Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » জীবন বোধ || Soma Bhattacharyya

জীবন বোধ || Soma Bhattacharyya

পর্ব ১
সকালে ঘুম থেকে উঠে কেমন যেন আলস্য লাগে বীথির, আলতো চোখে দেখে নরম রোদ জানালা চুঁইয়ে এসে পড়ছে, বাইরে রাধাচূড়া গাছের দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে, হঠাৎ একটা বাস সজোরে হর্ণ বাজিয়ে চলে যায়, মেজাজটা খাট্টা করে দিয়ে যায়। বিছানা থেকে নেমে আসে, রবিবার তাই কলরবের স্কুল নেই, বিশাল ঘুমাচ্ছে অঘোরে, দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বীথি বলে ওঠে, ঘুমিয়ে রাজ্য জয় করছেন দুজন, আমার ঘুম না ভাঙলে কারোর ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই, সাতরাতে বাড়িতে ফিরবে, কোম্পানিতে বিশাল বাবু ছাড়াতো আর সামলানোর কেউ নেই! যত্তসব বাজে কথা, তলে তলে কারুর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করছে কি কে জানে, আমি তো সংসারের ঠেলায় কোনোরকমে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের টিকে আছি,এই সপ্তাহে একদিন ও কাজে বসতে পারিনি…. কিন্তু এখন যদি তোমার ভিমরতি হয় তবে….নিজের মনে বলতে থাকে সিনেমাতে কতকিছু দেখায়… বিশাল ঘুমের ঘোরে বলে হ্যাঁ, একজন নয় অনেকের সঙ্গে প্রেম করবার দায়িত্ব বস দিয়েছেন,ভ্যালুয়েবল ক্লায়েন্ট কম্পানির, ক্লায়েন্ট বাড়লে তবে তো আমার প্রমোশন হবে, তবেতো তুমি কাজে মন না দিয়ে বিউটি পার্লারে বা NGOও তে ধেইত নাচন নাচতে পারবে।বীথি: এইতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলে ! অন্য সময় হাজারবার বলেও কথার কোন উত্তর পাওয়া যায় না,আর এখন দেখো! বিউটি পার্লার আমি অনেক মাস যাইনি আর NGO নিয়ে কোনো বাজে কথা বরদাস্ত করবো না, সবাই তোমার মতো hypocrite নয়। এখন ওঠো, বাজার থেকে মাছ আনো, মাংস ডিম এই গরমে কম খাওয়াই ভালো।কলরব: নিজেরা পেট রোগা মাছের ঝোল খাও, আমি খাসির মাংস খাবো,ও বাবা শুনছো! বিশাল: আমার পকেট তোমার আর তোমার মায়ের ফরমাশ জোগান দিতে দিতে একেবারে গড়ের মাঠে যাতে না পৌঁছে যায় তাই চিকেন,মাছ অনলাইনে অর্ডার করে দিচ্ছি, মধ্যবিত্তের মতো ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। বুবান তোমার বোর্ডের পরীক্ষার প্রস্তুতি কি বিছানায় ঘুমাতে ঘুমাতে চলছে! ইংলিশ মিডিয়ামে পড়েও যদি এইরকম ভেতো তৈরী হও কি করে চলবে! আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠো, পড়ার সময় বাড়াও, ঘুমালে জীবন ঘুমিয়ে থাকবে, খুব সাধারণ স্কুল থেকে পড়াশোনা করে আজ এইখানে পৌঁছেছি….নেক্সট উইকে সরকার দার মেয়ের বিয়ে, ওখানে গিয়ে একটু এটিকেট মেনে চলতে চেষ্টা করো, মেয়ে জামাই দুজনেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরী করে, হয়তো বিয়ের পর বিদেশে শেটেলড হবে। আমার হাড় জল করে তোমার জন্য সঞ্চয় করছি যাতে নিজের জীবনটা আরো ভালো হয়, আমিতো কলকাতাতেই বুড়ো হতে চললাম,আর তোমার মাকে বলো ওখানে NGO এর বুলি না কপচাতে, একটু আভিজাত্য দেখিয়ে চলতে যদি পার্লার থেকে সাজার ইচ্ছে থাকে সাজবে! যতই তোমাদের জন্য ভাবি আমিতো ভিলেন হিসেবেই তোমাদের চোখে, আমি আজকাল অবশ্য কারোর থেকে বেশি কিছু আশা করি না, একটু আলমোড়া ভেঙে নিজের মতো থাকতে শিখেছি, মডার্ন হয়ে ওঠা কোন অপরাধ নয় ।কলরব: ধুর তোমাদের বোরিং পার্টিতে আমার যাওয়া হবে না কারণ ফিটজিতে আমার টেস্ট আছে, তোমরা যা খুশি করো সেখানে, আমি জোম্যাটোতে খাবার অর্ডার করে নেব।কলরব বাথরুমে চলে গেলে বিশাল নিজের মনে বলে যেমন মা তেমন ছাঁ, অসহ্য! বেসরকারি ফার্মে অনেক কষ্ট করে টাকা উপার্জন করতে হয়, আমার টেনশন, উদ্বেগ শুধু আমি বুঝি। নিজেকে ঠিক ভাবে রিপ্রেজেন্ট না করলে স্যাক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তুমি বুঝবে কি করে, তোমার বাবাতো ছিলেন টাইপিস্ট, খটখট করে জীবন কাটিয়ে দিলেন, আমার ঘাড়ে তোমাকে ফেলে দিয়ে! বীথির মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠলেও আস্তে আস্তে বলে হ্যাঁ বিয়ের আগে যদি বুঝতে তাহলে আরো ভালো বৌ জুটতো কপালে,সবই ভাগ্য না হলে আমি অন্যের প্রপোজাল এড়িয়ে তোমার গলায় জুটি!!! কথা না বাড়িয়ে রান্নাঘরে ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করে, মডিউলার কিচেনে যেন বেসুরো ভায়োলিন বাজতে থাকে, বীথির হঠাৎ মনে হয় সবকিছু ছেড়ে বেরিয়ে যায়… কিন্তু কলরব! কলরবের বয়স যখন পাঁচ, তখন ওর অসুখের জন্য চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বীথি , বিশাল তখন কতটা সহজ সরলভাবে বলেছিল আমাদের একটাই লক্ষ্য ছেলের ভবিষ্যত…. তখন পুরানো বাড়ির মধ্যবিত্ত সংসারে সুখ ছিল অনেকটা… আর এখন পাঁচতলা ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ি তবু মনে অদ্ভুত অস্থিরতার পারদ মাঝে মাঝেই বাড়তে থাকে… যেন একটা বিষাদময় ছন্নছাড়া সংসার, ধুঁকছে, কোনোমতে জোড়া লাগিয়ে রেখেছে ছেলে কলরব। কখনো পায়ের হাঁটু,মাথার যন্ত্রণায় ঘুমহীন রাত এখন জানান দেয় বয়স বাড়ছে । চোখের কোণের ক্লান্তি ঢাকতে সোসাইটিতে লোক দেখানো হাসি ঠাট্টায়, বাড়ছে বীথির মেকআপের প্রলেপ। বিশাল চেঁচিয়ে ওঠে, ব্রেকফাস্ট পাওয়া যাবে? না বাইরে থেকে খেতে হবে? বীথি: যাচ্ছি… ডাইনিং হলে টেবিলে কলরব এসে বসেছে , দুজনের হাতেই মোবাইল!বিশাল পরোটা খেতে খেতে বলে এমন বিস্বাদ আলুর তরকারি কেন? কালকের চিজ স্যান্ডউইচটা খুব ভালো হয়েছিল আর নেই? বীথি ফ্রিজ থেকে যেটুকু ছিল মাইক্রোওভেনে গরম করে এগিয়ে দিয়ে বলে কলরব ঝাল খাওয়াটা একটু শিখে নে বাবা এরপর হস্টেলে যেতে হলে খিদে পেটে থাকতে হবে,ঝাল না দিলে স্বাদ আসে? কলরব: নিজেরা চেঁচামেচি করে নাটক ভালো হয় রান্না ভালো হয় না মা,আমি আসি আমার খাওয়া হয়ে গেছে। বীথি, বিশালের দিকে তাকিয়ে বলে আরো ছেলের সামনে ছোট করো আমাকে, ছেলে ও মাকে কথা শোনাতে শুরু করেছে। বিশাল: আহ্, চিজ স্যান্ডউইচটা ভালো করে খেতে দাওতো,ফ্যাচ ফ্যাচ না করে। কাল অফিসের কাজে বাইরে যাবো পরশু ফিরবো রাত হবে হয়তো, গোয়েন্দা সুত্রে খবর নিতে পারো একা যাচ্ছি না কোনো মহিলা সাথে যাচ্ছে, ওখানে অবশ্য অনেক সুন্দরী মহিলা থাকবে….বীথি কোনো কথা না বাড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে বিশালের দিকে,কান দুটো যেন গরম হয়ে ওঠে।
পর্ব ২
কাজের মাসী নিজের কাজ সারছে, বিশাল নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়, আজকাল আসছি কথাটুকু শুনতে পায় না বীথি! একটা অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করে বীথির, জলখাবারের পরোটা যেন তিতো লাগে।মনে মনে ঠিক করে রান্না করবে না, একটু বাইরে বেরোবে,পারলে একবার NGO তে ঘুরে আসবে। জানলা দিয়ে বাইরে রাস্তায় দেখে রোদ ভালোই তবু স্নান সেরে রেডি হচ্ছে এমন সময় মোবাইলটা বেজে ওঠে ,তিতিন ফোনে বলে একটা জরুরী খবর পেয়ে তোকে ফোন করছি,তোর আজ কি একটু সময় হবে? বীথি: হ্যাঁ হবে বল কি হয়েছে?তিতিন: নেহার মা কালরাতে ফোন করেছিলেন,নেহা সপ্তাহ খানেক আগে বাপের বাড়িতে এসেছিল মেয়েটাকে সাথে নিয়ে, বছর দুয়েকের মেয়ে মায়ের সঙ্গে আসবে এটাই স্বাভাবিক! বীথি: হ্যাঁ, কিন্তু তোর গলাটা এই রকম চিন্তিত লাগছে কেন? তিতিন: কাল সকালে বরের ফোন পায় নি, স্যুইচড অফ আসে যতবারই ফোন করে, একটু চিন্তিত হয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে মেয়েকে নিয়ে শশুর বাড়িতে ফিরে দেখে তালা, প্রথমে হতচকিত হয়ে যায়, তারপর বাড়িওলা জেঠিমাকে জিজ্ঞেস করতে উনি আশ্চর্য হয়ে বলেন ওরা মা ছেলে দুদিন আগে বাড়ি ভাড়া মিটিয়ে চলে গেছে, তোমার কথা জিজ্ঞেস করাতে তোমার বর বললে তোমাদের বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে একসাথে রওনা দেবে, তোমায় কিছু বলে নি! মাথা ঠাণ্ডা রেখে বাড়িতে ফিরে যাও, ফোনের সমস্যা হতে পারে। এরপর নেহা বাপের বাড়িতে ফিরে আসে। অন্য ফোন থেকে ফোন করেও বরং বা শাশুড়ির ফোন স্যুইচড অফ আসে, সেই জন্যই ওর মা খুব চিন্তিত, নেহা কান্নাকাটি করছে, তুই একবার বেরোতে পারবি? তাহলে ওদের কাছে একটু যেতাম। বীথি: হ্যাঁ, আমি মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে পিটিস পৌঁছে যাচ্ছি,তুই ওখানে চলে আয়।ওদের বাড়িটা কোথায়? খিদিরপুর শুনেছিলাম। তিতিন: হ্যাঁ, সেটাই ভালো হবে,আর বাচ্চাটার জন্য একটু জামা কিনে নেবো? বীথি: সেই ভালো,তুই কিনে নিতে পারিস, আমি টাকা দিয়ে দেব। তিতিন: ঠিক আছে। বীথি রেডি হয়ে দরজায় লক করে বেরিয়ে পড়ে। পিটিস এ পৌঁছে একটু দাঁড়ানোর পর তিতিন এসে পৌঁছায়। বাসে উঠে সিটে বসে তিতিন বীথিকে বলে নেহার বাড়িতে গিয়ে ওদের থেকে ঘটনাটা শুনে দরকার হলে থানায় ডায়েরি করতে হবে। বীথি: মিসিং ডায়েরি বলছিস, আচ্ছা ওদের কোনো এক্সিডেন্ট হয়নি তো! তিতিন: হতেও পারে, কোনো প্রবলেম তো নিশ্চয়ই হয়েছে, দুটো মানুষ এইভাবে ভ্যানিশ হয়ে যায় কিভাবে!বাস থেকে নেমে মিনিট পাঁচেকের মত রাস্তা, দুজনে হাঁটতে থাকে, প্রচন্ড রোদের প্রকোপ,তিতিন: আশপাশের ঘটনায় মনটা যেন শ্রান্ত হয়ে যায়। ছেলেটা হস্টেলে আছে,কি করছে, কি খাচ্ছে কি জানি! আজকাল কিছু বলতে চায় না, পড়ার চাপে কেমন যেন গুম হয়ে গেছে, সেদিন রাতে ওর বাবা বলছিল কোনো মেয়ের প্রেমে আঘাত পায় নি তো! আমার মনে শঙ্কার মেঘ, তৎক্ষণাৎ ফোন করলাম ছেলেকে , ছেলে শুনে হেসে কুটোকুটি,বলল তোমাকে, বাবাকে নাস্তানাবুদ হতে দেখার পর আমি প্রেম করবো, আঘাত পাবো। তোমাদের NGO তে কোনো কাজ নেই,সংস্থায় কাজ করো, আমার চিন্তা করতে হবে না, আমি তোমার ছেলে, জাস্ট চিল…
বীথি হেসে বলে, তবু ভালো! সত্যিই ছেলের জন্য চিন্তা হয়, আমারটাও বড়ো হচ্ছে যত পাখনা গজাচ্ছে যেন…
তিতিন: যতদিন নিজের কাছে থাকে ততদিন শান্তি, যতো বড়ো হবে জ্বালা বাড়বে…. কথা বলতে বলতে দুজনে পৌঁছে যায় নেহার বাড়িতে।
পর্ব ৩
নেহার মা দরজা খুলে দেন, বীথিদের বসিয়ে বলেন চিন্তায় চিন্তায় মেয়েটা সারারাত ঘুমায় নি, চোখমুখ বসে গেছে। বীথি: নেহা কোথায়? নেহার মা বলেন মেয়ের টিন ফুড কিনতে গেছে এখনি এসে পড়বে। বীথি: ভগবান না করুন নেহার বরের কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হয় নিতো! আমার মনে হয় থানায় একটা ডায়েরি করা উচিৎ।
জবা দেবী: সকালবেলা আমরা থানায় ঘুরে এসেছি,দেখি কি হয়। একটু সরবত আনি তোমাদের জন্য,যা রোদ! বীথির মনে হয় জবা দেবী একটু ইতস্তত করছেন,তিতিনের দিকে একবার তাকিয়ে জবা দেবীকে বলে মাসিমা আপনি কোন ইতস্তত বোধ করবেন না, আমরা আপনার মেয়ের মতো, এমন কোন ঘটনা যার থেকে কোনো ক্লু পাওয়া যায়। জবা দেবী:নেহা নিজের পছন্দে বিয়ে করে, দুপক্ষের অনুমতিতে,মাস ছয়েক পর থেকে ওরা মাঝে মাঝেই টাকার জন্য চাপ দিতো মেয়েকে, নেহার শাশুড়ি ফোনে বাড়ি করতে অনেক খরচ, হুগলিতে জমি কিনেছে জামাই এইসব কথা বলতেন, আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ, নেহার বাবার পেনশন নেই,তাই টাকার যোগান দিতে পারিনি। কথা বলতে বলতে নেহা ফিরে আসে। নেহার মুখচোখ বসে গেছে,তিতিন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে নেহাকে বলে শক্ত হয়ে মেয়েকে মানুষ করতে হবে নেহা, ভেঙে পড়লে চলবে না। বীথি: তুমি শিক্ষিত মেয়ে ঠিক সামলে নেবে, ফোনের বা অন্য কোনো কারণে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে হয়তো!
নেহা (দীর্ঘশ্বাস ফেলে ): আমার মনে হয় ওদের আর খোঁজ পাওয়া যাবে না, এতটা নিচে নেমে যাবে ভাবতে পারিনি , অনেকের থেকে ধার করা শুরু করে বছর খানেক হলো, আমি বারণ করলেও কথা শোনেনি, কিন্তু তাই বলে নিজের বৌ বাচ্চা ফেলে চলে যাবে, এতটা ভাবতে পারছি না। বিশ্বাস করো বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে, বীথি,তিতান মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।তিতান: ভগবানের উপর বিশ্বাস রাখো, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে তোমায়। নেহা: আমার সার্টিফিকেট, গহনা সবকিছুই ওখানে ছিল, কি অসহায় লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। বীথি: ইউনিভার্সিটি থেকে আবার পেয়ে যাবে , কিছু ডিটেইলস বললে। আমার কিছু চেনাশোনা আছে, তুমি একটু থিতু হয়ে সামলে নাও, জীবনে কখনো থেমে যেতে নেই, তোমার মেয়ের জন্য তোমাকে শক্ত হয়ে সামলে নিতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে। কথাগুলো ভেতরে ভেতরে যেন বীথি নিজের জন্য ও বলে, বিশালের শ্লেষাত্মক মন্তব্য হজম করে সংসার যাপন করতে নিজেকে রপ্ত করে ফেলেছে, হারিয়ে গেছে ভালোলাগার আবেশ, এখন শুধুই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ভবিষ্যতের জন্য রাখতে জীবন,যাতে কলরবের আগামী জীবনটা সুখের হবে।বেশ কিছু সময় কথা বলার পর ওরা বেরিয়ে পড়ে। তিতিন : আমাদের আশেপাশে কত ধরনের মানুষ আছে মুখোশধারী! আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না। বীথি: এতোবড় শয়তান ওর গহনাগুলো নিয়ে গেছে, সার্টিফিকেট তো কোন কাজে লাগবে না, তবে! তিতিন: বাড়ির মালিক যাতে সন্দেহ না করে।চল একবার NGO ঘুরে যাই, বাড়িতে যেন বড়ই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বীথি: হুম, দুস্থ বাচ্ছাদের যে বই,শুকনো খাবার দেওয়ার কথা হয়েছিল তার একটা লিস্ট বানিয়ে নিতে হবে।তিতিন: ছেলের ইঞ্জিনিয়ারিং কমপ্লিট হলে ওর বাবার ইচ্ছা MBA করে,এই নিয়ে বাবা ছেলের মতবিরোধ, আমার আর ভালো লাগে না, রাতে কয়েকদিন হলো পিঠে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে, ডাক্তার দেখিয়ে পেন কিলার খাচ্ছি, একগোছা টেস্ট করাতে ইচ্ছে করে না। বীথি: টেস্টগুলো করিয়ে নাও, বাড়িতে ঝামেলা সবার চলতেই থাকবে, নিজের যত্ন নিজে নাও। আমার ও বাড়িতে যেন দমবন্ধ হয়ে আসে, তোমার সঙ্গে কথা বললে, NGO তে গেলে ভালো লাগে।দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যায়।
পর্ব ৪
বাড়িতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়, বাথরুমে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা নিয়ে ছেলেকে ফোন করে, কলরব বলে ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যাবে, ভালো কিছু বানিয়ে রাখবে। রান্নার দিদি কাল আসবে না বলেছিল,তরকা আর ডিমের কারী করবে ভেবে ডিম সিদ্ধ বসিয়ে দিয়ে সোফায় বসে। নেহার অসহায় মুখটা যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে।আজ সত্যিই ঘটনাটা নয় যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেছে বীথি , মানুষ এতো অর্থ পিশাচ!! দুই বছরের ফুটফুটে মেয়েটার কথা মনে পড়লো না একবার! সাড়ে সাতটা নাগাদ কলরব আসে, হাতে একটা ছোট্ট শোপিস, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে তোমার জন্য আনলাম পছন্দ হয়েছে? বীথির মনটা যেন ভরে উঠল,আবেগ মিশ্রিত স্বরে বলে খুব পছন্দ হয়েছে বাবা, তুই জীবনে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারলেই আমার শান্তি।
বিশালের ফিরতে যথারীতি দেরি, রাতে খাওয়ার পর বিশাল লাগেজ প্যাকিং এ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, নিজের মনে গজগজ করে ভালো লাগে না, লাইফটা হেল হয়ে গেল ছোটাছুটি করতে করতে, বীথি পাশে বসে জিনিস এগিয়ে দিতে থাকে, কিছু সময় পর নেহার ঘটনা সংক্ষেপে বললে, বিশাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে নিজের প্রেজেন্টেশন নিয়ে টেনশনে আছি, তুমি অন্যলোকের টেনশন ঘরে টেনে এনো না, প্রতিদিন অনেক লোক মিসিং হয়,চুরি ডাকাতির FIR ফাইল হয় থানায়, সেই জন্য দুঃখযাপন তোমার সাজলেও আমার সাজে না।যে জামা কাপড়গুলো নোংরা কাচতে দিও প্লিজ, এখন আমায় একটু সেট হয়ে নিতে দাও, কাল ভোরে একটু চা বানিয়ে দিও। বীথি কোনো কথার উত্তর না দিয়ে শোবার ঘরে মোবাইলে নেট অন করে গান শুনতে থাকে। একটা মানুষের এতোটা পরিবর্তন হতে পারে, বিশাল যেন এক অচেনা মানুষ…. দীর্ঘশ্বাস ফেলে… আধা ঘন্টা পর ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। খুব ভোরে অ্যালার্মে ঘুম ভাঙ্গার পর জানলা দিয়ে বাইরেটা বেশ সুন্দর,মনোরম পরিবেশে নিজের মনে গুনগুন করে বাথরুমে যায়, ফিরে এসে বিশালকে ডেকে দেয়। খুব তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে চা পান করে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায়। বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে বাইরের রাস্তায় লোকজন,দুধ, সব্জির গাড়ি দেখতে বেশ লাগে বীথির। হঠাৎ নেহার মুখটা ভেসে ওঠে,চা যেন তিতো মনে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলরবকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ব্রেকফাস্ট বানাতে শুরু করে, অন্যদিকে ভাত বসিয়ে দেয়।কলরব কিছু সময় পর ভাত খেয়ে টিফিন নিয়ে বেরিয়ে যায়, স্কুলের পর ফিরতে সন্ধ্যা হবে বলে যায়।একটু বেলার দিকে তিতিনকে ফোন করলে ফোনটা রিং হয়ে যায়… একটু ভেবে নেহাকে ফোন করে,নেহা ধরা গলায় উত্তর দেয় পুলিশ কোনো খবর দিতে পারে নি, তারপর আস্তে আস্তে বলে আমি ওদের ছাড়াই বাঁচবো..
বীথি: নিজের সার্টিফিকেটগুলো উদ্ধার করতে হবে, তবে হয়তো কোন অসুবিধায় পড়েছে তোমার বর,হতেও পারে। নেহা: আমাকে একবার বলল না, কোথায় যাবে? কোনো আত্মীয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই? বাড়ি পুরো ফাঁকা করে দিতে কে বলেছিল? আমাকে এক প্রকার জোর করে বাপের বাড়িতে ঘুরে এসো বলেছিল! তখনই যদি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসতাম,আজ এই সর্বস্ব খুইয়ে বসতে হতো না। বীথি: শক্ত হয়ে মেয়েটাকে তোমায় মানুষ করতে হবে,ওর বাবা মা তুমি এখন। কিছু সময় কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় বীথি। খানিকটা পরেই তিতিন রিং ব্যাক করে, বীথি রিসিভ করতে বলে রাতে ঘুমাতে পারি নি তাই সকালে ঘুমিয়ে পড়েছি, বীথি জানায় নেহার সঙ্গে কথা হয়েছে, পুলিশ কোনো খোঁজ খবর পায় নি।তিতির: যে ইচ্ছে করে হারিয়ে যেতে চায় তাকে খুঁজে বের করা খুব মুশকিল। দুজনে কথা বলতে থাকে….
পর্ব ৫
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের প্রকোপ বেশি হতে থাকে, রান্নার দিদি এলে তার সঙ্গে চিকেন কারির কিছুটা কাজ এগিয়ে দেওয়ার পর বলে রাতে আসার দরকার নেই আমি একটু ভাত করে নেবো।ফ্রিজ থেকে জলের বোতল নিয়ে সোফায় এসে বসে বীথি, কি মনে হয় বিশালকে ফোন করে, যথারীতি এনগেজড আসে, মনটা যেন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কলরবের ফিরতে সন্ধ্যা হবে বলেছে যখন একটু বেরোতে পারলে হয়তো মনটা ভালো হয়ে যাবে,মেছেদায় এক বন্ধু একটি বৃদ্ধাশ্রম সংস্থা অনেকদিন আগে যোগাযোগ করতে বলছিল, ফোন নম্বর দিয়েছিল, ওখানে কিছু দরকারী জিনিস পৌঁছে দিতে পারলে ভালো হতো… তিতিনের শরীরটা খারাপ যখন একাই যাবে ঠিক করে , বৃদ্ধাশ্রমে ফোন করে বন্ধুর রেফারেন্স দিতে ওনারা বলেন আপনি কিছু ORS, sugar free biscuit, বিস্কুট,গ্লুকোজ এই ধরনের জিনিস আনতে পারেন, বীথি: ঠিক আছে আমি স্টেশনের পাশের দোকান থেকে নিয়ে যাবো, আপনারা আপনাদের লোকেশন আমার এই নাম্বারে হোয়াটস অ্যাপ করে দিলে ভালো হয়। ফোন রেখে বাথরুমে স্নান সেরে রেডি হয়ে নেয়।কোনোরকমে দুটো ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে বীথি কারণ কলরব ফেরার আগে ফ্ল্যাটে ফিরতে হবে। বাড়ির গাড়ি কোনোদিনই ব্যবহার করে না বীথি,টোটোতে মিনিট দশেকের মধ্যে স্টেশনে পৌঁছে যায়। মিনিট পনেরো পর ট্রেনে উঠে পড়ে একটা জানালার ধারে বসতে পেয়ে যায়, বাইরে তাকিয়ে থাকে, হাওয়ায় চুল এলোমেলো হয়ে যায়… মনটা ভালো হয়ে যায়, দূরে দেখে দুজন মিলিটারী যাচ্ছে, কথাশুনে বুঝতে পারে ওরা ডিউটিতে আছেন, ট্রেন জ্যামে আটকা পড়েছে এমন সময় কিছু লোক ট্রেনে উঠে বসে বীথির উল্টোদিকের সিটে, কিছুসময় পর অস্রাব্য ভাষায় নিজেদের মধ্যে হ্যা হ্যা করে কথা বলতে থাকে, কেউ কেউ গায়ের সার্ট খুলে ফেলে,এইসব আচরণ দেখে বীথির পাশের মহিলা বলেন জেনারেল কম্পার্টমেন্টে না উঠলেই ভালো হতো দেখছেন কিরকম অসভ্যতা করছে! বীথি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে এইরকম অস্রাব্য ভাষায় প্রকাশ্যে কথা বলছেন,জামা খুলছেন, কি অসভ্যতা হচ্ছে? একজন চেঁচিয়ে বলে মাগির তেজ আছে! বীথির মুখচোখ লাল হয়ে যায়, চেঁচিয়ে ওঠে মুখ সামলে কথা বলুন! ঠিক সেই সময়ে মিলিটারী দুজন উঠে লোকটাকে দু থাপ্পড় কষিয়ে বলে পরের স্টেশনে চুপচাপ নেমে যাবি, না হলে একটা হাড় ও আস্ত থাকবে না,যা উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, স্টেশন এলে নেমে যাবি। বীথি: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাদের, আপনারা দেশের গর্ব, আপনাদের জন্য আমরা নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারি। ওনারা হেসে বলেন আপনারা হলেন মায়ের জাত, আপনারা ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকবো। পরের স্টেশনে লোকগুলো ভয়ে ভয়ে নেমে পালায়… বীথি মনে মনে বলে বিশালের মতো স্বার্থপর মানুষদের সত্যি এদের থেকে শিখতে হবে জীবনে কিভাবে বাঁচতে হয়… আরো মিনিট পনেরো পর মেছেদায়
নেমে স্টেশনের পাশের দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে কিনে লোকেশন অনুযায়ী টোটো ধরে গিয়ে পৌঁছে যায়। বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় বয়স্ক মানুষগুলোর সাথে সময় দ্রুত ফুরিয়ে যায় যেন, নিজের বাবা মায়ের মুখগুলো যেন ভেসে ওঠে, কিন্তু সময়ে ফিরতে হবে নতুবা কলরব রেগে যাবে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে বেরিয়ে টোটো ধরে স্টেশনে পৌঁছে যায়, খুব তাড়াতাড়ি ট্রেন পাওয়ায় নিশ্চিন্ত হতে পারে,লেডিস কম্পার্টমেন্টে প্রথমে বসতে না পেলেও আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে যেতে বসতে পায়।ব্যাগ থেকে রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে সামনের সিটের দিকে দেখে দু তিনজন বসে আছে। ট্রেনে দ্রুত গতিতে যেন ছুটছে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় মন ভিজেছে যেন অন্তরে।
পর্ব ৬
আস্তে আস্তে ট্রেন বেশ ফাঁকা, বীথি আনমনে জানলার বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ সামনের সিটের অল্প বয়সী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মনে হয় চোখে জল,বেশ কয়েকবার চোখ মুছছে, দু তিনবার মোবাইলে ফোন এলে কেটে দিচ্ছে , তারপর ফোনটা স্যুইচড অফ করে দিয়ে যেন সিঁটিয়ে বসে আছে। বীথি একটু ইতস্তত করে মেয়েটিকে বলে আমার নাম বীথি, বাড়িতে একঘেয়েমিতে অনেক সময় ডিপ্রেশন লাগে তখন বাইরে বেরিয়ে পড়লে মন ভালো হয়ে যায়। তোমার দিকে কয়েকবার তাকিয়ে মনে হচ্ছে কোন সমস্যার মধ্যে আছো। আমি তোমার দিদির মত, যদি কিছু মনে না করো আমাকে বলতে পারো তোমার মনটা হালকা হবে, সমস্যার কোনো সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে। মেয়েটি চুপ করে বসে থাকে, দুচোখে জলের ধারা, বীথি পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে জীবনে কখনো হেরে যাবে না, আমি আমার ছেলেকে একই কথা বলতে থাকি। এগিয়ে চলার নামই জীবন। মেয়েটি জোর করে মুখে অল্প হাসি টেনে বলে কি সমাধান করবেন দিদিভাই, আমার নাম কান্তা,আমাদের গানের একটা ব্যান্ড আছে,তারই একজনের সঙ্গে আমি জড়িয়ে পড়ি, বাড়িতে বিয়ের সন্বন্ধ করছে তাই কিছু না জানিয়ে বেরিয়ে আসি কিন্তু ওর বাড়িতে গিয়ে আমার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে যায়,ও ও বিবাহিত!!! ওর বৌ দরজা খোলে, বলে কাজের জন্য এক সপ্তাহ বাইরে গেছে, অথচ পরশু আমার সঙ্গে দেখা করেছে, তখন বিয়ের সন্বন্ধ হচ্ছে তুমি আমার বাড়িতে দেখা করো বলাতে বললো এই বছরটা কোনো রকমে এড়িয়ে চলো, আমার কোম্পানিতে আরেকটু সেট হয়ে পরের বছর বিয়ে করবো আমরা। কিন্তু বাড়িতে অবস্থা অন্যদিকে ঘোরে,পাত্রের আমাকে দেখে পছন্দ হওয়ায় বাবা আমাকে না জানিয়ে রেজিস্ট্রেশন এর জন্য আবেদন করে দেয়। কাল রাতে জানতে পেরে মনে খুব অস্থিরতা কাজ করে, ভার্গবকে ফোনে পাই নি, অগত্যা আজ ও যেখানে থাকে বলেছিল সেই কমপ্লেক্সে পৌঁছে যাই, কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য সেখানে অপেক্ষায় আছে কি করে বুঝবো দিদি! বীথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে তুমি ওর স্ত্রীকে তোমার নাম বলেছ? আরও কিছু বলেছ? কান্তা: হ্যাঁ, নামটা বলেছি, ভদ্রমহিলা নিরীহ প্রকৃতির, বান্ধবী বলাতে ,আমায় বসতে বলছিলেন কিন্তু আমার মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়েছে! বীথি: নাম যখন বলেছ ভার্গব জানতে পারবে তুমি গিয়েছিলে ওদের বাড়ি, এবার ওর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দাও, বাড়িতে যেমন বিয়ের প্রস্তুতি চলছে মেনে নাও, এটাই জীবন এগিয়ে চলতেই হয়,আর তোমার যদি অপরাধ বোধ লাগে আরেকজনকে ঠকাচ্ছে কি তবে তাকে জানিয়ে দিও তুমি প্রতারণার শিকার হয়েছ আগে, অবশ্যই একটু সময় পিছিয়ে দিও, নিজেকেতো বাঁচতেই হবে, তোমার বাবা মায়ের অবলম্বন হয়ে ওঠো, দেশের সেনাবাহিনীর কথা ভাবো, নিজের দুঃখ কষ্ট সব ভুলে যাবে। ট্রেনে যাওয়ার সময়ের ঘটনা খুলে বলে বীথি। একরকম জোর করেই একটু ফ্রুট জুস খাওয়ায় কান্তাকে, ফোন নাম্বার নেয় । দেখতে দেখতে স্টেশনে পৌঁছে যায় ট্রেন। বীথি কান্তার পিঠ চাপড়ে বলে আজকে তুমি আগামীর অনেক বড়ো বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছ এইভাবে ভাবো, মোবাইল ফোন অন করে মাকে ফোন করো, চিন্তা করছেন হয়তো। বীথি অল্প হেসে এগিয়ে যাচ্ছে এমন সময় কান্তা হাতটা চেপে ধরে বলে অনেক ধন্যবাদ দিদি,আজ তুমি আমাকে নতুনভাবে বাঁচতে শেখালে… একটা অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসে বীথি।
পর্ব ৭
ঘন্টা খানেক পর কলরব ফিরে আসে, বীথি কলরবের সাথে স্কুল, পড়াশোনা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে, একটু হেসে কলরবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে জীবনে কখনো হেরে যেতে নেই, এগিয়ে চলতে হয়, কখনো যদি কোনোরকমে অসুবিধায় পড়িস মাকে লুকিয়ে রাখবি না। কলরব: মা তুমি মাঝে মাঝেই এইধরনের কথা বলো, আমার জাস্ট মাথার উপর দিয়ে যায়,হা হা… বীথি যেন অবাক হয়ে কলরবের প্রাণোচ্ছল হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে মা সবথেকে কাছের মানুষ হয়ে, মায়ের থেকে কোনো কথা লুকাতে নেই।কলরব: একদম ঠিক বলেছ, এখন বলোতো রাতে কি খাবো? বীথি: চিকেন কারি,ভাত। কলরব: উফ্, ফাটাফাটি। কলরব নিজের ঘরে ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। বীথি রান্নাঘরে কাজ এগিয়ে রাখে। ওরা তাড়াতাড়ি রাতে খেয়ে নেয়, কলরব বলে মা কাল ভোরে উঠবো স্যার সকালে পড়াবেন তাই শুয়ে পড়ছি।কলরব নিজের ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছে , বীথি টিভির চ্যানেল এধার ওধারে ঘোরাচ্ছে, তারপর যেন ঘুম জড়িয়ে আসছে চোখের পাতায়, টিভি বন্ধ করে শোবার ঘরে যেতে উঠেছে ঠিক সেই সময় কলিং বেলটা বেজে ওঠে, খুলে দেখে বিশাল, হতবাক বীথি: তুমি আজকে ফিরে এলে! বিশাল: কেন আমাকে দেখে খুশি হও নি!
বীথি যেন মদের গন্ধ পায়, দরজা থেকে সরে এসে বলে তুমি ড্রিঙ্ক করেছ!! বিশাল: ধুর ঢপের কম্পানি, কোনো কিছুর ঠিক নেই, মিটিং হয়েছে সাইট ভিজিট না করেই,সব জায়গায় ঘোটালা, আমি যেন হাঁপিয়ে উঠেছি! বীথি বোঝে অফিসের টেনশন কমাতে বিশাল এমন কান্ড ঘটিয়েছে, আস্তে আস্তে বলে বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও, ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, ছেলে বড়ো হচ্ছে আমাদের বুঝেশুনে এগোতে হবে, আমাদের বদ অভ্যাস যেন ওর মধ্যে সঞ্চারিত না হয়। বিশাল:সরি ভেরি ভেরি সরি ম্যাডাম,শোনোগো বোশেখী হাওয়া ভুল করেছি আমি,ধুস করেছি মাতলামি… বিশাল বাথরুমে ঢুকে গেলে সোফায় ধপ করে বসে পড়ে, নিজের মনে বলে জানিনা আরো কত কি যে দেখার বাকি আছে! পরমুহূর্তেই মনে পড়ে কলরব ভোরে ঘুম থেকে ডেকে দিতে বলেছিল ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে দেয়। বিশাল বাথরুমে থেকে বেরিয়ে এসে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে যেন একটা অদ্ভুত শূন্যতা গ্রাস করে বীথিকে, সামনের রাস্তায় নিয়নের আলোয় যেন মনে হয় মানুষের ভিতরটা এতো কদাকার কেন হয়!!কখন চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসে…. বেশ রাতে ঘুম ভাঙ্গার পর বিথী উঠে কলরবের ঘরে ঢুকে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরের অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গার পর চোখের পাতায় যেন ভারি লাগে, পাশে বিশাল নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে, একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেসিনে মুখ চোখে ভালো করে ধুয়ে নেয়। কলরবকে আদর করে ডেকে তুলে চা বানিয়ে নিয়ে আসে, কলরব: বাবা কাল কখন ফিরেছে? বীথি: তুই ঘুমানোর পর,তাই তোকে আর জাগাইনি, এখন যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব রেডি হয়ে নে, সন্ধ্যায় বাবার সঙ্গে কথা বলিস, বাবা খুব ক্লান্ত ছিল ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।কলরব রেডি হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর বীথি কিছুটা আশ্বস্ত হয়, অন্তত ছেলের কাছে বাবার ভাবমূর্তি ঠিক থাকলেও অনেকটা স্বস্তি! বেলায় ঘুম ভাঙ্গার পর বিশাল চুপচাপ নিজের ল্যাপটপে কাজ করতে থাকে, কিছু সময় পর বীথিকে বলে কিছু অর্ডার করতে হবে? বীথি: না ,আজ ভাত খেয়ে বেরোবে? বিশাল মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলে হ্যাঁ বেলার দিকে, হালকা কিছু রান্না করে রেখো। বীথি কথা না বাড়িয়ে রান্নার দিদির সাথে কাজ এগোতে থাকে।আর পাঁচটা দিনের মতোই কিছু সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে বীথি,বেশ কয়েকদিন পর কাজে সকাল থেকে সন্ধ্যা নেমে আসে, হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে, রিসিভ করতে অপর প্রান্তে পুরুষকন্ঠ ,চিনতে পারছিস? আমি কলেজের বন্ধু মহিরুহ বলে এই সামনের সপ্তাহে রিইউনিয়ন এ আসবি, আমি এবার এখানে আছি, পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হবে, তোর নাম্বারটা পেয়ে ফোন করবার লোভ সামলাতে পারলাম না। কেমন আছিস? বীথি একটু হেসে জবাব দেয় ভালো আছি, কিন্তু সামনের সপ্তাহে হবে না আমার, ভালো থাকিস। কিছু সময় কথা বলে ফোনটা রেখে দেয় বীথি। ইচ্ছে হলেই যেতে পারে কিন্তু যেন না বলতেই ভালো লাগলো, কিছু মানুষের কাছে অধরা থাকাই ভালো, সেই আগের সময়টুকু মনে গেঁথে থাক। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গান শুনতে থাকে বীথি, হঠাৎ মহিরুহর ম্যাসেজ ইচ্ছে করে আসছিস না, কোনো যোগাযোগ ছিল না বলে। বীথি কোনো রিপ্লাই দেয় না,কি হবে এমন অসম বন্ধুত্ব, কয়েকদিন পর বাইরে চলে যাবে ব্যস্ত জীবনে, বীথি সেই একই জায়গায়…. হঠাৎ কলরবের ছবির দিকে তাকাতেই মনটা ভরে ওঠে,এই একটা জায়গা বড়ো খাঁটি….
পর্ব
তিতিরের ফোন আসে একটু রাতে ,তিতিন বলে আগামীকাল নেহাকে ইউনিভার্সিটি নিয়ে যাবো,ওর সার্টিফিকেটগুলো উদ্ধার করতে হবে, বীথি: তোমার শরীর ঠিক আছে? তিতিন: হ্যাঁ কাল ডাক্তার দেখিয়েছি, স্পন্ডিলাইটিস বলছে, রেগুলার ব্যায়াম দিয়েছে। বীথি: হুম ব্যায়াম ঠিক ভাবে করবে, নেহার সার্টিফিকেট পেলে কোন জায়গায় ইনভলভ করাতে হবে, আমি যেমন কিছু সময় ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে থাকি, জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকবে না।তিতিন: ঠিক বলেছিস। ওর সঙ্গে যাচ্ছি ওর হারানো কনফিডেন্স ফিরে পাবে। বিথী: খুব ভালো।আগামী সপ্তাহে একদিন NGO তে যাবো। ফোন রেখে বাড়িতে বিশালের অগোছালো জামা কাপড় এক জায়গায় রাখার সময় ওষুধের ব্যাগ টেবিলে তুলে রাখে।
রাতে বাবা ছেলে গল্প করছে দেখে বারান্দায় চেয়ারে আলতো হেলান দিয়ে গান শুনতে থাকে, কলরব শোয়ার আগে বলে কাল পড়ার ছুটি সকালে তাড়াতাড়ি ডাকবে না। বিথী চুপচাপ তাকিয়ে মুচকি হেসে গান শুনতে থাকে।বেশ কিছু সময় পর হঠাৎ বিশাল বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে দেখে বিথী মুখটা তুলে উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু অবাক হয়ে যায় বিশালের মুখচোখ যেন উদভ্রান্তের মত, বিথী: কি হয়েছে? কিছু বলবে? বিশাল বিথীর কাঁধ চেপে ধরে বলে বলো তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না,বলো তুমি নিজের যত্ন নেবে। বিথী খুব অবাক হয়ে বলে কোথায় যাবো? তোমার ছেলে, সংসার ছেড়ে যাওয়ার জায়গাই বা কোথায়? বিশাল: নিজের যত্ন নিতে হবে, আমি আর তোমাকে কোনদিন কষ্ট দেবো না, কিন্তু মনে রাগ চেপে ধরে রেখো না। বিথী: কি হয়েছে বলোতো? ঝগড়া অশান্তি সব পরিবারে হয় তাই বলে কি কেউ ছেড়ে চলে যায়? মাথা খারাপ! এই বয়সে কে নেবে আমায়! এটা খুব রূঢ় সত্য। বিশাল: স্যারের স্ত্রী আজ আত্মহত্যা করেছে, এইমাত্র খবর পেলাম, সন্দেহের বশে এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন! জানি না কতটা সত্য কতটা মিথ্যা, কিন্তু আমি, আমরা তোমাকে ছাড়া বাঁচব না,আমায় ক্ষমা করে দাও, বিশাল বিথীকে শিশুর মতো জড়িয়ে ধরে ,আজ অনেক বছর পর যেন বিথী পুরানো বিশালকে খুঁজে পায়। জীবন বোধ এইরকমই,সুপ্ত ভালোবাসা যেন প্লাবিত আজ দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলে পুরাতন প্রেম নতুন আবেশে…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *