Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কৃষ্ণভামিনী || Sukanta Gangopadhyay

কৃষ্ণভামিনী || Sukanta Gangopadhyay

পুরো শরীর ঘুমিয়ে আছে। জেগে আছে শুধু কান দুটো। অদৃশ্য এই অপারেশনটার জন্য অনেক কসরত করতে হয়েছে উপলকে। দুপুরের মেনু ছিল মুড়ির সাইজের ভাত, হড়হড়ে ডাল, আলুপোস্ত আর লাবড়া। কীর্তন আসরের উলটোদিকে মাঠের ওপর খেতে বসেছিল ভক্ত গ্রামবাসীর দল। মাথার ওপর ছায়ার সান্ত্বনার মতো পাতলা জিনপলের চাঁদোয়া। উপল ওখানেই বসতে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে দেখে, শশব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এসেছিল শশাঙ্কর বাবা-মা, এ কী বাবা, তুমি এখানে বসে খেতে যাবে কেন? তুমি আমাদের বিশেষ অতিথি। তোমার ব্যবস্থা ভেতর বাড়িতে হয়েছে।

না না, এখানেই ঠিক আছে। আমার কোনও অসুবিধে হবে না। বলে ধপাস করে পঙ্ক্তিতে বসে পড়েছিল উপল। কাকা-কাকিমার চোখে অসহায় অপ্রস্তুত দৃষ্টি। সেই সময় শশাঙ্ক কোথা থেকে এসে যেন উপস্থিত। বলে, ছেড়ে দাও, মা। ওখানেই বসে খাক। গ্রাম দেখতে এসেছে যখন… বাকিটা আর শোনা যায়নি। অষ্টপ্রহর নামসংকীর্তনের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল শশাঙ্কর ব্যঙ্গোক্তি। সকালে এখানে পৌঁছোনোর পর থেকে শশাঙ্কর অনেক কথাই ওই কীর্তনের মধ্যে সেঁদিয়ে যাচ্ছে। অথচ ওদের গ্রাম দেখাতেই নিয়ে এসেছিল। ও কি জানত না, এই মচ্ছবে মানে মহোৎসবের হইহল্লায় গ্রাম দেখাও হয় না, শোনা তো নয়ই। কানের পরদায় অহরহ আছড়ে পড়ছে কৃষ্ণনাম। উপল পড়েছে মহা জ্বালায়। কলকাতা থেকে একসঙ্গে বাসে রামনগর, তারপর ভ্যানরিকশায় পাঁচ কিলোমিটার মাধবপুর। ভিটেতে পা রাখার পর সেই যে শশাঙ্ক লুঙ্গি আর গামছা গায়ে দিয়ে পাড়া বেড়াচ্ছে, টিকি খুঁজে পাওয়া ভার। যদি বা কখনও দৃষ্টিপথে আসে, দেখা যাচ্ছে, মাথার চুলে পিঠে জমা করেছে আরও ছোট ছোট পাতা, খড়। কলকাতায় শশাঙ্ককে দেখলে আন্দাজই করা যাবে না, ব্যাটা দেশে এসে এরকম মেঠো হয়ে যেতে পারে!

গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করার পর দুই বন্ধু সদ্য একটা অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে ঢুকেছে। চাকরির উপলক্ষে এই মহোৎসব। কলকাতার মেসে থাকা শশাঙ্ক মাসে এক-দুবার দেশে আসে। উপল বহুবার বলেছে, তোদের গ্রামে নিয়ে চল। এই প্রথমবার নিয়ে এল। বলল, চ বাড়িতে পুজো আছে, তোর ভালই লাগবে। পুজো মানে যে মানুষ সমান দুটো সাউন্ড বক্স দিয়ে কালা করে দেওয়ার ব্যবস্থা, জানত না উপল। খাওয়া শেষ হতে পড়েছিল আর এক বিপত্তিতে। ব্যাচের লোকেরা আবার করে ভাত ডাল নিচ্ছে। কখন যে এদের খাওয়া শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে উঠে যাওয়াটা শোভন নয়, কী করবে ভাবতে ভাবতেই উপল লক্ষ করেছিল, তার উপস্থিতি কেউ গ্রাহ্যই করছে না। যে

যার নিজের মতো হাপুসহুপুস করে খেয়ে যাচ্ছে। কোনও বাচ্চা হয়তো দুটো ব্যাচ আগে খেয়েছিল, সারিতে বসে থাকা বাবা তাকে হাতের কাছে পেয়ে আরও দু’গ্রাস খাইয়ে দিল। আসলে পিছিয়ে দিল খিদেকে। ধীরে ধীরে পক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে যেতেই উঠে পড়েছিল উপল।

হাত-মুখ ধুয়ে মাঠের রোদে এসে দাঁড়াতে ঝাঁপিয়ে ঘুম এল। এত আওয়াজে ঘুম হবে না জেনেও, পায়ে পায়ে নির্দিষ্ট ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়েছিল উপল। জেনারেটরে চলা ভাড়ার স্ট্যান্ড ফ্যানটা চালিয়ে দিয়েছিল কেউ একজন। এ গ্রামে এখনও লাইট আসেনি। তারপর থেকে অনেকক্ষণ চেষ্টা করে নিজের কানকে না নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল উপল। এখন ধীরে ধীরে পাতলা হচ্ছে ঘুম। খাটের পাশে জানলা দিয়ে ভেসে আসা রোদপোড়া বিকেলের গন্ধ পাচ্ছে। চোখ খুলে আধশোয়া হয় উপল। জানলার বাইরে এখনও অনেক লোক বসে খাচ্ছে। কিন্তু এখানে খাচ্ছে কেন? এদিকটা তো রান্নার জায়গা। তা হলে হয়তো খাওয়ার জায়গা উপচে গিয়ে ভক্তবৃন্দ এখান অবদি এসে পড়েছে। ক’টা গ্রামের লোক খাচ্ছে শশাঙ্কদের বাড়িতে কে জানে! বাড়িটাই না খেয়ে নেয়! ভাবনার সঙ্গে মিল আছে এমন একটা দৃশ্যে আটকে যায় উপলের দৃষ্টি। প্রথমে মেয়েটার ওপরই চোখ পড়েছিল, রং জ্বলা নীল সালোয়ার কামিজ পরা, গাঁ ঘরের পক্ষে বেমানান ফরসা মেয়েটি। আনাড়ি হাতে কাটা লক্সের আড়ালে মুখ লুকিয়ে পাহাড় প্রমাণ ভাতের সামনে বসে আছে। এত ভাত খাবে কী করে মেয়েটা! ওর পাশে বসা অন্য মেয়েগুলোর পাতেও বাঁকুড়া পুরুলিয়ার টিলা।

কী রে, ঘুম হল?

শশাঙ্কর ডাকে ঘোর ভাঙে উপলের। শশাঙ্ক এখনও একই ড্রেসে। জানলার বাইরে খেতে বসা মানুষদের দেখিয়ে উপল বিস্ময়ের কণ্ঠে বলে, এখনও দুপুরের খাওয়া শেষ হয়নি!

না, সে অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। সাড়ে চারটে বাজল। ওরা পালাগানের দল। একটু আগে এসেছে। সন্ধেবেলা ওদের পালা দেখবি, দারুণ ইন্টারেস্টিং। পিয়োর ভিলেজ কালচার।

ঠোঁট উলটে খাট থেকে নেমে আসে উপল৷ ভিলেজ না ঘেঁচু। নীল সালোয়ার পরা মেয়েটাকে একবার বিউটিপার্লার ঘুরিয়ে আনলে, গড়িয়াহাটের রোমিয়োরা হোঁচট খাবে। শশাঙ্ক বলে, উঠলি কোথায়! চা খাবি তো, আসছে।

যাই, একটু পরিবেশনে হেল্প করি। এসে থেকে কোনও কাজই করিনি।

ধুর ধুর, তুই ওসব পারবি না। শহরে থাকার ফলে আমারই অভ্যেস চলে গেছে। হাতা বালতির সাইজ দেখছিস! ওসব দুলালদা, উদয়দারা পারে। ব্যাচ খাওয়ানো হয়ে গেলেই, পাশের খেতে মাল টানতে বসে যাবে। আমরাই কিনে দিয়েছি। ঘুম থেকে উঠবে কাল দুপুরে। তবু গায়ের ব্যথা মরে না।

শশাঙ্কর কথা কানে না নিয়ে খাওয়ার জায়গায় যায় উপল। উদয়দা স্নেহপরবশ হয়ে গেস্ট আর্টিস্টের হাতে বালতি হাতা তুলে দেয়। সবার পাতে ভাত দিতে দিতে নীল সালোয়ার

কামিজের সামনে এসে সম্মোহিত হয়ে পড়ে উপল। চাপা হাসি নিয়ে মেয়েটা একদৃষ্টে তার দিকে চেয়ে আছে। যেন বুঝতে পেরেছে, ওর জন্যেই পরিবেশনে নেমেছে উপল। যৌবনের বাগানে কিছুটা ঢুকে আসা মেয়েটার সিঁথিতে এখনই অনুজ্জ্বল সিঁদুর রেখা, সরু পলা হাতে। এসব দেখে উপল একেবারে ফ্রিজশট। হাতায় ভাত তুলে থমকে আছে। নীল সালোয়ার কামিজের পাশে বসা ফচকে মেয়ে বলে ওঠে, কী হল মদনমোহন, পাথর হয়ে গেলে যে! ভাত দাও।

সংবিৎ ফিরতে উপল দেখে, ওরা পাঁচ-সাতটা মেয়ে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ে হাসছে। ভাগ্যিস কীৰ্তনটা চলছে, চাপা পড়ে যাচ্ছে লাঞ্ছনার আওয়াজ। তড়িঘড়ি ওদের পাতে ভাত দিয়ে সরে আসে উপল। মনে মনে বলে, ইটস্ নট মাই কাপ অফ টি। আর আশ্চর্য, ভিয়েনের পাশে হাতে কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শশাঙ্কর মা। ইশারায় চা খেতে ডাকছে।

চালাঘর, ধুলো ওঠা রাস্তা, বড় বড় গাছের ছায়া ফেলে এসে উপল এখন আলে আলে হেঁটে যাচ্ছে। সেইমতো হলদেটে চাদর গুটিয়ে নিচ্ছেন সূর্যদেব। কখনও কখনও দমকা হাওয়ায় হরিনাম ভেসে এলেও, অসহ্য ঠেকছে না। এখানে অনেক পাখির ওড়াউড়ি। এরাও বোধহয় কীর্তনের চোটে পালিয়ে এসেছে।

দিগন্তলীন খেত, জলা জমির ওপর কালো মেঘ চলমান। হাওয়া থেমে গেলে জেগে উঠছে জমাট নৈঃশব্দ্য। ক্বচিৎ পাখির ডাকে সেই ভাবগম্ভীর নৈঃশব্দ্য ভেঙে পড়ছে ছেলেমানুষের মতো। চারপাশের কর্ষিত জমি এখন বৃষ্টির অপেক্ষায়। শশাঙ্ক বলছিল, এবার নাকি বৃষ্টিই হয়নি।

আদ্যন্ত শহুরে ছেলে হয়েও মাটি, হাওয়া, আকাশ দেখে উপলের কেন জানি মনে হয়, বৃষ্টির আর বেশি দেরি নেই।

প্রকৃতির একদম গভীরে ঢুকে এসে উপলের এখন একটাই আক্ষেপ হচ্ছে, কেন যে কাগজ রং তুলি নিয়ে এলাম না! চাকরিতে ঢুকে যাওয়ার পর থেকে আর ল্যান্ডস্কেপ করা হয়নি। অথচ একসময় ওয়াটার কালার ল্যান্ডস্কেপেই তার ঝোঁক ছিল। প্রশংসাও জুটত প্রচুর।

মনের চোখের সামনে কাগজ টাঙায় উপল। হাতে কাল্পনিক তুলি। রং তুলে নেবে এই ঘাস, মাটি, মেঘ থেকে। কিছুটা আঁকতে গিয়েই দেখে, নিসর্গের ওপর তুলির টানে ভেসে উঠছে চাপা হাসির বেহায়া চাউনির মেয়েটা। কেন চলে আসছে এই মুখ? ফাঁপানো চুলের লক্স কাটা মেয়েটা তো গ্রাম বাংলার মুখ নয়। তার ওপর সিঁদুর, পলা। শাড়ির বদলে সালোয়ার কামিজ। মেয়েটার বর কি ওদের দলেই আছে? এরকম নানান চিন্তায় উপলের অদৃশ্য ক্যানভাস এলোমেলো রেখায় ভরে যাচ্ছে। এত কৌতূহলে কি মনোনিবেশ করা যায় ! অবিনশ্বর কথক ঠাকুর সূর্যদেব সারাদিনের গল্প শুনিয়ে অনেক কৌতূহল বজায় রেখে আজকের মতো পাটে বসেছেন। কিন্তু উপলের যে অনেক কিছু জানার আছে মেয়েটার সম্বন্ধে।

দূরের কোনও মাঠ থেকে গোরুর হাম্বা ডাক ভেসে আসে। বেলা পড়তে দেখে বেভুল রাখালরাজাকে জানান দিচ্ছে। শশাঙ্কদের বাড়ির উদ্দেশে পা চালায় উপল।

হরিবাসরে ফিরতে ফিরতে সন্ধে নেমে গিয়েছিল। গান এখনও চলছে। আর একটু পরেই শুরু হবে পালাগান। রাধাকৃষ্ণের লীলা গানে, কথায় অভিনীত হবে। তাই হয়তো আগের কীর্তনীয়াদের উৎসাহে ভাটার টান। বেখেয়ালে যদি বা তারা গান থামায়, হারমোনিয়াম থাকছে সচল। অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তনে এমনটাই নিয়ম। থামা চলবে না।

শশাঙ্কদের এই বাড়িটা নতুন, পাড়ার একমাত্র ঢালাই ছাদের বাড়ি। লাগোয়া মাঠ পেরোলেই সাবেক বাড়ি। ঘুরে এসেছে উপল। খড়ের চাল, মাটির দাওয়া, গাছপালা নিয়ে প্রকৃতই গ্রামের বাড়ি। ওখানেই থাকতে চেয়েছিল উপল, খাতির যত্নে ত্রুটি থেকে যাবে বলে হোস্ট রাজি হয়নি। অগত্যা এই হইহট্টগোলের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। এ বাড়ির সিমেন্টের বারান্দা ঘিরে রঙিন কাপড়, কাগজ দিয়ে তৈরি হয়েছে দেবতার মঞ্চ। সেখানে উদ্বাহু কাঠের গৌরাঙ্গ, রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি, আর ওদের কুলগুরুর ফটো। সব ফুলে ফুলে সাজানো। গৌরাঙ্গ মূর্তিটি মোবাইল। যখন যে পরিবার মচ্ছব দেয়, ঠাকুর পৌঁছে যায় সেখানে। হরিমঞ্চের সামনে শামিয়ানার নীচে ভিড় ক্রমশ বাড়ছে। ভক্তবৃন্দের মাঝে বৃত্তাকারে খোলা জায়গা। ওখানেই হবে পালাগান। জেনারেটরের দমে জ্বলা পাঁচ-ছ’টা টিউব অত মানুষের মুখে আলো ফেলতে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।

উপল বসে আছে দয়ালকৃষ্ণ কীর্তন গোষ্ঠীর মাস্টারের পাশে। নাম শ্রীধর দাস। গলায় কণ্ঠি। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আলাপ করিয়ে দিয়েছে শশাঙ্ক। তবে উপলের ইনট্রোডাকশান দিতে গিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, এই যে শ্রীধরবাবু, এ হচ্ছে আমার বন্ধু উপল। কলকাতায় থাকে। টিভিতে কাজ করে। অনেক সোর্স। এতটা না বললেও পারত। নিজে গ্রামের ছেলে হয়ে দেশগাঁয়ের মানুষকে ঠকাচ্ছে। ফলে হয়েছে মুশকিল, শ্রীধর দাস কিছুতেই কাছ ছাড়া করছে না উপলকে। উঠে যেতে চাইলেও, হাত ধরে বসিয়ে দিচ্ছে, বসুন না। অনেক কিছু দেখার আছে, জানার আছে। এতক্ষণ পর্যন্ত যা জানা গেছে, গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীঅমলকুমার বেরা। দলটা এখান থেকে পনেরো মাইল দূরে পানিপারুল গ্রামের। এই বর্ষাকালটায় বায়না হতে চায় না। প্রায় একমাস পর আজকের বায়না হয়েছে। এক সন্ধের জন্য আটশো টাকা। এত ক’টা পেট। ভক্তদের দানের ওপরই নির্ভর করতে হয় অনেকটা। এভাবে চলতে থাকলে এই লোকসংস্কৃতি ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। বলতে বলতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে নিজেকে উদ্দীপ্ত করে নিচ্ছেন শ্রীধর দাস। তাঁকে ঘিরে বসে আছে দোহারের দল। তারপর সার দিয়ে বসে বাঁশি, বেহালা, খোল এমনকী ক্যাসিয়ো বাজিয়ে। সবার সঙ্গেই অল্প আলাপ, অতি বিনয়ের নমস্কার বিনিময় হল। শ্রীধরবাবু এবার ডাক পাঠালেন নীলিমাকে। বললেন, মেয়েটাকে দেখুন। রাধারানির পাট করবে। যেমন অভিনয়, তেমনি দেখতে! সুযোগ পেলে… কথার মাঝেই এসে পড়ে রাধা। পরনে শস্তা ছিটের ম্যাক্সি, তবে মুখের মেকআপ কমপ্লিট।

বিকেলের নীল সালোয়ার কামিজকে এই বেশে দেখে যতটা না অবাক হয়েছে উপল,

তার থেকে বেশি বিস্মিত হয়েছে পূর্ণ চাঁদের মতো উদ্ভাসিত মুখ দেখে। পেন্ট করা মুখে বেহায়া দৃষ্টিটা এখন আরও ধারালো।

আলাপ পর্ব সারা হতে, ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে চলে গেল নিলীমা। মেয়েটা যে কেন এভাবে তাকে টার্গেট করেছে, বুঝতে পারে না উপল। হয়তো স্বভাবটাই এরকম। শ্রীধর দাস বলে চলেছেন, সবই আমার কপাল বুঝলেন। মাস আষ্টেক মেয়েটার বিয়ে হয়েছে, ভেবেছিলাম গেল বুঝি দলের সেরা আর্টিস্ট। ওকে দেখেই তো প্যালা পড়ে বেশি। রাধারানির অভিনয়ে মজিয়ে রাখে ভক্তের মন। শ্বশুরবাড়িতে কী হল কে জানে, দু’মাসের মধ্যে মেয়েটা ফিরে এল। এমনও হতে পারে অভিনয়টা ওর রক্তে মিশে গেছে।

উপল বুঝতে পারে না, এতে কার সুবিধে হয়েছে, শ্রীধর দাস না নীলিমার? দেখতে দেখতে সমোল্লাস হরিধ্বনি সহকারে শুরু হল আজকের পালা, পারের কাণ্ডারী।

প্রথমটায় মনোনিবেশ করতে অসুবিধে হচ্ছিল উপলের। কেমন যেন অচেনা বাংলায় কাহিনি গ্রন্থনা করছিলেন শ্রীধর দাস, মসীকৃষ্ণ রাত্রি তার অবগুণ্ঠন উন্মোচিত করেছে। ঊষাকাল আসন্ন। অভিসার কুঞ্জে নিদ্রাতুর রাধা-কৃষ্ণ। দীর্ঘরাত শৃঙ্গার রসে অতিবাহিত করে, উভয়ে সুখতৃপ্ত এবং ক্লান্ত… শুরু হল কীর্তন, নিশি অবশেষে কোকিল কুহরই/ জাগিল রসবতি রাই…

গান শেষ হলে গেঁয়ো বাংলায় শুরু হয় নাটক। কৃষ্ণের ডায়লগ, প্রিয়ে আমার বাঁশি দাও। রাধা, তোমার বাঁশির খবর আমি কী জানি। কোথায় কোন মেয়ের দলে ফেলে এয়েচো, দ্যাকো গিয়ে।

হাসি পেয়ে যাচ্ছিল উপলের। তবে এই হাসি তাচ্ছিল্যের নয়। অদ্ভুত এক ভাল লাগার। পৌরাণিক গল্পের মধ্যে মেঠো মানুষজন কেমন অনায়াসে উঠে আসছে তাদের নিজস্ব স্বভাব, আচরণ নিয়ে! এ এক আশ্চর্য সংমিশ্রণ। অজানা আবহ। কম দামি, মোটা দাগের মেকআপে চরিত্ররা আসছে, বড়াই মা, ইনি রাধার পক্ষে। এই চরিত্রে ছেলে, মেয়ে সেজেছে। কমিক রোল। তার কথায়, জেসচারে হেসে গড়িয়ে পড়ছে দর্শক। আসছে রাধার শাশুড়ি-ননদ, জটিলা কুটিলা। কৃষ্ণের মা, যশোদা। ভাই বলরাম, আর আছে রাধার অষ্ট সখী, ললিতা, বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, সুদেবিকা… আরও কী কী সব নাম যেন। এরাই সেই ফচকে মেয়ের দল, পরিবেশন করতে গেলে উপলকে যারা আওয়াজ দিয়েছিল। কৃষ্ণরাধার গল্পটা উপলের ভালভাবে জানা নেই। ক্রমশ কাহিনিটার মধ্যে ঢুকে পড়ছে উপল। অনেকে বলে রাধার চরিত্রটা কাল্পনিক। মহাকাব্যে এর উল্লেখ নেই। বাংলার লোকগাথায় রাধার জন্ম। এসব নিয়ে আগে কখনও ভাবেনি উপল। আপাতত এটা বুঝতে পারছে, যাঁরা বা যিনি রাধার চরিত্রটি কল্পনা করেছিলেন, তিনি অসম্ভব আধুনিক। যেমন শ্রীধর বলছেন, শ্রীমতির বড় সাধ হইল, নন্দপুরে গিয়ে দেখে কী করছে কৃষ্ণ। নিজে যাওয়া শোভা পায় না। একে তো রাজার ঝিয়ারি। তদুপরি আয়ান ঘরনি সে। সখীদের বারংবার প্রশ্ন করে, বল না তোরা আমায়, কৃষ্ণ আমার সেখানে কী করছে?

পুরো অনুষ্ঠানটা বেশ উপভোগ করছে উপল। এতক্ষণে মনে হচ্ছে মাধবপুরে এই সময়ই আসা ঠিক হয়েছে, নইলে এই গ্রামীণ সংস্কৃতি, শিল্পীরা তার কাছে অজানা থেকে

যেত। আর্টিস্টদের জামায়, শাড়িতে প্যালার টাকা সেফটিপিন দিয়ে সাঁটা হচ্ছে। পালাগান জমে উঠেছে খুব। শুধু একটাই অস্বস্তি, রাধারানি বেশিনী নীলিমা বেশিরভাগ ডায়লগ থ্রো করছে উপলের দিকে তাকিয়ে। কেউ কিছু বুঝে না ফেলে। রাধা এখন গুরুজনদের বলছে, তোমাদের শাসন, উপদেশ আমি গেরাহ্যি করি না। কৃষ্ণপ্রেমে আমার দেহ মন মাতাল হয়েচে। কুলধর্ম চুলোয় যাক খেতি নেই, তবু কৃষ্ণপ্রেমে সাঁতার দিতে আমি প্রস্তুত। কৃষ্ণ অঙ্গ ছুঁয়ে আসা সুগন্ধি বাতাস আমার অঙ্গে লেগেচে… আবেশে এলিয়ে যাওয়া হাত নীলিমা বাড়িয়ে ধরেছে উপলের দিকে। অষ্ট সখী হেসে কুটোপুটি। লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয় উপল।

শ্রীধর দাস আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে পাঠ করে চলেছেন, যমুনা তীরে অর্ধশায়িতা শ্রীমতী। ধুলায় গড়াচ্ছে হাতের কঙ্কন। ছিঁড়ে ফেলেছেন কণ্ঠের হার, কটিদেশের কিঙ্কিণী। কাজলগলা বিরহাশ্রু তাঁর স্তনতটে পড়ে তাদেরকে কৃষ্ণময় করেছে… এইটুকু শুনেই চমকে ওঠে উপল। ত্রস্ত চোখে বাকি শ্রোতাদের দিকে তাকায়, তাদের রিঅ্যাকশান কী? আশ্চর্য, সবাই কেমন বিভোর হয়ে পালা শুনছে, এই যৌনগন্ধি বর্ণনা কি তাদের মর্মে পৌঁছোচ্ছে না! না কি সবই ভক্তিরসে জারিত হয়ে যাচ্ছে! কেমিস্ট্রিটা ঠিক ধরতে পারে না উপল। তার সেইভাবে ঈশ্বর বিশ্বাস নেই, ফলে গোটা বর্ণনাটাই তার চেতনাকে কামনায় উন্মুখ করছে।

শ্রীধরবাবু বলছেন, মদন-বিলাস-লীলায় উভয়েই ক্লান্ত। রাধার কোলে কৃষ্ণর তন্দ্রাচ্ছন্ন মাথা। হাতের বংশী খসে পড়েছে। এই সেই বেণু…

আর বসে থাকতে পারে না উপল। কান মাথা ঝিমঝিম করছে। উঠে আসে শামিয়ানার বাইরে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। সামনের মাঠে চাঁদোয়ার নীচে বসেছে রাতের খাওয়ার ব্যাচ।

শশাঙ্ক হেঁটে আসে রাস্তা পেরিয়ে, কী রে, কেমন লাগছে?

ভালই।

খেয়ে নিবি নাকি?

নিলেই হয়।

সেই ভাল। বলে খাওয়ার জায়গার দিকে হেঁটে যায় শশাঙ্ক। পাশে হাঁটতে থাকা উপলকে বলে, এই ব্যাচটা হয়ে গেলেই বসে যাবি। এরপর কবির লড়াই। শুনবি তো?

নাঃ, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে। একটু শুতে পারলে ভাল হত।

শুয়ে পড়। এখন তো সব ঘরই ফাঁকা। অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া অবধি কেউ শুতে যাবে না।

আমি ভাবছি তোদের পুরনো বাড়িতে শুতে যাব। এই চেঁচামেচিতে আর ভাল লাগছে না।

ঠিক আছে, তাই নয় শুবি। কিন্তু সাবধান, ওখানে সিগারেট খেলে, খুব কশাস হয়ে খাবি। চারদিকে খড়, বিচালি, ধানগোলা।

‘পারের কাণ্ডারী’ শেষ হল। ভক্তবৃন্দের শোরগোল। উপল পেছন ফেরে। দর্শকরা উঠে আসছে। সাময়িক বিরতি। খেয়েদেয়ে এসে আবার বসবে কবির লড়াই দেখতে। মা, মাসি,

ছেলে, বুড়ো সবার মুখেই অফুরন্ত উদ্দীপনা। রাত্রি জাগরণের কোনও ছাপই নেই। রাত জেগে ফাংশন দেখার অভ্যেস আছে উপলের। কিন্তু আজকের এই পালাগান তাকে কেমন যেন আচ্ছন্ন করেছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে রাধা বেশিনী নীলিমার মুখ। কী প্রকট আবেদন! কোথাকার কোন গণ্ডগ্রামের মেয়ে, রাধারানির পাট পেয়ে নিজেকে দীপ্তিমতী করে তুলেছে। উপলের অবস্থা এখন শ্রীধর দাসের বর্ণনার মতো, পঞ্চশরে জর্জরিত। নিজেকে নিয়ে বড় অস্বস্তিতে পড়েছে উপল। পাছে কোনও অসংলগ্ন আচরণ করে বসে, তাই একটু আলাদা থাকতে চাইছে।

খাওয়া দাওয়া সেরে উপল এখন শশাঙ্কদের পুরনো বাড়ির মাটির দাওয়ায়। জায়গাটা ওর চাহিদা মতোই শান্ত, নিরিবিলি। ঘরের চাবি আর টর্চ দিয়েছে শশাঙ্ক। তালা খুলে শুয়ে পড়লেই হয়। তবু কেন জানি দোটানায় আছে উপল। একবার ভাবছে ফিরে যায় অনুষ্ঠান দেখতে। হয়তো শেষবার দেখা হবে নীলিমার সঙ্গে। নাকি ওরা এখনই তলপি তলপা গুটিয়ে রওনা দিয়েছে? পরক্ষণেই নিজেকে সামলায়, দু’জনের শ্রেণি অবস্থানের বিস্তর ফারাক, কী হবে আলাপ করে! গেঁয়ো আচরণ, বোকা বোকা কথায়, মেয়েটাকে খানিক পরেই পানসে লাগতে পারে। এমনিতেই উপল ভীষণ চুজি। আজ পর্যন্ত প্রেমিকা জোটেনি। কোন মন্ত্রবলে আজ শ্রেণিভেদ মুছে যাচ্ছে! এ কি আদি কৃষ্টির অমোঘ আকর্ষণ, গ্রামীণ সরল পরিবেশের প্রভাব, না কি মেয়েটার মধ্যেই এমন কিছু একটা আছে, যা এড়ানো কঠিন!

এ বাড়ির উঠোনে নিষ্পত্র সজনে গাছ, ধানের গোলা। তাদের মাথার ওপর পূর্ণ চাঁদ। তাকে ঘিরে দূর শোভা। অর্থাৎ নিকট জল। উপল কার থেকে যেন জেনেছিল এসব!

রাংচিতে বেড়ার ধারে উড়ে বেড়ানো জোনাকিরা চাঁদের আলোয় বড় ম্রিয়মাণ। ভিটে ঘিরে ঝিঁঝির কোরাস। গাছপালা, মাটির গন্ধ রাতের বেলায় কেমন যেন অন্যরকম। দূরে শেষ প্রহরের শেয়াল ডেকে উঠল। মাইকে কবির লড়াই ভেসে আসছে। দাওয়া থেকে উঠে দরজার তালা খোলে উপল। ঘরে আসতেই চমকে ওঠে। জানলা গলে যে ধবধবে আলোটা মেঝেয় পড়েছে, প্রথম দেখায় তাকে নীলিমা বলে ভ্রম হয়েছিল। যেন অনেক আগেই ঘরে এসে লুকিয়ে আছে।

আপনমনে হেসে নিজেকে ধাতস্থ করে উপল। তারপর শশাঙ্কর নির্দেশ মতো টেবিলের কাছে যায়। সেখানে হারিকেন দেশলাই। বিছানার মাথার কাছে মশারি। আলো জ্বালিয়ে মশারি খাটাতে যাচ্ছে উপল, উঠোন থেকে ভেসে আসে একদল মেয়ের কলকল শব্দ। আওয়াজটা দরজার চৌকাঠে এসে থেমে যায়। পেছন ফিরে উপল দেখে বিভ্রম নয়, সত্যিই নীলিমা সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের চোখেমুখে অক্লান্ত কৌতুক।

কিছুটা আশঙ্কায় উপল বলে, তোমরা এখানে!

আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। এখনই শুয়ে পড়বেন নাকি! এটা বলল নীলিমার এক সখী। পারমিশনের তোয়াক্কা না করে গোটা দলটা ঢুকে এল ঘরে। মধ্যমণি অবশ্যই নীলিমা। পরনে আগের সালোয়ার কামিজ। দৃষ্টি যথারীতি উপলের ওপরেই নিবদ্ধ। দেরিতে হলেও তখনই উপল আবিষ্কার করে, মেয়েটার চোখ দুটো অসম্ভব ভাল।

পাশ থেকে একটা মেয়ে বলে উঠল, আমাদের পালা কেমন লাগল, বললেন না তো!

ভাল। খুব ভাল। যথেষ্ট আন্তরিকভাবে বলে উপল। সখীদের দু’জন খাটে গিয়ে বসেছে। ওদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, ভালই যখন, আমাদের কলকাতায় ডাকেন না কেন? বলরামদার দল কলকাতার কত ফাংশানে বায়না পায়। আমরাই শুধু মরা সিজিনে বসে থাকি।

উপলের বুঝতে অসুবিধে হয় না, শশাঙ্কর তথ্য অনুযায়ী এরা ধরে বসে আছে, তার অনেক সোর্স। তাই বোধহয় এদের মনোযোগের লক্ষ্যবস্তু সে। একটু যেন মুষড়ে পড়ে উপল। নীলিমাও খাটে গিয়ে বসেছে। এই ঘরটা যেন এদের কতদিনের চেনা।

আর একটি মেয়ে স্বগতোক্তির ঢঙে বলে, যাই বলুন, আমাদের রাধারানি কিন্তু মেদিনীপুর জেলার সেরা। দেখলেন তো নিজের চোখে।

কথাটা শুনে নীলিমার থেকে উপলই যেন লজ্জা পেল বেশি। সামান্য নীরবতার সুযোগে মেয়েগুলো হঠাৎ উঠে দাঁড়াল, নিন, আপনারা দুটিতে গল্প করুন, আমরা যাই। উপল বাধা দেওয়ার আগেই মেয়েগুলো খিলখিল করতে করতে ধাঁ। নীলিমার দিকে তাকাতে দেখে, মিটিমিটি হাসছে। এ যেন রাধাকে অভিসার কুঞ্জে রেখে চলে গেল সখীর দল। ঘরের গাঢ় নির্জনতা ক্রমশ ভয় পাইয়ে দেয় উপলকে। নার্ভাস গলায় নীলিমাকে বলে, তুমি রয়ে গেলে! লোকে জানলে খারাপ বলবে।

গাঢ় কণ্ঠে নীলিমা বলে, কেউ জানবে না। রাধারানি আর কৃষ্ণের বাড়ি তো কাছেপিঠেই ছিল। কই, তাদের অভিসারের কথা তো কেউ জানতে পারত না।

প্রায় সরাসরি প্রস্তাবে রীতিমতো ঘাম হতে শুরু করে উপলের। অভিসার শব্দের অভিঘাত কী নীলিমা বোঝে না! তা হলে কেন ওরকম গল্প বলার কায়দায় বলে যাচ্ছে, যোগমায়ার মায়ার আচ্ছাদনে ওদের অভিসার সবসময় গোপন থাকত।

যোগমায়া কে? মুখ থেকে প্রশ্নটা আপনা-আপনি বেরিয়ে যায় উপলের। যোগমায়া হচ্ছেন দুর্গা। কাত্যায়নী। রাধামাধব তো আসলে ঈশ্বরের অংশ। একবার কী হয়েছিল…

গল্পটাকে আর বাড়তে না দিয়ে উপল ঠিক করে নীলিমার ভুলটা শুধরে দেওয়া ভাল। তাই সে বলে, তোমাকে একটা কথা বলি, আমি কিন্তু টিভি-তে চাকরি করি না।

আচমকা এ ধরনের কথায় বেশ অবাক হয় নীলিমা। নিজের মতো মানে করে নিয়ে বলে, সে আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। টিভি, কাগজের লোকেদের কাছে ক্যামেরাট্যামেরা, কাগজ, পেন থাকে। আপনার কাছে কিচ্ছু নেই। খালি ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে চেয়েছিলেন। কেন বলুন তো?

উপল ভাবে, দিব্যি নিজের দোষটা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে মেয়েটাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাস্তবে নামিয়ে আনতে হবে। নইলে যে-কোনও মুহূর্তে বিপজ্জনক সীমা পার করে ফেলতে পারে।

নীলিমা বলে, কী হল, আপনি মেঝেতেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি? আমিই আপনার খাটে শোব!

পায়ে পায়ে বিছানায় গিয়ে বসে উপল। বলে, তোমার বর কোথায় নীলিমা? শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ কেন?

প্রত্যাশামতো কোনও গাঢ় ছায়া নেমে আসে না নীলিমার মুখে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই সে বলে, আমার আয়ান ঘোষ সাধক মানুষ। এই দলেই বেহালা বাজাত। মধ্যে রাগারাগি করে চলে গেল বলরামদার দলে। ওদের বায়না বেশি। নাম বেশি। আমাকেও নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে রাধার পার্ট পেতাম না। দোহারকি করতে হত। ভাল লাগত না। চলে এলাম।

কথাবার্তা সহজ হয়ে আসছে দেখে, উপল নেহাত কৌতূহলবশে জিজ্ঞেস করে, তুমি কেন আমার দিকে টানা তাকিয়ে থাকছিলে? এতক্ষণে সামান্য সংকোচ জমা হয় নীলিমার আচরণে। লাজুক গলায় বলে, অ্যাক্টিং করতে সুবিধে হচ্ছিল।

মানে! উপলের চোখে বিস্ময় মেশানো কৌতূহল।

মাথা নামিয়ে নীলিমা বলে, আপনাকে অনেকটা মাধবের মতোই দেখতে। কথাটা আর একবার অথবা স্পষ্ট করে শোনার আগ্রহেই বুঝি নীলিমার আনত মুখ তুলে ধরে উপল৷ আয়ত চোখ দুটোয় অনন্ত ল্যান্ডস্কেপ।

মেঝেতে পড়ে থাকা চাঁদের আলোর উত্তাপ ক্রমশ বাড়ে। একসময় নীলিমার তলপেটের মতোই উষ্ণ হয়ে যায়। এভাবে কতক্ষণ কাটে কে জানে! মনে পড়ে শশাঙ্কর সতর্কবাণী, খড় বিচালির ঘরে সিগারেট ধরাস না। কিন্তু দেরি হয়ে গেছে।

ভিটে লাগোয়া রাস্তায় হঠাৎ কার যেন ডাক শোনা যায়, নীলিমা, ও নীলিমা! কোথায় গেলি ! নীলিমা রে…

শ্রীধর দাসের গলা। ঘোর ভাঙে উপলের নিজেকে আবিষ্কার করে নীলিমার আসঙ্গলিপ্সায়। তড়িঘড়ি মায়াজাল কেটে উঠে বসে উপল। বলে, তোমাকে খুঁজছে। নীলিমা নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে বলে, লোকটা আর সময় পেল না! তারপর উপলের দিকে ঘুরে বলে, কাল সকালে চলে যাচ্ছি।

কম আলোয় নীলিমার মুখটা পড়তে পারে না উপল। কী লেগে আছে সেখানে, বিষাদ নাকি শিকারির অতৃপ্তি!

প্রগাঢ় ক্লান্তিতে বিছানায় এলিয়ে যেতে যেতে উপল দেখে, মেঝেয় পড়ে থাকা চাঁদের আলোটা কখন যেন অন্তর্হিত হয়েছে।

ঠেলা দিয়ে ঘুম ভাঙাল শশাঙ্ক, উপল! এই উপল! ওঠ তাড়াতাড়ি।

চোখ কচলে উপল একসঙ্গে দুটো জিনিস লক্ষ করে, এখনও তেমন আলো ফোটেনি বাইরে, শশাঙ্কর মুখে কীসের যেন উৎকণ্ঠা !

কী হয়েছে রে? বলে উঠে বসে উপল। চাপা উত্তেজিত গলায় শশাঙ্ক বলে, তোর ঘরে রাতে পালা দলের একটা মেয়ে ছিল? উত্তর দেওয়ার আগেই শশাঙ্ক আবার বলে, তুই যে ব্যাটা এত ওস্তাদ হয়েছিস, জানতাম না। যাই হোক, ব্যাপার গুরুতর। মেয়েটাকে তোর ঘর থেকে বেরোনোর সময় শ্রীধর দাস হাতেনাতে ধরেছে। এই নিয়ে বহুত গজলা চলছে ভোররাত থেকে। বুঝতেই তো পারছিস, গাঁ-ঘরের ক্যাচাল। সকাল হলেই ব্যাপারটা পঞ্চায়েত অবধি চলে যাবে।

ঘটনার আকস্মিকতায় উপল হতভম্ব। কী একটা ভেবে নিয়ে শশাঙ্ক বলে, একটা কাজ করা যাক। তোর কাছে কিছু টাকা আছে? শ্রীধরকে খাইয়ে দিই। ব্যাটা শিয়োর চেপে যাবে।

উপলের মাথা এখন কাজ করছে না। হাতের কাছে সহজ অঙ্কটা পেয়ে আঁকড়ে ধরে। তাড়াতাড়ি পার্স বার করে, পাঁচ-ছ’শো টাকা শশাঙ্কর হাতে তুলে দেয়।

শশাঙ্ক বলে, এতেও যদি কেসটা না সালটায়, আমি কিছু দিয়ে দেব। ফেরার ভাড়া রেখেছিস তো?

ঘাড় হেলায় উপল। নিশ্চিন্ত হয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে শশাঙ্ক আবার ঘুরে দাঁড়ায়। বলে, ঘর থেকে বেরোস না। ভ্যানরিকশায় তোর লাগেজ চাপিয়ে এ বাড়ির দোরগোড়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছি। রিকশাওলা ঘুরপথে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেবে। তোর এখন গ্রামে থাকা সেফ নয়।

সব তড়িৎ পায়ে বেরিয়ে গেল শশাঙ্ক। যেন উপলের বুদ্ধি, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা, কিছু নিয়েই চলে গেল। উপল এখন পালিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।

মেঘলা বলেই দেরি হচ্ছে সকাল হতে। শশাঙ্কদের পাড়া ছেড়ে ভ্যানরিকশা এখন জনহীন রাস্তায় এসে পড়েছে। একটু যেন হাঁফ ছাড়ে উপল। মাটির রাস্তার একপাশে খেতজমি। অন্যপাশে ইতস্তত গাছপালা। মাথার ওপর আকাশটাও এখানে অনেক পরিষ্কার। উপল পেছনের ঘটনা ভাবতে থাকে। এত উদ্বেগ,অস্বস্তিজনক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেও উপল

লক্ষ করে, মনের কোণে রঙিন পালকের মতো পড়ে আছে রাতের সেই মিষ্টি মুহূর্ত। এমন সময় রাস্তার পাশে গাছপালার আড়াল থেকে বেশ ক’টা মেয়ে সমস্বরে ডেকে ওঠে, এই যে, দাঁড়ান, দাঁড়ান।

ঘাবড়ে গিয়ে রিকশাওলা ব্রেক কষে। ঘাড় ফিরিয়ে উপল দেখে, পালাগানের সেই মেয়েগুলো। খানিক তফাতে দাঁড়িয়ে পড়েছে ওরা। হাঁফাচ্ছে। সঙ্গে নীলিমাও আছে। হয়তো ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে রিকশা লক্ষ্য করে ছুটে আসছিল এতক্ষণ।

রিকশা থেকে নেমে উপল ওদের সামনে যায়। মেয়েগুলোর মুখ থেকে আগের সেই হাসিখুশি ভাব উধাও। কেউ কিছু বলছেও না। সবার অভিব্যক্তিতে চাপা রাগ, নাকি অভিমান! বুঝে ওঠার আগেই একটি মেয়ে বলে ওঠে, আপনি মাস্টারকে টাকা দিয়েছেন?

স্বীকার করা ঠিক হবে কি না, বুঝতে পারে না উপল। সেই ফাঁকে আর একটা মেয়ে বিষাদমাখা রাগে বলে ওঠে, মাস্টার একবার যখন বিনে মাগনায় অত টাকার সোয়াদ পেয়েছে, আমাদের দিয়ে এবার থেকে এসবও করাবে।

সদ্য বাজ পড়া বোবা গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকে উপল। এদিকটা সে ভেবেই দেখেনি। করুণা ভিক্ষার দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে একবার তাকায় উপল। অভিমান নয়, নীলিমার চোখে এখন শুধুই আক্রোশ। আর একটি মেয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, কী হল, উত্তর দিন। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন যে বড়! কী যেন একটা জড়িয়ে মড়িয়ে বলতে যাচ্ছিল উপল। প্রবল ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নেয় নীলিমা। সঙ্গীদের বলে, চ, ছেড়ে দে। আমারই ভুল হয়েছে।

খালি পা ধুলোয় দাপিয়ে বিশাখা, তুঙ্গবিদ্যা, মাধবিকা, ইন্দুলেখারা তাদের রাধারানিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে গাছপালার আড়ালে। ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে উপল৷ রিকশাওলা ডাকে, বাবু, তাড়াতাড়ি চলে আসুন। সুপারটা মিস করবেন।

শ্লথ পদক্ষেপে রিকশায় গিয়ে বসে উপল। রিকশাওলা বলে, এসব মেয়েদের সঙ্গে মুখ লাগাতে যাবেন না। খুব ডেঞ্জারাস! আপনারা শহরের লোক, ওদের সঙ্গে পারবেন কেন… প্যাডেল মারতে মারতে আরও কী সব বলে চলেছে রিকশাওলা। উপল আর একবার পেছন ফেরে, পিছিয়ে যাওয়া আবছা গ্রামরেখার মাথায় ঘন কালো মেঘ। বৃষ্টি হয়তো শুরু হয়ে গেছে ওখানে। ভাগ্যিস। ধুয়ে যাচ্ছে ভালবাসার স্বরূপ বুঝতে অক্ষম শহুরে সভ্যতার পায়ের ছাপ। পৌরাণিক চরিত্ররা অমর হতে ফিরে গেছে বৃষ্টিঘেরা গ্রামবাংলায়।

সানন্দা পুষ্পাঞ্জলি, ২০০৩

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *