Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দেবী মনসা এবং আমার ছেলেবেলা || Sanjit Mandal

দেবী মনসা এবং আমার ছেলেবেলা || Sanjit Mandal

আজ ১লা ভাদ্র সোমবার ১৪২৭
১৭ই আগষ্ট ২০২০
শ্রাবণ মাসে নাগ পঞ্চমীতে আর সংক্রান্তি তিথিতে অনেক বাড়িতে সর্পের দেবী মনসার পূজা করা হয়, অনেক বাড়িতে আবার ভাদ্র মাসের সংক্রান্তিতিথিতে দেবী মনসার পূজা করা হয়।
জল জঙ্গল আর সাপ খোপ পোকামাকড়ে ভরা দুই বাংলাতেই সাপ ইত্যাদির অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার পূজা সুপ্রসিদ্ধ। মনসা মঙ্গল কাব্যে দেবী মনসার সম্যক পরিচয় পাওয়া যায়। মনসামঙ্গল কাব্যের আদি কবি হরি দত্ত। পুরুষোত্তম, নারায়ণ দেব প্রমুখ আনুমানিক ১৫ শতকে মঙ্গল কাব্য রচনা করেন।।বিজয় গুপ্ত এই কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি, তার লেখা মনসা মঙ্গল বা পদ্মপুরাণ ( ১৪৮৪-৮৫) খ্রীস্টাব্দে, কাব্য গুণের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়। অন্যান্য কবিদের মধ্যে ক্ষেমানন্দ, কেতকাদাস, বিপ্রদাস পিপলাই প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। বর্তমান কালে প্রখ্যাত নাট্যকার শম্ভু মিত্র চাঁদ বণিকের পালা নামে একটি নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করেন। মূলত এই সব কবিদের হাত ধরে মনসা মঙ্গল কাব্য অবিভক্ত বাংলা ও বাঙালির মনে একসময় আলোড়ন তুলেছিল, দেবী মনসার মাহাত্ম্য কীর্তন ও ঘরে ঘরে পূজা প্রচলন, ভয়ে এবং ভক্তিতে বাঙালির জীবনে মঙ্গল কাব্যের মাধুর্য এক সময়ে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলো।
মঙ্গল কাব্যের কাহিনী প্রসঙ্গে বলা যায়, চাঁদ সদাগর, চাঁদ বেনে নামে পরিচিত, আর বেহুলা ও লক্ষ্মীন্দর দের উপাখ্যানে এক শিব ভক্তের অনিচ্ছুক মনসাপূজার কাহিনী ও একই সঙ্গে এক পতিব্রতা নারীর সাপের কামড়ে মৃত স্বামীকে মরণপণ লড়াইয়ে বাঁচিয়ে তোলার অপূর্ব কাহিনীর কথা উল্লেখ করা যায়। সেই কাহিনী যেমন লোমহর্ষক, তেমনই মর্মন্তুদ ও অসাধারণ জীবন যুদ্ধের পরিচায়ক। নদী মাতৃক বাংলা ও বাঙালির জীবনে তার প্রভাব সুদূর প্রসারী হয়েছিল।
ভয়ে হোক ভক্তিতে হোক সাপ খোপে ভরা বাংলা ও বাঙালির জীবনে সাপের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসার স্থায়ী আসন পাতা হয়েছিল মঙ্গল কাব্যের কবিদের হাত ধরে।

শ্রাবণের সঙ্ক্রান্তি তিথিতে আর ভাদ্র মাসের সঙ্ক্রান্তি তিথিতে অর্থাৎ ভরা বর্ষায় যখন সাপ খোপের উৎপাত ভীষণ বেড়ে যায় তখন সর্পের দেবী মনসার পূজা করা হয়। মূলত পূর্ব বাংলার এবং পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যেই এই দেবীর পূজা প্রচলিত ছিল বা আছে। ভাদ্র মাসের শেষ লগ্নে যে মনসা পূজা তা মূলত পশ্চিম বাংলার মানুষের মধ্যে প্রচলিত। পশ্চিমবঙ্গে ওই দিনটি অরন্ধন হিসাবে ও পালিত হয়। মনসা পূজার সাথে সাথে ওই দিন বাস্তুদেবতার পূজা করা হয়।
আমাদের বাড়িতেও মনসা পূজা এবং অরন্ধন পালিত হতো, মা, ঠাকুমা আর দিদিরা মিলে কয়েকদিন আগে থেকে ই জামাকাপড় কাচাকুচি, ঘর দুয়ার ঝাড়পোঁছ করে ঝকঝকে তকতকে করে রাখতে প্রাণান্তকর খাটুনি খাটতো, আর মনসা পূজার আগের দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন ধরনের রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিতো। বেহালা বাজার থেকে রাতে আমরা গোটা ইলিশ মাছ কিনে আনতাম, বাড়িতে সেই মাছ কাটা হতো। ঠাকুমা ই মাছ কেটে আমাদের দেখিয়ে দিতো অনেক কিছু কি কি জিনিস বাদ দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিয়ে মাছ কাটতে হবে কেননা ইলিশ কাটার পরে আর ধোয়া চলবে না।মাছের মাথার মধ্যে এক টুকরো কালো জিনিস দেখিয়ে বলতো এই দেখ পোড়া কাঠ, মাছের শরীর থেকে সাদা সাদা দুটো লম্বা সুতোর মতো জিনিস টেনে বের করে বলতো এই দেখ পৈতে, এগুলো খেতে নেই। আমাদের ভাই বোনেদের সকলের ইলিশের ডিম ভাজাও ছিলো দারুণ পছন্দের জিনিস। ইলিশের তেল আর ভাজা পেটি দিয়ে গরম পান্না খাওয়া ছিলো আর এক মজার জিনিস। তার জন্য একটা শর্ত ছিল, যতক্ষণ রান্না চলবে ততক্ষণ আমাকে পদ্মপুরাণ জোরে জোরে সুর করে পড়ে শোনাতে হবে। আমিও জোরে জোরে সুর করে বলতাম,
জাগো ওরে বেহুলা সায় বেনের ঝি।
তোরে পাইলো কাল নিদ্রা মোরে খাইলো কি।।

মা ঠাকুমা আর দিদিরা মিলে মুখে কাপড় বেঁধে, যাতে রান্না করতে করতে মুখের থুতু না ছেটায়, সারারাত ধরে শুদ্ধাচারে মনসা পূজার মহা যজ্ঞের রান্না সারতো, একদিকে যেমন ইলিশ, চিংড়ি পুঁটি,মৌরলা, ভেটকি, ন্যাদোস মাছ বাটা মাছ ইত্যাদি ভাজা হতো, অন্যদিকে আলু,বেগুন,পটল, কলা, বরবটি, লালশাক নারকেল ইত্যাদি ভাজা হতো, ইলিশের মাথা দিয়ে কচুশাক রান্না হতো, ডাল চচ্চড়ি হতো, নারকেল সাঁই হতো, চালতার টক হতো, গোবিন্দভোগ চালের সাথে নারকেলের দুধ আর কিসমিস পেস্তা কাজু দিয়ে সুগন্ধি পায়েস হতো। সমস্ত ধরনের পদ আগে মা মনসা এবং বাস্তু দেবতাদের উৎসর্গ করে তবে সেই প্রসাদ সকলের মধ্যে বিতরণ করা হতো। বিভিন্ন ধরনের অজস্র পদ রান্না হতো, কেননা আমাদের আত্মীয় স্বজন শুভানুধ্যায়ী পাড়া প্রতিবেশী দের সকলের নিমন্ত্রণ থাকতো অন্তত পক্ষে একশো জনের বেশি লোক আমাদের বাড়িতে খাওয়া দাওয়া করতো। আর আমাকে সারারাত ধরে মনসা মঙ্গল বা পদ্মপুরাণ জোরে জোরে সুর করে পড়ে শোনাতে হতো। সাধারণত ভোরের দিকে রান্না সমাপ্ত হলে মা ঠাকুমা রা মুখের বাঁধা কাপড় সরিয়ে গরম ভাতে জল ঢেলে পান্তাভাত বানাতো। আমার পদ্মাবতীর পদ্মপুরাণ পড়া শেষ হতো।
পরের দিন উনুনে আগুন জ্বলবে না, উনুনের মধ্যে মনসা গাছের ডাল, কাশফুল, শাপলা ফুলের মালা, আলপনা ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হতো, আমাদের বাড়িতে মনসা গাছের তলায় ভালো করে নিকিয়ে নিয়ে আলপনা দেওয়া হতো, নয় রকম নাগের মূর্তি মাটি দিয়ে বানানো হতো, দেবী মনসার ছলন কিনে আনা হতো, মনসা পুজো আর বাস্তু পুজো হতো একইসাথে খুব শুদ্ধাচারে, খাওয়া দাওয়া ও হতো খুব ধুমধাম করে, ওই দিন টাতেই সাধারণত বিশ্বকর্মা পুজো পড়তো, সারাদিন ঘুড়ি ওড়ানো, মাঞ্জা আর প্যাঁচ খেলাতেই মত্ত থাকতাম। কে কটা কেটে দিলো আর কে কটা কাটা ঘুড়ি ধরতে পারলো আর কে তার ঘুড়ি দিয়ে কটা ঘুড়ি লটকে আনলো তারও হিসাব চলত।

এবার বলি আমার ছোট বেলায় সাপের মুখোমুখি হওয়ার কাহিনী। আমার বয়স তখন ৬-৭ বছর হবে, বাবা খুব সকালে ৭টার মধ্যে অফিসে বেরিয়ে যেত, মা অতো সকালে ডাল আলুভাতে আর সামান্য মাছের ঝোল বানিয়ে দিতো, বাবা কিন্তু গরম ভাতে আলপাইন ঘি বা লক্ষ্মী ঘি মেখে তৃপ্তি করে খেয়ে নিতো। আর বাবার খাওয়া হলেই আমরা ভাইবোন মিলে ঘি আলুভাতে দিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে নিতাম, ওটাই ছিলো আমাদের হেভি ব্রেকফাস্ট। সেদিন ও অমন ভাত খেয়ে আমাদের খিড়কি পুকুরে আঁচাতে গেছি, পুকুরের ওপার থেকে এক কাকিমা চেঁচিয়ে বললো, শিগগির বাড়িতে গিয়ে দেখ কি হচ্ছে। আমি তড়িঘড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে খিড়কি দরজাটা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকতে যাবো, বাড়ির ভিতর থেকে সবাই চেঁচিয়ে বললো ঢুকিস না ঢুকিস না পালা। আমি ঘুরে বাগান পেরিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকে দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড চলছে। মনে কাকা, মদন কাকা, গোপাল কাকারা বড়ো বড়ো লাঠি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে, আর বিশাল এক সাপ যে নাকি আমার বড়দির দোলার সাথে সাথে মাথা দোলাচ্ছিল খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে, সে লোকজন দেখে মাথা নামিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। সাপটা এতো বড়ো আর ভয়ালদর্শন ছিলো যে লাঠিসোঁটা নিয়েও কেউ তার মুখোমুখি হতে পারছে না। সে তাড়া খেয়ে বাড়ির ড্রেনের পথে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, সাপের অর্ধেক টা বাড়ির ভিতরে আর অর্ধেক টা বাড়ির বাইরে, মোক্ষম সুযোগ বুঝে মদন কাকা সপাটে লাঠির আঘাত করে সাপটাকে কাবু করে ফেললো। আমরা তখন কাছে গিয়ে দেখলাম, বিশাল সাপের মাথায় জোড়া খড়মের চিহ্ন আঁকা, ভয়ংকর বিষধর, আমার বড়দি সেদিন ছোট বোনকে নিয়ে দোলায় দুলতে দুলতে ঘুম পাড়াচ্ছিলো, সাপটা উঠানে সটান দাঁড়িয়ে দোলার সাথে মাথা দোলাচ্ছিল। সামান্য অসাবধানতায় দুজনের ই ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারতো। বাবা অফিস থেকে ফিরে সব শুনে বলেছিল, বাস্তু সাপ, মেরে ফেলা ঠিক হয়নি। প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই ঘটনার পরে মদন কাকা ছয় মাস শয্যাশায়ী ছিলো। দুটো বড়ো বড়ো মাটি কাটার ঝুড়িতেও সাপটা ধরেনি।

আমার বয়স যখন ৯ -১০ বছর, একদিন ঠাকুমা বললো, চল দেখি আমার সঙ্গে, আমাদের ধান ক্ষেতে লাঙল দেওয়ার পরে আমাদের মইটা পড়ে আছে একলা আনতে পারবো না, তুই সঙ্গে চল। আমিও জলায় ধানগাছ দেখতে পাবো, আর ওই সময় টা পড়তে হবে না বলে এক পায়ে খাড়া। আমাদের ১৬ কাঠার ধানজমি পেরিয়ে ইন্ডিয়া ফ্যান কোম্পানির আমবাগান পেরিয়ে কোম্পানির বড়ো দিঘি পাড়ে একটা জাম গাছের পাশে এসেছি, ঠাকুমা বললো, তুই এখানে দাঁড়া, আর যেতে পারবি না এককোমর জল হয়ে গেছে, অনেক গুলো ধানজমি পেরিয়ে আমাদের ছোট কণি আর বেশ বড়ো দুটো ধানজমি। আমাকে দাঁড়াতে বলে ঠাকুমা চলে গেলো, আমি কোম্পানি বাগানের গোলাপজাম গাছটার দিকে তাকিয়ে আছি, অনেক গুলো পাখি জটলা করছে, উদাস হয়ে গেছিলাম, হঠাৎ পায়ের উপর কেমন একটা অনুভূতি হলো, মনে হলো কি যেন সড়সড় করে চলে যাচ্ছে। পায়ের দিকে তাকিয়ে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেলো, কালো একটা বড়ো সাপ গলায় লাল নীল কাঁটি, অর্ধেক ফণা বিস্তার করে আমার পায়ের উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে, আমি স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে আছি, একটু নড়াচড়া করছি কি ছোবল অবধারিত। সাপটা যখন অর্ধেকের বেশী আমার পা পেরিয়েছে মূহুর্তের মধ্যে পা টা ছুড়লাম, সাপটা ঘুরে ছোবল মারার আগেই তিন লাফে পেছিয়ে এসেই মারলাম ছুট বাড়ির দিকে। ওখান থেকে আমাদের বাড়ি প্রায় ১২ মিনিটের পথ, বাড়িতে এসে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম মায়ের কাছে। তখনও ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলাম। আমার বর্ণনা শুনে অনেকেই বলেছে ওটা কাল কেউটে ছিলো। এরও প্রায় একঘন্টা পরে ঠাকুমা এসে বলেছিল মই টা পাওয়া গেলো না, কেউ হয়তো নিয়ে চলে গেছে।

তৃতীয় ঘটনা ঘটেছিলো আমি যখন ক্লাস টেন এ পড়ি। আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার করুণাময় স্যার তার কোচিং সেন্টারে আমাকে বিনা পয়সায় পড়াতেন। সেদিন রাতে ক্লাস করে বাড়ি ফিরছি রাত ৯ টা নাগাদ। আকাশে জ্যোৎস্না, আমি আমাদের বাড়ির রাস্তায় ঢুকেছি আমার ডান দিকে শিব পুকুর, শিব পুকুরের পাশে বিরাট বড়ো কদম ফুলের গাছ, বাঁদিকে কাঁঠাল গাছ, দেবদারু গাছ শেওড়া আর কাঠ মল্লিকার গাছ। তাই একটু ছায়া ছায়া। সেই আবছা আলোয় দেখি বেশ বড়ো একটা সাপ এঁকেবেঁকে আমার দিকেই আসছে। চোখে পড়া মাত্রই বাড়ির পঞ্চাশ পা কাছে এসেও পিছন ফিরে দে ছুট। অনেকটা ঘুরে কালোর চায়ের দোকান পেরিয়ে, মুখুটি দের বাড়ির পিছন দিক দিয়ে পশুপতির বাগান পেরিয়ে আমাদের বাগান পেরিয়ে খিড়কি পুকুরের পাশ দিয়ে আমাদের খিড়কি দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। বাবা বারান্দায় ইজি চেয়ারে বিশ্রাম করছিল, আমাকে খিড়কি দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে বললো, কি ব্যাপার, খিড়কি দরজা দিয়ে কেন, বললাম, শিব পুকুর পাড়ে একটা সাপ দেখতে পেলাম, তাই ঘুর পথে ঢুকলাম। বাবা তৎক্ষনাৎ হ্যারিকেন নিয়ে জায়গাটা দেখে এসে বললো কই, কিছু দেখতে পেলাম না। পরে জেনেছি শিব পুকুরের পাড়ে জল ঢোঁড়া আর কেউটে দুই ধরনের সাপই বাসা বেঁধেছে।

চতুর্থ ঘটনা, আমি সন্তোষপুরে বাড়ি করেছি, একদিন দেখি একটা বিশাল বড়ো দাঁড়াশ সাপ আমার আম গাছের ডালে জড়িয়ে শুয়ে আছে। আমি চেষ্টা করছিলাম সাপটা কে কোনও মতে নামিয়ে বাড়ির ওপারে একটা পুকুরের দিকে তাড়িয়ে দিতে। সে উলটে আমার গ্যারেজে ঢুকে বসে রইলো। পাশের বাড়ির রায় বাবু সাহস করে তার ব্যবস্থা করে দিলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

মনসাপূজা উপলক্ষে সারাদিন ধরে নানা মেলা ও বিভিন্ন ধরনের ঘুড়ির লড়াই আকাশটাকে মুখরিত করে রাখে। সাধারণত এই দিনেই বিশ্বকর্মা পুজো হয়। সে পুজোর খাওয়া দাওয়া ও বেশ জমকালো হয়।
আর একটি কথা না বললেই নয়, সেটা হলো ইলিশ মাছ। পূব হোক আর পশ্চিম হোক দুই বাংলার মানুষের পাতে ওই দিন ইলিশ মাছের শোভা এক আলাদা মাত্রা বহন করে।

আমদের ছোটবেলায় বর্ষাকাল হোক বা এমনি অন্ধকার হোক বাড়ির আশেপাশে বা ঝোপঝাড়ে সাপের ভয় ছিলই। সাপ যাতে কোনো অনিষ্ট করতে না পারে সেইজন্য আমাদের মা আমাদের সব ভাইবোনকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন। রাতের অন্ধকারে আমাদের ভাইবোনেদের কাউকে প্রয়োজনে হ্যারিকেন নিয়ে বাইরে বেরোতে হলেও আমরা মায়ের শেখানো যে মন্ত্রটা সভয়ে বিড়বিড় করে আওড়াতে আওড়াতে পথ চলতাম সেটা হলো,

ওঁ আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা।
জরৎকারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তুতে।।

আমাদের মা আরও শিখিয়ে ছিলেন যদি খুব ভয় পাস, আর পুরো মন্ত্রটা মনে না পড়ে তবে শেষের লাইনটা মনে করে বলিস, অর্থাৎ
জরৎকারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তুতে।
এইটুকু বলিস। মাকে বলতাম মা তাও যদি মনে না থাকে তখন কি হবে?
মা আমাদের মনে সাহস যোগানোর জন্য বলতেন তা হলে শুধু জরৎকারু মুনির নামটা মনে মনে জপ করবি, দেখবি সাপ মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছে।
পরে বড়ো হয়ে জেনেছি সাপে কাটলেও কখনো ই ভয়ে ভীত হতে নেই, পরন্তু মনে সাহস সঞ্চয় করে প্রয়োজনীয় বাঁধন দিয়ে দেরি না করে হাসপাতালে বা স্থানীয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে যোগাযোগ করা উচিত। মা আমাদের মনে সাহস যোগানোর জন্যই যে আমাদেরকে অনেক কিছুই শেখাতেন সেটা বড়ো হয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি।
আমার সামান্য কাহিনীর শেষ অনুচ্ছেদ টানবো নবনাগ স্তোত্র দিয়ে, ভয়ে ভক্তিতে নয় বরং আমাদের দেশে সাপ তো অনেক আছে, তাদের যেমন বিচিত্র রূপের বাহার তেমনই নামের বাহার আর তেমনই তাদের বিষের বাহার। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি সব সাপ কিন্তু বিষধর নয়। আমাদের দেশে সাধারণত কেউটে, চন্দ্রবোড়া, শাঁখামুঠি, বোড়া ইত্যাদি সাপ বিষধর, আর সচরাচর দেখা যায় হেলে, ঢোঁড়া, বা জলঢোঁড়া, লাউডগা ইত্যাদি সাপের বিষ থাকে না। আমাদের দেশে যে নয়টি নাগ আছে তার পরিচয় জানতে আসুন নবনাগস্তোত্র খুঁজে দেখি।
নবনাগ স্তোত্রম
অনন্তং বাসুকিং শেষং পদ্মনাভঞ্চ কম্বলম।
ধৃতরাষ্ট্রং শঙখপালং তক্ষকং কালিয়ং তথা।।
এতানি নবনামানি নাগানাঞ্চ মাহাত্ম্যনাম্।
সায়ংকালে পঠেন্নিত্যং প্রাতঃকালে বিশেষতঃ।
নাস্তি তস্য বিষভয়ং সর্বত্র বিজয়ী ভবেৎ।।

ইতি দেবী মনসা ও আমার ছেলেবেলার সামান্য কথা সমাপ্তম।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *