Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মুকিদ আলীর বাবা খুব শখ করে তার ছেলের নাম রেখেছিল মোহাম্মদ মুকিদ আলী, কিন্তু এখন তাকে কেউ সেই নামে চিনে না, সবাই তাকে ডাকে মুইক্কা চোরা’। মুকিদ আলীর মাঝে মাঝে যে এটা নিয়ে দুঃখ হয় না তা না। একসাথে চুরি করতে গিয়ে ইদরিস আলী ধরা পড়ল না বলে তার কিছু হলো না আর সে ধরা পড়ে গেল বলে তার নাম হয়ে গেল মুইক্কা চোরা। শুধু কি নাম? সবাই মিলে এমন মার মেরেছিল যে পুরো এক মাস তার বিছানায় পড়ে থাকতে হয়েছিল। এখনো বাম পা-টাতে জোর পায় না একটু টেনে টেনে হাঁটতে হয়। কার্তিক মাসের অভাবের সময় অন্য দশজনের মতো সেও ছোটখাটো চুরি-চামারি করেছে কিন্তু এটাই যে তার সত্যিকার পেশা হয়ে যাবে সেটা সে কোনো দিন কল্পনা করে নাই। নামের পেছনে চোরা শব্দটা লেগে যাবার পর তার আর কোনো উপায় থাকল না, কেউ কাজকর্ম দেয় না, কোথাও গেলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় তাই শেষ পর্যন্ত এ কাজেই তাকে পাকাপাকিভাবে লেগে যেতে হলো। এখন সে মোটামুটিভাবে চুরি-চামারি করেই দিন কাটায়-তবে সমস্যা একটাই, আশেপাশে দশ গ্রামে কোনো বাড়িতে চুরি হলে থানাওয়ালারা প্রথমেই তাকে ধরে আনে, তারপর যা একটা পিটুনি দেয় তার কোনো মা-বাপ নেই। পাবলিকের মার তবু সহ্য করা যায় কিন্তু পুলিশের মার খুব কঠিন বস্তু।

চোর হলেও এ এলাকার মানুষ যে তাকে খুব হেলাফেলা করে তা না। অন্য গ্রামে বিএ পাস মাস্টার আছে, দারোগা আছে, পাস করা ডাক্তার আছে তাদের গ্রামের বিখ্যাত মানুষ বলতে এই মুইক্কা চোরা। কাজেই গ্রামের লোকজন তাকে অল্পবিস্তর খাতির করে। বলাইয়ের চায়ের দোকানে গেলে বলাই চোখ টিপে বলে, “কী রে মুইক্কা-আজকে কার সর্বনাশ করে আইলি?” মুকিদ আলী তখন দুর্বলভাবে হাসে কিছু বলে না। চোর-মানুষদের কথা বলা ঠিক না, কেউ তাদের কথা বিশ্বাস করে না। বলাই তার সাথে একটু-আধটু ইয়ারকি-তামাশা করে ঠিকই, কিন্তু দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় না। ভেতরে গিয়ে বসলেও আপত্তি করে না। মন-মেজাজ ভালো থাকলে একটা কুকি বিস্কুট, আধখানা গজা বা এক কাপ চা খেতে দেয়।

আজকে সন্ধ্যেবেলা মুকিদ আলী বলাইয়ের চায়ের দোকানে চাদর মুড়ি দিয়ে বসেছে, যা একটা ঠাণ্ডা পড়েছে সে আর বলার মতো না। গরম চা আর একটা বিড়ি টেনেও শরীরটা ঠিক মতোন গরম হচ্ছে না। সাহস করে আরো এক কাপ চা চেয়ে ফেলবে কী

বুঝতে পারছিল না। তখন গ্রামের মাতব্বর মোদাব্বের মুন্সী এসে ঢুকল, সে কখনো একা চলাফেরা করে না, সব সময়ে তার সাথে দু-একজন থাকে। আজকেও আছে, এ গ্রামেরই দুজন-কুদ্দুস আর গহর আলী। সবাইকে নিয়ে একটা টেবিলে বসে চোখ ঘুরিয়ে সবার দিকে একবার তাকাতেই তার মুকিদ আলীর দিকে নজর পড়ল। মোদাব্বের মুন্সী ভুরু কুঁচকে বলল, “‘কী রে মুইক্কা তুই এইখানে? কবে ছাড়া পেলি?”

মুকিদ আলী হাত কচলে বলল, “‘বছর দুই হইছে চেয়ারম্যান সাহেব।”

“দুই বছর জেলের বাইরে? বলিস কী রে মুইক্কা?”

মুকিদ আলী কথা না বলে তার ময়লা হলুদ দাঁত বের করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

“তা এইখানে কী মতলব? চুরি না অন্য কিছু?”

“কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব!” মুকিদ আলী নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “জব্বর ঠাণ্ডা পড়ছে তাই ভাবলাম বলাই কাকার রেস্টুরেন্টে এক কাপ চা খায়া যাই।”

“তোদের আবার ঠাণ্ডা লাগে নাকি? মাঘ মাসের শীতে খালি গায়ে তেল মাইখ্যা চুরি করস না?”

এই প্রশ্নের উত্তর সহজ ভাষায় দেয়া সম্ভব নয়, তাই মুকিদ আলী তার চেষ্টা করল না। হাসার একটা দুর্বল ভঙ্গি করে বলল, “ কী যে বলেন চেয়ারম্যান সাহেব!”

মোদাব্বের মুন্সী গ্রামের একজন গণ্যমান্য মানুষ, একটা চোরের সাথে তার বেশি সময় কথা বলা ঠিক না, তাই সে হঠাৎ মুখটা কঠিন করে তার দৃষ্টি সরিয়ে নিল। মুকিদ আলীকে যেন দেখতেই পায় নাই এরকম ভান করে বলাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “বলাই, তিন কাপ চা দো ফ্রেশ পাত্তি দিবি।”

বলাই বলল, “জে আচ্ছা চেয়ারম্যান সাহেব।”

মোদাব্বের মুন্সী তখন কুদ্দুস আর গহর আলীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তারপর কী হলো মোসলেম মিয়ার?”

“কী আর হবে। ঠাঠা পড়লে শরীরের কী কিছু থাকে? এত বড় জোয়ান মানুষ, পুরা শরীর পুইড়া কয়লা।”

মোসলেম মিয়া এই গ্রামেরই মানুষ, নানারকম অসামাজিক কাজ নেশা ভাং এসব নিয়ে থাকতো। বাবার একমাত্র ছেলে, বাবার সব সহায়-সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে মোটামুটিভাবে উচ্ছন্নে গিয়েছিল।

গতরাত্রে হঠাৎ করে অসময়ের ঝড়ে বাজ পড়ে মারা গিয়েছে। গ্রামের এতগুলো মানুষ, মৃত্যু এখানে এমন কিছু অপরিচিত বিষয় নয় তবে বাজ পড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা খুব বেশি ঘটেনি। সারা গ্রামেই এখন সেটা নিয়ে মোটামুটি একটা উত্তেজনা রয়েছে।

মোদাব্বের মুন্সী মাথা নেড়ে বলল, “আমি কতবার কইছি মোসলেম মিয়ারে এই নাফরমানি কাজ বন্ধ কর, হারামজাদা আমার কথা শুনল না। আল্লাহর গজব কারে কয় এখন বুঝল কী না?”

গহর আলী মাথা নেড়ে বলল, “আল্লাহর মাইর চিন্তার বাইর।”

মোদাব্বের মুন্সী বলল, “তার বাপ ছিল ভদ্রলোক। ছেলেটা এইভাবে নষ্ট হলো?”

কুদ্দুস বলল, “একদিক দিয়া ভালোই হইছে মরছে। টাকা-পয়সার খুব কষ্টে আছিল নাকি।”

গহর আলী বলল, “মনে আছে চেয়ারম্যান সাহেব, বাপের একমাত্র ছেলে কত সহায়-সম্পত্তি? বিয়া করল কাঞ্চনপুর গ্রামে?”

কুদ্দুস বলল, “বউটা মইরা বাঁচছে।”

মোদাব্বের মুন্সী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে। বউটার হায়াত নাই”

গহর আলী বলল, “এর বউটা ভালো ছিল। বউটা বাঁইচা থাকলে মনে হয় মোসলেম মিয়ার এই অবস্থা হয় না। টাকা-পয়সা এইভাবে নষ্ট করে না।”

কুদ্দুস বলল, “নষ্ট বলে নষ্ট। শেষের দিকে নাকি ভাত খাওয়ার পয়সা নাই। কী অবস্থা!”

মোদাব্বের মুন্সী হঠাৎ দুলে দুলে হাসতে শুরু করল। কুদ্দুস অবাক হয়ে বলল, “কী হলো চেয়ারম্যান সাহেব? হাসেন কেন?”

“মানুষের কপাল! এই মোসলেম মিয়ার টাকা-পয়সার কত দরকার, সেই টাকা-পয়সার খনি আল্লাহ তারে দিল কিন্তু ভোগ করার উপায় নাই!”

কুদ্দুস এবং গহর আলী কেউই ঠিক বুঝতে পারল না মোদাব্বের মুন্সী কী বলছে। একজন আরেজকনের দিকে তাকিয়ে তারা মোদাব্বের মুন্সীর দিকে তাকাল। কুদ্দুস বলল, “কী বলছেন চেয়ারম্যান সাহেব? টাকা-পয়সার খনি?”

মোদাব্বের মুন্সী মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়তে লাগল, বলল, “খনি না তো কী? দুই-চাইর লাখ টাকার কম না!”

কুদ্দুস সোজা হয়ে বসে বলল, “কী জিনিস দুই-চার লাখ টাকার কম না?”

মুকিদ আলীর একটা ঝিমুনির মতো এসেছিল, দুই-চার লাখ টাকার কথা শুনে মুহূর্তের মাঝে তার ঝিমুনি দূর হয়ে গেল কিন্তু সেটা সে কাউকে বুঝতে দিল না। চোখে-মুখে ঘুমের ভান করে ঘাপটি মেরে মোদাব্বের মুন্সীর কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগল।

মোদাব্বের মুন্সী এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, “তোমরা জানো না মানুষের শরীলে ঠাঠা পড়লে কী হয়?”

“কী হয় চেয়ারম্যান সাহেব?”

“ঠাঠা হইলো ইলেকট্রিসিটি। শরীলের ভেতর দিয়া যখন ইলেকট্রিসিটি যায় তখন চুল চামড়া গোশত পুইড়া কয়লা হইয়া যায়। কিন্তুক”

“কিন্তুক কী?”

“শরীলের হাড্ডির মাঝে পরিবর্তন হয়। শরীলের হাড্ডি চুমুক হয়ে যায়।”

গহর আলী চোখ বড় বড় করে বলল, “চুম্বুক? চুম্বুক কী চেয়ারম্যান সাহেব?”

“চুম্বুক হইলো সোনা থেকে দামি। এমন এক জিনিস যেটা সবকিছু আকর্ষণ করে।”

মোদাব্বের আলী চুম্বক নামক বস্তুটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে “ আকর্ষণের মতো একটা কঠিন শব্দ ব্যবহার করতে পেরে বিশেষ প্রীত হলো। মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “এই মোসলেম মিয়া-তার টাকা-পয়সার কত অভাব। কিন্তু চিন্তা করো তার শরীলের মূল্য এখন লাখ টাকার কম না!”

কুদ্দুস এবং গহর আলীর চোখে একধরনের লোভ খেলা করে সেটা আবার দপ করেনিভে যায়। একটা মৃত মানুষের পুড়ে যাওয়া শরীরের মূল্য যতই হোক সেটা তারা তুলে আনতে পারবে বিক্রিও করতে পারবে না।

মুকিদ আলীর কথা ভিন্ন, তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠেছে, কিন্তু সে সেটা কাউকে বুঝতে দিল না। মাথাটা পেছনে হেলান দিয়ে সে ঘুমের ভান করে বসে রইল। কুদ্দুস কিংবা গহর আলীর সাহস

থাকতে পারে কিন্তু তার সাহসের অভাব নাই। মোসলেম মিয়ার মূল্যবান শরীর সে ঠিকই তুলে আনতে পারবে! শুধু তার কবরটা খুঁজে বের করতে হবে। কোথায় দিয়েছে কবর? সে আবার কান খাড়া করে, কারণ শুনতে পেল মোদাব্বের মুন্সী ঠিক সেই প্রশ্নটাই করেছে।

“কবর দিছে কোনখানে?”

কুদ্দুস বলল, “সরকারি গোরস্তানে।

“সরকারি গোরস্তানে জায়গা কই?”

“একটা পুরান কবরের ভেতরে কবর দিছে। পশ্চিম দিকে একেবারে দেওয়ালের কাছে।”

“অ” মোদাব্বের মুন্সী একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “মোসলেম মিয়ার আত্মীয়স্বজন নাই। যদি থাকত আমি কী বলতাম জানো?”

“কী বলতেন চেয়ারম্যার সাহেব?”

“আমি বলতাম লাঠি-সড়কি নিয়া কবর পাহাড়া দিতে। এই কবর এখন সোনার খনি।”

কুদ্দুস এবং গহর আলীর চোখ আবার চকচক করে উঠে আবার দপ করে নিভে যায়।

বলাই ততক্ষণে টেবিলে চা দিয়ে গেছে। চা খেতে খেতে মোদাব্বের মুন্সী তখন রাজনীতির আলাপ করে। আমেরিকা এবং চীন কেন এ দেশের দিকে নজর দিচ্ছে সেই ব্যাপারটি সে কুদ্দুস এবং গহর আলীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। মুকিদ আলী সেগুলো বসে বসে শুনে কিন্তু কোনো কথাই তার মাথার ভেতরে ঢুকে না। সে চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পায় সরকারি গোরস্তানের পশ্চিম পাশে মোসলেম মিয়ার কবর, যেটা খুঁড়ে সে লাখ টাকা দামের পোড়া একটা শরীর বের করে আনছে। তার এ কষ্টের জীবন হয়তো এভাবেই শেষ হবে খোদা হয়তো এটাই তার কপালে রেখেছেন।

মোদাব্বের মুন্সী কুদ্দুস আর গহর আলীকে নিয়ে না ওঠা পর্যন্ত মুকিদ আলী ঘুমের ভান করে বসে রইল। তারা উঠে যাবার পর সেও উঠে দাঁড়ায়। বলাই চোখ মটকে বলে, “কী রে মুইক্কা কই যাস?”

“বাড়ি যাই। শরীলের মাঝে জুত পাই না।”

“এত সকালে বাড়ি গিয়া কী করবি? রাত গভীর না হলে কী চুরিতে বার হওয়া যায়?”

মুকিত আলী ভেতরে ভেতরে একটু চমকে উঠল, সত্যিই সে আজ রাতটা গম্ভীর হলেই চুরি করতে বের হবে কিন্তু বলাইয়ের সেইটা জানার কথা না। মুকিদ আলী জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, “আপনি যে কী কন বলাই কাকা!”

বাইরে ঘন কুয়াশা এবং কনকনে শীত। মুকিদ আলীর মনটা ভালো হয়ে গেল কবর খুঁড়ে লাশ চুরির জন্যে এর চাইতে ভালো পরিবেশ আর কিছু হতে পারে না। সরকারি কবরস্থান গ্রামের বাইরে, আশেপাশে বসতি নাই। বসতি থাকলেও এই শীতে কেউ বের হবে না। যদি বেরও হয় এই ঘন কুয়াশায় কেউ তারে দেখবে মনে হয় খোদা তার জন্যেই এইরকম একটা অবস্থা করে দিয়েছেন!

ঘরে ফিরে এসে মুকিদ আলী চারটে ভাত ফুটিয়ে নেয়। দুপুরের বাসি তরকারি ছিল, সেটা দিয়েই সে তৃপ্তি করে খায়। মোসলেম মিয়ার শরীর তুলে আনার পর তার আর বাসি তরকারি দিয়ে ভাত খেতে হবে না। থালাবাসন ধুয়ে সে তার ঘরের বারান্দায় বসে একটা বিড়ি ধরাল, তার ভেতরে একধরনের উত্তেজনা-কোথাও চুরি করতে যাবার আগে সে সব সময় এরকম উত্তেজনা টের পায়।

মুকিদ আলীর ঘড়ি নাই কিন্তু ঘড়ি ছাড়াই সে সময়ের আন্দাজ করতে পারে। ঠিক মাঝরাতে সে একটা কোদাল আর একটা বস্তা নিয়ে বের হলো। অন্ধকার রাত, ঘন কুয়াশায় ঢাকা, গ্রামের নির্জন পথে একটা মানুষ নেই। মুকিদ আলী নিঃশব্দে গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যায়, দীর্ঘদিনের অভ্যাস-হাঁটলে তার পায়ের কোন শব্দ হয় না।

সরকারি গোরস্তানের কাছাকাছি এসে সে খালের পাড়ে একটা ঝোঁপের আড়ালে কিছুক্ষণ বসে রইল। কেউ যদি আশেপাশে থেকে থাকে তাহলে তার চোখে পড়বে। যখন দেখল কেউ নেই তখন সে সাবধানে দেওয়াল টপকে গোরস্তানের ভেতরে ঢুকল। ভেতরে একধরনের সুনসান নীরবতা। গোরস্তানের ভেতর বড় বড় গাছ, নিচে গাছের শুকনো পাতা-অন্য যে কেউ হলে শুকনো পাতার শব্দ হতো কিন্তু মুকিদ আলী নিঃশব্দে হেঁটে গেল।

কৃষ্ণপক্ষের রাত, মাঝরাতের দিকে চাঁদ ওঠার কথা, হয়তো এতক্ষণে উঠে গেছে। ঘন কুয়াশায় এই চাঁদের আলো অন্ধকার দূর করতে পারছে না, চারপাশে শুধু একটা ঘোলাটে অস্বচ্ছ আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। মুকিদ আলী গোরস্তানের ভেতরে আবছা অন্ধকারে বাঁধানো কবরগুলো দেখতে পায়, সেগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ তার বুকের ভেতরে একধরনের কম্পন অনুভব করে, সে ছোটখাটো দুর্বল মানুষ,কিন্তু তার পরিচয় “মুইক্কা চোরা”–সে অনেক রাতবিরেতে অনেক বনজঙ্গল খালবিল গোরস্তান শ্মশানে রাত কাটিয়েছে, কখনো ভয় পায় নি। আজ এই মধ্যরাতে গোরস্তানে এসে হঠাৎ করে তার বুকে প্রথমবার ভয়ের একধরনের কাঁপুনি খেলে গেল।

মুকিদ আলী ভয়টাকে ঠেলে দূর করে দিয়ে পশ্চিম দিকের দেওয়ালের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। এইখানে কোনো এক জায়গায় মোসলেম মিয়াকে কবর দেয়া হয়েছে। নতুন কবর, বের করা কোনো সমস্যা হবে না। ওপরে ঢিবির মতো করে মাটি উঁচু করে দেওয়া থাকবে। ঘাসপাতা ঝোঁপঝাড় থাকবে না। শেয়াল যেন না আসে সেজন্যে তুষ ছিটিয়ে দেওয়া থাকবে। মুকিদ আলী অন্ধকারের মাঝে হাতড়ে হাতড়ে দেখতে থাকে। ঠিক তখন সে প্রথমবার শব্দটা শুনতে পায়। খুব মৃদু একটা শব্দ। হুম হুম করে কেউ যেন শব্দ করছে।

মুকিদ আলীর হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ করে যেন গলার কাছে এসে আটকে গেল। তার একবার মনে হলো বুঝি সে চিৎকার করে ছুটে পালায়, কিন্তু সে পালাল না, শক্ত হয়ে বসে রইল। শব্দটা থেমে থেমে হয়–একটানা কিছুক্ষণ হবার পর আবার থেমে যায়।

“প্যাঁচা।” মুকিদ আলী বোঝাল, “নিশ্চয়ই হুতোম প্যাঁচা।”

মুকিদ আলী গ্রামের মানুষ, গ্রামের পশুপাখির ডাক সে খুব ভালো করে চিনে। মুইক্কা চোরা হিসাবে রাতবিরেতে খালবিলের পাশে, ঝোঁপঝাড়ের আড়ালে বসে বসে অনেক রাতজাগা পাখির শব্দ শুনেছে, সে খুব ভাল করে জানে এটা প্যাঁচার ডাক না তবুও সে নিজেকে বোঝাল এটা আসলে একটা প্যাঁচার ডাক।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে কবরগুলো হাতড়ে হাতড়ে মুকিদ আলী মোসলেম মিয়ার কবরটা খুঁজে বের করল। কাঁচা মাটির ঢিবি, ওপরে তুষ ছড়ানো ঠিক সে যে রকম অনুমান করেছিল।

মুকিদ আলী গামছাটা কোমরে বেঁধে খুব সাবধানে কবরটা খুঁড়তে শুরু করে। কোদালের প্রথম কোপটা দেয়ার সাথে সাথে হঠাৎ করে হুম হুম শব্দটা থেমে গেল। এতক্ষণে এই হুম হুম শব্দে মুকিদ আলী কেমন যেন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল হঠাৎ করে শব্দটা থেমে যাওয়ায় সে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করে। অস্বস্তির কারণটা সে জোর করে নিজের ভেতরে থেকে সরিয়ে রাখে… তার কেমন জানি মনে হয় এই কবরের ভেতর থেকেই শব্দটা আসছে।

“কবরের ভেতর মোসলেম মিয়ার পুড়ে কয়লা হওয়া শরীল” মুকিদ আলী ফিসফিস করে নিজেকে বোঝাল “এই শরীলের প্রত্যেকটা হাড্ডি একটা করে চম্বুক। চম্বুক হচ্ছে সোনার থেকে দামি! মোদাব্বের মিয়ার নিজের মুখের কথা। আমি নিজের কানে। শুনেছি। কোনোমতে শরীলটা তুলে বস্তা করে বাড়ি নিয়া যামু। বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখমু! সময় হলে খোঁজখবর নিয়া এই হাড্ডি বেচে আমি বড়লোক হয়ে যামু।” মুকিদ আলী একটা উত্তেজনা অনুভব করে। ফিসফিস করে বলে, “আর চুরিচামারি না। এই মুইক্কা চোরা আর চুরি করবে না। এই হচ্ছে শেষ চুরি। জন্মের মতো শেষ।”

মুকিদ আলী নিঃশব্দে কবর খুঁড়তে থাকে। নরম মাটি সহজেই কোদালের কোপের সাথে উঠে আসে। আধাআধি হওয়ার পর হঠাৎ যেভাবে থেমে গিয়েছিল ঠিক সেইভাবে হুম হুম শব্দটা ফিরে এলো, আগের চেয়ে আরো অনেক জোরে, অনেক

স্পষ্টভাবে। শব্দটা লম্বা এবং দীর্ঘ সময়ের, হুম্মম হুম্মম করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মুকিদ আলীর মনে হয় কোনো মানুষ বুঝি জ্বরের ঘোরে কাতর শব্দ করছে। তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কনকনে শীতের মাঝে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। হঠাৎ করে সে নিজের ভেতরে একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, একধরনের জান্তব ভয়ে তার শরীর শিউরে ওঠে। এতক্ষণ সে নিশ্চিত হতে পারেনি কিন্তু এখন সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই শব্দটি আসছে কবরের ভেতর থেকে।

মুকিদ আলী কোদালটি হাতে নিয়ে জোরে জোরে মাটিতে দুবার ঘা দিল সাথে সাথে শব্দটা থেমে গেল। ঠিক কী কারণ কে জানে শব্দটা থেমে যাওয়ায় মুকিদ আলীর আতঙ্কটা কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

“এইসব কিছু না।” মুকিদ আলী নিজেকে বোঝাল, “মোসলেম মিয়ার পোড়া লাশ ভেতরে। এই লাশের হাড্ডি হচ্ছে সাত রাজার ধন। সোনার চেয়ে দামি। আমি এই লাশ না নিয়ে যামু না। কিছুতেই যামু না।”

মুকিদ আলী কোদাল হাতে নিয়ে আবার কোপাতে থাকে। শীতের রাতে তার শরীর ঘেমে যায়। চাদরটা খুলে সে কবরে নেমে মাটিগুলো ওপরে তুলতে থাকে। দেখতে দেখতে গর্ত গম্ভীর হয়ে যায় এবং শেষ পর্যন্ত সে কবরের ওপরে ছাউনির মতো করে দেয়া বাঁশগুলোর সন্ধান পায়।

ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, একটু আলো থাকলে খুব সুবিধে হতো। তার খুটের ভেতর ম্যাচ আছে সে একবার জ্বালাবে কী না বুঝতে পারছিল না। বাঁশগুলো সরালেই সে কাফন দিয়ে মোড়ানো লাশটা পেয়ে যাবে। মুকিদ আলী উবু হয়ে বসে বাঁশগুলো তুলতে শুরু করে।

হঠাৎ হুমমম করে একটা বিকট শব্দ হলো-সাথে সাথে কবরের বাঁশ ভেঙে সাদা কী একটা যেন ছিটকে বের হয়ে আসে। মুকিদ আলী আর্তচিৎকার করে পিছিয়ে আসে, আবছা অন্ধকারে বিস্ফারিত চোখে সে তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারে স্পষ্ট দেখা যায় না সাদা মতোন কিছু একটা দুলছে, দুলতে দুলতে সেটা হুমমম করে একটা শব্দ করছে। শব্দের সাথে সাথে মাংস পোড়া একটা দুর্গন্ধে পুরো জায়গাটা যেন ভরে গেল।

মুকিদ আলী কঁপা হাতে তার কোমরে গোজা ম্যাচটা বের করে ফস করে একটা কাঠি জ্বালাল। কাফনে মোড়া মোসলেম মিয়ার শরীর, কাফন থেকে মাথাটা বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ম্যাচের কাঠির আলো থেকে আড়াল করার জন্যে মোসলেম মিয়া দুই হাত সামনে তুলে ধরল, পোড়া মাংসের আড়াল থেকে হাড় বের হয়ে আছে।

“মুকিদ আলী কোদালটা হাতে নিয়ে পিছিয়ে আসে! প্রচণ্ড আতঙ্কে সে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, সে শুধু জানে তাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক পালাতে হবে।

ঠিক তখন কুয়াশা কেটে চাঁদের আলোতে হঠাৎ করে পুরো এলাকাটা আলোকিত হয়ে উঠল। মুকিদ আলী দেখল গোরস্তানের দেওয়ালে পা ঝুলিয়ে ছায়ামূর্তির মতো কারা যেন বসে আছে। দীর্ঘ দেহ ক্রুদ্ধ চোখের দৃষ্টি।

কোদালটা ফেলে দিয়ে সে উল্টোদিকে দৌড় দেবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল, তাকিয়ে দেখে সেদিকেও কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা একটা ছায়ামূর্তি, মনে হয় মাথাটা বুঝি গাছের ডগা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চেখের দৃষ্টিতে ক্রোধ এবং ঘৃণা।

গোঙানোর মতো একটা শব্দ করে মুকিদ আলী মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, আর উঠল না।

জীবনের শেষ চুরিটি সে আর সমাপ্ত করতে পারল না।

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *