Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ছাইয়ের আড়ালে || Anish Deb

ছাইয়ের আড়ালে || Anish Deb

খুন-জখমের পক্ষে দিনটা মোটেই আদর্শ ছিল না।

শীতের সবে শুরু।

আকাশ মেঘলা, থমথমে, আর নির্জন। সেখানে একটিও পাখি উড়ছে না। প্রতিটি গাছের পাতা স্থির, চুপচাপ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির সর্বাঙ্গে যেন অবসাদ আর ক্লান্তির ছাপ।

দোতলার ফ্যাটের জানলার কাছে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আনমনাভাবে কীসব ভাবছিলেন অধ্যাপক অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি।

মেয়ে ঊর্মিলাকে অনেকদিন পর তিনি লম্বা চিঠি লিখতে বসেছেন। চিঠিতে ‘লালমহল’-এর স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামীর প্রসঙ্গও এসে পড়েছে। এসিজি লিখেছেন : ‘…এই বিচিত্র কবি ভদ্রলোক কীভাবে আমার প্রশংসা করেন তার কয়েকটি নমুনা তোকে শোনাই। তুই তো আমাকে গোয়েন্দা বলে মনেই করিস না! অথচ এই ভদ্রলোক আমার সম্পর্কে কী-কী বলেছেন শোন, ”প্রাচীন গ্রিসে জ্ঞানী ছিলেন অ্যারিস্টটল/আপনি আরও জ্ঞানী দুঁদে ব্যারিস্টটল।” ‘ কিংবা ‘ ”আমি আপনার গুণমুগ্ধ/ আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ!”’ আবার ‘ ”গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/ অমর, আকবর, এবং অ্যান্টনি।”’ আর সবশেষে ‘ ”দেখে আপনার তীক্ষ্নবুদ্ধি/ হলেম আমি নিহতবুদ্ধি।” ‘

‘আমি তোর বাবা বলেই তুই আমাকে গোয়েন্দা হিসেবে পাত্তা দিস না। নইলে…’

উইলস ফিলটারে চোস্ত টান দিয়ে আপনমনেই হাসলেন অশোকচন্দ্র। ছোটবেলা থেকেই বরাবর ঊর্মিলাকে প্রশংসায় অবিচল থাকার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। অথচ আজ স্বভাবকবি রঙ্গলালের কথা বলতে গিয়ে, মেয়ের সঙ্গে চিঠিতে মজা করতে গিয়ে, সেইসব উদ্ভট ধরনের প্রশংসায় তিনি নিজেই অল্পসল্প তৃপ্তির আমেজ টের পাচ্ছেন।

এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল।

চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে টেলিফোন ধরলেন এসিজি।

যা ভেবেছেন তাই। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।

‘গুড মর্নিং, স্যার, রঘুপতি বলছি।’

‘বলো।’

‘মুড খারাপ করার জন্যে মাফ চাইছি। তবে ব্যাপারটা ক্লোজড রুম প্রবলেম। ইসি লিয়ে আপকো ডিসটার্ব কর রহা হুঁ।’

‘কেউ মারা গেছেন নাকি?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।

‘হ্যাঁ। ওল্ড ম্যান পরমেশ্বর সরকার।’

‘মার্ডার?’ মাথার সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দা।

‘সেটাই তো পারফেক্টলি ক্লিয়ার নয়। দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক।’

এসিজি একপলক আকাশের দিকে তাকালেন। তারপর ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তুমি চলে এসো। আর রওনা হওয়ার আগে রঙ্গলালবাবুকে একটা ফোন করে দিয়ো। ওর ফোন নাম্বারটা লিখে নাও…।’

ফোন নম্বরটা বলার পর এসিজি যেন আপনমনেই মন্তব্য করলেন, ‘লালমহলের রঙ্গলাল/দেখা হয়নি বহুকাল।’

তারপর ফোন রেখে দিয়ে ঊর্মিলার চিঠিটা শেষ করতে বসলেন।

হাতের সিগারেট শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই নতুন আর-একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।

কলিংবেলের শব্দটার মধ্যে রঘুপতির বাজানো চেনা সুর ছিল না। সুতরাং দরজা খুলতেই যে রঙ্গলাল গোস্বামীর মুখোমুখি হবেন সেটা এসিজি ভেবেই রেখেছিলেন।

পরনে হাফহাতা পাঞ্জাবি, ধুতি, আর হালকা বাদামি শাল। তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুলের মাঝবরাবর সিঁথি। ছোট-ছোট চোখ, কপালের বাঁদিকে একটা ছোট আঁচিল। সামান্য ঘামে ভেজা মুখে প্রসাধনের ছাপ।

আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘বহুদিন পরে এলাম/ গোয়েন্দাকে কবির সেলাম।’

রঙ্গলালের ঠিক পিছনেই ছিল রঘুপতি যাদব। প্রথম-প্রথম রঙ্গলালের আচরণে কিছুটা বিরক্ত হলেও এখন রঘুপতি ব্যাপারটা মানিয়ে নিয়েছে। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় এখন ও স্যারের মতো মজাই পায়।

ড্রইংরুমে তিনজনে গুছিয়ে বসামাত্রই রঘুপতি ওর কাজের কথা শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু প্রাক্তন ছাত্রকে বাধা দিলেন অশোকচন্দ্র। বললেন, ‘রঘুপতি, আগে একটু আরাম করে কফি খাও, তারপর শুরু করো তোমার রাজধানী এক্সপ্রেস—।’

জানলার বাইরে শীতের সন্ধে নেমেছে। এসিজির ঠিকে কাজের লোক ‘ললিতের মা’ আসতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। তবে বছর তেরো বয়েসের ‘কম্বাইন্ড হ্যান্ড’ বিশু রয়েছে। একটু আগেই এসিজির জন্য দু-প্যাকেট সিগারেট এনে দিয়েছে ও। নিজের কাজের ঝক্কি কমাতে এসিজি ওকে কফি তৈরি করা শিখিয়ে দিয়েছেন। এখন ওকে ডেকেই তিনকাপ কফির ফরমাশ করেছেন।

কফি খেতে-খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল। তারই মধ্যে রঙ্গলাল গোস্বামী হঠাৎ জানালেন, ‘আমার একটা কবিতার বই বের করছি।’

অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘এ তো খুবই ভালো খবর। তা কবে বেরোচ্ছে বইটা?’

‘সামনের মাসের অমাবস্যায়। বইয়ের নাম দিয়েছি ”স্বভাবকবিতাসমগ্র”।’

রঘুপতি যাদব জিজ্ঞাসা করল, ‘হঠাৎ অমাবস্যায় রিলিজ করছেন কেন?’

রঙ্গলাল লাজুক হেসে বললেন, ‘আমি মা-কালীর একটু ইয়ে কিনা…। আমার স্বভাবকবিতার প্রথম বই…তাই ঈশ্বরের একটু-আধটু ইয়ে দরকার…।’

রঘুপতি মুচকি হেসে তাকাল এসিজির দিকে। এসিজি তখন কফি শেষ করে একটা সিগারেট ধরাচ্ছেন। সেই অবস্থাতেই তিনি বললেন, ‘ঈশ্বর এখন থাক। বরং পরমেশ্বরের কথা শুনি—পরমেশ্বর সরকার। বলো, রঘুপতি, শোনাও তোমার ”বন্ধ ঘরের রহস্য”।’

রঘুপতি যাদব গলাখাঁকারি দিয়ে শুরু করল তার কাহিনি।

পরমেশ্বর সরকারের বাড়ি কেশব সেন স্ট্রিটে—আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা এলাকায়। ওঁরা কয়েক পুরুষের বনেদি বড়লোক—রইস আদমি বলতে যা বোঝায় তাই। কলকাতা আর তার আশেপাশে ওঁদের প্রায় গোটা আটেক সিনেমা হল আছে। এ ছাড়া জমিজমা আর বাড়ির কোনও হিসেব নেই।

পরমেশ্বর সরকারের বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। ভদ্রলোক বিপত্নীক। তাঁর এক ছেলে, দুই মেয়ে। বড় ছেলে অর্কদেবের বয়েস পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে, বউয়ের নাম সুভদ্রা। ওঁদের বছর আট-দশের পিঠোপিঠি দুই ছেলে—তুতুন আর মিমো।

অর্কদেবের পরের বোনের নাম ঈশানী। বছর পনেরো আগে বিয়ে হয়ে গেছে। ঈশানী দিনসাতেক হল বাপের বাড়িতে এসে রয়েছেন।

পরমেশ্বরবাবুর ছোট মেয়ে হিমানীর বয়েস প্রায় চল্লিশ হবে। বিয়ে করেননি। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিজিক্সে এম. এসসি. করার পর সেখানেই ফেলোশিপ নিয়ে গবেষণা করছেন।

ঘটনা ঘটেছে আজ সকালে।

দোতলায় পুবদিক ঘেঁষে পরমেশ্বরবাবুর পড়াশোনার ঘর। ঘরের লাগোয়া বড় বারান্দা। সেখানে আরামকেদারা আর টেবিল পাতা থাকে। পরমেশ্বরবাবু সেখানে বসে দিনের অনেকটা সময় কাটাতেন। কখনও চায়ের কাপ হাতে আয়েস করতেন, কখনও বা বইপত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন।

আজ সকালে ন’টা নাগাদ অর্কদেব হঠাৎ দেখেন পরমেশ্বরবাবু তাঁর ঘরে একটা চেয়ারে কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিমায় বসে আছেন। তাঁর সামনে টেবিলে আধ কাপ চা, অ্যাশট্রেতে জ্বলন্ত সিগারেট, আর তার পাশেই খানিকটা পোড়া ছাই।

বারান্দার দিকের কাচের জানলা দিয়ে অর্কদেব তাঁর বাবাকে ওই অবস্থায় দেখতে পান। কেমন যেন সন্দেহ হওয়ায় তিনি দরজার কাছে গিয়ে বাবাকে ডাকতে থাকেন। তারপর কোনও সাড়া না পেয়ে দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করেন। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল।

সুতরাং শেষ পর্যন্ত লোকজন জড়ো করে অর্কদেব দরজা ভাঙতে বাধ্য হন। সে সময় দু-বোন তাঁর কাছেই ছিলেন।

ঘরের সব ক’টা জানলাও ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। সুতরাং ব্যাপারটা সহজ-সরল আত্মহত্যা বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। ডাক্তারি পরীক্ষায় চায়ের কাপে পোকামাকড় মারার বিষও পাওয়া গেছে। আর পোস্ট মর্টেমের প্রাথমিক খবর অনুযায়ী সরকারসাহেবের পাকস্থলীতে ওই একই বিষের হদিস মিলেছে।

কিন্তু সবকিছু মিলে যাওয়া সত্ত্বেও একটা গোলমাল দেখা দিয়েছে।

পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট বলছে, পরমেশ্বরবাবু সকাল ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে মারা গেছেন। অথচ দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে অর্কদেববাবুরা চায়ের কাপে সামান্য গরম চা পেয়েছেন। এ ছাড়া জ্বলন্ত সিগারেটের ব্যাপারটাও সমস্যা বাঁধিয়েছে।

এমনিতে পরমেশ্বরবাবু প্রায় দশ বছর হল ডাক্তারের পরামর্শে নিয়মিত সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কখনও-সখনও কাজের লোকদের দিয়ে এক-আধটা আনিয়ে খেতেন। অথচ সমস্যা হল, তাঁর ঘরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও দেশলাই বা সিগারেট লাইটার পাওয়া যায়নি। আর শেষ সমস্যা ওই ছাই।

ধারাবিবরণী শেষ করে একটা জোরালো দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাঁটুতে চাপড় মারল রঘুপতি, বলল, ‘এইজন্যেই স্যার আপনাকে ফোনে বলেছি, মার্ডার না সুইসাইড ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক।’

এসিজি রোগা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে হাতের ছোট-হয়ে-আসা সিগারেটের টুকরোটাকে টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। সামান্য হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘সুইসাইড বা মাডার যা-ই হোক, কেসটা তোমার কাছে গেল কেমন করে?’

তেতো হাসল রঘুপতি। তারপর বৃদ্ধ হুনুরের চোখে তাকিয়ে বলল, ‘সিরফ আপকে লিয়ে, স্যার।’

এসিজি অবাক হয়ে প্রাক্তন ছাত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আমার জন্যে! তার মানে? ঠাট্টা করছ?’

হাসল রঘুপতি যাদব, বলল, ‘আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মা আমার খুব বন্ধু। আমার কাছে ও আপনার কথা অনেক শুনেছে। আপনার পিকিউলিয়ার ইন্টারেস্টের কথা ও জানে। তাই পি. এম. রিপোর্টের খবর পাওয়ামাত্রই আমাকে ফোন করে সব জানিয়েছে। আপনি চাইলে কাল আমরা পরমেশ্বর সরকারের বাড়ি ভিজিট করতে পারি। অব আপকি মরজি—।’

রঙ্গলালবাবু, এতক্ষণ চুপটি করে বসে রঘুপতির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। এখন হঠাৎই সক্রিয় হয়ে এসিজিকে অনুরোধের সুরে বললেন, ‘অবশ্যই যেতে হবে গোয়েন্দাপ্রবর/সুইসাইড না মার্ডার—রহস্য জবর।’

দু-হাতের দশ আঙুল মাথায়-মাথায় ঠেকালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক সেকেন্ড আপনমনে কী যেন ভাবলেন। তারপর মুখ তুলে রঘুপতির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাব তো নিশ্চয়ই, তবে তার আগে কয়েকটা প্রশ্ন আছে।’

রঘুপতি ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘মাফ করনা, গুপ্তাসাব। আপনার যা কিছু কোয়েশ্চেন আছে সব কাল শর্মাকে করবেন। ও অনেক বেটার উত্তর দিতে পারবে। আমি বরং ওকে ফোন করে বলে দিচ্ছি। যদি বলেন, কাল আমি আর ও আপনার এখানে চলে আসব। তারপর একসঙ্গে স্টার্ট দেব—।’

অশোকচন্দ্র একটু ভেবে বললেন, ‘তুমি শর্মাকে নিয়ে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে এখানে চলে এসো। কারণ, আমি আটটা থেকে ন’টার মধ্যে পরমেশ্বরবাবুর ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখতে চাই।’

এসিজির কথায় রঘুপতি তেমন একটা ভরসা পেল না। অস্পষ্ট স্বরে ও বলল, ‘শর্মা তো সব ছানবিন করে দেখেছে। আপনি কি আর নতুন কিছু পাবেন?’

রঘুপতির কথায় অশোকচন্দ্র হাসলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় বারকয়েক টান মেরে বললেন, ‘তুমি আমার কাছে কেন এসেছ, রঘুপতি? তুমি জানো, তোমার ওই শর্মাকে দিয়ে যা হবে না তা এই শর্মাকে দিয়ে হতেও পারে—তাই না? ঠিক আছে, তুমি যাতে হতাশ না হও সে-চেষ্টা আমি করব। নাউ চিয়ার আপ। এসো, একটু জমিয়ে গল্প করা যাক।’

রঙ্গলাল গোস্বামী হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘এসিজি স্যার, একটা কথা বলব?’

‘নিশ্চয়ই বলুন।’

চোখ নামিয়ে সঙ্কুচিতভাবে রঙ্গলাল বললেন, ‘যাতে কথাটা মোলায়েম শোনায় তাই স্বভাবকবিতায় বলছি। ”অকুস্থলে তিনজন মহা অনাচার/রঙ্গলাল সঙ্গী হলে সংখ্যা হবে চার।” এর ইনার মিনিংটা বুঝতে পারলেন, স্যার?’

অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। কাল সকালে তিনজন নয়, চারজন একসঙ্গে রওনা হব। তা না হলে আপনি আমার তদন্তরসে বঞ্চিত হবেন, আর আমরা বঞ্চিত হব আপনার কাব্যরস থেকে। এবার আপনার কয়েকটা কবিতা শোনান দেখি।’

‘কবিতা নয়, স্বভাবকবিতা।’ এসিজিকে শুধরে দিলেন রঙ্গলাল।

বাড়িটার নাম ‘সরকারভিলা’ শুধু নামে নয়, কাজেও।

প্রায় আট কাঠা জায়গা জুড়ে তিনতলা বাড়ি, আর লাগোয়া ছোট বাগান। বাড়িটার রং হালকা সবুজ। তবে বারান্দা আর জানলায় গাঢ় সবুজের বর্ডার দেওয়া।

সদরের বিশাল লোহার গেট খুলে দিল উর্দি পরা দারোয়ান। এসিজি, বিজন শর্মা, রঘুপতি যাদব আর রঙ্গলাল গোস্বামী ভেতরে ঢুকলেন।

সামনেই শান বাঁধানো বিশাল চাতাল। সেখানে দুটো নাদুস-নুদুস বাচ্চা ছেলে লাল রঙের একটা বল নিয়ে ছুটোছুটি করে খেলছে। ওদের বয়েস আট-দশ বছর হবে। পরনে টি-শার্ট, সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট।

দারোয়ানের প্রশ্নের উত্তরে বিজন শর্মা বলেছেন যে, ওঁরা অর্কদেববাবুর সঙ্গে দেখা করতে চান। দারোয়ান তখন ইশারা করে বাঁদিকের একটা ঘর দেখিয়ে দিয়েছে।

বাড়িটা সদর দরজার বাঁদিক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। বাড়ি আর উঠোন পেরোলেই শুরু হয়ে গেছে বাগানের এলাকা। সদরের কাছ থেকেই বাগানের বেশ কয়েকটা গাছের মাথা নজরে পড়ছিল।

বাঁদিকের দরজা লক্ষ করে এগোতেই ডানপাশে গ্যারেজ চোখে পড়ল। সেখানে একটা মারুতি জেন, আর একটা অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে।

মার্বেল পাথর বাঁধানো দুটো সিঁড়ির ধাপ উঠলেই বড় মাপের ভারী কাঠের দরজা। যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই অর্কদেব সরকার বলে মনে হল এসিজির।

টকটকে ফরসা গায়ের রং। পরনে সামান্য লাট হয়ে যাওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি। তার ওপরে একটা সাদা শাল জড়ানো। চোখে চশমা। মুখের চামড়ায় বয়েসের ভাঁজ পড়েছে। কাঁচা-পাকা চওড়া গোঁফ, জোড়া ভুরু, চোখের তারায় কটা ভাব, মাথার এলোমেলো চুল বেশ পাতলা হয়ে এসেছে।

বিজন শর্মা সৌজন্যের হাসি হেসে বললেন, ‘নমস্কার, অর্কদেববাবু। কাল রাতে আপনাকে তো ফোন করে বলে রেখেছিলাম। ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আপনার বাবার…মানে…ইয়ের ব্যাপারে আমাদের একটু হেলপ করতে এসেছেন।’

চঞ্চল চোখ ঘুরিয়ে অর্কদেব এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন : ‘আপনি ডাক্তার?’

মাথার চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে এসিজি বললেন, ‘হ্যাঁ, লেখাপড়ার ডাক্তার। আরও ভালো করে বলতে গেলে ফিজিক্সের ডাক্তার।’

অর্কদেব অপ্রস্তুতভাবে হাসলেন, বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। আসুন, ভেতরে আসুন বসুন।’

ওঁরা চারজন বসবার ঘরে ঢুকলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে ঘড়ির কাঁটা যেন পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে গেল।

ঘরের মেঝেতে চকচকে ইটালিয়ান মার্বেল পাথর বসানো। ডানদিকে পুরোনো ধাঁচের কারুকাজ করা ডিভান—বোধহয় মেহগনি কাঠের তৈরি। সোফা-সেটি যেন কারুকাজ করা ছোটখাটো সিংহাসন। ডিভানের পাশে দাঁড় করানো প্রায় আলমারির মাপের এক বিচিত্র পিতামহ-পেন্ডুলাম-ঘড়ি। তার নকশা কাটা পেন্ডুলামের সামনে ঝুলছে তিনটে পিতলের চোঙ। ঘণ্টি বাজানোর কাজটা বোধহয় ওরাই করে।

বাঁদিকে জানলার কাছে একটা সুদৃশ্য টেবিলে রাখা আছে দুটো টেলিফোন—একটা পুরোনো ধাঁচের, আর-একটা আধুনিক। সিলিং থেকে ঝোলানো রয়েছে সিলিং পাখা। তবে নজর করে দেখলে সেখানে ব্রিটিশ আমলের হাতে টানা পাখার আংটাও চোখে পড়ে।

সোফায় বসে অশোকচন্দ্র ঘরটাকে জরিপ করে দেখছিলেন।

এখানে আসার পথে ও. সি. বিজন শর্মা আর রঘুপতি যাদবের কাছে যা-যা শুনেছেন তাতে সরকাররা লাখপতি নয়, কোটিপতি। ওঁরা প্রায় চার পুরুষের ধনী।

পোস্ট মর্টেমের পর পরমেশ্বরবাবুর মৃতদেহ এখনও অর্কদেবরা হাতে পাননি। বিজন শর্মা সামান্য অপরাধী-সুরে জানালেন, ‘ডেডবডি পেতে-পেতে হয়তো বিকেল হয়ে যাবে।’

অর্কদেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোণ মুছে নিলেন, বললেন, ‘আমাদের যা-কিছু দেখছেন সবই বাবার দান। বাবাকে আমরা সবাই খুব শ্রদ্ধা-সমীহ করতাম। হঠাৎ কেন যে উনি সুইসাইড করলেন…যদিও কিছুদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন।’

শর্মা একটু গলাখাঁকারি দিলেন। তারপর সকলের সঙ্গে অর্কদেবের পরিচয় করিয়ে দিয়ে সামান্য ইতস্তত করে বললেন, ‘ওই সুইসাইডের ব্যাপারটা নিয়েই খানিকটা গোলমাল থেকে গেছে। সেইজন্যেই ডক্টর গুপ্তকে রিকোয়েস্ট করে নিয়ে এসেছি।’

‘গোলমাল! কীসের গোলমাল?’ শোকের মধ্যেও খানিকটা উত্তেজিত হয়ে পড়লেন অর্কদেব।

রঘুপতি ভুরু কুঁচকে অর্কদেবকে দেখছিল। এসিজি বুঝতে পারলেন, ও যদি সরাসরি এই কেসের দায়িত্বে থাকত তা হলে এখনই হয়তো রুক্ষভাবে কিছু বলে বসত।

বিজন শর্মা শান্তভাবে নরম গলায় বললেন, ‘মিস্টার সরকার, আপনার বাবার ঘরের দরজা-জানলা ভেতর থেকে ছিটকিনি এঁটে বন্ধ ছিল। সেই অবস্থায় টেবিলে জ্বলন্ত সিগারেট আর কাগজপোড়া ছাই পাওয়া গেল—অথচ ঘরের কোথাও দেশলাই কিংবা লাইটারের চিহ্নমাত্র নেই। অবশ্য দেশলাই কি লাইটার পাওয়া গেলেও আমাদের সন্দেহ থেকে যেত ওই সিগারেট পরমেশ্বরবাবু আদৌ ধরিয়েছেন কিনা। কারণ, উনি মারা গেছেন সকাল ছ’টা থেকে আটটার মধ্যে, অথচ সিগারেটটা ন’টার সময়েও জ্বলছিল। সুতরাং অন্য কেউ নিশ্চয়ই ওই সিগারেট ধরিয়েছে, কাগজ পুড়িয়েছে। কিন্তু…।’

শর্মার কথার খেই ধরে রঘুপতি বলল, ‘লেকিন অওর কোই যদি সিগারেট জ্বালাবে তো সে দরওয়াজা-খিড়কি বন্ধ করে ঘর থেকে পালাবে কেমন করে?’

অশোকচন্দ্র গুপ্ত অর্কদেব সরকারের অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন। সেটায় গভীর টান দিয়ে আমেজে চোখ বুজে ধোঁয়া ছাড়লেন। তারপর বললেন, ‘সুইসাইড হোক বা হোমিসাইড হোক, তাতে আপনার তো কোনও প্রবলেম হওয়ার কথা নয়, অর্কদেববাবু!’

‘না, তা নয়…তবু…।’

রঙ্গলাল গোস্বামী এই প্রথম মুখ খুললেন, ‘আসলে এসিজি স্যার জানতে চান : ”সুইসাইড, না হোমিসাইড/খাঁটি গোল, না সেমসাইড।” ‘

অর্কদেব অবাক হয়ে রঙ্গলালের মুখের নিকে তাকিয়ে রইলেন।

বাইরের উঠোনে বাচ্চা দুটো ‘গোল! গোল!’ করে প্রবল চিৎকার করছিল। অর্কদেব বিরক্ত হয়ে সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন জানলার কাছে। চেঁচিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘তুতুন! মিমো! কী হচ্ছে! গোলমাল কোরো না—এখানে আমি গেস্টদের সঙ্গে কথা বলছি।’

সাময়িকভাবে বাচ্চাদুটোর চেঁচামেচি কমে গেল।

এসিজি অর্কদেবকে বললেন, ‘আমি আপনার বাবার ঘরটা একবার দেখব।’

পেন্ডুলাম-ঘড়িতে মিষ্টি সুরে সাড়ে আটটার ঘণ্টা বাজতে শুরু করল।

ওঁরা উঠে দাঁড়াতেই কোথা থেকে একটা বড়সড় মাপের কানঝোলা লোমওয়ালা কুকুর ঘরে এসে ঢুকল। কুকুরটার গায়ের রং উজ্জ্বল হলদে-বাদামি। সামান্য লেজ নেড়ে কুকুরটা অর্কদেব সরকারের পায়ের কাছে গা ঘষতে লাগল।

এসিজি কুকুরটার জাত চিনতে পারলেন : গোল্ডেন রিট্রিভার।

অর্কদেব কুকুরটাকে ‘টমি! টমি! গো।’ বলতেই ওটা গম্ভীর চালে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

এসিজিকে উদ্দেশ করে অর্কদেব বললেন, ‘চলুন, ওপরে চলুন। মিস্টার শর্মা তো ঘরটা সিল করে রেখে গেছেন—।’

বিজন শর্মা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ। চলুন, খুলে দিচ্ছি।’

দোতলায় ওঠার সিড়ির মুখে মার্বেল পাথরের খাটো স্তম্ভ। সেখান থেকে শুরু হয়ে গেছে পালিশ করা কাঠের মসৃণ রেলিং।

মার্বেল পাথরের ধাপে পা ফেলে ওঁরা ওপরে উঠতে যাবেন, ঠিক তখনই তুতুন আর মিমো ছুটে চলে এল ওঁদের কাছে।

বয়েসে সামান্য ছোট ছেলেটি বল আঁকড়ে ধরে লুকিয়ে পড়তে চাইল অর্কদেবের পিছনে। একইসঙ্গে অনুযোগের সুরে বলল, ‘দ্যাখো না বাপি, দাদা আমার থেকে বল কেড়ে নিচ্ছে।’

বড়জন প্রতিবাদে কী একটা বলতে যাচ্ছিল, অর্কদেব তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে বললেন : ‘তুতুন, কেন এরকম অসভ্যতা করছ! বলো তো, ওঁরা কী ভাববেন!’

তারপর এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার দুই ছেলে…ভীষণ দুরন্ত…।’

এসিজি সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বাচ্চা দুটোকে বললেন, ‘তোমাদের দুজনকে একটা ইন্টারেস্টিং ধাঁধা দিই, সলভ করতে পারলে প্রাইজ পাবে।’

এ-কথা শুনেই গোলগাল দু-ভাই ঝগড়া ভুলে এসিজির কাছে চলে এল।

এসিজি বললেন, ‘বলো তো, একটা মশা আর একটা মাছির লড়াই হলে কে জিতবে?’

সঙ্গে-সঙ্গে দুজনে হাঁ করে ভাবতে শুরু করল।

এসিজি হেসে ওদের বললেন, ‘উত্তরটা ভেবে পেলেই আমাকে বলে যাবে—আমি দোতলায় তোমাদের ঠাকুরদার ঘরে আছি।’

ওঁরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করলেন।

অশোকচন্দ্রের প্রশ্নটা শোনার পর থেকেই রঙ্গলাল গুম হয়ে কী যেন ভাবছিলেন। সেই ভাবুক ভাবটা বজায় রেখেই তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘প্রশ্নটা বড় কঠিন, বড় ইন্টারেস্টিং/মশা জেতে, নাকি মাছি, করিলে ফাইটিং।’

বিজন শর্মা আর অর্কদেব অবাক হয়ে রঙ্গলালকে দেখলেন। অর্কদেবের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসিও দেখা গেল।

প্রাচীন বিলাসবহুল বাড়িটার প্রতিটি অংশই এসিজিকে মুগ্ধ করছিল। দোতলায় উঠতে-উঠতে তিনি মনে-মনে ভাবছিলেন এইবার বোধহয় একটা বড়সড় পাখির খাঁচা দেখতে পাবেন, অথবা দাঁড়ে বসা অস্ট্রেলিয়ার অপূর্ব কাকাতুয়া।

কিন্তু এসিজিকে হতাশ হতে হল। তবে অর্কদেবকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলেন, তিনতলার ছাদে পাখির খাঁচা একটা ছিল—দেশি-বিদেশি বহু পাখিও ছিল সেখানে। কিন্তু কী এক মড়ক লেগে রাতারাতি সব পাখি মারা যায়। তারপর থেকে পরমেশ্বর আর পাখি পোষেননি।

দোতলায় উঠে পরমেশ্বর সরকারের ঘরের দিকে এগোতে-এগোতে মহিলা-কণ্ঠের কথা শোনা গেল। তার একটু পরেই চওড়া বারান্দার লাগোয়া একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন দুজন ভদ্রমহিলা।

একজনের সিঁথিতে সিঁদুর। ফরসা মোটাসোটা ভারী চেহারা। চোখে চশমা। পরনে গোলাপি তাঁতের শাড়ি। বয়েস পয়তাল্লিশের এদিক-ওদিক হবে।

রঘুপতি যাদব আর বিজন শর্মার কাছে বিশদ বিবরণ যা শুনেছেন তাতে এসিজি অনুমান করলেন ইনি পরমেশ্বরবাবুর বড় মেয়ে ঈশানী মজুমদার।

দ্বিতীয় মহিলার রোগা ছিপছিপে চেহারা। পরনে হালকা রঙের আধুনিক নকশা কাটা শাড়ি। চোখে মানানসই চশমা। এখন চল্লিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও বেশ সুন্দরী। তবে চোখে মুখে চোয়ালে কেমন একটা একরোখা উদ্ধত ভাব। মনে হয় ইনি নির্দেশ দিতে অভ্যস্ত, নিতে নয়।

পরমেশ্বর সরকারের ছোট মেয়ে হিমানী সরকার। মনে-মনেই যেন আওড়ালেন এসিজি।

পরমেশ্বরবাবু মারা যাওয়ার ফলে তিন ছেলেমেয়েই সরাসরি বিশাল বড়লোক হয়ে যাবেন। বৃদ্ধ যদি সত্যি-সত্যিই খুন হয়ে থাকেন তা হলে এই তিনজনের মধ্যেই খুনি লুকিয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে ওঠার জন্য খুনি ব্যস্ত হয়ে উঠল কেন?

পরমেশ্বর সরকার যথেষ্ট বৃদ্ধ হয়েছিলেন। আর বছরকয়েক অপেক্ষা করলে স্বাভাবিকভাবেই হয়তো তাঁর মত্যু হত। তা হলে…।

অর্কদেব, ঈশানী আর হিমানীকে দেখে ওঁদের কাউকে খুনি বলে ভাবতে বেশ কষ্ট পেলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তুতুন আর মিমোর কথা মনে পড়ল তাঁর। বাপি অথবা পিসিদের একজনকে ঠাকুরদার হত্যাকারী হিসেবে মেনে নিতে কী কষ্টই না হবে ওদের! নেহাত বয়েস কম বলে হয়তো পুরো ব্যাপারটা ততটা বুঝে উঠতে পারবে না।

নাঃ, খুন যেমন জঘন্য কাজ তেমনই খুনি খুঁজে বের করার কাজটাও জঘন্য।

পরমেশ্বর সরকারের ঘরের কাছে এসে বিজন শর্মা সিল ভেঙে ঘরের তালা খুলে দিলেন।

অর্কদেব, হিমানী ও ঈশানীকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলে ওঁরা চারজন ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

ঘরে ঢুকেই রঙ্গলালবাবু নাক কুঁচকে গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করলেন কয়েকবার।

অশোকচন্দ্র অবাক হয়ে স্বভাবকবির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল?’

চোখে সবজান্তার দৃষ্টি ফুটিয়ে তুলে রঙ্গলাল বললেন, ‘অন্তরীক্ষ, জল, স্থল/সবার ওপরে অকুস্থল।’

বিজন শর্মা আর রঘুপতি ঠোঁট টিপে হাসল। তারপর রঘুপতি আঙুল তুলে পুবদিকের কাচের জানলার কাছে রাখা একটা বড় মাপের টেবিল দেখিয়ে মন্তব্য করল, ‘পরমেশ্বরবাবু ওই টেবিলে বসেছিলেন…।’

বিজন শর্মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

শুধু টেবিল নয়, গোটা ঘরটাকেই জরিপ করে দেখছিলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত।

পুরোনো সময়ের ছাপ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। চেয়ার, টেবিল, ছোট মাপের পেন্ডুলাম দেওয়াল-ঘড়ি, আলমারি, আর বইয়ের র‍্যাক—সবকিছুর গায়েই সেই পরিচয়ের সিলমোহর। বইয়ের র‍্যাকের অসংখ্য বই জানিয়ে দেয় পরমেশ্বর পড়ুয়া লোক ছিলেন।

জানলার কাছে রাখা টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলেন এসিজি।

কাচের জানলাটা প্রায় চার ফুট বাই চার ফুট। জানলা বন্ধ ছিল।

জানলার বাইরেই চওড়া বারান্দা। সেখানে একটা টেবিল আর ইজিচেয়ার রয়েছে। ওই চেয়ারে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকার আর কখনও শরীর এলিয়ে বিশ্রাম নেবেন না সেটা ভাবতেই কেমন অস্বস্তি হল এসিজির। পুরোনো আসবাবগুলো রয়ে গেছে, শুধু পুরোনো মানুষটা চলে গেছে।

বারান্দায় সকালের রোদ এসে পড়েছিল। কাচের জানলা দিয়ে রোদ এসে পড়েছে পরমেশ্বরের ঘরের টেবিলেও। টেবিলের ঝকঝকে পালিশ করা কাঠ সেই রোদের প্রতিবিম্ব ছিটকে দিয়েছে ঘরের দেওয়ালে।

হাতঘড়ি দেখলেন এসিজি। প্রায় পৌনে ন’টা। সূর্য যত ওপরে উঠবে টেবিলের রোদ ততই সরে যাবে জানলার দিকে। এখন টেবিলের মাত্র সিকিভাগ রোদের আওতায় রয়েছে। আরও আধঘণ্টা আগে নিশ্চয়ই বেশি ছিল।

টেবিলে একটা পাথরের তৈরি অ্যাশট্রে পড়ে ছিল। হাতের ছোট হয়ে আসা সিগারেটটা কী করে যেন নিভে গিয়েছিল। সেটা অ্যাশট্রের মধ্যে গুঁজে দিয়ে অশোকচন্দ্র ছোট্ট করে প্রশ্ন করলেন, ‘এটা পরমেশ্বরবাবুর সেই অ্যাশট্রে?’

বিজন শর্মার কপালে বেশ কয়েকটা ভাঁজ দেখা যাচ্ছিল। হয়তো বুঝতে চাইছিলেন রঘুপতি যাদবের প্রাক্তন স্যার এই বৃদ্ধ হুনুর তদন্ত করে নতুন আর কোন তথ্য আবিষ্কার করেন। এসিজির প্রশ্নে তটস্থ হয়ে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, একই অ্যাশট্রে। অ্যাশট্রের খাঁজে রাখা জ্বলন্ত সিগারেটটা আমরা নিয়ে গিয়েছিলাম। ফরেনসিক রিপোর্ট বলছে, সিগারেটের ফিলটারের দিকে ঠোঁটের চাপের কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি। হয়তো খেয়ালবশে পরমেশ্বর সরকার সিগারেটটা ধরিয়েছিলেন, তবে খাননি। খোঁজ করে জেনেছি, উনি গত পরশু একজন কাজের লোককে দিয়ে একটা সিগারেট আনিয়েছিলেন। হয়তো কাল সকালে সেটাই ধরাবেন বলে ভাবছিলেন।’

এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। তারপর ছোট্ট করে বললেন, ‘হুঁ—কিন্তু ধরাননি।’

‘কাগজ-পোড়া ছাইটা ওই জায়গায় ছিল—’ অ্যাশট্রের কাছাকাছি চক দিয়ে দুটো ‘ক্রস’ চিহ্ন দেওয়া ছিল। তারই একটা দেখিয়ে বিজন শর্মা বললেন।

তখন রঘুপতি অন্য ‘ক্রস’ চিহ্নটা দেখিয়ে বিড়বিড় করে বলল, ‘ওইখানে তা হলে চায়ের কাপ ছিল…।’

এসিজি লক্ষ করলেন, অ্যাশট্রে এবং চকের মার্ক দেওয়া জায়গা দুটো রোদের বেশ কাছাকাছিই রয়েছে। একটু আগেই হয়তো ওখানে রোদ পড়েছিল।

রঘুপতি কী যেন ভেবে ইতস্তত করে বলল, ‘গুপ্তাসাব, রোদ পড়ে চা গরম হয়ে যায়নি তো!’

অশোকচন্দ্র তারিফের নজরে ফিরে তাকালেন রঘুপতির দিকে, বললেন, ‘ভালো বলেছ। গুড ডিডাকশন। কিন্তু সিগারেটে আগুন ধরল কী করে, আর কাগজ পুড়ে ছাই হল কী করে?’

‘সেটাই তো আমি কাল থেকে ভাবছি।’ ব্যাজার মুখে মন্তব্য করলেন শর্মা।

টেবিলটাকে ঘিরে বারকয়েক পাক খেলেন এসিজি। একইসঙ্গে তিনি কাচের জানলার দিকে দেখছিলেন। হঠাৎই তিনি বিজন শর্মাকে লক্ষ করে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘জানলার লকটা ভালো করে চেক করেছেন তো?’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিজন শর্মা। তারপর শ্রান্ত গলায় বললেন, ‘চেক করেছি মানে! কাল এক চাবিওয়ালাকে পর্যন্ত ধরে নিয়ে এসেছিলাম। সে জানলা-দরজা সব ভালো করে খুঁটিয়ে দেখেছে। তারপর স্পষ্ট বলেছে, কোনও অবস্থাতেই জানলা দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে খোলা সম্ভব নয়। তা ছাড়া কেউ যে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে কায়দা করে জানলা বা দরজা টেনে দিয়ে ভেতরের ছিটকিনি আটকে দেবে, তাও অসম্ভব। সুতরাং বুঝতেই পারছেন…।’

রঘুপতি হেসে বলল, ‘লকড রুম পাজল…আপনার ফেভারিট, স্যার।’

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন এসিজি, পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে নতুন আর-একটা সিগারেট ধরালেন। ধোঁয়া ছেড়ে আরও একবার ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

ঘরটার মাপ বড়জোর দশ বাই দশ। ঘরে দুটো একই মাপের জানলা, একটা পুবদিকের দেওয়ালে, আর-একটা দক্ষিণে—দোতলায় ওঠার সিঁড়ির দিকটায়। দুটোই কাচের জানলা, তার ওপরে পরদা টেনে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। জানলা দুটোর ছিটকিনি ভেতর থেকে আঁটা। ঘরের একটিমাত্র দরজা ভারী কাঠের তৈরি, তবে তার ছিটকিনিটা ভাঙা। গতকাল এই সময়ে অর্কদেবরা ধাক্কা দিয়ে ছিটকিনি ভেঙে ঘরে ঢুকেছেন। ঘরের আসবাবপত্র বলতে দুটো চেয়ার, একটা টেবিল, একটা টিভি, আর চারটে বইয়ের র‍্যাক।

বিজন শর্মার কাছেই অশোকচন্দ্র শুনেছেন ঘরটা পরমেশ্বরবাবুর পড়াশোনার আর বিশ্রামের ঘর ছিল। দোতলার কোণের দিকে তাঁর শোওয়ার ঘর। রোজ ঘুম থেকে উঠেই তিনি এ-ঘরে চলে আসতেন। সকালের রোদ টেবিলে রেখে চা খেতেন, বই পড়তেন, ছেলেমেয়েরা বা অন্য কেউ কথা বলতে এলে এ-ঘরে বসেই সেইসব কথাবার্তা সারতেন।

কিছুদিন ধরে পরমেশ্বরবাবু নাকি মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। তাঁর বিষয়-সম্পত্তির অনেকটা অংশ রামকৃষ্ণ মিশন বা ওইরকম কোনও প্রতিষ্ঠানে দান করে দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এমনকী ফোন করে উকিলের সঙ্গে এ-ব্যাপারে প্রাথমিক কথাবার্তাও নাকি বলেছিলেন। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, কিছু দিন ধরেই ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর কথা কাটাকাটি তর্ক-বিতর্ক চলছিল। তাঁর বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল, ছেলেমেয়েরা তাঁকে গুরুজন হিসেবে ছিটেফোঁটাও গুরুত্ব দেয় না। এ-কথা তিনি প্রায়ই চিৎকার করে বলতেন। দু-নাতির কাছেও এ-নিয়ে আক্ষেপ করতেন। কথনও-কখনও নাকি কান্নাকাটিও করতেন। বাড়ির কাজের লোকরা সব শুনেছে।

ঘরটা দেখতে-দেখতে বিজন শর্মার কথাগুলো মনে পড়ছিল এসিজির।

তা হলে ডিপ্রেশানের শিকার হয়ে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকার সত্যি-সত্যিই সুইসাইড করেছেন? নাকি ব্যাপারটা খুব…আর রঘুপতি যাদবের কথামতো ‘দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক’!

কিন্তু খুনই যদি হবে, তা হলে দরজা-জানলার ছিটকিনি ভেতর থেকে এঁটে দিয়ে খুনি ঘর থেকে পালাল কেমন করে?

এইসব ভাবতে-ভাবতে একটা চেয়ারে বসে পড়লেন এসিজি। কার্বন ফ্রেমের চশমাটাকে সামান্য নেড়েচেড়ে সিগারেটে টান দিতে লাগলেন।

রঙ্গলাল গোস্বামী বইয়ের র‍্যাকের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন। হঠাৎই একটা বই তাক থেকে টেনে নিয়ে তিনি চলে এলেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার কাছে। বইটা এসিজির মুখের কাছে ধরে বললেন, ‘এই পুস্তকটি লক্ষ্যণীয়, এসিজি স্যার।’

এসিজি বইটার দিকে তাকালেন। জেমস হিলটনের লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস ‘ওয়াজ ইট মার্ডার?’ ১৯৩১ সালে গ্লেন ট্রেভর ছদ্মনামে লেখা।

সামান্য হেসে রঙ্গলালের দিকে তাকালেন তিনি, বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন, স্বভাবকবিবর, আমি এখন এই প্রশ্নটা নিয়েই ভাবছি।’

রঙ্গলাল একটু ইতস্তত করে বইটা আবার জায়গামতো রেখে দিয়ে এলেন।

রঘুপতি স্যারকে লক্ষ করছিল। ও আলতো গলায় জিগ্যেস করল, ‘অন্ধকারে কোনও রোশনি চোখে পড়ল, স্যার?’

এসিজি প্রাক্তন ছাত্রের দিকে ফিরে অনেকটা যেন আপনমনেই বললেন, ‘সেটাই হাতড়ে বেড়াচ্ছি। আচ্ছা, এমন যদি হয়, ধরো, খুনি বিষ মেশানো চা-টা পরমেশ্বর সরকারকে দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেল। তারপর পরমেশ্বরবাবু দরজা-জানলা সব ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলেন, এবং বিষাক্ত চা খেয়ে মারা গেলেন। তখন—’

বিজন শর্মা এসিজিকে বাধা দিয়ে বললেন, ‘তাতে গণ্ডগোল বাঁধিয়েছে চারটে ব্যাপার : গরম চা, জ্বলন্ত সিগারেট, কাগজ পোড়া ছাই, আর—।’

‘ঘরের ভেতরে নো দেশলাই—’ শর্মাকে বাধা দিয়ে ছন্দে পাদপূরণ করলেন রঙ্গলাল।

‘ব্যাপারটা মার্ডার বলে ভাবতে চাইলে যে-সমস্যা, সুইসাইড বলে ভাবলেও সেই একই। মানে, প্রবলেমের সেকেন্ড পার্টটা থেকেই যাচ্ছে।’ আপনমনে বললেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত, ‘তা হলে সেকেন্ড পার্টটাই প্রথমে সলভ করার চেষ্টা করে দেখি।’

রঘুপতি তার স্যারের কথায় হেসে বলল, ‘আপনার যা মরজি।’

এসিজি আনমনাভাবে সিগারেটে টান দিয়ে চললেন, আর একইসঙ্গে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে বৃদ্ধ পরমেশ্বর সরকারকে অনুভব করার চেষ্টা করলেন। ছেলেমেয়েদের ওপরে তিতিবিরক্ত মানসিক অবসাদে ক্লান্ত বৃদ্ধ মানুষটি কি সত্যই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন? নাকি বৃদ্ধ পিতার ওপরে তিতিবিরক্ত তিন ছেলেমেয়ের কেউ রাগের মাথায় একটা জঘন্য কাজ করে ফেলেছে?

আচ্ছা, এমন কি হতে পারে যে, সিগারেট ধরিয়ে কাগজ পোড়ানোর পর সেই আগুনে পরমেশ্বরবাবু দেশলাইটাকেও পুড়িয়ে ফেলেছেন! অথবা, দেশলাই বা লাইটারটাকে কারও হাত দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন, কিংবা জানলা দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে জানলা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছেন!

তাই যদি হবে, তা হলে উনি মারা যাওয়ার কম করে একঘণ্টা পরেও চা কী করে গরম ছিল, আর সিগারেটই বা কেমন করে জ্বলছিল।

এত দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নিয়েও বিষয়গুলো রঘুপতি আর শর্মার সঙ্গে আলোচনা করলেন এসিজি। এবং যথারীতি চা আর সিগারেটের সমস্যায় এসে ধাক্কা খেলেন।

সুতরাং এই সিদ্ধান্তেই তা হলে পৌঁছতে হয় যে, ঘরের জানলা-দরজা বন্ধ হওয়ার পর বাইরে থেকে চা-সিগারেটের ব্যাপারটা করা হয়েছে। অথচ আপাতভাবে কাজটা অসম্ভব।

নিজের ওপরে যেন খানিকটা বিরক্ত হয়েই ঘরের বাইরে চলে এলেন বৃদ্ধ হুনুর।

অর্কদেব ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করছিলেন। আত্মীয়স্বজন কয়েকজন চলে এসেছেন বাড়িতে। পরমেশ্বরের মৃত্যুতে শোকের ছায়া বলতে একমাত্র নিস্তব্ধতা। সকলেই বেশ নিচু গলায় কথা বলছিলেন।

বিজন শর্মা এসিজির পিছন-পিছন বেরিয়ে এসেছিলেন। তিনি এসিজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি অর্কদেব, ঈশানী বা হিমানীর সঙ্গে কথা বলতে চান?’

এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘নতুন আর কী জিগ্যেস করব! যা জানার আপনার কাছেই তো জেনে গেছি। বন্ধ ঘরের রহস্য ভেদ করতে পারলেই বাকি সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে।’

রঘুপতি যাদবের কথা মনে পড়ল আবার ‘দেয়ার মাস্ট বি সাম ট্রিক—।’

কিন্তু কী সেই ট্রিক, কী সেই কৌশল?

এইসব ভাবতে-ভাবতে পুব দিকের বারান্দায় চলে এলেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। সকালের রোদ সরতে-সরতে এখন পরমেশ্বরের ঘরের বাইরে, বারান্দার মেঝেতে। মেঝেতে পড়ে থাকা রোদের দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে পড়লেন বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন।

বারান্দার নিচেই বাগান। বাগানে অনেক সবুজ। রোদ পড়ে মসৃণ পাতাগুলো চিকচিক করছে। ছোট হয়ে আসা সিগারেটের টুকরোটা বাগানের দিকে ছুড়ে দিলেন এসিজি।

বাগানে নিয়মিত পোকামাকড় মারার ওষুধ দেওয়া হয়। সেই ওষুধই কেউ মিশিয়ে দিয়েছে পরমেশ্বরের চায়ের সঙ্গে। সকালে একসঙ্গে সকলের চা তৈরি হয়েছে। কাজের লোকরাই চা ভাগ করে যার-যার ঘরে পৌঁছে দিয়েছে। চা খাওয়ার সময় অর্কদেব একবার বাবার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। তাতে বৃদ্ধ পরমেশ্বর বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন। গতিক সুবিধের নয় দেখে অর্কদেব চলে এসেছিলেন ঘর থেকে।

অর্কদেবকে এ-ব্যাপারে প্রশ্ন করেছিলেন বিজন শর্মা।

অর্কদেব ঘটনাটা অস্বীকার করেননি। তিনি যা বলেছেন তা সংক্ষেপে এই : ব্যারাকপুরে ওঁদের তিনটে সেকেলে ধাঁচের সিনেমা হল আছে। অর্কদেবের ইচ্ছে, দুটো হল বিক্রি করে সেই টাকায় অন্য সিনেমা হলটাকে ভোল পালটে একেবার আধুনিক করে তোলেন। এ-ব্যাপারে তিনি লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তাও এগিয়ে রেখেছেন। কিন্তু পরমেশ্বর সরকার বেঁকে বসেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, সেকেলে হলেই কি যে-কোনও জিনিস বিক্রি করে দিতে হবে। তারপর সিগারেট খাওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে অর্কদেবের একটু কথাকাটাকাটি হয়।

সম্পত্তি থাকলে ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকে। কিন্তু তার জন্য এতবড় দুঃসাহসী কাজ কি অর্কদেব বা অন্য কেউ করতে পারেন! যদিও বা করে থাকেন তা হলে কীভাবে? তার ওপর গরম চা আর জ্বলন্ত সিগারেটের জট তো আছেই!

চুলের গোছায় টান মেরে চোখ থেকে কার্বন ফ্রেমের চশমাটা খুলে নিলেন এসিজি। সঙ্গে-সঙ্গে বাগানের গাছপালা তাঁর চোখে কিছুটা ঝাপসা হয়ে গেল। যে চোখ থাকতেও ভালো করে দেখতে পায় না তার ঝাপসা দেখাই ভালো—নিজের ওপরে বিরক্ত হয়ে ভাবলেন এসিজি। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে বারান্দার রেলিঙে হেলান দিয়ে তাকালেন পরমেশ্বরবাবুর ঘরের জানলার দিকে। কাচের ভেতর দিয়ে আবছাভাবে রঘুপতি, বিজন শর্মা ও রঙ্গলাল গোস্বামীকে দেখা যাচ্ছে। ওঁরা ঘরের ভেতরে ঘোরাঘুরি করছেন।

হঠাৎই অশোকচন্দ্রের চোখ পড়ল বারান্দার মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গেই তাঁর রোগা শরীরে পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল।

বারান্দার মার্বেল পাথরের মেঝেতে অনেকটা অংশ জুড়ে রোদ পড়েছে। আর একইসঙ্গে এসিজির হাতে আলতো করে ধরা চশমার ছায়াও পড়েছে সেখানে। চশমার কাচের ছায়ার মাঝখানটায় একটা করে রোদের উজ্জল টিপ : সূর্যের প্রতিবিম্ব।

এসিজি চশমাটা বারকয়েক নেড়েচেড়ে কাচের ছায়া দুটো লক্ষ করলেন। যদিও চোখে চশমা না থাকায় লক্ষ করার কাজটা খুব ভালোভাবে করা যাচ্ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা বুঝতে কোনওরকম অসুবিধে হল না।

চশমাটা চোখে দিয়ে পরমেশ্বরবাবুর জানলার কাছে এগিয়ে গেলেন অশোকচন্দ্র। জানালার কাচে টোকা দিয়ে রঘুপতিদের ইশারা করে বাইরে আসতে বললেন। তারপর আপনমনেই হেসে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ হুনুর।

‘কী ব্যাপার, গুপ্তাসব? এনি সলিউশান?’ কাছে এসে দাঁড়ানোমাত্রই কৌতূহলী প্রশ্ন ছুড়ে দিল রঘুপতি যাদব।

উত্তরে অশোকচন্দ্র হেসে বললেন, ‘আমি একটা খাঁটি গর্দভ, রঘুপতি। বুঝতে পারছি, ফিজিক্স নিয়ে পড়াশোনায় আমার অনেক ফাঁক থেকে গেছে। বিশেষ করে অপটিক্সে—মানে, আলোক-বিজ্ঞানে…।’

‘আপনার কথা তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ হতবম্ব হয়ে মন্তব্য করলেন বিজন শর্মা।

এসিজি শর্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার মার্ডার মিস্ট্রি আমি এখনও সলভ করতে পারিনি, তবে বন্ধ ঘরের মিস্ট্রি সলভ করতে পেরেছি।’

রঙ্গলাল বললেন, ‘অধম এখনও ইন অন্ধকার/ আজ্ঞা হোক খুলে বলিবার।’

এসিজি মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মেরে বিজন শর্মাকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনি অর্কদেববাবুকে একবার এখানে আসতে বলুন। আর ওঁর দু-বোনকেও আসতে বলবেন।’

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ওঁরা তিনজনে বারান্দায় এসে হাজির। অর্কদেব চেষ্টা করে শান্ত স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেছেন। তবে ঈশানী ও হিমানীর মুখে বিব্রত ও বিরক্ত ভাব বেশ স্পষ্ট।

অর্কদেব নরম গলায় বললেন, ‘ওপরের কাজ হয়ে গেলে নিচে চলুন—সেখানে আপনাদের জন্যে সামান্য একটু চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

এসিজি মাথা নেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, যাব—তবে তার আগে একটু জরুরি কাজ সেরে নেব।’

তারপর সরাসরি হিমানীর চোখে তাকিয়ে কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন বললেন, ‘হিমানীদেবী, আপনার কাছে কি চার-পাঁচ ইঞ্চি ডায়ামিটারের কোনও ম্যাগনিফাইং গ্লাস—মানে, আতসকাচ আছে?

চশমার পিছন থেকে কয়েক সেকেন্ড ঠান্ডা চোখে অপলকে অশোকচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন হিমানী। তারপর বললেন, ‘সবই বুঝতে পেরেছেন তা হলে?’

অর্কদেব আর ঈশানী অবাক চোখে ছোট বোনের দিকে তাকালেন।

হিমানীর বাঁকা প্রশ্নের উত্তরে এসিজি হেসে বললেন, ‘না, সবটা বুঝতে পারিনি—যেটুকু পেরেছি বলি—ভুল হলে ধরিয়ে দেবেন।’

‘সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে কোনও এক সময় আপনি পরমেশ্বরবাবুর ঘরে এসেছিলেন—হয়তো ওঁর সঙ্গে কোনও কথা বলার ছিল। আপনি এসে দেখলেন, ঘরের দরজা-জানলা ভেতর থেকে বন্ধ। আর বারান্দার লাগোয়া ওই জানলার কাছে টেবিলে মাথা রেখে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন আপনার বাবা।

‘এ ছাড়াও কয়েকটা জিনিস দেখতে পেলেন আপনি। অর্ধেক খাওয়া চায়ের কাপ, তার কাছাকাছি একটা কাগজ, আর অ্যাশট্রের খাঁজে রাখা একটা গোটা সিগারেট।

‘পরমেশ্বরবাবু যে সুইসাইড করেছেন, সেটা বুঝতে আপনার বিশেষ কষ্ট হল না। কিন্তু যে-কোনও কারণেই হোক, আপনার মনে হল ব্যাপারটা একটু জট পাকিয়ে দেওয়া যাক। তাই ঘর থেকে আতসকাচটা নিয়ে এলেন। এই বারান্দায় তখন রোদ এসে পড়েছিল। ওই কাচের জানলা দিয়ে সেই রোদ পরমেশ্বরবাবুর টেবিলে গিয়েও পড়েছিল। সুতরাং, এরপর আপনার কাজ হল, আতসকাচ দিয়ে সূর্যকে ফোকাস করে টেবিলের ওপরে ফেলা। বড় ডায়ামিটারের আতসকাচ থাকলে কাজটা মোটেই কঠিন নয়।

‘তারপর আতসকাচ তার যা-কাজ তা-ই করেছে। সিগারেট ধরিয়েছে, কাপের চা গরম করেছে, আর টেবিলে পড়ে থাকা কাগজটা পুড়িয়েছে। আমার ধারণা, কাগজটা পরমেশ্বরবাবুর সুইসাইড নোট ছিল—তাতেই স্পষ্ট লেখা ছিল, কেন তিনি আত্মহত্যা করছেন—।’

এসিজির কথা শেষ হল।

সবাই ভাবছিল, হিমানী নিশ্চয়ই চিৎকার-চেঁচামেচি করবেন, অথবা কান্নায় ভেঙে পড়বেন। কিন্তু হিমানী কোনওটাই করলেন না। বরং ঠান্ডা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ডক্টর গুপ্ত। ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা আমার ঘরেই আছে। আমার রিসার্চের কাজে লাগে—গ্রাফ থেকে কোনও ভ্যালু নেওয়ার সময়, কিংবা কোনও ফটোগ্রাফ খুঁটিয়ে দেখার সময়। আপনি ফিজিক্সের লোক—আপনি বুঝতে পারবেন।’ চোখের চশমাটা একবার ঠিক করে নিলেন হিমানী। তারপর আক্ষেপের সুরে বললেন, ‘বাবার দিন-দিন মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। মানসিক অবসাদে হয়তো ভুগছিলেন, কিন্তু একইসঙ্গে ভীষণ বদমেজাজি আর খিটখিটে হয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের তিনজনের সঙ্গে তো প্র্যাকটিক্যালি চাকর-বাকরদের মতো ব্যবহার করতেন।’

‘কিন্তু প্লেইন অ্যান্ড সিম্পল সুইসাইডটাকে আপনি হঠাৎ জট পাকাতে গেলেন কেন?’ বিজন শর্মা হিমানীর কাছে জানতে চাইলেন।

‘দাদার জন্যে।’ নিষ্প্রাণ গলায় স্পষ্ট উত্তর দিলেন হিমানী। তারপর অর্কদেবের দিকে ফিরে বললেন, ‘দাদা, কিছু মনে কোরো না। তোমার লোভ তোমাকে একটু-একটু করে অন্যরকম করে দিচ্ছে। বাবার সঙ্গে তোমার যেসব ব্যাপার নিয়ে প্রায়ই কথা কাটাকাটি হত তার অনেকটাই আমার কানে এসেছে। তোমার হাতে সমস্ত বিষয়-সম্পত্তির দায়িত্ব দিয়ে আমি বা দিদি কেউই নিশ্চিন্ত থাকতে পারব না। এ নিয়ে আমাদের খোলাখুলি আলোচনা করা দরকার। বাবার শ্রাদ্ধ-শান্তির ব্যাপারটা আগে মিটে যাক—।’

অর্কদেবের চোখমুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনি কোনও জবাব দিলেন না।

ঈশানী চোখে আঁচল চেপে হঠাৎই কাঁদতে শুরু করলেন।

এসিজি রঘুপতিকে বললেন, ‘রঘুপতি, আমার কাজ শেষ—এবার আমি যাই। তুমি আর শর্মা মিলে এই ব্যাপারটা নিয়ম-টিয়ম মেনে ফাইল বন্দি কোরো।’

বিজন শর্মা এসিজিকে বললেন, ‘চলুন, ডক্টর গুপ্ত, আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। হেলপ করার জন্যে মেনি থ্যাঙ্কস।’

অর্কদেব কাছে এগিয়ে এসে খুব কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘একটু চা না খেয়ে যেতে পারবেন না…প্লিজ…।’

অশোকচন্দ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নেড়ে রাজি হলেন।

রঘুপতি বলল, ‘শর্মা, চায়ের পর তা হলে ফরমালিটিগুলো সেরে নেওয়া যাবে।’

অর্কদেব ওঁদের চারজনের সঙ্গে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ঈশানী আর হিমানী একইভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

যেতে-যেতে অর্কদেব বললেন, ‘কাল সকালে সিগারেট খাওয়া নিয়ে বাবার সঙ্গে রাগারাগির সময় বাবার লাইটারটা আমিই কেড়ে নিয়ে এসেছিলাম…কিন্তু তারপর…এরকম সব ব্যাপার হবে বুঝিনি।’

রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন, ‘হিমানীদেবীকে আপনি কী করে সন্দেহ করলেন, স্যার?’

‘লেন্সের ব্যাপারটা বুঝতে পারার পরই মনে হয়েছিল এটা বোধহয় বিজ্ঞান জানা কোনও লোকের কাজ। আর সেরকম লোক তো এ-বাড়িতে একজনই…। কিন্তু আতসকাচ নিয়ে ওইসব কাণ্ড করার সময় হিমানীকে দোতলার বারান্দায় কেউ দেখতে পেল না, এটা ভাবতেই অবাক লাগছে!’

এসিজির এই সমস্যার সমাধান করে দিল দুই মূর্তিমান : তুতুন আর মিমো।

মশা-মাছি সমস্যার সমাধান করে দুটো বাচ্চাই উন্মুখ হয়ে বৃদ্ধ গোয়েন্দার জন্য অপেক্ষা করছিল।

এসিজি ওদের বললেন, ‘ধাঁধার উত্তর শোনার আগে তোমাদের একটা প্রশ্ন করব। কাল সকালে দোতলায় তোমাদের ঠাকুরদার বারান্দায় কাউকে দেখতে পেয়েছিলে?’

ওরা একইসঙ্গে জানাল, হ্যাঁ। ছোটপিসি বারান্দায় ঠাকুরদার জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিল। হাতে সেই বড় কাচটা ছিল—যেটা দিয়ে লেখা বড়-বড় দেখায়। ওরা তখন বাগানে খেলছিল।

অশোকচন্দ্র আপনমনেই হাসলেন। ওদের সঙ্গে কথা বললে অনেক আগেই বন্ধ ঘরের রহস্যের সমাধান হয়ে যেত। বাচ্চারা বড়দের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখে।

এইবার তিনি মশা-মাছির সমস্যার উত্তর জানতে চাইলেন বাচ্চা দুটোর কাছে।

উত্তরে মিমো প্রথমে বলল, ‘মশা জিতবে, মাছি হেরে যাবে।’

এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘কেন?’

‘মশা মাছিটাকে তাড়া করে হুল ফুটিয়ে সব রক্ত টেনে নেবে। তাতে মাছিটা উইক হয়ে গিয়ে মারা যাবে।’

তখন তুতুন বলল, ‘না, জেঠু, দুজনেই মরে যাবে। মশা মাছিটাকে কামড়ে দিলে মাছিটার ম্যালেরিয়া হবে, আর মাছির থেকে মশার হবে কলেরা—তাতে দুজনেই মরে যাবে।’

তুতুনের উত্তর শুনে কেউ আর হাসি চাপতে পারলেন না।

অশোকচন্দ্র পকেট থেকে টাকা বের করে অর্কদেবকে অনুরোধ করলেন কাউকে দিয়ে দুটো ক্যাডবেরি চকোলেট আনিয়ে দেওয়ার জন্য। ওদের প্রাইজ।

রঙ্গলাল গোস্বামী মাথা নেড়ে বললেন, ‘কোশ্চেনটা ছিল শক্ত, ছিল ইন্টারেস্টিং/মশা-মাছি দুজনেই ইকোয়াফাইটিং।’

রঘুপতি যাদব অবাক হয়ে রঙ্গলালকে প্রশ্ন করলেন, ‘ইকোয়াফাইটিং মানে?’

সলজ্জ হেসে রঙ্গলাল বললেন, ‘ওই ওয়ার্ডটা আমার ইনভেনশান। ”ইকোয়াল ইন ফাইটিং”-কে প্রথমে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসের নিয়মে সমাসবদ্ধ করেছি। তারপর নিপাতনে বয়েল করে সন্ধি করে ছেড়ে দিয়েছি।’

অশোকচন্দ্র গুপ্ত খোলা গলায় হেসে উঠে বললেন, ‘স্বভাবকবিবর, আপনার সত্যিই কোনও জবাব নেই।’

রঙ্গলাল বললেন, ‘স্বভাবকবিতায় ব্যাকরণের অ্যাপ্লিকেশানটাই আসল, স্যার।’

উপন্যাস

অন্তরে পাপ ছিল

image9.jpg
কে
যেন বলে গেছেন, খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য।

এ-কথাটা ভাবামাত্রই হেসে ফেললেন বৃদ্ধ হুনুর ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে এসিজি। কারণ, এই কথাটা কোনও মহাপুরুষ মোটেই বলে যাননি। বহু বছর ধরে খুন এবং খুনি ঘাঁটাঘাঁটি করে এই বিশ্বাসে তিনি নিজেই পৌঁছে গেছেন। একটা কথা বহুদিন ধরে বিশ্বাস করলে একসময় মনে হয়, কথাটা নিশ্চয়ই কোনও-না-কোনও মহাপুরুষ বলে গেছেন। নিজের বিশ্বাসের দায় তখন অনায়াসে কোনও মহাজনের ঘাড়ে চেপে যায়।

একটু আগেই একটা টেলিফোন এসেছিল। গড়পাড় থেকে কে এক দীপ্তিমান বসাক এসিজিকে ফোন করেছিলেন।

‘হ্যালো, ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত আছেন?’ একটু ভারি অথচ বেশ চমৎকার গলায় প্রশ্ন করল কেউ।

‘হ্যাঁ—বলছি।’

‘আ-আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। আ-আমাকে আপনি চিনবেন না।’ থতিয়ে-থতিয়ে বললেন দীপ্তিমান, ‘একটা জরুরি ব্যাপারে আপনার হেলপ চাইছি। যদি কাইন্ডলি আপনার সঙ্গে দেখা করার পারমিশান দেন…।’

দীপ্তিমান বসাক নামে কাউকে চেনেন না এসিজি। কী করে তিনি এসিজির ফোন-নম্বর পেলেন কে জানে! তবে ভদ্রলোকের গলা বেশ উত্তেজিত এবং নার্ভাস বলে মনে হল।

‘কী ব্যাপারে দেখা করতে চান আপনি?’ আন্তরিক গলায় জানতে চাইলেন এসিজি।

অশোকচন্দ্র একসময় রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে অধ্যাপনা করতেন। সেটা জেনে অনেকে ফিজিক্সের সমস্যা নিয়ে আসেন। তবে তাঁরা সবই পাড়ার লোক। আর এলাকার বাইরে থেকে অনেকে যোগাযোগ করেন ছাত্র পড়ানোর জন্য। তাতে তিনি বিব্রত হন—অনেকসময় বিরক্তও হন। কারণ, কোচিং ক্লাস তিনি অপছন্দ করেন।

দীপ্তিমান কি ছাত্র পড়ানোর ব্যাপারে দেখা করতে চান নাকি?

‘আমার খুব ক্লোজ একজন রিলেটিভ পাঁচদিন আগে মারা গেছেন। অ্যাক্সিডেন্ট। মানে, এমনিতে অ্যাক্সিডেন্ট বলেই মনে হচ্ছে। তবে…।’

এসিজি সজাগ হলেন পলকে। মাথার ধবধবে চুলের গোছায় আলতো করে কয়েকবার টান মারলেন।

‘তবে কী?’

‘আপনাকে…আপনাকে প্রমাণ করতে হবে ব্যাপারটা…ব্যাপারটা জেনুইন অ্যাক্সিডেন্ট। অন্য কিছু নয়।’ ফোনের ও-প্রান্তে দীপ্তিমানের গলা কাঁপছিল।

‘আপনার কি ধারণা ব্যাপারটা আসলে মার্ডার?

‘হতেও তো পারে!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান বসাক : ‘আবার নাও হতে পারে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে সব খুলে বলব। আজ সন্ধে সাতটা নাগাদ গেলে আপনার অসুবিধে হবে?’

দীপ্তিমানের কথায় একটা আকুল ভাব টের পাচ্ছিলেন এসিজি। তাই কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে রাজি হলেন। বাড়ির ঠিকানা জানিয়ে দীপ্তিমানকে বললেন সন্ধে সাতটায় আসতে।

আর তারপরই মনে হল ওই কথাটা : খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ তার চেয়েও জঘন্য। কারণ, আপাতভাবে নির্দোষ যে-মানুষটা স্বাধীনভাবে ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে, তার দিকে বেপরোয়া আঙুল তুলে খুনের কলঙ্কের সিলমোহর তার কপালে স্থায়ীভাবে এঁকে দেওয়া—সত্যিই খুব জঘন্য। তখন এসিজির নিজেকেই কেমন অপরাধী বলে মনে হয়।

একটা সিগারেট ধরালেন অশোকচন্দ্র গুপ্ত। তাঁর কাছে এসে দীপ্তিমান কী বলবেন কে জানে! তা ছাড়া, তাঁর ওই রিলেটিভ কোন থানার এলাকায় মারা গেছেন এসিজি জানেন না। যদি সত্যি-সত্যিই তাঁকে রহস্যভেদের কাজে নামতে হয় তা হলে ব্যাপারটা অনেকটা নাক গলানোর মতো ব্যাপার হয়ে যাবে। সেই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ইন্সপেক্টর রঘুপতি যাদব।

সুতরাং সিগারেটে কয়েকটা টান দিয়ে টেলিফোনের রিসিভার তুলে নিলেন অশোকচন্দ্র। লালবাজারের হোমিসাইড স্কোয়াডে ডায়াল করলেন।

দীপ্তিমান বসাক যখন এসিজির শ্যামবাজারে ফ্ল্যাটে এসে হাজির হলেন তখন সাতটা বেজে মিনিট পনেরো হয়েছে।

রঘুপতি যাদব এসেছে অনেক আগেই। বসবার ঘরে বসে আয়েস করে কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিল রঘুপতি। আর প্রাক্তন স্যারের কাছ থেকে পাখির বিষয়ে নানান কথা শুনছিল। সম্প্রতি এসিজি পাখির ডাকের স্পেকট্রাল অ্যানালিসিস নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন। বিদেশে স্মিথসোনিয়ান ইন্সটিটিউটে এ নিয়ে গবেষণা করে সিগনাল রিকন্সট্রাকশনের মাধ্যমে কোনও-কোনও পাখির ডাকের হুবহু নকল করতে পেরেছে। এমনকী, তারা বহু স্ত্রী-পাখির ব্রিডিং কল নকল করে পুরুষ-পাখিকে গাছের আড়াল থেকে বাইরে টেনে এনেছে।

এসব রোমাঞ্চকর গবেষণার কথাই এসিজি শোনাচ্ছিলেন রঘুপতিকে। আর রঘুপতি অবাক হয়ে লম্বা ছিপছিপে মানুষটাকে দেখছিল। কোথায় ফিজিক্স, আর কোথায় পাখি! আর কোথায়ই বা গোয়েন্দাগিরি!

‘স্যার, কী করে যে আপনি এতদিকে মন লাগাতে পারেন সে আপনিই জানেন!’ কফির কাপে চুমুক দিয়ে হেসে বলল রঘুপতি।

হাতের সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে এসিজি বললেন, ‘মন তো লাগাই না! মন লেগে যায়।’

ঠিক তখনই কলিংবেল বেজে উঠল।

এসিজি ওঠার আগেই সোফা ছেড়ে উঠে পড়ল রঘুপতি। প্রাক্তন স্যারের দিকে ইশারা করে বলল, ‘আপ বৈঠিয়ে…।’ এবং এগিয়ে গিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দিল।

‘নমস্কার। আমার নাম দীপ্তিমান বসাক। জ্যামের জন্যে পনেরো মিনিট দেরি হয়ে গেল।’

এ-কথা বলে ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁকে ভালো করে জরিপ করলেন এসিজি।

প্রথমেই যেটা নজরে পড়ে সেটা ভদ্রলোকের খুঁড়িয়ে চলা। বোধহয় ছোটবেলায় পোলিও বা ওইরকম কোনও অসুখ হয়েছিল। চৌকোনা মুখ। মাথায় ঘন কোঁকড়ানো চুল। চোখদুটো অস্বাভাবিকরকম বড়। গাল সামান্য ভাঙা। চোয়ালের হাড় বেরিয়ে আছে। পুরু ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফ। গায়ের রং ময়লা। বয়েস তেতাল্লিশ কি চুয়াল্লিশ।

চেহারায় বেঁটেখাটো দীপ্তিমানকে দেখে প্রথমেই যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা সেটা ভালো নয়। কিন্তু ওঁর গলার স্বর একেবারে হিপনোটাইজ করে ফেলার মতো।

এসিজি উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিমানকে প্রতি নমস্কার জানালেন। তারপর একটা খালি সোফায় বসতে ইশারা করলেন।

দীপ্তিমান বসতেই এসিজি গলা চড়িয়ে বিশুকে ডাকলেন। বিশু বোধহয় ভেতরের ঘরে টিভি দেখছিল। ডাক শুনে এসে দাঁড়াল। বারো-তেরো বছরের এই ছেলেটি অশোকচন্দ্রের দিন-রাতের সঙ্গী।

‘ভালো করে তিনকাপ কফি কর দেখি—।’

অর্ডার পেয়েই বিশু ব্যস্তভাবে চলে গেল কফির আয়োজন করতে।

রঘুপতির সঙ্গে দীপ্তিমানের আলাপ করিয়ে দিলেন এসিজি। দীপ্তিমান সতর্ক চোখে রঘুপতিকে দেখলেন।

পরনে সাদা-পোশাক, তবু পুলিশ-পুলিশ ভাবটা বোঝা যায়। ফরসা মুখে বসন্তের দাগ। ছোট করে ছাঁটা চুল। কাঁচা-পাকা গোঁফ। চওড়া কাঁধ দেখেই বোঝা যায় এঁর সঙ্গে হিসেব করে মোকাবিলায় নামলে ভালো হয়।

‘বলুন, মিস্টার বসাক। যা বলার খোলাখুলি বলুন—কোনও অসুবিধে নেই। আপনারটা পুরোপুরি শোনার পর আমার ওপিনিয়ন দেব।’

এক পলক দুজনের দিকে তাকালেন দীপ্তিমান। তারপর পুরু ঠোঁটের ওপরে জিভের ডগা বুলিয়ে নিয়ে ছোট্ট করে গলাখাঁকারি দিলেন। গায়ের হালকা নীল সোয়েটারটা বারকয়েক টানলেন। ওঁর ইতস্তত ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ঠিক কোথা থেকে শুরু করবেন সেটা ভেবে খানিকটা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর হ্যাঁচকা দিয়ে চলতে শুরু করা মোটরগাড়ির মতো কথা বলতে শুরু করলেন দীপ্তিমান।

এসিজির হাতের সিগারেট শেষ হয়ে এসেছিল। অবশেষটা টেবিলে রাখা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন। দীপ্তিমানকে উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘নিন, শুরু করুন…।’

আপনমনেই ছোট করে কয়েকবার মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান। তারপর রেডিয়োতে শোকসংবাদ পাঠ করার মতো ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন ‘ব্যাপারটা যেখানে হয়েছে সেই বাড়িটা বাদুড়বাগান স্ট্রিটে। চার নম্বর বাড়ি। আর যিনি মারা গেছেন তাঁর নাম চারুবালা মজুমদার। বয়েস হয়েছিল প্রায় পঁচাত্তর। তিনি ছিলেন ও-বাড়ির আশ্রিতা…।’ মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে তিনি যোগ করলেন, ‘আমি ওঁকে মা বলে ডাকতাম—চারুমা। আসলে আমি অনাথ। সংসারে আমার আপন বলতে কেউ কোনওদিন ছিল না। কিন্তু বছর পনেরো আগে চারুবালার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর ওঁর সঙ্গে কেমন যেন স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে জড়িয়ে গেলাম।’

রঘুপতি পকেট থেকে কাগজ-পেন বের করে দরকারমতো নোট নিচ্ছিল। ও জানে, স্মৃতির ওপরে পুরোপুরি নির্ভর না করে লিখে রাখাই ভালো। ওর স্যার অবশ্য মনে-মনে মাথায় সবকিছু লিখে নেন। নিজেকে থিঙ্কিং মেশিন বলে জাহির করাটা ওঁর পক্ষেই মানায়।

বিশু কফির ট্রে নিয়ে ঘরে এল। কফির কাপ আর বিস্কুটের প্লেট তিনজনের সামনে টেবিলে সাজিয়ে দিল। এসিজিকে লক্ষ করে বলল, ‘মাসি আটটার পর এসে রান্না করে দেবে বলে গেছে।’

এসিজি ঘাড় নাড়লেন। মাসি বলতে ললিতের মা—এসিজির ঠিকে কাজের লোক।

বিশু চলে যেতেই এসিজি আর রঘুপতি কফির কাপে চুমুক দিলেন। দীপ্তিমানকে ইশারায় কফি খেতে অনুরোধ করলেন এসিজি। কিন্তু দীপ্তিমান যেন ওঁর ইশারা দেখেও দেখলেন না। কেমন এক শূন্য চোখে ঘরের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

‘নিন, কফি নিন—।’ এসিজি বললেন।

‘ওঃ, হ্যাঁ—’ চমকে উঠে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘যা বলছিলাম। চারুবালার সঙ্গে আমি স্নেহ-মায়ার সম্পর্কে কেন জড়ালাম সে নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোটবেলায় অনাথ আশ্রম থেকে কী করে যেন আমি দেওঘরের সৎসঙ্গ আশ্রমে পৌঁছে যাই। সেখান থেকে পরে কলকাতায় আসি। গড়পাড়ে একটা বাড়িতে সিঁড়ির তলায় একটা ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। আর হালসীবাগানে সৎসঙ্গের একটা ছোট ব্রাঞ্চ আছে—সেখানে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। ছোটবেলা থেকেই জ্যোতিষে আমার আগ্রহ ছিল। বড় হয়ে সেই জ্যোতিষচর্চা করেই আমার দিন চলতে লাগল।

‘চারুবালা হালসীবাগানের আশ্রমে যাতায়াত করতেন। সেই থেকেই আমার সঙ্গে আলাপ। খুব অল্পবয়েসে ওঁর স্বামী মারা গিয়েছিলেন। সেই থেকেই উনি ভাইয়ের সংসারে থাকতেন। সংসারে ভাই-ই ছিল ওঁর একমাত্র আপনজন। কিন্তু সেই ভাই—মনোহর রায়—বছরআষ্টেক আগে ক্যান্সারে মারা যান। এমনিতেই চারুবালার মনে অনেক দুঃখ-কষ্ট ছিল। আশ্রমে গিয়ে আমাকে তার কিছু-কিছু বলতেন। ভাই চলে যাওয়ার পর ওঁর দুর্দশা অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ওঁর উপায় ছিল না। কপদর্কহীন বিধবা আর কোথায়-ই বা ঠাঁই পাবে! আর আমি যেখানে থাকি সেখানে আমারই জায়গা হয় না, তো চারুমা!’

চোখে কী পড়েছে এই ভান করে বোধহয় চোখের কোণ মুছে নিলেন দীপ্তিমান। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘চারুমা ঠিক কপর্দকহীন ছিলেন না। তবে ওঁর নিজস্ব চল্লিশ হাজার টাকা ওঁর বড় ভাইপো অজয়েন্দ্রর সঙ্গে জয়েন্টলি ফিক্সড ডিপোজিট করা ছিল। তার ওপরে চারুমার কোনও কন্ট্রোল ছিল না। আর, আজকের দিনে চল্লিশ-পঞ্চাশ হাজার টাকায় কী-ই বা হয়!

‘লাস্ট চার-পাঁচ বছর ধরে চারুমার মাথায় একটু গোলমাল দেখা দেয়। ঠিক পাগল হয়ে যাননি, তবে খানিকটা ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন বলা যায়। আমার কাছে এসে হঠাৎ-হঠাৎ ভাইয়ের বউ আর ভাইপোদের নামে নানান অকথা-কুকথা বলতেন। কখনও-কখনও বউমারা বা নাতি-নাতনিরাও বাদ যেত না। অনেক চেষ্টা করেও তখন ওঁকে শান্ত করা মুশকিল ছিল।

‘ব্যাপারটা আমি বয়েসের দোষ বলেই ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁর কোনও-কোনও কথায় বুঝতাম, পাগলামির ঝোঁকে উনি যা-যা বলেন তার অনেকটাই সত্যি। হয়তো কারও কথায় বা ব্যবহারে ব্যথা পেয়েছেন, অভিমান হয়েছে—আমার কাছে এসে চারুমা সবকিছু যেন উগরে দিতেন। আমি ওঁকে সান্ত্বনা দিতাম, শান্ত করতে চেষ্টা করতাম। কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের ব্যাপার যেটা ছিল—ওঁর বাড়ির প্রায় প্রত্যেকেই ওঁকে পাগলের মতো ট্রিট করতেন।

আমি—।’

দীপ্তিমানকে বাধা দিয়ে এসিজি বললেন, ‘উনি কীভাবে মারা গেছেন?’

স্রোতে আচমকা বাধা পড়ায় দীপ্তিমান পলকের জন্য যেন বেসামাল হয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তিনতলার ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে। আজ শুক্রবার। চারুমা মারা গেছেন শনিবার—সন্ধেবেলা।’

একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। দীপ্তিমানকে অফার করতে তিনি বললেন, ‘না, থাক। আমি কখনও-কখনও খাই।’

রঘুপতি যে সিগারেট খায় না তা এসিজি ভালো করেই জানেন।

সিগারেটে টান দিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত জানতে চাইলেন, ‘চারুবালা ছাদ থেকে পড়ে গেলেন কীভাবে?

‘ওঁদের বাড়িটা ভীষণ পুরোনো। বহুবছর ধরেই ডেঞ্জারাস কন্ডিশানে রয়েছে। রিপেয়ার-টিপেয়ার কখনও করা হয়নি। রং চটে গেছে, পলেস্তারা খসে গেছে। ছাদের পাঁচিল জায়গায়-জায়গায় ভাঙা। কড়ি-বরগার অবস্থাও ভালো নয়। ও-বাড়ির ছাদের সাউথ-ওয়েস্টের দিকটায় মেঝেতে বড় একটা ফাটল আছে। তা ছাড়া, ওদিকটার পাঁচিলও ছিল ধসে পড়া। চারুমা সাধারণত ছাদে উঠতেন না। তবু হয়তো কোনও কারণে ভুল করে ওদিকটায় চলে গিয়েছিলেন। তারপর…।’

মাথা নিচু করে আবার চোখ মুছলেন দীপ্তিমান।

‘পুলিশের কী আইডিয়া?’ প্রশ্নটা করল রঘুপতি যাদব।

কপালে হাত রেখে মাথা নাড়লেন দীপ্তিমান ‘সরাসরি কোনও আইডিয়া পাইনি। আবছাভাবে যা শুনেছি তাতে পুলিশ ব্যাপারটাকে অ্যাক্সিডেন্টই ভাবছে।’

‘আবছাভাবে শুনেছেন কেন?’ কৌতূহলী হলেন এসিজি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান। কফির কাপে ছোট চুমুক দিয়ে বললেন, ‘লুকোছাপা না করে একটা কথা আপনাকে খুলে বলি, ডক্টর গুপ্ত। ও-বাড়ির মানুষজন আমাকে ঠিক পছন্দ করে না। বিশেষ করে আমার মামিমা—প্রভাবতী তো বছরদুয়েক ধরে আমাকে দেখতেই পারেন না।’

‘প্রভাবতী মানে?’

বিষণ্ণ হাসলেন দীপ্তিমান, বললেন, ‘মনোহর রায়ের বিধবা স্ত্রী। বয়েস প্রায় সত্তর। প্যারালিসিস হয়ে অনেকটাই কাবু। তবে তিনিই রায়বাড়ির শেষ কথা। সবাইকে সবসময় পায়ের আঙুলের ওপরে দাঁড় করিয়ে রাখেন। ও-বাড়িতে চারুমার সঙ্গে দেখা করতে গেলে মামিমা যেভাবে আমাকে কথা শোনাতেন তাতে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই প্রায় বছরখানেক হতে চলল, আমি ও-বাড়িতে ক্বচিৎ-কদাচিৎ যেতাম। বিশেষ করে চারুমার অসুখ-টসুখের খবর পেলে তখন মামিমার অপমান সইতে হবে জেনেও যেতাম।’

‘আপনাকে এরকম ডিসলাইক করার পজিটিভ কোনও কারণ ছিল?’

আবার মলিন হাসলেন দীপ্তিমান : ‘থাকতে পারে—তবে আমার সেটা জানা নেই।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে বললেন, ‘হয়তো ভেবে থাকবেন, চারুমা ওঁর শেষ সম্বল আমাকে দিয়ে যেতে পারেন।’

‘চারুবালাদেবীর শেষ সম্বল কি অনেক কিছু ছিল?’ অশোকচন্দ্র সিগারেটে টান দিয়ে লম্বা শরীরটাকে সামনে ঝুঁকিয়ে প্রশ্ন করলেন।

‘তেমন কিছু আর কোথায়! ওই চল্লিশ হাজার টাকা…আর, গলার একটা সোনার হার…চার-সাড়ে চারভরি মতন হবে…। চারুমা সবসময় ওটা গলায় পরে থাকতেন। কিছুতেই কাছ-ছাড়া করতেন না।’ মাথা নামিয়ে আলতো গলায় দীপ্তিমান আরও বললেন, ‘পাগলামির সময়েও হারটার কথা চারুমার খেয়াল থাকত। ক’বছর ধরেই খালি আমাকে বলতেন, ‘দীপ্তিরে, তর বউরে এটা আমি দিয়া যামু। আর কাওরে দিমু না।’ আমি হেসে বলতাম, ‘চারুমা, বিয়া করলে তয় না বউ আইব।’ দীপ্তিমান হাসলেন আপনমনে, বললেন, ‘দু-বছর ধরে চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে একেবারে খেপে উঠেছিলেন। আমার সামান্য আয়…তার ওপরে শরীরে খুঁত আছে। আমায় কে বিয়ে করবে বলুন!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন দীপ্তিমান ‘কিন্তু চারুমা কোনও কথা শুনতে চাইতেন না। যাকে সামনে পেতেন তাকেই আমার পাত্রী দেখার জন্যে রিকোয়েস্ট করতেন। ব্যাপারটা আমার মোটেই ভালো লাগত না। কিন্তু চারুমা কষ্ট পাবেন এই ভেবে তেমন করে কিছু বলতে পারিনি। যাক, এখন নিয়তিই সব সমস্যার সমাধান করে দিল।’

এসিজি চোখ ছোট করে কী যেন ভাবছিলেন। একটু ফাঁক পেতেই দীপ্তিমানকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, ‘প্রভাবতীদেবীর সঙ্গে আপনার কখনও কথা-কাটাকাটি বা ঝগড়াঝাঁটি হয়েছিল?’

একটু চিন্তা করে তারপর দীপ্তিমান জবাব দিলেন, ‘না, কখনও হয়নি।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ আপনমনেই মন্তব্য করলেন এসিজি। তারপর ‘আচ্ছা, প্রভাবতী তো জানতেন চারুবালার শেষ সম্বল কতটুকু। তা হলে তার জন্যে আপনার সঙ্গে বাজে ব্যবহার করবেন কেন? আপনি ভালো করে ভেবে দেখুন—নিশ্চয়ই অন্য কোনও কারণ আছে।’

ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে মাথার ভেতরে হাতড়াতে শুরু করলেন দীপ্তিমান বসাক। এসিজি আর রঘুপতি চুপচাপ অপেক্ষা করতে লাগলেন।

বেশ কিছুক্ষণ পর দীপ্তিমান মাথা নামালেন। এসিজির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘রায় পরিবারের অনেকেরই আমি কোষ্ঠীবিচার করেছি। পাথর-টাথরও অনেক সময় দিয়েছি। কিন্তু ঈশ্বর জানেন, কখনও ওঁদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে দাম নিইনি, কিংবা ঝুটো পাথর দিয়ে ঠকাইনি। তবে মনোহরবাবুর—মানে, আমার মামার সবসময়েই একটা পেটের যন্ত্রণা হত। সেটা কমানোর জন্যে আমি একবার যজ্ঞ করেছিলাম, আর মামাকে পাথর দিয়েছিলাম। কিন্তু মামা শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারে মারা যান। এখন মনে পড়ছে…তারপর থেকেই প্রভাবতী আমার সঙ্গে একটু কোল্ড বিহেভিয়ার শুরু করেন। ধীরে-ধীরে সেটা আরও খারাপের দিকে গেছে। হয়তো আমি মামাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি, এটাই আমার অপরাধ…।’ হাত উলটে হতাশার একটা ভঙ্গি করলেন দীপ্তিমান।

এসিজি একবার কাশলেন। এ-বছর শীত যাই-যাই করেও অন্তত বারদুয়েক ফিরে এসেছে। তাতেই এসিজির একটু ঠান্ডা লেগে গেছে। দীপ্তিমানের কথা তিনি যেমন মন দিয়ে শুনছেন তেমনই মনোযোগ দিয়ে ওঁর প্রতিটি অভিব্যক্তি লক্ষ করছেন। ভদ্রলোককে এসিজির বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল।

এইবার এসিজি লাখ টাকার প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন দীপ্তিমানের দিকে।

‘চারুবালার ব্যাপারটা আপনি অ্যাক্সিডেন্ট বলে মেনে নিতে পারছেন না কেন?’

এই প্রশ্নে দীপ্তিমান কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়লেন। ওঁর মুখ যে খানিকটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল সেটা এসিজি ও রঘুপতি দুজনেরই চোখে পড়ল।

রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘আপনি তা হলে কী ভাবছেন? সুইসাইড, না মার্ডার?’

একটু সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন দীপ্তিমান। তারপর ভেতরে-ভেতরে কোনও গোপন শক্তি সঞ্চয় করে বললেন, ‘সুইসাইডের তো কোনও প্রশ্নই নেই! চারুমা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। এ-অবস্থায় কেউ সুইসাইড করে না। তা ছাড়া, ওঁর গলার হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। সেটা হঠাৎ পাওয়া গেল চারুমা মারা যাওয়ার দিন। ছাদের ভাঙা জায়গাটার কাছেই পড়ে ছিল। কে ওটা চুরি করেছিল, কেন চুরি করেছিল, কেনই বা ওটা চারুমার মারা যাওয়ার দিন ছাদে ফিরে এল—এসব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই…।’

‘ফির ভি, অ্যাক্সিডেন্ট তো হতে পারে।’ রঘুপতি বলল।

রঘুপতির দিকে তাকালেন দীপ্তিমান ‘হ্যাঁ, হতে পারত—যদি না চারুমার শেষ একটা কথা আমার কানে বাজত…।’

‘কী কথা?’ এসিজি জানতে চাইলেন।

দীপ্তিমান একটু ইতস্তত করলেন। ভুরু উঁচিয়ে দু-চোখে হাত ঘষলেন। যেন কোনও কারণে তিনি ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছিলেন না। তারপর দু-একটা টুকরো শব্দ করে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘আগেই তো বলেছি, মামিমাদের বাড়িতে আমার যাতায়াতের অসুবিধে ছিল। চারুমা আশ্রমে এলে তবেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ হত। তবে ওঁর বয়েস হয়েছিল, একা-একা আসতে পারতেন না। পাড়ার একটি সাদাসিধে ছেলে—নাম, রতন—ওকে সঙ্গে করে আসতেন। কোনও খবর দেওয়ার থাকলে রতনকে দিয়ে বলে পাঠাতেন। মোটামুটি রতনই আমাদের মধ্যে অনেকটা টেলিফোনের কাজ করত।’ হাসলেন দীপ্তিমান ‘আর দরকার পড়লে আমি চারুমাকে ও-বাড়িতে ফোন করতাম। সে-নিয়েও অবশ্য চারুমাকে কথা শুনতে হত। প্রভাবতী নাকি বলতেন : ”দিদি, আপনার এত ফোন আসে কেন? এ-বয়েসে এত ফোন আসা ভালো না।” অবস্থাটা একবার ভেবে দেখুন!…যাই হোক, চারুমা বোধহয় কিছু একটা দেখে ফেলেছিলেন। এমন কিছু, যেটা ভালো কাজ নয়। তাই মারা যাওয়ার দিনদশেক আগে থেকেই একটা কথা ওঁর মুখে শুনতাম : ”ছি ছি ছি, এই অন্যায় আমি সইহ্য করুম না! কিয়ের লেইগ্যা সইহ্য করুম? সারাটা জীবন সংসার আমারে জ্বালাইয়া-পোড়াইয়া খাইল। পাঁচকান কইর‍্যা দিলে বুঝব’অন ঠ্যালা! আমারে চিনে না।” ‘

‘কী অন্যায় তিনি পাঁচকান করে দেওয়ার কথা বলছিলেন সেটা আপনি জানতে চাননি?’

‘আমি অনেকবার চারুমাকে জিগ্যেস করেছি—কিন্তু চারুমা কোনও স্পষ্ট জবাব দেননি। বরং পাগলামির তোড়ে ভেসে গেছেন। পরে কখনও জানতে চাইলে বলতেন, ”কী কস? কুন কথা পাঁচকান করুম? আমি কইসি!” মানে, ওঁর ব্যাপারটা আর মনে পড়ত না। ও-বাড়ির সকলেই বোধহয় চারুমার এ-কথা শুনেছে। হয়তো পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়েও দিয়েছে…’ একটু থামলেন দীপ্তিমান। তারপর সিরিয়াস গলায় বললেন, ‘…শুধু একজন ছাড়া। যে সেই অন্যায়টা করেছিল। সে ব্যাপারটাকে মোটেই পাগলের পাগলামি বলে উড়িয়ে দেয়নি। বরং ভয় পেয়েছে। ভেবেছে, পাগল বিধবাটা এই বোধহয় ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল। আর প্রভাবতী একবার জানতে পারলেই সর্বনাশ! চরম শাস্তি দিয়ে ছাড়বেন। ওঁকে সবাই যমের মতো ভয় পায়। তাই সেই লোকটা হয়তো ভয় পেয়েই পাগল বিধবাটাকে কিছু একটা…’ দীপ্তিমানের গলা বুজে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে জড়ানো গলায় তিনি কোনওরকমে বললেন, ‘ওই পাগল বিধবাটাকে আমি ”মা” ডেকেছিলাম। ঈশ্বর জানেন, ওঁর গয়না বা টাকাপয়সার জন্যে কোনও লোভ আমার ছিল না। ঈশ্বর জানেন, চারুমা মারা যাওয়ায় আমি কী কষ্ট পেয়েছি। আমি…আমি…।’

আর বলতে পারলেন না দীপ্তিমান। মাথা নিচু করে বাচ্চাছেলের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

এসিজি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। দীপ্তিমানকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘আপসেট হবেন না, দীপ্তিমানবাবু…প্লিজ। যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না!’

রঘুপতি যাদব চুপচাপ নোট নিচ্ছিল। দীপ্তিমানের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিল।

হাতের সিগারেট কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসিজি সেটা অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে বারকয়েক কাশলেন। মেয়ে ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত সিগারেট হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাসন করার মতো কেউ আর কাছে নেই। যে সবচেয়ে কাছাকাছি থাকত, সবসময় থাকত, সে চলে গেছে বছরদশেক আগে। আকাশে। সেখানে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে।

নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুললেন দীপ্তিমান। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ফোনে আপনাকে এসব কথা বলতে পারিনি। বুঝতেই তো পারছেন, বলা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি কাইন্ডলি চারুমার মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখেন তা হলে আমি শান্তি পাব। চারুমার জন্যে আমি কর্তব্য করতে পারিনি। এমনকী মুখাগ্নিও ওরা করতে দেয়নি আমাকে। হয়তো শ্রাদ্ধের সময়েও ডাকবে না। তাই আমার খুব ইচ্ছে, ওঁর মৃত্যুতে যে শুধুমাত্র নিয়তির হাত ছিল না, সেটা প্রমাণ হোক। তা হলেই আমার শান্তি। আপনি আমাকে ফেরাবেন না…প্লিজ। আপনার ফিজ আমি দেব…হয়তো খুব বেশি পারব না…।’ জল-ভরা চোখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন দীপ্তিমান।

‘এ কী করছেন! শান্ত হয়ে বসুন।’ এসিজি বললেন, ‘ফিজের কথা আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। বরং ও-বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আর যা-যা জানেন সেগুলো আমাকে বলুন। কাজে নামার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা যতটা ডিটেলে জানা যায় ততই কাজের সুবিধে। আর আপনার খোলাখুলি মতামতও বলবেন কিন্তু…।’

এরপর দীপ্তিমান বলে চললেন, আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে আধবোজা চোখে সব শুনতে লাগলেন। রঘুপতি যথারীতি কাগজ-কলম নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যস্ত হল।

বিশু ফরমাশ পেয়ে আর-একদফা কফি দিয়ে গেল।

এসিজির আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে লাগল। আর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দীপ্তিমানের কথা শেষ হল।

এসিজি ওঁকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘সম্ভবত আমি রোববার প্রভাবতীদের বাড়িতে যাব। তার আগে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি.-র সঙ্গে কথা বলে রঘুপতি ফরমালিটিগুলো সেরে রাখবে। তা না হলে ইনভেস্টিগেশানে প্রবলেম হতে পারে। আপনাকে খবর পাঠিয়ে দেব। সেদিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’

‘তাতে মাসিমা হয়তো মাইন্ড করতে পারেন।’ দীপ্তিমান বললেন।

‘মাইন্ড করলেই হল!’ বলল রঘুপতি যাদব, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, মিস্টার বসাক। দ্যাট ইজ মাই প্রবলেম। কী বলেন, গুপ্তাসাব?’

রঘুপতির শেষ প্রশ্নটা প্রাক্তন স্যার এসিজিকে লক্ষ করে।

এসিজি হাসলেন। রঘুপতির মেজাজ যখন-তখন হারিয়ে যায়। তাই এসিজি প্রায়ই ওকে সাবধান করে বলেন, ‘রঘুপতি, ডোন্ট লুজ ইয়োর টেম্পার। ওটা খুব দামি জিনিস।’

দীপ্তিমান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একদফা অনুরোধ করে গেলেন অশোকচন্দ্রকে।

রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘স্যার, রঙ্গলালবাবুকে কি ইনফর্ম করতে হবে?’

প্রশ্নটা শুনে এসিজির হাসি পেয়ে গেল। আজকাল এমন একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে যে, তদন্তের সময় স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামী পাশে-পাশে না থাকলে তিনি যেন ঠিক মেজাজ পান না। ‘লালমহল’-এর চুনিলালবাবুর দামি পাথর খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁর ভাই রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গে এসিজির প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে স্বভাবকবি রঙ্গলাল এসিজির গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। রঙ্গলালের প্রশংসার দুটি অভিনব নমুনা মনে পড়ল এসিজির ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’, আর ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি’। এই স্বভাব-কবি কখনও এসিজির ‘তদন্তরসে’ বঞ্চিত হতে চান না।

সুতরাং, হাসতে-হাসতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতিকে বললেন, ‘ওঁকে ইনফর্ম অবশ্যই করবে, রঘুপতি। তা না হলে, ওঁর মতো স্বভাব-কবিতায় বলি—তোমার আমার মুন্ডুপাত/হয়ে যাবে অকস্মাৎ।’

রঘুপতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল প্রাক্তন স্যারের টেলিফোনের দিকে।

এসিজি পায়ে-পায়ে চলে এলেন জানলার গা ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে। এটা তাঁর পাঁচমিশেলি কাজের টেবিল। টেবিলে বই, পেন, কাগজপত্র সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা রুবিক কিউব।

রঙিন কিউবটা হাতে নিয়ে তার একটা থাক মোচড় দিতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র। সাজানো রংগুলো ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল।

আপনমনে বিড়বিড় করে এসিজি বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড, না মার্ডার?’

‘…কে দেবে তার কারেক্ট আনসার।’

প্রভাবতীদের পুরোনো পলেস্তারা-খসা বাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে আগের দিনের বিড়বিড় করে বলা কথাটাই জোরে-জোরে উচ্চারণ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। প্রশ্নটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী রঙ্গলালবাবুর দিকে। ব্যস!

রঙ্গলাল তৎক্ষণাৎ ওঁর স্বভাব-কবিতা রচনার তীব্র প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ছন্দ মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।

এসিজি হেসে বললেন, ‘উত্তর দিতে হবে আমাকেই। কোনও উপায় নেই। আমাকে নিয়ে রঘুপতির অনেক গর্ব। ওর মানটা তো বাঁচাতে হবে!’

প্রভাবতীদের বাড়িটা দেখামাত্রই ফিটন গাড়ি, ভোরবেলা গঙ্গার জল দিয়ে রাস্তা ধোওয়া, ভিস্তিওয়ালা—এসব পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়। একটা ভাঙা শ্বেতপাথরের ফলকে শুধু ‘…নিবাস’ টুকু পড়া যাচ্ছে। তিনতলা বাড়ির এখানে-সেখানে বট-অশ্বত্থের চারা মাথাচাড়া দিয়েছে। হালকা শীতের বাতাসে তাদের রোদ-চকচকে পাতা নড়ছে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি. বিজন শর্মার সঙ্গে রঘুপতি কথা বলে নিয়েছিল। কেসের ফাইলের একটা কপিও রঘুপতি পৌঁছে দিয়েছে এসিজিকে। তারপর জরুরি একটা তদন্তের কাজে ওকে আচমকা ভুবনেশ্বর চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তার আগে ও সব ব্যবস্থা করে দিয়ে গেছে।

প্রভাবতীদের বাড়িতে বিজন শর্মা জানিয়ে দিয়েছেন যে, একজন ইনভেস্টিগেটর দুজন ভদ্রলোককে নিয়ে রবিবার সকাল ন’টায় প্রভাবতীদের বাড়িতে আসবেন। বাড়ির প্রত্যেকে যেন তাঁর সঙ্গে হান্ড্রেড পার্সেন্ট কো-অপারেট করেন। তা না হলে ব্যাপারটা অনেক দূর গড়াতে পারে।

সুতরাং, রবিবার সকালে এসিজি, রঙ্গলাল ও দীপ্তিমান, পৌঁছে গেছেন প্রভাবতীদের বাড়িতে।

বিশাল সদর দরজায় বিশাল মাপের কড়া। বোঝাই যায়, কলিংবেলের ব্যাপারটা আধুনিক সংযোজন।

বেল টিপতেই দরজা খুলে গেল। বছর পঞ্চাশের একজন টাক-মাথা ভদ্রলোক বিগলিত হেসে এসিজিদের অভ্যর্থনা জানালেন। তবে দীপ্তিমানকে দেখামাত্রই তাঁর ফরসা কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ল।

‘আসুন, আসুন, ডক্টর গুপ্ত।’ রঙ্গলালবাবুকে নমস্কার জানিয়ে বললেন তিনি, ‘থানা থেকে আমাকে সবকিছু জানিয়ে আগাম খবর দিয়ে দিয়েছে। আমার নাম অজয়েন্দ্র—অজয়—আমারই পিসিমণি অ্যাক্সিডেন্টালি ছাদ ধসে পড়ে মারা গেছেন।’

এসিজি কিছু বলার আগেই রঙ্গলাল গোস্বামী ভুল ধরিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমি হলেম রঙ্গলাল স্বভাব-কবিবর/উনি হলেন এসিজি গোয়েন্দাপ্রবর।’

কবিতার আকস্মিক দাপটে অজয়েন্দ্র কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে চেয়ে রইলেন রঙ্গলালের কীর্তনীয়াগোছের চেহারার দিকে।

এসিজি সামান্য হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, মিস্টার রায়—আমরা ওই অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে এসেছি। মানে…ব্যাপারটা তো সুইসাইডও হতে পারে। পুলিশ ঠিক সেই অ্যাঙ্গেলটা এক্সপ্লোর করে দেখেনি।’

অস্বস্তির হাসি হাসলেন অজয়েন্দ্র : ‘মানে, কেউ কি পুলিশে কোনও নালিশ-টালিশ করেছে?’

অশোকচন্দ্র লক্ষ করলেন, অজয়েন্দ্রর চোখ চট করে দীপ্তিমানকে ছুঁয়ে গেল।

‘না, নালিশ-টালিশ কেউ করেনি। পুলিশই ব্যাপারটা ভেবে দেখেছে।’ তারপর একটু শক্ত গলায় বললেন, ‘হঠাৎ আপনার নালিশের কথা মনে হল কেন?’

‘মা বলছিল এই সাধারণ ব্যাপারটাকে নিয়েই হয়তো জল ঘোলা হবে—তাই।’ গালের খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে হাত বোলালেন অজয়েন্দ্র।

বসবার ঘরে ওঁদের বসাতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এসিজি বাদ সাধলেন ‘কিছু মনে করবেন না, আমরা আগে ছাদে যাব। জায়গাটা ভালো করে দেখব। তারপর আপনাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেব।’

‘সামান্য একটু চা-টা না খেলে কি চলে…।’ ইতস্তত করলেন অজয়বাবু।

‘সে পরে হবেখ’ন—’ জবাব দিলেন রঙ্গলাল, ‘থিতু হয়ে বসব যখন।’

ছন্দের গন্ধ পেয়ে এসিজি আড়চোখে তাকালেন রঙ্গলালের দিকে। কবিবর কাঁচুমাচু মুখ করে আকর্ণবিস্তৃত হাসলেন। দীপ্তিমান কিছু বললেন না, তবে রঙ্গলালের স্বভাব-কবিতা উপভোগ করছিলেন।

‘মা জানতে পারলে খুব রেগে যাবেন…’ বিড়বিড় করে এই কথা বলতে-বলতে অজয়েন্দ্র ওঁদের নিয়ে চললেন ওপরে।

সবসময়েই অশোকচন্দ্র গুপ্ত প্রথম অকুস্থল দেখাটা পছন্দ করেন। ওঁর মতে, আগে লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে পরে অকুস্থল দেখলে দৃষ্টিভঙ্গিটা ঠিক নিরপেক্ষ থাকে না।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে এসিজি বাড়িটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছিলেন।

ঢালাই লোহার রেলিং, মেঝেতে সাদা-কালো পাথর বসানো, দেওয়ালের খানিকটা পর্যন্ত সাদা টালি, লাল-নীল-সবুজ-হলদে কাচের শার্সি, বারান্দার সিলিং এর কার্নিশে গোলা পায়রার আস্তানা। তবে শুধু গোলা পায়রাগুলোই চকচকে-ঝকঝকে নতুন—বাকি সবই ময়লা, চিড় ধরা, ভাঙা।

বাড়ির ভেতরটায় যেরকম অন্ধকার-অন্ধকার ভাব ছিল, ছাদে পা দিতেই ছবিটা বদলে গেল। অকৃপণ রোদ সেখানে হেসে গড়াগড়ি যাচ্ছে।

বিশাল ছাদ। সেখানে প্রথমে যেটা চোখে পড়ে তা হল, কাপড় ছড়ানোর গোটা সাত-আট দড়ি নানান কায়দায় এ-মাথা ও-মাথা বাঁধা রয়েছে। কোনওটা নাইলনের দড়ি, কোনওটা সাদা কাপড়ের তৈরি, আর কোনওটা নিতান্তই পুরোনো শাড়ির পাড়।

ছাদের ডানদিকে প্রচুর টব। সেখানে সাধারণ সস্তার গাছ। কেউ কখনও টবগুলোর যত্ন নেয় বলে মনে হয় না। টবের সারির পিছনের পাঁচিলে দুটো কাক বসে আছে।

ছাদের মেঝেতে কম করেও তিন-চার জায়গায় ফাটল ধরেছে। আর দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটায় পাঁচিল ভাঙা, মেঝের খানিকটা অংশ নেই।

এসিজির নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘পিসিমণি ওখানটা দিয়েই পড়ে গেছেন।’

এসিজি পায়ে-পায়ে সেদিকটায় এগিয়ে গেলেন। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই অজয়বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আর যাবেন না! আর যাবেন না!’

এসিজি থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকালেন।

সে-চাউনিতে প্রশ্ন ছিল। তার উত্তরে ছাদের মেঝের দিকে আঙুল দেখালেন অজয়েন্দ্র ‘ওই দেখুন, দাগ দিয়ে সাবধান করা আছে। ওই দাগের ও-পাশে আমরা কেউ কখনও যাই না। করপোরেশান দুবার নোটিশ দিয়ে গেছে। বাচ্চাদের তো ছাদে ওঠাই বারণ—।’

এসিজি লক্ষ করে দেখলেন। সত্যিই সাদা তেল রং দিয়ে অপটু হাতে একটা চওড়া দাগ টানা আছে। দাগের ও-পাশে বেশ বড় মাপের একটা ফাটল—দেখলে ভয় হয়। সেই ফাটল ফুট তিনেক যাওয়ার পরই বড় হাঁ হয়ে গেছে। ছাদের সেই অংশটা চারুবালাকে নিয়ে ধসে পড়েছে নীচে। খোঁদল দিয়ে দোতলার একটা ঘরের অংশ নজরে পড়ছে।

এসিজিদের নজর লক্ষ করে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘ও-ঘরটায় কেউ থাকে না। এমনই স্টোররুম মতন—।’

একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। ধোঁয়া ছাড়লেন কয়েকবার। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন।

বাড়ির কেউ ওই দাগের ও-পাশে যেত না। সবাই ব্যাপারটা জানত। তা হলে চারুবালা গেলেন কেন? সে কি ওঁর মাথায় ছিট ছিল বলেই?’

‘দাগটা কবে আঁকা হয়েছে, অজয়বাবু?’

‘প্রায় সাত-আট বছর আগে। রং চটে গেলে আমিই আবার লাগিয়ে দিই।’

‘লাস্ট কবে রং লগিয়েছেন?’

‘তা প্রায় বছরখানেক হবে।’ একটা ছোট ঢেঁকুর তুললেন অজয়েন্দ্র, পেটে বারকয়েক হাত বোলালেন।

দীপ্তিমান বলেছেন, চারুবালার মাথায় ছিট দেখা দেয় চার-পাঁচ বছর ধরে। দাগ দেওয়ার ব্যাপারটা তারও আগের—চারুবালা যখন সুস্থ ছিলেন। তা ছাড়া, ছিটগ্রস্ত হয়ে পড়ার পরেও এতদিন কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। নাকি চারুবালা প্রায়ই ছাদের ওই বিপজ্জনক অংশে যাতায়াত করতেন? তারপর হঠাৎ একদিন ওই অংশটা ওঁকে নিয়ে ধসে পড়েছে?

‘আপনার পিসিমা ছাদে কি প্রায়ই উঠতেন?’

‘না, না।’ ব্যস্তভাবে বলে উঠলেন অজয়েন্দ্র, ‘বরং বলতে পারেন ন’মাসে ছ’মাসে কখনও-কখনও রোদ পোয়াতে উঠতেন। পিসিমণির অনেক বয়েস হয়েছিল। হাঁটুতে গেঁটে বাত ছিল। ওই শনিবার…মানে, যেদিন অ্যাক্সিডেন্টটা হয়…কেন উঠেছিলেন কে জানে?’

এসিজি বেশ অবাক হয়ে গেলেন। যে-মানুষ্টা ছাদে বলতে গেলে প্রায় আসতই না, সে হঠাৎ ছাদে উঠতে গেল কেন? আত্মহত্যা করার জন্য?

সুস্থ অবস্থা থেকেই লক্ষ্মণের গণ্ডি ওই সাদা দাগ দেখে এসেছেন চারুবালা। অসুস্থ অবস্থায় ওঁর কি সেসব কিছুই মনে ছিল না?

সাদা দাগটাকে ধরে ছাদের পাঁচিলের কাছে চলে গেলেন এসিজি। লক্ষ করলেন, পাঁচিলের গায়েও সরু-সরু ফাটল। গলা বাড়িয়ে পাঁচিলের ওপর দিয়ে নীচের গলির দিকে তাকালেন।

ঘাড় ঘুরিয়ে অজয়বাবুকে ডাকলেন এসিজি ‘অজয়বাবু, আপনার পিসিমার বডিটা কোন জায়গায় পড়েছিল দেখান তো—।’

অজয়েন্দ্র এসিজির পাশে চলে এলেন। আঙুল দিয়ে ইশারায় দেখিয়ে দিলেন জায়গাটা ‘ওই যে—ওইখানটায়…।’

এখান থেকে পড়লে কারও পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়। কিন্তু চারুবালা যদি আত্মহত্যাই করে থাকেন তা হলে ছাদের ওই ভাঙা জায়গাটাকেই বা বেছে নিলেন কেন! অন্য বহু জায়গা দিয়েই তো নীচে লাফ দেওয়া যেত!

‘আপনি জানেন, আপনার পিসিমার ডানহাতের মুঠোয় একটা ক্লিপ পাওয়া গিয়েছিল?’ অজয়েন্দ্রর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আচমকা প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন এসিজি।

‘ক্লিপ!’ অজয়েন্দ্র কেমন হকচকিয়ে গেলেন।

‘হ্যাঁ—’ সিগারেটে আয়েসী টান দিয়ে এসিজি বললেন ‘কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ। লাল রঙের।’

ক্লিপের তথ্যটা এসিজি কেস-ফাইল থেকে পেয়েছেন। পুলিশ এটা নিয়ে আর এগোয়নি কেন কে জানে!

‘ন-না, আমি তো শুনিনি।’ থতমত খেয়ে অজয়েন্দ্র বললেন, ‘জানলে মা হয়তো জানবে।’

‘আপনার পিসিমা কি কখনও-কখনও কাপড় ছড়াতে ছাদে উঠতেন?’

‘আগে হয়তো উঠতেন—এখন আর বয়েসের জন্যে পারতেন না। আরতিই মা আর পিসিমার সব কাজ করে দেয়।’

দীপ্তিমানের কাছে সব শুনেছেন অশোকচন্দ্র। সেরিব্রাল হেমারেজের পর প্রভাবতী প্রায় পঙ্গু হয়ে যান। তারপর ফিজিয়োথেরাপি, আকুপাংচার, আরও বহুরকম চেষ্টাচরিত্র করে ওঁর শরীর অনেকটা সচল হয়। এখন লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটা-চলা করতে পারেন। তবে সিঁড়ি ভাঙতে একেবারেই পারেন না। আরতি নামে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে প্রভাবতীর রাত-দিনের সঙ্গী।

এমনসময় একজন ভদ্রমহিলা ছাদে এলেন। ময়লা রং, বেঁটেখাটো চেহারা। ছাদের দরজার কাছ থেকেই তিনি বললেন, ‘অ্যাই, তোমাকে মা ডাকছে—।’

অজয়েন্দ্র ওঁর দিকে চোখ ফিরিয়ে বললেন, ‘যাও, যাচ্ছি।’

‘যাচ্ছি বললে হবে না—মা এক্ষুনি যেতে বলেছে।’ বলে ভদ্রমহিলা চলে গেলেন।

এসিজি অনুমান করলেন, ইনি অজয়েন্দ্রর স্ত্রী মনীষা।

‘আমি যাই—’ অজয়েন্দ্র এসিজিকে বললেন, ‘আপনারা কাজ সেরে দোতলায় মায়ের ঘরে আসুন।’

পকেট থেকে একটা কাগজ বের করলেন এসিজি। তাতে ছাদের ভাঙা জায়গাটার একটা স্কেচ আঁকা ছিল। সেটা সামনে ধরে আসলের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে লাগলেন।

একটু পরে বললেন, ‘সোনার চেনটা ওইখানটায় পড়ে ছিল।’

উৎসুক দীপ্তিমান ও রঙ্গলাল এসিজির কাছে এলে ওঁর হাতের কাগজটার ওপরে ঝুঁকে পড়লেন। স্কেচের একটা জায়গায় একটা কাটা চিহ্ন আঁকা ছিল। সেটাতে আঙুল দিয়ে টোকা মেরে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘ধসে পড়া পোরশানটার ঠিক পাশেই হারটা পাওয়া গেছে। চারুবালা ওটা হাতে তুলে নেওয়ারও সময় পাননি।’

‘হারটা হারানোর পর কী করে এখানে আবার ফিরে এল বলুন তো!’ দীপ্তিমান যেন আপনমনেই বললেন।

ছাদটা আরও কিছুক্ষণ ঘুরে-ফিরে দেখার পর এসিজি বললেন, ‘চলুন, নীচে যাই।’

হাতের শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ছাদে ফেলে পায়ে রগড়ে দিলেন। মাথার সাদা চুলের গোছায় টান মারলেন কয়েকবার। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে অস্পষ্ট গলায় বললেন, ‘সে-কথাই তো ভাবছি…।’

রঙ্গলাল গোস্বামী আচমকা মন্তব্য করলেন, ‘এসিজি স্যার, এ-বাড়িতে মোট চারটে ফ্যামিলি থাকে।’

‘কী করে বুঝলেন?’ এসিজি জানতে চাইলেন।

‘অ্যান্টেনা গুনে।’ হেসে বললেন রঙ্গলাল, ‘ফ্যামিলি পিছু একটা করে অ্যান্টেনা—চারটে অ্যান্টেনা, চারটে ফ্যামিলি।’

‘দারুণ বলেছেন।’ বলেই কী যেন ভাবলেন এসিজি। তারপর দীপ্তিমানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনি বলেছিলেন, প্রভাবতীর দু-ছেলে—অজয়েন্দ্র, বিজয়েন্দ্র। দুটো ফ্যামিলি, দুটো অ্যান্টেনা, আর-একটা অ্যান্টেনা ধরে নিচ্ছি প্রভাবতীর। তা হলে চার নম্বরটা কার? চারুবালার?’

‘কী যে বলেন!’ হেসে ফেললেন দীপ্তিমান ‘চারুমার জন্যে আলাদা টিভি! তা ছাড়া, দোতলার গলির দিককার একটা বড় ঘরে মামিমা আর চারুমা একসঙ্গে থাকতেন। তবে ঘরের টিভিটা অন-অফ হত মামিমার কথায়। ওই বাড়তি অ্যান্টেনাটা মামিমার বড় মেয়ে সুনন্দাদির। আপনাকে সেদিন বোধহয় বলিনি—মামিমার মেয়ে-জামাই এ-বাড়িতেই থাকেন। ঘরজামাইগোছের বলতে পারেন। সুনন্দাদির হাজব্যান্ড অমলেশদা কন্সস্ট্রাকশনের কীসব বিজনেস করেন। তবে চারুমা বলতেন, সে বিজনেসে নাকি সবসময়েই লস হত। প্রায়ই নাকি ছেলেদের লুকিয়ে অমলেশদা মামিমার কাছ থেকে টাকা নিতেন। মামিমার সব পুঁজি তো এভাবেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।’

‘চলুন, এবার নীচে যাওয়া যাক। সকলের সঙ্গে কথা বলতে হবে—বিশেষ করে আপনার মামিমার সঙ্গে।’

দীপ্তিমান কাঁচুমাচু মুখ করে তাকালেন এসিজির দিকে ‘মামিমার সঙ্গে কথা বলার সময় আমি সামনে না থাকলে হয় না? উনি একদম শিওর ভাববেন আমি আপনাদের ডেকে এনে অকারণে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট পাকাচ্ছি…।’

এসিজি আলতো হেসে বললেন, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন কেন! উনি কিছুই বলবেন না…।’

ওঁরা তিনজনে নীচে নামছিলেন। দীপ্তিমানের নামতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল। ছাদে রোদে ঘুরে যেটুকু তেতে উঠেছিলেন, বাড়ির ছায়ায় ঢোকামাত্রই ঠান্ডা আমেজ ওঁদের ঘিরে ধরল। ড্যাম্প-ধরা, পুরোনো বাড়ির বাড়তি শীত ওঁরা টের পেলেন।

কোথাও বকবকম করে গোলাপায়রা ডাকছিল। হঠাৎই সে-আওয়াজ ছাপিয়ে ঝগড়ার রুক্ষ চিৎকার ওঁদের কানে এল।

অজয়েন্দ্র কাউকে বলছিলেন, ‘পিসিমণির ওই টাকার আবার শেয়ার কী! পিসিমণি ঠিক করেছিল টাকাটা আমাকেই দিয়ে যাবে—তাই আমার সঙ্গে জয়েন্ট ফিক্সড ডিপোজিট করেছিল। মা বললেই তোদের ভাগ দিতে হবে নাকি!’

উত্তরে কোনও মহিলার চাঁচাছোলা গলা শোনা গেল।

‘অজু, বুঝেশুনে কথা বল। তোর সঙ্গে জয়েন্ট নামে রাখা মানেই সব তোর হয়ে গেল! ওই টাকা দিয়ে পিসিমণির কাজ হবে। ও-টাকার ভাগ আমার দরকার নেই।’

দীপ্তিমান চাপা গলায় বললেন, ‘সুনন্দাদি—অজুদা-বিজুদার বড়দি।’

অজয়েন্দ্র তখন বলছেন, ‘তোর আবার ভাগ দরকার হবে কেন! তুই আর অমলেশদা তো যা পেরেছিস এর মধ্যেই গুছিয়ে নিয়েছিস। ভাবিস, কিছু টের পাই না, জানি না! মা-কে বশ করে আমাদের এগেইনস্টে লেলিয়ে দেওয়া! আমি বিজুকে সব বলব। তারপরে…।’

‘অজু, কী হচ্ছে! চুপ কর বলছি!’ এক বৃদ্ধার তেজী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘সুনন্দা, তুই নিজের ঘরে যা। বাড়িতে এখন বাইরের লোক এসেছে। নিজেদের মধ্যে গোলমাল যা কিছু পরে মেটানো যাবে।’

সঙ্গে-সঙ্গে সব চুপচাপ। ভয় অথবা ভক্তি ছাড়া এ-ধরনের ‘জো হুজুর’ ছেলেমেয়ে আজকের দিনে পাওয়া মুশকিল।

‘বুঝতে পারলেন তো…মামিমা!’ দীপ্তিমান চাপা গলায় আবার বললেন।

এসিজি মাথার চুলের গোছায় দু-বার টান মেরে বললেন, ‘আমাদের প্রভাবতীদেবীর কাছে নিয়ে চলুন।’

দীপ্তিমান চমকে ঘুরে তাকালেন বৃদ্ধ গোয়েন্দার দিকে। বোধহয় ‘দেবী’ শব্দটা ওঁর কানে লেগেছে।

রঙ্গলাল এতক্ষণ গুম মেরে সব শুনছিলেন। হঠাৎই বললেন, ‘লোভ অতি সর্বনাশা/চেঙ্গিস খাঁ, কামাল পাশা।’

এসিজি স্বভাব-কবিবরের দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু কিছু বললেন না। ওঁর স্বভাব-কবিতায় উপমা, প্রতীক ইত্যাদি এতই অদ্ভুত যে, প্রথম-প্রথম শ্রোতারা একটু ধাক্কা খায়।

দীপ্তিমান হাসি চাপছিলেন, ছোট্ট করে বললেন, ‘এ-বাড়িতে লোভ একটা মেজর জায়গা নিয়ে আছে। কারণ, টাকাপয়সা, সম্পত্তি সবকিছুর কন্ট্রোল মামিমার হাতে।’

‘তা হলে সোনার হারটা ছাদ থেকে চুরি গেল না কেন?’ রঙ্গলাল এসিজিকে প্রশ্ন করলেন।

‘ওটাই তো আমার আসল খটকা।’ আনমনাভাবে অশোকচন্দ্র বললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। চশমাটা নাকের ওপর ঠিক করে বসালেন।

ওঁরা প্রভাবতীর ঘরে ঢুকলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওষুধ আর ফিনাইলের হালকা একটা গন্ধ সকলের নাক ছুঁয়ে গেল।

বৃদ্ধা একটা লম্বা সোফায় বসে ছিলেন। সামনে দুটো টেবিল। তাতে দুটো ছোট রেডিয়ো, কিছু ম্যাগাজিন, বইপত্তর, আর একটা দম দেওয়া কলিংবেল।

ঘরটা মাপে বেশ বড়। মেঝেতে পুরোনো দিনের মার্বেল পাথর। দু-প্রান্তে দুটো খাট। দেখে বোঝা যায়, একটা প্রভাবতীর—অন্যটায় চারুবালা শুতেন। দুটো আলমারি। একটা ছোট টিভি। আর একটা ড্রেসিং টেবিল।

প্রভাবতীর রোগা শরীরে সাদা শাল জড়ানো। চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা। মাথায় ঘোমটা। সামনের দিকের চুলে এখনও কালো ছোপ রয়েছে। হাতে সরু-সরু দু-গাছা চুড়ি। আর ডানহাতে একটা লাঠি।

ঘরে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে একপাশে দাঁড়িয়েছিল। এসিজি অনুমানে বুঝলেন, আরতি।

দীপ্তিমান পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং দেওয়ামাত্রই প্রভাবতী ওঁকে অনেকটা হুকুমের সুরে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পারো। আমাদের কথাবার্তার সময় তোমার থাকার দরকার নেই।’ তারপর আরতির দিকে ফিরে : ‘ওদিকের জানলাটা খুলে দে। আর টেবিলের ওই ঘটি থেকে আমাকে আধগ্লাস জল দে।’

প্রভাবতীর কাছাকাছি চারুবালার খাটের কিনারায় এসিজিরা বসেছিলেন। এসিজি সূক্ষ্ম নজরে রুগ্ন ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধাকে দেখছিলেন। সারা মুখে অহঙ্কারের ছাপ। এমনকী বলিরেখাগুলোও সেই অহঙ্কারী ঢঙে সামিল হয়েছে।

এসিজির গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেটের জন্য। কিন্তু এখানে সিগারেট মানায় না। একটু কেশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিসেস রায়, দীপ্তিমানবাবু আমাদের সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি।’

‘তার মানে! কী বলতে চান আপনি! আমাদের ফ্যামিলির কথা বাইরের কোন এক দু-পয়সার জ্যোতিষীর সামনে বলতে হবে!’ ঘাড় কাত করে ওপরওয়ালার ভঙ্গিতে এসিজির দিকে দেখলেন প্রভাবতী : ‘আপনার কাছে ও জরুরি হতে পারে, আমার কাছে নয়।’

এরপর আর কোনও কথা চলে না।

দীপ্তিমান মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এসিজির দিকে ‘আপনাকে বলেছিলাম না!’ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।

‘চারুবালা কীভাবে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়?’ এসিজি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।

‘সবাই যা জানে তাই—’ আরতির দেওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিলেন ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’ তারপর আরতিকে : ‘তোকে আধগ্লাস বললাম, এতটা দিলি! যা বাকি জলটা ঘটিতে ঢেলে রাখ। ঘটিটা ঠিকমতো ঢাকা দিবি। কোনও কাজের একটা ছিরি নেই।’

আরতি কোনও জবাব না দিয়ে হুকুম তামিল করল।

‘যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয় তবে আর কীভাবে চারুবালা মারা যেতে পারেন?’

বিরক্তির একটা শব্দ করে বৃদ্ধা বললেন, ‘সুইসাইড হতে পারে। পাগলের খেয়াল—কী করে বলব বলুন!’

‘খুনও হতে পারে।’

‘তার মানে! খুনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে! তখন তো ছাদে আর কেউ যায়নি!’

‘আপনি কী করে জানলেন?’ এসিজি হেসে প্রশ্ন করলেন। তারপর ‘আপনি শুধু আপনারটা বলতে পারেন।’

‘না, আমি জানি। দিদি যখন ছাদে যায়—ছাদ থেকে পড়ে যায়—তখন এ-ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি কতকগুলো জরুরি কথা বলছিলাম। অমলেশ বাড়ি ছিল না। আপনারা যেখানে বসে আছেন, অজু-বিজু, ওদের দু-বউ, ওখানে বসেছিল। আর সুনন্দা আমার বিছানায়। আরতি নীচে কলতলায় গিয়েছিল। এরপর বাকি রইল বাচ্চারা। ওরা নিশ্চয়ই তাদের ”দিদু”কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি!’

অশোকচন্দ্রের মনে হল তিনি কোনও জজসাহেবের এজলাসে বসে আছেন। প্রভাবতীর কথা শুনে মনে হল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি যেন আগেভাগেই জেনে তৈরি করে নিয়েছেন।

রঙ্গলাল এসিজিকে দেখছিলেন। থিঙ্কিং মেশিনকে খানিকটা যেন নাজেহাল দিশেহারা লাগছে।

‘আপনার দিদির হাতে কাপড় ছড়ানোর একটা ক্লিপ ছিল। উনি কি তখন কাপড় ছড়াতে গিয়েছিলেন, না তুলতে গিয়েছিলেন?’

‘পাগলের কখন কী খেয়াল হয়, আমি কী করে জানব!’

এসিজি দু-হাতের দশ আঙুল মাথায় ঠেকালেন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘পুলিশ এসে ছাদে কিন্তু কোনও কাপড় পায়নি।’

‘বললাম তো, পাগলের খেয়াল! হয়তো ক্লিপ হাতে এমনই ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল।’

‘ওঁর সোনার হারের ব্যাপারটা জানেন তো!’

‘জানাজানির আবার কী আছে! ওটা হয়তো দিদির কোমরেই বরাবর গোঁজা ছিল—ছাদে কোনওভাবে খসে পড়েছে।’

‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চারুবালা কারও একটা গোপন অন্যায় দেখে ফেলেছিলেন। সেটার কথা উনি মাঝে-মাঝেই বলতেন। আপনি কখনও শুনেছেন?’

‘না তো!’ তারপর আরতিকে : ‘বেলা হয়ে গেছে। তুই গিয়ে আমার স্নানের গরম জল বসিয়ে দে। কালকের মতো বেশি গরম করিস না।’

আরতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

‘ভালো করে মনে করে দেখুন, মিসেস রায়। কোনও কিছু একটা জেনে ফেলার ব্যাপারে…।’

‘আপনি কার থেকে এসব আজেবাজে কথা শুনেছেন বলুন তো!’

এসিজি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। এও বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই প্রভাবতীর কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন।

প্রভাবতী সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োর এফ. এম. চ্যানেল চালিয়ে শুনতে শুরু করলেন। গলা তুলে বললেন, ‘যাওয়ার আগে একটু চা-টা খেয়ে যাবেন—।’

একতলার দিকে নেমে-যাওয়া সিঁড়ির পাশে দীপ্তিমান অপাংক্তেয়র মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁর কাছে এসে বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। এবারে ছোটভাই আর দু-ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব।’

‘হ্যাঁ, ও-ঘরে চলুন। বিজুদার ঘরে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে।’

বিজয়েন্দ্রর ঘরে বসে চা খেতে-খেতে কথাবার্তা সেরে নিলেন এসিজি।

আলোচনাটা টাকাপয়সা আর বিষয়-সম্পত্তির দিকে চলে গেল।

এই বাড়িটা মনোহর রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে সেটা আইনমাফিক গিফট করে যান। টাকাপয়সার সবরকম দায়িত্বও প্রভাবতীর ওপরে। ফলে বিরাট বিষয়আশয়ের মালিক হয়েও ছেলেমেয়েরা মালিক নন। সবটাই মা-নির্ভর। প্রভাবতী যাঁকে পছন্দ করেন তাঁরই বাড়বাড়ন্ত। যেমন, এখন সুনন্দা আর অমলেশ প্রভাবতীর দু-নয়নের মণি। কিছুদিন পরই হয়তো অজয়েন্দ্র কিংবা বিজয়েন্দ্রর পালা আসবে। কলকাতার আশেপাশে জমিজিরেত অনেক ছিল। কিন্তু তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির টাকা প্রভাবতী অমলেশকে দিয়েছেন—কন্সট্রাকশানের ব্যবসা দাঁড় করাতে।

এসিজি বুঝলেন, মা-কে নিয়ে দু-ছেলে আর তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ কিছু করারও নেই—কারণ, প্রভাবতীই এ-বাড়িতে শেষ কথা।

এরপর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলে উলটো ছবি পাওয়া গেল। বড় মেয়ে মায়ের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। সারা জীবন ধরে প্রভাবতী যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত বললেন সুনন্দা। মায়ের স্নেহ-মমতা-দয়া সম্পর্কেও এত বলতে লাগলেন যে, এসিজির মনে হচ্ছিল তিনি ভগিনী নিবেদিতা অথবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী শুনছেন।

অমলেশ বাড়িতে নেই। তিনি দু-দিন আগে ব্যবসার কাজে ভাইজাগ গেছেন—পরশু ফিরে আসবেন। তবে অমলেশ থাকলেও বোধহয় কোনও লাভ হত না। কারণ, সুনন্দার কথারই প্রতিধ্বনি বোধহয় শুনতে পাওয়া যেত।

এসিজির মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। চারুবালা ছাদে গেলেন কাপড় ছড়াতে অথবা কাপড় তুলতে। অথচ ছাদে কোনও কাপড় পাওয়া গেল না। দীপ্তিমান, অজয়েন্দ্র—দুজনেই বলেছেন চারুবালা সাধারণত ছাদে যেতেন না। তা হলে সেদিন হঠাৎ গেলেন কেন! অন্যান্য দিন ওঁর কাপড়খানা কে ছড়াত, কে তুলত? নিশ্চয়ই আরতি! আরতির সঙ্গে একবার আলাদা কথা বলা দরকার।

বিজয়েন্দ্রকে ডেকে এসিজি বললেন, ‘বিজয়বাবু, আরতিকে একবার ডেকে দেবেন? নীচে বসবার ঘরে ওর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব। তবে কেয়ারফুলি ডাকবেন—আপনার মা যেন টের না পান। টের পেলেই হয়তো রাগারাগি করবেন…।’

বিজয়েন্দ্র ওঁর স্ত্রী তুলিকাকে ডেকে চাপা গলায় কী যেন বললেন। তুলিকা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

‘আপনারা নীচে যান—ও আসছে। তবে বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখবেন না। একটু পরেই মা চান করতে যাবে। তখন আরতিকে ডেকে না পেলে পরে তুলোধোনা করে ছাড়বেন।’ কথা শেষ করে অদ্ভুত হাসলেন বিজয়েন্দ্র।

নীচের বসবার ঘরে ওঁরা তিনজন সবে গুছিয়ে বসেছেন, আরতি দরজায় এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা।

‘আমায় ডেকেছেন, দাদাবাবু?’

‘তুমি তো জানো আমরা পুলিশের লোক—’ গম্ভীর চালে কথা শুরু করে এখন একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। গায়ের শালটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলে পড়েছিল, সেটা কাঁধের দিকে টেনে নিলেন।

আরতির শ্যামলা মুখ পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, জানি—।’

‘তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। একদম ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। উলটোপালটা চালাকি করলে…।’

‘মা কালীর দিব্যি—সত্যি বই মিথ্যে কইব না।’

‘চারুবালা—মানে, তোমার পিসিমার শাড়ি-জামাকাপড় রোজ কে ছাদে শুকোতে দিয়ে আসত, আর কে তুলে নিয়ে আসত?’

‘আ-আমি?’

‘অন্য কেউ কখনও যেত না?’

‘না। তবে কিছুদিন হল মা মাঝে-মাঝে বড়দিকে পাঠাতেন। কখনও বা পিসিমাকে পাঠাতেন।’

‘পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন পিসিমার কাপড় কে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল?’

একটু চিন্তা করে আরতি বলল, ‘বড়দি।’

‘শনিবার, পিসিমা যখন ছাদ ভেঙে পড়ে যান, তখন সত্যি-সত্যি বড়দি, দাদাবাবুরা, বউদিরা—সবাই মায়ের ঘরে ছিল?’

আবার সময় নিল আরতি। তারপর ‘হ্যাঁ। তবে তারপরই বড়দি আবার ছাদের দিকে গেছল। আমরা তখন বারান্দা দিয়ে গলিতে দেখচি কী পড়ল, কীসের ওরকম আওয়াজ হল।’

‘পিসিমার গলার চেনটা চুরি হয়েছিল তুমি জানো?’

‘মা কালীর দিব্যি, ও-হার আমি নিইনি, দাদাবাবু।’ আরতি আর একটু হলেই এসিজির পায়ে পড়ে আর কী!

‘না, না—তুমি নাওনি আমরা জানি। তবে হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়ে থাকবে…। তারপর—পিসিমা মারা যাওয়ার দিন—ছাদে পাওয়া গেছে।’

আরতি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

‘হারটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তুমি জানো?’ আবার প্রশ্ন করলেন এসিজি।

‘মনে হয় হারায়নি কোথাও। হয়তো মায়ের কাছটিতেই রেখে দিয়ে পিসিমা পাগলামির খেয়ালে ভুলে গেছে।’

এসিজির ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একবার দীপ্তিমানের দিকে দেখলেন। দুজনে চোখাচোখি হল।

‘হারটা সত্যি-সত্যি হারালে মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। দোকান-ফেরত সামান্য চার আনা আট আনার গণ্ডগোল হলেই আমায় যেরকম মুখ করে!’

এসিজির কোঁচকানো ভুরু সোজা হচ্ছিল না। মনে-মনে নতুন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, চারুবালাকে শুধু নিয়তির অদৃশ্য হাত পিছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, তারও পিছনে হয়তো মানুষেরও হাত ছিল।

এসিজি আনমনা হয়ে গেলেন। মাথার পিছনে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মারতে শুরু করলেন।

তারপর হঠাৎই আরতিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। আমার সঙ্গে যেসব কথা হল কাউকে বলবে না। বললে তোমারই বিপদ হবে।’

আরতি ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল।

কাজের লোকরা সত্যি-সত্যিই কাজের লোক। এটাকে কি যমক অলঙ্কার বলা চলে? আপনমনেই হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘গোস্বামী রঙ্গলাল / বাদ বাকিটা হবে কাল।’

‘কী বুঝলেন, ডক্টর গুপ্ত?’ দীপ্তিমান ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন।

‘মোটামুটি বোধহয় বুঝতে পারছি। আপনার সন্দেহ সত্যি হলেও হতে পারে। কাল আমি আর রঙ্গলালবাবু এ-বাড়িতে আর-একবার আসব। কী, রঙ্গলালবাবু, সময় হবে তো আপনার?’

আকর্ণ হাসলেন রঙ্গলাল ‘প্রশ্নটি অতি অবান্তরম/সময় হইবে সুনিশ্চিতম।’

দিনের আলোয় যে-বাড়িটাকে জীর্ণ অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল, রাতের আঁধারে সেটাকে ভুতুড়ে বলে মনে হল।

অশোকচন্দ্র ও রঙ্গলাল বাড়িতে ঢুকতেই সুনন্দার সঙ্গে দেখা হল। টেলিফোনে আগাম বলা ছিল। সুতরাং অপছন্দ মুখে সুনন্দা ওঁদের দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এসিজি টিভি চলার শব্দ পাচ্ছিলেন, বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রভাবতীর ঘরে ঢুকতেই টিভির শব্দ ওঁদের কানে ধাক্কা মারল।

গতকালের গন্ধটা আরও উগ্রভাবে এসিজির নাকে এল।

প্রভাবতী সম্রাজ্ঞীর ঢঙে সেজেগুজে সোফায় বসে ছিলেন। শরীর টান-টান। মুখে প্রসাধনের সামান্য আস্তর।

আরতি ওঁর পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিল। এসিজিদের দেখেই উঠে দাঁড়াল।

প্রভাবতী ওকে বললেন, ‘টিভির আওয়াজটা একদম কমিয়ে দে।’

হুকুম তামিল হল। টিভিতে মূকাভিনয় শুরু হল।

‘বলুন, ডক্টর গুপ্ত, কী ব্যাপারে দেখা করতে চেয়েছেন?’ প্রভাবতী মাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই এসিজি রঙ্গলালকে নিয়ে চারুবালার খাটের কিনারায় বসে পড়লেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা ছিল।’

সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম হল : ‘আরতি, তুই এখন যা। আমি ডাকলে তবে আসবি।’

আরতি তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে গেল। যেন পালিয়ে বাঁচল।

সুনন্দাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি ওঁকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর কাপড় ছড়াতে ছাদে গিয়েছিলেন? পরে, পিসিমা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও আপনি আবার ছাদে গিয়েছিলেন। অথচ তখন তো সকলের গলির দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। এটা একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’

সুনন্দা দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকালেন।

প্রভাবতী স্থির গলায় বললেন, ‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’

সুনন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এসিজির দিকে তাকিয়ে বোকা-বোকা হেসে চটপট চলে গেলেন।

‘যা বলার আমাকে বলুন, ডক্টর গুপ্ত। ওরা সব ছেলেমানুষ—।’

প্রভাবতীর গলায় সামান্য চ্যালেঞ্জের ছোঁওয়া ছিল। ঘরের জোড়া টিউব লাইটের আলোয় ওঁর বলিরেখাগুলো নিষ্ঠুর দেখাল।

এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পে হয়তো অনেক ফাঁকফোকর থাকবে—সেগুলো আপনাকেই ভরাট করতে হবে…।’

প্রভাবতীর মুখ পাথরের মতো। চোখ টিভির দিকে।

কাল সারাটা রাত ধরে বহু ভেবেছেন বৃদ্ধ হুনুর। মনে-মনে এমন একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন যেটা প্রতিটি সূত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সোনার হার, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, সুনন্দার ছাদে যাতায়াত—আর, সবশেষে চারুবালার নিয়তি। এখন সেই গল্পই শোনাতে এসেছেন প্রভাবতীকে।

সামান্য কেশে নিয়ে এসিজি বলতে শুরু করলেন ‘আপনি একটা চান্স নিয়েছিলেন, মিসেস রায়। চারুবালাকে আপনি নানান ছল-ছুতোয় ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গাটায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁর ভেজা কাপড় ইদানীং ওই বিপজ্জনক জায়গাতেই ছড়ানো হত। কে ছড়াতেন জানি না। তবে আপনি নন। সুনন্দা হতে পারে, আরতি হতে পারে। হয়তো ছড়ানোর জন্যে ওরা লাঠি বা অন্য কিছু ব্যবহার করত—যাতে ওই লক্ষ্মণের গণ্ডির ভেতরে ঢুকে পড়তে না হয়। তা ছাড়া, আমি দেখেছি, দড়িটা লাঠি দিয়ে টেনে এনেও নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় ছড়ানো যায়, ক্লিপ আঁটা যায়। আপনি সেই শনিবার চারুবালাকে বকাঝকা করে ওঁর শুকনো কাপড় তুলে আনতে পাঠিয়েছিলেন—আমার সেরকমই মনে হয়।

‘কিন্তু চারুবালা ছিলেন কিছুটা ছিটগ্রস্ত। তাই সবসময় হয়তো ছাদে গিয়েও ওই জায়গাটায় পা দিতেন না। হয়তো সাদা দাগটা ওঁকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিত—উনি সাবধান হয়ে যেতেন।

‘আপনি তখন খানিকটা সমস্যায় পড়লেন। তখন সোনার হারের টোপটা আপনার মাথায় এল। ওটা আপনি চারুবালার কাছ থেকে কোনও অজুহাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গায় হারটা রেখে দিয়ে এলেন। না, আপনি নন—আপনার হয়ে অন্য কেউ। আপনি যে সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না তা আমি জানি।

‘এইবার কাজ হল। চারুবালা ছাদে গেলেন। সোনার চেনটা দেখতে পেলেন। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। উনি শাড়ি থেকে ক্লিপটা আগে খুলেছেন, নাকি চেনটা আগে কুড়িয়ে নিয়েছেন কে জানে! চেনটা আগে নিয়ে থাকলে ওটা হয়তো আবার ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ছাদেই। কিন্তু ক্লিপটা হাতে থেকে গিয়েছিল…।’

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি। তারপর আবার খেই ধরলেন : ‘নিয়তি তার কাজ করল। চারুবালা পড়ে গেলেন। আর আপনার এ-ঘর থেকে সুনন্দা সঙ্গে-সঙ্গে ছাদে চলে গেল পিসিমণির শাড়িটা তুলে আনতে…।’

এসিজি থামলেন।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রভাবতী। টিভির দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁর দু-চোখ থেকে ভাঙা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। টিভির আলোয় জলের রেখা চকচক করছিল।

চাপা খসখসে গলায় বললেন, ‘হারটা আমি দিদির কাছ থেকে নিইনি। দিদিই আমাকে ওটা গলা থেকে খুলে রাখতে দিয়েছিল—পরে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য চাইলে আমিও অস্বীকার করতাম।

‘আপনার একটা গোপন অন্যায় চারুবালা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা কী আমি আঁচ করতে পারিনি—।’

নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক গলায় প্রভাবতী বললেন, ‘এই বাড়িটা আমি সুনন্দার নামে উইল করে গেছি। অমলেশ যেদিন কাগজপত্র সই করিয়ে নেয় দিদি সেদিন দেখেছিল। তারপর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারত। বলত, ”এ তুমি ঠিক করলা না। অজু-বিজু ভিটা ছাইরা কই যাইব!” কিন্তু কী করব! সুনন্দা-অমলেশের জন্যে যতটা আমার মন টানে অজু-বিজুর জন্যে ততটা না। ওরা অনেক পেয়েছে—।’

চোখের জল তখনও গড়িয়ে পড়ছিল—।

প্রভাবতীকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে তারপর এসিজি বললেন, ‘মিসেস রায়, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? আপনি দু-দুটো অন্যায় করেছেন—তার মধ্যে একটা এখনও শুধরে নেওয়ার সময় আছে। আমি হলে শুধরে নিতাম…।’

‘আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়েই প্রশ্ন করলেন।

‘না—’ হেসে মাথা নাড়লেন এসিজি ‘প্রমাণ নেই। প্রমাণই কি সব! একটা কথা আপনাকে বলি। ঈশ্বর কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ—এইসব পাংচুয়েশান মার্ক আমাদের হাতে দেন—তবে দাঁড়িটা নিজের হাতে রাখেন। সময় হলেই আমাদের জীবনে দাঁড়ি টেনে দেন। সেই দাঁড়িটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে ঈশ্বরকে অসম্মান করা। আপনি সেটাই করেছেন। প্রমাণ না থাকুক, যে-অন্যায়টা এখনও শোধরানো যায় আপনি সেটা অন্তত শুধরে নিন…।’

‘দিদিকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করব…সুনন্দাদের জন্যে পাগল-পাগল টান। কেন এমন টান কে জানে! আমার জন্যে দিদি…ছিল শুকতারা, সন্ধ্যাতারা হয়ে গেল। আমার জন্যে…।’

বৃদ্ধার মুখ ভেঙেচুরে গেল। জলভরা কাতর চোখে এসিজির দিকে তাকালেন তিনি। কিছু একটা বলতে চাইলেন।

এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’

একজন সর্বস্বান্ত রানিকে তাঁর মেকি সিংহাসনে বসিয়ে রেখে এসিজি আর রঙ্গলাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

টিভিতে তখনও মূকাভিনয় চলছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *