Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আগ্রা যখন টলমল || Premendra Mitra

আগ্রা যখন টলমল || Premendra Mitra

না, তস্য তস্য!

বললেন শ্রীঘনশ্যাম দাস ওরফে ঘনাদা নামে কোনও কোনও মহলে যিনি পরিচিত। বিস্ময়ে বিহ্বলতায় কারও মুখে তখন আর কোনও কথা নেই।

ঘনশ্যাম দাস নিজেই সমবেত সকলের প্রতি কৃপা করে তাঁর সংক্ষিপ্ত উক্তিটি একটু বিস্তারিত করলেন:

মানে, আমার ঊর্ধ্বতন ষোড়শতম পূর্বপুরুষ মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার—

ঘনশ্যাম দাসকে বাধা পেয়ে থামতে হল।

মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবু বিস্ফারিত চোখে বলে উঠলেন, আপনার পূর্বপুরুষ বলছেন, অথচ ওই মীর না পীর কী বললেন!

ঘনশ্যাম দাস তাঁর সেই নিজস্ব ট্রেডমার্কের ছাপমারা করুণার হাসি হাসলেন।

মীর পীর নয়, মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার বচনরাম দাস। মীর-ঈ-ইমার হল যাকে বলে বিল্ডিং সুপারিন্টেন্ডেন্ট আর সাওয়ানি নিগার মানে আমির-ওমরাহ রাজপুরুষদের না জানিয়ে গোপনে সবকিছু জরুরি খবর সংগ্রহ করে খোদ শাহানশাহ-এর কাছে লিখে ্পাঠানো যার কাজ।

আপনার পূর্বপুরুষ বচনরাম দাস তখন আগ্রায় থেকে ওই কাজ করতেন!

উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত সেই রামশরণবাবু বিমূঢ়-বিস্ময় প্রকাশ করলেন।

কিন্তু একটু বেসুরো বাজল, মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবুর কণ্ঠ।

অবিশ্বাস ও বিদ্রূপের রেশটুকু গোপন না করে তিনি বললেন, সবই বুঝলাম, কিন্তু আপনার পূর্বপুরুষ ওই মীর-ঈ-ইমারৎ সাওয়ানি নিগার বচনলাল না বচনরাম

তখন আগ্রায় না থাকলে ভারতবর্ষের ইতিহাসই অন্যরকম লেখা হত বলছেন?

তাই তো বলছি। ঘনশ্যাম দাস অবোধকে যেন বোঝাতে বসলেন—১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তারিখটার কথা একটু স্মরণ করুন। সারা দুনিয়ার চোখ-টাটানো শহর মোগল সাম্রাজ্যের অতুলনীয় রাজধানী আগ্রায় সেদিন যেমন সকাল হয়েছিল তেমনই নির্বিঘ্নে সন্ধ্যা যদি নামত, যদি হঠাৎ সেই তারিখটি আগ্রায়, না শুধু আগ্রার কেন, সমস্ত ভারতবর্ষের আকাশে আগুনের অক্ষরে না জ্বলে উঠত, তাহলে আজ যে ইতিহাসের ধারা আমরা দেখছি তা সম্পূর্ণ ভিন্নপথে কি প্রবাহিত হত না!

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট।

তারিখটার তাৎপর্য স্মরণ করতে সবাই যতক্ষণ চিন্তাকুল, ততক্ষণে এ সমাবেশের একটু পরিচয় ও এ কাহিনীর উদ্ভবের একটু উপক্রমণিকা বিবৃত করা যেতে পারে।

এক এবং অদ্বিতীয় শ্রীঘনশ্যাম দাসকে কেন্দ্র করে এই সমাবেশটি সচরাচর কোথায় জমে থাকে এবং প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিকভাবে কারা সেখানে উপস্থিত থাকেন, কেউ কেউ হয়তো জানেন।

স্থান এই কলকাতা শহরেরই প্রান্তবর্তী একটি নাতিনগণ্য জলাশয়, করুণ আত্ম-ছলনায় যাকে হ্রদ বলে আমরা অভিহিত করি কখনও কখনও।

জীবনে যাদের কোনও উদ্দেশ্য নেই, বা কোনও এক উদ্দেশ্যেরই একান্ত একাগ্র অনুসরণে যারা পরিশ্রান্ত, এই উভয় শ্রেণীর নানা বয়স্ক স্ত্রী-পুরুষ নাগরিক প্রতি সন্ধ্যায় এই জলাশয়ের তীরে নিজ নিজ রুচি ও প্রবৃত্তি অনুসারে স্বাস্থ্য অর্থ কাম মোক্ষ এই চতুর্বর্গের সাধনায় একাকী কিংবা সদলে ভ্রমণ করেন বা কোথাও উপবিষ্ট হন।

এ জলাশয়ের দক্ষিণ তীরে একটি নাতি-বৃহৎ পর্কটী বৃক্ষকে কেন্দ্র করে কয়েকটি আসন বৃত্তাকারে পাতা। আবহাওয়া অনুকূল হলে সেই আসনগুলিতে সাধারণত পাঁচটি প্রবীণ নাগরিককে নিয়মিতভাবে অপরাহুকালে সমবেত হতে দেখা যায়।

তাঁদের একজনের শিরোশোভা কাশের মতো শুভ্র, দ্বিতীয়ের মস্তক মর্মরের মতো মসৃণ, তৃতীয়ের উদরদেশ কুম্ভের মতো স্ফীত, চতুর্থ মেদভারে হস্তীর মতো বিপুল, এবং পঞ্চম জন উষ্ট্রের মতো শীর্ণ ও সামঞ্জস্যহীন।

এই পঞ্চরত্নের সভায় স্বাস্থ্য থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও বাজার দর থেকে বেদান্ত-দর্শন পর্যন্ত যাবতীয় তত্ত্ব আলোচিত হয়ে থাকে।

আলোচনার প্রাণ অবশ্য শ্রীঘনশ্যাম দাস, প্রাণান্তও তিনি। কারণ সকল বিষয়ে শেষ কথা তিনিই বলে থাকেন এবং তাঁর কথা যখন শেষ হয় তখন আর কারও কিছু বলবার থাকে না।

থাকলেও ঘনশ্যাম দাসের সামনে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করা নিরাপদ নয়। কোথা থেকে কী অশ্রুতপূর্ব উল্লেখ ও উদ্ভট উদ্ধৃতি দিয়ে বসবেন সেই ভয়ে সকলেই অল্পবিস্তর সন্ত্রস্ত।

সেদিন নিতান্ত নির্দোষভাবেই আলোচনাটার সুত্রপাত হয়েছিল।

মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু কিছুদিন ধরে এ সমাবেশে অনুপস্থিত ছিলেন।

তাঁর অনুপস্থিতির কারণ সম্বন্ধে ঔৎসুক্য প্রকাশ করে একটু পরিহাসের সূরে বলেছিলেন মর্মর-মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবু, কী মশাই! আমাদের যে ভুলেই গেছলেন! ড়ুব মেরেছিলেন কোথায়?

না, এই এখানেই ছিলাম! হরিসাধনবাবুকে কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম কুণ্ঠিত মনে হয়েছিল।

এখানেই ছিলেন! অসুখবিসুখ করেনি নিশ্চয়? কুম্ভের মতো উদরদেশ যাঁর স্ফীত সেই রামশরণবাবুর জিজ্ঞাসা।

না, অসুখবিসুখ নয়-হরিসাধনবাবু যেন আরও লজ্জিত।

এবার সভার সকলেই কিঞ্চিৎ বিস্মিত। অসুখবিসুখ নয়, তবু পঞ্চরত্নের একজন স্বেচ্ছায় এই সান্ধ্য-সমাবেশে অনুপস্থিত! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!

তাহলে সত্যিই ড়ুব মেরেছিলেন বলুন? শুধোলেন মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবু, কীসে?

নিরীহ নির্বিবাদী ভবতারণবাবুকেই যেন ভরসা করে হরিসাধনবাবু তাঁর অন্তর্ধান রহস্যটা জানাতে পারলেন।

এই মানে, একটু পড়ালেখা করছি কিছুদিন থেকে। সলজ্জভাবে স্বীকার করলেন হরিসাধনবাবু।

লেখাপড়া নয়, হরিসাধনবাবু শব্দটা পড়ালেখা বলে যে উচ্চারণ করেছেন তা লক্ষ করেছিলেন বোধহয় সকলেই।

প্রথমত সে কারণে এবং দ্বিতীয়ত হরিসাধনবাবু এই বয়সে হঠাৎ পড়ালেখায়। মেতে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় মজলিশে আসাও বন্ধ করতে দ্বিধা করেননি উপলব্ধি করে সকলেই অতঃপর অত্যন্ত কৌতূহলী।

কী লেখাপড়া করছেন, মশাই!

আপনিও তো রামশরণবাবুর মতো ভোজনরসিক!

রান্নার কোনও বই-টই লিখছেন নাকি?

নানাদিকের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হরিসাধনবাবু যেন নিরুপায় হয়ে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন—হ্যাঁ, বই-ই লিখছি, তবে রান্নার নয়।

রান্নার নয়? সকলে বিস্মিত—তবে কীসের?

আর রান্নার বই লেখা তো খুব সোজা। জনৈকের মন্তব্য—দেশি বিলাতি নানা বই থেকে টুকে মেরে দাও।

তবে রান্নার বই-এর তেমন কাটতি নেই। আর-একজনের আশঙ্কা!

আমি যা লিখছি তার কিন্তু খুব কাটতি! হরিসাধনবাবু একটু উৎসাহভরেই এবার জানিয়েছিলেন।

কী লিখছেন কী তাই শুনি না! স্বয়ং ঘনশ্যামবাবুর প্রশ্ন।

ঐতিহাসিক উপন্যাস।

সকলেই স্তম্ভিত ও নীরব।

হরিসাধনবাবু সকলের বিস্মিত বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে কৈফিয়ত দেবার চেষ্টা করেছিলেন।

সেই সেদিন ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা হচ্ছিল না? ভবতারণের ঘুম-ছাড়ানো দাওয়াইটা একবার তাই থেকে পরখ করে দেখবার সাধ হয়। সেই দেখতে গিয়েই নেশা চেপে গেল!

বলতে বলতে নিজের বক্তৃতাই হরিসাধনবাবুকে উদ্দীপিত করে তুলেছিল।

ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেছিলেন, হলফ করে বলছি আপনাদের, ঐতিহাসিক উপন্যাসের মতো অত সুখ কিছুতে নেই। যেমন পড়ে সুখ, তেমনই লিখে। লিখতে লিখতে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যায় টেরই পাই না। যা লিখি তা তো হাজার পাতার এধারে থামতেই চায় না!

হাজার পাতার ঐতিহাসিক উপন্যাস আপনি লিখে ফেলেছেন! কপালে চোখ তুলে ধরা-গলায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন শিবপদবাবু।

হ্যাঁ, তবে একটা নয়! এবার গর্বভরেই বলেছিলেন হরিসাধনবাবু, তিনটে হয়ে গেছে, আর তার পরেরটা মাঝামাঝি এসে একটু আটকেছে।

কেন? নালা বুজে গেছে বুঝি!

ঘনশ্যাম দাসের ঈষৎ অকরুণ মন্তব্যটা হরিসাধনবাবু তাঁর আত্মপ্রকাশের উৎসাহে গায়েই মাখেননি এখন। সরলভাবে বলেছিলেন, আটকেছে মানে ক-টা নাম তারিখ গোছের খুঁটিনাটি জোগাড় করার জন্যে লেখাটা বন্ধ রেখেছি ক-দিন!

কিন্তু তিনটে তো লেখা শেষ হয়ে গেছে! বলেছিলেন শিবপদবাবু, সেগুলো কোথাও আটকায়নি বুঝি!

না, আটকাবে কেন? হরিসাধনবাবু তাঁর লিখনকৌশলের গুপ্তরহস্য ব্যক্ত করে দিয়েছিলেন, সব যে আগে থাকতে হাতের কাছে গুছিয়ে রেখেছিলাম। এই ধরুন প্রথম উপন্যাসটা বর্গির হাঙ্গামার সময়কার। তাতে প্রত্যেক পাতায় একবার করে ছিটোবার জন্যে রঘুজি ভোঁসলে আর ভাস্কররাম কোলহাটকর, আর দুকদম না যেতে যেতেই জপের মন্ত্রের মতো আউড়ে ড়ুকরে ওঠবার জন্যে মুবারক মঞ্জিল নাম ক-টা বাগানো ছিল, তারপর ঠিক ঝোপ বুঝে কখনও সলিমুল্লার তারিখ-ই-বাংলা, কখনও বাণেশ্বরের চিত্ৰচম্পু, কখনও পিরলেনকার-এর পোর্তুগিজ-ই-মারাটার-এর উল্লেখ ছড়িয়ে দিয়েছি। বারো আনা লেখা তো এই করেই সারা হয়ে গেছে।

উৎসাহে উত্তেজনায় হরিসাধনবাবু বোধহয় আরও অনেক কিছু বলে ফেলতেন, কিন্তু ঘনশ্যাম দাসই তাঁকে থামিয়ে বলেছিলেন, তিনটে উপন্যাসই লিখে ফেলে চারটের বেলা আটকালো তাহলে কোথায়?

ওই একটু আগ্রা শহরে। হরিসাধনবাবু একটু যেন অধৈর্যের সঙ্গে জানিয়েছিলেন—নাম-টাম অনেক জোগাড় করেছি। দিওয়ান-ই-তান, দিওয়ান-ই-আলা, খান-ই-সামান, তসদিক্‌ সাজাওল, মুশরিফ, বাহারিস্তান-ই-ঘৈরি, হেদায়েৎ-উল-কোয়াই গোছের চমকে দেওয়া সব আরবি ফারসি শব্দ আর সেই সঙ্গে সোজা বাংলায় একটু রসুন ফোড়ন দেবার মতো উর্দু বুকনি, যেমন— তাড়াতাড়ির জায়গায় তুরন্ত লেখা, ভাগ্যের বদলে কিসম, সুগন্ধের বদলে খোসবু, একটুর জায়গায় জেরাসে, বই-এর জায়গায় কিতাব গোছের একরাশ কথা বসিয়ে ফেলেছি। এখন আগ্রা শহরের একটু বিবরণ আর কয়েকটা তারিখ ঠিকমতো জানবার জন্যেই থামতে হয়েছে। বই কাগজ সেজন্য ঘাঁটছি। ওইগুলো পেলেই উপন্যাস আর থামবে না।

উপন্যাসের রং পালিশ তো বুঝলাম, বলেছিলেন ঘনশ্যাম দাস, কিন্তু–কী নিয়ে উপন্যাস? গল্প একটা আছে তো?

আছে না? কিঞ্চিৎ ক্ষুগ্নস্বরে বলেছিলেন হরিসাধনবাবু, ঐতিহাসিক উপন্যাসে যেমন থাকা উচিত ঠিক সেই গল্প আছে। খুন-জখম, মারামারি, কাটাকাটি, তার মধ্যে অকুতোভয় নায়ক, সুন্দরী সপ্রতিভ নায়িকা, ঠিক সময়মতো দৈবের আবির্ভাব, কবি-টবি বা যাত্রার বিবেক গোছের কাউকে মাঝে মাঝে আসরে ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া, তারই সঙ্গে বেশ একটু চটচটে করে আদিরস, কিছু আমার গল্পে বাদ নেই।

তা গল্পটা কবেকার? জিজ্ঞাসা করেছিলেন শিবপদবাবু, আগ্রা শহরের ঠিক কোন সময় বাবদ!

ভারতসম্রাট আওরঙ্গজেব-এর বয়স যখন পঞ্চাশ, অর্থাৎ পঞ্চাশের জন্মদিনের কাছাকাছি সময়ে! বলেছিলেন হরিসাধনবাবু।

এইবার সেই পেটেন্ট নাসিকাধ্বনি শোনা গেছল।

সকলে সচকিত হয়ে ঘনশ্যাম দাসের দিকে চাওয়ার পর তিনি একটু চিন্তিতভাবে। বলেছিলেন, সময়টা ভালোই বেছেছেন, কিন্তু তার মান রাখতে পারবেন কি! আগ্রা আর সেই সঙ্গে সমস্ত মোগল সাম্রাজ্যের ভিত ওই সময়কার একটি তারিখেই প্রথম মোক্ষম নাড়া খেয়ে চিরকালের মতো আলগা হয়ে যায়। অবশ্য সেই তারিখটায় ওই আগ্রা শহরে একটি মানুষ যদি উপস্থিত না থাকতেন তাহলে ইতিহাস কোন পথে যেত কিছু বলা যেত না। হয়তো অন্যভাবেই সে ইতিহাস লেখা হত।

একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলার মতো একটা শব্দ করে ঘনশ্যাম দাস আবার বলেছিলেন, কিন্তু সেসব আর আপনারা জানবেন কোথা থেকে! বচনরাম দাসের নামই তো আপনারা শোনেননি বোধহয়।

না, শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না! শিবপদবাবু ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, বচনরাম দাস বলছেন? তিনি আপনারই কেউ হবেন নাকি? প্রপিতামহ বা তার ওপরে অতিবৃদ্ধ কেউ?

না, তস্য তস্য। তখনই বলেছিলেন ঘনশ্যাম দাস।

২.

তারপর আলোচনাটা যে ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট তারিখটার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টায় এসে থেমেছে, সে বিবরণ আগেই দেওয়া হয়েছে।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু প্রথম আঁধারে আলোক দেখতে পেলেন।

১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে আগস্ট! তিনি কপাল কুঞ্চিত করে বললেন, সেদিন—সেদিনই শিবাজি আগ্রা থেকে পালিয়েছিলেন না?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওই তারিখেই! সোৎসাহে শিবপদবাবুকে সমর্থন করলেন হরিসাধনবাবু, মনেই পড়ছিল না এতক্ষণ, অথচ খাতায় আমি টুকে রেখেছি তারিখটা, উপন্যাসে এক জায়গায় সুবিধামাফিক লাগিয়ে দেব বলে।

নেহাত এক জায়গায় লাগিয়ে দেবেন ভেবেছিলেন তারিখটা! ঘনশ্যাম দাসের তীক্ষ্ণ শ্লেষটা হরিসাধনবাবুর কানেও এবার বিধল।

কেমন একটু থতমত খেয়ে বললেন, কেন? লাগিয়ে দেওয়া অন্যায় হবে?

হ্যাঁ, হবে—দাসমশাই-এর স্বর যেন চাবুক—তলোয়ার দিয়ে কুটনো কোটা যেমন অন্যায়, যেমন অন্যায় কামান দিয়ে মশা মারা, চন্দনকাঠে চুলো ধরানো, মুক্তো দিয়ে খুঁটি খেলা। ভারতবর্ষের ইতিহাসের ওই তারিখ শুধু একবার উপন্যাসে উল্লেখ করেই ভুলে যাবেন? ১৮৫৭ সাল নিয়ে আপনি গল্প লিখবেন শুধু কলকাতার বাবুবিলাসের, ১৯৪২ সাল পার হয়ে যাবেন ইঙ্গ বঙ্গ পাড়ার কেচ্ছাই শধু গাইতে গাইতে?

সবাই নীরব হতভম্ব! হরিসাধনবাবু তো অপরাধটা ঠিক না বুঝেও লজ্জায় অধোবদন।

প্রথম সাহস সঞ্চয় করে শিবপদবাবুই বলেন, তারিখটা ভারতের ইতিহাসে ভোলবার নয় জানি, কিন্তু তারিখের সঙ্গে আপনার সেই পূর্বপুরুষ বচনরামের সম্বন্ধ কী? তিনি তখন আগ্রায় না থাকলে কি ও তারিখটা পাঁজি থেকে বাদ যেত, না শিবাজি আগ্রা থেকে পালাতেন না?

শিবপদবাবু কথার শেষে হুলটুকু প্রায় অজান্তেই না রেখে পারলেন না।

হুলের বদলে ছোবলই বুঝি আসে ঘনশ্যাম দাসের।

সবাই যখন সেই ভয়েই সন্ত্রস্ত তখন ঘনশ্যাম দাস অপ্রত্যাশিত উদারতায় সকলকে অবাক করে দিলেন।

হুলটুকু যেন টেরই না পেয়ে বললেন, না, ও তারিখ পাঁজি থেকে বাদ যেত না, আর শিবাজিও আগ্রা থেকে ঠিকই পালাতেন, কিন্তু এদিকে পশ্চিম ওদিকে দক্ষিণ দিকের খুফিয়ানবিশ আর হরকরাদের পাঠানোে উলটোপালটা গুপ্ত খবরে আগ্রার দরবারে আলমগিরের তাহলে মাথা খারাপ হবার জোগাড় হত না, ফৌজদার আলি কুলী আর তাঁর অনুচরেরা বার বার দিনদুপুরে ভূত দেখতেন না, সুরাটের বৈদ্যকুলতিলক দ্বিজোত্তম নাভা তাঁর সুরাটের প্রাসাদোপম ভবনে বারাণসীধামের, এক অত্যাশ্চর্য দৈবানুগ্রহের কাহিনী সকলকে নিত্য শোনাতেন না, আর সেদিনের টলমল আগ্রা শহরের ভিত্তিমূলেই দারুণ আঘাত পেয়ে মোগল সাম্রাজ্য অত তাড়াতাড়ি বোধহয় ধ্বংস পেত না। তা না পেলে কোথায় থাকত তুচ্ছ একটা সাগরপারের হিমেল দ্বীপের রাঙামুখ ক-টা সওদাগর! এই ভাগীরথীর কাদামাটির তীরে শেকড় গাঁথবার আগে কালাপানির জলেই কবে তাদের ইতিহাস তলিয়ে যেত!

এত কিছু সব হতে পারেনি শুধু ওই তারিখে আপনার পূর্বপুরুষ বচনরাম আগ্রায় হাজির ছিলেন বলে!

অকপট বিস্ময় বিমূঢ়তা ফুটে উঠেছে মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই ভবতারণবাবুর কণ্ঠে।

আসলে তিনি থাকায় হয়েছেটা কী? ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবুর গলাটা এখনও বেসুরো। সম্ভ্রমের চেয়ে সন্দেহটাই যেন তার মধ্যে প্রধান।

হয়েছে এই যে, ঐতিহাসিকরা সেদিন পর্যন্ত হিমশিম খেয়েছেন আগ্রা থেকে পালিয়ে শিবাজির রাজগড় পৌঁছোবার বৃত্তান্ত নিয়ে। দাসমশাই অনুকম্পাভরে হেসে বললেন, ১৬৬৬-র ১২ই সেপ্টেম্বর, না তারও দু-মাস পরে ১১ই নভেম্বর, তিনি রাজগড়ে ফিরেছেন, তা-ই সঠিক বলা সম্ভব হয়নি। কৃষ্ণাজি অনন্ত সভাসদের শিব-ছত্রপতি-চেন-চরিত্র আর তারিখ-ই-শিবাজির বিবরণে গরমিল হয়েছে। আওরঙ্গাবাদ থেকে এক গুপ্তচর খুফিয়ানবিশ হিসাবে দিল্লিতে যে চিঠি পাঠিয়েছে তার খবরের সঙ্গে জেধে শাকাবলি-র বিবরণের সামঞ্জস্য হয়নি। সেই সঙ্গে অখণ্ডপ্রতাপ মোগলসাম্রাজ্যের প্রখর পাহারার শ্যেনদৃষ্টিকে উপেক্ষা করে খগরাজের কাছে মূষিকের ন্যায় অকিঞ্চিৎকর শিবাজি ভোঁসলের এই অবিশ্বাস্য পলায়নের যাত্রাপথকে নির্দেশ করে বিচিত্র নানা কাহিনীর ধারা জন্ম নিয়েছে।

ঘটনার সময়েই দূর-দূরান্তর থেকে সে সব কাহিনীর ঢেউ আগ্রা পর্যন্ত পৌঁছে ভারতসম্রাটকে বিভ্রান্ত ও উত্ত্যক্ত করে তুলেছিল।

শিবাজি কী কৌশলে তাঁর মোগল দুশমনদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছিলেন, স্কুলপাঠ্য ইতিহাসেও তার উল্লেখ মিলবে, পূজার নৈবেদ্যের নামে পাঠানো মিষ্টান্নের ঝুড়ির মধ্যে লুকিয়েই তিনি আর তাঁর ছেলে শম্ভুজি পাহারাদারদের এড়িয়ে তাঁর বন্দিশিবিরের বাইরে যান ঠিকই। কিন্তু তারপর কী করেছিলেন তিনি! কোন পথে রওনা হয়েছিলেন নিজের রাজ্যের দিকে?

আওরঙ্গজেব-এর সতর্ক পাহারায় ব্যবস্থার তো কোনও ত্রুটি ছিল না। বন্দিশিবিরে জয়সিংহের পুত্র রামসিংহের নিজস্ব রাজপুত অনুচরেরা শিবাজিকে পাহারা দেবার জন্যে মোতায়েন। দিবারাত্রি তারা ঘিরে থাকে শিবাজির শিবির। দিনে রাত্রে বহুবার। শিবাজির শয্যা পর্যন্ত তদারক করে যায়। শিবাজিকে গুপ্তঘাতকের হাত থেকে রক্ষা করাই অবশ্য তাদের আসল উদ্দেশ্য।

রাজপুত প্রহরীদের দ্বারা শিবাজির বন্দিশিবির ঘিরে শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ জিসি আর দতি, মানে কামান-বন্দুক নিয়ে এক বিরাট বাহিনীকে পাহারায় রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন।

তা সত্ত্বেও পালিয়ে শিবাজি হঠাৎ অমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন কী করে? শিবাজির পালানোর খবর জানাজানি হয়েছিল প্রায় চোদ্দো ঘণ্টা পরে। এই চোদ্দো ঘণ্টা সময় হাতে পেয়েই শিবাজি কিন্তু যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন মনে হয়েছে।

খবর পাওয়া মাত্র আওরঙ্গজেব এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি। আগ্রার সবচেয়ে সেরা ঘোড়ায় চড়ে ওস্তাদ সওয়ারেরা দিগ্বিদিকে ঝড়ের বেগে ছুটে গেছে শিবাজির সব পালাবার রাস্তা বন্ধ করবার নির্দেশ জানাতে। মালোয়া খাণ্ডেশের ভেতর দিয়ে শিবাজির দক্ষিণ দিকে যাবার সম্ভাবনা বেশি। সেদিকের সমস্ত ফৌজদারদের সতর্ক করে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। তবু শিবাজিকে ধরা সম্ভব হয়নি।

প্রথম উড়ো খবর এসেছে মথুরা থেকে। আওরঙ্গজেব সে খবর বিশ্বাস করতে পারেননি। শিবাজিকে সেখানে নাকি সন্ন্যাসীর বেশে দেখা গেছে একদিন।

মথুরা আগ্রার উত্তরে। শিবাজির কি ভীমরতি ধরেছে যে, আওরঙ্গজেব-এর সেপাইরা ডালকুত্তার মতো তার সন্ধান করছে জেনেও দক্ষিণে নিজের রাজ্যের দিকে ছুটে উত্তরে রওনা হবেন!

প্রথমে খবরটায় বিশ্বাস না হলেও পরে শিবাজির এটা একটা সূক্ষ্ম চাতুরী বলেই সন্দেহ হয়েছে। সবাই যখন দক্ষিণ দিকে তাকে ধরবার জন্যে বিনিদ্র পাহারায় আছে তখন উত্তরে যাওয়াই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। শিবাজির ফন্দি যে এরকম কিছু হতে পারে, তার প্রমাণও যেন পাওয়া গেছে। উত্তর নয়, এবার পূর্বাঞ্চল থেকে। শিবাজিকে ছদ্মবেশে ইলাহাবাদে দেখা গেছে বলে লিখে পাঠিয়েছে এক হরকরা। বারাণসীধামে গঙ্গার ঘাটে একদিন সকালে শোরগোল উঠেছে শিবাজি ধরা পড়েছেন বলে। সংবাদটা সত্য নয় জানা গেছে তারপর।

সত্য মিথ্যা বিচারই কঠিন হয়ে উঠেছে এবার। গয়া, এমনকী সুদূর পুরী থেকেও শিবাজিকে স্বচক্ষে দেখার খবর লিখে জানিয়েছে অনেকে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। শিবাজি যেন ভোজবাজিতে নানা জায়গায় হঠাৎ দেখা দিয়ে আবার শূন্যে বিলীন হয়ে গেছেন।

ওদিকে আবার আওরঙ্গাবাদ থেকে এক খুফিয়ানবিশ-এর যে গোপন চিঠি ১৬৬৬-র ১৪ই নভেম্বর দিল্লি এসে পৌঁছেছে, তাতে আগ্রা থেকে পালাবার পঁচিশ দিন বাদেই শিবাজি রাজগড়ে পৌঁছে গেছেন বলে খবর দেওয়া হয়েছে। মথুরা ইলাহাবাদ বারাণসী গয়া পুরী হয়ে গণ্ডোয়ানা, হায়দরাবাদ ও বিজাপুরের পথে দিন-রাত্রি ঘোড়া চালিয়েও তো পঁচিশ দিনে আগ্রা থেকে রাজগড়ে পৌঁছনো অসম্ভব!

আগ্রা থেকে রাজগড় পর্যন্ত নাকের সোজা উড়ে যেতেই ছ-শো সত্তর মাইল।

কিন্তু উড়ে না গেলে সোজা একমুখো হয়ে তো চলা যায় না। রাস্তায় পাহাড় পর্বত। জঙ্গল আছে, আছে বহু নদী পার হওয়ার ঝামেলা, তার ওপর মোগল প্রহরীদের দৃষ্টি এড়াতে জানা সুগম পথ ছেড়ে দুর্গম ঘুরের পথে যাওয়ার প্রয়োজন। সরল রেখায় যা। ছ-শো সত্তর মাইল, আসলে তা হাজার মাইলের ওপর গিয়ে দাঁড়ায়। আর মথুরা বারাণসী গয়া পুরীর রাস্তায় তো কমপক্ষে কয়েক হাজার মাইল।

শিবাজি কোন পথে রাজগড়ে গেছেন তাহলে? আওরঙ্গাবাদের গুপ্তচরের খবর যদি ঠিক হয় তাহলে কাশী, ইলাহাবাদ, পুরী হয়ে পঁচিশ দিনে তাঁর রাজধানীতে পৌঁছনো অসম্ভব। এপথে যদি না গিয়ে থাকেন তাহলে অত জায়গা থেকে। শিবাজিকে অত লোকের দেখার গুজব ওঠে কী করে? সব গুজবই তো আজগুবি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য কয়েকটি খবরের উৎসও আছে। যেমন, খাফি খাঁ সুরাটের যে ব্রাহ্মণ চিকিৎসকের কথা লিখেছেন, তাঁর বিবরণ অবিশ্বাস করবার নয়।

ব্রাহ্মণের নাম নাভা। সুরাটে তাঁর বিরাট জমকালো প্রাসাদগোছের বাড়ি। যে বাড়ি কেনার রহস্য যে তাঁর কাছে যায় তাকেই তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে শোনান। সে-বাড়ি নিজের চিকিৎসার উপার্জনে তিনি তৈরি করেননি। তীর্থ করতে তিনি কাশী গেছলেন। আশ্বিনের তখন শেষ। একদিন ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে গঙ্গায় তিনি স্নান পূজাপাঠ করতে নেমেছেন হরিশ্চন্দ্রের ঘাটে। ঘাট তখন নির্জন। মাথায় পাগড়ি আর গায়ে মুড়িসুড়ি দিয়ে চাদর জড়ানো একটি লোক হঠাৎ তাঁর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করেছে, আপনি ব্রাহ্মণ?

আচার্য নাভা সবিস্ময়ে মাথা নেড়ে জানিয়েছেন, হ্যাঁ।

লোকটি কোমরের একটি থলি খুলে এক মুঠো মণিমুক্তা আশরফি আর হুন তাঁর হাত ভরে দিয়ে বলেছে, শিগগির আমায় তর্পণ করান।

নাভা বিমূঢ়ভাবে সেই অবিশ্বাস্য সম্পদ বস্ত্রপ্রান্তে বেঁধে অপরিচিত লোকটিকে গঙ্গাতীরে তর্পণ করাতে বসেছেন।

তর্পণ করতে করতেই কোথায় শারগাল শোনা গেছে ঘাটের ওপরে।

লোকটি হঠাৎ নাভার কো-কুশি কমণ্ডলু নিজের কাছে টেনে নিয়ে চাপা-গলায় বলেছে, এবার আমিই আপনাকে তর্পণ করাচ্ছি। ভক্তিভরে হাতজোড় করে বসুন।

হতভম্ব হয়ে নাভা তা-ই করেছেন।

ঘাটের ওপরে খোলা তলোয়ার হাতে নগররক্ষী সেপাই আর মহল্লার দারোগাকে এবার দেখা গেছে।

তারা নীচে নামতে শুরু করেছে।

অজানা লোকটি তার আগেই গায়ের চাদর খুলে ফেলেছে। দেখা গেছে তার গলায়ও উপবীত জড়ানো। ডান কাঁধে সে উপবীত আর উত্তরীয় রেখে দক্ষিণমুখো হয়ে বসে মাটিতে বাঁ হাটু রেখে ডান হাতের তর্জনী আর বুড়ো আঙুলের মূল দিয়ে এক অঞ্জলি জল নিয়ে সে তখন বিশুদ্ধ সংস্কৃত উচ্চারণে মন্ত্রপাঠ করছে, ওঁ যমায় ধর্মরাজায় মৃত্যবে চান্তকায় চ। বৈবশ্যতায় কালায় সর্বভূতক্ষরায় চা ঔড়ুস্বরায় দমায় নীলায় পরমোষ্ঠিনে। বৃকোদরায় চিত্রায় চিত্রগুপ্তায় বৈ নমঃ।

সেপাই আর দারোগা ঘাটের নীচে এসে দাঁড়িয়ে দুজনকেই লক্ষ করেছে কিছুক্ষণ।

অজানা লোকটি তখন নমো-তর্পণ সেরে পিতৃ আবাহন শুরু করেছে, ওঁ উশন্তা নিবীমবুশন্তঃ সমিধীমহি। উশন্ন শত আবহ পিতৃন হবিষে অন্তবে।

মন্ত্রপাঠের মাঝখানেই অধৈর্য হয়ে মহল্লার দারোগা আচার্য নাভাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তাঁরা গঙ্গার ঘাটে নামবার পর আর কাউকে এদিকে আসতে দেখেছেন কি না?

ব্রাহ্মণকে মিথ্যা কথা বলতে হয়নি। তিনি বিনাদ্বিধায় জানিয়েছেন যে, তাঁরা দু-জন ছাড়া এ ঘাটে এ পর্যন্ত আর কেউ আসেনি।

দারোগা আর সেপাইরা তারপর চলে গেছে। অজানা লোকটির দিকে একবার দৃপাতও করেনি।

ব্রাহ্মণ অজানা লোকটির দিকে চেয়ে এবার তীব্র কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছেন, কে আপনি? আপনার পিতৃ আবাহনের মন্ত্রপাঠ শুনে বুঝলাম, আপনি ঋগ্বেদী কি যজুর্বেদী ব্রাহ্মণ! কিন্তু চেহারা আপনার ক্ষত্রিয়ের মতো! অনুগ্রহ করে জানাবেন, আপনি কে?

অজানা লোকটি একটু হেসে বলেছে, আমার মুখে না-ই শুনলেন। আমি কে তা হয়তো অচিরেই জানতে পারবেন।

ব্রাহ্মণ তা-ই পেরেছেন। লোকটি শেষ কথা বলেই হরিশ্চন্দ্রের ঘাট থেকে গঙ্গায় নেমে ড়ুব দিয়েছিল। একটা কালোমাথা ভোরের অস্পষ্ট আলোয় ভেসে উঠেছিল বহুদূরে গঙ্গার স্রোতের প্রায় মাঝামাঝি। সেই লোকটিই হবে নিশ্চয়।

ব্রাহ্মণ নিজের পূজাপাঠ সেরে ঘাটের ওপর উঠেই সেখানে সমবেত উত্তেজিত জনতার কাছে কিছুক্ষণ আগেকার শোরগোলের কারণ জানতে পেরেছিলেন। খানিক আগে স্বয়ং শিবাজি-ই নাকি এই মহল্লায় মোগল সিপাহিদের হাতে ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে পালিয়ে গেছেন। অকাতরে অত মণিমুক্তো হুন দান করায় অজানা লোকটিকে শিবাজি বলেই বিশ্বাস হয়েছে নাভার, সেই সঙ্গে একটু ধোঁকাও লেগেছে তর্পণের বিশুদ্ধ মন্ত্র আবৃত্তিতে। শিবাজি সারাজীবন শস্ত্র নিয়েই লড়া করতে করতে এমন শাস্ত্র শেখবার সময় পেলেন কখন?

৩.

দাসমশাই একটু থামলেন।

ইতিহাসের অধ্যাপক এই ফাঁকটুকুর জন্যে যেন মুখিয়ে ছিলেন। দাসমশাই নীরব হতে না হতেই বলে উঠলেন, মাপ করবেন, খাফি খাঁর বিবরণ আমিও এক সময়ে পড়েছি। আপনি যা শোনালেন তার সঙ্গে খাফি খাঁর বিবরণের মিল তো বেশি নেই।

না থাকাই স্বাভাবিক। দাসমশাই তাচ্ছিল্যভরে বললেন, খাফি খাঁর বিবরণই যে বেঠিক। তিনি সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভার—মনে রাখবেন উর্দু হরফের গোলমালে নামটা বাভাও হতে পারে কাছে যা শুনেছেন, তা ভাল করে সবটা বুঝতেও পারেননি। তিনি লিখে গেছেন, নাভা কাশীতে এক ব্রাহ্মণের শিষ্য হয়েছিলেন। সেই ব্রাহ্মণ গুরুর কাছে কিন্তু তিনি পেটভরে খেতে পেতেন না। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো শিবাজির কথা বলতে গিয়ে গুরুর বাড়িতে নাভার খেতে না পাওয়ার গল্প বলা একেবারে অর্থহীন ও অবান্তর নয় কি? খাফি খাঁ তারপর লিখে গেছেন যে, শিবাজি নাভার হাতের মুঠোয় ধনরত্ন ভরে দেবার পর তাঁরই অনুরোধে নাভা শিবাজিকে কামানো, স্নান ইত্যাদি করাতে শুরু করেন। হিন্দু আচার-অনুষ্ঠান কিছু জানা থাকলে ব্রাহ্মণ-পুরোহিত যজমানের ক্ষৌরকর্ম করছেন এমন আজগুবি কথা খাফি খা লিখতেন না। খাফি খাঁ যা লিখে গেছলেন, তার ভিত্তিটা খাঁটি হলেও সম্পূর্ণ সঠিক বিবরণ তিনি দিতে পারেননি।

সে-বিবরণ আপনি শুধু পেরেছেন!

না, শিবপদবাবুর কৌতুক-মেশানো বিদ্রূপের খোঁচা নয়, মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র, সেই হরিসাধনবাবুর মুগ্ধ সম্ভ্রমের বিহ্বলতা।

মহৎ অনাসক্তিতে এ উচ্ছাস অগ্রাহ্য করে দাসমশাই সবিনয়ে বললেন, শুধু আমি কেন, চেষ্টা করে হারানো আখবরাত খুঁজে বার করলে যে-কেউ এ বিবরণ পেতে পারেন।

ইতিহাসের অধ্যাপক আবার কী যেন ফ্যাকড়া তুলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে সে-সুযোগ দাসমশাই দিলেন না। তাড়াতাড়ি আগেকার কথার খেই ধরে শুরু করলেন—শুধু সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভার বিবরণই নয়, শিবাজির দীর্ঘতর ঘোরানো পথে নিজের রাজ্যে ফেরার অন্য জোরালো প্রমাণও আছে। যেমন, গোদাবরীর তীরের একটি গ্রামে এক চাষি পরিবারের অবিশ্বাস্য সৌভাগ্যের কাহিনী।

এক সন্ধ্যায় এক সন্ন্যাসী দু-একটি শিষ্যসামন্ত নিয়ে ওই চাষির ঘরে আশ্রয় নেয়। কুটিরের কত্রী বৃদ্ধা কৃষক-জননী সাধু-সন্ন্যাসীদের ভাল করে খেতে না দিতে পারার আফশোশে শিবাজি আর তাঁর সেনাদলকে প্রাণভরে গালাগাল দেয়। কিছুদিন আগেই শিবাজির এক লুঠেরা দল সে-গ্রাম লুণ্ঠন করে গেছে।

সন্ন্যাসী আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ নীরবে এসব অভিযোগ শুনে পরের দিন সকালে বিদায় নেয়। কিন্তু কিছুকাল বাদেই শিবাজির রাজদরবার থেকে ডাক আসে ওই পরিবারের। প্রাণের আশা ছেড়ে দিয়ে সে চাষি পরিবার সভয়ে গিয়ে হাজির হয় শিবাজির রাজসভায়। সেখান থেকে কল্পনাতীত উপহার নিয়ে তারা ফেরে। সৈনিকরা যা তাদের লুঠ করেছিল, শিবাজি তার চতুগুণ তাদের দান করেছেন।

এ-সব কাহিনী আওরঙ্গজেবের কাছেও পৌঁছে তাঁকে বিভ্রান্ত করে তুলেছে। ১৬৬৬-র ১৪ই নভেম্বর যে আখবরাত দিল্লি এসে পৌঁছোয়, তার খবরের সঙ্গে এসব বিবরণের কোনও সামঞ্জস্যই হয় না। আখবরাত-এর খবর হল, শিবাজি আগ্রা থেকে পালাবার পঁচিশ দিন বাদে ১২ই সেপ্টেম্বর রাজগড় পৌঁছেছেন। পোঁছে বেশ কয়েকদিন তিনি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, তারপর সেরে উঠে আবার অসুখে পড়েছেন।

আখবরাত-এর খবর সত্যি হলে সমস্ত ব্যাপারটা দুর্ভেদ্য রহস্য হয়ে দাঁড়ায় বলে মনে হয়েছে আওরঙ্গজেব-এর। রাজগড় থেকে মোগল গুপ্তচর শিবাজির রাজধানীতে ফেরার যে-খবর পাঠিয়েছে, তা আওরঙ্গাবাদের খুফিয়ানবিশের কাছে পৌঁছোতে লেগেছে অন্তত পাঁচ দিন। আর আওরঙ্গাবাদ থেকে দিল্লি পর্যন্ত আখবরাত আসতে একুশ দিন। তার আগে শিবাজির দুবার অসুখে পড়ার সময় ধরলে সবসুদ্ধ কমপক্ষে দু-মাস আগে শিবাজির রাজগড়ে পৌঁছোনো মিথ্যে নয় বলেই মনে হয়। কিন্তু তা কী করে সম্ভব?

এ-সমস্যার সমাধান না করতে পেরে আওরঙ্গজেব আওরঙ্গাবাদের খুফিয়ানবিশ-এর কাছে কড়া চিঠি পাঠিয়েছেন তার খবরটা খাঁটি কি না ভাল করে যাচাই করে জানবার জন্যে। কিন্তু খুফিয়ানবিশ-এর কোনও জবাব আসেনি। তাকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি আওরঙ্গাবাদে। আর-এক গভীর রহস্য সৃষ্টি করে সেও হঠাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।

১৬৬৬-র উনিশে আগস্ট সুতরাং সামান্য তারিখ নয়। আগ্রা শহর টলমল করে উঠে মোগল সাম্রাজ্যের বনেদে ফাটল দেখা দিয়েছে সেইদিনই।

অনেক দুঃখে ভারতসম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর শেষ ইচ্ছাপত্রে লিখে গেছলেন: রাজশক্তির সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হল রাজ্যে যা-কিছু ঘটছে, সবকিছুর খবর রাখা,নইলে এক মুহূর্তের গাফিলতিতে চিরকাল আফশোশ করতে হয়। দেখো, উপযুক্ত হুঁশিয়ারির অভাবে শিবাজি সেই যে পালিয়েছিল, তারই জন্যে অন্তিমকাল পর্যন্ত যুদ্ধ-বিগ্রহের জ্বালা আমার ঘুচল ন।

কিন্তু সত্যিই আওরঙ্গজেবের শিবাজি সম্বন্ধে হুঁশিয়ারির কিছু ত্রুটি ছিল কি?

মনে হয় না। শিবিরে শিবাজিকে দিবারাত্রি পাহারা দিয়েছে রামসিং-এর রাজপুত অনুচরেরা। শিবিরের বাইরে এক মীর আতিশ-এর অধীনে তোপদার এক বিরাট সেনাদল সারাক্ষণ সজাগ থেকেছে! এই বেষ্টনী ভেদ করে শিবাজি পালিয়েই বা যাবে কোথায়!

আগ্রার পথঘাটে সেই কথাই আলোচনা করেছে বড়-ছোট সবাই।

৪.

শিবাজির পলায়নের কয়েক দিন আগেকার কথা। শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ-এর বাড়ি এসেছিল মীর-ঈ-ইমার একটা জরুরি তলব পেয়ে।

সিদ্দি ফুলাদ ক-টা বিশ্বাসী ও চৌকস হালালখোর অর্থাৎ ময়লা সাফ করার মেথর চেয়েছেন মীর-ঈ-ইমারৎ-এর কাছে।

শহর-কোতোয়ালের সামান্য ক-টা ঝাড়ুদারের জন্যে মীর-ঈ-ইমারকে কেন তলব দিতে হয়, তা বুঝতে তখনকার দস্তুর একটু জানতে হয়। প্রত্যেক মহল্লায় বাড়ি-ঘর সাফ করবার ঝাড়ুদারেরাই ছিল কোতোয়ালের গুপ্ত খবর সংগ্রহের প্রধান। চর।

কোন মহল্লায় কার বাড়ির জন্যে হালালখোর দরকার, শুনে মীর-ঈ-ইমার-এর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি ফুটে উঠেছে।

সে-হাসি ফুলাদ-এর দৃষ্টি এড়ায়নি। অন্য কেউ শহর-কোতোয়াল হলে সামান্য মীর-ঈ-ইমার-এর এ-বেয়াদপি সহ্য করতেন না। সিদ্দি ফুলাদ মানুষটা কিন্তু খুব খারাপ নয়। মনটা তাঁর খোলামেলা। তা ছাড়া মীর-ঈ-ইমারকে তিনি একটু অন্য চোখে না দেখে পারেন না। তার প্রতি গোপন একটা কৃতজ্ঞতা শহর-কোতোয়ালের আছে।

সিদ্দি ফুলাদ তাই একটু কপট রাগে ভুরু কুঁচকে বলেছেন, হাসছ যে বড়, বচনরাম! হাসবার কী আছে এতে? রামসিং-এর বাড়ি হালালখোর দরকার হয় না?

হবে না কেন, কোতোয়ালসাহেব! বচনরাম হাসিটুকু মুখ থেকে না মুছে ফেলেই বলেছে, তবে রামসিং বাহাদুরের জন্যে তো নয়, হালালখোর কার জন্যে লাগাতে হচ্ছে, তা তো জানি। ওই একটা নেংটিকে সামলাতে এত হাঁসফাঁস দেখে তাই একটু হাসি পায়। তাও যে-নেংটি তার আপনার গর্তে নেই, খোদ শের-ই-হিন্দুস্তানের ডেরায় নাক বাড়াতে এসে জাঁতাকলে বন্দি। জাঁতাকল ছাড়িয়ে যদি পালায়ও, তাহলে হবে কী? শাহানশাহ্-এর বিরাট রাজত্বের কোণে কানাচে পাহাড়ে-জঙ্গলে কোথায় একটা-দুটো নেংটি-নেউল চরে বেড়ায় তা কি মোগল-সাম্রাজ্যের মাথা ঘামাবার বিষয়!

সিদ্দি ফুলাদ বচনরামের দিকে চেয়ে তার অজ্ঞতায় একটু অনুকম্পার হাসিই হেসেছেন। বলেছেন, নেংটি যাকে বলছ, সে যে কী জিনিস, তাহলে জানো না, বচনরাম। ওই নেংটির দাপটে সমস্ত দক্ষিণ ভারতে থরহরিকম্প লেগেছিল, বিজাপুর রাজ্য যায়-যায়, জাঁদরেল সব মোগল সেনাপতিরা নাকের জলে চোখের জলে হয়েছে এই শিবাজির রণকৌশলে। ওকে তাই অনেক ফন্দি করে মিথ্যে টোপ দেখিয়ে আগ্রায় এনে পোরা হয়েছে। একবার এখান থেকে ছাড়া পেলে ও কী সর্বনাশ করতে পারে কেউ জানে না!

বচনরামের মুখে সরল বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে যেন। কথাটায় বিশ্বাস করতে যেন। কষ্ট হচ্ছে এইভাবে সে বলেছে, ওই একরত্তি মানুষটার মধ্যে এত দুশমনি! আমারই মতো তো ক্ষয়া-পাতলা মাঝারি মাপের চেহারা!

তুমি কোথায় দেখলে শিবাজিকে! সিদ্দি ফুলাদ একটু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন।

দেখেছি আগ্রায় যেদিন প্রথম আসে, সেইদিনই। বচনরাম একটু হতাশ হওয়ার। সুর ফুটিয়েছে গলায়, শহরের নানা মহল্লায় নানা গুজব শুনে ইচ্ছে হয়েছিল স্বচক্ষে একবার মানুষটাকে দেখবার। এমন একটা কেও-কেটার ইস্তিল কেমন হয় তাও দেখতে চেয়েছিলাম। শহর ছাড়িয়ে তাই মানিকচাঁদের সরাই পর্যন্ত গেছলাম। গিয়ে আফশোশই হল। এই শিবাজি ভোঁসলের অভ্যর্থনা! আগ্রা শহর তাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি।

সত্যিকার হোমরা-চোমরাদের বেলা ইস্তিবাল-এর কী দস্তুর? আগ্রা থেকে অন্তত একদিনের পথ বাকি থাকতে মানী অতিথি যাত্রা থামিয়ে বিশ্রাম করতেন। শাহানশাহ-এর প্রতিনিধি দামি উপহার নিয়ে সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে শোভাযাত্রা করে সসম্মানে তার পরদিন শহরের রাস্তা দিয়ে এনে জ্যোতিষীদের বিধান দেওয়া শুভসময়ে সম্রাটের সামনে হাজির করবেন। কোথায় কী! সব দেখলাম ভোঁ ভোঁ। শুনলাম, কুমার রামসিং-এর ওপর শিবাজিকে অভ্যর্থনা করার ভার ছিল। তিনি নাকি শিবাজির পৌঁছোবার খবর জানতেই পারেননি। জানতে যখন পেরেছেন। তখন আবার পাঠিয়েছেন তাঁর মুনশি গিরধরলালকে। ইস্তিকাল-এর এই ছিরি দেখেই আমার তো ভক্তি উড়ে গেছল। আগ্রা শহরে পরের দিন ঢোকবার পর আর-এক কেলেঙ্কারি। কুমার রামসিং-এর সেদিন বুঝি প্রাসাদ পাহারা দেওয়ার হফত চৌকি ছিল। সে কাজ সেরে রামসিং আর মুকলিস খাঁ তাঁদের লোকলশকর নিয়ে যখন শিবাজিকে অভ্যর্থনা করতে ছুটে গেছেন খোজা ফিরোজার বাগিচার পথ ধরে, তখন মুনশি গিরধরলাল শিবাজিকে নিয়ে আসছে দহর-আরা বাগিচার রাস্তায়। শেষে কোনওরকমে এ ভুল শুধরে শিবাজির সঙ্গে কুমার রামসিং-এর দলের দেখা হল খাসবাজারের নূরগঞ্জ বাগিচায়। তারপর শিবাজিকে প্রায় ঘোড়দৌড় করিয়ে শাহানশাহ্-এর কাছে হাজির করবার চেষ্টা। তখন দিওয়ান-ই-আম-এর পালা শেষ হয়ে গেছে, সম্রাট বসেছেন দিওয়ান-ই-খাস-এ গিয়ে। ছোট মীর বকশি আসাদ খাঁ সেখানে শাহানশাহ-এর সামনে হাজির করেছেন শিবাজিকে। শিবাজি ভোঁসলে। হাজার মোহর আর দু হাজার সিক্কা নজর দিয়েছেন। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার সিক্কা নিসার। সম্রাট কিন্তু মুখের একটা কথা বলেও শিবাজিকে সম্ভাষণ করেননি। শিবাজিকে তারপর নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানো হয়েছে পাঁচ-হাজারি মনসবদারদের সারিতে।

ধৈর্য ধরে এতক্ষণ পর্যন্ত সব শুনে শহর-কোতোয়াল একটু ভুরু কুঁচকে বলেছেন, তুমি এতক্ষণ ধরে যা শোনালে আগ্রা শহরে কারও তা জানতে বাকি আছে মনে করো! তবু অত ফলাও করে আমায় সব শোনাবার মানেটা কী বলো তো?

আজ্ঞে, সোজা মানে তো আগেই জানিয়ে দিয়েছি, কোতোয়াল সাহেব! বচনরাম সরলভাবে বলেছে, ওই যার ইস্তিল-এর নমুনা, শাহানশাহ্ যাকে মুখের একটা কথায় সম্ভাষণ করবার যোগ্য মনে করেন না, সেই তুচ্ছ একটা মানুষকে অত ভয় করবার কিছু আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তাকে আটক রাখবার এত তোড়জোড় তাই একটু বাড়াবাড়িই মনে হয়।

উঁহুঃ—সিদ্দি ফুলাদ একটু হেসেছেন—তুমি একটা কথা ভুলে যাচ্ছ, বচনরাম। শিবাজির ইস্তিল যে ঠিকমতো হয়নি তা তাকে তাচ্ছিল্য দেখাবার জন্য নয়।

তবে কি সম্মান দেখাবার জন্যে!

বচনরামের গলার স্বরটা প্রায় বেয়াদবির কিনারা ছুঁয়ে গেছে।

চোখটা বচনরামের মুখে তোলবার সময় ঝিলিক দিয়ে উঠলেও সিদ্দি ফুলাদ খোঁচাটা তেমন গায়ে মাখেননি বোধহয়। ভুল শোধরাবার ভঙ্গিতে সহজভাবেই বলেছেন, সম্মান দেখাবার উদ্দেশ্যই ছিল, কিন্তু তারিখটাই গোলমাল করে দিয়েছে।

বচনরামের কাছে যেন একটা প্রশ্ন আশা করে একটু থেমেছেন শহর-কোতোয়াল। সে প্রশ্ন না আসায় নিজেই আবার বলেছেন, দিনটা কী ছিল এখন আশা করি মনে পড়েছে। শিবাজি যেদিন আগ্রায় এসে ঢুকলেন, শাহানশাহ্-এর সেই দিনই পঞ্চাশের জন্মদিন। শহরের কারও মাথায় আর কোনও চিন্তা কি আছে তখন! চার মাস আগে শাজাহান মারা গেছেন আগ্রার দুর্গে। সম্রাট আওরঙ্গজেব এতদিন দিল্লি থেকেই সাম্রাজ্য চালিয়েছেন। এই প্রথম তিনি দিল্লি ছেড়ে আগ্রায় এসে দরবার বসিয়েছেন। চোদ্দোশো গাড়িতে যে-সব ঐশ্বর্য এসেছে দিল্লি থেকে আগ্রায়, তা সাজিয়ে রাখা হয়েছে প্রাসাদে, সম্রাটের জন্মদিন পালন করতে যারা আসবে তাদের চোখ ধাঁধাবার জন্যে। তা সত্যিই তো আগ্রাবাসীর মাথা ঘুরে গেছে তৈমুরবংশের ঐশ্বর্য দেখে। বড়-ছোট সবাই তখন সম্রাটের জন্মদিনের উৎসবেই মত্ত। শিবাজি যদি আগ্রায়। পৌঁছোতে দেরি না করতেন, যদি একদিন আগেও তিনি আগ্রায় পা দিতেন, তাহলে এ সমস্ত গোলমাল কিছুই হত না।

সম্রাটের জন্মদিনের দরুন তাঁকে খাতির করে আগ্রায় আনার না-হয় ত্রুটি হয়েছে, কিন্তু শাহানশাহ নিজেই যে একটা কথা বলেও তাঁকে মেহেরবানি করেননি, তাঁকে যে পাঁচহাজারি মনসবদারদের সারিতে দাঁড় করানো হয়েছে, সেটাও কি জন্মদিনের গোলমালে? বচনরাম মাথা নেড়েছেনা কোতোয়াল সাহেব, যা-ই আপনি বোঝান, শিবাজি একটা কেও-কেটা আমি মানতে পারব না। সামান্য একটা পাহাড়ি ভুইয়ার লুঠেরা হয়ে দুদিন একটু পিঁপড়ের পাখা গজিয়েছিল। সে পাখা হেঁটে দিয়ে সম্রাট তাই তাকে পোকামাকড়ের শামিলই মনে করেছেন। আপনারাই মিছিমিছি শিবাজিকে ফানুসের মতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তার ভয়-ভাবনায় অস্থির। এই যে জিসি-দতি নিয়ে শিবাজির শিবির ঘেরাও করে রেখেছেন, আগ্রার সাধারণ মানুষ তাতে কিন্তু তাজ্জব। তারা কেউ কেউ আবার হাসে। বলে, জিসি-দতি, মানে কামানবন্দুক লাগে ওই একটা পাহাড়ি চুহাকে আটকে রাখতে। বন্দুকচি তো নয়ই, নেহাত সাধারণ পাহারাদারের যারা শামিল সেই আশা-ও নয়, তারও চেয়ে ওঁচা যত হতভাগা বেকার বাউন্ডুলেদের দিয়ে গড়া সেহবন্দি ক-টা সেপাই রাখলৈই তো ঠাণ্ডা!

সেহ-বন্দি সেপাই রাখলেই ঠাণ্ডা! এবার সিদ্দি ফুলাদ বচনরামকে ব্যঙ্গ করেই হেসে উঠেছেন। তার পর চোখ দুটো কুঁচকে, মুখ বেঁকিয়ে বলেছেন, শহরের উটকো লোক যা বলে, তোমারও তাহলে তাই ধারণা!

বচনরাম চুপ করে থেকেই তার সায় জানিয়েছে।

সিদ্দি ফুলাদ এবার বচনরামের প্রতিবাদে যেন নয়, নিজের ও সেই সঙ্গে সারা মোগল জাহানের অন্তরের জ্বালাটা প্রকাশ করে বলেছেন, শোনো বচনরাম, ও চুহা নয়। পাহাড়ি চিতা। ওর নিজের এলাকায় পাহাড়-জঙ্গলে ও মোগল শেরকেও ঘায়েল করে। সায়েস্তা খাঁর শিক্ষাটাই মনে করো না! পুনায় ভোঁসলে পরিবারের নিজেদের মোকামে সায়েস্তা খাঁ তার লোক-লশকর হারেমসুদ্ধ নিয়ে আছে। তার নিজের সৈন্যবাহিনী তো আছেই, তার ওপর যশোবন্ত সিং-এর দশ হাজার জোয়ান। এইসব হেলায় তুচ্ছ করে শিবাজি চারশো বাছাই করা অনুচরের মধ্যে মাত্র দুশো জনকে নিয়ে সায়েস্তা খাঁর হারেমের ভেতর পর্যন্ত ঢুকে সব লণ্ডভণ্ড করে সায়েস্তা খাঁর বুড়ো আঙুল কেটে নিয়ে আসে। না বচনরাম, শিবাজি হেলাফেলা করবার লোক নয়, তা আলমগির ভালো কইে জানেন। তিনি দরবারে ওকে যে একটু অগ্রাহ্য করেছেন সে শুধু পরীক্ষা করবার জন্যে। তাতে ওরকম হাত-পা ছুঁড়ে চেঁচিয়ে সম্রাটের আর তাঁর। দরবারের অপমান করা কি শিবাজির উচিত ছিল?

ওঃ, হ্যাঁ, তাও তো বটে! শিবাজি তো খুব চেঁচামেচি করেছিলেন ওই দরবারের মধ্যেই! বচনরামের মুখের ভাবে অবিশ্বাস আর বিস্ময়ই যেন ফুটে উঠেছে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে-মুখে একবার চোখ বুলিয়ে সিদ্দি ফুলাদ বলেছেন, চেঁচামেচি নয়, তাকে বলে কেলেঙ্কারি। সম্রাটের কাছে কোনও অভ্যর্থনা না পেয়ে পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে শিবাজি যেই শুনলেন কুমার রামসিং-এর কাছে যে, সেটা পাঁচহাজারি মনসবদারদের সারি, তৎক্ষণাৎ তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন কী! আমার খাতির এই! আমার ছেলে আগ্রা না এসেই পাঁচহাজারি মনসবদারি পেয়েছে। আমার কাছে যে চাকরি করে সেই নেতাজিও পাঁচ-হাজারি! আর আমি পাহাড়-জঙ্গল ভেঙে আগ্রা এসেছি এই সম্মান পেতে! শিবাজির সামনে দাঁড়িয়েছিল যশোবন্ত সিং আর প্রধান ওয়াজির জাফর খাঁ। সম্রাটের কাছে তারাও যখন খিলাত পেল শিবাজিকে বাদ দিয়ে, তখন শিবাজির চোখ দিয়ে যেন আগুন ছিটোচ্ছে। সম্রাটের পর্যন্ত তা নজরে পড়েছে তখন। কুমার রামসিংকে তিনি পাঠালেন শিবাজি অমন অস্থির কেন জানতে। শিবাজি যা মুখে আসে, বিক্ষোভে জানিয়ে মনসবদারি ছেড়ে দিয়ে এবার যা করেছে, বাবর শাহ-এর আমল থেকে মোগল রাজত্বে তা দিল্লি কি আগ্রা কোথাও কেউ করতে সাহস করেনি। শিবাজি সিংহাসনের দিকে পেছন ফিবে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে গেছে। কুমার রামসিং সন্ত্রস্ত হয়ে তাকে হাতে ধরে ফেরাতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শিবাজি সজোরে হাত ছিনিয়ে নিয়ে একটা থামের পেছনে গিয়ে সেই যে বসেছে, শত অনুনয়-বিনয়েও আর ওঠেনি। সেখানে বসেই কুমার রামসিংকে বলেছে, আমায় এখুনি কাটো মারো যা খুশি করো, সম্রাটের সামনে আমি যাব না। আলমগির কুমার রামসিং-এর কাছে শিবাজির অভিমানের কথাই একটু শুনেছেন। শুনে, অন্য ওমরাহদের শিবাজিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ফেরাতে বলেছেন, তাকে খিলাত পর্যন্ত দিয়েছেন, কিন্তু শিবাজি তার গোঁ ছাড়েনি। শাহনশাহকে তো এত কিছু বলা যায় না, তাঁকে এবার বোঝানো হয়েছে যে, দারুণ গরমে মারাঠা সর্দার বেহুশ হয়ে পড়েছে।

ওঃ! এত কাণ্ড! বচনরামের গলা এবার যেন অপ্রসন্ন–দরবারের বাইরে তো ঠিক খবর আমরা পাইনি। সত্য-মিথ্যে হরেকরকম গুজব আমাদের কানে এসেছে। সত্যি যা হয়েছে তাতে শাহানশাহ্ তো রাগ করতেই পারেন। তাই বুঝি আপনার ওপর হুকুম হয়েছিল শিবাজিকে কিল্লাদার রাদ-আন্দাজ খাঁর হাতে তুলে দেবার?

কে—কে বললে তোমায় এ কথা?

সিদ্দি ফুলাদ-এর হাবসি শ্যামলা মুখ এবার বেগনে হয়ে উঠেছে সত্যিকার রাগে। বচনরামের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছেন, এ সমস্ত মিথ্যা কথা!

তা তো হতেই পারে!বচনরামকে তেমন বিচলিত মনে হয়নি—বাজারে কতরকম বাজে গুজবই তো রটে। এও রটেছে যে, রাদ-আন্দাজ খাঁর জিম্মায় কেল্লার ভেতরে পাঠানো মানেই হল একেবারে শেষ করে দেওয়া। রাদ-আন্দাজ খাঁ নাকি পিশাচদেরও হার মানায় শয়তানিতে আর নিষ্ঠুরতায়। ছোট থেকে বড় হয়েছে সে শুধু এই নৃশংসতার জোরে। আলওয়ারের সনামী সম্প্রদায়কে ঝাড়ে বংশে শেষ করে দেওয়ার পরই নাকি আগ্রায় কিল্লাদারি পেয়েছে। সত্য-মিথ্যে জানি না, তার জিম্মায় শিবাজিকে পাঠানোর খবর পেয়ে কুমার রামসিং নাকি শাহানশাহ্-এর কাছে বলেছেন, তার আগে আমাকে মারবার হুকুম দিন, জাঁহাপনা! আমার বাবা শিবাজিকে অভয় দিয়ে আগ্রা পাঠিয়েছেন। রাজপুতের জবানের দাম তার প্রাণের চেয়ে বেশি। সম্রাট তাতে নাকি কুমার রামসিং-এর কাছে খত চেয়েছেন শিবাজিকে পাহারায় রাখার দায় স্বীকার করে। তাই লিখে দিয়েছেন কুমার। কিন্তু আবার নাকি নতুন ফন্দি হয়েছে শিবাজিকে শেষ করবার। ভারতের পশ্চিম সীমান্তে ইউসুফজাই আর আফ্রিদি বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করবার জন্যে কুমার রামসিং-এর সঙ্গে শিবাজিকে পাঠাবার মতলব হয়েছে। ঠিক হয়েছে, এবারও কাবুলের পথে আগুসার বাহিনীতে থাকবে সেই রাদ-আন্দাজ খাঁ, রাস্তাতেই হঠাৎ দুশমনদের আক্রমণের নাম করে শিবাজিকে যাতে খতম করে ফেলা যায়। কুমার রামসিং-এর জন্যে সে ফন্দিও কাজে লাগানো নাকি যায়নি।

এইসব গুজব আগ্রায় রটে তুমি বলছ।

সিদ্দি ফুলাদ-এর গলা এখন জলদগম্ভীর।

কিন্তু নির্দোষ বলেই বোধহয় বচনরামের ভয়-ডর কিছু নেই। অবিচলিতভাবে বলেছে, তা না হলে আমি আর কোথা থেকে জানব কোতোয়াল সাহেব! হালালখোর দু-চারজন নোকরির দায়ে সব সময়ে আসা-যাওয়া করে। তাদের কাছেই কখনও-সখনও উড়ো গুজব শুনি।

হুঁ! বলে সিদ্দি ফুলাদ কী যেন ভেবে নিয়ে আবার সহজ হয়ে বলেছেন, এ ধরনের খবর পেলে আমায় জানিও। আর গিয়েই ভাল দেখে দু-জন হালালখোর পাঠিয়ে দেবে।

যো হুকুম কোতোয়াল সাহেব! বলে সেলাম করে বচনরাম বেরিয়ে গেছে।

৫.

বচনরামের চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারেননি সিদ্দি ফুলাদ। দেউড়িতে বাঁধা তার ঘোড়ার আওয়াজ বাইরের রাস্তায় মিলিয়ে যেতে না যেতে তাঁর তবিনান-এর এক সিপাইকে পাঠিয়েছেন কাটরা-ই-পচার দারোগাকে তলব দিতে। বচনরাম ওই কাপড়ের বাজারের একটি বাড়িতেই থাকে। দারোগা এলে সিদ্দি ফুলাদ তাকে নির্দেশ দিয়েছেন সারা দিনরাত দু-জন হরকরা লাগিয়ে বচনরামের চলাফেরা। সবকিছুর খবর নিতে। দিন দুই এভাবে নজরবন্দি রেখে তৃতীয় দিনেই বচনরামকে ভোরবেলাই যেন কয়েদ করা হয়, এ-ই সিদ্দি ফুলাদ-এর হুকুম।

এ হুকুম দেবার আগে সামান্য একটু দ্বিধা জয় করতে হয়েছে সিদ্দি ফুলাদকে। বচনরামের কাছে একটা ঋণের কথা মন থেকে উড়িয়ে দিতে সময় লেগেছে। এই ঋণটুকুর জন্যেই বচনরামের অনেককিছু এ পর্যন্ত সহ্য করেছেন সিদ্দি ফুলাদ, তাকে একটু আশকারাই দিয়েছেন বলা যায়। কিন্তু এবার দাঁড়ি না টানলে নয়। বচনরাম মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তা ছাড়া ওই ক্ষয়া-পাতলা অথচ ইস্পাতের মতো মজবুত আর ধারালো মানুষটাকে কেমন যেন ভয়ও হয় আজকাল, ভয় আর সন্দেহ। মানুষটার ভেতর যেন গোলমেলে কিছু আছে। এরকম লোককে সময় থাকতে নিকেশ করে দেওয়াই ভাল। ঋণের কথাটা মন থেকে মুছে ফেলবার জন্যে যুক্তিও একটা খাড়া করেছেন সিদ্দি ফুলাদ। বচনরাম তাঁর আশাতীত উপকার যদি একদিন করে থাকেও, সিদ্দি ফুলাদও তার প্রতিদান দিয়েছেন তাকে মীর-ঈ-ইমারৎ-এর কাজ পাইয়ে দিয়ে। খাঁটি সুন্নি ছাড়া শিয়ারাও সহজে যা পায় না, বিধর্মী হয়ে সেই কাজ কি যথেষ্ট নয়! তাইতেই শোধবোধ হয়ে গেছে অনেক আগে। সুতরাং এখন আর বিবেকের খোঁচা থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে সাম্রাজ্যের খাতিরে এসব সন্দেহজনক মানুষের উচিত ব্যবস্থা করতে তিনি বাধ্য।

বচনরামের কাছে ঋণটা যত বড়ই হোক, তার চেয়ে বড় শাহানশাহ্ আওরঙ্গজেব-এর প্রতি তাঁর কর্তব্য।

ঋণটা অবশ্য ছোটোখাটো নয়। বচনরাম না থাকলে তাঁর নয়নের মণি একমাত্র মেয়েকে তিনি আর জীবনে পেতেন না। আর তাহলে আগ্রায় এসে এই একাধারে মীর আতিশ আর শহর-কোতোয়াল হওয়া তাঁর ভাগ্যে কি থাকত!

সে প্রায় তিন বছর আগের কথা। কচ্ছ উপসাগরের মান্দভি বন্দর থেকে মোগল নৌয়ারার দারোগাগিরি ছেড়ে স্ত্রী কন্যা নিয়ে আসছেন আগ্রায়। নামের আগে সিদ্দি থাকলেই জাঞ্জিরার হাবশি রাজবংশের লোক বুঝতে হবে। আর সিদ্দিদের ওপরই ছিল পশ্চিম সমুদ্রের নৌবাহিনীর ভার। সিদ্দি ফুলাদ-এর কিন্তু উচ্চাশা ছিল জল ছেড়ে ডাঙার উচ্চপদে ওঠবার। তাই তিনি চলেছিলেন এক কাফিলার সঙ্গে আগ্রায়।

রাজপুতানার মরুভূমির মধ্যে দিয়ে পথ। চোদ্দোআনা পথ তখন পার হয়ে এসেছেন। হিন্দৌন ছাড়িয়ে আর প্রায় পঁচিশ ক্রোশ যেতে পারলেই আগ্রা। সেখানেই মরুভূমির বালিয়াড়ির মাঝে এক রাত্রে ডাকাতের দল হানা দিয়েছে তাঁদের কাফিলায়। মরুভূমির ধুলোবালির ঝড় সে সময়ে যেন ঈশ্বরের দয়াতেই না উঠলে ধনসম্পদ মানুষজন কিছুই বা কেউই রক্ষা পেত না নিশ্চয়। ঝড়ই সিদ্দি ফুলাদ-এর দলকে সাহায্য করেছে। প্রচণ্ড বালুঝড়ের মধ্যে ডাকাতের দল আর তাদের শিকারদের দুরবস্থা হয়েছে একই। কে কোথায় যে ছিটকে গেছে কেউ জানে না। ঝড় থামবার পর চোখ মেলে চাইবার মতো অবস্থা হলে সিদ্দি ফুলাদ দেখেছেন, ধন-সম্পদ তাঁর বিশেষ কিছু খোয়া যায়নি, কিন্তু যা গেছে তার কাছে দুনিয়ার সম্পদ সিদ্দি ফুলাদ-এর চোখে তুচ্ছ। জাঞ্জিরার শ্রেষ্ঠ সুন্দরী, সিদ্দি ফুলাদ-এর নয়নের মণি, তাঁর কুমারী কন্যারই খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। বালির ঝড়ে সে নিজেই কোথাও কোনও ধূ-ধূ প্রান্তরে ছিটকে গিয়েছে, না দস্যুরাই তাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, কে জানে!

সিদ্দি ফুলাদ প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছেন শোকে হতাশায়। তাঁর মনে পড়েছে মান্দভির এক হিন্দু জ্যোতিষীর কথা। নৌবহরের কাজ ছেড়ে আগ্রা রওনা হবার আগে তাঁকে একদিন হাত দেখাতে গেছলেন সিদ্দি ফুলাদ। জানতে চেয়েছিলেন, আগ্রায় যে উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন তা বিফল হবে কি!

না, তা হবে না, বলেছিলেন হিন্দু জ্যোতিষী, অনেক কিছুই পাবেন আগ্রা গিয়ে, উঠবেন অনেক ওপরে। কিন্তু পাবেন যেমন অনেক কিছু, হারাবেনও তেমনই কোনও একটা রত্ন।

একটা রত্ন শুধু? জিজ্ঞাসা করেছিলেন সিদ্দি ফুলাদ।

হ্যাঁ, একটা রত্নই! বলে কীরকম যেন অদ্ভুতভাবে তাঁর দিকে চেয়েছিলেন জ্যোতিষী। তারপর আবার বলেছিলেন, একটা রত্নের বদলে অনেক কিছু পেতে আপনার আপত্তি নেই তা হলে?

সিদ্দি ফুলাদ হেসে বলেছিলেন, না, আপত্তি নেই। একটার জায়গায় অনেক পাব? তো ঠিক?

হ্যাঁ, তা পাবেন! কীরকম একটু রহস্যমেশানো হাসি মুখে মাখিয়ে বলেছিলেন জ্যোতিষী।

সেই একটি রত্ন মানে কি তাঁর প্রাণাধিক এই মেয়ে!

তা যদি জানতেন তাহলে কোনও সৌভাগ্যই তিনি চাইতেন না জীবনে। মান্দভিতে মোগল নৌবাহিনীর একজন অধ্যক্ষ হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতেন।

একটি মাত্র মেয়ে। তার ভবিষ্যতের জন্য ভাবনা তত তাঁর সত্যি কিছু ছিল না। তাঁর নিজের কিছু থাক বা না থাক, ফিরোজা নিজের রূপগুণেই উপযুক্ত আমির-ওমরাহের ঘরে সাদরে সমাদরে জায়গা পেত।

মেয়ে তাঁর সত্যিই অসামান্যা সুন্দরী।

তাঁরা হাবশি, কিন্তু কাফ্রি তো নয়। সত্যি কথা বলতে গেলে, রং একটু ময়লা। হলেও যৌবনে ইরানি তুরানি সুপুরুষরা আভিজাত্য মেশানো দেহসৌষ্ঠবে তাঁর কাছে। দাঁড়াতে পারেনি। তিনি বিয়ে করেছেন আবার আসোয়ান-এর তখনকার ডাকসাইটে মিশরি সুন্দরীকে। ফিরোজা তাই একদিকে বসরার গুলের মতো মধুর আর কোমল,

আর একদিকে বিদ্যুতের চমক দেওয়া দীপ্তি তার রূপে।

কিন্তু এহেন রূপকেও ভুলিয়ে দেয় তার গুণ। ষোলো থেকে এখনও সতেরোয় পা দেয়নি, এরই মধ্যে নিজেদের আম্‌হারিক তো বটেই, তার ওপর আরবি, ফারসি, তুর্কি, এমনকী ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষা পর্যন্ত, সে ভালরকম শিখেছে। এদেশের। গানবাজনার দিকে তাঁর ঝোঁক একটু বেশি। এমনিতে সে কোকিলকণ্ঠী, তার ওপর জেদ করে বীণা বাজানোও শিখেছে।

মেয়ের এই জেদ-ধরা গোঁ-ই সিদ্দি ফুলাদকে ভাবিত করেছে একটু-আধটু। এই জেদের জন্যেই মেয়েটা ভবিষ্যতে ঘা খাবে না তো! তাই বা খাবে কেন, নিজেকে বুঝিয়েছেন ফুলাদ সাহেব। এমন কিছু অন্যায় জেদ তো সে এখনও ধরেনি। আর যা ধরে তা শেষ পর্যন্ত সফল করেই ছাড়ে। যেমন, সেই তলোয়ার খেলা শেখার ঝোঁক। শুনেই বেগমসাহেবা তো আঁতকে উঠেছিলেন—মেয়েছেলে তলোয়ার খেলতে শিখবে কী। কিন্তু সিদ্দি ফুলাদ তাঁর স্নেহের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। চারশো বছর আগে এই ভারতবর্ষেই এক মুসলিম মহিলা কি রানি হিসেবে অস্ত্রধারণ করেননি! স্বামীর সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পরাজিত হয়ে প্রাণও দিয়েছিলেন। ফিরোজাকে তো আর সেরকম কিছু করতে হবে না। খেয়াল হয়েছে যখন, শিখুক। ফিরোজা তলোয়ার চালানো সত্যিই শিখেছে, এমন শিখেছে যে সিদ্দি ফুলাদ শুধু নয়, ফিরোজার শিক্ষাগুরু বুড়ো ওস্তাদও অবাক হয়ে গেছেন। বেশিদিন এ নেশা থাকেনি এই ভাগ্যি। মেয়ের এ-ধরনের খেয়াল বেশিদিন থাকে না।

এ মেয়ে সম্বন্ধে কত আশা না করেছেন সিদ্দি ফুলাদ, কত স্বপ্নই না দেখেছেন। বড় হবার, ধনী হবার এত যে চেষ্টা এ তো শুধু তারই জন্যে। আগ্রায় যাচ্ছেন। মোগল জাহানের রাজধানীতে আগ্রা শহরের শ্রেষ্ঠ সব পরিবারে তাঁর মেয়ের অসামান্য রূপগুণের খবর চাপা থাকবে না! ফিরোজা তার যোগ্য ঘর বর পাবে।

সব স্বপ্নই কি তাহলে ধূ-ধূ বালুর দেশের মরীচিকা হয়ে গেল?

উদ্ভ্রান্তের মতো সিদ্দি ফুলাদ কয়েকজন বিশ্বস্ত অনুচর নিয়ে মরুভূমির মধ্যে কন্যার সন্ধান করে ফেরেন।

কিন্তু কোথাও তার কোনও চিহ্নও নেই। না তার, না দস্যুদলের কারও।

৬.

দ্বিতীয়দিনে সকালবেলা উষার আলোয় রাঙা দিগন্তব্যাপী বালুকা-প্রান্তরে দূরে একজন ঘোড়সওয়ারকে দেখা যায়। ঘোড়সওয়ার ঘোড়া থামিয়ে পাষাণমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে নীচের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে।

ফুলাদ সাহেবের অনুচরেরা চিৎকার করে ওঠে হিংসায় আক্রোশে, ডাকু! ওই একটা ডাকু!

দূর থেকে সওয়ার মুখ তুলে তাকায়। কিন্তু পালাবার কোনও চেষ্টা তার দেখা যায়। যেমন ছিল তেমনই স্থিরভাবেই সে ঘোড়ার ওপর বসে থাকে।

সিদ্দি ফুলাদ আর তাঁর অনুচরেরা ঘোড়া ছুটিয়ে নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে।

অনুচরেরা খোলা তলোয়ার নিয়ে তারপর লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছে, কিন্তু ডাকুটাকে তাতেও নির্বিকার থাকতে দেখে ফুলাদ সাহেব নিজেই অনুচরদের নিরস্ত করেছেন।

ডাকুটার ব্যবহার সত্যি তাঁর অদ্ভুত লেগেছে। ফুলাদ সাহেব ঘোড়া চেনেন। ডাকুটার ঘোড়া দেখেই তিনি বুঝেছেন, দূর থেকে যখন তাঁদের সাড়া সে পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে তখনই সে নিজের ঘোড়া ছুটিয়ে পালাতে পারত। তার ঘোড়ার নাগাল ধরা সিদ্দি ফুলাদের দলের কোনও ঘোড়ার সাধ্যে কুলোত না।

তবু লোকটা পালাবার চেষ্টা তো করেইনি, এমনকী তাঁর অনুচরদের ঝাঁপিয়ে পড়বার উপক্রম করতে দেখেও কোমরের খাপবন্দি তলোয়ারের হাতলে পর্যন্ত হাত বাড়ায়নি।

বিস্ময়ের সঙ্গে রাগ ও বিরক্তি মিশিয়ে সিদ্দি ফুলাদ একটু তিক্ত বিদ্রূপের সুরেই বলেছেন, খুব তোমার সাহস, না? ভেবেছ, সাহস দেখেই আমরা চিনতে ভুল করব?

লোকটা ঠোঁট ফাঁক না করে সামান্য একটু হেসেছে। তারপর সিদ্দি ফুলাদকে উদ্দেশ করেই আবৃত্তি করেছে সুরেলা গলায়—হর কস কি খিয়ানৎ কুন আলবত্তা বতর্সদ। বেচারা নূরী না করে হ্যায় না ডরে হ্যায়।

সিদ্দি ফুলাদ সত্যি চমকে উঠেছেন। আকবরের সভাসদ বিখ্যাত ফৈজির প্রাণের দোস্ত মুল্লা নূরীর এ বিরল কবিতা এই একটা ডাকুর মুখে!

কবিতার মোদ্দা মানে হল—অন্যায় যে করে সেই ভয় পায়, অন্যায় যে করে না তার ভয়ও নেই।

তুমি দস্যুদের কেউ নও! কে তাহলে তুমি! রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন সিদ্দি সাহেব, কিন্তু স্বরটা নিজের অজান্তেই নরম হয়ে এসেছে শেষের দিকে।

এবার লোকটা একটু অবান্তর হলেও আধ্যাত্মিক কবিতাতেই জবাব দিয়েছে। আমির খসরুর একটি চেৎ কবিতার কলি আউড়ে চলেছে–

সব কোয়ি উসকো জানে হৈ
পর এক নহী পহচানে হৈ
আঠ দহড়ী মে লেখা হৈ
ফিকর কিয়া মন-দেখা হৈ।

নিজেই তারপর হেসে উঠে বলেছে, কিছু মনে করবেন না, একটু তত্ত্বকথা বলে ফেললাম। কিন্তু আপনাদের ধরন দেখে মনে হচ্ছে কাউকে মারকাট করে একটা রক্তারক্তি না করলে আপনাদের শান্তি নেই। এ মরুভূমিতে বড় বেয়াড়া সব পোকামাকড় আছে বালির গাদার ভেতরে। তার কোনটা আপনাদের কামড়াচ্ছে জানতে পারি?

লোকটার নির্বিকার ভাব দেখে মনে মনে একটু দ্বিধাগ্রস্তই হয়েছেন সিদ্দি সাহেব। বাইরে তবু রূঢ় গলাটা বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করেছেন আবার, ওসব বাজে কথা রেখে আগে বলো, তুমি কে! কী করছ এখানে?।

আমি! লোকটা হেসে বলেছে, ছিলাম সামান্য একজন শিলাদার। আমার মনসবদার ছিলেন হাজারি জাট দো সদ সওয়ার। আর আমি তাঁর দলে বিস্তি। একদিন তাঁর সঙ্গে করার করার অপরাধে তিনি কুড়িজনের বদলে দশজনের সর্দারিতে নামিয়ে বিস্তির জায়গায় মীর-দহ্ করে দেন। সেই দুঃখেই কাজ ছেড়ে মিরাট থেকে গুজরাট যাচ্ছি সেখানে যদি ভাগ্য ফেরাতে পারি।

লোকটার চেহারা, পোশাক ও ঘোড়াটাকে লক্ষ করে তার কথাটা খুব অবিশ্বাস। করতে পারেননি সিদ্দি ফুলাদ।

কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে করছিলে কী নীচের বালির দিকে চেয়ে?

সন্দেহের চেয়ে সরল কৌতূহলই বেশি ছিল তাঁর জিজ্ঞাসায়।

এখানে বালিতে লেখা একটা অদ্ভুত গল্প পড়ছিলাম! গম্ভীর মুখেই বলেছে লোকটা।

বালিতে লেখা গল্প! লোকটার পরিহাস করার স্পর্ধায় সিদ্দি আগুন হয়ে উঠেছেন আবার।

মিছে গরম হবেন না। লোকটি শান্ত গম্ভীর স্বরে বলেছে, কাল রাত্রেই এখানে একটা নাটকীয় ব্যাপার ঘটেছে, বালিতে তার চিহ্ন এখনও মোছেনি। সেই চিহ্নগুলোই পড়ছিলাম।

চিহ্নগুলো কী নাটকীয় ব্যাপার জানাচ্ছে? উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন সিদ্দি ফুলাদ।

জানাচ্ছে যে, এখানে বালির ওপর একটা দ্বন্দ্বযুদ্ধ গোছের হয়ে গেছে। একজন। লম্বা-চওড়া জোয়ান আর একজন বালক বলেই মনে হয়। লড়াইটা তলোয়ার নিয়েই হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, তাতে জোয়ান মর্দকে হারিয়ে ছেলেটি ঘোড়ায় চড়ে পালিয়ে গেছে। এই দেখুন, দুজনের লড়াই-এর ঘোরাফেরার দাগ। ওই দেখুন একটা পাগড়ির টুকরো। তলোয়ারের কোপে কাটা হয়ে মাটিতে পড়েছে। তারপর ওখানে দেখুন হালকা ছেলেমানুষের পায়ের দাগ ঘোড়ার খুরের দাগে গিয়ে মিলেছে। তারপর ঘোড়া ছুটিয়েই সে পালিয়ে গেছে। এই দেখুন তার পেছনে ভারী নাগরার। দাগ। সে দাগ এইখানে এসে থেমেছে, তারপর আবার ফিরে গিয়ে আর-এক ঘোড়ার খুরের দাগের সঙ্গে মিশেছে। জোয়ান মর্দটা ছেলেমানুষটিকেই ঘোড়ায় চড়ে এবার অনুসরণ করেছে বোঝা যাচ্ছে।

ফিরোজা! নিশ্চয় আমার ফিরোজা! চিৎকার করে উঠেছেন সিদ্দি ফুলাদ।

ফিরোজা! কে ফিরোজা? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছে অচেনা ভূতপূর্ব শিলাদার।

ফিরোজা আমার মেয়ে! আমার একমাত্র মেয়ে! আর্তকণ্ঠে বলেছেন ফুলাদ সাহেব, তোমার কথা যদি সত্য হয় তাহলে এখনও সে বেঁচে আছে। তবে যে-দস্যুরা। আমাদের কাফিলায় হানা দিয়েছিল তাদেরই কেউ এখনও তাকে অনুসরণ করছে। নিশ্চয়। আমার মেয়েকে যদি উদ্ধার করতে পারো তাহলে

তাহলে দেবার মতো আপনার এমন কিছুই নেই যার লোভ দেখাতে পারেন। শিলান্দার হেসে বলেছে, সুতরাং ও সব আশা দিয়ে আপনার মেয়ের একটু বর্ণনা দিন।

বেশ একটু ক্ষুব্ধ হলেও সিদ্দি ফুলাদ তা-ই দিয়েছেন।

শিলাদার তা শুনে একটু চিন্তিতভাবে বলেছে, ব্যাপারটা খুব সহজ মনে হচ্ছে।। বোঝা যাচ্ছে এই ডাকুর দলের কেউ-ই আপনার মেয়ের পেছনে লেগে আছে। তাকে এড়াতে গিয়ে আবার সে-দলের কবলে যদি আপনার মেয়ে পড়ে তাহলে তাদের হদিস পেলেও গায়ের জোরে লড়াই করে আপনার মেয়েকে উদ্ধার করা যাবে। না। কারণ আপনার অনুচর তো মাত্র এই ক-টি, আর সঙ্গে আছি মাত্র আমি। সুতরাং উদ্ধার করতে বাহুবলের সঙ্গে বুদ্ধিও খাটাতে হবে।

শিলাদার লোকটি তারপর ঘোড়া ছুটিয়ে একাই মরুপ্রান্তরের ওপর দিয়ে দিগন্ত ছাড়িয়ে চলে গেছে।

সিদ্দি ফুলাদ আর তাঁর অনুচরেরা তার সঙ্গে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাতে ফল খারাপ হতে পারে বলে সে বারণ করেছে।

৭.

শিলাদারের কথা তখন মেনে নিলেও নিজেদের কাফিলার দিকে ফিরতে ফিরতে সিদ্দি ফুলাদ-এর মনে সন্দেহ জেগেছিল।

ওই একটা অজানা অচেনা সওয়ার তাঁকে মিথ্যে ধাপ্পাই কি দিয়ে গেল! তার কথায়। বিশ্বাস করা কি ঠিক হয়েছে!

কিন্তু বিশ্বাস না করেই বা কী করতে পারতেন! লোকটা ডাকুদের কেউ হলে। অতি-বড় ধড়িবাজ অভিনেতা বলতে হবে। সেই সঙ্গে কিছু বিদ্যে আর রসকষও আছে। কবিতার কলি আবৃত্তি থেকেই তা বোঝা গেছে। প্রথমে তার ওপর যে সন্দেহটা হয়েছিল তা সে কথাবার্তায় ব্যবহারে দূর করে দিয়েছে। সন্দেহটা আলগা হবার পর তাকে আর মারধোর করা তো যায় না। লোকটা বালিতে তখন যে সব চিহ্ন দেখিয়ে তার অর্থ বুঝিয়েছিল, সেগুলি আজগুবি বলেও মনে হয়নি। লোকটা যদি ঠকবাজ হয় তাহলে তা মেনে নিয়ে নিজেদেরই যা খোঁজবার খুঁজতে হবে। সে সুযোগ তো সে কেড়ে নিয়ে যায়নি। কিন্তু খুঁজবেন কোথায়?

বেলা বাড়ার সঙ্গে সমস্ত মরুভূমি বিরাট তপ্ত বালির তাওয়া হয়ে ওঠে। চোখের ওপর দিকচক্রবাল তখন প্রচণ্ড তাপে যেন কাঁপতে থাকে। যেদিকে তাকাও শুধু ধূ ধূ শূন্যতা। এর মধ্যে কোথায় পাবেন তাঁর হারানো মেয়ের সন্ধান?

তিন দিনের অবিরাম ছোটাছুটিতে, অমানুষিক পরিশ্রমের ক্লান্তিতে হতাশায় সিদ্দি ফুলাদ এবার একেবারে ভেঙে পড়ে প্রায় বেহুঁশ হয়ে গেছেন মরুভূমির হলকা-লাগা জ্বরে।

সেই রাত্রেই তাঁর মেয়ে ফিরে এসেছে। এনেছে সেই শিলাদার অজানা সওয়ার। কী করে কোথা থেকে ফিরোজাকে সে উদ্ধার করেছে তা সে কিছুই বলেনি। সিদ্দি ফুলাদও তখন জানতে চাননি। প্রাণের প্রাণ মেয়েকে ফিরে পেয়েই তিনি তখন আনন্দে অধীর। মন্ত্রবলে যেন সুস্থও হয়ে উঠেছেন। সিদ্দি বংশের পরমাসুন্দরী যুবতী। মেয়ের, কে জানে, ক-দিন ক-রাত একত্র থেকে একই ঘোড়ার পিঠে অপরিচিত অনাত্মীয় একজন যুবাপুরুষের সামনে বসে জনহীন মরুপ্রান্তরের ভেতর দিয়ে আসার মতো অবিশ্বাস্য ব্যাপারে চরম ইজ্জতহানির আতঙ্কে তটস্থ হতেও ভুলে গেছেন।

সত্যি কথা বলতে গেলে নিজের অগোচরে মনের ভেতর একটা বাসনা তাঁর জেগেছিল। হলই বা সামান্য শিলাদার, তার ভবিষ্যৎ কী হবে কে বলতে পারে! কুড়িজনের সর্দারি বিস্তি থেকে দশজনের নায়ক মীর-দতে নামিয়ে দিয়েছিল বটে, তবু সরকারের দেওয়া ঘোড়া হাতিয়ার নিয়ে কম মাইনের সওয়ার-সিপাই যারা হয় সেই পাশা তো নয়, নিজের ঘোড়া আর হাতিয়ার নিয়ে যারা অনেক বেশি তঙ্খার ফৌজি হয়—সেই শিলাদার। আর মীর-দহতে নামলেও আবার একদিন দহ-হাজারিতে যে উঠবে না, কে বলতে পারে!

শিলাদারের চেহারাটাও তাঁর ভাল লেগেছে। লম্বা-চওড়া জোয়ান নয়, একটু রোগা-পাতলাই মনে হয় বরং, কিন্তু একেবারে যেন ইস্পাতের ফলা। আর মুখোনা একটু যেন আলাদা ছাঁচের। কোথায় যেন এ মুখ তিনি দেখেছেন বলেও তাঁর মনে হয়েছে। ইরানি তুরানি হাবশি ধাঁচের মুখ নয়, তা থেকে আলাদা যেখানে তাঁদের আদিবাস, সেই জাঞ্জিরায় থাকবার সময়ই রত্নগিরি না কোথায় একবার গিয়ে প্রায় হুবহু এই ছাঁচের মুখ যেন দেখেছিলেন, ঠিক স্মরণ করতে পারেননি।

সামান্য শিলাদার হয়ে সন্তুষ্ট থাকবার মানুষ যে সে নয়, লোকটার চেহারা-চরিত্র দেখেই বোঝা যায়। সিদ্দি ফুলাদ পেছনে থেকে তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করতে প্রস্তুত। ফিরোজার ভাবগতিক যদি তিনি কিছু বুঝে থাকেন তাহলে উদ্ধারকর্তার প্রতি সে বিরূপ নয় বলেই মনে হয়। না, জুটি তাদের খুব বেমানান হবে না। আর এদের দুজনকে মিলিয়ে দিতে পারলে মরুভূমির বিশ্রী ব্যাপারটা আর বিশ্রী থাকবে না। তার কালিমাই রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।

কিন্তু সব পরিকল্পনা অমনভাবে ভেস্তে যাবে তিনি ভাবতে পারেননি। চালচলন দেখে আর আবৃত্তি করা শায়েরিতে চোস্ত ফারসি আরবি জবান শুনে যা ভেবেছিলেন, আগ্রায় পৌঁছোবার পর বচনরাম নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সে ধারণা চুরমার হয়ে বুকে বড় বেজেছে।

মন থেকে তখনই বচনরামকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মেয়েকে উদ্ধার করার ঋণশোধ হিসেবে নিজে প্রথম মীর আতিশ হবার পরই বচনরামকে একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছেন। সেই কাজই বচনরামের মীর-ঈ-ইমার হবার পথে প্রথম ধাপ হয়েছে। বচনরামকে কোতল করবার হুকুম দেওয়ার সময় সিদ্দি ফুলাদ তাই শোধবোধ ওইভাবেই হয়ে গেছে বলে মনের বেয়াড়া কাঁটাটা চাপা দিতে পেরেছিলেন।

বচনরাম কিন্তু ধরা পড়েনি। ধরা পড়া দূরে থাক, শহর-কোতোয়ালের বাড়ি থেকে সে যে কোথায় গেছে তারই কোনও হদিস পাওয়া যায়নি। মহল্লার দারোগা দু-দিন তার কাটরা-ই-পর্চার বাসার কাছে ওত পেতে থেকে শেষ পর্যন্ত তার বিফলতার কথা সিদ্দি ফুলাদকে জানিয়েছে। শহর-কোতোয়ালের লাগানো হরকরারাও বচনরামের কোনও খবর আনতে পারেনি।

ইতিমধ্যে আর ক-টা এমন ব্যাপার ঘটেছে যা জানতে পারলে সিদ্দি ফুলাদ আরও। বিচলিত হতেন। কিন্তু এ খবর জেনেছেন শুধু কুমার রামসিং তার বিশ্বস্ত মুনশি গিরধরলালের কাছে। তিনি অবশ্য উচ্চবাচ্য করে এ খবর একেবারে চেপে গেছেন। কিন্তু বেশ একটু বিমূঢ়ই হয়েছেন ভেতরে ভেতরে।

৮.

খবরটা সত্যই অদ্ভুত। সকালেই মুনশিজি ফ্যাকাশে মুখে আগ্রা প্রাসাদের পূর্ব প্রাকারের ঝরোকা-ই-দর্শনের নীচে কুমার রামসিং-এর খোঁজে এসেছেন। আওরঙ্গজেব তখনও এই বারান্দায় প্রতি সকালে প্রজাদের দেখা দেওয়ার রেওয়াজ উঠিয়ে দেননি। সূর্যোদয়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে প্রতিদিন তিনি ওই ঝরোকা-ই-দর্শনে প্রজাদের দর্শন দিয়ে সেখানেই আধঘণ্টার ওপর সময় দেওয়ান-ই-আম-এ যারা ঢুকতে পায় না, সেই অতি-সাধারণ প্রজাদের আর্জিনালিশ শোনেন।

সেদিন সম্রাট তখনও ঝরোকায় এসে পৌঁছোননি। সম্রাটকে নিত্য দেখা যারা ধর্মের অনুষ্ঠান করে তুলেছে, প্রভাতে তাঁর মুখ না দেখে যারা জলগ্রহণ করে না, সেই দর্শনীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা বারান্দার নীচে যমুনা-তীরের বালুকা প্রান্তরে ঊর্ধ্বমুখ হয়ে আছে সম্রাটের আবির্ভাবের প্রতীক্ষায়। সেদিন সকালে কুমার রামসিং-এর চৌকি ছিল বলে তিনিও সম্রাটের দেখা দেওয়ার অপেক্ষায় বাইরে অনুচর সমেত তৈরি হয়ে আছেন।

মুনশি গিরধরলাল তাঁর কাছে গিয়ে প্রথমেই উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করেছেন, খারাপ খবর কিছু নেই তো?

কুমার রামসিং বেশ অবাকই হয়েছেন। গিরধরলালের হঠাৎ মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! নইলে কথা নেই বার্তা নেই, সাত-সকালে এই ঝরোকা-ই-দর্শন-এ এসে এরকম আহাম্মকের মতো প্রশ্ন করার মানে কী?

খারাপ খবর থাকবে কেন? কীসের খারাপ খবর? গিরধরলালের ফ্যাকাশে মুখ আর ভীত দৃষ্টি লক্ষ করে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন।

এবার মুনশিজি একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে মুনিবকে সেই অদ্ভুত ঘটনাটা সবিস্তারে জানিয়েছেন। গত রাত্রে ফৌজদার আলি কুলীর সঙ্গে একটা মুশায়েরা থেকে ফিরছিলেন। তখনকার আগ্রা কেন, কোনও শহরেই রাস্তায় আলো দেবার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। নেহাত প্রাসাদের তোরণে, দু-একটা সরকারি দোকানে আর কোতোয়ালি চবুতরায় রাত্রে আলো জ্বলত। এ বাদে কোথাও সিপাইদের ঘাঁটিতে বা কোথাও আমির-ওমরাহ-এর বাড়িতে তেলের আলো বা মশাল জ্বালা হত। আলি কুলীর সঙ্গে গল্প করে ফিরতে ফিরতে খাস বাজারের পাশে একেবারে কোতোয়ালি চবুতরার কাছেই সেখানকার আলোয় একজনকে দেখে মুনশিজি একেবারে থ হয়ে যান। ফৌজদার আলি কুলীও তাকে দেখেছে। কিন্তু সে তো চেনে না! সে গিরধরলালের যেন ভূত দেখার মতো থমকে থামা দেখেই অবাক হয়ে যায়।

ভূত দেখলে নাকি, মুনশিজি! আলি কুলী ঠাট্টার সুর দিতে গিয়েও একটু বিস্মিত কণ্ঠেই জিজ্ঞাসা করেছে।

না, ও কিছু নয়!

ব্যাপারটা হালকা করে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মুনশিজি আবার হাঁটতে শুরু করেছেন।

লোকটাও মুনশিজিকে দেখে একটু যেন থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। চবুতরায় জ্বলা বাতির আলোয় তখন তাকে ভালভাবেই দেখা গেছে। তারপর হন হন করে হেঁটে সে আলোর পরিধি ছাড়িয়ে আবার দূরের অন্ধকারে মিলিয়ে গেছে। গিরধরলাল তখনই একটা কিছু করতে পারতেন। কিন্তু ব্যাপারটা এমন অবিশ্বাস্য যে, নিজের চোখের ভুল মনে করে মিছে কেলেঙ্কারির ভয়ে কাউকে কিছু আর জানাতে সাহস করেননি। আলি কুলীর কাছে এক জায়গায় বিদায় নিয়ে সেই রাত্রেই অন্ধকার শহরের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে কুমার রামসিং-এর বাড়িই গেছেন তাঁকে ব্যাপারটা জানাতে।

কিন্তু সেখানে মীর আতিশ শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদ-এর রক্ষীদল তোপ বন্দুক নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। সিদ্দি ফুলাদ নিজে উপস্থিত থাকলে হয়তো ভেতরে যাবার অনুমতি পেতেন, কিন্তু শহর-কোতোয়ালের অধীন থানাদার তা দেয়নি।

বিফল হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়েছে গিরধরলালকে। সারারাত তারপর ঘুমোতে পারেননি। সেদিন সকালে কেল্লার বাইরে তাঁর প্রভু কুমার রামসিং-এর চৌকি জেনে ভোর না হতেই সেখানে ছুটে এসেছেন তাঁর কাছে।

মুনশিজির মুখে সব শুনে কুমার রামসিং-ও এ ব্যাপারে তাজ্জব বনে গেছেন। তিনিই এবার বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন মুনশিজিকে, আপনি শিবাজি ভোঁসলেকেই দেখেছেন বলছেন! দেখার ভুল হয়নি তো?

তা হতে পারে কুমার সাহেব! মুনশিজি দিশাহারাভাবে বলেছেন, কিন্তু আমি স্পষ্ট শিবাজি ভোঁসলেকেই দেখেছি। ও মুখ তো আমার মনে ছাপা। একটা গোটা দিন তাঁর সঙ্গে কাটিয়ে তাঁকে আগ্রা নিয়ে এসেছি এই আমিই। তাই ভয় পেয়ে কাল রাত্রেই আপনার কাছে ছুটে গেছলাম। দেখা করতে না পেরে আজ ভোরেই আবার এসেছি। আপনি তো চৌকিতে আসবার আগেই শিবাজির শিবির হয়ে এসেছেন!

তা এসেছি! চিন্তিতভাবে বলেছেন কুমার, নিজের চোখে দেখেও এসেছি তাঁকে। উনি কিছুদিন ধরে অসুখের মানত হিসেবে রোজ ভারে ভারে মিঠাই-মণ্ডা, ফলমূল নানা মন্দিরে আর ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত, সাধু-সন্ন্যাসীকে পাঠাচ্ছেন, জানো তো! অসুখ সত্ত্বেও ভোরে উঠে পূজা-পাঠ সেরে তারই ব্যবস্থা করেন। কাল রাত্রের ব্যাপারটার কোনও মানে পাচ্ছি না, কিন্তু আজ ভোরে স্বচক্ষে তাঁকে দেখে এসেছি।

সেদিন চৌকি সেরে অত্যন্ত দুর্ভাবনা মাথায় নিয়ে কুমার বাড়ি ফিরেছেন। যত আজগুবিই মনে হোক, সাবধানের বিনাশ নেই বলে কুমার তাঁর নিজের অনুচরদের পাহারা আরও কড়া করেছেন। দণ্ডে দণ্ডে তারা শিবাজির খবর নেবে। রাত্রে পর্যন্ত ঘুরে আসবে তাঁর শোবার ঘর।

পরামর্শ করবার জন্যে শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদকে বিশ্বাস করে ব্যাপারটা জানাবার কথা একবার ভেবেছেন। কিন্তু তার সুবিধে হয়নি। ফুলাদ সাহেব দু-দিন ধরে নাকি কোতোয়ালিতে আসছেন না। শিবাজির শিবির পাহারা দেবার অমন গুরু দায়িত্বও তাঁর অধীন থানাদারের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। হয়তো হঠাৎ অসুস্থই হয়েছেন কোতোয়ালের সাহেব—ভেবেছেন কুমার রামসিং।

সিদ্দি ফুলাদ-এর অসুখ কিন্তু হয়নি। হয়েছে তার চেয়ে অনেক দারুণ কিছু। তাঁর পাগল হতে আর বাকি নেই। সেই অবস্থাই তাঁর হয়েছে, যা হয়েছিল রাজপুতানার মরুতে প্রথম আগ্রা আসবার পথে মরুর ঝড় আর দস্যুদের হানার পর।

তখনকার মতোই তাঁর নয়নের মণি ফিরোজাকে হঠাৎ আর পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ কে যেন অন্দরমহলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ও পাহারা তুচ্ছ করে তাকে হাওয়ার মতো অদৃশ্য করে নিয়ে চলে গেছে।

সেবারে এই বিপদে দেবদূতের মতো দেখা দিয়ে কন্যাকে যে উদ্ধার করে এনেছিল সেই বচনরাম নিজেও নিরুদ্দেশ।

পারিবারিক এ চরম লজ্জাকর ব্যাপারের কথা কাউকে জানাবারও নয়। সিদ্দি ফুলাদ সমস্ত কাজকর্ম ছেড়ে একাই সারা শহর খুঁজে বেড়িয়েছেন দিনরাত্রি। কিন্তু বৃথাই।

৯.

এরই মধ্যে এসেছে ষোলোশো ছেষট্টি সালের উনিশে আগস্ট তারিখ!

আগ্রা আর সেই সঙ্গে মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তি যা টলিয়ে দিয়েছিল ওই তারিখে, আগ্রার কেউ কিন্তু তার কোনও আভাস পায়নি।

শিবাজি একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ে শয্যাগত হয়েছেন এই কথাই সকলে জেনেছে। প্রহরীরা তাঁকে বিছানায় শায়িত অবস্থায় দেখেও গেছে। গায়ে লেপ ঢাকা। তার ভেতর দিয়ে শিবাজির বিশেষ সোনার কঙ্কণ পরা হাতটা দেখলেই চেনা যায়।

সন্ধ্যার সময় যথারীতি মিষ্টান্নের ভারাগুলি বাহকেরা বয়ে নিয়ে গেছে বাইরে। গোড়ায় গোড়ায় নিত্য পরীক্ষা করে দেখলেও রক্ষীরা এখন আর তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারা মিষ্টান্নের ভারীদের বাধা দেয়নি।

শিবাজির ঘরে রাত্রেও কুমার রামসিং-এর অনুচরেরা এসে তদারক করে গেছে। শিবাজির সোনার কঙ্কণ পরা সেই হাত দেখেই তারা আশ্বস্ত হয়েছে। তারা দেখেছে। একজন চাকর শয্যাপ্রান্তে বসে শিবাজির পদসেবা করছে। পরের দিন সকালে আটটা নাগাদ শিবাজির সৎভাই চাকরটিকে নিয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে গেছেন। যাবার সময় সকলকে সাবধান করে গেছেন, অসুস্থ শিবাজিকে যেন বিরক্ত না করা হয়। .

কেউ তা করেনি। কিন্তু ক্রমশ প্রহরীরা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে শিবাজির শিবির, অস্বাভাবিক রকম শান্ত দেখে। শিবাজির দর্শনার্থীদের কোনও ভিড়ই না থাকাটা বেশ সন্দেহজনক।

শিবাজি যে তাঁর ছেলে শম্ভজিকে নিয়ে পালিয়েছেন তা ধরা পড়েছে সকাল দশটা নাগাদ। হুলস্থুল পড়ে গেছে শহরে সম্রাটের দরবারে। যেমন করে তোক শিবাজিকে ধরতেই হবে আবার।

কিন্তু ধরবে কোথায়? মালোয়া খাণ্ডেশের ভেতর দিয়েই নিজের রাজ্যে পালাবার চেষ্টা করা শিবাজির পক্ষে স্বাভাবিক। সে দিকেই অনুসরণ করবার দ্রুত ব্যবস্থা যখন হচ্ছে তখনই মথুরায় হঠাৎ শিবাজিকে তাঁর ছেলে সমেত দেখতে পাওয়ার খবরে সব. গোলমাল হয়ে গেছে।

মালোয়ার দিকে অনুসরণ তাতে একটু হয়তো বিলম্বিত হয়ে থাকবে। উত্তর দক্ষিণ এবং তারপর পূর্বদিকে কিন্তু অক্লান্তভাবে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। মাঝে মাঝে শিবাজির যা খবর এসেছে তা কিন্তু পূর্বদিক থেকেই, কখনও ইলাহাবাদে কখনও বারাণসীধামে কখনও গয়ায়, এমনকী এদিকে পুরী আর ওদিকে গোদাবরী তীরের গ্রামে পর্যন্ত শিবাজিকে দেখেছে বলে অনেকে দাবি করে পাঠিয়েছে।

শিবাজির সঙ্গে একটি বালককেও দেখা গেছে। সে বালক শম্ভুজি ছাড়া আর কে হতে পারে। বালকটিও সামান্য নয়। এক জায়গায় ঘোড়া কেনবার ব্যাপারে বচসা হওয়ায় নগররক্ষীরা এসেছে শিবাজি আর ছেলেটিকে গ্রেফতার করতে। শিবাজি শুধু নয়, সেই ছেলেটিও হঠাৎ তলোয়ার খুলে দাঁড়িয়েছে। রক্ষীরা সংখ্যায় অনেক বশি। কিন্তু অসি-যুদ্ধে তাদের শুধু প্রাণটুকু রেখে দিয়ে নাকালের একশেষ করে শিবাজি আর ছেলেটি নিজেদের মুক্ত করে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে।

এসব কাহিনী আগ্রায় পৌঁছে আওরঙ্গজেবকে যদি দিশাহারা করে থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। এদিকে দক্ষিণ থেকে যখন গুপ্তচরের খবর আসছে যে শিবাজি তাঁর রাজধানীতে পৌঁছে গেছেন, তখনও বিশ্বস্ত হরকরা মারফত পুব দিক থেকেও শিবাজির সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে।

সত্যি তাহলে কোনটা?

আওরঙ্গজেব তা নির্ধারণ করতে পারেননি। সঠিকভাবে ঐতিহাসিকরাও পারেননি জয়পুরের দপ্তরখানায় পুরনো ডিঙ্গল পত্রগুলি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত। এ চিঠিগুলি অমূল্য। কুমার রামসিং-এর সভাসদেরা প্রতিদিনের একেবারে টাটকা খবর, এমনকী কথাবার্তার বিবরণ পর্যন্ত রাজস্থানের কথ্য ডিঙ্গল ভাষায় লিখে পাঠিয়েছে। রাত্রের লেখা চিঠি পরের দিন সকালেই চলে গেছে উটের ডাকে।

এসব চিঠি থেকে শিবাজি যে আগ্রা থেকে রাজগড়ের সরলরেখার দূরত্ব ছ-শো সত্তর মাইল দিনে অন্তত চল্লিশ মাইল ঘোড়া চালিয়ে মোট পঁচিশ দিনে পার হয়েছিলেন তা নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শিবাজির মতো অসামান্য বীরের পক্ষে কাজটা অসাধ্যও নয়। তাঁর বয়স তখনও চল্লিশ হয়নি।

শিবাজির আগ্রা থেকে পালাবার সঠিক রাস্তা জানবার পর প্রশ্ন থেকে যায়, মথুরা ইলাহাবাদ বারাণসী ইত্যাদি জায়গায় তাহলে শিবাজির মতো কাকে দেখা গেছে। তার সঙ্গে বালকটিই বা কে!

সুরাটের ব্রাহ্মণ চিকিৎসক নাভাকে সত্যিকার ওই ধনরত্ন তাহলে কে দিয়েছিলেন? স্বয়ং শিবাজি রাজগড় থেকে গোদাবরী তীরের গ্রামের সেই কৃষক-জননীকে সত্যিই ডেকে পাঠিয়ে তার অভিযোগের প্রতিকার করেছিলেন কেন?

দাসমশাই থামলেন।

মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু বলে উঠলেন, তার মানে আপনি বলতে চান, ওই আপনার পূর্বপুরুষ বচনরামই শিবাজি সেজে উত্তর আর পুব দিকে গিয়ে মোগলদের ধোঁকা দিয়েছিলেন।

না, ঘনশ্যাম দাস অনুকম্পাভরে বললেন, তবে কৃষ্ণাজি অনন্ত সভাসদের শিব-ছত্রপতি-চেন চরিত্র-এর মতো আর-একটি যে অমূল্য মারাঠি বখর হারিয়ে গেছে তা খুঁজে পাওয়া গেলে এই বিবরণই পাওয়া যাবে।

সে বিবরণ কে লিখে গেছলেন? সেই বচনরাম? শ্রদ্ধাবিগলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন শিরোশোভা যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু।

হ্যাঁ, তিনিই লিখে গেছলেন—শিবাজির সঙ্গে তাঁর চেহারায় মিলের কথা জানতে পারার পর কীভাবে ওই ফন্দি এঁটে তিনি কাজে লাগান। শহর-কোতোয়াল সিদ্দি ফুলাদও এই মিলটাই লক্ষ করেছিলেন, শুধু মিলটা কার সঙ্গে তা স্মরণ করতে পারেননি তখন!

ঘনশ্যাম দাস ওঠবার উপক্রম করলেন।

কিন্তু ওই ফিরোজাবিবি! ব্যাকুলভাবে বলে উঠলেন মেদভারে হস্তীর মতো যাঁর বিপুল দেহ সেই ভবতারণবাবু, তার কী হলো তা কি জানা গেছে? সে কি ফিরেছে তার বাবার কাছে?

ফেরেনি বলেই তো জানি!—একটু রহস্যময় হাসি যেন ফুটে উঠল ঘনশ্যাম দাসের মুখে, সে মুখে হাসি ফোটা যদি সম্ভব হয়—কে জানে, নকল শিবাজির সঙ্গে যাকে বালকঘেশে দেখা গেছে সে কে?

Pages: 1 2
Pages ( 1 of 2 ): 1 2পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *