কেয়ারটেকার – 01
সময়টা বর্ষার ঠিক পরে, আকাশে বাতাসে যখন পুজো পুজো ভাব লেগে গেছে।
এইটেই হোল পর্যটকদের আসার সময়। মানুষের যখন ছুটি শুরু হয়, সুদেবের ছুটি ফুরোয়।
সুদেব চলে যাবে, বাঁধবেড়া গ্রামে ওদের বাড়িতে যেন বিদায়ের বাঁশি বাজল। মাদুলি মাছ কুটতে বসেছে। দাদা ভূদেব সাতসকালে আধ কিলো রুইয়ের পোনা কিনে এনেছে। বলে গেল, টাটকা মাছগুলো পেয়ে গেলাম ঝপ করে। খোকাকে ভেজে দাও, ঝোল করে দাও।
বউদি মীনা ভাত টিপে দেখছে। মা মুড়ির নাড়ু কৌটোয় ভরছে। সুদেব জানে যে মা কাল অনেক রাত অবধি বসে আধগুঁড়ো মুড়ি আর চিনেবাদাম তপ্ত গুড়ে মেখে নাড়ু তৈরি করেছে। না নিয়ে গেলে মা খুব কষ্ট পাবে।
মাদুলি বলল, আবার কবে আসবি ছোড়দা?
—কবে যে আসতে পারব!
—বটব্যালবাবু চাকরি দিয়েছে মানি, কিন্তু এমন চাকরি দিল যে ছুটি নেই।
মা বলল, সে যা হোক, বাঁচিয়ে দিয়েছে।
—ছোড়দাকে থাকতেই হয় আটকে, নইলে ঘর থেকে যেতে পারত, তাই না?
মীনা বলল, বাপ রে, ছোড়দা যদি না থাকে তাহলে সবই গণ্ডগোল।
সুদেব বলল, চান করে আসি। কি রে টিয়া, যাবি নাকি? চল, চান করিয়ে দিই।
মা বলল, পুকুরে যাবি?
—না না, ঘরে কুয়ো থাকতে….
আজ তাদের নিজের কুয়ো আছে, ঘরে টিনের চাল, দাওয়ার কোলে তিনটে ঘর, এ যেন ভাবা যায় না।
সবাই বলে, ওদের উন্নতি হচ্ছে। হবে না? দুই ভাই একত্র আছে, জমিজমা নেই যে বিবাদ লাগবে।
সবই ভালো এখন। দু’বছর সুদেব চাকরি করছে, আর ক’বছর চাকরি করলে ওরা জমি কিনবে, তখন আরো ভালো হবে।
দাদার স্বপ্ন, একটু জমি কেনা।
মার স্বপ্ন, সুদেবের বিয়ে হোক।
সুদেবের স্বপ্ন, মাদুলির জীবনটা একটা ঠিকানায় পৌঁছাক। ছোট বোন মাদুলি, ওকে দেখলে বড় কষ্ট হয়।
ওদের কপাল ভালো, বউদি মীনা একটু বোকাসোকা, মনটা ভালো, বিবাদ ঝগড়া করে না।
কাকার সঙ্গে স্নান করতে করতে টিয়া বলল, এবার পুজোয় আমি অপ্সরা ড্রেস নেবো।
—নিস, নিস।
—এবার ফাংশান হবে কাকা। তুমি আসবে না?
—দেখি, দেখি।
—বাবা বলেছে একদিন আমরা টাউনে পুজো দেখতে যাব।
—যাবি, যাবি।
স্নান করে সুদেব বলল, তুই জামা পর। আমি বালতিগুলো ভরে দিই। কি মাদুলি, মাছ ধুবি, জল দেব?
—দে।
মাদুলির সিঁথেয় এখনো সিন্দুর। কার কল্যাণে ও সিঁন্দুর পরে এখনো? ও কি মনে করে পরিমল ওকে নিয়ে যাবে কোনোদিন? যে পরিমল ”মৃদুলাকে পেলে ধন্য হবো” বলেছিল, রানীপুর ব্লকে চতুর্থ শ্রেণীর চাকরি পাবার পর সে খুব বদলে গেছে। মাদুলিকে নিতে আসে না, আবার বিয়ে করবে বলে শোনা যাচ্ছে।
সুদেব বলে এসেছে, পরিমল যেন মনে রাখে মাদুলি কার বোন। সুদেব রায় কেস করবে না, দরকারে অন্যভাবে শাস্তি দেবে। সুদেবের খ্যাতি কিসে তা যেন মনে রাখে। বিয়ে করলে আমার বোনকে ডিভোর্স দাও, মাইনে পাচ্ছ, খোরপোষ দাও। পঞ্চায়েতে এসো, সেখানেই কথাবার্তা হয়ে যাবে।
না, পরিমল পঞ্চায়েতে আসেনি, কথাবার্তা বলেনি।
ওই চাকরিও তো সুদেবের মনিব অপরূপ বটব্যালের চেষ্টাতেই হোল। চাকরি পেয়েই তার মাথা ঘুরে গেল। সাইকেল, ঘড়ি এসব না নিয়ে বিয়ে করে খুব ঠকেছে বলে বোধ হোল। তারপরেই মাদুলির সঙ্গে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া শুরু হোল।
সুদেবের শাসানি শোনার পর পরিমলের মা নাকি বলছে, সাইকেল ঘড়ি দিয়ে বোনকে পৌঁছে দিক।
সাইকেল, ঘড়ি দুম করে কেনা যায়? বিয়েতে ট্রানজিস্টার, বাসন দু’প্রস্থ বিছানা, বরকে রূপোর বোতাম দেওয়া হয়েছিল। সবাই সুদেবদের অনেক টাকা দেখেছে!
সুদেব পায় আটশো টাকা।
ভূদেব পায় ছ’শো টাকা।
অঘ্রাণে ধান কেনে ভূদেব, জ্যৈষ্ঠ থেকে বেচে। ধান বেচে বেচে সংসারের হাল যা হয় ফিরছে। সুদেব ঘর থেকে চালটা নিয়ে যায় বলে খাওয়া খরচা সাশ্রয় হয়।
মাদুলি এইট পাশ। বাবুকে বলে ওকে মেয়ে ইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ঢোকাতে পারলে মস্ত কাজ হয়।
পরিমলের ওকে ফিরে নেবার চাড় হবে। ডিভোর্স হলেও আবার বিয়ের বাজারে ওর একটা দাম হবে।
বাবু বলে, সুবর্ণ লজে রাখা যেত। কিন্তু তুমি তো দেখছ, কতরকম মানুষ আসে। এখানে ওর ইজ্জত থাকবে না। দেখি কি করা যায়।
এসব ভাবতে ভাবতে ভাত বাড়া হয়ে যায়। মাদুলি পাখা নিয়ে বসে। টিয়া পাশে বসে।
ওর মা বলে, কাকার পাতেই খা।
—না না, ওকে আলাদা দাও। মাছের গন্ধ পেয়েছে, ও কি ছেড়ে দেবে? এ মেয়েটাকে জেলেপাড়ায় বিয়ে দিতে হবে গো বউদি! রোজ মাছ খাবে।
মা বলে, এবার মাছ খেয়েছে খুব। ওর মা তো খাল—কাঁদোর—ধানক্ষেক কোথা কোথা থেকে মাছ এনেছে।
—বড় মাছটা তো কবেই ধরেছে।
মীনা মুখ মুচকায়। মাছ ধরা আর আম চুরি করার দিন থেকে ভুদেব আর মীনার প্রেম। বিয়ের ছ’বছর বাদেও ওদের প্রেম সজীব আছে।
মীনার বোনদের বিয়ে টাউনে হয়েছে। একজনের স্বামী ক্যাসেট বেচে, পয়সা করেছে। আরেকজন কম্পাউন্ডার, সেও ভালো রোজগার করে। মীনার মা বুদ্ধিমতী।
তিনি যখন বাঁধবেড়াতে পুকুর—বাগান—জমি নিয়ে পড়ে থাকবেন স্বামী নেই ছেলে কোনোদিন হয়নি, তখন গ্রামের মধ্যে জামাই পেলে তাঁরও বল—ভরসা।
সর্বস্ব তিন মেয়ের, তবে মীনা একটু বেশি পাবে। একে ছোট মেয়ে, তায়, কাছে থাকে। ডাকলেই পান। মেয়ের ডান পায়ে ছয়টি আঙুল। জামাই কিনতে গেলে তাঁকে সর্বস্ব বেচতে হোত। ভুদেবের মা তো দু’ছেলের দাবড়িতে কিছুই চাননি। মীনার মা অবশ্য সাইকেল ঘড়ি, চৌকি, আলনা আর ছোট লোহার আলমারি দিয়েছেন, মেয়েকে চার ভরি সোনা। তাঁর বাগানের তরকারি, টাটকা মুড়ি, কাঁঠাল—আম—পেঁপে এ বাড়িতে আসে। এসব কারণে মীনার বোনরা বেশ অসন্তুষ্ট। একজন বাঁকুড়ায়, আরেকজন ছাতনায় থাকে।
বাঁধবেড়া থেকে দুটোই অনেক দূর।
মীনা যে খুব সুখী সেটাও ওদের পছন্দ নয়।
সুদেব খাওয়া শেষ করে।
—না, বউদি রান্না শিখে ফেলেছে।
—ভাগ্যে বললে!
—দেখ বউদি, বাঁধবেড়া থেকে সোনারেখা বাঁধ এগারো কিলোমিটার। এটা সেটা দিয়ে দাদাকে পাঠিও না তো। দাদার কষ্ট হয়।
ভূদেব ঢুকে পড়ে।
—কিছু কষ্ট হয় না। তোর হোল?
—হ্যাঁ, পান দাও।
মাদুলি এক কৌটা পান এগিয়ে দেয়। সুদেব মা আর দাদাকে প্রণাম কারে। বউদিকে বলে, আসি গো বউদি। টিয়াকে আদর করে আর মাদুলিকে বলে, অত ভাবিস না রাতদিন।
মাদুলি বলে, সায়া কিনবে আমার জন্যে। মায়ের জামাও লাগবে।
—আনব, সব আনব। সীজিন ভালো যায় তো কাপড়ও আনব।
ভূদেব ওর সঙ্গে এগোয়।
—সীজিন ভালো যায় তো, তোর বউদি বলছিল যে সাইকেল একটা, আর ঘড়ি কিনে…
—দাদা! সে দুটি হাজার টাকার ধাক্কা।
—বুঝি সবই। মাদুলির মুখ চেয়ে…
—এর তো শেষ নেই দাদা। ও বলল, লোকমুখে শুনে আমরা সব কিনেকেটে দিয়ে এলাম। ক’দিন বাদেই মাদুলিকে পাঠিয়ে দিল আর আরো কিছু চেয়ে বসল।
—কী করা যায় বলতো?
—পরিমল নিজে এসে বলুক, তবে ভেবে দেখব। ও ভেবেছে সুদেব মরে গেছে। সুদেব রায়ের বোনকে বিয়ে করে দু’নম্বরী করা অত সহজ নয়।
ভূদেব উদ্বিগ্ন হয়।
—মারদাঙ্গা করিস না সুদেব।
—না না, তুমি ভেবো না তো।
—রানীপুর গেলে ঘুরে আসব’খন।
—এসো। আমি আসি দাদা। তুমি সাবধানে থেকো। দিনকাল খুব খারাপ হয়ে গেছে।
—বাবুদের বিবাদ, আমাদের মরণ।
—তোমার কি! কাজ তো করো বড়বাবুর।
সুদেব সাইকেল চালিয়ে দেয়। দাদা তিরিশ না হতেই চুল পাকিয়ে ফেলেছে। বাঁধবেড়ায় বসে বাবুদের স্যালোগুলির তদারকি বড় কম কাজ নয়।
বাবুদের পৌষ মাস যে শুরু হয়েছে, সে চলছেই কত বছর। বাঁধবেড়া থেকে কয়েক মৌজা জুড়ে ওদের যেসব জমি পড়েছিল, সোনা নদীর বাঁধ ও ক্যানেল হবার পর সেসব জমিতে তিনটে ধান উঠছে।
সোনা বাঁধ, সংলগ্ন সরকারের তৈরি ফরেস্ট, নিচু পাহাড়, এসব এখন খুব ব্যস্ত ট্যুরিস্ট জায়গা। নিকটতম শহর রানীপুরের গুরুত্বই বেড়ে গেছে।
বাঁধের এক সাব—কন্ট্রাক্টার ছিল অপরূপ বটব্যাল, সুদেবের মনিব। বাঁধবেড়া গ্রামেই এখন কত পাকা বাড়ি, মল্লভূম গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, পোস্টাপিস, তিনটে স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সারের দোকান। জয়পুর রোড দিয়ে বাস—মিনিবাস যাচ্ছে। কলেজে পড়তে চাও তো চলে যাও রানীপুর।
জায়গাটি সংরক্ষিত তপশিলী উপজাতি কেন্দ্র।
নির্বাচিত সদস্য গৌরদাস হেমব্রম। পঞ্চায়েত প্রধান ও উপপ্রধান হারান বাস্কে, শশধর সিং। কিন্তু টাকা, প্রভাব, প্রতিপত্তি বটব্যালদের। ওরা এক সময়ে জমিদার ছিল, আজও জমি ভূমি ওদের।
সুদেব শুনেছে ওর পূর্বপুরুষ রাজপুত ছিল। মল্ল রাজাদের কালে সেপাই ছিল, লড়ত। অনেকে জমি—ভূমিও পেয়েছিল। এখনো ওদের জ্ঞাতগুষ্টি বাঁকুড়া জেলায় ছড়িয়ে আছে। সবে ক্রমে তারা বাঙালী হয়ে গেছে। পুরুলিয়ার দিকে যেসব রাজপুত সে সময়ে জমিদার হয়েছিল, অনেকে ধনী থেকে গেছে।
পুরনো কথায় ফিরতে চায় না মন। কে কবে কোথা থেকে এসেছিল তা দিয়ে কি হবে। বহুকাল ওরা বাঁধবেড়ার অধিবাসী। এ দিকটা আদিবাসী অঞ্চল। আদিবাসী অঞ্চলে রাজপুত, ব্রাহ্মণ, তাম্বুলী, এরা বাইরে থেকেই এসেছিল নিশ্চয়।
সোনা বাঁধ থেকে বাঁধবেড়া তেমন দূর নয়। আদিবাসী অঞ্চলে পথঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকে না। বর্তমান সরকার বাঁধ, সংলগ্ন অরণ্য, এটাকে ”ভ্রমণকারীর স্বর্গ” বলে বিজ্ঞাপন করেন। ফলে জয়পুর রোড বাঁধ অবধি পৌঁছে বাঁধ ঘুরে রানীপুর চলে গেছে। বাঁধ পত্তন হয় উনিশশো ষাট সালে। সে সময় সুপারভাইজার বাঁধ ঘিরে, তখনকার কাঁচা রাস্তার দুপাশে অনেক শাল ও অর্জুন গাছ লাগান।
সেসব গাছ এখন বড় হয়ে গেছে। বাঁধের পশ্চিম থেকে সরকারী বন শুরু। সরকারের বন বিভাগের বাংলো আছে, পর্যটন বিভাগ বাংলো করেছে, সেচ বিভাগের বাংলো আছে।
আর আছে সুবর্ণ লজ। পরিবার সহ থাকবার উত্তম ব্যবস্থা। নিজস্ব জেনারেটরে আলো পাখা চলে। কামরা সংলগ্ন বাথরুম, গ্রীল বেষ্টিত বারান্দা উপরন্তু আকর্ষণ, ছাদ থেকে সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়।
সবটাই অপরূপবাবু বাঁধের সাব—কন্ট্রাক্টরি থেকে করে নিয়েছে।
রানীপুরে সে বড় কন্ট্রাক্টর। সরকারী প্রকল্পগুলির ঠিকাদারি সেই পায় তার যোগাযোগেই নানারকম পর্যটক আসে। এটা স্বাভাবিক যে তারা সুবর্ণ লজে আসবে।
সরকারী বাংলোগুলি সুবর্ণ লজের খদ্দের কেড়ে নিতে পারে না। এখানে এসো। আরাম করো। এখানে আরাম করো। আর, অপরূপবাবুর একান্ত অনুগত আমিত কাপুর (ওরা অমিত বলতে পারে না), যে নাকি কলকাতায় কয়েকটি হাইরাইজ তুলেছে, সে একটি রঙিন টি.ভি., ভি.সি.আর. দিয়ে গেছে। উপহার। অপরূপবাবুর ছেলের দোকান থেকে ক্যাসেট নিয়ে চলে এসো। ছবি দেখ।
অপরূপবাবু বলে, টুরিস পয়সা খরচ করতে চায়, আনন্দ করতে চায়, সস্তার জায়গা সবাই খোঁজে না।
কাছাকাছি আছে বটেশ্বর শিবমন্দির। ইদানীং আমিত কাপুর মন্দির বড় করে দিয়েছে। সেখানে শিব ও জীয়ৎকুণ্ডের খুব নাম আছে। মানুষ সেখানেও পুজো দিতে যায়।
অপরূপবাবু বলেছে, এবার একটা মিনিবাস লাগাব। রানীপুর থেকে টুরিস আনবে, এলাকা ঘোরাবে। বটেশ্বর যাও, বিষ্ণুপুর ঘুরে এসো, শুশুনিয়া পাহাড় দেখ। প্যাকেজ টুর, বাঁকুড়া ভ্রমণ।
সুদেব জানে, অপরূপবাবুর বৃহস্পতি তুঙ্গে বসে আছে। সব করে ফেলবে ও।
”সুবর্ণ” নামের সঙ্গে সোনা নদী ও বাঁধের কোনো সম্পর্ক নেই। সুবর্ণ অপরূপবাবুর স্ত্রী। বড়লোকের মেয়ে, স্বামীর সব কথা মানে না।
তার কড়া হুকুম, সুবর্ণ লজে মদের ব্যবস্থা তুমি রাখতে পারবে না। যে খায় সে নিয়ে আসবে, খাবে।
এর জন্যে সুদেব খুবই কৃতজ্ঞ।
সুবর্ণ লজে যদি মদও পাওয়া যেত, তাহলে যে কি বিপদ হোত তা বলা যায় না। মদ নিয়ে একেক পার্টি ঢোকে, তাদের হাঙ্গামা মেটাতে হয় সুদেবকে। সবচেয়ে ঝামেলা করে অপরূপের ছেলে দেবরূপ।
সে কথা মনিবকে বলা যায় না।
যদি চাকরি চলে যায়।
সুদেব রায়, উচ্চ—মাধ্যমিকে আর.এ; পাঁচ ফিট এগারো ইঞ্চি লম্বা; বুকের ছাতি চল্লিশ; সমস্ত দেহে যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন; খুব পরিচিত মুখ রানীপুর থানায়; খুব পরিচিত নাম।
সুদেবকে কে চাকরি দিত, অপরূপবাবু ছাড়া?
ছাব্বিশ বছর বয়স না হতে সুদেব চাকরি—দেনে—অলা পার্টিদের অর্থাৎ লোকদের চিনে ফেলেছে।
খেলাধুলোয় খুব ভালো ছিল।
দৌড়, হাই জ্যাম্প, বাঁধবেড়া সুরাজমোহিনী স্কুল থেকে জেলা প্রতিযোগিতায় সুদেবই যেত।
ফেরার সময়ে খাটুয়ার দোকানে ঢুকত। মোহন ব্যাঙ্ক লোন নিয়ে কাঠচেরাই কল ও ছুতোর কাজের দোকান করেছিল। মোহন ওকে উৎসাহ দিত।
—খেলাধুলো রাখবি, চাকরির বাজারে সুবিধে।
মারদাঙ্গা করাটা যে কিছুকালের মতো ওর জীবিকা হবে, তা সুদেব ভুলেও ভাবেনি।
বাঁধবেড়া ছোট জায়গা এক অর্থে। এই সম্পন্ন গ্রাম পাড়ায় পাড়ায় বিভক্ত। গ্রামে বহুজনের নিজস্ব স্যালো আছে। কে কবে টাকা পেল, কত পেল, সে কথা জানাজানি হয়েই যায়।
কলকাতায় অর্ডারী মাল চালান দিয়ে মোহন একান্ন হাজার টাকা পেয়েছে এটা বাঁধবেড়ায় সবাই জেনেছিল। এটা সাব—কন্ট্রাক্ট সাপ্লাই। চেকের ওপরে দশ হাজার টাকা ছিল নগদে।
নগদ টাকা বাড়িতে রাখার বিপদ মোহনকে সবাই বুঝিয়েছে। কিন্তু মোহন গ্রাজুয়েট, চাকরি করে না ব্যবসা করে। কাঠের ঠিকাদারি ও কাঠ চোরাই ফাড়াই কাজ ও স্ববুদ্ধিতে করেছে। বাপ ওকে ”হারামজাদা” বলেছিল, এখন চুপ করে থাকে। মোহনের আত্মবিশ্বাস খুব বেড়েছিল। রানীপুরে বাড়ি করছে, বাড়ির কাজ ধিমা গতিতে এগোলেও বাড়ির কাজে নগদ দরকার। বাঁধবেড়ায় ওর বাড়িতেই দেয়ালে গাঁথা লোহার সিন্দুক আছে। সেখানেই ও টাকা রাখে।
ওর বাড়িতে ডাকাত পড়ে।
দিনটি সুনির্বাচিত ছিল।
মেয়ের বিয়ে এগিয়ে এসেছে। বাড়িতে গয়নাগাঁটি থাকবে, টাকা থাকবে এটা প্রত্যাশিত।
মোহন বাড়ি গিয়ে মাকে বলে এসেছিল, সুদেব খাটা—খাটনি করছে, রাতটা যদি থাকে ভরসা পাই। বাবা সবে মারা গেছে। দাদা একা সংসার টানে। সুদেবের মা লোকের বাড়ি ধান ভাপায় শুকোয়। সে সময়ে সুদেবের পড়ার খরচও জুটত না ঠিকমতো। মোহন খাটুয়া তখন সুদেবের মা’র চোখে খুব বড়লোক। মোহনকে ধরে থাকলে সুদেবের কিছু একটা হিল্লে হয়ে যাবে, এই ভাবে মা।
—তা থাকবে এখন, তাতে কি হয়েছে।
মোহনের মেয়ে অনীতার চোখটি টেরা, রং ময়লা, সে সময়ে তাকে বিয়ে দিতে পঞ্চাশ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল মোহনের। অনীতা, অমিতা, মুক্তি, তারপরে শিবনাথ।
অনীতার মনটা ভালো ছিল। সুদেবকে খুব মমতা করত, তুই বলত।
অমিতা সুদেবেরই বয়সী। ইচ্ছে করে ওর গায়ে ঠেলা তাতে, গা ঘেঁসে দাঁড়াত, ফাজলামি করত।
মুক্তি নেহাতই ছোট, আর ছোট হয়েই থাকল। বয়স বেড়ে বেড়ে এখন ষোল হোল। দেহ বেড়েছে, মন বাড়ে নি।
সে সময়ে অনীতার বিয়ে।
মোহন বুঝতে পারত না, ওর কথায় সুদেবের মনে কোথাও খোঁচা লাগে। গরীবের মন খুব অনুভূতিপ্রবণ হয়, তা ধনীরা বোঝে না।
ঘটনার দিন সুদেব, মোহন আর মোহনের শালা, ভাইপো, ভাগ্নে, এমন অনেকের সঙ্গে খেতে বসেছিল। অনীতা আর অমিতা পরিবেশন করছিল।
মোহন উদার আতিথ্যে বলল, দে দে, সুদেবকে চারখানা মাছ দে। বাঁধের মাছ। এমন মাছ তো বেশি খেতে পায় না, পাকা মাছ।
কথাটা সুদেবের কানে লাগল।
—না না, আমি তেমন মাছের ভক্ত নই।
অমিতা গা দুলিয়ে বলল, শেলীর দাদার বিয়েতে তো কুড়িখানা মাছ খেয়েছিলে।
—সে বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ফেলে।
মোহন এবার বলল, খা, খা। দেহটা রাখতে হবে।
খেলাধুলো করতে হবে। এবারে কলকাতা যাবি।
খাওয়াদাওয়া মিটলে বাড়ির ইন্দিছিন্দি বন্ধ করতে করতে মোহন নিশ্বাসে ফেলেছিল।
—তোরা ভালো আছিস সুদেব। ঘরে নেইও কিছু, ডাকাত পড়বে না।
আপনি কাকা, বড় রিস্ক নেন।
—কেন কেন?
—আজকাল আপনার চেয়ে ছোট কারবারীরা বন্দুকের লাইসেন্স নিচ্ছে, দিনকাল খারাপ!
—হ্যাঁ… এবারে দেখতে হবে। ডাকাতি রাহাজানিও বেড়েছে… ঝালাপাড়া থেকে গাড়ি নিয়ে এল, ডাকাতি করে কেটে গেল সিংভূমে, বিহারে… পুলিশ করে না কিছু!
—গ্রামে ব্যাঙ্ক হয়েছে সেখানে রাখুন।
—ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয় না?
—তাতে আপনার কি? টাকা তো পাবেন।
এক সঙ্গে দুটো কাজ পড়ল… বাড়ি উঠছিল বটে…
অনীতার বিয়েটা ঝপ করে লেগে গেল! যাকগে, ছেলেটা ইনকামট্যাক্সে কাজ পেয়েছে। তেমন ঝামেলা নেই সংসারে… ভাবনায় নানাখানা হয়ে বাড়িতে টাকা রাখা… যাকগে, লোকজন জমজম করছে, তোমরা আছ।
মোহনের ভাইপো বরেন সুদেবের সহপাঠী! বরেন কাকার কাছে থেকে পড়ে। সে বয়সে যেমন হয়, বরেন সুদেবকে যাকে বলে ‘হীরো’ মনে করত।
অ্যাথলেটিকসে ভালো সুদেব। সাঁতারে ওস্তাদ।
লেখাপড়াতেও ভালো।
স্বভাবে সিরিয়াস।
বরেন, সুদেব, ওরা কয়েকজন বারান্দায় বসে তাস খেলল অনেকক্ষণ। মোহনের কাঠগোলার দু’জন লোকও থাকল। জেনারেটার আছে, আলো জ্বলছে।
এর মধ্যেই ডাকাত পড়েছিল।
সিনেমার ডাকাত নয়, সত্যি ডাকাত। বাঁধবেড়া অবধি জীপ এনেছিল। মুখে কালো রুমাল, একজনের হাতে বন্দুক। ওরা তিনজন ঢুকে পড়ে, জীপে দু’জন ছিল। ওদের আত্মবিশ্বাসও ছিল। গ্রামে বন্দুক নিয়ে ডাকাতি করলে সন্ত্রস্ত মানুষ তেমন বাধা দেয় না।
কিন্তু সুদেব ওদের ওপর ঝাঁপিয়েই পড়ে। ও চেঁচিয়ে সকলকে ডাকতে থাকে ও লোহা বাঁধানো লাঠির ঘায়ে বন্দুকের হাত ভেঙে দেয়। এবার লোকজন এসে পড়ে। গণধোলাইয়ে নিদারুণ জখম হয় ডাকাতরা। বাকি দু’জন জীপ চালিয়ে পালায়।
রাণীপুরে থানায় বলে, এই সুদেব রায় সাহস করে না এগোলে… যাকে বলে প্রাণটা চলে যেতে পারত। সাহসী ছেলে।
ও. সি. বলেছিলেন, বাঃ বাঃ!
‘রানীপুর বার্তা’ কাগজে সুদেবের প্রশংসা বেরিয়েছিল। আর মোহন খাটুয়া একটি একশো টাকার নোট সুদেবকে দিয়ে বলেছিল, টাকাটা কথা নয়, মান রক্ষে করলি এটাই বড় কথা।
সুদেব সেদিন খুব অভিভূত হয়।
এর কিছু পরেই তো ঘটে সেই ঘটনা। বাঁধবেড়ার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা অবনী মহান্ত ছেলের বিয়ে দিয়ে খাওড়া থেকে বউ নিয়ে ফিরছিল। ছেলে সূর্য, সুদেবদের ক্লাবের সেক্রেটারি, স্কুলে মাস্টার। সুদেবরা বরযাত্রী গিয়েছিল। ক্লাবের টপ টেন, দশ জন ছেলে।
বটেশ্বর শিবমন্দির ছাড়িয়ে জয়পুর রোড ধরার পরই পথে আড়াআড়ি গাছ দেখে গাড়ি থামাতে হয়।
মিনিবাস আক্রমণ করে দুঃসাহসিক সে ডাকাতি হয়েই যেত, এরা বোমাও ফাটিয়েছিল, কিন্তু সুদেব যে ওদের ওপর ঝাঁপ মারবে সেটা অবনীবাবুরাও ভাবেনি।
ওদের পিছনে আরেকটি বাস এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।
লোকজন দেখে তবে ডাকাতরা পালায়। তবে সুদেব পায়ে চোরা খেয়েছিল, পিঠে রড।
রাণীপুরের হাসপাতালে ওকে অবনীবাবু বলল, কোন সাহসে তুমি ঝাঁপ মারলে?
সুদেব বলেছিল, ভাবিনি।
কাউকে মারতে হবে, কেউ হামলা করছে দেখলে সুদেব বুদ্ধিবিবেচনা হারিয়ে ফেলত।
এবারে মা আর দাদা বলেছিল, তোকে বীরত্ব দেখাতে হবে না। পরীক্ষা দে, কাজ কর, পাঁচজনে যা করে। তাই করত, তাই করত সুদেব। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের সীট পড়ল রানীপুরে। পাশের ছেলের টুকলি করার জন্য সুদেব আর.এ. হয়ে গেল। সুদেবরা কয়েকজনই আর.এ. হোল।
সুদেব ক্ষেপে গিয়েছিল। বিনা দোষে আর. এ. করার জন্যে ও ইনভিজিলেটরকে ধরেছিল বাইরে।
ভীষণ মেরেছিল।
—আমার জীবন নষ্ট করে দেবে, আর.এ. করে দেবে? এটা দণ্ডনীয় অপরাধ।
থানা থেকে সাতদিন বাদে ওকে ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। ওর নিজের স্কুলের হেডমাস্টারও ওকে যথেষ্ট শাসান। বাঁধবেড়া স্কুলের সুনাম ও নষ্ট করেছে। ও গুণ্ডা, মস্তান হয়ে গেছে। একজন শিক্ষককে যে মারতে পারে…..
মা বোবা, দাদা বোবা।
সুদেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রানীপুরে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছয়। কত দিকে বাস যাচ্ছে, চলে যাবে দুর্গাপুর।
না হয় কুলীর কাজই করবে।
সেখানেই ওকে ধরে ফেলে অনিল, ওরফে সিতু, ওরফে ভোম্বল। সুদেব ওকে দেখেছে। সুদেবদের সঙ্গে লকআপে তরুণ নামে যে ছেলেটি ছিল, অনিল তাকেই ছাড়াতে এসেছিল।
—এই যে, এখানে কি করছ?
—বসে আছি।
—স্কুল ঘুচে গেল?
সুদেব ক্ষেপতে শুরু করেছিল।
অনিলের মুখে একটা হাসি লেগে আছে।
—বাঁধবেড়ার দুঃসাহসী বালকের চেষ্টায় ডাকাত দল ধৃত। তারপর অবনী মহান্তির পুত্র যখন বিবাহ করে ফিরছিল…
—আপনি কে?
—অনিল। কোথায় যাচ্ছ, দুর্গাপুর?
—যেতে পারি।
—তাই যায় সবাই। কেন যাচ্ছ, কাজ খুঁজতে?
—হ্যাঁ। বাড়িতে আর…
—আমি তোমায় কাজ দেব।
—কি কাজ?
—ভালো কাজ, টাকা পাবে। কাজ করছ, টাকা আনছ, এ কথা জানলেই বাড়িতে পোজিশান ভালো হয়ে যাবে।
—দেবেন কাজ আপনি?
—নিশ্চয়ই। তোমার মতো ছেলেদেরই তো খুঁজি আমি। তরুণও একদিন বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল।
—ও লকআপে ছিল কেন?
—পুলিসের কাজই হোল ফলস কেস দেওয়া।
সুদেবের অভিজ্ঞতা থাকলে বুঝত, অনিলের সঙ্গে থানার সম্পর্ক খারাপ নয়। তরুণকে ও তুড়ি মেরে বের করে এনেছিল। অনিলের ওই হাসিও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে তখন সুদেব সে সব বোঝেনি। পরে বুঝেছিল। অনিল ওকে হোটেলে মাংস ভাত খাওয়ায়। তারপর নিয়ে যায় ওর গ্যারেজে। সুদেব খুব চমকে যায়। চারটে ট্রাক আছে যার, ধনী লোক। গ্যারেজের পিছনে ওর দু’খানা ঘর, একটি গুদামঘর। অনিল ওকে বুঝিয়ে বলে।
—ট্রান্সপোর্ট বিজনেস। মানুষ মাল কেনে, আমি পৌঁছই।
খড়্গপুর, দুর্গাপুর, কলকাতা, দিকে দিকে … ট্রাকে থাকবে, কেন না ডাকাতের ভয় থাকেই।
—তারপর?
—কতদিন থাকো দেখি। মাসে পাঁচশো দেব।
পড়া শুরু করতেই বয়স হয়েছিল। উনিশ বছর বয়সে পাঁচশো টাকাকে রাজার ঐশ্বর্য মনে হয়েছিল।
এখন মনে করলে বিস্ময় লাগে।
রানীপুর ছিল অনিলের অফিসিয়াল ঠিকানা। দুর্গাপুর, খড়্গপুর, সর্বত্র ওর যোগাযোগ ছিল। সুদেব, তরুণ, ভাল্লা, প্রবীণ, ওরা আজ দুর্গাপুর, সাতদিন বাদে খড়্গপুর, একেক জায়গায় পৌঁছত।
লরিতে লোহার রড, সিমেন্ট, চাল, কাপড়, চিনি, তেল, কি থাকত, কি থাকত না সুদেব জানে না।
তরুণ বলেছিল, কোথা থেকে আসছে জানতে চেও না। কোথায় যাচ্ছে তা তো দেখতেই পাচ্ছ। কথা বোল না। সুদেবের গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।
—আমরা কি চোরাই মাল চালান করছি?
—আমরা অনিলদার কাজ করছি।
—আমার ভয় করছে।
—তাহলে এলে কেন?
সে কি জীবন ছিল, কি জীবন! ওদের ট্রাকে হামলা হয়েছে, সুদেবরা মেরেছে, মার খেয়েছে। খড়্গপুরে সুজান সিং বলত, চলে এস অনিল। আমরা পার্টনার হয়ে যাই।
অনিল বলত, যে যার মতো থাকি।
অনিল টাকা ওদের দিত। দু’মাসের টাকা নিয়ে সুদেব বাড়ি গিয়েছিল একবার। বলেছিল, ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির চাকরি। ট্রাকে হেলপার।
দাদা বলেছিল, অনিল কিন্তু নোংরা লোক।
—পরিষ্কার লোক কে?
—চল তুই স্বরূপবাবুর কাছে।
—কি করব?
—ফিশারি করছে, পুকুর পাহারা দিবি।
—কত দেবে?
—দু’আড়াই শো’ কি দেবে না?
—না দাদা!
সুদেব বলতে পারেনি, অনিল ওকে ছাড়বে না।
—কি কাজ করিস, কপালে হাতে কাটাকুটি?
—অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল।
এ ভাবে চলতে চলতে তরুণ একদিন ক্যাশ ভেঙে উধাও হয়ে যায়। অনিল বলেছিল, ভুল করল। আমার কাছে থাকলে পুলিস থেকে ছাড়াই, হাসপাতালে দিই। যাবে তো শিলিগুড়ি বা নেপাল। সেখানে ক’দিন টিকবে?
বলেছিল, এখন তুমিই আমার ভরসা।
—আমাকেও ছুটি করে দাও।
—তা হয় না সুদেব। পুলিস প্রোটেকশান দেয়, আবার ধরেও। ধরলে তুমি সব বলে দেবে।
—বলব না।
—পুলিসের হাতে থার্ড ডিগ্রী তো জানো না।
—মার কম খেলাম না, জখম কম হইনি।
—এ লাইফটাই তো ওই রকম।
—তুমি পারো কি করে?
—ঢুকে গেছি, বেরোনো যায় না।
সে তো সত্যি নয়, সত্যি নয়।
কলকাতাতেই সর্বনাশ হয়ে গেল। কলকাতা ছেড়ে খালি ট্রাক বেরিয়েছে, দক্ষিণেশ্বর ছাড়াতেই পুলিসের গাড়ি ওদের আটকাল।
ভাল্লা, প্রবীণ, ড্রাইভার পালাল। সুদেবও লাফিয়ে নেমেছিল। পায়ে গুলি লাগতে ও পড়ে যায়।
ধরা পড়ল সুদেব একা।
থানা—হাসপাতাল—থানা—জেল।
সুদেব আগাগোড়া বোবা হয়ে থাকল।
জাল নম্বরী ট্রাক অসদুদ্দেশে ব্যবহার করার জন্যে সুদেবের তিনমাস জেল হয়ে যায়।
জেলে খবর চলে এল, অনিল ওর জন্যে অপেক্ষায় থাকবে। ও যেন দেখা করে।
সুদেব জানত, ও দেখা করবে না।
কিন্তু অনিল কালো চশমা পরে গাড়ি দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সুদেবকে ও তুলে নেয়। দমদমে একটি বাড়িতে নিয়ে যায় ওকে। সারা পথ কথা বলে না কোনো।
একতলা বাড়ি। একটি মোটা লোক চা খাবার আনতে চলে যায়। বিচলিত, বিস্মিত অনিল বলে, তুমি পুলিসকে কিছু বলোনি তা জানি।
বললে না কেন?
—কেন বলব?
—নিজে তো বেঁচে যেতে।
—না, তুমি ধরা পড়তে, বেরোলে আমাকে খুঁজে বের করতে, তা জানি।
—সেই ভয়েই বললে না?
—না অনিলদা। তোমার নিমকও খেয়েছি।
—খুব মার খেয়েছ, না?
—হ্যাঁ। পা থেকে গুলি বেরোল, ব্যান্ডেজ, তার ওপর মার পড়েছে। পিঠ কেটে গেছে, দেখে নাও।
—এখন কি করবে?
—আমি কি তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছি?
—হ্যাঁ…. বলতে পার….
—বিশ্বাস করো যে আমি তোমার কথা কাউকে বলব না কখনো?
—বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু করি।
—এবারে আমাকে ছেড়ে দাও।
—কি করবে?
—আমি খুব সামান্য মানুষ অনিলদা। আমি গ্রামে ফিরে যাব। এ জীবন আমার নয়।
—আমিও এখন বসে গেছি।
—আমাকে ছেড়ে দাও।
—সুজান সিংয়ের সঙ্গে যাচ্ছ না তো?
—লাইনে থাকলে তোমার সঙ্গেই থাকতাম।
—বেশ, যাও। আমিও যাচ্ছি ধানবাদ। অনিল ওকে টাকা দিয়েছিল।
—তোমার সার্ভিসের দাম টাকায় হয় না… তবু।
সুজন টাকা নিয়ে বাঁধবেড়া ফিরেছিল। দাদা আর মাকে বলেছিল, দাদা বিয়ে করে ফেলল?
—তোকে খবর দেব কি করে? তুই তো…
—জানো তাহলে?
দাদা বলেছিল, থানায় দেখা করতে বলেছে।
ও.সি. বললেন, এখন সৎপথে চলো।
কাজকর্ম করো। কি আর বলব…
অপরূপবাবু বলল, ভূদেব কোথায় আর তুমি কোথায়। যে সুখ্যাত করেছ, কাজ দেবে কে?
মোহন খাটুয়া বলল, খবর কি চাপা থাকে সুদেব? মানছি, তুমি আমার বড় উপকারই করেছিলে সেদিন। তা বলে এখন তোমায় কাজ দিতে ভরসা পাই না।
অবনীবাবু বলল, হ্যাঁ… সেদিন ব্যাপারটা … কিন্তু টাটকা জেল থেকে এলে, এখন আমার পক্ষে তো…
সুদেব বলল, দাদা! সৎপথে তো দরজা বন্ধ।
—তোর টাকাটায় হাত দিইনি আমি। তা নিয়ে ব্যবসাপাতি করতে পারিস। নয় দুটো স্যালো কেন, ভাড়া খাটা।
—না দাদা। মাদুলির বিয়ে আছে।
টাকা ব্যাঙ্কে ফিক্স করে রাখো, খানিক বাড়বে।
কতই বা টাকা, পাঁচ হাজার মাত্র।
অনিল ও টাকা না দিলেই বা সুদেব কি করত?
বড় বন্ধুর মতো ব্যবহার করল উপেন কিসকু, সাঁওতাল পাড়ার মাঝি।
—মদ খাও না, নেশা কর না, বদনামটি নিলে কেন?
—কাকা, চক্করে পড়ে গিয়েছিলাম।
—একশো টাকা নিয়ে নেমে পড়তো।
—ব্যবসা করব?
নেশারক্ত চোখে উপেন বলল, গ্রাম গ্রাম থেকে তেঁতুল কেনো, এক হাটে বেচ, সে হাটে বেগুন কেনো, আর হাটে বেচ, চাল কিনতে বেচতে পারলে লাভ উঠবে। তা তুমি মাসে আড়াই তিনশো টাকা কামাবে।
—যাক, তবু তুমি বললে।
—বটেশ্বরে তো বারোমাসই হাট এখন।
—মন্দ বলনি।
তরকারি কেনাবেচা নয়। সুদেব বটেশ্বরে মন্দির কর্তৃপক্ষকে পয়সা দিয়ে একটা চালাঘর তুলেছিল। চা—বিস্কুট—পাঁউরুটি! দিন বিশ পঁচিশ টাকা বিক্রি হয়। তাই ভালো।
কিনেছিল এই সাইকেলটা। দাদাই কিনে আনল। বলল, তোর টাকা, তোর জিনিস, বেচলে দাম আছে। ওখানে পড়ে থাকবি, বাসে যাবি—আসবি কেন?
সাইকেলে চেপেই ও ফিরছিল গ্রামে।
বটেশ্বরে শিবরাত্রি উপলক্ষে তিনদিন মেলা চলে। শিব—পার্বতী সেজে ছেলেরা নাচে, সাঁওতালরা মোরগ লড়ায়, আর দিক দিক থেকে লোক আসে।
কেনাবেচা মন্দ হয়নি। সুদেবের মনটা হালকা লাগছিল। বাড়ি পৌঁছতে আটটা বাজবে।
পথে একটি গাড়ি দেখে ও ভ্রূ কুঁচকোয়। গাড়ির দরজা খোলা, কি ব্যাপার?
—কে, কে ওখানে?
—বাঁচাও…
কোনো স্ত্রীলোকের গলা।
সুদেব তখনি অতীত অভিজ্ঞতা ভুলেছিল। সাইকেল থামিয়ে ও নেমে পড়ে, দৌড়তে থাকে। টর্চ মারতে দেখতে পায় দুটি কালো কালো মস্তান চেহারা।
একজন স্ত্রীলোক!
সুদেব ঝাঁপ দেয়। টর্চের বাড়ি মারে একজনকে। তারপর স্ত্রীলোকটিকে টেনে সরিয়ে এলোপাথারি মার। একজনকে ও জাপটেই রাখে ও গলা পিষতে থাকে।
—কি হোল, কি হোল?
কে দৌড়ে আসছে।
একজন ছেনতাই পালায়।
এসে পৌঁছয় লোকটি।
—আমি জল আনতে গেলাম…
টর্চ জ্বালো।
লোকটি অপরূপবাবুর ড্রাইভার। আর আক্রান্ত স্ত্রীলোকটি অপরূপের বউ সুবর্ণ।
—এর মুখে ব্যাটারি মারো তো?
বছর বাইশের এই লাফাংগা ছেলেটাকে মেলায় তিনদিনই দেখেছে সুদেব।
ড্রাইভার বলে, তুই রানা। তোকে আমি….
সুদেব বলে, কোন আক্কেলে এই বেপট জায়গায় একা মেয়েছেলেকে ফেলে রেখে জল আনতে গিছলে?
মহিলাকে বলে, কিছু খোয়া গেছে?
—গলার চেনটা…
ড্রাইভার তেড়ে লাথি মারে রানাকে।
সুবর্ণ বলে, থাক! এই ছেলে না থাকলে আমি বাঁচতাম না। তুমি বুড়ো হচ্ছ, বাবু বলল, আরেকটা লোক নাও।
ছি ছি ছি, একটা ভালো কাজে এসেছিলাম, ফেরার কালে…
—একে নিয়ে যান, থানায় দিন।
—তুমি চলো বাবা…
—মন্দিরে চলুন, সেখানে ফাঁড়ি আছে।
গাড়ি থেকে নামবার সময়ে সুদেব রানাকে আরেকটি থাপ্পড় মারে।
ড্রাইভার বলে, বলতে পারবি সুদেব রায়ের হাতে মার খেয়েছিলি হে হে হে!
গাড়ির মাথা থেকে সাইকেল নামায় সুদেব। বলে, ওই ফাঁড়ি, চলুন চলুন।
পুলিশ রানাকে বলে, এক মাসও বেরোসনি। আবার…. জিত কোথায়?
সুদেব বলে, ভেগেছে।
পুলিস বলে, এই সময়ে সোনাদানা পরে বেরোবেন না। এখন হরঘড়ি ছেনতাই চলছে।
—নিন, মাল ক্যাচ করুন, আমি ফিরব।
—আপনাকেও তো স্টেটমেন্ট দিতে হবে।
—কাল দেব, আজ আমি ফিরব।
—ওই পথ দিয়ে ফিরবেন?
—তাইতো ফিরি।
সুবর্ণকে বলল, আপনি মা! দশ ভরি সোনা পরে এসব জায়গায় আসবেন না। এখন পাঁচ টাকার জন্যেও খুন হয়। এই ড্রাইভারের ভরসায় এমন বেপট জায়গায় আসে কেউ? সঙ্গে বেটাছেলে নেই।
পুলিশকে বলল, চেনেন তো এদের, ওর সঙ্গীতে ধরুন!
—হ্যাঁ এবারে পাচ—সাতটা কেস ফেলে…পরদিন বাঁধবেড়া থেকে বটেশ্বর গল্প উড়তে লাগল।
উপেন কিসকু বটেশ্বরে এসে জমিয়ে বসল।
—তা সুদেব! ওরা ছিল দশজন, আর তুমি একাই ওদেরকে…অপাবাবুর বউয়ের লাখ টাকার গয়না।
—নাও কাকা, চা খাও।
—আর ওই বিস্কুট!
—নাও।
উপেন হলুদ, বিভ্রান্ত চোখটি তুলে বলল, জলধরকে নিয়ে কি করি বল তো? পড়াতে পারলাম না, কাজ কে দেবে?
—আমার দোকান তো দেখছো, এখানে কাজ করতে পারে। কিবা দিতে পারব।
—তাই করুক।
—অবনীবাবু কিছু করে না?
—কিচ্ছু না। শোনেই না।
তারপর বলল, ওই রাস্তাটা! আলো যে কবে জ্বলবে!
—জ্বলবে। ভোট আসুক।
সুখ—দুঃখের কথা বলে উপেন চলে গেল। বটেশ্বরে আজ সুদেবের কৃতিত্বের কথা মুখে মুখে।
তারপরই আশ্চর্য, অবাক করা ব্যাপার। অপরূপবাবু আর সুবর্ণ গাড়ি থেকে নামল। ওরা সুদেবের দোকানের দিকেই আসছে।
—আপনারা?
—একটু আসবে সুদেব, কথা ছিল।
—কি কথা?
—গাড়িতে এসো।
—আজ অন্য ড্রাইভার। গাড়ি চলে এল সুবর্ণ লজে।
—ভেতরে চলো।
—কী হয়েছে, বলুন তো?
সুবর্ণ লজের ভেতরে এই প্রথম ঢোকা।
—বোস, বোস।
সুদেব বসল।
—তোমার কাছে আমি কত যে কৃতজ্ঞ…
—সে তো হয়ে গেছে।
—সুবর্ণর প্রাণটা বেঁচেছে।
সুদেব মনে মনে ভাবল, এবার নোট বের করবে।
—সুবর্ণ বলে টাকা দিয়ে ওকে ছোট কোর না। বরঞ্চ… সুদেব! এই লজে বসাই এমন বিশ্বাসী, আবার সাহসী লোক খুঁজছিলাম আমি। তা তোমাদের তো জানি কবে থেকে…
সুবর্ণ বলল, থামো তো। শোনো ছেলে! ”না” বললে শুনব না। এই লজ আমার। তুমি এর কেয়ারটেকারের চাকরিটা করলে আমি খুব খুশি হব।
—আপনি আমার কথা জানেন না।
—আমি আমার স্বামীর মতো মানুষ নই। কাল অমন বাগে পেয়ে যদি তুমিই হার ছিনিয়ে নিতে…. ব্যাগে টাকাও ছিল… সব জেনেই বলছি ছেলে। এখানে থাকবে, সব দেখবে। আটশো টাকায় শুরু করো, ক্রমে ব্যবসা জমলে বাড়িয়ে দেব।
অপরূপবাবু বলল, এই কথাটা বলতে ডেকেছি।
—আমাকে …. কাজ দেবেন?
—দেব।
—আমি যদি সব লুট করে পালাই?
—পালাবে না। অনিল আমাকে সব বলেছে। অবাক হচ্ছ কেন? অনিলের বাবা আমাদের ম্যানেজার ছিল। অনিল আমায় খুব চেনে। ছেলেটা কুপথে চলে গেল, নইলে..
সুদেব বলল, বেশ। করব কাজ।
—তাহলে এখনি সব বুঝিয়ে দিই।
অপরূপবাবু হেসেছিল।
—হয়ে গেল, সুবর্ণ, হয়ে গেল। এতদিন ধরে লজটা চালুই করতে পারছিলাম না। দেবু, আমার ছেলে, সে তো আজ আসে, কাল আসে না। অথচ টুরিস পাঠাই আমি। সরকারী বাংলোতে সবার মন ওঠে না।
সুদেবের মনে পড়েছিল দুর্গাপুরে ভিকট্রি হোটেলের কথা। ও বলেছিল, সাজিয়ে গুজিয়ে ওপনিং করুন নতুন করে।
—করো, করো যা দরকার।
—এখনো তো খাটনি আছে, পয়সাও ঢালতে হবে।
সুবর্ণ বলল, সব করো ছেলে। ওনার যত কিছু সব আমার প’য়ে। সব করো।
সুদেব বুঝেছিল, সরকার যে জায়গাকে ট্যুরিস্ট আকর্ষণ করতে চায়, সে জায়গায় ট্যুরিস্ট লজ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ।
টাকাঅলা লোক ছাড়া বুদ্ধি করেও লাভ নেই।
অপরূপবাবু বলল, কয়েকবারে ভারত ভ্রমণ করে নিয়েছি। দিকে দিকে কত চমৎকার সব থাকার ব্যবস্থা করেছে। এ জায়গার বাজার আছে। ফরেস্ট পাচ্ছ, বাঁধ পাচ্ছ, মন্দির পাচ্ছ, আশপাশে পাহাড়ও আছে। খুব ভালো হবে।
সুদেবের চাকরি দু’বছরের।
তিনমাস লেগেছিল লজ রেডি করতে। আগেকার লোকজনের মধ্যে কুক মোহর ও তার বউ বিবি আছে। বাসন মাজে সনাতন হাঁসদার বউ গৌরী, সনাতন জল টানে। কুয়োর সঙ্গে পাম্প আছে। অমরু একাধারে মালী ও দারোয়ান। উপেনের ছেলে জলধর আর সুবর্ণর ড্রাইভারের ছেলে স্বপন লজের ”বয়”। জলধর বাগানের কাজও করে।
ঘরে ঘরে পর্দা, কার্পেট, ডানলোপিলোর বিছানা, সংলগ্ন বাথরুম। বসার ঘরটি সকলের জন্য। পাশেই সুদেবের ঘর ও বাথরুম। সুদেবের ঘরে যখন সুদেব থাকে না, জলধর থাকে। পিছনে চারটি ঘর, সামনে বারান্দা। দুটিতে মোহর, বিবি এবং স্বপন ও জলধর থাকে। অন্য দুটো ঘরে দরকারে ক্যাম্প খাট ফেলে অতিথি রাখা যায়। অমরুর ঘর গেটের পাশে।
সুদেব সাইকেল থেকে নামল।
লজের পূর্বদিকে সুবর্ণ কখনো এসে থাকবে বলে একটি কটেজ হয়েছে। অপরূপবাবু রানীপুরে কলেজ হোস্টেল, নতুন হাসপাতালের কনট্রাক্টর। রানীপুর মানেই অপরূপবাবু।
ইউক্যালিপটাস ও কৃষ্ণচূড়া গাছ বড় হয়ে গেছে। বুগেনভিলিয়া গাছ অনেক। বাগানে একটি ছোট লিলিপনড আছে। তাছাড়া গোলাপ, বেল, ক্যানা, করবী অনেক গাছ। অমরু কোন নার্সারিতে কাজ করত, গাছের ব্যাপারটা বোঝে। কোয়ার্টারে মোহরের বউ লাউ কুমড়ো লাগায়। পিছনে অনেকটা জমি পড়ে আছে। অপরূপবাবুর অনেক পরিকল্পনা। ওখানে স্কুল কলেজের ছাত্রদের থাকার জন্যে ডর্মিটরি করবে। সোনা বাঁধ ও ফরেস্ট এখন জনপ্রিয় জায়গা।
এখন রাস্তায় বাতির পোস্ট। পথ পেরোলেই ফরেস্ট। ফরেস্ট পেরোলেই বাঁধ।
সুদেব এসেছে দেখে জলধর দৌড়ে এল।
—খবর কি, সব ঠিক আছে তো?
—সিনেমা পার্টি আসছে। দেবুবাবু এসেছে। এখানে শুটিং হবে। মালা রায় থাকবে।
—কখন আসছে?
—বিকেলে পৌঁছবে। বাবু বসে আছে। অপরূপের ছেলে দেবরূপের নাম ও চেহারা কাছাকাছি যায়। সুদর্শন, স্মার্ট, চোখ দু’টি সুন্দর। চুলের ছাঁট ওর, জলধরের, অমরুর, স্বপনের, সকলেরই সিনেমার নায়কদের মতো। জলধররা এক জায়গায় চুল ছাঁটে, দেবরূপ অন্যত্র।
অমরু সরেন, জলধর কিসকু, সনাতন ও গৌরী হাঁসদাকে কাজ দেবার প্রস্তাব সুদেবের।
অমরু এদের মধ্যে শিক্ষিত। আট ক্লাস পড়েছে, দুর্গাপুর—ধানবাদ—হাওড়া লেবার খেটেছে। সরকারী চাকরির চেষ্টায় আছে, হয়তো হয়ে যাবে। ওদের বাড়ি কাছাকাছি কয়েকটি গ্রামে। সুদেব অপরূপকে বলেছিল, ভালো সার্ভিস চান, বিশ্বাসী হবে, ওদের রাখুন। সরকারী কাজ ছাড়া বেসরকারী কাজে ওরা সুযোগ পাক।
—বেকার তো আরো আছে।
—কাছাকাছি গ্রামে বাড়ি, যাবে—আসবে। ভালো ব্যবহার করলে ওরা মনে রাখে। সুদেবের কথা কার্যকরী বলে প্রমাণ হয়েছে। এখন দেবরূপও তা স্বীকার করে।
দেবরূপ ওদের সম্পর্কে ”বুনো, জংলী” এসব একদা বলত। দিনকাল পাল্টে গেছে, এখন আর তা বললে বিপদ আছে তা ও ভালোই বোঝে। ফলে কথাবার্তা পাল্টেছে।
দেবরূপ বসেছিল। সঙ্গে একটি প্রৌঢ়। ওরা মারুতি ভ্যানে এসেছে নিশ্চয়ই, সব সময়ে তাই আসে।
—এই যে সুদেববাবু। বাড়ি থেকে ফিরতে এত দেরি?
—ক’মাসে এক দিন, তাও গেস্ট থাকলে যাই না।
—যাক গে, আপনার সুবর্ণলজ তো জাতে উঠে গেল।
—জাতে নিচু তো ছিল না।
—আরে ”দু’বার বিয়ে” ছবির শুটিং হবে, তিনদিন পুরো লজ বুকিং, ইনি প্রোডাকশান ম্যানেজার রবীনবাবু। অ্যাডভান্স টাকা নিয়ে চলে এসেছেন।
—সুবর্ণ লজের ভালো পাবলিসিটি হবে।
—পুরোটা বুকিং।
—ক’দিনের জন্যে?
রবীনবাবু বলে, তিন দিনের জন্যে নিচ্ছি, অত লাগবে না।
—ক’জন থাকবেন?
—নায়িকা, নায়িকায় ডবল, ডিরেক্টর। আর ইউনিটে…. তা ধরুন জনা ছয়েক।
দেবরূপ বলে, নায়িকা, নায়িকার ডবল, ডিরেক্টর, ওনারা এখানে থাকবেন। ইউনিট থাকছে ইরিগেশন বাংলোয়। ওঁরা ওখানে খাবেন, এঁরা এখানে।
—সবটা বুক করবেন বললেন?
দেবরূপ বলে, মালা রায় টপ যাচ্ছে, মেজাজ তেমনি। ও চারপাশে গাদাগুচ্ছের লোক নিয়ে থাকবে না।
রবীনবাবু বলে, নায়িকার মা থাকবেন, সেটা বলা হয়নি। তারপর খাওয়া দাওয়া…
—কি হবে, বলুন?
—নায়িকা রাতে চিকেন সুপ, একটা রুটি, স্যালাড। সকালে কমলালেবুর রস, দইয়ের ঘোল। দুপুরে কি খাবেন, তা নিজেই বলবেন….
সুদেব বলে, দেবুবাবু! এখানে কমলালেবু পাব কোথায়? রানীপুরেই কি পাব?
দেবরূপ বলে, ভাবনা কি সুদেববাবু? সকালে আমি এসে যাব দশটা নাগাদ। রানীপুর থেকে সব নিয়ে আসব।
রবীনবাবু বলে, না, না, ফল আমরা নিয়ে আসব। ফ্রিজে রেখে দেবেন।
—দেবুবাবু! আপনার বাবাকে বলে কয়ে যদি রসুনকে জোগাড় করতে পারেন… মোহর যদি না পারে?
—জোগাড় করতেই হবে।
রবীনবাবু ভরসা দিয়ে বলে, মালা যা খেয়ালী। হয়তো পরশুই বলবে কলকাতা চলো।
দেবরূপ বলে, আমাদের প্রেস্টিজ এটা। আমি আর অমিত কাল দশটার মধ্যে… ভাবতে পারছি না, ভাবতে পারছি না সুদেববাবু! মালা রায়! ন্যাশনাল প্রোগ্রামে অভিনয় করছে… সে এখানে… মিউজিক রাহুলদেব বর্মন… প্লে ব্যাক আশা ভোঁসলে .. খবর পেলে শুটিং দেখতে … রবীনবাবু! ইন্দ্র বোস রানীপুরের ছেলে বলেই এ জায়গা বেছেছে। এ ছবির খবর বেরোলে দমাদম শুটিং পার্টি আসবে।
—ঘরটর দেখে নিই?
সুদেব বলে, দেখুন।
ঘর দেখে রবীনবাবু বলেছিল চলবে। ওনার ঘরে ধোয়ানো পর্দা দিয়ে দেবেন।
—হ্যাঁ, পর্দা, তোয়ালে….
—আপনাদের তোয়ালে ও ব্যবহার করবে না। ও হচ্ছে… মানে খুব মুডি মেয়ে… নির্জনতা …. একা একা … এসব ভালবাসে। তিন বছর লাইনে এসেছে… আলিপুরে বিশাল ফ্ল্যাট কিনল… গাড়ি…. এখন সব চটপট হয়ে যায়। আগে এত টাকা তো ছিল না!
—আপনি পুরানো লোক।
—হ্যাঁ, সে সময়ে টাকা ছিল না।
মানুষজন অন্যরকম ছিল। পাহাড়ীদা, এসেই বলত, রবীন কোথায়? উত্তম, আহা—হা, মানুষ ছিল বটে! কতবার কত সাহায্য করেছে… শুনুন, উনি যখন যা চাইবেন সেটুকু জোগান দিয়ে যাবেন, ব্যস। ইন্দ্র আজকালকার ছেলে, খুব বুঝদার, সে সব সামলে নেবে।
—নায়িকা কখন কি চাইবেন, জায়গা তো তেমন নয়!
—মাছ পাওয়া যাবে?
দেবরূপ বলে, বাঁধের মাছ খাইয়ে দেব।
আরে, বাঁধবেড়ায় আমাদের চারটে পুকুর আছে, মাছের অভাব?
রবীনবাবুর হঠাৎ কি মনে হয়।
—সুদেববাবু কি ছবি—টবি দেখেন না?
—অনেককাল দেখা হয় না।
দেবরূপ বলে, সুদেব জানে শুধু সুবর্ণ লজ! দারুণ ছেলে! আমার মাকে ডাকাতের হাত থেকে…
রবীনবাবু বলে, বা বা! কলকাতা এলে আসবেন ভাই গরীবের বাড়ি। আমার কাকা, স্বাধীনতা সংগ্রামীর পেনশান পান, সর্বদা বলেন, বাঙালী লাঠি ধরতে ভুলে গেছে। আপনাকে দেখলে খুব আনন্দ পাবে।
সুদেব বলে, কাগজ পড়লে দেখবেন, বাঙালী পরের জন্যে না হোক, নিজের কাজ হাসিল করতে লাঠি থেকে রিভলভার, সব চালাচ্ছে।
দেবরূপ বলে অন্তত একটি ক্রাউড সীনে আমার মুখ দেখাবার ব্যবস্থাটা করে দেবেন।
—দেখা যাবে, দেখা যাবে। এখানে তো নায়ক—নায়িকার গান….ও, নায়ক আসবে পরশু। নতুন ছেলে রূপক, ইরিগেশান বাংলোতেই থাকবে। ওই গানের শট জঙ্গলে… মানে নায়িকা ভাবছে। নায়ক তো ওকে গোপনে বিয়ে করে শহরে কেটেছে…নায়িকা বাঁধে ঝাঁপ দেবে… মানে ওর ডবল…. তারপর নায়িকাকে বাঁচাবে এক ডাক্তার। সে ভীষণ ধনী। নায়িকা তাকে ”বাবা” বলবে, তার সম্পত্তি পাবে, তারপর নায়কের সঙ্গেই তার দু’বার বিয়ে হবে।
—এর নাম সিনেমা।
—ডবল মেয়েটা ভালো। দেবরূপবাবু, সাঁতার জানা লোক মোতায়েত রাখবেন আপনি।
—অবশ্যই।
পরে অমরু বলে, হয়ে গেল কাজ।
—কি হোল?
—সুদেবদা, সিনেমার লোক এলে ভিড় যা হবে!
—তুমি ঘর থেকে ভাইকে নিয়ে এসো। গেট সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে।
মোহর বলে, ইনসাল্ট হয়ে গেল দাদা।
কি এমন খাবে যে আমি পেরে উঠব না?
—মনিবের ছেলের কাস্টমার মোহরদা! তোমারও চাকরি, আমারও চাকরি। বোঝোই তো!
—গৌরী মাসিকে মুরগি আর ডিম আনতে দাও।
—হ্যাঁ, চিনি, চা—পাতা, কফি, আমুলের কৌটো, সব্জী, সবই আনতে হবে।
সুদেব বোঝে, এটা ওর পরীক্ষা।
—জলধর, বাঁশি বাজাবি না। পার্টি খুব নির্জনতা ভালোবাসে।
অত্যন্ত নির্জনতা প্রিয়, একলা থাকতে ভালোবাসা, খেয়ালী নায়িকার জন্যে সকালেই দেবরূপ ”দাতা” ; ”জঙ্গবাজ” ; ”ত্রিদেব” ; ”যৈসি করনি ঐসি ভরনি” ; ”রামলাখন”; ”বাটোয়ারা” ; ইত্যাদি ক্যাসেট নিয়ে চলে আসে।
বিকেলে সোনা বাঁধের নির্জনতা ভেঙে দিয়ে কয়েকটি মারুতি, একটি মারুতি ভ্যান চলে আসে।
মালা রায় নেমেই বলে, ডিভাইন, ডিভাইন, কিন্তু চা খাব ইন্দ্র। এক পেয়ালা গ্রীন টি না পেলে মরে যাব—আর একটু স্নান… ও ডিভাইন বয়। ও কে?
সুদেব বলে, জলধর কিসকু।
—সেটা কি?
—ও সাঁওতাল।
—কি চেহারা। ইন্দ্র, কাল ওকে অবশ্য রেখো।
—ও এখানেই থাকে।
—আপনি?
—আমি এখানকার কেয়ারটেকার।
—ডিভাইন!
—ভেতরে চলুন।
—হ্যাঁ। ওঃ, এই ফুল, এই গাছ, আমি ভাবতে পারছি না। ইন্দ্র, এখানে একটা বাড়ি বানাব।
—অবশ্যই। দীঘা, চাঁদিপুর, খাজুরাহো, কোথায় বাড়ি বানাসনি? এখানেও হয়ে যাক।
মালা গলে পড়ে।
—কলেজে একসঙ্গে পড়তাম তো! ইন্দ্র আমাকে ”তুই” বলে। কি সুইট, বলুন তো?
নায়িকার মা বললেন, ভেতরে চলো আগে।
—নিশ্চয়।
ঘর ডিভাইন, আলোর শেড কি মিষ্টি, জলটা কি ঠাণ্ডা! স্নানের পর, শুধু একটু কফি, একটু কাজু বাদাম। নায়িকার পিছনে ছোটাছুটি দেবরূপই করে। ওর জীবনে এটা একটা ঐতিহাসিক দিন।
স্বপন সুদেবকে বলে, ছোটবাবু ক্ষেপে গেছে।
—কিচ্ছু বলিস না।
নায়িকার মা কিন্তু সহজে খুশি হন না।
—নমিতা! নমিতা!
শান্ত চেহারার মেয়েটি সুদেবের ঘরে এসে দাঁড়ায়।
—বসতে পারি?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, কি আশ্চর্য, বসুন না।
—শুনুন, নায়িকার মা’র জন্যে স্নানের গরম জল চাই। আপনাদের কাপড় ধোবার লোক আছে?
—জায়গা তো দেখছেন। লনডারিং সার্ভিস নেই। হয়ে যাবে। তবে দরকার হলে বিবি মাসি ধুয়ে দেবে, চার্জ দেবেন।
নায়িকার চেয়ে নায়িকার মা অনেক বেশিবার কাপড় ছাড়বেন, ধুতে দেবেন। আপনারা ওঁকে চিনতে পারেননি, উনিও অভিনয় করতেন। নাম ছিল অনসূয়া দেবী।
—আমরা বুনো জংলী লোক!
—সকালে ওঁর চাই কড়া টোস্ট, দুধ, চীজ, মাখন।
—চীজ হবে না।
—ডিরেক্টরের কোনো বায়নাক্কা নেই।
—আপনার?
—আমার? আপনারা যা খাবেন তাই দেবেন।
—মাপ করবেন, আপনিও কি অভিনয় করেন?
—আমি এ ছবিতে নায়িকার ডবল।
নায়িকা তো জলে ঝাঁপ দিতে পারে না, আমি দেব।
—সোনা বাঁধে। সাঁতার জানেন?
—শুনেছি তোলার লোক থাকবে….
সাঁতার! জানতাম একসময়ে। যেহেতু ডুবছি আর ডুবছি, বুঝেছি জলে সাঁতার জানাটা কিছু কাজে লাগে না।
এবার ডিরেক্টরের প্রবেশ।
—নমিতা এইখানে? যাও যাও, স্নান করে নাও, স্নান করে নাও। সুদেববাবু! রাতের খাবারটা ন’টার মধ্যে দিয়ে দেবেন। রাতে বিশ্রাম দরকার। কি খেতে দেবেন?
—ফ্রায়েড রাইস, চিকেন দো পেঁয়াজী, স্যালাড, কাস্টার্ড। এখানে সব পাওয়াও যায় না, অসুবিধে খুব।
—যথেষ্ট, যথেষ্ট। সকালে আমাদের সকলকে… রবীনবাবুকে তো সন্ধের পর পাবেন না। সকালে একটা লুচি তরকারি করে দেবেন।
—দুপুরে মাছ দিতে পারব।
—চমৎকার জায়গা মশাই! আমার ছবির বিজ্ঞাপন শুরু হলেই এখানে শুটিং করার ভিড় লেগে যাবে।
—আমরা বিখ্যাত হয়ে যাব।
—রবীনবাবু কিছু দিয়েছে?
—হাজার টাকা আগাম দিয়েছেন।
—ওই পুরনো অভ্যেস। কাল সন্ধ্যায় মনে করাবেন তো। লজ চার্জ, খাওয়ার বিল, সব ধরিয়ে দেবেন।
ব্যস্ত সমস্ত ইন্দ্র বেরিয়ে যায়। মূল কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা ইন্দ্র বসুর।
নমিতা বলে, টাকাটা নিয়ে নেবেন।
—আপনি শুধু জলে ঝাঁপ দেবেন?
—পেছন ফিরে। নায়িকার মতোই লম্বা, এক ফিগার, ইত্যাদি ইত্যাদ, ঝাঁপ দিয়েই আড়াইশো টাকা।
—কি করেন, এমনিতে?
নমিতার চোখ দুর্বোধ্য, কঠিনও বটে। ঈষৎ শুকনো গলায় বলে, একদিনেই সব জেনে নেবেন? গরম জলটা দিন।
—হ্যাঁ, পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দেবরূপ শশব্যস্ত হয়ে ঢোকে।
—সুদেববাবু! রান্নার তো দেরি আছে।
—হ্যাঁ, ঘণ্টা দুই তো বটেই।
অনাবশ্যক গলা নামিয়ে দেবরূপ বলে, আমি ওদের ইরিগেশান বাংলায় ঘুরিয়ে আনি। কামেরা—ট্যামেরা এখানেই রইল। ফিরে এসে খাওয়াদাওয়া করা যাবে।
এখানে থাকছেন নায়িকা, তাঁর মা, নমিতা দেবী আর পরিচালক, এই তো?
—হ্যাঁ; বললাম তো!
সুদেব নিচু গলায় বলে, দেবুবাবু, এরকম পার্টি তো কখনো হ্যানডল করিনি। আপনাকে সাহায্য করতে হবে। নইলে বদনাম হয়ে যাবে। বাবুর বদনাম হবে।
দেবরূপ বলে, সব সাহায্য করব। বাবুর কথা বলবেন না। তার ক্ষমতা ছিল এ পার্টি আনে?
—একটু দেখবেন। আর… ওনারা যেন খানিক বুঝে চলেন…. এ সব জায়গায় মানুষ তো বাইরের লোকজনের উৎপাত সয়ে সয়ে অতিষ্ঠ হয়ে আছে। ওই ইরিগেশন বাংলোতেই সেবারে কি হয়ে গেল। আপনি জানবেন সবই।
—হ্যাঁ… তা বটে, তা বটে।
সকলেরই মনে থাকবে। এক সরকারী কেউ কেটা, ইরিগেশন বাংলোয় মদটদ খেয়ে সাঁওতালগ্রামে চলে গিয়েছিল। তখন ওখানে চলছে সারহুল পরব। মেয়েদের সঙ্গে নাচতে চেয়েছিল। ফলে মারধোর খায়, খুব হাঙ্গামা হয়। সে কথা এখানে সবাই মনে রেখেছে। বস্তুত, এরা আসার পরেই জলধর, অমরু, এদের চোখের ওপর একটা সতর্কতার ছায়া নেমে এসেছে। বাইরের টুরিস্ট এসে হৈ—চৈ, অসভ্যতা করে উত্তেজনার কারণ সৃষ্টি করলে তার ফল ভালো হয় না।
জলধর সুদেবকে ডাকল।
—কি হোল?
—বুড়ো বাবুটা কি এখানেই থাকবে?
—সে কোথায়?
—বাগানে বসে খাচ্ছে।
সুদেব ইন্দ্রকে খুঁজতে গেল। রূপক ইন্দ্রকে বলেছিল, আমি হীরো, কিন্তু আমাকে ওখানে ঠেলছেন, এটা ঠিক করছেন না, এটা অপমানজনক।
—দেখ রূপক! আমি স্বচ্ছন্দে ওখানে যেতে পারি, তোমাকে এখানে রাখতে পারি। তারপরের পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?
—কি বলতে চান বলুন তো?
—নায়িকা তোমার ওপর ক্ষেপে আছে।
—এটা কি…জেলাসি?
—জেলাসি নয়। কিন্তু নায়িকা সামনে থাকতে তুমি নায়িকার ডবলকে চাঁদ দেখাবে, এটা চলে না। তুমি ওপরে ওঠো ভাই, এক নম্বর হও, তোমার সব ইচ্ছে অনিচ্ছে সহ্য করব।
—গল্পতে হীরো তো ভিলেন।
—অভিনয়ের স্কোপ পাচ্ছ, কাজে লাগাও। দেখ, মালার কথায় ঝামরিয়া টাকা ঢালছে। মালার কথা আমাদের শুনতেই হবে। এ ছবি না লাগলে আমিও…আর মালা আমাকে সুযোগটা এনে দিয়েছে।
সুদেব গলা খাঁখারি দিয়ে ঢোকে।
—ব্যস্ত আছেন স্যার?
—কেন ভাই?
—রবীনবাবু বাগানে বসে…উনি তো এখানে থাকবেন না।
—দেখছি, আমি দেখছি। খাবারটি খাবে, চলে যাবে। চলুন তো দেখি। ওখানে কি করছে?
বাগানের মাঝখানে শুকনো লিপিপুলের ধারে বসে রবীনবাবু, নমিতা দাঁড়িয়ে।
—নমিতা গ্রেট ম্যানেজার, ওকে ঠান্ডা করে দেবে।
নমিতা বলছিল, আপনি আর মদ খাবেন না।
—চুপ করো। চোখ রাঙাচ্ছে, জানো আমি তোমাকে…
—জানি। তবু বলছি, আপনি এভাবে চললে…
—আমাকে ইন্দ্র দেখিও না। আদি সিনেমার বাদশাহের সঙ্গে কাজ করেছি। ইন্দ্র এগিয়ে এল। বলল, আপনি চলে যান সুদেববাবু। এই এক দোষে লোকটা কাজ পেলেও রাখতে পারে না। নমিতা ঘরে যাও। মালার মা তোমায় খুঁজছিলেন।
—হ্যাঁ, যাচ্ছি।
—মালা এতক্ষণ চুপচাপ কেন?
—উনিতো ঘরেও নেই। তাই দেখতেই…
—ঘরে নেই? যাবে কোথায়?
বললেন, হাঁটতে যাব।
সুদেব বলল, একা হাঁটতে যাওয়া…
ঝোপঝাড় আছে… সাপখোপও আছে….
মালা সুবর্ণ লজে নেই, সামনের বাগানে নেই। অবশেষে অমরু টর্চ নিয়ে বেরিয়ে ওকে আবিষ্কার করল ফরেস্টে।
ইন্দ্র বলল, মালা! সাপের ভয় আছে কিন্তু।
—সেজন্যেই তো ফিরলাম। ইউক্যালিপটাস বনে হেঁটে দেখিস ইন্দ্র, ডিভাইন।
—গ্রেটা গার্বোর মতো করিস না ভাই।
—ইয়েস, আমি গার্বো।
—বুঝেছি। এবার বিশ্রাম কর।
—ইশ! এখন আমি ভি. সি. পি. দেখব।
—তাই দেখিস, কাল দেখিস।
—তোর মধ্যে কবিতা নেই।
—সবিতাকে বিয়ে করার পর কবিতা উধাও।
—ওঃ, ছাত্রজীবন, ছাত্রজীবন। সবিতা আর ইন্দ্র। আমি আর পল্লব। তারপর সবিতা পড়াচ্ছে ফিলজফি। ওদের কি মিষ্টি দুটো যমজ মেয়ে আছে সুদেববাবু। পল্লবতো এখন অ্যাড ফিল্ম করে। সবচেয়ে ডিভাইন কি ইন্দ্র, এরা কেউ আমাদের ছবি দেখে না, মফঃস্বলেও ভি. সি. পি. আর হিন্দী ছবি।
সুদেব বলে, তা কেন, স্বপন, দেবুবাবু, ওরা আপনার সব ছবি দেখেছে। আমাদের কথা ছেড়ে দিন।
—বেশ! ছেড়ে দিলাম!
সুদেব বোঝে, মালা নেশা করেছে।
—চলুন, ভেতরে যাই। নইলে বুড়ী ক্ষেপে যাবে।
ওরা ভেতরে আসে। রবীনবাবু গুম হয়ে থাকে। ইন্দ্র বলে, আপনি এখানে পুরো টাকাও দেন নি। দিন, টাকা আমাকে দিন। সেবারের মতো হারিয়ে যাবে।
—অবিশ্বাস করছ? নাও।
সুদেব বলে, ডিনার কি…
—হয়ে গেছে?
—মনে হয়।
—একসঙ্গে ক’জন বসা যায়?
—আটজন।
—আমি, রবীনবাবু, রূপক, নমিতা বসে যাই। মালার তো সুপ আর স্যালাড।
তোমার মা…
মালা বলে, আজ ইন্দ্র, তুই যা খাবি আমি তাই খাব।
—তোর মা?
অনসূয়া দেবী কালো জর্জেট, কালো জামা পরে ঢোকেন ঘরে। বলেন, যা হয়েছে তাই খাব। কি নির্জন জায়গা বেছেছ বাবা, প্যাঁচার ডাক শোনা যায়।
—লোকেশান কেমন তাই বলুন?
—জঙ্গল বলে জঙ্গল।
—এটা কি জঙ্গল ম্যাডাম। জঙ্গল দেখাই যায় না এখন। এ জঙ্গলে কোনো জীবজন্তু নেই।
—জঙ্গল আমি দেখেছি ইন্দ্র। মালার বাবার সঙ্গে ইউরোপ ঘুরেছি, কত বন—জঙ্গল দেখেছি। সে বাগানের মতো।
—ইন্দ্রও যাবে মা, দেখবে। খাও।
রবীনবাবু হঠাৎ বলে, হাজারিবাগের জঙ্গলে ”পলাশ মহুয়া” ছবির শুটিং হয়েছিল, আপনার তো মনে থাকবে।
মালার মা গলে যান সহসা।
—সে তো ছোট্ট রোল। বাপ রে, কি জঙ্গল।
—আমার মনে আছে।
ইন্দ্র তাড়াতাড়ি বলে, খেয়ে নিই আমরা।
ওরাও তো আসবে। না সুদেববাবু, রান্না চমৎকার।
মা বলেন, মালা! তুমি এই ঘি—তেলের রান্না খাচ্ছ?
—খাচ্ছি, খুব আরাম করেই খাচ্ছি।
—তোমার ডায়েট!
—কাল থেকে।
—প্রভাত জানলে..
—তুমি ঝামারিয়ার এজেন্ট, না আমার মা? আমার মনে হচ্ছে তোমাকে নিয়ে ঘোরাফেরা করা আর চলবে না।
ম্যাডাম গলার স্বর বদলে পেলেন।
—এই দেখ! মেয়ের কথা মা ভাববে না তো কে ভাববে? কবে তোমার কথা ভাবিনি বলো?
—ভেবেছ। ভাবছ, কিন্তু আমি সাবালিকা।
ইন্দ্র বলল, তুই এখন আমাদের ভরসা।
কালকে গানের লিপটা সকালে প্রাকটিস করে নিবি।
দেখিস, তোর নাম কি ওপরে উঠে যায়।
—তোর ছবিতে আমি গ্রামের মেয়ে।
রঞ্জনবাবুর ছবিতে আমি হাসপাতালের ডাক্তার! কিন্তু গল্পগুলো তোরা এমন বাছিস, ভাবিস না।
—এ গল্প তো তোর পছন্দ।
—হ্যাঁ, তা পছন্দ।
সুদেব বলে, চিকেন কেমন খেলেন?
—ভীষণ ভালো।
—হতেই হবে। সাঁওতাল গ্রাম থেকে চিকেন আর ডিম আনাই, তার স্বাদই আলাদা।
মালা নেচে ওঠে।
—সাঁওতাল গ্রামও আছে।
—অনেক।
—ইন্দ্র! গ্রামে চল না।
—সময় তো কম। আমার স্বপ্ন অমলেন্দু মিত্রের ”কৃষ্ণা” গল্পটা ছবি করা। সেটা করতে পারলে গ্রামেই যাব।
—ওদের নাচ—গানের শট নে না।
সুদেব বলে, সেজন্যে অনুমতি নিতে হয়। ওদের উৎসবের সময়ে চলে আসবেন, তখন হবে।
—ওরা ডিভাইন!
—ওরা ঠিক আমাদের মতো মানুষ।
ইন্দ্র বলে, আমার উচিত, কুককে ধন্যবাদ দেওয়া।
—যাবার সময়ে দেবেন!
—মা, বুড়ী হয়েছ, অত খেও না।
পঞ্চাশটা কোনো বয়স নয় মালা!
—ও, পঞ্চাশ! স্যরি!
ওরা উঠে পড়ে। সৌভাগ্যক্রমে দেবরূপরা এসে যায়। ইন্দ্র বলে, ভাই! ঝটপট সেরে নিলে আমরা একটু ঘুমোতে পারি।
ক্যামেরাম্যান সিং বলে, বউকে চিঠি লিখবে।
—এবার কিছু ছবি তুলে নিয়ে যাব।
ম্যাডামকে আনাটা ভুল হয়েছে। মালার মুড বিগড়ে দেবে।
—আবার হবে আউটডোর।
—এ বাজেটে? তাছাড়া মালা এখন ডেট—ই দিতে পারে না। বড় পর্দা, ছোট পর্দা, চালাচ্ছে বটে।
সিংহ বলে, সিমপ্যাথি, সিমপ্যাথি। ও তো টিকবে না। এরমধ্যেই বাজার পড়ছে।
বড় ছবি ধরতে পারছে না। ফলে যা পারে করে নিচ্ছে।
—চেহারা ছিল।
—সুচিত্রা ফেস, সুচিত্রার ট্যালেন্ট নেই।
দেবরূপ বলে, ইন্দ্র দা, আপনার ছবির টাকা আসছে বছর আমিই দিতে পারব।
—এই লজ থেকে?
—না না। ব্যবসা থেকে। জয়পুর কলিয়ারি ঘিরে নতুন টাউনশিপের কন্ট্রাক্টার আমার বাবা। সুবর্ণ লজ নাথিং। আমার মায়ের একটা শখ। অবশ্য সুদেববাবু আছে বলে এই জঙ্গলে ম্যাজিক করে ছেড়ে দিচ্ছে। সুদেববাবু! কাল সকালে লুচি, তরকারি, মিষ্টি। দুপুরে মাছ, ভাত, দই। রাতে মুরগির ঝোল আর ভাত। সকালে আমিতো আনছি টাটকা ফল, কাজু, আখরোট, মেওয়া। কলকাতা থেকে আনাচ্ছি। সম্মানিত অতিথিদের জন্যে…
মেকাপ—ম্যান বলে, ইরিগেশন বাংলো তো বিশাল!
—জয়পুর প্রপার্টি ছিল। জয়পুর স্টেটের ম্যানেজারের বাংলো ছিল।
—কোন জয়পুর?
—এখানকার জয়পুর।
—রাজাদের কিছু নেই?
—বাঁধের তলায়।
—ইন্টারেস্টিং।
সুদেব বলে, গল্প অনেক আছে। পরে শুনবেন।
নমিতা হঠাৎ বলে, খাওয়ার পরে সে সব গল্পই বলুন না।
ইন্দ্রবাবুও জানবেন।
ইন্দ্র মাথা নুইয়ে বলে, ইন্দ্রবাবু উচ্চমাধ্যমিকের পর কলকাতায় প্রেসিডেন্সিতে বিতাড়িত। তারপর বিজ্ঞাপন অপিসে যোগদান, তারপর বিবাহ, সংসার… রানীপুরেও তো থাকি নি। নরেন্দ্রপুরের ছাত্র।
সুদেব একটু মুগ্ধ হয়।
—আপনারা প্রেসিডেন্সির…?
—কলেজের নাম করি এমন রেজাল্ট করি নি। মালা অবশ্য ইকনমিক্স অনার্স ছেড়ে দিল। নইলে ও ভালো ছাত্রী ছিল। অত অ্যাডমায়ারার পিছনে ঘুরলে কি পড়াশোনা হয়? ফার্স্ট পার্টে হাইসেকেন্ড ক্লাশ পেল, কিচ্ছু পড়াশোনা করেনি। তারপর আমাদের টা টা করে চলে গেল অ্যামেচার থিয়েটারে।
—আর না, ইন্দ্র। আমার জীবনীটা তুই লিখিস।
—লেখার লোক অনেক আছে।
মালা আস্তে, একইসঙ্গে মুখে হাসি আর চোখে সামান্য জল নিয়ে বলে, আমি যে আবৃত্তি করতাম, কলেজ ম্যাগাজিনে লিখেছিলাম, পিকনিকে তোদের নেরুদা শুনিয়ে অবাক করে দিয়েছিলাম, ইনিসিয়েটিভ নিয়ে চাঁদা তুলে শ্রাবণী আর বিজুর বিয়ে দিয়েছিলাম, কি ভালো মাংস রাঁধতাম, এসব কথা তুই ছাড়া কেউ ভালো লিখতে পারবে না।
সবাই চুপ হয়ে যায়।
মালা বলে, আজ তাহলে গল্প হবে। আজ ক্যাসেট দেখব না।
দেবরূপরা খেতে বসে।
সব মিটতে মিটতে এগারোটা বাজে।
বিবি বলে, দাদা, তুমি আর আমরা দু’জন।
—খাবার কিছু বাঁচল কি?
—ভাতটা বেঁচেছে।
—সনাতনদা চলে গেছে?
—ওরা মিষ্টি ভাত খাবে না। জলধর আর অমরুও খাবে না। যা হয় হবে, খেতে এসো।
—তোমরাও শুয়ে পড়ো। যা ধকল গেল!
মোহর বলে, ধকল যাবে কাল। শুটিং দেখতে বাজার বসে যাবে এখানে। রাতে সব ঘুরে ঘুরে দেখা সুদেবের কাজ। করিডোর, দরজা, সব দেখতে গিয়ে ও চমকে ওঠে।
মালার মা’র বিষাক্ত গলা।
—দু’বার আমাকে ”বুড়ী” বলেছ।
—বেশ! ”যুবতী” বলব।
—বড্ড বাড়াবাড়ি করছ মালা। মনে রেখো, লাইনে তোমায় এনেছি আমি। আর এখনো তোমার ভালোমন্দ দেখে চলার দায়িত্ব আমার। কি করে ইন্দ্রের ছবিতে অত কম টাকায় সই করলে তা তুমিই জানো।
—জানি। সে আমি বুঝব।
—আর কতদিন ”নো—গুড” গুলোকে ঠেলবে?
যতদিন পারি। আমিও তো ”নো—গুড”। আর তুমি? আদর্শ মা! বিশ বছর বয়স থেকে আমায় এর কাছে, তার কাছে ভিড়িয়ে দিয়ে—যথেষ্ট তো করে দিয়েছি। তোমাকে পুষছি, তোমার বয়ফ্রেন্ড সাহাকে… যাদবপুরের ফ্ল্যাটটা তোমার। তুমি ওকে বিয়ে করো না। কেন করছ না?
—তোমার ভালোর জন্যে।
—আমার ভালো আর হবে না। আমার ভাবনাটা আমাকে ভাবতে দাও। তোমার জন্যে…
ও, সেই ”নো গুড” জার্নালিস্টটাকে বিয়ে করতে দিইনি বলে এত কথা বলছ?
—কিছু বলছি না। তুমি যেতে পারো।
সুদেব যেন গভীর লজ্জা পেয়ে নিঃশব্দে চলে আসে।
বাইরের ঘরে ধোঁয়ার স্পাইরাল।
ইন্দ্র বলে, বসুন।
—শুতে যাননি?
—যাব। শুনে ফেললেন মা—মেয়ে সংলাপ?
—আমি…আমি সব চেক করছিলাম।
—তবে তাই।
—লজের এবং গেস্টদের দায়িত্ব আমার।
—ওই সংলাপ সিনেমায় ব্যবহার করা যাবে না। ওই মহিলা মালার দখল ছাড়বেন না। মালা…খুবই দুর্ভাগা মেয়ে। তবে গ্রেট বিগ হার্ট। ওকে মানসিক যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে…এই হয়। মালা এখন ওঁর ক্যাপিটাল। ক্যাপিটাল ভাঙাচ্ছেন
—দরজাটা খোলা কেন?
—নমিতা সিঁড়িতে বসে আছে।
নমিতা! শুতে যাও ভাই। সুদেববাবু, আর্ট ফিল্ম করলাম, ”প্ল্যাটফর্ম”, প্রশংসা পেলাম, চলল না। একেবারে বিদেশী ছবি মেরে করলাম ”হোটেল”, চলল।
এখন তো আরো বড় মেয়ে—কাঁদানী ছবি করছি। মেয়েরা কাঁদবে, বাচ্চুরা শিস দেবে, গান হিট হবে, তার নাম ছবি।
এ ছবিতেও দিসুম দিসুম পাঞ্চ থাকবে।
খাঁটি হুইস্কি সাধ্যে নেই। সবাই ককটেইল করছি। আচ্ছা, গুড নাইট।
এত রাতে নমিতা ভিজে চুল ছড়িয়ে নিশ্চল বসে আছে। আলো ওর মাথার ওপর।
—কাইন্ডলি শুতে যান।
—আপনি, এখানকার গল্প বললেন না?
—আজ থাক। ভেতরে আসুন।
দরজায় তালা মারব।
—ভয় আছে না কি?
—সাবধান তো হতে হবে। গেস্ট হাউস, গেস্ট থাকে, সাবধান হতেই হয়।
—চুরি ডাকাতি হলে?
—বটেশ্বর আউটপোস্ট আছে। সেটা তেমন কিছু নয়। তারপর রানীপুর থানা। সোনা বাঁধ থানা এ বছর শুরু হবে শুনছি।
—চোর ডাকাত এলে?
—এখনো আসেনি। এলে দেখা যাবে।
—দেবরূপ বলছিলেন, আপনি খুব…
—শুয়ে পড়ুন দয়া করে।
—হ্যাঁ….. যাই…..। রাতের মিউজিকটা অন্যরকম। পাতায় বাতাস বইছে, কি একটা পোকার ডানায় আওয়াজ … আর গাছপালায় যে কি রকম একটা….
—শুয়ে পড়ুন। দরজা বন্ধ করবেন, বাথরুম দেখে নেবেন। প্রতি ঘরের সঙ্গে কলিংবেল আছে। জানালায় গ্রীল ও জাল আছে। মশারি ফেলতে ভুলবেন না। এ সব লেখাই আছে।
—মশা আছে?
—বাঁধের ধার… সাপ আসতে পারে….
আসেনি অবশ্য, এলেও তো কিছু করার নেই।
—হ্যাঁ … গুড নাইট।
—গুড নাইট।
জলধর বলল, কাল আমরা শুটিং দেখব দাদা। গ্রাম থেকে সব আসবে। আমি বলে দিয়েছি।
—মস্ত কাজ করেছ। শুয়ে পড়ো।
—বুড়ি মেমটা এই কাগজ দিল।
”মালার জন্য :—সকাল ছ’টায় পাতিলেবু, গরমজল, মধু। সাড়ে সাতটায় টোস্ট…কমলার রস…”
—দেখা যাবে।
এত রাতে সুদেব স্নান করে। বাড়িতেও খবর চলে যাবে। এসব খবর বাতাসে ছড়ায়। মাদুলি, বউদি, টিয়া, আসতে চাইবে। না, এরকম পার্টি যদি ঘন ঘন জোটায় দেবরূপ, সুদেব তা সামলাতে অক্ষম।
সুদেব শুয়ে পড়ে।