Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » গোলকধাম রহস্য (১৯৮০) – ফেলুদা || Satyajit Ray

গোলকধাম রহস্য (১৯৮০) – ফেলুদা || Satyajit Ray

জয়দ্ৰথ কে ছিল?

দুর্যোধনের বোন দুঃশলার স্বামী। i

অস্ত্ৰ জরাসন্ধ?

মগধের রাজা।

ধৃষ্টদ্যুম্ন?

দ্ৰৌপদীর দাদা।

অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের শাঁখের নাম কী?

অৰ্জ্জুনের দেবদত্ত, যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয়।

কোন অস্ত্ৰ ছুড়লে শত্রুরা মাথা গুলিয়ে সেমসাইড করে বসে?

ত্বাষ্ট্র!

ভেরি গুড!

যাক বাবা, পাশ করে গেছি! ইদানীং রামায়ণ-মহাভারত হল ফেলুদার যাকে বলে স্টেপল রিডিং। সেই সঙ্গে অবিশ্যি আমিও পড়ছি। আর তাতে কোনও আপশোস নেই। এ তো আর ওষুধ গেলা না, এ হল একধার থেকে ননস্টপ ভূরিভোজ। গল্পের পর গল্পের পর গল্প! ফেলুদা বলে ইংরেজিতে বইয়ের বাজারে আজকাল একটা বিশেষণ চালু হয়েছে—আনপুটডাউনেবুল। যে বই একবার পড়ব বলে পিক-আপ করলে আর পুট ডাউন করবার জো নেই। রামায়ণ-মহাভারত হল সেইরকম আনপুটডাউনেবল। ফেলুদার হাতে এখন কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের দ্বিতীয় খণ্ড। আমারটা অবিশ্যি কিশোর সংস্করণ। লালমোহনবাবু বলেন, ওঁর নাকি কৃত্তিবাসী রামায়ণের অনেকখানি মুখস্থ, ওঁর ঠাকুমা পড়তেন, সেই শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতে কৃত্তিবাসের রামায়ণ নেই; ভাবছি। একটা জোগাড় করে জটায়ুর স্মরণশক্তিটা পরীক্ষা করে দেখব। ভদ্রলোক আপাতত ঘরবন্দি অবস্থায় পুজোর উপন্যাস লিখছেন, তাই দেখা-সাক্ষাৎটা একটু কম।

বই থেকে মুখ তুলে রাস্তার দরজাটার দিকে চাইতে হল ফেলুদাকে। কলিং বেল বেজে উঠেছে। হিজলীতে একটা খুনের রহস্য সমাধান করে গত শুক্রবার ফিরেছে ফেলুদা। এখন আয়েশের মেজাজ, তাই বোধহয় বেলের শব্দে তেমন আগ্রহ দেখাল না। ও যা পারিশ্রমিক নেয় তাতে মাসে একটা করে কেস পেলেই ওর দিব্যি চলে যায়। জটায়ুর ভাষায় ফেলুদার জীবনযাত্রা সেন্ট পার্সেন্ট অনাড়ম্বর। এখানে বলে রাখি, জটায়ুর জিভের সামান্য জড়তার জন্য অনাড়ম্বরটা মাঝে মাঝে অনারম্বড়ি হয়ে যায়। সেটা শোধরাবার জন্য ফেলুদা ওঁকে একটা সেনটেন্স গড়গড় করে বলা অভ্যোস করতে বলেছিল; সেটা হল—বারো হাঁড়ি রাবাড়ি বড় বাড়াবাড়ি। ভদ্রলোক একবার বলতে গিয়েই চারবার হোঁচট খেয়ে গেলেন।

ফেলুদা বলে, নতুন চরিত্র যখন আসবে, তখন গোড়াতেই তার একটা মোটামুটি বর্ণনা দিয়ে দিবি। তুই না দিলে পাঠক নিজেই একটা চেহারা কল্পনা করে নেবে; তারপর হয়তো দেখবে যে তোর বর্ণনার সঙ্গে তার কল্পনার অনেক তফাত। তাই বলছি, ঘরে যিনি ঢুকলেন তাঁর রং ফরসা, হাইট আন্দাজ পাঁচ ফুট ন ইঞ্চি, বয়স পঞ্চাশ-টঞ্চাশ, কানের দুপাশের চুল পাকা, থুতনির মাঝখানে একটা আচিল, পরনে ছাই রঙের সাফারি সুট। ঘরে ঢুকে যেভাবে গলা খাঁকরালেন তাতে একটা ইতস্তক ভাব ফুটে ওঠে, আর খাঁকরানির সময় ডানহাতটা মুখের কাছে উঠে আসাতে মনে হল ভদ্রলোক একটু সাহেবভাবাপন্ন।

সরি, অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে পারিনি, সাফার এক পাশে বসে বললেন আগন্তুক— আমাদের ওদিকে রাস্তা খোঁড়াখুড়িতে লাইনগুলো সব ডেড।

ফেলুদা মাথা নাড়ল। খোঁড়াখুড়িতে শহরের কী অবস্থা সেটা আমাদের সকলেরই জানা আছে।

আমার নাম সুবীর দত্ত।—গলার স্বরে মনে হয় দিব্যি টেলিভিশনে খবর পড়তে পারেন। ইয়ে, আপনিই তো প্রাইভেট ইনভেস—

আজ্ঞে হ্যাঁ।

আমি এসেছি আমার দাদার ব্যাপারে।

ফেলুদা চুপ। মহাভারত বন্ধ অবস্থায় তার কোলের উপরে, তবে একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল গোঁজা রয়েছে।

অবিশ্যি তার আগে আমার পরিচয়টা একটু দেওয়া দরকার। আমি করবেট অ্যান্ড নরিস কোম্পানিতে সেলস এগজিকিউটিভ। ক্যামাক স্ট্রিটের দীনেশ চৌধুরীকে বোধহয় আপনি চেনেন; উনি আমার কলেজের সহপাঠী ছিলেন।

দীনেশ চৌধুরী ফেলুদার একজন মক্কেল সেটা জানতাম।

আই সি ভীষণ সাহেবি কায়দায় গভীর গলায় বলল ফেলুদা। ভদ্রলোক এবার তাঁর দাদার কথায় চলে গেলেন—

দাদা এককালে বায়োকেমিস্ট্রিতে খুব নাম করেছিলেন। নীহার দত্ত। ভাইরাস নিয়ে রিসার্চ করছিলেন। এখানে নয়, আমেরিকায়। মিশিগ্যান ইউনিভার্সিটিতে। ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে। করতে একটা এক্সপ্লোশন হয়। দাদার প্রাণ নিয়ে টানাটানি হয়; কিন্তু শেষে ওখানকারই হাসপাতালের এক ডাক্তার ওঁকে বাঁচিয়ে তোলে। তবে চোখ দুটোকে বাঁচানো যায়নি।

অন্ধ হয়ে যান?

অন্ধ। সেই অবস্থায় দাদা দেশে ফিরে আসেন। ওখানে থাকতেই একজন আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করেন; অ্যাক্সিডেন্টের পর মহিলা দাদাকে ছেড়ে চলে যান। তারপর আর দাদা বিয়ে করেননি।

তাঁর গবেষণাও তো তা হলে শেষ হয়নি? না। সেই দুঃখেই হয়তা দাদা প্রায় মাস ছয়েক কারওর সঙ্গে কথা বলেননি। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শেষে ক্ৰমে মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেন।

এখন কী অবস্থা?

বিজ্ঞানে এখনও উৎসাহ আছে সেটা বোঝা যায়। একটি ছেলেকে রেখেছেন—ওঁর হেলপার বা সেক্রেটারি বলতে পারেন—সেও বায়োকেমিষ্ট্রির ছাত্র ছিল—তার একটা কাজ হচ্ছে সায়েন্স ম্যাগাজিন থেকে প্ৰবন্ধ পড়ে শোনানো। এমনিতে যে দাদা একেবারে হেলপলেস তা নন; বিকেলে আমাদের বাড়ির ছাতে একই লাঠি হাতে পায়চারি করেন। এমনকী বাড়ির বাইরেও রাস্তার মোড় পর্যন্ত একাই মাঝে মাঝে হেঁটে আসেন। বাড়িতে এঘর ওঘর করার সময় ওঁর কোনও সাহায্যের দরকার হয় না।

ইনকাম আছে কিছু? বায়োকেমিস্ট্রির উপর দাদার একটা বই বেরিয়েছিল। আমেরিকা থেকে, তার থেকে একটা রোজগার আছে।

ঘটনাটা কী?

আজ্ঞে?

মানে, আপনার এখানে আসার কারণটা…

বলছি।

পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে ধরিয়ে নিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন সুবীর দত্ত—

দাদার ঘরে কাল রাত্তিরে চোর এসেছিল।

সেটা কী করে বুঝলেন?

ফেলুদা এতক্ষণে হাত থেকে মহাভারত নামিয়ে সামনের টেবিলের উপর রেখে প্রশ্নটা করল।

দাদা নিজে বোঝেননি। ওঁর চাকরিটাও যে খুব বুদ্ধিমান তা নয়। নটার সময় ওঁর সেক্রেটারি এসে ঘরের চেহারা দেখে ব্যাপারটা বুঝতে পারে। ডেস্কের দুটো দেরাজই আধাখোলা, কাগজপত্র কিছু মেঝেতে ছড়ানো, ডেস্কের উপরের জিনিসপত্র ওলট-পালট, এমনকী গোদরেজের আলমারির চাবির চারপাশে ঘষটানার দাগ; বাঝাই যায় কেউ আলমারিটা খোলার চেষ্টা করেছে।

আপনাদের পাড়ায় চুরি হয়েছে ইদানীং?

হয়েছে। আমাদের বাড়ির দুটো বাড়ি পরে। পাড়ায় এখন দুটো পুলিশের লোক টহল দেয়। পাড়া বলতে বালিগঞ্জ পার্ক। আমাদের বাড়িটা প্রায় আশি বছরের পুরনো। ঠাকুরদার তৈরি। খুলনায় জমিদারি ছিল আমাদের। ঠাকুরদা চলে আসেন কলকাতায় এইটিন নাইনটিতে। রাসায়নিক যন্ত্রপাতি ম্যানুফ্যাকচারিং-এর ব্যবসা শুরু করেন। কলেজ স্ট্রিটে বড় দোকান ছিল আমাদের। বাবাও চালিয়েছিলেন কিছুদিন ব্যবসা। বছর ত্রিশেক আগে উঠে যায়।

আপনার বাড়িতে এখন লোক কজন? আগের তুলনায় অনেক কম। বাবা-মা দুজনেই মারা গেছেন। আমার স্ত্রীও, সেভেনটি ফাইভে। আমার দুটি মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, বড় ছেলে জার্মানিতে। এখন মেম্বার বলতে আমি, দাদা, আর আমার ছোট ছেলে। দুটি চাকর আর একটি বান্নার লোক আছে। আমরা দোতলায় থাকি। একতলাটা দুভাগ করে ভাড়া দিয়েছি।

কারা থাকে। সেখানে?

সামনের ফ্র্যাটটাতে থাকেন। মিঃ দস্তুর। ইলেকট্রিক্যাল গুডসের ব্যবসা। পিছনে থাকেন। মিঃ সুখওয়ানি, অ্যান্টিকের দোকান আছে লিন্ডসে স্ট্রিটে।

এদের ঘরে চোর ঢোকেনি? শুনে তো বেশ অবস্থাপন্ন বলে মনে হয়।

পয়সা তো আছেই। ফ্ল্যাটগুলোর ভাড়া আড়াই হাজার করে। সুখওয়ানির ঘরে দামি জিনিস আছে বলে ও দরজা বন্ধ করে শোয়। দস্তুর বলে বন্ধ ঘরে ওর সাফোকেশন হয়।

চোর আপনার দাদার ঘরে ঢুকেছিল কী নিতে অনুমান করতে পারেন?

দেখুন, দাদার অসমাপ্ত গবেষণার কাগজপত্র দাদার আলমারিতেই থাকে, আর সেগুলো যে অত্যন্ত মূল্যবান তাতে কোনও সন্দেহ নেই। অবিশ্যি সাধারণ চার আর তার মূল্য কী বুঝবে। আমার ধারণা চার টাকা নিতেই ঢুকেছিল। অন্ধ লোকের ঘরে চুরির একটা সুবিধে আছে সেটা তো বুঝতেই পারেন?

বুঝেছি। বলল ফেলুদা অন্ধ মানে বোধহয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, কারণ চেক সই করা তো…

ঠিক বলেছেন। বই বাবদ দাদা যা টাকা পান সব আমার নামে আসে। আমার অ্যাকাউন্টে জমা পড়ে। তারপর আমি চেক কেটে টাকা তুলে দাদাকে দিয়ে দিই। সেই ব্যাঙ্কের টাকা সব ওই গোদরেজের আলমারিতেই থাকে। আমার আন্দাজ হাজার ত্ৰিশোক টাকা ওই আলমারিতে রয়েছে।

চাবি কোথায় থাকে?

যতদূর জানি, দাদার বালিশের নীচে। বুঝতেই পারছেন, দাদা অন্ধ বলেই দুশ্চিন্তা। রাত্তিরে দরজা খুলে শোন, চৌকাঠের বাইরে শোয় চাকর কৌমুদী—যাতে মাঝরাত্তিরে প্রয়োজনে ডাক দিলে আসতে পারে। ধরুন যদি তেমন বেপরোয়া চোর হয়, আর চাকরের ঘুম না ভাঙে, তা হলে তো দাদার আত্মরক্ষার কোনও উপায় থাকে না। অথচ পুলিশে উনি খবর দেবেন না। বলেন ওরা কেবল জানে জেরা করতে, কাজের বেলায় ঢু, সব ব্যাটা ঘুষখোর ইত্যাদি। তাই আপনার কথা বলতে উনি রাজি হলেন। আপনি যদি একবারটি আমাদের বাড়িতে আসেন, তা হলে অন্তত প্রিভেনশনের ব্যাপারে কী করা যায় সেটা একটু ভেবে দেখতে পারেন। এমনকী বাইরের চোর না। ভেতরের চোর সেটাও একবার—

ভেতরের চোর?

আমি আর ফেলুদা দুজনেই উৎকৰ্ণ মানে কান খাড়া।

ভদ্রলোক চুবুটের ছাই অ্যাশট্রেতে ফেলে গলাটা যতটা পারা যায় খাদে নামিয়ে এনে বললেন, দেখুন মশাই, আমি স্পষ্টবক্তা। আপনার কাছে যখন এসেছি, তখন জানি ঢেকেঢুকে কথা বললে আপনার কোনও সুবিধে হবে না। প্রথমত আমাদের দুজন ভাড়াটের একটিকেও আমার খুব পছন্দ না। সুখওয়ানি এসেছে বছর তিনেক হল। আমি নিজে জানি না, কিন্তু যারা পুরনো আর্টের জিনিস-টিনিস কেনে তেমন লোকের কাছে শুনেছি সুখওয়ানি লোকটা সিধে। নয়। পুলিশের নজর আছে। ওর ওপর।

আর অন্য ভাড়াটো?

দস্তুর এসেছে মাস চারেক হল। ও ঘরটায় আমার বড় ছেলে থাকত সে পার্মানেন্টলি দেশের বাইরে। ডুসেলডর্ফে একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে চাকরি করে জার্মান মেয়ে বিয়ে করেছে। দস্তুর লোকটা সম্বন্ধে বদনাম শুনিনি। তবে সে এত অতিরিক্ত রকম চাপা যে সেটাই সন্দেহের কারণহয়ে দাঁড়ায়। আর, ইয়ে-

ভদ্রলোক থামলেন। তারপর বাকি কথাটা বললেন মুখ নামিয়ে, দৃষ্টি ছাইদানিটার দিকে রেখে।

শঙ্কর, আমার ছোট ছেলে, একেবারে সংস্কারের বাইরে চলে গেছে।

ভদ্রলোক আবার চুপ। ফেলুদা বলল, কত বড় ছেলে?

তেইশ বছর বয়স। গত মাসে জন্মতিথি গেল, যদিও তার মুখ দেখিনি সেদিন।

কী করে?

নেশা, জুয়া, ছিনতাই, গুণ্ডাগিরি কোনওটাই বাদ নেই। পুলিশের খপ্পরে পড়েছে তিনবার। আমাকেই গিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে। আমাদের পরিবারের একটা খ্যাতি আছে সেটা তো বুঝতেই পারছেন, তাই নাম করলে এখনও কিছুটা ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সে নাম আর কদ্দিন টিকবে জানি না।

চোর যেদিন আসে সেদিন ও বাড়িতে ছিল?

রাত্তিরে খেতে এসেছিল—সেটাও রোজ আসে না—তারপর আর দেখিনি। ঠিক হল আজই বিকেলে আমরা একবার যাব বালিগঞ্জ পার্কে। কেসটাকে এখনও ঠিক কেস বলা যায় না, কিন্তু আমি জানি বিস্ফোরণে অন্ধ হয়ে যাওয়া বৈজ্ঞানিকের ব্যাপারটা ফেলুদার মন টেনেছে। তার মাথায় নিশ্চয়ই ঘুরছে ধৃতরাষ্ট্র।

খবরের কাগজের কাটিং-এর বাইশ নম্বর খাতা থেকে মিশিগ্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে বিস্ফোরণে উদীয়মান বাঙালি জীবরসায়নিক নীহাররঞ্জন দত্ত-র চোখ নষ্ট হয়ে যাওয়ার খবরটা খুঁজে বার করে দিতে সিধুজ্যাঠার লাগল সাড়ে তিন মিনিট। তার মধ্যে অবিশ্যি দুমিনিট গেল ফেলুদা অ্যাদ্দিন ডুব মেরে থাকার জন্য তাকে ধমকানিতে। সিধুজ্যাঠা আমাদের সত্যি জ্যাঠা না হলেও আত্মীয়ের বাড়া। কোনও অতীতের ঘটনার বিষয় জানতে হলে ফেলুদা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে না গিয়ে সিধুজ্যাঠার কাছে যায়। তাতে কাজ হয় অনেক বেশি তাড়াতাড়ি আর অনেক বেশি ফুর্তিতে।

ফেলুদা প্রসঙ্গটা তুলতেই সিধুজ্যাঠা ভুরু কুঁচকে বললেন, নীহার দত্ত? যে ভাইরাস নিয়ে রিসার্চ করছিল? এক্সপ্লোশনে চোখ হারায়?

বাপরে বাপ!— কী স্মৃতিশক্তি! বাবা বলেন শ্রুতিধর। ফেলুদা বলে ফোটাগ্রাফিক মেমরি; একবার কোনও ইন্টারেস্টিং খবর পড়লে বা শুনলে তৎক্ষণাৎ মগজে চিরকালের মতো ছাপা হয়ে যায়।—কিন্তু সে তো একা ছিল না?

এ খবরটা নতুন।

একা ছিল না মানে? ফেলুদা প্রশ্ন করল।

তার মানে, যদ্দূর মনে পড়েছে— সিধু জ্যাঠা ইতিমধ্যে তাঁর বুকশেলফের সামনে গিয়ে খবরের কাটিং-এর খাতা টেনে বার করেছেন— এই গবেষণায় তাঁর একজন পার্টনার ছিল— হ্যাঁ এই যে।

বাইশ নম্বর খাতার একটা পাতা খুলে সিধুজ্যাঠা খবরটা পড়লেন। ১৯৬২-র খবর। তাতে জানা গেল যে নীহার দত্তের গবেষণার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কাজ করছিলেন আরেকটি বাঙালি বায়োকেমিস্ট, নাম সুপ্ৰকাশ চৌধুরী। অ্যাক্সিডেন্টে চৌধুরীর কোনও ক্ষতি হয়নি, কারণ সে ছিল ঘরের অন্য দিকে। এই চৌধুরীর জন্যই নাকি নীহার দত্ত নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলেন, কারণ আগুন নেবানো ও তৎক্ষণাৎ নীহার দত্তকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থাটা চৌধুরীই করেন।

এই চৌধুরী এখন—?

তা জানি না, বললেন সিধু জ্যাঠা। সে খবর আমার কাছে পাবে না। এদের জীবনে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটলে যদি সেটা খবরের কাগজে স্থান পায় তবেই সেটা আমার নজরে আসে। আমি যেচে কারুর খবর নিই না। কী দরকার? আমার খবর কজন নেয় যে ওদের খবর আমি নেব? তবে এটা ঠিক যে, এই চৌধুরী যদি বিজ্ঞানের জগতে সাড়া জাগানো একটা কিছু করত, তা হলে সে খবর আমি নিশ্চয়ই পেতাম।

Pages: 1 2 3 4
Pages ( 1 of 4 ): 1 234পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress