Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছায়ালীন || Muhammad Zafar Iqbal

ছায়ালীন || Muhammad Zafar Iqbal

মাঝরাতে হঠাৎ কী খেয়াল হলো, নীতু বলল, “আয় চক্রে বসি।”

সাথে সাথে সবাই হই হই করে বলল, “চল, চল বসি৷”

গরমের ছুটির শেষে মাত্র সবাই হোস্টেলে ফিরে এসেছে, ক্লাসের চাপ এখনো পুরোপুরি চেপে বসেনি। প্রতি রাতেই সবাই বসে গল্পগুজব করতে করতে রাত গভীর করে ফেলে, ছুটিতে কী হয়েছে সেটা নিয়ে সবারই কিছু না কিছু বলার আছে। অতি সাধারণ ঘটনা সেটা শুনেই সবাই হেসে কুটি কুটি হয়। গরমের ছুটিতে মৌসুমী নামের মেয়েটিরই শুধু সত্যিকার অর্থে বলার মতো একটি ঘটনা রয়েছে। তার দূরসম্পর্কের এক চাচা বেড়াতে এসে সবাইকে নিয়ে চক্রে বসে মৃত আত্মাদের ডেকে এনেছিলেন। চক্রে বসা মানুষদের ওপর আশ্রয় নিয়ে মৃত আত্মারা কথাবার্তা বলেছে, মৌসুমীর নিজের চোখে দেখা ঘটনা অবিশ্বাস করার উপায় নেই।

ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের আড্ডায় গল্পটি এর মাঝে অনেকবার শোনা হয়ে গেছে এবং আজ রাতে ঠিক যখন আড্ডা ভাঙার সময় এসেছে তখন নীতু এই চক্রে বসার প্রস্তাবটি করেছে। শাহানা দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করল, বলল, “কিন্তু কীভাবে চক্রে বসতে হয় আমরা তো জানি না।”

নীতু বলল, “কে বলেছে জানি না? মৌসুমী আমাদের বলল না?”

কথাটি সত্যি, কীভাবে চক্রে বসতে হয় বিষয়টা মৌসুমী এর মাঝে বেশ কয়েকবার সবার কাছে বর্ণনা করে ফেলেছে। ভীতু প্রকৃতির কয়েকজন মেয়ে তারপরেও দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করল কিন্তু অন্যদের প্রবল উৎসাহে সেই আপত্তি জায়গা করতে পারল না।

তাই কিছুক্ষণের মাঝে নওরীনের রুমের খাটগুলো পেছনে ঠেলে জায়গা করা হলো, টেবিল ধাক্কা দিয়ে কোনায় সরিয়ে নেয়া হলো, চেয়ারগুলো ঘর থেকে বের করা হলো এবং ঘরের মেঝেতে একটা বড় চাদর বিছিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে গেল। ঘরের আলো নিভিয়ে ছোট একটা পিরিচে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নেয়া হয়েছে। মোমবাতির আলোর কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক বেশ সহজেই ঘরের ভেতরে কেমন যেন একটা ছমছমে আবহাওয়া তৈরি হয়ে গেল।

নীতু বলল, “‘সবাই সামনে হাত রাখ, একজনের বাম হাতের ওপর আরেকজনের ডান হাত। তাই না রে মৌসুমী?”

মৌসুমী মাথা নাড়ল।

শাহানা জিজ্ঞেস করল, “এখন কী করব?”

মৌসুমী বলল, “চোখ বন্ধ করে মৃত মানুষের কথা ভাবতে থাক।”

“কোন মৃত মানুষের কথা ভাবব?”

নীতু ধমক দিয়ে বলল, “তোর যাকে ইচ্ছা।”

শাহানা বলল, “আমি মরা মানুষের কথা ভাবতে পারব না। আমার ভয় করে।”

“ভয় করলে চুপ করে বসে থাক। অন্যদের ডিস্টার্ব করবি না।”

মোমবাতিটা নিভিয়ে দিতেই ঘরের ভেতরে একটা আবছা অন্ধকার নেমে আসে। সাথে সাথে শাহানা হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, “না না ভাই। আমি বসব না। আমার ভয় করে।”

নীতু ধমক দিয়ে বলল, “এতগুলো মানুষ বসে আছে, তার মাঝে তোর ভয়টা কিসের?”

শাহানা যুক্তিতর্কের মাঝে গেল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি বসব না বাবা আমি যাই। আমার এসব ভালো লাগে না।”

সত্যি সত্যি শাহানা দরজা খুলে বের হয়ে যায়। নীতু পেছন থেকে বলল, “দাঁড়া। আগে প্রেতাত্মারা আসুক। আমরা যদি তাদের তোর ঘরে না পাঠাই।”

শাহানা চলে যাবার পর অন্যেরা খানিকক্ষণ শাহানাকে নিয়ে গজগজ করে আবার চক্রে বসে পড়ে। একজনের হাতের ওপর অন্যজনের হাত রেখে তারা মৃত মানুষের কথা ভাবতে থাকে। ঘর অন্ধকার, সবার চোখ বন্ধ এবং মাথা নিচু, দেখতে দেখতে ঘরের ভেতর একধরনের আধিভৌতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে যায়।

মৌসুমীর গল্পে চক্রে বসার বিষয়টি যে রকম ভাবগম্ভীর এবং চমকপ্রদ ছিল এখানে অবিশ্যি মোটেও সেটা এরকম হলো না। যারা বসেছে তাদের মাঝে মিতুলের একটু হাসির রোগ আছে এবং দেখা গেল কিছুক্ষণের মাঝেই সে হাসতে শুরু করে দেয়। হাসিটা গোপন রাখার জন্যে সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কিন্তু তার শরীর কাঁপতে থাকে এবং মাঝে মাঝে মুখ থেকে বিদঘুঁটে একটা-দুইটা শব্দ বের হয়ে আসে। মধ্যরাত্রিতে চক্রে বসে মেয়েরা দ্বিতীয় একটা জিনিস আবিষ্কার করল, সেটা হচ্ছে হাসি অত্যন্ত সংক্রামক একটি রোগ এবং মিতুলের দেখাদেখি নাজু, নওরীন আর সাথী দিয়ে শুরু করে একটু পরে নীতি আর মৌসুমীর মতো এক-দুজন সিরিয়াস মেয়ে ছাড়া অন্য সবাই গা দুলিয়ে হাসতে শুরু করে দেয়।

মৃত আত্মারা নিশ্চয়ই কৌতুকপ্রিয় মেয়েদের মাঝে আসতে পছন্দ করে না, তাই ঘণ্টাখানেক পরে সবাই আবিষ্কার করল রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে কিন্তু তাদের কেউ মিডিয়াম হয়ে কোনো আত্মাকে আনতে পারেনি।

মৌসুমী বিরক্ত হয়ে বলল, “অনেক হয়েছে। এখন শেষ কর।”

নীতু বলল, “তোদের দিয়ে কোনো কাজ হবে না। চক্রে বসেও শুধু ফাঁচ ফাঁচ করে হাসিস।”

মৌসুমী বলল, “এটা মোটেও হাসির ব্যাপার না। এটা খুব সিরিয়াস ব্যাপার।” মিতুল হাসি চেপে বলল, “হাসি উঠে গেলে আমি কী করব?” নীতু রেগে বলল, “হাসি উঠে গেলে এরকম জায়গায় আসবি না।” মৌসুমী বলল, “অমার চাচা বলেছেন চক্রে মৃতআত্মা আনার পর ঠাট্টা-তামাশা করলে আত্মার কষ্ট হয়।” মিতুল বলল, “তাহলে মৃত আত্মা না এনে জীবন্ত আত্মা আনলেই হয়।”

নীতু বলল, “জীবন্ত আত্মাটা কী জিনিস।”

“যে মানুষ মারা যায় নাই তার আত্মা।” জীবন্ত মানুষের আত্মা আনার পুরো ব্যাপারটি মিতুলের কাছে খুব কৌতুকের মনে হলো এবং সেটা কল্পনা করে সে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

নওরীন বলল, “আচ্ছা! মিতুল তো ঠিকই বলেছে। চক্রে বসে যদি জীবন্ত মানুষের আত্মা আনার চেষ্টা করি তাহলে কী হবে?”

মৌসুমী বিরক্ত হয়ে বলল, “‘ফাজলেমি করবি না। চক্রে বসে ডাকা হয় মৃত আত্মাদের–”

“আমরা ডাকব জীবন্ত মানুষের আত্মাদের।”

মিতুল হঠাৎ হাসি থামিয়ে বলল, “আয় আমরা এক্সপেরিমেন্টটা করে ফেলি। চক্রে বসে আমরা শাহানাকে ডাকি! দেখি এই ভীতুর ডিমটার ঘুম ভেঙে যায় কী না!”

মৌসুমী বলল, “দেখ। চক্র ব্যাপারটা হাসি-তামাশার না। এটা সিরিয়াস ব্যাপার। এটা নিয়ে ফাজলেমি করবি না।”

“আমরা ফাজলেমি করছি কে বলল?” মিতুল বলল, “আমরা একটা এক্সপেরিমেন্ট করছি। মৃত মানুষের আত্মাকে না ডেকে জীবন্ত মানুষের আত্মাকে ডাকছি। জীবন্ত মানুষকে পরে জিজ্ঞেস করব সে কিছু টের পেয়েছে কী না!”

খানিকক্ষণ এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক হলো এবং শেষ পর্যন্ত সবাই আবার চক্রে বসতে রাজি হলো, তবে এবারে মৃত মানুষকে ডেকে জীবন্ত মানুষকে ডাকা হবে। কোনো জীবন্ত মানুষকে ডাকা হবে সেটা নিয়ে অবিশ্যি কোনো তর্কবিতর্ক হলো না! শাহানাই হবে সেই মানুষ।

ঘরের বাতি নিভিয়ে আবার তারা গোল হয়ে বসে। একজনের হাতের ওপর আরেকজন হাত রেখে চোখ বন্ধ করে তারা শাহানার কথা ভাবতে থাকে। মিতুল পর্যন্ত হাসি বন্ধ করে রইল, মৌসুমী ফিসফিস করে বলল, “শাহানা! আমরা তোমাকে চক্রে আহ্বান। করছি। তুমি আসো! তুমি আসো আমাদের মাঝে।”

মিনিট দশেক এভাবে কেটে যাবার পর হঠাৎ একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটে। তাদের মাঝে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট মেয়ে নাজু হঠাৎ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে, মনে হতে থাকে তার বুঝি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শুধু তাই নয় তার শরীরটা থরথরকরে কাঁপতে শুরু করে, পাশে বসে থাকা নওরীন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই নাজু! কী হয়েছে তোর?”

নাজু কোনো কথা বলল না, শুধু তার নিঃশ্বাস দ্রুততর হয়ে ওঠে, শরীরটা আরো জোরে কাঁপতে থাকে। মুখ দিয়ে হঠাৎ গোঙানোর মতো একধরনের শব্দ হতে থাকে।

নীতু জিজ্ঞেস করল, “নাজু৷ কী হয়েছে তোর?”

নাজু কোনো উত্তর করল না।

নীতু আবার ডাকল, “নাজু। এই নাজু৷”

নাজু এবারে উত্তর দেয়, চাপা গলায় ফিসফিস করে বলে, “ আমি নাজু না।”

“তাহলে তুই কে?”

“আমি শাহানা।”

সবাই কেমন জানি চমকে উঠল। মৌসুমী বলল, “তুই এখানে কী করছিস?”

“তোরা আমাকে ডেকেছিস, তাই আমি এসেছি। তোরা বল কেন আমাকে ডেকেছিস কেন?

তারা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না, শুধু যে কণ্ঠস্বর হুবহু শাহানার মতো তা নয়, কথা বলার ভঙ্গি এমন কী কথায় রাজশাহী অঞ্চলের টানটুকু পর্যন্ত আছে। মৌসুমী বলল, “ তুই আসলেই শাহানা?”

“হ্যাঁ।”

“তোর কেমন লাগছে?”

“ভালো লাগছে না।”

“কেন ভালো লাগছে না?”

শাহানার গলার স্বরটা হঠাৎ কেমন জানি হাহাকারের মতো শোনায়। ভাঙা গলায় বলল, “তোরা কেন আমাকে ডাকলি? কেন?”

শাহানার গলার স্বরে নাজু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করে। মৌসুমী ভয় পাওয়া গলায় বলল, “চক্র ভেঙে দাও সবাই। হাত ছেড়ে দাও।”

সবাই তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিল, প্রায় সাথে সাথেই নাজু কান্না বন্ধ করে মাথা তুলে তাকাল। নীতু গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে দেয়, হঠাৎ করে আলো জ্বালানোয় সবারই চোখ সয়ে যেতে একটু সময় লাগে। সবাই নাজুর মুখের দিকে তাকাল। নীতু জিজ্ঞেস করল, “নাজু তোর কী হয়েছিল?”

নাজুকে কেমন যেন বিচলিত দেখায়, শুকনো মুখে বলল, “আমি জানি না। আমার স্পষ্ট মনে হলো—”

“কী মনে হলো?”

নাজু প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “আয় আগে দেখি শাহানা কী করছে।”

“ঠিকই বলেছিস,” বলে নীতু দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে। করিডরের শেষ মাথায় শাহানার সিঙ্গেল সিটেড রুম। তারা দ্রুত পায়ে শাহানার রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নীতু দরজায় শব্দ করে ডাকল, “শাহানা।”

ভেতর থেকে কোনো শব্দ হলো না। তখন নীতু আরো জোরে দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “এই শাহানা। শাহানা-”

শাহানা তবুও জেগে উঠল না। তখন অন্যেরাও দরজা ধাক্কা দিতে শুরু করে, ভয় পাওয়া গলায় ডাকতে থাকে, “শাহানা! দরজা খোল শাহানা!”

তাদের হইচই শুনে আশেপাশের রুম থেকে অন্যেরা জেগে উঠে ভিড় করে তবু শাহানা ঘুম থেকে জাগে না। ভয় পেয়ে এবারে একসাথে কয়েকজন মিলে দরজায় ধাক্কা দেয়। কয়েকবার সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতেই দরজার ছিটকানি ভেঙে হঠাৎ করে দরজাটা খুলে যায়।

মেয়েরা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকল। একজন লাইট সুইচটা টিপে আলো জ্বালিয়ে দিল। মশারির ভেতর একধরনের অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে শাহানা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নীতু ছুটে গিয়ে শাহানাকে ঘুরিয়ে নেয়-তার চোখ দুটো আধখোলা সেখানে শূন্য দৃষ্টি। মুখটা অল্প একটু ফাঁক হয়ে জিব খানিকটা বের হয়ে আছে।

নীতু একটা আর্তচিৎকার করে পেছনে সরে আসে, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সে থরথর করে কাঁপতে থাকে।

বিছানায় শুয়ে শাহানার মৃতদেহ শূন্যদৃষ্টিতে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। চক্রে বসে সত্যি সত্যি তারা শাহানার আত্মাটিকে বের করে এনেছে।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 1 of 6 ): 1 23 ... 6পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *