Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

যখন বিকেলবেলা রওনা দিয়েছি তখন একবারও সন্দেহ করিনি সন্ধ্যের পর এরকম অবস্থা হবে। শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত মোটামুটি গাড়ি চালিয়ে আনা গেছে, শ্রীমঙ্গলের পর হঠাৎ করে কোথা থেকে যেন কুয়াশা এসে চারিদিক ঢেকে ফেলল। শীতকালে সন্ধ্যেবেলায় একটু-আধটু কুয়াশা পড়তেই পারে, কিন্তু তাই বলে এরকম কুয়াশা? দেখে মনে হয় যেন সামনে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল, গাড়ির হেডলাইট সেই দেওয়ালকে ভেদ করে যেতে পারে না-শুধু সেটাকে সামনে কয়েক ফুট ঠেলে সরিয়ে দেয়। কুয়াশায় সেই দেওয়ালকে ঠেলে সরিয়ে সরিয়ে গারি চালানো নিশ্চয়ই খুব সহজ ব্যাপার না, ঘণ্টাখানেক চালিয়ে আমার ড্রাইভার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “অবস্থা জটিল স্যার।”

আমার ড্রাইভার কম কথার মানুষ। কোনো পরিস্থিতিকেই তার কাছে জটিল মনে হয় না-শেষবার সে যখন বলেছিল অবস্থা জটিল-তখন কিছু ডাকাত রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে ডাকাতি করার চেষ্টা করেছিল। আমাদের করিৎকর্মা ড্রাইভারের নির্বুদ্ধিতার কাছাকাছি দুঃসাহসিকতা আর কপাল গুনে সেবার বেঁচে গিয়েছিলাম। কাজেই আজকে সে যখন আবার বলল, “অবস্থা জটিল, তখন আমি নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তিত হয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, “কী করবে তাহলে? গাড়ি থামাবে?”

ড্রাইভার ঘন কুয়াশায় সাদা দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থেমে বলল, “না স্যার, গাড়ি থামানো যাবে না। জায়গাটা ভালো না।”

জায়গাটা কেন ভালো না আমি সেটা আর জিজ্ঞেস করলাম না, আমি জানি জিজ্ঞেস করলে সে কথার উত্তর দেবে না। রাস্তাঘাট বা গাড়ি চালানো এরকম কিছু বিষয়কে সে পুরোপুরি তার নিজস্ব বিষয় বলে বিবেচনা করে, আমার সাথে সেই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে চায় না। আমি বললাম, “ সামনে কোনো চা বাগানে ঢুকে গেলে কেমন হয়?”

ড্রাইভার আমার কথার কোনো উত্তর দিল না, আমি আন্দাজ করেছিলাম সে উত্তর দিবে না। আমি প্রস্তাবটাকে আরেকটু জোরদার করার জন্যে বললাম, “চা বাগানে সব সময় একটা গেস্ট হাউস থাকে।”

ড্রাইভার এবারেও কোনো উত্তর দিল না। আমার প্রস্তাবটি এখনো তার কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। আমি বললাম, “আমার পরিচিত একজন ম্যানেজার আছে–

ড্রাইভার এবারে কথার উত্তর দিল। বলল, “কোন বাগানের ম্যানেজার, স্যার?”

“বাগানের নাম মনে হয় চাকলী ছড়া। এই আশেপাশে থাকার কথা।”

ড্রাইভার আমার কথার এবারেও কোনো উত্তর দিল না, কাজেই তার হাতে পুরোপুরি নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া এখন আমার আর কিছু করার নেই। কুয়াশায় একটু পরে পরে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, তাই ওয়াইপার দিয়ে সেটা পরিষ্কার করতে হচ্ছে কিন্তু কাঁচ পরিষ্কার হচ্ছে কীনা বোঝার কিছু নেই-সামনে কুয়াশার দুর্ভেদ্য সাদা দেওয়াল। মাঝে মাঝে একেবারে হঠাৎ করে সামনে থেকে আসা কোনো গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়-কিন্তু সেটা দেখা যায় একেবারে কাছে চলে আসার পর, দূর থেকে দেখা যাবার কোনো উপায় নেই। ভাগ্যিস কুয়াশার ভয়ে সবাই গাড়ি চালাচ্ছে একেবারে শামুকের গতিতে তা না হলে যে কী অবস্থা হতো কে জানে। প্রত্যেকবার সরু রাস্তায় একটা ট্রাক বা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে যাই আর আমি বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিই। এই ভয়ংকর রাস্তা কখন শেষ হবে কখন ঢাকা পৌঁছাব কে জানে।

এভাবে আরো কতক্ষণ গিয়েছে কে জানে, হঠাৎ ড্রাইভার ব্রেক করে গাড়িটা থামাল। আমি ভয় পাওয়ার গলায় বললাম,”কী হয়েছে?”

“বাগান।”

“বাগান?”

“জে। চাকলী ছড়া বাগান।”

এই ঘোর কুয়াশার মাঝে সে চাকলী ছড়া চা বাগান কেমন করে খুঁজে পেল কে জানে। আমি ডানে-বামে তাকিয়ে ঘন কুয়াশায় দেওয়াল ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, “ কোথায় বাগান?”

“ওইদিকে। বাম দিকে।”

আমি বাম দিকে তাকালাম এবং মনে হলো ঘন কুয়াশার মাঝে টিমটিম করে একটা আলো জ্বলছে। ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে কুয়াশার মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং কিছুক্ষণের মাঝে তার উত্তপ্ত গলায় আওয়াজ শুনতে পেলাম। সে কম কথার মানুষ এবং যে দু-একটি কথা বলে সেটি ঠাণ্ডা গলায় বলতে পারে না। অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবার আগে আমিও গাড়ি থেকে নেমে টিমটিমে আলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। ছোট একটা চালাঘরের মাটির মেঝেতে কাঠকুটো দিয়ে একটা আগুন জ্বালিয়ে একজন হালকা-পাতলা মানুষ চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা গরম করছে। আমার ড্রাইভার আবার গর্জন করে বলল, “গেট খুলো তাড়াতাড়ি।”

চাদর মুড়ি মানুষটা বলল, “আপনারা কেডা? কী চান?”

ড্রাইভার আবার হুঙ্কার দিয়ে বলল, “সেইটা দিয়ে তোমার কী হবে? গেট খুলতে বলছি গেট খুলো।”

আমি তাড়াতাড়ি বললাম, “আমি ইউনিভার্সিটিতে পড়াই। ম্যানেজার সাহেব আমার পরিচিত, তার সাথে দেখা করতে যাব।”

মানুষটা উঠে পঁড়িয়ে আগুনের আলোতে আমাকে যাচাই করে দেখল, মনে হলো তার পরীক্ষায় আমি পাস করে গেলাম। ইউনিভার্সিটির মাস্টারদের চেহারায় একধরনের গোবেচারা গোবেচারা ভাব থাকে, কেউ খুব একটা সন্দেহ করে না। সে তার কোমরে সুতায় বাঁধা একটা চাবি হাতে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে গেল। গেটটা অবিশ্যি খুব সরল, একটা বাঁশ আড়াআড়িভাবে ফেলে রেখেছে, সেটাই শিকল দিয়ে বাঁধা। বাঁশের ওপরে এবং নিচ দিয়ে যে কোনো প্রাণী চলে যেতে পারবে সেটা নিয়ে কারো কোনো দুশ্চিন্তা নেই। এই গেটের উদ্দেশ্য গাড়িকে আটকানো।

বাঁশটা তুলে দেবার পর ড্রাইভার গাড়িতে বসে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “ম্যানেজার সাহেবের বাসা কোথায়?” দারোয়ান গেট খোলা এবং বন্ধ করার বাইরে কোনো দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, সে অনিশ্চিত একটা ভঙ্গি করে বলল, “ওই যে হেই দিকে।”

কথাটি দিয়ে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না, ড্রাইভারও কিছু বুঝল বলে মনে হলো না, কিন্তু সে তার সাথে কথা বলে আর সময় নষ্ট করল না, চা বাগানের ভেতরে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেলল। একটু আগে রাস্তাটি অন্তত পাকা রাস্তা ছিল, এখন রাস্তাটি কাঁচা, ঘন কুয়াশায় সেটি কোথা থেকে শুরু হয়েছে, কোথায় শেষ হয়েছে এবং কোনদিকে যাচ্ছে আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। আমি ভয়ে ভয়ে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম, সে মুখের মাংসপেশি শক্ত করে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখেছে। উঁচু-নিচু খানাখন্দ ভেঙে সে ঘন কুয়াশা ভেদ করে যে পথ দিয়ে যাচ্ছে সেটা যে একটি রাস্তা আমার পক্ষে সেটা বোঝা সম্ভব না। কতক্ষণ এভাবে গিয়েছি জানি না, এক সময় ড্রাইভার ব্রেক কষে গাড়ি থামিয়ে বলল, “এসে গেছি।”

আমি আশেপাশে ঘন কুয়াশা ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলাম। না, কিন্তু ড্রাইভার যখন বলেছে এসে গেছি তখন নিশ্চয়ই এসে গেছি। আমি গাড়ি থেকে নামলাম, সত্যি সত্যি মনে হলো দুই পাশে আবছা জমাট বাঁধা অন্ধকার, এগুলো নিশ্চয়ই বাড়িঘর। চা বাগানের ম্যানেজার বা স্টাফদের বাসা এখানে থাকার কথা। কোথায় গিয়ে কীভাবে খোঁজ নেব বিষয়টি নিয়ে যখন একটু অস্বস্তি বোধ করছি ঠিক তখন মনে হলো অন্ধকার কুঁড়ে হঠাৎ একজন মানুষ আমার সামনে হাজির হলো। আমি চমকে উঠেছিলাম, কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যানেজার সাহেবের বাসা কোনটা?”

“এই তো এইটা।” বলে মানুষটা হাত তুলে কিছু একটা দেখিয়ে দিল, আমি ভালো করে তাকিয়ে দেখি সত্যি সত্যি বড় বড় গাছে ঢাকা একটা বাসা, কুয়াশার জন্যে ভালো করে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

“গেটটা কোথায়?”

“এই যে এইখানে–” মানুষটা হাত তুলে সামনে দেখাল। আমি একটু এগিয়ে দেখি সত্যি সত্যি একটা গেট। গেট খুলে নুড়ি বিছানো পথ দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে থাকি–বেশ কিছুক্ষণ থেকে আমি ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করছিলাম, এখন অস্বস্তিটা হঠাৎ করে বেড়ে গেল। আমি ড্রাইভারের কাছে বেশ জোর গলায় দাবি করেছি এই বাগানের ম্যানেজারের সাথে আমার পরিচয় আছে–কথাটা আসলে পুরোপুরি সত্যি নয়। একদিন ট্রেনে করে আসার সময় ম্যানেজার সাহেব পাশের সিটে বসেছিলেন, ট্রেনে পাশাপাশি বসলে যেরকমটি কথা হয় তার সাথে সেরকম কথা হয়েছে এবং ট্রেন থেকে নামার সময় আমাকে বলেছিলেন, “একদিন বাগানে বেড়াতে আসবেন।” আমিও বলেছিলাম, “আসব, নিশ্চয়ই আসব।” ভদ্রলোকও ভদ্রতা করে বলেছিলেন আমিও ভদ্রতা করে উত্তর দিয়েছিলাম। এখন সত্যি সত্যি বিনা আমন্ত্রণে রাত কাটাতে চলে এসেছি বিষয়টি রীতিমতো লজ্জাজনক। ম্যানেজার ভদ্রলোক যদি আমাকে চিনতে না পারেন, তখন কী হবে?

আমি লাজলজ্জা ঝেড়ে ফেলে দরজায় টোকা দিলাম, কয়েকবার শব্দ করার পর কালো এবং শুকনো মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ দরজা খুলে দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমি কেশে গলা পরিষ্কার করে বললাম, “ম্যানেজার সাহেব বাসায় আছেন?”

“জে। আছে।” মানুষটা আমাকে একটু খুঁটিয়ে দেখে বলল, “ বসেন। সাহেবরে খবর দিই।”

ভেতরে দামি সোফা। শোকেসে নানা ধরনের জিনিসপত্রে বোঝাই। দেওয়ালে কিছু বাঁধানো ছবি। ঘরে টিমটিম করে একটা বাতি জ্বলছে। এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে কিন্তু ভোল্টেজ কম আলোগুলি অনুজ্জ্বল এবং মন খারাপ করা। আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে সোফায় বসে আছি, ম্যানেজার সাহেব আসার পর তিনি যদি আমাকে না চেনেন তাহলে কীভাবে কথা বলব?

আমি যখন এ ব্যাপারটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছি ঠিক তখন ভেতর থেকে একজন লোক বের হয়ে এলো, এই শীতের মাঝে তার পরনে হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট। আমাকে দেখে চোখ বড় বড় করে বলল, “আরে আপনি?”

আমি লোকটাকে এবার চিনতে পারলাম, এই চা বাগানের ম্যানেজার। ট্রেনে তিনি যখন আমার পাশে বসেছিলেন তখন রীতিমতো স্যুট-টাই পরেছিলেন এখন হাফ প্যান্ট পরে আছেন বলে চিনতে পারছি না। চা বাগানের ম্যানেজাররা যে হাফ প্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াতে পারেন আমি সেটা কখনো কল্পনাও করিনি! ম্যানেজার সাহেব এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে জোরে জোরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললেন, ‘আপনি যদি আর একদিন আগে আসতেন কী চমৎকার হতো!”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন?”

“আমার স্ত্রীর সাথে দেখা হতো। আজ দুপুরেই ঢাকা গেছে।”

ট্রেনে পাশাপাশি বসে আসার সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম চা বাগানের ম্যানেজারেরা খানিকটা নিঃসঙ্গ হন। তাদের ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যাবার পর ভালো স্কুলে যাবার জন্যে ঢাকা চলে যায়, সাথে মায়েরাও থাকে, নিঃসঙ্গ বাবা একা একা চা বাগানে ঘুরে বেড়ান। ম্যানেজার সাহেব মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘আমার স্ত্রী থাকলে খুব খুশি হতো–এই সেদিনও তার সাথে আপনার কথা বলছিলাম!”

এই ভদ্রলোক তার স্ত্রীর সাথে আমার সম্পর্কে কী কথা বলছিলেন আমি আর সেটা নিয়ে কৌতূহল দেখালাম না। ভদ্রলোক আমাকে চিনতে পেরেছেন তাতেই আমি খুশি। বুকের মাঝে আটকে থাকা চাপা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বললাম, “ আমিও ঢাকা যাচ্ছিলাম। পথে যা কুয়াশা পড়েছে সেটা আর বলার মতো নয়। ড্রাইভার আর এগুতে সাহস করছে না, ভাবলাম এখানে রাত কাটিয়ে যাই।”

ম্যানেজার সাহেব হাসার ভঙ্গি করে বললেন, “কুয়াশাকে ধন্যবাদ দিতে হয়, তার কারণে অন্তত আমাদের বাগানে আপনার পায়ের ধুলো পড়ল!”

আমি বললাম, “আমার পায়ের ধুলো এত মূল্যবান জানলে তো আমি অনেক আগেই খামে ভরে এক প্যাকেট পাঠিয়ে দিতে পারতাম।”

আমার এই মোটা রসিকতাতেই ম্যানেজার সাহেব হা হা করে হাসতে লাগলেন, হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমার স্ত্রী থাকলে খুব খুশি হতো। সে খুব মানুষ পছন্দ করে। আপনাদের মতো মানুষ হলে তো কথাই নেই!”

আমাদের মতো মানুষ বলতে ঠিক কী বোঝাচ্ছেন আমি সেটা নিয়েও কৌতূহল দেখালাম না। ম্যানেজার সাহেব হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আপনি এত লম্বা জার্নি করে এসেছেন নিশ্চয়ই খুব টায়ার্ড।”

আমি বললাম, “না, না–আমি মোটেও টায়ার্ড নই। ঢাকা পর্যন্ত যাবার কথা ছিল–অর্ধেক রাস্তাও যাইনি। টায়ার্ড হবার সময় পাইনি।”

“টায়ার্ড না হলে ভালো কিন্তু আগে আপনাকে হাত-পা ছেড়ে একটু রিলাক্স করার ব্যবস্থা করে দিই। আমার স্ত্রী থাকলে আপনাকে কিছুতেই গেস্ট হাউসে থাকতে দিতো না–এই বাসাতেই রাখতো। কিন্তু আমি সেই রিস্ক নেব না। আপনাকে গেস্ট হাউসেই ব্যবস্থা করে দিই, সেখানে সাপোর্ট স্টাফ ভালো।”

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “হঠাৎ করে চলে এসে আপনাকে কী ঝামেলার মাঝে ফেলে দিলাম!”

ম্যানেজার সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “ছিঃ ছিঃ–আপনি ঝামেলার কথা কী বলছেন! আমার কত বড় সৌভাগ্য আপনি এসেছেন। আর আমাদের চা-বাগানে গেস্ট হাউস সবসময় রেডি থাকে–কখন কে চলে আসে তার ঠিক নেই। আসেন যাই–”

ম্যানেজার সাহেব উঠে একটা হাঁক দিতেই কয়েকজন মানুষ ছুটে এলো, তিনি তাদের একজনকে পাঠালেন গেস্ট হাউস খুলে দিতে, একজনকে পাঠালেন বাবুর্চিকে ডেকে আনতে এবং একজনকে পাঠালেন গাড়ি থেকে আমার ব্যাগ নামিয়ে আনতে। দেখেশুনে মনে হচ্ছে চা-বাগানের ম্যানেজাররা মোটামুটি জমিদারদের মতো থাকেন।

গেস্ট হাউসে বেশ কয়েকটি ঘর, আমার জন্যে এক কোনার একটা ঘর খুলে দেয়া হলো, কথা শুনে বুঝতে পারলাম এটা সবচেয়ে ভালো ঘর। ভেতরে ঢুকে আমার নিজেরও সন্দেহ থাকল, মোজাইক করা মেঝে, টাইল করা বাথরুম, বড় বড় কাঁচের জানালা, দেয়ালে এয়ারকুলার। বড় বিছানা আমার সামনেই হইচই করে বিছানার চাদর, কম্বল পাল্টে মশারি টানিয়ে দেয়া শুরু হলো।

ম্যানেজার সাহেব এদিক-সেদিক দেখে অপ্রয়োজনে দুই-চারটি ধমক দিয়ে দিলেন এবং তখন চারিদিকে অনেক মানুষজন ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ম্যানেজার সাহেব এই ফাঁকে আমাকে গেস্ট হাউসটা ঘুরিয়ে দেখালেন। সেই ব্রিটিশ আমলে বাংলো ধাঁচে তৈরি, ইটের গাঁথুনির ওপর টিনের ছাদ। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অনেকবার ভেতরে পরিবর্তন করা হয়েছে। এখন বাইরে থেকে এটাকে পুরনো একটা বাংলো মনে হলেও ভেতরে একেবারে আধুনিক আয়োজন। এয়ারকুলার, গরম পানি, ফ্রিজ এমন কী মাঝখানের হলঘরে একটা টেলিভিশন পর্যন্ত রয়েছে! আমি টেলিভিশনটি দেখে বললাম, “চা বাগানের এই নিরিবিলিতে টেলিভিশনটা কেন জানি মানায় না।”

ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে তাকালেন, কিছু বললেন না। টেলিভিশনের পাশে রিমোট কন্ট্রোলটি রাখা, অনেকটা অভ্যাসের বশেই আমি সেটা হাতে নিয়ে টিপে দিয়েছি, সাথে সাথে ঘ্যাস ঘ্যাস শব্দ করে টেলিভিশনটি চালু হয়ে গেল। রিসেপশন খুব খারাপ ঝিরঝিরে স্ক্রিনের ভেতর বাংলা নাটকের আঠা আঠা ভালোবাসার একটা দৃশ্য দেখতে পেলাম। নায়ক কিংবা নায়িকা কারো চেহারাই স্পষ্ট নয় ভাসাভাসা ভাবে তাদের আবেগাপ্লুত গলা শোনা গেল। আমি চ্যানেল পাল্টানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম, “কিছুই তো দেখা যায় না।”

“না।” ম্যানেজার বললেন, “পাহাড়ের আড়ালে সে জন্যে সিগন্যাল পাওয়া যায় না।”

আমি বললাম, “উঁচুতে একটা এন্টেনা ঝোলালে মনে হয় ভালো রিসেপশন হবে।”

ম্যানেজার সাহেব হাত নেড়ে অস্পষ্ট গলায় কিছু একটা বললেন তারপর এগিয়ে গিয়ে সুইচ টিপে টেলিভিশনটা বন্ধ করে দিলেন। বললেন, “বাগানের মালিকের জন্যে রাখতে হয়-তার টেলিভিশন রোগ আছে।”

“কিন্তু কিছু যদি দেখা না যায় তাহলে টেলিভিশন রেখে লাভ কী?

‘লাভ নেই। কিন্তু অনেকের কাছে টেলিভিশনটা একটা থেরাপির মতো। কাছাকাছি আছে জানলে তাদের একধরনের আরাম হয়। না থাকলে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে!”

আমি শব্দ করে হাসলাম, ব্যাপারটা সত্যি হতেও পারে।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা গেস্ট হাউসের বারান্দায় বসেছি। কুয়াশা একটু কমেছে বলে মনে হলো, আশেপাশে উঁচু টিলা আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ আছে কী না দেখা যাচ্ছে না কিন্তু চারিদিকে একটা নরম আলো। পুরো এলাকাটাতে একধরনের অপার্থিব সৌন্দর্য। গেস্ট হাউসের বয় এসে আমাদের চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে বললাম, “জায়গাটা কী সুন্দর!”

ম্যানেজার সাহেব হাসলেন, বললেন, “বাইরে থেকে যারাই আসে তারাই এই কথা বলে। কিন্তু কয়েকদিন একসাথে থাকতে হলেই তারা হাঁপিয়ে ওঠে। চলে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যায়।”

আমি বললাম, “সৌন্দর্য জিনিসটা মনে হয় অল্প অল্প করে দেখার জিনিস। মাঝে মাঝে দেখলে ভালো লাগে। একটানা বেশি দেখলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।”

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না, আমি বললাম, “আপনার কেমন লাগে?

“আমার?”

“হ্যাঁ।”

“আমি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা থাকি–এখানে সৌন্দর্য আছে না অসৌন্দর্য আছে সেটাই কখনো খেয়াল করে দেখি না।”

ঠিক এরকম সময় দূর থেকে ঢং ঢং করে দশটা বাজার শব্দ শুনতে পেলাম। অনেকদিন পর হাতে বাজানো ঘণ্টার শব্দ শুনছি, বিষয়টি এখনো আছে সেটাই জানতাম না। বললাম, “ভারি মজা তো। হাত দিয়ে পিটিয়ে সময় জানিয়ে দিচ্ছে।”

“হ্যাঁ। সেই ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসছে।”

আমি বললাম, “মাত্র দশটা বাজে, মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।”

ম্যানেজার সাহেব বললেন, “চা বাগানে রাত দশটা হচ্ছে নিশুতি রাত।”

আমি বললাম, “আপনার টেলিভিশন ঠিক থাকলে এখন খবর শোনা যেতো।”

ম্যানেজার সাহেব কিছু বললেন না। আমি একটু পরে বললাম, “মনে হচ্ছে পৃথিবীর একেবারে বাইরে চলে এসেছি।”

“উঁহু! পুরোপুরি মনে হচ্ছে না। তাহলে পৃথিবীর খবর শোনার জন্যে আপনি এত ব্যস্ত হতেন না।”

আমি হাসলাম, বললাম, “এটা অভ্যাস। খবর না শুনলে পত্রিকা না পড়লে কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকে।”

ম্যানেজার বললেন, “ এন্টেনা নাড়াচাড়া করে আপনাকে খবরটা শুনিয়ে দিতে পারি। আমাদের এটেনডেন্ট এ ব্যাপারে মহাওস্তাদ।”

“থাক!” আমি বললাম, “দরকার নেই। এক রাত খবর না শুনলে এমন কিছু ক্ষতি-বৃদ্ধি হবে না।”

“থ্যাংক ইউ।” ম্যানেজার সাহেব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি টেলিভিশন একেবারে পছন্দ করি না।”

আমি হেসে বললাম, “এটা পছন্দ করার বিষয় নয়। এখনো কাউকে দেখিনি যে টেলিভিশন অপছন্দ করে।”

ম্যানেজার সাহেব বললেন, “আমার অপছন্দ একটি অন্যরকম।”

আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, “কী রকম?”

“টেলিভিশনের অনুষ্ঠান নয়-টেলিভিশন জিনিসটাই আমি দেখতে পারি না। সহ্য করতে পারি না। আমার আমার—”

ম্যানেজার কথা থামিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার কী?”

“আসলে টেলিভিশন নিয়ে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছিল, সেই থেকে আমি আর এটা সহ্য করতে পারি না।”

“কি ঘটেছিল?”

“আমি সাধারণত এটি কাউকে বলি না, বললে বিশ্বাসও করবে না। আপনাকে বলি। বিশ্বাস না করতে চাইলে করবেন না।”

“বিশ্বাস করব না কেন?”

ম্যানেজার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “শুনলেই বুঝতে পারবেন।”

কাছাকাছি কোনো গাছে একটা রাতজাগা পাখি পাখা ঝাঁপটিয়ে শব্দ করে কর্কশ স্বরে ডাকতে ডাকতে গেস্ট হাউসের ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল। বহু দূর থেকে কোন একটা বুনো পশুর ডাক শুনতে পেলাম। চারিদিকে সুনসান নীরব, তার মাঝে ম্যানেজার সাহেব তার গল্প শুরু করলেন। গল্পটা এরকম:

আমার যখন বিয়ে হয় আমি তখনো বুঝতে পারিনি যে আমার স্ত্রী নীলা, অন্য দশটা মেয়ে থেকে অন্যরকম। কখনো গান গাইতে শিখেনি কিন্তু খুব সুন্দর গানের গলা। ছবি আঁকতে শিখেনি। কিন্তু রঙিন কাগজ কেটে আঠা দিয়ে লাগিয়ে চমৎকার ডিজাইন করে ফেলতে পারতো। আমার জন্মদিনে একটা পাঞ্জাবি উপহার দিল, নিজ হাতে সেখানে বাটিকের কাজ করেছে। এত সুন্দর যে যেই দেখে সেই অবাক হয়ে যায়। বই পড়ার খুব সখ আমি মোটামুটি চাঁছাছোলা মানুষ তার আগ্রহেই আমারও আস্তে আস্তে বই পড়ার অভ্যাস হলো। মানুষটাও খুব ভোল, হাসি-খুশি চঞ্চল টাইপের। মাঝে মাঝেই আমার মনে হতো আমার মত মানুষের এত ভালো বউ পাওয়ার কথা না।

আমার স্ত্রী নীলার আগ্রহ কিংবা অনাগ্রহের কারণে আমরা কোনোদিন টেলিভিশন কিনি নি। সে টেলিভিশন পছন্দ করতো না, বলতো যন্ত্র আমার যেটা দেখার দরকার সেটা দেখিয়ে দেবে, যেটা শোনার দরকার সেটা শুনিয়ে দেবে, যেটা বোঝার দরকার সেটা বুঝিয়ে দেবে সেরকম যন্ত্রের আমার দরকার নেই। আমার যখন দেখার দরকার তখন দেখব যখন শোনার দরকার তখন শুনব, যখন বোঝার দরকার তখন বুঝব। যুক্তিটা ভালো না খারাপ আমি জানি না কিন্তু নীলাকে আমি এত ভালোবাসি যে সে যেটা বলে সেটাই আমার সব কিছু। তাই আমার বাসায় শেলফ ভরা বই, তাক ভরা লং প্লেয়িং রেকর্ড, দেওয়াল ভরা পেইন্টিং কিন্তু কোন টেলিভিশন নেই। টেলিভিশন না দেখে দেখে আমারও কেমন যেন অভ্যাস হয়ে গেল। মাঝে মাঝে যখন কারো বাসায় বেড়াতে যাই, তারা যখন টেলিভিশন চালু করে রাখে আমার তখন কেমন যেন হাঁসফাঁস লাগতে থাকে।

আমি তখন একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। এর মাঝে হেড অফিস থেকে চিঠি এসেছে আমাকে ছয় সপ্তাহের জন্যে আমেরিকা যেতে হবে। আমি নীলাকে বললাম “তুমিও চল।”

নীলা বলল “তোমার কোম্পানি আমাকে নেবে কেন?”

আমি বললাম “আমার কোম্পানি নেবে আমাকে, আমি নেব তোমাকে।”

“আর এই বাসা? এটা কে দেখবে।”

“তালা মেরে চলে যাব।”

নীলা হেসে বলল, “তাহলে যখন ফিরে আসবে তখন দেখবে তোমার বাসা ধু ধু খালি। নীলক্ষেতে পুরানো বইয়ের দোকান থেকে আমার সব বই খুঁজে খুঁজে বের করে কিনতে হবে।”

আমি বললাম, “তুমি চিন্তা করো না, আমি একজনকে খুঁজে বের করব যে তোমার বাসা ছয় সপ্তাহ পাহারা দেবে।”

“আগে খুঁজে বের করো তারপর দেখা যাবে।”

কাজটা যত সহজ হবে ভেবেছিলাম সেরকম সহজ হলো না। একই সাথে বিশ্বাসী এবং ছয় সপ্তাহের জন্যে কাজকর্ম নেই এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া খুব মুশকিল। শেষ পর্যন্ত মনে হলো দারোয়ান বা কেয়ার টেকার ধরনের একজন মানুষকে রেখে যেতে হবে তখন হঠাৎ করে আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন নীলার বাবা! নীলার মা মারা গেছেন বেশ অনেক দিন হলো, এখন একা মানুষ দেশের বাড়িতে থাকেন। তিনি আমাদের বাসায় ছয় সপ্তাহ থাকতে রাজি হলেন, তবে একটা শর্ত সাপেক্ষে। টেলিভিশনে তখন খুব জমজমাট একটা সিরিয়াল হচ্ছে সেটা দেখার জন্যে প্রতি বুধবার তাকে বাড়ি যেতে হবে। আমরা বললাম, তার কোনো প্রয়োজন নেই ছয় সপ্তাহের জন্যে তিনি তার টেলিভিশনটাই এখানে নিয়ে আসতে পারবেন। নীলা যেখানে টেলিভিশন দেখতে পারে না সেখানে তার বাবা এরকম টেলিভিশন ভক্ত কেমন করে হলো কে জানে?

নীলার বাবাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে আমরা প্লেনে করে সোজা নিউইয়র্ক। আমি সারাদিন অফিসে কাজ করি নীলা নিউইয়র্কের মিউজিয়ামে মিউজিয়ামে আর বইয়ের দোকানে ঘুরে বেড়ায়। সন্ধ্যেবেলা কোনো ছোট রেস্টুরেন্টে খাই, কোনো কোনোদিন নিজেরা কিছু রান্না করি। উইক এন্ডে ছুটি তখন আরো দূরে কোথাও যাই, সব মিলিয়ে খুব চমৎকার ছয় সপ্তাহ কাটিয়ে দেশে ফিরে এলাম। রওনা দেবার আগে টেলিফোনে নীলার বাবার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম, লাভ হয়নি। দেশে লাইন পাওয়া খুব কঠিন, পাওয়া গেলেও কানেকশন এত দুর্বল যে কথা বলা যায় না। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বাসায় এসেছি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, ভেতরে টেলিভিশন চলছে শুনতে পাচ্ছি কিন্তু যতই বেল বাজাই কেউ দরজা খুলে না। শেষে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে আমরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম। টেলিভিশনের সামনে নীলার বাবা মৃত পড়ে আছেন, টেলিভিশনে একটা হাসির নাটক হচ্ছে। নাটকের চরিত্রগুলো একটু পরে পরে হেসে উঠছে, দেখে মনে হয় মৃতদেহটি দেখে হাসছে। কী ভয়ানক একটা দৃশ্য!

নীলার বাবা কতদিন আগে মারা গেছেন কে জানে-আমি সেই দৃশ্যের বর্ণনা দিতে চাই না। নীলাকে সরিয়ে নিয়ে কোনোভাবে লোকজনকে খবর দিলাম। পুলিশ এলো, ডাক্তার এলো, আত্মীয়স্বজন এলো। ঘর ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। জানাজা পরিয়ে দাফন করিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে আমরা যখন আবার আমাদের জীবন শুরু করার চেষ্টা করছি তখন প্রায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেছে।

নীলার সাথে তার বাবার খুব ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক ছিল। মা মারা যাবার পর সেটি আরো গম্ভীর হয়েছিল। হঠাৎ করে বাবার এরকম অস্বাভাবিক একটা মৃত্যু নীলাকে খুব বড় একটা ধাক্কা দিল। সে কেমন যেন চুপচাপ হয়ে গেল। আমি বাসায় এসে আবিষ্কার করতাম সোফায় পা তুলে চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে। প্রায় সময়েই আবিষ্কার করতাম সে টেলিভিশনটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।

একদিন আমি নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম, “টেলিভিশনটা কী করব বলো দেখি?”

“বিক্রি করে দাও।”

“বিক্রি করে দেব?”

“হ্যাঁ।”

“পুরনো টিভি-কয় টাকায় আর বিক্রি হবে।”

“তাহলে কাউকে দিয়ে দাও।”

“কাউকে দিয়ে দেব?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে।”

আমি তাই টেলিভিশনটা কাকে দেয়া যায় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকি। আজকাল গ্রামে ইলেকট্রিসিটি চলে এসেছে, গ্রামে গরিব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের কাউকে দিয়ে দিলেই হবে। গ্রাম থেকে মাঝে মাঝে আত্মীয়স্বজন আসে-পরের বার তাদের কেউ এলে এটা ধরিয়ে দেয়া যাবে। কেমন করে নেবে সেটা তাদের দায়িত্ব।

এর মাঝে একদিন একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেছে, তাকিয়ে দেখি পাশে নীলা নেই। আমি বিছানায় উঠে বসেছি তখন মনে হলো পাশের ঘর থেকে মানুষের কথার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। আমি অবাক হয়ে বিছানা থেকে নেমে পাশের ঘরে গিয়ে দেখি টেলিভিশন চলছে এবং তার সামনে সোফায় শুয়ে নীলা ঘুমুচ্ছে। আমি নীলাকে ডেকে বললাম, “নীলা।”

নীলা চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, “কী?”

“তুমি এখানে কী করছ?”

“ঘুম আসছিল না তো-তাই এখানে শুয়েছি।”

“আমাকে ডাকলে না কেন?”

নীলা কিছু বলল না। চুপচাপ বসে রইল।

আমি বললাম, “শুতে চলো।”

নীলা স্বাভাবিক গলায় বলল, “চলো।”

আমি টেলিভশনটা বন্ধ করে নীলাকে শোয়ার ঘরে নিয়ে এলাম।

এরপর থেকে আমি মাঝে মাঝেই দেখি নীলা টেলিভিশন অন করে বসে আছে। টেলিভিশন দেখাটা এমন কিছু বড় অপরাধ নয়, তার মানসিক এই অবস্থায় সে যদি টেলিভিশনের কোনো অনুষ্ঠান দেখে ভুলে থাকতে চায় সেটা একদিক দিয়ে ভালোই। কিন্তু আমি একটা বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করলাম। সে টেলিভিশন অন করে তাকিয়ে থাকে কিন্তু সেখানে কী হচ্ছে সে তার কিছু লক্ষ করে না। সে টেলিভিশনটা দেখে, তার অনুষ্ঠানকে দেখে না। আমি তাকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি তো আগে টেলিভিশন দেখতে না। এখন দেখো?”

নীলা দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, “মাঝে মাঝে দেখি।”

“কোন অনুষ্ঠান তোমার প্রিয়?”

“অনুষ্ঠান?” নীলা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মনে হলো আমার কথাটা বুঝতে পারছে না।

“হ্যাঁ। কোন অনুষ্ঠান?”

নীলা আমতা আমতা করে বলল, “না, মানে ইয়ে–” সে তার কথা শেষ করল না।

এরকম সময় আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে দূরসম্পর্কের এক চাচাতো ভাই শহরে এসেছে, মোটামুটি অপদার্থ পরিবারের ছেলে, যখনই টাকার দরকার হয় কোনো ছল-ছুতোয় শহরে হাজির হয়। আমার মনে হলো টেলিভিশনটা দূর করার এই সুযোগ। নীলাকে কথাটা বলতেই সে কেমন যেন চমকে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, “ না, না, প্লিজ এখন দিও না।”

“কেন? তুমি তো আগে কখনো টেলিভিশন দেখতে না।”

নীলা মাথা নেড়ে বলল, “আমি এখনও দেখি না। কিন্তু মানে ইয়ে—”

“কী?”

নীলা একটু ছটফট করে বলল, “মানে এটা তো বাবার একটা স্মৃতি। সেজন্যে ভাবছিলাম–”

“কী ভাবছিলে?”

“আরও কয়দিন যাক? তারপর দেব।” আমার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ।”

কাজেই টেলিভিশনটা বাসাতেই থেকে গেল।

আমাদের বাসার পরিবেশটা কিন্তু অনেক পাল্টে গেছে। নীলা কথা বলে খুব কম। সেরকম বইও পড়ে না, গানও শুনে না। আমার ধারণা আমি যখন থাকি না তখন সে সারাক্ষণ টেলিভিশন চালিয়ে তার সামনে বসে থাকে। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে আমি আবিষ্কার করি সে বিছানা থেকে উঠে টিলিভিশনের সামনে বসে আছে। আগে সোফায় বসে থাকতো-এখন সে বসে টেলিভিশনের খুব কাছে। শুধু তাই নয় চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে এমন একটা চ্যানেল বের করে যেখানে কোনো অনুষ্ঠান নেই। তারপর সেই শূন্য স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাকিয়ে কী দেখে আমি বুঝতে পারি না–কারণ আমি যখন তাকে এভাবে আবিষ্কার করি তখন সে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে! মনে হয় সে সত্যিই কিছু দেখছে।

আমি একদিন গভীর রাতে তাকে আবিষ্কার করলাম টেলিভিশন স্ক্রিনের সাথে প্রায় মুখ লাগিয়ে সে দেখছে। আমি আস্তে আস্তে নীলার পিঠে হাত রেখে ডাকলাম, “নীলা।”

সে চমকে আমার দিকে তাকাল। চোখ দুটো অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো। আমি বললাম, “কী হয়েছে নীলা?”

“কিছু হয় নাই।”

“কী দেখছ টেলিভিশনে?”

নীলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “কী দেখছ?”

“বাবাকে।”

আমি অবাক হয়ে বলাম, “বাবা! কোথায়?”

নীলা টেলিভিশনটি দেখিয়ে বলল, “এই তো এখানে।”

“কোথায়?”

নীলা কিছুক্ষণ টেলিভিশনটির দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, “এখন নাই।”

আমি তার হাত ধরে বললাম, “উঠ। চলো, শোবে।”

নীলা বাধ্য মেয়ের মতো বলল, “চলো।”

আমি কয়েকদিন খুব দুশ্চিন্তার মাঝে কাটালাম। ব্যাপারটা নিয়ে কার সাথে কথা বলতে পারি সেটাও বুঝি না। নীলার সাথেও কথা বলতে পারি না, দিনেরবেলা বিষয়টাকে রীতিমতো হাস্যকর বলে মনে হয়।

কয়দিন পর আবার গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল, শুনতে পেলাম নীলা ফিসফিস করে কথা বলছে। আমি পা টিপে টিপে উঠে গেলাম, গিয়ে দেখি নীলা টেলিভিশনের সামনে উবু হয়ে বসে আছে। শুনতে পেলাম সে মাথা নেড়ে বলছে, “ভয় করে বাবা। অনেক ভয় করে।”

আমি বুকের ভেতর একধরনের গভীর শূন্যতা অনুভব করি, নীলা প্রায় মানসিক রোগীর মতো হয়ে গেছে। তার ধারণা সে টেলিভিশনে তার বাবাকে দেখছে, কথা শুনছে।

আমি নীলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ থমকে দাঁড়ালাম, আমার মনে হলো আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম টেলিভিশন থেকে অস্পষ্ট গলার কেউ একজন বলল, “কোনো ভয় নেই।

“সত্যি বাবা?”

আমি আবার শুনলাম, “হ্যাঁ সত্যি। তুই ছাদ থেকে লাফ দে। তাহলেই তুই আর আমি একসাথে থাকব।”

আতঙ্কে আমার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল। নীলা বলল, “ তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে বাবা?”

“থাকব। এই তো আছি দেখছিস না?”

আমি টেলিভিশনের দিকে তাকালাম, সত্যি সত্যি সেখানে একজন মানুষের ছবি দেখা যাচ্ছে। আবছা অস্পষ্ট ছবি কিন্তু মানুষের ছবি তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

নীলা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, “যাচ্ছি বাবা। তুমি আমার সাথে থাকবে তো?”

“হ্যাঁ থাকব। তোর কোনো ভয় নেই।”

নীলা দরজার দিকে এগিয়ে গেল, আমি আতঙ্কে পাথর হয়ে দেখলাম সে ছিটকিনি খুলে বারান্দায় যাচ্ছে। সেখান থেকে নিচে লাফিয়ে পড়বে?

টেলিভিশন থেকে আবার একটা কণ্ঠস্বর বের হয়ে এলো, “ এগিয়ে যা মা। রেলিংয়ের ওপর দাঁড়া। আমি যখন বলব, ওয়ান টু থ্রি তখন লাফ দিবি। পারবি না?”

“পারব বাবা।”

“চমৎকার। তাহলে তুই আমার কাছে চলে আসবি। আমার আর তোর কাছে আসতে হবে না।”

“ঠিক আছে।”

আমি তখন দরদর করে ঘামছি। কী করছি বুঝতে পারছি না, কোনোমতে নীলার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে জাপটে ধরলাম। সে ঝটকা মেরে আমার থেকে মুক্ত হয়ে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেল। আমি আবার তাকে ধরার চেষ্টা করলাম, কীভাবে কীভাবে জানি সে আবার নিজেকে মুক্ত করেনিল। আমি শুনতে পেলাম টেলিভিশন থেকে আবার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “রেলিংয়ের ওপর দাঁড়া।”

নীলা বলল, “‘দাঁড়াচ্ছি।”

আমি ভয়ে অধীর হয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখলাম, নীলা রেলিংয়ের ওপর উঠে দাঁড়িয়েছে।

টেলিভিশনে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি বলল, “ওয়ান।”

নীলা খুব ধীরে ধীরে তার দুই হাত দুই দিকে প্রসারিত করে দাঁড়াল, মনে হলো সে বুঝি এক্ষুনি উড়ে যাবে।

টেলিভিশন ছায়ামূর্তি এবারে অনেক স্পষ্ট হয়ে এসেছে, কঠিন আর স্পষ্ট গলায় বলল, “টু।”

আমি তখন ঘরের ভেতরে ছুটে গেলাম কী করছি না বুঝেই হ্যাঁচকা টানে।

টেলিভিশনটা তুলে নিয়ে প্রচণ্ড জোরে মেঝেতে আছড়ে মারলাম, কয়েকটা বিদ্যুতের স্ফুলিঙ্গ আর পোড়া গন্ধ ভেসে এলো তারপর হঠাৎ সারা ঘর নীরব হয়ে গেল।

নীলা তখনও রেলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখলাম সে থরথর করে কাঁপছে। যে কোনো মুহূর্তে সে ওখান থেকে পড়ে যাবে। আমি আবার বারান্দায় ছুটে এলাম, শুনলাম নীলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি তার পেছনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় ডাকলাম, “নীলা”।

নীলা বলল, “আমার কী হয়েছে?”

আমি বললাম, “তোমার কিছু হয়নি। তুমি নেমে এসো।”

নীলা বলল, “আমার ভয় করছে আমি যদি পড়ে যাই?”

আমি পেছন থেকে তাকে ধরে বললাম “তুমি পড়বে না। আমি আছি না?”

নীলা নিচে নেমে এসে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

ম্যানেজার সাহেব তার গল্প শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিশ্বাস হলো?”

আমি অন্ধকার নির্জন কুয়াশা ঢাকা রাতের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কাল দিনের বেলা কী মনে হবে জানি না। এখন তো অবিশ্বাস করার কিছু দেখছি না।”

ম্যানেজার সাহেব হাসলেন, বললেন, “শুয়ে পড়েন। অনেক রাত হয়েছে।”

আমিও উঠে দাঁড়ালাম। শুতে যাব সেটা ঠিক আছে, ঘুমাতে পারব কী না কে জানে! আমি আবার খুব ভীতু মানুষ!

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *