দস্যু বনহুর ও রাণী দুর্গেশ্বরী
খট খট খট শব্দ মিশে যাওয়ার পূর্বেই বনহুর তাজের পিঠে চেপে বসলো।
সঙ্গে সঙ্গে তাজ পিছনের দু’পায়ে ভর দিয়ে সম্মুখের দু’পা উঁচু করে অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো- চি হি চি হি—তারপর উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো। গোরী পর্বতের চূড়ায় চূড়ায় তাজের খুরের প্রতিধ্বনি জাগলো। নিস্তব্ধ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলো সে শব্দে।
একপাশে আকাশচুম্বী সুউচ্চ পর্বতমালা আর একপাশে গভীর খাদ। কোনক্রমে একবার তাজের পদস্ফলন ঘটলে আর রক্ষা নেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মৃত্যু অবধারিত।
কোনো দিকে খেয়াল নেই বনহুরের উল্কা বেগে ছুটে চলেছে সে তাজের পিঠে। কে সে নারীমূর্তি যে রাক্ষসীর চেয়েও ভয়ঙ্কর, সাংঘাতিক। যে বিনা দ্বিধায় দস্যু বনহুরের আস্তানায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। যে নির্মমভাবে হত্যা করলো লালারামকে হত্যা করলো নিরীহ ডাক্তারটাকে। কে সেই পিশাচিনী রাণী দুর্গেশ্বরী। যার হাসির শব্দ শুধু অদ্ভুত বিস্ময়কর নয়। যাদুমন্ত্রের মত তীব্র। কিছুতেই তাকে ক্ষমা করবে না সে ক্ষমা করতে পারবে না। দস্যু বনহুর প্রতিশোধ নেবে লালারাম ও ডাক্তার হত্যার আর তার আস্তানায় প্রবেশের অপরাধের।
বনহুরের কানে ভেসে আসছে তখনও সেই শব্দ খট খট খট–দূরে অনেক দূরে সরে গেছে শব্দটা।
বনহুর সেই ক্ষীণ শব্দ লক্ষ্য করেই অশ্ব চালনা করে চলেছে।
অভিজ্ঞ অশ্বতাজ–প্রভুর মনোভাব সে বেশ বুঝতে পারে। এই মুহূর্তে সে বুঝে নিয়েছে কি তার কর্তব্য। ঐ ক্ষীণ শব্দটাই যে প্রভুর লক্ষ্য তা সে জানে তাই সে প্রাণপণে ছুটছে।
পর্বতের গা বেয়ে পথটা ক্রমান্বয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। কোনো স্থানে গভীর ঢালু কোনো স্থানে দু’পাশে সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ। আবার কোনো স্থানে পর্বতের গা বেয়ে নেমে এসেছে। খরস্রোতা ঝর্ণাধারা।
তাজ ঝর্ণার পানির মধ্য দিয়েই ছুটলো।
যেখানে গভীর খাদ সেখানে লাফ দিয়ে পার হচ্ছে। দূরে, বহু দূরে চলে এসেছে বনহুর তাজসহ। আশ্চর্য হলো বনহুর গোরী পর্বতের এ অঞ্চলের মনোরম দৃশ্য দেখে। অশ্ব খুরের ক্ষীণ শব্দটা এখন সম্পূর্ণ মিশে গেছে।
বনহুর তাজের লাগাম টেনে ধরলো।
গোরী পর্বতের এ স্থানটা বেশ প্রশস্ত, মাঝে মাঝে পাথর খণ্ডের বুক চিরে বয়ে চলেছে নদী আর নালা। স্থানে স্থানে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত নদীর ধারগুলো।
বনহুর তাজের পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ালো, আর এগুবে কিনা ভাবছে সে। সম্মুখে কলকল করে বয়ে চলেছে একটি সরু নদী। নদীর জলধারা ছোট ছোট পাথরখণ্ডের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে নিচের দিকে।
বনহুর অত্যন্ত পিপাসা বোধ করায় পানির ধারে এসে হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর দু’হাতের অঞ্জলি ভরে তুলে নিলো স্বচ্ছ পানি। যেমন সে মুখে ধরবে ঠিক সেই সময় একখানা ছোরা এসে গেঁথে গেলো তার পাশে মাটির মধ্যে।
পানি পান করা আর হলো না বনহুরের। চমকে ফিরে তাকাতেই তার আংগুলের ফাঁকে অঞ্জলির পানিগুলো ঝরে পড়ে গেলো। তাড়াতাড়ি ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে। এ যে সেই ছোরা, ছোরার বাটে স্বর্ণ তৈরি সিংহী মূর্তি।
বনহুর উঠে দাঁড়ালো নিশ্চয়ই আশে পাশে দূরে কোথাও আত্মগোপন করে আছে সেই পিশাচিনী। বনহুরের ধমনীর রক্ত উষ্ণ হয়ে উঠলো মুহূর্তে তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো।
হঠাৎ ভেসে এলো সেই হাসির শব্দ নারীকন্ঠের খিল খিল আওয়াজ।
বনহুর শব্দ লক্ষ্য করে ছুটে গেলো, দক্ষিণ হস্তে গুলিভরা উদ্যত রিভলভার। চোখ দুটি দিয়ে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হচ্ছে।
বনহুর অনেক সন্ধান করেও কোথাও কাউকে দেখতে পেল না। সন্ধ্যার অন্ধকারে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এলো তার। চারদিকে শুধু পাথর আর খরস্রোতা জলধারা ছাড়া কিছুই নজরে পড়লো না।
তাজের লাগাম ধরে এগুলো বনহুর সম্মুখে, এদিক-সেদিক আরও কিছুক্ষণ অনুসন্ধান করার পর আবার ফিরে এলো গোরী আস্তানায়।
বনহুর ফিরে আসতেই রহমান তাকে অভ্যর্থনা জানায়।
অন্যান্য অনুচর তাজকে নিয়ে চলে যায়।
বনহুর আর রহমান এগিয়ে চলে আস্তানার মধ্যে বিশ্রাম কক্ষের দিকে।
সর্দারের মুখোভাব লক্ষ্য করে রহমান বুঝতে পারে নিশ্চয়ই কার্যসিদ্ধ হয়নি। সহসা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহসও হয় না তার। বনহুরকে নীরবে অনুসরণ করলো সে।
বনহুর বিশ্রামাগারে প্রবেশ করে মাথার পাগড়িটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিলো বিছানার উপরে। হাতের রিভলভারখানা সশব্দে টেবিলে নিক্ষেপ করলো।
রহমান নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে।
বনহুর ক্ষিপ্রভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করলো তারপর গম্ভীর কণ্ঠে অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো–হাঃ হাঃ হাঃ।
বিস্মিত হলো রহমান, সর্দারকে এভাবে হঠাৎ হাসতে দেখে মনে মনে শিউরে উঠলো সে। না জানি কি ঘটনার সংযোগ ঘটেছে তার জীবনে, যার জন্য সর্দার এত বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।
সহসা আপন মনেই বলে উঠলো বনহুররাণী দুর্গেশ্বরী–হাঃ হাঃ হাঃ, রাণী দুর্গেশ্বরী— দস্যু বনহুরের চোখে ধুলো দেবে সে! রহমান।
বলুন সর্দার?
লালারামের মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করেছো?
হা সর্দার! লালারামের মৃতদেহ দাহ করার জন্য শ্মশান ঘাটে পাঠানো হয়েছে।
শ্মশানঘাটে কেন?
লালারাম হিন্দু, কাজেই তার মৃতদেহ হিন্দুমতেই সৎকার করা হয়েছে সর্দার।
বেশ ভালই করেছে। বনহুর আসন গ্রহণ করলো।
রহমান বললো–সর্দার, রাণী দুর্গেশ্বরীর কোন সন্ধান পাননি?
পাইনি, সত্যি বিস্ময়কর এ নারী। আবার অদ্ভুতভাবে হেসে উঠলো বনহুর। সে হাসির শব্দে গোরী পর্বতের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনি জাগলো।
গোরী পর্বতের দুর্গম গহ্বরে রাণী দুর্গেশ্বরীর আস্তানা। আস্তানার চারপাশে গোরী পর্বতের সুউচ্চ পাষাণ প্রাচীর। সে স্থানে দুর্গেশ্বরীর অনুচর ছাড়া একটি পিপীলিকা প্রবেশেরও সাধ্য নেই।
রাণী দুর্গেশ্বরী জানে,এই গোরী রাজ্যের একমাত্র রাণী সে। শুধু রাণীই নয় নিজকে সে নারীরত্ন বলে মনে করে। কারণ দুর্গেশ্বরী শুধু শক্তিশালিনী নারী নয় সে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা রমণী।
কিন্তু কে এই দুর্গেশ্বরী? কি এর পরিচয়?
গোরী রাজ্য আজ প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে এই দস্যুরাণীর অত্যাচারে। প্রতিদিন গোরী রাজ্যের দু’চার জন নাগরিকে যে নিরুদ্দেশ হচ্ছে না তা নয়। এসব নিরীহ জনগণ কোথায় যায় কি হয়–কেউ জানে না। শুধু এটুকুই সবাই জানে, যারা নিখোঁজ হয়েছে তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কারণ যারা একবার হারিয়ে গেছে তারা আর আসেনি।
শুধু নাগরিকদের হরণ করেই ক্ষান্ত হয় না দুর্গেশ্বরী। লুট তরাজ লেগেই আছে। গভীর রাতে অসংখ্য অনুচরসহ গোরী রাজ্যে প্রবেশ করে এবং নাগরিকদের সব কিছু হরণ করে নিয়ে যায়। ঐশ্বর্য আর সম্পদের সঙ্গে বাড়ির দু’চার জনকেও বেঁধে নিয়ে যায় তারা।
গোরী রাজ্যের এই চরম মুহূর্তে নিশ্চুপ থাকতে পারলেন না গোরীরাজ বাসুদেব। তিনি গোরীর পুলিশ মহলকে সজাগ হবার জন্য নির্দেশ দিলো।
পুলিশ মহল সজাগ হয়েও কোন ফল হলো না। রাণী দুর্গেশ্বরী ঠিক তার পূর্বকার্য পদ্ধতি মতই কাজ হাসিল করে চললো।
গোরীর রাজা বাসুদেব বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লো। কি করা যায় কি করে রাণী দুর্গেশ্বরীকে দমন করা যায়। রাজ্যের সৈন্য-সামন্ত এবং পুলিশ ফোর্স বহু সন্ধান করেও এই দুর্দান্ত মহিলার কোন খোঁজই পেলো না।
রাজা বাসুদেব যখন রাণী দুর্গেশ্বরীকে নিয়ে ভীষণ অশান্তি আর দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিলেন তখন হরিনাথের রাজপুত্র স্বপন কুমার এসে জানালো-মহারাজ, আমি রাণী দুর্গেশ্বরীকে পাকড়াও করবো।
বাসুদেব স্বপন কুমারের কথায় অত্যন্ত প্রীত হলেন, তিনি নিজের আসনের পাশে বসিয়ে– বললেন–তোমার কথা শুনে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম। রাণী দুর্গেশ্বরীর অত্যাচারে গোরী রাজ্য অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এ সময় তোমার মত একজন সাহসী যুবককে পেয়ে আমি অনেক খুশি হলাম। স্বপন, তোমার পিতা আমার বাল্যবন্ধু কাজেই তুমি আমার সন্তান সমতুল্য।
মহারাজ বাসুদেব পত্নী রাণী মঙ্গলা দেবী স্বপনকুমারকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন, যদিও রাণী মঙ্গলা দেবীর বয়স স্বপনকুমারের চেয়ে কমই হবে তবু তার মধ্যে ছিলো মাতৃ সুলভ একটি মায়াময়ী প্রাণ। অত্যন্ত মহৎ হৃদয়সম্পন্ন মহিলা ছিলো তিনি।
বৃদ্ধা বাসুদেবের দ্বিতীয় পক্ষ স্ত্রী মঙ্গলা দেবী।
প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর মহারাজ বাসুদেব যখন শোকে কাতর হয়ে পড়েছিলো, একমাত্র সন্তান যুবরাজ মহাদেবকে নিয়ে তিনি যেন কোন স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তখন বৃদ্ধ মন্ত্রীকন্যা মঙ্গলা দেবী স্বইচ্ছায় বৃদ্ধা মহারাজ বাসুদেবের গলায় মালা দিয়ে ছিলো এবং নিজ হস্তে যুবরাজ মহাদেবের লালন-পালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলো।
মঙ্গলা দেবী হরিনাথের রাজপুত্র স্বপনকুমারকে পুত্র সমতুল্য স্নেহে গ্রহণ করলেন।
রাজ অন্তঃপুরে স্থান পেল স্বপনকুমার।
স্বপনকুমার হরিনাথ রাজ্যের মহারাজ গণেশের একমাত্র সন্তান। গোরী রাজ্যের এই চরম দুর্দিনে মহারাজ গণেশ বন্ধুবর রাসুদেবের সাহায্য এগিয়ে আসবেন ভাবছেন এমন সময় স্বপন কুমার জানালো– বাবা আপনি বৃদ্ধ, কাজেই আপনি ক্ষান্ত, হউন, আমি যাচ্ছি কাকা বাসুদেবকে সাহায্য করতে।
পুত্রের কথা শুনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন মহারাজ গণেশ তিনি আনন্দিত মনে পাঠালেন স্বপন কুমারকে গোরী রাজ্যে।
স্বপন কুমার ছিলো শিশুকাল থেকেই দুঃসাহসী আর দুর্দান্ত। গোরী রাজ্যে যখন রাণী দুর্গেশ্বরী তোলপাড় শুরু করেছে তখন সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারলো না। মনে অদম্য উৎসাহ নিয়ে ছুটে এলো দস্যুরাণী দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার আশায়।
আশা তার সফল হবে কিনা সন্দেহ।
রাণী দুর্গেশ্বরীর অজ্ঞাত কিছু ছিলো না, গোরী রাজ্যের সব ছিলো তার নখদর্পনে।
আজ দুর্গেশ্বরী তার আসনে উপবিষ্টা অনুচরগণকে লক্ষ্য করে কঠিন কণ্ঠে বললো– তোমরা জানো না, আমাকে গ্রেফতারের জন্য শুধু পুলিশ মহলই নয় মহারাজা বাসুদেবের বন্ধু সুসন্তান স্বপন কুমার সেনও ছুটে এসেছে হরিনাথ রাজ্য থেকে গোরী রাজ্যে।
দুর্গেশ্বরীর প্রধান অনুচর রক্তচক্ষু ধারণ করে গর্জে উঠলো– স্বপন কুমারের সাধ্য কি রাণীজীকে পাকড়াও করে।
দুর্গেশ্বরী দাঁতে দাঁত পিষে বললো–স্বপন কুমারকে আমি গ্রাহ্য করি না বাহরাম। ওকে আমি তুচ্ছ মনে করি। আমি চাই দস্যু বনহুরকে সায়েস্তা করতে। কারণ সে আমার পিছু নিয়েছে।
রাণীজী হুকুম করুন, আমরা তাকে হত্যা করে তার মাথাটা কেটে নিয়ে আসি?
না, তাকে হত্যা করা চলবে না।
তা হলে কি করবো রাণীজী?
তাকে বন্দী করে নিয়ে এসো।
দুর্গেশ্বরীর প্রধান অনুচর বাহরাম ক্ষণিকের জন্য চিন্তিত হলো সে কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নত করলো।
দুর্গেশ্বরী গর্জে উঠলো–দস্যু বনহুরকে বন্দী করে আনার মত সাহস তোমার নেই বাহরাম?
বাহরাম মুখ তুললো–রাণীজী দস্যু বনহুর—থেমে ছিলো বাহরাম।
দুর্গেশ্বরীর চোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে, বললো–বললো, থামলে কেন?
রাণীজী দস্যু বনহুর অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, তাকে গ্রেফতার করে ধরে আনা কম কথা নয়।
বুট দিয়ে মাটিতে আঘাত করে দুর্গেশ্বরী–অপদার্থ তোমরা পারবে কেন। লারাম শেষ পর্যন্ত দস্যু বনহুর হস্তে আত্মসমর্পণ করে পরিত্রাণ পেতে চেয়েছিল—হাঃ হাঃ হাঃ আমি তাকে জন্মের মত পরিত্রাণ দিয়েছি। দাঁতে দাঁত পিষলো দস্যুরাণী।
ঐ মুহূর্তে দুর্গেশ্বরীর পদতল আসনে এসে বিদ্ধ হলো একটি তীক্ষ্ণ তীরফলক। চমকে উঠলো সবাই। দুর্গেশ্বরী আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো দু’চোখে তার বিস্ময়।
দুর্গেশ্বরী নত হয়ে তীরটি তুলে নিলো হাতে; সঙ্গে সঙ্গে অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলো–দস্যু বনহুর।
দুর্গেশ্বরীর অনুচরগণও প্রতিধ্বনি করলো–দস্যু বনহুর।
হাঁ, এ তীর নিক্ষেপ করেছে দস্যু বনহুর। আশ্চর্য, আমার আস্তানায় দস্যু বনহুর প্রবেশ করলো কি করে? অনুচরদের লক্ষ্য করে বললো–যাও, শীগৃগীর দেখো কোথায় সেই ভয়ঙ্কর দস্যু।
রাণীর আদেশের সঙ্গে সঙ্গে অনুচরগণ যেদিকে পারলো ছুটলো।
দুর্গেশ্বরী উন্মাদিনীর ন্যায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। দাঁত পিষে বললো–দস্যু বনহুর যখন আমার আস্তানার সন্ধান পেয়েছে তখন তাকে আর জীবিত রাখা যায় না। বাহরাম।
বলুন রাণীজী? অদূরেই ছিলো বাহরাম,এগিয়ে এলো।
দুর্গেশ্বরী বললো আবার শোন বাহরাম, আমি আজই চাই–হয় জীবিত নয় মৃত দস্যু বনহুরকে।
আচ্ছা রাণীজী। বললো বাহরাম।
তখনই দুর্গেশ্বরী সবাইকে দরবারগৃহ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলো।
অনুচরগণ তখনই মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ছুটলো যে যেদিকে পারে সেই দিকে।
দুর্গেশ্বরী যে মুহূর্তে আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়িয়েছে সেইক্ষণে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো এক জমকালো মূর্তি দক্ষিণ হস্তে তার রিভলভার।
সম্মুখে যমদূতের মত ভয়ঙ্কর একটা মূর্তি দেখে দুৰ্গেশ্বরী ঘাবড়ে গেলো কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো–কে তুমি?
আমি তোমার অতি পরিচিত জনদস্যু বনহুর।
খিল খিল করে হেসে উঠলো দুর্গেশ্বরী–তুমিই তাহলে তীর নিক্ষেপ করেছে?
হাঁ, আমি।
জানো আমার আস্তানায় প্রবেশ করলে সে আর ফিরে যেতে পারে না। আমি পারি।
না, পারবে না। তোমাকে আমি শুধু বন্দীই করবো না, তোমাকে আমি হত্যা করবো দস্যু বনহুর। কথা শেষ করে হাতে তালি দেয় দুর্গেশ্বরী–একবার দু’বার তিনবার।
কিন্তু কেউ আসে না।
এবার দুর্গেশ্বরীর মুখ কালো হয়ে উঠলো।
বনহুর হেসে উঠলোহাঃ হাঃ হাঃ—-তারপর হাসি বন্ধ করে বললো–কেউ আসবে না দুর্গেশ্বরী, সবাই বিশ্রাম করছে।
দুর্গেশ্বরী অবাক হয়ে তাকালো দস্যু বনহুরের মুখের দিকে।
দস্যু বনহুর বললো–এসো রাণী আমার সঙ্গে। দেখবে চলো আমার কথা সত্য কিনা।
দুর্গেশ্বরীর দু’চোখে আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে, সে ক্রুদ্ধভাবে অগ্রসর হলো।
বনহুর যেন তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।
দুর্গেশ্বরী কারাগার কক্ষের সম্মুখে এসে দাঁড়াতেই চক্ষুস্থির। বিস্ময় নিয়ে দেখলো তার সবগুলো অনুচর কারাগার কক্ষে বন্দী হয়ে খাঁচার পাখির মত ছটফট করছে।
দুর্গেশ্বরী ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলো, তার পিছনে যে স্থানে দস্যু বনহুর দাঁড়িয়ে ছিলো সে স্থান শূন্য।
দুর্গেশ্বরী নিজের কোমরের পিস্তলে এতক্ষণ হাত দেবার সুযোগ খুঁজছিলো কিন্তু পারেনি, দস্যু বনহুর তাকে সে সুযোগ দেয়নি। এবার দুর্গেশ্বরী পিস্তলখানা খুলে দাঁড়ালো কিন্তু কোথায় সেই মূর্তি।
দুর্গেশ্বরী নিজ হস্তে খুলে দিলো কারগার কক্ষ, তারপর ক্ষিপ্তের মত গুলি করে হত্যা করতে লাগলো এক-একজন অনুচরকে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো কারগার মেঝে।
এমন সময় দুর্গেশ্বরীর প্রধান অনুচর বাহরাম এসে দাঁড়ালো–রাণীজী ক্ষান্ত হন।
না, আমি ক্ষান্ত হবে না বাহরাম। এত হীন কাপুরুষ আমার অনুচরগণ আগে জানতাম না। আমি সবাইকে নিঃশেষ করে আবার নতুন দল গঠন করবো।
রাণীজী, আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েছেন। আপনি জানেন না কতবড় শক্তিবান দস্যু বনহুর। তার শক্তিই শুধু নেই, বুদ্ধিও তীক্ষ্ণ—
চুপ করো। আমার চেয়ে শক্তিশালী আর কেউ নেই বাহরাম। এক নিমিশে শত শত জীবন বিনষ্ট করতে পারি। আর আমার বুদ্ধিও দস্যু বনহুরের বুদ্ধির কাছে নিছক ক্ষীণ নয়। দস্যু বনহুরের আস্তানা আমি লুট করেছি। তার সব ধন-রত্ন হরণ করেছি লালারামের দ্বারা বুঝলে?
তা আমি জানি রাণীজী। কিন্তু নিছকভাবে এই অসহায় অনুচরদের হত্যা করা একেবারে অন্যায় হবে।
কিসে ন্যায়-অন্যায় আমি জানি না। জানতেও চাই না বাহরাম। আমি জানতে চাই কি করে দস্যু বনহুর এতগুলো জোয়ান দুর্দান্ত দুস্যুকে মেশ শাবকের মত কারাগারে ভরালো। আমি দরবারকক্ষে যাচ্ছি, যারা জীবিত আছে নিয়ে এসো আমার সম্মুখে। কথা কয়টি বলে দ্রুত পদক্ষেপে চলে গেলো দুর্গেশ্বরী কারাগার থেকে।
মহারাজ বাসুদেবের চোখে ন্দ্রিা নেই। তিনি কক্ষমধ্যে পায়চারী করে চলেছেন। চোখেমুখে তাঁর উদ্বিগ্নতার ছাপ বিদ্যামান। দুর্গেশ্বরী শুধু গোরী রাজ্যে অশান্তির সৃষ্টি করেনি, সমস্ত গোরীবাসীর মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছে।
গতরাতের একটি ঘটনা বেশি করে ভাবিয়ে তুলেছে বাসু দেবকে। রাণী দুর্গেশ্বরী রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে হরিনাথের রাজপুত্র স্বপন কুমারকে হরণ করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বিফল হয়েছে দুর্গেশ্বরী।
কাল গভীর রাতে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকারে রাজবাড়ির সবাই জেগে উঠলো, চিৎকারটা যেদিক থেকে এসেছিলো সেই দিকে ছুটে গিয়ে সকলের চক্ষুস্থির! দেখলো তারা স্বপন কুমার তার কক্ষে মেঝেতে হাত পা মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
বাসুদেবের আদেশে তাড়াতাড়ি স্বপন কুমারের হাত পা-মুখের বন্ধন উন্মোচন করা হলো।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে স্বপন কুমার, তার মুখোব রক্তশূন্য ফ্যাকাশে।
মহারাজ বাসুদেব স্বপন কুমারকে তার শয্যায় শুইয়ে দিয়ে পাশে এসে বসলেন, বুকে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-কি ব্যাপার? কে তোমাকে এভাবে হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে গেছে?
স্বপন কুমার কম্পিত কণ্ঠে বললো–মহারাজ সে এক ভীষণ চেহারার নারীমূর্তি—
বলো, বলো থামলে কেন, বলো?
আমার বড্ড ভয় করছে বলতে।
মহারাজ মনে মনে ভীত হলেও মুখে হাসি টেনে বলেন তুমি এই ভয়ঙ্করী দস্যু নারীকে পাকড়াও করতেই তো এসেছো। আশ্চর্য হচ্ছি, এই সাহস নিয়ে তুমি তাকে কিভাবে পাকড়াও করবে?
স্বপন কুমার মাথা চুলকায়–তাই তো ভাবছি, কি করে এই নারীকে আমি পাকড়াও করবো। তবে আমার মন বলছে তাকে আমি পাকড়াও করতে পারবো।
এত দুঃখেও হাসি পেয়েছিলো মহারাজের।
গতরাতের এই ঘটনার পর কিছুতেই সাহস পাচ্ছিলেন না বাসুদেব, কখন যে আবার দুর্গেশ্বরী হানা দেবে কে জানে।
রাণী মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের জন্য অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন, তাঁর মাতৃহৃদয়ে আশঙ্কা জেগেছিল যদিও স্বপন কুমার তাঁর পুত্র নয়, তবু তাকে স্নেহ করেন পুত্র সমতুল্য।
রাজকুমার মহাদেব আর স্বপন একই গৃহে শয়ন করে। রাণী দুর্গেশ্বরী মহাদেবকে হরণ করার চেষ্টা না করে স্বপন কুমারকে নিয়ে যাবার জন্য চেষ্টা করেছিলো বুঝতে পেরেছেন মঙ্গলা দেবী। তাই তিনি আরও বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
আজ মহারাজ যখন নিদ্রাহীন চোখে বিশ্রামাগারে পায়চারী করছিল তখন রাণী মঙ্গলা এসে দাঁড়ালেন। স্বামীকে অত্যন্ত চিন্তিত দেখে তিনি ব্যথিত হলেন। বৃদ্ধ স্বামীর অশান্তি তাকেও উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।
মঙ্গলা দেবী বিমর্ষ মুখে স্বামীকে লক্ষ্য করে বলেন–মহারাজ, এমনি করে আর কতদিন অশান্তি পোহাবেন?
গম্ভীর কণ্ঠে বলেন বাসুদেব–যতদিন শয়তানী দুর্গেশ্বরীকে আমি বন্দী করতে সক্ষম না হয়েছি।
কিন্তু সে রকম আশা তো দেখছি না। দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার করার জন্য আপনি কত সৈন্য সামন্ত কত পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন পুলিশ মহল অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে সদা সর্বদা শহর প্রদক্ষিণ করে ফিরছে,প্রজারা প্রত্যেকে সজাগ পাহারা দিচ্ছে। তবু অজও কেউ রাণী দুর্গেশ্বরীকে পাকড়াও করতে সক্ষম হলো না, আর কিনা আপনি তাকে বন্দী করবেন।
এমন সময় কক্ষে প্রবেশ করে স্বপন কুমার–কেউ না পারলেও আমি পারবো মাসীমা।
চমকে ফিরে তাকালেন বাসুদেব এবং মঙ্গলা দেবী।
মঙ্গলাদেবী অস্ফুট শব্দ করে উঠলেন–স্বপন তুমি।
হাঁ মাসীমা আমি।
তুমি এখানে—
আমার চোখেও ঘুম আসছিলো না, তাই ছাদে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছিলাম।
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন মঙ্গলা দেবী–প্রতীক্ষা করছিলে! কার প্রতীক্ষা করছিলে?
দুর্গেশ্বরীর!
ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠে মঙ্গলা দেবীর মুখমণ্ডল কোনো অমঙ্গল আশঙ্কায় শিউরে উঠলেন তিনি বললেন–হতভাগা ছেলে, গতরাতের ঘটনার পরও তুমি রাণী দুর্গেশ্বরীকে পাকড়াও করার মত সাহস রাখো।
ঠিক সাহস নয় মাসীমা, দুঃসাহস রাখি।
কিন্তু—
এমনভাবে নাকানি-চুবানি খেয়েও আমি এমন দুঃসাহস করছি কি করে?
এবার কথা বলেন মহারাজহাঁ স্বপন কুমার এত বড় একটা বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েও তুমি সেই ভয়ঙ্কর ইচ্ছা পোষণ করছো?
আমি যে আমার বাবা-মাকে কথা দিয়ে এসেছি।
তাতে কি যায় আসে। দেখো স্বপন তুমি ফিরে যাও বাবা ভালোয় ভালোয় তাহলে কতকটা নিশ্চিন্ত হই আমি। মঙ্গলা দেবী অত্যন্ত বিষণ্ণ মনে কথা কয়টি বলেন।
বাসুদেবও যোগ দিলো পত্নীর কথায়–হাঁ তাই ভালো, হঠাৎ দুর্গেশ্বরী তোমার যদি কোন ক্ষতি করে বসে তখন আমি বন্ধুর কাছে কি উত্তর দেবো?
স্বপন কুমারের মনেও যে ভয়ের উদ্বেগ হয়নি তা নয়। মনোভাব গোপন করে বললো– এসেছি যখন তখন ফিরে যাবো না। আশীবাদ করুন মাসীমা যেন আপনাদের দুশ্চিন্তা দূর করতে পারি। কথাটা হৃষ্ট মনে বলে বেরিয়ে গেলো স্বপন কুমার।
বাসুদেব বললেন–রাণী, স্বপন কুমার সত্যিই একজন মহৎ হৃদয় যুবক।
তাতো নিশ্চয়ই কিন্তু ওর জন্য আমার বড় মায়া হয়। বেচারী আমাদের জন্য জীবন না হারায়।
ঠিক সেই মুহূর্তে একখানা ছোরা এসে গেঁথে গেলো মহারাজ বাসুদেব আর মঙ্গলা দেবীর পায়ের কাছে।
ভয়চকিতভাবে বাসুদেব আর মঙ্গলা দেবী চোখ চাওয়া চাওয়ি করে নিলেন।
বাসুদেবের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে।
মঙ্গলা দেবীও কাঁপতে শুরু করেছেন।
বাসুদেব উবু হয়ে হাতে তুলে নিলেন ছোরাখানা।
মঙ্গলা দেবী বিহ্বল কণ্ঠে বললেন–দুর্গেশ্বরী রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছে।
ছোরাখানাতে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন মহারাজ–এ যে দেখছি দস্যু বনহুর।
মঙ্গলা দেবী অস্ফুট ধ্বনি করে উঠলেন–দস্যু বনহুর!
হাঁ রাণী। একটু থেমে বললেন আবার–এক দস্যুর আর্বিভাবে অস্থির হয়ে পড়েছি তারপর আবার দস্যু বনহুর! একি বিপদ দেখা দিল। ভগবান রক্ষা করো।
ঠিক সেইক্ষণে আচমকা এক জমকালো মূর্তি এসে দাঁড়ালো মহারাজ বাসুদেব ও রাণী মঙ্গলা দেবীর দিকে। পা পা করে এগিয়ে এলো একেবারে সম্মুখে।
বাসুদেব আর মঙ্গলা দেবী ভয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছেন। তাঁদের দেহে জীবন আছে কিনা সন্দেহ। আতঙ্কভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছেন তারা জমাকালো মূর্তির দিকে।
বাসুদেব তাকিয়ে দেখলেন, কালো মূর্তির হস্তে উদ্যত রিভলভার। রিভলভার লক্ষ্য করে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন মহারাজা এবং মহারাণী। কম্পিতভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন উভয়ে। কোন কথা তাদের কণ্ঠ দিয়ে বের হলো না।
জমকালো মূর্তি যে দস্যু বনহুর তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মহারাজ এবং মহারাণীকে ভীত অবস্থায় দেখে হাসলো বনহুর, তারপর বললো–মহারাজ, ভগবান আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। তবে দস্যু বনহুরের কবল থেকে রক্ষার জন্য নয় রাণী, দুর্গেশ্বরীর হাত থেকে আপনাকে বাঁচানোর জন্য—
বাসুদেব ঢোক গিয়ে বললেন–তুমি, তুমিই দস্যু বনহুর?
হাঁ মহারাজ।
কেন এসেছে আমার কাছে?
দুর্গেশ্বরীর কবল থেকে আপনাকে আর আপনার রাজ্য রক্ষার জন্য।
তুমি কি আমার হিতাকাক্ষী?
হ্যাঁ, আপনার হিতাকাক্সক্ষী বন্ধুই বটে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন যান ঘুমান। কিন্তু মনে রাখবেন, কোনো সময় যেন অসাবধান হবেন না।
বাসুদেবের চোখ দুটো বিস্ময়ে গোলাকার হয়, দস্যুর মুখে যেন তিনি অমৃতবাণী শুনছেন।
একটু আনমনা হয়েছেন, তাকিয়ে দেখেন দস্যু বনহুর কোথায় উধাও হয়েছে।
মঙ্গলা দেবী এতোক্ষণ আরষ্ট হয়ে ভয়ে কাঁপছিল। কোন কথা তার মুখ দিয়ে যেন বের হচ্ছিলো না। এবার তিনি সজাগ হয়ে উঠলেন, বললেন–মহারাজ আশ্চর্য। কি করে এই রুদ্ধ কক্ষে দস্যু বনহুর প্রবেশ করলো?
তাইতো! আমিও সে কথাই ভাবছি। পাহারা পরিবেষ্টিত পাষাণ প্রাচীর ঘেরা এই দুর্গম রাজপ্রাসাদে কি করে সে প্রবেশ করলো? আরও কোথাই বা উবে গেলো এক মুহূর্তে?
মঙ্গলা দেবী ভীতকণ্ঠে বললো-মহারাজ, আমার বড্ড ভয় করছে।
চলো রাণী, তোমাকে তোমার কক্ষে পৌঁছে দিয়ে আসি।
চলুন মহারাজ।
বাসুদেব আর মঙ্গলা দেবী এগুলেন রাণী মহলের দিকে।
মহারাজ মঙ্গলা দেবীকে তার কক্ষে পৌঁছে দিয়ে চলে গেলো নিজ বিশ্রামাগারে।
পাশাপাশি দু’খানা খাটে শয়ন করে রয়েছে স্বপন কুমার ও রাজপুত্র মহাদেব। গভীর নিদ্রায় তারা অচেতন। কক্ষের একপাশে ত্রি-পায়ার উপরে মোমবাতি জ্বলছে। মোমটা জ্বলে জ্বলে প্রায় নিভু নিভু হয়ে এসেছে।
একটা আবছা ছায়া ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো সেই কক্ষে, মহাদেবের বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। ত্রি-পায়ার উপরের মোমের আলোতে ছায়াটির হস্তে চক্চক্ করে উঠলো একখানা ছোরা।
ছায়াটির সমস্ত শরীরে কালো কাপড় ঢাকা শুধু চোখের কাছে দুটি মাত্র ছিদ্র। ছায়াটি নিদ্রিত মহাদেবের শয্যার পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো তারপর উদ্যত করে ধরলো তার হস্তস্থিত ছোরাখানা।
কিন্তু পিছন থেকে কেউ যেন ধরে ফেললো ছোরাসহ ছায়ামূর্তির হাতখানা।
চমকে উঠলো ছায়ামূর্তি।
ততক্ষণে জেগে উঠেছে রাজপুত্র মহাদেব। সে শয্যায় উঠে বসতেই তার চক্ষুস্থির। একটি জমকালো মূর্তি তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পিছনে স্বপন কুমার তার হাত থেকে ছোরা কেড়ে নেবার চেষ্টা করছে।
মহাদেব জেগে উঠতেই ছায়ামূর্তি ছোরাখানা স্বপন কুমারের হাতে ছেড়ে দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেলো।
মহাদেব শয্যা ত্যাগ করে ছায়ামূর্তির পিছনে ধাওয়া করতে যাচ্ছিলো স্বপন কুমার বললো–যেও না মহাদেব।
ক্ষান্ত হলো মহাদেব।
স্বপন কুমারের পাশে এসে দাঁড়ালো, উভয়ে মোমের আলোতে দেখলো ছোরার বাটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে– দস্যু বনহুর।
মহাদেব চিৎকার করে উঠলো–পাকড়াও করো—দস্যু বনহুর এসেছে। দস্যু বনহুর এসেছে—দস্যু বনহুর—
গভীর রাতে মহাদেবের ভয়ার্ত চিৎকারে চারদিক থেকে ছুটে এলো সবাই। সকলেরই মুখমণ্ডলে ভীত আতঙ্কিত ভাব।
রাজপ্রাসাদের সবাই এসে প্রায় জমায়েত হলো সেই কক্ষে; মহারাজ-মহারাণী তাঁরাও এসে হাজির হলেন। দস্যু বনহুর নাম লেখা ছোরা দেখে সবাই বুঝতে পারলো, দস্যু বনহুরই এসেছিলো। মহাদেবকে হত্যা করতে।
সবাই যখন দস্যু বনহুরকে নিয়ে আলোচনায় মত্ত তখন মহারাজ নিজেও বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই এটা দস্যু বনহুর ছাড়া কেউ নয়, কারণ ছোরাখানাই তার প্রমাণ। মহাদেবকে কেন দস্যু বনহুর হত্যা করতে চেষ্টা করবে।
স্বপন কুমার ছোরাখানা অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে বললো–
–ছোরাখানা দস্যু বনহুরের সুনিশ্চয়, কিন্তু যে ছায়ামূর্তিটি মহাদেবের বুকে ছোরা বসিয়ে দিতে যাচ্ছিলো সে পুরুষ নয়নারী।
কক্ষমধ্যে সবাই চমকে উঠলো।
মহারাজ বললেন–নারী। তবে কি দস্যু বনহুর নারী?
স্বপন কুমার মাথা চুলকে বললো–আমার যতদূর ধারণা দস্যু বনহুর নারী নয়–সে পুরুষ—
মঙ্গলা দেবী অবাক কণ্ঠে বললেন–তবে যে বললে যে ছায়ামূৰ্তি মহাদেবের বুকে ছোরা বসাতে যাচ্ছিলো সে নারী?
হাঁ মাসীমা সে নারী–কারণ আমি তার হাত স্পর্শ করে বুঝতে পেরেছি সে হাত পুরুষের নয়–নারীর।
আশ্চর্য বটে। বললেন মহারাজ বাসুদেব।
স্বপন কুমার আবার বললো–আমাকে যে ছায়ামূর্তি হাত-পা-মুখ বেঁধে অনুচর দ্বারা নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিলো, সেই ছায়ামূর্তিই মহাদেবকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো, আমার ধারণা ঐ ছায়ামূর্তিই রাণী দুর্গেশ্বরী!
একসঙ্গে বাসুদেব এবং মঙ্গলা দেবী অস্ফুট ভয়ার্ত শব্দ করে উঠলো–ছায়ামূর্তি রাণী দুর্গেশ্বরী!
হাঁ, আমার তাই মনে হয়। বললো স্বপন কুমার।
মহারাজ বাসুদেবের ললাটে ফুটে উঠলো গভীর চিন্তারেখা, তিনি বলেন–কিন্তু কি করে তা সম্ভব হয় বলে স্বপন? ছায়ামূর্তি যদি রাণী দুর্গেশ্বরী হয় তাহলে ছোরার বাটে কি করে দস্যু বনহুরের নাম লেখা থাকবে?
স্বপন কুমার এবার দমে গেলো একেবারে, মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বললো–তাইতো!
সে রাত আর কারো চোখে ঘুম এলো না।
মহাদেব আর স্বপন কুমার জেগে রইলো নিজেদের ঘরে। মহারাজ এবং মঙ্গলা দেবীও জেগে রইলেন। রাজ প্রাসাদের চারদিকে সজাগ প্রহরী পাহারা দিতে লাগলো।
কুয়াশাচ্ছন্ন গোরী পর্বত। পর্বতের পাথুরে পথ ধরে এগিয়ে চলেছে দুটি অশ্বারোহী। এক দৃঢ় সঙ্কল্পের ছাপ ফুটে উঠেছে তাদের চোখেমুখে। অশ্বারোহীদ্বয় কথাবার্তা বলতে বলতে অগ্রসর হচ্ছিলো।
দ্বিতীয় অশ্বারোহী প্রথম অশ্বারোহীকে লক্ষ্য করে বললো–সর্দার, রাণী দুর্গেশ্বরীর সন্ধান করতে গিয়ে আমাদের বহু সময় নষ্ট হয়ে চলেছে। কান্দাই আস্তানা থেকে গত রাতে কায়েস ওয়্যারলেসে জানিয়েছে, কান্দাই-এর অবস্থা আবার পূর্বের আকার ধারণ করেছে। বড় বড় ব্যাবসায়িগণ ভেজাল মেশানো বস্তু বিক্রয় করে কোটি কোটি অর্থ মুনাফা করে চলেছে।
প্রথম অশ্বারোহী স্বয়ং দস্যু বনহুর।
দ্বিতীয় অশ্বারোহী তার সহচর রহমান।
উভয়ে এগিয়ে চলেছে তাদের গোরী আস্তানার দিকে। কুয়াশা ঢাকা পথ বেয়ে দ্রুত অশ্ব চালনা সম্ভব নয়, তাই দস্যু বনহুর এবং রহমান অশ্বপৃষ্ঠে ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছিলো।
রহমানের কথায় বনহুর বললো–আর বেশি দিন ওরা এ সৌভাগ্য লাভ করতে সক্ষম হবে না রহমান। দুর্গেশ্বরীকে সায়েস্তা করেই আমি ফিরে যাবো কান্দাই, তারপর দেখে নেবো সব।
সর্দার, দুর্গেশ্বরীর সন্ধান তো পেয়েছেন, এবার তাকে খতম করে দিন।
রহমান, খতম করা অত্যন্ত সহজ কিন্তু আমি প্রমাণ করতে চাই, কে এই দুর্গেশ্বরী, কি এর পরিচয় আর কিইবা এর উদ্দেশ্য। একটু থেমে বললো আবার বনহুর রহমান, তুমি কান্দাই ফিরে যাও এবং অনুচরদের নিয়ে অনুসন্ধান করে দেখো সত্যিকারের শয়তান কারা কারা লোকসমাজের মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে।
আচ্ছা সর্দার, তাই করবো।
কিছুক্ষণ নীরবে অশ্বচালনা করে চললো উভয়ে, তারপর বললো রহমান–সর্দার, ঐ সব শয়তান দল শুধু সমাজের মেরুদণ্ডই ভাঙছে না, দেশের শত শত নাগরিকের বুকের রক্ত শুষে নিচ্ছে। কান্দাই-এর পথে পথে অগণিত অসহায় জনগণ আবার না খেয়ে ধুকে ধুকে মরছে।
আমি জানি রহমান। বিভিন্ন কারণে আমাকে বহুদিন কান্দাই ত্যাগ করে থাকতে হয়েছিলো। কান্দাই-এর কোনো সন্ধান নেওয়া আমার সম্ভব হয়নি। কাজেই এমন হবে তাতে। কোনো সন্দেহ নেই।
কথায় কথায় একসময় তারা পৌঁছে গেলো গোরী পর্বতে দস্যু বনহুরের আস্তানায়।
আস্তানায় পৌঁছে বনহুর ও রহমান নেমে দাঁড়ালো নিজ নিজ অশ্ব থেকে।
তাজ আর দুলকীকে অন্যান্য অনুচর অশ্বশালার দিকে নিয়ে গেলো।
বনহুর আর রহমান প্রবেশ করলো আস্তানার মধ্যে। পাহারাদারগণ মাথা নত করে কুর্ণিশ জানালো।
বনহুর ও রহমান সোজা দরবারকক্ষে এসে বসলো।
এমন সময় বনহুরের দু’জন অনুচর একটি বৃদ্ধকে নিয়ে হাজির করলো তাদের সম্মুখে।
রহমান বললো–এই বৃদ্ধ গোরী পর্বতের একটি গুহায় ধ্যানে মগ্ন ছিলো। সর্দার, একে। আমাদের অনুচরগণ গুপ্তচর সন্দেহে পাকড়াও করে এনেছে।
মশালের আলোতে বনহুর ভালোভাবে তাকালো বৃদ্ধের দিকে। শুভ্র দাড়ি-গোঁফ ঢাকা প্রশান্ত একখানা মুখ। ললাটে চন্দনের আলপনা আঁকা, হাতে এবং বাজুতে রুদ্রাক্ষের মালা। দক্ষিণ। হস্তে লৌহ চিমটা, বাম হস্তে ত্রিশূল।
বনহুর বৃদ্ধের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে বললো–সন্ন্যাসী বাবা, আপনি কি উদ্দেশ্যে গোরী পর্বতে ধ্যানরত ছিলেন?
সন্ন্যাসী তার মুদিত চক্ষুদ্বয় বিস্ফোরিত করে বললো–ভগবানের আরাধনায় মগ্ন ছিলাম। যারা আমার ধ্যান ভঙ্গ করেছে তাদের আমি অভিশাপ দেবো।
বনহুর বললো–সন্ন্যাসী বাবা, অভিশাপ দিয়ে বেচারাদের ক্ষতি করবেন না। আমি আপনাকে স্বস্থানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি।
সন্ন্যাসী ক্রুদ্ধভাবে বলে উঠলোনা, আমি ক্ষমা করবো না তাদের। কারণ আমার ধ্যানভঙ্গ হওয়ায় দেবতাগণ অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
হাসলো বনহুর, তারপর বললো–দেবতাদের খুশি করার ভার আমি গ্রহণ করলাম। আপনি যান, আপনাকে আমি মুক্তি দিলাম।
বৃদ্ধ সন্ন্যাসীকে তার আবাসে পৌঁছে দেবার জন্য আদেশ দিলো বনহুর।
অনুচরদ্বয় সন্ন্যাসী বাবাজীকে নিয়ে চলে গেলো।
রহমান বললো–সর্দার, আপনি ওকে মুক্তি দিয়ে ভুল করলেন।
না, ভুল করিনি রহমান, কারণ এই বৃদ্ধ কোনো গুপ্তচর নয়।
সর্দার!
হাঁ রহমান।
একি সত্যিই কোনো সন্ন্যাসী?
সন্ন্যাসী হলে আমি নিজ হস্তে তাকে হত্যা করতাম।
কিন্তু তাকে এভাবে মুক্তি দেওয়া
ঠিকই হয়েছে রহমান। কাল তোমাকে এর কারণ বলবো।
মাথা নত করে রইলো রহমান, কোনো কথা বললো না।
আরও কিছুক্ষণ বনহুর আর রহমানের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হলো। তারপর বনহুর দরবারকক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো বাইরে।
রাত্রির অন্ধকার থমথম করছে চারদিক।
বনহুর নিজের বিশ্রামকক্ষের দিকে এগিয়ে চললো।
বনহুর নিজ কক্ষের দিকে প্রস্থান করলো, রহমান অনুসরণ করলো তাকে।
কিন্তু কক্ষের নিকটে এসে যখন কক্ষমধ্যে নজর ফেললো তখন দেখলো কক্ষ শূন্য-দরজা। যেমন বন্ধ তেমনি আছে–সর্দার নেই। রহমান কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তারপর ছুটলো অশ্বশালার দিকে।
অশ্বশালায় পৌঁছে বিস্ময় আরও বাড়লো, তাজও নেই সেখানে। রহমান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই স্থানে। সর্দারের সঙ্গে তাজও উধাও হলো কোথায়!
সেদিনের ঘটনার পর স্বপন কুমার প্রায়ই রাজপুত্র মহাদেবের কাছে কাছে থাকতো। সে বুঝতে পেরেছিল, দস্যু বনহুরের ছোরা নিয়ে রাণী দুর্গেশ্বরী তাকে হত্যার চেষ্টা করে চলেছে। তাকেও কম নাজেহাল-পেরেশান করেনি। স্বপন কুমারের মনে পড়ে, যেদিন সে রাজবাড়িতে প্রথম এলো সেই দিন রাতে কোনো এক নারী তার কক্ষে আগমন করেছিলো এবং তাকে হাত পা-মুখ বেঁধে কোথাও চালান করার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু কে সে নারী–তবে কি সেই দুর্গেশ্বরী?
আরও কোন সন্ধান পায়নি স্বপন কুমার রাণী দুর্গেশ্বরীর। হরিনাথপুর থেকে অনেক ভরসা নিয়ে স্বপন কুমার এসেছিলো, নিশ্চয়ই সে এই দুঃসাহসিক নারীটিকে গ্রেফতার করে গোরী রাজ্যে নাম কিনবে কিন্তু এ ক’দিনেই হতাশ হয়ে পড়েছে। সে বুঝতে পেরেছে, রাণী দুর্গেশ্বরীকে যতই অবলা নারী বলে অবহেলা করুক, আসলে সে অবলা নয়। রীতিমত বুদ্ধিমতী সুকৌশলা রমণী।
একদিন স্বপন কুমার বাগানে বসে গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছিলো, অল্পক্ষণ হলো মহাদেব চলে গেছে তার পাশ থেকে।
স্বপন কুমার মহাদেব সম্বন্ধেই ভাবছে, কিছুক্ষণ পূর্বে মহাদেব বলেছিলো–স্বপন দাদা, তুমি আছো তাই আমি অনেকটা নিশ্চিন্ত। সত্যি তোমাকে পেয়ে আমার কত আনন্দ!
যদিও স্বপন কুমারের চেয়ে মহাদেব বয়সে বেশি ছোট নয় তবু মহাদেব স্বপন কুমারকে ‘স্বপন দাদা’ বলে ডাকে।
স্বপন কুমার ভালোবাসে, স্নেহ করে তাকে আপন সহোদরের মত। মহাদেবের অমঙ্গল আশঙ্কায় মহারাজ বাসুদেব এবং মঙ্গলা দেবী যেমন উদ্বিগ্ন তেমনি উদ্বিগ্ন স্বপন কুমার।
এই মুহূর্তেও স্বপন কুমার মহাদেব সম্বন্ধেই ভাবছিলো। সন্ধ্যার অন্ধকার এখনও জমাট বেঁধে উঠেনি। সূর্যাস্তের ক্ষীণ সোনালী আভার রেশ লেগে রয়েছে বাগানবাড়ির ফুলগাছের শাখায় শাখায়। দিনান্তে পাখিরা সব ফিরে এসেছে নিজ নিজ নীড়ে। পাখির কিচির মিচির কলরবে মুখরিত চারদিক।
স্বপন কুমার বাগানবাড়িতে একটি পাথরাসনে বসে ছিলো, উঠে দাঁড়ালো আনমনে।
এমন সময় পাশে নিজের কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে চমকে উঠলো স্বপন কুমার–রাণী মা আপনি!
স্বপন কুমার দেখলো মঙ্গলা দেবী দাঁড়িয়ে তার পাশে, চোখেমুখে তার আবেগভরা ভাব। স্বপন কুমারকে লক্ষ্য করে বললো মঙ্গলা দেবী-রাণীমা নয়, বলো মঙ্গলা!
রাণীমা!
স্বপন, এ বাড়িতে তুমি আসার পর আমার মনে তুমি আগুন জ্বেলে দিয়েছে। রাতে ঘুমোতে পারি না, দিনে বিশ্রাম করতে পারি না। আহারে রুচি নেই, সর্বক্ষণ শুধু তোমার কথা আমার সমস্ত মন জুড়ে আকুলি বিকুলি করে ফিরছে।
স্বপন কুমারের সুন্দর মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠেছে। মাথাটা আপনা আপনি নত হয়ে এসেছে, কোনো কথা সে উচ্চারণ করতে পারলো না।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের কাছে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালেন–স্বপন, কথা বলছে না কেন?
স্বপন কুমার বিব্রত বোধ করছিলো, নত দৃষ্টি তুলে তাকালো সে মঙ্গলা দেবীর দিকে। মঙ্গলা দেবীর সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো স্বপন কুমারের। ঘেমে নেয়ে উঠতে লাগলো সে ভিতরে ভিতরে। কণ্ঠটা পরিষ্কার করে নিয়ে বললো এবার সে অতি কষ্টে–আমি আপনাকে মাতৃসম শ্রদ্ধা করি,
মঙ্গলা দেবী অভিমানভরা কণ্ঠে বললেন আমি কি তোমার মাতৃসম বয়স্কা? আমি কি তোমার চেয়ে বয়সে দু’এক বছরের ছোট নই? বলো, বলো যদি তুমি আমার পুত্র হবার যোগ্য বয়স্ক হও তবে আমি তোমায়…..।
এ বাড়িতে আসার পর আপনি আমাকে মাতৃস্নেহে…….
না না, তুমি বুঝতে পারেনি। মহাদেবের সঙ্গে থাকো বলে আমি তোমাকে তার মতই আদর-যত্ন করে থাকি কিন্তু আমি তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে পেতে চাই স্বপন।
আমাকে ক্ষমা করুন রাণীমা…….
আবার রাণীমা! স্বপন, জানো এ বাড়িতে তুমি আমার অনুগ্রহেই স্থান লাভ করেছো?
আপনার অনুগ্রহ হতে পারে কিন্তু আমার কোন স্বার্থ নেই এতে, বরং আপনাদেরই উপকার আছে। দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার করার আশাতেই আমার আগমন, আর তাকে যদি গ্রেফতারে সক্ষম হই তাহলে আপনারাই উপকৃত হবেন।
আমি জানি তুমি পারবে না তাকে গ্রেফতার করতে।
যদি না পারি তাহলে আমার লজ্জার সীমা থাকবে না। আমি দুঃখিত হবো।
ঠিক সেই মুহূর্তে কারো পদশব্দ শোনা যায়।
চমকে সরে দাঁড়ান মঙ্গলা দেবী, দেখতে পান মহারাজ বাসুদেব স্বয়ং সেদিকে এগিয়ে আসছেন।
স্বপন কুমার এতক্ষণ যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, মুখমণ্ডল প্রসন্ন হয়ে উঠে তার। এতোক্ষণ মঙ্গলা দেবীর সান্নিধ্যে যেন ঘেমে উঠেছিলো সে।
মহারাজ এসে দাঁড়ালেন–এই যে রাণী, তুমি এখানে! আমি তোমাকে খুঁজে ফিরছি। স্বপনের সঙ্গে আলাপ করছিলে বুঝি?
হাঁ মহারাজ, স্বপনের সঙ্গে গল্প করছিলাম।
তা আমাকে দেখে থামলে কেন? বলল, বলল কিসের গল্প হচ্ছিলো শুনি?
কি আর শুনবেন মহারাজ। স্বপন কুমার রাণী দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না।
এ তো ভাল কথা! আমার মনে হয়, এই শয়তানীকে গ্রেফতারের জন্য এক আমি ভাবছি। আর একজন সে ঐ স্বপন কুমার। সত্যি বাবা, তোমার মহৎ হৃদয়ের পরিচয় আমাকে শুধু মুগ্ধ করেনি, আমি আত্নহারা হয়েছি। বন্ধুপুত্র হয়ে তুমি আমার একজন পরম হিতাকাক্ষী। বেশ বেশ, তোমরা গল্প করো, আমিও বসছি তোমাদের সঙ্গে।
মহারাজ স্বপন আর মঙ্গলা দেবীর মাঝখানে বসে ছিলো তারপর বললেন–বসো তোমরা।
মঙ্গলা দেবীর মুখমণ্ডল গম্ভীর থমথমে হয়ে উঠলো। স্বপন কুমারকে বেশ প্রসন্ন লাগছে এখন। স্বপন কুমার দাঁড়িয়ে রইলো কারণ মঙ্গলা দেবী আসন গ্রহণ না করা পর্যন্ত সে আসন গ্রহণে সক্ষম হচ্ছিলো না।
মঙ্গলা দেবী বললেন–এখানে আর বিলম্ব করা শ্রেয় নয় কারণ সন্ধ্যার অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হয়ে আসছে।
বাসুদেব মঙ্গলা দেবীর কথায় যোগ দিয়ে বললেন–হাঁ রাণী, ঠিকই বলেছো, দুর্গেশ্বরী যে কোন মুহূর্তে হানা দিতে পারে।
স্বপন কুমার কণ্ঠে সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে বললো–সাধ্য কি দুৰ্গেশ্বরী এখানে হানা দেয়! সেদিন পালাতে সক্ষম হয়েছে বলে আবার পালাবে, কখনোই না। আমি তাকে এবার পাকড়াও না করে ছাড়বো না।
মঙ্গলা দেবী বলেন–অতো সাহস দেখানো উচিত নয় স্বপন। দুর্গেশ্বরীর অসাধ্য কিছুই নেই, তার চেয়ে চলো এখন প্রাসাদে ফেরা যাক।
মহারাজ বাসুদেব ও রাণী মঙ্গলা দেবীসহ স্বপন কুমার রাজপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হলো।
দুর্গেশ্বরী সুউচ্চ আসনে উপবিষ্টা।
আসনের দু’পাশে দণ্ডায়মান দুর্গেশ্বরীর অনুচরগণ। প্রত্যেকের মুখে মুখোশ, হাতে সূতীক্ষ্ণ ধার বর্শা আর বলুম।
সম্মুখে কয়েকজন বন্দী নরনারী হাতমুখ বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। আর রয়েছে স্থূপাকার মালপত্র। বন্দী নরনারীর মুখে অসহায় করুণ ভাব, কারো দেহের জামা-কাপড় ছিন্নভিন্ন, কারো বা প্রায় অর্ধ-উলঙ্গ।
দুর্গেশ্বরীর সমস্ত শরীর কালো কাপড়ের আলখেল্লায় ঢাকা, শুধু চোখের কাছে দুটোমাত্র ছিদ্রপথ, ঐ ছিদ্রপথে দুর্গেশ্বরীর চোখ দুটো মশালের আলোতে জ্বলছিলো।
আসন ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো দুর্গেশ্বরী। দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করে কিছু ইশারা করলো, তারপর আলখেল্লার ভিতর থেকে বের করে আনলো একখানা সূতীক্ষ ধার ছোরা।
মশালের তীব্র আলোতে ঝকমক করে উঠলো দুর্গেশ্বরীর হস্তের ছোরাখানা।
অনুচরগণ ততক্ষণে বন্দী নরনারীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
দুর্গেশ্বরী নেমে এলো তার আসন থেকে। অনুচরগণ তার পাশের দু’পাশে মাথা নত করে অভিনন্দন জানাতে লাগলো।
দুর্গেশ্বরী সূতীক্ষ্ণ ধার ছোরা হস্তে এগিয়ে আসছে বন্দী নরনারীদের দিকে। সেকি অদ্ভুত ভয়ঙ্কর মূর্তি!
বন্দী নরনারীর গায়ের রক্ত জমে বরফ হয়ে গেছে যেন, ছাই-এর মত ফ্যাকাশে বিবর্ণ। মুখমণ্ডল, বলির পাঠার মত থর-থর করে কাঁপছে ওরা।
এখনও জানে না ওরা দুর্গেশ্বরী কেন তাদের দিকে এভাবে এগিয়ে আসছে।
বন্দী নরনারীর পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিকট চেহারার একটি পুরুষ। সমস্ত শরীর তার প্রায় উলঙ্গ। শুধুমাত্র একটা কাপড়ের টুকরা নেংটী আকারে লজ্জাস্থান ঢাকা রয়েছে। লোকটার কালো পাথরমূর্তির মত চেহারা তেল চক্ করছে।
দুর্গেশ্বরী লোকটার নিকটে এসে ছোরাখানা ছুঁড়ে দিলো তার হাতে।
ভয়ঙ্কর লোকটা লুফে নিলো ছোরাখানা, পরক্ষণেই উন্মত্ত জানোয়ারের মত ঝাঁপিয়ে পড়লো বন্দী নরনারীদের উপর–এক-এক আঘাতে নিহত করে চললো বন্দী নরনারীগুলোকে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো পাথুরিয়া মেঝেটা।
নিস্তব্ধ গুহায় এক-একটা তীব্র আর্তনাদ জেগে উঠে পর মুহূর্তেই আবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। সে এক বীভৎস-ভয়ঙ্কর নৃশংস দৃশ্য!
লোকটা যখন এক-এক জনের বুকে ছোরা বসিয়ে দিচ্ছিলো তখন দুর্গেশ্বরী হেসে উঠছিলো হাঃ হাঃ করে। নারীকণ্ঠের হাস্যধ্বনিতে গোরী পর্বতের গুহার দেয়ালগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছিলো থরথর করে।
বন্দী নরনারীগুলোকে হত্যা করার পর দুর্গেশ্বরী ইংগিত করলো লাশগুলোকে বের করে নিয়ে যেতে।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন অনুচর রাণীর আদেশ পালন করতে লাগলো। একটি করে লাশ দু’জন অনুচর টেনে নিয়ে চললো।
দুর্গেশ্বরী পুনরায় আসন গ্রহণ করতেই স্থূপাকার মালপত্র হাজির করা হলো তার আসনের পাশে। একটির পর একটি করে খুলে মেলে রাখা হলো।
দুর্গেশ্বরী দেখার পর বললো–নিয়ে যাও, মালগুদামে মজুত করে রাখে।
কয়েকজন অনুচর মালপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
দুর্গেশ্বরী উঠে দাঁড়ালো তারপর তীব্রকণ্ঠে বললো–বাহরাম।
কুর্ণিশ জানালো বাহরামবলুন রাণীজী?
আজ আমি যাবো তোমাদের সঙ্গে।
জো হুজুর রাণীজী।
দুর্গেশ্বরী দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। শহরের দিকে এগিয়ে চললো তারা।
গোরী পর্বতের পাথরখণ্ডে অশ্বপদ শব্দ আছাড় খেয়ে ফিরতে লাগলো।
আজ দুর্গেশ্বরী শহরের সেরা ব্যাঙ্ক লুট করার উদ্দেশ্যে গমন করলো। সঙ্গে বাহরাম ও তার অন্যান্য অনুচর রয়েছে।
রাত্রি গম্ভীর হওয়ায় পথঘাট নির্জন।
দুর্গেশ্বরীর অশ্ব তীরবেগে শহর অভিমুখে চললো।
ব্যাঙ্ক লুট করে নিয়ে ফিরে এলো দুর্গেশ্বরী। কিন্তু আস্তানায় প্রবেশ করার পূর্বেই সম্মুখে এসে দাঁড়ালো দস্যু বনহুর। তার দু’হাতে দু’খানা রিভলভার।
দস্যু বনহুর তার নিজস্ব দস্যু ড্রেসে সজ্জিত। মাথার পাগড়ি দিয়ে মুখের নিচ অংশটা ঢাকা রয়েছে।
দস্যু বনহুরের অগ্নিচক্ষু আর উদ্যত রিভলভার দু’টির দিকে তাকিয়ে দুর্গেশ্বরী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়ালো, এক পা এগুতে সাহস পেল না সে কিংবা তার অনুচরগণ।
দুর্গেশ্বরী দস্যু বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো-দস্যু বনহুর?
হ্যাঁ আমি!
কি চাও?
ব্যাঙ্ক লুট করে যে অর্থ তুমি এনেছে।
অসম্ভব!
তাহলে মুত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।
আমাকে হত্যা করবে?
কেন, বিশ্বাস হচ্ছে না?
না, আমি প্রতিদিন তোমার মত কতজনকে হত্যা করে থাকি আর তুমি করবে আমাকে?
এই মুহূর্তে ব্যাঙ্ক লুট করা সমস্ত অর্থ আমাকে না দিলে আমি শুধু তোমাকেই নয়, তোমার প্রত্যেকটা অনুচরকে হত্যা করবো…….বনহুরের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে তার রিভলভার দুটি একসঙ্গে গর্জে উঠে।
তৎক্ষণাৎ তীব্র আর্তনাদ করে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো দুর্গেশ্বরীর দু’পাশ থেকে দু’জন অনুচর। দু একবার ছটফট করে নীরব হয়ে গেলো।
বনহুর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে, তারপর বললো–কি, এখন দেবে না?
এবার দুর্গেশ্বরী পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হলো, সে দেখলো অমত করলেই আবার তার দু’টি অনুচর প্রাণ হারাবে। তা ছাড়া এমনভাবে গুহামুখ রুদ্ধ করে বনহুর দাঁড়িয়েছে কোনো দিকে সরার উপায় নেই। সম্মুখে অগ্রসর হলেও মৃত্যু, পিছন হটলেও রক্ষা নেই বনহুরের হাত থেকে। দুর্গেশ্বরী তার প্রধান অনুচর বাহরামের হাত থেকে টাকার থলে নিয়ে দস্যু বনহুরের হাতে ছুঁড়ে দিল।
দস্যু বনহুর টাকার থলেটা লুফে নিয়ে বললো–সাবাস! তারপর পিছু হটে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। পরক্ষণেই গোরী পর্বতের পাথরে পাথরে প্রতিধ্বনি শুনা গেলো খট খট খট……খট খট খট্…….
দুর্গেশ্বরীর মুখ রাঙা হয়ে কালো হয়ে গেলো। ডাকাতির উপর ডাকাতি-দস্যু বনহুরের কাছে রাণী দুর্গেশ্বরীর এতোবড় পরাজয়! অনুচরদের আদেশ দিলো–এক্ষুণি ওর পিছু নাও।
তখনই কয়েকজন অনুচর অশ্ব নিয়ে ছুটলো দস্যু বনহুরের সন্ধানে কিন্তু বিফল হয়ে ফিরে এলো সবাই।
দুর্গেশ্বরী আসনে উপবিষ্টা হয়ে অধর দংশন করতে লাগলো। অনুচরগণ তার সম্মুখে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইলো, সকলের চোখেমুখেই গ্লানি আর পরাজয়ের ছাপ ফুটে উঠেছে। এই মুহূর্তে দস্যু বনহুরকে পেলে দুর্গেশ্বরী যেন ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলতো।
বনহুর দুর্গেশ্বরীর লুণ্ঠিত অর্থ লুটে নিয়ে শহরের নিকৃষ্ট বস্তিগুলোর মধ্যে এসে হাজির হলো। তাজকে এক স্থানে রেখে প্রবেশ করলো বস্তির মধ্যে।
সবে প্রভাত হয়েছে।
বস্তির শ্রমিকগণ রাতের অলসতা মুছে ফেলে জেগে উঠেছে সবাই। হাতমুখ ধুয়ে ছুটবে এবার সবে কল-কারখানা আর শহরের আনাচে-কানাচে কাজের আশায়। হয়তো কেউ কাজ পাবে, কেউ পাবে না। পথে পথে ঘুরে রিক্ত হস্তে ফিরে আসবে আবার তারা এই নিকৃষ্ট বস্তির বুকে। খাবার যদি কিছু ঘরে থাকে খাবে, নয় একবাটি পানি পান করে বস্তির স্যাঁতসেতে মেঝেতে খেজুর পাতার চাটাই বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে নাক ডাকাবে। আবার পরদিন জেগে উঠবে পাখি ডাকার সঙ্গে সঙ্গে।
প্রতিদিনের মত আজ যখন বস্তির সবাই জেগে উঠলো তখন দেখলো তারা, কে এক দীপ্ত পুরুষ তাদের বস্তির মধ্যে এগিয়ে আসছে। অপূর্ব অদ্ভুত সুন্দর বলিষ্ঠ পুরুষ, হাতে তার অর্থভাণ্ডার।
সবাইকে ডাকলো বনহুর, তারপর সকলের মধ্যে রাণী দুর্গেশ্বরীর নিকট হতে লুটে নেওয়া অর্থগুলো সমান করে ভাগ করে দিলো। যারা উপার্জনে অক্ষম তাদের জন্য বেশি দিলো, যতদিন বাঁচবে বসে বসে যেন খেতে পায়।
শুধু বস্তিই নয়, গোরীর আনাচে-কানাচে যত দুঃস্থ-অসহায় ছিলো তাদের মধ্যেও প্রচুর অর্থ বিলিয়ে দিলো দস্যু বনহুর।
একটি ভিখারী বৃদ্ধ পথের ধারে বসে করুণ কণ্ঠে চিৎকার করছিলো-বাবা দুটো পয়সা। দাও, খানা খাবো। বাবা দুটো পয়সা দাও, খানা খাব……
বনহুর তার পাশে এসে দাঁড়ালো, বৃদ্ধার মাথায় হাত বুলিয়ে এক থলে টাকা তার হাতে খুঁজে দিয়ে চলে গেলো।
এমনি বহু দীন-দুঃখীর মধ্যে অর্থ বিলিয়ে দিতে লাগলো দস্যু বনহুর।
কেউ জানে না কে এই লোক, যে এত অর্থ দান করে চলেছে। কি এর পরিচয়!
রাণী দুর্গেশ্বরীর ভয়ে রাজ্যময় যেমন আতঙ্ক তেমনি অজানিত এক পুরুষের জন্য সবাই। আকুল।
এ সংবাদ রাজদরবারে গিয়ে পৌঁছলো।
মহারাজ বাসুদেব আর মহারাণী মঙ্গলা দেবী রাজসিংহাসনে বসে আছেন, এমন সময় কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি এসে নালিশ জানালেন, রাণী দুর্গেশ্বরী গারী রাজ্যের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক হানা দিয়ে সব লুট করে নিয়ে গেছে। গোরী রাজ্যের বহুলোক একেবারে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছেন।
বাসুদেব তার মন্ত্রী এবং সেনাপতিকে লক্ষ্য করে বললেন–আপনারা কি করছেন? রাণী দুর্গেশ্বরীকে আজও আপনারা কেউ গ্রেফতার করতে সক্ষম হলেন না! সে দিনের পর দিন এমনভাবে দেশময় অত্যাচার আরম্ভ করেছে যার জন্য দেশবাসীর শান্তি সমূলে বিনষ্ট হয়েছে।
সেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন–মহারাজ, আমরা কম চেষ্টা নেইনি। রাজ্যময় হাজার হাজার পাহারাদার মোতায়েন করা হয়েছে। সশস্ত্র সৈনিকগণ দিবারাত্র কড়া পাহারায় নিযুক্ত। এ সবের মধ্যেই দুর্গেশ্বরী তার কাজ চালিয়ে চলেছে।
রাজদরবারেই উপস্থিত ছিলো স্বপন কুমার, এবার সে উঠে দাঁড়ালো-মহারাজ, দুর্গেশ্বরী রাজ্যময় যতই অত্যাচারে লিপ্ত হউক তার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কারণ সে…….থামলো স্বপন কুমার।
রাণী মঙ্গলা দেবী বলে উঠলেন–স্বপন, থামলে কেন, বলো? দুর্গেশ্বরীর আচরণে শুধু প্রজারাই নয়, আমিও অতিষ্ঠ। কারণ আমি রাজমাতা, প্রজাগণ আমার সন্তানসম।
কারণ সে নারী। যতই বুদ্ধিমতী আর বীরাঙ্গনা হউক তার মন দুর্বল, ক্ষণে ক্ষণে পরাজয় হবার সম্ভাবনা তার থাকবেই। কাজেই আমার মনে হয় তার কাজ শেষ হয়ে এসেছে।
মঙ্গলা দেবী খুশি হলেন, স্বপন কুমারের কথাগুলো তার মনকে আশ্বস্ত করে তুললো।
এমন সময় কয়েকজন সৈনিক দু’জন ভিখারীকে পাকড়াও করে আনলো।
একজন সৈনিক বললো-মহারাজ, এই ভিখারীদ্বয়ের নিকটে অনেকগুলো টাকা পাওয়া গেছে, পুলিশ প্রমাণ করেছে এ টাকা ঐ ব্যাঙ্কের টাকা। যে ব্যাঙ্ক গতপরশু রাতে রাণী দুর্গেশ্বরী দ্বারা লুষ্ঠিত হয়েছিলো।
মহারাজ গর্জে উঠলেন–এরা নিশ্চয়ই দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচর।
মহারাণী মঙ্গলা দেবীর মুখ ভয়ে বিবর্ণ হলো, রাজদরবারে দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচর দেখে ক্রুদ্ধও হলেন তিনি। মঙ্গলা দেবী মহারাজকে লক্ষ্য করে বললেন–মহারাজ, এদের হত্যার আদেশ দিন, নিশ্চয়ই এরা রাণী দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচর।
মহারাজ বাসুদেব বলেন–হাঁ, আমারও সেই ধারণা। দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচরই বটে, নাহলে ব্যাঙ্কের টাকা ওদের কাছে আসবে কি করে?
মহারাজের কথা শুনে কেঁদে ফেললো ভিখারীদ্বয়। ভিখারীদ্বয়ের মধ্যে একজন ছিলো সেই বৃদ্ধা ভিখারিনী, যাকে দস্যু বনহুর নিজ হস্তে দান করেছিলো অর্থের থলে।
প্রথম ভিখারী হাউমাউ করে কেঁদে বললো–আমি আমার ঈশ্বরের শপথ করে বলছি, এ টাকা আমরা চুরি করিনি। একজন সুন্দর লোক আমাদের দিয়েছে। আমরা শয়তানী দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচরও নই।
মঙ্গলা দেবীই বললেন এবার–মহারাজ, মিথ্যা কথা বলছে ওরা। চোর-ডাকু-দস্য এরা কোনোদিন ঈশ্বরকে ভয় করে না, কাজেই ঈশ্বরের শপথ করা ওদের ছলনা।
স্বপন কুমার উঠে দাঁড়ালো–মহারাণী, আপনি যা বলছেন সত্য কিন্তু এই ভিখারীদ্বয় আসলেই চোর-ডাকু বা দস্য কিনা তা প্রথমে না জেনে ওদের কোনরকম শাস্তি দেওয়া উচিত নয়।
মহারাজ বললেন–হাঁ, স্বপন তুমি ঠিকই বলেছে। এরা ভিখারীও হতে পারে। কিন্তু এ অর্থ তারা পেলো কোথায়?
এবারও স্বপন কুমার জবাব দিলো–ভিখারীদ্বয় বলছে এরা দুর্গেশ্বরীর গুপ্তচর নয় আর অর্থগুলো দিয়েছে কোনো এক সহৃদয় ব্যক্তি। অথচ পুলিশ জানিয়েছে, এদের কাছে যে অর্থ পাওয়া গেছে তা গত পরশু রাতে ব্যাঙ্ক থেকে দুৰ্গেশ্বরী কতৃক লুষ্ঠিত টাকা।
হ্যাঁ, তুমি যা বলছে তা সত্য স্বপন।
তাই আমার মনে হয় দুর্গেশ্বরী এখন সৎপথে এসেছে। ব্যাঙ্ক লুট করার পর অনুশোচনা হয়েছে তাই সে তারই কোন অনুচর দ্বারা অর্থগুলো গোরী রাজ্যের অসহায় দুঃস্থ অনাথদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে।
মহারাজ গম্ভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন। হয়তো তিনি ভাবছেন রাণী দুর্গেশ্বরীর তাহলে সুমতি হয়েছে।
মন্ত্রীবর উঠে বললেন–স্বপন কুমারের উক্তি ঠিক হতে পারে কিন্তু যতক্ষণ ভিখারীদ্বয়কে আসল ভিখারী বলে প্রমাণ করা না হয়েছে ততক্ষণ কারো কথাই সঠিক নয়। কাজেই ভিখারীদ্বয়কে। আপাতত বন্দী করে রাখাই শ্রেয়।
মঙ্গলা দেবী মন্ত্রীবরের কথায় সায় দিয়ে বললেন–হাঁ, ভিখারীদ্বয়কে বন্দী করে রাখাই সমীচীন হবে।
সেদিনের মত দরবার ভঙ্গ হলো।
নিস্তব্ধ নিকষ অন্ধকারে প্রাসাদের টানা বেলকুনি ধরে একটা আলখেল্লাধারী ছায়ামূর্তি এগিয়ে চলেছে মহারাজ বাসুদেবের কক্ষের দিকে। একসময় এসে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি বাসুদেবের কক্ষের দরজায়। আস্তে দরজা ফাঁক করে প্রবেশ করলো ভিতরে। সন্তর্পণে এগুলো মহারাজের শয্যার দিকে।
শয্যার পাশে এসে আলগোছে মহারাজের বালিশের নিচ থেকে বের করে নিলো একটা চাবী। চাবীটা হাতে নিয়ে তাকালো ছায়ামূর্তি কক্ষের চারিদিকে। তারপর যেমন সতর্কভাবে কক্ষমধ্যে প্রবেশ করেছিলো তেমনি সর্তকতার সঙ্গে বেরিয়ে আসে।
আলখেল্লাধারী এবার রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো বাইরে। অন্ধকারে একটি অশ্ব। অপেক্ষা করছিলো, আলখেল্লাধারী অশ্বপৃষ্ঠে চেপে বসলো।
অন্ধকারে উল্কাবেগে ছুটলো আলখেল্লাধারী।
রাজপ্রাসাদ ছেড়ে কয়েক মাইল দূরে কারাগার কক্ষ। আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে আত্মগোপন করে আলখেল্লাধারী এসে পৌঁছলে বন্দীশালার সম্মুখে। প্রহরিগণের চোখে ধূলো দিয়ে অতি সাবধানে কারাগার মধ্যে প্রবেশ করলো, তারপর সন্তর্পণে এসে দাঁড়ালো একটি কারাকক্ষের সম্মুখে।
নিপুণ দৃষ্টি মেলে তাকালো এদিক ওদিক।
নিবু নিবু মশালের আলোতে দেখতে পেল পাহারাদারগণ বসে বসে ঝিমুচ্ছে।
আলখেল্লাধারী তার আলখেল্লার মধ্য হতে বের করে আনলো দক্ষিণ হাতখানা, তারপর খুলে ফেললো কারাকক্ষের তালা।
এ সেই কারাকক্ষ যে কক্ষে বন্দী করে রাখা হয়েছে নিরীহ অসহায় ভিখারীদ্বয়কে। গভীর রাতে কারাকক্ষের মেঝেতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে ওরা।
আলখেল্লাধারী নিদ্রিত ভিখারীদ্বয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো, দক্ষিণ হস্তে সূতীক্ষ্ণধার একখানা ছোরা বের করে নিলো। যেমন আলখেল্লাধারী ছোরাখানা একজন নিদ্রিত ভিখারীর বুকে বসিয়ে দিতে যাবে অমনি পিছন থেকে কে যেন ছোরাসহ আলখেল্লাধারীর হাতখানা ধরে ফেললো।
মুহূর্তে আলখেল্লাধারী ফিরে তাকালো, অস্ফুটকণ্ঠে বললো–দস্যু বনহুর!
দস্যু বনহুর আলখেল্লাধারীর হাত থেকে ছোরাখানা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলো দূরে, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো–নিরীহ ভিখারীকে হত্যা করে দস্যু বনহুরের প্রতিশোধ নিতে চাও দুর্গেশ্বরী? হাঃ হাঃ হাঃ এটাই বুঝি তোমার নীতি?
আলখেল্লাধারী নারী তাতে সন্দেহ নেই, কারণ তার কণ্ঠস্বরেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
দস্যু বনহুরের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে কারাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যায় দুর্গেশ্বরী, পরক্ষণে শোনা যায় অশ্বখুরের শব্দ।
ততক্ষণে জেগে উঠেছিলো ভিখারীদ্বয়, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছিলো ওরা।
দস্যু বনহুর ভিখারীদ্বয়কে কারাকক্ষ থেকে মুক্ত করে দিলো–যাও তোমরা।
ভিখারীদ্বয় খুশি হয়ে বনহুরকে আর্শীবাদ করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
প্রহরিগণ ততক্ষণে জেগে উঠেছে, তারা বিপুল বিক্রমে আক্রমণ করলো বনহুরকে। বনহুর প্রস্তুত ছিলো, সে প্রহরিগণের আক্রমণের জবাব দিতে লাগলো।
দস্যু বনহুরের সঙ্গে পেরে উঠা কম কথা নয়, বনহুর এক এক আঘাতে এক একজনকে ভূতলশায়ী করে চললো, অল্পক্ষণেই সবাইকে পরাজিত করে বেরিয়ে গেলো দস্যু বনহুর।
কতকগুলো সৈন্য ছুটলো বনহুরের পিছু পিছু কিন্তু তারা বিফল হয়ে ফিরে এলো একসময়।
পরদিন রাজদরবার লোকে লোকারণ্য।
রাজকারাগার থেকে ভিখারী বন্দীদ্বয়কে কে বা কারা মুক্ত করে নিয়ে গেছে, আর প্রহরিগণকে হত্যা করেছে। এই সংবাদ রাজ্যময় প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতাদের মধ্যে একটা বিপুল আগ্রহ জন্মেছে–কে সেই দেবপুরুষ যার হৃদয়ে এত মায়া! সামান্য দুটি ভিখারীর জন্য যে নিজের জীবন বিপন্ন করে রাজকারাগারে প্রবেশ করতে সাহসী হয়েছিলো এবং সশস্ত্র প্রহরিগণকে হত্যা করে ভিখারীদ্বয়কে মুক্ত করে নিয়ে গেছে।
মহারাজ বাসুদেব আসনে উপবিষ্ট।
মন্ত্রী, সেনাপতি এবং অন্যান্য রাজপরিষদ নিজ নিজ আসনে অধিষ্ঠিত। সকলেরই মুখমণ্ডল অতীব গম্ভীর আশঙ্কাগ্রস্ত।
মহারাজ বাসুদেবের পাশেই রাণী মঙ্গলা দেবী উপবিষ্ট রয়েছেন। তাঁর মুখমণ্ডলেও গাম্ভীর্যের ছায়াপাত ঘটেছে।
সবাই যখন গতরাতের ঘটনা নিয়ে আলাপ-আলোচনায় মত্ত তখন মহারাজ বাসুদেবের। সম্মুখস্থ টেবিলে খচ করে এসে গেঁথে গেলো একখানা ছোরা।
একসঙ্গে চমকে উঠলো সবাই।
মন্ত্রীবর ছোরাখানা তুলে নিলেন হাতে, সংগে সংগে অস্ফুটকণ্ঠে বললেন–দস্যু বনহুর মহারাজ দেখুন, ছোরার বাটে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে দস্যু বনহুর’।
মহারাজ বাসুদেব ছোরাখানা হাতে নিলেন। শুধু ছোরাই নয়, ছোরার সংগে গাঁথা রয়েছে। একটি কাগজ। মহারাজ মন্ত্রীর হাতে কাগজখানা দিয়ে বললেন–পড়েন!
মন্ত্রীবর ভাঁজ করা কাগজখানা পড়তে শুরু করলেন—
মহারাজ,
গতরাতে ভিখারীদ্বয়কে আমিই আপনার কারাগার হতে মুক্ত করে দিয়েছি।
– দস্যু বনহুর
দরবারকক্ষে আবার একটা মৃদু গুঞ্জনধ্বনি উঠলো। মঙ্গলা দেবী উচ্চকণ্ঠে বললেন– সেনাপতি, এখনি রাজপ্রাসাদ ঘেরাও করে ফেলার আদেশ দিন। নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর এই প্রাসাদের কোথাও আত্নগোপন করে আছে। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসুন রাজদরবারে।
সেনাপতি উঠে মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন তারপর আদেশ পালনে দ্রুত প্রস্থান করলেন দরবারকক্ষ থেকে।
মহারাজ বাসুদেব এতোক্ষণ ক্রুদ্ধভাবে দরবারে গত রাতের ভিখারীদ্বয়ের অন্তর্ধান নিয়ে পাহারাদারদের উপর কৈফিয়ৎ তলব করছিলো, যেইমাত্র তিনি ছোরাখানার গাঁথা চিঠির কথা জানতে পারলেন সেইমাত্র তার মুখোভাব প্রসন্ন হয়ে এলো–তিনি বুঝতে পারলেন, এ কাজ দস্য বনহুরের। মহারাজের চোখের সম্মুখে স্পষ্ট হয়ে ভেসে উঠলো একটি জমকালো ছায়ামূর্তি, পাগড়ির অংশে মুখের অর্ধেক ঢাকা, চোখে দীপ্তময় চাহনী। সুন্দর গম্ভীর কণ্ঠস্বর……মহারাজ, ভগবান আপনার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন, তবে দস্যু বনহুরের হাত থেকে রক্ষার জন্য নয়–রাণী দুর্গেশ্বরীর মৃত্যুছোবল থেকে বাঁচানোর জন্য…….
……তুমি, তুমি কি আমার হিতাকাক্ষী? ……
হ্যাঁ, আমি আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু বটে……
বাসুদেব রাণীর আচরণে মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেন, কারণ দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করা তাঁর ইচ্ছা নয়।
দরবারকক্ষে সকলে ভয়কম্পিতভাবে প্রতীক্ষা করতে লাগলো, এখনি দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করে নিয়ে ফিরে আসবেন সেনাপতি। আশঙ্কা জাগছে সবার মনে, না জানি কেমন মূর্তি সেই দস্যুর।
কয়েক ঘণ্টা পর ফিরে এলেন সেনাপতি বেশ কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে। সকলেরই চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ। হাঁপাচ্ছে সবাই, গা ঘেমে নেয়ে উঠেছে যেন তাদের।
দরবারকক্ষে প্রবেশ করে মহারাজ এবং মহারাণীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন সেনাপতি। তাঁর পেছনে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্যান্য সৈন্য।
সেনাপতি বললো–সমস্ত রাজপ্রাসাদ ঘেরাও করে ফেলা হয়েছিলো। সমস্ত প্রাসাদের প্রত্যেকটা জায়গা তন্ন তন্ন করে খোঁজ করা হলো কিন্তু কোথাও পাওয়া গেলো না দস্যু বনহুরকে। স্বপন কুমার এবং রাজকুমার মহাদেব দস্যু বনহুরের সন্ধানে রাজপ্রাসাদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে ফিরছে।
অল্পক্ষণ পর ফিরে এলো স্বপন কুমার ও রাজপুত্র মহাদেব, বিষণ্ণ মুখোভাব উভয়ের।
মঙ্গলা দেবী বললেন–তোমরাও অপদার্থ! দস্যু বনহুর রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করে রাজদরবারে ছোরা নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায় আর তোমরা সবাই কি করো?
স্বপন কুমার আমতা আমতা করে বলে–আমরা কেমন করে জানবো দস্যু বনহুর রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেছে? ক্ষমা করুন, এরপর থেকে আমরা পাহারাদারদের সংগে পাহারা দেবো।
মহারাজ বললেন–তোমার কথা শুনে খুশি হলাম স্বপন। শুধু দস্যু বনহুর নয়, দুর্গেশ্বরীও যেন আমার প্রাসাদে প্রবেশ করে কোন অমঙ্গল ঘটাতে না পারে।
স্বপন কুমার মস্তক অবনত করে সম্মতি জানালো।
মহারাজ তাকে বসার জন্য আদেশ দিলো!
মঙ্গলা দেবীর সখ তিনি নৌকা ভ্রমণে যাবেন। সঙ্গে যাবেন মহারাজ বাসুদেব আর স্বপন কুমার।
রাণীর সখে বাধা দিতে পারলেন না মহারাজ। কারণ তাঁর আদরিণী রাণীর জন্য তিনি সব করতে পারেন। তবে দেশের এই বিপদ মুহূর্তে মনে আশঙ্কা জাগছিলো, হঠাৎ দুর্গেশ্বরী কোনো অমঙ্গল ঘটিয়ে না বসে!
রাণী মহারাজের কোনো কথা শুনলেন না, যাবেনই। কাজেই মহারাজ বাধ্য হয়ে মন্ত্রীকে আদেশ দিলো নৌকাবিহারের জন্য নৌকা প্রস্তুত করতে।
একখানা নয়, কয়েকখানা লৌকা সাজানো হলো। অগণিত সৈন্য-সামন্ত নেওয়া হলো বিভিন্ন নৌকায়। সৈন্যরা সবাই অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রয়েছে, যে কোনো দস্যু বা দস্যুরাণী হানা দিতে না পারে।
মঙ্গলা দেবীর কণ্ঠে রয়েছে বহুমূল্য একটি হীরককণ্ঠী। লক্ষ লক্ষ টাকা এর মূল্য।
মহারাজ অনেক করে বললেন–রাণী, এ কণ্ঠীহার আজ না পরাই ভালো, কারণ দুর্গেশ্বরী হানা দিতে পারে।
মঙ্গলা দেবী কোন কথাই শুনলেন না, কীহার তিনি গলায় পরলেন।
যাত্রা শুরু হবার পূর্বে নানারকম বাদ্যযন্ত্র সুর ছড়াতে লাগলো।
নদীতীর মুখর হয়ে উঠলো সে সুরের আবেশে। মহামান্য রাণী মঙ্গলা দেবী নৌকায় এসে বসলেন। এখনও মহারাজ বাসুদেব আর স্বপন কুমার এসে পৌঁছেননি নৌকার পাশে।
হঠাৎ একখানা তীর এসে গেঁথে গেলো রাণী মঙ্গলা দেবীর সম্মুখে নৌকার ভিতরে!
চমকে উঠলেন রাণী মঙ্গলা দেবী।
সঙ্গে সঙ্গে রাণীর নৌকার মাঝিমাল্লাগণ আতঙ্কিত ভয়চকিত হয়ে পড়লো। অন্যান্য নৌকায় সৈন্যসামন্ত ছিলো, তারা সবাই এসে ঘিরে ধরলো রাণীর নৌকাখানা।
রাণীর আদেশে কতকগুলো সৈন্য ছুটলো চারদিকে। কে এই তীর নিক্ষেপ করলো তারই অন্বেষণে।
ততক্ষণে মহারাজ এবং স্বপনকুমার এসে পৌঁছে গেছেন। মহারাজ ব্যাপার শুনে থ’ হয়ে। গেলেন। স্বপন কুমারের চোখেমুখে ফুটে উঠলো একটা ক্রুদ্ধভাব, সে তখনই তীরফলক হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলো।
তীরফলক পরীক্ষা করে নিক্ষেপকারীর কোন হদিস পাওয়া গেলো না কারণ তীরফলকে কারোও নাম খোদাই করা ছিলো না। স্বপন কুমার বললো–এটা দস্যু বনহুরের কাজ।
মহারাজ বললেন–না, এ তীর নিক্ষেপ করেছে দুর্গেশ্বরী।
শেষ পর্যন্ত সৈন্যসামন্ত সবাই বিফল হয়ে ফিরে এলো, কেউ কোন সন্ধান আনতে পারলো না কে রাণীর নৌকায় তীর নিক্ষেপ করেছে।
মহারাজ আশঙ্কিত হয়ে ছিলো, এ যাত্রা কখনই শুভ হবে না বলে তিনি রাণীকে জানালেন।
রাণী যা জেদ ধরলেন তা থেকে ক্ষান্ত হবেন না, কাজেই একসঙ্গে সাতখানা নৌকা। ভাসলো।
রাণীর নৌকার সম্মুখে এবং পিছনে চললো সৈন্য-সামন্ত ভরা নৌকাগুলো, মাঝখানে রাণীর নৌকা। সম্মুখের তিনখানা নৌকার মধ্যে সর্বাগ্রে যে নৌকাখানা চলেছে সে নৌকাখানায় রয়েছে শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্রসহ বাদকগণ।
নৌকা চলার তালে তালে বাদকগণ সুর ছড়িয়ে চলেছে। সূর্যাস্তের সোনালী আভায় নদীর পানি চিকচিক করছে।
সারিবদ্ধভাবে নৌকা চলেছে।
বেলা ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাকাশে রূপালী থালার মত জেগে উঠলো পূর্ণিমার চাঁদ। জ্যোছনার আলোতে ঝলমল করে উঠলো সমস্ত পৃথিবী।
নদীর পানিতে ঢেউ-এর বুকে দোল খাচ্ছে আঁকাবাঁকা সাজের আকারে চাঁদখানা।
ছৈ-এর বাইরে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ বাসুদেব আর মহারাণী মঙ্গলা দেবী।
স্বপন কুমার তখন বসে বসে ঝিমুচ্ছিলো।
বৃদ্ধ মহারাজ বাসুদেব স্বপন কুমারকে নৌকার পাটাতনে বসে ঝিমুতে দেখে হাসলেন– রাণী, তুমি স্বপনকে সঙ্গে নিয়েছে বীরপুরুষ মনে করে কিন্তু ঐ দেখো সন্ধ্যারাতেই সে ঘুমে ঢলে পড়ছে।
মঙ্গলা দেবী মায়াভরা কণ্ঠে বললেন–আহা, বেচারী ছেলে মানুষ, একটু ঘুমিয়ে নিক। ফিরতে রাত হবে, তখন জেগে থাকবে।
মঙ্গলা দেবী আর মহারাজ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো।
মহারাজ বললেন-রাণী, চলো নৌকার ভিতরে যাই।
মঙ্গলা দেবী ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বলেন–এই সুন্দর চাঁদকে আপনি অবহেলা করতে পারেন মহারাজ কিন্তু আমি পারি না। আমার সমস্ত মনপ্রাণ আজ উচ্ছল হয়ে উঠেছে!
মহারাজ আশঙ্কাভরা কণ্ঠে বললেন–তাতো বুঝলাম কিন্তু এরি মধ্যে ভুলে গেছো নৌকা ছাড়ার পূর্বে সেই অজ্ঞাত হস্তের নিক্ষিপ্ত তীরখানার কথা?
অবজ্ঞাভরে বললেন মঙ্গলা দেবী–ভুলে যাইনি মহারাজ। আমি জানি তীর নিক্ষেপকারী কে?
অবাক কণ্ঠে বললেন মহারাজ–জানো! তুমি জানো রাণী?
হাঁ মহারাজ, তীর নিক্ষেপ করেছে সেই শয়তান দস্যু বনহুর।
রাণী!
হা।
দস্যু বনহুরকে তুমি শয়তান বলছো রাণী?
বলবো না? সে আমার বন্দীশালার ভিতরে প্রবেশ করে ভিখারী বন্দীদের মুক্তি দেয় কোন্ সাহসে?
রাণী আমার বন্দীশালা থেকে ভিখারীদ্বয়কে মুক্তি দিয়েছে দস্যু বনহুর–আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি আর তুমি পারলে না?
না, আমি দস্যু বনহুরকে ক্ষমা করবো না।
রাণী, জানো দস্যু বনহুর আমাদের একজন হিতৈষী বন্ধু?
আপনার হতে পারে আমার নয়!
রাণী! এ তুমি কি বলছো? সেদিন শয়তানী দুর্গেশ্বরীর ভয়ে তুমি আর আমি যখন কুঁকড়ে গিয়েছিলাম তখন দেবপুরুষের মত আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলো দস্যু বনহুর…..রাণী, মনে রেখো দুর্গেশ্বরী যদি আজ আমাদের উপর হামলা করে বসে তখন দেবে মজাটা কেমন।
আপনি ভিতরে যান মহারাজ, আমাকে কিছুক্ষণ একা থাকতে দিন।
বেশ, তাই যাচ্ছি কিন্তু সাবধানে থেকো।
আচ্ছা।
মহারাজ নৌকামধ্যে প্রবেশ করলেন।
রাণী আকাশে পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
অদূরে হাঁটুর মধ্যে মাথা খুঁজে নাক ডাকাচ্ছে স্বপন কুমার।
মঙ্গলা দেবী ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন, বোধ হয় করুণার হাসি। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন স্বপন কুমারের পাশে।
হাঁটু গেড়ে বসে ডাকলেন মঙ্গলা দেবী–এই, ঘুমাচ্ছো?
ধড়মড় করে সোজা হয়ে বসলো স্বপন কুমার। চোখ রগড়ে লজ্জিতভাবে বললো–একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মাফ করবেন রাণী…….
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের ঠোঁটের উপরে তার সুকোমল আংগুলগুলো চাপা দিল–রাণী নয়, বলো মঙ্গলা দেবী।
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে স্বপন কুমার, প্রথমে সে হাবা বনে গেলো, কোন কথা বললো না।
মঙ্গলা দেবীর চোখেমুখে একটা ভাবের উন্মেষ, আবেগভরা কণ্ঠে বললেন–স্বপন, দেখো কি সুন্দর চাঁদ!
আমতা আমতা করে বললো স্বপন কুমার–আমি দেখেছি মঙ্গলা দেবী।
স্বপন, তুমি গান জানো?
গান…..না না, আমি গান জানি না। তবে ছোটবেলায় একটু আধটু গাইতাম।
আজ একটা গান গাওনা কেন?
আমার গলার সুর শুনে নদীর মাছগুলো সব নৌকায় উঠে আসবে যে রাণীমা…….
আবার রাণীমা! বলেছি তুমি আমাকে মঙ্গলা বলে ডাকবে?
মঙ্গলা বলে? না, আমি মঙ্গলা বলে আপনাকে ডাকতে পারব না, মঙ্গলা দেবী বলে। ডাকবো।
বেশ তাই ডেকো। স্বপন?
বলুন মঙ্গলা দেবী?
জানো আজ কেন নৌকা ভ্রমণে এসেছি?
জানি।
জানো?
হাঁ।
বলো তো কেন?
মহারাজের মনে আনন্দ দেবার জন্য।
তুমি বড় অবুঝ। স্বপন, শুধু তোমার জন্য।
আমার জন্য?
হাঁ, তোমার জন্য।
কিন্তু আমি……আমি বুঝতে পারছি না মঙ্গলা দেবী।
এটাই আমার দুঃখ, আজও তুমি আমার মনের কথা বুঝতে পারলে না।
আপনি কি চান মঙ্গলা দেবী?
আমি চাই তোমাকে।
ঢোক গিলে বুকে হাত রেখে বললো স্বপন কুমার–আমাকে?
হ্যাঁ, আমি সব দেবো, সব দেবো তোমাকে। সমস্ত রাজ্য তোমার হবে স্বপন…….
আমি রাজ্য নিয়ে কি করবো?
হরিনাথ রাজ্যের অধিকারী তুমি, আবার গোরী রাজ্যের অধীশ্বর হবে……।
দুটো রাজ্য আমি কি করে চালাবো?
এত বোকা তুমি!
না না, ও আমি পারবো না।
এই সাহস নিয়ে তুমি এসেছো রাণী দুর্গেশ্বরীকে দমন করতে! প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তুমি সত্যি বীরপুরুষ কিন্তু এখন দেখছি তোমার মধ্যে কিছু নেই! শুধু তোমার চেহারাটাই যা রাজ পুত্রের মত……
সেজন্য আমি লজ্জিত। বললো স্বপন কুমার।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের কথায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললেন–স্বপন, তোমার বৃদ্ধ রাজাকেও আমি ত্যাগ করতে পারি।
ভয়ে শিউরে উঠলো স্বপন কুমার রাণী বলে কি এসব! অন্তরে অন্তরে ঘৃণায় ভরে উঠলো তার মন। মঙ্গলা দেবীর প্রতি তার এতোদিন যে একটা শ্রদ্ধা ছিলো সব এক নিমিশে উবে গেলো। নৌকা ভ্রমণে রাণী-রাজার সঙ্গী হওয়ায় নিজকে অপরাধী মনে হচ্ছিলো তার।
চুপ করে বসে রইলো হতবুদ্ধি হয়ে।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের কাঁধে হাত রাখলেন।
বিব্রত বোধ করলো স্বপন কুমার। উঠে দাঁড়ালো সে রাণীর সঙ্গ ত্যাগ করার জন্য। কিন্তু রাণীকে এড়িয়ে যেতে পারলো না।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের বুকে মাথা রেখে বললেন–পারবে আমাকে সুখী করতে?
স্বপন কুমার ঢোঁক গিললো, কোন জবাব সে দিতে পারলো না।
মঙ্গলা দেবী বললেন–জানো স্বপন, কত ব্যথা আর বেদনা আমার বুকে জমা হয়ে আছে?
রীতিমত ঘেমে উঠেছে স্বপন কুমার, বারবার রুমালে মুখ মুছছে সে।
মঙ্গলা দেবীর অধরখানা তখন স্বপন কুমারের অধরে এসে ঠেকেছে।
এমন সময় নৌকার মধ্য হতে শোনা যায় মহারাজের কণ্ঠস্বর–মঙ্গলা, ভিতরে এসো।
মঙ্গলা দেবী এবার স্বপন কুমারের নিকট হতে ভিতরে চলে যান, কতকটা বাধ্য হয়েই যান তিনি।
নৌকার ভিতরে এসে মহারাজের পাশে বসলেন আমাকে ডাকছেন মহারাজ?
হাঁ রাণী, এক একা ভাল লাগছিলো না। তা ছাড়া এবার ফেরা যাক, কি বলো?
এতো ভীতু আপনি! চলুক, আরও কিছুটা চলুক–নৌকার দোলায় আমার ঘুম পাচ্ছে। মঙ্গলা দেবী স্বামীর পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেন, তারপর বললেন–আপনি ও ঘুমান মহারাজ, আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।
বেশ, তাই দাও। মহারাজ বাসুদেব স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলেন।
মঙ্গলা দেবী স্বামীর চুলবিহীন চৰ্চকে মাথায় ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে চললেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিদ্রার কোলে ঢলে ছিলো মহারাজ বাসুদেব। জ্যোছনা রাতের ফুরফুরে বাতাসে আর নৌকার মিষ্টি মিষ্টি দোলায় নাক ডাকতে শুরু করলো তার।
রাণী মঙ্গলা দেবী এবার সোজা হয়ে বসলেন তারপর শিস্ দিলো সন্তর্পণে।
সংগে সংগে নৌকার খোলসের মধ্য হতে বেরিয়ে এলো কয়েকজন সশস্ত্র সৈন্য! তারা। নৌকার ভিতরে প্রবেশ করতেই মঙ্গলা দেবী ইংগিত করলেন মহারাজকে বেঁধে ফেলতে।
আদেশ পালন করলো সশস্ত্র সৈন্যগণ।
মহারাজের হাত-পা-মুখ বেঁধে ফেললো তারা, তারপর রাণী মঙ্গলার আদেশে ওরা তুলে নিলো মহারাজকে কাঁধে। নৌকার বাইরে এনে আলগোছে নৌকা থেকে রাজাকে নদীর পানিতে ছেড়ে দিলো।
ঝুপ করে সামান্য একটু শব্দ হলো কিন্তু সে শব্দ কারো কানে পৌঁছলো না, দাঁড়ের শব্দের সংগে মিশে গেলো শব্দটা।
চোখ মেলে তাকালেন মহারাজ, পাশে উপবিষ্ট সেই জমকালো মূর্তি। মহারাজের চিনতে বাকি রইলো না, এ সেই লোক যে একদিন গভীর রাতে রাজপ্রাসাদে অকস্মাৎ আবির্ভূত হয়েছিলো। ভয়ে আড়ষ্ট হয়েছিলো মহারাজ এবং মঙ্গলা দেবী, তখন ছায়ামূর্তি বলেছিলো……..ভয় নেই মহারাজ, আমি আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী।
মহারাজ যখন চোখ খুলে চাইলেন তখন ছায়ামূর্তির মুখমণ্ডল উজ্জ্বল দীপ্তময় হয়ে উঠেছে।
মহারাজ বললেন–আমি কোথায়?
ছায়ামূর্তি বললো–দস্যু বনহুরের আস্তানায়।
তুমি–তুমিই সেদিন আমার রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করেছিলে?
হাঁ আমি।
তুমি দস্যু বনহুর?
হাঁ, আমি দস্যু বনহুর।
কিন্তু তুমি না আমাকে বলেছিলে, তুমি আমার মঙ্গলকামী! আমার হিতাকাঙ্ক্ষী বন্ধু?
হাঁ, আমি আপনার বন্ধু।
তবে কেন আমাকে এভাবে নৌকা থেকে চুরি করে আনলে? আর কেনইবা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিলে? সত্যি আমি কোন অন্যায় করিনি!
জানি আপনি ন্যায়বান রাজা এবং সে কারণেই আমি আপনার বন্ধু। আর আপনি যা ভেবেছেন তা সত্য নয়। আজ আপনি অসুস্থ কাজেই সব বলবো না, পরে সব জানতে পারবেন।
বনহুরের ইংগিতে তার সম্মুখে গরম দুধের বাটি ধরা হলো।
বনহুর বললো–দুধ খেয়ে নীরবে ঘুমান।
রাজা বিনা বাক্যে দুধটুকু পান করলেন।
ঔষধপত্র খাইয়ে মহারাজ বাসুদেবকে সুস্থ করে তুললো দস্যু বনহুর।
যখন মহারাজ বাসুদেব জানতে পারলেন, রাণী মঙ্গলা দেবীর চক্রান্তেই তার এ অবস্থা সেদিন রাণীর চক্রান্তেই তাকে হাত-পা-মুখ বেঁধে নদীবক্ষে বিসর্জন দেওয়া হয়েছিলো তখন মহারাজের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো, তার আদরিণী রাণী বিশ্বাসঘাতকিনী!
মহারাজ বাসুদেব ভীষণভাবে ক্রোধান্ধ হয়ে উঠলেন, রাণীর উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠলেন তিনি।
দস্যু বনহুর মহারাজকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন–ক্ষান্ত হন মহারাজ, প্রতিশোধ নেবার সময় এলে তখন আমি আপনাকে বলে দেবো।
মহারাজ দস্যু বনহুরের গোপন আস্তানায় রয়ে গেলেন।
ওদিকে রাণী মঙ্গলা দেবী শোকে কাতর হয়ে পড়েছেন। শোক বস্ত্র পরিধান করে রাজসিংহাসনে উপবেশন করলেন।
প্রজাগণ তখন সবাই এসে জমায়েত হয়েছে রাজবাড়ির সম্মুখে। সবার চোখে অশ্রু, মুখমণ্ডলে বিষণ্ণতার ছাপ, কারণ তাদের রাজার আকস্মিক মৃত্যুতে তারা মর্মাহত শোকাতুর হয়ে পড়েছে।
রাণী মঙ্গলা দেবী দরবারকক্ষে সিংহাসনে বসেছেন। তার দু’পাশে দু’জন বসেছে, রাজপুত্র মহাদেব ও হরিনাথের রাজপুত্র স্বপন কুমার!
রাজপরিষদগণ নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট। সকলেরই মুখোভাব করুণ বিষাদময়।
রাজপুত্র মহাদেব তো কেঁদেকেটে দু’চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। স্বপন কুমারের চোখেও অশ্রু, হাজার হলেও বৃদ্ধ মহারাজ বাসুদেবকে সে নিজের পিতার মতোই শ্রদ্ধা করতো।
মঙ্গলা দেবী সিংহাসনে উপবেশন করে শোকাতুর প্রজাদের ডাকলেন।
প্রজাগণ দরবারকক্ষে সমবেত হয়ে রাজমাতার চোখে অশ্রু এবং দেহে শোকাবস্ত্র দেখে মর্মাহত হলো। প্রায় অনেকেই আকুলভাবে কাঁদাকাটা করতে লাগলো।
রাণী মঙ্গলা দেবী উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর গণ্ড বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু। তিনি বাষ্পরুদ্ধ গলায় প্রজাদের সম্বোধন করে বললেন–বৎসগণ, আমি অতীব দুঃখিত আর শোকাতুরা হয়ে পড়েছি। হঠাৎ মহারাজের আকস্মিক মৃত্যুর জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। পূর্বে যদি এতটুকু জানতাম, এই নৌকা ভ্রমণ আমার বৈধব্য টেনে আনবে তাহলে আমি কিছুতেই এই অশুভ নৌকা ভ্রমণে গমন করতাম না! কথা বন্ধ করে আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন মঙ্গলা দেবী।
মঙ্গলা দেবীর পিতা অবসরপ্রাপ্ত মন্ত্রীবর আজ দরবারে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি বৃদ্ধ হবার পর থেকে রাজকার্যে বড় একটা যোগ দিতেন না। আজ কন্যার এই বিপদ মুহূর্তে না এসে পারলেন না। কন্যাকে রোদন করতে দেখে বৃদ্ধ মন্ত্রীবরও অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না, তিনি উঠে দাঁড়িয়ে কন্যাকে সম্বোধন করে বলেন–কেঁদো না মা, যা ভাগ্যে ছিলো তাই ঘটেছে। এখন তাঁর পবিত্র আত্মার যেন সঙ্গতি হয় সেই চিন্তা করো। মহারাজ বাসুদেব ছিলো মহৎ এবং মহান ও ন্যায়পরায়ণ রাজা। প্রজাদের তিনি নিজ সন্তানের মত মনে করতেন। দীন দুঃখিগণ ছিলো তার প্রিয়, কাজেই মহারাজের আত্নার মঙ্গলের জন্য শ্রাদ্ধ-শান্তি করো। রাজ্যের সমস্ত গরিব দীনহীন প্রজাদের মধ্যে অর্থ এবং বস্ত্রাদি বিতরণ করো, এতে মৃত মহারাজের আত্না তৃপ্তি লাভ করবে।
রাণী মঙ্গলা দেবী নীরবে মাথা নাড়লেন।
স্বপন কুমার বললো–মন্ত্রীবরের কথা মতই কাজ করা শ্রেয় মঙ্গলা দেবী।
স্বপন কুমার মঙ্গলা দেবীর অনুরোধেই তাকে আজকাল মঙ্গলা দেবী বলে ডাকে। স্বপন। কুমারের মুখে নিজ নাম শ্রবণে আনন্দ পান তিনি।
প্রজাদের সান্ত্বনা বাক্যে বিদায় করলেন মহারাণী মঙ্গলা দেবী।
রাজ্যময় ঘোষণা করে দেওয়া হলো মহারাজের শ্রাদ্ধ ক্রিয়ার কথা। দীন-দুঃখী-গরিব বেচারীদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেলো, মহারাণী মঙ্গলা দেবী মহারাজের শ্রাদ্ধ-শান্তিতে নিজ হস্তে দান করবেন।
বিরাট ভোজের আয়োজন চলেছে।
রাজপ্রাসাদের প্রতিটি ব্যক্তি ব্যস্তসমস্ত হয়ে পড়েছেন। এই শ্রাদ্ধ-শান্তি প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলবে। হাজার হাজার লোকের আগমন হবে এই শ্রাব্ধ।
মহারাজ বাসুদেবের শ্রাদ্ধ–কম কথা নয়।
মহারাজের পাশে উপবিষ্ট দস্যু বনহুর।
বনহুর সম্মুখস্থ প্লেট থেকে আঙ্গুরের ঝোঁপগুলো তুলে নিয়ে মুখে ধরছিলো আর খেতে খেতে মহারাজের সঙ্গে কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছিলো।
মহারাজের মুখমণ্ডল-গম্ভীর, ললাটে গভীর চিন্তারেখা ফুটে উঠেছে। আজ গোরী রাজ্যের সবাই জানে নৌকা ভ্রমণে গমন করে মহারাজের মৃত্যু ঘটেছে। তিনি যে এখনও পৃথিবীর বুকে সশরীরে বিরাজ করছেন, এ কথা এক দস্যু বনহুর আর রহমান কাহিনী ছাড়া কেউ জানে না।
মহারাজ বাসুদেব বলেন–আমি বিশ্বাস করি না আমার প্রিয় রাণী মঙ্গলা বিশ্বাসঘাতকিনী! আমাকে কে নিজ জীবনের চেয়ে বেশি ভালবাসতো……
বনহুর সোজা হয়ে বসলো, তারপর বললো–মহারাজ, আগামীকাল আপনি তার প্রমাণ পাবেন। আজ বিশ্রাম করুন।
পরদিন দস্যু বনহুর মহারাজসহ একটি গুপ্ত গুহায় প্রবেশ করলো। তারপর মহারাজকে এক সাধু বাবার বেশে সজ্জিত করে নিজেও তাঁর শিষ্য সাজলো। হাতে চিষ্টা, গলায় এবং বাজুতে রুদ্রাক্ষের মালা, কপালে শ্বেত চন্দনের আল্পনা, মাথায় জটাজুট চুল।
বনহুর রহমানকে পূর্বেই একখানা গাড়ির ব্যবস্থা করতে বলেছিলো। মোটর গাড়ি বা কোন যন্ত্রচালিত গাড়ি নয়, ঘোড়া গাড়ি।
রহমান একখানা ঘোড়াগাড়ি এনে হাজির করলো।
বনহুর এবং মহারাজ ঘোড়াগাড়ির মধ্যে উঠে বসলেন।
রহমান কোচওয়ানের বেশে বসলো কোচ বাক্সে! সে গাড়ি খানাকে চালনা করে নিয়ে গেলো।
গোরী পর্বতের গা বেয়ে সরু পথ, সেই পথে অতি সতর্কতার সঙ্গে গাড়ি চালাচ্ছিলো রহমান। হঠাৎ ঘোড়ার পা যেন পিছলে না যায়।
রহমান এবং দুস্য বনহুর ও মহারাজ বাসুদেবকে কেউ সহসা চিনতে পারবে না, তারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে ছদ্মবেশের আড়ালে।
মহারাজ বাসুদেব চিন্তিত মুখে বসে তাকিয়ে ছিলো বাইরের দিকে।
বনহুর বসে ছিলো তার অপর পাশে, সেও বাইরে সুইচ্চ পর্বতশৃঙ্গের দিকে তাকিয়ে ছিলো। বনহুরের দৃষ্টি মাঝে মাঝে বাসুদেবের মুখে ফিরে আসছিল, সে দেখছিলে রাজা বাসুদেবের মুখোভাব। সুপক্ক দাড়ি-গোঁফ এবং রাশিকৃত জটাজুট চুলের আড়ালে মহারাজ একেবারে বদলে গেছেন, চিনার উপায় নেই তাঁকে।
গাড়িখানা গোরী পর্বতের পাথুরিয়া পথের উপর দিয়ে হোঁটচ খেয়ে খেয়ে দ্রুত ছুটে চলেছে।
বনহুর বললো-মহারাজ, কোথায় চলেছেন কিছু অনুমান করতে পেরেছেন?
মহারাজ বনহুরের মুখে দৃষ্টি রেখে বললেন–না, আমি এখনও কিছু বুঝতে পারিনি।
মহারাজ, আজ আপনি আপনার শ্রাদ্ধে চলেছেন।
শ্রাদ্ধ!
হ্যাঁ, আপনার শ্রাদ্ধক্রিয়া আজ সম্পূর্ণ হচ্ছে। রাজপ্রাসাদ আজ লোকে লোকারণ্য। রাণী মঙ্গলা দেবী স্বামীর মৃত্যুশোকে মুহ্যমান হয়ে স্বামীর আত্মার শান্তির জন্য এই শ্রাদ্ধ-শান্তির আয়োজন করেছেন। শত শত দীন-দুঃখীকে মহারাণী নিজ হস্তে দান করবেন।
বিস্মিত দৃষ্টি মেলে মহারাজ বাসুদেব তাকিয়ে আছেন দস্যু বনহুরের মুখের দিকে–বলে কি সে! মৃত্যু না হতেই আমার শ্রাদ্ধ-শান্তি হচ্ছে? হায় ভগবান, একি শুনছি…….বলে উঠলেন মহারাজ!
বনহুর শান্তকণ্ঠে বললো–শুনছেন নয়, এবার দেখবেন চলুন।
একসময় গোরী পর্বতের পাথুরিয়া পথ ছেড়ে রাজপথে এসে ছিলো তাদের গাড়িখানা। রাজ্যমধ্যে পৌঁছতেই মহারাজ দেখতে পেলেন অগণিত লোকজন এবং সাধু-সন্ন্যাসী রাজ প্রাসাদ। অভিমুখে সারিবদ্ধভাবে চলেছে।
গাড়ি রাখতে বললো বনহুর।
রহমান গাড়ি রুখলো।
বনহুর একদল সাধু বাবাজীকে ডেকে বললো–বাবাজী, আপনারা কোথায় চলেছেন?
সন্ন্যাসিগণ বলেন–তোমরা কোন রাজ্যে বাস করো? শোনোনি আজ আমাদের মৃত মহারাজ বাসুদেবের শ্রাদ্ধ-শান্তি হচ্ছে। আমরা সেখানেই চলেছি।
সন্ন্যাসী বাবাজীর কথা শুনে মহারাজ বাসুদেব দু’হাতে মাথা চেপে ধরলেন। জীবিত থেকেও নিজের মৃত্যু-সংবাদে তাঁর মাথাটা ভনভন করে ঘুরে উঠলো।
বনহুর গাড়ি ছাড়ার জন্য রহমানকে আদেশ করলো। জনমুখর রাজপথ ধরে দস্যু বনহুরের গাড়িখানা এগিয়ে চলেছে।
বনহুর বললো–মহারাজ, এবার আপনি বিশ্বাস করছেন তো?
মাথা দোলালেন মহারাজ, বলেন–হ বনহুর, তোমার কথা যে মিথ্যা নয় এখন তা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি।
আরও পারবেন অপেক্ষা করুন মহারাজ। এখন আমাদের গাড়িখানা রাজপ্রাসাদের অনতিদূরে এসে গেছে, আমাদের নামতে হবে।
গাড়ি রুখলো রহমান।
বনহুর মহারাজ বাসুদেবসহ নেমে পড়লো। রহমানকে গাড়িসহ নিভৃত একস্থানে অপেক্ষা করতে বলে তারা প্রসাদ অভিমুখে রওনা দিলো।
আরও বহু দীন-দুঃখী চলেছে, তাদের দলে মিশে গেলো মহারাজ বাসুদেব আর দস্যু। বনহুর। তারাও দীনহীন অনাথের মত ভীড়ের মধ্যে এগিয়ে চললো।
রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন প্রাচীরঘেরা একস্থানে মহারাণী মঙ্গলা দেবী গরিবদের মধ্যে নিজ হস্তে দান করে স্বামীর পুণ্য কামনা করবেন।
প্রাসাদের সম্মুখ আঙ্গিনায় শ্রাদ্ধে আমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ ভোজনে রত। দলের মধ্যে মহারাজ বাসুদেব স্বয়ং এসে বসলেন, পাশে বসলো দস্যু বনহুর।
মহারাজ বাসুদেব ও বনহুর খেতে শুরু করলো।
মহারাজ বাসুদেবের কানে এলো, তার অদূরে কোন দীনহীন গরিব বেচারী খেতে খেতে বলছে–হে ভগবান, তুমি মহারাজের আত্মার শান্তি দিও!
বনহুর খাবার চিবুতে চিবুতে তাকালো মহারাজের মুখের দিকে।
মহারাজের মুখ কালো হয়ে উঠেছে, খাবারসহ হাতখানা তার থেমে গেছে মাঝপথে। এসব কি শুনছেন তিনি, আর দেখছেন। মহারাজ উঠে দাঁড়ালেন, ক্রুদ্ধভাবে চিৎকার করে বলতে চাইলেন–আমি মরিনি…সব মিথ্যা, সব মিথ্যা……
কিন্তু মহারাজের কণ্ঠ দিয়ে কিছু উচ্চারণ হবার পূর্বেই বনহুর মহারাজকে টেনে বসিয়ে দক্ষিণ হস্তে দৃঢ়ভাবে মহারাজের মুখ চেপে ধরলো–সব নষ্ট করতে যাচ্ছেন মহারাজ! সব নষ্ট করতে যাচ্ছেন…..চাপাকণ্ঠে বললো সে কথাটা।
না না, আমাকে ছেড়ে দাও, আমি রাণীর কাছে যাবো, শুনবো সব কথা……..
চুপ করুন, চুপ করুন…..
ততক্ষণে মহারাজ আর বনহুরের পাশে লোকজন জমা হয়ে গেছে।
সবাই বললো, কি হয়েছে, ব্যাপার কি? ব্যাপার কি?
বনহুর শান্তকণ্ঠে বললো–কিছু হয়নি, এর মাথায় কিছুটা গণ্ডগোল আছে কিনা তাই……
মহারাজসহ বনহুর শ্রাদ্ধমণ্ডপ থেকে বেরিয়ে এলো ভীড় এড়িয়ে। ঘোড়াগাড়ির পাশে এসে দাঁড়ালো–মহারাজ, আরও দেখতেন, কিন্তু আপনি যেভাবে চিৎকার করতে যাচ্ছিলেন তাতে সবকিছু পণ্ড হবার যোগাড় হয়েছিলো। মহারাণী নিজহস্তে দীন-দুঃখীদের মধ্যে অর্থ এবং বস্ত্রাদি বিতরণ করবেন।
আমি যাবো সেখানে। আমাকে রাণীর কাছে নিয়ে চলো বনহুর, আমাকে রাণীর কাছে নিয়ে চলো।
কিন্তু আপনি নিজকে সংযত রাখতে পারবেন তো মহারাজ?
পারবো।
তাহলে চলুন?
মহারাজসহ বনহুর আবার এলো প্রাসাদে, যে স্থানে রাণী মঙ্গলা দেবী নিজহস্তে অর্থ এবং বস্ত্রাদি বিতরণ করছিলো।
দীন-দুঃখীগণ ভোজনশেষে সারিবদ্ধভাবে রাণীর সম্মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে আর রাণী তাদের মধ্যে মুক্তহস্তে দান করে চলেছেন।
দস্যু বনহুর এবং মহারাজ বাসুদেব সারি মধ্যে এসে দাঁড়ালো।
মহারাণী মঙ্গলা দেবী তখন সুউচ্চ স্থানে দণ্ডায়মান অবস্থায় অর্থ এবং বস্ত্রাদি বিতরণ করছেন।
মহারাজ আর বনহুর সারির মধ্যে অগ্রসর হয়ে রাণীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, হাত পাতলো তারাও অন্যান্য দুস্থদের সঙ্গে।
রাণী কাপড় এবং অর্থ নিয়ে দস্যু বনহুর ও মহারাজের হাতে দিলো।
রাণীর দেহে শোকবস্ত্র কিন্তু মুখোভাবে তেমন কোনো শোকের ছায়া নেই।
যদিও রাণী নিজকে শোকাচ্ছন্ন করে রাখার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হচ্ছিলো না তার মধ্যে। তার মনের আসল ভাব প্রকাশ হয়ে পড়ছিলো।
বনহুর আর মহারাজ বাসুদেব বেরিয়ে এলো প্রাসাদ থেকে। বাইরে এসে বস্ত্র এবং অর্থগুলো তারা দিয়ে দিলো ভিখারীদের মধ্যে।
ভিখারী অবাক হলো প্রথমে, বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–তোমরা এসব দিয়ে দিলে কেন ভাই?
মহারাজ এবং বনহুর ভিখারীদের কথায় কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেলো।
আবার ফিরে এলো মহারাজ দস্যু বনহুরের সঙ্গে তার আস্তানায়।
মহারাজের মনে শান্তি নেই, সদা-সর্বদা তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকেন। তিনি ভাবতেও পারেননি তাঁর প্রিয়তমা রাণী মঙ্গলা দেবী এত হৃদয়হীন পিশাচিনী। তাঁকে আদর দিয়ে নৌকা ভ্রমণে এনে হত্যা করার ফন্দি এটেছিলো! কি উদ্দেশ্য আছে যার জন্য মঙ্গলা দেবী স্বামীহত্যা করলো? মহারাজ যত ভাবেন ততই বেশি উন্মত্ত হয়ে উঠেন! কেন কেন তাকে এভাবে হত্যা করলো! যদিও মহারাজের মৃত্যু ঘটেনি কিন্তু লোকসমাজে তিনি মৃত। তাঁকে হত্যাই করে ফেলেছে। রাণী মঙ্গলা। এ বেঁচে থাকা না থাকার মতোই।
নির্জন একটি গুহায় মহারাজের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মহারাজের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেজন্য বনহুর তার গোরী আস্তানার অনুচরগণের প্রতি ভালোভাবে নির্দেশ দিয়েছে।
যদিও মহারাজ বাসুদেবের কোনো অসুবিধা হচ্ছিলো না এখানে, তবু তার অন্তরে সদা সর্বদা দাহ হয়ে চলেছে। তিনি অহরহ অশান্তি আর দুশ্চিন্তায় ছটফট করছেন।
বনহুর যতক্ষণ তার পাশে থাকে ততক্ষণ অনেকটা নানারকম কথাবার্তা, আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হয়। আর যখন তিনি একা থাকেন তখন একেবারে দুশ্চিন্তায় মুষড়ে পড়েন। কিন্তু কোন উপায় নেই, বনের পশুকে যেমন আঁচায় বন্দী করলে তার অবস্থা হয় তেমনি অবস্থা হয়েছে মহারাজ বাসুদেবের।
শত শত প্রজার যিনি ভাগ্যনিয়ন্তা তিনি কিনা আজ দস্যু বনহুরের গুপ্ত গুহায় অস্বাভাবিকভাবে কালযাপন করে চলেছেন।
এদিকে রাজাহারা রাজ্যে দস্যুরাণী দুর্গেশ্বরী সুযোগ পেয়ে বসলো, চরম আকার ধারণ করলো সে। প্রতিরাতে রাজ্যের এখানে সেখানে হানা দিয়ে লুটতরাজ করে চললো!
ঐশ্বর্য আর অর্থ নিয়েও দুর্গেশ্বরী ক্ষান্ত হতো না, অযথা লোকজনদের ধরে নিয়ে যেতো এবং তাদের নির্মমভাবে হত্যা করতো।
প্রজাগণ মহারাজের শোকে মুহ্যমান তদুপরি আবার দুর্গেশ্বরীর এই চরম উদ্ৰব, অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো সবাই।
কার কাছেই বা নালিশ জানাবে, কেই বা দুর্গেশ্বরী দমনে এগিয়ে আসবে।
একমাত্র স্বপন কুমার দিবারাত্র সব সময় দুর্গেশ্বরীর সন্ধানে নানা জায়গায় নানাভাবে অন্বেষণ করে ফিরছে। মঙ্গলা দেবী তাকে সৈন্য দিয়ে, অর্থ দিয়ে যথাযথভাবে সাহায্য করে চলেছেন। অবশ্য মঙ্গলা দেবীও দুর্গেশ্বরীর জন্য সদা আশঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, না জানি কখন সে তার রাজ প্রাসাদে হানা দিয়ে বসে।
আজকাল প্রায়ই মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের সঙ্গে নির্জনে বসে রাণী দুর্গেশ্বরী সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করে থাকেন। কিভাবে তাকে গ্রেপ্তার করা যায়, কিভাবে তাকে বন্দী করে রাজ্যের শান্তি ফিরে আনা যায়। শুধু তাই নয়, দস্যু বনহুরকেও গ্রেফতার করতে হবে, তা নাহলে রাজ্যের শান্তি ফিরে আসবে না।
স্বপন কুমার মঙ্গলা দেবীর কথা মতোই কাজ করে। রাণীর পরামর্শ ছাড়া তার আজকাল একেবারে চলেই না। প্রথম কেমন বোকা বোকা ছিলো এখন আগের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান হয়েছে। সে।
স্বপন কুমার আর মহাদেব একই কক্ষে ঘুমায়।
কিন্তু রাণীর ইচ্ছা নয় স্বপন কুমার মহাদেবের ঘুরে ঘুমাক। রাণী অনেক বলা সত্ত্বেও স্বপন কুমার তার কথায় রাজি হয়নি। এজন্য মঙ্গলা দেবী তার প্রতি ক্ষুণ্ণ হয়েছেন মনে মনে।
সেদিন গভীর রাতে স্বপন কুমারের ঘুম ভেঙে গেলো, দেখলো পাশের বিছানায় মহাদেব নাই। স্বপন কুমার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ছিলো–ব্যাপার কি! মহাদেব গেলো কোথায়? তাড়াতাড়ি স্লিপিং গাউন গায়ে পরে বেরুতে যাবে, এমন সময় তার পথ রোধ করে দাঁড়ালেন মহারাণী স্বয়ং।
স্বপন কুমার চমকে উঠলো–আপনি! এতো রাতে?
কোথায় যাচ্ছো? মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসলেন।
স্বপন কুমার বললো–মহাদেবকে দেখছি না তাই…….
ও, মহাদেবের খোঁজে যাচ্ছো?
হাঁ, কোথায় সে দেখতে যাচ্ছি।
মঙ্গলা দেবী মৃদু হেসে বললেন–মহাদেব আমার কক্ষে।
অবাক হয়ে বললো স্বপন কুমার-আপনার কক্ষে কেন?
আমি কোনো কাজে বাইরে যাবো বলে আমার কক্ষে আমার বিছানায় শয়ন করতে বলেছি…….।
বাইরে! বাইরে কোথায় যাবেন আপনি?
পরে বলবো, এসো আমার সঙ্গে। এসো!
স্বপন কুমার বাধ্য হয়ে মঙ্গলা দেবীর সঙ্গে গমন করতে। মঙ্গলা দেবীর সংগে দু’জন পরিচালিকা ছিলো, তারা দরজার বাইরে অপেক্ষা করছিলো। মঙ্গলা দেবী তাদের চলে যাবার জন্য ইংগিত করলো।
পরিচালিকা দু’জন চলে গেলো নিজদের বিশ্রামকক্ষের দিকে।
নির্জন এক স্থানে এসে দাঁড়ালেন মঙ্গলা দেবী, স্বপন কুমার তার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলো। সে ভাবতে পারেনি, এত রাতে রাণী মঙ্গলা দেবী তাকে এমন নির্জন আধো অন্ধকার স্থানে নিয়ে আসবেন।
মঙ্গলা দেবী সরে এলেন স্বপন কুমারের দিকে ঘনিষ্ঠ হয়ে, ডাকলেন–স্বপন।
বলুন মঙ্গলা দেবী?
আর কতদিন তুমি আমাকে এভাবে জ্বালাবে বলো?
অবাক হয়ে বললো স্বপন কুমার-আপনি কি বলছেন মঙ্গলা দেবী ঠিক বুঝতে পারছি না?
স্বপন, আমার সমস্ত মনপ্রাণ তোমার জন্য জ্বলে-পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে, তুমি কি আজও। বুঝলে না আমার মনের কথা?
মঙ্গলা দেবী, আমাকে মাফ করুন মঙ্গলা দেবী।
স্বপন তুমি কি মানুষ নও? আমার মন যে তোমার জন্য আকুল তাকি তুমি বুঝ না?
স্বপন কুমার কি করবে বা কি বলবে ভেবে পায় না। পালাবার জন্য মন তার আকুলি-বিকুলি করে উঠে।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের দক্ষিণ হাতখানা মুঠায় চেপে ধরেন–স্বপন, আমি বলেছি তুমি যা চাও তাই দেবো। সব দেব তোমাকে!
স্বপন কুমার ঘামতে শুরু করেছে।
মঙ্গলা দেবী মাথা রাখে স্বপন কুমারের প্রশস্ত বুকে।
কতক্ষণ নীরবে কাটে উভয়ের, নির্জন বাগানবাড়ির আধো অন্ধকারে শুধু দুটি প্রাণী–মঙ্গলা। দেবী আর স্বপন কুমার।
হঠাৎ এমন সময় অদূরে শোনা যায় কারো পদশব্দ, কোনো পাহারাদার বাগানবাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে বলেই মনে হলো।
রাণী মঙ্গলা দেবী বললেন–স্বপন, তুমি ঘরে ফিরে যাও, আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে।
স্বপন কুমার কোনো জবাব দেবার পূর্বেই মঙ্গলা দেবী অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে যায়।
স্বপন কুমার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
এগিয়ে আসে পাহারাদার, লণ্ঠন উঁচু করে ধরে বলে-কে ওখানে?
স্বপন কুমারের সংজ্ঞা যেন ফিরে আসে পাহারাদারের কণ্ঠস্বরে, বলে সে–আমি স্বপন কুমার।
পাহারাদার সসম্মানে মাথা নত করে কুর্ণিশ জানায় তারপর বলে–কুমার বাবু, আপনি!
হা মহেশ, আমি।
রাজপ্রাসাদের সবাই জানে, স্বপন কুমার দুর্গেশ্বরী এবং দুস্য বনহুর গ্রেফতারের জন্যই রাজ প্রাসাদে আছেন এবং তিনি যখন-তখন এ প্রাসাদের সর্বত্র স্বচ্ছন্দে গমনাগমন করতে পারেন।
পাহারাদার চলে গেলো আপন কাজে।
স্বপন কুমার অগ্রসর হলো তার শয়নকক্ষের দিকে।
পাহারাদার এসে পড়ায় মঙ্গলা দেবী আড়ালে আত্নগোপন করেছিলো। পাহারাদার ও স্বপন কুমার চলে গেলে রাণী মঙ্গলা দেবী বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। সন্তর্পণে এগিয়ে চললেন রাণীমহলের দিকে।
কক্ষে প্রবেশ করে দরজা ভেজিয়ে দিলো রাণী মঙ্গলা দেবী। টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কৌটা বের করলেন। তারপর টেবিলে ঢাকা একটি পানির গেলাস তুলে নিয়ে কৌটা থেকে কিছুটা গুড়ো পাউডার মিশালেন।
পানির গেলাসটা পুনরায় ঢাকা দিয়ে এগিয়ে গেলো মঙ্গলা দেবী বিছানার দিকে।
খাটের উপর নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে রাজপুত্র মহাদেব।
মঙ্গলা দেবী ডাকলেন-বাছা, আমি এসেছি এবার উঠো। মহাদেব, মহাদেব বাছা।
উঠো……..।
মহাদেবের নিদ্রা ভেঙে গেলো, ধড়ফড় করে উঠে বসলো মহাদেব–মা, তুমি এসেছো?
মাতৃহীন মহাদেব মঙ্গলা দেবীকে মায়ের মতই শ্রদ্ধা করতো, তেমনি করতে বিশ্বাস। আজ গভীর রাতে হঠাৎ মা যখন তাকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন তখন সে কোনো কিছু মনে না করে মায়ের ঘরে এসে দাঁড়ালো, বলেছিলো–মা, তুমি ডেকেছো?
মঙ্গলা দেবী সজ্জিত হয়ে গায়ে চাদর ঢাকা দিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। উদ্বিগ্নভাবে পায়চারী করছিলো কক্ষমধ্যে।
মহাদেব এসে দাঁড়াতেই মঙ্গলা দেবী বললেন–বাছা, আমার কক্ষে শয়ন করো, আমি বিশেষ দরকারে বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। অল্পক্ষণ পরই ফিরে আসবো।
মহাদেব বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছিলো, বলেছিলো–আচ্ছা মা, তুমি যাও, আমি তোমার খাটে শয়ন করছি।
এক্ষণে মঙ্গলা দেবীকে ফিরে আসতে দেখে মহাদেব শয্যা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়ালো। ঘুমের ঘোরে চোখ দুটো তার ঢুলুঢুলু করছে।
মহাদেব উঠে দাঁড়াতেই মঙ্গলা দেবী বললেন–বৎস, নিদ্রা ভংগের পর ঠাণ্ডা জল পান করতে হয়। মহাদেব, তুমি জল পান করে নিজ কক্ষে শয়ন করতে যাও।
মঙ্গলা দেবী টেবিল থেকে পানির গেলাসটা নিয়ে বাড়িয়ে ধরে মহাদেবের সম্মুখে।
মহাদেব কোনোরকম সঙ্কোচ না করে পানির গেলাস হাতে নিয়ে যেমন মুখে ধরতে যায় অমনি তার গেলাসটা কিসের আঘাতে যেন ভেঙে খান খান হয়ে যায়।
ভাঙ্গা গেলাসটা ছড়িয়ে পড়ে মেঝেতে। পানিতে ভিজে যায় মহাদেবের জামাকাপড়।
মঙ্গলা দেবী চমকে উঠেন সঙ্গে সঙ্গে।
মহাদেবও বিস্মিত হতবাক, মুহর্তে ঘুমাচ্ছন্ন ভাবটা ছুটে যায় তার চোখ থেকে।
মঙ্গলা দেবী এবং মহাদেব এক সঙ্গে ফিরে তাকায় পিছনে, ভীষণভাবে আঁতকে উঠে উভয়ে।
দক্ষিণ হস্তে রিভলভার জমকালো এক মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তাদের পাশে।
মঙ্গলা দেবী চিনতে পারেন কারণ মহারাজ বাসুদেব এবং তিনি যখন একদিন কক্ষমধ্যে রাণী দুর্গেশ্বরীর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছিলেন, তখন এই জমকালো মূর্তির আবির্ভাব ঘটেছিলো–সেই হলো সাক্ষাৎ দস্যু বনহুর। মঙ্গলা দেবী অস্ফুটধ্বনি করে উঠলো–দস্যু বনহুর!
হাঁ মহারাণী, দস্যু বনহুর।
মহাদেব দস্যু বনহুরের নাম শোনামাত্র থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে সে জমকালো মূর্তিটার দিকে। ভীত দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছে সে জমকালো মূর্তিটার দিকে। হঠাৎ ভয়াতুর কণ্ঠে মহাদেব চিৎকার করতে যায়–পাহারাদার……পাহারাদার……
সঙ্গে সঙ্গে বনহুর মহাদেবের বুকে রিভলভার চেপে ধরে বলে–খবরদার, চেঁচাবে না।
মঙ্গলা দেবী পালাতে যাচ্ছিলেন, তার উদ্দেশ্য কোনক্রমে কক্ষ থেকে বেরুতে পারলে দস্যু বনহুরকে বন্দী করা তাঁর পক্ষে কঠিন হবে না।
কিন্তু মঙ্গলা দেবী দরজার দিকে পা বাড়াতেই দস্যু বনহুর তার পথরোধ করে দাঁড়ালো, তারপর মহাদেবকে লক্ষ্য করে বললো–এসো মহাদেব তোমার শয়নকক্ষে চলল।
মহাদেব ও দস্যু বনহুর কক্ষ থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বনহুর বাইরে থেকে শিকল বন্ধ করে দিলো, মঙ্গলা দেবী যেন কক্ষ থেকে বের হতে না পারে।
দস্যু বনহুরের সঙ্গে এগিয়ে চলেছে মহাদেব। একটি টু শব্দ তার মুখ দিয়ে বের হলো না।
চলতে চলতে বললো দস্যু বনহুর-মহাদেব, জানো এ মুহূর্তে তোমার মৃত্যু হতো?
থমকে দাঁড়ালো মহাদেব, কিন্তু কোনো কথা সে বলতে পারলো না।
বনহুর বললো–যে জল তুমি পান করতে যাচ্ছিলে তাতে বিষ মিশানো ছিল।
মহাদেব অস্ফুট শব্দ করে উঠলো–বিষ!
হাঁ, তোমার মা তোমাকে হত্যা করার জন্য আগ্রহশীল। কাজেই তুমি সব সময় সাবধানে থাকবে। যাও, ঘরে গিয়ে শয়ন করোগে, যাও।
কথাটা বলে দস্যু বনহুর পিছন দিকে অন্ধকারে চলে যায়। মহাদেব বিস্মিত, হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বনহুরের চলে যাওয়া পথের দিকে।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে পায় মহাদেব, ভাবে একি! সে এখানে এমন করে দাঁড়িয়ে আছে কেন? তাড়াতাড়ি নিজের শয়নকক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
কক্ষে প্রবেশ করে তাকায় মহাদেব স্বপন কুমারের শয্যার দিকে। স্বপন কুমার তখন ঘুমাচ্ছে।
মহাদেব শয্যায় শয়ন করে বটে কিন্তু ঘুম তার চোখে আর আসে না। আজ রাত তার। জীবনের এক চরম রাত। বারবার মনে পড়ছে সেই অদ্ভুত লোকটার কথা–দস্যু বনহুর এবং তার কথাগুলো।
ওদিকে স্বপন কুমার কিন্তু ঘুমাতে পারেনি, তখনও তার মনেও আলোড়ন জাগাচ্ছিলো আজ রাণী মঙ্গলা দেবীর আচরণ। তার ব্যবহারে আজ সে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো, মহারাণী যখন তার বুকে মাথা রেখে বলেছিলো, স্বপন, তুমি ছাড়া আমি আর কিছু বুঝি না। তুমি আমার যথাসর্বস্ব……যতই কথাগুলো ভাবছে স্বপন কুমার, কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করছে।
ওদিকে মহাদেব ভাবছে দস্যু বনহুরের কথা।
আসলে কেউ, ওরা ঘুমাতে পারেনি। মহাদেব একসময় ডাকে–স্বপন দা! স্বপন দা ঘুমাচ্ছো?
স্বপন কুমার পাশ ফিরে চোখ মেলে–তুমি ঘুমাওনি মহাদেব?
না ঘুমাইনি। এসো স্বপন দা আমরা এক বিছানায় শয়ন করি।
কেন?
আমার ভয় পাচ্ছে স্বপন দা।
ভয়! ভয় কিসের মহাদেব?
এসো বলছি। তোমার কথা শুনে যদি আমার ভয় পায়–ভূতের কথা বলবে না তো?
না না, ভূতের কথা নয়।
তবে কিসের মথা মহাদেব?
আমার বিছানায় এসো বলছি।
স্বপন কুমার শয্যা ত্যাগ করে মহাদেবের শয্যায় চলে আসে, বসে সে মহাদেবের পাশে।
মহাদেব তখন উঠে বসলো, তারপর চারদিকে তাকিয়ে বললো–স্বপন দা তুমি দরজা জানালাগুলো খুব ভালো করে আটকে এসো। আমি তোমাকে একটা বিস্ময়কর কথা বলবো।
আগ্রহভরা গলায় বললো স্বপন কুমার–এখন কি কথা বলবে যা এতো বিস্ময়কর?
আগে দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করে এসো। বললো মহাদেব।
স্বপন কুমার মহাদেবের কথামতো দরজা জানালাগুলো ভালোভাবে বন্ধ করে ফিরে এলো– বলো?
মহাদেব ফিস্ ফিস্ করে বললো–দস্যু বনহুর এসেছিলো।
মুহূর্তে স্বপন কুমারের মুখে একটা ভীত ভাব ছড়িয়ে ছিলো, ঢোক গিলে বললো–দস্যু বনহুর এসেছিলো রাজপ্রাসাদেবলো কি?
হাঁ, শুধু আসেই নি সে আমার সঙ্গে কথাও বলেছে। আমাকে পৌঁছে দিয়ে গেলো আমার কক্ষের দরজায়।
সত্যি বলছো মহাদেব?
সম্পূর্ণ সত্যি স্বপন দা! সে কি বিকট ভয়ঙ্কর চেহারা!
বলো কি?
যদি তাকে দেখতে একবার?
তাহলে দস্যু বনহুরের সাধ্য ছিলো আমার হাত থেকে পালায়। মহাদেব, তুমি আমাকে না ডেকে ভুল করেছে। এবার যদি কোনোদিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে আমাকে তখনই ডাকবে।
মহাদেব হাসলো–তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি সত্যি মস্ত বীর পুরুষ কিন্তু তোমার মুখে যে ভয়ের ছাপ বিদ্যমান….
বাজে কথা বলে আমাকে অপমান করো না মহাদেব। আমি বলছি দস্যু বনহুর আর রাণী দুর্গেশ্বরীকে আমি গ্রেফতার করবোই করবো।
জানো দস্যু বনহুর কেমন?
জানি, তোমার আমার মতই একজন মানুষ।
মানুষ তো বটেই কিন্তু সে এক অদ্ভুত মানুষ। তার চেহারা বীর সৈনিকের মত; দেহে। জমকালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি, পায়ে বুট, হাতে উদ্যত রিভলভার…..
রিভলভার ছিলো তার হাতে?
হাঁ, শুধু রিভলভার নয় গুলিভরা রিভলভারসামান্য একটা টু শব্দ করলেই মৃত্যু। স্বপন দা, জানো দস্যু বনহুর যেমন ভয়ঙ্কর তেমনি কোমল। এমন লোক আর হয় না, যেন দেব পুরুষ……
বলো কি মহাদেব, তুমি যে আমাকে একেবারে দস্যু বনহুরের গুণমুগ্ধ করে তুলছে। কিন্তু তুমি তার যতই প্রশংসা করো আমি তোকে রেহাই দেব না। পাকড়াও করে সমুচিত শাস্তি দেবোই। দেব….
না না, সে আমার জীবনরক্ষক। বিনীত কণ্ঠে বললো মহাদেব।
অবাক কণ্ঠে বললো স্বপন কুমার দস্যু বনহুর তোমার জীবনরক্ষক?
হাঁ স্বপন দা।
সত্যি বলছো?
সত্যি বলছি। মহাদেব গলার স্বর খাটো করে নিয়ে বললো–জানো আমার মা আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলো!
বিস্ময় ভরা অস্ফুট কণ্ঠে বললো স্বপন কুমার–এ তুমি কি বলছো মহাদেব!
শোন স্বপন দা সব সব বলছি তোমাকে।
বলো দেখি কি ব্যাপার?
মহাদেব তাকে সব কথা বলতে শুরু করে মায়ের ঘরে যাওয়ার পর থেকে সমস্ত ঘটনা, বলে যায় সে স্বপন কুমারের কাছে। অবাক কণ্ঠে বলে–মা আমাকে ঠাণ্ডা জল পান করতে দিলো, আমি বিনা দ্বিধায় জলটা পান করতে গেলাস, ঠিক সেই মুহূর্তে কোথা থেকে একটা পাথরের ছোট্ট টুরা এসে আমার হাতের গেলাসের গায়ে লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে গেলাসটা আমার হাতের মধ্যে ভেঙে গেলো টুকরা টুকরা হয়ে। জলগুলো গড়িয়ে পড়লো আমার জামাকাপড়ে।
মহাদেবের কথা শুনে স্বপন কুমারের চোখেমুখে এক অদ্ভুত বিস্ময়কর ভাব ফুটে উঠলো বললো সে–তারপর কি হলো?
মহাদেব বলে চলে–মা আর আমি এক সঙ্গে ফিরে তাকাই–দেখতে পাই, একটা জমকালো পোশাকপরা লোক দক্ষিণ হস্তে রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের পিছনে। মা দস্যু বনহুরকে চেনেন, কাজেই মা বলেন–দস্যু বনহুর, তুমি! আমি তো তাকে দেখিনি কোনোদিন, হতবুদ্ধি হয়ে গেলাস একেবারে! দস্যু বনহুর আমাকে লক্ষ্য করে বললো–এসো মহাদেব আমার সঙ্গে এসো। পরের ঘটনাগুলো সব এক এক করে ব্যক্ত করলো মহাদেব স্বপন কুমারের নিকটে। তারপর বললো সে–স্বপন দা দস্যু বনহুর রক্ষা না করলে আজ আমার মৃত্যু নিশ্চিত ছিলো।
তাতো বুঝলাম, কিন্তু……।
না, কোনো কিন্তু নয়, স্বপন দা তুমি দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করতে পারবে না। আমি তাকে গ্রেফতার করতে দেবোনা তোমাকে।
হাসে স্বপন কুমার–বেশ, তোমার কথাই রইলো।
আগামীকাল রাজকুমার মহাদেবের অভিষেক। মহারাজের মৃত্যুর পর রাণী মঙ্গলা দেবী স্বয়ং রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছিলো কিন্তু প্রজাগণ তাতে আপত্তি তুলেছিলো। কারণ রাজকুমার শিশু বা নাবালক নয়। মহাদেব এখন পূর্ণবয়স্ক, কাজেই প্রজাগণ রাজপুত্রকেই তাদের রাজা হিসাবে পেতে চায়।
মঙ্গলা দেবীর ইচ্ছা সমূলে বিনষ্ট হলো, প্রজাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি রাজ সিংহাসনে উপবেশন করতে রাজি নন।
প্রজাদের মনস্কামনা পূর্ণ আশাতেই মঙ্গলা দেবী রাজকুমার মহাদেবকে রাজসিংহাসনে বসাতে সম্মত হয়েছেন এবং তারই অভিষেক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে কাল।
রাজ্যময় ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে, আগামীকাল মহাদেবের অভিষেক।
রাজ্যের প্রতিটি প্রজার মনে নতুন এক আনন্দ-উৎসব বইতে শুরু করেছে। রাজার মৃত্যু ঘটেছে, যাক এবার তারা রাজপুত্র মহাদেবকে রাজা হিসাবে পাবে। মহাদেব সিংহাসনে উপবেশন করার পর তিনি রাজ্যের মঙ্গলদণ্ড হাতে নেবেন এবং প্রজাদের মঙ্গল কামনা করবেন। তখন রাণী দুর্গেশ্বরী দমনেও মনোযাগী হবেন।
প্রজাদের মনে অফুরন্ত আনন্দ, রাজার মৃত্যুশোক তারা ভুলে যায় যেন সবাই বাড়িঘর আলোকমালায় সজ্জিত করে। পথঘাট সব সাজানো হয়, মন্দিরে মন্দিরে রাজপুত্রের মঙ্গল কামনায় পূজা অর্চনা শুরু হয়।
রাজপ্রাসাদ আলোকমালায় ঝলমল করছে। দাসদাসী থেকে রাজ-পরিষদগণ সবাই নতুন সাজে সজ্জিত হয়েছে।
রাণী মঙ্গলা দেবীর মনের অবস্থা ভাল নয়, তবু তিনি নিজকে সামলে নিয়ে পুত্র মহাদেবের অভিষেকের আয়োজন করে চলেছেন।
কিন্তু সেদিন গভীর রাতে মহাদেব যখন কক্ষে ঘুমাচ্ছিলো তখন একদল দস্যু তার কক্ষে প্রবেশ করে এবং মহাদেব ও স্বপন কুমারকে মজবুত করে বেঁধে ফেলে।
ঘুম ভেঙে যায় স্বপন কুমার এবং মহাদেবের কিন্তু তখন নড়ার কোন উপায় নেই। ঘুমের ঘোরেই তাদের হাত-পা মুখ শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে।
স্বপন কুমার বুঝতে পারলো–তার হাত-পা শক্ত করে খাটের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে। মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা, শুধু চোখ দুটো খোলা রয়েছে তাই সে দেখতে পাচ্ছে সব। স্বপন কুমার তাকালো মহাদেবের খাটের দিকে, বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখলো, কয়েকজন লোক মহাদেবকে হাত-পা-মুখ বেঁধে তুলে নিল কাঁধে তারপর বেরিয়ে গেলো। আশ্চর্য হলো স্বপন কুমার, মহাদেবকেই শুধু নিয়ে গেলো আর তাকে ছেড়ে গেলো কেন? বড় আফসোস হচ্ছে, এমন ঘুম। তার কি করে পেয়েছিল? একটু যদি টের পেত তাহলে ওদের পাকড়াও না করে ছাড়তো না সে। কিছুতেই। স্বপন কুমার ভাবতে থাকে–এরা কারা? দস্যু বনহুরের অনুচর না দুর্গেশ্বরীর লোক?
কিন্তু কে তাকে বলে দেবে, সবাই তখন অদৃশ্য হয়েছে। কক্ষের দরজা বন্ধ, তাছাড়া হাত মা-মুখ সব বাধা রয়েছে মজবুত করে। চিৎকার করে কাউকে ডাকবে তারও উপায় নেই।
মনটা কিন্তু স্বপন কুমারের ছটফট করছে, না জানি মহাদেবকে ওরা কোথায় নিয়ে গেলো? কি করবে ওকে নিয়ে গিয়ে।
নানা কথা ভাবতে ভাবতে একসময় রাত ভোর হয়ে এলো। কোনো একজন মহাদেব ও স্বপন কুমারকে জাগাতে এসে স্বম্ভিত হতবাক হলো। মহাদেবের খাট শূন্য, স্বপন কুমারকে বন্ধন অবস্থায় পাওয়া গেলো।
খবর শুনে রাণী মঙ্গলা দেবী ছুটে এলেন, নিজ হস্তে খুলে দিলো স্বপন কুমারের বন্ধন। মহাদেবের জন্য মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলো। আজ অভিষেক আর কিনা মহাদেব উধাও!
মন্ত্রী এবং সেনাপতির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো একি বিভ্রাট ঘটলো!
কথাটা অল্পক্ষণের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়লো রাজ্যময়। প্রজাগণ হাহাকার করে উঠলো, কারণ বেশি দিনের কথা নয় মহারাজের অকস্মাৎ মৃত্যু ঘটেছে, তারপর এই অদ্ভুত কাণ্ড! রাজপুত্রকে কে বা কারা হরণ করে নিয়ে গেছে।
রাজ অভিষেক বন্ধ করা যায় না, মঙ্গলা দেবীই রাজ-সিংহাসনে উপবেশন করবেন।
কিন্তু রাজ-পরিষদগণ এতে খুশি হলেন না, তারা বলেন আমরা রাজপুত্র মহাদেবের জন্য। কিছুদিন অপেক্ষা করতে চাই। রাজ্যময় ঘোষণা করে দেওয়া হলো যে রাজপুত্র মহাদেবের সন্ধান এনে দিতে পারবে তাকে বহু অর্থ পুরস্কার দেওয়া হবে।
রাজ-পরিষদগণ মহাদেবের সন্ধানে যে যেদিকে পারে ছুটলো। পুলিশ মহলেও সাড়া পড়ে গেলো, তারাও অনুসন্ধান করে ফিরতে লাগলো।
মহাদেবের অন্তর্ধানে রাজ্যময় একটা অশান্তির ছায়াপাত ঘটলো। প্রজাদের মনে আতঙ্ক আর উদ্বিগ্নতা, তাদের রাজ পুত্র হঠাৎ কোথায় উধাও হলো! কে তাকে চুরি করে নিয়ে গেলো। অল্পদিন আগেই তারা দয়াবান মহারাজকে হারিয়ে শোকসাগরে ভাসছে, তারপর এই অঘটন অশুভ কাণ্ড! কাল হবে অভিষেক আর আজ রাজপুত্র নিরুদ্দেশ।
মঙ্গলা দেবীও সকলের সম্মুখে মহাদেবের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়লেন, কিন্তু ভিতরে ভিতরে তাঁরই চক্রান্তে রাজকুমার মহাদেবকে অভিষেক রাত্রে রাজপ্রাসাদ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
প্রাসাদের অনেকেই স্বপন কুমারকে সন্দেহ করে বসলো। মহাদেবের নিরুদ্দেশ ব্যাপারের সঙ্গে নিশ্চয়ই জড়িত আছে সে। রাজ-পরিষদগণও এই মন্তব্য প্রকাশ করলেন।
সেনাপতি মঙ্গলা দেবীর নিকটে এসে জানালেন–মহারাণী স্বপন কুমারকে প্রাসাদের অনেকেই সন্দেহ করছেন। তারা বলছেন, মহাদেবের অন্তর্ধান ব্যাপারের সঙ্গে তিনি জড়িত আছেন।
সেনাপতির কথায় মঙ্গলা দেবী ক্রুদ্ধভাবে বলে উঠলেন–এটা তাদের অহেতুক সন্দেহ সেনাপতি। স্বপন কুমার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
রাণীর কথায় কোন প্রতিবাদ করার সাহস ছিলো না সেনাপতির, তিনি নত মস্তকে প্রস্থান। করলেন রাণীমহল থেকে, কিন্তু মনে মনে ভয়ানক ক্ষুদ্ধ হলেন।
শুধু সেনাপতিই নয়, রাণীজীর কথায় রাজপরিষদ সবাই ক্ষুব্ধ হলেন। স্বপন কুমার গোরী। রাজ্যের কেউ নয়, এখানে কোন অধিকারই নেই তার। কেন সে এখানে থাকে? দস্যু বনহুর এবং দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার করা তার ছলনা ছাড়া কিছু নয়।
আজকাল স্বপন কুমারের সঙ্গে রাণী মঙ্গলা দেবীর ঘনিষ্ঠতাও যেন বেড়ে গেছে চরম আকারে। সর্বক্ষণ মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারকে পাশে পাশে রাখেন। কোনো গুরুত্বপূর্ণ আলাপ আলোচনা চলাকালেও স্বপন কুমার সে স্থানে উপস্থিত থাকে। এতে সেনাপতি বা মন্ত্রীবর কোন আপত্তি করতে পারে না।
মাঝে মাঝে মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারসহ বাগানবাড়িতে ভ্রমণ করেন এবং হাসিগল্প করে। থাকেন। এসব ব্যাপার নিয়ে রাজপ্রাসাদে নানারকম গুঞ্জন শুরু হয়েছে কিন্তু প্রকাশ্যে কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
আগের চেয়ে স্বপন কুমারকে এখন কিছুটা বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। তার কথাবার্তায় যদিও ছেলেমি ভাব যথেষ্ট রয়েছে তবু রাণী তাকে অত্যন্ত সমীহ করে। রাণী মঙ্গলা দেবীর সহানুভূতিই স্বপন কুমারকে সত্যিকারের সাহসী করে গড়ে তোলে।
মঙ্গলা দেবীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে প্রথমে বড় ঘাবড়ে যাচ্ছিলো স্বপন কুমার। আজকাল অনেকটা সচ্ছ স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কিন্তু একেবারে দুঃসাহসী হতে পারেনি।
মঙ্গলা দেবীর সঙ্গে কথাবার্তা, হাসিগল্প করতে তার বাঁধতো না কিন্তু যখন মঙ্গলা দেবী তার বুকে মাথা রাখতো বা তার হাতখানা মুঠায় চেপে ধরে আবেগভরা কণ্ঠে বলতো–স্বপন তুমি। আমার স্বপ্নরাজ্যের রাজা, তুমি আমার কামনার জন, তোমাকে না পেলে আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে…..তখন কেমন যেন ঘেমে উঠতো স্বপন কুমার ভিতরে ভিতরে। আবার সরে যেতেও পারতো না। রাণী মঙ্গলা দেবীর মোহ তাকে মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিলো।
মঙ্গলা দেবী যখন স্বপন কুমারকে নিয়ে আত্নহারা, রাজ্যময় যখন মহারাজের অভাব অশান্তির ঘনছায়া। রাজপুত্র মহাদেবের হরণ ব্যাপার নিয়ে যখন প্রজাদের মনে গভীর আশঙ্কা, তখন। দস্যুরাণী দুর্গেশ্বরী রাজ্যের নিরীহ প্রজাদের বাড়িতে হানা দিয়ে তাদের যথাসর্বস্ব লুটে নিয়ে যেতে লাগলো, এবং যাকে পেলো হত্যা করে চললো। ভীষণ এক তাজ্জবলীলা শুরু করে নিলো সে।
পুলিশ মহল নানা চেষ্টা করেও দুর্গেশ্বরী গ্রেফতারে সক্ষম হলো না। পথে-ঘাটে-মাঠে সদা ভয় আর আশঙ্কা নিয়ে লোকজন চলাফেরা করতে লাগলো।
সন্ধ্যার পর নগর মধ্যে জনপ্রাণী চলাফেরা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হলো। বিশেষ জরুরি কাজ না থাকলে কেউ বাড়ির বাইরে যেতো না। কিন্তু বাইরে না গিয়েই বা কি, গভীর রাতে নগরবাসী যখন আরামে একটু ঘুমিয়ে পড়তো তখন আচমকা দুর্গেশ্বরী দলবল নিয়ে হানা দিতো লুটে নিতে সমস্ত ধন-সম্পদ এবং বাড়ির দু’চারজনকেও ধরে নিয়ে যেতো, পরে পথের উপর কিংবা ময়দানের মধ্যে পাওয়া যেতো সেইসব হরণকারী জনগণের মৃতদেহ।
সমস্ত রাজ্যটা যখন চরম পরিস্থিতির সম্মুখীন তখন মঙ্গলা দেবী নিজে সিংহাসনে উপবেশন করবেন এবং রাজদণ্ড হাতে নেবেন বলে ঘোষণা করলেন। প্রজাদের কোন আপত্তিই তিনি কানে নেবেন না। রাজ-পারিষদগণকে ডেকে আয়োজন করতে বললেন।
আগামী পূর্ণিমা রাতে তার অভিষেক হবে।
মহারাজের মৃত্যু ঘটেছে, মহাদেব অন্তর্ধান হয়েছে বলে রাজসিংহাসন শূন্য থাকতে পারে না। রাণী মঙ্গলা দেবী রাজ্যের মঙ্গল কামনাতেই সিংহাসনে উপবেশন করবেন।
রাজ-পারিষদগণ ভিতরে ভিতরে অনিচ্ছা পোষণ করলেও প্রকাশ্যে কেউ কোন মত প্রকাশ করলেন না। রাণী মঙ্গলা দেবীর অভিষেক আয়োজনে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
মঙ্গলা দেবীর মনে অফুরন্ত আনন্দ উৎস। এবার সে গোরী সিংহাসনের একেশ্বরী রূপে প্রতিষ্ঠা হবেন। হরিনাথপুরের রাজ পুত্র স্বপন কুমার থাকবে তাঁর পাশে। স্বপন কুমারের সৌন্দর্য তাকে একেবারে অভিভূত করে ফেলেছিলো। স্বপন কুমার এখন মঙ্গলা দেবীর ধ্যান-জ্ঞান-স্বপ্ন।
মহারাণী মঙ্গলা দেবীর আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন সেনাপতি এবং মন্ত্রীবর। তাঁরা স্বপন কুমারকে রাজ্য থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
একদিন রাজদরবারে মঙ্গলা দেবী সিংহাসনের পাশের আসনে উপবেশন করে দরবার পরিচালনা করছেন। অভিষেক না হওয়া অবধি সিংহাসনে উপবেশন নিষিদ্ধ তাই তিনি এইভাবে দরবার চালনা করে থাকেন।
দরবার-কক্ষে রাজ-পারিষদ সবাই উপস্থিত রয়েছেন। মহারাজ বাসুদেবের ভক্ত প্রজাদের মধ্যেও আজ অনেকে রাজসভায় আগমন করেছে।
রাণীর পাশের আসনেই উপবিষ্ট স্বপন কুমার।
এতোগুলো লোকের সামনে স্বপন কুমার মহারাণীর পাশে নিজকে পেয়ে গৌরবান্বিত না হয়ে অত্যন্ত বিব্রত বোধ করছিলো।
মাঝে মাঝে রাণী মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের মুখে তাকিয়ে মৃদু মৃদু হাসছিলো। মুখোভাবে প্রকাশ পাচ্ছিলো স্বপন কুমারের প্রতি তার গভীর অনুরাগ।
হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন সেনাপতি, মহারাণীকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন–রাণীজী, একটা কথা আজ আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি।
বলুন সেনাপতি? বললেন মঙ্গলা দেবী।
সেনাপতির সঙ্গে রাজ-পারিষদগণের একবার দৃষ্টি বিনিময় হলো। সেনাপতি বললেন– রাণীজী, প্রজাগণ আজ এক চরম অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। মহারাজের আকস্মিক মৃত্যু, রাজপুত্র মহাদেবের অন্তর্ধানে রাজ্যময় এক শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
তা জানি সেনাপতি। রাজ্যের মঙ্গল কামনাতেই আমি রাজ্য পরিচালনার ভার গ্রহণ করতে মনস্থ করেছি–বললেন মহারাণী মঙ্গলা দেবী!
সেনাপতি পুনরায় বললেন–প্রজাগণ দুর্গেশ্বরীর নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে। প্রতিরাতে সে রাজ্যমধ্যে হানা দিয়ে লুটতরাজ এবং খুন-জখম করে যায়। অনেক প্রজাদের সে চুরি করে নিয়ে যায়, আর হত্যা করে রাজপথে কিংবা মাঠে-ঘাটে ফেলে রেখে যায়। সেকি ভীষণ মর্মান্তিক দৃশ্য!
হাঁ, দুর্গেশ্বরীর অত্যাচার দিন দিন চরম আকার ধারণ করেছে, তারপর আরও এক ভয়ঙ্কর দস্যুর আবির্ভাব ঘটেছে, সে ইলো দস্যু বনহুর!
এবার মন্ত্রীবর উঠে দাঁড়ালেন, তিনি বললেন–গোরী রাজ্যে দস্যু বনহুরের আবির্ভাব যতখানি আতঙ্ক সৃষ্টি না করেছে ততখানি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে দুর্গেশ্বরী..
আচমকা উঠে দাঁড়ালো স্বপন কুমার–আমি কাউকেই ক্ষমা করবো না মন্ত্রীবর দস্যু বনহুর এবং রাণী দুর্গেশ্বরী দু’জনাকেই আমি পাকড়াও করে আপনাদের সম্মুখে হাজির করবো। তারপর হবে তাদের বিচার, বিচারের পর মৃত্যুদণ্ড…….
স্বপন কুমারের কথা শুনে রাজ-পারিষদগণ ব্যঙ্গপূর্ণ হাসি হাসলেন। কারণ তাঁরা জানে, স্বপন কুমার মুখে যত সাহসপূর্ণ উক্তিই উচ্চারণ করুন, আসলে তার ক্ষমতা এতোটুকু নেই।
দস্যু বনহুরকে গ্রেফতার করা তো দূরের কথা, দুর্গেশ্বরী নারী হয়েই স্বপন কুমারকে কতবার নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছে।
কতবার তাকে তার শয়নকক্ষে খাটের সঙ্গে হাত-পা-মুখ বেঁধে রেখে গেছে। রাণী স্বয়ং তাকে মুক্ত করে দিয়েছেন কতদিন। সেই স্বপন কুমার কিনা দুর্গেশ্বরীকে গ্রেফতার করবে শুধু দুর্গেশ্বরী নয়, দস্যু বনহুরকেও বন্দী করে রাজদরবারে হাজির করবেন, এ যেন এক হাস্যকর উক্তি। রাজ-পারিষদগণ মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
সেনাপতি বললেন–স্বপন কুমার, আপনার বাহাদুরী আমরা উপলব্ধি করেছি। আপনি বসুন।
সেনাপতির কথায় স্বপন কুমারের সুন্দর দীপ্ত মুখমণ্ডল কালো হয়ে উঠলো, অন্তরে অন্তরে অপমান বোধ করলো সে। আসন গ্রহণ করলে লজ্জিতভাবে।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের মুখোভাব লক্ষ্য করে ব্যথিত হলেন, তিনি চান না স্বপন কুমার কোন কারণে বিব্রত বা অপমানিত হয়।
মহারাণী আর কথা না বাড়িয়ে সেদিনের মত দরবার ভঙ্গের আদেশ দিলো। নিজেও আসন ত্যাগ করে অন্তপুরে চলে গেলেন।
স্বপন কুমারও দরবার ত্যাগ করে রাণীকে অনুসরণ করলো!
রাজ-পারিষদগণ এ-ওর মুখে তাকালেন।
মঙ্গলা দেবী আপনি আমাকে ডেকেছেন? মহারাণী মঙ্গলা দেবীর কক্ষে প্রবেশ করে বললো স্বপন কুমার।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারকে দেখামাত্র উঠে তার হাত ধরে নিজের পাশে খাটের উপর বসালেন, তারপর বললেন–হ্যাঁ, তোমাকে ডেকেছি স্বপন!
স্বপন কুমার সঙ্গোচিতভাবে বসে পড়লো বটে কিন্তু তার চোখেমুখে ফুটে উঠলো একটা দ্বিধাভরা ভাব। নিজকে রাণীর কক্ষে এমন নির্জন যেন বড় বেখাপ্পা লাগছিলো তার কাছে।
মঙ্গলা দেবী বললেন–কেন ডেকেছি, জানো?
না তো!
শোন স্বপন?
বলুন মঙ্গলা দেবী? প্রশ্নভরা দৃষ্টি তুলে তাকালো স্বপন কুমার মঙ্গলা দেবীর মুখে।
মঙ্গলা দেবী স্বপন কুমারের পাশে এত ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছেন যাতে উভয়ের শরীরে উভয়ের ছোঁয়া লাগে। স্বপন কুমারের দক্ষিণ হস্তখানা মঙ্গলা দেবীর কোলের উপর রয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও স্বপন কুমার হাতখানা সরিয়ে নিতে পারছিলো না সহজে।
মঙ্গলা দেবীর হাতখানাও তার হাতের উপর ছিলো তখন।
মঙ্গলা দেবী বললেন–স্বপন, আমি রাণী, আমার হৃদয় রাজ্যের রাজাই শুধু তুমি নও তোমাকে আমি গোরী রাজ্যের অধীশ্বর করতে চাই! বলো রাজি আছো?
বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলে উঠে স্বপন কুমার–গোরী রাজ্যের অধীশ্বর হবো আমি?
হ, কেন তুমি কি উপযুক্ত নও?
মঙ্গলা দেবী……মানে আমি, আমি…
চুপ করো, জানি তুমি রাজ্য চালনায় অপটু। তবু, তবু আমি তোমাকে গোরী রাজ্যের রাজা করবো।
আমার বাবা আছেন, মা আছেন, তারা যদি অমত করে বসেন?
সে ভার আমার। আমি তাদের রাজি করাবো স্বপন, বলো তুমি রাজি আছে কিনা?
আমি… বিব্রত মুখে তাকায় স্বপন কুমার মঙ্গলা দেবীর মুখের দিকে।
কেন ভয় পাচ্ছো নাকি? দস্যু বনহুরকে পাকড়াও করতে চাও? রাণী দুর্গেশ্বরীকে বন্দী করতে চাও, আর এই সাহসটুকু তোমার হবে না? স্বপন, আমাকে তুমি বাঁচাও স্বপন।
মঙ্গলা দেবী!
জানো, আমি যা চেয়েছি সব পেয়েছি। ধন-রত্ন-ঐশ্বর্য,রাজ্য, রাজ-সিংহাসন সব পেয়েছি শুধু পাইনি একটি জিনিস, স্বামীর প্রেম-ভালবাসা…
স্বপন কুমার হঠাৎ বলে বসলো–শুনেছি এবং দেখেছিও বৃদ্ধ রাজা আপনাকে যথেষ্ট ভালবাসতেন।
মিথ্যা নয় স্বপন, মহারাজা আমাকে ভালবাসতেন কিন্তু সে ভালবাসা ছিলো প্রাণহীন। যার মধ্যে ছিলো না কোন অনুভূতি। স্বপন, তোমার পৌরুষদীপ্ত কণ্ঠস্বর, তোমার বলিষ্ঠ সুঠাম চেহারা, তোমার ঐ গভীর নীল দুটি চোখ আমাকে সব দিতে পারে। ধনরত্ন-ঐশ্বর্য, রাজ্য, রাজসিংহাসন যা দিতে পারেনি তাই, দিতে পারো তুমি……
মঙ্গলা দেবী আমাকে আজ ক্ষমা করবেন, আমি চিন্তা করে সব বলবো।
না, আজ তোমাকে কথা দিতে হবে স্বপন। আমাকে স্পর্শ করে শপথ করতে হবে। বলল, আমাকে স্পর্শ করে বলো তুমি আমাকে ফেলে আর যাবে না?
শপথ করলাম, যাবো না। কিন্তু আজ আমাকে ভাবার সময় দিন।
বেশ, যাও। কিন্তু মনে রেখো, আমি তোমার..
দেবী! আনন্দসূচক শব্দ করে স্বপন কুমার।
মঙ্গলা দেবীর চোখ দুটো মুদে আসে গভীর আবেশে, অস্ফুট আবেগভরা কণ্ঠে বলেন– স্বপন, আর একবার দেবী বলে ডাকো! আর একবার ডাকো! অমৃত না সুধা তোমার কণ্ঠে? জানি না, তোমার গলার স্বর আমার এত ভালো লাগে কেন?
স্বপন কুমার ডাকে আবার–দেবী, চলি আজ?
এসো! এসো স্বপন!
স্বপন কুমার বেরিয়ে যায়।
মহারাণী শয্যায় গা এলিয়ে দেন। কতকথা, কতছবি ভাসে তার মানসপটে। স্বপন কুমার তাঁর স্বপন তার সবকিছু।
তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়েন রাণী মঙ্গলা দেবী।
আগামীকাল পূর্ণিমা।
মহারাণী মঙ্গলা দেবীর অভিষেকপর্ব অনুষ্ঠিত হবে। রাজ্যময় সাড়া পড়ে গেছে, যদিও প্রজাগণ সচ্ছ মনে রাণীকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না তবু তাদের প্রস্তুত হতে হচ্ছে। হাসিমুখে। যে প্রজা এ ব্যাপার নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে বা কোনরকম প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাকেই বন্দী করে আনা হয়েছে রাজদরবারে। বিচারে তার কারাদণ্ড নয়, দ্বীপান্তর দেওয়া হচ্ছে।
কাজেই প্রজাগণ মনোভাব গোপন রেখে অভিষেক-উৎসব পালন করে চলেছে।
সমস্ত রাজপ্রার্শাদ আলোকমালায় সজ্জিত করা হয়েছে। মণিমুক্তাখচিত সিংহাসনটা নানারকম সুন্দর ফুলে ফুলে সাজানো হয়েছে।
প্রাসাদময় আনন্দ-উৎসব বয়ে চলেছে। রাজপরিষদগণ গোপনে নানারকম আলাপ আলোচনা করলেও সাক্ষাতে তাঁরা মহারাণীর অভিষেকপর্ব সুন্দরভাবে যাতে অনুষ্ঠিত হয়, এ চেষ্টাই করে চলেছেন।
কিন্তু সকলের মনেই স্বপন কুমারকে নিয়ে একটা গভীর রহস্যজাল ছড়িয়ে পড়েছে। তারা কিছুতেই যেন তাকে রাজপ্রাসাদে মেনে নিতে চাইছেন না।
হরিনাথপুরের রাজকুমার কেন তাদের সঙ্গে থাকবে? কি অধিকার আছে তার এখানে চিরদিন থাকার? বিশেষ করে মুহাদেবের অন্তর্ধানের পর থেকে বিষদৃষ্টি নিয়ে দেখতে শুরু করেছে স্বপন কুমারকে।
স্বপন কুমার অবশ্য রাণীকে অনেকবার জানিয়েছে, এখানে থাকতে তার মন আর চাইছে না কারণ সবাই চায় তাকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু রাণী কিছুতেই স্বপন কুমারকে বিদায় দিতে রাজি নন!
কাজেই স্বপন কুমার কতকটা বাধ্যও হয়েছে এ ব্যাপারে। মহারাণী মঙ্গলার ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে পারেনি হরিনাথপুরে ফিরে যেতে।
রাণী মঙ্গলা যখন স্বপন কুমারকে নিয়ে স্বপ্নসৌধ গড়ার আয়োজনে ব্যস্ত তখন দস্যু বনহুরের আস্তানায় মহারাজা বাসুদেব দুশ্চিন্তা আর অশান্তিতে কাল কাটাচ্ছেন। তিনি পৃথিবীর বুকে জীবিত থেকেও আজ মৃত। তাঁর প্রজাগণ জানে, তাদের মহারাজ আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না। যদিও দস্যু বনহুরের আস্তানায় তার কোন অসুবিধা হচ্ছে না–দুগ্ধফেননি শয্যা, সুস্বাদু ফলমূল, সুগন্ধি পনির সবকিছুই বনহুর মহারাজের জন্য ব্যবস্থা করেছিলো। কিন্তু এত করেও মহারাজের মনের চিন্তা দূর করতে পারেনি।
সেদিন শ্রাদ্ধ-শান্তি হতে ফিরে আসার পর মহারাজা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছেন। খাওয়া-দাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন তিনি। সবসময় গভীরভাবে চিন্তা করেন।
দস্যু বনহুর মাঝে মাঝে আসে মহারাজের নিকটে, সান্ত্বনা দেয় সে তার পাশে বসে।
রাণী মঙ্গলা, দেবীর অভিষেকের সংবাদ দস্যু বনহুর জানার পরও মহারাজের নিকটে গোপন রেখেছিলো কিন্তু আজ আর সে চেপে রাখতে পারলো না। মহারাজের কক্ষে প্রবেশ করে ডাকলো বনহুর–মহারাজ!
চমকে উঠলেন মহারাজ বাসুদেব কারণ তিনি তখন অন্যমনস্ক ছিলো। দস্যু বনহুরকে দেখেই সোজা হয়ে বসলেন। তাকালেন সম্মুখে, মহারাজের দৃষ্টি ছিলো দস্যু বনহুরের ভারী বুট দু’খানার দিকে, তারপর দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হলো তার মুখে।
বনহুর পাশের আসনে বসে পড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো–মহারাজ, আজ আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
না না, আমি আর রাজ্যে যাবো না। আমাকে তুমি এ দৃশ্য দেখতে নিয়ে যেও না বনহুর।
রাজ্যে নয়……
তবে কোথায় আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?
রাণী দুর্গেশ্বরীর ওখানে।
রাণী দুর্গেশ্বরী! এ তুমি কি বলছে বনহুর?
হাঁ, আজ রাতে আমি দুর্গেশ্বরীর আস্তানায় হানা দেবো।
ঢোক গিলে বলেন মহারাজ–তা আমি তোমার সঙ্গে গিয়ে কি করবো বলো?
আমার সঙ্গে থাকবেন, দল আরও ভারী হবে।
এই বৃদ্ধ বয়সে আমাকে তুমি…..না না, আমাকে ক্ষমা করো বনহুর।
না, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতেই হবে। মহারাজ, আপনি তৈরি থাকবেন।
বনহুর একটু থামলো তারপর আবার বললো–আরও একটি ঘটনা ঘটে গেছে মহারাজ, যা আপনাকে আমি জানাইনি অথচ আপনার জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ঘটনা! কি ঘটনা ঘটেছে? আর কিই বা ঘটতে পারে? আমার জীবন থেকে সব আশা-ভরসা মুছে গেছে বনহুর, সব নিঃশেষ হয়ে গেছে। যার স্ত্রী ব্যভিচারিণী, যার স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করতে পারে সে পৃথিবীর বুকে একটা নিকৃষ্ট পশুর চেয়েও অধম। আমার জীবনে কি এমন থাকতে পারে?
মহারাজ, আপনার প্রিয় পুত্র মহাদেব নিরুদ্দেশ হয়েছে।
মহারাজ বাসুদেব বনহুরের কথাটা শোনামাত্র অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠলেন–আমার মহাদেব নিরুদ্দেশ হয়েছে? রাজ্য থেকে সে চলে গেছে?
না মহারাজ, তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে!
মহারাজ উন্মাদের মত বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরলেন–কে কে মহাদেবকে রাজ্যে থেকে সরিয়ে দিয়েছে? কোন্ নরাধম, কোন পাষণ্ড সে?
শান্ত হন মহারাজ!
না না, আমি শান্ত হতে পারবো না, আমার মহাদেবকে কেউ হত্যা করে ফেলেনি তো?
মহারাজ, আপনার মহাদেব জীবিত আছে।
সত্যি! সত্যি বলছো বনহুর?
হাঁ মহারাজ। কিন্তু তার আয়ু আজ রাত পর্যন্তই আছে। কাল ভোর হবার পূর্বে তাকে হত্যা করা হবে।
বনহুর!
মহারাজ, তাকে যেন হত্যা করা না হয় সে চেষ্টা করতে হবে।
বনহুর, বন্ধু আমার, তুমি নদী গর্ভ হতে আমাকে উদ্ধার করে আমার জীবন রক্ষা করেছে। প্রাণদান করেছো তুমি।
সবই ঐ দয়াময়ের ইচ্ছা মহারাজ।
হাঁ, তা জানি কিন্তু তুমি যে দেবতার চেয়েও বড়। অনেক বড়, মহান তুমি……
থাক, ওসব বলতে হবে না; আমি কথা দিলাম আপনার পুত্র মহাদেবকেও মৃত্যুমুখ থেকে উদ্ধার করে নেবো।
উচ্ছ্বসিতভাবে মহারাজ বাসুদেব বনহুরের হাত দু’খানা চেপে ধরলেন–বন্ধু, চিরদিন আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
বেশ, তাহলে আপনি প্রস্তুত থাকবেন, আজ রাতে আমাদের সংগে যেতে হবে আপনাকে। কথাটা বলে তখনকার মতো বেরিয়ে গেলো বনহুর।
অনেক রাত।
জ্যোছনা ভরা আকাশ।
গোরী পর্বতের চূড়ায় চূড়ায় জ্যোছনার আলো ঝলমল করছে। চারদিকে যেন শুধু আলোর বন্যা। ধূসর পৃথিবী যেন তার প্রাণ খুলে হাসছে।
দস্যু বনহুরের দল সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। গোরী পর্বতের পিছল পথ বেয়ে পিঁপড়ের সারির মতই লাগছে। নিস্তব্ধ পর্বতের কন্দরে কন্দরে প্রতিধ্বনি হচ্ছে শুধু ঘোড়ার খুরের শব্দ।
সর্বাগ্রে দস্যু বনহুর।
তার ঠিক পেছনে মহারাজ বাসুদেব অশ্বপৃষ্ঠে রয়েছেন। রহমান এবং অন্যন্য অনুচর সবাই চলেছে সশস্ত্র বেশে। শরীরে জমকালো ড্রেস, মাথায় পাগড়ি, পায়ে হাঁটু অবধি ভারী বুট, কোমরের বেল্টে গুলিভরা রিভলভার, পিঠের সঙ্গে বাঁধা রাইফেল।
প্রতিটি দস্যুর মুখের নিচ অংশ পাগড়ির শেষ ভাগ দিয়ে ঢাকা। জ্যোছনার আলোতে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিলো ওদের।
বহুক্ষণ চলার পর বনহুরের ইংগিতে অশ্বের গতিবেগ কমিয়ে নেওয়া হলো। কারণ এখন, তাদের অশ্বখুরের শব্দ যেন দূরে না গিয়ে পৌঁছে।
বনহুর জ্যোছনার আলোতে ফিরে তাকালো মহারাজ বাসুদেবের মুখে, বললো–মহারাজ, আপনার কোনো কষ্ট হচ্ছে কি?
মহারাজের দেহেও ছিলো দস্যু-ড্রেস। জমকালো পোশাক, মাথায় পাগড়ি, পায়ে ভারী বুট। পাগড়ির শেষ অংশ দিয়ে মুখের নিচের অংশ ঢাকা। মহারাজকে চেনার উপায় কোনো ছিলো না। এসব পোশাক পরে তিনি কোনো দিনই অভ্যস্ত নন কাজেই অত্যন্ত অসুবিধা বোধ করলেও বনহুরের কথায় বললেন–না, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না।
পারবেন এভাবে আরও কয়েক মাইল যেতে? পারবো?
এরপর যে পথে আমরা চলবো তা আরও দুর্গম। এক পাশে গভীর খাদ, অন্য পাশে সুউচ্চ গোরী পর্বত। যদি কোনোক্রমে অশ্বের পা একবার পিছলে যায় তাহলে হাজার হাজার ফিট নিচে পাথরের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মৃত্যু। মহারাজ, আপনি সাবধানে অশ্বচালনা করবেন।
কথাগুলো মহারাজকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর।
মহারাজ বাসুদেব অন্তরে অন্তরে শিউরে উঠলেও মুখে সাহস টেনে বললেন–আমি সাবধানে অশ্বচালনা করবো বনহুর। আমার মহাদেবকে দেখার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি মরতে চাই না।
আলখেল্লায় আচ্ছাদিত দেহে রাণী দুর্গেশ্বরী দণ্ডায়মান তার সুইচ্চ আসনের পাশে। দক্ষিণ হস্তে সূতীক্ষ্ণধার ছোরা। আলখেল্লার মধ্যে চোখ দুটো যেন তার জ্বলছে।
সম্মুখে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে গোরী রাজ্যের রাজকুমার মহাদেব। সমস্ত দেহে তার কষাঘাতের চিহ্ন। চামড়া কেটে ঘা হয়ে গেছে স্থানে স্থানে। চোখ দুটো বসে গেছে, চোয়ালটা উঁচু হয়ে হাড় বেরিয়ে পড়েছে। রুক্ষ চুল, ছিন্নছিন্ন বসন।
তার দু’পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে দুর্গেশ্বরীর অনুচরগণ। প্রত্যেকের হস্তেই সূতীক্ষ্ণধার অস্ত্র। এক-একজনের চেহারা ঠিক জীবন্ত শয়তানের মত। … :
দুর্গেশ্বরী সুউচ্চ স্থান হতে ছোরাখানা নিক্ষেপ করলো মহাদেবের পার্শ্বস্থ অনুচরটির হাতে।
সে যেন এই ছোরাখানার প্রতীক্ষাতেই ছিলো। দুর্গেশ্বরী ছোরাখানা নিক্ষেপ করতেই লোকটা খপ করে ছোরার বাট ধরে ফেললো। চোখ দুটো জ্বলে উঠলো ভয়ঙ্কর চেহারার অনুচরটির, সে। ছোরাখানা বাগিয়ে ধরলো।
দুর্গেশ্বরীর দিকে তাকালো অনুচরটি।
শিউরে উঠলো মহাদেব, ছাই-এর মত বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার মুখমণ্ডল।
দুর্গেশ্বরী ইংগিত করতেই লোকটা ছোরাখানা বসিয়ে দিতে গেলো মহাদেবের বুকে….ঠিক ঐ মুহূর্তে একটা গুলির শব্দ হলো।
চমকে উঠলো দুর্গেশ্বরীর আস্তানার সবাই।
বিস্মিত স্তম্ভিত হলো দুর্গেশ্বরী।
যে লোকটা মহাদেবের বুকে ছোরা বিদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছিলো সে তীব্র আর্তনাদ করে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো ভূতলে। রক্তে রাঙা হয়ে উঠলো মেঝেটা।
সম্মুখে দৃষ্টি তুলে ধরতেই সকলে দেখলো–দস্যু বনহুর দক্ষিণ হস্তে উদ্যত রিভলভার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, পিছনে তার অনুচরগণ। প্রত্যেকেরই হস্তে আগ্নেয় অস্ত্র, সবাই অস্ত্র উদ্যত করে আছে।
মুহূর্তে দুর্গেশ্বরী এবং তার অনুচরবর্গের মুখে একটা গভীর ভাবের ছায়াপাত ঘটলো। অনুচরগণ তাকালো দুর্গেশ্বরীর মুখের দিকে।
বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে গর্জে উঠলো–একজন নড়েছো কি মরেছো। কাউকে আমি রেহাই দেবো না। কথা কয়টা বলে বনহুর অনুচরদের ইংগিত করলো দুর্গেশ্বরীর অনুচরদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিতে।
আদেশ পাওয়া মাত্র বনহুরের অনুচরগণ দুর্গেশ্বরীর প্রত্যেকটা অনুচরের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নিলো।
বনহুর রিভলভার উদ্যত করে এগিয়ে গেলো দুর্গেশ্বরীর দিকে।
দুর্গেশ্বরী তখনও তার সুউচ্চ স্থান হতে একটুও নড়েনি। আলখেল্লার মধ্যে চোখ দুটো যেন আগুন ছড়াচ্ছে। বনহুরকে এগিয়ে আসতে দেখে দুৰ্গেশ্বরী প্রস্তুত হয়ে দাঁড়ালো।
বনহুরের মুখের অর্ধেক অংশ তার কালো পাগড়ির শেষভাগ দিয়ে ঢাকা ছিলো শুধু চোখ দুটো এবং প্রু জোড়া ও নাকের কিছু অংশ পরিলক্ষিত হচ্ছিল।
বনহুর দুর্গেশ্বরীর সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, মহারাজ বাসুদেবকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর এখানে আসুন।
জমকালো পোশাক পরা, পাগড়ির শেষ অংশ দিয়ে মুখের অর্ধেক ঢাকা মহারাজ বাসুদেব এসে দাঁড়ালেন দস্যু বনহুরের পাশে। যদিও তিনি নিজ পুত্র মহাদেবের নির্মম করুণ অবস্থা দেখে একেবারে মুষড়ে পড়ছিলো তবুও নিজকে সংযত রাখতে বাধ্য হয়েছিল, কারণ দস্যু বনহুর তাকে বারবার সাবধান করে দিয়েছিলো। সেখানে গিয়ে কোনো চরম অবস্থার সম্মুখীন হলেও আপনি। নিজকে যেন প্রকাশ করবেন না।
বনহুরের কথাটা ফেলতে সাহস করেননি মহারাজ বাসুদেব। অতি কষ্টে নিজকে তিনি শক্ত করে রেখেছেন, যদিও মহাদেবের অবস্থা তাকে একেবারে উত্তেজিত করে তুলেছিলো।
বনহুরের নির্দেশে মহাদেবের হাত-পা এবং মুখের বন্ধন উন্মোচন করে দেওয়া হলো।
অন্যান্য অনুচর দুর্গেশ্বরীর প্রত্যেকটা অনুচরকে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেললো। কারো নড়ার জো রইলো না।
বনহুর তখন দুর্গেশ্বরীর বুকে রিভলভার চেপে ধরে আছে।
আলখেল্লার মধ্যে দুর্গেশ্বরীর চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। এই মুহূর্তে তার হাতে যদি কোন অস্ত্র থাকতো তাহলে সে বনহুরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হত তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
দুর্গেশ্বরীর চোখের সম্মুখে তার অনুচরগণের চরম অবস্থা দেখে সে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলো না। রুখে উঠার জন্য সিংহীর ন্যায় ফোঁস ফোঁস করছিলো।
বনহুর তাকে সে সুযোগ দিলো না, আলখেল্পাসহ দুর্গেশ্বরীকে বেঁধে ফেলার নির্দেশ দিলো।
অত্যন্ত বুদ্ধিবলে এবং কৌশলে দস্যু বনহুর ভয়ঙ্করী দস্যু রাণী দুর্গেশ্বরীকে বন্দী করে কাবু করলো। শুধু দুর্গেশ্বরীই নয়, তার অনুচরগণ সবাই বন্দী হলো।
বনহুর দুর্গেশ্বরীর অনুচরগণকে একটা গুহায় আটক করে গুহার মুখে পাথরচাপা দিল, তারপর হেসে উঠলো হাঃ হাঃ করে। হাসি থামিয়ে ফিরে তাকালো দুর্গেশ্বরীর দিকে রাণী দুর্গেশ্বরী, তোমার অনুচরগণ এই বদ্ধ গুহায় তোমার আসার প্রতীক্ষা করবে।
দুর্গেশ্বরী আলখেল্লার মধ্যে অধর দংশন করলো–সে জানে তার অনুচগরণ অল্পক্ষণের মধ্যেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করবে, কারণ গুহাটার কোন ছিদ্রপথ ছিলো না।
বনহুর এবার তার অনুচরগণসহ রহমানকে চলে যাবার জন্য আদেশ করলো।
রহমান সর্দারকে কুর্নিশ জানিয়ে দলবল নিয়ে বিদায় গ্রহণ করলো।
বনহুর এবার দুর্গেশ্বরীকে লক্ষ্য করে বললো–দুর্গেশ্বরী তোমার বিচার করবেন মহারাজা বাসুদেব।
আলখেল্লার মধ্যে চমকে উঠলো দুর্গেশ্বরী।
বনহুর মহারাজ বাসুদেব ও দুর্গেশ্বরীসহ রাজদরবারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। সঙ্গে মহাদেবও রয়েছে।
সম্মুখস্থ অশ্বপৃষ্ঠে মহারাজ বাসুদেব, তাঁর দেহে এখনও দস্যু-ড্রেস। মুখের নিচের অংশ ঢাকা থাকায় তার মুখমণ্ডল দেখা যাচ্ছে না। তার পিছনের অশ্বে রাজপুত্র মহাদেব চলছে।
মাঝের অশ্বে রাণী দুর্গেশ্বরী তার দেহে আলখেল্লা হাতে এবং মাজায় লৌহ শিকল বাধা। রয়েছে। অশ্বপৃষ্ঠে আরষ্টভাবে বসে আছে সে।
পিছনের অশ্বপৃষ্ঠে স্বয়ং দস্যু বনহুর। তার দক্ষিণ হস্তে গুলিভরা রিভলভার। জমকালো ড্রেস পরিহিত এই তিনজনকে জ্যোছনা ভরা রাতে বড় অদ্ভুত লাগছিলো। মহাদেব মাঝে মাঝে তাকাচ্ছিলো তাদের দিকে।
অভিষেকপর্ব শুরু হবার পূর্ব মুহূর্তে রাজদরবারে সবাই উপস্থিত হয়েছেন। নিজ নিজ আসনে উপবিষ্ট সবাই। মন্ত্রীবর, সেনাপতি এবং রাজ পারিষদ সবাই রয়েছেন। অভিষেক করবেন রাজগুরু তিনি এসেছেন রাজদরবারে।
শুধু আসেননি মহারাণী মঙ্গলা দেবী এবং স্বপন কুমার। তাঁদের প্রতীক্ষায় সবাই প্রহর গুণছেন।
ঠিক ঐ মুহূর্তে দরবারকক্ষে প্রবেশ করে জমকালো ড্রেস পরিহিত মহারাজ বাসুদেব এবং দস্যু বনহুর এবং লৌহশিকল বাঁধা অবস্থায় রাণী দুর্গেশ্বরী ও মহাদেব।
দরবারকক্ষের সবাই বিস্মিত হয়ে তাকালো। কেউ কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই বলে উঠলো। বনহুর–আপনারা আমাদের দেখে অবাক হয়েছেন বুঝতে পেরেছি। আর অবাক হয়েছেন। মহাদেবকে দেখে। স্বপন কুমার আপনাদের কাছে কথা দিয়ে ছিলো সে আজ দস্যু বনহুর এবং দুর্গেশ্বরীকে পাকড়াও করে আপনাদের সম্মুখে হাজির করবে। দস্যু বনহুর ও দুর্গেশ্বরী আপনাদের সম্মুখে হাজির হয়েছে।
দরবারকক্ষে যেন বাজ পড়লো, সবাই বিস্ময়ভরা নয়নে তাকালো পাশের জমকালো পোশাকপরা দেহগুলোর দিকে। বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে দরবারকক্ষস্থ সকলের মুখমণ্ডল। একি তারা স্বপ্ন দেখছে! সত্যি কি তাদের সম্মুখের দস্যু বনহুর আর দুর্গেশ্বরী উপস্থিত? আলখেল্লা ঢাকা নারীমূর্তিই যে দুর্গেশ্বরী এটা তারা বুঝতে পারে, কিন্তু দস্যু বনহুর কে? কারণ দু’জনার দেহে ছিলো একই রকম ড্রেস-মহারাজ এবং দস্যু বনহুরের।
উপস্থিত সবাই মহাদেবের আবির্ভাবে একেবারে যেন বিস্মৃত হয়ে যায়। তারা রাণী দুর্গেশ্বরী এবং দস্যু বনহুর সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে নির্বাক হতভম্ব দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে তারা।
বনহুর বললো এবার–শুধু দস্যু বনহুর আর দুর্গেশ্বরীকেই আজ পাকড়াও করে আনিনি, মহারাজ বাসুদেবকেও স্বর্গ থেকে উদ্ধার করে এনেছি—
একটা গুঞ্জনধ্বনি উঠলো দরবারকক্ষ মধ্যে মহারাজ জীবিত–একি শুনছি আমরা—একি, শুনছি—
বললো বনহুর –হাঁ, আপনাদের মহারাজ আজ স্বয়ং রাণী দুর্গেশ্বরীর বিচার করবেন।
বনহুরের কথায় দরবার কক্ষের সকলের মুখমণ্ডলে রাজ্যের বিস্ময় ফুটে উঠেছে।
সেনাপতি উঠে দাঁড়ালেন, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন–কে তুমি? স্বর্গীয় মহারাজের সম্বন্ধে যা তা বলছো? জানো এর শাস্তি দেবো আমরা।
জানি কিন্তু আমার কথা মিথ্যা নয়। এই মুহূর্তেই আপনারা বিশ্বাস করবেন আপনাদের মহারাজ জীবিত। বনহুর মহারাজের পাশে এসে দাঁড়িয়ে তার মুখের কাল, পাগড়ির আঁচল খুলে ফেললো।
সঙ্গে সঙ্গে দরবারকক্ষের সকলে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠলো মহারাজ! মহারাজ জীবিত রয়েছেন—জয়! ভগবানের জয়—জয়! ভগবানের জয়—
মন্ত্রীবর এবং সেনাপতি উঠে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের সঙ্গে দরবারকক্ষের সবাই মহারাজের সম্মানার্থে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো।
মহাদেব পিতাকে দেখামাত্র আনন্দসূচক শব্দ করে ছুটে গিয়ে পিতাকে জড়িয়ে ধরলো– বাবা, বাবা তুমি বেঁচে আছে! বাবা, আমার বাবা—
মহাদেব এতক্ষণ জানতো না তার পিতা তাদের সঙ্গেই রয়েছেন। সে ভেবেছিলো ওরা উভয়েই দস্যুদলের লোক। যে মুহূর্ত বনহুর মহারাজের মুখের আবরণ খুলে ফেলেছিলো তখন মহাদেব পিতাকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে ছিলো, তাই সে ছুটে গিয়ে পিতাকে জাপটে ধরলো।
পিতা-পুত্রের মিলন হলো।
রাজগুরু এসেছিলো মঙ্গলা দেবীকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করতে, আজ তারই অভিষেক। কিন্তু মহারাণী মঙ্গলাদেবী কোথায়?
দস্যু বনহুর রাজগুরুকে লক্ষ্য করে বললো–রাজগুরু, আপনি মহারাজ বাসুদেবকে তাঁর সিংহাসনে আজ নতুন করে আবার প্রতিষ্ঠা করুন।
মহারাজ বাসুদেব সিংহাসনে উপবেশন করলেন।
রাজগুরু তাকে আশীর্বাদ করলেন–জয়! মহারাজ বাসুদেবের জয়! জয়! ভগবানের জয়–
আলখেল্লার মধ্যে দুর্গেশ্বরীর চোখ বিস্ময়ে গোলাকার হয়ে উঠেছে, মহারাজ বাসুদেব জীবিত। একি কথা! তার যে মৃত্যু ঘটেছিলো।
বনহুর দুর্গেশ্বরীর পাশে গিয়ে বললো–এবার আমি দুর্গেশ্বরীর পরিচয় আপনাদের জানাবো।
দরবারকক্ষের সকলে বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টি নিয়ে দুর্গেশ্বরীর দিকে তাকালো, সকলের মনে ভয়-ভীতি আর আশঙ্কা–এই আলখেল্লার নিচে না জানি কি রূপ ঢাকা আছে, যার ভয়ে তারা সদা-সর্বদা তটস্থ থাকতো। কে এই নরহত্যাকারিণী?
বনহুর একটানে খুলে ফেললো দুর্গেশ্বরীর মুখের আবরণ।
সঙ্গে সঙ্গে কক্ষমধ্যে যমদূত দেখার মত চমকে উঠলো সবাই। কারো মুখে কোন কথা নেই, সবাই যেন পাথরের মূর্তির মত জমে গেছে একেবারে।