Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » তেরো পার্বণ || Samaresh Majumdar

তেরো পার্বণ || Samaresh Majumdar

দিল্লিতে প্যান অ্যাম

দিল্লিতে প্যান অ্যাম নেমেছিল মাঝরাত্রে। সারাটা রাত চেয়ারে বসে কাটিয়ে দশটার ফ্লাইট ধরতে হয়েছে গৌরবকে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের প্লেনে বসে তার ক্লান্তিটুকু চলে গেল। আর কিছুক্ষণ মাত্র, তার পরেই কলকাতার মাটিতে পা রাখবে। এই তিরিশ ঘন্টার পাড়ি কোনো সমস্যাই নয় এখন। বারো বছর পর সে দেশে ফিরছে। এক যুগ।

গৌরব জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। নিচে মেঘ। পৃথিবীর সব আকাশের চেহারাই তো এক। কিন্তু এই মেঘগুলোকেও কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দীর্ঘ পথে যা শোনেনি, এয়ারলাইন্সের এই প্লেনে ওঠার পর বাংলা শব্দ অনর্গল শুনছে। আসলে শব্দগুলোই মেঘগুলোকে পরিচিত চেহারা দিচ্ছে। বারোটা বছর কি দ্রুত কেটে গেল। একটা শক্ত প্রতিজ্ঞা ছিল তার। যতদিন না আর পাঁচজনের চেয়ে মাথাটা উঁচুতে না উঠবে তদ্দিন দেশে ফিরবে না। তাকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় মানুষ হতে হবে। কাজের ক্ষেত্রে তার বিকল্প খুঁজতে হিমশিম খেতে হবে। সেই জায়গায় পৌঁছেছে আজ। প্রেসিডেন্সি থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বারো বছর দাঁতে দাঁত চেপে ন্যুয়র্কে পড়ে থেকে একটা জায়গা দখল করার পর কলকাতায় ফিরছে সে। উত্তেজনাটা শুরু হয়েছে ন্যুয়র্ক থেকেই। দিল্লি থেকে দমদমের যাত্রা শুরু করার পর সেটা তুঙ্গে উঠল।

একটু আগেই এয়ারহোস্টেস সিগারেট নিবোতে এবং সিটবেল্ট বাঁধতে বলেছে। সিগারেট খায় গৌরব। আমেরিকায় ওই নেশাটি এখন প্রায় অচল হতে চলেছে। কুইন্সের যে পাড়ায় গৌরব থাকে সেখানে দোকান নেই। কিনতে হলে কোনো পেট্রলপাম্পে যেতে হবে। তাছাড়া বেশিরভাগ বাড়ির বাচ্চারাই সিগারেট খেতে দেখলে চেঁচামেচি করে। ফলে ওই নেশাটা করা হয়ে উঠল না তার। সেইসঙ্গে মদ্যপানও। কারণ তাকে গাড়ি চালাতে হয়। রোজ সত্তর মাইল যাওয়া আসা করতে হয়। মদ খেয়ে গাড়ি চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ ওখানে। তাছাড়া বস্তুটা গৌরবকে আদৌ টানে না।

বারো বছর কলকাতার সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখতে চেয়েছে। প্রতি মাসে সে বাড়িতে চিঠি লিখেছে। এবং ধাপে ধাপে দাদার উন্নতির খবর জেনেছে। মায়ের চিঠিতে টুকিটাকি খবর পাওয়া যেত। কিন্তু গত তিন মাস কোনো চিঠিপত্র নেই। না মায়ের না দাদার। এমন কি সে যে অ্যাদ্দিন বাদে কলকাতায় ফিরছে এই খবরটার প্রতিক্রিয়াও জানা যায়নি ওদের চিঠিতে। এই সময় আর একটি মুখের আদল চোখের সামনে ভেসে এল। তিনমাস নয়, তার সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় চার বছর ধরে নেই। কী অবস্থায় আছে সে তা বোধহয় জানে না। যার মুখ মনে পড়লে শুধু নিশ্বাস আচমকা কেঁপে ওঠে। চার বছর গৌরব তাকে চিঠি লেখেনি, সেও না। হুহু করে প্লেনটা নিচে নামছে। কলকাতার মাটি ছোঁয়ার মুহূর্তে যে ঝাঁকুনি তা যে কি আরামের ওই মুহূর্তে বুঝতে পারল গৌরব।

ধীরে ধীরে অন্য যাত্রীদের পিছু পিছু বাইরে আসতেই এয়ারপোর্ট বিল্ডিং নজরে এল। এই আকাশ কলকাতার। দূরে কোথাও বোধহয় মাইকে হিন্দি গান বাজছে। ওইটে ছাড়া এয়ারপোর্টের আবহাওয়ার করাচি কিংবা দিল্লির সঙ্গে কোনো ফারাক নেই। নিচে নেমে খুব ভাবপ্রবণ হয়ে যাচ্ছিল সে। হাতব্যাগটা সঙ্গে নিয়ে সে দূরের গ্যালারির দিকে তাকাল। অনেক মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছেন নবাগত যাত্রীদের উদ্দেশে। তার নিজের জন্যে কি কেউ এসেছে? তার দেশে ফেরার খবরটা নিশ্চয়ই জানবে না।

কাস্টমসের বেড়া ডিঙিয়ে প্লেনের পেট থেকে আনা মালপত্তরের পাহাড় থেকে নিজের সুটকেশ দুটো বের করে গৌরব কয়েক পা হাঁটতেই চিৎকার শুনতে পেল, হা-ই, গ্যারি। গৌরব প্রথমে বুঝতে পারেনি তারপর খানিক দূরে একজন সুন্দরী মহিলাকে হাত নাড়তে দেখে থমকে গেল। সুটকেশ দুটো নামিয়ে রেখে সে ভালো করে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, আরে, বউদি, তুমি?

ততক্ষণে মলি ছুটে এসেছে কাছে। দুহাতে আঁকড়ে ধরেছে গৌরবের হাত, কি ভালো লাগছে তোমাকে দেখে গ্যারি, দেশে ফেরার জন্যে আমার কনগ্রাচুলেশন নাও।

গৌরবের কপালে ভাঁজ পড়ল, সে হেসে বলল, তোমাকে প্রথমটায় আমি চিনতেই পারিনি।

ওঃ, নো, আমি কি এমন বদলেছি! তোমার নিজের চেহারা কী হয়েছে?

কেন? আমাকে তো সহজেই চিনতে পারলে।

তা পারব না কেন? কিন্তু কি হ্যান্ডসাম হয়েছ তুমি। ওখানে রক্ষাকবচ বেঁধে এসেছ নাকি, নইলে এখানকার মেয়েরা তোমাকে ছিঁড়ে খাবে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি।

তুমি বড্ড বাড়িয়ে বলছ বউদি। সত্যি অবাক করে দিয়েছ। আমি যখন বিদেশে গেলাম তখন তুমি আর এই তুমির মধ্যে আকাশ আর পাতাল ফারাক।

সঙ্গে সঙ্গে ইস্ত্রি করা চুলের রাশি এক ঝাঁকুনিতে কিছুটা সরিয়ে মলি কপট অভিমানে জিজ্ঞাসা করল, কেন এখন কি আমাকে খুব খারাপ দেখাচ্ছে?

না, না, আমি কি সেটা বলেছি? তোমাকে দারুণ দেখাচ্ছে। আর সব কোথায়? মা, দাদা–। এবার চারপাশে তাকাল গৌরব। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁট ফোলাল মলি, ও গ্যারি! তোমার দাদাটা না যাচ্ছেতাই! এমন একটা চাকরি করে যে নিজের বলতে কিছুই থাকে না। বিলেত থেকে কয়েকজন শেয়ারহোল্ডার এসেছে তাদের নিয়েই আজ এত ব্যস্ত যে বেচারা ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারে নি।

মা?

উফ? উনি, মানে, ইউ আর স্টিল এ মাদারস বেবি, গ্যারি। চলো, বাড়িতে চলো। টনি বনিরা গাড়িতে বসে আছে। মলি মুখ ঘুরিয়ে চিৎকার করল, পোর্টার, পোর্টার! সঙ্গে সঙ্গে সুটকেশ দুটো তুলে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, আরে, খামকা কুলিকে ডাকছ কেন?

তুমি এই লাগেজ বইবে?

কেন নয়? এমন কিছু ভারী নয়, তাছাড়া আমার শরীর অসুস্থও নয়।

হাঁটতে হাঁটতে গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টনি বনিকে গাড়িতে রেখে এলে কেন?

টনিকে তো জানো না, তোমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলতে দিত না গ্যারি।

কি আশ্চর্য! তুমি আমায় আজ থেকে গ্যারি বলছ কেন বলোতো? আমি গোরা, গৌরব।

ডোন্ট বি সিলি! তুমি গোরা মায়ের কাছে, আমাদের গ্যারি! ইউ নিড এ রাইট নেম, ইজন্ট ইট?

গৌরব হতভম্ব হয়ে যাচ্ছিল। বারো বছর আগে সে যখন এয়ারপোর্ট দিয়ে বিদেশে গিয়েছিল সেইদিন এখানে মা দাদা বউদি এসেছিল। বউদির কোলে তখন তিন বছরের বনানী। আর পাঁচটা মধ্যবিত্ত বাড়ির বউ যেমন হয়, বেথুনে পড়া মলি সেইভাবেই মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিল সজল চোখে। তখন পারতপক্ষে ওর গলায় ইংরেজি শব্দ শোনা যেত না। পায়ে দাগ হলে আলতা পরত। বিয়ের পর চিনে দোকানে খেতে গিয়ে খুব আড়ষ্ট হয়ে বসেছিল। তাই নিয়ে দাদা ঠাট্টা করত মনে আছে। আসলে দাদাও তখন সামান্যই চাকরি করত। উত্তর কলকাতার যে বাড়িতে ওরা থাকত তার ভাড়াও কম ছিল। গৌরবের বিদেশে পড়তে যাওয়া ওই পরিবারের পটভূমিকায় বিশ্বাস্য নয়। কিন্তু মেধা এবং চেষ্টার সঙ্গে যোগাযোগ মিলে গেলে কোনো কিছুই অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে না। আর এই বারো বছরে ধাপে ধাপে উঠে গেছে দাদা। এখন দক্ষিণের সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় ওঁদের ফ্ল্যাট। কিন্তু বউদি? গৌরব আড়চোখে তাকাল। পাঁচফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি লম্বা, মেদহীনা, রোদ-চশমা পরা এই মহিলাটি যেভাবে তরতরিয়ে হাঁটছেন তার সঙ্গে সেই বউদির কোনো মিল নেই। এখন নাভিমূলের চারইঞ্চি অবহেলায় উন্মুক্ত, সাদা ব্লাউজ বাহুমূল পর্যন্ত নামেনি। সবচেয়ে বিস্ময়ের, শাড়ি পরার ধরনটাই পাল্টে গেছে তার। এত দ্রুত কি করে মানুষের বদল হয় তা ভাবতে পারছিল না গৌরব।

এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রচুর গাড়ি দেখতে পেল সে। এবং ওই গাড়িগুলো বেশ নিয়ম মেনে রাখা হয়েছে। অনেক দূরে লম্বা একটা গাড়ি নজরে পড়ল। মলি একটি গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ডাকলেন, ড্রাইভার, ড্রাইভার। সঙ্গে সঙ্গে একজন প্রৌঢ় ছুটে এল। মলির ইঙ্গিত বুঝে সে চলে এল গৌরবের কাছে। তারপর দিন স্যার নইলে চাকরি যাবে গোছের মুখ করে সুটকেশ দুটো ছিনিয়ে গাড়ির পেছন দিকে চলে গেল। গৌরব দেখল ড্রাইভারের পাশের আসনে একটি কিশোরী বসে তন্ময় হয়ে বই পড়ছে। তার রোদ-চশমা মাথায় তোলা। পেছনের আসনে দাঁড়িয়ে একটি চার পাঁচবছরের ছেলে প্রবল নৃত্য করছে বাজনার তালে। টেপে বাজনা বাজছে সজোরে। মলি মেয়ের দিকে তাকাল, বনি, লুক, কে এসেছে!

বনির পড়ায় বিঘ্ন হলো, ঈষৎ বিরক্ত কিন্তু গৌরবকে দেখে বলল, হা-ই। ওর উচ্চারণ, হাসির মাত্রা অত্যন্ত শিক্ষিতা মহিলার মতো। শব্দটা উচ্চারণ করার সময় বইটা বন্ধ করেছিল, গৌরব লক্ষ্য করল, গডফাদার। কই গডফাদার? মেরুদণ্ড চিনচিন করে উঠলেও সে হাসল, আরে বনানী না? কত বড় হয়ে গেছিস তুই। হাত বাড়িয়ে বনানীর চিবুক স্পর্শ করতেই মেয়েটি ঈষৎ লজ্জিত হয়ে কাঁধ নাচাল।

মলি বলল, আর ওই বিচ্ছুটা টনি। তুমি যাওয়ার অনেক পরে ও এসেছে। গৌরব নৃত্যরত বালকটির দিকে তাকাতেই সে ওই অবস্থায় জিভ ভ্যাংচালো, মলি দরজা খুলে পেছনে উঠে গৌরবকে পাশে জায়গা করে দেওয়ার সময়েও টনির নাচ থামছিল না। ড্রাইভার সুটকেশ পেছনে তুলে দিয়ে স্টিয়ারিং-এ এসে বাজনা কমিয়ে দিতেই টনি চিৎকার করে উঠল, ওঃ নো! আই ওয়ান্ট টু ডান্স!

বনি মুখ ফিরিয়ে বলল, ওঃ টনি, বিহেভ ইওরসেলফ!

টনি তীব্র প্রতিবাদ করল, নো, মিউজিক বাড়িয়ে দাও!

মলি মৃদু বকল, ওঃ টনি, আচ্ছা ড্রাইভার, একদম বন্ধ কোরো না, আর একটু জোরে করো। বুঝলে গ্যারি, আজকালকার বাচ্চারা এমন হয়েছে, হটট্র্যাক ছাড়া একদম থাকতে চায় না।

গাড়ি তখন ভি আই পি রোড ধরে ছুটছে। দুহাতে কান ঢাকল গৌরব। এই কলকাতাকে সে যাওয়ার আগে দেখে যায়নি।

আজ পথে জ্যাম ছিল না। ভি আই পি রোডের মতন অমন চমৎকার পথ, বাইপাসের মতো চওড়া রাস্তার দুপাশে চাষের মাঠ, খোলা জমি, আদিগন্ত আকাশ কখনও কলকাতার শরীরের পাশে দেখবে বলে ভাবেনি গৌরব। আর রাস্তাটা কয়েক মিনিটের মধ্যে যখন বাঁক নিয়ে পার্কসার্কাসের পেটে চলে এল তখন সে আরও তাজ্জব। এবং তখনি পরিচিত কলকাতাকে পেয়ে মন খুশিতে ভরে গেল। একটা আদুরে আলস্য বাড়িগুলোর শরীরে মাখানো, রাস্তায় অলস মানুষের চলাফেরা। ট্রামগুলো আজন্ম একই চেহারায় রয়ে গেছে। কিছু রঙিন এস মার্কা বাস চোখে পড়ল।

দক্ষিণখোলা ছতলা বাড়ির লিফট তাদের নিয়ে এল চারতলায়। নিচে দাঁড়িয়েই গৌরব লক্ষ্য করেছিল এই বাড়ির বাসিন্দাদের অধিকাংশই অবাঙালি। অন্তত লেটার বক্সগুলো সেই কথাই বলছে। নাম লেখা দরজার বোতাম টিপল মলি। মলি মিত্র আর সৌরভ মিত্র। বনি স্থির হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে, টনি তখনও নাচের ভঙ্গি চালিয়ে যাচ্ছে। এই ছেলে বড় হয়ে মাইকেল জ্যাকসন না হয়ে যায় না। দরজা খুলতেই মোক্ষদাকে চিনতে অসুবিধে হলো না। তাকে দেখেও একটু ঘোমটা টানল মোক্ষদা। যাক, তাহলে বাল্যকালের মানুষকেও দাদা সঙ্গে করে বাড়িতে এনেছে। গৌরব সহজ গলায় জিজ্ঞাসা করল, কেমন আছ মোক্ষদা? মাথা নেড়ে সসঙ্কোচে মোক্ষদা নীরবে জবাব দিল, ভালো। তারপর চলে গেল ভেতরে।

মলি সোফায় বসে বলল, বসো, কাল নিশ্চয় সারারাত ঘুমাওনি। একটু জিরিয়ে স্নান করলে ফ্রেশ লাগবে। কেমন দেখছ ফ্ল্যাটটা?

চমৎকার। সত্যি সুন্দর সাজানো হয়েছে হলঘরটা। উত্তর কলকাতার বাড়িতে এসব স্বপ্নের বিষয় ছিল। সে বলল, কটা ঘর আছে এই ফ্ল্যাটে?

পাঁচটা। তোমার ঘরটা আমি নিজে হাতে সাজিয়েছি। আফটার অল আমেরিকা থেকে আসছ, হাজার হাজার ডলার আর্ন করছ, তোমার জন্যে দক্ষিণের ঘরটা ছেড়ে দিয়েছি। মোক্ষদা, ড্রাইভারকে ছোটবাবুর ঘরটা দেখিয়ে দাও, সুটকেশগুলো রেখে আসুক। মলি শেষ কথাগুলো চেঁচিয়ে বলল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোথায়? মাকে দেখছি না তো!

একটু মেঘ জমতে না জমতেই সরিয়ে ফেলল মলি, উনি আসবেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন! চা না কফি?

কিছু না। আসবেন মানে? মা বাড়িতে নেই? গৌরব খুব অবাক।

না, মানে, এই মুহূর্তে নেই। তবে তিনি এসে পড়বেন যে কোনো মুহূর্তেই।

মা কোথায় গিয়েছেন?

তোমার মামার বাড়িতে, যিনি রাণাঘাটে থাকেন। তুমি এত ভাবছ কেন এই নিয়ে?

বাঃ এতকাল পরে দেশে ফিরলাম আর সেই সময় মা বাড়িতে নেই, আমি ভাবব না? কী ব্যাপার? হঠাৎ রাণাঘাটে কেন? কোনো অনুষ্ঠান ছিল নাকি ওখানে?

তোমার দাদা হয়তো নিয়ে আসবে রাণাঘাট থেকে। উনি জানেন তুমি আজ আসছ। অত ব্যস্ত হয়ো না, আমরা আছি তোমার অযত্ন হবে না এই ভেবে মা নিশ্চিন্তে আছেন। দুপুরে কী খাবে? চাইনিজ না ইংলিশ?

মানে? গৌরব হতভম্ব।

বাঃ, বারো বছর ওখানে থেকে নিশ্চয়ই তোমার ফুড হ্যাবিট পাল্টে গেছে। আমাদের মোক্ষদা এখন সব রান্না করতে পারে। চাইনিজটা তো দুর্দান্ত।

বউদি। শুধু মাছের ঝোল আর ভাত।

ন্যাকা।

.

স্নান করে বেশ তাজা লাগছিল। মাছের ঝোল আর ভাত খেয়ে লম্বা ঘুমিয়ে নিল গৌরব। চোখ মেলে দেখল কলকাতায় বিকেল নেমেছে। তড়াক করে উঠে বসতেই বিয়ারের বোতলগুলো চোখে পড়ল। খাওয়ার আগে বউদি ফ্রিজ থেকে কনকনে বিয়ার বের করে দিয়েছিল খিদে বাড়াবার জন্যে। বাড়িটার হাল কি পাল্টে গেছে। উত্তর কলকাতায় বাড়িতে বসে বিয়ার খাওয়ার কথা কেউ কল্পনাও করতে পারত না।

সামনে ছোট্ট ব্যালকনিতে দাঁড়াতেই চোখ জুড়িয়ে গেল। সামনেই লেক। সেখানে মেলা বসে গেছে যেন। চারতলা থেকেই নিচের পৃথিবীটা অন্যরকম দেখাচ্ছে। কিন্তু ওই আকাশ, গাছের পাতা ন্যুয়র্কের স্মৃতিটাকে চট করে আড়াল করে দেয়। এ চেহারা একদম আলাদা, একদম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর গৌরব পিছন ফিরল। সাধ্যের মধ্যে যা সম্ভব তাই এই ঘরে রাখা হয়েছে। নিশ্চয়ই বউদি তাকে সেরা আরাম দিচ্ছেন। সে দেখল মোক্ষদা চা নিয়ে ঢুকছে। এগিয়ে নিয়ে কাপটা নিল গৌরব, মা এসেছে?

মাথা নাড়ল মোক্ষদা। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তুমি বোবা হয়ে গেলে নাকি? মাথা নেড়ে জবাব দিচ্ছ কথা বলছ না কেন?

মোক্ষদা এবার মুখ তুলল, তুমি নাকি সাহেবদের ভাষায় কথা বলো এখন।

হো হো করে হেসে উঠল গৌরব, একথা কে বলেছে তোমাকে! বাঃ কি মনে হচ্ছে তোমার? আমার কথা বুঝতে পারছ না? যত সব! হ্যাঁ, মা কবে রাণাঘাটে গিয়েছে বলো তো?

এসব কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না দাদাবাবু।

কেন?

ছোট মুখে বড় কথা বলতে নেই।

কবে গেছে সেই কথাটা তো বলতে পারবে?

তিন মাস।

তিন মাস? কি আশ্চর্য! তিন মাস মা রাণাঘাটে কী করছে? দাদা বাড়িতে ফিরেছে?

না।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। যাক, তোমার খবর কি বলো? দেশে যাও না?

আমি গেলে বউদির অসুবিধে হয়! মা নেই, তাই! মেয়েটারও বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। সে ছাড়া তো কোনো পিছুটান নেই। মেদিনীপুরে থাকে তারা। শুনেছি বাচ্চা হবে। সেই সময় যাব।

মোক্ষদা চলে গেলে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকল সে। মা কেন অ্যাদ্দিন বাইরে রয়েছে তা মাথায় ঢুকছিল না। বউদির সঙ্গে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে। বিয়ের পর তো বউদি মাকে খুব সমীহ করত! দাদা মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করবে তাও ভাবা যায় না। জ্ঞান হবার পর মাকে এতদিন রাণাঘাটে সে কখনও থাকতে দ্যাখেনি। বাবা মারা যাওয়ার পরও নয়। রাণাঘাটে একটা ফোন করলে কেমন হয়? ওখানে তো ফোন আছে।

গৌরব হলঘরে বেরিয়ে এল। বনি একটা গল্পের বই নিয়ে বসে আছে সোফায় হেলান দিয়ে। তাকে দেখে সোজা হয়ে হাসল, কী খবর সব! কোন ক্লাসে পড়িস তুই?

নাইন।

তাহলে তো লেডি হয়ে গেছিস। হ্যাঁরে রাণাঘাটের মামাদের ফোন নম্বর কত?

গাইডেই লেখা আছে। বনি উঠে গাইডটা এনে পাতা খুলে দেখাল। সেখানে অনেকের টেলিফোন নম্বর পর পর লেখা। মিনিট পাঁচেক নষ্ট হলো গৌরবের। কিছুতেই এক্সচেঞ্জকে ধরতে পারছে না। শেষের দিকে ক্রশ কানেকশন হয়ে গেল। আর এক ভদ্রলোক চেঁচাচ্ছেন, তারও রাণাঘাট দরকার। শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল সে। বনি এক দৃষ্টিতে দেখছিল। সে রিসিভার ছাড়তে জিজ্ঞাসা করল, আমেরিকায় এইরকম হয়?

মাথা খারাপ। সত্যি যদি কেউ কথা বলে তো অন্য কথা। কিন্তু তা নাহলে লাইন পেতে পাঁচ সেকেন্ডও লাগে না। এরকম হলে ওখানে টেলিফোন কোম্পানি উঠে যেত। গৌরব বিরক্তিতে কথাগুলো বলল। বনি বলল, কি ভালো, না! আচ্ছা আঙ্কল–

দাঁড়া। গৌরব থামিয়ে দিলো আমাকে আঙ্কল বলবি না, কাকু বলবি।

হেসে ফেলল বনি, তোমাকে অনেকদিন কেউ কাকু বলে ডাকেনি, না?

থতমত হয়ে গেল গৌরব। তারপর হেসে বলল, ধরে নে, তাই। কি বলছিলি বল।

তুমি মাইকেল জ্যাকসনকে দেখেছ?

মাইকেল? না।

ডাস্টিন হফম্যান?

দূর থেকে দেখেছি। ব্রডওয়েতে ডেথ অফ এ সেলসম্যান নাটকে উনি অভিনয় করেন। সেটা দেখতে গিয়ে দেখেছি। কেন বল তো?

তোমার কি মজা না!

মোটেই নয়। এদের দেখতে পাওয়া মোটেই জীবন ধন্য হওয়ার মতো ব্যাপার নয়।

বনির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। সেটা দেখে গৌরব তার পাশে এসে বসল, ওদের চেয়ে আমার ঢের বেশি ভালো লাগছে তোদের দেখে।

ইউ আর সামথিং। বনি কাঁধ নাচাল।

কেন?

আমার এক বন্ধুর দাদা দুবছর আমেরিকায় ছিল। ফিরে এসে একদম বাংলা বলে না।

তিনি জিনিয়াস। আমি নিজের রান্না নিজে করি, মেসিনে কাপড় কাচি, গাড়ি চালিয়ে অফিসে যাই, বাজার করি, ঘরদোর নিজেকেই পরিষ্কার করতে হয়। আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনি। একদম সাদামাঠা বাঙালি যাকে বলে তাই।

তোমার আমেরিকান বন্ধু নেই?

প্রচুর। তারা আমার হাতের রান্না খেতে খুব ভালবাসে। শুধু মশলাটা কম দিতে হয়।

অফিসের পরে তুমি কী করো?

আড্ডা মারি, নিজের সঙ্গে।

নিজের সঙ্গে মানে?

শুক্র এবং শনি রবি ছাড়া কেউ অফিসের পর বাড়ি থেকে বের হয় না। আমাদের যখন ছুটি হয় তখনও সূর্য বেশ গনগনে তবু বাঙালিরা বাড়ি ছোটে এই বলে যে কাল অফিস আছে। হাজার নিমন্ত্রণ করলেও আসবে না। ওদের আড্ডা ওই তিনদিন। আমি ম্যানহাটনে টাইম স্কোয়ারে হাঁটি। নিজের সঙ্গে কথা বলি। কয়েকটা পাঙ্ক ছেলে-মেয়ের সঙ্গে আমার চমৎকার বন্ধুত্ব হয়ে গেছে।

পাঙ্ক মানে?

বাউণ্ডুলে কিন্তু হিপিদের মতো ভালোমানুষ নয়। ওদের গল্প পরে একদিন বলব। তাছাড়া আমার পাশের বাড়িতে মিসেস ডেভিস আছেন। ঠিক তোমার ঠাকুমার মতন। ওর ছেলে-মেয়েরা আর কাছে আসার সময় পায় না। বুড়ি আমার সঙ্গে গল্প করতে খুব ভালবাসে।

তোমার কোন গার্ল ফ্রেন্ড নেই?

গৌরব চট করে বনির মুখ দেখে নিল। এবং বুঝল প্রশ্নটিতে কোনো জটিলতা নেই। তার মনে হলো ছেলেবেলায় তারা কখনও কোনো বয়স্ক মানুষকে এই প্রশ্ন করার কথা ভাবতেও পারত না। ভারতবর্ষেও তাহলে যুগের হাওয়াটা পৌঁছেছে। সে স্বাভাবিক গলায় বলল, থাকবে না কেন? প্রচুর আছে। সব মেয়েই তো আমার বন্ধু। তুইও আমার বন্ধু হয়ে যেতে পারিস।

সত্যি? বনির মুখে একটা আলো পড়ল যেন।

সত্যি। গৌরব হাত বাড়াল। বনি ওর হাতটা খুশির সঙ্গে ধরল। গৌরব বলল, আচ্ছা, তোর বাবা কখন আসবে কিছু বলেছে?

মাথা নেড়ে না বলল বনি। তারপর চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে গলা নামাল, আজ সকালে তোমাকে নিয়ে মা আর বাবা খুব ঝগড়া করছিল। তারপর খুব রেগে নিয়ে বাবা বাড়ি থেকে চলে যায়। কাল রাত্রে পার্টি থেকে ফেরার পরই বাবার মেজাজ খুব খারাপ ছিল।

আমাকে নিয়ে ঝগড়া, কেন? গৌরব বিস্মিত।

বাবা মাকে বলেছিল তোমাকে আনতে যেতে এয়ারপোর্টে। মা বাবাকেও যেতে বলেছিল। কিন্তু। বাবা যেতে চাইছিল না। বলছিল, তোমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।

কেন?

তুমি যখন জিজ্ঞাসা করবে গ্রামি কোথায় তখন বাবা কি জবাব দেবে, তাই।

গ্রামি মানে?

উঃ, তুমি কিস্যু জানো না। গ্রামি মানে গ্র্যান্ডমাদার। ওটা টনি বানিয়েছে।

ও। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিল গৌরব। যথেষ্ট হয়েছে। ওইটুকুনি বাচ্চা মেয়েকে আর প্রশ্ন করা অনুচিত হবে। তার খারাপ লাগছিল। বড়রা যখন ঝগড়া করে তখন ছোটদের অস্তিত্ব উপেক্ষা করে কেন! বনি কথার সূত্র ধরে রাখতে চাইছিল, মা বাবার অফিসে ফোন করেছিল তুমি আসার পর। কিন্তু বাবা নাকি আজ সারাদিন অফিসেই যায়নি।

বোধহয় রাণাঘাটে গিয়েছে ঠাকুমাকে আনতে। গৌরব প্রসঙ্গ ঘোরাতে চাইল।

.

কিন্তু রাত আটটা বেজে গেল তবু কারও দেখা নেই। এর মধ্যে যতবার বেল বেজেছে গৌরব বেরিয়ে এসেছে। হয় টনির টিচার নয় অন্য কেউ। রাণাঘাটের টেলিফোন লাইনটাও পাওয়া যাচ্ছে না। গৌরব ঠিক করল সে রাণাঘাটেই যাবে। আজ রাত্রেই। দাদা বউদির সঙ্গে মায়ের যাই হোক না কেন সে আসছে জেনেও মা কি করে রাণাঘাটে থাকল। যদি তেমন কিছু এই বাড়িতে হয়ে থাকে তাহলে তো এয়ারপোর্টেই যেতে পারত। বিকেল থেকে বউদিও যেন অত্যন্ত অস্বস্তিতে রয়েছে। সকালের সেই স্বাভাবিক ব্যবহারটা করছে না। বলতে কি সামনেই আসতে চাইছে না যেন। খানিক আগে গৌরব ঘরে উঁকি দিয়েছিল। মলি বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। সেই অবস্থায় ডাকা উচিত মনে হয় নি গৌরবের। ওর মনে হয়েছিল সকাল থেকে যেটা আড়ালে রাখতে চেয়েছিল মলি সেটা ক্রমশ প্রকাশিত হয়ে যাচ্ছে বলে কুণ্ঠিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় কোনো প্রশ্ন করা মানে আরও বিব্রত করা হবে। কিন্তু রাণাঘাটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত তো জানাতে হয়।

এই সময় দরজার বেল বাজল। গৌরব এগিয়ে এসে সেটা খুলতেই জমে গেল। মা দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে একটা ব্যাগ। কয়েক লহমা, যেন কয়েক হাজার মাইল পরিক্রমার মতো, পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকাল। শেষে পর্যন্ত গৌরব উচ্চারণ করল, মা! এবং তখনই সে আবিষ্কার করল তার বুকের সব জল বাষ্প হয়ে গলায় আটকেছে। সরলা এগিয়ে এলেন। বারো বছর তাঁর শরীরে অনেক কিছু চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাঁর চোখ তীব্রভাবে ছেলের মুখ দেখছিল। তারপর দুহাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে শুরু করলেন তিনি। ঠিক কান্না নয় সমস্ত শরীরে একটা কাঁপুনি যা এই মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল ছেলের শরীরের চাপে। মায়ের চুলে মুখ রেখে নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টা করছিল গৌরব। কিন্তু চোখের জল মনের নিষেধ কখনো মানে না। প্রায় মিনিটখানেক লাগল স্থির হতে। সরলা শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পারলেন, কখন এলি?

সকালে। খুব কষ্ট হচ্ছিল শব্দটা উচ্চারণ করতে গৌরবের।

ও।

তুমি কেমন আছ মা? তখন ছেলের দুহাতের বাঁধনে বাঁধা সরলা। কোনো রকমে ভালো বলতে গিয়ে চোখের কোণ থেকে জল গড়িয়ে এল। গৌরব সেই অবস্থায় তাঁকে বলল, চলো, ঘরে গিয়ে কথা বলি আমরা।

ওই যতটুকু, দুয়ার থেকে অন্দর, যেতে যেতে নিজেকে পাল্টে ফেলতে পারলেন সরলা। ঘরে ঢুকে ছেলের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে বললেন, এতদিনে বাবুর সময় হলো! উচ্চারণে একটু অভিমান, একটু স্নেহের ধমক। গৌরব নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, না এলেই তো ভালো ছিল।

কেন? সরলা মুখ ঘুরিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছিলেন। যেমন রেখে গিয়েছিলেন তেমনই রয়েছে। তবে মনে হয় মোক্ষদা রোজ ঝাড়ামোছ করে। ছেলের কথা শুনে মুখ ফেরালেন।

বাঃ। আমি অ্যাদ্দিন বাদে বাড়িতে ফিরলাম আর তুমি রাণাঘাটে গিয়ে বসে আছে। কী হয়েছিল মা? এ বাড়ির কেউ তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছিল?

ওমা, কে আবার খারাপ ব্যবহার করবে? তুই একটা পাগল।

তাহলে তুমি তিন মাস রাণাঘাটে বসে রইলে কেন? উঁহু, তুমি চেপে যাচ্ছ।

ওরে বাবা, না। মনে হলো অনেকদিন দাদার বাড়িতে যাই না, তাই থেকে এলাম। এবার বল, তুই কেমন আছিস? গায়ে গতরে একটুও লাগেনি, শুধু ঢ্যাঙাই হয়েছিস। খাওয়া দাওয়া করতিস না বোধহয়। সরলা ছেলের চিবুকে হাত দিলেন।

তোমার চোখেই আমি রোগা। চশমাটা পালটাও। কিন্তু তোমার খবর কী?

ভালো। আমি খুব ভালো আছি।

তাহলে আমার চিঠির উত্তর দাওনি কেন গত তিন মাস। আর আগে আমার এত বড় চিঠির উত্তরে এই এতটুকু। তোমার ভাগ্যে কি জায়গা জুটত না?

রাণাঘাটে তোর খটমট ঠিকানাটা কিছুতেই মনে পড়ছিল না। লিখে নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। আর সবাই এখানে এত লিখত যে আমি–। চিঠি তো পেতিস তা হলেই হলো। কতদিনের ছুটি তোর?

তিন মাস।

তিন মাস পরে চলে যাবি?

সেইটাই ভাবছি। যদি এখানে একটা ভালো কাজ জোটাতে পারি–দেখি।

তোর মতো বিদ্বান ছেলে এখানে চাকরি পাবে না? হতেই পারে না।

তুমি কিন্তু আসল কথাটা এড়িয়ে যাচ্ছ?

ও কথা বাদ দে। বউমা কোথায়? তোর দাদা? বাচ্চাদের দেখছি না কেন?

আছে সবাই। দাদার সঙ্গে আমার এখনও দেখা হয়নি। মা, তোমার কী হয়েছে?

কি আর হবে।

ঠিক এই সময় বাইরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। সরলা বিছানায় বসলেন। পাশে গৌরব। দরজায় এসে দাঁড়াল সৌরভ। গৌরবের চেয়ে বছর দশেকের বড় সে। পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। মাথার চুল এলোমেলো। উদভ্রান্ত চেহারা দেখলেই বোঝা যায় সে মদ্যপান করেছে। একটা হাত দরজায় রেখে অন্য হাত বুকের কাছে নিয়ে সৌরভ বলল, গোরা, আমি বলছি তোকে। আমি দোষী। আমি ছেলে হয়ে মাকে রাখতে পারিনি।

দাদা! গৌরব চাপা গলায় বলে উঠল।

ইয়েস আমি। যে ছেলে মাকে নিজের কাছে রাখতে পারে না, ভাইকে এয়ারপোর্টে বারো বছর পর রিসিভ করতে যেতে পারে না তার–! কথাটা শেষ না করে বিকৃত মুখে মাথা নাড়ল সৌরভ। তারপর সেই জড়ানো গলা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে বলল, মা, তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

আঃ, খোকা, কি যা তা বলছিস! সরলা ধমকে উঠলেন।

না। আমি তোমাকে আনতে রাণাঘাটে গিয়েছিলাম। ওরা বলল, তুমি সকাল বেলায় বেরিয়ে গেছ। আমি ক্ষমা চাইছি মা।

গৌরব চমকে উঠল, সকালে রাণাঘাট থেকে বেরিয়ে এতক্ষণ কোথায় ছিলে মা?

সরলা মাথা নিচু করে বললেন, দক্ষিণেশ্বরে।

হঠাৎ সব শব্দ যেন মরে গেল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। সৌরভ শেষ পর্যন্ত জড়ানো গলায় কথা বলল, সত্যি বলছি মা, তুমি এই বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর আমি এক মুহূর্ত ভালো ছিলাম না। কিন্তু আমি জানতাম তোমাকে আনতে গেলে তুমি কিছুতেই আসবে না। মলি না, দোষ আমার, আমাকে ক্ষমা করো।

সরলা ডাকলেন, এখানে আয়, আমার পাশে বোস।

সৌরভ নিজেকে কোনোরকমে সামলে সরলার আর এক পাশে গিয়ে বসল। দুই পুত্র দুই দিকে। সরলা বললেন, আমারই দোষ। আমিই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি। তোদের যে জীবন না মানলে চলে না আমার তাই নিয়ে রাগারাগি করা উচিত ছিল না। শুধু আমার বাচ্চা দুটোর জন্যে ভয় হয়, খুব ভয় হয়।

গৌরব মুখ তুলল, বউদি কোথায় দাদা!

সৌরভ মাথা নাড়ল। ইঙ্গিতে বোঝাল সে দ্যাখেনি। সরলা উঠলেন, তোরা বোস, আমি দেখছি বউমা কোথায়। রাতও হয়েছে, ওরা তোদের খাবার দিচ্ছে না কেন?

কথা বলতে বলতে সরলা যেন ঘরের বাইরে যেতে পেরে স্বস্তি পেলেন। দুই ভাই একটু পাশাপাশি বসুক। ওদের মধ্যে তো ঝগড়াবিবাদ নেই। তিনি বউমার স্বামীর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া পছন্দ করেন নি বলেই তো সংঘর্ষ। এবার তিনি মানিয়ে নেবেন। তিন মাসে তিনি বুঝতে পেরেছেন মানিয়ে না নিলে শুধু দুঃখই বাড়ে, ব্যবধান ঘোচে না।

এখন পরিবেশ অনেকটা স্বাভাবিক। ডাইনিং টেবিলে সৌরভ বসেছিল গৌরবের পাশে। স্নান করে নেওয়ায় সৌরভের ব্যবহারটাও নিয়ন্ত্রণে এসেছে। উল্টোদিকে বসে খাচ্ছে টনি বনি। টনির চোখে ঘুম। তার পাশে দাঁড়িয়ে সরলা আদুরে গলায় ঘুম ভাঙাচ্ছিলেন। মলি পরিবেশন করছিল। হঠাৎ গৌরব মুখ তুলে বলল, মা, তুমি খাবে না?

সরলা হাসলেন, আমি আজ একটু দুধ মিষ্টি খেয়ে নেব।

কেন? হঠাৎ এত বৈরাগ্য কেন? গৌরব প্রশ্ন করল।

বৈরাগ্য আবার কি! তুই খা তো। সরলা চাপা ধমক দিলেন।

সৌরভ খাওয়া শুরু করেছিল, থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মায়ের খাবার তৈরি হয় নি?

প্রশ্নটা যার উদ্দেশে তার ঠোঁটে টান পড়ল। মলি নিচু গলায় বলল, করেছি।

গৌরব বলল, তাহলে দুধ মিষ্টি কেন! বউদি তুমি মায়ের খাবারটা এখানে এনে দাও।

সরলা বললেন, না না, কী করছিস তোরা?

গৌরব মাথা নাড়ল, আমাদের সঙ্গে খেলে তোমার জাত চলে যাবে?

ব্যাপারটা ক্রমশ অন্যরকম হয়ে গেল। সরলা না খেলে কেউ খেতে চাইছে না। এমন কি টনি বনিও সেই তালে তাল দিল। সৌরভ স্মিত মুখে দেখছিল। গৌরব আসার পর অনেকদিন বাদে বাড়িটায় এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত সরলা বললেন, তোরা সত্যি পাগল। বউমা, তুমিও বসো।

এতক্ষণ মলি যেন বৃত্তের বাইরে ছিল হঠাৎ নিজের নামটা শুনে তড়িঘড়ি বলল, আমি–আমি তো খাবার দিচ্ছি, আপনারা বসুন।

গৌরব চোখ বড় করল, তা বললে চলবে না। সমস্ত খাবার টেবিলের ওপর জড়ো করো। কাউকে দিতে হবে না, যার দরকার সে নিজেই নিয়ে নেবে! তুমি বসে যাও।

এবার দৃশ্যটা চমৎকার। গৌরব ভাবল। টনি বনি মা বউদি দাদা এবং সে একই টেবিলে। মলি মুখ নিচু করে খাচ্ছিল। হঠাৎ তার শরীরে কাঁপুনি এল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে সে মুখ চাপা দিল। সরলা সেটা লক্ষ্য করেছিলেন। খাওয়া থামিয়ে বাঁ হাত মলির পিঠে রাখলেন তিনি, ছি বউমা, খাওয়ার সময় চোখের জল ফেলতে নেই।

হঠাৎ আবহাওয়াটা থমথমে হয়ে গেল। কেউ কোনো কথা বলছে না। সরলা চাপা গলায় বললেন, সহজ হও বউমা। মানুষ মাত্রই ভুল করে, মানুষই তা শুধরে নেয়। অতীতের কোনো কথা আমার মনে নেই। তুমিও মনে রেখো না। এক হাতে তালি বাজে না, দোষ হয়তো আমারও ছিল।

মলি কোনো উত্তর দিলো না। চেষ্টা করে নিজেকে স্বাভাবিক করল সে। সৌরভ বলল, শুনলে কথাগুলো? চিরকাল মনে রেখো। ভাগ্যিস গোরা আজ দেশে ফিরল নইলে মা তুমি হয়তো আসতেই না।

সরলা দ্রুত মাথা নাড়লেন। তারপর হেসে বললেন, না খোকা, আমি আসতাম।

সৌরভের বিশ্বাস হলো না কথাটা। সে আবার প্রশ্ন করল, তুমি আসতে? আজ?

সরলা বললেন, আজ নয়। এমাসের দশ তারিখে আমাকে আসতেই হতো খোকা।

সবাই উৎসুক চোখে সরলার দিকে তাকিয়ে। সরলা কিন্তু টনির দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, দেখেছ কাণ্ড! ছেলেটা ঘুমে ঢুলছে। এইটুকুনি ছেলে এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকতে পারে। থাক ওকে আর খেতে হবে না। না না, তুমি বসো বউমা। আমি ওকে হাত ধুইয়ে শুইয়ে দিয়ে আসছি। চট করে উঠে বেসিনে নিজের হাত ধুয়ে টনিকে তুললেন সরলা। বেচারা সত্যি আর পারছিল না। কোনোরকমে হাত ধুইয়ে সরলা ওকে ওপরে নিয়ে গেলেন।

সৌরভ জিভে একটা শব্দ করল, মাঝখান থেকে মায়ের আর খাওয়া হলো না।

গৌরব এক দৃষ্টিতে মায়ের চলে যাওয়া দেখছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে সৌরভকে জিজ্ঞাসা করল, দশ তারিখে কী ব্যাপার দাদা?

দশ তারিখ। সৌরভ চিন্তা করল। তারপর বলল, ওহো। তার মুখ লাল হয়ে গেল আচমকা।

কী ব্যাপার? গৌরব এবার দাদার দিক থেকে বউদির দিকে ফিরল।

মলির ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসি জন্ম নিল। নিচু গলায় সে বলল, আমাদের বিয়ের তারিখ।

.

সকালবেলায় ড্রইংরুমে বসে মলি তার হিসেবের খাতায় কিছু লিখছিল। এখন তার পরনে নীল ডুরে কাটা সাদা শাড়ি। সাজগোজ তেমন নেই কিন্তু সে কারণেই বেশ মিষ্টি দেখাচ্ছে তাকে। উল্টোদিকের সোফায় বসে সৌরভ জুতোর ফিতে আঁটছিল। লিখতে লিখতে মলি জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আজ তোমার অফিসে না গেলেই নয়?

জুতো বাঁধা হয়ে গেলে সৌরভ বলল, একবার যেতেই হবে। ফাইল দুটোয় সই করে চলে আসব।

আজকের দিনে ছুটি নিলে ভালো করতে।

সেভেনটিনথ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে ছুটি চাইতে গেলে জুনিয়াররা ঠাট্টা করবে।

তাই নাকি? মলির নাক কুঁচকে গেল, তাহলে তো অ্যানিভার্সারিটা না করলেই পারতে।

সৌরভ হেসে উঠল শব্দ করে, তুমি এই চটজলদি রেগে যাওয়ার হ্যাবিটটা ত্যাগ করো। থাক, কতজনকে বললে?

কেটেছেঁটে পনেরো। মলি গম্ভীর গলায় জবাব দিলো। এখন কাঁচা বাজারে যেতে হবে।

মোক্ষদাকে পাঠাও। সৌরভ উঠে দাঁড়াতেই বেল বাজল। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল একটি পোস্টাল পিয়ন দাঁড়িয়ে, টেলিগ্রাম।

সৌরভ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, সেকি। কার টেলিগ্রাম?

পিওন সই করিয়ে খামটা দিয়ে গেলে সৌরভ কাঁপা হাতে সেটাকে খুলল। মলিও উদ্বিগ্ন মুখে উঠে এসেছিল কাছে। টেলিগ্রাম পড়ে সৌরভ সেটাকে বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। খবরটা জেনে মলি জিজ্ঞাসা করল, এখন কী করা যায়?

বুঝতে পারছি না। সৌরভ জবাব দিলো।

শোন, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মানেই মারা যায় নি। টেলিগ্রামটা একদিন দেরিতেও আসতে পারত। আজ বাড়িতে কাজ। আজ যদি ও চলে যায় তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। মলি বলল।

তাহলে?

শোন, বলতে হয় কালকে বলব। বাড়িতে এত লোকজন আসবে আমি একা সামলাতে পারব না!

সৌরভ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর। ও হ্যাঁ, গোরাকে এই ব্যাপারটা জানাতে যেও না। হি ইজ ভেরি মাচ সেন্টিমেন্টাল।

খেপেছ। গোরাকে আমার জানাতে বয়ে গেছে। মলি ফিরে এসে টেলিগ্রামটা হিসেবের খাতায় ঢুকিয়ে রাখল। সৌরভ বেরিয়ে গেল অফিসে। সেই সময় গৌরব নেমে এল ওপর থেকে। চিৎকার করে বলল, অনেক অভিনন্দন বউদি। তোমাদের দাম্পত্যজীবন দীর্ঘজীবী হোক।

মলি হেসে বলল, ফাজিল। কোথায় বেরুনো হচ্ছে?

স্রেফ আড্ডা মারতে। দেশটায় কতদিন পরে ফিরলাম। একটু ঘুরে-টুরে দেখি। আচ্ছা বউদি, জয়তী কোনোদিন এখানে ফোন করেছিল?

কে জয়তী?

ওঃ, তোমার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। আমরা কলেজে একসঙ্গে পড়তাম।

ওহো, তোমার সেই বান্ধবী? বছর তিনচার হলো তার কথা তো এ বাড়িতে শুনি না। আগে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। মাকে জিজ্ঞাসা করেছ?

হ্যাঁ। মাও একই কথা বলল।

বেশ, আমাকে এখন বেরুতে হবে।

কোথায়?

বাঃ, এতগুলো লোক খাবে বাড়িতে, কেনাকাটা নেই?

মোক্ষদাকে নিয়ে যাও।

মোক্ষদা? মলির মুখ গম্ভীর হলো, না। ও বাড়িতে থাক।

তাহলে চলো আমি তোমার সঙ্গী হই।

তুমি যাবে? বা, তাহলে খুব ভালো হলো। দাঁড়াও, আমি শাড়িটা পাল্টে আসি। মলি আনন্দিত হয়ে ওপরে উঠে গেলে গৌরব শিষ দিল। তারপর টেলিফোনের কাছে গিয়ে ডাইরেক্টরি খুঁজল। কাছাকাছি না পেয়ে সে চেয়ারের কাছে ফিরে এসে হিসেবের খাতাটাকে দেখতে পেল। ওটাকে তুলে নিয়ে আবার রাখতে গিয়ে টেলিগ্রামটা নজরে এল তার। একটু দ্বিধা করে সেটাকে খুলতেই মুখ গম্ভীর হয়ে গেল গৌরবের। ঠোঁট কামড়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে সে টেলিগ্রামটা যথাস্থানে রেখে দিল। তারপর চটজলদি রান্নার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

বাজার করে ঘর্মাক্ত হয়ে ফিরল ওরা। পনেরোজন লোক খাবে। এদের মধ্যে গৌরবদের মাসতুতো ভাই টুলুও আছে। গৌরব খুশি হলো, টুলু বিয়ে করেছে রত্নাকে। রত্না ওর সঙ্গে কলেজে পড়ত। জয়তীর সঙ্গে রত্নার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। হলঘরে ঢুকে মলি ডাকল, মোক্ষদা, মোক্ষদা! কেউ সাড়া দিল না। মলি উষ্ণ হলো। চাপা গলায় বলল, কি আশ্চর্য! কাজের তাড়ার মধ্যে কোথায় গেল সে! জিনিসপত্রগুলো এক জায়গায় রেখে সোফায় বসে গৌরব লক্ষ্য করছিল। সমস্ত বাড়িটা তোলপাড় করছে মলি। মোক্ষদা কোথাও নেই। সরলা পর্যন্ত অবাক। মোক্ষদা কোথাও গেলে না বলে যায় না। তাছাড়া এ পাড়ায় তার তেমন আড্ডাও নেই। ওপাশে পার্কের ধারে ওর এক বোনপো কাজ করে মুদির দোকানে। সেখানে মোক্ষদা যায় না, প্রয়োজনে ছেলেটি আসে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যখন মোক্ষদার দর্শন পাওয়া গেল না তখন মাথায় হাত পড়ল। মলি ভেবে পাচ্ছিল না কী করবে! এতগুলো লোক খাবে, বাজারহাট সব করা হয়ে গেছে, একা পেরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া মোক্ষদা চীনে এবং মোগলাই রান্নায় আজকাল এক্সপার্ট। সে থাকলে কোনো সমস্যাই থাকে না। এতদিনের পুরনো লোক না বলে কয়ে এমন-উধাও হয়ে যাবে কেউ চিন্তা করতে পারছেনা। এই সময় সৌরভ অফিসের বুড়ি ছুঁয়ে বাড়িতে ফিরতেই মলি তাকে সমস্যাটা জানাল। মোক্ষদা এ বাড়িতে আছে অনেককাল। কখনও এমন করেনি। এমনও হতে পারে সে কিছু আনতে দোকানে বেরিয়েছিল এবং পথে দুর্ঘটনা ঘটেছে। অতএব হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া দরকার। কিন্তু সেরকম কিছু হলে তো পাড়ার মধ্যেই হবে। সৌরভ একবার পাক দিয়ে এল। এমন কি মোক্ষদার বোনপোর সঙ্গে দেখা হলো তার। কোনো দুর্ঘটনা আজ সকালে ঘটেনি। বোনপো বলল, তার মাসীকে আজ দেখেনি।

সৌরভ শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব দিল শোন, আমার মনে হচ্ছে, মোক্ষদা যখন নেই, হোটেল থেকে খাবার আনা যাক। খরচ বেশি পড়বে কিন্তু এ ছাড়া কোনো উপায় নেই।

সরলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। মোক্ষদার এই ব্যবহারে তিনিও খুব আহত। মুখ তুলে বললেন, বাড়িতে নেমন্তন্ন করে হোটেলের খাবার খাওয়াবি?

সৌরভ বলল, এ ছাড়া আর উপায় কি মা। মলির পক্ষে এতো রান্না করা সম্ভব নয়। মাছ মাংস তুমি রান্না করো না। তাছাড়া তোমারও বয়স হয়েছে। এখন হোটেলই ভরসা।

মলি বলল, এখন এইগুলো নিয়ে আমি কী করি! এত মাছ মাংস ফ্রিজে ঢুকবে না। সব্জিগুলোর কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। আইসক্রিমের অর্ডার দিয়ে এসেছি। একটু পরেই সেসব এসে যাবে। এত টাকা লোকসান।

সৌরভ বলল, যা যাবার তা যাবে। মোক্ষদা এলে নিশ্চয়ই কৈফিয়ত চাইবে।

মলি ঠোঁট ওল্টাল, ওদের কৈফিয়ত! আমি বলি কি সবাইকে ফোন করে জানিয়ে দাও কোনো হোটেলে যেতে। আমরা বাড়ির বদলে হোটেলে করছি।

হোটেলে? সৌরভের কথাটা মনঃপুত হলো না।

হ্যাঁ। হোটেল থেকে না হয় খাবার আনলে। কিন্তু এত ডিশ গ্লাস কে ধোবে? বাসন মাজার লোকটার ওপর তো ভরসা করা যায় না।

এবার সৌরভ চিন্তিত হলো। এখন টেলিফোনে সবাইকে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এই শেষ সময়ে হোটেলে ব্যবস্থা করাটা সম্ভব হয়ে উঠলেও খবরটা হবে সীমা ছাড়ানো। তার খুব রাগ হচ্ছিল মোক্ষদার ওপরে। পুরো ব্যাপারটাই ডুবিয়ে দিলো। গৌরব এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। সে সোফা ছেড়ে উঠে চুপচাপ রান্নাঘরে চলে এল বাজারের ব্যাগগুলো দুহাতে তুলে। গ্যাস আছে, প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র। মোক্ষদা চমৎকার গুছিয়ে রেখেছে সব। রান্নাঘরের এবং ডাইনিং রুমের ছোট্ট একটা জানলা আছে। গৌরব ইশারায় সেখান থেকে বনানীকে ডাকল। বনানী এতক্ষণ বিপর্যয়ের কথা শুনছিল চুপচাপ। ডাক পেয়েই সে কাকার কাছে চলে এল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, তোর এখন কী করার আছে?

কিছু না। বনানী মাথা নাড়ল।

তাহলে আমার সঙ্গে হাত লাগা। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি কিভাবে সব্জিগুলো কাটবি, ঠিক সেই ভাবে ছুরি দিয়ে কাটতে আরম্ভ কর। পারবি না?

এই বয়স অবধি কখনো রান্নাঘরের ত্রিসীমা মাড়ায়নি বনানী। কিন্তু আজ ব্যাপারটা তার কাছে বেশ অভিনব মনে হলো। সে জিজ্ঞাসা করল, কে রান্না করবে?

সবাই। গৌরব কাজ আরম্ভ করল।

তখন মলি সরলাকে জিজ্ঞাসা করছে, আচ্ছা বাইরে থেকে কেউ এসে মোক্ষদাকে কোনো খবর দেয়নি তো? আপনি ঠিক জানেন?

সরলা মাথা নাড়লেন, কেউ তো বেল বাজায়নি বউমা।

মলি সৌরভের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করল। এই সময় গৌরব রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল, বউদি, তোমাদের বিবাহবার্ষিকীতে কী কী মেনু হবে বলো?

মলি হকচকিয়ে গেল, তার মানে?

মানে টানে কিছু নেই। চটপট বলে ফেলো। আমাকে আর একবার বাজারে যেতে হবে।

সৌরভ বলল, তুই কী বলছিস? আমার মাথায় ঢুকছে না।

তোমরা যে কজনকে ইনভাইট করেছ তাদের রান্না করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। শুধু বলো, এখানকার লেটেস্ট মেনু কী!

কে রান্না করবে?

কেন আমি? হাঁ করে দেখছ কী?

সরলা চাপা গলায় বললেন, আর মাথা খারাপ করে দিস না গোরা। কোনো কালে তুই রান্নাঘরে ঢুকলি না আর আজ রান্না করবি?

গৌরব হেসে ফেলল, তুমি আমাকে কী ভাবো বলতো মা? বারো বছর আমেরিকায় আছি, ওখানে আমার রান্না করে দেয় কে? যত বড়লোকই হোক বাড়িতে তো কারও চাকরবাকর নেই। চাকরের যা মাইনে তা দিতে গেলে পথে বসতে হবে। সেটাও আবার ওখানে বেআইনি। আমি এখন চাইনিজ মোগলাই এবং ইংলিশ চমৎকার রাঁধতে পারি।

মলি অবিশ্বাসীর গলায় বলল, সত্যি?

একশোবার সত্যি। ওখানে কারও বাড়িতে পার্টি থাকলে আমাকে তোয়াজ করে ডেকে নিয়ে যায়। বলো মেনু কী হবে? গৌরব হাসছিল।

সৌরভ কিন্তু কিন্তু করে বলল, আমার বাবা বিশ্বাস হচ্ছে না। দেখ গোরা, এটা ফাজলামির ব্যাপার না। এতগুলো লোক আসবে, শেষ পর্যন্ত বেইজ্জত না হই।

সেটা আমার ওপরে ছেড়ে দাও। বউদি চটপট।

মলি আনন্দিত এবং লজ্জিত একই সঙ্গে। সে বলল, কী বলি বলোতো। যা বাজার হয়েছে তাতে ঠিক ছিল ফ্রায়েড রাইস, চিলিচিকেন, চিংড়ির একটু টকমিষ্টি, আর স্মোকড ইলিশ।

ব্যস? গৌরব হাত নাড়ল, এ তো দেখতে দেখতে হয়ে যাবে। দাদা, তুমি একটা কাজ করো। দুডজন ভালো পেপার প্লেট এবং গ্লাস কিনে আনো। তাহলে আর বাসন ধোয়ার ঝামেলা হবে না। আর বউদি তুমি ঘরদোর একটু গুছিয়ে ফেলো। বনি আমাকে হেল্প করছে, আর কাউকে রান্নাঘরে ঢুকতে হবে না।

সরলা বললেন, তুই যে কী করছিস আমি বুঝতে পারছি না। আমি বরং তোর সঙ্গে থাকি।

মাথা নাড়ল গৌরব, উঁহু। তোমার ওপরে অন্য কাজ দিচ্ছি। তুমি টনিকে সামলাও। আচ্ছা, সবাই যে যার কাজে লেগে যাও।

.

এতো সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠান শেষ হবে কেউ ভাবেনি। প্রতিটি খাবারের প্রশংসায় অতিথিরা পঞ্চমুখ। রত্নার শরীর খারাপ বলে সে আসেনি। টুলু এসেছিল। গৌরবের চেয়ে বয়সে বছর দুয়েকের বড় কিন্তু দেখে মনে হয় না। টুলু জিজ্ঞাসা করল, সত্যি তুই এইসব রান্না করেছিস?

গৌরব হাসছিল। এতোক্ষণ এখানে প্রচুর মদ্যপানের সঙ্গে তার ওপর প্রশংসা বর্ষিত হয়েছে। সবাই চলে গেলেও টুলু বসে কথা বলছিল। তার কথায় এখন সামান্য জড়ানো ভাব। সে তখনও তাকিয়ে আছে দেখে গৌরব বলল, আমেরিকায় বারো বছর থেকে এই সব দিশি রান্না শিখেছি। হ্যাঁ আমেরিকানরা তো এইসব রান্না করে না। রেস্তোরাঁতে গিয়ে চাউমেন চাইলে যা দেবে তা দেখে চোখ কপালে উঠবে। ওদের লামেন হলো আমাদের চাউমেন। অবশ্য চীনে রেস্তোরাঁয়।

ইয়ার্কি মারিস না। শুনেছি তুই কম্পুটার নিয়ে পড়াশোনা করেছিস। সেই সঙ্গে এইসব শিখলি কী করে? সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছি। টুলু বলছিল।

না শিখলে স্যান্ডুইচ আর হামবার্গার খেয়ে থাকতে হতো। ওখানে যে যার নিজের কাজ নিজেই করে। করতে হয়।

তুই কি আমেরিকায় থেকে যাবি?

দেশে এসে মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যাই। আমি যে বিষয়ে স্পেশালাইজড সে বিষয়ে কাজ করার সুযোগ পেলেই এখানে থেকে যাব।

কিন্তু ও দেশের মতো টাকা তো এখানে আশা করাই যাবে না।

টাকা তো কোনো ফ্যাক্টর নয়। মোটামুটি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার পক্ষে যথেষ্ট টাকা পেলেই চলবে। মায়ের কাছে তো থাকা যাবে।

টুলু উঠে দাঁড়াল, এবার বিয়ে-থা কর। বউদি গোরার জন্যে ভালো পাত্রী চাই?

মলি খুশি মনে কথাবার্তা শুনছিল। এতবড় ঝামেলা, এত সহযে যে উৎরে যাবে তা সে ভাবতে পারেনি। শুধু উৎরে যাওয়া নয় প্রত্যেকে প্রশংসা করেছে। এবার টুলুর প্রশ্নের জবাবে বলল, দাও না ভাই, তোমার হাতে যদি ভালো মেয়ে থাকে তাহলে ওকে ধরে বসিয়ে দিই।

আমার মতো কপাল যেন না হয়। টুলু বিড় বিড় করা মাত্র টেলিফোন বাজল।

সৌরভ উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরল, হ্যাঁ, কে বলছেন? মেশোমশাই? হ্যাঁ টুলু এখানে আছে। সৌরভ ইঙ্গিতে টুলুকে রিসিভার নিতে বলল।

আমার ফোন! একটু বিস্মিত হয়ে রিসিভার কানে নিল টুলু, হ্যালো।

কথাগুলো শুনে রিসিভার নামিয়ে রেখে টুলু উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, আমাকে এখনই চলে যেতে হবে।

গৌরব উঠে এল, কেন কী হয়েছে?

টুলু একটু অন্যমনস্ক। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল–রত্না আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। এখন ভালো।

বেরিয়ে গেলে গৌরব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বল তো?

সৌরভ বলল, বুঝতে পারছি না। মেসোমশাই তো টুলুকে ডেকে দিতে বললেন।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, টুলু কি সুখী নয়? অসুখী হলেই তো আত্মহত্যা করার কথা ভাবে লোকে। আমার মনে হয় এখনই ওদের বাড়িতে যাওয়া দরকার।

মলি বলল, মনে হয় ব্যাপারটা খুব সিরিয়াস কিছু নয়। টুলুতো বলে গেল রত্না এখন ভালো আছে। মেসোমশাইও তো কিছু বলতে চাননি। এখন গেলে বোধহয় ওদের বিব্রত করা হবে। যদি যেতেই হয়–।

মলিকে থামিয়ে দিয়ে সৌরভ বলল, কাল যাস। আজ অনেক খাটুনি গেল, এখন রেস্ট নে।

গৌরব বুঝতে পারছিল এই রাত্রে টুলুদের বাড়িতে যাওয়াটা কেউ পছন্দ করছে না। তার মনে পড়ল খবরটা পেয়ে টুলুও তাদের সাহায্য চায়নি। কিন্তু রত্না কেন আত্মহত্যা করতে চাইবে?

টেবিলজোড়া কাগজের প্লেট, এবং উচ্ছিষ্ট। সে উঠে প্লেটগুলো একটা ট্রের ওপর জড়ো করতে করতে বনিকে ডাল, আয় বনি, ওগুলো পরিষ্কার করে ফেলি।

মলি হাঁ হাঁ করে উঠল, না না, ওসব তোমাদের করতে হবে না। কাল সকালে ঠিকে ঝি এলে ও পরিষ্কার করবে। তোমরা কেন নোংরায় হাত দেবে।

গৌরবের প্লেট গ্লাস গোছানো হয়ে গেছিল। বনির হাতে ট্রে তুলে দিয়ে বলল, ডাস্টবিনের পাশে রেখে দে। আর একটা ডাস্টার নিয়ে আয়। কী বলছিলে বউদি? সারাদিন তো নিজেরাই সবকিছু করলে। এই সামান্য কাজটা শেষ করলে বাড়ি ছিমছাম হয়ে যায়। আমরা ওদেশে নিজেদের প্লেট ডিশ নিজেরাই পরিষ্কার করি। এনেছিস? বনির হাত থেকে ডাস্টার নিয়ে চটপট টেবিল পরিষ্কার করতে করতে গৌরব বলল, চেয়ারগুলো সাজিয়ে রাখ। জানো বউদি, পৃথিবীতে কেউ অবশ্যই প্রয়োজনীয় নয়। একজন না থাকলে সব ভেস্তে যাবে কেন? নিজেরা যদি নিজেদেরটা করে নিই তাহলে কোনো সমস্যাই থাকে না। আমাদের দেশের নিয়মটাই গোলমেলে। এক কাপ চায়ের জন্যেও ছেলেরা হয় কাজের লোক কিংবা মেয়েদের ওপর নির্ভর করে থাকে।

সৌরভ বলল, আমাকে কিচেনে ঢুকতেই দেবে না।

মলি প্রতিবাদ করল, বাজে বকবে না। তুমি নিজে চা করবে? তা ভাই ঠিকই বলেছ গোরা। কাজের লোক আর মেয়েদের মধ্যে কোনো তফাত রাখবে না ছেলেরা।

সৌরভ উঠে দাঁড়াল, যত আজেবাজে কথা। আমার ঘুম পাচ্ছে।

গৌরব বলল নিজেরা এবার থেকে হাত লাগাও। স্বাবলম্বন না কি যেন বলে!

সৌরভ বলল, ঠেলায় না পড়লে হবে না। আজ মোক্ষদা হাওয়া হয়ে গেল বলে। আচ্ছা, মোক্ষদার কথা তো আর তালে-গোলে মনেই ছিল না। মলি, আমি একবার থানায় ফোন করি। যদি কিছু হয়ে থাকে তাহলে থানা থেকে আমাদেরই দোষ দেবে।

হেসে ফেলল গৌরব, মোক্ষদার কিছু হয়নি দাদা।

কিছু হয়নি মানে?

আমি ওকে দেশে পাঠিয়েছি।

তুই? তুই জানতিস?

হ্যাঁ। বেচারার মেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ। নইলে টেলিগ্রাম পাঠাত না। অথচ আমাদের ফাংশন নষ্ট হবে বলে ওকে তোমরা জানাচ্ছিলে না খবরটা। ঠিক করোনি। আমিই ওকে চুপচাপ দেশে পাঠিয়েছি। কিন্তু তাই বলে এখানে তো কারও কোনো অসুবিধে হয়নি। তাই না? চলো ওঠো, ওঠো, অনেক রাত হয়ে গেছে। গৌরব তাড়া দিল।

মলির চিবুক নেমে এসেছিল বুকে। সৌরভ নিচু গলায় বলল, চলো।

.

সকালবেলায় টুলুর ফোন এল। রত্না এখন ভালো আছে। ইদানীং মানসিক স্থিতি ছিল না ওর! বাথরুমে গিয়ে ও গলায় দড়ি দেবার চেষ্টা করছিল। মাসীমার নজরে পড়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। টুলু সৌরভকে ফোনে চাইল। সৌরভ সব শুনে বলল, দেখি আমি কী করতে পারি। তুমি দুটো দিন অপেক্ষা করো।

সরলা উদ্বিগ্ন হয়ে শুনেছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন– কী হয়েছে?

সৌরভকে চিন্তিত দেখালো, টুলু বলছে রত্নাকে ভালো মেন্টাল অ্যাসাইলামে ভর্তি করতে চায়। আমার এক জায়গায় জানাশোনা আছে ও জানত। তাই রিকোয়েস্ট করছে।

সে কী? খামোকা মেয়েটাকে পাগলা গারদে দেবে কেন?

সৌরভ বলল, ওদের বাড়ির বউ, ওরা যা ভালো বুঝছে করছে। টুলু বলল বাড়ির কেচ্ছা বাইরে যাক চাই না, কিন্তু তোমার সাহায্য চাই।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, রত্নার মাথা কবে থেকে খারাপ হলো মা?

সরলা মাথা নাড়লেন, বিয়ের সময় দেখেছিলাম। আসা-যাওয়া তো নেই আজকাল। কিন্তু তখন তো আমার সুস্থ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। আমার মনে পড়ছে মেয়েটা বেশ হেসে তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। জয়তীও ছিল। ওই মেয়ে পাগল হয়ে গেল কী করে? খোকা, তুই চেষ্টা কর মেয়েটা যাতে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওঠে। নইলে আমার জামাইবাবুকে তো আমি চিনি।

কি চেনো? গৌরব জিজ্ঞাসা করল।

রত্না পাগল বলে বিয়ে ভেঙে দিতে কতক্ষণ!

সৌরভের চোয়াল শক্ত হলো, দেখি।

.

কলকাতার রাস্তায় হাঁটলে বুক ভরে যায় গৌরবের। যতই খোঁড়াখুঁড়ি, ট্রাফিক জ্যাম হোক কলকাতা ইজ কলকাতা। খুব দূরে না হলে সে ট্যাক্সি নেয় না। অবশ্য বাসের ভিড় সে এড়িয়ে চলে। পায়ে হেঁটে হাঁটার একটা মজা আছে। পরিচিত জায়গাগুলোকে আরও নিজের বলে মনে হয়। পুরনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি। গতকাল সে জয়তীদের বাড়িতে গিয়ে অবাক হয়েছিল। জয়তীরা বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। এখন ওরা কোথায় গিয়েছে বাড়িওয়ালা বলতে পারলেন না। তবে পাইকপাড়ার টালাপার্কের কাছে কোথাও বলে জানালেন। জয়তীর বাবা মারা গেছেন, এই খবরটাও সে প্রথম জানল।

বারো বছর ধরে জয়তীর জন্যে একটা কষ্ট বুকে রেখেছে গৌরব। ও এমন একটা মেয়ে যাকে ধরা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। সে যখন প্রথম আমেরিকায় গেল তখন নিয়মিত চিঠি পেত। একটু গুছিয়ে নিয়ে যখন জয়তীকে সে ওদেশে যেতে লিখল তখন থেকেই মেয়েটা একটু একটু করে দূরে সরে যেতে চাইল। একসময় গৌরব লিখেছিল, যদি জয়তী মনে করে তাহলে পছন্দমত মানুষের সঙ্গে জীবন শুরু করতে পারে। যদি কোনো দায় থেকেই থাকে তাহলে গৌরব তা তুলে নিতে প্রস্তুত। তারপর থেকেই চিঠিপত্র বন্ধ। সত্যি, কোনো মেয়েকে সে সুখী করতে পারবে না যখন, তখন তাকে কেন আশায় রাখবে। তবু দেশে ফেরার সময় তার মনে হয়েছিল হয়তো জয়তী বিয়ে করেনি। বাড়িওয়ালাকে সেকথা জিজ্ঞেস করা যায়নি। কিন্তু পাইকপাড়ার ঠিকানাটা খুঁজে বের করতেই হবে।

টুলুদের বাড়িটা বেশ অভিজাত এলাকায়। মেসোমশাই বড়লোক ছিলেন কিন্তু এতটা অবস্থা ভালো বুঝতে পারেনি গৌরব। গ্যারেজে দুটো গাড়ি। নতুন কোলাপসিবল গেট বসেছে। শুধু দারোয়ানটাই যা নেই। যে চাকরটা দরজা খুলল তাকে সে কোনো দিন দ্যাখেনি। পরিচয় ভেতরে নিয়ে গিয়ে অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত সে গৌরবকে বাইরে বসিয়ে রাখল। তারপর গৌরবকে ডেকে পৌঁছে দিল যে ঘরে সেখানে মেসোমশাই একা বসে দাবা খেলছেন। গৌরব দেখল মেসোমশাই বেশ মোটা হয়েছেন। গিলে করা পাঞ্জাবি এবং মসৃণ টাকে তাঁকে সফল মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

এই যে গৌরব। টুলুর মুখে শুনলাম তুমি দেশে ফিরেছ। কেমন আছ? দাবার বোর্ড থেকে একবার চোখ সরিয়ে গৌরবকে দেখলেন মেসোমশাই।

ভালো। আপনারা কেমন আছেন?

আর আমরা। একমাত্র ছেলের বিয়ে দিয়ে এখন! শুনেছ বোধহয়। টুলু তো কাল তোমাদের বাড়িতেই ছিল। সবই কপাল, তোমার দাদা কিছু খবর দিয়েছে?

না। টুলু সকালে ওকে ফোন করেছিল। ও খোঁজ নিয়ে জানাবে। রত্নার কী হয়েছে?

তুমি বউমাকে চেন? ও হ্যাঁ, তাই তো শুনেছিলাম। সত্যি কথা বলোতো, ওর কি আগে কারো সঙ্গে ইনভলভমেন্ট ছিল?

আমি জানি না মেসোমশাই।

হুঁ। আবার দাবার দিকে মন দিতে দিতে বললেন, কদ্দিন আছ?

আছি কিছুদিন। মেসোমশাই, মাসীমা কোথায়?

মাসীমা আর টুলু একটু বেরিয়েছে। এই ব্যাপারেই। পেটটা ভালো নেই হে, তুমি বসো, আমি একটু টয়লেট থেকে ঘুরে আসি। খুব তাড়াতাড়ি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। পুরো বাড়িটাই শব্দহীন। কিছুক্ষণ একা বসে থেকে গৌরব উঠল। টুলুর বউ রত্নাকে দেখতে তার খুব ইচ্ছে করছিল। বারো বছর পর রত্নাকে সে স্পষ্ট মনে করতে পারছে না কিন্তু আবছা ভাবতে পারছে। রত্না কি এখন এই বাড়িতেই আছে? নাকি ওর বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে ওরা। গৌরব উঠল। ভেতরে কেউ নেই। দোতলায় উঠে এল সে। টুলুর ঘরটা বন্ধ। দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ কি? ঠেলতেই খুলে গেল। আর দৃশ্যটা দেখে চমকে উঠল সে। ডাবলবেড খাটের মাঝখানে যে মেয়েটি শুয়ে আছে, তার হাত পা চারটে দড়িতে বাঁধা। দরজার শব্দ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে অস্ফুট চিৎকার করে উঠল মেয়েটি। এবং তখনই রত্নাকে চিনতে পারল গৌরব। সে অবাক বিস্ময়ে উচ্চারণ করল, রত্না!

রত্নার চোখে মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। সে বিড় বিড় করল, কে আপনি, কী চান?

রত্না, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি গৌরব।

গৌরব! ও, গৌরব। কী করতে এসেছ তুমি? মজা দেখতে? পাগল দেখতে। আঃ। চোখ বন্ধ করল রত্না আর তার গালের শুকনো জলের দাগ আবার ভিজে উঠল।

গৌরব চটপট পাশে এসে দাঁড়াল, কী হয়েছে তোমার?

আমি পাগল। ওরা আমাকে পাগল বলছে। আমি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম তাই।

কথা বলছে রত্না অস্বাভাবিক চোখে মুখে। গৌরব আবার জিজ্ঞাসা করল, কেন আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলে? কীসের দুঃখ তোমার?

আমার বাবাকে বাঁচাতে।

ঠিক সেই সময় মাসীমা এসে দরজায় দাঁড়ালেন, গোরা!

গৌরব ঘুরে দাঁড়াল, এই যে মাসীমা!

তুই হঠাৎ ওপরে চলে এলি কেন?

না, মানে–।

আয় নিচে আয়।

গৌরব রত্নার দিকে আর একবার তাকিয়ে মাসীমাকে অনুসরণ করল। বাইরে বেরিয়ে মাসীমা বললেন, তুই দেশে ফিরেছিস তা টুলুর কাছে শুনেছিলাম।

হ্যাঁ, অনেকদিন বাদে এসে অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড দেখছি। তুমি কেমন আছ মাসীমা?

এই নিয়ে কী করে ভালো থাকি। দেখলি তো নিজের চোখে।

রত্নাকে বেঁধে রাখা হয়েছে কেন?

বউমাকে তুই–! ও হ্যাঁ, মনে পড়ছে। তোরা একসঙ্গে পড়তিস। ওর কি মাথার দোষ ছিল?

না, আমার তো মনে পড়ছে না। খুব ব্রাইট মেয়ে ছিল রত্না।

বেঁধে না রাখলে সামলানো যাচ্ছে না। হয়তো আমাদেরই খুন করে ফেলবে।

কী করে হলো এমন?

জানি না। একদিন ওর বাবা ফোন করল তারপর থেকেই এইসব হচ্ছে। আসলে ওই বাড়িতে সম্বন্ধ করাটাই ভুল হয়ে গেছে। রত্নার বাবা সৎ মানুষ নন। তাঁর কথার ঠিক নেই। যাকগে। ওকে আমরা বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু তোর মেসোমশাই বললেন, বাড়ির বউয়ের চিকিৎসা বাড়িতেই করব। তাছাড়া নিজেদের লজ্জার কথা পাঁচজনে জানুক তাও চাই না। তোর দাদার হাত আছে হাসপাতালে তাই বলা। তোকে কী বলল ও?

সাধারণ কথাবার্তা।

ওইতো! শুনলে মনে হবে ভালো মানুষ। কিন্তু সেটাও পাগলামি। আয় চা খাবি। মাসীমা নিচের দিকে পা বাড়াল। গোরার বিন্দুমাত্র চায়ের প্রয়োজন ছিল না। সে নামতে নামতে বলল, মাসীমা, আজ চা থাক। আর একদিন এসে খেয়ে যাব।

মাসীমা চোখ তুললেন, প্রথম দিন বাড়িতে এসে না খেয়ে যাবি! ও হ্যাঁ, দিদি কেমন আছে?

ভালো।

রাণাঘাট থেকে শেষ পর্যন্ত ফিরল!

গৌরব উত্তর দিল না। মাসীমা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ছেলের বউ এনে দিদি শেষ পর্যন্ত ঘর ছাড়া হলো তো। তুই না এলে দাদার গলগ্রহ হয়ে থাকতে হতো। মলি এখন দিদির সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে? বাড়িতে মদের ফোয়ারা এখনও চলছে?

গৌরব হাসল, যা বলেছ। তবে ফোয়ারা একবার চালু হলে থামা বড় মুশকিল। চলি মাসীমা, টুলুকে বোলো এসেছিলাম। মেসোমশাই কোথায়?

সে দাবা নিয়ে ব্যস্ত। মাসীমা দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।

রাস্তায় বেরিয়ে ঠোঁট কামড়াল গৌরব। রত্নার কথাবার্তায় যদি অস্বাভাবিকতা এসেও থাকে তাহলে কি ওভাবে বেঁধে রাখার জন্যে? না সত্যি পাগল হয়ে গেছে মেয়েটা! দ্বিতীয় চিন্তাটা কিছুতেই মনে ধরল না তার। কলেজে পড়ার সময় একদিন জয়তী আর সে রত্নার বাড়িতে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিটের জন্যে। পাড়াটা মনে আছে। গৌরব ঠিক করল সে একবার রত্নার বাড়িতে যাবে। রত্নার বাবা এ ব্যাপারে কী বলেন শোনা দরকার।

.

বাড়িটাকে চিনে বের করতে অসুবিধে হলো না। কিছু কিছু স্মৃতিকে দূর থেকে খুব অস্পষ্ট মনে হয়। মুখোমুখি হলে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় আচমকা। রত্নার বাবাই দরজা খুললেন। এই বারো বছরে লোকটি কতটা বদলেছে তার মনে নেই। তবে সমস্ত চুল সাদা, চোখের তলায় ভাঁজ এই প্রায় বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?

গৌরব বলল, আমি আর রত্না একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। আপনি তো ওর বাবা?

হ্যাঁ। কিন্তু তার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে।

জানি। সেই সুবাদেও আমি আত্মীয়। আমার নাম গৌরব। আমেরিকায় চাকরি করি। আমার মাসীমার ছেলে হলো টুলু। গৌরব এগিয়ে এসে প্রণাম করতেই ভদ্রলোক বললেন, ও, হ্যাঁ তোমার কথা শুনেছি রত্নার কাছে। এসো এসো, ভেতরে এসো।

বসবার ঘরটি ঠিক যত্নে নেই। গোরা বসতেই ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে চাকরকে ডাকাডাকি করতে লাগলেন। গোরা বলল, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। আমি এখন চা খাব না।

ও! রত্নার বাবা চেয়ারে বসলেন, আসলে বাড়িতে কোনো মহিলা নেই তো।

ঠিক আছে। মেসোমশাই, আমি একটু আগে রত্নাকে দেখে আসছি।

ও। কেমন আছে রত্না? বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আপনি কিছুই জানেন না?

কী ব্যাপারে?

গৌরব একবার ভাবল বলবে কি না। ওরা কি এঁকে জানায়নি রত্নার আত্মহত্যার চেষ্টার কথা! সে বলল, ও বাড়িতে গিয়ে শুনলাম রত্নার মানসিক গোলমাল হয়েছে।

মিথ্যে কথা। টুলুর বাবা এইভাবে আমার ওপরে চাপ দিচ্ছে।

চাপ দিচ্ছে! কেন?

বৃদ্ধ চকিতে তাকালো গৌরবের দিকে। তারপর মুখ নামিয়ে বললেন, সে আমার অক্ষমতার কথা বাবা, লজ্জার কথা। তোমাকে বলাটা–!

আপনি বলতে পারেন।

একটা নিশ্বাস বৃদ্ধের বুক খালি করল। ছেলে ভালো বলে মেয়েকে লুকিয়ে আমি কথা দিয়েছিলাম পঞ্চাশ ভরি সোনা আর পঞ্চাশ হাজার নগদ দেব। সোনা কিনতেই ফতুর হয়ে গেলাম। এখনও তিরিশ হাজার টাকা দিতে পারিনি। উনি অনেকবার চেয়েছেন। শেষে মেয়ে যখন জানতে পারল তখন থেকেই কেলেঙ্কারি।

গৌরবের চোয়াল শক্ত হলো, কী কেলেঙ্কারি?

সে খেপে গেল। কেন আমি এই ভাবে বিয়ে দিলাম। অনেক বুঝিয়ে পাঠিয়েছি ওখানে। কিন্তু কিছুদিন থেকে শুনছি মেয়ের নাকি মাথা খারাপ হয়েছে। আমি ছুটে গিয়েছিলাম, দেখা করতে দেয়নি ওরা। বলেছিলাম ধার করে মেয়ের চিকিৎসা করাব। সে কথাও শোনেনি। তিরিশ হাজার না দিলে উনি আমার মুখ দর্শন করবেন না। আমি মিথ্যুক, অসৎ। কান্নায় বৃদ্ধের গলা বুজে এল। গৌরব একটু সময় দিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কি বিশ্বাস করেন রত্না সুস্থ?

হ্যাঁ। অবশ্যই।

কেন এই বিশ্বাস?

কোনোদিন সে অসুস্থ ছিল না।

কিন্তু নতুন পরিস্থিতিতে আচমকাই মানুষের মস্তিষ্ক বিকৃত হতে পারে।

তাহলে গত সপ্তাহে আমি ওর চিঠি পেলাম কী করে?

গত সপ্তাহে? চিঠিটা দেখাতে পারেন?

হ্যাঁ। বৃদ্ধ উঠে ভেতরে গেলেন। গৌরব মেসোমশাইকে এই ভূমিকায় ভাবতে পারছিল না। টুলুর বিয়ে দিয়েছেন এত টাকার বিনিময়ে? পুরোটা না পাওয়ায় এই চাপ দিচ্ছেন। এতদিনের দেখা মানুষটা! কিন্তু রত্নার সঙ্গে কথা বলেও তো তাকে পাগল মনে হয়নি। বৃদ্ধ চিঠিটা এনে দিলো। একটা ইনল্যান্ড লেটার। চিঠিটা পড়ল গৌরব–

বাবা, তুমি কিছুতেই ওদের একটা পয়সা দেবে না। আমার শরীরটার দাম কি পঞ্চাশ ভরি সোনা আর পঞ্চাশ হাজার টাকা। তুমি যে অন্যায় আমাকে না জানিয়ে করেছ তা আর শোধরাবার উপায় নেই। কিন্ত আর নয়। এবার হয়তো বাড়ি বাঁধা দিয়ে ওই টাকার ব্যবস্থা করবে। কেন? আমাকে সুখী করবার জন্যে? বাবা, তুমি যদি ওদের দাবি মেনে নিতে চাও তাহলে আমি আত্মহত্যা করব। আত্মহত্যা করলে তো আর টাকাটা দিতে হবে না। টাকা না পেয়ে ওরা আমাকে পাগল প্রমাণ করতে চাইছে। পাগল বউকে তাড়ানো খুব সোজা। আমি স্বেচ্ছায় ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলাম। এরা আমার কথা বিশ্বাস করছে না। শেষবার আমার কথা ভেবো। এই চিঠি লিখছি লুকিয়ে। বাড়ির ঝি যদি দয়া করে পোস্ট করে তাহলেই তুমি পাবে। ইতি তোমার হতভাগিনী মেয়ে রত্না।

গৌরব কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। বৃদ্ধ বললেন, তুমি বলো বাবা, এইরকম চিঠি কোনো পাগল কি লিখতে পারে? না, আমার মেয়ে পাগল নয়। ওরা পাগল বলছে যাতে খোরপোষ দিতে না হয়। আমি যে কী করি এখন।

কী করবেন? পুলিশে যান।

পুলিশে? না না। ঘরের কথা বাইরে যাক এ আমি চাই না। পুলিশ মানেই আইন আদালত, খবরের কাগজ। না, ওসব চিন্তা আমি করি না।

তাহলে?

আমি মেয়েকে লুকিয়ে টাকাটা তোমার মেসোমশাইকে দিয়ে আসব। সত্যি এই বাড়ি আমি বন্ধক রাখতে যাচ্ছি। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, আপনি বিশ্বাস করে এই চিঠিটা আমাকে দিতে পারবেন?

বিশ্বাস করে বলছ কেন?

আমি তো ওদের হয়ে এসে এই চিঠি নিয়ে যেতে পারি।

তাতে আমার কী ক্ষতি! আমি তো মামলা করতে যাচ্ছি না। তুমি প্রথমেই পরিচয় দিলে রত্নার বন্ধু বলে। তুমি নিশ্চয় ওর ভালো চাইবে।

আপনাকে আমি বলছি, রত্না বোধহয়, আচ্ছা, চলি। কথাটা বলল না গৌরব। আত্মহত্যার চেষ্টার কথা বললে বৃদ্ধ খুব ঘাবড়ে যাবেন।

তুমি কি ওখানে, মানে, টুলুদের বাড়িতে যাচ্ছ?

হ্যাঁ।

তাহলে একটা চিঠি রত্নাকে দিতে পারবে?

কী চিঠি?

ওর নামে একটা স্কুল থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার আছে। বিয়ের আগে ইন্টার দিয়েছিল। তারা অ্যাদ্দিনে চাকরি দিয়েছে। এখন তো এর কোনো প্রয়োজন নেই। তবু যার চিঠি তাকে পৌঁছে দাও। বৃদ্ধ ভেতরে চলে গেলেন চিঠিটা আনতে।

.

টুলু বলল, আমার কিছু করার নেই গোরা। তুই বাবার সঙ্গে কথা বল।

গৌরব বলল, সেকী তোর বউ আর তোর কিছু করার নেই?

এই বাড়িটা এখনও পিতৃতান্ত্রিক পরিবার। আর আমি নিয়মটা মেনে চলছি। রত্নার সঙ্গে আমার কোনো আন্ডারস্ট্যান্ডিং, আজ অবধি হয়নি। মানসিক অস্থিরতা না থাকলে কেউ আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে না! টুলু জানাল

মেসোমশাই কোথায়?

বাবা একটু বেরিয়েছে মায়ের সঙ্গে।

একটু ইতস্তত করল গৌরব। তারপর বলল, আমি একবার রত্নার সঙ্গে দেখা করব।

কেন?

এমনি। তোর আপত্তি আছে?

টুলু বুঝতে পারছিল না কী বলবে। শেষপর্যন্ত মাথা নাড়ল, কাছাকাছি যাস না, একটু আগে আমাকে কামড়ে দিতে চেয়েছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নেমে আসিস। বাবা পছন্দ করবে না।

ধন্যবাদ। তুই ততক্ষণ এই চিঠিটা পড়। রত্না ওর বাবাকে কদিন আগে যে চিঠি লিখেছিল এটা তার জেরক্স কপি। গৌরব চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল।

রত্না শুয়েছিল চোখ বন্ধ করে। গৌরব ডাকল, রত্না।

চোখ খুলে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস ভঙ্গি করল রত্না, আবার এসেছ? কী চাই তোমার? কাছে এসো না, কামড়ে দেব।

তুমি আমার সঙ্গে পাগলামি করো না।

গৌরবের কথাটা শোনামাত্র রত্না যেন একটু ঘাবড়ে গেল। গৌরব বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই, তোমার বাবার সঙ্গে আমি একটু আগে কথা বলেছি। কথা বলতে বলতে গৌরব রত্নার বাঁধন খুলে দিল। বন্ধনমুক্ত হয়েও রত্না কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে পড়ে রইল। গৌরব ওর হাত ধরল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।

ওরা যখন নিচে নামছে তখন, সিঁড়ির মুখে মেসোমশাই, মাসীমা। টুলুকে দেখা যাচ্ছে না। মেসোমশাই উত্তেজিত গলায় প্রশ্ন করলেন, কী হচ্ছে এসব। কে তোমাকে ওর বাঁধন খুলতে বলেছে?

আপনি অযথা রাগ করছেন। রত্না পাগল নয়।

সেটা ডাক্তার বলবে। তুমি সীমা ছাড়াচ্ছ গৌরব।

না। রত্না আমার বন্ধু। ওর বাড়িতে গিয়ে আমি প্রমাণ পেয়েছি আপনি কি জাল ছড়িয়েছিলেন। ওকে আমি বাড়ির বাইরে নিয়ে যাচ্ছি।

মেসোমশাই চিৎকার করলেন, এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে তোমার জন্যে দরজা চিরকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে বউমা।

গৌরব বলল, ও-আর এখানে আসবে না। আপনাকে একটা খবর দিচ্ছি– রত্না একটা চাকরি পেয়েছে। মাসে পনেরশো টাকা মাইনে। বছরে আঠারো হাজার।

প্রায় তিরিশ বছর কাজ করলে ও মোট পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার টাকার ওপর রোজগার করবে। মনে হয় এই টাকায় ওর চলে যাবে।

মাসীমা হতভম্ব গলায় বললেন, পাঁচ লক্ষ চল্লিশ হাজার! ও বউমা তুমি এই বাড়ির লক্ষ্মী। গোরার কথা কানে নিও না। ভুল বোঝাবুঝি তো মানুষ মাত্রেরই হয়। তুমি এসো আমার কাছে।

রত্না মাথা নাড়ল, না, আমাকে যেতে দিন। আপনার ছেলে কোথায়?

সে নিচের ঘরে। মাসীমা জানালেন।

চলো গৌরব। ওদের বিস্মিত মুখের পাশ দিয়ে রত্না দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গৌরব তার পেছনে। ঘরের দিকে মুখ করে রত্না বলল, আমি যাচ্ছি। তোমাদের কোনো দায় রইল না। স্বচ্ছন্দে তুমি আর একটা বিয়ে করতে পার। কোনোদিন কোনো দাবি নিয়ে সামনে দাঁড়াব না। এই হারটা তুমি বিয়ের দিন আমাকে দিয়েছিলে। এটা রইল। পাশের লম্বা টুলের ওপর হারটাকে রাখল রত্না। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, আর হ্যাঁ, বিয়ের পর এই কিছুদিন আগে ইচ্ছেয় হোক কিংবা অনিচ্ছেয় হোক আমার শরীরে তুমি যাকে দিয়েছ তাকে আমি ফিরিয়ে দেবো না। সে আমার, একান্তই আমার। চলো গৌরব।

গৌরব এবং রত্না বাইরের আকাশের নিচে এসে দাঁড়ালে রত্না ছেলেমানুষের মতো বলে উঠল, পৃথিবীটা কি সুন্দর, না গৌরব?

.

কলকাতায় পা দিয়েই গৌরব এখন কিছুটা হতভম্ব। বারো বছর একটা শহর একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবে? এক পা এগোবে না দেশটা? শাশুড়ি-বউমার ঝগড়া হয়তো পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত থেকে যাবে। অধিকার হস্তান্তর কেউ সানন্দে মেনে নেয় না। কিন্তু এদেশের মানুষ যাদের হাতে পয়সা আছে তারা এখনও ঝি-চাকর নির্ভর হয়ে থাকবে? কখনও কখনও সেই নির্ভরতা যে অধিকারবোধের ফসল হিসেবে আসে তাতে ঝি-চাকরকে ক্রীতদাসের পর্যায়ে নামিয়ে আনে। অর্থবান এবং আধুনিক রাষ্ট্রগুলো যখন মানুষের সমানাধিকার দিচ্ছে তখন অনুন্নত দেশের কিঞ্চিত মধ্যবিত্ত মানুষ এখনও সেই মধ্যযুগে বাস করছে। মলি কিংবা সৌরভ বিবাহবার্ষিকীর সাফল্য কদিন মনে রাখবে। কিংবা টুলুর ব্যাপারটা? এখানে এসে অবধি তো কাগজে বধূ-নির্যাতন বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা পড়ছে। সে এই দেশ থেকে যাওয়ার আগেও নগদ নিয়ে গোলমাল ছিল। এবং এটা নিয়মের মধ্যেই চালু ছিল। কিন্তু নিয়ম ভাঙার চেষ্টাও শুরু হয়েছিল কয়েকদশক থেকে। অথচ এখনকার মতো এত হত্যা নির্যাতনের কথা তখন কাগজে পড়েছে বলে মনে পড়ে না গৌরবের। দেশটা এগোচ্ছে না পিছিয়ে যাচ্ছে।

তেরো সপ্তাহের ছুটি। এখনও বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে মোলাকাত হলো না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। মনের মতো চাকরি পাওয়া যায় কি না সেই চেষ্টাও করতে হবে। যদি মেলে থেকে যাবে এখানে। এবং সবচেয়ে যেটা জরুরি, জয়তীর দর্শন চাই, সে যে অবস্থায় থাকুক, একবার তাকে দেখতে চায় গৌরব।

কলকাতা শহরে নিজের গাড়ি না থাকলে কথা রাখা অসম্ভব। গৌরবের মনে হচ্ছে এই বারো বছরে মানুষের সংখ্যা বেড়েছে কিন্তু বাস-ট্রাম বাড়েনি। ট্যাক্সিওয়ালাগুলোকে দুতিন টাকা বেশি দিলে যে কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায়। আমেরিকায় পারতপক্ষে ট্যাক্সিতে চাপে না সে। যে দূরত্ব ভারতবর্ষে ট্যাক্সিতে যেতে পঁচিশ টাকা লাগবে ওখানে তার জন্যে কম করে দুশো টাকা দিতে হবে। তার ওপর আছে টিপস্। কম করে মিটারের শতকরা দশ থেকে পনেরো ভাগ বখশিস দিতে হবে। অতএব যতটা সম্ভব ট্যাক্সিতে এড়িয়ে চলত সে। কিন্তু আমেরিকায় যারা থাকে তারা এক ডলারকে একটা টাকা বলেই মনে করে। অর্থাৎ দুশো চল্লিশ টাকা না ভেবে সেটা কুড়ি টাকা ভেবে নিলে স্বস্তি। কারণ কুড়ি ডলার মানেই দুশো চল্লিশ টাকা। যাহোক টিপস্ যখন ওখানে চালু আছে তখন এখানে সেটা দিতে দোষ কী। ওদেশ থেকে ডলার এনে এদেশে খরচ করার মধ্যে যে আরাম তার তুলনা নেই। ওখানকার দুটাকায় এখানকার চব্বিশ টাকার সুবিধে পাওয়া যায়।

কিন্তু ট্রামে যদিবা হলো বাসের দিকে তাকালে গায়ে জ্বর আসে। তার ওপর আছে জ্যাম। সাধারণত তিনটে কারণে এখানে জ্যাম হয় এবং জনসাধারণ দিব্যি মেনে নেয়। এ ব্যাপারে কেউ কোনো প্রতিবাদ করে না। প্রথম কারণ মিছিল। যে কোনো কারণেই রাজনৈতিক দল বা ট্রেড ইউনিয়নগুলো মিছিল নামায় পথে। এবং তাদের যাওয়াটা এমন রাজকীয় যে সমস্ত যানবাহন জগন্নাথ হয়ে বসে থাকে। ওর মনে হচ্ছিল হাসপাতাল স্টেশন কিংবা জরুরি প্রয়োজনে যাওয়া মানুষদের জন্যে এইসব মিছিলের একটা আলাদা রাস্তা সরকারের করা উচিত। যেখানে মিছিল হলে শহরের মানুষদের কোনো অসুবিধে হবে না। দ্বিতীয় কারণ, আইন না মেনে গাড়ি চালানো। এদেশে পার্কিং লটের ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিক রুল বলে যেটা আছে সেটা ছেলেমানুষি। ড্রাইভাররা কোনো নিয়মকানুন মানেন না। আর এই কারণেই গাড়িগুলো জট পাকায়। কলকাতার রাস্তা চওড়া নয়, এবং প্রতিটি নাগরিকের পৈতৃক সম্পত্তি বলে একবার জট পাকালে সেটা খোলা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে। তৃতীয় কারণ, ট্রাফিক পুলিশ। জ্যাম হলে তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র তৎপরতা দেখা যায় না সেটা ছাড়ানোর। গৌরব নিজে দেখেছে সমস্ত গাড়ি জ্যামে স্থির হয়ে আছে। মোড়ের মাথায় দাঁড়ানো ট্রাফিক পুলিশ অত্যন্ত নিশ্চিন্ত মুখে খইনি ডলছেন হাতে। তারপর সেটাকে মুখে পুরে ধীরেসুস্থে এগিয়ে গেলেন একটা গাড়ির পিছনে দাঁড়ানো ঠেলার দিকে। এই পথে সে বেআইনিভাবে ঢুকেছে। অতএব একটা আধুলি হাত বদল হলো। অসহায় শিশুর মতো ফিরে এসে ট্রাফিক পুলিশ তার জায়গায় এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

ভেবেছিল তিনটের মধ্যে কফিহাউস পৌঁছে যাবে গৌরব। কিন্তু ট্যাক্সি নেওয়া সত্ত্বেও সে মেডিক্যাল কলেজের সামনে পৌঁছালো সাড়ে তিনটের পর। আর গাড়ি এগোচ্ছে না। তাকে অনুরোধ করল ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ছেড়ে দিতে। সে ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করবে। ট্যাক্সি ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল। বন্ধ-ঘরে পুরোনো জিনিসপত্র বাতিল হয়ে যেভাবে স্তূপ অবস্থায় থাকে সেইভাবে ডাবলডেকার, প্রাইভেট বাস, অ্যাম্বাসাডার, মারুতি ট্যাক্সি থেকে ঠেলারিকশা রয়েছে জড়াজড়ি করে। ভাঙা ফুটপাতে মানুষের ভিড়। ইউনিভারসিটির সামনে এসে চমকে গেল গৌরব। জোর বক্তৃতা চলছে। দুদল ছাত্রকর্মচারী আলাদা আলাদা মাইকে জ্বালাময়ী ভাষণ দিচ্ছে ফলে কারও কথা শোনা যাচ্ছে না। মিটিংয়ের শ্রোতারা ট্রাম রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে যানবাহন চলতে পারছে না। একটিও পুলিশ ধারে কাছে নেই। ওপাশের গাড়িগুলোও তেমনি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। গৌরব বক্তৃতা শোনার চেষ্টা করল। দুপক্ষই পরস্পরকে দোষারোপ করছে। পড়াশুনা সম্পর্কিত কোনো অবিচারকে কেন্দ্র করে এই বিক্ষোভ নয়। ছাত্রদের স্বার্থরক্ষার জন্যে এই জেহাদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত ক্লাস তিনমাস বন্ধ রাখা হয়েছে বলে উপাচার্যের মুণ্ডুপাত করা হচ্ছে। কিন্তু এই রকম বক্তৃতার মধ্যে কি করে ছাত্ররা ক্লাস করবে তা ভেবে পাচ্ছিল না গৌরব।

প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনে এসে মনটা ভালো হলো। কলেজের চেহারাটা একই রকমের আছে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল একবার ভেতরে যেতে। কিন্তু হাতে সময় নেই-ই, বরং বেশ দেরি হয়ে গেছে। সে লক্ষ্য করল এখন কলেজের সামনে কোনো উত্তেজক পোস্টার সাঁটা নেই। পাশের বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তাপ কি আজকাল কলেজের গায়ে লাগছে না? কে জানে!

কফিহাউসে ঢুকে মনে হলো কতদিন পরে পরিচিত পরিবেশে সে আসতে পারল। সেই চিৎকার নয় অথচ কানের মধ্যে সমুদ্রের গর্জন, টেবিল উপচে পড়া ছেলেমেয়েদের জমাটি আড্ডা একইরকম রয়েছে। অনেকে এটাকে যৌবনের অপচয় বলে থাকেন। শুধু কথা বলে মূল্যবান সময়টাকে নষ্ট করা। আমেরিকাতেও এইরকম বিরাট জায়গা নিয়ে আড্ডা মারতে সে কাউকে দেখেনি। কিন্তু গৌরবের নিজের কখনই অপচয় মনে হয় না। এই কয়েকঘণ্টা যদি বিভিন্ন পরিবারের ছেলেমেয়ে এক জায়গায় বসে মত বিনিময় করতে পারে তাহলে মনের সঙ্কীর্ণতা কমবে, দৃষ্টিশক্তি জোরদার হবে। কফিহাউসে আড্ডা মেরে জীবনে সফল হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা নিশ্চয়ই কয়েক হাজার। গৌরব একটা বসার জায়গা খুঁজল। কিন্তু কোনো চেয়ার খালি নেই। সুব্রতর সঙ্গে আজ সকালে ফোনে কথা হয়েছিল। ও বলেছিল ঠিক তিনটের সময় এখানে আসবে। সুব্রত পার্ক স্ট্রিটের কোথাও দেখা করতে চেয়েছিল। পুরোনো দিনের কথা ভেবে গৌরবই কফিহাউসের নাম করেছে। সুব্রত এখানকার সরকারের একজন বড় কর্তা। ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিট্রেটিভ সার্ভিসের কল্যাণে অল্প বয়সে যেখানে পৌঁছেছে তা অবশ্যই ঈর্ষার ব্যাপার অনেকের কাছে। তার গলা পেয়ে সুব্রত অবাক হয়েছিল। বারো বছর আমেরিকায় ছিল জানার পর কথা বলার ধরন সহজ হয়েছিল। সুব্রতটা চিরকালই বেশি ইংরেজী বলে। আজও সেই স্বভাবটা রয়ে গেছে। গৌরব ঘড়ি দেখল। পঁয়তাল্লিশ মিনিট নিশ্চয়ই সুব্রত অপেক্ষা করবে না। দেরি করে আসার জন্যে ক্ষমা চাইবে হবে।

ধীরে ধীরে কফিহাউস থেকে বেরিয়ে এল গৌরব। এই প্রায়-বিকেলে একটিও পরিচিত মুখকে দেখতে পেল না সে। বেয়ারাদের মধ্যে তিনজনকে সে চিনতে পেরেছিল। তাকে দেখে রানু একগাল হেসে এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেছিল বসবার চেয়ারের ব্যবস্থা করবে কি না! কিন্তু এখন একা একা বসতে খুব খারাপ লাগছিল গৌরবের। হঠাৎই ওর মনে হলো সে যেন এই জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বারো বছরের যোগাযোগহীনতা তার অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে খুব বিষণ্ণ মনে হচ্ছিল নিজেকে।

আর তখনই সে সুব্রতকে দেখতে পেল। শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের ফুটপাতে গাড়িটা পার্ক করছে সে। বারো বছরে সুব্রতর চেহারাটা পাল্টেছে বেশ। শরীরে ভালো মেদ জমেছে, মাথায় টাক শুরু হলেও গায়ের রঙ ফর্সা হয়েছে। জামা-প্যান্টে বেশ স্মার্ট ভাব এসেছে ওর। গৌরব গিয়ে সামনে দাঁড়াল, বিস্মিত হলো সুব্রত। তারপর হাত বাড়িয়ে বলল, সরি, এমন একটা জরুরি মিটিং পড়ে গেল যে, কিছু মনে করিস না।

করমর্দন করে গৌরব বলল, যাচ্চলে। আমি ভাবলুম তুই অপেক্ষা করে ফিরে গেছিস। আসলে জ্যামের জন্য আমিই দেরিতে পৌঁছেছি।

ও তাই নাকি। জ্যাম আমাদের জলভাত। আমেরিকায় তো আরামে আছিস!

আমেরিকাতেও জ্যাম হয়। মাঝে মাঝেই। তবে ছেড়ে যায় খুব দ্রুত। কোথায় বসবি? ওপরে একটা চেয়ার খালি নেই, গৌরব জানাল।

টেরিবল! কী করে যে ভদ্রলোকেরা ওপরে বসে! কারও কথা শোনা যায় না, গরম। আমি তো আজকাল ওখানে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। তুই বললি বলে এলাম। আয় গাড়িতে উঠে পড়। সুব্রত আবার দরজা খুলল।

গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কোথায় যাবি।

দেখি তোর যোগ্য একটা জায়গায় নিয়ে যেতে হবে তো।

গৌরব সুব্রতর গাড়িতে বসতেই ও সামনে এগোল। গৌরব জিজ্ঞাসা করল, কলেজ স্ট্রিটের যা ট্রাফিকের অবস্থা, তুই এলি কী করে?

ধুঁকতে ধুঁকতে। এখন আর রিস্ক নেব না। সোজা গলি তস্যগলি দিয়ে বেরিয়ে যাব। তারপর বল আমেরিকায় এতদিন কি করছিলি? সত্যি একটা গলিতে গাড়ি ঢোকাল সুব্রত। পায়ে হাঁটা মানুষ আর রিকশা ছাড়া কোনো গাড়ি বোধহয় এই পথে চলাচল করে না।

গৌরব জবাব দিলো, চাকরি। কম্পুটার নিয়ে পড়েছিলাম। ডক্টরেট করেছি। এখন তাই ভাঙিয়ে খাচ্ছি। মাসে হাজার পাঁচেক দেয় তাতেই চলে যায়।

হাজার পাঁচেক? টাকা না ডলার?

ওদেশে আমরা ডলারকে টাকাই বলি।

সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষল। সুব্রত। বড় বড় চোখে তাকাল। তারপর কোনো মতে উচ্চারণ করল, তুই তাহলে রীতিমত বড়লোক। সকালে ইয়ার্কি মারছিলি?

কোন্ ব্যাপারটা?

এখানে চাকরি পেলে থেকে যাবি, মামারবাড়ি।

না, সিরিয়াসলি। ইয়ার্কি মারতে যাব কেন?

কোন্ চাকুরে ভারতবর্ষে মাসে ষাট হাজার টাকা মাইনে পায়? কে দেবে?

আমি তো ওই টাকা চাইছি না। আমি একটি ভদ্র মাইনে চাইছি যা আমাকে দেশের হয়ে কাজ করতে সাহায্য করবে। গৌরব আন্তরিকভাবে কথাগুলো বলল।

পাগল! ওসব দেশপ্রেম ছাড়। এখানে থেকে কিস্যু হবে না।

তুই নিজে এ দেশের প্রশাসক হয়েও এ কথা বলছিস?

সিওর। এখানে কেউ কাজ করে না। কাজের কথা বললেই আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ইউনিভার্সিটির সামনে যা হচ্ছে তা সমস্ত দেশের প্রতীক। তুই খুব ভাগ্যবান যে এদেশ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিস। ওসব চাকরির ধান্দা মাথা থেকে তাড়া। বিয়ে করেছিস?

না। সময় হলো না।

চকিতে সুব্রত তাকাল গৌরবের দিকে, আচ্ছা! তোর একটা কেস ছিল না কলেজে?

কেস ছিল নাকি?

দাঁড়া, দাঁড়া! হ্যাঁ, জয়তী নাম মেয়েটার। ওকে বিয়ে করলি না কেন?

সুযোগ হলো না। আমি চলে গেলাম বিদেশে। বারো বছর দেখা সাক্ষাৎ নেই। আর সময়টা এত দীর্ঘ যে কারও মনের পরিবর্তন হওয়ার পক্ষে অনেকখানি। হয়তো সে এর মধ্যে সংসারী হয়ে গেছে। সময় কারও জন্যে বসে থাকে না সুব্রত।

আমেরিকায় থেকে প্রেম করিস নি?

বন্ধুত্ব হয়েছে, প্রেম জমেনি। জমতে চায়নি।

তুই একটা যাচ্ছেতাই। আমি ছিলাম গাড়িতে। মাসচারেক আগে বালীগঞ্জ প্লেস দিয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হলো জয়তী। হাতে কিছু খাতাপত্তর। চেহারাটা একই আছে কিন্তু মুখে বয়সের ছাপ। বাঙালি মেয়েদের যেটা হয় আর কি! সুব্রত এবার বড় রাস্তায় গাড়ি তুলেছে। এদিকটা ফাঁকা। গৌরবের অবশ্য সেদিকে নজর ছিল না। জয়তী বালিগঞ্জ প্লেস দিয়ে খাতা হাতে হাঁটছিল। তার মানে ও নিশ্চয়ই ওই অঞ্চলে থাকে অথবা কাছে-পিঠে স্কুলে পড়ায়। সুব্রতর সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হলো। মনে মনে ধন্যবাদ দিলো সে। অবশ্য রত্নাকে জিজ্ঞাসা করলে নিশ্চয়ই একটা হদিশ পাওয়া যেত। কিন্তু ও বেচারা নিজের সমস্যা নিয়ে এতটা বিভ্রাটে যে প্রশ্নটা করার মতো পরিস্থিতি পায়নি গৌরব। যা হোক, একটা মেয়ে কলকাতার স্কুলে পড়ায় আর তাকে খুঁজে বের করা যাবে না এমন হতে পারে না। সুব্রত একটা সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে ধরতে গৌরব মাথা নাড়ল। সুব্রত হাসল, আমেরিকায় গেলে এটা হয়, না? ও দেশের সিগারেটের কোম্পানিগুলো তো উঠে যাবে রে। আমার থিওরি যদ্দিন আছি ভোগ করে যাব।

এই ভোগ করার পদ্ধতিটা এক এক জনের এক এক রকম। বিয়ে করেছিস?

চল্লিশের আগে ব্যাপারটা ভাবছি না।

সেকি রে! তখন তো জীবন টলমলে।

সেই কারণেই তখন বিয়ে করা দরকার। টলমলে জীবনটা স্থির করতে আর একজনের সাহায্য চাই।

কিন্তু আমরা যাচ্ছি কোথায়? গৌরব লক্ষ্য করল তারা ভি. আই. পি. রোডে পড়েছে। এখনও আকাশে আলো। কলকাতার এই অঞ্চলটা সত্যি সুন্দর। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার সময় সে এই পথে ফিরেছিল। সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, তোর হাতে সময় আছে তো?

আমি তো বেড়াতেই এসেছি। তবে এখানে আসার পর একটি নিয়ম চালু হয়েছে বাড়িতে। রাতের খাওয়া-দাওয়া একসঙ্গে হবে। অতএব তার আগেই ফিরব।

ঠিক হ্যায়। আমি যদি ফিরতে না পারি তোকে ট্যাক্সি ধরিয়ে দেবো।

কলকাতায় এত রকমের কায়দাবাজ বাড়ি এর আগে দেখিনি। গৌরবের ধারণা হলো বাছাই করা নবীন বড়লোক সল্টলেকে বাড়ি করেছেন। সুব্রত থাকে পার্কসার্কাসে। এখানে ও কোথায় যাচ্ছে টের না পেলেও গৌরবের মনে হলো সুব্রত জায়গাটাকে পছন্দ করে। নেহাৎ পৈত্রিক বাড়ি বলে ছেড়ে আসতে পারছে না। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝে গাড়ি ছাড়া কিছু নেই। লোকজনও হাঁটছে না। বা কোনো শহরের আশেপাশের সঙ্গে চমৎকার মিল আছে।

একটা ঝকঝকে দোতলা বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সুব্রত। বাড়িটার সামনে ছোট্ট একটা লন, ফুলের গাছ মায় একটা বড় চৌবাচ্চাও রয়েছে। পুরো বাড়িটা যেন কাচে মোড়া। শেষ সূর্যের মরা আলোয় লালচে দেখাচ্ছে। সুব্রত বলল, নাম, এসে গেছি। গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই কুকুরের ডাক শুনতে পেল ওরা। সুব্রত বেলের বোতামে চাপ দিতে একটি আধবয়সী মহিলা দরজা খুলে সন্তর্পণে একপাশে সরে দাঁড়াল। ভেতরে পা দিতে দিতে সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, মেমসাহেব কোথায়?

বাড়িতে নেই।

নেই মানে? কোথায় গিয়েছে?

চুলের দোকানে।

ওঃ। আর চুল তৈরি করার দিন পেলে না। বস গৌরব। চা না কফি কী দিয়ে হবে? গৌরব ঠিক ধরতে পারছিল না। তার মুখ দেখে সুব্রত বলল, কফিই হোক। আমরা তো কফিহাউসে গিয়েছিলাম। ভালো করে কফি করো তো। সুব্রত পরিচারিকাকে হুকুম করা মাত্রই সে দ্রুত বেরিয়ে গেল। যেন যাওয়ার সুযোগ পেয়ে সে খুশি হলো।

চমৎকার গোছানো ড্রইংরুম। সাজানোর মধ্যে রুচির ছাপ আছে। রঙিন টি. ভি. এবং খুব মূল্যবান মাছের ঘর। আধুনিক টেলিফোন। সোফাসেট দেখলে বোঝা যায় অর্থ এবং পছন্দ একসঙ্গে হাত মিলিয়েছে। আরাম করে বসেই আবার উঠে পড়ল সুব্রত, না, এখানে নয়। আমার একটা ফেবারিট জায়গা আছে, চল সেখানে গিয়ে বসি। বিনা বাক্যব্যয়ে সুব্রতর পেছন পেছন দোতলায় উঠে এল। বাড়িটার ঘর বেশি নেই কিন্তু এমন কায়দায় তৈরি হয়েছে যে মনে হয় বিশাল বাড়িতে এসেছি। দোতলায় ব্যালকনিতে পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসতেই গৌরব অনেকটা খোলা জায়গা আর আকাশ দেখতে পেল। নিচে কালো রাস্তায় সুব্রতর গাড়িটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে যেন তৃপ্তি পেল সুব্রত। তারপর বলল, খুব সৌখিন মেয়ে, বুঝলি।

কে?

কঙ্কা। চুল বাঁধতে গিয়েছে। এখনই চলে আসবে।

বুঝলাম কিন্তু বাড়িতে আর কাউকে তো দেখছি না। আমরা যেভাবে জবরদখল করে বসেছি সেটা খুব ভালো লাগছে না। আর সব কোথায়?

আর কাকে এক্সপেক্ট করছিস?

মহিলার কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?

আছে। কিন্তু তারা এ বাড়িতে থাকে না। তুই কি রে! আমেরিকায় আছিস অথচ একজন মহিলা একা আছেন এটা ভাবতে পারছিস না? সুব্রত উঠে বসল।

তাই বল। তবে তার অনুপস্থিতিতে আসাটা আরও অন্যায় হলো না?

ন্যায় অন্যায় জানিনে। তুই আমার সঙ্গে এসেছিস অ্যান্ড দ্যাটস অল।

কঙ্কা নামক মহিলার সঙ্গে তোর কী সম্পর্ক? কিছু মনে করিস না প্রশ্নটা করলাম বলে।

বন্ধুত্ব। কঙ্কা খুব ভালো ছবি আঁকে। ভালো বিক্রি হয়। প্রায়ই একজিবিশান লেগে আছে।

আচ্ছা! গৌরব হাসল, এই প্রথম কোনো আর্টিস্টকে চুল বাঁধার দোকানে যেতে শুনলাম।

তার মানে? যে আঁকে সে চুল বাঁধে না?

আর্টিস্টরা শুনেছি খুব উদাসীন হয়।

সেসব দিন পাল্টে গেছে। তুই ব্যাটা ব্যাকডেটেড। কঙ্কা ইজ এ ভেরি গুড ফ্রেন্ড অব মাইন। উই জাস্ট স্টে টুগেদার। সুব্রত এতক্ষণে ঘোষণা করল।

সোজা হয়ে বসল গৌরব, তাই বল! ব্যাপারটা এ দেশেও চালু হয়েছে?

অনেকদিন। দুটো মানুষ তাদের ভালা লাগা দিয়েই একসঙ্গে বসবাস করতে পারে। সেটা দেশকালের গভীরে সীমাবদ্ধ নয়। সুব্রত আর একটা সিগারেট ধরাল।

গৌরব অন্যমনস্ক হলো। সুব্রতর ডাকে সে মুখ তুলল, কি অদ্ভুত ব্যাপার। যে দেশে এখনও নগদ টাকা গয়নার চাপ দিয়ে বিয়ে হচ্ছে, দিতে না পারলে কেউ মরছে সে দেশেই স্টে-টুগেদার চালু হয়েছে। আকাশ পাতালের মধ্যেও এত পার্থক্য নেই।

ঠিক সেই সময় নিচে একটা গাড়ি এসে থামল। সুব্রত বলল, এসে গেছে। গাড়ির দরজা খুলে যে মেয়েটি নামল সে ন্যুয়র্কেও থাকতে পারত। জিন্সের প্যান্টের ওপর লাল সার্ট। লম্বা, সুন্দরী এবং স্বাস্থ্যবতী। মাথার চুল নিতম্ব পর্যন্ত টানটান ইস্ত্রি করা। মুখে চকচকে ভাব। মহিলা শুধু চুল ঠিক করতে যান নি মুখেরও মেরামত করে এসেছেন। কাঁধে ব্যাগ। গেট খুলে কয়েক পা এগোতে ওপরের দিকে তাকাতেই দাঁড়িয়ে গেলেন তারপর চিৎকার করে বললেন, হোয়াট এ সারপ্রাইজ। কখন এলে?

গদগদ গলায় সুব্রত বলল, অনেকক্ষণ। মহিলা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সুব্রত জিজ্ঞাসা করল, কেমন দেখছিস?

উত্তর দেবার সুযোগ পেল না গৌরব। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। এবং তার পরেই ভদ্রমহিলা সামনে এসে দাঁড়ালেন, হা-ই।

গৌরব উঠে দাঁড়াল, নমস্কার।

সুব্রত হাত বাড়িয়ে মহিলার হাত ধরল বসে বসেই, এ হলো কঙ্কা, আর এর নাম গৌরব, আমার কলেজের বন্ধু, আমেরিকায় বড় চাকরি করে। সুব্রতর কথার প্রতিবাদ করল গৌরব, বড় চাকরি কথাটা খুব গোলমেলে। সুব্রতর কথায় কান দেবেন না। হঠাৎ এসে আপনাকে বিব্রত করলাম বোধহয়

মোটেই না। আমি এইরকম ব্যবহারে অভ্যস্ত। বসুন। কফি দিয়েছে?

দিচ্ছে। গৌরব বলছিল, ভালো শিল্পী নাকি চুল নিয়ে মাথা ঘামায় না।

তাই? মহিলা অদ্ভুত ভঙ্গিতে গৌরবকে দেখলেন।

এই সময় সেই কাজের মেয়েটি কফি নিয়ে আসায় আপাতত রক্ষা পেল গৌরব। কঙ্কা কফির কাপ হাতে তুলে দিয়ে বলল, আমি ভালো ছবি আঁকি আপনাকে কে বলল? আমার ছবি দেখেছেন?

সুব্রত কিছু বলতে যাচ্ছিল। গৌরব বলল, মাপ করবেন। ব্যাপারটা বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর ঠাট্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ওর উচিত হয়নি সেটাকে টেনে আপনার সামনে হাজির করা। এখানকার শিল্প সাহিত্যের কোনো খবর আমি জানি না। সুব্রত বলল আপনি খুব ভালো আঁকেন।

ও ছবির কিছু বোঝে? খুব নির্মোহ ভঙ্গিতে কঙ্কা বলল।

দ্যাটস রাইট, আমি ছবি বুঝি না। সবাইকে সব বুঝতে হবে তার মানে নেই। আমি তোমাকে বুঝি অ্যান্ড দ্যাটস অল।

আশ্চর্য! তুমি আমাকে বোঝো?

চেষ্টা করছি, করে যাচ্ছি।

এইভাবে কথা বোলো না।

গৌরববাবু, আমি কেমন আঁকি জানি না, তবে যেভাবে কাজ করতে ও খেতে হয়, স্নান করতে হয়, টয়লেটে যেতে হয় তেমনি নিজেকে সাজাতেও হয়। আপনার কাছে হয়তো বেমানান ঠেকতে পারে কিন্তু আমি নাচার। ওহো, সুব্রত, একটু বাদে আমার এক বন্ধু আসবে। তোমার খারাপ লাগলে আমার কিছু করার নেই। কঙ্কা উঠে দাঁড়াল।

বন্ধু আসবে! কে?

তুমি সবাইকে চেনো না।

স্টিল! কী রকমের বন্ধু?

ওহো! তুমি কি সব ব্যাপারে আমার কাছে এক্সপ্ল্যানেশন চাইবে?

কঙ্কা আমার খারাপ লাগবে এমন কাজ করছ কেন?

তুমি কী বলতে চাইছ? ক্ষমা করবেন গৌরববাবু, সুব্রত আর আমার মধ্যে এইসব কথাবার্তা আপনার সামনে হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আমি জানতাম না আজ ও আপনাকে নিয়ে আসবে। অতএব মার্জনা করবেন।

হ্যাঁ,-–তুমি কী বলতে চাইছ সুব্রত?

কিছুই না। আমাদের মধ্যে চুক্তি ছিল পরস্পরের সম্পর্কে সৎ থাকতে হবে।

চুক্তি? বেশ, তাই মানছি। কিন্তু আমার বন্ধু এলে অসৎ হব কেন?

হতে পার। আমার সন্দেহ হতে পারে।

সেটা তোমার অক্ষমতা। সুব্রত, উই লাভ ইচ আদার, তার মানে এই নয় যে আমরা আমাদের সব স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে বসে আছি। এদেশের যা সিস্টেম তা মানব না বলেই আমরা মন্ত্র পড়ি নি বা সই করিনি। অতএব সেই মানসিকতা এখানে টেনে এনো না। তোমার যদি আমার বন্ধুকে পছন্দ না হয় তুমি চলে যেতে পার আজ। না না গৌরববাবু আপনি বসুন। আপনি প্রথম এলেন আর তাছাড়া আমার বন্ধুকে নিয়ে আপনার কোনো কমপ্লেক্স থাকার কথা নয়। কঙ্কা হাসল।

সুব্রত অত্যন্ত আহত গলায় বলল, তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

চোখের বাইরে কিছু ঘটলে প্রতিক্রিয়া কম হয়, তাই।

বাঃ আমি যদি তোমার চোখের বাইরে পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে ঘুমোই তাহলে তুমি সহ্য করতে পারবে? মানতে পারবে? উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল সুব্রত।

প্রথম কথা, পাঁচটা মেয়েকে ট্যাকল করার মানসিকতা তোমার আছে কি না সন্দেহ। দ্বিতীয়ত, তুমি বাইরে কি করছ তাতে আমার কিছু এসে যায় না। আমি চাইব তুমি আমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার কর, কেয়ার নাও এবং অপমান কোরো না। দ্যাটস অল। উই আর লিভিং টুগেদার, সপ্তাহে দুদিন উই আর স্টেয়িং টুগেদার টু। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক হলো পেঁয়াজের মতো। খুব টাইট, বড়সড়। কিন্তু যদি তুমি মূর্খ হও তাহলে খোসা ছাড়াবার চেষ্টা করবে। ছাড়াতে ছাড়াতে আলটিমেট শূন্যতায় পৌঁছাবে এবং আঙুলে গন্ধ হবে। সো ডোন্ট ট্রাই ফর ইট। আসুন গৌরববাবু আপনাকে আমার ছবি দেখাই।

গৌরব সুব্রতর দিকে তাকাল। সুব্রত বলল, কঙ্কা চাইছে না আমি আজ থাকি। কে আসছে জানি, তবে কঙ্কার ব্যাপারে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহ্য করতে পারি না আমি। আমি যাচ্ছি, তুই ছবি টবি দেখে চলে যাস।

সেকি! তোর সঙ্গে এলাম আর

আপনি কি আমার কাছে নিজেকে নিরাপদ মনে করছেন না? কঙ্কা হাসল, আগামীকাল আপনি একা এখানে এলে সুব্রত অবশ্য আপনাকেও প্রতিদ্বন্দ্বী ভাববে।

স্টপ ইট। চিৎকার করে উঠল সুব্রত, ভীষণ বাড়াবাড়ি করছ।

চিৎকার কোরো না। আমার চিৎকার সহ্য হয় না।

তুমি ভুলে যাচ্ছ কঙ্কা আমি তোমার জন্যে কি করেছি! আমার বন্ধুর সামনে তুমি আজ আমাকে অপমান করছ। তোমার কাছে এলাম কোথায় আনন্দ করতে তা না–

আনন্দ করতে আমার কাছে। কলকাতা শহরে আনন্দ দেবার জন্যে কি কোনো মহিলা আজ তৈরি নেই? চাবুকের মতো কথাগুলো ছুড়ল কঙ্কা। এবং এই সময় একটি ট্যাক্সি এসে থামল নিচে গেটের সামনে। ট্যাক্সি থেকে নামলেন একটি বিদেশিনী মহিলা। কঙ্কা চিৎকার করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিচু গলায় বলল, আমার বন্ধু, যার কথা বলছিলাম।

সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল সুব্রত, ওহো! তুমি একটি জিনিস। এতক্ষণ বলো নি কেন যে তোমার বান্ধবী আসছে। তুমি যা নাটক করতে পার না সোনা!

পারি, না? উদাস গলায় বলল কঙ্কা।

গৌরব এবার নমস্কার করল, আপনারা গল্প করুন। সুব্রত এবার তুই থাকতে পারিস মনে হয়। আমি চলি। তারপর সেখান থেকে চিৎকার করে বলল, ট্যাক্সি দাঁড়ান। সুব্রত হতভম্ব হয়ে গেল চলে যাবি মানে? তুই তো বললি ডিনার অবধি ফ্রি!

একটা ব্যাপার মাথায় ছিল না। কঙ্কা, আজ চলি। আপনাকে আমার অভিনন্দন। তবে একটা কথা, আকাশের গায়ে যতই রঙের তুলি বোলান তা ধোপে টেকে না। একসময় নিশ্চয়ই ক্লান্তি আসবে তাই না?

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে নেমে এল। দরজার গোড়ায় বিদেশিনীর সঙ্গে মুখোমুখি। মহিলা হেসে বললেন, হাই!

গৌরব মাথা নাড়ল, হাই। কঙ্কা ইজ দেয়ার। মাথা ঘোরাতে সে কঙ্কাকে দেখতে পেল। সিঁড়ির মুখে পাথরের মতো মুখ নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। সে হেসে বলল, আপনার সঙ্গে আবার দেখা করার ইচ্ছে রইল। ট্যাক্সিতে বসে রুমালে মুখ মুছল সে। সুব্রত কঙ্কা স্বামী-স্ত্রী নয়, কিন্তু পরস্পরকে ভালবাসে কি না তাতেও সন্দেহ হচ্ছে। যেই মহিলা ট্যাক্সি থেকে নামলেন অমনি সুব্রতর সব বদলে গেল? এতক্ষণের ঝগড়া, অস্তিত্ব নিয়ে কামড়াকামড়ি সব থেমে গেল? আর সেইটেই তাকে বাধ্য করল উঠে আসতে। কঙ্কাকে ভালো লাগছিল তার। মেয়েটার দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা স্বচ্ছ। কিন্তু ব্যাপারটা কী হলো? কলকাতা শহরে এখন একটি মেয়ে একা যে কোনো পুরুষবন্ধুর সঙ্গে আইনের বন্ধন ছাড়াই নাক তুলে বসবাস করতে পারে? অবশ্য সুব্রত সপ্তাহে পাঁচ দিন ওই বাড়িতে থাকে না। কিন্তু তার আচরণ টিপিক্যাল স্বামীর মতনই। গৌরবের অস্পষ্ট ধারণা হচ্ছিল কলকাতার কিছু মানুষ খুব দ্রুত ইউরোপ আমেরিকাকে স্পর্শ করতে যাচ্ছে। কিন্তু আদলটা রপ্ত করলেও সেখানকার মানুষদের নির্মোহ দৃষ্টিটা নিতে পারেনি। এক্ষেত্রে এরা দেশীয় সেন্টিমেন্ট আর পুরুষজাতির দখলদারি মনোভাবটা ত্যাগ করতে পরেনি। ফলে একটা দোঁআশলা সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। যদিও এটা খুব সামান্য পুরো দেশের পরিপ্রেক্ষিতে, কিন্তু তা ব্যাপক হলে যে অবস্থা দাঁড়াবে তা ভাবতে গিয়ে শিউরে উঠল গৌরব। ভি. আই. পি. রোডে পৌঁছে ট্যাক্সিড্রাইভার জিজ্ঞাসা করল তাকে কোথায় যেতে হবে। এখন সবে সন্ধে। বাড়িতে ফেরার বদলে শোভাবাজারের দিকে যেতে বলল গৌরব।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *