ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল সোদপুরে। শিলাদের যতদূর বিশ্বাস, তার অপকর্মের সাক্ষী একজনই। সে-ই কি তা হলে বলে দিল সন্তুকে? বলে তার তো লাভ হবে না কোনও। বরং কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। তা হলে কে বলতে পারে? হতে পারে কেউই বলেনি। সন্তু গত রাতে সুইসাইড করবে ঠিকই করে নিয়েছিল। ঘটনাচক্রে তার আগের দিন শিলাদ যদি অবিবেচনার কাজটি না করত, এতটা অপরাধবোধে ভুগতে হত না। কাণ্ডটা করার পর থেকেই শিলাদ অনুশোচনায় ভুগছিল, সন্তুর মৃত্যু তাকে ঠেলে দিল চরম আত্মগ্লানিতে।

এমনও হতে পারে— শেষ চিঠি না লিখলেও সন্তু হয়তো ওর ঘনিষ্ঠ কাউকে বলে গেছে যে, সে শিলাদের কারণেই আত্মহননের পথ বেছে নিতে যাচ্ছে! পুলিশি ঝামেলার ভয়ে সেই ব্যক্তি ক’দিন চুপচাপ থাকবে। ওদিককার ব্যাপার মিটে গেলে, সে ধীরে ধীরে একে-তাকে বলতে থাকবে, সন্তুর মৃত্যুর জন্য দায়ী কে। এ পাড়ার সকলের তখন নজর স্থির হবে শিলাদের ওপর।

গলা শুকিয়ে গেছে শিলাদের। জল খেলে হয়। অন্যদিন দোকান খোলার পর ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে শিলাদ দুটো বড় বোতলে জল এনে রাখে। আজ হাত-পা চলতে চাইছে না। টুল থেকে নেমে আসে শিলাদ। বোতলে কালকের জল এখনও অনেকটা আছে। তাই খেয়ে নেবে।

মেঝেতে রাখা বোতল তুলে জল খাচ্ছে, পিছন থেকে দিনের প্রথম কাস্টমারের গলা, আমার প্রেশারের ওষুধটা একপাতা দাও।

মনোতোষ সরকার। এ পাড়ার পুরনো লোক। লুঙ্গি, গেঞ্জি পরে আশপাশের দোকানে

কেনাকাটি করেন। বয়স পঞ্চাশ হবে। ভদ্রলোক নিয়মিত শিলাদের কাছে ওষুধ কেনেন। ব্লাডপ্রেশারের কোন ওষুধ ওঁর লাগে, শিলাদ জানে। ট্যাবলেট রাখার বাক্স থেকে এক পাতা বার করে ছোট খামে ঢোকায়।

মনোতোষবাবু বলেন, তোমার পাশে তো বিরাট ঘটনা ঘটে গেল।

সরাসরি উত্তর না দিয়ে শিলাদ প্যাকেটটা মনোতোষবাবুর হাতে দেয়। নিচু স্বরে জানতে চায়, গিয়েছিলেন নাকি ওখানে?

হাতে ধরে থাকা পার্স থেকে টাকা বার করে শিলাদকে দেন মনোতোষবাবু। বলেন, গিয়েছিলাম। পাড়ার ব্যাপার, বিপদের দিনে মুখটা তো একবার দেখাতে হবে।

শিলাদ আন্দাজ করতে পারছে, দায়িত্ববোধের তাড়নায় মনোতোষবাবু ঘটনাস্থলে ঢুকে গোটা বিষয়টা খতিয়ে দেখে এসেছেন। দমচাপা সতর্ক গলায় শিলাদ তাই জিজ্ঞেস করে, কেন করল সুইসাইড, কিছু জানতে পারলেন?

এ আর জানার কী আছে! বোন আর মাসির জন্যই করেছে। যা শুরু করেছে ওরা। সন্তু

ছেলেটা ছিল একদম অন্যরকম। পেটে অল্পস্বল্প বিদ্যে ছিল, একসময় খেলাধুলো করত। মেলামেশা ছিল ভদ্রলোকের সঙ্গে। বাড়ির নোংরামি সহ্য করতে পারল না।

সুইসাইডাল নোটফোট লিখে গেছে নাকি? দরকারি প্রশ্নটা করেই ফেলল শিলাদ। লিখেছে। বলার পরই মনোতোষবাবু আগ্রহী হয়ে উঠলেন বিশেষ কিছু একটা জানাতে৷ বললেন, সত্যিকারের ভাল ছেলে একেই বলে। ওই চিঠিতে বোন বা মাসির সম্বন্ধে কিচ্ছুটি লেখেনি। শুধু লিখেছে, মায়ের কাছে চললাম, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

কথা শেষ করার আগে মনোতোষবাবুর গলাটা একটু যেন উদাস হয়ে গেল। এদিকে শিলাদের আনন্দের কাছাকাছি একটা অনুভূতি হচ্ছে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেরকম হয়। মনোতোষবাবু কাউন্টার ছেড়ে যেতে যেতে বললেন, চলি। টাইমলি অফিসেও তো যেতে হবে।

দোকানের সামনেটা আবার ফাঁকা হয়ে গেল। অন্যান্য দিন এতক্ষণে দু’-চারজন কাস্টমার এসে যায়। সন্তুর ঘটনাটা এমন একটা মৃত্যুর আবহাওয়া এনে দিয়েছে, লোকে রোগ সারাতে আসতে বোধহয় ইতস্তত করছে। বাড়িওয়ালা পর্যন্ত এখনও নীচে নামলেন না। রোজ দোকান খোলার একটু পরেই নেমে এসে শিলাদের নেওয়া খবরের কাগজটা পড়েন। দেশের সাময়িক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।

শিলাদেরও ওলটানো হয়নি আজকের কাগজ। ইচ্ছে করছে না। তবে এখন অনেকটা ফ্রি বোধ করছে। তাকে অন্তত পুলিশের ঝামেলায় ফেলেনি সন্তু। যদি কাউকে শিলাদের অন্যায় কাজটা বলেও থাকে এবং সেই ব্যক্তি চেষ্টা করে কেচ্ছাটা চাউর করতে, পাত্তা পাবে না। প্রথমত কোনও সাক্ষী নেই, তা ছাড়া এ পাড়ায় শিলাদের যা রেপুটেশন, লোকে বিশ্বাস করবে না ওইসব গল্প। নার্ভ স্ট্রং রেখে ব্যাপারটা জাস্ট ইগনোর করলেই চলবে।

ফের টুল থেকে নেমে আসে শিলাদ। টাটকা জল এখনই বোতলে ভরতি করে রাখা দরকার। আর একটু বাদেই মিউনিসিপ্যালিটির জল চলে যাবে। অনেক কাস্টমার ট্যাবলেট কিনে দোকানে দাঁড়িয়েই খেয়ে নেয়। তাদের তো বাসি জল দেওয়া যায় না।

বোতল দুটো নিয়ে দোকানের বাইরে আসে শিলাদ। ছিপি খুলে গতকালের জলটা নর্দমায় ফেলতে গিয়ে দেখে, হাতটা কাঁপছে। এটাই স্বাভাবিক, এতক্ষণ যা চাপের মধ্যে ছিল।

রাস্তা পার হয়ে ফ্ল্যাটবাড়ির পাশে টাইম কলের সামনে যায়। অঝোরে পড়ে যাচ্ছে জল। ব্যবহার করার পর কারও খেয়াল থাকে না কল বন্ধ করার কথা। কলের মুখে বোতল ধরে আর একবার সন্তুদের বাড়ির দিকে তাকায় শিলাদ। ভিড় আরও বেড়েছে। নিঃশব্দ জমায়েত। মৃত্যু ঘেরা ভিড়ে কখনও হইচই হয় না।

সন্তুর বাড়ির লোকেদের এখন কী অবস্থা, কে জানে। ওদের মধ্যে একজন কি ভিড়ের মধ্যে খুঁজছে শিলাদের মুখ? মনে হয় না। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার লোক অনেক আছে। তবে সেই লোকগুলো খুব একটা সুবিধের নয়। পুলিশের কাছাকাছি তারা কতটা থাকবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ভরতি হয়ে গেছে দ্বিতীয় বোতলটাও। কল বন্ধ করে বোতলের ছিপি এঁটে দোকানের

দিকে পা বাড়ায় শিলাদ। কাউন্টারে ফ্ল্যাটবাড়ির এক বউদি এসে দাঁড়িয়েছে। শিলাদের অনুপস্থিতির কারণে মুখে অধৈর্যের ভাব।

তাড়াতাড়ি দোকানে পৌঁছোয় শিলাদ। প্রেসক্রিপশন বার করে বউদি একনম্বর ওষুধটা দিতে বলল। বাচ্চাদের সর্দিকাশির অ্যান্টিবায়োটিক। দ্বিতীয় ওষুধ কাফ সিরাপ, বোধহয় বাড়িতে আছে। তাক থেকে ক্যাপসুলের বাক্স নামিয়ে দুটো স্ট্রিপ বার করে আনল শিলাদ। বউদি বলল, ডাক্তার কোনও ভিটামিন দিল না কেন বলো তো? অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে একটা করে ভিটামিন ট্যাবলেট দিত আগে।

ব্যবসায়িক নম্রতায় শিলাদ বলল, এই অ্যান্টিবায়োটিকের কম্পোজিশনে ভিটামিন দেওয়াই আছে বউদি।

নিশ্চিন্ত হয়ে পার্স বার করে বউদি জানতে চাইল, কত হল?

শিলাদ দাম বলতে, টাকা মিটিয়ে দিয়ে চলে গেল বউদি। পাড়ায় যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটেছে, যেন জানেই না। কোনও ছাপ নেই চেহারায়। অথচ পাড়ার বিজয়ের মুদিখানার একই চাল, ডাল, তেল, নুন খাচ্ছে দুই বাড়ির লোক।

আবার একা হয়ে গেল শিলাদ। সামনের চাতালে একটা শালিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কী যে খুঁটে খাচ্ছে, ওই জানে। হাত চারেকের মধ্যে বসে আছে শিলাদ, পাখিটা গ্রাহ্য করছে না। দোকানটা তেমন ব্যস্ত নয় বলেই চাতালে পাখি হেঁটে বেড়ায়। শালিক ছাড়াও কাক, পায়রা আসে। এ পাড়ায় ব্যাবসা যে সেরকম চলবে না, দোকান উদ্বোধনের পরের দিনই বলে রেখেছিল সন্তু। তখন ওর কথা বিশ্বাস হয়নি। পরে সেটাই প্রমাণ হয়েছে।

বেশ একটা চনমনে ভাব নিয়ে দোকান উদ্বোধনের পর দ্বিতীয় দিন দোকানের শাটার তুলেছিল শিলাদ। খানিকক্ষণ পর এই চাতালে এসে দাঁড়িয়েছিল এক সদ্যযুবক। অনুজ্জ্বল পোশাক, বেশ রোগা, গায়ের রং ফরসার দিকে, একমাথা কোঁকড়ানো চুল। সব মিলিয়ে গরিবঘরের ভদ্রছাপ। বলল, এত বড় দোকান ফঁাঁদলেন, এখানে চলবে? পাড়াটার সম্বন্ধে একটু খোঁজখবর করে নিলে পারতেন তো!

স্বাভাবিক কারণেই কথাটা পছন্দ হয়নি শিলাদের। দোকান নিয়ে তখন তার কত স্বপ্ন! বিরক্তি গোপন করে শিলাদ জানতে চেয়েছিল, কেন, চলবে না কেন?

বড়লোক কাস্টমার পাবেন না। বেশির ভাগ হোমিওপ্যাথি পার্টি। দশ বছর আগেও এ পাড়ায় হাতে গোনা পাকা বাড়ি ছিল। এখন অনেক পাকা ছাদ দেখছেন বটে, তবে পয়সা খরচ করার দম নেই, মনও নেই।

সন্তুর কথার পরে শিলাদ চোখের ইশারায় উলটো দিকে ফ্ল্যাটবাড়িটা দেখিয়ে বলেছিল, আর এগুলো?

ফিচেল হাসি হেসে সন্তু বলল, ওদের অবস্থা আরও খারাপ। লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে। ভীষণ হিসেব করে চলে। নইলে চপের দোকানে কেউ ধারের খাতা রাখে…

সেদিন এ কথা সে কথায় জানা গেল, চপের দোকানটা সন্তুর। বিক্রিবাটা মোটামুটি, সংসার চালানোর মতো নয়।

নতুন ব্যবসায় নামা শিলাদের ভিতর তখন আলাদা উদ্দীপনা কাজ করছে, সেই প্রত্যয়

থেকে ঘুরিয়ে একটু জ্ঞান দিয়েছিল সন্তুকে। বলেছিল, বিজনেস যদি মন লাগিয়ে করা যায়, যে-কোনও জায়গায় চলবে।

ওই দিনই সন্ধেবেলা ছেঁড়াফাটা জামা পরা একটা বাচ্চা ছেলে শালপাতায় দুটো চপ নিয়ে এসে শিলাদকে দিল। বলল, সন্তুদা পাঠাল।

দাম না নিয়ে দৌড়োল ছেলেটা। চপ দুটো খেল শিলাদ। টেস্ট দারুণ! সেদিন আর দাম দিতে পারেনি। দোকান বন্ধ করে সন্তুদের বাড়ির দিকে গিয়ে দেখে, আগেই ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে।

পরের দিন সন্তু এসেছিল শিলাদের দোকানে। এমনিই, একটু আড্ডা মারতে। শিলাদ চপের দাম দিতে গেলে, সে কিছুতেই নেয়নি। বলেছিল ওটুকু খাওয়ানোর মতো রোজগার আমার হয়। তারপর ভ্রূ নাচিয়ে জানতে চেয়েছিল, তা, খেয়ে কী মনে হল, চপটা মন দিয়ে বানাই তো?

আগের দিন শিলাদের দেওয়া জ্ঞানের উত্তর ছিল সেটা। ওতেই শিলাদ টের পায়, ছেলেটার আত্মসম্মান জ্ঞান টনটনে। সন্তুর মনোভাবকে সমাদর করে শিলাদ ব্যাবসার অন্যদিকগুলোর কথা আর তোলেনি। কোয়ালিটি জিনিস দিলেই যে বিজনেস ভাল চলবে তার কোনও মানে নেই। দরকার ঠিকমতো সার্ভিস আর সেলসম্যানশিপ।

দিন কাটে। শিলাদ টের পেতে থাকে ওই দুটো গুণ তার যেমন আছে, সন্তুরও কিছু কম নেই। তবু এ পাড়ায় ব্যাবসা চালানো বেশ কষ্টকর। পারচেজিং ক্যাপাসিটি নেই এখানকার লোকের। ধারবাকি রাখার ঝোঁক প্রবল। মানুষগুলোর চালচলন, পোশাক আশাক দেখে বোঝাই যায় না ভিতরটা এরকম ফাঁপা! এদিকে চৌধুরী পরিবারের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে, বিশেষত কাকাদের ইন্ধনে এত বড় দোকান করে দিয়েছে বাবা। প্রচুর স্টক। বিক্রির যা হাল, অনেক ওষুধের ডেট এক্সপায়ার করে যাবে। সতর্ক হয়ে গিয়েছিল শিলাদ। কোনও ওষুধ ফুরোলে লিখে রাখে। খুব অল্প পরিমাণে সাপ্লায়ারের থেকে নেয়। ধার দেয় সন্তুর গাইড অনুযায়ী। পাড়ার লোকেদের নেচার আলাদা করে জানে সন্তু। স্টক কমিয়ে ফেলার দরুন বড় দোকানটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। ওষুধের বোতল, বক্সগুলো নানান কায়দায় সাজিয়ে ফাঁকটা ভরাট করার চেষ্টা করে শিলাদ। কিন্তু দোকানের সময়টাকে ভরাট করবে কীভাবে!

শিলাদকে একা কাউন্টারে বসে থাকতে দেখে সন্তু চলে আসত গল্প করতে। বেশিক্ষণ থাকত না। কাস্টমার এলেই চলে যেত। ওর সঙ্গে আড্ডা মারতে ভাল লাগত শিলাদের। অন্যদের মতো মাপজোখ করে কথা বলে না। কোনও ধান্দা নিয়ে আসত না শিলাদের কাছে। প্রাণ খুলে মনের কথা বলত। ফুটবল আর ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো-তে বাংলা সিনেমা দেখা ছিল ছেলেটার নেশা। শিলাদের মতোই মোহনবাগানের সাপোর্টার। দোকান খুলতে দেরি হবে বলে কলকাতায় গিয়ে খেলা দেখা হত না ওর। এখানকার সাবডিভিশন ম্যাচগুলো দেখত।

বাচ্চা ছেলেটাকে দিয়ে মাঝেমধ্যেই শিলাদকে চপ পাঠাত সন্তু। দাম নিতই না। শিলাদ বলত, আরে, এভাবে রেগুলার ভাজাভুজি পাঠাস না, অম্বলে মারা পড়ব।

সন্তু বলত, ওষুধের দোকানদারের আবার অম্বল! চপ খাওয়ার পরই ট্যাবলেট চিবিয়ে নেবে।

সম্বোধনে দু’জনেই ততদিনে এক ধাপ আন্তরিক হয়েছে। সন্তু ওর বাড়ির কথা বলত— পরিবারে কে কে আছে, আর্থিক পরিস্থিতি কীরকম ইত্যাদি— আর চিরকাল যা হয়ে এসেছে, আপার ক্লাসের যেন বরাবরের অধিকার তার চেয়ে লোয়ারের হাঁড়ির খবর জানা। এখানেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিজের কথা কিছু না জানিয়েও সন্তুর মুখে তার জীবনের গল্প শুনত শিলাদ। সন্তুর বাবা একসময় গঙ্গার ওপারে রিষড়ায় রংকলে কাজ করত। ছাঁটাই হওয়ার পর রংমিস্ত্রির কাজ শুরু করে। কাজটা আজ অবধি রপ্ত করতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই বেকার হয়ে যায়। চুল্লুর নেশা আছে। বাড়িতে প্রায় থাকেই না। পেটের রোগের ঠিকমতো চিকিৎসা না হয়ে সন্তুর মা মারা গেছে বছর আটেক হল। সন্তুরা এক ভাই, এক বোন। মা মারা যাওয়ার পর বাবা সন্তুর মাসিকে এ বাড়িতে নিয়ে আসে। সন্তু জানত না বাবা তার শালিকে বিয়ে করেছে কিনা।…

বাড়ির ব্যাপারে বেশিক্ষণ কথা বলতে পছন্দ করত না সে। প্রসঙ্গ পালটে চলে যেত খেলা আর সিনেমায়। পাড়ার দু’-চারটে লোকের সম্বন্ধে একটু নিন্দেমন্দ করত, তারা নাকি সন্তুকে চাকরি দেবে বলে কথা দিয়েও আজ পর্যন্ত দেয়নি। সময় কেটে যেত শিলাদের। এরই মধ্যে কোনও কারণে শিলাদ দু’-একবার সন্ধেবেলা কিছুক্ষণের জন্য দোকানের বাইরে এসে দেখেছে, সন্তুর চপের দোকানে মাছিপড়া ভিড়। খদ্দের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সন্তু। বাচ্চা ছেলেটা অবশ্য আছে, ভিড়ের ধাক্কায় পিছনে চলে যাচ্ছে বেচারা। শিলাদ জানে, সব চপের দোকানেই ঘণ্টা দুয়েকের একটা ভিড় লাগে। তাড়াতাড়ি সাপ্লাই দিয়ে ভিড় হালকা করতে পারলে আরও কাস্টমার জোটে। নয়তো ভিড় দেখে কেটে যায় পাবলিক। রোজগার বাড়ে না। শিলাদ একদিন কথায় কথায় সন্তুকে বলেছিল, সারাদিনে দু’ঘণ্টা তো চাপ থাকে দোকানে। তোর বোন আর মাসিকে বলিস না কেন হাতে হাতে একটু জোগাড় দিতে। অদ্ভুত একটা বিষণ্ণ হাসি হেসেছিল সন্তু। বলেছিল, বাড়ির সব কথা তো তোমায়

বলিনি। আমার মাসিকে হয়তো দেখোনি তুমি। বোনকে তো দেখেছ। দেখলে মনে হয়, চপের দোকানে হেল্প করবে?

কে তোর বোন? আমি দেখেছি কি?

সত্যি কথাই বলেছিল শিলাদ। তার আলাদা কোনও আগ্রহ ছিল না সন্তুর বোন বা মাসিকে চেনার। কিন্তু তারপরে সন্তু যা বলল তাতে রীতিমতো থতমত খেয়ে যায় শিলাদ। সন্তু বলেছিল, আরে বাবা, এ পাড়ার মিলি গো, ওই আমার বোন।

মেয়েটিকে বিলক্ষণ চেনে শিলাদ। এ পাড়ায় দোকান খোলার পর থেকেই চোখে পড়েছিল। নাম জেনেছে কিছুদিন বাদে। কিন্তু ওই মেয়েটাই যে সন্তুর বোন, ঘুণাক্ষরেও আন্দাজ করতে পারেনি! মিলি দোকানের সামনে দিয়ে প্রায়ই যাতায়াত করে। লেটেস্ট ডিজাইনের সালোয়ার-কুর্তি, জিন্‌স-টিশার্ট। তবে পোশাকগুলোকে ব্যবহারের শিক্ষা যে তার নেই, তা পরিষ্কার বোঝা যেত। শিলাদ ধরে নিয়েছিল মিলি অশিক্ষিত, কালোটাকাওলা বাড়ির মেয়ে। গায়ের রং একটু চাপা হলেও মিলির মুখ-চোখ খুব সুন্দর, অ্যাট্রাকটিভ

ফিগার! একটা ব্যাপারই বড় গন্ডগোলের। ওর চলাফেরা, তাকানোতে সর্বদাই থাকে যৌন প্ররোচনা। নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য যেন উন্মুখ হয়ে আছে। শিলাদ ধরে নিয়েছিল, মেয়েটার বয়স অল্প, লেখাপড়া বিশেষ করেনি, প্রেমের সূক্ষ্ম মহার্ঘ অনুভূতি সম্বন্ধে অবগত নয়। প্রেম বলতে সরাসরি যৌনতাকেই বোঝে। তাই আগুনে ঝাঁপ দেওয়া পোকার মতো বেপরোয়া হয়ে গেছে। একবার পূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা হলেই, মেয়েটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। এমনটা এই ধরনের মেয়েদের ক্ষেত্রে হয়। শিলাদের দিকেও মিলি নিয়মিত উসকানিমূলক আবেদন রেখে এসেছে। চোখ দিয়ে জবাব দিয়েছে শিলাদ। তবে তার অভিব্যক্তি ছিল খুবই আড়ষ্ট। শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়নি। ছাড়ানো সম্ভবও নয়। শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন পরিবারে বেড়ে উঠেছে সে। চোখে চোখে খেলার নির্দোষ লোভটাকেও সামলানো যেত না। ওষুধ কেনার ছুতোয় মিলি মাঝে মাঝে উঠে আসত দোকানে, চোখেমুখে যৌনতার ধারালো হাসি। এসে হয়তো চাইল মাথা ধরার ট্যাবলেট কিংবা গলা খুসখুসের লজেন্স। শার্ট বা কামিজের সামনেটা অনেকটা উন্মুক্ত। কাউন্টারে কনুই রেখে, বাহুর চাপে দুই বুকের মাঝে আনত গভীর বিভাজিকা। এত ঝাঁঝ সহ্য করার ক্ষমতা শিলাদের ছিল না। অপ্রতিভ হয়ে পড়ত খুব। আর এতেই মিলি বুঝে যেত শিলাদের দৌড়। আর বাড়াবাড়ি করত না। খেলাটা অবশ্য চালিয়ে যেত। শিলাদেরও নেশার মতো পেয়ে বসেছিল। নারীবিহীন জীবনে ওইটুকু পাওয়াই অনেক। স্বমৈথুনের সময় হামেশাই মিলিকে মনে মনে নগ্ন করে নিত শিলাদ। যখনই জানল মিলি সন্তুর বোন, ভিতরে ভিতরে অপরাধবোধে ভুগেছিল শিলাদ। এক ধরনের সামাজিক মূল্যবোধ আর কী! বন্ধু বা ওই স্থানীয় কারও বোনকে নিয়ে অশ্লীল কিছু ভাবতে নেই।

সেদিন মিলির বিষয়ে সন্তু আরও কিছু হতাশার কথা শুনিয়েছিল। বলেছিল, বোনটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে। বলার কেউ নেই। বাবা ছেলেমেয়ের ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। মাসি আশকারা দিয়ে বোনের মাথাটা খাচ্ছে।

মিলি সম্বন্ধে অনেকটাই কমিয়ে বলেছিল সন্তু। ও যে কী পরিমাণে খারাপ হয়ে গেছে, প্রমাণ পাওয়া গেল ক’দিন বাদেই। রাত তখন আটটা-সাড়ে আটটা হবে। শিলাদের দোকানে খদ্দের। লম্বা প্রেসক্রিপশন। খুঁজে এনে ওষুধ দিচ্ছে শিলাদ। এমন সময় সন্তুদের বাড়ির দিক থেকে ভেসে এল চিৎকার-চেঁচামেচি। আওয়াজটা ক্রমশ বাড়ছিল। রাস্তার লোকজন ছুটে যাচ্ছে ওদিকে। শিলাদের কাস্টমারও প্রেসক্রিপশন রেখে নেমে গেল ঝগড়া দেখতে। সন্তুর দোকানে কোনও ঝামেলা হল না তো? আশঙ্কা করে শিলাদ বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়, সন্তুদের বাড়ির দোরগোড়ায় একটা রিকশা। তাতে বসা মুশকো চেহারার একটা লোক। হেভি ড্রেস, উঁচু হিলের চটি পরা মিলি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে লোকটাকে কী সব বলছে, লাফিয়ে উঠে পড়ছে রিকশায়। লোকটাকে চড়থাপ্পড় মারছে। প্রত্যাঘাতের ধার মাড়াচ্ছে না লোকটা। নিজেকে বাঁচাতেই ব্যস্ত। প্রতিবাদস্বরূপ মিনমিন করে কিছু বলছে। সদরে দাঁড়িয়ে মিলির মাসিও সমানে হাত পা ছুড়ে চিল্লিয়ে যাচ্ছে। মিলির মাসিকে ততদিন চিনে গেছে শিলাদ। ঝগড়াটা কেন্দ্র করে জমা হচ্ছে পাবলিক।

শিলাদও পায়ে পায়ে গিয়েছিল সেখানে। কাছ থেকে মিলির ড্রেস, মেকআপের হাল

দেখে বুঝল, বাইরে থেকে ঘুরে এসেছে। মিলিকে বলতে শুনল, কী ভেবেছ শালা। নেশা করিয়ে দিয়েছ বলে টাকার খেয়াল থাকবে না। যা কথা হয়েছে পুরোটা দিতে হবে ফুল পেমেন্ট চাই…

নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা লোকটা জড়িয়েমড়িয়ে কী একটা বলতেই মিলি আবার উঠে পড়ল রিকশায়, লোকটার মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেবে। পারল না। লোকটা আঁকড়ে ধরে রেখেছে নিজের বুকপকেট। মিলি নেমে এল নীচে। তখনই একবার চোখাচোখি হয়েছিল শিলাদের সঙ্গে। একটু বুঝি মিইয়ে গিয়েছিল মিলি। আর ওখানে দাঁড়ায়নি শিলাদ। দোকানে ফিরতে থাকে। ওর সঙ্গে ফিরছিল প্রেসক্রিপশন রেখে যাওয়া কাস্টমার। মাঝবয়সি সেই লোকটা বলছিল, পাড়াটাকে একেবারে নরক করে দিল। আমাদের ছেলেমেয়েরা কী শিখবে বলো তো। সবাই মিলে এদেরকে পাড়া থেকে তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে। সন্তু পরের দিন দোকানে এল। চোখেমুখে বিমর্ষ ভাব। বলল, আমাদের বাড়ির কালকের

ঘটনাটা শুনেছ তো?

দেখেছি। সিরিয়াস থেকে বলেছিল শিলাদ।

আর-এক পরত বিষণ্ণ হয়েছিল সন্তু। বলেছিল, পাড়ার লোক ছ্যা ছ্যা করছে। আমার আর এ বাড়িতে থাকতে ভাল লাগছে না। ভাবছি এবার পালিয়ে যাব। ঝামেলাটা যখন হচ্ছিল, কোথায় ছিলি তুই? দোকান দেখলাম বন্ধ।

শিলাদের কথার উত্তরে সন্তু বলেছিল, আমি তো লাফরাটা শুরু হতেই ঝাঁপ টেনে ধাঁ। আশপাশের কত ভাল ভাল ফ্যামিলির লোকজন আমার কাছে আসে। তাদের সামনে আমার মাথা কাটা যাবে না।

সন্তুর পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা যে এমন পাকাপাকি পর্যায়ের ছিল, তখন আন্দাজ করতে পারেনি শিলাদ। পাড়ায় ওরকম একটা জঘন্য সিন করার পরও মিলির মধ্যে কোনও চেঞ্জ দেখা গেল না। ঘটনাটার সময় শিলাদকে দেখে থমকালেও, পরবর্তীকালে যেমনকার তেমন কোমর দুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল রাস্তায়। ঘটনাটা যেন ঘটেইনি। উলটে অন্য একটা উপসর্গ দেখা দিল। শিলাদ যেহেতু তার আসল রূপ জেনে গেছে, অতিরিক্ত সাহসী হয়ে উঠল সে। একদিন কাউন্টারে উঠে এসে বিদেশি কন্ডোমের প্যাকেটগুলো দেখিয়ে বলেছিল, একবার দাও না, দেখি ছবিগুলো। এখন তো কোনও কাস্টমার নেই।

ভীষণরকম গুম মেরে গিয়েছিল শিলাদ। রাগে কান মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছিল। একই সঙ্গে অনুভব করছিল তীব্র এক কামতাড়না। সেই কারণে নিজের ওপর এক ধরনের গ্লানিও তৈরি হচ্ছিল। মেয়েটাকে দু’কথা শুনিয়ে দেওয়ার মতো মনের জোর পাচ্ছিল না। সিমেন্টের মেঝেতে খুচরো পয়সা ফেলার মতো হেসে চলে গিয়েছিল মিলি।

ফের এসেছিল একদিন। র‍্যাকে পুরুষদের যৌনক্ষমতাবর্ধক ক্যাপসুলের প্যাকেট দেখিয়ে বলল, মেয়েদের জন্য ওরকম কিছু ওষুধ পাওয়া যায় না? মস্তিটা কেমন হয় একটু দেখতাম।

শিলাদ আগের মতোই বোবা হয়ে বসে ছিল। হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল মিলি। সন্তু আসত। দুঃখ করত বোনকে নিয়ে। বলত, লেখাপড়ায় ভাল মাথা ছিল, জানো।

মাসি এসে স্কুল ছাড়াল, ওর একটা কাজের জন্য পাড়ার কত লোককে যে বলেছি। কিন্তু পেটে ওই সামান্য বিদ্যে নিয়ে ঝি-গিরি করা ছাড়া আর কী কাজ পাবে বলো?

শিলাদ বলেছিল অনেক হোমটোম আছে শুনেছি। এই ধরনের মেয়েদের হাতের কাজ শিখিয়ে রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেয়। দেখ না, ওরকম কোনও অর্গানাইজেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কিনা।

সন্তু হাল-ছাড়া গলায় বলেছিল, এখন কাঁচা টাকা দেখে নিয়েছে, হোমে কি আর যেতে চাইবে! বাবা আর মাসিও ওকে ছাড়বে না। ওর টাকাতেই তো সংসারের লপচপানি চলছে। আমার দোকান থেকে ক’পয়সা আর আয় হয় বলো!

শিলাদও জানে, এই সমস্যার সমাধান সহজ নয়। দিন যাচ্ছিল। সন্তু আসে, একথা সেকথা হয়। সন্তুর মধ্যে আগের সেই এনার্জি দেখা যাচ্ছিল না। ক্রমশ ঝিমিয়ে পড়ছিল। দিন চারেক হল শিলাদের দোকানে হঠাৎ সন্তুর মাসি এসে হাজির। বলল, মেয়েটার জ্বর এসেছে। ওষুধ দাও তো বাবা।

শিলাদ বলেছিল, ডাক্তার দেখিয়ে নিন।

মাসি বলল, একটু-আধটু জ্বরের জন্য আবার ডাক্তার। আশি-একশো টাকা বেরিয়ে যাবে। তা ছাড়া আমার মেয়েই বলে দিল তোমার কাছে আসতে।

বাবা মাসিকে বিয়ে করেছে কিনা সন্তু নিশ্চিত নয়। মাসি কিন্তু নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিচ্ছে মিলির। সন্তুর ক্ষেত্রেও হয়তো তাই করে। সম্পর্কটা মমত্বের, নাকি লোকদেখানো, তা বোঝা ভারী কঠিন।

ডাক্তার না দেখিয়ে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়া এখন কমন প্র্যাকটিস। আর শিলাদ নিজেও যখন বিক্রি করে, মাসিকেও দিতে হবে। শিলাদ জানতে চেয়েছিল, জ্বরের সঙ্গে সর্দিকাশি আছে?

কাশি নেই। ভীষণ হাঁচছে। জল গড়াচ্ছে নাক দিয়ে।

সিম্পটম শুনে নিয়ে জ্বর আর অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ট্যাবলেট দুটো করে দিয়েছিল শিলাদ। দেওয়ার সময় দোকানের ঠাকুরের উদ্দেশে মনে মনে বলেছিল, মান রেখো। ওষুধে যেন কাজ হয়।

মুখে রোগ শুনে ওষুধ দিতে হলে প্রতিবারই এইভাবে ঠাকুরকে স্মরণ করে নেয় শিলাদ, ওষুধে মোটামুটি কাজ হয়। কিন্তু মিলির ক্ষেত্রে হল না। একদিন বাদেই মাসি এসে যথেষ্ট অনুযোগের সুরে বলতে শুরু করল, কী ওষুধ দিলে। মেয়ের জ্বর তো ছাড়েই না। এখন আবার সর্দি বসে একসা কাণ্ড।

মাসিকে তখন আর বলে লাভ নেই যে, প্রথমেই ডাক্তার দেখাতে বলা হয়েছিল। ওষুধ একবার দিয়ে ফেলেছে শিলাদ। তাই বলেছিল, ওকে দেখতে পারলে ভাল হয়।

তা যাও না। গিয়ে দেখো। বলে দোকানের সামনে থেকে চলে গিয়েছিল মাসি। খানিক বাদে বাড়িওয়ালা নেমে এসেছিল শিলাদের কাছে ওষুধ নিতে। শিলাদ বলেছিল,

মেসোমশাই, আপনি দোকানে একটু বসুন। আমি একটা কাজ সেরে এক্ষুনি আসছি। সন্তুদের উঠোনে পা দিয়ে মনটা ভাল হয়ে গিয়েছিল শিলাদের। বেশ গাছপালা আছে।

সামনেই নাতিদীর্ঘ একটা কাঁঠাল গাছ, যার গাঢ় সবুজ পাতায় বিকেলের সোনালি আলো, পাঁচিল ঘেঁষে সারি দেওয়া পেঁপে গাছ। একটু দূরে পেয়ারা। এসবের সঙ্গে সন্তুদের টালি চালের বাড়ি। এই ইট-কাঠের শহরে এক চিলতে গ্রামের অনুষঙ্গ।

সন্তুর নাম ধরেই হাঁক পেড়েছিল শিলাদ। তিনটে ঘরের একটা থেকে ভেসে এল মিলির দুর্বল স্বর, দাদা নেই। আমি এই ঘরে।

গলার আওয়াজ অনুসরণ করে শিলাদ পৌঁছেছিল ঘরটায়। আবছা অন্ধকারে মিলি চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে ছিল খাটে। শিলাদকে দেখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আধশোয়া হল।

দেখি, জ্বর কীরকম। বলে মিলির কপালে হাত রেখেছিল শিলাদ। পরমুহূর্তে বুঝেছিল ওকে ছোঁয়া কত বড় ভুল হয়ে গেছে। শিলাদের হাতটা ধরে নিয়ে মিলি বলেছিল, জ্বর ওখানে নেই, এখানে।

ম্যাক্সির ভিতর দিয়ে শিলাদের হাত টেনে এনে রেখেছিল নিজের বুকে। শিলাদের কী একটা হয়ে গেল, পড়ে গেল অদ্ভুত ঘোরে। চরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছিল মিলি। বলেছিল, দাদা ম্যাচ দেখতে গেছে, মাসি এখন ফিরবে না।

বাবার কথা তোলেনি, রাতের আগে কোনওদিনই ফেরে না। সম্পূর্ণ যৌন অভিজ্ঞতা শিলাদের নেই। সমস্তটাই নিয়ন্ত্রণ করছিল মিলি। শিলাদের মনে হচ্ছিল সে বুঝি কোনও আগুনের গোলা আঁকড়ে আছে অথচ পুড়ছে না। অদ্ভুত এক সুখ।

একসময় নিভল আগুন। বিছানায় বসে শিলাদ দেখেছিল জানলার বাইরে কাঁঠাল গাছে একটু একটু করে সন্ধে জড়ো হচ্ছে।… শিলাদের সংবিৎ ফিরল রাস্তায় মানুষজনের চঞ্চলতা দেখে। সন্তুদের বাড়ির ভিড়টা চারিয়ে গেছে রাস্তায়। পাবলিক রাস্তার দু’ধারে সরে দাঁড়িয়ে কী যেন আসতে দিচ্ছে। শিলাদ আন্দাজ করার আগেই ভ্যানরিকশায় প্লাস্টিক শিটে মোড়া সন্তুর দেহ এসে পড়ে। সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে সন্তু। মাথাটা শুধু নড়ছে। একবার যেন স্থির হল শিলাদের দোকানের দিকে। নীল প্লাস্টিকে মোড়া মুখটা মানসচক্ষে দেখতে পেল শিলাদ, সন্তুর চোখে হতাশা, ঠোঁটে ঘৃণা-মাখানো হাসি।

দুপুরবেলা এখানকার দোকানপাট সব বন্ধ থাকে। শাটারে তালা মেরে শিলাদও গিয়েছিল বাড়িতে স্নান-খাওয়া করতে। স্নানের সময় ধুয়ে গেল সমস্ত গ্লানি, অনুতাপ, অপরাধবোধ খাওয়া অবশ্য ভাল করে হল না। মা বারবার বলছিল, কী হয়েছে বল তো তোর? ভাত নিয়ে খালি নাড়াচাড়া করে যাচ্ছিস! শরীর খারাপ নাকি?

শিলাদ কোনও উত্তর দেয়নি। সন্তুর অপমৃত্যুর ধাক্কায় সে মারাত্মক একটা ব্যাপার ভুলতে বসেছিল! হঠাৎ মনে পড়ে গেছে। সেদিন মিলির সঙ্গে ওইসব হওয়ার পর বিছানায় থম মেরে বসে ছিল শিলাদ। মিলি বলেছিল, কী হল, ওরকমভাবে বসে রইলে যে! চিন্তা হচ্ছে? আমার সঙ্গে শোওয়ার ফলে রোগ হয়ে যাবে কিনা?

চমকে উঠেছিল শিলাদ, কী করে মনের কথা পড়ে ফেলল মিলি ! বিস্মিত শিলাদকে আশ্বস্ত করে মিলি বলেছিল, কন্ডোম ছাড়া আমি পার্টির সঙ্গে শুই না। রোগের ভয় আমারও আছে। তোমার বেলায় অন্যরকম হয়ে গেল। আমার এখন চিন্তা হচ্ছে পেটে না কেউ এসে যায়।

মুহূর্তের মধ্যে দুশ্চিন্তা উলটো খাতে বইতে লাগল। আগের চিন্তার থেকে যা কোনও অংশে কম নয়। অসহায়ের মতো বসে ছিল শিলাদ। মিলিই বাতলে দিয়েছিল সমাধানের পথ। বলেছিল, এখন কী একটা ট্যাবলেট বেরিয়েছে না, তিন দিনের মধ্যে খেয়ে নিলে ঝামেলা থাকে না কোনও। ওই একটা দিয়ো আমাকে। জ্বর-সর্দির জন্য কী দেবে দেখো।

অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজ পকেটে করে নিয়ে গিয়েছিল শিলাদ। ট্যাবলেটগুলো দিয়ে এসেছে। হাতে যেহেতু সময় আছে, মিলিকে একটা দিন সুস্থ হতে দিয়েছিল। ভেবেছিল মিলি নিজে এসে বাহাত্তর ঘণ্টার ডোজটা নিয়ে যাবে। স্ট্রিপে দুটো ট্যাবলেট থাকে। ওই সময়ের মধ্যে বারো ঘণ্টা অন্তর খেয়ে নিতে হয়। একান্ত যদি সম্ভব নাহয়, শেষ ঘণ্টায় দুটো ট্যাবলেট এক সঙ্গে খেয়ে নিলেও চলে। এ সবই মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিল সন্তুর ঘটনায়। প্রায় বিয়াল্লিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। বিকেলে দোকান খোলার পর থেকেই ছটফট করছে শিলাদ, ওষুধটা কীভাবে দেওয়া যায়। সন্তুর ঘটনাটা সকালেই ঘটেছে, ওদের বাড়ির অবস্থা এখন খুবই খারাপ। হয়তো মিলিরও মাথায় নেই ট্যাবলেটের কথা। এই সময় গিয়ে ওষুধটা দেওয়া ভীষণই অস্বস্তিকর। এদিকে শিলাদের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে চলে। ভেবে পায় না, কী করবে!

সন্ধের মুখে দেখা গেল সন্তুর দোকানের বাচ্চা ছেলেটা উদাস হয়ে রাস্তায়, ঘোরাঘুরি করছে। সন্তুর কাছে চাকরি করত না ছেলেটা, নিজের মনেই হেল্প করত। খুশি হয়ে দু’চার টাকা দিত সন্তু।

বাচ্চাটাকে হাতের ইশারায় ডাকল শিলাদ। চাতালে উঠে এল সে। ইমারজেন্সি পিলের প্যাকেট র‍্যাক থেকে নামিয়ে পকেটে পুরল শিলাদ। বাচ্চাটাকে বলল, দোকানটা একটু দেখ। আমি যাব আর আসব।

রাস্তায় নেমে এল শিলাদ। সন্তুদের বাড়ির দিকে পাঁচ-ছ’কদম এগিয়েই থমকে যেতে হল। একটা রংজ্বলা ম্যাক্সি পরে সদরের চৌকাঠে এলোচুলে বসে আছে মিলি। শবদেহ চলে গেলে যেমনভাবে খই পড়ে থাকে।

আর মাত্র ঘণ্টা তিনেক রয়েছে হাতে। গতকাল মিলিকে ওইভাবে সদরে বসে থাকতে দেখে এগোতে পারেনি শিলাদ। ফিরে এসেছিল দোকানে। ভেবেছিল, যাক গে, এখনও তো একটা দিন আছে। শোকটা একটু থিতুক মিলিদের বাড়িতে। কিন্তু সময় যে কখনও সখনও এত তাড়াতাড়ি কাটে, ধারণা ছিল না শিলাদের। আজ দোকান খোলার খানিকক্ষণের মধ্যেই যেন একটা বেলা কেটে গিয়েছিল। ভীষণ উদ্গ্রীব হয়ে মিলির জন্য অপেক্ষা করেছে শিলাদ। দোকান থেকে নেমে বেশ কয়েকবার মিলিদের বাড়ির সামনে গেছে, সদর হাট করে খোলা। বাড়ির মধ্যে কেউ আছে বলে মনে হয়নি। দোকান বন্ধ করার পর ঢুকে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে, একটা দাঁড়কাক কাঁঠাল গাছে বসে ডেকে যাচ্ছে। কেমন একটা গা ছমছমে ভাব। মাসি বাড়িতে ছিল। বলল, মিলি বেরিয়েছে।

শিলাদ জানতে চেয়েছিল, দূরে কোথাও গেছে নাকি? রাত হবে ফিরতে? ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল মাসি। চোখ যেন বলতে চায়, কী মনে করো মেয়েটাকে!

দু’দিনও পুরো কাটেনি দাদা মারা গেছে, এখনই রং মেখে বাজারে বেরিয়ে যাবে! মুখে বলল, খুব দূরে কোথাও যায়নি। ম্যাক্সি পরে আছে। সকাল থেকে কোথায় কোথায় যে ঘুরছে…

শিলাদের মাথায় আরও একটা আশঙ্কা ভর করে, মিলির মনের অবস্থা এখন কীরকম বোঝা যাচ্ছে না। পালিয়ে যাবে না তো?

একরাশ চিন্তা নিয়ে বিকেলে দোকান খুলেছে শিলাদ। একজন-দু’জন কাস্টমার এল গেল। তারা কারা, কী ওষুধ দিল, কিচ্ছু খেয়াল নেই। চোরাবালির মতো সময় সরে যাচ্ছে পায়ের নীচ থেকে। টেনশনে সারা শরীরে বিজবিজ করছে ঘাম। শূন্য দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে রাস্তার দিকে।

মোবাইল চা-ওয়ালাটা উঠে এল দোকানে। এই সময় রোজ আসে। ভাঁড়ে চা দিয়ে নেমে গেল। পরে এসে দাম নেবে।

শিলাদ চায়ে চুমুক মেরে ভাঁড়টা কাউন্টারে রেখেছে, দেখে, দোকানের চাতালে উঠে আসছে মিলি। পরনে অর্ডিনারি সালোয়ারকামিজ। শরীরের সমস্ত অস্বস্তি উধাও হতে থাকে শিলাদের।

মিলি অলস ভঙ্গিতে কাউন্টারে ঠেসান দিয়ে দাঁড়ায়। বলে, দুপুরে বাড়ি গিয়েছিলে শুনলাম।

শিলাদ চুপ করে থাকে। ফের মিলি বলে, ভুলিনি। ট্যাবলেটটা দাও।

পিলের প্যাকেটটা কাউন্টারের নীচের র‍্যাকে রাখা ছিল, বার করে খামে ঢোকাতে থাকে শিলাদ। এই ফাঁকে মিলিকে বলে, এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল। এবার তো নিজেকে শোধরাও!

খামটা রাখে মিলির সামনে। সেই দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে মিলি বলে, শোধরানোই যায়। ওষুধটা তুলে রাখো তা হলে।

বুকটা ধক করে ওঠে শিলাদের। মিলি কী বলতে চাইছে, বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। ওষুধের দিকে তাকিয়ে শিলাদ শুনতে পায় ঘড়ির বালি পড়ে যাওয়ার নিঃশব্দ শব্দ। খসে যাচ্ছে সময়। কার্যকরী ক্ষমতা ফুরিয়ে আসছে ড্রাগটার। কী বলে যে ওষুধটা মিলির হাতে তুলে দেবে, ভেবে পাচ্ছে না সে।

ঝিমানো গলায় মিলি বলতে থাকে, মারা যাওয়ার আগের রাতে দাদা আমাকে শোধরানোর কথা বলছিল। তুমি নাকি কীসব হোমটোমের গল্প করেছ। আমি আর বলিনি আগের দিনই তুমি আমার সঙ্গে…

থেমে গেল মিলি। গলা শুকিয়ে গেছে শিলাদের। ভাঁড়টা তুলে চা-টা যে খাবে, সেই ক্ষমতাটুকুও নেই।

ফের মিলি বলে, হোমটোমে গিয়ে কী আর হবে। একবার যখন বদনাম হয়ে গেছে, সবাই আমায় একই চোখে দেখবে। বিয়ে-শাদি করে কোনওদিনই ঘর করতে পারব না।

শিলাদ এখন ওষুধ, মিলি, কোনও দিকেই তাকাচ্ছে না। চেয়ে আছে রাস্তার ওপর।

বারবার চোখে ভেসে উঠছে ভ্যানরিকশায় প্লাস্টিকে মোড়া সন্তুর শবদেহ চলে যাওয়ার দৃশ্য। কোনও মুমূর্ষু রোগীকে ডাক্তার যেমন বাহাত্তর ঘণ্টা সময় দেয়, সমাজের মূলস্রোতে থাকা শিলাদের অস্তিত্বও বাঁধা পড়ে গেছে ওই ঘণ্টার শৃঙ্খলে। দ্রুত ফুরিয়ে আসছে তার পরিচয় সুরক্ষিত রাখার ওষুধের আয়ু। আর কিছুক্ষণ পরে এর আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না। এই মুহূর্তে শিলাদের কানে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এ পাড়ার প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ। ক্রমশ বাড়ছে আওয়াজটা। এতটাই জোরে বাজতে শুরু করেছে, এবার বুঝি শিলাদ কালা হয়ে যাবে।

বড় একটা শ্বাস ফেলে মিলি হঠাৎ প্যাকেটটা তুলে নেয়। বলে, চলি।

শিলাদ আশ্চর্য হয়ে দেখে,তাকে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে তার নিজের হাত ধরে নিয়েছে মিলির ওষুধ ধরা মুঠো।

একই ভূখণ্ডে দুটো নদী যখন মিলিত হয়, কারই বা অনুমতি নেয়। তুলনামূলক শীর্ণ নদীটাতে হঠাৎ ঢেউ ওঠে খুব। বিস্ময়ের আলোতে চিকচিক করে জল। মিলির চোখের কোণদুটোয় এখন সেই জলেরই ছায়া।

শারদীয় দেশ ২০১০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *