ছায়ালীন : আংটি
কফিল উদ্দিন পকেট থেকে চিরুনিটা বের করে তার চুলের ওপর দিয়ে আলতোভাবে একবার বুলিয়ে নিল, এই চেহারাটা তার একটা বড় সম্পদ তাই সে এটার যত্নআত্তি করে। সে রীতিমতো জেলখাটা ঘাগু অপরাধী কিন্তু তার চেহারার মাঝে মফস্বল কলেজের বাংলা শিক্ষকের নির্দোষ একটা সারল্য আছে। মানুষ তার চেহারা দেখে তাকে বিশ্বাস করে এবং কফিল উদ্দিন সেই সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগায়। এখন পর্যন্ত তার হাতে কেউ খুন হয়ে যায়নি কিন্তু মানুষের বিশ্বাস অর্জন করে সে তার জীবনে অনেককে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দিয়েছে।
এ মুহূর্তে কফিল উদ্দিন কমলাপুর রেলস্টেশনে টিকিট কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় সে একটু বিব্রত এবং হতচকিত ভাব ফুটিয়ে রেখেছে যদিও সে ভেতরে ভেতরে একেবারে একশ’ ভাগ সজাগ। সে একটি শিকার খুঁজছে যাকে আজ রাতে সে সর্বস্বান্ত করে ছেড়ে দেবে। ট্রেনের টিকিট খুঁজতে এসেছে এরকম মানুষকে সে ভেতরে ভেতরে যাচাই করে দেখছে। প্রথম ষণ্ডা গোছের মানুষটাকে সে বাতিল করে দিল, দ্বিতীয় মানুষটিকে শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দিল কারণ মনে হলো তার কাছে টাকা-পয়সা বেশি থাকবে না। তৃতীয় মানুষটিকে তার বেশ পছন্দ হলো এবং সে মাকড়সার সতর্ক পদক্ষেপে তার দিকে এগিয়ে যায়। মানুষটা টিকিট কাউন্টারে যাবার আগেই তাকে ধরতে হবে। কাছাকাছি গিয়ে কফিল উদ্দিন বলল, “শুনছেন?”
“জি। আমাকে বলছেন?”
“হ্যাঁ। ইয়ে-আমি একটা ছোট ঝামেলার মাঝে পড়েছি।” কফিল উদ্দিন মুখে চমৎকার একটা বিব্রতভাব ফুটিয়ে তুলল।
“কী ঝামেলা?”
“আমার আর এক বন্ধুর আজ রাতে সিলেট যাবার কথা। ফার্স্ট ক্লাস বার্থে দুটা টিকিট ছিল। একটু আগে ফোন করে বলল সে আসতে পারছে না–”
মানুষটির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, “আপনার কাছে স্লিপিং বার্থের একটা টিকিট আছে?”
কফিল উদ্দিন বিব্রতভাবে বলল, “হ্যাঁ। আপনি যদি ইন্টারেস্টেড হন-”
“হা হা-অবশ্যই।”
কফিল উদ্দিন পকেট থেকে টিকিটটা বের করে মানুষটির হাতে দিল, সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মুখে সন্তুষ্টির ভান করে তার মানিব্যাগে হাত দেয়। কফিল উদ্দিন বলল, “আপনাকে এখনই দিতে হবে না। আমিও তো যাচ্ছি। ট্রেনে সারা রাত একসাথে থাকব পরে দিয়ে দেবেন।”
মানুষটি বলল, “না, না। এখনই দিয়ে দিই।” সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে, কফিল উদ্দিন নিস্পৃহ ভঙ্গি করে কিন্তু উত্তেজিত হয়ে লক্ষ করল মানিব্যাগটা মোটা, সেখানে থরে থরে নোট সাজানো। মানুষটার সাথে একটা হ্যান্ড ব্যাগ, ভারী হ্যান্ড ব্যাগ-ভেতরে নিশ্চয়ই ভালো জিনিসপত্র আছে। হাতে আংটি আর ঘড়ি, পকেটে মোবাইল ফোন, কফিল উদ্দিন দ্রুত হিসেব করে দেখল আজ রাতের দাওটি খারাপ হবার কথা না। এখন সব ভালোয় ভালোয় শেষ করতে পারলে হয়।
দুজনের কেবিন, নিচের বার্থ কফিল উদ্দিনের ওপরের বার্থটা মানুষটির। দুজনে যখন আরাম করে বসেছে তখন লম্বা হুইসিল দিয়ে ট্রেনটা মোটামুটি সময়মতো ছেড়ে দিল, এটেনডেন্ট এসে মাথা ঢুকিয়ে বলল, “স্যার আপনারা কিন্তু রাত্রে জানালা বন্ধ রাখবেন।”
কফিল উদ্দিন বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমরা বন্ধ করে
দেব।”
“চোর-ছ্যাঁচড়ে দেশ ভরে গেছে স্যার।”
এটেনডেন্ট চলে যাবার পর কফিল উদ্দিন একটা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, “দেশের অবস্থাটা দেখেছেন? একজন মানুষ ট্রেনের জানালা খোলা রেখে ট্রাভেল করতে পারে না।”
সঙ্গী মানুষটি বলল, “কোন জায়গায় জানালা খোলা রাখতে পারে?”
কফিল উদ্দিন মাথা নাড়ল, বলল, “তা ঠিক।” তারপর সে ঢাকা শহরে আসার পর একজন মানুষ কীভাবে অপরাধীর পাল্লায় সর্বস্বান্ত হয়েছে তার একটা নিখুঁত বর্ণনা দিল। বানানো গল্প কিন্তু এ মানুষটার সেটা বোঝা সম্ভব না। সবকিছু পরিকল্পনামতো চলতে থাকলে এখন এ মানুষটারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে একটা গল্প বলার কথা, কিন্তু মানুষটি তার চেষ্টা করল না। সম্ভবত নিজের গাড়িতে চলাচল করে, হাইজ্যাক-ছিনতাই দেখেনি।
কফিল উদ্দিন তার ব্যাগ খুলে একটা ইংরেজি বই বের করল-তার পড়াশোনা নেই। বানান করেও ইংরেজি পড়তে পারে না কিন্তু এ মানুষটার বিশ্বাস অর্জন করার জন্যে এগুলো দরকার। বইটা সিটের ওপরে উপুর করে রেখে সে পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে তার কাল্পনিক স্ত্রীর সাথে কথা বলার অভিনয় শুরু করে, “রুমানা?” প্রথমে কিছু একটা শোনার অভিনয় করল, বলল, “না, না কিছু দরকার নেই-এত সকালে বেচারা ড্রাইভারের স্টেশনে আসার কোনো দরকার নেই। আমি একটা স্কুটার নিয়ে নেব।” আবার কিছুক্ষণের বিরতি দিয়ে এবং হুঁ হাঁ করে জিজ্ঞেস করল, “তিন্নি কী করে? দাও দেখি তার সাথে একটু কথা বলি।” কফিল উদ্দিন তারপর একটা ছোট মেয়ের সাথে খানিকক্ষণ কাল্পনিক কথাবার্তা বলল। সঙ্গী মানুষটি পুরো কতাবার্তা মনোযোগ দিয়ে না শুনলেও যেটুকু শুনেছে তাতেই তাকে একজন সচ্ছল ভালোমানুষ বিবাহিত সুখী পারিবারিক মানুষ হিসেবে ধরে নেবে।
মোবাইল টেলিফোনটা রেখে কফিল উদ্দিন সঙ্গী মানুষটার সাথে আবার একটু-আধটু কথাবার্তা বলে, মানুষটি একটু কম কথার মানুষ কিন্তু শেষ পর্যন্ত আলাপে আলাপে টেনে আনা গেল। প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে, নিঃসন্তান এবং বিপত্নীক। স্ত্রীকে নিশ্চয়ই খুব ভালোবাসে, কারণ, তার কথা বলার সময় আঙুলের আংটিটাতে বারবার হাত বুলিয়ে দেখল। নিশ্চয়ই বিয়ের আংটি, কফিল উদ্দিনও আড়চোখে আংটিটা দেখে, খাঁটি সোনার মোটা একটা আংটি, দামি পাথরও আছে! শুধু এই আংটির জন্যেই এ মানুষের ওপর একটা দাও মারা যায়।
ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই কফিল উদ্দিন মানুষটার সাথে আন্তরিকতার একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায়। দুজন দুজনের সাথে ছোটখাটো ব্যক্তিগত কথা বলল হালকা দু-একটা রসিকতাও করা হলো এবং যখন মনে হলো পরিবেশটা পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে তখন কফিল উদ্দিন তার আসল কাজ শুরু করে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “খিদে লেগে গিয়েছে। খেয়ে আসতে পারিনি। আপনি খেয়েছেন?”
“হ্যাঁ খেয়েছি।”
“আমি আসার সময় ফাস্টফুডের দোকান থেকে কয়টা স্যান্ডউইচ তুলে এনেছি। একটু খেয়ে নিই যদি কিছু মনে না করেন?”
“না, না-আমি কী মনে করব? আপনি খান।”
কফিল তার ব্যাগ থেকে একটা খাবারের প্যাকেট বের করল, কয়েকটা স্যান্ডউইচ পাশাপাশি সাজানো-প্রথমটাতে ধুতুরার বিষ মেশানো। অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছে বাজারের অন্য বিষের তুলনায় এখনো ধুতুরার বিষটাই ভালো, কোনো গন্ধ নেই, তিতকুটে স্বাদ নেই, মানুষকে সহজে খাইয়ে নেয়া যায়।
কফিল স্যান্ডউইচের প্যাকেটটা একনজর দেখে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল–‘অনেক দিয়েছি দেখি। খাবেন একটা?”
মানুষ যদি একটা তুলে নেয় প্রথমটাই নেবে, সেটাই ধুতুরার বিষ দেয়া। কিন্তু মানুষটা নিল না। বলল, “না, না, আমি খেয়ে এসেছি। থ্যাংক ইউ।”
কফিল আর জোর করল না, বলল, “খেয়ে এসে থাকলে খামোখা স্যান্ডউইচ খেয়ে মুখ নষ্ট করবেন না। সে প্যাকেট থেকে দ্বিতীয় স্যান্ডউইচটা তুলে খেতে শুরু করে। খেতে খেতে সে বাঙালির খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে একটু রসিকতা করল, “বুঝলেন? ভেতো বাঙালি তো স্যান্ডউইচ খেলে পেট ভরে না! এই খাবারটা যে কারা আবিষ্কার করেছে।”
মানুষটি হাসল, বলল, “বিপদে পড়ে খেতে হয়। শখ করে কে আর কোনো দিন স্যান্ডউইচ খেয়েছে?”
“তা ঠিক।” কফিল উদ্দিন প্যাকেট থেকে দুটি কোল্ড ড্রিংকসের এলুমিনিয়ামের ক্যান বের করল, একটার মাঝে ধুতুরার বিষ মেশানো। দ্বিতীয়টা ভালো। সে মানুষটার দিকে এগিয়ে দিলে বলল, “নেন, একটা ড্রিংকস খান।”
শতকরা নব্বই ভাগ চান্স যে মানুষটা কোল্ড ড্রিংকস নেবে। সত্যি সত্যি নিল এবং ধুতুরার বিষ মেশানোটাই। ক্যানটা খুব ভাল করে পরীক্ষা করলেও মানুষটা বুঝতে পারবে না যে একটা সূক্ষ্ম ফুটো করে এখানে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ দিয়ে ধুতুরার বিষ ঢোকানো হয়েছে। ফুটোটা নিখুঁতভাবে ইপক্সি দিয়ে বুজে দেয়া আছে। মানুষটা ক্যান হাতে নিয়ে সেটা খুলে ঢকঢক করে খানিকটা ড্রিংকস খেয়ে নেয় এবং সাথে সাথে কফিল তার বুকের ভেতর থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে দেয়। কাজ হয়ে গেছে এখন শুধু সময়ের ব্যাপার, মানুষটা যখন ঘুম থেকে উঠবে-সম্ভবত কোনো একটা হাসপাতালে তখন অবাক হয়ে বোঝার চেষ্টা করবে কেমন করে সে এখানে এসেছে।
কফিল আড়চোখে মানুষটাকে লক্ষ করে, ক্যান থেকে ঢকঢক করে আরো খানিকটা ড্রিংকস খেয়ে হঠাৎ কেমন যেন একটু অবাক হয়ে কফিল উদ্দিনের দিকে তাকাল। কফিল উদ্দিন তার দৃষ্টি এড়িয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। মানুষটা জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে কেমন যেন বিচিত্রভাবে চোখ পিট পিট। করতে থাকে। কফিল একটু সরে গিয়ে বলল, “ঘুম পাচ্ছে? শুয়ে পড়ুন তাহলে। অনেক রাত হয়েছে?”
মানুষটি কেমন যেন অস্বস্তির ভাব করে মাথা নাড়ে, এদিক-সেদিক তাকায়, তারপর বিড়বিড় করে বলে, “শরীরটা ভালো লাগছে না।”
“তাই নাকি?” কফিল উদ্দিন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “শুয়ে থাকেন-কিছুক্ষণ শুয়ে থাকেন তাহলে।”
মানুষটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কেমন যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কফিল মানুষটাকে বার্থে তুলে দেয়, মাথার নিচে একটা বালিশ গুঁজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “নিশ্চিন্ত মনে ঘুমাও সোনার চাঁদ।”
কফিল কেবিনের লাইটটি নিভিয়ে দিতেই জানালা দিয়ে ভেতরে জ্যোৎস্নার একটা নরম আলো এসে ঢুকল, কফিল উদ্দিন খানিকক্ষণ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল জ্যোৎস্নার আলোতে বাইরে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। এটা কি সুন্দর নাকি অসুন্দর সে বুঝতে পারে না।
কফিল কোনো তাড়াহুড়ো করল না। ঘণ্টাখানেক পর সে কেবিনে, লাইট জ্বালিয়ে মানুষটাকে পরীক্ষা করার জন্যে গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠল, মানুষের শরীরটা আশ্চর্য রকম শীতল। সে ভয়ে ভয়ে মানুষটার দিকে তাকাল, মানুষটা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। ভয়ে ভয়ে আবার সে মানুষটার বুকে হাত দিল, হৃদস্পন্দনের কোনো চিহ্ন নেই। হঠাৎ করে ভয়াবহ আতঙ্কে কফিল লাফিয়ে পেছনে সরে আসে। সর্বনাশ! এই মানুষটা মরে গেছে।
কফিল উদ্দিনের ইচ্ছে হলো ভয়ংকর একটা চিৎকার করে কেবিনের দরজা খুলে বের হয়ে যায়, কিন্তু সে জানে এটা সে করতে পারবে না। তাকে এখন এই মৃত মানুষের দেহটি নিয়ে এই কেবিনে বসে থাকতে হবে। কফিল উদ্দিন হঠাৎ কুল কুল করে ঘামতে থাকে।
অনেক কষ্ট করে কফিল উদ্দিন নিজেকে শান্ত করল। এখন যদি সে নিজের মাথা ঠাণ্ডা না রাখে তাহলে ভয়ানক বিপদে পড়ে যেতে হবে। যেভাবেই হোক তাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে, ঠাণ্ডা মাথায় খুব সাবধানে পরের স্টেশনে নেমে যেতে হবে। যতক্ষণ পরের স্টেশন না আসে ততক্ষণ তাকে চুপচাপ বসে থাকতে হবে।
ঠিক তখন ট্রেনটা আস্তে আস্তে থেমে যায়, এখানে সে নেমে যেতে পারে, কিন্তু মানুষটার মানিব্যাগ ঘড়ি-আংটি কিছুই এখনো নেয়া হয়নি। এত কষ্ট করে শেষে সে তো শুধু খালি হাতে নেমে যেতে পারে না। কফিল উদ্দিন মানুষটার পকেটে হাত দিয়ে তার মানিব্যাগটা খুঁজতে থাকে ঠিক তখন জানালায় একজন মানুষের মুখ দেখা গেল, মানুষটি অবাক হয়ে ভেতরে তাকিয়ে আছে। কফিল উদ্দিন লাফিয়ে সরে এলো, জানালার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? কী চাও?”
“মিনারেল ওয়াটার লাগবে? ঠাণ্ডা মিনারেল ওয়াটার?”
“না না লাগবে না।”
মানুষটা সরে যাবার পরও সে জানালা থেকে সরল না। কেউ যেন দেখতে না পারে ভেতরে কী হচ্ছে।
একটু পরে ট্রেনটা আবার ছেড়ে দিলে কফিল উদ্দিন এসে মানুষটার পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে। ভেতরে নোটগুলোর বেশির ভাগ পাঁচ শ টাকার নোট, এখন গোনার সময় নেই কিন্তু চোখ বন্ধ করে আট-দশ হাজার টাকা হয়ে যাবে। কফিল হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নেয়, বুক পকেট থেকে মোবাইল টেলিফোনটা নেয়। বাম হাতের মাঝখানের আঙুলে তার বিয়ের আংটিটা খুলতে অনেক সময় নিল। আংটিটা শক্ত হয়ে আটকে গেছে, টেনে খোলা যাচ্ছিল না, কফিল উদ্দিন একবার প্রায় হাল ছেড়েই দিচ্ছিল কিন্তু খাঁটি সোনার মোটাসোটা পাথর বসানো আংটিটার লোভ ছেড়ে দেয়া এত সোজা নয়। টানাটানি করে শেষ পর্যন্ত আংটিটা ছুটিয়ে নিয়ে আসে। নিজের আঙুলে পরে দেখল বেশ ফিট করে গেছে। কফিল উদ্দিন আংটিটা আর খুলল না, আঙুলে লাগিয়ে রেখে দিল।
কফিল উদ্দিন তারপর মানুষটার ব্যাগ খুলল। ভেতরে কাপড়, জামা, তোয়ালে এবং তার তলায় একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার। কফিলের মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে ল্যাপটপটা বের করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। এখন সে মোটামুটি ট্রেন থেকে নেমে যাবার জন্যে প্রস্তুত। মানুষটাকে মেরে ফেলার তার এতটুকু ইচ্ছে ছিল না। মানুষটার সম্ভবত হার্টের সমস্যা ছিল। হয়তো এমনিতেই মারা যেত-আজ ধুতুরার বিষ খেয়ে একটু আগে মারা পড়েছে।
কফিল উদ্দিন মানুষটার দিকে তাকাল, আধখোলা চোখ-মুখটা অল্প একটু খোলা। গায়ের রংটা এর মাঝে কেমন জানি অসুস্থ নীলাভ হয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে চোখ-মুখ একটু ফুলেও এসেছে। কফিল উদ্দিনের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে-একটু আগেই মানুষটা বেঁচে ছিল তখন তাকে এতটুকু ভয় লাগেনি, কিন্তু এখন তার দিকে তাকাতেই তার শরীরটা কাটা দিয়ে উঠতে থাকে।
কফিল উদ্দিন কোথায় বসবে বুঝতে পারে না, মৃতদেহটির পাশে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, ওপরের বার্থে ওঠার সাহস করছে না। শেষ পর্যন্ত সে চাদরটা বিছিয়ে মেঝেতেই বসে পড়ল। এখন ট্রেনটা থামতেই সে নেমে পড়বে।
মেঝেতে বসে যাবার পর কফিল উদ্দিনের চোখ একটু পর পর মৃতদেহটার দিকে যেতে লাগল এবং প্রতিবারই সে চমকে উঠতে লাগল। একটি মৃতদেহ দেখে এত ভয় লাগে কেন কে জানে? একবার ইচ্ছে হলো বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু মৃতদেহটা রেখে দরজা খোলা রাখাও বিপজ্জনক। কেউ যদি ঢুকে গিয়ে দেখে ফেলে তখন কী হবে?
কফিল উদ্দিন কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত কেবিনের লাইট নিভিয়ে দিল, সাথে সাথে ভেতরে জ্যোৎস্নার একটা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ে। আবছা অন্ধকারে হঠাৎ করে মৃতদেহের বিভীষিকাটা আড়াল হয়ে যায়। মানুষটাকে এখন আর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। জ্যোৎস্নায় আবছা আলোতে শুধু তার অবয়বটুক অস্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। কফিল উদ্দিন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল-এখন ট্রেনটা কোনো একটা স্টেশনে থামতেই সে নেমে পড়বে।
ট্রেনটা থামার কোনো লক্ষণ দেখাল না। গভীর রাতে জ্যোৎস্নার আলোতে গ্রাম ক্ষেত নদী গাছপালা ভেঙে ট্রেনটা ছুটে যেতে থাকে। কফিল উদ্দিন অপেক্ষা করতে থাকে, ঠিক কী কারণ জানা নেই তার ভেতরে হঠাৎ অন্য একধরনের আতঙ্ক এসে ভয় করে। অশরীরী আতঙ্ক।
কফিল উদ্দিন চোখ বুজে বসে থাকে, সে ভুলে যাবার চেষ্টা করে এই কেবিনের বার্থে একটা মৃতদেহ শুয়ে আছে এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করে ছোঁয়া যায় এরকম দূরত্বে সে মেঝেতে বসে অপেক্ষা করছে ট্রেনটি থামার জন্যে।
হঠাৎ তার মনে হলো কেউ তার ঘাড়ে স্পর্শ করেছে। কফিল উদ্দিন আতঙ্কে চমকে উঠে চোখ খুলে তাকায় এবং একটা আর্তচিৎকার করে ওঠে। জ্যোৎস্নায় আলোতে সে স্পষ্ট দেখতে পেল সামনের বার্থে মৃতদেহটি উঠে বসেছে। চলন্ত ট্রেনটা দুলছে। কিন্তু তার ভেতরে বসে থাকা মৃতদেহটি আশ্চর্য রকম স্থির। কফিল উদ্দিন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল এবং তার মাঝে দেখতে পেল মৃতদেহটি আবার হাত বাড়িয়ে তার ঘাড়টি স্পর্শ করেছে। ভয়ংকর আতঙ্কে তার ছুটে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা তার মাঝে জেগে উঠল কিন্তু সে কোথায় ছুটে যাবে? কোনদিকে ছুটে যাবে।
মৃতদেহটি কিছু একটা বলছে, কথাটা সে শুনতে পেল না, কিন্তু অসুস্থ একধরনের দুর্গন্ধ তার নাকে এসে ধাক্কা দেয়। মৃতদেহটি আবার কথা বলল, “খসখসে একধরনের কণ্ঠস্বর, চাপা গলায় বলছে, “আংটি।”
কফিল উদ্দিন কী করবে বুঝতে পারল না, মৃতদেহটি তার আংটিটি ফেরত চাইছে। সে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না, বিকারগ্রস্ত মানুষের মতো সে তার আংটি খোলার চেষ্টা করে কিন্তু সেটা আঙুলে আটকে গেছে, টেনে খুলতে পারছে না।
মৃতদেহটি খপ করে তার কাধ ধরে নিজের দিকে টেনে এনে জড়িত গলায় বলল, “আংটি। আমার আংটি।”
ভয়ংকর আতঙ্কে কফিল উদ্দিন চিৎকার করে ওঠে কিন্তু মৃতদেহটির কোনো ভাবান্তর হলো না, লোহার মতো শক্ত শীতল হাতে তার বাম হাতটা ধরে মাঝের আঙুলটি নিজের দিকে নিতে থাকে। কিছু বোঝার আগে মৃতদেহটি তার আঙুলটি কামড়ে ধরে।
কফিল উদ্দিন প্রাণপণে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে, নিজের ভেতরে শুধু একটা চিন্তা কাজ করছে, তার নিজেকে মুক্ত করতে হবে, যেভাবে হোক তাকে পালিয়ে যেতে হবে। প্রাণপণে সে নিজের হাতকে মুক্ত করে জানালা দিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে-বাতাসে তখনো তার আর্তনাদ শোনা যেতে থাকে।
কেবিনের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে ট্রেনের কর্মকর্তারা একটা মৃতদেহকে আবিষ্কার করলেন। সেটি মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সোজা করার পর দেখা গেল তার মুখে রক্ত।
কাছেই একটি আঙুল পড়ে আছে। দেখে মনে হয় কেউ আঙুলটি ছিঁড়ে শরীর থেকে আলাদা করেছে।
মৃতদেহটির পকেটে মানিব্যাগ, মোবাইল টেলিফোন বাঁ হাতে ঘড়ি ছিল না।-শুধু বাম হাতের মধ্যমাতে একটা আংটি ছিল। পাথর বসানো সোনার সুদর্শন একটি আংটি।