গ্রামের নাম কাঁকনডুবি : 03
অনেক দিন থেকে নানি ঘ্যান ঘ্যান করছে যে বাদলা শুরু হওয়ার আগে আমি যেন কিছু লাকড়ি কুড়িয়ে আনি। বাড়ির পেছনে বিশাল জংলা জায়গা, সেখানে হাজার রকম গাছ, লতাপাতা। একদিন সেগুলো ঘাটাঘাটি করলেই অনেক শুকনো কাঠ হয়ে যায়। আমি সেখান থেকে টেনে টেনে অনেকগুলো শুকনো গাছ উঠানে এনেছি, এখন কুড়াল দিয়ে ছোট ছোট টুকরো করলেই নানি তার বাদলা দিন পার করে ফেলতে পারবে।
আমি মাত্র টুকরো করতে শুরু করেছি তখন মামুন ছুটতে ছুটতে হাজির হলো, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, মিলিটারি আসতেছে।
আমি চমকে উঠে বললাম, মিলিটারি?
মামুন মাথা নাড়ল। তার মুখ ফ্যাকাসে, চোখে আতঙ্ক। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন কোনখানে আছে?
বড় সড়কে।
কই যাইব?
জানি না, মনে হয় এই দিকেই আসতেছে।
আমি কুড়ালটা রেখে নানিকে বললাম, নানি, আমি গেলাম।
কই গেলি?
মিলিটারি দেখতে। মিলিটারি আসতেছে।
নানি চোখ কপালে তুলে বলল, মিলিটারি আসতেছে আর তুই তাদের দেখতে যাইতাছস? মিলিটারি কি একটা দেখনের জিনিস? খবরদার।
নানি চিৎকার করতে লাগল আর আমি তার মাঝে মামুনকে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। গ্রামের সড়কটা ধরে ছুটতে ছুটতে গ্রামের কিনারায় ধানক্ষেতের কাছে দাঁড়ালাম। বহু দূরে বড় সড়কটা গঞ্জের দিকে গিয়েছে। সেই সড়কে আবছা আবছা একটা মিলিটারির দলকে দেখা গেল। তারা এদিকে আসছে। পেছনে কয়েকটা বাড়ি থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে, সেখানে মনে হয় আগুন দিয়েছে।
আরো অনেকেই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে, শুকনো মুখে দূরে তাকিয়ে আছে। একজন জিজ্ঞেস করল, কোন দিকে যায়?
আরেকজন উত্তর দিল, মনে তো হয় এদিকেই আসতেছে।
এদিকে কেন? আমাগো গেরামে কী আছে?
যেখানে আওয়ামী লীগ, যেখানে হিন্দু, যেখানে মুক্তিবাহিনী, সেখানেই মিলিটারি।
আওয়ামী লীগ কি শরীলে লেখা থাকে? ভোটের সময় তো সবাই শেখ সাহেবের নৌকায় ভোট দিল। তাহলে তো পুরা দেশই আওয়ামী লীগ।
আমরা লক্ষ্য করি নাই, কখন জানি ফালতু মতি এসে দাঁড়িয়েছে, সে বলল, বিপদ ডেকে আনলে এই রকমই হয়।
কিসের বিপদ?
আরে এই চ্যাংড়া মাস্টার দুই-চারটা ফুটুসফাটুস করল মনে নাই? চ্যাংড়া মাস্টার এই গেরামে থাকত না?
তারে ধরতে আসতেছে?
কবে কেডা? খবর কী আর যায় নাই?
ঠিক তখন দূরে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। পরপর বেশ কয়েকটা গুলি হলো। বয়স্ক একজন হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, ইয়া মাবুদ! কারে জানি মারল!
মতি বলল, গেরামটারে রক্ষা করা দরকার।
কেমনে রক্ষা করবা?
দেখি বাপজানরে জিজ্ঞেস করি। তখন আমার মনে পড়ল ফালতু মতির বাবা লতিফুর রহমান মুসলিম লীগ করে। আগে চেয়ারম্যান ছিল, তাই গ্রামের মানুষ তাকে লতিফ চেয়ারম্যান ডাকে। মতির অবশ্যি তার বাবার কাছে যাওয়ার দরকার হলো না, দেখলাম লতিফ চেয়ারম্যান নিজেই আসছে। এই গরমের মাঝে একটা কালো আচকান পরেছে, মাথায় জিন্নাহ ক্যাপ। তার সাথে আরো কয়েকজন মুরব্বি, তারাও সেজেগুজে আছে, মাথায় টুপি, চোখে সুরমা। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো তাদের একজনের হাতে লম্বা বাঁশ, সেই বাঁশের আগায় পাকিস্তানের পতাকা। কয়দিন আগে সারা দেশে যত পাকিস্তানের পতাকা ছিল দেশের মানুষ সব পা দিয়ে মাড়িয়ে পুড়িয়ে শেষ করেছে, লতিফ চেয়ারম্যান যে তার পাকিস্তানের পতাকাটা বাঁচিয়ে রেখেছে কে জানত।
আমরা অবাক হয়ে এই দলটার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারা ধান ক্ষেতের পাশে আমাদের কাছে দাঁড়াল। আমাদের দিকে এক নজর দেখে লতিফ চেয়ারম্যান গম্ভীর গলায় বলল, পোলাপান এইখানে কী করো? এইটা রং তামাশা দেখার বিষয় না। সবাই বাড়ি যাও। বাড়ি গিয়ে আল্লাহর নাম নাও।
আমরা একটু সরে দাঁড়ালাম কিন্তু চলে গেলাম না।
লতিফ চেয়ারম্যান উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাদের যাদের মাথায় টুপি নাই তারা বাড়ি যান। বাড়ি গিয়ে মেয়ে-ছেলেদের সাবধান করেন। ভুলেও যেন ঘর থেকে বের না হয়।
এবারে ভয় পেয়ে বেশ কয়েকজন সরে যেতে শুরু করল। লতিফ চেয়ারম্যান এবারে তার ছেলে মতির দিকে তাকিয়ে বলল, মইত্যা? তুই এইখানে কী করস? বাড়ি যা।
মতি বলল, আমি থাকি বাপজান।
না, বাড়ি যা।
তোমার সাথে থাকলে আমারে কিছু করব না বাবা।
মিলিটারির মেজাজ-মর্জির কুনো ঠিক নাই।
তা ছাড়া গফুর ভাই আমারে চিনে–
লতিফ চেয়ারম্যান ঠাণ্ডা চোখে তার ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তাহলে থাক।
মিলিটারির দলটাকে এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। যদি কোথাও না থামে তাহলে কিছুক্ষণের মাঝে এখানে হাজির হবে। আমার বুকটা কেমন জানি ধক ধক করতে থাকে। লতিফ চেয়ারম্যান আবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এই পোলাপান, যা, সবাই বাড়ি যা।
অন্যেরাও আমাদের হাত নেড়ে তাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। তখন টুপি মাথায় অল্প কয়জন মানুষ ছাড়া অন্য সবাই সরে যেতে শুরু করল। আমরাও সরে এলাম কিন্তু একেবারে চলে গেলাম না। একটু দূরে গিয়ে একটা কাঁঠালগাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলাম।
লতিফ চেয়ারম্যান তখন ঢাউস পাকিস্তানের ফ্ল্যাগটা হাতে নিয়ে ডানে-বামে নাড়তে লাগল, তারপর জোরে জোরে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলে চিৎকার করতে লাগল। দেখলাম মতিও চিৎকারে যোগ দিয়েছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই মিলিটারির দলটা হাজির হলো। খাকি পোশাক, মাথায় হেলমেট, পায়ে কালো বুট। সবার হাতে ভয়ংকর দেখতে অস্ত্র। বুকের মাঝে গুলির বেল্ট। মিলিটারির দলের সাথে দুই-একজন বাঙালি আছে। একজনের মাথায় টুপি, আরেকজন টুপি ছাড়া তবে গালে চাপ দাড়ি।
মিলিটারির দলটা লতিফ চেয়ারম্যানের দলটার কাছে দাঁড়িয়ে গেল। লতিফ চেয়ারম্যান তখন হাত কচলে কাঁচুমাচু করে মাথা নিচু করে কিছু একটা বলল, এত দূর থেকে কী বলল শুনতে পেলাম না। শুনলেও নিশ্চয়ই বুঝতে পারতাম না, নিশ্চয়ই উর্দুতে কিছু একটা বলেছে।
মিলিটারিটা কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, দূর থেকে শুধু ইন্দু শব্দটা শুনতে পেলাম, মিলিটারিরা হিন্দুকে ইন্দু বলে। লতিফ চেয়ারম্যান হাত দিয়ে হিন্দুপাড়ার দিকে দেখাল, তখন মতিও কিছু একটা বলার চেষ্টা। করল, আর হঠাৎ করে একটা মিলিটারি জানি কেমন খেপে উঠে খপ করে মতির চুল ধরে কাছে টেনে নিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, তু ইন্দু?
মিলিটারির গলার স্বর মোটা, আমরা এত দূর থেকেও স্পষ্ট শুনতে পেলাম। হঠাৎ করে আরেকটা মিলিটারি তার রাইফেলটা মতির গলায় ধরে কী যেন বলল, আমার মনে হলো এক্ষুনি গুলি করে দেবে আর মতির মাথাটা আলগা হয়ে উড়ে যাবে।
মতি দুই হাত নেড়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে, আমরা আবছা আবছা শুনলাম, মতি বলছে, হাম মুসলমান। হাম সাচ্চা মুসলমান। হাম পাকিস্তানি আল্লাহর কসম লাগতা হয়।
মিলিটারিগুলো মতির কথা বিশ্বাস করল না। তারপর যা একটা কাজ করল, সেটা বলার মতো না। টান দিয়ে ফালতু মতির লুঙিটা খুলে তাকে ন্যাংটা করে ফেলল। আমরা বুঝতে পারলাম তার খতনা হয়েছে কি না দেখছে। মতি মুসলমান তার প্রমাণ পাবার পর তার গালে একটা চড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, ভাগো হিয়াসে। বুরবাক।
মতি তখন তার লুঙিটা কোনো মতে কোমরে প্যাঁচিয়ে ছুটতে ছুটতে আমাদের সামনে দিয়ে গ্রামের দিকে চলে গেল। আমরা মাথা নিচু করে বসেছিলাম বলে আমাদের দেখতে পেল না।
মিলিটারিগুলো কিছুক্ষণ অন্যদের সাথে কথা বলে আবার হাঁটতে থাকে, কোথায় যাচ্ছে আমরা জানি না। যেদিকে হাঁটছে সেদিকে আমাদের স্কুল, আমাদের স্কুলে নিশ্চয়ই যাচ্ছে না। আমি আর মামুন ফিসফিস করে কথা বলে ঠিক করলাম আমরা মিলিটারিগুলোর পেছন পেছন গিয়ে দেখব ওরা কোথায় যায়, কী করে। যখন খুব সাবধানে উঠে দাঁড়ালাম হঠাৎ কর্কশ গুলির শব্দে পুরো এলাকাটা কেঁপে উঠল, সাথে সাথে মানুষের আর্তনাদ শুনতে পেলাম। মিলিটারিগুলোও বিজাতীয় ভাষায় কী যেন চিৎকার করতে লাগল।
ভয়ে আমাদের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল, মামুন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, সর্বনাশ! এখন কী হবে? কী হবে?
আমি বললাম, আয় আমরা পালাই। মিলিটারি গুলি করে কাকে যেন মেরে ফেলেছে।
আমরা খুব সাবধানে গ্রামের পথ ধরে ছুটতে ছুটতে বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। গ্রামের বাড়িগুলোতে কোনো শব্দ নেই, সবাই নিঃশব্দে ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে আছে। মনে হয় গরু-ছাগল, কুকুর-বেড়ালও বুঝতে পারছে এখন খুব বিপদ, তাই সেগুলোও কোনো শব্দ করছে না। আমাদেরকে দেখে একটা বাড়ি থেকে কয়েকজন মানুষ বের হয়ে এল, জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? কারে গুলি করছে?
আমরা মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি না।
মেরে ফেলছে?
মনে হয়। অনেক জোরে চিৎকার শুনলাম। আমার সারা শরীর কাঁপছে, কথা বলতে গিয়ে আমার গলা ভেঙে গেল। মামুনের গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না, সে ফাঁস ফাস করে কাঁদতে আরম্ভ করেছে।
বুড়ো মতন একজন মানুষ বলল, তোমাদের যাওয়া ঠিক হয় নাই। বাড়ি যাও। আল্লাহ মেহেরবান।
আমি আর মামুন আবার বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলাম। শুধু মনে হচ্ছিল আমাদের পেছন দিয়ে মিলিটারি বুঝি ছুটতে ছুটতে আসছে গুলি করার জন্য।
অন্য যেকোনো সময় হলে নানি আমার ওপর খুব রাগ করত, মনে হয় কানে ধরে পিঠে দুইটা চড়-চাপড় দিত কিন্তু আজকে কিছুই করল না। নানি তার শুকনো আঙুল দিয়ে আমাকে ধরে রাখল, আর ফিসফিস করে বলতে লাগল, খোদা তুমি মেহেরবান। খোদা মেহেরবান।
মিলিটারিগুলো দুপুরবেলা আবার সড়ক ধরে হেঁটে হেঁটে ফিরে গেল। তারা কেন এসেছিল আর কেন ফিরে গেল, আমরা কিছু বুঝতে পারলাম না। মিলিটারিগুলো চলে গেছে সেটা নিশ্চিত হবার পর সবাই বাড়ি থেকে বের হয়েছে। ততক্ষণে সারা গ্রামে খবর ছড়িয়ে গেছে মাস্টারবাড়ির সাদাসিধে কামলা বগাকে মিলিটারি গুলি করে মেরে ফেলেছে। সাদাসিধে মানুষ, সড়কের ধারে গরুটা বেঁধে রাখতে গিয়েছিল, মিলিটারি দেখে ভয়ে দৌড় দিয়েছে, মিলিটারি সাথে সাথে গুলি করে তাকে মেরে ফেলেছে।
আমরা সবাই বগাকে দেখতে গেলাম, সড়কের পাশে উবু হয়ে পড়ে আছে ময়লা গেঞ্জিটা রক্তে ভিজে কালচে লাল হয়ে আছে। চোখগুলো খোলা, মনে হয় একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টি কী ভয়ংকর! মনে হয় যেন এক্ষুনি মাথা ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকাবে। বগাকে আমরা কতবার গ্রামের সড়ক দিয়ে গরু আনতে-নিতে দেখেছি, কখনো তাকে দেখে আমরা ভয় পাই নাই। কিন্তু এই সড়কের পাশে তাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে কেমন জানি ভয় লাগতে লাগল। গ্রামের মানুষ যখন ধরাধরি করে বগার শরীরটা তুলে আনছে তখন আমি বাড়ি চলে এলাম।
রাতে আমি ভালো করে খেতে পারলাম না। সারা রাত ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখে চমকে চমকে উঠতে লাগলাম।
দুই দিন পর বলাই কাকুর স্টলে মতির সাথে দেখা হলো। মতি খুব তৃপ্তি করে চা খেতে খেতে অন্যদের সাথে কথা বলছে, মিলিটারির কী খান্দানি চেহারা। গায়ের রং একেবারে আপেলের মতো।
একজন বলল, আপেল তো দেখি নাই কুনো দিন।
মতি বলল, আপেল হইল গোলাপি রঙের। মিলিটারির যে খালি রংটা গোলাপি সেটা সত্যি না, লম্বায় আপনার-আমার থেকে কমপক্ষে দেড় গুণ। ভারী ভারী অস্ত্রপাতি এমনভাবে ধরে যেন পাটশলা ধরে রাখছে। গায়ে মইষের মতন জোর। মিলিটারির গুনগান করার সময় মতির চেহারা থেকে যেন আলো বের হতে থাকে।
একজন জিজ্ঞেস করল, মিলিটারি দেখে তোমার ভয় করে নাই!
মতি হাসার ভঙ্গি করে বলল, আরে ভয় করবে কেন? এক দেশের মিলিটারি, তারাও মুসলমান আমরাও মুসলমান। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। ভাই ভাইরে ভয় পায় নাকি?
আমি অবাক হয়ে মতির দিকে তাকালাম, সেদিন মিলিটারি যে তাকে ন্যাংটা করে দেখেছে তারপর চড় মেরে বিদায় করেছে সেই কথাটা মনে হয় কাউকে বলে নাই। এখন আমি যদি সবাইকে বলে দিই?
একজন জিজ্ঞেস করল, সেই দিন মিলিটারি আসল কী জন্য। আবার গেল কী জন্য? মাঝখান থেকে আমাগো বগার জীবনটা শেষ।
মতি বলল, মিলিটারি কী জন্য আসছে এখনো বুঝেন নাই?
না।
দেশটা যে বাংলাদেশ হয় নাই, এখনো পাকিস্তান আছে সেইটা বুঝছেন?
চায়ের স্টলের মানুষেরা এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। মতি উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করল না, বলল, দেশটা যে পাকিস্তান আছে সেইটা সবাইরে বোঝনোর দরকার আছে। সেই জন্য মিলিটারি সারা দেশের চিপায় চিপায় একবার ঘুরান দিয়া আসতেছে।
কিন্তু বগারে মারল কেন? বগা কী দোষ করছে?
বগা দৌড় দিল কেন? দৌড় না দিলে কি গুল্লি করে?
আবার কি আসব মিলিটারি?
আসবে তো বটেই। দেশটারে একটা শৃঙ্খলার মাঝে আনতে হবে। শেখ সাহেব দেশটার কী সর্বনাশ করছে মনে আছে। মতির কথা শুনে কেউ কোনো কথা বলল না।
তোমার লগে কি মিলিটারির কথা হইছে?
বাপজানের সাথে বেশি কথা হইছে। আমার সাথে একটা-দুইটা কথা। ক্যায়সা হায় আছি হায় এই রকম ভদ্রতার কথা।
তোমার বাপজানরে কী বলছে মিলিটারি?
বলছে কোনো ভয় নাই। পুরা দেশ এখন তাগো দখলে। হিন্দুস্থানিদের মতলব হাসিল হয় নাই। বলছে মুক্তিবাহিনীর দেখা পাইলে খবর দিতে। অবশ্যি মুক্তিবাহিনী বলে নাই। বলছে ‘মিসকিরেন্ট’, মিসকিরেন্ট মানে দুষ্কৃতিকারী।
ও।
আমি ধৈর্য ধরে ফালতু মতির কথা শুনলাম। চা শেষ করে চায়ের দাম দিয়ে মতি যখন বের হলো তখন আমিও তার পেছন পেছন বের হলাম। একটু সামনে গিয়ে তাকে ডাকলাম, মতি ভাই।
মতি পেছনে ঘুরে আমাকে দেখে বলল, কে র?
হ্যাঁ।
খবর কী তোর? কাজীবাড়ির মাইয়ার কী খবর?
ভালো। আমি মতির কাছে গিয়ে বললাম, মতি ভাই তোমারে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কী কথা?
মিলিটারি যে তোমারে ন্যাংটা কইরা–
আমি কথা শেষ করার আগেই মতি খপ করে আমার চুল ধরে ফেলল, বলল, হারামজাদা, তুই যদি মুখ খুলস, আমি তোরে জবাই করে ফেলমু।
আমি অবাক হয়ে মতির দিকে তাকালাম। এত দিন এই মানুষটা ছিল পুরোপুরি অপদার্থ ফালতু একজন মানুয়। হঠাৎ করে মানুষটা অন্য রকম হয়ে গেছে, চোখ দেখলেই ভয় করে।
মতি আমার চুল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আমারে তুই চিনস না? আগের দিন আর নাই? এখন নূতন দিন আসতাছে। ক্ষমতা এখন আমাগো হাতে? বুঝছস?
আমি চুলের যন্ত্রণা সহ্য করে বললাম, বুঝছি।
তোর মুখ থেকে যদি একটা কথা বের হয় আমি তোর বাড়িতে আগুন দিমু, মনে থাকবে?
থাকবে।
মতি আমার চুল ছেড়ে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, যা হারামজাদা। মনে থাকে যেন।
আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, মতি হেঁটে চলে গেল। রাগে-অপমানে আমার ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছিল।
পরের দিন খবর পেলাম মিলিটারি আমাদের স্কুলে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে কিছু একটা দেখে চলে গেছে। যাওয়ার আগে আমাদের শহীদ মিনারটা ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। বাঁশ দিয়ে তৈরি আমাদের এই শহীদ মিনারের ওপর মিলিটারির এত রাগ কেন?
কাঁকনডুবিতে মিলিটারি আসার ঠিক এক সপ্তাহ পর আমি আর ডোরা গ্রামের শেষে যে ধানক্ষেত আছে, সেখানে বেড়াতে গেছি। ডোরা আসার আগে আমি জানতাম না যে ধানক্ষেত বেড়ানোর জায়গা আর ধানক্ষেতের আল ধরে হাঁটা একটা মজার খেলা। শহরে থাকত বলে গ্রামের খুব সাধারণ জিনিসগুলোই ডোরা দেখেনি। যে জিনিসগুলো আমাদের কাছে যন্ত্রণার মতো ডোরার কাছে সেটাই খুবই উত্তেজনার একটা বিষয়। সময়ে-অসময়ে ডোরা আমাকে নিয়ে কাঁকনডুবি গ্রামের আজব আজব জায়গায় চলে যেত– আমার ধারণা ছিল তার মা, বড় বোন কিংবা অন্যেরা খুবই বিরক্ত হবে, গ্রামের মানুষের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
কিন্তু আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম, যখন দেখলাম তার মা কিংবা বোন বিরক্ত তো হচ্ছেই না, বরং কেমন যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। ডোরার বড় বোন নোরা কারণটা আমাকে একদিন বলেছে, বাবাকে মিলিটারি মেরে ফেলার পর ডোরা নাকি পুরোপুরি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। সে খেত না, ঘুমাত না, চোখ বড় বড় করে বসে থাকত, বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলত। এই কাঁকনডুবিতে এসে ডোরা প্রথম একটু স্বাভাবিক হয়েছে। বড় বোন আর তার মা দুজনেই আমাকে বলেছে ডোরাকে একটু দেখে রাখতে। তাই আমি তাকে দেখে রাখছি। প্রচণ্ড দুপুরের রোদে আমি ডোরাকে নিয়ে ধানক্ষেতের ভেতরে আলের ওপর দিয়ে হাঁটছি। ডোরা তার পায়ের স্যান্ডেলগুলো খুলে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে লাগল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হলো? জুতা খুলছ কেন?
খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাস করি।
কেন?
যখন মুক্তিবাহিনী হব তখন খালি পায়ে হাঁটতে হবে না?
ডোরার বেশির ভাগ কথাবার্তা হয় মুক্তিবাহিনী নিয়ে, যখন সে মুক্তিবাহিনী হবে তখন কী করবে তার কথাবার্তায় সে সময়ের নানা রকম বর্ণনা থাকে। এই যে দুপুরের রোদে বের হয়ে এসেছে মনে হয় এইটাও তার মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং।
আমি খানিকক্ষণ তার খালি পায়ে হাঁটা দেখলাম, অভ্যাস নাই বলে তার রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে। তার পরও সে হেঁটে যাচ্ছে। আমি বললাম, তোমার কি ব্যথা লাগছে?
একটু একটু। সমস্যা নাই। তুমি যদি পারো আমি কেন পারব না? তোমার সাথে আমার কী পার্থক্য?
আমি দাঁত বের করে হেসে ফেললাম, আমি জন্মে কোনো দিন জুতা পরি নাই আর তুমি জন্মে কোনো দিন খালি পায়ে হাঁট নাই! এইটা হচ্ছে পার্থক্য।
ডোরা আমার কথার উত্তর না দিয়ে আলের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আষাঢ় মাস শুরু হয়ে গেছে কিন্তু আকাশে এতটুকু মেঘ নাই। ডোরা জিজ্ঞেস করল, আকাশে কী দেখ?
মেঘ আছে কি না দেখি। নাই, কোনো মেঘ নাই। আষাঢ় মাস শুরু হয়ে গেছে এখনো কোনো মেঘ নাই।
ডোরা বিষয়টা বুঝতে পেরেছে সেই রকম ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। বলল, যখন বর্ষাকাল শুরু হবে তখন পাকিস্তানি মিলিটারিদের বারোটা বেজে যাবে। তাই না?
বর্ষাকালের সাথে পাকিস্তানি মিলিটারির বারোটা বেজে যাওয়ার কী সম্পর্ক আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমি ডোরার কথা নিয়ে কোনো আপত্তি করলাম না। ডোরাকে খুবই আনন্দিত দেখা গেল। চোখ বড় বড় করে বলল, পাকিস্তান তো মরুভূমি, কোনো পানি নাই। নদী নাই। তাই ওই বদমাইশগুলো সাঁতার জানে না। পানিকে খুব ভয় পায়।
আমি আবার মাথা নাড়লাম। ডোরা বলল, যখন বর্ষাকাল শুরু হবে তখন মুক্তিবাহিনীর খুবই সুবিধা হবে। হবে না?
আমি বললাম, হবে।
মুক্তিবাহিনীর সবাই তো সাঁতার জানে। জানে না?
জানে।
মুক্তিবাহিনী নৌকা করে আসবে, এসে যুদ্ধ করবে। আর মিলিটারিরা বসে বসে মার খাবে। খাবে না?
আমি মাথা নাড়লাম, খাবে।
ডোরা বলল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?
কী কাজ?
প্রথমে আমি আর তুমি মুক্তিবাহিনী হব। তারপর–
দাঁড়াও দাঁড়াও। দুইজনে কি একটা বাহিনী হয়? বাহিনী বানাতে অনেক মানুষ লাগে।
ডোরা একটু বিরক্ত হলো, বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে। তাহলে আমরা দুইজন মুক্তিযোদ্ধা হব আর আমাদের বাহিনী হবে দুইজন মুক্তিযোদ্ধার একটা বাহিনী। তোমার সমস্যাটা কী?
না না, কোনো সমস্যা নাই।
ঠিক আছে। আমাদের কাছে রাইফেল থাকবে, স্টেনগান থাকবে, গ্রেনেড থাকবে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের খবর শুনতে শুনতে আমরা অনেক কিছু শিখে গেছি। আগে সবকিছুকে বলতাম বন্দুক এখন বলি রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান। আগে গ্রেনেডের নামও শুনি নাই এখন আমরা গ্রেনেড কী জানি। মর্টার কী জানি। ব্রাশফায়ার মানে কী জানি। অ্যামবুশ মানে কী জানি।
ডোরা বলল, আমরা কী করব জানো?
কী?
আমরা আমাদের রাইফেল নিয়ে কালী গাংয়ের পাড়ে শুয়ে থাকব। আমাদেরকে দেখে যেন চিনতে না পারে সেই জন্য আমরা আমাদের মাথার ওপরে কয়েকটা গাছের ডাল-পাতা–এই গুলি দিয়ে রাখব। দূর থেকে মনে হবে একটা ঝোঁপ।
আমি বললাম, ঠিক আছে।
তারপর যখন মিলিটারি নৌকা করে আমাদের সামনে দিয়ে যাবে তখন কী করব বুঝেছ?
কী করব?
নৌকার মাঝে একটা গুলি। বেশি না, মাত্র একটা গুলি।
তখন কী হবে?
তখন নৌকার মাঝে ফুটা হয়ে যাবে, নৌকার মাঝে পানি ঢুকবে, নৌকা ডুবে যাবে আর সবগুলো মিলিটারি ডুবে মরবে। ওরা সাঁতার জানে না তো তাই কেউ বাঁচবে না। সব শেষ! একটা বুলেট দিয়ে আমরা একশ মিলিটারি মেরে ফেলব।
ডোরার মুখ আনন্দে ঝলমল করতে থাকে। তাকে দেখে মনে হতে থাকে সে আসলেই বুঝি একশ মিলিটারি মেরে ফেলেছে। একটা নৌকাতে আসলেই একশ মিলিটারি উঠবে কি না আর ছোট একটা ফুটো দিয়ে পানি ঢুকতে থাকলে সেটা কোনো কিছু দিয়ে বন্ধ করা যায় কি না কিংবা সেঁচতে থাকা যায় কি না–এ রকম একটা জিনিস নিয়ে তর্ক করা যায় কিন্তু আমি মোটেও তার চেষ্টা করলাম না। আমিও যোগ দিলাম, বললাম, আমরা চুতরা পাতা আর বানরশলা ডিব্বার ভেতরে ভরে রাখব, এরা যখন রাস্তা দিয়ে যাবে তখন এই ডিব্বা ছুড়ে দেব, এদের শরীরে যখন চুতরা পাতা আর বানরশলা লাগবে, তখন সারা শরীর চুলকাতে থাকবে, তখন আমরা অ্যামবুশ করব!
ঠিক জায়গামতো অ্যামবুশ শব্দটা বলতে পেরে আমার খুবই আনন্দ হলো।
আমার কথা শুনে ডোরাও হি হি করে হাসতে থাকে। তারপর সে আরেকটা বুদ্ধি বের করে। রাস্তা কেটে রেখে তার ওপর একটা পাতলা ঢাকনা দিয়ে মিলিটারির জিপ ফেলে দেওয়ার বুদ্ধি। তারপর আমি পোষা কবুতর দিয়ে কীভাবে মিলিটারি ক্যাম্পের ওপর পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া যায় তার একটা বুদ্ধি বের করলাম। তখন ডোরা পোষা কুকুরকে কীভাবে ঠিক মিলিটারির মাঝখানে একটা গ্রেনেড ফেলে দেওয়ার ট্রেনিং দেবে, সেইটা নিয়ে একটা বুদ্ধি বের করল। এইভাবে আমরা একটার পর একটা বুদ্ধি বের করে সেটা নিয়ে গল্প করতে থাকলাম, কথা বলতে থাকলাম। এভাবে কতদূর হেঁটে এসেছি তার ঠিক নেই। ঠিক তখন প্রথমে একটা গুলির শব্দ, তারপর একটা ব্রাশফায়ারের শব্দ শুনলাম। মনে হলো খুব কাছে থেকে। আমরা চমকে উঠে ভয় পেয়ে সাথে সাথে সেখানে মাথা নিচু করে বসে পড়লাম। তারপর যে দৃশ্য দেখতে পেলাম তাতে আমাদের শরীর পাথরের মতো জমে গেল। বড় সড়ক দিয়ে লাইন ধরে খাকি পোশাক পরা মিলিটারি আসছে। আগে যে রকম অল্প কয়জন এসেছিল সে রকম না, দেখে মনে হয় শত শত। সবাই তাদের হাতের অস্ত্র উঁচু করে রেখেছে, দরকার হলেই গুলি করবে সে রকম একটা ভঙ্গি। কয়েকজন সড়কের দুই পাশে উবু হয়ে বসে মেশিনগান তাক করে রাখে, অন্যেরা তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। তখন অন্য আরো দুইজন মেশিনগান নিয়ে উবু হয়ে বসে আর অন্যেরা তাদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। শুধু যে মিলিটারি তা না। মিলিটারির সাথে অনেক গ্রামের মানুষ। তাদের মাথায় গুলির বাক্স, নানা রকম মালপত্র। মিলিটারিগুলো গ্রামের মানুষগুলোকে ধরে এনেছে তাদের মালপত্র টেনে আনার জন্য। আমরা কী করব বুঝতে পারলাম না, দাঁড়ালেই আমাদের দেখা যাবে, আমাদের দেখলে মিলিটারিগুলো কী করবে কে জানে। যদি গুলি করে দেয়? তাই আমি আর ডোরা একটা ঝোঁপের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে রইলাম, ভয়ে আমাদের বুক ধক ধক করছে।
ডোরা ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল এরা কোথায় যায়?
আমি বললাম, জানি না। সাথে অনেক মালপত্র, যেখানেই যাক, মনে হয় সেখানে অনেক দিন থাকবে।
ডোরা বলল, সর্বনাশ! এইখানে থাকবে না তো?
এইখানে কোথায় থাকবে?
আমরা ঝোপের আড়াল থেকে দেখলাম, মিলিটারিগুলো হেঁটে হেঁটে আসছে, আমাদের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে গেল। এত কাছ দিয়ে যে আমরা তাদের চেহারাগুলো পর্যন্ত দেখতে পেলাম। কী ভয়ংকর চেহারা, চোখগুলো কোটরের ভেতর, চোয়ালগুলো উঁচু, পাথরের মতো মুখ। কেউ কথা বলছে না, একজনের পেছনে আরেকজন হেঁটে যাচ্ছে। এদেরকে দেখতে মানুষের মতো লাগলেও আসলে এরা সবাই এক-একটা রাক্ষস। এই সব রাক্ষস কোথাও না কোথাও কোনো মানুষকে মেরেছে। কী অবিশ্বাস্য ব্যাপার!
গ্রামের যে মানুষগুলোকে ধরে এনেছে তাদের মাঝে একেবারে কমবয়সী থেকে বুড়ো মানুষ পর্যন্ত আছে। সবার মাথায় নানা ধরনের মালপত্র, গুলির বোঝ। কতদূর থেকে তারা আসছে কে জানে, দেখেই বোঝা যায় ক্লান্তিতে তাদের দম বেরিয়ে যাচ্ছে। সবাই ধুকে ধুকে যাচ্ছে, পরিশ্রমে তাদের সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
মিলিটারিগুলো সড়ক ধরে আমাদের স্কুলের দিকে হেঁটে গেল। আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম, যখন সবাই চলে যাবে তখন বের হয়ে দৌড়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে পড়ব। এতক্ষণে নিশ্চয়ই গ্রামের সবাই খবর পেয়ে গেছে, বাড়িতে নিশ্চয়ই আমাদের জন্য দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গেছে। আজকে নানির কাছ থেকে মনে হয় শুধু বকুনি না, একটু মারধরও খেতে হবে।
ঠিক তখন আমরা একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পেলাম। আমরা দেখলাম দুইটা মিলিটারি বলাই কাকুকে ধরে আনছে। বলাই কাকু এমনভাবে হাঁটছে যে মনে হচ্ছে তার চারপাশে কী হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছে না। পেছনে একটা মিলিটারি তার পিঠে রাইফেলটা ধরে রেখেছে। হেঁটে হেঁটে ধানক্ষেতে নামিয়ে আনল, তারপর ঠেলে ঠেলে ঠিক আমাদের দিকে আনতে লাগল। ভয়ে আর আতঙ্কে আমরা তখন পরিষ্কার করে চিন্তাও করতে পারছি না, ডোরা এখনো বুঝতে পারছে না কিন্তু আমি বুঝতে পারছি বলাই কাকুকে গুলি করার জন্য আনছে।
আমি ডোরাকে ফিসফিস করে বললাম, ডোরা চোখ বন্ধ করো।
কেন?
করো বলছি।
ডোরা চোখ বন্ধ করল, আমিও আর তাকিয়ে থাকতে পারছিলাম না কিন্তু তার পরও কীভাবে জানি তাকিয়ে রইলাম। বলাই কাকুকে একটা আলের ওপর দাঁড়া করাল, তারপর মিলিটারি দুইটা কয়েক পা পিছিয়ে গেল। আমি দেখলাম একটা মিলিটারি কোমরে হাত দিয়ে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে। অন্যজন রাইফেল তুলল।
আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, ভয়ংকর দুইটা গুলির শব্দ হলো। ডোরা নিশ্চয় চিৎকার করেছিল কিন্তু গুলির শব্দের জন্য সেটা আলাদাভাবে শোনা গেল না, আমি জাপটে তার মুখ ধরে ফেললাম, ডোরা তখন থরথর করে কাঁপছে। আমি সাবধানে তাকালাম, যেখানে বলাই কাকু দাঁড়িয়েছিল সেখানে নাই, নিচে পড়ে আছে। মিলিটারি দুইটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। একজন পকেট থেকে সিগারেট বের করে আরেকজনকে একটা দিল, দুজনে সিগারেট ধরাল, তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। একজন কী একটা বলল, অন্যজন তখন হাসতে হাসতে তাকে একটা ধাক্কা দিল, নিশ্চয়ই মজার কিছু একটা বলেছে।
ডোরা মুখ ঢেকে থরথর করে কাঁপছে, আমি তাকে ধরে রেখেছি। মিলিটারিগুলো একেবারে চোখের আড়াল হয়ে যাবার পরও আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, তারপর ডোেরাকে টেনে দাঁড় করালাম। বললাম, চল।
ডোরা কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, যেতে পারবে?
ডোরা মাথা নাড়ল। তখন আমি তার হাত ধরে ছুটতে লাগলাম। বলাই কাকুর পাশ দিয়ে যখন ছুটে যাচ্ছি তখন একবার চোখের কোনা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, বলাই কাকু নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! কী বিচিত্র সেই দৃষ্টি।
হেই খোদা! তুমি এটা কী করলে? কীভাবে করলে?
পুরো একদিন বলাই কাকুর লাশটা ধানক্ষেতে পড়ে থাকল। শ্মশানে তার লাশটা পোড়ানোর কেউ সাহস পেল না। কেমন করে পাবে? পাকিস্তানি মিলিটারি এসে আমাদের স্কুলে ক্যাম্প করেছে এক-দুই দিনের জন্য নয়, পাকাপাকিভাবে। তারা যেই মানুষটাকে মেরেছে তার লাশের একটা গতি করবে, কারো সেই সাহস নাই। পরের দিন দেখা গেল রাত্রে শেয়াল লাশের খানিকটা খেয়ে গেছে।
পরের দিন ফালতু মতির বাবা লতিফ চেয়ারম্যান আমাদের স্কুলে গিয়ে মিলিটারির সাথে কথা বলে গ্রামের মানুষদের বলল, লাশটা পুঁতে ফেললে তারা কিছু বলবে না। তখন গ্রামের কিছু মানুষ যারা এত দিন বলাই কাকুর চায়ের স্টলে চা খেয়েছে, আড্ডা দিয়েছে, রেডিও শুনেছে, তারা এসে লাশের পাশে একটা গর্ত করে লাশটা সেখানে ফেলে মাটিচাপা দিয়ে দিল। এই পৃথিবীতে বলাই কাকুর কোনো চিহ্ন থাকল না। তার চায়ের স্টলটা প্রথম দুই দিন বন্ধ থাকল, পরের দিন দেখা গেল সুলেমান নামের একজন মানুষ, লতিফ চেয়ারম্যানের দূরসম্পর্কে শালা, বলাই কাকুর চায়ের স্টলটা দখল করে নিয়েছে। সেই চায়ের স্টলে জোরে জোরে রেডিও পাকিস্তান বাজতে লাগল, কোথা থেকে ইয়াহিয়া খানের বাঁধাই করা একটা ছবি টানিয়ে দেয়া হলো কিন্তু খরিদ্দার বলতে গেলে কেউ নাই। সুলেমান বলাই কাকুর মতো ভালো চা বানাতে পারে না, সেটা একটা কারণ হতে পারে, ইয়াহিয়া খানের চেহারা খুবই খারাপ, সেই চেহারার মানুষের বাঁধাই করা ছবি দেখতে কারো ভালো লাগে না, সেটা একটা কারণ হতে পারে, রেডিও পাকিস্তানে উর্দু খবর কেউ শুনতে চায় না, সেটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে আসল কারণ হচ্ছে, বলাই কাকুর চায়ের স্টলটা আমাদের স্কুলের খুব কাছে। মিলিটারির এত কাছে চা খেতে আসার মতো সাহস কারো নাই।
কাঁকনডুবিতে মিলিটারি আসার পর প্রথম চব্বিশ ঘণ্টা তারা স্কুল থেকে বের হলো না। কাঁকনডুবি গ্রামের কোনো মানুষও তাদের বাড়ি থেকে বের হলো না। আমি অবশ্যি তার মাঝেও এক ফাঁকে বের হয়ে গেলাম, বলাই কাকুর চায়ের স্টল পর্যন্ত গিয়ে আমি স্টলের সামনে দাঁড়ালাম। বলাই কাকু আর কোনো দিন এই স্টলে আসবে না, সেটা এখনো বিশ্বাস হয় না। স্টলে কোনো খরিদ্দার নাই, সুলেমান একা একা বসে বসে কাঁচের গ্লাসগুলো পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করছে। আমাকে দেখে সুলেমান খুবই খুশি হয়ে গেল, আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, কী মিয়া চা খাইবা? কুকি বিস্কুট? কুনো কাস্টমার নাই, আস বউনি কইরা যাও।
আমি বললাম, পয়সা নাই।
সুলেমানের মুখটা ধপ করে নিভে গেল। একটু পরে বলল, আস ভেতরে আস। তোমারে এক কাপ ফ্রি চা দিই।
এই লোকের কাছ থেকে আমার চা খাওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই, মনে হলো বলি তোমার চা খাই তো পিশাব খাই কিন্তু সেটা তো বলা যায় না। তাই আমি মাথা নেড়ে বললাম, লাগবে না।
তারপর আমি সড়কটা ধরে সাবধানে স্কুলের দিকে আগাতে লাগলাম। খানিকদূর যাবার পর আমি একধরনের খটখট শব্দ শুনতে পেলাম। মনে হলো কুড়াল দিয়ে অনেক মানুষ কিছু একটা কাটছে। আমি ভয়ে ভয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম, শব্দটা আরো স্পষ্ট হলো। দূর থেকে স্কুলটাকে দেখা যায় কিন্তু এখন সেটাকে খুবই অদ্ভুত দেখাচ্ছে। স্কুলের চারপাশে অনেক গাছ ছিল, সব গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এই এলাকার সব মানুষকে ধরে এনে মিলিটারি তাদেরকে দিয়ে গাছ কাটাচ্ছে। সব গাছ কেটে ফেলার জন্য আমাদের স্কুলটাকে কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া দেখাচ্ছে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম স্কুলের ছাদে বালুর বস্তা দিয়ে ঘেরাও করছে, এর ভেতরে নিশ্চয়ই মিলিটারির পাহারা থাকবে। আমার বেশিক্ষণ থাকার সাহস হলো না, তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এলাম।
আসার সময় কাজীবাড়িতে একটু ঢুঁ দিয়ে এলাম। সেদিন আমাদের চোখের সামনে যখন বলাই কাকুকে গুলি করে মেরে ফেলল তখন আমি ডোরার জন্য খুব ভয় পেয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল ডোেরারও কিছু একটা হয়ে যায় কি না। কিন্তু ডোরা শেষ পর্যন্ত সামলে নিয়েছে। আমাকে ঢুকতে দেখে বাড়ির বেশ কয়েকজন আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। একজন জিজ্ঞেস করল, মিলিটারির কী খবর?
ঠিক কী কারণ জানি না, সবারই ধারণা আমি এই গ্রামে কী হচ্ছে না হচ্ছে তার সবকিছু জানি। আমি একটু আগে স্কুলের কাছাকাছি গিয়ে কী দেখে এসেছি, সেইটা অনেক বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম। বলাই কাকুর। পরে আর কাউকে মেরেছে কি না জানতে চাইল, আমি বললাম যে এখনো সে রকম কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
আশপাশে ডোরাকে দেখলাম না, তখন আমি ডোরার বড় বোন নোরাকে জিজ্ঞেস করলাম, নোরা বুবু, ডোরা কই?
ঘরের ভেতরে।
কী করে?
কিছু করে না। বিছানার ওপর বসে আছে। তুমি যাও দেখি, একটু কথা বলে দেখ মনটা ভালো করতে পারো কি না। এই ডোরার জন্য আমাদের এত চিন্তা হয়।
ডোরাকে যে ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছে সেখানে একটা জানালা আছে। মাঝে মাঝে জানালায় টোকা দিয়ে আমি ডোরাকে ডেকে আনি, আজকে সরাসরি ঘরের ভেতরে গেলাম, ডোরা বিছানায় পা তুলে হাঁটুর ওপরে মুখটা রেখে বসে আছে, আমাকে দেখে এমনভাবে তাকাল যেন আমাকে আগে কোনো দিন দেখেনি। আমি বললাম, ডোরা, তোমরা শরীর ভালো আছে?
ডোরা কোনো কথা বলল না, শুধু মাথা নাড়ল। বলাই কাকুর চায়ের দোকান সুলেমান দখল করে নিয়েছে, সেখানে একটা ইয়াহিয়া খানের ছবি টানিয়ে রেখেছে, সেটা বলা মনে হয় ঠিক হবে না। আমাদের স্কুলের সব গাছ কেটে ন্যাড়া করে ফেলেছে, সেটা বলাও ঠিক হবে না। শুনে ডোরার আরো মন খারাপ হয়ে যাবে। তবে এই খবরগুলোই অন্যভাবে দেয়া যায়। আমি চেষ্টা করলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে চরমপত্রে যেভাবে খবর দেয় সেই কায়দায় বললাম, মিলিটারি স্কুলে ক্যাম্প করেছে শুনেছ তো?
ডোরা মাথা নাড়ল। আমি বললাম, এত ক্যাম্প এত মিলিটারি কিন্তু ভয়ে মিলিটারির অবস্থা কেরোসিন!
ডোরা এই প্রথম কথা বলল, কেন? কেরোসিন কেন?
ভয়ে ওদের ঘুম নাই, খাওয়া নাই। কখন মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করে। ভয়ে ওরা কী করেছে জানো?
কী করেছে?
স্কুলের সব গাছ কেটে ফেলেছে। বালুর বস্তা দিয়ে বাংকার বানিয়ে সেইখানে চব্বিশ ঘণ্টা মেশিনগান নিয়ে বসে আছে! ভয়ে সবগুলোর ঘুম হারাম।
ডোরা চোখে-মুখে একটু উৎসাহ দিয়ে বলল, সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? বেকুবেরা ভেবেছে কয়টা গাছ কেটে ফেললে আর বালুর বস্তা ফেললেই মুক্তিবাহিনীর হাত থেকে বাঁচবে? কোনো দিন না! এরা মুক্তিবাহিনীকে চিনে না।
মুক্তিবাহিনী আসবে?
আসবে না মানে? যেকোনো দিন আসবে। আমি মাসুদ ভাইকে খুব ভালো করে চিনি। মাসুদ ভাই আসবেই আসবে।
মুক্তিবাহিনী আসলে আমি আর তুমি ওদের সাথে চলে যেতে পারব না?
আমি চেষ্টা করেছিলাম মাসুদ ভাই আমাকে নেয় নাই, কিন্তু ডোরাকে সেটা আবার বলে লাভ নাই, তাই বললাম, মনে হয় যেতে পারব। একলা আমাকে নিতে চায় নাই। দুইজন বললে মনে হয় না করতে পারবে না।
ডোরা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, দরকার হলে আমি চুল কেটে ছেলেদের মতো হয়ে যাব। শার্ট-প্যান্ট পরে থাকব। কেউ বুঝতে পারবে না আমি মেয়ে।
সেটা খুবই বুদ্ধিমানের মতো একটা কাজ হবে–এ রকম ভান করে আমি জোরে জোরে মাথা নাড়ালাম। ডোরা তখন মুক্তিবাহিনীতে গিয়ে কী কী করবে তার অনেক রকম বর্ণনা দিতে লাগল আর আমি মাথা নাড়তে লাগলাম। কিছুক্ষণের মাঝেই ডোরার মন ভালো হয়ে গেল
আমি ওঠার আগে বললাম, তুমি কি শুনেছ বলাই কাকুর চায়ের স্টলে কী হয়েছে?
কী হয়েছে?
সুলেমান নামে একটা পাকিস্তানি দালাল স্টলটা দখল করেছে, কিন্তু কী হয়েছে জানো?
কী হয়েছে?
এই স্টলে একজনও চা খেতে যায় না। কুত্তা-বিলাই পর্যন্ত যায়।
সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি? আমি গিয়েছিলাম আমার হাত-পা ধরে তেল-মালিশ, আমি যেন চা খাই। পয়সা লাগবে না, ফ্রি।
তুমি খেয়েছ?
মাথা খারাপ? আমি ওই দালালের দোকানে চা খাব? কী বলেছি, জানো?
ডোরা চোখ বড় বড় করে বলল, কী বলেছ?
আমি বলেছি আমি আপনার দোকানের চা খাই তো পিশাব খাই!
সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি! আসলে সত্যি না, কিন্তু এই কথাটা যে বলতে চেয়েছিলাম, সেটা তো একশ বার সত্যি। আর গল্প করার সময় একটু সত্যি-মিথ্যা মিলিয়ে গল্প করতে হয়। তাছাড়া ডোরার বড় বোন আমাকে পাঠিয়েছে ডোরার মন ভালো করার জন্য, আমাকে তো একটু চেষ্টা করতে হবে। আমার কথা শুনে ডোরা হি হি করে এত জোরে হাসতে শুরু করল যে পাশের ঘর থেকে তার আম্মু পর্যন্ত চলে আসলেন ঘটনাটা কী দেখতে।
স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্পটা ঠিকভাবে বসিয়ে দুই দিন পর মিলিটারির একটা দল বের হলো গ্রামটা ঘুরে দেখতে। মিলিটারি রাস্তাঘাট চিনে না তাই তাদের রাস্তাঘাট দেখিয়ে নেওয়ার জন্য সাথে থাকল লতিফ চেয়ারম্যান। খবর পেয়ে আমরা দলটার পিছু নিলাম, বেশ পেছনে পেছনে তাদের সাথে হেঁটে হেঁটে দেখতে থাকি মিলিটারি কী করে। খুবই ভয় লাগছিল কিন্তু কী আশ্চর্য ব্যাপার, ভয় পাবার পরও দেখার কৌতূহল হয়।
মিলিটারি যুদ্ধ করে তাই আমার ধারণা ছিল তারা বুঝি গ্রামটা চক্কর দিয়ে দেখবে কীভাবে যুদ্ধ করা যায়। কিন্তু আমি খুবই অবাক হলাম যখন দেখলাম মিলিটারিগুলো মানুষের গোয়ালঘরের মাঝে থেমে গরুগুলো টিপেটুপে দেখতে লাগল। আমাদের দশ গ্রামে যখন ষাঁড়ের লড়াই হয় তখন মনু চাচার ষাঁড়টাকে কেউ হারাতে পারে না। পর পর দুইবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, গতবার পেয়েছে চার ব্যান্ডের রেডিও, এর আগেরবার দেয়ালঘড়ি। মিলিটারির দলটা মনু চাচার বাড়ির সামনে বেঁধে রাখা ষাঁড়টাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। সারাক্ষণই তাদের মুখে একটা রাগ রাগ ভাব ছিল কিন্তু মনু চাচার বিশাল ষাঁড়টাকে দেখে তাদের মুখে প্রথমবার হাসি ফুটে উঠল। লতিফ চেয়ারম্যানকে কিছু একটা বলল, লতিফ চেয়ারম্যান হাত কচলে কিছু একটা উত্তর দিল, তখন মিলিটারিগুলো তাকে একটা ধমক দিল।
ধমক খেয়ে লতিফ চেয়ারম্যান মনু চাচাকে বাড়ির ভেতর থেকে ডেকে পাঠাল। মনু চাচা ভয়ে ভয়ে বের হয়ে মিলিটারিগুলোকে একটা সালাম দিল, মিলিটারিগুলো সালামের কোনো উত্তর না দিয়ে হড়বড় করে মনু চাচাকে কী একটা জানি বলল। মনু চাচা কিছুই বুঝতে পারল না, তখন লতিফ চেয়ারম্যান মনু চাচাকে কথাটা বুঝিয়ে দিল। স্কুলে মিলিটারির ক্যাম্পে তাদের খাওয়ার জন্য একটা গরু দরকার এই গরুটা তাদের খুব পছন্দ হয়েছে। তাই মনু চাচাকে বলেছে গরুটা স্কুলে পৌঁছে। দিতে।
কথাটা শুনে মনু চাচা একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন। আমরা সবাই জানি মনু চাচা এই ষাঁড়টাকে একেবারে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন। এই ষাঁড়টাকে বেছে বেছে খাওয়ান, কালী গাংয়ে নিয়ে নিজের হাতে গোসল করান, ষাঁড়ের লড়াইয়ের সময় তার ধারালো। শিংয়ে ফুলের মালা লাগিয়ে নিয়ে যান। সেই ষাঁড়টাকে মিলিটারিরা জবাই করে কেটেকুটে খেয়ে ফেলবে–এটা শুনে তো হাউমাউ করে কাঁদতেই পারেন। মনু চাচার কান্না শুনে মিলিটারিগুলো খুবই বিরক্ত হলো, একজন তার রাইফেলের বাঁট দিয়ে মনু চাচাকে মারতে গেল তখন ভয়ে মনু চাচার কান্না থেমে গেল। বিজাতীয় ভাষায় গালাগাল করতে করতে মিলিটারিগুলো লতিফ চেয়ারম্যানকে কী যেন বলল, লতিফ চেয়ারম্যান মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিয়ে গেল।
একটু পরেই দেখলাম কয়েকজন মানুষ মিলে মনু চাচার বিশাল তেজি ষাঁড়টাকে আমাদের স্কুলে মিলিটারি ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে, আর মনু চাচা বুক চাপড়াতে চাপড়াতে গরুটার পেছনে পেছনে যাচ্ছেন। দেখে আমার এত কষ্ট লাগল যে সেটা বলার মতো না।
মনু চাচার বাড়ি থেকে বের হয়ে মিলিটারিগুলো লতিফ চেয়ারম্যানকে কিছু একটা জিনিস জিজ্ঞেস করল, আমি শুধু ইন্দু শব্দটা বুঝতে পারলাম। তার মানে এখানে হিন্দু কোথায় আছে, সেটা জানতে চাচ্ছে। লতিফ চেয়ারম্যান হাত নেড়ে হিন্দুপাড়ার দিকে দেখাল, মিলিটারিগুলো তখন তাদের সেখানে নিয়ে যেতে ইঙ্গিত করল।
কী সর্বনাশ! নীলিমারা চলে গেছে কিন্তু এখনো বেশ কয়েকটা হিন্দু পরিবার রয়ে গেছে। মিলিটারিগুলো দেখলে নিশ্চয়ই সবাইকে মেরে ফেলবে। আমি তখন দেরি করলাম না, একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে সামনে চলে গেলাম। যখন সড়কটা একটু বাঁক নিয়েছে আমাকে আর দেখতে পাচ্ছে না, তখন প্রাণপণে ছুটতে লাগলাম। একটু সামনে গিয়ে সড়ক থেকে নেমে কারো সবজি ক্ষেতের ভেতর দিয়ে, কারো উঠানের ওপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আমি হিন্দুপাড়ার মাঝে হাজির হলাম। একজন থুরথুরে বুড়ি আমাকে দেখে বলল, বাবাধন! দৌড়াও কেন? কী হইছে তোমার?
আমি চিৎকার করে বললাম, মিলিটারি আসতেছে! আপনারা বাড়ি থেকে পালান! তাড়াতাড়ি!
আমার চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে আরো অনেকে বের হয়ে এল, আমি আবার চিৎকার করে বললাম, মিলিটারি আসতেছে আপনাদের মারার জন্য। আপনারা এক্ষুনি পালান?
মানুষগুলো সাথে সাথে বুঝে গেল। তারা চিৎকার করে নিজেদের ছেলেমেয়ে, বউ-বাচ্চাদের ডাকতে থাকে। দেখতে দেখতে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে। নিশ্চয়ই আগে থেকে ঠিক করে রেখেছে কোথায় পালাবে, সবাই সেই দিকে ছুটতে থাকে। থুরথুরে বুড়িটাকেও একজন পাঁজাকোলা করে নিয়ে বাড়ির পেছনে জঙ্গলের দিকে ছুটতে লাগল।
আমিও তখন সরে গেলাম, মিলিটারি এসে যদি আমাকে দেখে, সমস্যা হতে পারে। মাথামোটা মিলিটারি মনে হয় বুঝবে না কিন্তু লতিফ চেয়ারম্যান সাথে সাথে বুঝে যাবে ঘটনা কী।
মিলিটারিগুলো নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়িঘর দেখতে দেখতে ধীরে-সুস্থে এসেছে, তাই তারা যখন এসেছে তখন পুরো হিন্দুপাড়া ধূ ধূ ফাঁকা। মিলিটারিগুলো বাড়ি বাড়ি গিয়ে হিন্দুদের খুঁজল, কাউকে না পেয়ে খুবই বিরক্ত হলো। ঘরের ভেতর ঢুকে লাথি দিয়ে জিনিসপত্র ফেলতে লাগল। তারপর বাইরে এসে লতিফ চেয়ারম্যানকে কিছু একটা বলল। লতিফ চেয়ারম্যান তখন এদিক-সেদিক তাকাল। কী হচ্ছে দেখার জন্য কিছু মানুষ আশেপাশে জড়ো হয়েছে, লতিফ চেয়ারম্যান তাদেরকে বলল, এটা হিন্দুদের বাড়ি। হিন্দুর মাল এখন গণিমতের মাল। তোমাদের যার যা ইচ্ছা এই বাড়ি থেকে নিয়ে যাও।
যারা কৌতূহলী হয়ে এসেছিল তারা কেউ নড়ল না। হিন্দু-মুসলমান সবাই একসঙ্গে এত দিন একই গ্রামে আছে; এখন হঠাৎ করে তাদের মালপত্র বাড়িঘর সবকিছুকে গণিমতের মাল বললেই তো সেটা লুটপাট করে নেয়া যায় না।
লতিফ চেয়ারম্যান আবার বলল, কী হলো? নিচ্ছে না কেন? যাও নেও।
এবারেও কেউ নড়ল না, বরং দুই-একজন চলে যেতে শুরু করল। সেটা দেখে মিলিটারিগুলো হঠাৎ করে খেপে গেল। জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করে হঠাৎ করে যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের দিকে রাইফেল তাক করে হুংকার দিল। যারা দাঁড়িয়েছিল তারা হঠাৎ করে ভয় পেয়ে যায়, একজন-দুইজন তখন ভয়ে ভয়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। বেশির ভাগ মানুষই অবশ্যি বাড়ির ভেতর থেকে ছোটখাটো জিনিস নিয়েই পালিয়ে গেল। কয়েকজনকে দেখা গেল খুব উৎসাহ নিয়ে লুট করতে শুরু করেছে। তাদের মাঝে একজন হচ্ছে মন্তাজ মিয়া–মন্তাজ মিয়া এই গ্রামের চোর, রাত-বিরেতে শরীরে তেল মেখে মানুষের বাড়িতে চুরি করতে যায়। প্রকাশ্য দিনের বেলায় মিলিটারির সামনে এইভাবে লুট করার সুযোগ আর কবে পাবে।
আমি কাছাকাছি একটা গাছের তলায় বসে বসে পুরো দৃশ্যটুকু দেখলাম। একসময় লতিফ চেয়ারম্যান মিলিটারিদের নিয়ে চলে গেল। আমি তার পরও হিন্দুপাড়ায় বসে রইলাম। তখন একজন-দুইজন করে মানুষগুলো ভয়ে ভয়ে ফিরে আসতে লাগল। তাদের সবার মুখ রক্তশূন্য। কমবয়সীরা নিঃশব্দে কাঁদছে। একজন মহিলা আমাকে দেখে এগিয়ে এল, কাছে এসে বলল, বাবা, তোমার জন্য আজকে আমরা বেঁচে গেলাম। তুমি নিশ্চয়ই আগের জন্মে আমার বাবা ছিলে। আমায় বাঁচাইতে আসছ। ভগবানের কাছে তোমার জন্য প্রার্থনা করি।
আমি দাঁড়িয়ে বললাম, কাকিমা, মিলিটারি গ্রামের মানুষদের দিয়ে আপনাদের বাড়ি লুট করিয়ে নিয়েছে।
মহিলাটি বলল, নিক বাবা। যার যেটা ইচ্ছা নিয়া যাক। আমরা মানুষ কয়টা বাঁইচা থাকলেই হবে। আর কিছু চাই না।
মহিলাটি চলে গেল, ছোট একটা বাচ্চা তাকে ধরে কাঁদছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শেষ পর্যন্ত কি এই মানুষগুলো বেঁচে থাকতে পারবে?
আমি কি বেঁচে থাকব?
সেই ইলেকশনের সময় আমাদের গ্রামে এক-দুইটা মিটিং হয়েছিল, তারপর আর কোনো মিটিং হয় নাই। কয়েক দিন থেকে শুনতে পাচ্ছি আমাদের গ্রামে একটা মিটিং হবে। মিটিংয়ের কথাটা বলে বেড়াচ্ছে ফালতু মতি। আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তখন শুনেছি মতি যাকেই পাচ্ছে, তাকেই মিটিংয়ের কথা বলছে। হয়তো লোকমান গরু নিয়ে মাঠে যাচ্ছে তাকে বলল, এই যে লোকমান ভাই, পরশু দিন বিকালে কিন্তু মিটিং। মনে আছে তো?
লোকমান কিছুই জানে না চোখ কপালে তুলে বলে, মিটিং? কিসের মিটিং।
খবর রাখেন না কিছু? হিন্দুস্তান দেশটারে দখল করে নিতে চাচ্ছে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে না? শহর থেকে বড় নেতা আসবে। আসবেন কিন্তু।
লোকমান মাথা নাড়ে। একটু পরে মতি ফজলু চাচাকে বলে, চাচা, শরীরটা ভালো?
ফজলু চাচা সন্দেহের চোখে মতির দিকে তাকায়। মতি বলে, পরশু বিকাল বেলা জুমা ঘরের সামনে আসবেন।
কী হবে? শিন্নি?
মতি মাথা নাড়ে, না না, শিন্নি না। মিটিং।
কিসের মিটিং?
শহর থেকে বড় নেতা আসবে। তার মিটিং।
ফজলু চাচা আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। আজকাল কেউ মতির সাথে বেশি সময় কথা বলে না!
দুই দিন পর বিকেলবেলা আমি মিটিংটা দেখতে গেলাম। মানুষ খুব বেশি নাই, আমার মতো পোলাপানই বেশি। কী নিয়ে মিটিং, সেটা দেখতে এসেছে। জুমা ঘরের কাছে একটা টেবিল আর তার পেছনে দুইটা চেয়ার। একটা চেয়ারে শার্ট-প্যান্ট পরা একজন কমবয়সী মানুষ। আরেকটা চেয়ার খালি সেখানে কে বসবে বুঝতে পারলাম না। মতি ব্যস্তভাবে এদিক-সেদিক হাঁটছে, লোকজনকে ডেকে আনছে, সড়ক ধরে যারা বাড়িঘরে যাচ্ছিল তাদেরকেও জোর করে ধরে আনল। চেয়ারে যে কমবয়সী মানুষটা বসেছিল এক সময়ে সে অধৈর্য হয়ে বলল, মতি, মিটিং শুরু করে দেও।
আমি খুবই অবাক হলাম মতির মতো একজন ফালতু মানুষ একটা মিটিং শুরু করবে? কিন্তু দেখা গেল আসলেই ঘটনা সে রকম, মতি টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে বলল। ভাইসব- তারপর থেমে গেল, গলা পরিষ্কার করে আবার বলল, ভাইসব–তারপর আবার থেমে গেল। মনে হচ্ছে কী বলবে, ভুলে গেছে। আবার গলা পরিষ্কার করে বলল, এ্যাঁ এ্যাঁ আপনারা জানেন এ্যাঁ এ্যাঁ আমাদের প্রিয় দেশ এ্যাঁ এ্যাঁ পাকিস্তান আজ এ্যাঁ এ্যাঁ– মতি এবারে পুরোপুরি থেমে গেল। তার মুখের রং লাল-নীল হতে লাগল, বোঝাই যাচ্ছে তার মুখ থেকে আর কোনো শব্দ বের হবে না।
তখন চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা দাঁড়িয়ে মতিকে বসে যেতে বলল আর মতি সাথে সাথে ঝপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। মানুষটা তখন দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে থাকে, তার অবস্থা মোটেও মতির মতো না, সে খুবই ভালো বক্তৃতা দিতে পারে। সে শুরু করল এইভাবে, আপনারা জানেন, আমাদের প্রিয় ওয়াতান পাকিস্তান, পৃথিবীর অন্যতম মুসলিম রাষ্ট্রকে হিন্দুস্থান ভেঙে ফেলতে চাচ্ছে, তারা দুষ্কৃতিকারী পাঠাচ্ছে কিন্তু আমরা তাদের বিষদাঁত ভেঙে দেব। আমাদের নেতা জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম টিক্কা খানের সাথে দেখা করে তাকে বলেছেন আমরা তাদের পাশে আছি। আমি ইসলামী ছাত্রসংঘের একজন নগণ্য কর্মী আমার প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জন্য সারা দেশে আপনাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করছি। আপনারা জেহাদের জন্য প্রস্তুত হন।
মানুষটা অনেকক্ষণ কথা বলল, শেষের দিকে বলল, আমরা পাকিস্তান মিলিটারিকে বলেছি, আমরা শুধু মুখের কথা বলতে চাই না, আমরা আপনাদের পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতে চাই। আমাদের অস্ত্র দিন। আপনারা শুনে খুশি হবেন পাকিস্তান আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে নিয়ে একটা সামরিক বাহিনী তৈরি করতে যাচ্ছে। তার নাম হচ্ছে রাজাকার বাহিনী।
মানুষটা রাজাকার বাহিনী কথাটা অনেক জোরে উচ্চারণ করল, সে আশা করছিল সবাই সেটা শুনে আনন্দে হাততালি দেবে কিন্তু কেউ হাততালি দিল, শুধু মতি জোরে জোরে হাততালি দিল এবং তার দেখাদেখি আর দুই-একজন একটু হাততালি দেয়ার চেষ্টা করল।
মানুষটা অবশ্যি নিরুৎসাহিত হলো না, বলল, আপনাদের গ্রামে আমরা রাজাকার বাহিনী তৈরি করব। জওয়ান মানুষেরা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন। আপনাদের অস্ত্র দেবে, ট্রেনিং দেবে, পোশাক দেবে মাসে মাসে বেতন দেবে। আপনারা দেশের খেদমত করবেন সাথে সাথে বেতন পাবেন। এই দেশে হিন্দুস্থানের কোনো দুষ্কৃতিকারীর জায়গা নাই। আপনারা পাকিস্তান রক্ষার জেহাদে, ইসলাম রক্ষার জেহাদে শরিক হন!
মতি চেয়ারে বসে বসে জোরে জোরে হাততালি দিতে লাগল।
এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে আমরা দেখলাম ফালতু মতি একটা পায়জামার ওপর একটা ঢলঢলে খাকি শার্ট পরে ঘাড়ে একটা রাইফেল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার পেছনে পেছনে আমাদের গ্রামের আরেক ফালতু মানুষ জালাল তাকে অবশ্য কেউই জালাল বলে ডাকে না, সবাই জালাইল্যা বলে ডাকে। সাথে আরো দুইজন আছে কিন্তু আমরা তাদের চিনি না, তারা পাশের গ্রামের মানুষ। এই তিনজনের মাঝে মতি হচ্ছে কমান্ডার।
আমরা কয়েকজন মতির পেছনে পেছনে হাঁটলাম, মতি গ্রামের মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে সড়ক ধরে হাঁটছিল। ফজলু চাচাকে বলল, চাচাজি, দোয়া করবেন আমার জন্য।
ফজলু চাচা জিজ্ঞেস করলেন, কিসের জন্য দোয়া চাও?
বুঝতেই পারছেন চাচাজি, দেশকে রক্ষা করার জন্য অস্ত্র হাতে নিছি, যুদ্ধ যদি করতে হয় আপনাদের দোয়া লাগবে।
তুমি বন্দুক দিয়া গুল্লি করতে পারো?
মতি বলল, এইটারে বন্দুক বলে না। এইটা হচ্ছে রাইফেল।
গুল্লি করবার পারো?
কী যে বলেন চাচাজি। পুরা এক সপ্তাহ ট্রেনিং দিচ্ছে একেবারে খাঁটি পাঞ্জাবি মিলিটারি ট্রেনিং। গুলি করা তো সোজা দরকার হলে এই রাইফেল পুরাটা খুলে আবার জোড়া দিতে পারমু।
মতি যখন কথা বলছিল তখন তার সাথে অন্য যে তিনজন ছিল তারা জোরে জোরে মাথা নাড়ল। ফজলু চাচা বললেন, একটা গুল্লি কর দেখি।
মতি বলল, গুল্লি করমু?
হ্যাঁ। আকাশের দিকে গুল্লি কর, দেখি কেমন লাগে শুনতে?
মতি বলল, আমাদের গুল্লি হিসাব কইরা দিছে চাচাজি। কারণ ছাড়া গুল্লি করা নিষেধ। সব গুল্লির হিসাব দিতে হয়। বুঝতেই পারেন মিলিটারি নিয়ম। তয় যদি দুষ্কৃতিকারী দেখি, তাহলে সেটা ভিন্ন কথা। তখন গুল্লি করার নিয়ম আছে?
দুষ্কৃতিকারীটা কারা?
ওই তো মুক্তিবাহিনী। ইন্ডিয়ার দালাল।
ফজলু চাচা মাথা নাড়ল, বলল, ও।
ওদের সাথে যুদ্ধ করার সময় গুল্লি করা ঠিক আছে।
তোমরা যুদ্ধ করবা?
মতি তার সিনা টান করে বলল, জি চাচাজি।
ও।
আমরা প্রায় মিলিটারি চাচাজি। আমাগো নাম রাজাকার বাহিনী।
ও। ফজলু চাচা আর কথা বাড়াল না।
কয়েক দিনের ভেতরেই ফালতু মতির নাম হয়ে গেল প্রথমে মতি রাজাকার, সেখান থেকে ধীরে ধীরে হলো মইত্যা রাজাকার। আমরা যারা তাকে আগে মতি ভাই ডাকতাম, এখন সামনাসামনি তাকে মতি রাজাকার আর আড়ালে মইত্যা রাজাকার ডাকি। মতি রাজাকার কিংবা মইত্যা রাজাকারের কাজ একটাই মিলিটারির পেছনে পেছনে থাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি মিলিটারি এই দেশের কিছু চেনে না, রাজাকার বাহিনী তাদেরকে সবকিছু চিনিয়ে দেয়। আশপাশে যত গ্রামে যত হিন্দুবাড়ি আছে তার সবগুলোতে নিয়ে গেল, সেগুলো লুট করিয়ে দিল। কয়েকটাতে আগুন দিল। শুধু হিন্দু বাড়ি না, যারা আওয়ামী লীগ করে তাদের বাড়িতেও আগুন দিয়ে দিল। প্রত্যেক দিনই আমরা দেখতাম দূরে কোনো গ্রাম থেকে ধোঁয়া উঠছে। আমাদের গ্রামে মাহতাব মিয়ার বাড়িতে যেদিন আগুন দিল, সেটা ছিল ভয়ংকর একটা দিন।
মাহতাব মিয়া খুবই সাদাসিধা মানুষ, বঙ্গবন্ধুর খুব ভক্ত তাই বঙ্গবন্ধুর বড় একটা ছবি নিজের বাংলাঘরে বাধিয়ে রেখেছিল। সেটাই হয়েছে তার অপরাধ। মতি রাজাকার মিলিটারিদের বোঝাল মাহতাব মিয়া আওয়ামী লীগ, তাই একদিন মিলিটারি নিয়ে তার বাড়ি ঘেরাও করল। মাহতাব মিয়া আগেই খবর পেয়েছিল তাই বউ-বাচ্চা সবাইকে নিয়ে সরে গিয়েছিল। প্রথমে তার ঘর লুট করল, বঙ্গবন্ধুর ছবিটা উঠানে রেখে মতি রাজাকার পা দিয়ে মাড়িয়ে সেটা নষ্ট করল। মিলিটারিদের মনে হয় বঙ্গবন্ধুর ওপর খুবই রাগ। একজন মিলিটারি তার রাইফেল দিয়ে তার ছবির ওপরেই কয়েকটা গুলি করে দিল।
বাড়িতে কেমন করে আগুন দেয় সেটা আমি তখন প্রথমবার দেখলাম। প্রথমে কেরোসিন দিয়ে ঘরের চারদিকে ভিজিয়ে দেয়। তারপর খড়ের স্তূপ ঘরের ভেতরে ফেলে সেটাতেও কেরোসিন ঢেলে দেয়। তারপর বাইরে থেকে একটা খড়ের গোছায় আগুন ধরিয়ে ভেতরে ছুড়ে দেয়। দেখতে দেখতে পুরো ঘরে আগুন ধরে যায়।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখলাম কীভাবে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। এত বড় আগুন আমি জন্মেও দেখি নাই। ঠাস ঠাস করে শব্দ হতে থাকে, শো শো করে ঝড়ের মতো বাতাস বইতে থাকে। আগুনের এত তাপ হলো যে আমাদের অনেক দূরে সরে যেতে হলো।
মাহতাব মিয়ার বাড়িতে যখন আগুন দেয়া হয় তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু আগুনের জন্য পুরো এলাকাটা দিনের মতো আলো হয়ে গেল। মিলিটারিগুলো রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আর মতি রাজাকার তার দলবল নিয়ে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ‘হিন্দুস্থান মুর্দাবাদ’ বলে চিৎকার করে লাফাতে লাগল। আগুনের লাল আভার সামনে রাজাকারগুলোর কালো ছায়া দেখে আমার মনে হলো, জাহান্নাম নিশ্চয়ই এ রকম হয়। জাহান্নামের আগুনের সামনে শয়তান নিশ্চয়ই এভাবে লাফাতে থাকে।
মিলিটারিগুলো আস্তে আস্তে আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষজনদের ধরে নিয়ে যেতে শুরু করল। কালী গাংয়ের তীরে দাঁড় করিয়ে তাদের গুলি করে পানিতে ফেলে দিত। আমরা যদি কালী গাংয়ের তীরে বসে থাকি তাহলে মাঝে মাঝেই দেখি একটা-দুইটা লাশ ভেসে যাচ্ছে। অনেক কমবয়সী মেয়েমানুষের লাশও ভেসে যায়। রঙিন শাড়ি পরা একজন মেয়ের লাশ যখন ভেসে যায়, তখন সেটা দেখতে এত অদ্ভুত লাগে যে কাউকে বোঝাতে পারব না।
একদিন আমি আর মামুন কালী গাংয়ের পাড়ে বসে আছি তখন দেখলাম একটা মেয়ের লাশ ভাসতে ভাসতে আমাদের তীরে এসে লাগল। মামুন বলল, মাটি চাচ্ছে। এই লাশটা মাটি চাচ্ছে।
লাশ মাটি চাইলে কী করতে হয় আমরা জানি না। আমরা তো আর লাশটাকে টেনে তুলে কবর দিতে পারব না। ঠিক তখন কোথা থেকে জানি কয়েকটা কুকর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল, কুকুরগুলো একটা আরেকটার সাথে ঝগড়া করতে করতে লাশটাকে কামড়ে ওপরে তুলে আনতে লাগল। এটা নূতন শুরু হয়েছে, কুকুরগুলো মানুষের লাশ খাওয়া শিখেছে। নদীর পাড়ে এরা ঘোরাঘুরি করে, মানুষের লাশ দেখলে টেনে তীরে এনে খেতে থাকে কী ভয়ংকর একটা দৃশ্য। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কেউ যদি আমাকে বলত যে কুকুর মানুষের লাশ খেতে থাকবে আর আমরা সেটা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব, আমি সেটা কখনোই বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন সেটা প্রত্যেক দিন চোখের সামনে হচ্ছে।
আমি মামুনকে বললাম, আয় কুকুরগুলোকে তাড়িয়ে দিই।
মামুন সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বলল, চল।
আমরা চিৎকার করে ঢিল ছুড়ে কুকুরগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কুকুরগুলো নড়ল না বরং দাঁত বের করে আমাদের দিকে তাকিয়ে গর্জন করতে লাগল। জীবনেও আমি কোনো কুকুরকে এ রকম করতে দেখি নাই। নিশ্চয়ই মানুষের লাশ খেয়ে খেয়ে এগুলো এখন আর মানুষকে ভয় পায় না। বরং জীবন্ত মানুষকে দেখলে মনে করে এটা কেন লাশ হয়ে যায় না, তাহলে তো এটাকেও খেতে পারি।
আমি তখন খুঁজে খুঁজে একটা লাঠি নিয়ে এসে কুকুরগুলোকে ধাওয়া করলাম। কুকুরগুলো তখন একটু সরে গেল কিন্তু একেবারে চলে গেল না, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে দাঁত বের করে গরগর শব্দ করতে লাগল। আমরা লাঠি দিয়ে ধাক্কা দিয়ে লাশটাকে নদীর দিকে ঠেলে দিলাম। একটু চেষ্টা করতেই লাশটা নদীর স্রোতে গিয়ে পড়ল, তারপর পানিতে ভেসে যেতে শুরু করল। কুকুরগুলো তীরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘেউ ঘেউ করে শেষ পর্যন্ত চলে গেল। আমি মামুনের দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা মামুন, আমি তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি।
কী কথা?
তুই কি কোনো দিন ভেবেছিলি আমাদের সামনে কুকুর মানুষের লাশ খাবে আর আমরা সেটা দেখব?
না।
তুই কি ভেবেছিলি আমরা একটা মেয়ের লাশ লাঠি দিয়ে পানিতে ঠেলে দেব?
না।
তুই কি ভেবেছিলি আমাদের কাছে মনে হবে এটা খুবই সাধারণ একটা ঘটনা?
না।
রাত্রিবেলা যখন আমি ভাত খেতে বসেছি একবার রঙিন শাড়ি পরা মেয়েটির কথা মনে পড়ল। কে জানে সে কি নদীর পানিতে ভেসে যাচ্ছে নাকি আবার কোথাও আটকা পড়েছে আর হিংস্র কুকুর তার লাশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে?
নানি আমার থালায় ভাত তুলে দিতে দিতে বলল, কী ভাবিস?
আমি বললাম, কিছু না নানি। আমি নানিকে সব কথা বলি কিন্তু আজকে এই মেয়েটার কথা বলতে ইচ্ছে করল না।
ডোরা আমার হাতে একটা কাঁচি দিয়ে বলল, নে।
আগে সে আমাকে তুমি তুমি করে বলত, আজকাল তুই করে বলতে শুরু করেছে। একজন তুই বললে আরেকজনকেও তুই বলতে হয়, তাই আমিও ডোরাকে তুই করে বলি। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও আজকাল অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি কাঁচিটা নিয়ে বললাম, কেন?
তুই আমার চুল কেটে দিবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কী কেটে দেব?
চুল। চ-উকারে চু আর ল, চুল।
আমি কোনো দিন কারো চুল কাটি নাই। আর মেয়েদের চুল তো কাটতে হয় না, মেয়েদের চুল বড় রাখতে হয়।
আমি মেয়েদের মতো চুল কাটতে বলি নাই। ছেলেদের মতো চুল কাটতে বলছি।
আমি হাঁ হয়ে বললাম, কার মতো?
ছেলেদের মতো। ছ একারে ছে আর ল একারে লে, ছেলে।
তুই তোর চুল ছেলেদের মতো করে কাটবি?
হ্যাঁ।
কেন?
সেটা তুই একটু পরেই দেখবি।
আমি জিজ্ঞেস করলাম তোর আম্মু আর নোরা বুবু জানে?
ডোরা বলল, সবকিছু সবার জানার দরকার নাই।
তার মানে জানে না। তুই তাদেরকে না বলে ছেলেদের মতো করে চুল কাটছিস?
ডোরা বলল, তুই কি মনে করিস আম্মু আর আপুকে বললে তারা আমাকে ছেলেদের মতো করে চুল কাটতে দেবে?
তাহলে?
ডোরা বলল, তাহলে কী?
তোর চুল কেটে দিলে তোর আম্মু আর নোরা বুবু আমার ওপর রাগ হবে না?
তার মানে তোর এতটুকু সাহস নাই। এ রকম মুরগির বাচ্চার মতো সাহস নিয়ে তুই মুক্তিযোদ্ধা হবি? বলে আমার হাত থেকে কেড়ে কাঁচিটা নিয়ে ডোরা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে নিজের মাথার চুল কাটতে থাকে।
আমি হাঁ হাঁ করে উঠলাম, করছিস কী? করছিস কী?
ঠিকই করছি বলে সে আবার ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চুল কাটতে থাকে। দেখতে দেখতে ডোরার মাথার চুলগুলো খোঁচা খোঁচা হয়ে কাটা পড়তে থাকে।
আমি তখন ডোরার হাত থেকে কাঁচিটা কেড়ে নিয়ে বললাম, ঠিক আছে, ঠিক আছে, দে আমাকে দে। আমি কেটে দিই।
আমি কেটে না দিলে সে নিজেই কেটে ফেলবে, তখন তার ভয়ংকর একটা চেহারা হবে, তাই আমার কাটাই ভালো। আমি তখন ডোরার চুল কাটতে লাগলাম। আমি যে ডোরার থেকে খুব ভালো করে কাটলাম, তা নয় কিন্তু তার পরও মোটামুটিভাবে ছেলেদের মতো চুল কাটা হলো।
ডোরা নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল, ঠিক আছে। এখন তুই বাইরে যা।
কোথায় যাব?
বাইরে। ঘরের বাইরে।
আমরা বাংলাঘরে বসে চুল কাটাকাটি করছিলাম। আমাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে বলছে কেন জানি না। কিন্তু সেটা নিয়ে কোনো কথা না বলে আমি ঘর থেকে বের হলাম। ডোরা দরজাটা বন্ধ করে দিল তারপর কয়েক মিনিট পর দরজা খুলে বের হয়ে এল। একটু আগে যে ফ্রকটা পরছিল সেটা খুলে শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরেছে, দেখে সত্যি সত্যি তাকে একটা ছেলের মতো লাগছে। আমি অবাক হয়ে ডোরার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ডোরা বলল, আমাকে চিনতে পারছিস? আমি হচ্ছি খোকন। ডোরা হচ্ছে আমার মামাতো বোন। আমি হচ্ছি ডোরার ফুপাতো ভাই। ডোরার দাদা-দাদি হচ্ছে আমার নানা-নানি। বুঝেছিস?
আমি আসলে কিছু বুঝি নাই। কিন্তু মাথা নাড়লাম, বললাম, ঝুঝেছি।
তাহলে চল।
কোথায়?
গ্রাম থেকে ঘুরে আসি দেখি গ্রামের লোকজন খোনকে চিনতে পারে নাকি। বলে সে খালি পায়ে ঘর থেকে বের হলো। আমিও তার পিছু পিছু বের হলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এই শার্ট-প্যান্ট কোথায় পেয়েছিস?
জোগাড় করেছি।
তোর আম্মু আর আপু দেখলে কী বলবে? তোর দাদা-দাদি?
সেটা নিয়ে তোর দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আয়।
কাজেই আমি ডোরাকে নিয়ে বের হলাম। গ্রামে মিলিটারি আসার পর ঘর থেকে মানুষজন একটু কম বের হয়, তার পরও কয়েকজনের সাথে দেখা হলো। বেশির ভাগ মানুষই ডোরাকে লক্ষ্য করল না। শুধু একজন আমাকে জিজ্ঞেস করল, এটা কে? আগে গেরামে দেখি নাই।
আমি বললাম, এর নাম খোকন। যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব মারা গেছেন তার বোনের ছেলে।
ও। বলে মানুষটা ডোরাকে জিজ্ঞেস করল, এই গ্রামে থাকবা কয় দিন?
ডোরা মাথা নাড়ল, বলল, জি। আমাদের স্কুল বন্ধ ক্লাস হয় না, তাই আবু-আম্মু এইখানে পাঠিয়ে দিয়েছে।
ডোরার গলার স্বরটা শুনেও মানুষটা কিছু সন্দেহ করল না। হেঁটে চলে গেল।
ডোরাকে যে কেউ চিনবে না সেটা একটু পরেই আমরা আরো ভালো করে বুঝতে পারলাম। সড়কে মতি রাজাকারের সাথে দেখা হয়ে গেল। সে তার দুইজন শাগরেদকে দিয়ে জোরে জোরে হেঁটে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম একটা পায়জামার ওপরে খাকি শার্ট পরে থাকত, এখন কোথা থেকে কালো রঙের প্যান্ট জোগাড় করেছে, পায়ে কাপড়ের জুতা। আমাদের দেখে তীক্ষ্ণ চোখে একবার আমাকে আরেকবার ডোরাকে দেখল, তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, এইটা কেডা?
আমি বললাম, খোকন।
খোকন কেডা?
ডোরাকে চিনতে পারে নাই, আমি তখন বললাম, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবরে মিলিটারি মেরে ফেলেছে মনে আছে?
মতি রাজাকার অস্বস্তির সাথে মাথা নাড়ল, তার প্রিয় পাকিস্তানের মিলিটারি কাউকে মেরে ফেলেছে এ রকম কথা শুনতে তার ভালো লাগে না।
আমি বললাম, ইঞ্জিনিয়ার চাচার ছোট বোনের ছেলে। খোকন।
ও। মতি রাজাকার এইবারে মাথা নাড়ল।
ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মেয়ে ডোরাকে দেখেছিলেন না?
হ্যাঁ। মতি রাজাকার আবার মাথা নাড়ল।
তার ফুপাতো ভাই।
ও। মতি রাজাকার তখন শার্টের হাতা সরিয়ে ঘড়ি দেখল, আগে তার হাতে ঘড়ি ছিল না, রাজাকার হওয়ার পর কোনো জায়গা থেকে এই ঘড়ি লুট করেছে। মতি রাজাকারের এখনো ঘড়ি দেখা অভ্যাস হয় নাই, কয়টা বাজে বুঝতে একটু সময় লাগল। বলল, সর্বনাশ দেরি হয়ে গেছে।
কই যান?
মিলিটারি ক্যাম্পে।
আমি বললাম, ও।
ক্যাম্পে নূতন একজন মেজর সাহেব আসছেন, নাম হচ্ছে মেজর ইয়াকুব।
আমি কোনো কথা বললাম না। মতি রাজাকার বলল, চেহারাটা একেবারে ফিল্ম স্টারের মতো। দেখলে ট্যারা হয়ে যাবি।
আমি কিছু বললাম না। মতি রাজাকার বলল, অন্য মিলিটারির মতো না, কলিজা যে রকম বড়, দিলটাও সেই রকম বড়। পূর্ব পাকিস্তান বলতে পাগল, চারদিক তাকায় আর বলে, কেয়াবাত কেয়াবাত হাউ বিউটিফুল।
অন্য দুইজন রাজাকার জোরে জোরে মাথা নাড়ল। একজন বলল, একেবারে আসল খান্দানি।
মেজর সাহেবের সাথে আমাগো মিটিং। মেজর সাহেব আমাগো খুবই মায়া করেন।
আমি এবারেও কোনো কথা বললাম না। মতি রাজাকার তখন তার ঘড়ি আরো একবার দেখল তারপর হেঁটে হেঁটে চলে গেল।
আমি তখন বললাম, ডোরা, তুই–।
ডোরা বলল, ডোরা না। খোকন।
ঠিক আছে, খোকন, তুই পরীক্ষায় পাস। তোরে যখন মইত্যা রাজাকার চিনতে পারে নাই, আর কেউ চিনতে পারবে না।
আমি জানি।
আমি তখন ডোরাকে মাহতাব মিয়ার বাড়িতে নিয়ে গেলাম, পুরো বাড়িটা পুড়ে কালো ছাই হয়ে আছে। টিনের একটা চাল একদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে। বাড়ির আশপাশে বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ ছিল, আগুনের তাপে গাছগুলো ঝলসে গেছে। গাছগুলোর পাতা ঝরেও গেছে, দেখেই বোঝা যায় গাছগুলো মরে গেছে। মানুষের মতো গাছও মরে যায়।
আমরা যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন কাত হয়ে থাকা টিনের চালের নিচ থেকে একটা শেয়াল বের হয়ে পেছনে জঙ্গলের দিকে ছুটে গেল। কয়দিন আগেও যেখানে মানুষ থাকত এখন সেখানে শেয়াল থাকে।
ডোরা জিজ্ঞেস করল, মাহতাব মিয়া এখন কোথায়?
জানি না। মনে হয় অন্য কোনো গ্রামে চলে গেছে।
সবাই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে, তাই না?
আমি মাথা নাড়লাম আর ঠিক তখন গুড়গুড় করে মেঘের ডাক শুনলাম। আজকাল দূর থেকে যখন গোলাগুলির শব্দ হয় সেটাকে অনেক সময় মেঘের ডাকের মতো শোনায় কিন্তু এই মেঘের ডাকটি একেবারে আসল মেঘের ডাক। আমি আকাশের দিকে তাকালাম, সত্যি সত্যি আকাশ মেঘে ঢেকে আছে তার মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে।
আমি বললাম, বৃষ্টি আসছে। চল বাড়ি যাই তাড়াতাড়ি।
কেন, তাড়াতাড়ি কেন?
বৃষ্টি হলে ভিজে যাবি না?
ডোরা বলল, আমি তো ভিজতেই চাই। বাড়ি গেলেই তো সবাই আমাকে বকাবকি করবে। একটু দেরি করেই যাই। বকাবকি যখন করবেই তখন ভালোমতোই করুক।
খুবই আজব যুক্তি, কিন্তু একটা যুক্তি, তাতে কোনো সন্দেহ নাই। আমি কিছু বললাম না। তাই আমরা গ্রামের সড়ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে একেবারে হিন্দুপাড়া গেলাম। এর মাঝে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, প্রথমে টিপ টিপ করে তারপর ঝিরঝির করে সর্বশেষে ঝমঝম করে। আমি আর ডোরা বৃষ্টির পানিতে ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেলাম। শুকনো মাটি বৃষ্টির পানিতে ভিজে নরম হয়ে গেল, গাছের পাতাগুলো ধুয়ে সবুজ হয়ে গেল। চারদিকে কেমন যেন একটা তাজা তাজা ভাব।
আমি লক্ষ করলাম ডোরা একসময় বৃষ্টির পানিতে ভিজে ঠাণ্ডায় তিরতির করে কাঁপছে। আমি বললাম, আয় বাড়ি যাই। তুই শীতে কাঁপছিস।
ডোরা বলল, কিছু হবে না।
তোর অভ্যাস নাই, পরে জ্বর উঠে যাবে।
উঠবে না।
আমি তবু রাজি হলাম না, ডোরাকে নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম।
বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছানোর আগেই আমি একটা উত্তেজনা টের পেলাম। বাড়ির সবাই এই বৃষ্টির মাঝে ছাতা মাথায় দিয়ে ছোটাছুটি করছে। আমাদের দেখে ডোরার বড় বোন নোরা বুবু ছুটে এল, খোকন। সেজে থাকা ডোরাকে দেখেও দেখল না, আমাকে জিজ্ঞেস করল, রঞ্জু, তুমি কি জানো ডোরা কোথায় গেছে? দুপুর থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি কিছু বলার আগেই নোরা বুবু ডোরার দিকে তাকাল এবং সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল, এই তো ডোরা! তোর এ কী অবস্থা?
নোরা বুবুর চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে আসে, ডোরা চুল কেটে শার্ট প্যান্ট পরে ছেলে সেজেছে, তারপর বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে, কারো মুখ থেকে কোনো কথা বের হয় না। ডোরার আম্মু অনেকক্ষণ ডোরার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোর কী হয়েছে ডোরা? তুই আমারে আর কত কষ্ট দিবি?
নোরা বলল, তুই এত সুন্দর চুলগুলো কেমন করে কাটলি ডোরা? শার্ট-প্যান্ট পরে ছেলে সেজেছিস কেন?
ডোরা বলল, আমি এখন থেকে আর ডোরা না। আমি হচ্ছি খোকন। আমি আর মেয়ে না, আমি ছেলে।
সবাই হাঁ করে ডোরার দিকে তাকিয়ে রইল।
ডোরাকে দেখে বাড়িতে যে রকম হইচই চিৎকার হবে বলে ভেবেছিলাম তার কিছুই হলো না। তাকে সবাই যেভাবে বকাবকি করবে ভেবেছিলাম, তাও করল না তার কারণ বাড়িতে খুঁজে না পেয়ে সবাই এত চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল যে এখন তাকে পেয়ে সবাই খুশি। ডোরা হিসেবে পেলেও খুশি, খোকন হিসেবে পেলেও খুশি। এই গ্রামে মিলিটারির ক্যাম্প, রাজাকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে তার মাঝে যদি একটা মেয়েকে খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে চিন্তা তো করতেই পারে। সেই মেয়েটা ছেলে হয়ে ফিরে এসেছে, না মেয়ে হয়ে ফিরে এসেছে, সেটা নিয়ে কেউ আর মাথা ঘামাচ্ছে না। একটা খুবই জটিল সমস্যার এ রকম একটা সহজ সমাধান হবে, সেটা কে ভেবেছিল?
আমি ডোরাকে বাড়ির মানুষের হাতে ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে এলাম। বৃষ্টিটা একটু কমে এসেছে, আকাশে এখনো কালো মেঘ, মাঝে মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে আবার হয়তো বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে।
আমি লতিফা বুবুর বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ভাবলাম তার একটু খোঁজ নিয়ে যাই। কিন্তু খোঁজ নেয়ার জন্য ভেতরে যেতে হলো না, লতিফা বুবু নিজেই বের হয়ে এল। লতিফা বুবুর মুখটা কেমন জানি থমথম করছে। আমাকে বলল, এই রঞ্জু, শোন। আমি তোকে কয়দিন থেকে খুঁজছি। ভালোই হলো, তোকে পেয়ে গেলাম।
আমি বললাম, কী হয়েছে, লতিফা বুবু।
তুই আমাকে একটা কাজ করে দিতে পারবি?
কী কাজ?
আগে বল করে দিবি। লতিফা বুবুর চোখ কেমন যেন ছলছল করতে থাকে।
আমি বললাম, একশ বার করে দিব লতিফা বুবু। কী কাজ বলো।
বল খোদার কসম।
খোদার কসম।
আমার গা ছুঁয়ে বল খোদার কসম।
লতিফা বুবু তার হাতটা বাড়িয়ে দিল, আমি হাতটা ছুঁয়ে বললাম, খোদার কসম।
লতিফা বুবু তখন তার হাতে মুঠি করে রাখা দলামোচা এক টাকার একটা নোট বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, তুই আমাকে এটা দিয়ে ইঁদুর মারার বিষ কিনে দিবি।
আমি অবাক হয়ে বললাম, ইঁদুর মারার বিষ?
হ্যাঁ।
কেন?
তোর সেটা জানার দরকার নাই। তোকে বলেছি কিনে দিতে, তুই কিনে দিবি।
আমি লতিফা বুবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, লতিফাবু—
কী হয়েছে?
তুমি কেন ইঁদুর মারার বিষ কিনতে চাচ্ছ?
লতিফা বুবু আমার দিকে কেমন করে জানি তাকাল, তারপর বলল, আমি খাব।
এ আমি চমকে উঠলাম। আমাদের গ্রাম দেশে মানুষ তিনভাবে আত্মহত্যা করে, হয় গলায় দড়ি দেয়, না হলে ধানক্ষেতে পোকা মারার বিষ খায়, তা না হলে ইঁদুর মারার বিষ খায়। লতিফা বুবু কেন বিষ খেতে চাচ্ছে?
আমি বললাম, কী হয়েছে তোমার লতিফা বুবু?
তোর জানার দরকার নাই। তোকে বলেছি বিষ কিনে দিতে তুই বিষ কিনে দিবি। তুই কসম কেটেছিস।
বড় মানুষও মাঝে মাঝে বোকা হয়ে যায়, লতিফা বুবুও মনে হলো সে রকম। লতিফা বুবু কেমন করে ভাবল আমি কসম খেয়েছি বলে তাকে আত্মহত্যা করার জন্য বিষ কিনে দেব? কিন্তু এখন সেটা নিয়ে আলোচনা করার সময় না তাই আমি সেটা নিয়ে কোনো কথা বললাম না। আমি লতিফা বুবুর হাত ধরে বললাম, তোমার কী হয়েছে লতিফা বুবু? বলবে?
লতিফা বুবুর চোখ দুইটা কেমন যেন জ্বলে উঠল, দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, হারামজাদা মইত্যা রাজাকার আমারে বিয়া করবার চায়।
মামুন এই কথাটা আমাকে অনেক দিন আগেই বলেছে, আমি সেটা জানি কিন্তু এমন ভান করলাম যে আমি এই প্রথম শুনলাম। চোখ কপালে তুলে বললাম, কী বলছ তুমি লতিফা বুবু।
হ্যাঁ। এই হারামজাদার কত বড় সাহস সে আমারে বলে তাকে বিয়া করতে। বলে বিয়া না করলে–
বিয়া না করলে কী?
থাক তোর শোনার দরকার নাই।
বলো।
লতিফা বুবু নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মইত্যা রাজাকার আমারে বলে আমি যদি তারে বিয়া না করি তাহলে সে নাকি আমারে ধইরা মিলিটারি ক্যাম্পে দিয়া আসব। কত বড় সাহস হারামজাদার।
আমি কিছু বললাম না, বড়রা এ রকম একটা বিষয় নিয়ে আজকাল কথা বলে আমাদের মতো ছোটদের দেখলেই থেমে যায়। চারপাশের কমবয়সী মেয়েরা আরো দূরের গ্রামে চলে যাচ্ছে, যাদের বিয়ে হয় নাই তারা বিয়ে করে ফেলছে।
লতিফা বুবু বলল, মইত্যা রাজাকার খালি আমারে কয় নাই, বাবারেও কইছে। বাবা অনেক ভয় পাইছে, মনে হয় সত্যি সত্যি আমারে মইত্যা রাজাকারের সাথে বিয়া দিয়া দেব। যদি আসলেই বিয়া দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে আমি বিষ খামু। খোদার কসম।
লতিফা বুবুর চোখ দুটি জ্বলজ্বল করতে লাগল। দেখে বুঝতে পারলাম সত্যি সত্যি দরকার হলে লতিফা বুবু বিষ খেয়ে ফেলবে।
লতিফা বুবু আমার হাতে টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল, যা, এক্ষুনি যা। ইন্দুর মারার বিষ কিনে দে।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। লতিফা বুবুর টাকাটা পকেটে ঢুকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। আমার এত মন খারাপ হলো যে সেটা বলার মতো না। যতই দিন যাচ্ছে গ্রামের অবস্থা ততই খারাপ হচ্ছে। আমাদের গ্রামে এখন কোনো হিন্দু নাই। আওয়ামী লীগ করে সেই রকমও কেউ নাই। মতি রাজাকার মিলিটারির দল নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। মিলিটারি মানুষ মেরে কালী গাংয়ে ফেলে দেয়, বাড়িতে আগুন দেয়। কমবয়সী মেয়েদের ধরে নিয়ে যায়। কয়েক দিন পরে তাদের লাশও কালী গাংয়ে ভেসে ওঠে। কী হবে চিন্তা করে কূল-কিনারা পাই না। শুধু মাঝে মাঝে বহুদূর থেকে গোলাগুলির শব্দ আসে, তখন বুঝতে পারি মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে। কখন মুক্তিযোদ্ধারা এই গ্রামে এসে এই ক্যাম্পটা দখল করবে? কখন আমরা শান্তিতে ঘুমাব?
এখন তার সাথে যোগ হয়েছে লতিফা বুবুর ব্যাপারটা, পকেটে তার দলামোচা টাকার নোটটা কেমন যেন গরম কয়লার মতো জ্বলছে। আমি কী করব এখন? আসলেই লতিফা বুবুকে ইঁদুর মারার বিষ কিনে দেব?
আমি তখনও জানতাম না এই সমস্যাটা খুব তাড়াতাড়ি এমনভাবে মিটে যাবে, যেটা স্বপ্নেও কল্পনা করি নাই।
মিলিটারিরা মানুষ মারার জন্য কিংবা গ্রাম জ্বালানোর জন্য যেখানেই যাক না কেন তারা অন্ধকার হবার আগে ফিরে আসে। আমি আর মামুন কালী গাংয়ের পাড়ে বসে দেখছিলাম মিলিটারিগুলো কোনো একটা গ্রামে সর্বনাশ করে ফিরে এসে সারি বেঁধে আমাদের স্কুলে ঢুকে গেল। মতি রাজাকার আর তার দলও তাদের লুট করা মালপত্রের বোঁচকাকুঁচকি নিয়ে নিজেদের বাড়িতে রওনা দিল।
তখন একটা খুবই বিচিত্র ব্যাপার ঘটল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম ধানক্ষেতের কাদার ওপর দিয়ে ছপাত ছপাত করে হেঁটে লুঙ্গি গেঞ্জি পরা কিছু মানুষ আসছে। তাদের কাঁধে রাইফেল, বুকের মাঝে গুলির বেল্ট। মাথার মাঝে গামছা বাঁধা। দেখেই বুঝতে পারলাম এরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম–এরা কি মিলিটারির সাথে যুদ্ধ করতে আসছে? এখন? এভাবে?
মুক্তিযোদ্ধার দলটা কোনো দিকে তাকাল না, ধান ক্ষেত থেকে সড়কে উঠে আমাদের সড়ক ধরে হাঁটতে লাগল। তারা হেঁটে হেঁটে একেবারে কালী গাংয়ের তীরে এল। তারপর ডান দিকে ঘুরে বলাই কাকুর চায়ের স্টলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে কালী গাংয়ের তীর ঘেঁষে জংলা জায়গাটার দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম আজকে এখানে তাদের যুদ্ধ করার পরিকল্পনা নেই, এরা কোথাও যাচ্ছে। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম কারণ দেখতে পেলাম মুক্তিযোদ্ধারা আসছে তো আসছেই, মনে হচ্ছে তাদের কোনো শেষ নেই। প্রথম প্রথম তাদের কাছে ছিল রাইফেল পরের দিকে যারা আসতে লাগল তাদের কাছে আরো ভারী ভারী অস্ত্র, নানা রকম মেশিনগান, মর্টার, গ্রেনেড লঞ্চার আমরা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
তখন সবচেয়ে সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটল, আমরা মাসুদ ভাইকে দেখলাম। প্রথমে চিনতে পারিনি কারণ চুল লম্বা হয়ে গেছে, মুখে দাড়ি গজিয়ে গেছে। মাসুদ ভাই আলগোছে একটা স্টেনগান ধরে হেঁটে হেঁটে আসছে। তার ঠিক পেছনে দুইজন, মনে হলো মাসুদ ভাইয়ের বডিগার্ড।
এতক্ষণ কেউ থামে নাই সবাই হেঁটে হেঁটে চলে গেছে কিন্তু মাসুদ ভাই বলাই কাকুর চায়ের স্টলে থামল। একটা চেয়ার বাইরে নিয়ে এসে সেখানে আরাম করে বসল। তার দুইজন বডিগার্ড স্টলের দুই পাশে মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাসুদ ভাই পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। আমরা সবাই তখন মাসুদ ভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়েছি, মাসুদ ভাই আমাদের সবার দিকে তাকাল কিন্তু কারো সাথে একটা কথাও বলল না। এমন কি আমাদের চিনতে পেরেছে সে রকমও কোনো ভাব দেখাল না। সিগারেট টানতে টানতে প্রথম কথা বলল, সুলেমান নামের যে মানুষটা বলাই কাকুর চায়ের স্টল দখল করেছে তার সাথে। তাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম সুলেমান?
সুলেমানের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, কোনো মতে সে মাথা নাড়ল।
তুমি নাকি মতি রাজাকারের মামু? সত্যি নাকি?
সুলেমানের হাত তখন কাঁপতে শুরু করেছে, কোনোমতে আবার মাথা নাড়ল।
এই স্টলটা দখল করার জন্য বলাই কাকুরে মিলিটারি দিয়ে মার্ডার করিয়েছ, নাকি বলাই কাকু মার্ডার হয়েছে বলে এটা দখল করেছ?
সুলেমান এইবার প্রথম কথা বলল, আমি দখল করতে চাই নাই, আল্লাহর কসম। দুলাভাই কইল-
দুলাভাইটা কে? লতিফ চেয়ারম্যান?
জে। দুলাভাই কইল, বলাইয়ের এত সুন্দর স্টলটা মানুষ লুটেপুটে নেবে, তার থেকে চায়ের স্টলটা তুমি চালাও।
ও। মাসুদ ভাই সিগারেটে একটা টান দিয়ে বলল, চায়ের স্টল চলে? নাকি মিলিটারিদের ফ্রি চা খাওয়াও?
সুলেমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই স্টলের ভেতরে তাকাল, তখন ফ্রেম করে রাখা ইয়াহিয়া খানের ছবিটা তাঁর চোখে পড়ল। মাসুদ ভাই বলল, ইয়াহিয়া খানের ছবিটা কে লাগিয়েছে? তুমি?
সুলেমান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই বলল, এই মানুষটা দেশের কত মানুষকে মেরেছে তুমি জানো?।
সুলেমান কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই বলল, তোমারে কেউ কিছু বলে নাই, কোনো জোর করে নাই আর তুমি ইয়াহিয়া খানের মতো একটা মানুষের ছবি বলাই কাকুর চায়ের স্টলে ঝুলিয়ে দিলে। কাজটা ঠিক হলো?
সুলেমান মাথা নেড়ে জানাল, কাজটা ঠিক হয় নাই। মাসুদ ভাই বলল, ছবিটা নামাও।
সুলেমান কাঁপতে কাঁপতে ছবিটা নামাল। মাসুদ ভাই বলল, আমার সামনে রাখো।
সুলেমান তার সামনে রাখল। মাসুদ ভাই তখন পা দিয়ে মাড়িয়ে ফ্রেমের কাঁচটা ভেঙে ফেলল। তারপর লাথি দিয়ে ফ্রেমটা সুলেমানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ভেতর থেকে ছবিটা বের কর।
সুলেমান ছবিটা বের করল। মাসুদ ভাই বলল, এখন এটা ছিঁড়ে চায়ে ভিজিয়ে ভিজিয়ে খাও।
সুলেমান কথাটা বুঝতে পারল না, হাঁ করে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মাসুদ ভাই এবার ধমক দিয়ে বলল, কথা কানে যায় না? বললাম না ছবিটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও। খেয়ে আমাকে বল এর টেস্ট কেমন।
সুলেমান ধমক শুনে কেঁপে উঠল, তারপর সত্যি সত্যি ছবিটার একটু খানিক ছিঁড়ে মুখে দিয়ে চিবুতে লাগল। দৃশ্যটা দেখে আমাদের এত হাসি পেল যে বলার নয়, সত্যি সত্যি আমরা হেসে ফেললাম আর আমাদের হাসি শুনে অন্যেরাও হাসতে শুরু করল।
মাসুদ ভাই সত্যি সত্যি সুলেমানকে দিয়ে পুরো ছবিটা খাওয়াত কি না আমরা সেটা দেখতে পেলাম না। কারণ ঠিক তখন দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মতি রাজাকারকে ধরে মাসুদ ভাইয়ের কাছে নিয়ে এল। একজন মুক্তিযোদ্ধা বলল, এই রাজাকার লুকিয়ে মিলিটারির ক্যাম্পে যাচ্ছিল খবর দিতে!
মাসুদ ভাই বলল, তুমি যেতে দিলে না কেন? তুমি কি মনে করো খবর পেলেও মিলিটারি এখন বের হতো? কখনো না। এরা অন্ধকারে বের হয় না। এদের সব বীরত্ব দিনের বেলা পাবলিকের সাথে! মাসুদ ভাই মতি রাজাকারের দিকে তাকিয়ে বলল, কী রাজাকার সাহেব? আপনার কি মনে হয় আপনার মিলিটারি বাবারা যদি খবর পায় আমরা এখানে বসে আছি তাহলে তারা বের হবে? এই সাহস আছে?
মতি রাজাকার কোনো কথা বলল না, কী রকম জানি ফ্যাকাসে মুখে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। মাসুদ ভাই কিছুক্ষণ মতি রাজাকারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর বলল, তুমি মইত্যা রাজাকার না?
মতি রাজাকার কেমন যেন ভয় পেয়ে মাসুদ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই এবারে স্টেনগানটা কোলের ওপর থেকে হাতে নিল, সাথে সাথে মতি রাজাকার মাথা নাড়তে থাকল।
মাসুদ ভাই বলল, আজকে কী কী লুট করেছ দেখাবে?
মতি রাজাকার তার পোঁটলাটা ধরে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা টান দিয়ে পোটলাটা হাতে নিয়ে সবকিছু মাটিতে ঢেলে দিল, কয়েকটা ঘড়ি, একটা ট্রানজিস্টর রেডিও, বিছানার চাদর, কয়েকটা শাড়ি, কাঁসার থালাবাসন কিছু খুচরা টাকা বের হলো। মাসুদ ভাই সেগুলো দেখে হতাশভাবে মাথা নাড়ল, জিজ্ঞেস করল, এই? কোনো সোনাদানা পাও নাই?
মতি রাজাকার কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই তখন হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে গেল, হাত দিয়ে তাঁর গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমি আসলে তোমাকে খুঁজছিলাম। খবর পেয়েছি তুমি নাকি গ্রামে গ্রামে খুব উৎপাত করো। কমবয়সী মেয়ে-ছেলেদের দিকে নজর? সত্যি নাকি?
মতি রাজাকার মাথা নেড়ে জানাল যে এটা সত্যি না। মাসুদ ভাই বলল, ঠিক আছে তাহলে এখানেই বিচার হয়ে যাক। এই যে সব গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে তাদেরকে জিজ্ঞেস করি। তারা যদি বলে তুমি নির্দোষ আমি তোমাকে ছেড়ে দেব। তুমি তোমার লুটের মাল নিয়ে বাড়ি যাবা। রাজি?
মতি রাজাকার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, কোনো কথা বলল না। মাসুদ ভাই তখন একটা ধমক দিল, কী হলো? কথা বলো না কেন?
মতি রাজাকার ধমক খেয়ে চমকে উঠে বলল, আপনার পা ধরি আমারে মাফ করে দেন। এই কান ধরে বলছি আর জীবনে কাউরে কিছু করব না। আল্লাহর কসম। কথা বলতে বলতে সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল, কাঁদতে কাঁদতে বলল, ভুল করে ফেলেছি, আর করব। আজ থেকে আমি জয় বাংলা হয়ে যামু, খোদার কসম বলছি। আর মিলিটারির লগে থাকমু না গ্রামের মানুষরে কোনো উৎপাত করমুনা, সবার সামনে কথা দিতেছি।
মাসুদ ভাই হাত তুলে বলল, থামো। খামোখা কান্নাকাটি করো না। তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি আবার রাজাকার হয়ে যাবে, আমি জানি। বলাই কাকুরে তোমরা যেভাবে মেরেছ, তোমাকে সেই ভাবে মারলে তোমার আর রাজাকার হওয়ার উপায় থাকবে না। বুঝেছ?
মতি রাজাকার হঠাৎ ছুটে এসে মাসুদ ভাইয়ের পা ধরে সেখানে মাথা ঘষতে ঘষতে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, আল্লাহর কসম লাগে আমারে মাফ করে দেন। আর জীবনে বেইমানি করমু না, আজ থেকে আমি জয় বাংলা, পাকিস্তানের মুখে জুতা মারি…
মাসুদ ভাই পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মতি রাজাকারকে সরিয়ে দিয়ে বলল, থামো। কান্নাকাটি করো না, তোমাকে মারতে হলে আমার একটা গুলি খরচ হবে, আমি তোমার জন্য একটা গুলি নষ্ট করতে রাজি না। আমাদের অস্ত্রপাতি অনেক সাবধানে খরচ করতে হয়।
মতি রাজাকার মাথা তুলে বলল, তাহলে আমারে মাফ করে দিলেন?
না, মাফ করি নাই। কিন্তু তোমারে একটা সুযোগ দিলাম। তুমি যদি আর মানুষের উৎপাত করো, মেয়েদের দিকে নজর দাও তাহলে তোমারে আমি শেষ করে দেব। গুলি যদি একটা নষ্ট করতে হয়, তাও নষ্ট করব। মনে থাকবে?
মতি রাজাকার মাথা নাড়ল, বলল, মনে থাকবে।
আর তোমাকে আরো একটা কাজ করে দিতে হবে।
কী কাজ?
তোমার বাবা যে মিলিটারিরা আছে তাদেরকে বলবা আমরা আসতেছি। যদি তারা বাপের বেটা হয় তাহলে যেন আমাদের সাথে যুদ্ধ করে। গ্রামের নিরীহ মানুষজনকে ধরে লাইন করে গুলি করার মাঝে কোনো বীরত্ব নাই। বুঝেছ?
মতি রাজাকার মাথা নাড়ল। মাসুদ ভাই বলল, তোমাদের একজন নূতন মেজর আসছে না? কী যেন নাম ইয়াকুব না বিয়াকুব?
মেজর ইয়াকুব।
তারে আমার নাম বলবা। আমার নাম জানো?
মতি রাজাকার মাথা নাড়ল, জানি।
না জানলে চ্যাংড়া মাস্টারও বলতে পারো, কোনো সমস্যা নাই। তোমার মেজরকে বলবা আমি আমার বিচ্ছুদেরকে নিয়া আসতেছি। সে যেন প্রস্তুত থাকে। বলবা তো?
মতি রাজাকার মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। মাসুদ ভাই দাঁড়াল, দাঁড়িয়ে বাইরে তাকাল, বাইরে আবছা অন্ধকার, তার মাঝে এখনো মুক্তিযোদ্ধার দল হেঁটে যাচ্ছে। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম, তখন হঠাৎ একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল, আমার মনে হলো এই মুক্তিযোদ্ধাটাকে একটু আগে আমি হেঁটে যেতে দেখেছি। এখন আবার যাচ্ছে, কী আশ্চর্য! একজন মানুষ দুইবার যায় কেমন করে?
মাসুদ ভাই মতি রাজাকারকে বলল, তুমি যাও। বিদায় হও। যাওয়ার আগে তোমার লুটের মাল নিয়ে দাও। মতি রাজাকার তার পোঁটলাটার ভেতরে লুট করা জিনিসগুলো ভরে মাথা নিচু করে বের হয়ে গেল। প্রথমে আস্তে আস্তে হাঁটল, তারপর দৌড়াতে লাগল।
আমরা যারা মাসুদ ভাইকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলাম তাদের দিকে তাকিয়ে মাসুদ ভাই বলল, আপনারা এখন বাড়ি যান। কেউ আমার সাথে কথা বলবেন না। কথা বললেই সেটা মিলিটারির কানে পৌঁছাবে, আপনাদের বিপদ হবে। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। আগে ভাবতাম দেশ স্বাধীন করতে নয়-দশ বছর যুদ্ধ করতে হবে, এখন আমি জানি ছয় মাসের মাঝে দেশ স্বাধীন হবে। ইনশা আল্লাহ।
তারপর মাসুদ ভাই তার দুইজন বডিগার্ড নিয়ে অন্যদের সাথে হাঁটতে শুরু করল, আমিও তার পিছু নিলাম। কালী গাংয়ের তীর ঘেঁষে বেশ খানিকটা যাবার পর আমি বললাম, মাসুদ ভাই।
কী ব্যাপার রঞ্জু?
আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
এখন আশপাশে কেউ নাই, জিজ্ঞেস করতে পারো।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধাকে দুইবার হেঁটে যেতে দেখলাম-
মাসুদ ভাই হা হা করে হেসে উঠল, সাথে সাথে অন্যরাও হাসতে শুরু করল। হাঁটা থামিয়ে তারা দাঁড়িয়ে গেল এবং দাঁড়িয়ে হাসতে লাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হাসেন কেন মাসুদ ভাই?
মাসুদ ভাই আমার মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, রঞ্জু, তোমার বুদ্ধি আছে! আর কেউ বুঝতে পারে নাই, খালি তুমি বুঝতে পেরেছ।
কী বুঝতে পেরেছি?
আজকে আমরা এসেছি সবাইকে ধোকা দিতে।
ধোঁকা দিতে?
হ্যাঁ। আমরা দেখলাম মিলিটারি রাজাকার মিলে খুব বেশি উৎপাত শুরু করেছে তাই আজকে তাদের একটু ভয় দেখালাম।
ভয় দেখালেন?
হ্যাঁ। আমরা জঙ্গলের ভিতরে ক্যাম্প করেছি। সেখানে আমাদের প্রায় চল্লিশজনের মতো মুক্তিযোদ্ধা আছে, তারাই এখানে পাক খাচ্ছে। জঙ্গল থেকে বের হয়ে গ্রামের ভেতর দিয়ে হেঁটে অন্য মাথায় ঢুকে যায়। তারপর জঙ্গল দিয়ে আগের জায়গায় এসে আবার রওনা দেয়! এই ভাবে চল্লিশজন এক ঘন্টা থেকে পাক খাচ্ছে–সবাই ভাবছে শত শত মুক্তিযোদ্ধা! খালি তুমি ধরতে পেরেছ। অন্ধকারের মাঝে তুমি দেখলে কেমন করে?
তাহলে আসলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা নাই?
আছে আছে। সবাই ট্রেনিং নিচ্ছে, বর্ষার জন্য অপেক্ষা করছিল। বর্ষা শুরু হয়েছে। এখন এক লাখের বেশি মুক্তিযোদ্ধা নামবে। তারা আসছে। অস্ত্র নিয়ে আসছে।
অস্ত্র তো আছে আপনাদের! কত অস্ত্র!
মাসুদ ভাই আবার হা হা করে হাসল, হেসে বলল, আর এক মাসের মাঝে আরো অস্ত্র এসে যাবে। কিন্তু এক মাস অপেক্ষা করলে এই এলাকার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। মিলিটারি যেন ক্যাম্প থেকে বের না হয় সে জন্য এখনই একটা মহড়া দিলাম। এইগুলো আসল অস্ত্র না। বাঁশ দিয়ে কাঠ দিয়ে বানিয়ে আলকাতরা দিয়ে রং করে দিয়েছি।
একজন মুক্তিযোদ্ধা আমাকে একটা ভারী অস্ত্র হাতে নিতে দিল, হাতে নিয়ে টের পেলাম অস্ত্রটা একেবারেই ভারী না, বাঁশ-কাঠ দিয়ে তৈরি, ওপরে আলকাতরা। আবছা অন্ধকারে সত্যি না মিথ্যা বোঝার উপায় নাই।
আমার একটু মন খারাপ হলো, আমি ভেবেছিলাম শত শত মুক্তিযোদ্ধা অনেক রকম অস্ত্র। আসলে মাত্র চল্লিশজন মুক্তিযোদ্ধা, অল্প কয়টা অস্ত্র। কিন্তু আমি মন খারাপটা প্রকাশ করলাম না। মাসুদ ভাই বলল, যাও, বাড়ি যাও। আর তোমাকে নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না যে, তুমি কাউকে বলবে না আজকে কেমন একটা ধোকা দিলাম।
না, বলব না। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমাকে আপনাদের সাথে নেবেন?
তুমি তো আমাদের সাথেই আছ। তুমি আমাদের মতো একজন মুক্তিযোদ্ধা তা না হলে আমাদের এত বড় একটা গোপন কথা তোমাকে কেমন করে বললাম।
আমি আসল মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই। বিশ্বাস করেন, আমি পারব।
আমি জানি, তুমি পারবে।
আগে বলেছিলেন নয়-দশ বছর লাগবে, আমি ভেবেছিলাম তত দিনে বড় হয়ে যাব। এখন বলছেন মাত্র ছয় মাস
রঞ্জু, যদি সত্যি সত্যি ছয় মাসে দেশ স্বাধীন হয়ে যায় তাহলেও তুমি সুযোগ পাবে। তুমি তোমার চোখের সামনে দেখবে। তুমি ইতিহাসের অংশ হবে।
মাসুদ ভাই এখন অনেক ভালো ভালো কথা বলতে লাগল, কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম আমাকে আসলে নেবে না, সে জন্য এত ভালো ভালো কথা বলছে! আমার এত মন খারাপ হলো যে চোখে পানি এসে গেল। অন্ধকার বলে মাসুদ ভাই দেখতে পেল না।
আমি একা একা কালী গাংয়ের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরে এলাম।
মাসুদ ভাই ঠিকই বলেছিল, মুক্তিবাহিনীর এই মহড়ার পর মিলিটারির খুব দরকার না হলে ক্যাম্প থেকে বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। রাজাকারদের উৎপাতও কমে গেল। মাসুদ ভাই মতি রাজাকারকে এমন ভয় দেখিয়েছিল, যে সে একেবারে সিধে হয়ে গেল। তার রাইফেলটা মুক্তিবাহিনীরা নিয়ে গিয়েছিল বলে মিলিটারিরা তাকে আরেকটা রাইফেল দিয়েছে (তার আগে শুনেছি মিলিটারি তাকে কঠিন শাস্তি দিয়েছে!) এখন সে খুবই মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এতজন মানুষের সামনে মাসুদ ভাইয়ের পা ধরে মাফ চেয়ে কোনোভাবে জান বাঁচিয়েছে সেটার জন্য তার খুব বেইজুতি হয়েছে। লতিফা বুবুকে বিয়ে করার চিন্তা এখন তার মাথায় নাই, মুখ দেখানোর উপায় নাই, বিয়ে করার চিন্তা করে কেমন করে?
আমি লতিফা বুবুকে তার ইঁদুর মারার বিষ কিনে দেয়ার টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম। লতিফা বুবু নেয় নাই, বলেছে, এটা তোর। তুই জিলাপি কিনে খাস।
এক টাকার জিলাপি আমি একা খেয়ে শেষ করতে পারব মনে হয় না।
কয়দিন থেকে ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে। এত বৃষ্টি যে মনে হচ্ছে আকাশ বুঝি ভেঙে পড়ছে। অন্য সময় এত বৃষ্টি হলে আমার মনে হয় একটু মেজাজ খারাপ হতো, এইবারে তা হচ্ছে না। বৃষ্টি মানেই পাকিস্তান মিলিটারির সমস্যা, বৃষ্টি মানেই মুক্তিবাহিনীদের সুবিধা। মুক্তিবাহিনীদের অস্ত্র নৌকা করে আনে, বর্ষার সময় নদীতে যখন অনেক পানি থাকে তখন অস্ত্র আনা-নেয়ার অনেক সুবিধা।
আমি আর ডোরা মাঝে মাঝেই বৃষ্টির মাঝে বের হই। ডোরাকে অবশ্য এখন ডোরা না ডেকে খোকন ডাকাই ভালো, কারণ সে সত্যি সত্যি চুল ছোট করে শার্ট-প্যান্ট পরে খোকন হয়ে গেছে। বাড়ির কয়েকজন ছাড়া অন্যরা তাকে খোকন বলেই জানে! বের হওয়ায় সময় হাতে একটা ছাতা থাকে। একটু পরেই ছাতা গুটিয়ে আমরা বৃষ্টিতে ভিজি। বৃষ্টিতে ভিজতে অবশ্যি ডোরার আগ্রহই বেশি। শহরে থাকে বলে আগে এ রকম বৃষ্টিতে ভিজে ছপছপ করে কাদার ভেতর দিয়ে কখনো হাঁটেনি। তা ছাড়া এগুলো সব হচ্ছে ডোরার মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সে এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে সে মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
সেদিন মুক্তিবাহিনীর দল গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিল তখন সে খবর পায়নি বলে নিজের চোখে দেখতে পায়নি, সেটা নিয়ে তার আফসোসের সীমা নাই। তার সবচেয়ে দুঃখ যে সুলেমান আর মতি রাজাকারকে কীভাবে মাসুদ ভাই একটা উচিত শিক্ষা দিয়েছে, সেটা সে নিজের চোখে দেখতে পারল না। তাই যখনই ডোবার সাথে আমার দেখা হয় আমার পুরো গল্পটা বলতে হয়। আমি গল্পটাতে অনেক রংচং লাগিয়ে বলি আর সেটা শুনে ডোরা হাসতে হাসতে মারা যায়।
আজকেও আবার পুরো গল্পটা বলতে হলো, ডোরা তখন জিজ্ঞেস করল, সুলেমান কি পুরো ইয়াহিয়া খানের ছবিটা খেয়ে শেষ করেছিল?
ঠিক তখন মতি রাজাকারকে ধরে এনেছিল বলে কেউ সুলেমানের দিকে নজর দেয়নি তাই কেউ সেটা লক্ষ্য করেনি কিন্তু আমি সেটা বলে গল্পের মজা নষ্ট করলাম না। আমি বললাম, শেষ করে নাই মানে! পুরো ছবিটা খেয়ে পেছনের কার্ডবোর্ডটা খেয়েছে, তারপর ছবির ফ্রেমটা চাবাতে শুরু করেছিল।
আর মতি রাজাকার? মতি রাজাকার মাসুদ ভাইয়ের পা ধরে কী করল?
আমি তখন বাড়িয়ে-চাড়িয়ে বললাম, পুরো জুতোর তলাটা চেটে চেটে পরিষ্কার করল।
সত্যি?
সত্যি না তো মিথ্যা নাকি! মাসুদ ভাই কত কাদা গোবর মাড়িয়ে এসেছে, জুতার নিচে কত ময়লা সব চেটে খেয়ে ফেলল!
ডোরা বলল, ইয়াক থু! তারপর হি হি করে হাসতে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজে কাদার ওপর খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে আমরা কালী গাং পর্যন্ত গেলাম। কালী গাংয়ে অনেক পানি এসেছে, ঘোলা পানিতে অনেক স্রোত, পানি পাক খেতে খেতে যাচ্ছে, দেখলে একটু ভয় ভয় করে। আমার বাবা আর মা মনে হয় এ রকম একটা স্রোতের মাঝে নৌকা ডুবে মারা গিয়েছিলেন।
আমরা অনেকক্ষণ কালী গাংয়ের তীরে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যখনই একটা নৌকা যাচ্ছিল তখনই আমরা বলছিলাম, এইটা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর নৌকা! কিংবা এইটাতে বোঝাই করে নিশ্চয়ই অস্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছে। তারপর কী কী অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছে সেগুলোর নাম বলতে শুরু করলাম। আমি একটার নাম বললাম তখন ডোরা আরেকটার নাম বলল। এইভাবে দুইজনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল রাইফেল, স্টেনগান, মেশিনগান, এসএলআর, গ্রেনেড, মর্টার এই সব শেষ হয়ে গেলে আমি বললাম কিল!
ডোরা বলল, কিল কি আবার অস্ত্র নাকি?
একশবার অস্ত্র। একটা মিলিটারিকে ধরে আনলে সবাই কিলিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে না?
ঠিক আছে। ডোরা হাসতে হাসতে রাজি হয়ে গেল। তারপর বলল, ঘুষি।
আমি বললাম, চড়।
ডোরা বলল, থাপ্পর।
খামছি।
চিমটি। এভাবে বলতেই থাকল আর আমরা বোকার মতো হাসতেই থাকলাম।
যখন বৃষ্টিটা কমছে তখন আমি আর ডোরা বাড়ি ফিরে যেতে শুরু করলাম। ডোরা হঠাৎ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই আমাকে একটা কথা দে।
কী কথা।
আগে বল আমার কথাটা রাখবি।
কথাটা আগে শুনি।
ডোরা মাথা নাড়ল। বলল, না, আগে কথা দে।
ঠিক আছে কথা দিলাম। এখন বল, কী কথা।
ডোরা মুখ গম্ভীর করে বলল, তুই আমাকে ছাড়া কখনো একা একা মুক্তিবাহিনীতে যাবি না।
আমি শব্দ করে হাসলাম, বললাম, মুক্তিবাহিনী কি আমাকে নেবে? যখনই মাসুদ ভাইকে বলি তখনই মাসুদ ভাই বলে তুমি ছোট, তুমি ছোট।
ডোরা হাসল না, মুখ শক্ত করে বলল, আমি সেটা জানি না। কিন্তু তুই কথা দে, আমাকে না নিয়ে তুই একা কখনো মুক্তিবাহিনীতে যাবি না।
আমি বললাম, কথা দিলাম।
আমাকে ছুঁয়ে কথা দে।
আমি ডোরার হাত ছুঁয়ে বললাম, কথা দিলাম।
ডোরাকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন যাচ্ছি তখন হঠাৎ তাকিয়ে দেখি সড়ক ধরে মিলিটারি আর রাজাকারের একটা দল আসছে। আমার বুকটা ধক করে উঠল। আমি সড়ক থেকে সরে পাশে এসে দাঁড়ালাম।
বৃষ্টি কমেছে বলে অনেকেই কাজকর্ম করার জন্য ঘর থেকে বের হয়েছে, সড়কে কিছু লোকজন ছিল তারা সবাই কেমন যেন ভয় পেয়ে সড়ক থেকে সরে রাজাকার আর মিলিটারিদের যাবার জায়গা করে দিল।
কিছু মানুষকে দেখে মিলিটারিগুলো দাঁড়িয়ে গেল, তখন আমি একজনকে আলাদাভাবে লক্ষ্য করলাম। সে নিশ্চয়ই মেজর ইয়াকুব, কারণ অন্যেরা তার থেকে একটু পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে। মেজর ইয়াকুব মানুষগুলোকে জিজ্ঞেস করলে, কেয়া হাল হায়? আচ্ছে হোনা?
মানুষগুলো মাথা নাড়ল।
তোম কেয়া মুক্তি হো? না কেয়া পাকিস্তানি হো?
আমাদের গ্রামের মানুষেরা উর্দু জানে না কিন্তু প্রশ্নটা ঠিকই বুঝতে পারল। জিজ্ঞেস করছে তারা কি মুক্তিবাহিনীর পক্ষে, নাকি পাকিস্তানের পক্ষে। মানুষগুলো বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল, যার অর্থ যা কিছু হতে পারে। মেজর ইয়াকুব তখন বলল, বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মানুষগুলো অস্পষ্ট স্বরে বলল, পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
মেজর ইয়াকুব তখন খুব খুশি হয়ে তার দলবল নিয়ে হাঁটতে থাকে। আমি ভেবেছিলাম আমাকে কোনো পাত্তা দিয়ে হেঁটে চলে যাবে। কিন্তু মেজর ইয়াকুব হঠাৎ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মেরা বেটা, তোম ক্যোয়সা হো।
আমি কেমন আছি জানতে চাচ্ছে। ছোট হওয়ার একটা সুবিধা আছে, কিছু বুঝি নাই এ রকম ভান করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা যায়। আমি তা-ই করলাম, ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।
মেজর ইয়াকুব বলল, কেয়া! তোম মুক্তি হয় না?
বলা উচিত ছিল তোমরা কয়জন ছাড়া এই দেশের সবাই মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু এটা তো আর বলা যায় না। তাই চুপ করে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব তখন বলল, বেটা, বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
এই কথাটা বুঝতে পারি নাই সেটা ভান করে লাভ নাই। যে কেউ এই কথাটা বুঝবে। কিন্তু আমি কেমন করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলি? বুঝে হোক না বুঝে হোক আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব কেমন জানি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, তারপর নরম গলায় বলল, বোলো বেটা।
আমি বললাম না।
বোলো। বোলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
আমার মাথায় কী হলো আমি জানি না, আমি চুপ করে রইলাম, শুধু যে চুপ করে রইলাম তা না, আমি সোজা মেজর ইয়াকুবের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি দেখলাম, মেজর ইয়াকুবের চোখ ধক ধক করে জ্বলে উঠল। একটা রাজাকার রাইফেলের বাঁট দিকে দিয়ে আমাকে মারার জন্য এগিয়ে এল। মেজর ইয়াকুব হাত বাড়িয়ে তাকে থামাল, নিচু গলায় বলল, ছোড় দো। লেট ইট গো।
তারপর পকেট থেকে একটা লজেন্স বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি হাত বাড়িয়ে লজেন্সটা নিলাম। মেজর ইয়াকুব একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে আবার হাঁটতে শুরু করল। রাজাকার আর মিলিটারিগুলো আমার সামনে থেকে একটু সরে যেতেই আমি লজেন্সটা সড়কের নিচে ছুড়ে ফেলে দিলাম। পাকিস্তানি মিলিটারির হাতের লজেন্স খাওয়ার আগে আমার মরে যাওয়া ভালো।
পরদিন দুপুরবেলা রাজাকারের একটা দল আমাকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গেল। নানি কিছুতেই নিতে দেবে না, চিৎকার করে আমাকে শক্ত করে ধরে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু রাজাকাররা ধাক্কা দিয়ে নানিকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে টেনে নিতে লাগল।
আমাকে যখন টেনে সড়ক দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন নানি চিৎকার করতে করতে বিলাপ করে আমার পেছনে পেছনে ছুটে আসছিল, একসময় গ্রামের লোকজন তাকে ধরে সরিয়ে নিয়েছে। গ্রামের অনেক মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি লতিফা বুবুকেও দেখলাম। ডোরা নিশ্চয়ই খবর পায় নাই, তাই তাকে দেখলাম না। গ্রামের একজন মুরব্বি রাজাকারদের থামিয়ে আমাকে ছুটিয়ে নিতে চেষ্টা করল, বলল, বাবারা, এই মাসুম বাচ্চাটারে কেন ধরে নিয়ে যাচ্ছ?
মেজর সাহেবের অর্ডার।
গিয়া বল, পোলাটা বাড়িতে নাই। খুঁজে পাও নাই।
না না, মিছা কথা বলা যাবে না।
বাবা, এই ক্যাম্পে যারা ঢুকে তারা তো কখনো জ্যান্ত বের হয় নাই।
একজন রাজাকার বলল, সেইটা আমাদের বিষয় না।
আরেকজন বলল, এত চিন্তা করেন কেন? দুই-চাইরটা চড়-থাপ্পর দিয়া তো ছাইড়াও দিতে পারে।
মুরব্বি বলল, আল্লাহর কসম লাগে। বাপ-মা মরা এতিম ছাওয়ালটাকে ছাইড়া দেও।
রাজাকারগুলো মুরব্বিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক কী কারণ জানা নাই, আমার কেন জানি খুব বেশি ভয় লাগছিল না। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আমি চিন্তা করতে পারছিলাম, মানুষ যখন ঠিক করে চিন্তা করতে পারে না, তখন মনে হয় ভয় পায় না। আনন্দ কিংবা দুঃখও পায় না।
স্কুলের গেটে বালুর বস্তা দিয়ে ঘেরাও করে মিলিটারিরা পাহারা বসিয়েছে। ওপরে সাইনবোর্ডে বড় করে আমাদের স্কুলের নাম নবকুমার হাই স্কুল লেখা ছিল। আলকাতরা দিয়ে সেটা মুছে সেখানে লেখা হয়েছে গাঁজালা ইয়াকুব হাই স্কুল। হিন্দু নাম সরিয়ে মুসলমান নাম। গাজালা ইয়াকুব মানুষটা কে? মনে হয় মেজর ইয়াকুবের বাবা কিংবা মা।
স্কুলের ভেতর ঢুকে আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম, এটা যে আমাদের স্কুল ছিল বোঝার কোনো উপায় নাই। স্কুলের ভেতরে কত গাছ ছিল, এখন কোনো গাছ নাই, কেমন জানি ন্যাড়া লাগছে। জায়গায় জায়গায় তাঁবু খাটিয়েছে। তেরপল টানিয়ে নিচে বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। পানির ড্রামে মিলিটারিগুলো খালি গায়ে গোসল করছে। এই মাথা ওই মাথা দড়ি টানানো সেইখানে কাপড়ও ধুয়ে শুকাতে দিয়েছে। স্কুলের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা বাঁশ পুঁতে তার আগায় একটা পাকিস্তানের পতাকা টানিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানের পতাকা দেখতে যে এত ভয়ংকর সেটা আমি আগে কখনো বুঝতে পারি নাই।
রাজাকারগুলো হেডমাস্টারের রুমের সামনে দাঁড়াল। মনে হয় এখন এই রুমটা মেজর ইয়াকুবের রুম। দরজার কাছে একটা মিলিটারি পাহারা দিচ্ছিল, রাজাকারগুলোর সাথে আমাকে দেখে সে ভেতরে ঢুকে কিছু একটা বলল, তখন আমি মেজরের গলার স্বর শুনতে পেলাম, আন্দার লে আও।
রাজাকারগুলো আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। আমাদের হেডমাস্টারের রুমটা এখন চেনা যায় না। এক পাশে আলমারি ছিল, আলমারিতে বই ছিল, ফুটবল খেলায় জিতে আমরা যে ট্রফি পেয়েছিলাম, সেগুলো ছিল, এখন তার কিছু নাই। বড় টেবিলের পাশে একটা ছোট টেবিল, সেই টেবিলের ওপর একটা পিস্তল। পাশে একটা বোতল, পাশে কয়েকটা গ্লাস। আমি আগে কখনো মদের বোতল দেখি নাই কিন্তু মনে হলো এইটা নিশ্চয়ই মদের বোতল।
মেজর ইয়াকুব সবাইকে চলে যেতে বলল, তখন একজন একজন করে সবাই বের হয়ে গেল। মেজর ইয়াকুব একটা সিগারেট ধরিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ক্যায়া, ডর লাগতি হু?
আমি ভয় পেয়েছি কি না জানতে চেয়েছে। আস্তে আস্তে আমার ভয় লাগতে শুরু করেছে। আমি তাই মাথা নেড়ে জানালাম যে আসলেই আমার ভয় লাগছে।
মেজর ইয়াকুব হাসার মতো ভঙ্গি করল, তারপর বাংলা বলার চেষ্টা করল, বয় নাই। কুনু বয় নাই।
কী কারণ জানি না, মেজর ইয়াকুবের মুখে এই বাংলা শুনে আমার হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক হতে থাকে। মেজর ইয়াকুব তার পা দুইটা টেবিলে তুলে দিয়ে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করল। আধা বাংলা আধা উর্দুতে সে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এই স্কুলে পড়ো?
আমি মাথা নাড়লাম।
এই স্কুলে মাসুদ আহমেদ নামে একজন শিক্ষক পড়াত তুমি তাকে চিনো?
আমি এক মুহূর্ত চিন্তা করলাম, চিন্তা করে মাথা নেড়ে জানালাম যে চিনি।
তার সাথে তোমার যোগাযোগ আছে?
আমার হঠাৎ করে গলা শুকিয়ে গেল, বললাম, নাই।
মেজর ইয়াকুবের মুখ শক্ত হয়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না। আমরা জানি যেদিন তোমার শিক্ষক মুক্তিবাহিনীর দল নিয়ে এসেছে সেদিন তুমি তার সাথে দেখা করেছ। তুমি তার সাথে কথা বলেছ।
আমি চমকে উঠলাম। মেজর ইয়াকুব হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, কী নিয়ে কথা বলেছ?
আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলাম। মাসুদ ভাই আমাকে বলতে না করেছে আমি কাউকে বলতে পারব না। আমাকে মেরে ফেললেও বলব না।
মেজর ইয়াকুব টেবিল থেকে তার পা নামিয়ে আমার দিকে হিংস্র চোখে তাকিয়ে বলল, তার দলে কতজন আছে, কী কী অস্ত্র? কোথায় থাকে তুমি জানো?
আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে আমি জানি না। মেজর ইয়াকুব টেবিলে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করল। কালকে আমি তোমাকে পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে বলেছিলাম, তুমি বলো নাই। কেন বলো নাই?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না। কী উত্তর দেব? মেজর ইয়াকুব বলল, আমি বলি, তুমি কেন বলো নাই? তুমি বলো নাই তার কারণ তুমিও আসলে মুক্তিবাহিনী! তোমার মতো বাচ্চা ছেলেদেরও ব্রেন ওয়াশ করা হয়ে গেছে। বুঝেছ?
আমি কিছু বললাম না। তু
মি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। বলো।
আমি বললাম, আমি কিছু জানি না।
তুমি যদি উত্তর না দাও তাহলে তোমার মুখ থেকে আমি জোর করে উত্তর বের করব। তুমি বাচ্চা দেখে আমি ছেড়ে দেব না। এই বাঙালি হচ্ছে জারজ সন্তানের জাতি। এদের বাঁচিয়ে রেখে কোনো লাভ নাই। ছোট-বড় কাউকে বাঁচিয়ে রেখে লাভ নাই।
আমি ভয় পাওয়া চোখে মেজর ইয়াকুবের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেজর ইয়াকুব বলল, ম্যায় ইস মুলককা সেরফ জমিন চাতা হু। লোক নেহি। আমি এই দেশের খালি মাটি চাই, মানুষ চাই না।
আমার গলা শুকিয়ে গেল, বুক কাঁপতে লাগল। একবার মনে হলো যা জানতে চেয়েছে বলে দিই। তারপরেই মাথা থেকে সেই চিন্তা সরিয়ে দিলাম, আমি মাসুদ ভাইকে কথা দিয়েছি কাউকে বলব না। আমাকে কথা রাখতে হবে। আমি পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিলাম না।
মেজর ইয়াকুব উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে বোতলটা নিয়ে গ্লাসে পানির মতো একটা তরল ঢালল, সাথে সাথে ঘরের ভেতর ঝাঁঝাল টক টক একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। এক টোকে গ্লাসের পুরো তরলটা খেয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে ডাকল, সরফরাজ।
বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা ভেতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেজর ইয়াকুব বলল, ইসকে টর্চার সেল মে লে যাও।
মিলিটারিটা খপ করে আমার ঘাড়টা ধরল, লোহার মতো শক্ত হাত, মনে হলো আমার ঘাড়ের ভেতর তার আঙুলগুলো ঢুকে গেছে। যখন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছি তখন মেজর ইয়াকুব মিলিটারিটাকে আবার কিছু একটা বলল, কী বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হলো বলেছে। আমাকে টর্চার করে আমার ভেতর থেকে কথা বের করতে।
ক্লাস নাইন সেকশন ‘বি’টা হচ্ছে টর্চার সেল। বাইরে তালা লাগানো। বড় বড় গোঁফওয়ালা একজন তালা খুলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়।
ঘরের মাঝে কয়েকজন লোক পড়ে আছে, সারা শরীরে রক্ত শুকিয়ে আছে। মানুষগুলো বেঁচে আছে না মরে গেছে, বোঝা যাচ্ছে না। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে একজন বসে ছিল, আমাকে দেখে বিড়বিড় করে বলল, হেই খোদা এই বাচ্চাটারে কেন আনছে।
বড় বড় গোঁফওয়ালা মানুষটা ধমক দিয়ে বলল খামোশ।
মানুষটা খামোশ হলো না, বলল, উসকো ছোড় দাও! আল্লাহর কসম। হামকো মারো। ইয়ে মাসুম বাচ্চা হয়।
খামোশ গাদ্দার। বলে গোঁফওয়ালা মানুষটা তাকে একটা লাথি দিল, মানুষটা নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে, পারে না। লাথি খেয়ে সে কাত হয়ে নিচে পড়ে গোঙাতে থাকে।
আমাকে বেঞ্চের ওপর উপুড় করে শুইয়ে বেঞ্চের পায়ার সাথে আমার হাত দুটি বেঁধে ফেলল। তারপর পা দুটি আলাদা করে বেঁধে নেয়। আমার বুকটা ধক ধক করছে। আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না। ভয়ে আতঙ্কে আমার সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে ছিল মজনু। মাঝে মাঝেই তাকে স্যারদের হাতে ভয়ংকর মার খেতে হতো। সে আমাদের শিখিয়েছিল যখন বেত মারা হয় তখন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে হয় তাহলে নাকি ব্যথা কম লাগে। আমি কি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করব? তাহলে সত্যিই কী ব্যথা কম লাগবে?
আমি টের পেলাম মিলিটারিটা আমার শার্টটা টেনে ওপরে তুলেছে, প্যান্টটা টেনে নিচে নামিয়ে এনেছে। তারপর দড়ির মতো কিছু একটা হাতে নিয়ে মানুষটা আমাকে মারল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম, আমি চিৎকার থামাতে পারলাম না। আমার সেই চিৎকারে সারা পৃথিবীটা নিশ্চয়ই টুকরা টুকরা হয়ে গেল।
আমি কতক্ষণ চিৎকার করেছি, জানি না। কিছুক্ষণ পর আমার আর কিছু মনে নাই। আমি নিশ্চয়ই মরে গেছি।
একটু পর পর আমার ঘাড়ে কেউ যেন খোঁচা দিচ্ছে, আমি হাত দিয়ে খোঁচাটা থামাতে গেলাম তখন একটা পাখা ঝটপটানোর শব্দ শুনতে পেলাম। কিছু একটা আমার কাছ থেকে উড়ে গেল। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলাম, মনে হলো বহুদূরে একটা নদী। আমি কোথায়?
আমি চারপাশে দেখার চেষ্টা করতেই শরীরের কোথায় জানি প্রচণ্ড ব্যথা করে উঠল। আমি যন্ত্রণার শব্দ করে খানিকক্ষণ ঝিম ধরে শুয়ে থাকলাম। তাহলে আমি কি বেঁচে আছি? বেঁচে থাকলে আমি কোথায় আছি? মিলিটারির ক্যাম্পে নাকি অন্য কোথাও?
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম। কয়েকটা কাক একটু দূরে বসে আমাকে লক্ষ্য করছে। এরাই মনে হয় ঘাড়ে ঠোকর দিচ্ছিল। কাঁকনডুবিতে কোনো কাক ছিল না। কাক নাকি শুধু নোংরা জিনিস খায়, মরা জিনিস খায়, তাই কাঁকনডুবিতে তাদের কোনো খাদ্য-খাবার ছিল না। এখন কাঁকনডুবিতে অনেক মরা মানুষ। তাদের অনেক খাবার। আমাকে মরা মনে করে কাকেরা খেতে এসেছিল। একটু পরে মনে হয় কুকুরগুলো আসবে, কাকের মতো এত সহজে সরে যাবে না। আমি বেঁচে থাকলেও তারা ছিঁড়ে-খুঁড়ে আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমার মনে হয় উঠে বসার চেষ্টা করা উচিত। আমি একটু চেষ্টা করতেই শরীরের কোথায় জানি ভয়ংকর ব্যথা করে উঠল। আমি আবার যন্ত্রণার শব্দ করে শুয়ে থাকলাম। আবার আমি অচেতন হয়ে যাচ্ছি। সবকিছু অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো আসলে আর কিছুতে কিছু আসে যায় না। বেঁচে থাকলেই কী আর মরে গেলেই কী। মনে হয় মরে গেলেই ভালো। বাবা আর মায়ের সাথে দেখা হবে কোনো দিন দেখি নাই। দেখা হলে কি চিনতে পারব? আমি কী বলব তাদেরকে?
ঠিক তখন মনে হলো কেউ একজন বলল, ইয়া মাবুদ! এইখানে এইটা কে?
তারপর ধুপ ধুপ পায়ের শব্দ শুনলাম। কেউ একজন আমার কাছে এসে আমার গায়ে হাত দিয়ে বলল, বেঁচে আছে। মরে নাই। বাচ্চা ছেলে।
আরেকজন বলল, এইটা রঞ্জু না? কালকে রাজাকাররা এরে ধরে নিল না?
মানুষ দুইজন আমাকে ধরাধরি করে তুলে নিল, শরীরের ভেতর আবার কোথায় জানি ভয়ংকর যন্ত্রণা করে উঠল। আমি চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, পারলাম না, চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।
আমার আবার যখন জ্ঞান হলো তখন আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে অনেক মানুষ, তারা কথা বলছে, একটা ছোট ছেলে আমার হাত ধরে বসে আছে। ছেলেটা কে? একটু পরে আমি ছেলেটাকে চিনতে পারলাম। ছেলেটা খোকন, চুল কাটা, শার্ট-প্যান্ট পরা ডোরা। আমি চোখ খুলতেই ডোরা চিৎকার করে বলল, চোখ খুলেছে। চোখ খুলেছে।
আমার ওপরে অনেকে ঝুঁকে পড়ল, নানির মুখটা দেখতে পেলাম, আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইডি! বাঁইচা আছস?
আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ, নানি।
বাঁইচা থাকবি? আল্লাহর কসম, তুই বল তুই বাঁইচা থাকবি! বল। বল তুই আমারে ছাইড়া যাবি না।
আমি বললাম, আমি তোমারে ছাইড়া কই যামু নানি।
তুই বাঁইচা থাকবি?
হ্যাঁ, নানি। আমি বাঁইচা থাকমু।।
তখন নানি আমারে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ডোরা আমার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ল, আমি দেখলাম তার চোখ থেকে টপ টপ করে আমার মুখের ওপর পানি পড়ছে। ডোরা কাঁদছে। আহা বেচারি।
ডোরা ফিসফিস করে বলল, রঞ্জু! তোমার অনেক সাহস।
আমার সুস্থ হতে অনেক দিন লাগল। পিঠের ঘা শুকালেও সেখানে লম্বা লম্বা কাটা দাগ রয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত হাঁটাচলার মতো যখন একটু সুস্থ হয়েছি তখন একদিন গভীর রাতে নানি আমাকে ডেকে তুলল, ফিসফিস করে বলল, তোর সাথে একজন দেখা করতে আসছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমার সাথে? এত রাত্রে?
হ্যাঁ।
কে?
জানি না।
বাতি জ্বালাও নানি, অন্ধকারে তো দেখা যাবে না।
বাতি জ্বালাইতে না করছে।
কেন বাতি জ্বালাইতে না করছে?
তখন অন্ধকার থেকে আমি মাসুদ ভাইয়ের গলা শুনতে পেলাম, মাসুদ ভাই বলল, এত রাতে বাতি জ্বালালে লোকজন সন্দেহ করবে। তোমার বাড়ির দিকে তো রাজাকারের নজর আছে, জানো না?
মাসুদ ভাই আপনি আসছেন?
আবছা অন্ধকারে মাসুদ ভাই এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত রাখল, বলল, তুমি আমার জন্য খুব কষ্ট করলে রঞ্জু। এরকম ভয়ংকর একটা অত্যাচার হলো তোমার ওপর। আমার খুব খারাপ লাগছে।
আমি বললাম, না, মাসুদ ভাই, আপনার কী দোষ! একটু থেমে বললাম, মাসুদ ভাই।
বলো।
আমাকে এত অত্যাচার করলেও আমি কিন্তু আপনাদের একটা কথাও মিলিটারিকে বলি নাই।
মাসুদ ভাই অন্ধকারে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি জানি। সেই জন্য আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
সত্যি? আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, সত্যি মাসুদ ভাই?
হ্যাঁ, তোমার এখানে থাকা নিরাপদ না। মিলিটারিরা তোমাকে মারে নাই, বাঁচিয়ে রেখেছে। তোমাকে দরকার হলে আবার ক্যাম্পে নিবে। অত্যাচার করবে। আমি খবর পেয়েছি।
আমি মাসুদ ভাইয়ের কথা ভালো করে শুনলামই না। আনন্দে আবার চিৎকার করলাম।
আমাকে মুক্তিবাহিনীতে নেবেন?
মাসুদ ভাই বলল, তোমাকে মুক্তিবাহিনীতে নিতে হবে না তুমি এর মাঝে মুক্তিবাহিনীতে আছ! তোমাকে আমাদের ক্যাম্পে নেব।
আমি আবছা অন্ধকারে নানির দিকে তাকিয়ে বললাম, নানি, আমি মুক্তিবাহিনীতে যাব।
নানি একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। আমার সাথে কথা বলছে। রাজাকাররা নাকি অপেক্ষা করতেছে একটু সুস্থ হলে তোরে আবার মিলিটারি ক্যাম্পে নেবে। এর থেকে এইটাই ভালো তুই এদের সাথে থাক। কথা শেষ করতে করতে নানি হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
আমি নানিকে ধরে বললাম, নানি তুমি কাইন্দ না। আমি তোমার সাথে দেখা করতে আসব।
মাসুদ ভাই বলল, একটু পরেই চাঁদ উঠে যাবে–তার আগে আমাদের গ্রাম থেকে বের হয়ে যেতে হবে। চল রঞ্জু।
আমার জামাকাপড় নিতে হবে না? বই-খাতা।
তাড়াতাড়ি নাও। দেরি করো না। অন্ধকারে যেটুকু পারো ততটুকু।
আমি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে একটা ব্যাগে সবকিছু ভরে নিলাম, তারপর মাসুদ ভাইয়ের হাত ধরে ঘর থেকে বের হলাম। নানি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, ফি আমানিল্লাহ। হেই খোদা ছেলেডারে আমি তোমার হাতে দিলাম, তুমি দেইখা রাখিও। তারপর কাঁদতে লাগল।
বাড়ির বাইরে দুইটা মুক্তিযোদ্ধা পাহারায় ছিল, তারা আমাদের সাথে সাথে হাঁটতে থাকে। আমরা সড়কে পা দিতেই হঠাৎ করে আমার ডোরার কথা মনে পড়ল, আমি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, কী হলো? দাঁড়ালে কেন?
মাসুদ ভাই, আমি একা একা মুক্তিবাহিনীতে যেতে পারব না। আমার আরেকজনকে নিয়ে যেতে হবে।
মাসুদ ভাই অবাক হয়ে বলল, আরেকজন? আরেকজন কে?
ডোরা।
ডোরা? ডোরা কে?
এখন তার নাম খোকন।
মাসুদ ভাই বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না রঞ্জু। তুমি কী বলছ পরিষ্কার করে বলো।
আমি মাসুদ ভাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ডোরা হচ্ছে যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে মেরে ফেলেছে, তার মেয়ে। ডোরার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার এত শখ যে সে চুল কেটে ফেলেছে, এখন শার্ট-প্যান্ট পরে ছেলের মতো থাকে। তার এখন নূতন নাম খোকন।
ঠিক আছে, যখন সুযোগ পাবে ডোরাও নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীতে যাবে।
মাসুদ ভাই, আমি তাকে কথা দিয়েছি তাকে না নিয়ে আমি মুক্তিবাহিনীতে যাব না।
তাকে কথা দিয়েছ?
হ্যাঁ, মাসুদ ভাই তার গা ছুঁয়ে কথা দিয়েছি। তাকে না নিয়ে আমি যেতে পারব না।
মাসুদ ভাই আমার কথা শুনে খুব ঝামেলায় পড়ে গেল। সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, দেখো রঞ্জু, তোমাকে নিতে আসাটাই খুবই বিপজ্জনক একটা মিশন। এই জন্য অন্য কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে আমি নিজে এসেছি। এখন সাথে আরেকজন ছোট মেয়েকে নেয়া তো খুব প্র্যাকটিকেল কথা না।
আমি খুব অনুনয় করে বললাম, কিন্তু মাসুদ ভাই আমি যে ডোরার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছি। এখন যদি তাকে না নিয়ে যাই তাহলে তো–
তাহলে কী?
তাহলে তো ডোরা মরে যাবে।
মরে যাবে?
হ্যাঁ।
মাসুদ ভাই খুব বিপদে পড়ে গেল। মাথা চুলকে বলল, তাহলে এখন কী করা যায়?
আমি বললাম, ডোরাকে না বলে আমি যেতে পারব না মাসুদ ভাই।
কখন বলবে?
এখন।
মাসুদ ভাই বলল, এখন? এই গভীর রাতে?
হ্যাঁ। এই তো সামনে তাদের বাড়ি। জানালার পাশে ঘুমায়। জানালায় টোকা দিলেই ঘুম থেকে উঠে যাবে। ডোরার ঘুম খুবই পাতলা। আমাকে বলেছে।
অন্ধকারে মাসুদ ভাইয়ের মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তাই বুঝতে পারছিলাম না মাসুদ ভাই বিরক্ত হচ্ছে কি না। হলেও কিছু করার নেই, আমি ডোরার সামনে বিশ্বাসঘাতক হতে পারব না। মরে গেলেও না।
মাসুদ ভাই বলল, ঠিক আছে তাহলে আমরা দাঁড়াই, তুমি ডোরাকে বলে এসো।
ঠিক আছে।
দেরি করো না। রাজাকারদের বাড়ির সামনে মুক্তিযোদ্ধা পাহারা রেখেছি কিন্তু এই রাতে আমি গোলাগুলি করতে চাই না।
ঠিক আছে। আমি অস্বস্তির সাথে বললাম, এখন ডোরাকে বোঝাতে পারলে হয়। তার মাথায় একটা জিনিস ঢুকে গেলে সেটা আর বের করা যায় না।
দেরি করো না। যাও।
কিছুতেই রাজি হবে না। আমাকে খুন করে ফেলবে।
মাসুদ ভাই তাড়া দিল, যাও যাও, অড়াতাড়ি যাও। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না আমি এটা করতে দিচ্ছি।
ডোরাদের বাড়ির কুকুরটা আমাকে দেখে একটা হালকা ডাক দিল কিন্তু কাছে এসে আমাকে চিনতে পেরে পরিচিত মানুষের মতো লেজ নাড়তে লাগল। আমি ডোরার ঘরের জানালায় গিয়ে টোকা দিলাম, সত্যি সত্যি সাথে সাথে ডোরা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে?
আমি চাপা গলায় বললাম, আমি রঞ্জু।
ডোরা তখনই জানালাটার পর্দা সরিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী হয়েছে রঞ্জু? মুক্তিবাহিনী এসেছে?
হ্যাঁ।
সত্যি?
সত্যি।
এখন যুদ্ধ করবে? ক্যাম্প আক্রমণ করবে?
না।
তাহলে? আমি একটু অস্বস্তি নিয়ে বললাম, আমাকে নিতে এসেছে।
আর আমি?
তোকে মানে তোকে তুই তো মানে– আমি কথা শেষ করতে পারলাম না।
ডোরা প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, বুঝেছি। আমাকে নিবি না। তুই একা যাবি। তুই আমাকে কিন্তু কথা দিয়েছিলি–
দেখ ডোরা, মাসুদ ভাই খবর পেয়েছে রাজাকাররা আবার আমাকে ধরে নিয়ে যাবে। সেইজন্য আমাকে নিতে এসেছে। আমি তো চলেই যেতে পারতাম। কিন্তু তোকে কথা দিয়েছি তাই তোকে না বলে যাই নাই।
ডোরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল, ঠিক আছে, তুই যা।
তুই রাগ করছিস?
ডোরা আমার কথার উত্তর দিল না। আমি বললাম, দেখ ডোরা, আমি তোকে কথা দিচ্ছি আমি তোকে নিতে আসব
তোর আর কথা দিতে হবে না। তুই যা।
দেখ ডোরা।
তুই যা। বলে ডোরা জানালার পর্দা টেনে দিল। আমার মনে হলো ডোরা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আমি খুব মন খারাপ করে মাসুদ ভাইয়ের কাছে এলাম। মাসুদ ভাই জিজ্ঞেস করল, বলেছ?
হ্যাঁ। বলেছি।
গুড। এখন তাহলে চল যাই।
ডোরা খুব মন খারাপ করেছে।
মাসুদ ভাই কোনো কথা বলল না, আমার হাত ধরে হাঁটতে লাগল। আমি আবার বললাম, ডোরা আমার ওপর মনে হয় খুব রাগ হয়েছে। তার এত মুক্তিবাহিনীতে যাওয়ার ইচ্ছা।
মাসুদ ভাই এবারেও কোনো কথা বলল না। আমি বললাম, ডোরা আমার সাথে ভালো করে কথাই বলল না।
মাসুদ ভাই বলল, যখন যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে তখন আমি তোমার পক্ষ থেকে ডোরার কাছে মাফ চেয়ে নেব। ঠিক আছে?
আমি বললাম, ডোরা মাফ করবে না। কোনো দিন মাফ করবে। ডোরার খুব রাগ।
গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযোদ্ধারা লুকিয়ে পাহারা দিচ্ছিল তাদের সবাইকে একত্র করে মাসুদ ভাই রওনা দিল। আকাশে মেঘ, মনে হয় যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে। এর মাঝে সবাই পা চালিয়ে হাঁটছে। মাসুদ ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি হাঁটতে পারছ তো?
পারছি, মাসুদ ভাই।
কষ্ট হলে বলো। তোমাকে ঘাড়ে তুলে নেয়া যাবে।
লাগবে না মাসুদ ভাই। আমি ঠিক হয়ে গেছি।
ঘণ্টা খানেক পর আমরা একটা জলা জায়গা পার হলাম। জায়গাটা পার হবার পর গভীর জঙ্গল, মনে হয় সবাই এই জঙ্গলে ঢুকে যাবে।
হঠাৎ করে মাসুদ ভাই থেমে ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বলল, চুপ।
আমি ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
মাসুদ ভাই ফিসফিস করে বলল, শোনো।
আমরা সবাই কান পেতে শুনলাম, একটা ছপ ছপ শব্দ হচ্ছে। কেউ একজন জলা জায়গাটা পার হচ্ছে।
মাসুদ ভাই বলল, নিশ্চয়ই রাজাকার। আমাদের ক্যাম্পটা কোথায় জানার জন্য পিছে পিছে আসছে।
একজন মুক্তিযোদ্ধা ঘাড়ে ঝোলানো স্টেনগানটা হাতে নিয়ে বলল, শেষ করে দেব?
না, গুলি করা যাবে না। ধরে আনতে হবে।
আপনি থাকেন, আমরা দুইজন যাই।
মুক্তিযোদ্ধা দুইজন অদৃশ্য হয়ে গেল।
আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছি, তখন হঠাৎ একটা হুটোপুটির শব্দ শুনতে পেলাম। কিছুক্ষণের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা দুইজন একজনকে ধরে নিয়ে এল। মাসুদ ভাই মানুষটার মুখে টর্চের আলো ফেলল, সাথে সাথে আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, ডোরা!
ডোরা চোখ পিটপিট করে বলল, রঞ্জু দেখবি একটু, আমার মনে হচ্ছে আমার পায়ে একটা জোঁক ধরেছে।