Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ || Adrish Bardhan

ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ || Adrish Bardhan

ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ

গোয়েন্দা আমরা প্রত্যেকেই, দাঁতে কামড়ানো চুরুটের ফাঁক দিয়ে জড়িয়ে মড়িয়ে বলল ইন্দ্রনাথ। প্রাত্যহিক জীবনে কে গোয়েন্দা নয় বলতে পারো?

চাইনিজ শ্রিম্প বল খাওয়ার নেমন্তন্ন করেছিল কবিতা। সাদা বাংলায়, চিংড়ি, পকৌড়া। পাকস্থলী পরিপূর্ণ হওয়ার পর শুরু হয়েছে নির্ভেজাল আচ্ছা।

মেয়ে-গোয়েন্দা অবশ্য ঘরে ঘরে, সোয়ামীদের ওপর নজর রাখার সময়ে, মুচকি হেসে চুটকি ছাড়ল কবিতা : যেমন আমার ঘরে আমি গোয়েন্দা।

ইন্দ্রনাথ রসিকতার মুডে ছিল না। তাই একতাল ধোঁয়া ছেড়ে বললে, যেমন ধরো উকিল, ডাক্তার, অফিসার, ব্যবসাদার, রিপোর্টার। হোয়াইট হাউসের ভিত কাঁপিয়ে ছাড়ল দুজন রিপোর্টার। গিয়েছিল চুরির ঘটনার খোঁজে–পেলো সাপের সন্ধান। শুরু হল গোয়েন্দাগিরি। টেলিফোনে খবর নিতে হবে? প্রশ্ন করে চুপ করে থাকো দশ সেকেন্ড। জবাব না এলে বুঝতে হবে প্রশ্নের জবাব হল হ্যাঁ। টেলিফোনও যখন বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল, তখন হোয়াইট হাউসের কেউকেটাটির সঙ্গে দেখা করার সঙ্কেত জানানো হত ঝুল বারান্দার কোণে ফুলদানি বসিয়ে দেখাসাক্ষাতের সময় জানানো হত পরের দিনের নিউইয়র্ক টাইমস-এর ২০ নম্বর পৃষ্ঠায়। সেই পৃষ্ঠায় ঘড়ির কাঁটা এঁকে গোপন সংবাদদাতা জানিয়ে দিতেন কোথায় কখন দেখা পাওয়া যাবে তার। আশ্চর্য, তাই না? গোয়েন্দা সাংবাদিকদের দৌলতেই সিংহাসনচ্যুত হলেন বহু কু-কর্মের নায়ক প্রেসিডেন্ট নিকসন।

আমি বললাম, নতুন কথা কিছু শুনছি না।

ভুরু তুলে ইন্দ্রনাথ বললে, নিকসনের ছিদ্র অন্বেষণ দূর করে শুধু একখানা বই লিখেই বব আর কার্ল আজ পর্যন্ত পিটেছেন এক কোটি চোদ্দো লক্ষ টাকা। বই লেখার আগেই প্রকাশকের কাছে পেয়েছেন পঁয়তাল্লিশ হাজার ডলার। প্লেরা পত্রিকা লেখাটা ছেপেছে ত্রিশ হাজার ডলার দিয়ে। ফিল্ম প্রোডিউসার সিনেমা করবেন বলে দিয়েছেন সাড়ে চার লক্ষ ডলার। পেপার ব্যাক বার করার জন্যে নিলাম করে বইটার দাম তুলে দিয়েছেন দশ লক্ষ ডলার পর্যন্ত। পুলিজার পুরস্কার পর্যন্ত পকেটে পুরেছেন ওঁরা। মৃগাঙ্ক, ইচ্ছে যায় আমার কেসগুলো বব আর কার্লের হাতে তুলে দিই। কলমের জোর থাকলে কি না হয়!

মাথা গরম হয়ে গেল আমার : নিজেকে বিরাট মনে করছিস মনে হচ্ছে? আমার না হয় কলমের জোর নেই, তোরও গোয়েন্দাগিরির জোর এমন কিছু নেই যে রাতারাতি পৃথিবী বিখ্যাত হবি। এত অহঙ্কার ভালো নয়। পতনের পূর্ব লক্ষণ।

যেন শুনতেই পায়নি। এমন ভাবে জানলা দিয়ে আকাশ দেখতে দেখতে ইন্দ্রনাথ আত্মগত ভাবে বলে চলল, যত ভাবি ততই অবাক হই। গোয়েন্দা কে নয়? সব মানুষই নিজের নিজের পেশায় অল্পবিস্তর গোয়েন্দা। চিন্তাকে যে ডিসিপ্লিনে আনতে পেরেছে, বুদ্ধিকে যে একাগ্র করতে পেরেছে, পর্যবেক্ষণকে যে প্রয়োগ করতে পেরেছে–গোয়েন্দা হবার যোগ্যতা তার মধ্যে আছে। ভালো ডাক্তারকেও ফাঁদ পেতে রোগকে সন্ধান করতে হয়। এইরকম একটি চরিত্র শার্লক হোমস এবং সুবিখ্যাত ডিটেকটিভ মেথডের সৃষ্টি করেন কোনান ডয়াল। অফিসার যদি অন্ধ হয়, কারবারি যদি ভোঁতা-বুদ্ধি হয়, তাহলে লুঠেরা জোচ্চোরেরা দুদিনেই রাজা হয়ে বসত। বুদ্ধির লড়াই চলছে। সর্বক্ষেত্রে। এরকম টুকটাক অনেক ঘটনা আমার জানা আছে। অফিসার নিজেই গোয়েন্দা হয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছে কোম্পানির।

তা ঠিক, সায় দিল কবিতা : প্রবঞ্চকরা দুষ্ট জীবাণুর মতোই কিলবিল করছে আশেপাশে। যে যত ভালো গোয়েন্দা, সে তত নিরাপদ। কথাগুলো দামি কথা সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার নিরীহ সোয়ামীকে ঠেস দিয়ে কথা বলার কি দরকার বলতে পারো?

কেন বলব না বলতে পারো? চুরুট নামিয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, স্ট্যানলি গার্ডনার, সিরিল হেয়ার–এঁরা প্রত্যেকেই পেশায় উকিল। তাই তাদের গোয়েন্দা গল্পে অত ধার। কোনান ডয়াল, নীহার গুপ্ত পেশায় ডাক্তার–তাই লেখাও ক্ষুরধার। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, জি-কে চেস্টারটন সাহিত্যের সম্রাট–গোয়েন্দা গল্পেও তার আভাস। কিন্তু আমাদের মৃগাঙ্ক রায়ের কি গুণ আছে বলতে পারো। না, না, চটলে চলবে না। গুণীর কাছে প্রশস্তির চেয়ে সমালোচনার কদর বেশি।

কিন্তু এর নাম ছিদ্রান্বেষণ–সমালোচনা নয়। মুখ টিপে হেসে বলল কবিতা।

ছিদ্র অন্বেষণ করাই তো আমার কাজ। চুরুট ফের কামড়ে ধরে বলল ইন্দ্রনাথ, নিচ্ছিদ্র চক্রান্তে ছিদ্র খুঁজে বার করার সাধু নাম হল গোয়েন্দাগিরি। সত্য আর ছিদ্র এক্ষেত্রে একই টাকার এপিঠ-ওপিঠ।

মুখ লাল করে বললাম, এর শোধ আমি তুলব, ইন্দ্র। এখন থেকে তোকে ছিদ্রান্বেষী ইন্দ্রনাথ বলেই চালাব–সত্যান্বেষী নয়।

অট্টহেসে বললে ইন্দ্রনাথ, ভালোই তো, তাতে এক ঢিলে দু-পাখি মরবে। তোর ভাষায় গ্ল্যামারের অভাব প্রকাশ পাবে। আর, এতদিন বাদে আমার কপালে একটা খেতাব অন্তত জুটবে।

এমন সময়ে কবিতা বললে সবিস্ময়ে, ওকি অবনীবাবু, নাক টিপে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

রাগ জল হয়ে গেল দরজার দিকে তাকাতেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার অবনী চাটুয্যে দাঁড়িয়ে সেখানে। তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে আছেন বাঁ-নাকের বাম ছিদ্র। বললেন অনুনাসিক কণ্ঠে, দেখছি উঁন ফুটোয় নিসে পড়ছে কিনা।

তাজ্জব হয়ে বললাম, সে আবার কী?

নাক ছেড়ে দিয়ে বাঁ-পা আগে বাড়িয়ে ঘরে পদার্পণ করলেন অবনীবাবু। বললেন, শাস্ত্র তো মানেন না। মানলে এত দুর্ঘটনা দেশে ঘটত না।

সকৌতুকে বলল ইন্দ্রনাথ, ইড়া আর পিঙ্গলার ব্যাপার মনে হচ্ছে?

ভীষণ খুশি হলেন অবনীবাবু ও যাক, জানেন তাহলে। শুভকর্মে চন্দ্রনাড়ী প্রশস্ত। মানে, বাঁ-নাকে নিসে পড়লেই শুভকর্ম করা উচিত।

এখন কোন নাকে পড়ছে দেখলেন?

বাঁ-নাকে। সেই জন্যেই তো বাঁ-পা ফেলে ঢুকলাম মশায়।

অশুভ ঝাটে পড়েছেন মনে হচ্ছে?

টাক চুলকে বললেন অবনীবাবু, আর বলেন কেন, একেবারে নিচ্ছিদ্র প্লট মশাই– স্কাউড্রেলটাকে ধরেও ধরতে পারছি না।

অপাঙ্গে আমার পানে চাইল ইন্দ্রনাথ। বলল, ছিদ্র খুঁজতে হবে তো? বলুন, বলুন, ছিদ্রান্বেষী হাজির।

.

বলব কি মশায়, রাত দুটোর সময়ে সে কি উৎপাত! ঝনঝনঝন। বুঝছেন তো কীসের উৎপাত? টেলিফোন! টেলিফোন! যতক্ষণ মরে থাকে, ততক্ষণ ঘুমিয়ে খেয়ে জিরিয়ে বাঁচি মশায়, জ্যান্ত হলেই প্রাণান্ত!

যাক, যা বলছিলাম, রাত দুটোর সময়ে আরম্ভ হল টেলিফোনের বাঁদরামি। ঠিক যেন ঘুংড়ি কাসি। ইচ্ছে হল দিই ব্যাটাকে এক ডোজ স্পঞ্জি খাইয়ে। হোমিওপ্যাথি বিদেশ থেকে এসেছে বলে এত হেনস্থা করবেন না। গরু হারালে শুধু গরু খুঁজে পাওয়া যায় না। বাদবাকি সব হয়। মহাত্মা হানিম্যান বলেছেন…

যাচ্চলে! যা বলতে যাচ্ছিলাম ভুলে গেলাম…। ও হ্যাঁ, নিচ্ছিদ্র প্লট। রাত দুটো। টেলিফোন। ঘুম ভাঙতেই তেড়েমেড়ে রিসিভার খামচে ধরে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে? কে? এত রাত্রে কীসের দরকার?

অমনি মিষ্টি গলায় তোতলা স্বরে ককিয়ে উঠছিল একটা মেয়েছেলে : অবনীবাবু? বাঁ-বাঁচান! ওরা আ-আ-আমাকে কিডন্যাপ করতে আসছে!

সে এক জ্বালা মশায়! ভগবান তোতলাদের মেরেছেন। আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু কথা বলতে গেলে বলুন দিকি মাথা গরম হয় না?

যাই হোক, হড়বড় করে তোতলাতে তোতলাতে মেয়েটা বললে পার্ক টেরেসের দশতলার ফ্ল্যাট থেকে তাকে গায়েব করতে আসছে ডাকাতরা। এক্ষুনি না এলেই নয়।

কথার শেষ পর্যন্ত শোনা গেল না, কড়-ড়-ড় করে গেল লাইনটা কেটে। এদিকে অ্যাটম বোমা ফাটিয়ে মরছি; অথচ টেলিফোনটা পর্যন্ত নিখুঁত বানাতে পারি না। মাইক্রোস্কোপ আনাই বিলেত থেকে। ঘেন্না ধরে গেল মশাই দেখে শুনে।

ওইরকম টেলিফোন পেলে চুপচাপ থাকা যায় না। দূরভাষিণীর মুণ্ডপাত করতে করতে ধড়াচূড়া এঁটে নিলাম। পার্ক স্ট্রিটেই যখন বদলি হয়েছি, তখন পার্ক টেরেসে না গিয়েও তো থাকা যায় না। বেরোতে যাচ্ছি, এমন সময়ে আবার উৎপাত। ফের টেলিফোন!

এবার অবিকল সেই রকম মেয়েলি গলা। সেই রকমই মিষ্টি, কিন্তু যেন সর্দিৰ্বসা–মানে আপনাদের ছেলেছোকরাদের ভাষায় সেক্সি। শুধু যা তোতলা নয়।

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। প্রথম মেয়েটার নাম হিমি, দু-নম্বর মেয়েটার নাম হিমা। হিমি নাকি হিমার ছোটবোন। হিমা কান্না কান্না গলায় বললে, এক্ষুনি নাকি হিমিকে জোর করে নিয়ে যাবে মেয়েচোরেরা। ঠিকানাও বলে দিল। একই ঠিকানা। পার্ক টেরেসের দশতলা।

দুজন সেপাই আর একজন অফিসারকে নিয়ে ছুটলাম তক্ষুনি। নির্জন রাস্তা। পার্ক স্ট্রিটে অবশ্য রাত বলে কিছু নেই। দশতলা পার্ক টেরেসের সামনে আসতে না আসতে দেখলাম, সত্যি সত্যিই একটা মেয়েকে কাঁধের ওপর ফেলে বেরিয়ে আসছে একজন লোয়ার ক্লাসের লোক। পেছনে আরও দুজন। ওরা এসে দাঁড়াল একটা উইলিজ জিপের সামনে।

কিন্তু ঠিক সেই সময়ে মোড় ঘুরল আমার জিপ। ফুলস্পিডে গাড়ি চালাচ্ছিলাম। টহলদারি পুলিশকার হলে অত জোরে ছুটত না। ধড়িবাজ মেয়েচোরেরা তা বুঝেই বোধহয় মেয়েটাকে ফুটপাতে ফেলেই ফের ঢুকে পড়ল পার্ক টেরেসে।

মহা পড়ে পড়লাম তাই দেখে। মেয়েটাকে সামলাব, না স্কাউনড্রেলগুলোর পেছনে দৌড়াব। বুড়ো বয়েসে আমি তো আর ছুটতে পারি না। পার্ক টেরেসের বাড়িখানাও চাট্টিখানি কথা নয়। ফ্ল্যাটের সংখ্যাই তো আড়াইশ। শয়তান তিনটে কোথায় লুকিয়েছে দেখতে হলে আরও সেপাই চাই। আমি তাই মেয়েটাকে জিপে চাপিয়ে একজন সেপাই নিয়ে ফিরে এলাম থানায়। পরে ভ্যানভর্তি সেপাই পাঠালাম বটে কিন্তু ওদের আর টিকি দেখতে পেলাম না। উইলিজ জিপটাও নাকি চোরাই জিপ।

চুলোয় যাক সেকথা। ফ্যাসাদের শুরু হল থানায় ঢুকতেই। দেখি কি আমার অফিস ঘরে বসে অবিকল, ওই রকম চেহারার একটা মেয়ে। বলব কি মশায়, ঠিক যেন সন্দেশের ছাঁচে তৈরি মুখ চোখ। যমজ। বুঝেছেন? বউমা, অমন চোখ বড় বড় করে অকিও না মা। আরও আছে। শেষকালে চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসতেও পারে।

অজ্ঞান মেয়েটার জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করলাম। যমজ বোনের পরিচয়ও পেলাম। হিমি আর হিমা। বড়লোকের মেয়ে মশাই। আদুরে আদুরে চেহারা। আইবুড়ো। অথচ বাপ এখনই দশতলা বারোতলা বাড়িতে একটি করে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন। ব্ল্যাকমানির খেলা তো, বলবার কিছুই নেই। মেয়েগুলিও হয়েছে তেমনি।

মরুকগে! ওদের কথা শুনব বলে বসতে না বসতেই রাতবিরেতে আর এক আপদ। বলুন দিকি কি আপদ? কল্পনাও করতে পারবেন না মশাই। মৃগাঙ্কবাবু অবশ্য আমাকে নিয়ে ঠেসে ক্যারিকেচার লিখছেন, কিন্তু বললে রাগ করবেন জানি–ওঁর কল্পনা শক্তিও তো তেমন নয়।

বউমার মুখ ভার হল কেন? আসল কথা না বলে, বাজে কথা বলছি বলে? বুড়ো হয়েছি তো। রিটায়ারের সময় হয়ে এল। এখন একটু ফালতু কথা বলে ফেলি। কিছু মনে কোরো না। কী বলছিলাম? ও হ্যাঁ। আর একটা আপদ। ধরতে পারেননি তো কি আপদ? মেয়েছেলে মশায়, আর একটা মেয়েছেলে। ভোর চারটের সময়ে হন্তদন্ত হয়ে থানায় ঢুকল আর একটা মেয়েছেলে। অবিকল অন্য দুজনের মতো দেখতে।

বললে না পেত্যয় যাবেন মশায়, থানাশুদ্ধ লোক ব্যোমকে গেল তিন তিনটে একই ছাঁচের সন্দেশ দেখে। সরেশ সন্দেশ। কিন্তু এরকম কাণ্ড কখনও দেখিনি হোল লাইফে। যমজ পর্যন্ত দেখেছি, কিন্তু…কিন্তু…তিনটে মেয়ে একই ডিম ফুটে বেরোলে কী বলা উচিত মৃগাঙ্কবাবু?…এমজ? ঠিক, ঠিক! এমজ! এমজ বোনই বটে। নামও শুনলাম তিন নম্বরের। হিমু। মানে, হিমি, হিমা আর হিমু হল

অনেক রাত্রে গ্র্যান্ড হোটেলের বিউটি কনটেস্ট থেকে। তিনজনেই ড্রেসিং টেবিলে একটা করে চিঠি পেয়েছে। তিনজনের চিঠিতেই লেখা আছে–বাপের পকেট থেকে লাখখানেক টাকা খসিয়ে না আনলে, খাঁচায় পোরা হবে সেই রাতেই। রাজি থাকলে জানলায় টর্চের আলো জ্বেলে রাখতে হবে একটানা এক মিনিট রাত ঠিক দুটোর সময়ে।

রূপকথা শোনাচ্ছি, ভাববেন না যেন। খাস কলকাতায় এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা মোহন সিরিজকেও টেক্কা মারতে পারে মশাই। সাঙ্কোপাঞ্জা শুধু রোমাঞ্চের পাতায় কেন, এই শহরেই আকচার ব্যাচেলার কিনা ভগবান জানেন–একা একা ফ্ল্যাটে থাকে–বাপ-মা অন্যবাড়িতে ফুর্তি করে নাগর নাগরী নিয়ে–এ ভাবা যায় না!

এই দেখুন, আবার আলতু-ফালতু বকতে আরম্ভ করেছি। দেখছি, আমার নিজেরই ব্যারাকার্ব খাওয়া উচিত। হোমিওপ্যাথি ওষুধ মশাই, বাঁচালতার দাওয়াই।

যাচ্চলে, আবার সব গুলিয়ে গেল। ও হ্যাঁ…হিমা আর হিমু চালাক মেয়ে। চিঠি পেয়েই টর্চ জ্বালিয়ে সঙ্কেত করেছে জানলায়। হিমি করেনি। ভয়ের চোটে সটান ফোন করেছে আমাকে। তারপর টেলিফোনে খবর দিয়েছে দুই বোনকে। টেলিফোন পেয়েই ওরা দুজনেই ছুটে এসেছে থানায়। এবার শুনুন, আসল কারবারটা!

তার আগে মা লক্ষ্মী, একটু চা-টা হবে? কফি-টফি না হলে গলাটা ইদানীং বড় শুকিয়ে যায়। আসছে? বেশ! বেশ! মা লক্ষ্মী আমাদের সাক্ষাৎ শচী দেবী–মৃগাঙ্কবাবু ভাগ্যবান ব্যক্তি। আমার গিন্নিটি হয়েছে বেয়াড়া টাইপের। কেউ চা চাইলেই এমন মুখখানা করবে, যেন ঘরে চিনি নেই।

গেল যা। আবার অন্য লাইনে চলে এসেছি। সেদিন একটা আমেরিকান নাটক দেখলাম মশাই। আমার হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা। এক বুড়ো আর এক বুড়ি। দুজনেরই দ্বিতীয় বিয়ে। দুজনেই খালি খুলে যায়। দুজনেই এক পার্টনারের স্মৃতি, আরেক পার্টনারের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলছে। আমার হয়েছে…।

ধুত্তোর! কী বলছিলাম? ও হ্যাঁ…আসল কারবারটা। আসল কারবারটাই বলা হয়নি এতক্ষণ। হিমি, হিমা আর হিমুর মাটি হলেন আর এক শচী দেবী। এই…এই…এই দ্যাখো মা! কী বলতে কী বলে ফেললাম। ইন্দ্রজায়া শচী দেবীর একটা মস্ত দুর্নাম আছে, জানো তো? যখন যার, তখন তার। পুরোনো ইন্দ্রকে হটিয়ে স্বর্গটা যে দখল করবে, শচী দেবী হাসি হাসি মুখে অমনি তার হেঁসেল ঠেলতে আরম্ভ করে দেবেন। হিমি, হিমা আর হিমুর জননীটি অনেকটা তাই। মানে, সোসাইটি গার্ল। গার্ল এককালে ছিল–এখন পাক্কা লেডি। ফাংশন, মিটিং, পার্টি নিয়েই ব্যস্ত। স্বামীর নাম? এখনও বলিনি? হ্যাঃ হ্যাঃ! এই জন্যেই বোধ হয় ডি-সি পোস্টে প্রোমোশনটা আটকে গেল আমার। ভদ্রমহিলার স্বামী মস্ত কারবারি। কোচিন থেকে নারকেল এনে কলের ঘানিতে পিষে তেল বার করে সাপ্লাই দেন নানা কোম্পানিতে। বি-এম-পি তেলের নাম শোনেননি? খাঁটি নারকেল তেল বলতে আর কিছু নেই এদেশে।

কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর ভদ্রলোকের মতিভ্রম হয়েছে বোধ হয়। বিশেষ করে প্যারালিসিসে কোমর থেকে নীচ পর্যন্ত অবশ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই মাথায় নাকি ভূত চেপেছে। অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবসার পরিকল্পনা কাঁদছেন। মানে, শেষ পর্যন্ত কারবারটাকে তুলে দেওয়ার মতলব আর কি।

একটা প্ল্যান শুনবেন? কোচিন আর সিলোন থেকে জাহাজ-ভর্তি নারকেল এনে নাকি পোষাচ্ছে না। ঠিক করেছেন, চাষ করবেন নিজের দেশেই। সুন্দরবনে নারকেল ফলিয়ে দেশের চেহারা পাল্টে দেবেন। হাসবেন না! হাসবেন না। প্ল্যানটা একেবারে অবাস্তব নয়। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাঁধবে কে? পশ্চিম বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে বঙ্গোপসাগরের গায়ে যে রিজার্ভ ফরেস্ট আছে, সেখানকার নোনা মাটি আর আবহাওয়া নাকি নারকেল চাষের উপযুক্ত। উনি ঠিক করেছেন সেখানে এক লাখ নারকেল চারা লাগাবেন। মোটামুটি আট থেকে দশ বছরের মধ্যে ফল দেবে এক-একটা নারকেল গাছ। গাছ যতদিন বাঁচবে, ফলও তদ্দিন মিলবে। এক লাখ চারার মধ্যে পঁচাত্তর হাজার চারাও যদি বেঁচে থাকে, মন্দ কি? গাছ পিছু বছরে মাত্র একশো টাকার নারকেল ধরলেও, বছরে পঁচাত্তর লক্ষ টাকা নীট লাভ।

শুধু কি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা? নারকেল তেল, নারকেল দড়ি ইত্যাদির জন্যেও কলকারখানা গড়ে তোলা যাবে ওখানে। ফলে, সুন্দরবন অঞ্চলের সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। সুন্দরবনে হঠাৎ ক্রাইম বেড়ে যাওয়ায় কর্তাদের গরম মাথা ঠান্ডা হয়ে যাবে। হাতে পয়সা এলে চুরি-ডাকাতির সাধ কার থাকে বলুন?

গভর্নমেন্ট প্রকল্পটি লুফে নিয়েছেন। রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে জমিও দিয়েছেন। তাইতেই লেগেছে গৃহবিবাদে। মানে বি-এম-পি অয়েল মিলের মালিক সনাতনপ্রসাদের সঙ্গে তার বিদুষী বিবি অহল্যার।

নামখানা শুনেছেন? অহল্যা। মেয়েদের মুখে শুনলাম, মা নাকি সত্যিই অহল্যা রূপের দিক দিয়ে। বাবা এই রূপ দেখেই টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন ভদ্রমহিলাকে। মেয়েদের জুলুষ দেখলেই অবশ্য খানিকটা আঁচ করা যায়। কিন্তু মায়ের ছিটেফোঁটাও নাকি ওদের বরাতে জোটেনি।

কী বলছিলাম মা লক্ষ্মী? কর্তা-গিন্নির ঝগড়ার কথা, তাই না? সুন্দরবনে নারকেল চাষ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই খিটিমিটি লেগেছে, বাপ-মায়ের মধ্যে, বলল এমজ মেয়েরা। সনাতনপ্রসাদ নাকি নিজে তো মরতে বসেছেন, মরার আগে কারবার পর্যন্ত মেরে যাবেন।

যাকগে সেসব ঘরোয়া কেচ্ছা। মেয়ে তিনটের ওপর এই সময়ে নেকনজর পড়ল কোন হারামজাদাদের, জানবার জন্যে শুরু করলাম তদন্ত। সেরকম তদন্ত, কিছু মনে করবেন না ইন্দ্রনাথবাবু, আপনিও পারবেন না। অত ঝক্কি সইবার ক্ষমতা আপনাদের নেই। মৃগাঙ্কবাবু অবিশ্যি রুটিন তদন্ত বলে যথেষ্ট বিদ্রূপ করেন আমাদের পদ্ধতিকে। কিন্তু রুটিন তদন্তে একবার করতে আসুন না। কাছা খুলে যাবে।

তদন্তর ফিরিস্তি দেব না। তবে কি জানেন, তদন্তই সার হল। বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো আর কি। মেয়ে তিনটেকে কিছুতেই ফ্ল্যাট থেকে সরানো গেল না। সনাতনপ্রসাদের স্পেশাল রিকোয়েস্টে কনস্টেবল বসিয়ে রাখলাম ফ্ল্যাটের গোড়ায় দিন কয়েকের জন্যে। কিন্তু সাতটা দিনও গেল না।

এবার আসছি আসলের আসল ব্যাপারে। রিয়াল মিস্ট্রি এইখানেই। কান খাড়া করে শুনুন মৃগাঙ্কবাবু। দয়া করে, নেক্সট গল্পে আমাকে একটু ক্রেডিট দেবেন।

সনাতনপ্রসাদের ফ্যাক্টরিতে কিছুদিন আগে বিশ্রী লেবার মুভমেন্ট হয়ে গিয়েছিল। জানেন তো, আজকালকার শ্রমিক-কর্মচারীরা কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে। ম্যানেজমেন্টকে যা খুশি তাই করতে দেয় না। ইউনিয়নের সঙ্গে মিটিং করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

সনাতনপ্রসাদ তার ধার ধারেননি। সুন্দরবনে নারকেল চাষ প্রসঙ্গে সরাসরি সরকারের সঙ্গে চুক্তিতে নেমেছেন। ফলে, আতঙ্ক দেখা দিয়েছে কারখানায়। লিডাররাও কিছু একটা না পেলে লেবার তাতাতে পারে না। এই ইস্যু নিয়ে ওরা এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করল কারখানায় যে, সনাতনপ্রসাদের প্রাইভেট কোয়ার্টারের সামনে সি-আর-পি বসাতে হল চৌপর দিনরাত।

আরও খবর পেয়েছি মশাই। অহল্যা দেবী নিজেও নাকি কারখানার লোককে খেপিয়ে তুলেছেন। লিডারদের ডেকে উস্কে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, কাটা দিয়ে কাঁটা তোলা। শ্রমিকদের চাপে যেন স্বামীরত্ন ভড়কে যান এবং নারকেল চাষ শিকেয় তুলে রাখেন। বড় ঘরের বড় ব্যাপার। দেখে দেখে চোখ পচে গেল।

হঠাৎ হিমি-হিমা-হিমুর কেস টেকআপ করার সাতদিন পরে, একটা অদ্ভুত কাণ্ড ঘটল সেদিন রাত্রে একটা বিয়ে বাড়িতে নেমন্তন্ন গিয়েছিলেন অহল্যাদেবী। আত্মীয় বাড়ির নেমন্তন্ন। মাঝরাতে লগ্ন। তাই ঠিক করেছিলেন, ভোররাতে ফিরবেন। রাত নটার সময়ে সেজেগুজে নীচে নেমেছিলেন। কারখানার পাশেই ওদের কোয়ার্টার। সি-আর-পি-দের বলেছিলেন, কর্তা একলা রইল। যেন একটু নজর রাখা হয়। আঙুল তুলে দেখিয়েছিলেন, আলো জ্বলছে তিনতলায়। বলেছিলেন, একটু বরং দাঁড়িয়ে যাই। আলো নিভিয়ে উনি শুয়ে পড়লে যাব। ড্রাইভারও দেখেছে আলো জ্বলছে। তারপর সবার সামনেই আলো নিভে গেল। অর্থাৎ সনাতনপ্রসাদ মাথার কাছে বেডসুইচ টিপে আলো নিভিয়ে দিয়ে ঘুমের আয়োজন করছেন। তিনতলায় আর কেউ থাকে না–অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা ছাড়া। সনাতনপ্রসাদ কাউকে বিশ্বাস করেন না রাত্রে–কুকুর ছাড়া।

অহল্যা দেবী তিনতলার দরজায় নিজে চাবি লাগিয়েছিলেন। একটা চাবি ছিল ভেতরে– সনাতনপ্রসাদের বালিশের তলায়। দরজায় ইয়েল লক লাগানো ছিল। একবার চাবি লাগালে নিশ্চিন্ত। বিয়েবাড়ি যাচ্ছেন বলে হ্যান্ডব্যাগ রাখেননি। তাই চাবির গোছা রাখতে দিয়েছিলেন ড্রাইভারকে। বিদূষী বিবি তো–আপটুডেট লেডি। আঁচলে চাবি বাঁধলে ইজ্জত চলে যায়।

পরের দিন সকালবেলা কুকুরের হাঁক-ডাকে চমকে উঠল কারখানার দারোয়ান থেকে আরম্ভ করে সি-আর-পি পর্যন্ত। চাকরবাকররা দোতলা থেকে ছুটে গেল তিনতলায়। সবাই শুনলে, অ্যালসেশিয়ান কুকুরটা ভেতর থেকে দরজা আঁচড়াচ্ছে আর ভীষণ চেঁচাচ্ছে। কোনওদিন কিন্তু এভাবে চেঁচায় না।

আচ্ছা জ্বালা তো! দরজা খোলারও উপায় নেই। চাবি মেমসাহেবের কাছে। ঘরে আলোও জ্বলছে। কিন্তু সাহেব তো কুকুরটাকে ধমক দিচ্ছেন না?

ভোর ছটায় এসে পৌঁছোলেন অহল্যা দেবী। কুকুরে হাঁক-ডাক শুনে আর দরজার সামনে চাকর-বাকরের জটলা দেখে ড্রাইভারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুললেন। কুকুরটাকে ডেকে নিয়ে চলে গেলেন করিডরের দিকে। তারপর ফিরে এসে গেলেন বেডরুমে।

চাকরবাকররা ছুটে গেল চিৎকার শুনে। দেখল, সনাতনপ্রসাদ মরে কাঠ হয়ে পড়ে আছেন বিছানায়। চোখ খোলা। মুখের ওপর মাছি উড়ছে।

জানেন তো, মরা হাতির দাম লাখ টাকা। ডাক পড়ল এই ঘাটের মড়া অবনী চাটুয্যের। চুলেচেরা রুটিন তদন্ত করে তো মশাই বিলকুল ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম। ঘর বন্ধ। চাবি ড্রাইভারের কাছে। আর একটা চাবি সনাতনপ্রসাদের বালিশের তলায়। বিয়েবাড়ির সবাই সাক্ষী–অহল্যা দেবী আর ড্রাইভার দুজনেই বাড়ি ছেড়ে নড়েননি। সনাতনপ্রসাদেরও বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা নেই। বেড সুইচ টিপে না হয় আলো নিভিয়েছিলেন রাত নটায়। কিন্তু আলোটা জ্বালল কে? সারারাত আলো জ্বলেনি–সি-আর-পিরা সাক্ষী। ভোরবেলা বন্ধ ঘরে আলো জ্বালল কে? সনাতনপ্রসাদ? কি যে বলেন। তিনি তো তখন মরে ভূত। ময়নাতদন্তে দেখা গেল, তিনি হার্টফেল করেছেন রাত নটা থেকে দশটার মধ্যে। মানে আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘুমের মধ্যেই স্থূল শরীর ত্যাগ করেছেন। আলোটা তাহলে জ্বালল কে? ভূত? অ্যালসেশিয়ানের পক্ষেও সম্ভব নয় দাঁতে কামড়ে আলো জ্বালানো। সেক্ষেত্রে সুইচে দাঁতের দাগ থাকত। মনিব মারা গেছে বুঝেই সে দরজা খুলতে চেষ্টা করেছে, চেঁচিয়েছে–সুইচ টিপে আলো নিশ্চয় জ্বালায়নি। কে টিপল বেড সুইচ? তবে কি সি-আর-পি-রা মিথ্যে বলছে? আলো সারারাত জ্বলে ছিল, কিন্তু ব্যাটারা ঘুমোচ্ছিল বলে দেখেনি? এখন মানতে চাইছে না?

একটা স্ট্রোকের ফলেই শুয়ে পড়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। চিন্তাভাবনাও ইদানিং খুব বেড়েছিল। হার্ট আর অত ধকল সইতে পারেনি। ফাইনাল স্ট্রোকেই শেষ হয়ে গেছেন। বিধাতার কি লীলা। এত টাকার মালিক! মৃত্যুকালে মুখে জলটুকুও পেল না। কারও দেখা পেল না। তা না হয় হল, কিন্তু আলোটা জ্বালল কে?

না, না, যা ভাবছেন তা নয়। আলো যে জ্বেলেছে, তার নাম জানতে আমি আসিনি। শোনাতে এসেছি। বুঝলেন না? কে আলো জ্বেলেছে, সবই মোটামুটি আঁচ করে ফেলেছি। না, না, আমাকে বলতে দিন..পুলিশ গোয়েন্দারা ঘাসে মুখ দিয়ে চলে না। আমাদেরও ব্রেন আছে। আমি খবর নিয়ে জেনেছি, কারখানার ওয়ার্কস ম্যানেজারের সঙ্গে অহল্যা দেবীর একটু গুপ্ত প্রণয় ছিল। ভদ্রলোক খুবসুরৎ। বিলেত-ফেরত। ব্যাচেলর। আর কী চাই বলুন? আরও খবর পেয়েছি–পতিদেবতাকে রোজ স্বহস্তে ওষুধ খাওয়াতেন অহল্যা দেবী। এ ব্যাপারে কাউকে বিশ্বাস করতেন না সনাতনপ্রসাদ। শুনবেন আরও? সনাতনপ্রসাদের হার্ট হোঁচট খেয়ে খেয়ে চলছিল বলে একটা ওষুধ দেওয়া হত যার পাঁচ ফোঁটা মানে অমৃত, দশ ফোঁটা মানে বিষ-হার্টের রুগির পক্ষে। দোহাই মৃগাঙ্কবাবু, ওষুধটার নাম জিগ্যেস করবেন না। আপনারা–লেখকরা বড় অবিবেচক হন। যা শুনবেন তাই লিখবেন, তারপর আরও একশোটা খুনের কেস নিয়ে নাকের জলে চোখের জলে হতে হবে আমার মতো অনেক বান্দাকে। একটু বুঝেসুঝে লিখবেন মশাই। জানেন তো, শতং বদ মা লিখ।

আচ্ছা মুশকিল তো, আবার বেরুটে চলে গেলাম। আসল কথাটাই তো এখনো বলিনি। বিয়েবাড়িতে যাওয়ার আগে কর্তা-গিন্নিতে বেশ খানিকটা বচসা হয়েছিল। চাকরবাকররা শুনেছিল। চড়া গলায় ধমক দিয়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। অহল্যাও দু-কথা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তারপরই সেজেগুজে হোল নাইট বাইরে থাকবেন বলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন অহল্যা। যাবার আগে সেই বিশেষ ওষুধটা খাইয়ে গিয়েছিলেন কর্তাকে রোজকার মতো রাত নটায়।

এখন কথা হচ্ছে কটো খাইয়েছিলেন? আমি বলব দশ ফোঁটা–মানে সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছিলেন সনাতনপ্রসাদ। প্রমাণ এখনও পাইনি; কিন্তু বিষয় মানেই বিষ–বিষয়ের লোভে সবই সম্ভব। আর এখানে তো নাগর জুটেছে। ঘরে পঙ্গু স্বামী কঁহাতক আর সহ্য করা যায়? সুতরাং পতিদেবতাকে তিনিই সরিয়ে দিয়েছেন ধরে নিলাম। কিন্তু আলোটা কীভাবে জ্বলল সেইটাই তো বুঝতে পারছি না।

দাঁড়ান, দাঁড়ান, এখনো শেষ হয়নি। আরও একটা জবর খবর শুনিয়ে দিই। শোনবার পর কিন্তু চোখ দুটো কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসতে পারে মা লক্ষ্মী। সাবধান! সাবধান!

হিমা-হিমি-হিমু, এই মজকে ফ্ল্যাট থেকে লোপাট করার ষড়যন্ত্রটি কে এঁটেছিল জানেন? কল্পনা করুন তো। পারলেন না তো? দুয়ো! দুয়ো! স্বয়ং গর্ভধারিণী মশাই। অহল্যা দেবী নিজে লোক লাগিয়ে মেয়েদের লোপাট করতে চেয়েছিলেন। কেন? কেন আবার–মেয়েরা কোনও গতিকে জেনে ফেলেছিল মায়ের হাতে বাবার জীবন বিপন্ন হলেও হতে পারে। অথচ সেকথা সবাইকে বলা যায় না। তাই ওরা ঠিক করল আমার দোর ধরবে। অহল্যা দেবী চলেন শিরায় শিরায়। মেয়েদের মতলব টের পেয়ে পুলিশের নজর অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে ইচ্ছে করেই মেয়েদেরকে গায়েব করতে আরম্ভ করলেন। আসলে পুরো ব্যাপারটাই সাজানো। অর্থাৎ সেই রাতে আমাকে স্রেফ বোকা বানিয়ে ছেড়েছেন অহল্যা দেবী তাঁর ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে। মেয়েরাও বিহ্বল হয়ে পড়ল হঠাৎ এই উৎপাতে। বাপের কথা খেয়াল রইল না।

তার সাতদিন পরেই কাজ হাসিল করে ফেললেন অহল্যা দেবী। তিনি জানেন, মেয়েরা বাপকে বাঁচাতে চেয়েছে ঠিকই, কিন্তু মাকে ফাঁসাতে চায়নি। পুলিশের কাছে এলেও তারা মায়ের নাম করত না। বাবা মারা যাওয়ার পর তো আরও বোবা হয়ে যাবে। সনাতনপ্রসাদ মারা যেতেনই–না হয় দুদিন আগেই তার কষ্ট ঘুচিয়ে দেওয়া হল। মাকে ফাঁসিয়ে ঘরোয়া কেলেঙ্কারি ফাঁস করে আর লাভ আছে কী?

বলব কি মশায়, গোটা ফ্যামিলিটাই যেন কেমনতর। সব ছাড়া ছাড়া। অথচ তালে হুঁশিয়ার। মা থেকে মেয়েরা পর্যন্ত কেউ একটি কথাও ফাস করেনি। কিন্তু আমার নাম অবনী চাটুয্যে। ঠেঙিয়ে নকশাল তাড়িয়েছি। কি বললেন? খুব বাহাদুরি করেছি? চাকরি মশাই, চাকরি! চাকরি করতে গেলে নিজের ছেলেকেও ফাটকে পুরতে হয়, নকশাল তো ছার!

এখন বলুন, প্লটটা নিচ্ছিদ্র কিনা। বেশ বুঝতে পারছি, সনাতনপ্রসাদ এমনি এমনি মরেননি। কিন্তু শালা কিছুতেই তা প্রমাণ করতে পারছি না। নিচ্ছিদ্র প্লটে একটা ছিদ্রও আবিষ্কার করতে পারছি না। একি গেরোয় পড়লাম বলুন তো? আলোটা কে জ্বেলেছে, তা তো জানি। কিন্তু জ্বালল কী করে তাইতো বুঝছি না। বেশ বুঝছি, ছিদ্রটা ওইখানেই। ওই ছিদ্রটা আবিষ্কার করতে পারলেই ফাঁসিয়ে দেব অহল্যা দেবীকে।

ম্যারাথন বক্তৃতা থামতেই কবিতা বললে, আপনার কফি জুড়িয়ে গেল। চাইনিজ শ্রিম্প বলগুলো পর্যন্ত ইটের গুলি হয়ে গেল।

আঁ! কখন এল এসব? বলোনি তো? আঁতকে উঠে প্লেটভর্তি চিংড়ি পকৌড়া আক্রমণ করলেন অবনী চাটুয্যে।

বলতে দিলেন কই? যতবার মুখ খুলতে গেলাম, ততবারই তো দাবড়ানি দিয়ে থামিয়ে দিলেন।

মুখভর্তি পকোড়া নিয়ে অঁ-অঁ-অঁ-অঁ করে কি যেন বললেন অবনী চাটুয্যে, বোঝা গেল না।

হাসি চেপে ইন্দ্রনাথ বলল, আস্তে আস্তে খান, বিষম লেগে যাবে। খেয়ে নিয়ে চলুন ঘরটা দেখে আসি।

কোঁৎ করে গিলে নিয়ে বললেন, অবনীবাবু, কার ঘর?

সনাতনপ্রসাদের।

হা পোড়া কপাল! সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শুনে সীতা কার বাবা! আরে মশায়, এখনো বুঝলেন রুটিন-তদন্তে আমরা কিছুই বাদ দিই না?

রুটি আর লুচির মধ্যে যা তফাত, আপনার রুটিন-তদন্ত আর আমার লুচিন তদন্তেও সেই তফাত অবনীবাবু।

মানে? মানে? মানে? এত অবিশ্বাস আমার ওপর কেন? বলেই খপাৎ করে আরও দুটো পকৌড়া মুখগহ্বরে ঠেসে দিলেন অবনীবাবু।

দেখবেন শ্বাসনালীতে যেন আটকে না যায়। বলল ইন্দ্রনাথ, আপনি এত সুন্দরভাবে সব কথা বললেন যে, অবিশ্বাস করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। জ্বলন্ত বর্ণনা যাকে বলে–আপনার বর্ণনাও তাই। বায়োস্কোপের ছবির মতো সব চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি বলেই একটা খটমট জায়গা ভেরিফাই করতে চাই।

মুখভর্তি পকৌড়া চিবোনো বন্ধ করে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন অবনীবাবু। ভাবখানা-খটমট জায়গাটা আবার কোথায় দেখলেন মশায়?

ইন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিলে, অহল্যা দেবী বিয়েবাড়ি থেকে এসে দরজা খুলেই কিন্তু বেডরুমে যাননি–যা সবাই যায়। উনি কুকুরটাকে নিয়ে করিডরে গেলেন। কেন?

চোখদুটো আস্তে আস্তে ছানাবড়ার মতো করে ফেললেন অবনীবাবু।

ইন্দ্রনাথ আরও বললে, উনি কি তাহলে জ্ঞানপাপী? উনি কি জানতেন, শোবার ঘরে স্বামীর মৃতদেহ পড়ে রয়েছে? কুকুরের অস্বাভাবিক চেঁচামেচির পর দরজা খুলেই ওঁর উচিত ছিল অসুস্থ স্বামীর কাছে ছুটে যাওয়া। কিন্তু কেন উনি করিডরে গেলেন, আমি গিয়ে দেখতে চাই।

কণ্ঠনালী দিয়ে মস্ত ডেলাটাকে পাকস্থলীতে চালান করে দিয়ে বললেন অবনীবাবু, একটু দাঁড়ান। আর মোট চারটে আছে।

.

ইন্দ্রনাথ আগে থাকতেই শিখিয়ে পড়িয়ে রেখেছিল অবনীবাবুকে।

সনাতনপ্রসাদের ঘরে ঢুকে তাই অবনী চাটুয্যে সোজা চলে গেলেন বেডরুমে। অহল্যা দেবীকে আবোল তাবোল কথায় আটকে রেখে দিলেন সেখানে।

ইন্দ্রনাথ এল করিডরে। ঢুকেই বাঁদিকে। শেষপ্রান্তে একটা কাঠের বাক্স। অ্যালসেশিয়ানের শোবার জায়গা। বাক্সটা তখন খালি। কুকুর বেরিয়েছে চাকরের সঙ্গে হাওয়া খেতে।

ইন্দ্রনাথ আগে থেকেই ভেবে রেখেছিল, কী করতে হবে। তাই হেঁট হয়ে কাঠের বাক্সটা সরিয়ে রাখল পাশে।

বাক্সর তলায় একটা ময়লা লিনোনিয়াম পাতা। লিনোনিয়ামটাও তুলে ফেলল ইন্দ্রনাথ।

তলায় একটা কাঠের পাটাতন। লম্বায় একফুট, চওড়ায় একফুট। দেওয়ালের গা ঘেঁষে কাঠের ঢাকনির গায়ে পেনসিল ঢোকানোর মতো একটা ফুটো।

ছিদ্রপথে কড়ে আঙুল ঢুকিয়ে পাটাতনটা উঠিয়ে ফেলল ইন্দ্রনাথ। মেঝের চৌকোণা গর্তে একটা বাক্স বসানো। ইলেকট্রিক মিটার আর মেন সুইচের জঙ্গল সেখানে। হালফ্যাসানের বাড়ি তো–দেওয়ালের গায়ে কিছু নেই।

পকেট থেকে টর্চ বের করে খুঁটিয়ে দেখল ইন্দ্রনাথ। কাঠের ঢাকনির যেখানে ফুটো, ঠিক তার তলায় কাঠের গায়ে দুটো ছোট ছোট ছিদ্র। যেন স্কু লাগানো ছিল। মেন সুইচের মাথা থেকে দুটো তার বেরিয়েছে। একটা তারে কিন্তু ব্ল্যাকটেপ জড়ানো।

সন্তর্পণে ব্ল্যাক টেপ খুলে ফেলল ইন্দ্রনাথ তার না ছুঁয়েই। তারটা সত্যিই কাটা। দুটো প্রান্ত জুড়ে ব্ল্যাক টেপ দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে।

বাক্সের তলায় ছোট্ট একটা টুকরো। সোলার ছিপির টুকরো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল ইন্দ্রনাথ।

ফিরে এল শোবার ঘরে। অহল্যা দেবী গালে হাত দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুনছেন অবনীবাবুর ফালতু বক্তিমে।

ভদ্রমহিলা নিঃসন্দেহে অপূর্ব সুন্দরী। খুঁত কোথাও নেই। বয়স হয়তো তিরিশ, মনে হচ্ছে আরও কম।

ইন্দ্রনাথকে দেখেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন অবনীবাবু। চোখের মধ্যে প্রশ্ন ফুটিয়ে জানতে চাইলেন–হল কিছু?

গম্ভীর মুখে পলকহীন চোখে অহল্যা দেবীর পানে চেয়ে বলল ইন্দ্রনাথ, নমস্কার, আমার নাম ইন্দ্রনাথ রুদ্র। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার কাছে শুধু দুটি জিনিস চাইতে এলাম।

প্রতি নমস্কার করলেন অহল্যা, বলুন।

একটা কলিংবেলের টেপা সুইচ। আর একটা ছোট্ট সোলার ছিপি।

নিমেষ মধ্যে নিরক্ত হয়ে গেলেন অহল্যা।

অবনীবাবুর পানে ফিরে বলল ইন্দ্রনাথ, এখন গ্রেপ্তার করতে পারেন। প্রমাণ পাওয়া গেছে।

.

আবার চিংড়ি পকৌড়া। আবার কফি। আবার সরগরম বৈঠক।

ইন্দ্রনাথ বললে, ছিদ্রান্বেষী ছিদ্র খুঁজতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ছিদ্র বের করে ফেলল।

সেটা কিন্তু এখনও আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। উৎকট গম্ভীর হয়ে বললাম আমি।

ইহজন্মে হবে না। অবনীবাবু নিচ্ছিদ্র প্লটের ছিদ্রটা তার অজান্তেই শুনিয়ে দিয়েছিলেন। তোরা প্রত্যেকে শুনেছিস। আমিও শুনেছি কিন্তু ওই যে বললাম, যার চিন্তার ডিসিপ্লিন, বুদ্ধির একাগ্রতা আর পর্যবেক্ষণ প্রয়োগশক্তি আছে–সে ছাড়া গোয়েন্দা হওয়া কাউকে সাজে না। তাই নিচ্ছিদ্র প্লটের ছিদ্র আমার মাথায় এসে গেল, তোদের মাথায় এল না।

কবিতা একদম না ঘাঁটিয়ে ভালো মানুষের মতো মুখ করে বলল, হার মানছি ঠাকুরপো। কিন্তু আর সাসপেন্সে রেখো না। প্রেশার উঠে যাচ্ছে।

প্রসন্ন হয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, আমি এইখানে বসেই আঁচ করেছিলাম, আলোর তারে এমন কিছু কারচুপি করা হয়েছিল যা অহল্যা দেবীর অনুপস্থিতিতে আপনা থেকেই আলো নেভাবে বা জ্বালাবে। ঘরের মধ্যে প্রাণী ছিলেন দুজন। সনাতনপ্রসাদ আর কুকুর। সনাতনপ্রসাদ চলৎশক্তিহীন এবং আলো যখন জ্বলেছে বা নিভেছে–তখন তিনি মৃত। জীবিত প্রাণী বলতে রইল শুধু কুকুরটা। কুকুরটার সঙ্গে আলো জ্বলা নেভার কোনও সম্পর্ক নেই তো? অহল্যা দরজা খুলে ঢুকেই কুকুরটাকে নিয়ে করিডরে গেছিলেন কেন? করিডরেই কারচুপিটা নেই তো? হতে পারে কুকুরটা না জেনেই পুশ বাটনে চাপ দিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়েছে অথবা জ্বালিয়েছে। কিন্তু নিভেছে রাত্রে– কুকুরের শোবার সময়। জ্বলেছে ভোরে কুকুরের ওঠার সময়। তবে কি শোবার জায়গাটাতেই টেপা সুইচটা আছে?

তাই তিনতলায় গিয়ে আমি আগে গেলাম করিডরে। দেখলাম, সত্যিই কুকুরের শোবার বাক্স রয়েছে সেখানে। সুসংবদ্ধ চিন্তা আর শৃঙ্খলাবদ্ধ যুক্তির প্রথমটি যদি সঠিক হয়, পরেরগুলোও সঠিক হতে বাধ্য। তাই বাক্স সরাতেই কী-কী পেলাম তা আগেই বলেছি।

মেন সুইচের একটা তার কেটে, সেই তারে বাড়তি তার জুড়ে এনে লাগানো হয়েছিল একটা টেপা সুইচে। সুইচটা ভ্রু দিয়ে লাগানো হয়েছিল কাঠের ডালার ছোট্ট ফুটোর ঠিক তলায়। সুইচের ভেতরে কনট্যাক্ট প্লেট দুটোকে ইচ্ছে করে বেঁকিয়ে এমন জায়গায় রাখা হয়েছিল, যাতে বাক্সের মধ্যে কুকুর শুলেই ঢাকনি চেপে বসবে সুইচের ওপর। ফলে কনট্যাক্ট কেটে যাবে। মানে আলো নিভে যাবে। কুকুরটা বাক্স থেকে নেমে এলেই ডালাটা সুইচের ওপরে উঠে যাবে–আলো জ্বলে উঠবে। অর্থাৎ পুশ বাটন টিপে ধরলে আলো জ্বলে, ছেড়ে নিলে নেভে। এই সুইচে ঠিক তার উল্টো ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। টিপলে নিভবে, ছাড়লে জ্বলবে।

কিন্তু ছিপিটার ভূমিকা কী? শুধোলাম আমি।

কাঠের ঢাকনিটা সুইচের মাথায় ঠেকছিল না বলেই ফুটো দিয়ে সোলার ছিপি এঁটে দিয়েছিলেন অহল্যা দেবী। ছিপির তলাটাই সুইচের ওপর চেপে বসে আলো নিভিয়েছে কুকুরের শোবার সময়ে। ঘরে ঢুকেই ওই ছিপিটা সরিয়ে নেবেন বলে অহল্যা দেবী আগে করিডরে গিয়েছিলেন। পুশ বাটন সরিয়েছেন পরে ধীরে সুস্থে।

বিমূঢ় কণ্ঠে কবিতা বললে, দরজা বন্ধ করে অহল্যা দেবী নীচে নামার আগেই তো কুকুরটা বাক্সে গিয়ে শুড়ে পড়তে পারত! তাহলে তো আলো নেভার ব্যাপারে সি-আর-পি-দের সাক্ষী রাখা যেত না?

হাল ছেড়ে দিয়ে ইন্দ্রনাথ বললে, জন্মে এমন দেখিনি! আরে বাবা, খানকয়েক বিস্কুট শোবার ঘরে ছড়িয়ে এলেই তো হল! কুকুর বিস্কুট না খেয়ে শুতে আসবে না। ততক্ষণে অহল্যা দেবী নীচে পৌঁছে যাবেন। সি-আর-পি-দের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন–ঘরে আলো জ্বলছে। হয়েছেও তাই। সব কবুল করেছেন অহল্যা দেবী।

ত্রমজ মেয়ে তিনটে? বোকার মতো জিগ্যেস করে ফেলেছিলাম আমি।

সঙ্গে সঙ্গে তেড়ে উঠেছিল : মরণ আর কি! সে-খোঁজে তোমার দরকার কী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *