Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কান্দাই রহস্য || Romena Afaz

কান্দাই রহস্য || Romena Afaz

কান্দাই পুলিশ অফিস।

পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ, মিঃ ইয়াসিন, মিঃ হারুন, মিঃ হুসাইন এবং মোদনমোহন বার এর মালিক মোদন, তার সহকারী বোমসিং বসে আলোচনা চলছিলো।

সেদিন মোদনমোহন বার-এ দস্যু বনহুরের অকস্মাৎ আবির্ভাব এবং মূল্যবান মতিচুর মালা আর লাখ টাকা হরণ ব্যাপার নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিলো।

সকলের মুখেই একটা গভীর দুঃশ্চিন্তার ছাপ বিদ্যমান।

মিঃ আরিফ, পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিনকে লক্ষ্য করে বললেন– দস্যু বনহুর সম্বন্ধে কান্দাই পুলিশ রিপোর্টে যতদূর জানা গেছে তাতে মনে হয়, এ দস্যুকে গ্রেপ্তার করা সহজ হবে না? কাজেই আপনি এমন কৌশলে কাজ করবেন যাতে তাকে পাকড়াও করা সম্ভব হয়।

মিঃ ইয়াসিন বললেন– স্যার, আপনি যেভাবে আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন সেইভাবেই আমরা অগ্রসর হচ্ছি।

বোমসিং বলে উঠলো- স্যার, আমাদের হারানো সম্পদ উদ্ধার করতে আরও যত টাকা। প্রয়োজন আমরা ব্যয় করতে রাজি আছি। যেমন করে হোক দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করতেই হবে। এবং আমাদের সম্পদ উদ্ধার করতেই হবে। স্যার আমরাও যথাসাধ্য সাহায্য করবো আপনাদের।

কান্দাই হেড ওসি মিঃ হারুন বললেন আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে আপ্রাণ চেষ্টা নিয়েছি।

মোদন বললো– ঈশ্বরের কৃপায় আপনারা কৃতকার্য হবেন আশা করছি…

ঠিক সেই মুহূর্তে সাঁ করে একখানা ছোরা এসে গেঁথে গেলো মাঝখানের টেবিলে। এক সঙ্গে চমকে উঠলো অফিস কক্ষের সবাই, সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়লো।

পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ ছোরাখানা তুলে নিলেন হাতে। বিস্ময়ে অবাক হয়ে দেখলেন ছোরায় একখানা ভাঁজ করা কাগজ গাঁথা রয়েছে। মিঃ আরিফ ছোরা থেকে কাগজখানা খুলে মেলে ধরলেন চোখের সামনে, তাতে লেখা আছে–

দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারে মাথা না ঘামিয়ে, কান্দাই রহস্য উদঘাটনে মনোযোগ দিন। দস্যু বনহুর।

মিঃ আরিফ আশ্চর্য কণ্ঠে বললো– এই ছোরা দস্যু বনহুর নিক্ষেপ করেছে। এই দেখুন তার লেখা চিঠি।

ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন মিঃ আরিফের হাত থেকে চিঠিখানা নিয়ে পড়লেন, কুঁচকে উঠলো তার আপন মনে বললেন– দস্যু বনহুর।

মোদন এবং বোমসিং-এর মুখ মরার মুখের মত ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ী করছে।

পুলিশ অফিসারগণের মুখেও উদ্বিগ্নতার সুস্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। সবাই আতঙ্কিতভাবে তাকাচ্ছে চারিদিকে।

মিঃ আরিফ আর মিঃ ইয়াসিনের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে উঠেছে। তীব্র কণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ– পুলিশ এরিয়ার মধ্যে দস্যু বনহুর প্রবেশ করলো কিভাবে? মিঃ হারুন দেখুন পাহারাদার ঠিক মত আছে কিনা?

মিঃ হারুন সেলুট দিয়ে বেরিয়ে গেলো– দেখছি স্যার।

অফিস ইনচার্জ মিঃ সিদ্দিকীকে লক্ষ্য করে বললেন– দস্যু বনহুর নিশ্চয়ই পুলিশ অফিসের এরিয়ার মধ্যে আছে, আপনি পুলিশগণসহ সমস্ত জায়গা ভালভাবে খুঁজে দেখুন।

প্রস্থান করে মিঃ সিদ্দিকী।

মিঃ ইয়াসিন বলেন– কি ভয়ঙ্কর দুঃসাহসিক এই দস্যু বনহুর, যে নির্বিঘ্নে কান্দাই পুলিশ অফিসে প্রবেশ করে ছোরা নিক্ষেপ করতে পারে।

মিঃ আরিফ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন– পুলিশ ডায়েরীতে জানা যায় দস্যু বনহুর অসাধ্য সাধন করতে অদ্বিতীয়। হাঙ্গেরী কারাগারে তাকে আটকে রাখতে সক্ষম হয় নাই।

মোদন আর বোমসিং মুখ চাওয়া- চাওয়ী করছিলো। ওদের মুখভাবে ভয়-ভীতি আর শয়তানীর সুপষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছিলো। পুলিশ অফিস থেকে সরে পড়ার জন্য উসখুস করছিলো তারা। এদের বেশি ভয় দস্যু বনহুর আবার তাদের উপর কোন হামলা করে না বসে।

সমস্ত পুলিশ অফিসে হুলুস্থুল পড়ে গেলো!

পুলিশ সুপার স্বয়ং পুলিশদের নিয়ে দস্যু বনহুরের সন্ধানে অফিস এরিয়া তন্ন তন্ন করে খুঁজলেন। ইন্সপেক্টারও হন্তদন্ত হয়ে ছুটাছুটি করলেন কিন্তু দস্যু বনহুরকে তারা খুঁজে পেলেন না।

মোদন আর বামসিং সরে পড়ার জন্য সুযোগ সন্ধান করছিলো, এক সময় বললো মোদন– স্যার আমরা এবার চলতে পারি?

মিঃ ইয়াসিন বললেন– হা এখন আপনারা যেতে পারেন।

মোদন আর বোমসিং পুলিশ অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। পুলিশ অফিসের সম্মুখে তাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিলো, মোদন আর বোমসিং গাড়িতে উঠে বসলো।

মোদন বললো– সোজা পথে যেওনা ড্রাইভার। বিভিন্ন পথে গাড়ি চালিয়ে তবে আমাদের আড্ডায় নেবে।

বোমসিং বললো– ঠিক বলছো মোদন, দস্যু বনহুর পিছু নিতে পারে।

হাঁ, সে জন্যই তো আমি এই মতলব এটেছি। ড্রাইভার তুমি ভীমসিং ১৩ নং রোডে চলো। বললো মোদন।

ড্রাইভার বললো– আচ্ছা ওস্তাদ।

খুব হুশিয়ার, পিছনে কোন গাড়ি আমাদের ফলো করছে কিনা খেয়াল রাখবে।

ড্রাইভার বললো খেয়াল আছে ওস্তাদ।

মোদন আর বোমসিং এবার নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করে।

মোদন বললো- ভীমসিং ১৩ নং- এ যে বন্দী আটক আছে তার মধ্যে কোলাই-এর যুবরাজ আছে। তার জন্য আমরা পঞ্চাশ হাজার চেয়েছি। কোলাই মহারাজ স্বীকার করেছে আজ রাত দুটোয় ঝিন্ধ নদী তীরে সেই টাকা নিয়ে অপেক্ষা করবে মহারাজের লোক। বোমসিং তুমি এবং মানসিং আমার সঙ্গে থাকবে।

বোমসিং অবাক হয়ে বললো– কোলাই রাজকুমার নাকি মৃত্যুবরণ করেছে?

হা।

তবে টাকা নিয়ে রাজকুমার দেবে কোথা থেকে,

এই বুদ্ধিটুকু তোমার ঘটে নাই বন্ধু। আমাদের একজনকে রাজকুমার সাজিয়ে বুঝলে……. হাঃ হাঃ হাঃ মোদন বুদ্ধি রাখে কেমন করে টাকা আদায় করতে হয়।

ড্রাইভ আসনে বসে অধর দংশন করে ড্রাইভার। চোখ দুটো তার জ্বলে উঠে আগুনের ভাটার মত। কান পেতে মোদন আর বোমসিং-এর কথাগুলো শুনতে থাকে সে।

কান্দাই শহরের প্রত্যেকটা পথঘাট জায়গা ড্রাইভারের পরিচিত, কাজেই পথ চিনে চলতে তার কোন অসুবিধা হলো না। এ পথ সে পথ করে এগিয়ে চলে ভীমসিং ১৩ নং-এ।

কান্দাই শহরের প্রায় শেষ প্রান্তে ভীমসিং ১৩ নং রোড।

এদিকের পথ-ঘাট বড় নির্জন। পুরানো শহর বলে পরিচিত অঞ্চল এটা। এদিকে ভদ্র কোন পরিবেশ নাই, কোন সভ্য লোকজনের আনা-গোনাও নাই। এদিকে বসবাস করে সব নিকৃষ্ট জন মজুর আর টাঙ্গাওয়ালাগণ।

ভীমসিং ১৩ নং- এ গাড়ি গিয়ে থামলো।

বোমসিং আর মোদন নেমে পড়লো গাড়ি থেকে।

ড্রাইভার বললো– ওস্তাদ গাড়ি রাখবো?

হাঁ, অপেক্ষা করো। বললো মোদন।

মোদন আর বোমসিং একটা পোড়ো বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।

একটা অন্ধকার দুর্গম সরুপথ ধরে কিছুটা এগিয়ে একটা দেয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। দেয়ালের পাশে মাটিতে একটা স্প্রিং-এর মত জিনিস রয়েছে।

মোদন সেই স্প্রিং-এর মত জিনিসটায় পা দিয়ে চাপ দিতেই দেয়ালটা ফাঁক হয়ে একটা দরজা বেরিয়ে এলো।

মোদন আর বোমসিং প্রবেশ করলো ভিতরে।

ওপাশে বড় একটা ঘর।

মোদন আর বোমসিং এগুতেই দু’জন গুণ্ডা ধরনের লোক তাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। একজন মোটা ধরনের লোক বললো– ওস্তাদ, সে কাল রাতে মরেছে।

কোথায় সে লাশ? বললো মোদন।

লোকটা বললো যেভাবে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছিলো সেভাবেই আছে।

বোমসিং বললো–কদিন তাকে এইভাবে বেঁধে রাখা হয়েছিলো এলড্রিন?

এক মাস তিন দিন? বললো দ্বিতীয় লোকটা।

এলড্রিন কোন জবাব দেবার পূর্বে মোদন বলে উঠলো– মরলো কি করে?

ওস্তাদ তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি, শুকিয়ে শুকিয়ে মরে গেছে—- এলড্রিনের কথা শেষ হয় না, একখানা ছোরা এসে বিদ্ধ হয় তার বুকে।

বিস্ময়ে চমকে উঠে মোদন তার বোমসিং এবং দ্বিতীয় লোকটা?

এলড্রিন তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেছে ভূতলে।

মোদন একটানে ছোরাখানা তুলে নেয় এলড্রিনের বুক থেকে! একি এ ছোরা যে সেই পুলিশ অফিসে নিক্ষিপ্ত ছোরার মত হুবাহু। তেমনি একখানা কাগজ বাঁধা আছে ছোরার বাটে?

মোদন তাড়াতাড়ি ছোরাখানা থেকে কাগজটা খুলে নিয়ে মেলে ধরলো চোখের সামনে, সঙ্গে সঙ্গে ভীত কণ্ঠে বললো– এই চিঠিখানাও দেখছি দস্যু বনহুরের লেখা।

বোমসিং বললো– বলো কি মোদন?

হাঁ, এই দেখো।

সর্বনাশ দস্যু বনহুর এখানেও……. পড়ো দেখি কি লিখেছে চিঠিতে?

মোদন ভয় বিহ্বল গলায় পড়তে লাগলো– —

পাপের প্রায়শ্চিত্ত ভোগ কর শয়তান।
–দস্যু বনহুর

মোদনের হাত থেকে খসে পড়লো কাগজখানা।

করতালি দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে ডাকলো মোদন– লোম্যান, জোসেফ, হিরণ….

সঙ্গে সঙ্গে সাত আট গুণ্ডা-শণ্ডা লোক ছোরা, লাঠি হাতে ছুটে এলো, ঘিরে দাঁড়ালো মোদন আর বোমসিংকে। সম্মুখে রক্তাক্ত এলড্রিনের মৃত দেহ দেখে সবাই মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলো।

মোদন ভয়-কম্পিত ব্যস্তভাবে বলে উঠলো– দস্যু বনহুর আমাদের ১৩ নং-এ প্রবেশ করেছে। সে আমাদের বিশ্বস্ত অনুচর এলড্রিনকে হত্যা করেছে। দেখো সে কোথায় লুকিয়ে আছে! খুঁজে বের করা চাই……..

বোমসিং-এর মুখও ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে।

সঙ্গে সঙ্গে ওরা ছড়িয়ে পড়লো দস্যু বনহুরের সন্ধানে।

একটু পরে ফিরে এলো সবাই হন্তদন্ত হয়ে, কেউ পেলো না দস্যু বনহুরকে?

মোদন আর বোমসিং এবার ভিতরে প্রবেশ করলো, যে কক্ষে কোলাই যুবরাজ এবং আরও কয়েকজনকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে এলড্রিনের মৃত দেহ এনে মেঝেতে শুয়ে রাখা হলো।

মোদন আর বোমসিং তাকালো কোলাই যুবরাজের ঝুলন্ত মৃত দেহের দিকে। জীর্ণ কঙ্কালের মত সুন্দর ফুটফুটে একটা দেহ। মাথাটা ঝুলে পড়েছে বুকের উপর। নিস্পন্দ প্রাণহীন দেহ।

মোদন হেসে উঠলো- হাঃ হাঃ হাঃ বেটা মরেছে, আজ বেঁচে থাকলে ফিরে যেতে পারতো।

বোমসিং বললো আমাদের টাকা তো আর মরেনি।

হাঁ ঠিক বলেছো বোমসিং, আজ রাত দুটোয় ঝিন্ধ নদীর তীরে আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাভ ………… হাঃ হাঃ হা।

বোমসিং বললো– মোদন হাসছো যে বড় যুবরাজ কাকে বানিয়ে নিয়ে যাবে শুনি?

কেনো হীরালালকে। কই হীরালাল কোথায়?

একজন বললো– হীরা লাল আছে ওস্তাদ। অলপক্ষণে হীরালাল এসে পড়ে সেখানে, মোদন আর বোমসিংকে আদাব দিয়ে দাঁড়ায়।

মোদন যুবকটার আপাদমস্তক লক্ষ্য করে বললো– চমৎকার, একে দিয়েই কাজ চলবে, জোসে একে যুবরাজের পোশাক পরিয়ে বারে নিয়ে আসবে। আমরা সেখান থেকেই রওনা দেবো।

বহুৎ আচ্ছা ওস্তাদ। বললো জোসেফ।

মোদন ফিরে দাঁড়াতেই ড্রাইভারকে দেখে অবাক হলো– তুমি কি করে এলে?

ওস্তাদ আপনার সঙ্গেই তো আছি।

চলো। হাঁ শোন জোসেফ, যুবরাজের লাশটা অন্ধকূপে গুম করে দিও।

হিরণ বলে উঠল– এলড্রিনের লাশটা….

ওটাকে নদীর তীরে পুতে ফেলো, তবু ওর আত্মা শান্তি পাবে।

আচ্ছা ওস্তাদ।

মোদন আর বোমসিং ফিরে চললো।

ড্রাইভার পিছনে তাদের অনুসরণ করলো।

চারিদিকে অন্ধকার।

ঝিন্ধ নদী তীরে এসে গাড়ি থামলো।

নেমে দাঁড়ালো মোদন আর বোমসিং। মানসিং আর জোসেফ নকল যুবরাজ হীরালালকে নিয়ে নেমে পড়লো।

এখন জোসেফ নিজে গাড়ি চালিয়ে এসেছে।

ওরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে তাকালো চারিদিকে।

জমাট অন্ধকারে চারিদিক আচ্ছন্ন। কেমন যেন একটা শীতল বাতাস বইছে। কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না কারো।

মোদন তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে লাগলো।

বোমসিং বললো– কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না বন্ধু? তবে কি কোলাই মহারাজ আসল ব্যাপার জানতে পেরেছে?

অসম্ভব কোলাই মহারাজ তো দূরের কথা, কান্দাই-এর কোন প্রাণীও জানে না কোলাই যুবরাজ খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে।

জোসেফ বলে উঠে– ওস্তাদ ঐ যে নদীর ধারে একটা ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে।

সকলের দৃষ্টি গিয়ে পড়ে নদীর কিনারে। সত্যই একটা ক্ষুদ্র আলোর ছটা এগিয়ে আসছে।

বোমসিং বললো– নিশ্চয়ই কোলাই মহারাজের লোক টাকা নিয়ে আসছে।

মোদন আর অন্যান্য সকলের চোখ লোভাতুর শার্দুলের মত জ্বলে উঠলো। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো সবাই আলোক-রশিটার দিকে।

যা ভেবেছিলো তাই। একটা নৌকা তীরে এসে লাগলো। দু’জন লোক নেমে দাঁড়ালো নৌকা থেকে। যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না তবু বুঝা যাচ্ছে। একজন মাটিতে লগি গেড়ে রাশি দিয়ে। বাঁধলো নৌকাখানাকে।

আর একজন লণ্ঠন ধরে আছে উঁচু করে।

যে লোকটার হাতে লণ্ঠন তারই বাম হস্তে একটি ব্যাগ কিংবা থলের মত কিছু আছে মনে হচ্ছে।

বোমসিং বললো টাকা পায়ে হেঁটে এসে যাচ্ছে।

মোদন বললো– বাৎ জোর বন্ধু। বরাৎ জোর

ততক্ষণে নৌকা রেখে লোক দুটো এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।

মোদন বললো– জোসে হীরালালসহ তুমি আর মানসিং এগিয়ে যাও, আমরাও আসছি। দেখো হীরালালকে যেন চিনে না ফেলে।

জোসে বললো– আমি ঠিক আছি ওস্তাদ।

মানসিং বললো– টাকা হাতে নিয়েই, দু’টোকে খতম করে ফেলবো।

দেখো টাকাগুলোতে যেন রক্তের ছাপ লাগে। বললো মোদন।

বোমসিং বললো- খুব হুশিয়ার কিন্তু………

মোদন বললো- ছোরাগুলো সাবধানে লুকিয়ে নাও।

হাঁ ওস্তাদ বলতে হবে না। জোসেফ আর মানসিং ছোরাগুলোকে ভাল করে কাপড়ের তলায় লুকিয়ে নিলো।

লণ্ঠন হাতে লোক দু’জন এগিয়ে আসছে।

মোদন আর বোমসিং গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।

মানসিং সংকেতধ্বনি করে জানালো তারা এখানেই আছে।

লোক দু’জন অতি নিকটে এসে পড়েছে। মানসিং-এর সংকেতধ্বনি শুনে ওরা সেইদিকে এগুচ্ছিলো।

মোদন আর বোমসিং গাড়ির আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।

মানসিং ও জোসেফ হীরালালকে দূরে রেখে এগিয়ে এলো।

লোক দু’জন তখন একেবারে নিকটে এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের মুখোভাবে ভয় আর আতঙ্কের ছায়া ফুটে উঠেছে। একজন বলে উঠলো– কই, আমাদের কুমার-বাহাদুর কই? ব্যাকুল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো চারিদিকে।

মানসিং বলে উঠলো– আছে, কই আসুন কুমার-বাহাদুর এগিয়ে আসুন। আপনার লোক এসেছে।

হীরালাল অন্ধকারে এগিয়ে আসার ভান করে।

জোসেফ বলে উঠে আগে টাকাটা হাতে নাও বাবা। রাজকুমার আপনি একটু অপেক্ষা। করুন…..

মানসিং-এর হাতে লোকটা টাকার থলে তুলে দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে মোদন আর বোমসিং, ঘিরে ফেলে লোক দুটোকে।

সকলেই হাতেই সূতীক্ষ্মধার ছোরা।

অন্ধকারে ছোরাগুলো চক্ চক্ করে উঠে।

লোক দুটো ভয়ে শিউরে উঠলো। বিহ্বল-কণ্ঠে ডাকলো কুমার-বাহাদুর……….. কুমার বাহাদুর………

মোদন দাঁতে দাঁত পিষে বললো চেঁচাচ্ছো কোনো! মরার জন্য প্রস্তুত হও…………ছোরা উদ্যত করে ধরে সে।

অমনি বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে কে যেন হুঙ্কার ছাড়ে- ছোরা নামিয়ে নাও শয়তান…….

থমকে উঠে সবাই। সঙ্গে সঙ্গে ফিরে তাকায় মোদনের দল। আরষ্ট হয়ে যায় ওরা। উদ্যত রিভলভার হস্তে তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে জমকালো একটা মূর্তি।

মোদন অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করে– দস্যু বনহুর!

হাঁ, হাত থেকে ছোরাগুলো নদীর জলে নিক্ষেপ করো। বিলম্ব করলে মরবে।

নির্জন নদী তীরে গভীর অন্ধকারে লণ্ঠনের ক্ষীণ আলোকরশ্মিতে বনহুরের জমকালো মূর্তি আর গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ এক ভয়াবহ ভাব সৃষ্টি করে তুললো।

মোদনের দল ছোরা নিক্ষেপ করলো এক এক করে।

বনহুর বললো– টাকার থলে আমাকে দাও?

মোদন মনসিং-এর হাত থেকে টাকার থলেটা নিয়ে চেপে ধরলো বুকে– না না এ টাকা দেবো না।

কি বললে, টাকা দেবে না?

না, তুমি আমাদের এক লাখ টাকা নিয়েছে। মতিচুর মালা নিয়েছে। এ টাকা দেবো না।

তাহলে মরার জন্য প্রস্তুত হও …….

বোমসিং বলে উঠে — দিয়ে দাও ভাই টাকা, তবু জীবন যদি রক্ষা পায়।

অগ্যতা মোদন টাকার থলেটা ছুঁড়ে দেয় বনহুরের দিকে।

বনহুর বাম হাতে টাকার থলেটা ধরে ফেলে খপ করে।

কোলাই মহারাজের লোক দু’জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে। তারা ভেবে পায় না কি ঘটেছে আর কি ঘটলো। তারা থর থর করে কাঁপতে শুরু করছে। কোথায় যুবরাজকে নিয়ে আনন্দ করতে করতে ফিরে যাবে না মৃত্যুর জন্য তৈরি হচ্ছে। ভাগ্যিস জমকালো মূর্তিটার আবির্ভাব ঘটেছিলো তাই রক্ষা, না হলে এতোক্ষণ প্ৰাণবায়ু অসীমে মিশে যেতো।

এবার বনহুর কোলাই-রাজের অনুচর দু’জনকে লক্ষ্য করে বলে আপনারা আমার সঙ্গে আসুন।

বনহুর মোদনের গাড়িখানার দিকে এগুলো।

ভয়ার্তভাবে তাকে অনুসরণ করলো মহারাজের অনুচরদ্বয়। তারা ভেবে পাচ্ছে না কি। ব্যাপার।

বনহুর গাড়ির দরজা খুলে ধরে বললো– উঠে পড়ুন গাড়িতে।

লোক দুটি অসহায় চোখে তাকালো বনহুরের জমকালো পোশাকের দিকে, ওদের কণ্ঠনালী শুকিয়ে আরষ্ট হয়ে গেছে। একজন বললো– যুবরাজকে ছেড়ে আমরা যাবো না।

বললো বনহুর কোথায় আপনাদের যুবরাজ! যুবরাজ বেশে এক শয়তানকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। বনহুর ওদের হাত থেকে লণ্ঠন নিয়ে হীরালালের মুখের কাছে উঁচু করে ধরলো– দেখুন।

অস্ফুটধ্বনি করে উঠলো মহারাজের অনুচরদ্বয়, হায় হায় আমাদের যুবরাজ কোথায়?

বনহুর বললো- তার আশা ত্যাগ করুন আপনারা, কারণ তাকে শয়তান দল হত্যা করেছে।

হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলো লোক দু’জন।

বনহুরের চোখ দুটো অশ্রুসজল হলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো– উঠে পড়ুন।

লোক দু’জন উঠে পড়লো গাড়ির মধ্যে।

বনহুর রিভলভার ঠিক রেখে এতোক্ষণ কথা বলছিলো। কারণ সে জানে সুযোগ পেলেই শয়তান দল তাকে আক্রমণ করবে। মোদন এবং তার দলকে লক্ষ্য করে বললো বনহুর এক পা নড়োনা বলে দিলাম…….. কথা শেষ করে দ্রুত ড্রাইভ আসনে উঠে বসে স্টার্ট দিলো।

মুহূর্তে গাড়িখানা উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

সঙ্গে সঙ্গে মোদন চিৎকার করে উঠলো গাড়ির চাকা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়। গুলি ছোড়ঃ…………টায়ার ফাঁসিয়ে দাও

নিস্তব্ধ নদী তীরে জমাট অন্ধকার খান খান হয়ে ভেঙে পড়লো, গুলির শব্দ হলো –গুড় ম… গুড় ম…….

কিন্তু ততক্ষণে গাড়িখানা অনেক দূরে সরে পড়েছে।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো মোদন এবং তার দল-বল। লণ্ঠনটা কাৎ হয়ে পড়ে তখন দ দপ্ করে জ্বলছে।

বনহুরের হাতে গাড়িখানা স্পীড়ে ছুটে চলেছে।

পিছনের আসনে বসে কোলাই-মহারাজের অনুচরদ্বয়। তারা এখনও ভেবে পাচ্ছে না কে এই লোক, আর কেনই বা তাদেরকে এ ভাবে উদ্ধার করে আনলো।

এক সময় গাড়িখানা কোলাই শহরে এসে পৌঁছলো। রাত তখন ভোর হয়ে আসছে। লোক দু’জন ঝিমুচ্ছিলো বসে বসে। বনহুর গাড়ি থামিয়ে ফেললো। ড্রাইভ-আসন থেকে নেমে দাঁড়ালো বনহুর, পিছন আসনের দরজা খুলে ধরে বললো এবার আপনারা বিপদমুক্ত, নেমে পড়ুন।

লোক দু’জন নেমে দাঁড়ালো।

বনহুর টাকার থলেটা ওদের একজনের হাতে দিয়ে বললো– টাকা মহারাজকে ফেরত দেবেন। তাঁর পুত্র আর জীবিত নেই। শয়তানের দল তাকে হত্যা করেছে।

লোক দুটো বিস্ময় আর কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় বনহুরের মুখমণ্ডলের দিকে।

বনহুর বলে– এবার আপনারা যেতে পারেন।

একজন বলে উঠে– আপনার পরিচয়।

দস্যু বনহুর।

আপনি! আপনি দস্যু বনহুর?

হা।

লোক দুটোর মুখে ফুটে উঠে অপূর্ব এক ভাবের উন্মেষ।

বনহুর তখন গাড়িতে চেপে বসেছে।

গাড়ি দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।

লোক দুটি পা বাড়ায় রাজপ্রাসাদের দিকে।

মোদনমোহন বার-এর গোপন কক্ষে চলেছে গোপন পরামর্শ। গত রাতে দস্যু বনহুর আচমকা হামলা দিয়ে তাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে আর কোলাই-মহারাজের অনুচরদ্বয়কেও উদ্ধার করে নিয়ে গেছে সে তাদের কবল থেকে।

মোদন ক্রুদ্ধ জন্তুর মত রাগে গ গ করছিলো। বোমসিং এখন নাই। অন্যান্য দলবল সবাই দাঁড়িয়ে আছে তার সম্মুখে। প্রত্যেকের চোখে-মুখেই ভীষণ প্রতিহিংসার ভাব পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছে।

এমন সময় ভোলানাথের বেশে দস্যু বনহুর প্রবেশ করে সেখানে।

মোদন ওকে দেখা মাত্র আনন্দ-সূচক শব্দ করে উঠলো– ভোলা, কাল আসনি কেনো বন্ধু। সর্বনাশ হয়ে গেছে।

অবাক হবার ভান করে বললো বনহুর — সর্বনাশ!

হাঁ সর্বনাশ হয়েছে। কাল যদি আসতে তাহলে আমাদের এমন সর্বনাশ হতো না এবং পঞ্চাশ হাজার টাকাও হাতে পেয়ে হারাতে হতো না।’

পঞ্চাশ হাজার টাকা?

হাঁ। তুমি থাকলে কাল উচিৎ শিক্ষা পেতো দস্যু বনহুর।

বলো কি কাল আবার দস্যু বনহুর হামলা দিয়েছিলো? লোকটা দেখছি অত্যন্ত বদ-সাহসী? একবার আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে আমি তাকে দেখিয়ে দেবো, কেমন উচিৎ সাজাটা। মুষ্টিঘাত করলো ভোলা টেবিলে।

মোদন বললো– বসো বন্ধু। বসিয়ে দিলো মোদন ভোলাকে আদর করে।

অন্যান্য দলবল সকলে খুশি হলো, সবাই ভোলার মনে আনন্দ দেবার জন্য চেষ্টা করতে লাগলো।

মোদন বললো– নর্তকী নাচ দেখাও।

নর্তকী এসে দাঁড়ালো বনহুরের সম্মুখে, তারপর নাচতে শুরু করলো।

বনহুর মৃদু মৃদু হাসতে লাগলো।

নর্তকী নানা ভঙ্গীমায় নেচে চললো।

এমন সময় বার গৃহের মধ্যে শোনা গেলো হই-হুঁল্লোড়। ছুটে এলো একজন লোক– ওস্তাদ ওস্তাদ একজন গুণ্ডা ম্যানেজারকে মারছে।

মোদন মুহূর্তে উঠে দাঁড়ালো, অবাক হয়ে বললো –তার মানে?

মদের দাম নিয়ে গণ্ডগোল বেঁধেছিলো।

চলো দেখি …… বনহুরের পিঠে চাপড়ে বললো– ভোলানাথ উঠে পড়ো বন্ধু।

বনহুর উঠে পড়লো।

মোদন, বনহুর আর অন্যান্য সকলে এসে দাঁড়ালো বার-গৃহের মধ্যে। দেখলো জোয়ান একজন লোক ম্যানেজার মথুরা মহাতককে ভীষণ প্রহার করেছে।

দলবল ক্ষেপে গেলো মুহূর্তে, সবাই লোকটাকে আক্রমণ, করার জন্য পা বাড়াতেই মোদন হাতে দিয়ে তাদের পথ রোধ করে বললো– ভোলানাথ ওকে উপযুক্ত সাজা দেবে।

মোদন ভোলাকে ঠেলে দিলো– যাও ভোলানাথ।

বনহুর ধীরে সুস্থে হাতের জামাটা গুটিয়ে নিল খানিকটা তারপর এগিয়ে পিছন থেকে লোকটার ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলো সোজা ওর নাকটার উপরে।

হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো লোকটা কিন্তু পরক্ষণেই উঠে পাল্লা আক্রমণ করলো এবার সে ভোলাকে।

ম্যানেজারের নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছিলো, রীতিমত হাঁপাচ্ছিলো সে ধুকে ধুকে।

এবার ভোলার সঙ্গে শুরু হলো লড়াই।

কিন্তু মাত্র কয়েক মিনিট।

ভোলার ঘুষি খেয়ে অল্পক্ষণেই কাবু হয়ে পড়লো গুণ্ডা লোকটা। পেট ধরে উবু হয়ে বসে পড়লো মেঝেতে।

ভোলা ওর ঘাড়ের জামা ধরে টেনে নিয়ে গেলো বার-এর দরজা অবধি তারপর ধাক্কা দিয়ে পথে ঠেলে ফেলে দিলো।

মোদন আর অন্যান্য সবাই আনন্দধ্বনি করে উঠলো।

মোদন বনহুরকে আলিঙ্গন করে বললো– সাবাস বন্ধু।

এবার বনহুরকে নিয়ে মোদন ভিতরে বড় হলঘরে চলে গেলো। এ ঘরখানা পূর্বদিনের সেই ঘর, যে ঘরে মোদন আর বনহুর দাঁড়িয়ে প্রথম শুনতে পেরেছিলো গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর।

আজও মোদন আর বনহুর এসে দাঁড়ালো।

মোদন কিছু বলার পূর্বেই শুনতে পেলো সেই রহস্যময় কণ্ঠস্বর…… ভোলার বীরত্ব আমাদের মোদনমোহন বার-এর গর্ব। ওকে কাল তোমরা সঙ্গে না নিয়ে ভুল করেছিলে।

মোদন করজোরে বললো- আর এমন ভুল হবে না মালিক।

আবার সেই আওয়াজ বার বার দস্যু বনহুর তোমাদের মুখের খোরাক কেড়ে নেবে আর তোমরা এমনি করে নিশ্চুপ হজম করে যাবে? ভোলানাথকে বলে দাও সে যেন এখন থেকে রাতে একবার করে আসে।

মোদন বললো শুনলে তো ভোলা? তোমার উপর মালিকের কত ভরসা।

হাসলো ভোলা।

মোদন বললো আবার মালিক ভোলার বখশীস?

প্রতি রাতে তাকে হাজার টাকা দেওয়া হবে

। মালিক! মালিক আমি খুশি হলাম শুনে।

মোদন ভোলাসহ বেরিয়ে এলো সেই আধো অন্ধকার কক্ষ থেকে।

মোদন আর ভোলা যখন মালিকের সঙ্গে আলাপ করছিলো তখন বার-এর গোপন কক্ষে দলবলও সব শুনতে পাচ্ছিলো। কারণ এই গোপন কক্ষেও সাউণ্ডবক্স আছে এবং সবাই তারা মালিকের নির্দেশ এ ঘরে বসেই পায়।

মোদন ভোলাসহ ফিরে এলো। নর্তকীকে নৃত্যের নির্দেশ দিয়ে আসন গ্রহণ করে সে।

ভোলা তখন গুম হয়ে বসে আছে।

মোদন নিজ হাতে সরাব ঢেলে গেলাসটা বাড়িয়ে ধরলো। বললো– খাও বন্ধু?

বনহুর আজ গেলাসটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

নর্তকী তখন নেচে চলেছে।

ভোলানাথ জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।

নর্তকী নাচতে নাচতে এগিয়ে গেলো ভোলার পাশে। ভোলা ওর একখানা হাত ধরে ফেললো। ঠিক সেই মুহূর্তে সরাবগুলো ফেলে দিলো জানালা দিয়ে বাইরে।

মোদন ও তার দলবল সরাব পানে মত্ত হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ নাচ-গান আমোদ-ফুর্তি চললো।

ভোলাকে বশীভূত করাই তাদের কাজ। নর্তকীকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে যেমন করে হোক ভোলাকে আয়ত্বে আনতেই হবে। তাই মোদনও তার দলবলের এতো প্রচেষ্টা। ভোলার মত ব্যক্তিকে যদি তারা সর্বক্ষণের জন্য তাদের পাশে পায় তাহলে সব কাজ হাসিল হবে বিনা দ্বিধায়। তার চেয়েও বড় কথা দস্যু বনহুরকে কাবু করা। তাকে হত্যা কিংবা গ্রেপ্তার করতে না পারলেই কোন মতেই তাদের ব্যবসা সুবিধা মত চলবে না। কারণ, তাদের বহু টাকা দস্যু বনহুর হরণ করে নিয়ে গেছে। তাছাড়া সব সময় দস্যু বনহুরের ভয়ে তাদেরকে আতঙ্কিত থাকতে হয়।

ভোলা সরাব পানের ভঙ্গী করে চললো বটে কিন্তু আর সে ঐ বস্তু গলধঃকরণ করবে না, শপথ করেছে সে নূরীর কাছে, শপথ করেছে সে মনিরার গা স্পর্শ করে। মিছে মিছে ভান করলো ভোলা। জড়িত-কণ্ঠে কথা বলতে লাগলো।

মোদন বললো– দেখো ভোলানাথ, এখন থেকে তুমি রোজ রাতে আসবে বুঝলে? হাজার টাকা পাবে।

হাজার টাকা?

হাঁ বন্ধু হাজার টাকা।

আজ কিছু দাও।

পকেট থেকে এক হাজার টাকা বের করে মোদন খুঁজে দিলো ভোলাবেশী দস্যু বনহুরের হাতে।

বনহুর মাতালের অভিনয় করছিলো, টাকাটা চোখের সম্মুখে মেলে ধরে হেসে উঠলো –হাঃ হাঃ হাঃ এ- ক– হাজার টাকা …… হাঃ হাঃ হাঃ …… হাঃ হাঃ হাঃ…..

মোদন এবং তার দলবল ভোলানাথের হাসি দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। হতভম্বের মত তাকিয়ে রইলো ভোলার মুখের দিকে। ওরা ভাবলো ভোলা এতো টাকা পেয়ে খুশি হয়ে হাসছে।

ভোলা বেরিয়ে গেলো এবার বার থেকে।

মোদন বললো– মানসিং।

বলুন ওস্তাদ?

ভোলানাথ পূর্বের চেয়ে অনেক বেগে এসেছে। ওকে আরও কৌশলে হাত করতে হবে।

মানসিং বলে উঠলো– ওস্তাদ, একটা কথা বলবো।

বলো, একটা কেননা যত পারো বলো? কিন্তু কথার মত কথা হতে হবে বুঝলে?

ওস্তাদ পুরুষকে আয়ত্বে আনতে হলে চাই….

অর্থ এই তো?

না ওস্তাদ।

তবে?

মেয়ে মানুষ দরকার।

সেতো আছেই– নর্তকী পেয়ারী, নর্তকী লীলাবাঈ, যমুনারাণী এদের দিয়ে বাগিয়ে নাও।

ভোলানাথকে আয়ত্বে আনতে হলে চুনোপুটি নর্তকীগুলো দিয়ে হবে না।

তা হলে কি করতে চাও?

বোম্বে থেকে একটা লোক তার মেয়েকে নিয়ে এসেছে, বড় সুন্দরী মেয়ে। মানসিং থামলো।

মোদন বললো– বোম্বে থেকে?

হাঁ ওস্তাদ, লোকটার নাম মহেন্দ্র গড়সে আর তার কন্যার নাম কস্তুরী বাঈ।

কোথায় তারা?

আজ সকালে এসেছিলো, মেয়েটাকে আমাদের মোদনমোহন বার-এ রাখতে চায়।

কেন?

ভাল নাচ জানে।

ভাল নাচ জানলেই যে ভোলানাথকে আয়ত্বে আনতে পারবে এ বিশ্বাস তোমার কেমন করে হলো?

আপনি দেখলে তবেই বিশ্বাস করবেন ওস্তাদ। একেবারে স্বর্গের অস্পরী—- হুরপরী যাকে বলে—-

তাই নাকি?

হাঁ ওস্তাদ কাল আবার বাপ-বেটি আসবে।

আমার সম্মুখে এনো আমি দেখলেই বুঝতে পারবো ভোলাকে সে বশীভূত করতে পারবে কিনা।

পরদিন।

মোদনমোহন বার-এ পিতা-পুত্রী এসে হাজির হলো।

মানসিং ওদের দু’জনাকে নিয়ে উপস্থিত করলো মোদনের সম্মুখে।

মোদন কস্তুরীবাঈকে দেখে অবাক না হয়ে পারলো না। এতরূপ বুঝি সে জীবনে দেখে নাই। বিস্ময়-বিমুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো মোদন মেয়েটির দিকে।

মানসিংহ বললো– কেমন মনে ধরলো ওস্তাদ?

হ; একে দেখে মনে হচ্ছে কাজ হবে। তোমার নাম কি? কস্তুরীবাঈকে লক্ষ্য করে বললো মোদন।

কস্তুরীবাঈ জবাব দিলো আমার নাম কস্তুরীবাঈ।

চমৎকার। নাচতে পারো?

পারি! খুব পারি!

পুরুষ মানুষকে খুশি করতে পারবে?

শুধু খুশি নয় ওস্তাদ, যে কোন পুরুষ মানুষকে এক কথায় উঠাতে বসাতে পারবো।

সাবাস! তুমি কাজের মেয়ে দেখছি। যা আজ থেকে তোমাকে আমরা বহাল করে নিলাম।

এবার কস্তুরীবাঈ-এর বাবা মহেন্দ্র গড়সে বললো আমার মেয়ে সবদিন আসতে পারবে না সাহেব, সপ্তাহে দুটো দিন।

বলো কি?

হাঁ।

কস্তুরীবাঈ বললো– হতাশ হবেন না ওস্তাদ দু’দিনেই আমি সব ঠিক করে ফেলবো।

মানসিংকে লক্ষ্য করে বললো মোদন–ওকে সব কথা বুঝিয়ে বলে দাও মানসিং। কেন আমরা তাকে এখানে নিচ্ছি।

ওস্তাদ আমি সব বলেছি।

বলছো?

হ ওস্তাদ।

এবার মোদন ফিরে তাকালো মহেন্দ্র গড়সের দিকে তোমার মেয়েকে দু’টো দিনের জন্য কত করে দিতে হবে?

ওস্তাদ যা খুশি তাই দেবেন। আমার মেয়ে তো আর যেমন তেমন নর্তকী নয়।

আচ্ছা বিবেচনা করে দেওয়া যাবে। তবে কাজ হাসিল হলে বহুত বখশীস পাবে বাপ-বেটি বুঝলে?

বুঝেছি ওস্তাদ।

মোদন বললো– কস্তুরীবাঈ তোমাকে আমাদের দরকার রাতে, দিনে নয়।

আচ্ছা ওস্তাদ আপনি ঠিক সময় পাবেন।

আজ এখন যেতে পারো কিন্তু রাত দশটার পর তোমাকে আসতে হবে। কথাগুলো বলে মোদন পাঁচখানা একশত টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলো কস্তুরীবাঈ-এর দিকে।

কস্তুরীবাঈ নোটগুলো নিয়ে বাঈজী কায়দায় সেলাম জানালো, তারপর মহেন্দ্র গড়সের দিকে টাকাগুলো বাড়িয়ে ধরে বললো রাখো বাপুজী।

মহেন্দ্র গড়সে কস্তুরীবাঈ- এর হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে পকেটে রাখলো।

মোদন বললো- ঠিক সময়মত আসবে কিন্তু।

আচ্ছা ওস্তাদ। বললো কস্তুরীবাঈ। তারপর পিতাকে লক্ষ্য করে বললো– চলো বাপু।

মহেন্দ্র গড়সে সহ কস্তুরীবাঈ বেরিয়ে গেলো মোদনমোহন বার থেকে।

মোদন খুশিতে আত্মহারা হয়ে টেবিলে চপেটাঘাৎ করলো মানসিং তোমাকে তারিফ না করে পারছি না। এমন চিজ বহুতদিন মেলেনি বন্ধু। একেবারে খাসা মাল! অপূর্ব সুন্দরী বটে। এবার ভোলানাথ যাবে কোথায়। একে দেখলে ঠিক বেগে আসবে আগুনের পোড়া লোহার মত।

মানসিং বললো– আমার বখশীশ ওস্তাদ?

পাবে, পাবে আগে কাজ হাসিল হতে দাও।

রাত অনেক হয়েছে।

মোদনমোহন বার-এর অভ্যন্তরে গোপন কোন আলোচনা চলছে। মোদন, বোমসিং আরও অন্যান্য দলবল অনেকেই আছে সেখানে। এমন সময় ভোলানাথ হাজির হলো সেখানে।

মোদন আর বোমসিং আসন ত্যাগ করে ভোলানাথকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালো, তারপর নিজেরা আসন গ্রহণ করলো।

আবার শুরু হলো আলোচনা।

মোদন বললো আমাদের মধ্যে কে পারবে কোলাইমহারাজকে বন্দী করে আনতে? যে পারবে তাকে বিশ হাজার টাকা…. কথাটা শেষ করে একখানা ছোরা গেঁথে ফেলে মোদন টেবিলে তারপর বললো যে পারবে সে এই ছোরাখানা উঠিয়ে নাও।

টেবিলের চার পাশে অনুচরগণ ঘেড়াও করে বসেছিলো। সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে নিলো। মানসিং ছোরাখানা তুলে নিলো হাতে চট করে।

মোদন বলে উঠলো– সাবাস।

একজন বললো কিন্তু মহারাজকে হরণ করা সহজ নয়।

মানসিং বললো– বলাইরাম, মানসিং সব পারে বুঝলে?

মোদন বললো– কোলাই-মহারাজ পুত্রশোকে অস্থির আছে। সে এখন কোন সময়ের জন্য। বাইরে বের হয় না। তাকে বন্দী করা একটু কঠিন হবে।

মানসিং বললো– আমি জানি কোলাই-মহারাজ রোজ সন্ধ্যায় কালী মন্দিরে যান। ফিরে আসেন অনেক রাতে সেই সময় আমরা তাকে বন্দী করব! হয়তো দু’চার জনকে খুন করতে হবে এই মাত্র। তুমি কিছু ভেবো না ওস্তাদ।

ভাববার কিছু নেই কিন্তু কাজ উদ্ধার করতে না পারলে সাজা পেতে হবে এ কথা ভুলে যেওনা মানসিং।

আর কাজ হাসিল করলে?

মোটা পুরস্কার পাবে। কিন্তু সাবধান দস্যু বনহুর যেন টের না পায়। ঐ শয়তান বেটা আমাদের পিছু নিয়েছে।

শুধু পিছু নয় ওস্তাদ একেবারে সর্বনাশ করেছে সে আমাদের। বললো বলাইরাম।

মোদন বললো– একবার কোলাই-মহারাজকে আটক করে এক লাখ টাকা আদায় করবো।

মানসিং বললো– আমাকে কিন্তু মোটা বখশীশ দিতে হবে ওস্তাদ?

পাবে। পাবে, আগে কাজ হাসিল হোক। হাঁ এবার যখন টাকা প্রতিশ্রুতি মত গ্রহণ করতে যাবো, তখন সঙ্গে থাকবে ভোলানাথ। দেখা যাবে দস্যু বনহুর কেমন করে কাবু করে আর টাকা। ছিনিয়ে নেয়– কি বলো বন্ধু ভোলানাথ?

হাঁ, আমি রাজি আছি।

মোদন আর ভোলানাথ করমর্দন করে।

এবার সবাই মিলে পাশের গুপ্ত কক্ষে প্রবেশ করলো। যেখানে বন্দীদের আটক করে রাখা হয়েছে। দু’জনার মৃত্যু ঘটেছে ইতিমধ্যে।

মোদন যখন ওদের পরীক্ষা করে দেখছিলো তখন ভোলানাথের চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিলো এক ব্যথার করুণভাব।

মোদন একজন অনুচরকে লক্ষ্য করে বললো– রামচন্দ্র, এদের সবাই-এর মুক্তির জন্য টাকার সংখ্যা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছো?

হাঁ, ওস্তাদ দেওয়া হয়েছে।

কেউ রাজি হয়েছে কি?

একজন রাজি হয়েছে, সে হলো বণিক বজ্রমোহন বাবুর কনিষ্ঠ ছেলের জন্য বিশ হাজার।

কই সে চিঠিতো আমাকে দেখাওনি?

ওস্তাদ চিঠিখানা অল্পক্ষণ হলো আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সেই কারণে…….

বুঝেছি কই সে চিঠি দাও?

এই নিন। একটা ভাঁজ করা কাগজ এনে হাতে দেয় রামচন্দ্র মোহনের।

মোদন চিঠিখানায় দৃষ্টি বুলিয়ে চলে।

মানসিং মোদনের পাশ দিয়ে তাকিয়ে চিঠিখানা পড়ে নিয়ে বলে– চালাকি করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবে না তো?

মোদন বলে উঠলো– পুলিশের চেয়ে বেশি ভয় দস্যু বনহুরকে বুঝলে মানসিং?

ভোলানাথ বলে উঠলো বন্ধু, ভোলানাথ থাকতে কোন ভয় নেই। দস্যু বনহুর তো দূরের কথা, শয়তানের বাবা মোদন ভায়াকেও উচিৎ সাজা দিয়ে ছাড়বো….

মোদন মুখ কালো করে ফেলে– কি বললে?

আরে যা নামটা ভুলে গিয়েছিলাম– মানে শয়তান মদনা ডাকাতের কথা বলছিলাম হঠাৎ….

ও মদনা ডাকাত?

হ বন্ধু?

সে তো পুঁচকে চোর। পকেটমার মদনা।

ও আমি কিন্তু ওকে মদনা ডাকাত বলি।

সবাই হো হো করে হেসে উঠে।

সত্যি কান্দাই শহরে নাম করা একটা পুঁচকে পকেটমার চোর ছিল। প্রায় লোকেই তাকে চিনতো, জীবনের বেশি সময় তাকে হাজতে থাকতে হতো। পকেট না মারলে তার নাকি পেট চলতো না, কারণ পকেট মারলে পুলিশ তাকে হাজতে পাঠাতো, যে ক’দিন হাজতে থাকতো পেটের চিন্তা করতে হতো না তাকে। হাজত থেকে ছাড়া পেলেই আবার সে পকেট মেরে হাজতে যাবার জোগার ধরতো।

এবার সবাই এসে বসলো বার-এর মধ্যে।

টেবিলে টেবিলে তখন নানারকম নারী পুরুষ মিলে হাসিগল্প আর খানাপিনা চলেছে।

নর্তকী পিয়ারী তখন সরাব পেয়ালা হাতে নৃত্য পরিবেশন করে চলেছে।

এক পাশে ভায়াসে পিয়ানো বাদক পিয়ানো বাজীয়ে চলেছে।

মোদন দলবল নিয়ে বসলো মাঝখানের গোল টেবিলটা ঘিরে। ভোলাকেও নিজের পাশে বসিয়ে নিলো মোদন, তারপর বললো– নিয়ে এসো।

মোদন কি নিয়ে আসতে বললো উল্লেখ না করলেও বয় মাংস আর কয়েক বোতল সরাব এনে টেবিলের মাঝখানে রাখলো।

মোদন একটা বোতল টেনে নিলো সামনে।

অন্যান্য দলবল মনের নেশায় মেতে উঠলো। মাংস আর সরাব গো- গ্রাসে গলধঃকরণ করতে রাগলো।

মোদন মাংস আর সরাব-পাত্র ভোলানাথের দিকে বাড়িয়ে ধরলো–নাও বন্ধু পান করো।

ভোলা ঠেলে দিলো– না ওসব খাবো না! ফল আনো।

তখনই মোদন ফল আনার জন্য নির্দেশ দিলো।

ফল এলো।

ভোলানাথ গোগ্রাসে ফল খেতে লাগলো।

তখন পিয়ারী নর্তকীর নাচ পুরো দমে চলেছে।

এগিয়ে আসে পিয়ারী।

মোদন সরাব-পাত্র নর্তকীর হাতে দিয়ে ইংগিৎ করে ভোলানাথের দিকে যাবার জন্য।

নর্তকী নাচের তালে তালে সরাব-পাত্র তুলে ধরে ভোলানাথের মুখের কাছে।

ভোলানাথ মাথা নাড়ে– উ হু …..

তবু নর্তকী নাছোড়বান্দা যেন।

ঠিক সেই মুহূর্তে সমস্ত শরীর কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত কস্তুরীবাঈ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে নিচে। শুধু চোখ দুটো খোলা মুখের নিচের অংশ কালো আবরণে ঢাকা। কপালের কিছু অংশ আর দুটো ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না।

সোজা কস্তুরীবাঈ এসে দাঁড়ালো ভোলানাথ আর মোদনের সম্মুখে। স্থির দৃষ্টি নিয়ে তাকালো সে ভোলার দিকে।)

ভোলানাথের দু’চোখে বিস্ময় ফুটে উঠলো, সেও নির্বাক নয়নে তাকিয়ে আছে কস্তুরীবাঈ-এর দিকে।

মোদনের মুখে আনন্দের হাসি ফুটে উঠলো, ভাবলো ঠিক্ যা চেয়েছে তাই পেয়েছে। কস্তুরীবাঈকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছে ভোলানাথ তাতে কোন সন্দেহ নেই।

ভোলানাথ যখন কস্তুরীবাঈ-এর দিকে নিৰ্ণিমেষ নয়নে তাকিয়ে আছে তখন মোদন দলবলের সঙ্গে মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে নেয়। মনোভাব, কাজ হাসিল হয়ে এসেছে এবার।

কস্তুরীবাঈ পিয়ারী নর্তকীর হাত থেকে সরাব-পাত্র নিয়ে নাচতে শুরু করে।

মোদন পিয়ারীকে ইংগিত করে চলে যাবার জন্য।

পিয়ারী সরে যান সেখান থেকে, কিন্তু একটা ক্রুদ্ধভাব ফুটে উঠে তার মুখমণ্ডলে।

কস্তুরীবাঈ অদ্ভুত ভঙ্গীমায় নাচতে শুরু করেছে। যদিও তার দেহ কালো ঘাগড়া আর ওড়নায়। আবৃত, মাথায় একটা ওড়না বাঁধা, মুখের নিচের অংশও কালো কাপড়ে ঢাকা তবু তার নৃত্যভঙ্গী অপূর্ব। সরাব-পাত্র হাতে নিয়ে ঘুরপাক খেয়ে নাচতে নাচতে ফিরে এলো আবার কস্তুরী ভোলানাথের পাশে। হাত ধরে উঠিয়ে নিলো ভোলানাথকে প্রায় একরকম জোর করে। ওর হাত ধরে নাচতে লাগলো কস্তুরীবাঈ নানা ভঙ্গীমায়।

এক ফাঁকে কস্তুরীবাঈ সরাবগুলো ফেলে দিলে ওদিকের একটা মাংসের পেয়ালার মধ্যে। তারপর ভোলানাথের মুখে চেপে ধরলো সরাব-পাত্র, যেন, ওকে জোরপূর্বক খাইয়ে দিলো সে তরল পদার্থগুলো।

কস্তুরীবাঈ-এর এই কাজ আর কেউ লক্ষ্য করলেও ভোলানাথের কাছে চাপা রইলো না। সে সরাব পানের অভিনয় করে গেলো কিন্তু ভিতরে ভিতরে অবাক হলো চরমভাবে।

কস্তুরীবাঈ ভোলার হাতে হাত রেখে সাহেবী ড্যান্স শুরু করলো।

মোদন আর দলবল আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছে। এমনভাবে ভোলানাথকে কোন নর্তকী আজও আয়ত্বে আনতে পারেনি।

রাত বেড়ে আসছিলো।

বার-গৃহ এক সময়ে লোকশূন্য হয়ে পড়লো।

ভোলানাথ বিদায় নিলো বার থেকে।

কস্তুরীবাঈ আর পিতা বেশ কিছুক্ষণ পূর্বে বার গৃহ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।

ভোলানাথবেশী বনহুর ফিরে এলো এক সময় কান্দাই আস্তানায়।

নূরী ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিলো বনহুরের জন্য। বনহুর আসতেই তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে এগিয়ে নিলো। অবাক হলো বনহুর আজ নূরীকে অন্যান্য দিনের চেয়ে আনন্দ-মুখর লাগছে।

বনহুর বললো– নূরী আজ রাগ করলে না তো?

আমি শপথ করেছি আর রাগ অভিমান করবো না।

হঠাৎ এমন সাধুতা লাভের কারণ?

কারণ আমি নিজেও সরাব পানে অভ্যস্তা হচ্ছি। বেশ ভাল লাগে কিন্তু…….।

সেকি!

হাঁ এই দেখো আমার মুখে গন্ধ লেগে আছে এখনও।

দেখো রে তুমি সরাব পান করবে আর আমি…..

বনহুর ঠাই করে একটা চড় বসিয়ে দিলো নূরীর গালে।

নূরী হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো বিছানার উপরে। ফুঁফিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো নূরী।

বনহুর ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো– নূরী এতো অধঃপতনে গেছো তুমি?

কি করবো, তুমি যতদিন ওসব পান করবে আমিও পান করবো।

আমি সরাব পান করেছি কে বললো?

তোমার মুখে এবং জামায় গন্ধ তুমি লুকিয়ে রাখতে পারবে না বুঝলে?

নূরী। আমি ওসব পান করিনি।

আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না।

বেশ যদি না করো তাহলে আমি অক্ষম। কিন্তু তুমি কোনদিন ঐ সব পান করতে পারবে না।

আগে তুমি সরাব ত্যাগ করবে তাহলে আমিও ত্যাগ করবো।

সত্যি!

হাঁ সত্যি বলছি!

বনহুর নূরীকে তুলে নিলো, মুখের কাছে মুখ নিয়ে বললো– বিশ্বাস করো নূরী আমি সরাব। পান করিনি।

সূরী স্বামীর বাহুবন্ধনে নিজকে বিলিয়ে দিলো।

পুলিশ অফিসে ব্যস্তভাবে পায়চারী করে চলেছেন ইন্সপেক্টার ইয়াসিন সাহেব। মুখভাবে তার দারুন দুঃচিন্তার ছাপ।

এমন সময় মোদন আর মানসিং এসে হাজির হলো সেখানে।

মিঃ ইয়াছিন তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বসালেন। তিনি জানেন এরা তাঁদের কাছে কোন প্রয়োজন খাতিরেই এসেছে। তাই মিঃ ইয়াসিন জিজ্ঞাসা করলেন– আজ কোন খবর আছে কি?

মোদন বললো– স্যার আমাদের নতুন কোন খবর নাই। শুধু জানতে এলাম আপনারা কেমন আছেন তাই।

মানসিং বলে উঠলো আপনাকে অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে স্যার?

হাঁ একটা ভয়ঙ্কর টেলিফোন এই মাত্র পেয়েছি।

ভয়ঙ্কর টেলিফোন!

ভয়ঙ্করই বটে। দস্যু বনহুর ফোন করেছিলো….

দস্যু বনহুর বলেন কি? বললো মোদন।

মানসিং বললো– দস্যু বনহুর পুলিশ অফিসে ফোন করেছিলো তার মানে?

ইয়াসিন সাহেব চেয়ার টেনে বসে পড়ে বললেন– দস্যু বনহুর টেলিফোনে আমাকে জানালো সে এক অদ্ভুত সংবাদ।

কি সংবাদ বলুন ইন্সপেক্টার?

বলছি। হাঁ-দস্যু বনহুর যা বলেছে, ইন্সপেক্টার কোলাইমহারাজ অচিরেই হরণ হবেন, তাকে সাবধানে রক্ষার ব্যবস্থা করবেন। যদি মহারাজের কোন অমঙ্গল হয় তা হলে আপনাদের মৃত্যু অনিবার্য। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কে আপনি? কোথা হতে বলছেন? ওপাশ থেকে জবাব এলো– আমি দস্যু বনহুর কথা বলছি। এবং কান্দাই শহরের কোন রিসিভার থেকেই বলছি…… তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর কোনও জবাব পাইনি।

মোদন আর মানসিং-এর মুখমণ্ডল কেমন যেন বিবর্ণ হলো। মুহূর্তে ওরা উভয়ে মুখ চাওয়া চাওয়ী করে নিলো।

মিঃ ইয়াসিন ভাবলো দস্যু বনহুরের নাম শুনে এরা ভয় পেয়ে গেছে, কিন্তু আসলে তারা ভাবছে তাদের গোপন আলোচনা কি করে দস্যু বনহুর জানলো।

মিঃ ইয়াসিন বললেন পুনরায় ব্যাপারটা অত্যন্ত রহস্যজনক কিছুদিন পূর্বে কোলাই মহারাজের একমাত্র সন্তান নিখোঁজ হয়েছে। আজও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি….

মোদন আর মানসিং মুখ চাওয়া-চাওয়ী করে বললো- এ সব কি আজগুবি ব্যাপার?

মিঃ হারুন এতোক্ষণ চুপ করেই ছিলেন তিনি বললেন– শুধু কোলাই-মহারাজের পুত্রই নিখোঁজ হয়নি স্যার। ইতিমধ্যে আমাদের পুলিশ ডায়েরীতে আরও কয়েকজন ব্যক্তির নিখোঁজ সংবাদ আছে। তাদের সন্ধানে পুলিশ জোর তদন্ত চালিয়ে চলেছে কিন্তু আজও একটি ব্যক্তিকেও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

মিঃ হারুনের কথা শেষ হয় না টেলিফোন বেজে উঠে ক্রিং ক্রিং করে।

মিঃ ইয়াসিন রিসিভার তুলে নিলেন হাতে–হ্যালো, স্পিসিং মিঃ ইয়াসিন…. কি বললেন আপনি …. আপনি দস্যু বনহুর বলছেন ……… কোলাই-মহারাজের একমাত্র সন্তানকেই দুষ্টু তোক হত্যা করেছে? কি আশ্চর্য নানা আমাদের কোন ত্রুটি নাই…… আমরা ঠিভাবেই কাজ করে চলেছি… কিন্তু …… কিন্তু কি করে যে এসব হচ্ছে…. আর কারাই বা করছে…

মোদন আর মানসিং মুখ কালো করে শুনছিলো কথাগুলো। মিঃ ইয়াসিনের উত্তরে সব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলো তারা। বুঝতে পারছিলো ওপাশে স্বয়ং দস্যু বনহুর কথা বলছে।

মিঃ ইয়াসিনের মুখমণ্ডলেও একটা ভীতিকর ভাব দেখা যাচ্ছিলো, তিনি কথা বলতে বেশ হাঁপিয়ে পড়ছিলেন বলে মনে হচ্ছিলো। রিসিভার রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে ললাটের বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে ফেললেন।

মানসিং আর মোদন বসেছিলো স্থির হয়ে কিন্তু মনের মধ্যে আলোড়ন চলেছে। মুখে কিছু বলতে পারছে না তারা। মিঃ ইয়াছিন রিসিভার রাখতেই নড়ে বসলো মোদন আর মানসিং।

মোদন বললো স্যার, আমাদের মনে হচ্ছে এ সবই দস্যু বনহুরের কারসাজী। সে নিজে নিতান্ত অর্থ পিপাসু। তারই ইংগিতে কান্দাই এবং আশে পাশের এলাকাগুলো থেকে প্রায় লোকজন চুরি হচ্ছে। তাদের কৌশলে বন্দী করে রেখে আত্মীয়-স্বজনদের নিকট হতে টাকা আদায় করে নিচ্ছে। আর নিজকে নির্দোষ রাখার জন্য টেলিফোনে পুলিশকে বার বার সাবধানী বাণী শুনাচ্ছে।

মিঃ ইয়াসিন গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ঠিক বলেছেন আপনি মিঃ মোদন বাবু।

মোদন বলে আবার ইন্সপেক্টার দস্যু বনহুর অত্যন্ত আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। আমাদের উপর তার চরম আক্রোশ। অনুগ্রহপূর্বক আমার বার-এর প্রতি আপনারা পুলিশমহল কৃপা-দৃষ্টি রাখবেন।

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। পুলিশ মহল শুধু আপনাদের নয় সমস্ত জনগণের মঙ্গলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবে।

ধন্যবাদ ইন্সপেক্টার। চলি তাহলে আমরা?

আচ্ছা আসুন। বললেন মিঃ ইয়াসিন।

মোদন আর মানসিং বেরিয়ে গেলো পুলিশ অফিস থেকে।

মিঃ ইয়াসিন এই সংবাদ জানানোর জন্য চললেন তিনি পুলিশ সুপারের অফিসে।

সঙ্গে মিঃ হারুন এবং দু’জন পুলিশ নিলেন তিনি।

এখানে যখন পুলিশ অফিসে ফোন করছিলো দস্যু বনহুর, তখন সে তার কান্দাই শহরের আস্তানা থেকেই করেছিলো।

রিসিভার রেখে ফিরে দাঁড়াতেই দেখলো বনহুর তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে এলিন।

বনহুর বললো– এলিন কেমন আছো?

এলিন অভিমানে মুখ ভার করে বললো- ভাল না।

বনহুর অবাক হয়ে বললো– ভাল না! কোন অসুখ-বিসুখ হয়নি তো?

না।

তবে কি ওরা তোমার প্রতি কোন…..

না, ওরা আমার কোন অনিষ্ট করেনি। ওরা সব সময় আমাদের যত্ন নিয়েছে। আমার কোন অসুবিধা হয়নি…..

তাহলে ভাল নয় বললে যে?

সেই যে রেখে গেলেন তারপর আর আসেননি কেন?

অনেক কাজ এলিন, তাই আসতে পারিনি।

এলিন আর বনহুর পাশাপাশি এগিয়ে চললো।

বনহুর এসে বসলো নিজের বিশ্রাম কক্ষে।

এলিন বললো মিঃ শোহেল আপনি বড় খেয়ালী মানুষ। না হলে এমন ভাবে ভুলে যান আমাকে? বলুন তো সত্য কিনা?

হেসে বললো বনহুর ভুলিনি এলিন। তুমি বিশ্বাস করো আমাকে। শুধু কাজের চাপে তোমার কাছে আসতে পারিনি। অবশ্য তোমার সংবাদ আমি সব সময় পেয়েছি এলিন।

এলিন বনহুরের পাশে চেয়ারের হাতলে ঘনিষ্ট হয়ে বসে– মিঃ শোহেল

বল এলিন?

এলিন এবার বনহুরের কণ্ঠ বেষ্টন করে আবেগভরা কণ্ঠে বললো– কতদিন এমনি করে। আমাকে এড়িয়ে চলবেন মিঃ শোহেল?

হঠাৎ এলিনের আবেগভরা কঠিন প্রশ্নে বনহুর চমকে উঠলো। কই এ কথা সে তো কোনদিন ভাবেনি। এলিন যে তারই জন্য বিপুল আগ্রহ নিয়ে প্রতিটি মুহূর্তে অপেক্ষা করে চলেছে।

বনহুরকে নিরুত্তর দেখে বললো এলিন আমার আমি প্রথম হতে আপনাকে লক্ষ্য করে এসেছি, আপনি আমাকে সব সময় …

বনহুর বলে উঠলো– এলিন তুমি আবার সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানো না, এবং জানোনা বলেই তুমি আমাকে ভুল বুঝছো?

মিঃ শাহেল আমি কিছুই জানতে চাই না। শুধু চাই আমি আপনার প্রেম-ভালবাসা আর। আপনাকে, মিঃ শোহেল আমি ভালবাসি আপনাকে।

বনহুর হেসে বললো– আমিও তোমাকে ভালবাসি এলিন কিন্তু………. থাক্‌ আজ নাইবা শুনলে। এলিন এখানে তোমাকে কেমন লাগছে তাতো বললে না?

বনহুর এলিনকে অন্য মনস্ক করার চেষ্টা করে।

এলিন বলে– ভাল লাগছে, কিন্তু একা একা নিজকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হয় মিঃ শোহেল। আমি বড় অভাগিনী মেয়ে, জন্মের পর থেকে কোন দিন সঙ্গী-সাথী পাইনি। শিশু বেলায়, জানি পিতা-মাতা কে ছিলেন কেমন ছিলেন। ভাই বোন ছিলো কিনা তাও জানি না। নিষ্ঠুর নিঃসঙ্গ পরিবেশে মানুষ হয়েছি। শিশুকালে যেমন খেলার সাথী পাইনি, তেমনি বালিকা বয়সে পাইনি কোন বান্ধবী। যখন বড় হলাম তখন বুঝলাম আমি সত্যি বড় একা….. বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এলো এলিনের গলা।

বনহুর স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে এলিনের মুখের দিকে। বড় অসহায়া যুবতী এলিন। কিন্তু কি করতে পারে সে তার জন্য? এলিনকে সব দিতে পারে সে– অর্থ, ঐশ্বর্য, সম্পদ যা ওকে রাজরাণী অপেক্ষা সুখে রাখবে। কিন্তু তাহলেই কি এলিন সুখী হবে? বনহুর গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যায়।

এলিন বলে– মিঃ শোহেল আপনাকে আমি আমার নিঃসঙ্গ জীবনের…

এলিনের মুখে হাত চাপা দেয় বনহুর– কে যেন আসছে এলিন।

অল্পক্ষণে কায়েস এসে হাজির হয়, কুর্নিশ জানিয়ে বলে একটি সংবাদ আছে।

চলো আসছি।

কায়েস চলে যায়।

বনহুর বলে– এলিন আজকের মত আমাকে যেতে হবে। আবার কবে আসবেন মিঃ শোহেল!

সময় পেলেই আসবো! তাছাড়া এটাও তো আমার বাড়ি, কাজেই আসতে হবে। চলি কেমন?

আচ্ছা।

বনহুর বেরিয়ে যায়।

কায়েস বাইরেই অপেক্ষা করছিলো, বনহুরকে দেখে বলে উঠলো– সর্দার একটা জরুরি সংবাদ আছে।

চলো ওদিকে।

বনহুর ভূগর্ভ দরবার কক্ষে প্রবেশ করলো। সর্দার দরবার কক্ষে গমন করেছে শুনে শহরের আস্তানার অনুচরগণ সবাই তটস্থ হয়ে প্রবেশ করলো সেই কক্ষে।

বনহুর আর কায়েস সুউচ্চ আসনের পাশে এসে দাঁড়ালো। অন্যান্য অনুচর-দল সম্মুখে। দাঁড়ালো, সকলের দৃষ্টি সর্দারের দিকে।

বনহুর কায়েসকে লক্ষ্য করে বললো– বলো কি সংবাদ?

সর্দার বলছি! কাপড়ের মধ্যে হতে বের করলো একটা ছোট্ট টেপ-রেকর্ড বাক্স।

বনহুর বললো– ওটা কেনো?

সর্দার গোপন রহস্যকে আমি টেপ রেকর্ডে ধরে এনেছি। বনহুরের হাতে না দিয়ে কায়েস টেপ-রেকর্ড চালু করে উচ্চ আসনের উপরে রাখলো।

প্রথম সাউণ্ড হতেই বনহুর চমকে উঠলো এ যে মোদনের গলার আওয়াজ,—- মালিক পাঁচ শত ব্যাগ চাউল মুঙ্গের সুরঙ্গ মধ্যে গোপনে সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে—- আপনার হুকুম হলেই ব্যাগগুলো পাঠাবো…. অপর একটা আওয়াজ, এ শব্দও বনহুরের পরিচিত। বনহুর বারগৃহের গুপ্তকক্ষে অদৃশ্য কোন কণ্ঠে শুনেছিলো। কাল রাতে ঠিক দুটোর সময় গাড়ি যাবে, তোমরা ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলে দিও … রাতারাতি বর্ডার পার হয়ে গাড়িগুলো যেন বাইরে চলে যায়… আবার মোদনের গলা…….মালিক আপনার কথা মতই কাজ হবে …. তারপর ঘর ঘর আওয়াজ, পরে সম্পূর্ণ নীরব।

কায়েস টেপ রেকর্ড মেসিন বন্ধ করে দেয়।

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বলে– এ সংবাদ তুমি কোথা হতে সংগ্রহ করলে কায়েস?

কায়েস হঠাৎ কোন জবাব দিতে পারলো না।

বনহুর বললো– ঠিক রহমান এই সংবাদ সংগ্রহ করেছে?

হাঁ হাঁ সর্দার… কিছু যেন গোপন করার চেষ্টা করলো কায়েস।

রহমান কোথায়?

সর্দার, কান্দাই জঙ্গলের আস্তানায়।

কায়েস এখানে যারা আছে তারা কি সবাই উপস্থিত আছে?

আছে সর্দার।

বনহুর সকলকে লক্ষ্য করে বললো তোমরা সবাই টেপ রেকর্ড সংবাদ শুনেছো?

হাঁ সর্দার! এক সঙ্গে বললো সবাই।

বনহুর বললো–এই চাউলের ব্যাগগুলো আমাদের প্রয়োজন বুঝলে? কারণ, কান্দাই থেকে চাউল বাইরে বাইরে চলে যাচ্ছে আর কান্দাই-এর শত শত লোক না খেয়ে ধুকে ধুকে প্রাণ। হারাচ্ছে। এ চাউলের ব্যাগগুলো নেওয়ার জন্য চারখানা ট্রাক সগ্রহ করবে। এবং কাল রাত দুটোর পূর্বে মুঙ্গের সুরঙ্গ মধ্যে হাজির হবে। আমিও উপস্থিত থাকবো সেখানে।

শহরের আস্তানার বনহুরের সহকারী হলো সর্দার রুস্তম। রুস্তমের উপর দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নিলো বনহুর সেদিন।

বহুর কান্দাই জঙ্গলে ফিরে গেলো, এবং পরদিন মুঙ্গের সুরঙ্গ হতে চাউল উদ্ধারের জন্য দলবলকে প্রস্তুত হবার জন্য নির্দেশ দিলো।

নূরী সব শুনে বললো– কেন তুমি আবার এ কাজে যাচ্ছো হুর? কি প্রয়োজন ওদের চাউল লুটে নেবার?

বনহুর গম্ভীর কণ্ঠে বললো– কান্দাই থেকে কান্দাই– এর খাবার চাল যাবে বাইরে, আর কান্দাই-এর শত শত লোক না খেয়ে মরবে?

তুমি ও চাউল কি করবে হুর?

যারা খেতে পায় না, যারা এক মুঠি অন্নের জন্য তিল তিল করে ধুকে মরছে, আমি ঐ চাউল তাদের ঘরে পৌঁছে দেবো নূরী।

নূরীর চোখ দুটো অশ্রু ছল ছল হয়ে উঠলো, সে বললো– আল্লা যেন তোমাকে হিম্মৎ দেন! তুমি যেন জয়ী হও বনহুর।

নূরী তোমার দোয়া আমার পাথেয়।

পরদিন।

বনহুর দলবল নিয়ে প্রস্তুত হয়ে নিলো।

কান্দাই জঙ্গল মধ্যে জমকালো পোশাক পরিহিত দস্যু বনহুরদল এক একটা অশ্বপৃষ্টে চেপে বসলো।

বনহুর আর রহমান সর্বপ্রথম রয়েছে।

বনহুর তাজের পিঠে, আর রহমান দুলকীর পিঠে।

জমকালো পোশাকে আচ্ছাদিত তাদের দেহ। মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির কিছুটা অংশ দিয়ে মুখের নীচ ভাগ ঢাকা। পায়ে ভারী বুট, কোমরের বেল্টে রিভলভার, পিঠে রাইফেল ঝুলছে।

বনহুরের অশ্ব তাজ প্রভুকে পিঠে পেয়ে সম্মুখের দু’পা উঁচু করে আনন্দে চিহি চিঁহি শব্দ করে উঠলো। তারপর উল্কা বেগে ছুটতে শুরু করলো।

অল্পক্ষণেই দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেলো সবগুলো অশ্ব। নূরী আর নাসরিন আস্তানার মুখে দাঁড়িয়েছিলো অস্ফুট কণ্ঠে বললো নূরী–খোদা, তুমি ওকে হেফাযতে রেখো।

ফিরে এলো নাসরিন আর নূরী।

মুঙ্গের সুরঙ্গ মধ্যে হানা দিয়ে দস্যু বনহুর লুটে নিলো মোদনের পাঁচশত ব্যাগ চাউল। চারখানা ট্রাক বোঝাই করে চাউলের ব্যাগগুলো উঠানো হলো।

বনহুর আদেশ করলো– রহমান সবাইকে বেঁধে চাউলের ব্যাগ যেখানে ছিলো সেখানে এদের রেখে দাও।

বনহুরের আদেশ মত কাজ হলো।

রাত দুটো বাজবার পূর্বেই চাউলের ব্যাগগুলো নিয়ে বনহুরের দল বিদায় নিলো।

রাত দুটোর সময় মোদন হাজির হলো তার দলবল এবং গাড়ি নিয়ে। মুঙ্গের সুরঙ্গ মধ্যে প্রবেশ করে শিউরে উঠলো। বার বার শিস দিয়েও কোন সাড়া পেলো না তার কোন অনুচরের।

মোদন ক্ষেপে গিয়ে বললো– শয়তানগুলো গেলো কোথায়?

মশাল নিয়ে সন্ধান করতে গিয়ে তাদের নজরে ধরা পড়লো যেখানে চাউলের বস্তাগুলো রাখা হয়েছিলো সেখানে তাদের দলবলের সবাই হাত-পা মুখ বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।

মুহূর্তে মোদনের চোখ আগুনের ভাটার মত জ্বলে উঠলো। তীব্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠলো– একি দেখছি আমি!

মোদনকে লক্ষ্য করে বললো মানসিং– ওস্তাদ, চাউলের ব্যাগ উধাও হয়েছে! কে বা কারা আমাদের লোকজনকে হাত-পা বেঁধে রেখে সব নিয়ে গেছে

মোদন পূর্বের ন্যায় চিৎকার করে বললো– কার এমন সাহস যে আমার অনুচরদের বেঁধে রেখে পাঁচশত ব্যাগ চাউল নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। খুলে দাও, এদের বন্ধন খুলে দাও মানসিং..

মানসিং তার সঙ্গীদের ইংগিত করলো সকলের হাত-পা মুখের বাঁধন খুলে দিতে।

হঠাৎ মানসিং-এর দৃষ্টি পড়লো একখানা কাগজের উপর। তাড়াতাড়ি কাগজখানা তুলে নিয়ে অবাক হয়ে বললো- ওস্তাদ দস্যু বনহুর……।

অকস্মাৎ যেন বজ্রধ্বনি করে উঠল মোদন– কোথায়? কোথায় সে?

ওস্তাদ এই দেখুন। মোদনের হাতে দিলো কাগজখানা।

মোদন মশালের আলোতে কাগজখানা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো- দস্যু বনহুর! আমি যা সন্দেহ করেছিলাম তাই হল। দস্যু বনহুর সব নিয়ে উধাও হয়েছে এবং যাবার সময় তার নাম সই করা কাগজের টুকরাখানা রেখে গেছে।

মানসিংহ বললো– কত বড় দুঃসাহসী সে, জানিয়ে গেছে ব্যাগগুলো আমিই নিলাম। ঐ কাগজখানা রেখে না গেলে আমরা তাকে সন্দেহ নাও করতে পারতাম তো।

ততক্ষণে মোদনের অনুচরগণ বন্ধন-যুক্ত অনুচরদের বন্ধন মুক্ত করে দিয়েছে। সবাই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো এবার। এতোক্ষণ মুখ বাঁধা থাকা কোনরকম শব্দ উচ্চারণ করতে পারেনি।

সবাই কাঁদতে লাগল আর মোদনের পায়ে ধরে বলতে লাগলো ওস্তাদ আমাদের কোন। অপরাধ নেই। দস্যু বনহুর আমাদের বেঁধে রেখে সব চাউল নিয়ে গেছে…….

কঠিন কণ্ঠে গর্জে উঠলো মোদন–যত সব অকেজো অপদার্থের দল……. কথার সঙ্গে সঙ্গে পদাঘাত করলো এক এক জনের বুকে।

মোদনের লাথি খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো কেউ বা উবু হয়ে, কেউ বা মুখ থুবড়ে, কেউ বা চীৎ হয়ে! মোদন ক্রুদ্ধ জানোয়ারের মত ফোঁস ফোঁস করে ফুলতে লাগলো। চোখ মুখ ওর কালো হয়ে উঠেছে শয়তানের মুখের মত। চিৎকার করে বললো– সবাইকে বেঁধে চাবুক লাগানো হবে। পিঠের চামড়া কেটে রক্ত বের করে দিতে হবে। দস্যু বনহুরের দল শুধু মানুষ আর তোমরা কি পশু?

মানসিং বলে উঠলো– পশুর তবু শক্তি আছে, এরা পশুর অধম গর্দভ-এর চেয়েও অক্ষম—— কথাটা বলে মানসিং একজনকে পদাঘাত করলো।

লোকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ভূতলে।

মোদনের রাগ তখনও পড়েনি, পায়চারী করতে লাগলো আর বলে চললো– দস্যু বনহুর দস্যু বনহুর– আমি দস্যু বনহুরকে সমুচিত শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবো না। পাঁচশো ব্যাগ চাউল গেছে যা লাখ ব্যাগ চাউল আবার সংগ্রহ করবো।

অট্ট হাসিতে ভেঙে পড়ে বনহুর হাঃ হাঃ করে।

মনিরা পত্রিকা খানার দিকে তাকিয়ে বলে– অর্থ হরণ ত্যাগ করে এবার চাউল হরণে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। কবে শুনবো দস্যু বনহুর নারী হরণ শুরু করেছে।

প্রয়োজন হলে নারী হরণ কেননা সব কিছুই হরণ করতে পারে দস্যু বনহুর। মনিরা তুমি মিছেমিছি বেশি ভাবছো?

এতো চাল কি করবে তুমি?

কেন আমার কি মুখ নেই? খাবো।

আবার ঠাট্টা শুরু করলে?

কে বলে দস্যু বনহুর তার প্রিয়তমার সঙ্গে ঠাট্টা করতে পারে। বনহুর মনিরাকে চিবুকটা উঁচু করে ধরে।

মনিরা স্বামীর হাতখানা সরিয়ে দিয়ে বলে– কতকাল তুমি আর এমনি করে আমাকে ভোগাবে বলো?

বনহুর বিছানায় বসে মনিরাকে টেনে নেয়, বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে– মনিরা জানি না কবে আমি তোমার মনের মত হবো। জানি না আমার জীবনের অভিশাপ কবে মুক্ত হবে। মনিরা, আমি ইচ্ছে করে কোনদিন দস্যুতা করি না। আমার বিবেক আমাকে দস্যুতায় উত্তেজিত করে। আমি চাই অন্যান্যের মত নিজকে স্বাভাবিক করে নিতে কিন্তু কেন– কেন পারি না? কেন আমি নিজের কাছে নিজেই হারিয়ে যাই……

মনিরা বলে উঠে- তুমি না শপথ করেছিলে সংসারী হবে?

পারলাম কই! শপথ রক্ষা করতে পারলাম কই! বড়ই দুঃখ তোমাকে কথা দিয়ে কথা রাখতে পারিনি। মনিরা বিশ্বাস করো আমি মনেপ্রাণে সংসারী হতে চেয়েছি, কিন্তু কিসের ডাকে আমি ভুলে যাই আমার শপথ, সব প্রতিজ্ঞা। ছুটে যাই আমি সেই অদৃশ্য শক্তির অসীম আকর্ষণে। আমাকে তুমি ক্ষমা করো মনিরা। হাঁ, তুমি বললে অতো চাল আমি কি করবো। মনিরা তুমি জানো না কত শত শত মানুষ আজ ক্ষুধার জ্বালায় ধুকে ধুকে মরছে। কত শিশু না খেয়ে মায়ের শুকনো বুক কামড়ে খাচ্ছে। কত বালক ক্ষুধার নিষ্পেষণে পথে পথে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছে। কত নারী তার অমূল্য ইজ্জত নষ্ট করে দিচ্ছে ক্ষুধার তাড়নায়। কত যুবক মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, তবু বৃদ্ধ-পিতা-মাতার ক্ষুধা নিবারণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তখন তারা বেছে। নিচ্ছে অসৎ উপার্জন— আরও কত শুনতে চাও মনিরা? বড় লোকের আদরিণী কন্যা তুমি, বড় লোকের পুত্রবধু তুমি, তুমি বুঝবে না মনিরা এই সুন্দর পৃথিবীর নীল আকাশের তলে কত বিচিত্ররূপের খেলা চলেছে। কেউ অরুচিবোধে খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে, কেউ ক্ষুধার অতিষ্ঠ হয়ে। ডাস্টবিন থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে।

চুপ করো– চুপ করো আমি শুনতে পারছি না। যা খুশি তাই করো। আমি আর বলবো না কিছু …।

মনিরা, এদের দুঃখ যদি তুমি একবার স্বচক্ষে দেখতে তাহলে বুঝতে, তুমিও পারতে না স্থির হয়ে থাকতে। এ পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ আছে কিন্তু কে কার জন্য ভাবে বলো। স্বার্থান্ধ। মানুষ শুধু চায় নিজের ভাল, নিজের মঙ্গল। নিজে কিসে দালান কোঠায় বাস করবে। কেমন করে বাড়ির গেটে পাগড়ি ওয়ালা পাহারাদার রাখবে। কেমন করে লোকের কাছে স্বনামধন্য ব্যক্তি বলে। পরিচিত হবে। কেমন করে সুস্বাদু খাবারে উদর পূর্ণ করবে। কেমন করে দেহের পুষ্টিবর্ধন করবে সদা এই চিন্তা। নিজে খাচ্ছে পাশে তারই ভাই না খেয়ে শুকিয়ে মরছে। নিজে দালান কোঠায় সুখে নিদ্রায় মগ্ন রয়েছে। পাশের জীর্ণ কুড়ে ঘরে তারই ভাই রোদ-বৃষ্টি ঝড়ে অনিদ্রায় রাত কাটাচ্ছে কে তার খোঁজ রাখে! গাড়ি-বাড়ি ঐশ্বর্যের মায়ায় অন্ধ সবাই। সবাই চায় বাঁচতে, বাঁচাতে। চায় না কেউ কাউকে। এই সুন্দর পৃথিবীর মানুষগুলো কত নির্মম আর হৃদয়হীন। পশু তবু উদর পূর্ণ হলে আহারে ক্ষান্ত হয়। মানুষের উদর পূর্ণ হয় না কোনদিন, যত পায় আরও চায় তারা। কেমন করে গরিবের বুকের রক্ত শুষে খাবে সেই চিন্তায় অস্থির থাকে ……….

এমন সময় নূর এসে পড়ে ক্ষান্ত হয় বনহুর।

মনিরা মাথার কাপড় টেনে দিয়ে সরে বসে।

নূর বলে উঠে– আবু সবাই বলে দস্যু বনহুর নাকি খুব ভয়ঙ্কর আর নির্দয়? জানো আব্বু আম্মি কি বলে?

কি বলে তোমার আম্মি?

আম্মি বলে দস্যু বনহুরের মত নাকি দয়ালু আর দ্বিতীয় জন নেই। দস্যু বনহুর নাকি ভয়ঙ্কর নয় খুব সুন্দর সুপুরুষ…..

বনহুর নূরকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বলে–তোমার আম্মি সব মিথ্যা কথা বলেছে। তুমি তোমার আম্মির কথা বিশ্বাস করো না।

তুমি দস্যু বনহুরকে দেখেছো আব্বু?

দেখেছি।

সত্যি! সত্যি তুমি দস্যু বনহুরকে দেখেছো?

হা।

কেমন দেখতে বলো না আব্বু?

সর্বনাশ বললে, তুমি এক্ষুণি ভয় খেয়ে যাবে।

পিতা-পুত্র যখন কথা হচ্ছিলো তখন মনিরা স্বামীর জন্য খাবার জোগাড়ে চলে যায়। যাবার সময় ছোট্ট করে বলে– এতো দুষ্টুমি ছেলের সঙ্গে করতে আছে ……….

বনহুর পুত্রের অলক্ষ্যে স্ত্রীর মুখে তাকিয়ে একটুখানি হাসে।

পিতার কোলে প্রবেশ করে বলে নূর তুমি বলো আব্বু আমি একটুও ভয় পাবো না।

সত্যি ভয় পাবে না?

না। বলো আব্বু?

বনহুর একটু চিন্তা করলো তারপর বললো– যদি বলি আমার মত?

বাঃ, তুমি তো খুব সুন্দর।

কেনো দস্যু বনহুর কি সুন্দর হতে পারে না নূর?

উঁ হুঁ রাক্ষসের মত নাকি তার দেহটা। এ তো বড় মাথা। মস্ত বড় বড় চোখ ……।

তারপর বলো।

হেঁইয়া মোটা মূলোর মত দাঁত।

বলো বলো এই তো সব তুমি ঠিক ঠিক বলছো। আমি দেখেছি তবু বলতে পারছি না আর তুমি দেখো না দেখেই কত সুন্দর বলছো। বলো চুলগুলো কেমন? ঠিক ঝাড় র মত তাই না?

হাঁ, আমাদের স্কুলের ছেলেরা বলে খুব ভয়ঙ্কর দেখতে।

ও বুঝেছি ওরা সবাই দেখেছে তাই না?

দেখেনি, শুনেছে।

আচ্ছা আমি একদিন তোমাকে দেখাবো ভয় করবে না তো?

একদম ভয় করবো না। তোমার কোলে লুকিয়ে দেখবো কেমন?

মনিরা খাবার প্লেট হাতে ঘরে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলো এমন সময় সরকার সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। এতোগুলো সিঁড়ি অতিক্রম করে দ্রুত আসতে রীতিমত হাঁপিয়ে পড়েছিলেন তিনি। মনিরাকে লক্ষ্য করে বললেন– মুনিরা পুলিশ এসেছে।

পুলিশ! অস্ফুট শব্দ করে উঠে মনিরা। হাত থেকে খাবারের প্লেট পড়ে যাচ্ছিলো কোন রকমে শক্ত করে ধরে বলে– কোথায় পুলিশ?

হল ঘরে! বাড়ি সার্চ করবে।

তাহলে উপায়?

পিছনে এসে দাঁড়ায় বনহুর, নূরের হাত ধরে রয়েছে সে। মনিরাকে কথায় বললো– উপায় আমিই বলে দেবো চলুন সরকার সাহেব।

এক সঙ্গে সরকার সাহেব এবং মনিরা অবাক হয়ে তাকায় বনহুরের মুখের দিকে।

মরিয়ম বেগমও হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন সেখানে। তিনিও হতভম্ব ভয়-বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। রান্না ঘরে রান্না করছিলেন সেখানে কে যেন গিয়ে খবর দিয়েছে হল ঘরে পুলিশ এসেছে। কথাটা শোনা মাত্র ব্যস্ত সমস্ত হয়ে ছুটে এসেছেন তিনি উপরে। আশঙ্কায় দুলে উঠেছে মায়ের প্রাণ।

বনহুর বললো– চলুন——

বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো মরিয়ম বেগম আর মনিরা, বনহুরের নূরের হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো নিচে।

পিছনে সরকার সাহেব।

হল ঘরে প্রবেশ করতেই পুলিশ ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন উঠে দাঁড়ালেন।

বনহুর হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলো তার।

মিঃ ইয়াসিন বললেন– আমি একবার বাড়িটা পরীক্ষা করে দেখতে চাই?

বনহুর মৃদু হেসে বললো- হঠাৎ কি মনে করে?

আপনি জানেন না আমরা কেন এসেছি।

কেন?

দস্যু বনহুরের জন্য।

অবাক হয়ে বললো বনহুর দিন দুপুরে দস্যু বনহুর আসবে এখানে? আশ্চর্য পুলিশের লোক আপনারা!

আমরা হুকুমের চাকর …….চলুন বাড়িটা ইকোয়ারি করে দেখবো।

বেশ চলুন।

বনহুর পুলিশ ইন্সপেক্টার সহ উপরে এলো।

প্রত্যেকটা ঘরখানা তল্লাসী করে ফিরে এলেন– ইন্সপেক্টার ইয়াসিন এবং তাঁর সহকারীদ্বয়। বিদায় চাইলেন তারা।

বনহুর বললো– চা পান করে তবে যেতে পারবেন। বসুন আপনারা।

অগ্যতা বসলেন মিঃ ইয়াসিন ও তার সহকারীদ্বয়।

বনহুর সরকার সাহেবকে বললেন– যান সরকার সাহেব এঁদের জন্য খাবার এবং চা নিয়ে আসুন। এরা বড় ক্লান্ত……

নানা এসব আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে।

বনহুর বললো– নূর তুমিও যাও সরকার দাদুর সঙ্গে কেমন? নূরকে ভুলিয়ে সরিয়ে দিলো বনহুর।

বনহুর এবার পকেট থেকে সিগারেট ক্যাসটা বের করে বাড়িয়ে ধরলো– নিন।

মিঃ ইয়াসিন এবং সহকারীদ্বয় সিগারেট হাতে উঠিয়ে নিলেন। বনহুর নিজে ওদের সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে নিজের সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করলো।

বনহুরের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গেলেন পুলিশ অফিসারয়। মিঃ ইয়াসিন বললেন– আপনি বুঝি ….

আমি জামাতা। চৌধুরী সাহেবের কন্যার———–

ও বুঝেছি। আপনার নামটা, যদি কিছু মনে না করেন।

আমার নাম মিঃ শোহেল।

ধন্যবাদ।

ততক্ষণে সরকার সাহেব বয়ের হাতে চা-নাস্তার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হলেন।

চা-নাস্তা ভক্ষণের পর বিদায় গ্রহণ করলেন ইন্সপেক্টারয়। বনহুর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলো।

যাবার সময় পুলিশ অফিসারত্ৰয় বনহুরকে হ্যাঁণ্ডসেক করলেন। ফিরে এলো বনহুর অন্তঃপুরে।

মনিরা নিশ্বাস ফেলে বাঁচলো।

মরিয়ম বেগম খোদার কাছে শুকরিয়া করলেন।

সরকার সাহেবও দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হলেন!

কেবল নূর বুঝলো না কিছু।

মনিরা বললো– কি দুঃসাহস তোমার?

আমি জানতাম যারা আমাকে চিনে তারা এখন নেই। সবাই নতুন পুলিশ অফিসার কাজেই সাহসের কোন প্রয়োজন ছিল না। নিজকে চৌধুরী জামাতা বলে চালিয়ে নিয়েছি।

মনিরা হেসে বলে মিথ্যা বলতে একটু বাধলো না?

কেন আমি জামাতা নই? যাক্ ও সব কথা– মনিরা আর বিলম্ব করা মোটেই উচিৎ হবে, হঠাৎ ফেসে যেতে পারি।

হ তুমি এবার যাও।

মরিয়ম বেগম এবং মনিরার কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসতেই নূর পথ রোধ করে দাঁড়ালো– আব্বু আমি যাবো তোমার সঙ্গে।

পরে যেও কেমন?

আচ্ছা।

বনহুর পুত্রের গণ্ডে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

গাড়ি বারেন্দায় অপেক্ষা করছিলো, বনহুর গাড়িতে বসে স্টার্ট দিলো। মনিরা স্বামীর পিছনে পিছনে গাড়ীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো, নূরকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে স্বামীকে লক্ষ্য করে বললো– খোদা হাফেজ।

বনহুর হাত নেড়ে বিদায় গ্রহণ করলো।

বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা হাঁপানি রোগে ভুগছে। বেচারী টাঙ্গা নিয়ে বেরিয়ে ছিলো কিন্তু কেউ তার টাঙ্গায় চাপেনি। একটি পয়সা রোজগার হয়নি তার।

সন্ধ্যার পর ফিরে এলো বেচারী রিক্ত হস্তে।

ছোট ছোট বাচ্চা-কাচ্চা এরা সবাই পিতার ফিরে আসার প্রতিক্ষায় ছিলো। পিতা ফিরে আসতেই সবার তাকে ঘিরে ধরলো আব্বা খাবার এনেছো, আব্বা খাবার এনেছো?

কি জবাব দিবে বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালা, ছল ছল চোখে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললো- আজ তোমাদের জন্য কিছু আনতে পারিনি-রে। আজ একটি পয়সা ও কামাই হয়নি।

বাচ্চাগুলো সারাদিন অভুক্ত, পিতার কথায় ওরা কাঁদতে শুরু করে দিলো। বৃদ্ধা মা অসহায় ভেবে চোখের পানি মুছতে লাগলো কিইবা উপায় আছে তার করার।

রাত বেড়ে আসছে বাচ্চাগুলোর কান্না যেন থামতে চায় না। ছোটগুলো কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছে।

বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালাই বা কি করবে তারই কি কম ক্ষুধা পেয়েছে। একে বৃদ্ধ তারপর অসুস্থ।

জায়নামাজে বসে চোখের পানি ফেলে সে নীরবে। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ে।

বৃদ্ধ টাঙ্গাওয়ালার আত্মা কেঁপে উঠে আতঙ্কে, না জানি কোন চোর ডাকু এসে তার দরজায় ধাক্কা দিলো। বললো বৃদ্ধ- কে?

দরজার বাইরে আওয়াজ হলো– দরজা খোল।

বৃদ্ধ ভয়-কম্পিত হৃদয় নিয়ে দরজা খুলে দিলো বিস্ময়-ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখলো দু’জন লোক দাঁড়িয়ে আছে, পিঠে দুটো বস্তা।

বৃদ্ধ দরজা খুলে দিতেই লোক দুজন পিঠে বস্তাসহ প্রবেশ করলো ভিতরে।

বৃদ্ধা এবং বাচ্চারা অবাক হয়ে গেলো।

লোক দু’জন বস্তা দুটো মেঝেতে নামিয়ে রেখে বললো- এতে চাউল আছে তোমরা রান্না করে খাবে বুঝলে? আর এই নাও টাকা। একটা টাকার থলে বের করে দিলো বৃদ্ধের হাতে।

বৃদ্ধের দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময়, সে হতভম্ব হয়ে গেছে একেবারে এতরাতে কে এরা? আর চাউলের বস্তা নিয়ে এসেছে, সে তো স্বপ্ন দেখছে না?

বৃদ্ধ কিছু বলার আগেই বেরিয়ে যায় তোক দুটো।

বৃদ্ধ ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

বিধবা মা তার এক গাদা ছেলে–মেয়ে নিয়ে কোন রকমে দিন কাটায়। হঠাৎ বিধবা অসুস্থ। হয়ে পড়েছে আজ ক’দিন হলো। ঘরে এক মুঠি খাবার নাই। ছেলে-মেয়েরা কেঁদে কেঁদে অস্থির হয়ে পড়েছে।

হঠাৎ দরজায় ধাক্কা পড়ে।

গভীর রাতে কে দরজায় আঘাত করলো। শিউরে উঠে বিধবা মহিলা। ভয়-বিহ্বল গলায় বলে –কে? কে দরজায়?

জবাব আসে–দরজা খোল।

বিধবা কম্পিত কণ্ঠে বলে–বাবা আমার ঘরে কিছু নাই, কি নেবে তোমরা—-মহিলা চোর বা ডাকু মনে করে কথাগুলো বলে।

দরজার বাইরে থেকে পুনরায় শোনা যায় পুরুষ–কণ্ঠ-ভয় নেই মা দরজা খোল।

বিধবা বেতস-পত্রের মত থর থর করে কাঁপছিলো দরজা খুলে দিতেই দু’জন লোক দুটো বস্তা পিঠে প্রবেশ করলো কক্ষমধ্যে।

বিধবা বিস্ময়-ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে, এরা কারা? ওদের পিঠে বস্তা কেনো? কিই বা আছে ও বস্তায় কে জানে। লোক দুটো বস্তা নামিয়ে রাখলো এক পাশে, বললো একজন– এতে তোমাদের খোরাকী আছে, খেয়ো। আর এই নাও কিছু টাকা খরচ করো।

বিধবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো, সে ভেবেছিলো এতো রাতে নিশ্চয়ই কোন চোর ডাকু হামলা করে তাদের যা সামান্য জিনিস পত্র আছে সব লুটে নিয়ে যাবে। কিন্তু তার পরিবর্তে এ কি? এরা কি খোদার ফেরেস্তা না অন্য কেউ।

মহিলা কোন কিছু বলার পূর্বেই বেরিয়ে যায় লোক দু’টো।

মহিলা বস্তা খুলে অবাক হয়, এক সঙ্গে এতো চাউল সে বহুদিন দেখেনি আর এতো পয়সা।

মনের আনন্দে রান্না চড়িয়ে দেয় মহিলা।

বনহুর তার আস্তানায় বসে পচ শত বস্তা চাউল কান্দাই শহরের দুঃস্থ অসহায়দের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলো। চাউলের বস্তাগুলোর সঙ্গে কিছু কিছু অর্থও দিলো সে প্রত্যেককে।

কিন্তু কেউ জানে না এ চাউল আর অর্থ কে তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিলো, আর কেনোই বা দিলো। কেউ প্রশ্ন করার সাহসী হলো না কিছু।

দীনহীন গরিব বেচারীদের মুখে হাসি ফুটলো, তারা দু’মোঠো পেট পুরে খেতে লাগলো।

গভীর রাতে বনহুর ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে দেখলো, দীন-দুঃখী অসহায়দের হাসি-ভরা মুখ তার প্রাণে অনাবিল আনন্দদান করলো।

বৃদ্ধ গরিব মুচি রঘুনাথ নিঃসন্তান, দিন তার যায় না। কোন রকমে সামান্য কাজ করে কারণ সে চোখেও ভাল দেখে না, জুতো সেলাই ভাল হয় না তাই তার কাছে কেউ জুতো সেলাই-এর জন্য দেয় না। একারণেই তার কোনদিন অর্ধহারে কোনদিন অনাহারে কাটে। বুড়ো মুচির বুড়ি স্ত্রী সেও স্বামীর সঙ্গে উপবাস করে। এ ছাড়া তাদের কিই বা করার আছে।

আজ বুড়ো মুচি রঘুকে পথের মোড়ে বেশ হাসি-খুশিভাবে জুতো সেলাই করতে দেখা যাচ্ছে। মুখে তার প্রসন্নতার ছাপ।

বনহুর সাধারণ একটা নাগরিকের বেশে এসে দাঁড়ালো রঘুর সম্মুখে। পা থেকে ছেঁড়া জুতোটা খুলে দিয়ে বললো–এটা সেলাই করে দিতে পারবে?

বুড়োর আজ পেটে ভাত আছে, মুখে তাই হাসি নিয়ে বললো–পারি কিনা দেখো না। একবার। কই দেখি কি করতে হবে তোমার জুতোর?

বনহুর জুতো একটা এগিয়ে দেয়–খুলে গেছে সেলাই করে দেবে।

রঘু জুটো হাতে নিয়ে উল্টে-পাল্টে দেখে ঠোঁট উল্টে বললো–এতো ছেঁড়া জুতো কি করে সেলাই করবো। একটা নতুন কিনে নিতে পারো না?

মাথা চুলকে বলে বনহুর–বড্ড গরিব মানুষ, পয়সা কোথায় পাব তাই নতুন এক জোড়া কিনে নেবো বলো?

আচ্ছা বসো করে দিচ্ছি। রঘু জুতোটার দিকে মনোযোগ দিলো।

বনহুর বসলো ওর পাশে।

বুড়ো জুতো সেলাই করে চলেছে।

বনহুর এক সময় বললো তোমার খুব বুঝি রোজগার হয়?

না বাবা রোজগার তেমন হয় না।

তবে কি করে চলে?

খুব কষ্টে দিন যাচ্ছিল, তবে ক’দিন হলো সব কষ্ট দূর হয়েছে।

তার মানে?

আল্লা আমার উপর রহম করেছে।

আল্লা রহম করেছে কি রকম?

আর আমাকে পেটের জন্য এতো ভাবতে হবে না। দু’বস্তা চাউল, একশো টাকা, আল্লার ফেরেস্তা এসে আমাকে দিয়ে গেছে। বহুদিন আমরা বুড়ো বুড়ি মিলে খাবো।

এ কথা সে কথার ফাঁকে জুতো সেলাই হয়ে যায়। বনহুর পকেট থেকে একটা সিকি বের। করে ওকে দিতে যায়।

রঘু বলে উঠে–যাও বাবা পয়সা লাগবে না। যখন আমার অভাব ছিলো তখন পয়সার প্রয়োজন ছিলো, এখন আমার অভাব নেই কাজেই তোমার মত গরিবের কাছে পয়সা নেবো না।

বনহুর হাসলো, বিদায় নিলো মুচির কাছ থেকে।

এমনি আরও অনেক জায়গায় বনহুর নিজের গরিব সেজে নানা ছলনায় গরিবদের ঘরে ঘরে সন্ধান নিয়ে দেখলো সত্যি তাদের অভাব কিছুটা মোচন করতে সক্ষম হয়েছে কিনা সে।

বনহুর চায় না সুনাম, চায় না সে আত্মসম্মান, সে চায় এ পৃথিবীতে মানুষ মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার পাক। ‘বেলা দু’মুঠো খাবার পেট পুরে পাক, দু’খানা কাপড় পাক তারা লজ্জা নিবারণের জন্য। ধনবানগণই শুধু এ পৃথিবীতে মানুষ নয়, যাদের বুকের রক্ত গড়ে উঠেছে এই সুন্দর পৃথিবীর বাস্তবরূপ তারাও মানুষ। কিন্তু কেন তারা এই পৃথিবীতে মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার পায় না?

বনহুরের কঠিন প্রাণ কাঁদে শুধু তাদের জন্য, এই সব নিকৃষ্ট মানুষগুলোর জন্য তার বেদনার অন্ত নেই।

কোলাই-মহারাজ দেবকী নারায়ণ পুত্র শোকে অত্যন্ত কাতর। তবু তিনি প্রতিদিন রাজ প্রাসাদের অদূরে কালী মন্দিরে যান পূজা করতে।

কান্দাই পুলিশ মহল সদাসর্বদা রাজপ্রাসাদ পাহারার ব্যবস্থা করেছেন। দেবকী নারায়ণ। যখন পূজার জন্য মন্দিরে যান তখন তার সঙ্গে সশস্ত্র পুলিশ পাহারা-রত থাকে।

এমন অবস্থার মধ্যে একদিন দেবকী নারায়ণ হরণ হলেন তার শয়ন কক্ষ থেকে।

কে কেমনভাবে তাকে হরণ করলো কেউ বুঝতে পারলো না। সমস্ত দেশব্যাপী সাড়া পড়ে গেলো। পুলিশ মহলেও আতঙ্ক সৃষ্টি হলো কি করে এতো সাবধানতার মধ্যেও মহারাজ নিখোঁজ হলেন।

পুলিশ সুপার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার ঘাবড়ে গেলেন চরমভাবে। তারা পাহারার কোন গাফেলতি করেননি বা সাবধানতার কোন ত্রুটি করেননি। কি করে অসম্ভব সম্ভব হলো।

সকলের মুখে মুখে কোলাই-মহারাজের হরণ খবর ছড়িয়ে পড়লো। ভয়ে বিবর্ণ হলো দেশবাসীর মুখ।

এমন দিনে ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন চিঠি পেলেন, এক লাখ টাকার বিনিময়ে মহারাজদেবকী নারায়ণকে ফিরে দেওয়া হবে।

মিঃ ইয়াসিন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়েছেন, বিশেষ করে দস্যু বনহুর তাকে চিঠি দিয়ে অবগত করানো সত্ত্বেও মহারাজকে পুলিশ-মহল রক্ষা করতে পারেননি।

দুঃশ্চিন্তায় দুর্ভাবনায় একেবারে মুষড়ে পড়লেন মিঃ ইয়াসিন। সমস্ত রাত্রি অন্দ্রিায় কাটলো তার। গোয়েন্দা পুলিশ কান্দাই শহরের নানা স্থানে নানাভাবে সন্ধান করে ফিরতে লাগলো।

পুলিশ সুপার নিজেও সহকারীদের নিয়ে নানা জায়গায়-তল্লাসী চালালেন। যেখানে সন্দেহ হলো সেখানেই হানা দিয়ে সার্চ করলো। বড় বড় হোটেল নাইট ক্লাব জুয়ারুদের আড্ডা, পতিতালয়ের গোপন স্থান কোথাও সন্ধান করা বাদ রইলো না।

দুদিন হলো কোলাই মহারাজ হরণ হয়েছে।

শহরে গ্রামে সব জায়গায় ভীষণ একটা চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। একি অদ্ভুত কাণ্ড, কিছুদিন পূর্বেই হরণ করা হলো রাজকুমারকে, তারপর মহারাজ। দেশের এখানে সেখানেও প্রায়ই শোনা যায় এমনি নারী-পুরুষ এবং ছেলেমেয়ে নিখোঁজ সংবাদ।

ছেলেমেয়ে হারানো ব্যাপারটা আজকাল গা সওয়া হয়ে গেছে, লোক চুরি ও শোনা যায় মাঝে মাঝে, নারীহরণ তো প্রায়ই ঘটেছে। কিন্তু মহারাজ চুরি, কি ভয়ঙ্কর কথা।

রাতে শয্যায় শুয়ে ছট ফট করছিলেন মিঃ ইয়াসিন। দস্যু বনহুর তাকে মৃত্যু ভয় দেখিয়েছিলো তবু সে পারেনি মহারাজকে রক্ষা করতে, মৃত্যু ভয়ের চেয়ে মিঃ ইয়াসিন বৃদ্ধ মহারাজের জন্য বেশি ব্যথিত এবং চিন্তিত হয়েছেন।

গভীরভাবে তিনি চিন্তা করছেন, মহারাজ দেবকী নারায়ণকে কিভাবে কেমন করে উদ্ধার করবেন। হঠাৎ ইন্সপেক্টারের চিন্তা-স্রোতে বাধা পড়ে, কক্ষ মধ্যে একটা শব্দ হয়।

চমকে উঠেন ইন্সপেক্টার বিস্ময়-ভরা দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকাতেই আরষ্ট হয়ে যান মিঃ ইয়াসিন, দেখতে পান তার কক্ষের মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে জমকালো পোশাক-পরা একটা মূর্তি।

মিঃ ইয়াসিন চমকে উঠলেন ভীষণভাবে, বললেন–কে তুমি? এবং সঙ্গে সঙ্গে বালিশের। তলা হতে রিভলভার বের করতে গেলেন।

জমকালো মূর্তি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন–রিভলভার বের করার চেষ্টা করবেন না কারণ আমার হাতে ঐ অস্ত্র রয়েছে।

মিঃ ইয়াসিন সোজা হয়ে দাঁড়ালেন ধীরে ধীরে হাত দু’খানা উঁচু করলেন মাথার উপরে।

জমকালো মূর্তি বললো–হাত নামিয়ে নিন। হাত উপরে উঠাবার কোন প্রয়োজন নেই।

মিঃ ইয়াসিন তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো জমকালো মূর্তির দিকে। জমকালো পোশাক পরা, মাথায় পাগড়ি, পায়ে বুট, কোমরের বেল্টে ছোরা হাতে উদ্যত রিভলভার। মুখের নিচের অংশ কালো রুমালে ঢাকা, শুধু চোখ দুটি দৃষ্টিগোচার হচ্ছে তার। ডিম লাইটের স্বল্প আলোতে চোখ দুটো যেন জ্বলছে।

মিঃ ইয়াসিন বললো–কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? আর এলেই বা কি করে এখানে?

জমকালো মূর্তি পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠে বললো–আমি কে এখনও চিনতে পারেননি? দস্যু বনহুর!

অস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন ইন্সপেক্টার দস্যু বনহুর তুমি?

হাঁ, ইন্সপেক্টার। আর কেন এসেছি আপনার কাছে জানতে চান?

মিঃ ইয়াসিন কোন কথা বলতে পারলেন না, শুধু তাকিয়ে রইলেন অবাক দৃষ্টি মেলে। ভয় হচ্ছে তার নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর তাকে হত্যা করতে এসেছে। মহারাজ দেবকী নারায়ণকে রক্ষায় তিনি অক্ষম হয়েছেন, কাজেই মৃত্যু তার অনিবার্য। বললেন মিঃ ইয়াসিন-দস্যু বনহুর তোমাকে দেখার সুযোগ লাভ করে আমি অত্যন্ত খুশি হলাম। তোমার নির্দেশ মত আমি মহারাজ দেবকী নারায়ণকে রক্ষার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম–

কিন্তু সক্ষম হননি এই তো?

হা

ইন্সপেক্টার আমি জানি আপনি মহারাজকে রক্ষার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। সেই কারণেই আপনাকে আমি হত্যা না করে আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।

বনহুর!

হা ইন্সপেক্টার। শুনুন মহারাজ দেবকী নারায়ণ কোথায় আছে এবং কারা তাকে আটক করে এক লাখ টাকা দাবি জানিয়েছে সব সংবাদ আপনি পাবেন। আপনি পুলিশ ফোর্স সহ তৈরি। থাকবেন যখন আমার নির্দেশ পাবেন তখন আপনি কাজ করবেন। কিন্তু মনে রাখবেন কোন রকম চালাকি করতে যাবেন না।

না আমি কোন রকম চালাকি করবো না।

কাউকে বলবেন না যেন আমি এসেছিলাম আপনার কক্ষে।

নিশ্চয়ই না। তবে কর্তব্য পালন করতে কোন সময় দ্বিধা বোধ করবো না।

সুযোগ পেলে আমাকে গ্রেপ্তার করতে ছাড়বেন না এই তো?

হা

হাত বাড়ালো বনহুর ইনপেক্টার মিঃ ইয়াসিনের দিকে। হ্যান্ডসেক করে বললো বনহুর– খুশি হলাম ইন্সপেক্টার কর্তব্যের কাছে পিতা পুত্র সম্বন্ধও কিছু নয়।

এবার বনহুর দ্রুত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

মিঃ ইয়াসিন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো বনহুরের চলে যাওয়া পথের দিকে।

সমস্ত রাত ঘুমাতে পারলো না মিঃ ইয়াসিন। যে দস্যু বনহুরের সন্ধানে পুলিশ মহল এতো উকুণ্ঠিত সেই দস্যু বনহুর স্বয়ং এসেছিলো তার সম্মুখে। তার হাতে হাত রেখে করমর্দন করেছে, তাঁর চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে কি আশ্চর্য ঘটনা।

মিঃ ইয়াসিন সমস্ত রাত অনিদ্রায় কাটিয়ে এতো ভেবেও যেন সমাধান খুঁজে পেলেন না। দস্যু বনহুর যে এতোখানি মহৎ হৃদয় হতে পারে এ যেন তার কল্পনার বাইরে। মিঃ ইয়াছিন দস্যু বনহুর সম্বন্ধে যত ভাবতে লাগলেন ততই যেন বেশি বিমুগ্ধ হলেন। দস্যু বনহুর ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করতে পারতো। লুটে নিতে পারতো তার টাকা-পয়সা জিনিস পত্র, কিছুই করার ছিলো না তার। বরং দস্যু বনহুর তাকে মহারাজ উদ্ধার ব্যাপারে সহায়তা করবে আশ্বাস দিয়ে গেছে।

মিঃ ইয়াসিন রাতের ঘটনাটা সম্পূর্ণভাবে গোপন রেখে যান, তিনি ভুল করেও কাউকে এ ব্যাপারটা বললেন না।

পুলিশ মহলে যখন দস্যু বনহুর নিয়ে ভয়ানকভাবে আলাপ আলোচনা চলেছে তখন ইন্সপেক্টার ইয়াসিন নিশ্চুপ। তিনি শুধু কিছু না বলে সকলের সব কথা শুনে যান নীরবে।

পুলিশ মহল এবং সর্বসাধারণের ধারণা দস্যু বনহুরেরই এ কাজ। সে ছাড়া এমন দুঃসাহসী কাজ কে করতে পারে।

সমস্ত পুলিশ অফিসার এবং পুলিশ সুপার স্বয়ং দস্যু বনহুরের সন্ধানে আত্মনিয়োগ করলেন।

মিঃ ইয়াসিন তখন ধীরস্থির শান্ত, আজকাল তাঁকে সর্বক্ষণ বেশ চিন্তামগ্ন বলে মনে হয়। অন্যান্য পুলিশ অফিসারগণ মিঃ ইয়াসিনকে এমন ভাবগম্ভীর দেখে কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়েন।

ভোলানাথকে ঘিরে ধরে আনন্দ-উল্লাসে মেতে উঠলো মোদন মোহন বার-এর গোপন আড্ডাখানার অনুচর দল। মোদন নিজে ভোলানাথকে জড়িয়ে ধরে বললো–তোমাকে বাহবা না দিয়ে পারলাম না ভোলা। এতো সহজে তুমি কোলাই-মহারাজকে এনে দিলে আমার হাতে। সত্যি তোমাকে মোটা বখশীশ দেবো। পিঠ চাপড়ে দিলো মোদন ভোলানাথের।

আজ ভোলানাথের উপর মোদন বড় খুশি, কারণ তাদের অনুচরদের মধ্যে কেউ পারেনি কোলাই-মহারাজ দেবকী নারায়ণকে হরণ করে আনতে। পুলিশ সদা সর্বদা কড়া পাহারারত থাকতো রাজপ্রাসাদের চারিপাশে। তাছাড়া মহারাজের নিজস্ব পাহারাদার ছিল বহু, রাজ পরিষদগণ অত্যন্ত সতর্ক থাকতেন সর্বদা। সাধ্য কি মহারাজের নিকটে কেউ পৌঁছতে পারে।

ভোলা সেই অসাধ্য সাধন করেছে, মহারজাকে তার শয়ন কক্ষ হতে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চুরি। করে এনেছে সে। দেখিয়ে দিয়েছে ভোলা, সে শুধু শক্তিতেই অসীম নয়, বুদ্ধি কৌশলেও অসীম।

মোদন কস্তুরীবাঈকে এক সময় নির্জনে ডেকে নিয়ে একটা মতির মালা উপহার দিয়ে বলে–কস্তুরী তোমার উপহার গ্রহণ করো।

কস্তুরী না মস্তকে মোদনের দেওয়া মতিমালা গ্রহণ করে সেলাম জানায়।

মোদন চাপা গলায় বলে–কস্তুরী আমি জানি তুমিই পারবে ভোলাকে আয়ত্বে আনতে। তোমার বুদ্ধিবলে এবং কৌশলে ভোলাকে আমি বশীভূত করতে সক্ষম হবো।

কস্তুরীর আবরণে ঢাকা চোখ দুটো চচক করে উঠলো, বললো–খোদা মেহেরবান তাই আমি আপনার কাজ হাসিল করতে পেরেছি ওস্তাদ।

মোদন বললো আবার–কস্তুরীবাই এর পিছনে এসে দাঁড়ায় ভোলা–ওস্তাদ আমার বখশীশ?

মোদন পকেট থেকে একথলে টাকা বের করে ভোলার হাতে দেয়নাও তোমার বখশীশ বিশ হাজার।

ভোলানাথ থলেটা হাতে নিয়ে থলেতে চুম্বন করে বলে–সেলাম ওস্তাদ। এবার চলি তা হলে…….

মোদন ওর হাত ধরে ফেলে–এক্ষুণি কোথায় যাবে বন্ধু? কস্তুরীবাঈ বহুক্ষণ ধরে তোমার জন্য এন্তেজার করছে।

ও–বহুৎ খুশি—তাকায় ভোলানাথ কস্তুরীবাঈ এর দিকে।

কস্তুরীবাঈ-এর মুখ আবরণে ঢাকা, শুধু চোখ দুটো কালো আবরণের ফাঁকে পরিলক্ষিত হচ্ছে। বনহুরের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় হলো কস্তুরীবাঈ-এর।

মোদন কস্তুরীবাঈকে ইশারা করলো।

কস্তুরীবাঈ হাত বাড়ালো ভোলানাথের দিকে, মিষ্টি কণ্ঠে বললো–এসো।

বনহুর তাকালো মোদনের দিকে।

মোদন সরে গেলো কস্তুরীবাঈ-এর দিকে ইংগিৎ করে।

কস্তুরীবাঈ বনহুরের হাত ধরে নিয়ে এলো পাশের ঘরে। বসিয়ে দিলো একটা চেয়ারে, তারপর নাচতে শুরু করলো কস্তুরীবাঈ।

বনহুর বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে আছে কস্তুরীবাঈ-এর কালো আবরণে ঢাকা নৃত্য তরঙ্গায়িত যৌবনভরা দেহটার দিকে।

কস্তুরীবাঈ বিশেষ ভঙ্গীমায় নৃত্য করে চলেছে।

বনহুর মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।

কস্তুরীবাঈ যখন নাচছিলো-তখন মোদন এক হাতে মদের বোতল অন্য হাতে কাঁচ-পাত্র নিয়ে প্রবেশ করে সেইখানে, বসে পড়ে সে ভোলানাথের পাশে। নেশার টুলু ঢুলু করছে মোদনের দেহটা। জড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো-বাঃ বাঃ বাঃ—-নাচো, আরও নাচো—কথার ফাঁকে কাঁচ পাত্রে মদ ঢেলে এগিয়ে ধরে ভোলার মুখের কাছে–নাও ভোলা খাও।

ভোলা হাত দিয়ে গেলাস স্পর্শ করার পূর্ব মুহূর্তেই কস্তুরীবাঈ নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে মোদনের হাত থেকে গেলাস নিয়ে নাচতে শুরু করে।

হাসে মোদন।

কস্তুরী ঈশারা করে মোদনকে বেরিয়ে যাবার জন্য।

মোদন বুঝতে পারে কস্তুরীবাঈ ভোলাকে আয়ত্বে এনে সরাব পানে অভিভূত করবে। এবং, সেই কারণেই তাকে বেরিয়ে যাবার জন্য ইংগিত করলো।

মোদন টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো।

ভোলানাথ মোদন এবং কস্তুরীবাঈ-এর ইংগিতপূর্ণ চালচলন লক্ষ্য করলো, হাসলো সে মনে মনে। ভোলানাথ উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেলো সে কস্তুরীবাঈ-এর দিকে।

কস্তুরীবাই কাঁচ-পাত্র থেকে মূল্যবান সরাবগুলো আলগোছে ঢেলে দিলো ভোলানাথের পায়ের কাছে।

বিস্ময়ে চমকে উঠলো ভোলানাথ, অবাক হয়ে তাকালো কস্তুরীবাঈ এর দিকে।

কস্তুরীবাঈ গেলাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো এক পাশে তারপর নাচতে লাগলো চঞ্চল ঝরনার মত ক্ষিপ্রগতিতে। বনহুর কস্তুরীবাঈকে ধরতে গেলো খপ করে কিন্তু তার পূর্বেই সে সরে গেলো দ্রুতগতিতে।

ভোলা বিস্ময়ভরা হৃদয় নিয়ে ভাবতে লাগলো–অদ্ভুত এ নর্তকী। তার চেয়ে অদ্ভুত এর চাল চলন। কতদিন হলো ভোলার সঙ্গে মিশছে অথচ আজও ভোলানাথ দেখলো না, কালো আবরণের নিচে কেমন ওর দেহ, কেমন মুখ-মুণ্ডল, কেমন তার ওষ্ঠদ্বয়। শুধু দুটো চোখ ছাড়া হাত দু’খানাও ঢাকা থাকে কালো কভারে। ভোলানাথের মনে বিপুল বাসনা জাগে ওকে একবার দেখবে সে।

ভোলার বাসনা পূর্ণ হয় না, কস্তুরীবাঈ তার যত সান্নিধ্যের মধ্যেই আসুক কোনদিন সে মুখের আবরণ উন্মোচন করে না।

ভোলানাথ আজ ওকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে কিন্তু সেই মুহূর্তে কস্তুরীবাঈ সরে পড়তেই বলে উঠে মোদ–ঘাবড়াবে না বন্ধু, ঘাবড়াবে না সবুরে মেওয়া ফলে বুঝলে?

ভোলানাথ শুধু হাসলো একটু, তারপর বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।

মোদনমোহন বার থেকে বেরিয়ে ভোলা সোজা চলে এলো ভীমসিং ১৩নং রোড বাড়িতে। ভোলানাথ সোজা চলে গেলো ভিতরে।

কতকগুলো গুণ্ডা ধরনের লোক ভোলানাথকে দেখে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিলো।

এগিয়ে এলো জোসেফ; ভোলানাথকে বললো– ভোলা তুমি এসেছো ওস্তাদ কই?

ওস্তাদ আসেনি, আমি এসেছি। মহারাজ কেমন আছে জোসেফ?

ভাল আছে।

চলো আমি তাঁকে দেখে আসি?

চলো ভোলা।

পাশাপাশি এগিয়ে চলে ভোলানাথ আর জোসেফ।

জোসেফ বলে–আরে ভাই বন্দীর জন্য এতো দরদ কেন?

ভোলানাথ বলে উঠে–একে বুড়ো মানুষ তারপর যদি অযত্ন হয় তা হলে বুঝতে পারছ না, সব মাটি হবে এক লাখ টাকা গুল যাবে ভায়াগুল যাবে।

বুঝেছি………..বললো জোসেফ।

ভোলানাথ বললো-তুমি বুঝবে না তো বুঝবে কে? মহারাজ যদি ফসকে যায় ত’হলে সব মাটি হবে, আমার এতো খাটুনি বিফলে যাবে।

কথায় কথায় ওরা ভীমসিং ১৩নং এর অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। যেখানে আরও অনেক যুবক বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ বালক বন্দী করে রাখা হয়েছে।

একপাশে একটা খাটিয়ায় মাদুর পাতা শয্যায় শুয়ে আছে মহারাজ দেবকী নারায়ণ। ভোলানাথের কথায় মহারাজকে হাত পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়নি, তাকে শোবার বসার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

ভোলানাথ এবং জোসেফ এসে দাঁড়ালো।

মহারাজ উঠে বসলো শয্যায়, ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে তার সৌম্য-সুন্দর মুখখানা। অসহায় করুণ চোখে তাকালেন তিনি ওদের দিকে।

ভোলানাথ জোসেফকে লক্ষ্য করে বললো মহারাজের শয্যায় গদি এবং ভাল চাদরের ব্যবস্থা। করে দেবার আদেশ দাও জোসেফ।

জোসেফ অবাক হলেও কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। কারণ সে জানে তাদের ওস্তাদ মোদনমোহন পর্যন্ত ভোলানাথকে সমীহ করে চলে। কাজেই ভোলানাথের আদেশ পালনে বাধ্য সে।

ভোলানাথ বললো আবার–জোসেফ মহারাজের ভাল খাবার নিয়ে এসো। আমি তাকে নিজ হাতে খাইয়ে দিবো।

ভোলার হুকুমে ভাল ভাল খাবার এলো।

ভোলানাথ নিজ হস্তে মহারাজ দেবকী নারায়ণকে খাইয়ে দিলো।

তৃপ্তি সহকারে খেলো মহারাজ, ঘোলাটে দৃষ্টি মেলে ভোলাকে দেখতে লাগলো। আঁখি দুটি ছল ছল হয়ে উঠলো তাঁর।

ভাবলো কে এই যুবক যে তাঁকে পিতৃসম দরদ করতে পারে।

মহারাজের হৃদয় ভরে উঠলো পিতৃ স্নেহে বললো কে বাবা তুমি? আমাকে এমন মায়াময় স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করছো? আমি পুত্রহারা অসহায় এক বৃদ্ধ…….

ভোলানাথ বললো–আপনি ভাববেন না মহারাজ আমরাই আপনার পুত্র এবং আপনাকে আমরা কোন কষ্ট দেবো না।

তবে কেন আমাকে এ ভাবে বন্দী করে এনেছো?

বললো ভোলানাথ–অর্থের লোভে।

অর্থ! কত অর্থ চাও তোমরা?

এক লাখ। বললো ভোলানাথ।

মহারাজ দেবকী নারায়ণ বললেন–তার চেয়েও আমি বেশি টাকা দেবো তোমাদের। আমাকে তোমরা মুক্তি দাও।

হাঁ পাবেন, মুক্তি পাবেন আপনি, কিন্তু কয়েকদিন আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে।

ভোলানাথ চলে যায় সেখান থেকে, যাবার সময় বলে যায় মহরাজের যেন কোন অসুবিধা না হয়।

বনহুর তার বিশ্রাম কক্ষে অৰ্দ্ধশায়িত অবস্থায় বসে সিগারেট পান করছিল। রহমান দণ্ডায়মান তার সম্মুখে, সে গম্ভীর মুখে বললো–সর্দার, সমস্ত নারুন্দী অধিবাসী তাকে দেবী বলে পূজা করতে শুরু করেছে।

এ্যাসট্রোর মধ্যে সিগারেট থেকে ছাই-এর অংশ ঝেড়ে ফেলে সোজা হয়ে বসলো বনহুর, কুঞ্চিত করে বললো–তোমার কথা শুনে অবাক হচ্ছি রহমান। কে সে নারী যে নারুন্দীর দেবী বনে বসেছে?

সর্দার, শুনেছি এই নারী নারুন্দীর গভীর-জঙ্গলে এক গুপ্ত স্থানে বাস করে। সপ্তাহে সে এক নির্দিষ্ট দিনে নিজকে বিকাশ করে সে লোক চক্ষুর সম্মুখে। ঐ দিন সে মুক্ত হস্তে নারুন্দীবাসীদের মধ্যে শত শত অর্থ এবং বস্ত্র বিতরণ করে। আর বিতরণ করে অন্ন।

আশ্চর্য বটে।

শুধু আশ্চর্য নয় সর্দার এ নারী অদ্ভুত। লোক মুখে শুনেছি শুভ্র-বসনা, এলায়িত কেশ রাশি, অপূর্ব সুন্দরী এই নারী।

বনহুর শুধু অস্ফুট শব্দ করলো–হু।

এমন সময় নূরী প্রবেশ করলো সেখানে, হাতে তার এক খোকা ফুল।

রহমান বেরিয়ে গেলো আর বিলম্ব না করে।

নূরী এসে বসলো বনহুরের পাশে বললো–অপূর্ব সুন্দরী—–কে–কার কথা হচ্ছিলো শুনি?

বনহুর হাসলো একটু।

নূরী অভিমান ভরা কণ্ঠে বললো–দস্যু সম্রাট এখন থেকে নারী ব্যবসা শুরু করেছে বুঝি? না হলে সুন্দরী নারীর হিসাব কেন এতো?

যদি বলি–হাঁ।

বেশ তাহলে দস্যু সম্রাট তাদের নিয়েই থাক, আমি আর আসবো না তাকে বিরক্ত করতে। কথাটা বলে চলে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বনহুর খপ করে ধরে ফেলে ওর হাতখানা।

নূরী রাগতভাবে বলে–আঃ ছেড়ে দাও বলছি।

যদি না ছাড়ি?

সত্যি বনহুর তোমার আচরণ আমার মোটেই ভাল লাগছে না।

কেনো?

দস্যুতা ত্যাগ করে এখন তুমি মেয়েদের নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করেছে।

হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হেসে উঠে বনহুর হাসি থামিয়ে বলে আমি মেয়েদের নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না–মেয়েরাই আমাকে নিয়ে.. ………

নূরী হাসি চেপে বললো–বয়েই গেছে মেয়েদের তোমাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে। দস্যু বনহুরের নাম শুনলে মেয়েরা ভয়ে আতঙ্কে কুঁকড়ে যায় বুঝলে?

যেমন তুমি তাই না?

নাঃ তোমার জ্বালায় পারি না আর। একটা কথা তোমাকে বলবো হুর?

বলো?

না আজ থাক–পরে বলবো। লজ্জায় মুখ নত করে নেয় নূরী।

বনহুর ওকে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে বলে–না বললে ছাড়ছি না আমি?

নূরী বলে আগে আমাকে বাহুমুক্ত করে দাও?

বেশ দিলাম, বলো?

আমি মা হতে চলেছি………কথাটা বলেই নূরী ছুটে পালিয়ে যায় সেখান থেকে।

বনহুরের সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়ে একটা স্নিগ্ধ হাসির দীপ্তভাব। তাকিয়ে থাকে বনহুর নূরীর চলে যাওয়া পথের দিকে। নূরের সুন্দর মুখের পাশে ভেসে উঠে আর একটা ফুটফুটে কচি মুখ। বনহুর শয্যায় গা এলিয়ে দেয়।

বনহুর একদিন এক গরিব সন্ন্যাসীর বেশে সজ্জিত হলো। কেউ তাকে বুঝতে পারবে না সে স্বাভাবিক মানুষ। ললাটে শ্বেত চন্দনের রেখা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, হাতে চিন্তা, মাথায় জটাজুট পরনে ব্যাঘ্র চর্ম।

গভীর রাতে সকলের অজ্ঞাতে বনহুর বেরিয়ে এলো তার আস্তানা থেকে।

তাজের পিঠে চেপে বসলো বনহুর।

তাজ প্রভুর ছদ্মবেশের সঙ্গে পরিচিত ছিল। প্রভুর দেহের গন্ধ তাকে চিনতে সহায়তা করতো। কাজেই তাজ নীরবে প্রভুর আদেশ মেনে চললো।

বনহুর রাতের অন্ধকারে এক সময়ে পৌঁছে গেলো নারুলী শহরে। তাজকে জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে বনহুর শহরে গমন করলো। নারুন্দী শহর বনহুরের অতি পরিচিত। কান্দাই শহরের অনতি। দূরেই এই নারুন্দী শহর।

শহরে প্রবেশ করেই শুনতে পেলো বনহুর দেবীরাণীর প্রশংসাবাণী। সকলের মুখে মুখে সেই অদ্ভুত দেবীর প্রশংসা। ধনবান, ঐশ্বর্যবান দীনহীন গরিব সকলের মুখেই তার নাম।

বনহুর বিস্মিত হলো মনে মনে। কে এই নারী যার জন্য নারুন্দী নারী পুরুষ বিমুগ্ধ। বনহুর তাকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো।

বনহুর সন্ন্যাসীর বেশে নারুন্দীর পথে পথে ঘুরলো। ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে এক সময় বসে পড়লো পথের ধারে, ক্ষুধা পিপাসায় অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছে সে।

এমন সময় একজন ভিখারী বললো–সন্ন্যাসী তুমি এখানে বসে আছো কেনো। এসো আমার সঙ্গে।

বললো বনহুর–কোথায় যাবো?

দেবীরাণীর ওখানে।

আশ্চর্য হয়ে বললো বনহুর–সে কোথায়?

ঐ নারুন্দী জঙ্গলে।

এতো পথ যেতে পারবো?

কেনো পারবে না আমরা তো চলেছি। এসো যা চাও তাই পাবে! তোমার দুঃখ আর থাকবে না।

তবে নিয়ে চলো আমাকে।

এসো।

বনহুর ভিখারীটার সঙ্গে এগিয়ে চললো।

পথে আরও বহু দীনদুঃখী গরিব লোক নারুন্দী জঙ্গল অভিমুখে চলছে তাদের দলে মিশে গেলো বনহুর। সেও একজন সন্ন্যাসী ভিখারীর মতই এগিয়ে চললো ধীর-মন্থর পদক্ষেপে।

যতই বনহুর নিকটবর্তী হচ্ছে ততই সে অবাক হয়ে যাচ্ছে এতো লোক চলেছে সারি সারি হয়ে। এতো লোককে অন্ন-বস্ত্র অর্থ দান করা কম কথা নয়।

এক সময় বনহুর অন্যান্য দীনহীন ভিখারীদের দলে মিশে পৌঁছে গেলো নারুন্দী জঙ্গলে। বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখলো পূর্ণ কুঠির দুয়ারে দাঁড়িয়ে এক দেবীমূর্তি দু’হাত ভরে মুঠা মুঠা দান করে চলেছে।

অগণিত ভিখারীদল সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে আসছে। দেবীমূর্তি তাদের হাতে এবং ঝোলায় পূর্ণ করে দিচ্ছে তার দেবার সামগ্রীগুলো।

এক সময় বনহুরও এগিয়ে আসে অন্যান্যর সঙ্গে।

দেবীর নিকটবর্তী হতেই বিস্ময়ে চমকে উঠে বনহুর, চিনতে তার বিলম্ব হয় না এ যে রাণী দুর্গেশ্বরী।

রানী দুর্গেশ্বরীর সম্মুখে এসে হাত পাতে স্বয়ং দস্যু বনহুর।

দুর্গেশ্বরী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় সন্ন্যাসীর চোখের দিকে। হাত থেকে খসে পড়ে দান পাত্র।

সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য ভিখারী দল অবাক হয়ে যায়। তাকায় তারা তাদের দেবীরাণী তখন। সংজ্ঞা হারিয়ে ঢলে পড়ে যাচ্ছিলো।

সন্ন্যাসীবেশী দস্যু বনহুর দেবীরাণীকে দু’হাত ধরে ফেলে, তারপর তাকে নিয়ে যায় কুঠিরের মধ্যে।

দেবীরাণীর সহকারিনী বলে উঠে–তোমরা আজ যাও। দেবী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

দীনদুঃখী গরিব ভিখারী দল সবাই তাদের দেবী মায়ের জন্য বিশেষ ভাবে চিন্তিত হয়ে পড়লো। নীরবে সবাই বিদায় গ্রহণ করলো সেদিনের মত।

বনহুর দুর্গেশ্বরীর সংজ্ঞাহীন দেহটাকে কুঠিরের মধ্যে নিয়ে শুইয়ে দিলো বিছানায়।

আসলে দুর্গেশ্বরী দেবী জ্ঞান হারায় নাই, সে দস্যু বনহুরকে চিনতে পেরেছিলো, বনহুরের চোখ দুটো যে তার অতি পরিচিত। সংজ্ঞা হারানোর ভান না করলে ঐ মুহূর্তে ওকে আটকাতে পারতো না। সে জানতো বনহুর তাকে জ্ঞানহারা অবস্থায় রেখে পালাতে পারবে না। তাই দুর্গেশ্বরী দস্যু বনহুরকে রাখার জন্যই ভান করেছিলো।

বনহুর দুর্গেশ্বরীকে তার কুঠিরের শয্যায় শুইয়ে দিতেই বললো দুর্গেশ্বরীদেবরাজ আমার সাধনা সফল হয়েছে।

বনহুর বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–আমি একজন সন্ন্যাসী মাত্র।

জানি তোমার ছলনা। জানি তুমি আমার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবে না। কেন তুমি সন্ন্যাসী সেজে আমার চোখে ধূলো দিচ্ছো বনহুর?

বনহুর ভেবেছিলো দুর্গেশ্বরী তাকে চিনতে পারেনি। অবাক না হয়ে পারলো না বনহুর এমন নিখুঁত ছদ্মবেশেও তাকে সে চিনলো কি করে? বললো–আশ্চর্য তুমি আমাকে চিনে ফেলেছো?

দুর্গেশ্বরী বনহুরের দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরলো–পৃথিবীর সবাই যদি তোমাকে ভুল করে আমি কোনদিন তোমাকে ভুল করবো না। তোমার ঐ চোখ দুটো আমার মনে গাঁথা হয়ে গেছে। দেবরাজ।

দুর্গেশ্বরী তোমার এই পরিবর্তন দেখে সত্যি আমি অভিভূত হয়েছি। বললো বনহুর।

দুর্গেশ্বরী বনহুরের হাতকানা তখনও মুঠায় চেপে ধরে আছে, বনহুরকে সে যেন অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে চায়। বললো–তোমাকে ভালবেসে আমি বেছে নিয়েছি এই সাধনা। তোমাকে না পাওয়ার বেদনা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে পরকে ভালবেসে, পরের জন্য সমস্ত মনপ্রাণ আমি উৎসর্গ করে দিয়েছি।

দুর্গেশ্বরী আমি খুশি হলাম। তোমার সাধনা যেন স্বার্থক হয়।

হাঁ আমাকে সেই আর্শীবাদ তুমি করো। দুর্গেশ্বরী বনহুরের পা দু’খানা চেপে ধরে দু’হাতে।

স্থির পাথরের মূর্তির মত আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বনহুর, অভিভূতের মত তাকিয়ে থাকে। সে দুর্গেশ্বরীর দিকে।

বনহুরের পা-দুখানা সিক্ত হয়ে উঠে দুর্গেশ্বরীর চোখের জলে।

এমন সময় বাইরে থেকে ডাক দেয় আশ্রমের পূজারী বৃদ্ধ ঠাকুর মা-দেবী………

চমকে উঠে বনহুর।

দুর্গেশ্বরী মাথা তোলে বনহুরের পা-দু’খানার উপর থেকে, উঠে দাঁড়ায় সে। আঁচলে চোখের পানি মুছে বলে–আসছি বাবা।

দুর্গেশ্বরী স্থির শান্ত দেবীমূর্তির মত বেরিয়ে আসে কক্ষ থেকে।

বনহুর বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে থাকে।

দুর্গেশ্বরী বেরিয়ে আসতেই বনহুর তাকে অনুসরণ করে বাইরে এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায় দুর্গেশ্বরীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে এক সৌম্য সুন্দর বৃদ্ধ।

বনহুর মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ আর দেবীমূর্তি দুর্গেশ্বরীর দিকে। অগণিত দীনহীন ভিখারী দল আবার আসতে শুরু করেছে। আনন্দে ভরে উঠে বনহুরের হৃদয়–দুর্গেশ্বরী মরে গিয়ে এখন দেবীরাণীর জন্ম হয়েছে।

বনহুর দুর্গেশ্বরীর অলক্ষ্যে বিদায় গ্রহণ করে সেখান থেকে।

এক সময় তাজের পাশে এসে দাঁড়ালো।

তাজ প্রভুর আগমনে আনন্দবোধ করলো, বার বার মাথা নেড়ে প্রভুকে অভিনন্দন জানালো।

বনহুর তাজের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করলো তারপর চেপে বসলো ওর পিঠে।

মোদন, বোমসিং, মানসিং আর ভোলানাথ এসে দাঁড়ালো ভীমসিং ১৩নং গোপন আড্ডার। অভ্যন্তরে। রাত গভীর। মহারাজের শয্যার পাশে এসে দাঁড়ালো ওরা চার ব্যক্তি।

বৃদ্ধ মহারাজ তখন নিদ্রায় অচেতন।

মোদন একখানা উদ্যত ছোরার আগা দিয়ে মহারাজের দেহের চাদরখানা সরিয়ে দিতেই জেগে উঠলেন মহারাজ দেবকী নারায়ণ। এতোরাতে এক সঙ্গে চারজন ভীষণ জোয়ান বলিষ্ঠ লোকগুলোকে তার বিছানার চার পাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেলেন। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাতে লাগলেন মহারাজ তাদের মুখের দিকে।

মোদন একখানা কাগজ মেলে ধরলো মহারাজের সামনে তারপর একটা কলম গুঁজে দিলো, তার হাতের মধ্যে বললো–আপনার মন্ত্রির কাছে লিখে দিন। এক লাখ টাকা নিয়ে তারা যেন কান্দাই পর্বতমালার দক্ষিণ পাদমূলে পৌঁছে দেয়। সেখানে আমরা ঐ টাকা গ্রহণ করে আপনাকে মুক্তিদান করবো।

মোদনের কথায় মহারাজের কলমসহ হাতখানা থর থর করে কাঁপতে লাগলো তবু তিনি লিখলেন।

লিখা শেষ হলে চিঠিখানা পড়লো মোদন। তারপর চিঠি খানা ভাঁজ করে রেখে বললো আমরা চারজন ছাড়া আর কেউ যেন এ সংবাদ জানতে না পারে। এবার দেখাবো দস্যু বনহুর কেমন করে আমাদের মুখের শিকার ছিনিয়ে নেয়। ভোলানাথ?

বলো ওস্তাদ?

এবার তুমি থাকবে আমাদের সঙ্গে বুঝলে?

হাঁ ওস্তাদ।

মোদন চিঠিখানা ভাঁজ করে মানসিং এর হাতে দিয়ে বললো খুব সাবধানে রাজপ্রাসাদে পৌঁছাবে। একটা প্রাণী যেন জানতে না পারে।

মানসিং গর্বভরে বললো–কেউ জানবে না। এমন কি পিঁপড়ে পর্যন্ত জানতে পারবে না।

ভোলানাথ গম্ভীর কণ্ঠে বললো–পিঁপড়ে না জানলেও দস্যু বনহুর জানতে পারবে কারণ দেয়ালের কান আছে।

বোমসিং বলে উঠলো–দেয়ালের কান থাকলেও মুখ নেই, কাজেই দস্যু বনহুরের কানে পৌঁছানো কিছুতেই সম্ভব নয়।

এক সময় তারা ফিরে এলো মোদনমোহন বার-এ।

চললো নানারকম আমোদ-প্রমোদ আর নাচ গান।

ভোলানাথ এক পাশে চুপচাপ বসেছিলো, সে নীরবে ফল ভক্ষণ করছিলো, আর লক্ষ্য করছিলো চারদিক।

মোদনমোহন বার-এ শিকার ধরার জন্য কতকগুলো অর্ধনগ্ন যৌবনা নারী ছিলো তারা। সদাসর্বদা নতুন অতিথিদের অভ্যর্থনা জানিয়ে সাদরে বরণ নিতো বার-এর অভ্যন্তরে। তারপর নেশায় চুরচর করে তাকে সর্বশান্ত করে ফেলতো।

আজও লীলাবাঈ আর যমুনারাণী এই কাজে ব্যস্ত ছিলো। নতুন আগন্তুকদের নানা ছলনায় নেশাপানে মত্ত করে তুলেছিলো ওরা।

এমন সময় একজন লোক ভিতরে প্রবেশ করলো তার হাতে ব্যাগ। লোকটার দেহে মূল্যবান স্যুট, প্যান্ট ও টাই পরা রয়েছে।

লোকটা প্রবেশ করতেই বার-এর মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হল। মোদন ইশারা করলো বোমসিং এর দিকে, বোমসিং মানসিংকে।

লীলাবাঈ আর যমুনারাণী এগিয়ে গেলো, দু’জনা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এলো ভিতরে।

ভোলানাথ নীরবে লক্ষ্য করছে সব।

লোকটার ব্যাগে নিশ্চয়ই কোন মূল্যবান দ্রব্য আছে, না হলে মোদনের দল ওমনভাবে নড়ে উঠতো না। লোকটা অতি দ্র তাতে কোন ভুল নেই।

যমুনারাণী আর লালীবাঈ লোকটাকে নিয়ে প্রবেশ করলো একটা নির্জন কক্ষে। বসিয়ে দিলো ওরা তাকে চেয়ারে।

মোদন আর মানসিং কিছু কানাকানি করে বললো। বোমসিং তখন অন্যান্য দলবলের সঙ্গে কানাঘুষা করছে। মানসিং ছোরা বের করে নিলো হাতে।

ভোলানাথ সকলের অগোচরে সরে গেলো সেখান থেকে। কেউ টের পেলো না ওর চলে যাওয়া।

লীলাবাঈ লোকটার সম্মুখে নাচতে শুরু করে দিয়েছে।

যমুনারাণী সরাবের পাত্র তুলে নিয়ে মুখে ধরলো ভদ্রলোকের। ভদ্রলোক যেন হাবা বনে গেছে একেবারে, বললো–আমি সরাব খাই না।

যমুনা একগাল হেসে বললো–এ সরাব নেশা ধরায় না শুধু মনকে করে তোলে উন্মাদ। খেয়ে নিন বাবু বহুৎ ভাল সরাব………মুখে চেপে ধরে যমুনারাণী ভদ্র বেচারীটার।

মোদন আর বোমসিং প্রবেশ করে সেই কক্ষে। ভদ্রলোকের দু’পাশে এসে বসে দু’জন। বলে মাদন খেয়ে নিন বাবু যমুনারাণীর মনে ব্যথা দেবেন না।

হা খান আপনি………….যুমনারাণী ঢল ঢল হয়ে বাবুর মুখে ঢেলে দেয়।

অগত্যা খেয়ে ফেলে বাবু এক নিঃশ্বাসে।

যমুনারাণী খিল খিল করে হেসে উঠে–বাবু আর একটু দেবো।

ভদ্রলোক হাতের পিঠে মুখ মুছে বলে–না আর খাবো না। বড় জ্বালা করছে বুক আমার……..

বোমসিং হেসে বলে–কত ভাগ্যি বার-এ এসেছেন এই সুধা যদি পান না করেন তাহলে চলবে কি করে?

ভদ্রলোক বললোনা, আমাকে এক্ষুণি বাসায় ফিরতে হবে। আমার স্ত্রী আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

মোদন বলে উঠে–তা এক সময় ফিরবেন নিশ্চয়ই। তাড়াহুড়ো কেন এতো বলুন তো? ব্যাগে কি আছে?

আমার ব্যাগে অলঙ্কার আছে। বহু মূল্যবান অলঙ্কার এইগুলো। কাল আমার মেয়ের বিয়ে এসব তাকেই যৌতুক দেবো বলে ব্যাঙ্ক থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি।

মোদন হেসে উঠলো, খুব ভাল কথা—

লীলাবাঈ এর নাচ তখন পুরাদমে চলেছে।

রাত বেড়ে আসছে।

ভদ্রলোক সরাব পান করে জড়িত কণ্ঠে আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেছে।

এমন সময় মোদন আর বোমসিং এর মাঝখানে ভদ্রলোকটার পিছনে এসে দাঁড়ায় মানসিং হাতে তার উদ্যত ছোরা।

মোদন ইশারা করতেই মানসিং পিশাচের মত ছোরাখানা বসিয়ে দিতে যায় ভদ্রলোকটার পিঠে।

সঙ্গে সঙ্গে কেউ পিছন থেকে ধরে ফেলে খপ করে ওর হাতখানা।

চমকে ফিরে তাকায় মানসিং অস্ফুটধ্বনি করে উঠে–দস্যু বনহুর।

একসঙ্গে চমকে উঠে দাঁড়ায় মোদন, বোমসিং তারাও বলে উঠে–দস্যু বনহুর।

বনহুর তার উদ্যত রিভালভার মোদনের বুক লক্ষ্য করে ধরে বলে–একজন তোমরা নড়বে না, তাহলেই মোদন মরবে।

ওস্তাদের বুকে আগ্নেয় অস্ত্র, কাজেই কেউ এক চুল নড়ার সাহসী হলো না।

ভদ্রলোকটা তখন যেন হুস্ ফিরে পেয়েছে, উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে বনহুরের দিকে। বনহুরের জমকালো মূর্তি এবং তার হাতে উদ্যত রিভলভার দেখে হতভম্বের মত আরষ্ট হয়ে গেছে সে।

বনহুর বললো ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে ব্যাগ হাতে উঠিয়ে নিন।

ভদ্রলোক যন্ত্র চালিতের মত ব্যাগখানা হাতে তুলে নিলো।

বললো বনহুর–বেরিয়ে যান বার হতে।

দ্রলোক ব্যাগ বগলে নিয়ে টলতে টলতে বেরিয়ে গেলো বার থেকে।

ভদ্রলোক বার এর বাইরে বেরিয়ে যেতেই বনহুর মুহূর্ত বিলম্ব না করে পিছু হটে বেরিয়ে এলো বার থেকে। একটি লোক কিছু বলার বা নড়ার সাহস হলো না।

বনহুর বাইরে বেরিয়ে এসেই ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে বললো–আসুন এই গাড়িতে! দ্রুত হস্তে গাড়ির দরজা খুলে ধরলো বনহুর।

ভদ্রলোক ব্যাগটা এটে ধরে ভয়ে পালাতে যাচ্ছিলো, বনহুরকে দেখে ঘাবড়ে গেছে ভদ্রলোক ভীষণভাবে।

বনহুর রিভলভার চেপে ধরলো ভদ্রলোকটার বুকে দৃঢ়কণ্ঠে বললো শীৰ্গগীর চেপে বসুন নইলে এক্ষুণি আপনাকে হত্যা করবো।

ভদ্রলোকটা একেবারে ভড়কে গেলো, মুহূর্তে চেপে বসলো সে প্রাণভয়ে ভীতু হয়ে।

বনহুর ড্রাইভ আসনে চেপে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো।

দস্যু বনহুরকে পিছা করতে কেউ সাহসী হলো না। সবাই হা হুতাস করতে লাগলো।

ভোলানাথ এ সময় থাকলে উপকার হতো বেটা গেলো কোথায়? মোদন ভোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

পিয়ারী নর্তকী বললো ভোলা চলে গেছে আজ সকাল সকাল। …।

এদিকে ভোলানাথকে নিয়ে মোদনমোহন বার-এ মোদনের দল যখন ব্যতিব্যস্ত তখন বনহুর ভদ্রলোকটিকে নিয়ে কান্দাই পার্ক হাউস ছেড়ে এগিয়ে চলেছে। অত্যন্ত স্পীডে গাড়ি ছুটে চলেছিলো, এবার স্পীড কমিয়ে দেয় বনহুর, ঘাড় ফিরিয়ে বলে–কোথায় আপনার গন্তব্যস্থান?

এতোক্ষণ মৃতের ন্যায় বসেছিলো ভদ্রলোক বনহুরের কথায় যেন হুস্ হলো তার, বললো আমার গন্ধব্যস্থান হলো বেলুচাবালী ৩নং রোড—

বনহুর এক সময় তাকে পৌঁছে দিলো তার বেলুচাবালী ৩নং রোডের বাস ভবনে।

গাড়ী রেখে বনহুর বললো–যান এবার আপনি।

ভদ্রলোক কম্পিত পদক্ষেপে ব্যাগ রেখেই নেমে যাচ্ছিলেন তিনি ভাবছেন প্রাণ পেলেন এই যথেষ্ট। তাড়াতাড়ি সরে পরার চেষ্টা করতেই বনহুর বললো–আপনার গহনার ব্যাগ নিয়ে যান।

ভদ্রলোক যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। বলে কি ডাকাতটা তাকে গহনার ব্যাগ নিয়ে যাবার জন্য আদেশ করলো। ভয়কম্পিত হস্তে ভদ্রলোক গহনার ব্যাগ হাতে উঠিয়ে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।

বনহুর তখনও মুখের আবরণ উন্মোচন করে নাই।

এবার ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতাপূর্ণ কণ্ঠে বললো জানি না কে তুমি? আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি চিরসুখী হবে।

বনহুর বললো–আমার নাম দস্যু বনহুর। খেয়াল রাখবেন আর কোনদিন ঐ দিকে যাবেন না।

লোকটা বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললো–তুমি তুমি দস্যু বনহুর? কিন্তু তোমার আচরণ তো দস্যুর মত নয়? তুমি দেবতা—

ততক্ষণে বনহুর গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে।

ভদ্রলোকটার কথার শেষ অংশ কানে যায় বনহুরের। একটা স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠে তার ঠোঁটের কোণে।

বনহুরের গাড়ি এসে থামলো ইন্সপেক্টার মিঃ ইয়াসিন-এর বাড়ির পিছনে। অতি সন্তর্পনে নেমে দাঁড়ালো সে।

মিঃ ইয়াসিন গভীর রাতে নির্জনে কক্ষে বসে মনোযোগ সহকারে ডায়েরী লিখছিলেন। টেবিলে ল্যাম্প জ্বলছে। এক রাশ কাগজপত্র ছড়ানো চার পাশে।

টেবিলের সম্মুখে এসে দাঁড়ায় দস্যু বনহুর, একটু খানি শব্দ করে টেবিলে আঘাত করে।

মিঃ ইয়াসিনের সম্বিৎ ফিরে আসে, দৃষ্টি তুলতেই চমকে উঠে, তার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসে অস্ফুট একটা আওয়াজ–দস্যু বনহুর তুমি!

হাঁ, ইন্সপেক্টার নিতান্ত প্রয়োজনেই এলাম।

মিঃ ইয়াসিন বিস্ময়ভরা নয়নে তাকিয়ে আছেন দস্যু বনহুরের মুখের দিকে। কালো আবরণে

বনহুরের মুখের নিচের অংশ নীল দীপ্ত উজ্জ্বল সুন্দর দুটি চোখ আর টানা এক জোড়া ভ্র। না জানি আবরণের নিচে কেমন একখানা মুখ আছে কে জানে।

মিঃ ইয়াসিনকে নির্নিমেষ দৃষ্টি ফেলে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বনহুর হেসে বলে– কি দেখছেন ইন্সপেক্টার?

মিঃ ইয়াসিন বললো–আপনাকে দেখছি! অদ্ভুত মানুষ আপনি।

হাঁ, সে কথা মিথ্যা নয় ইন্সপেক্টার। কারণ আপনার বিনা অনুমতিতে আপনার গৃহে প্রবেশ করেছি। অবশ্য বিশেষ জরুরি প্রয়োজন না হলে আসতাম না। শুনুন ইন্সপেক্টার আগামী সপ্তাহের তৃতীয় দিন, ২৪শে মার্চ রাত্রিতে আপনারা প্রস্তুত থাকবেন–সেইদিন মহারাজ দেবকী নারায়ণ এবং এক লাখ টাকা উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন। আর আপনাদের হাতে আসবে বেশ কিছু সংখ্যক কান্দাই শয়তান, যারা কান্দাই শহরে বাস করে কান্দাইবাসীর সর্বনাশ করে চলেছে।

মিঃ ইয়াসিন হতভম্বের মত স্তব্ধ হয়ে শুধু শুনে চললেন। একটি কথা বলতে পারলেন না, তিনি সেই মুহূর্তে।

বনহুর বললো ইচ্ছা করলে আমি শয়তানদের সমুচিত শাস্তিদান করতে পারতাম, কিন্তু পুলিশ মহলের হাতে আমি তাদের সমর্পণ করে দেখতে চাই তারা এ ব্যাপারে কেমন পারদর্শী।

এবার মিঃ ইয়াসিন বললেন–আপনার সহযোগিতায় আশা করি আমরা কৃতকার্য হবো।

ধন্যবাদ মিঃ ইয়াসিন। বনহুর কথাটা বলে যেমন হঠাৎ এসেছিলো তেমনি বেরিয়ে গেলো। সে আচমকা।

মিঃ ইয়াসিন বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করার জন্য সদাসর্বদা পুলিশ মহল ব্যতিব্যস্ত হয়ে রয়েছে সেই দস্যু তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে কথা বলে গেলো। ইচ্ছা করলে তিনি তাকে গ্রৈপ্তারে চেষ্টা নিতে পারতেন কিন্তু করেননি। কারণ দস্যু বনহুর তার কাজে সহায়তা করে চলেছে।

রহমান আর মাহবুব বসে রাইফেল পরিষ্কার করছিলো। আরও অনেকগুলো অনুচর নিজ নিজ রাইফেল পরিষ্কারে ব্যস্ত।

মাহাবুব হঠাৎ রহমানকে লক্ষ্য করে বলে উঠে–আচ্ছা রহমান ভাই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো, সঠিক জবাব দেবেতো?

নিশ্চয়ই দেবার মত হলে দেবো।

রহমান ভাই আমি বুঝতে পারলাম না সর্দার কোলাইমহারাজকে হরণ ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক করে দিয়ে আবার নিজেই তিনি মহারাজকে কৌশলে হরণ করে শয়তান মোদনের দলের হাতে এনে দিলেন, কেননা এমন করলেন তিনি আজও ভেবে পাচ্ছি না?

হা ব্যাপারটা অত্যন্ত রহস্যপূর্ণই বটে। রাইফেল পরিষ্কার করতে করতে জরাব দিলো রহমান, একটু ভেবে বললো–প্রথমে আমি নিজেও এমনি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। নানারকম প্রশ্ন জেগেছিলো আমার মনে কিন্তু এখন সব বুঝতে পেরেছি।

সেই কারণেই তো তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি ব্যাপারটা।

রহমান রাইফেলটা এক পাশে রেখে সোজা হয়ে বসলো তারপর বলতে শুরু করলো– কান্দাই শহরের অভ্যন্তরে এবং আশে পাশে গ্রাম ও শহরগুলোতে একটা ভয়ঙ্কর রহস্য জাল ছড়িয়ে পড়েছে, সেই রহস্য উদঘাটনে সর্দার গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেছেন। এবং সেই কারণেই তাকে নানারকম রহস্যপূর্ণ কাজ করতে হচ্ছে বুঝলে? সর্দার মহারাজকে হরণ করার পূর্বে পুলিশকে সাবধান করে দিয়েছিলেন এ কারণে যেন তাকে কোন শয়তান লোক চুরি করতে না। পারে বা তার কোন অনিষ্ট করতে সক্ষম না হয়। সর্দার জানতো পুলিশ মহলের সাবধানতা ভৈদ করে শয়তান দল তাদের কার্যোদ্ধারে সক্ষম হবে না। কিন্তু কতদিন পুলিশ মহল মহারাজকে এ ভাবে সাবধানে পাহাড়া দিয়ে রাখতে পারবে একদিন না একদিন নরপিশাচের দল তাকে নিহত। করতে পারে তাই তিনি নিজে মহারাজকে হরণ করে এনে পৌঁছে দিয়েছে শয়তানদের হাতে। সর্দার জানে এবার মহারাজকে ওরা হত্যা করতে পারবে না, কারণ নিজে তিনি মহারাজের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। মহারাজকেও বাঁচাতে হবে এবং কান্দাই রহস্য উদঘাটন করতে হবে এ জন্যই সর্দার এ কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন বুঝলে মাহাবুব?

বুঝেছি রহমান ভাই।

রহমান পুনরায় রাইফেলখানা টেনে নিলো হাতে তারপর বললো–২৪শে মার্চ রাত্রিতে কান্দাই পর্বতমালার দক্ষিণ পাদমূলে এই পাষণ্ড শয়তান নরপিশাচ দলকে সমুচিত শাস্তি দান করবেন সর্দার–

রহমান এবং মাহাবুব কথাবার্তা চলছিলো এমন সময় কায়েস এসে দাঁড়ায় সেখানে, চোখে মুখে উকুণ্ঠার ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে, ব্যস্ত কণ্ঠে বললো– তোমরা দরবার কক্ষে চলে এসো; সর্দারের আদেশ।

সঙ্গে সঙ্গে রহমান এবং দলবল সবাই রাইফেল হাতে নিয়ে ছুটলো দরবার কক্ষের দিকে।

বনহুর তার সুউচ্চ আসনের পাশে দণ্ডায়মান হলো।

রহমান এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

অন্যান্য অনুচরগণ প্রত্যেক উগ্রীব হয়ে দণ্ডায়মান হলো দরবার কক্ষের মেঝেতে।

বনহুরের সুন্দর মুখমণ্ডল কঠিন আঁর রক্তাভ হয়ে উঠেছে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হচ্ছে। বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে বললো বনহুর–এই মুহূর্তে তোমরা প্রস্তুত হয়ে নাও, কান্দাই জঙ্গলের অদূরে একদল ডাকু আস্তানা গেড়েছে আজ রাতে তারা কান্দাই শহরে বিক্ষিপ্তভাবে হানা দিয়ে নিরীহ জনগণকে হত্যা করবে এবং লুটে নেবে তাদের সব কিছু।

রহমান বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললো–আশ্চর্য, ডাকুর দল কান্দাই জঙ্গলে প্রবেশ করেছে! এতো বড় দুঃসাহস তাদের?

রাসেল বনহুরের একজন বিশ্বস্ত অনুচর সেই এই সংবাদ বহন করে এনেছে। বললো রাসেল–ডাকুর দলটা শুধু দুঃসাহসী নয় অতি ভয়ঙ্কর।

এদের কাছে আছে নানারকম ভয়ঙ্কর মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র। আমি এবং আমাদের দলের আর একজন এই দলটাকে প্রথম আবিষ্কার করেছি।

বনহুরের নির্দেশে তার অনুচরগণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিলো।

বনহুর নিজেও সজ্জিত হয়ে নিলো তার দস্যু ড্রেসে।..

নূরী জানতে পেরে ছুটে এলো, বনহুরকে লক্ষ্য করে বললো–তুমি কোথায় যাচ্ছো, আমি সব জানি। তোমাকে আমি যেতে দেবো না হুর।

নূরী এ তুমি কি বলছো?

না না আমি তোমাকে সেই ডাকুর সঙ্গে লড়তে দেবো না। ওরা তো তোমার কোন অন্যায় করেনি?

আমার না করতে পারে কিন্তু আমার দেশের ভাইদের সে অন্যায় করবে আমি সহ্য করবো? নূরী আমাকে বাধা দিও না।

কিন্তু তোমার যদি কোন অমঙ্গল হয়?

আজও তোমার মনে এ দুর্বলতা দূরী? মানুষ হয়ে জন্মেছি মরতে হবেই একদিন।

তাই বলে..

নূরী লক্ষীটি আমাকে বাধা দিও না। ডাকুর দলকে আমি সমুচিত শাস্তি দান করতে সক্ষম। হবো.

বনহুরের কথা শেষ হয় না রহমান ব্যস্তভাবে প্রবেশ করে সেই স্থানে সর্দার, ডাকু দলের সর্দারের নাম মনসুর ডাকু।

মনসুর! বনহুর অবাক কণ্ঠে নামটা উচ্চারণ করলো।

রহমান বললো–সর্দার মনসুর ডাকু নাম আপনার স্মরণ নাই। মুনসুর ডাকু একবার সর্দার কালুখার সঙ্গে লড়াই করে পরাজিত হয়েছিলো।

হুঁ, এবার আমার খেয়াল হয়েছে, সেই মনসুর ডাকু যে বাপুর কাছে পরাজিত হয়ে কান্দাই জঙ্গল থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিলো?

হাঁ সর্দার।

বুঝেছি মনসুর তা হলে কালুখাঁর কাছে পরাজিত হবার প্রতিশোধ নিতে এসেছে আবার কান্দাই জঙ্গলে।

আপনার অনুমান সত্য সর্দার।

কিন্তু কালুখাকে সে কোথায় পাবে?

মনসুর জানে কালুখার মৃত্যু হয়েছে এবং তারই পুত্র দস্যু বনহুর এখন কান্দাই জঙ্গলের অধিশ্বর।

আমার সঙ্গেই তাহলে বুঝাঁপরা করতে এসেছে এবার মনসুর ডাকু?

হাঁ, সর্দার সেই রকম মনে হচ্ছে।

রহমান তোমরা প্রস্তুত হয়ে নিয়েছো?

হাঁ আমরা সবাই প্রস্তুত।

নূরীর মুখ বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে, একবার বনহুর আর একবার রহমানের মুখে তাকাচ্ছে সে কাতর দৃষ্টি মেলে। অজানিত আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে তার মন।

রহমান বেরিয়ে যেতেই নূরী বনহুরের জামার আস্তিন চেপে ধরলো আমার কেমন যেন। লাগছে হুর…….কেমন যেন ভয় হচ্ছে..

নূরী তুমি অবুঝ হচ্ছো কেনো? এই মুহূর্তে আমার থাকার কোন উপায় নেই। মনসুর ডাকু এসেছে বাপুর বদলে আমাকে সাজা দিতে……হঠাৎ বনহুর অট্টহাসিতে ভেঙে পড়লো।

নূরী বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে, কোন কথা বের হয় না তার কণ্ঠ দিয়ে।

বনহুর নূরীর চিবুকে মৃদু নাড়া দিয়ে বলে–কিছু ভেবো না নূরী। খোদা হাফেজ।

নূরী বাষ্পরুদ্ধ অস্ফুট কন্ঠে বলে উঠলো–খোদা হাফেজ।

ছুটে গিয়ে লুটিয়ে পড়লো বিছানায় বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। অল্পক্ষণ পরই শোনা গেলো অসংখ্য অশ্বপদ শব্দ খট খট খট ……..দু’হাতে নূরী কান চেপে ধরলো অশ্বপদ শব্দগুলো যেন তার বুকের পাঁজর চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়ে গেলো। নূরী দু’হাত উঁচু। করে বললো–হে খোদা তুমি ওকে হেফাযতে রেখো—

মনসুর ডাকু অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দলবল সহ প্রস্তুত হচ্ছিলো। তাবুর ভিতরে সারিবদ্ধ হয়ে দণ্ডায়মান তার দলবল, প্রত্যেকের হস্তে মারাত্মক অস্ত্র।

মনসুর ডাকু গম্ভীর কর্কশ কন্ঠে বললো–তোমাদের সবাই এমনভাবে আক্রমণ চালাবে যাতে একটি প্রাণী রক্ষা না পায়।

সমস্ত দলবল বলে উঠলো–হ সর্দার।

ঠিক ঐ মুহূর্তে মনসুর ডাকুর পিছনে আবির্ভাব হয় দস্যু বনহুর, মনসুর ডাকুর পিঠে রাইফেল চেপে ধরে গুরু-গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠেসে সুযোগ আর পাবে না মনসুর।

এক সঙ্গে সকলের দৃষ্টি এসে পড়লো বনহুরের উপর। সকলের চোখে-মুখে বিস্ময় ফুটে উঠলো।

মনসুর আচমকা হতভম্ভ না হয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বললো–কে তুমি?

বনহুর বললো–যার পিতার কাছে একদিন পরাজয়ের কালিমা মেখে পলায়ন করেছিলে, সেই পিতার পুত্র দস্যু বনহুর—-

দস্যু বনহুর!

হাঁ চমকে উঠলে কেন মনসুর?

সেদিনের সেই ফুটফুটে বালক,

হাঁ, আজকের এই সাক্ষাৎ যমদূত। মনসুর তুমি আমার পিতা বয়সী, তাই তোমাকে আমি হত্যা করবো না। তোমাকে আমি বন্দী করলাম—

বনহুর! মনসুর ডাকু তোমার মত একটা নগন্য ডাকুর হস্তে বন্দী হবার পূর্বে মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছে, তবু………মনসুর ইংগিত করলো তার অনুচরদের দিকে।

বনহুর রাইফেল আরও ভালভাবে চেপে ধরলো মনসুর ডাকুর পিঠে-খবরদার এক পা কেউ। অগ্রসর হবে না, হলেই তোমাদের দলপতি প্রাণ হারাবে।

বনহুর প্যান্টের পকেট থেকে হুইসেল বের করে ফুঁ দিলে সঙ্গে সঙ্গে তাবুর চার পাশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো দস্যু বনহুরের অসংখ্য অনুচর।

বনহুর বললো–তোমরা স্থির হয়ে দাঁড়াও।

বনহুরের অনুচর দল স্থির হয়ে দাঁড়ালো।

রহমান ও দাঁড়িয়ে আছে সকলের আগে। সে দেখছে তার সর্দার মনসুর ডাকুকে কাবু করে ফেলেছে বুদ্ধি কৌশলে। রহমান সর্দারের আদেশের প্রতিক্ষা করতে লাগলো।

বনহুর বললো-মনসুর তুমি কি চাও, মুক্তি না যুদ্ধ?

আমি মনসুর ডাকু, যুদ্ধকে ভয় করি না বনহুর।

বেশ তা’ হলে অস্ত্র হাতে উঠিয়ে নাও।

মনসুর বার বার তাকাচ্ছিলো বনহুরের হস্তস্থিত রাইফেলের দিকে।

বনহুর বললো–ভয় নেই মনসুর দস্যু বনহুর কোনদিন নিরস্ত্ৰজনকে হত্যা করে না। তুমি অস্ত্র বের করে নাও।

মনসুর তার রাইফেল পিঠ থেকে হাতে খুলে নিলো। যেমন সে বনহুরের বুক লক্ষ্য করে রাইফেল উঁচু করে ধরলো, সঙ্গে সঙ্গে বনহুর বুটের এক লাথিতে তার হাত থেকে রাইফেল ছিটকে ফেলে দিলো দূরে।

বনহুর মুহূর্তে মনসুর ডাকুকে গ্রেপ্তার করার জন্য রহমানকে ইংগিত করলো।

শুরু হলো তুমুল যুদ্ধ।

দু’দলের লোক নিহত এবং আহত হয়ে চললো।

মনসুর ডাকু এবং তার দলবল সবাই এক সময় বন্দী হলো দস্যু বনহুরের হস্তে। নিহত লোকগুলোকে বনহুরের আদেশে কবর দেওয়া হলো। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো।

বনহুর মনসুর ডাকু এবং তার দলবলকে বন্দী করে নিয়ে ফিরে এলো আস্তানায়।

নূরীর আনন্দ আর ধরে না, বনহুর জয়ীই শুধু হয়নি সে শত্ৰু দলকে বন্দী করে এনেছে।

মনসুর ডাকুকে লৌহ শিকলে আবদ্ধ করে বন্দীশালায় রাখা হলো।

মনসুর ডাকুর অন্যান্য অনুচরদেরও বন্দী করে রাখলো বনহুর আস্তানার অদূরে তার গোপন। বন্দীশালায়। সবাইকে লৌহ শিকলে আবদ্ধ করে রাখা হলো এবং কড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হলো।

হিংস্র ব্যাঘ্র বন্দী হলো সিংহের খাঁচায়।

ভোলানাথের সম্মুখে ফলমূলের পাত্রটা এগিয়ে দিয়ে বলে মোদন–ভোলানাথ দিন তো এগিয়ে এলো, খুব হুশিয়ার, যে ভাবে তোমাকে বলেছি ঠিক সেইভাবে কাজ করবে কিন্তু। মহারাজের বিনিময়ে এক লাখ টাকা পাবো আমরা বিশ হাজার দেবো তোমাকে। হাঁ, এবার দস্য বনহুর কেমন করে টের পায় দেখে নেবো।

ভোলানাথ একটা নাশপাতি হাতে নিয়ে কামড় দিলো ঠিক সেই মুহূর্তে মোদন কথাটা শেষ করলো।

হেসে উঠলো ভোলানাথ হাঃহাঃ হাঃ—-

মোদন ভোলানাথের হাসি দেখে অবাক হয়ে বললো– হাসছো যে ভোলা?

দস্যু বনহুরের নাম শুনে হাসি পেলো আমার।

তার মানে?

মানে, এবার দস্যু বনহুর কেমন জব্দ হবে। তাই হাসি পেলো আমার।

মোদন পিয়ারী নর্তকীকে লক্ষ্য করে ইংগিত করলো ভোলার সম্মুখে সরাব পরিবেশন : করতে।

সেই মুহূর্তে মোদনের ডাক এলো, মালিক তাকে স্মরণ করেছে।

মোদন চলে গেলো।

ভোলানাথও সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়তে যাচ্ছিলো।

পিয়ারী একটা কাঁচ পাত্রে সরাব ঢেলে বিশেষ ভঙ্গীমায় এগিয়ে ধরে ভোলানাথের মুখের কাছে–খাও প্রিয়তম……..

ভোলানাথ মৃদু হেসে বললো–উ হু নাচ দেখাও।

পিয়ারী সরাব পাত্র হাতে নিয়ে নাচতে শুরু করলো। নাচের তালে তালে তার যৌবনভরা সুডৌল দেহটা যেন ঢেউ খেলে চলেছে।

ভোলানাথ স্থির নয়নে তাকিয়ে আছে পিয়ারীর দিকে। সত্যি অদ্ভুত নাচে পিয়ারী। মোদনমোহন বার-এর দক্ষ নর্তকী সে।

কক্ষে আর কেউ নেই শুধু ভোলানাথ আর পিয়ারী নর্তকী। পিয়ারী চঞ্চল চরণ ক্ষিপ্রভাবে বেড়াচ্ছে মেঝের কার্পেটের উপর। ভোলানাথকে বশীভূত করার জন্য পিয়ারীর চেষ্টার কোন ক্রটি নেই। মোদন বলেছে, পিয়ারী তোমার কাজ শুধু ভোলানাথকে খুশি রাখা। সে যেন কোনক্রমে মোদনমোহন বার ছেড়ে কোনদিন সরে না যায়। অবশ্য পিয়ারী ছাড়াও আর একজনকে মোদন বহাল করেছে এ কাজে সে হলো কস্তুরীবাঈ।

ভোলাকে করায়ত্ত করার জন্য মোদনের চেষ্টার অন্ত নেই। ভোলানাথের মত একটা লোক যদি তাদের হাতের মুঠায় থাকে তা হলে তাদের বরাৎ খুলে যাবে। যে কোন অসাধ্য সাধন করতে সক্ষম হবে তারা।

মোটা বখশীশের লোভে পিয়ারী এবং কস্তুরী দু’জন ভোলাকে আয়ত্বে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে।

পিয়ারী এক সময় ভোলানাথের মুখের কাছে সরাব পাত্রটা তুলে ধরতেই; হঠাৎ আবির্ভূত হলো কস্তুরীবাঈ–এক ঝটকায় পিয়ারীর হাত থেকে পাত্রটা কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো।

পিয়ারী ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো, সে একবার কস্তুরীবাঈ এর কালো আবরণে ঢাকা মুখখানার দিকে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দ্রুত বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।

বনহুর বিস্ময় নিয়ে তাকালো কস্তুরীবাঈ-এর মুখে, কে এই বাঈজী:যে শুধু আজ নয় বার বার তার মুখ থেকে সরাব পাত্র সরিয়ে নিয়েছে তাকে রক্ষা করেছে চরম মুহূর্ত থেকে।

বনহুর উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে আসতে লাগলো কস্তুরীবাঈ-এর দিকে।

কস্তুরীবাঈ পিছু হটেছে।

বনহুর এগিয়ে আসছে তার দিকে।

কস্তুরীবাঈ দেখলো এবার আর পালাবার উপায় নেই, ভোলানাথ তাকে ধরে ফেলবে। কস্তুরীবাঈ বিলম্ব না করে নাচতে শুরু করলো।

ভোলানাথ ব্যর্থ হলো।

কস্তুরীবাঈ অদ্ভুত ভঙ্গীমায় নেচে চলেছে। নাচের সঙ্গে সঙ্গে কস্তুরীবাঈ-এর দৃষ্টি যেন আকর্ষণ করে চলেছে ভোলানাথকে। মুগ্ধ হয়ে যায় ভোলানাথ অস্ফুট কন্ঠে বলে–কস্তুরীবাঈ তোমার মুখের আবরণ খুলে ফেলো—

কস্তুরী বলে উঠে –উ হুঁ আমার মুখের আবরণ খুলে ফেলতে পারবো না। তুমি আমাকে অনুরোধ করো না ভোলানাথ।

না আমি তোমাকে দেখতে চাই।

তুমি আমাকে দেখলে ঘৃণা করবে।

সেকি? তোমার এ মিথ্যা সন্দেহ।

না, কারণ আমার চেহারা কদাকার। তুমি আমাকে দেখলে ভয় পাবে ভোলানাথ।

ভয়! ভোলানাথ তোমার চেহারা দেখলে ভয় পাবে?

ভয় না পেলেও ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে কারণ আমার মুখ বিকৃত।

ভোলানাথ কস্তুরীবাঈ-এর একেবারে নিকটে এসে দাঁড়ায়। বলে ভোলানাথ–আজ আমি তোমাকে দেখবোই কস্তুরীবাঈ। খপ করে ধরে ফেলে সে কস্তুরীবাঈ-এর একখানা হাত।

ঠিক সেই মুহূর্তে মোদন প্রবেশ করে সেই কক্ষে–ভোলা শীঘ্র এসো মালিক তোমাকে স্মরণ করেছে।

ভোলানাথ কস্তুরীবাঈকে ছেড়ে দিয়ে ফিরে দাঁড়ায়।

কস্তুরীবাঈ ভোলার কবল থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

মোদনের সঙ্গে বেরিয়ে গেলো ভোলানাথ।

মোদনমোহন বার এর গোপন কক্ষে এসে হাজির হলো ভোলানাথ আর মোদন।

ভোলানাথ সম্মুখে তাকালো সাউন্ড বক্স ঝুলছে।

আওয়াজ হলো–ভোলা ২৪শে মার্চ রাত্রির জন্য প্রস্তুত থাকবে। তোমার উপর নির্ভর করছে। সেদিনের এক লাখ টাকা।

মোদন আর ভোলানাথ স্তব্ধ হয়ে শুনতে লাগলো।

সাউন্ড বক্সে আওয়াজ হলো আবার–এই টাকা হাতে এলে আমরা তোমাকে বিশ হাজার বখশীস দেবো। কান্দাই পর্বতের দক্ষিণ পাদমূলে মহারাজকে নিয়ে অপেক্ষা করবে আমার লোজন আর তুমি থাকবে আড়ালে বুঝলে–

মোদন বললো–মালিক, ভোলাকে আমরা যেভাবে বলবো সেইভাবে সে কাজ করবে।

হাঁ, আমি খুশি হবো এবং তাকে আজীবন আমাদের বার-এ কাজে বহাল থাকবে। কিন্তু ঐ এক লাখ টাকার উপর নির্ভর করছে তার ভবিষ্যত।

এবার ভোলানাথ বললো-মালিক, আপনি যা বলবেন সেইভাবে আমি কাজ করবো। এক। লাখ টাকার জন্য কোন চিন্তা করবেন না।

সাউন্ড বক্সে শব্দ হলো–সেই বিশ্বাস আমার আছে। ভোলানাথ আমার লোক যা পারেননি। সেই কাজ তুমি করেছো। মহারাজ দেবকী নারায়ণকে হরণ করে এনেছে, তার পাষাণ প্রাচীরের শত বাধা উপেক্ষা করে। পুলিশ ফোর্স তোমাকে আটকাতে সক্ষম হয়নি। তুমি বাহাদুর ভোলানাথ।

মোদন বললো–মালিক, ২৪শে মার্চ রাত্রে কান্দাই পর্বত মালার দক্ষিণ পাদমূলে মহারাজ দেবকী নারায়ণকে নিয়ে আমরা ক’জন যাবো?

সাউন্ড বক্সে আওয়াজ হলো–সাবাস ভোলা। কিন্তু এবার যদি তোমরা বিফল হও তাহলে শাস্তি পেতে হবে। লৌহ শিকলে আবদ্ধ করে চাবুক মারা হবে তোমার পিঠে।

ভোলা লক্ষ্য করলো, মোদনের সাহসী মুখেও কালিমার ছাপ পড়লো।

সাউন্ড বক্সে হুকুম এলো এবার–ভোলা তুমি যাও।

ভোলানাথ বেরিয়ে গেলো।

কিন্তু আসলে ভোলা লুকিয়ে রইলো দরজার আড়ালে, সে কান পেতে শুনলো সাউন্ড বক্সে এবার কথা হচ্ছে–মোদন টাকা হাতে নেবার সঙ্গে সঙ্গে মহারাজকে হত্যা করবে। কারণ, সে ফিরে গিয়ে আমাদের ব্যাপারে সব ব্যক্ত করে দেবে। হাঁ এ কথা যেন ভোলা না জানতে পারে কারণ মহারাজের প্রতি ভোলার দরদ আছে।

আচ্ছা মালিক কেউ জানবে না, ভোলানাথ ও জানবে না। আমরা তাকে খতম করে দেবো।

ভোলা আর বিলম্ব না করে সরে পড়লো সেখান থেকে। রাগে অধর দংশন করে সে, নিরীহ মহারাজ দেবকী নারায়ণকে ওঁরা হত্যা করবে এবং তার পরিবর্তে অর্থও গ্রহণ করবে শয়তানের দল। ভোলা আপন মনেই হাসে কিন্তু পরক্ষণেই মুখ তার গম্ভীর হয়ে উঠলো। ভোলানাথের ললাট কুঞ্চিত হলো কান্দাই রহস্য এবার সে উদঘাটন করবে এবং তাদেরকে শায়েস্তা করবে সে নিজে। মোদন হলো দুই নম্বর কিন্তু এক নম্বর কে? যে মালিকের আসনে বসে এই সব শয়তানের পরিচালনা করে চলেছে?

পুলিশ সুপার এবং পুলিশ ইন্সপেক্টার বসে কোন বিষয় নিয়ে গভীরভাবে আলোচনা হচ্ছিলো।

এমন সময় টেবিলে টেলিফোনটা বেজে উঠলো ক্রিং ক্রিং করে। স্বয়ং পুলিশ সুপার মিঃ আরিফ রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিলেন–হ্যালো, মিঃ আরিফ বলছি……..দস্যু বনহুর! মুহূর্তে পুলিশ সুপারের মুখমণ্ডল গম্ভীর আর কঠিন হয়ে উঠলো।

পাশেই মিঃ ইয়াসিন চমকে সোজা হয়ে বসলেন, তিনি উগ্রীবভাবে কান পাতলেন। দস্যু বনহুর নামটা শুনতেই তিনি অনুমানে বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই দস্যু বনহুর ফোন করেছে।

মিঃ আরিফ বলছেন–দস্যু বনহুর তুমি কোন সাহসে পুলিশ অফিসে ফোন করেছে…….কি বললে দেখা করতে আসছে পুলিশ অফিসে……… আমার আর মিঃ ইয়াসিনের সঙ্গে জরুরি আলাপ আছে তোমার…….. হ্যালো…হ্যালো……হ্যালো…রিসিভার রেখে ব্যস্তকণ্ঠে বললো মিঃ আরিফ–দেখেছেন, দস্যু বনহুর টেলিফোন করেছিলো! আর বলে কি পুলিশ অফিসে আসছে সে। আমার এবং আপনার সঙ্গে তার নাকি জরুরি আলাপ আছে।

মিঃ ইয়াসিন বললেন–হয়তো কোন বিশেষ সংবাদ আছে বলে মনে হচ্ছে।

বলেন কি ইন্সপেক্টার দস্যু বনহুর আসবে পুলিশ অফিসে কোন বিশেষ সংবাদ জানাতে? এতো বড় দুঃসাহস হবে তার?

স্যার, দস্যু বনহুর যা বলে তা সে করে। শুধু সে দুঃসাহসীই নয়, সম্ভবহীন সাহসী সে।

তাহলে আপনি কি মনে করেন দস্যু বনহুর প্রকাশ্যে পুলিশ অফিসে আসবে?

বললাম তো স্যার তার অসাধ্য কিছু নেই………

তাহলে এক্ষুণি পুলিশগণকে অস্ত্র নিয়ে তৈরি হতে বলুন। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তার করবো।

পুলিশ সুপারের কথায় নীরব রইলেন মিঃ ইয়াসিন। সহসা কোন জবাব দিলেন না তিনি।

মিঃ আরিফ বললেন–চুপ করে রইলেন কেন এই মুহূর্তে পুলিশ ফোর্স তৈরি হতে বলে দিন। দস্যু বনহুর এলেই তাকে আমরা পাকরাও করবো…..

দস্যু বনহুর,আমাদের সঙ্গে কোন সৎপরামর্শ নিয়ে তো আসতে পারে?

আপনি কি পাগল হয়েছেন? দস্যু বনহুরকে নাগালের মধ্য পেয়েও তাকে ছেড়ে দেবো? যত সৎপরামর্শ নিয়েই সে আসুক না কেন।

মিঃ ইয়াসিন কোন কথা না বলে তখনই পুলিশ সুপারের আদেশ পালনে চলে গেলেন।

অল্পক্ষণের মধ্যে পুলিশ অফিস এলাকায় পুলিশ ফোর্স অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে কড়া পাহাড়ায় নিযুক্ত হলো। মিঃ আরিফের আদেশ–যে কোন লোক পুলিশ এলাকায় প্রবেশ করবে তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে।

সমস্ত পুলিশ অফিসার এবং পুলিশ ফোর্স দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য প্রস্তুত হয়ে রইলো।

মিঃ ইয়াসিন কোন কাজে অল্পক্ষণের জন্য বাইরে চলে গেলেন।

পুলিশ সুপার স্বয়ং রইলেন পুলিশ অফিসে, তিনি রিভলভারে গুলি ভরে প্রস্তুত হয়ে বসে প্রতিক্ষা করতে লাগলেন পুলিশ অফিসে–পুলিশ মহল যখন অত্যন্ত উকুণ্ঠার সঙ্গে দস্যু বনহুরের জন্য অপেক্ষা করছে, সেই মুহূর্তে মেজর হোসেন কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ এসে হাজির হলেন স্বয়ং তারা পুলিশ অফিসে।

মিঃ আরিফ এবং থানা অফিসারগণ ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে পড়লেন মিঃ আরিফ নিজে তাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে পুলিশ অফিসে নিয়ে বসালেন।

মেজর হোসেন কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ আসন গ্রহণ করলেন।

মিঃ আরিফ তাদেরকে জানালেন, দস্যু বনহুর সম্বন্ধে সব কথা। দস্যু বনহুরকে গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ ফোর্স এবং পুলিশ অফিসারগণ উগ্রীব আছেন।

ব্যাপার শুনে মেজর হোসেন কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

বললেন মেজর কাওসার–এত বড় সাহস দস্যু বনহুরের যে পুলিশ অফিসে আগমন করে! আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন আমি নিজে দেখে নেবো দস্যু বনহুরের সাধ্য কি সে এসে পুলিশ অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন মজিদ আপনি খেয়াল রাখবেন, আমি ততক্ষণে আমাদের আগমনের কারণটা মিঃ আরিফকে জানিয়ে দেই।

ক্যাপ্টেন মজিদ বললেন–ইয়েস স্যার, আমি সতর্ক আছি।

মিঃ কাওসার বললেন–দেখুন, আমি জানতে পেরেছি কাল ২৪শে মার্চ গভীররাতে কান্দাই পর্বতমালার দক্ষিণ পাদমূলে মহারাজ দেবকী নারায়ণকে নিয়ে একদল শয়তান অপেক্ষা করবে। মহারাজের পরিবর্তে এক লাখ টাকা তারা দাবি করেছে মহারাজের মন্ত্রিবরের কাছে। সেই টাকা গ্রহণ করার জন্যই এই উপায় অবলম্বন করা হয়েছে।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ–কোলাইমহারাজ দেবকী নারায়ণের সন্ধান পাওয়া। গেছে?

হাঁ মিঃ আরিফ এবং সেই সংবাদ আপনাকে জানানোর জন্য আমি নিজে এলাম। দেখুন,মহারাজ দেবকী নারায়ণকে উদ্ধার করতে হবে তার সঙ্গে গ্রেপ্তার করতে হবে কান্দাই এর নরপিশাচ শয়তান দলকে যারা কান্দাই অধিবাসীদের চরম ক্ষতি সাধন করে চলেছে।

আপনি নিজে কষ্ট করে এসে এই সংবাদটা জানালেন এজন্য সত্যি আমরা চরম উপকৃত হলাম।

মেজর কাওসার বললেন–যদি প্রয়োজন মনে করেন ক্যাপ্টেন মজিদ সৈন্য দিয়ে আপনাদের সাহায্য করবেন।

থ্যাঙ্ককিউ মিঃ কাওসার আপনি এবং ক্যাপ্টেন মজিদ আমাদের নিকটে সংবাদটা জানিয়ে যে উপকার করলেন তাতেই আমরা অত্যন্ত উপকৃত হবে বলে আশা করছি। মহারাজ দেবকী নারায়ণ মহাশয় ব্যাপারে আমরা অত্যন্ত ব্যস্ত এবং চিন্তিত ছিলাম। এবার আমরা সুষ্ঠভাবে কাজ করতে সক্ষম হবো.. ………

মিঃ কাওসার বললেন–দেখুন অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। পুলিশ মহল ছাড়া এ কথা যেন ঘুণাক্ষরে বাইরের কেউ জানতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন।

আরও কিছুক্ষণ মেজর কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ অপেক্ষা করলেন, দস্যু বনহুর যদি এসে পড়ে তাহলে পুলিশ সুপারকে তারা সাহায্য করবেন। কিন্তু দস্যু বনহুরের আসার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না।

এক সময় মেজর হোসেন কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ বিদায় গ্রহণ করলেন।

কাজ শেষ করে সেই সময় ফিরে এলেন মিঃ ইয়াসিন, তিনি বিশেষ কাজে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন বাইরে।

এসে যখন জানতে পারলেন এখনও দস্যু বনহুর আগমন করেনি তখন মিঃ ইয়াসিন মনে মনে খুশি হলেন, কতকটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন যেন।

মিঃ আরিফ বললেন মিঃ ইয়াসিন একটা সংবাদ আছে।

সংবাদ। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন মিঃ ইয়াসিন।

মিঃ আরিফ বললেন–আপনি বসুন সব বলছি। একটু পূর্বে মেজর হোসেন কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ এসেছিলেন তারা জানিয়ে গেলেন কোলাই-মহারাজ দেবকী নারায়ণকে কোন শয়তান দল ২৪শে মার্চ রাতে কান্দাই পর্বতমালার দক্ষিণ পাদ মূলে……..

মিঃ ইয়াসিনের মুখমণ্ডল হঠাৎ দীপ্ত হয়ে উঠলো, তিনি বুঝতে পারলেন দস্যু বনহুর তার কথামতই এসেছিলো পুলিশ অফিসে। মেজর কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ তারা নিশ্চয়ই আসেন নাই। সব শোনার পর বললেন মিঃ ইয়াসিন–স্যার দস্যু বনহুর তা হলে…..

মিঃ ইয়াসিনের কথার মাঝখানে বলে উঠলেন মিঃ আরিফ আমি জানতাম সে যতই দুঃসাহসী হোক পুলিশ অফিসে আসার সাহস তার হবে না।

মিঃ ইয়াসিন বললেন- স্যার দস্যু বনহুর স্বয়ং এসেছিলো।

বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বললেন মিঃ আরিফ–এ আপনি কি বলছেন!

হাঁ স্যার কারণ মেজর কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদ এখন কান্দাই-এর বাইরে গেছেন কোন জরুরি কাজে……….

বলেন কি, তাহলে….

মেজর কাওসার এবং ক্যাপ্টেন মজিদরূপেই দস্যু বনহুর ও তার কোন সহচর এসেছিলো পুলিশ অফিসে।

মিঃ ইয়াসিন আপনি..

স্যার, আমার সন্দেহ সম্পূর্ণ সত্য হওয়াই স্বাভাবিক।

তাহলে আমি এক্ষুণি মেজর অফিসে ফোন করে জেনে নিচ্ছি?

তা নিতে পারেন স্যার কিন্তু দস্যু বনহুর যে আমাদের পুলিশ অফিসে এসেছিলো এবং সে কোলাই-মহারাজ সম্বন্ধে এতো কিছু বলে গেছে এ সব কোনক্রমেই প্রকাশ করবেন না। কারণ দস্যু বনহুর আমাদের সতর্ক করে দিয়েছে বাইরে একথা প্রকাশ হলে মহারাজ দেবকীচরণকে উদ্ধার করা হয়তো সম্ভব নাও হতে পারে।

মিঃ আরিফ যেন থ’ হয়ে গেছেন। দস্যু বনহুর প্রকাশ্য পুলিশ অফিসে এসে আবার নির্বিঘ্নে চলে গেলো তাকে গ্রেপ্তার করা তো দূরের কথা চিনতেও পারলো না কেউ। কিন্তু এখন ভাবভার

সময় নেই, আজই যে ২৪শে মার্চ কান্দাই পর্বতের উদেশ্যে রওনা দিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *