Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কর্মফল || Sujan Dasgupta

কর্মফল || Sujan Dasgupta

১.

গতকাল রাত্রে কলকাতায় এসে পৌঁছেছি, ভালো করে ঘুমও হয়নি। সকালে হাতমুখ ধুয়ে চা নিয়ে পত্রিকা খুলতেই চোখে পড়ল–

‘কিলার নার্ভ-ডিজিজ!!! আরেক বলি!’

দ্রুত পড়ে যেটুকু বুঝলাম, এবার মৃত কিশলয় দত্ত বলে এক যুবক। গত দু’মাসে এই নিয়ে তিনজনের মৃত্যু। কোনও চিকিৎসাই কাজ দিচ্ছে না। রোগলক্ষণ অনেকটা সিভিয়ার মেনিঞ্জাইটিস বা এনফেলাইটিজের মতো। শুরু হয় অসহ্য মাথা ধরা, ধূম জ্বর, ডিজওরিন্টেশন, ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া দিয়ে। দেখতে দেখতে সেটা চলে যায় কোমায়। কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু। এখন পর্যন্ত যারা আক্রান্ত হয়েছে সবাই যুবক… কোনও শিশু বা বৃদ্ধ নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে এটা মশাবাহিত রোগ নয়, জলবাহিতও নয়।

রোগের কারণটাই জানলি না, কিন্তু বুঝে গেলি এটা মশাবাহিত বা জলবাহিত নয়! যত্তসব! সক্কাল বেলাতেই গেল মেজাজটা বিগড়ে।

মা-কে জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার! আমাকে তো আগে কিছু জানাওনি?”

“কী জানাব?”

“এই যে ছেলেদের এরকম প্রাণঘাতি অসুখ হচ্ছে! আমিও তো একটা ছেলে।”

মা অবাক হয়ে বলল, “দেশে কি অসুখের কমতি আছে? আর অসুখ তো হয়েছে মাত্র তিনজনের… আর শুধু ছেলেদের অসুখ বুঝছে কী করে?”

“মা যে স্ট্যাটিস্টিকসের ছাত্রী ছিল ভুলেই গিয়েছিলাম। আসলে অসুখকে আমার ছেলেবেলা থেকেই ভয়। তিরিশ পেরিয়েও সেই ভয় যায়নি। প্রতিবারই দেশে আসি আর দুশ্চিন্তা করি, যদি অসুস্থ হয়ে পড়ি? ডেঙ্গু, ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া, চিকেনগুনিয়া.. অসুখের কি আর শেষ আছে? নিউ ইয়র্কে যে অসুখ হয় না তা নয়… তবে কলকাতার তুলনায় তা নস্যি। কলকাতায় মশা সমস্যা দেখি এতটুকু কমেনি, দেশ যখন ছেড়েছি তখনও যা ছিল, এখনও তাই আছে। প্রতিবছরই শুনি এইবার নাকি এমন মশা-নিধন হবে, মশাবাহিত কোনও রোগই এপিডেমিক পর্যায় পৌঁছবে না। কোথায় কি! আর এবার তো দেখছি কোত্থেকে এসে হাজির হয়েছে বিদঘুঁটে এই নার্ভের অসুখ!

প্রমথ আর আমি সাধারণত একসঙ্গে কলকাতায় আসি। এবার ও দু’দিন আগে এসেছে ওর ভাগ্নের মুখে ভাতে বলে। ফোন করলাম।

“শুনেছিস নার্ভের অসুখের খবরটা?”

“কখন এসে পৌঁছলি?” প্রমথ আমার প্রশ্নটাকে পাত্তা দিল না।

“কাল রাত বারোটায়। কিন্তু নার্ভের অসুখের ব্যাপারটা দেখেছিস, কী বিপদ বল তো!”

“মরেছে তো মাত্র তিনজন, এত টেনশন করছিস কেন?”

“বলিস কি? একটা অজানা রোগ কেন হচ্ছে, কী করে হচ্ছে… একটা চিন্তার বিষয় নয়?”

“নিউ ইয়র্কে তো অটো-অ্যাকসিডেন্ট আর বন্দুকের গুলিতেই মরে অনেক বেশি লোক। তোর চিন্তা তো তাতেই বেশি হওয়া উচিত। বাদ দে ওসব কথা, আজ বিকেলে একেনবাবু চা খেতে ডেকেছেন পাঁচটা নাগাদ, চলে আসিস।”

একেনবাবুর কথাটা তো এখনও বলা হয়নি। একেনবউদি যে নিউ ইয়র্ক যাচ্ছেন না সেটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত। এতদিন আশায় আশায় থেকে অবশেষে একেনবাবু হাল ছেড়েছেন। তাই কলকাতায় একটা ডিটেকটিভ এজেন্সি শুরু করেছেন পুরোনো কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে। আপাতত দু-নৌকোয় পা, কলকাতায় পাঁচ মাস আর নিউ ইয়র্কে সাতমাস। এই পাঁচ-সাতের ব্যাপারটার সঙ্গে মনে হয় ট্যাক্সের কোনও বিষয় জড়িত। যদিও বিশদ করে বলেন না। নিউ ইয়র্কে ওঁর প্র্যাক্টিস হল ‘সোলো’, গোয়েন্দাগিরি যা করার একাই করেন। নিউ ইয়র্কে যখন থাকেন না, আরেকটা এজেন্সির সাহায্য নেন। কলকাতার বড় বড় কাজগুলো উনিই দেখেন, নিউ ইয়র্কে থাকলে লং ডিস্টেন্সে। দৌড়োদৌড়ির কাজগুলো করেন ওঁর সহকর্মীরা, উনি খেলান মাথা। এইবার এসে সেই নিয়ে একেনবাবু একটু ব্যস্ত। এজেন্সিটা কয়েক বছরের মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলে… গুডবাই ম্যানহাটান, গুডবাই নিউ ইয়র্ক।

কলকাতায় বেড়াতে এলেও দৈনিক আড়ার অভ্যাস আমাদের ছাড়ে না। আচ্ছাটা তখন হয় একেনবাবুর বাড়িতে। অন্যতম কারণ, একেনবউদি সবসময়েই চমৎকার চা আর উপাদেয় টা’র বন্দোবস্ত করেন।

আজকে গিয়ে দেখি একেনবাবু নেই, ওঁর এখানকার এজেন্সির কী একটা কাজে নাকি আটকা পড়েছেন। তবে শিগগিরি আসবেন। বিশেষ করে বলে গেছেন আমরা যাতে চলে যাই।

চলে যাবার প্রশ্নই উঠছে না। একেনবউদি আজ লুচি আর আলুর-দম করেছেন। সেগুলোর সদ্ব্যবহার না করে কে পালাবে? তারপর প্রমথর বায়না রাখতে লম্বা লম্বা ফালি করে বেগুন ভাজা হচ্ছে। ভাজছে বাড়ির কাজের মেয়েটি, একেনবউদি আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন।

একেনবউদিকে আলাদা ভাবে তেমন পাওয়া যায় না, একেনবাবু সব সময়েই উপস্থিত থাকেন। ফলে বউদির সঙ্গে গল্প করতে গেলেই একেনবাবু অদ্ভুত কিছু একটা বলে বসেন, কথা ঘুরে যায়। আজকে তার সম্ভাবনা নেই।

নানান গল্প হচ্ছে। প্রমথ হঠাৎ একেনবউদিকে বলল, “এবার মনে হচ্ছে একেনবাবু সিরিয়াসলি দেশে ফেরবার কথা ভাবছেন।”

“কে জানে ভাই, এজেন্সিটা দাঁড়িয়ে গেলে মনে হয় আসতে পারবে। কিন্তু এগুলো কি বলা যায় কবে হবে।”

“আচ্ছা বউদি, একেনবাবু হঠাৎ নিউ ইয়র্ক গেলেন কেন? যাওয়ায় আমাদের অবশ্য মস্ত লাভ হয়েছে, কিন্তু কেন হঠাৎ করে গেলেন সেটা কোনওদিনই জানতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলেই কেমন জানি এড়িয়ে যান।”

একেনবউদি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “অনেকদিন তো হয়ে গেছে, এখন হয়তো বলতে বাধা নেই। আগে হলে বলতে দিত না।

“তাহলে একেনবাবু আসার আগেই বলে ফেলুন, নইলে আবার ঝামেলা পাকাবেন।” আমি বললাম।

“না ভাই, এখন আর মনে হয় পাকাবেন না। ও কলকাতা ছেড়েছিল, একটা কনফারেন্সে যেতে পারার সুযোগে। তবে আগেও এ ধরণের সুযোগ পেয়েছিল, নিজের কাজে খুব সুনাম ছিল তো। কিন্তু যায়নি।”

“আর এবার? নিশ্চিন্ত মনে বলুন বউদি, একেনবাবু কিছু জানতে পারবেন না।” প্রমথ অভয় দিল।

“আরে না ভাই, ও এখন আর এ নিয়ে কিছু মনে করবে না। আসলে সেই সময়ে ও একটা মানসিক ধাক্কার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ভালো লাগছিল না পুলিশের কাজটা…।”

“কেন?”

হঠাৎ একেনবউদির কী জানি মনে হল। বললেন, “না, ভাই ওর কাছেই উত্তরটা জেনে নেবেন, ওই ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারবে।”

এমন সময়ে ডিং ডং ডোর বেল। দরজায় পুলিশের পোষাক পরা এক সুন্দরী। “এই যে বউদি, দাদা আছে?”

“আরে শ্রেয়া, আয় আয়। তোর দাদা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে। বস, এঁদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই।” বলে আমাদের দিকে তাকালেন।

শ্রেয়া নামে সেই পুলিশ অফিসারটি এক মুহূর্ত আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, “এঁরাই দাদার সেই দুই বন্ধু?”

“হ্যাঁ, ইনি হচ্ছেন বাপি, আর ইনি প্রমথ।”

“আপনাদের দু’জনের কথা আমি অনেক শুনেছি।” মুখে মিষ্টি হাসি।

“এটা তো অন্যায়, আপনার কথা আমরা শুনিনি কেন?” প্রমথ অভিযোগের সুরে বলল।

“ওকে আবার আপনি আপনি করছেন কেন ভাই, দু’বছরও হয়নি ও অফিসার হয়েছে।”

“তা হোক, বউদি, পুলিশ অফিসার তো, কখন হাতকড়া লাগিয়ে দেন!”

প্রমথর কথা বলার ভঙ্গিতে শ্রেয়া হাসল, এবার আর নিঃশব্দে নয়।

শ্রেয়ার পরিচয় বিশদ করে পেলাম। একেনবাবুর দূর-সম্পর্কের খুড়তুতো বোন। ইন্ডিয়ান পুলিস সার্ভিসে ঢুকে বছর দেড়েক পোস্টেড ছিল বেনারসে। বদলি নিয়ে কলকাতায় এসেছে মাস কয়েক হল। প্রবাসী বাঙালি, তাই বাংলায় একটু হিন্দির টান। অত্যন্ত মিশুকে মেয়ে। একে আপনি আজ্ঞে করা যায় না বেশিক্ষণ। আপনি’ হিসেবেও নিজেকে দূরে রাখা যায় না।

একেনবউদি শ্রেয়ার জন্য চা-জলখাবারের বন্দোবস্ত করতে গেলেন।

প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি পুলিশি কাজে এসেছ, না একেনবাবুর সঙ্গে আড্ডা দিতে?”

“আড্ডা দিতেই, তবে দাদার কাছে তো শুধু আড্ডা দিয়ে ফেরা যায় না, কাজের কথাও দুয়েকটা এসে যায়!”

“একেনবাবু কিন্তু এখন চার্জ করবেন কাজের জন্য, ডিটেকটভ এজেন্সি খুলেছেন যে।”

“বোনকে চার্জ করবে না, আর গিভ এন্ড টেক-এর ব্যাপার… আমিও তো সাহায্য করব দরকার পড়লে…।”

শ্রেয়া কথা শেষ করতে পারল না, একেনবাবু এসে হাজির।

“কি রে কখন এলি?” শ্রেয়াকে কথাটা বলে আমাদের দিকে তাকালেন একেনবাবু। “আপনারা কি স্যার অনেকক্ষণ বসে আছেন?”

“আছিই তো! কী ধরণের হোস্ট মশাই আপনি, গেস্টদের ডেকে নিজে হাওয়া হয়ে যান!” প্রমথ ওর ইউয়াল খোঁচা দেওয়ার মুডে।

“কী যে বলেন স্যার, ফ্যামিলিকে তো বলে গিয়েছিলাম আপনাদের বসাতে।”

“প্রমথর কথা ছাড়ুন, আপনার ফ্যামিলি, মানে আমাদের বউদি, শুধু আমাদের বসাননি, ভালোমন্দ খাবারের বন্দোবস্তও করেছেন।”

আমাদের মধ্যে সম্পর্কটা শ্রেয়া মনে হয় ভালো করেই জানে, দেখলাম হাসিহাসি মুখেই উপভোগ করছে।

“আসলে স্যার, একটা সমস্যা নিয়ে আটকা পড়েছিলাম। ভালোই হয়েছে শ্রেয়া এসেছে, ওরও সাহায্য লাগবে।”

‘সাহায্য করব, সাহায্য নেব।” শ্রেয়া আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল। ভাবটা, কী, বলেছিলাম না একটু আগে?

“আপনি মশাই সামথিং!” প্রমথ আবার একেনবাবুকে চার্জ করল। “কেন স্যার?”

“আপনার বোন যে পুলিশে আছে, সেটা লুকিয়ে রেখেছিলেন কেন?”

“কী মুশকিল স্যার, লুকাবো কেন, প্রসঙ্গটা ওঠেইনি!”

“বেশ এখন প্রসঙ্গটা তুলছি, আপনার ভাই বোনরা আর কে কোথায় পোস্টেড বলুন।” আমার দিকে তাকালেন একেনবাবু, “এই প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

“এই নে তোর চা,” শ্রেয়াকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে একেনবাবুকে বউদি বললেন, “লুচি আসছে, ভাজা হচ্ছে। তুমিও হাতমুখ ধুয়ে নাও।”

২.

একেনবাবু হাতমুখ ধুয়ে আসতেই শ্রেয়ার আসার আসল কারণ বুঝলাম। এসেছে একটা ঝামেলায় পড়ে। কাজে যোগ দিতে না দিতেই ওর ঘাড়ে একটা বড়োসড়ো দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। ক’দিন আগে নার্ভের অসুখে কিশলয় রায় বলে যে যুবকটি মারা গেছে, তার মৃত্যুর তদন্ত করা।

“পত্রিকায় তো পড়লাম ব্যাপারটা, চব্বিশ ঘণ্টার নিউজেও বেশ জল ঘোলা হচ্ছে। কিন্তু পুলিশি তদন্তের ব্যাপারটা আসছে কেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“কারণ হল, রোগীর ফ্যামিলি কানেকশন। কিশলয়ের বাবা খুব ইনফ্লুয়েনশিয়াল বিজনেসম্যান, তার ওপর শাসকদলের পেয়ারের লোক। তাঁর অভিযোগ ছেলের মৃত্যু ঘটেছে প্রাইভেট হাসপাতালের গাফিলতিতে। ভুল চিকিৎসা, সেবাযত্নে অবহেলা, ইত্যাদি। হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ সেটা মানতে রাজি নয়। তাদের বক্তব্য, স্নায়ুরোগে আক্রান্ত কিশলয় হাসপাতালে ছিল সপ্তাহ চারেক। প্রথম দিন থেকেই প্রয়োজনীয় সব চিকিৎসাই করা হয়েছিল, তা সত্ত্বেও কোমায় চলে যায়। কোমায় ছিল মাস চারেক, তারপর একটার পর একটা অর্গান ফেল করে মৃত্যু।”

“পোস্ট মর্টেম করা হয়েছে?” একেনবাবুর প্রশ্ন।

“হ্যাঁ। ব্রেন-এ বিপজ্জনক পরিমাণের মার্কারি পাওয়া গেছে। মার্কারি নার্ভের পক্ষে মারত্বক। প্রশ্ন হল, মার্কারিটা এল কোত্থেকে?”

“দাঁড়া দাঁড়া! এই যে কিশলয়ের কথা বলছিস, তিনি তো হাসপাতালেই এসেছিলেন অসুস্থ অবস্থায়?”

“হ্যাঁ, কিন্তু কিশলয়ের বাবার বক্তব্য তখন অতটা অসুস্থ সে ছিল না। হাসপাতালে নানান ধরণের ওষুধপত্র ইঞ্জেকশন ইত্যাদি দেওয়া হয়েছিল, সেখান থেকেই মার্কারি পয়েজনিং হয়েছে।”

“বুঝলাম। কিন্তু তুই নিশ্চয় শুনেছিস, কিছুদিন আগে আরও জনা দুই নার্ভের অসুখে মারা গেছে, সেগুলোও কি এই হাসপাতালে?”

আমি বুঝতে পারছিলাম, একেনবাবু কোনদিকে এগোচ্ছেন। কয়েক বছর আগে মার্কিন মুলুকে একজন নার্সকে ধরা হয়েছিল রোগীদের গোলমেলে ওষুধ দিয়ে খুন করার অভিযোগে। পুরো কেসটা অবশ্য মনে নেই।

“না, আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এই হাসপাতালে এই একটাই কেস।”

“অন্য যেসব লোক নার্ভের অসুখে মারা গেছে, তাদের অটোপ্সি হয়েছে?”

“না, দাদা। তুমি তো জানো, সব সময়ে করা হয় না– যদি না মৃত্যুর সঙ্গে কোনও অপরাধ জড়িয়ে আছে সন্দেহ করা হয়।”

“ঠিকই বলেছিস।” বলে একেনবাবু প্রমথর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তো স্যার এইসব জিনিস অনেক জানেন, মার্কারি শরীরে কী ভাবে ঢুকতে পারে?”

“মার্কারি পয়জন নিয়ে মার্কিন মুলুকে অনেক কাজ হয়েছে।” প্রমথ বলল, “লিকুইড মার্কারিতে সমস্যা নেই, তবে মার্কারি ফিউম বা ধোঁয়া নার্ভকে অ্যাটাক করে।”

প্রমথ অনেক কিছু জানে, আবার মাঝে মাঝে গুলতাপ্পিও দেয়।

“এখানে কয়েকজন পয়জন স্পেশালিস্টের সঙ্গে কথা বলেছি,” শ্রেয়া জানাল। “ওঁরা নানান রকমের মার্কারি কম্পাউন্ডের কথা বলেছেন, এই ধোঁয়ার কথাও বলেছেন। কিন্তু তার আগে বুঝতে হবে এভাবে হত্যা করার মোটিভটা কি? আর এটা যদি হত্যা না হয়, কেমিক্যাল এক্সপোজারের কথা ভাবতে হবে। কোনও হ্যাঁজার্ডাস সাইটে উনি গিয়েছিলেন কিনা। কেউ কেউ আবার পত্মশনের প্রসঙ্গও তুলেছেন। জাপানের মিনামাতার কাহিনি শুনিয়েছেন। সেই অ্যাঙ্গেল দিয়েও দেখছি।”

“মিনামাতা’ কেসটা কি?” আমার মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল।

“মিনামাতা জাপানের একটা শহর। মিনামাতার একটা কেমিক্যাল প্ল্যান্ট থেকে বিষাক্ত মিথাইল মার্কারি বর্জ হিসেবে সমুদ্রে ফেলা হত। ফলে সমুদ্রের মাছগুলো বিষাক্ত হয়ে যায়। সেগুলো খেয়ে এক সময়ে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছিল নার্ভের অসুখে। আমরাও খোঁজ নিচ্ছি কলকাতার কোনও কেমিক্যাল প্ল্যান্ট এই কাজ করছে কিনা।”

“সেটার সম্ভবনাই তো বেশি মনে হচ্ছে, যখন নার্ভের অসুখে লোকে মারা যাচ্ছে। তবে একটাই খটকা।” একেনবাবু বললেন।

“কী বল তো দাদা?”

“শুধু যুবা পুরুষই কি মাছ খায়?”

শ্রেয়ার মুখটা দেখে বুঝলাম, এই বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি। প্রমথ অবশ্য ফোড়ন কাটল, “তার কারণ, মেয়েদের জেনেটিক মেক-আপ অনেক স্ট্রং।”

মনে হল কথাটা শ্রেয়ার পছন্দ হয়েছে।

“মুশকিল কী জানিস,” একেনবাবু মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন। “এই সমস্যার সমাধান করতে গেলে কিশলয়বাবুর জীবনের প্রতিটা স্টেপ মিনিট বাই মিনিট তোকে ফলো করতে হবে। কোথায় গিয়েছেন, কী করেছেন, কী খেয়েছেন, কী মেখেছেন। করতে করতে তোর জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে, যদি না হঠাৎ একটা শর্ট-কাট মেলে।”

“শুনছো দাদার কথা!” শ্রেয়া অনুযোগ ভরা দৃষ্টিতে একেনবউদির দিকে তাকাল।

“আচ্ছা বোনটাকে একটু সাহায্য করো না… ওর নতুন চাকরি!” একেনবউদি একটু বিরক্ত হয়েই যেন কথাটা বললেন।

“আরে শোনো না, ওই শর্ট-কাট পাওয়াটা খুব ইম্পর্টেন্ট।” এটা একেনবউদিকে বলে খানিকটা কৈফিয়তের সুরে আমাদের বললেন, “আচ্ছা, আপনারাই বলুন স্যার… ধরুন, মহারাজ দিগবিজয় সিং মনে মনে একটা সংখ্যা ভেবেছেন এক থেকে দশ লক্ষের মধ্যে। আপনাদের সেই সংখ্যা খুঁজে বার করতে হবে। প্রতিদিনই শুধু একটা করে সংখ্যা মহারাজকে বলতে পারবেন। শুনে মহারাজ জানাবেন, সেটা ঠিক না ভুল। তাহলে ক’দিন লাগবে সংখ্যাটা বার করতে?”

“একদিনও লাগতে পারে, আবার দশলক্ষ দিনও লাগতে পারে।” আমি বললাম।

“ঠিক স্যার, সেইজন্যেই শ্রেয়াকে বলছিলাম শর্ট-কাট-এর কথা। অর্থাৎ আমরা যদি জানতাম মহারাজ দিগবিজয়ের দুর্বলতা হল ছয়। ছয় ছাড়া উনি আর কিছু ভাবতে পারেন না। তাহলে ৬ হবে সেই শর্ট-কাট। উনি ভাববেন ৬ বা ৬৬ বা ৬৬৬ বা ৬৬৬৬.. তাহলে চট করে সংখ্যাটা বার করে ফেলা যাবে।”

“ননসেন্স, শ্রেয়ার সমস্যার শর্ট-কাটটা কি?” প্রমথ একটু বিরক্ত হয়েই একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল।

“আই হ্যাভ নো ক্লু স্যার। কিন্তু সেটাই প্রথম খুঁজে বার করতে হবে।”

“তোমার দাদার কথা কিছু বুঝলে?” শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল প্রমথ।

শ্রেয়া মাথা নাড়ল। কিন্তু হাসি দেখে বুঝলাম, বোনের হাত থেকে একেনবাবু সহজে ছাড়া পাবেন না।

ইতিমধ্যে লুচি আলুর দম এসে যাওয়ায় এ নিয়ে আর কথা হল না। তবে খেতে খেতে শ্রেয়া একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমার কী সাহায্য চাইছ, সেটা তো বললে না?”

“একজন মিসিং পার্সনের খোঁজ করতে।”

“মিসিং পার্সন?”

“হ্যাঁ।”

“ডিটেল-এ বলো।”

“পরে বলব রে, এখন বলতে গেলে লুচি আর আলুর দম মিসিং হয়ে যাবে।”

বোনের সঙ্গে একেনবাবুর আচরণ একেবারে টিপিক্যাল ভাই-বোনের মতো, একেবারে অন্য একেনবাবু! বেশ মজা লাগছিল দেখতে।

সেদিন বাড়িতে ফেরার পথে প্রমথ আমার পেছনে লাগতে শুরু করল। কোনও নতুন মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হলেই যেটা ও করে।

“হ্যাঁরে, শ্রেয়াকে কেমন লাগল?”

“বেশ তো।”

“আমার কি মনে হয় জানিস, ওর মতো একটা মেয়ে তোর পক্ষে খুব ভালো হবে।”

“তুই নিজের চরকায় তেল দে।”

“না সিরিয়াসলি, মেয়েটা সুন্দরী, ব্রাইট… পুলিশে যখন চাকরি করে তখন তোর মতো ন্যালা-খ্যাপাকে সামলাতে পারবে।”

“তুই থামবি?”

“বেশ এখন থামছি, কিন্তু একেবউদির কাছে কথাটা পাড়ব।”

“বউদিকে কিছু বললে তোকে আমি খুন করব।”

“করলে তো সেই শ্রেয়ার হাতেই ধরা পরবি। তারজন্যেই না হয় আমি মরব, তোদের মিলনের জন্য সেটা হবে আমার আত্মত্যাগ।”

“এবার স্টুপিডামিটা বন্ধ করে উত্তর দে, কাল ‘গ্রিন-লিফ’-এ যাব চুল কাটতে– আসবি?”

‘গ্রিন-লিফ’ নামটা বানালাম, খামোক একটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন দিতে চাই না। যার নামটা উহ্য রাখলাম, সেটা একটা ঝকঝকে ফাইভ-স্টার ইউনিসেক্স বিউটি সেলুন, একটা তিনতলা বাড়ির পুরো দোতলা জুড়ে। আমাদের বাড়ির থেকে বেশি দূরেও নয়।

“হঠাৎ গ্রিন লিফ-এ যাবি কেন, কোনও পাত্রীপক্ষ তোকে দেখতে আসছে নাকি?”

“এবার তোকে সত্যিই ঠ্যাঙাবো। যাবি কি না বল?”

“এটা একটা প্রশ্ন হল নাকি! নিশ্চয় যাব। যখন যাচ্ছি, তখন ব্ল্যাকহেডগুলোও তুলে ফেলব।”

৩.

আমি আর প্রমথ কলকাতায় এলে সব সময়ে চুল কাটি। এখানে অনেক সস্তা। হিসেব করে দেখেছি, গ্রিন লিফ-এর মতো দামি সেলুনেও বেশি হলে আড়াইশো টাকা দিই। ম্যানহাটনে ওই স্ট্যান্ডার্ডের দোকানে টাকার হিসেবে অন্তত বারোশো গুনতে হয়! আর প্রমথ যে ব্ল্যাক-হেড তোলার কথা বলল, সেটা কী জানেন তো? চামড়ার ওপর কালো কালো বিন্দুর মতো। ওগুলো কেন হয় তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রমথ দিয়েছিল, সেটা অবশ্য এখন মনে নেই। তবে মনে আছে প্রমথর গার্ল ফ্রেন্ড ফ্রান্সিস্কার পরামর্শে লোয়ার ম্যানহাটানের একটা বিউটি পার্লারে গিয়েছিলাম ব্ল্যাকহেড তুলতে। তোলার কাজটা মোটেই কঠিন নয়… ব্ল্যাক-হেডের ওপর প্লাস্টিকের সরু নল বা নক্ল বসিয়ে ভ্যাকুয়ামের টানে চামড়ার ভেতর থেকে উৎপাটিত করা। তার আগে অবশ্য মুখে স্টিম দিয়ে চামড়াকে ঢিলে করতে হয়। ফলে এতটুকু ব্যথা লাগে না। তারপর মুখে ক্রিমটিম মাখিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুছলেই একেবারে চকচকে পরিষ্কার নতুন মুখ!

ম্যানহাটানে এটা করাতে আমাদের লেগেছিল কড়কড়ে একশো ডলার! নিতান্ত ফ্রান্সিস্কার চাপে পড়ে গিয়েছিলাম। কলকাতার গ্রিন-লিফ-এ ওই একই কাজ ৮০০ টাকায় করানো যায়। একজনকে করাতেও দেখলাম গত বছর। যন্ত্রপাতি প্রায় একই, সেই লেটেক্স-এর গ্লাভস পরা বিউটিশিয়ান, মুখে যে ক্রিমটা দেয় সেটাও আলো ভেরা… ম্যানহাটানে ওটাকেই লাগাতে দেখেছি। সুতরাং করানো যেতে পারে। করালে মা খুশি হবে, ক’দিন আগেই বলছিল, “হ্যাঁরে, তোর মুখে আবার ওই কালো কালো ফুটকিগুলো ফিরে এসেছে।”

গ্রিন লিফ-এ আগের চেনা মেয়েদের মধ্যে মাত্র একজনকে দেখলাম। রিসেপশিস্ট জানতে চাইল, আমরা কী করাতে চাই। উত্তর দিতে যাব এমন সময়ে মা-র একটা ফোন। আমি একটু সরে গিয়ে ফোনটা ধরলাম। মা-র প্রেশারের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, বাড়ি আসার সময় যেন কিনে আনি। ফোন শেষ করে দেখি প্রমথ সেই চেনা মেয়েটির সঙ্গে গিয়ে একটা চেয়ারে বসেছে। পাশে গোটা দুই চেয়ার খালি, কিন্তু সেখানে কোনও বিউটিশিয়ান নেই। প্রমথ কী বলেছিল জানি না, আমাকে রিসেপশনিস্ট মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “আপনিও কি হেয়ার কাট, ফেশিয়াল– দুটোই করবেন?”

আমার ধারণা ছিল ফুল-ফেশিয়াল-এ আরও অনেক কিছু করা হয়। তাই বললাম, “চুল কাটব, আর ব্ল্যাকহেড রিমুভ করব। তার জন্য কি ফুল-ফেশিয়াল করতে হবে?”

“ঠিক আছে, আপনি একটু বসুন, আমি ভেতরে খবর দিচ্ছি।”

বসার জায়গাটা বেশ প্রশস্ত। একটা বড়ো সোফা, উলটো দিকে দু’জন বসার লাভসিট আর পাশে দুটো চেয়ার। মাঝখানে লম্বা কফি টেবিল। দেয়াল ঘেঁসে একটা র‍্যাকে হরেক রকমের ম্যাগাজিন– বাংলা, ইংরেজি, কয়েকটা হিন্দিও দেখলাম। সেখান থেকে ইন্ডিয়া টুডে-টা তুলে নিয়ে বসলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বড় সানগ্লাস চোখে হিজাব আর নিকাব পরা একটি মেয়ে ভিতরের একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এল। প্রথমে ভেবেছিলাম কাস্টমার। না, এখানেই কাজ করে, বিউটিশিয়ান।

“আসুন স্যার।”

আমার অসোয়াস্তি লাগল। শেষে হিজাব নিকাব পরা একটা মেয়ে চুল কাটবে, তার ওপর সানগ্লাস পরে! অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠলাম। প্রমথর পাশের চেয়ারে মেয়েটি আমাকে বসাল। চাদর দিয়ে গা-টা ঢাকতে ঢাকতে জিজ্ঞেস করল, “প্লেইন হেয়ারকাট, শ্যাম্পু দিতে চান না, তাই তো?”

“ঠিক।”

“আর ব্ল্যাকহেড রিমুভ করাবেন?”

“এক্সাক্টলি, আর কিছু করার দরকার নেই।”

মেয়েটা দেখলাম চোখের সানগ্লাসটা খোলেনি। পুরো মুখটাই হিজাব, নিকাব আর সানগ্লাস-এ ঢাকা।

“সানগ্লাস চোখে ব্ল্যাকহেডগুলো দেখতে পারবেন?” মুখ দিয়ে ফস করে বেরিয়ে গেল।

“নিশ্চয় পারব।”

মুসলিম মেয়ে, মুখ দেখাতে চায় না বুঝতে পারি, কিন্তু চোখ দেখাতে এত অসুবিধা কেন বুঝলাম না! প্রমথ দেখি ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ভাবটা কেমন জব্দ

আমার দুর্ভাবনার কোনও কারণ ছিল না। মেয়েটা এফিশিয়েন্ট। নিউ ইয়র্কের সেলুনের মতোই ইলেক্ট্রিক হেয়ার-ক্লিপারের সঙ্গে কয়েক ধরণের চিরুনি অ্যাটাচমেন্ট লাগিয়ে দ্রুত চুল-কাটার পর্ব শেষ করল। তারপর মুখে স্টিম দিয়ে আঙুলে কটন প্যাড জড়িয়ে কপালে আর গালের কয়েকটা জায়গায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চাপ দিল। শেষে ভ্যাকুয়াম চালিয়ে কাজটা সম্পূর্ণ করল। ব্ল্যাকহেড তোলার পর আমার সামনে একটা বড় আয়না ধরে দেখাল। সত্যিই সবগুলো দাগই অদৃশ্য।

আমি সন্তোষ প্রকাশ করলাম, কিন্তু মুক্তি পেলাম না।

একটু ক্রিম মাখিয়ে দিচ্ছি বলে আলো ভেরার একটা বড় বোতল ড্রয়ার থেকে বার করে জিজ্ঞেস করল, আমার কোনও ক্রিম-এ অ্যালার্জি আছে কিনা। নেই শুনে চেয়ারটা হেলিয়ে দিয়ে মুখে ক্রিম লাগাতে শুরু করল। চুপচাপ না থেকে আমিও খেজুরে আলাপ শুরু করলাম।

“কতদিন ধরে বিউটিশিয়ানের কাজ করছেন?”

“বছর ছয়েক।”

“গত বছর কিন্তু আপনাকে এখানে দেখিনি।”

“আমি সব সময়ে কাজ করি না, আজকে আমরা শর্ট হ্যাঁন্ডেড, তাই করছি।”

“ও, তার মানে আপনি ম্যানেজার?”

“তা বলতে পারেন, নিকাবের ভেতর থেকে একটু যেন হাসির আওয়াজ। “এই দোকানটা আমার।”

“আপনার! এটা তো একটা বিশাল চেইন!” অজান্তেই আমার বিস্ময়টা চেপে রাখতে পারলাম না।

“ঠিক। কিন্তু আমি শুধু এই ব্রাঞ্চটার ফ্যানচাইজ নিয়েছি। গ্রিন লিফ-এর মালিককে আমি চিনতাম, তাই পেলাম।”

“কিন্তু এটাও তো বিরাট দোকান, মাই গড!”

“থ্যাঙ্ক ইউ।” মুখটা দেখতে পারছি না, কিন্তু আমার এই প্রবল বিস্ময়ে নিশ্চয় সেটা কৌতুকে পরিপূর্ণ।

“আপনি বোধহয় এখানে থাকেন না, তাই না?”

“হ্যাঁ, আমি বছর আটেক বিদেশে।”

“বিদেশে কোথায়?”

“নিউ ইয়র্ক। আমি ওখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়াই।” বাড়তি ইনফরমেশনটা না দিলেও চলত।

“কোন সাবজেক্ট?”

অর্ডিনারি বিউটিশিয়ান নয় বোঝাই যাচ্ছে। উত্তর দিলাম, “ফিজিক্স।”

“খুব কঠিন সাবজেক্ট, তাই না?”

আমি হাসলাম। তারপর একটু মজা করেই বললাম, “আমার এক গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট মুসলিম মেয়ে। কাজের মাঝখানেই দেখি সে টুক করে নামাজ পড়তে বসে। টাইমটা বোধহয় ফিক্সড। তা, আপনার কাজ করতে অসুবিধা হয় না?”

“এই কাজ করতে গেলে সময় মতো নামাজ পড়া যায় না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর।

প্রশ্নটা করা বোধহয় আমার উচিত হয়নি, মনে হল বিরক্ত হয়েছেন। কত বয়স মহিলার? ইচ্ছে হচ্ছিল মহিলার মুখটা দেখি। কী ঝামেলা! এই হিজাব-নিকাব ব্যাপারটা আমার একেবারেই অপছন্দ! না দেখা যায় চুল, না দেখা যায় মুখ।

ক্রিম-ফ্রিম লাগানো হয়ে যাবার পর ভাবছি এঁকে টিপস দিই কী করে, ইনি তো আমাকে দশবার কিনে বেচে দিতে পারেন! ক্যাশিয়ারের কাছে যাবার আগে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আপনারা দেখি প্লাস্টিক গ্লাভস পরে কাজ করেন, কারণটা কি?”

“অনেক সংক্রামক অসুখ স্কিন কনটাক্টে হতে পারে। সবাইকেই এটা সুরক্ষা দেয়। তাছাড়া আমরা নানান রকম কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করি, অ্যাসিটোন, ফরম্যাল্ডিহাইড, টলুইন…।”

আরও দুয়েকটা নাম বলেছিলেন, মনে করতে পারছি না। পরিষ্কার ইংরেজি উচ্চারণ, বোঝাই যায় এজুকেটেড মুসলিম মহিলা। এমন সময় আরেক জন কাস্টমার এসে যাওয়ায় আর কথা হল না।

প্রমথর আগেই হয়ে গিয়েছিল। দোকান থেকে বেরিয়ে এসে ওকে বললাম, “জানিস, আমাকে যিনি ফেশিয়াল দিলেন, এই দোকানটা তাঁর।”

“ওই হিজাব-নিকাব পরা মহিলা?”

“হ্যাঁ। অবভিয়াসলি খুব কট্টর মুসিলিম ফামিলির।”

“নো ওয়ান্ডার। আমি আরেকজন মুসলিম মেয়েকে দেখলাম– হিজাব নিকাব নয়, এক্কেবারে মাদার অফ অল থিংস, বোরখা। ভিতরের একটা ঘরে একজনকে বিউটি ট্রিটমেন্ট দিচ্ছে।”

“ইন্টারেস্টিং, নিশ্চয় এই মালকিনের রিক্রুট! আমি কী ভাবছি জানিস, এদিকে শরীর আর মুখ ঢেকে রাখছে পর-পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে থাকার জন্য, আবার আড়ালে থেকে পর-পুরুষদের গায়ে হাতও লাগাচ্ছে বিউটিকেয়ার করার অজুহাতে। এক ধরণের ক্যাথারসিস বলতে পারিস! নিজেরদের অবদমিত ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশ।”

“ওরেব্বাস, বড় বড় কথা বলছিস!”

প্রমথ উঠতে বসতে আমাকে জ্ঞান দেয়, কিন্তু ওকে সিরিয়াস কিছু বলতে গেলেই মজা করে উড়িয়ে দেয়।

৪.

পরের দিন দশেক বেশ ব্যস্ততার মধ্যে কাটল। বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলের রি-ইউনিয়ন আর যাদবপুরে কয়েকটা স্পেশাল লেকচার দেবার ব্যাপার ছিল। যাদবপুরে বছর দুই আগে স্যাবাটিক্যাল নিয়ে এসেছিলাম, ওখানে ডাকলে তো যেতেই হয়। শুক্রবার বিকেলে লেকচার দিয়ে বেরোচ্ছি হঠাৎ পেছন থেকে কে জানি ডাকল, “বাপিদা!”

ফিরে যাকে দেখলাম, তাকে এখানে দেখব কল্পনা করিনি। শ্রেয়া। ধরাচুড়ো নেই। কাঁধ পর্যন্ত নামা এলো চুল। হাল্কা কমলা শর্ট-স্লীভ টি-র ওপর হাত-কাটা ডেনিম জ্যাকেট আর ম্যাচিং জিনস। আজকাল ম্যানহাটান আর কলকাতার পোশাকে অনেক সময়েই ফারাক দেখি না।

“তুমি!”

“এখানে এসেছিলাম একটা কাজে। শুনলাম তুমি বক্তৃতা দিতে এসেছ। ভাবলাম একটু দাঁড়িয়ে যাই।”

“ভালো করেছ। কিন্তু কী কাজে এসেছিলে… সেই হসপিটাল ডেথের কেস?”

“না,” হেসে ফেলল শ্রেয়া, “নিজের কাজে।”

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।

“আমি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি করার কথা ভাবছি।”

“পুলিশের এত ভালো কাজ ছেড়ে দিয়ে?”

“কেন, ছাড়া যায় না?”

“তা নিশ্চয় যায়। কিন্তু পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করে করবেটা কী?”

“কেন, তোমাদের মতো পড়াব?”

“তোমার মাথাটা একবার দেখাও তো? আইপিএস অফিসার এইসব কথা বলছে শুনলে লোকে এটাই বলবে।”

আমার কথাটাকে কানে তুলল না শ্রেয়া। “দাদার সঙ্গে সকালে কথা হল। তুমি নাকি একটা ভালো রিসার্চ গ্র্যান্ট পেয়েছ?

“ভালো কিনা জানি না, তবে এনএসএফ-এর একটা গ্র্যান্ট এবার জুটে গেছে।”

“আমি যদি ওখানে গিয়ে ভালো গ্রেড পাই, তাহলে তো তুমি একটা অ্যাসিস্টেন্টশিপ দিতে পারবে। পারবে না?”

“আমার ভরসায় থাকলে তোমার কপালে দুঃখ আছে। তার থেকে তোমার দাদাকে ধর, উনি বেশ টু-পাইস কামাচ্ছেন। পার্ট-টাইম ওঁর সঙ্গে কাজ করলে কোনও চিন্তাই নেই।”

“তাহলে তো যাওয়াটা মুশকিল।” শ্রেয়া মুখ গম্ভীর করার চেষ্টা করেও হেসে ফেলল।

“ব্যাপারটা কি, তুমি সিরিয়াস নাকি?”

“নিশ্চয়, এখানে তো এসেছি রেকমেন্ডেশন লেটারের জন্য… আমাদের বিএইচইউ-র মাস্টারমশাই এখন যাদবপুরের ফ্যাকাল্টি।”

এমন সময়ে শেয়ার মোবাইল বেজে উঠল।

“হ্যাঁ, আসছি স্যার।” উত্তর দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে বলল, “মাস্টারমশাই ডেকেছেন… লেটার রেডি হয়ে গেছে। পরে কথা হবে।”

“গুডলাক।” বললাম ঠিকই, কিন্তু সত্যিই যদি চাকরি ছেড়েছুঁড়ে দেয়, পরে আপশোস করবে। দ্য গ্রাস ইজ অলয়েজ গ্রিনার অন দ্য আদার সাইড। অথবা অন্য কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা? কে জানে!

শীতকালে কলকাতা আসার একটা বড় নেগেটিভ হল থাকার সময়টা বড্ড অল্প। মেরে কেটে সপ্তাহ চারেক, তাও নয়। গ্রীষ্মকালে সময় বেশি পাই, কিন্তু গরমের কষ্টটা সহ্য করতে হয়। মা অপেক্ষা করে থাকে। তাই বছরে দু’বার করেই আসি। যদ্দিন মা আছে, সেটাই করতে হবে। যাবার সময় এগিয়ে আসছে। ব্যাগ গোছানো শুরু করেছি, জানুয়ারির দশ তারিখ থেকে ক্লাস আরম্ভ হবে পুরোদমে। কলকাতা ছাড়ার আগের দিন একেনবাবুর বাড়ি গেলাম। বেশ কয়েক দিন আমাদের আড্ডা হয়নি। ফোনে অবশ্য কথা হয়, বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই। কিন্তু ওঁর নিউ ইয়র্কে যাবার প্ল্যানটা এখন পর্যন্ত জানতে পারিনি। আর এবার যাবার পর কতদিন ওখানে থাকবেন, সেটাও জানি না। হয়তো আর এক বছর, কিছুই নিশ্চিত নয়। উনি না থাকলে আমাদের ছোটো অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজতে হবে। তবে কিনা প্রমথর ব্যাপারটাও অনিশ্চিত। প্রমথ যদি এরমধ্যে ফ্রান্সিস্কাকে বিয়ে করে, তাহলে তো প্রমথও থাকছে না।

কলকাতা ছেড়ে যাচ্ছি বলে মনটা বিক্ষিপ্ত, জমিয়ে তেমন গল্প হল না। একেনবউদিকে কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, হঠাৎ নিজের থেকেই আমার দুটো হাত ধরলেন, “আপনাদের ওখানে ও থাকে বলে কত নিশ্চিন্তে থাকি! ও-ও আপনাদের দু’জনকে ভাইয়ের মতো দেখে।” তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন, “ও চলে এলে আপনাদেরও খুব খারাপ লাগবে জানি।”

“তা লাগবে বউদি, খুবই লাগবে। কিন্তু উনি তো ফিরে আসবেন নিজের জায়গায়। তাই না?” বলতে বলতে আমিও একটু ইমোশানাল হয়ে গেলাম।

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *