Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায় || Sunil Gangopadhyay » Page 2

সন্তু কোথায়, কাকাবাবু কোথায় || Sunil Gangopadhyay

রামা রাও এর মধ্যে টেবিলের সবকটা ড্রয়ার খুলে, বিছানা উলটে খাটের তলায় উঁকি মেরে দেখে নিয়েছে। কাকাবাবুর সুটকেস ঘাঁটাঘাঁটি করে আর কিছু না পেয়ে একটা গোল করে পাকানো শক্ত কাগজ তুলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

কাকাবাবু বললেন, খুলে দেখলেই বোঝা যাবে, ওটা একটা ম্যাপ।

রঙ্গরাজ বলল, কোথাকার ম্যাপ?

কাকাবাবু বললেন, যে সমস্ত জায়গায় আমার স্মাগলিং ডেন আছে, সেইসব জায়গা ম্যাপে এঁকে রেখেছি।

রঙ্গরাজ বলল, এটা আমাদের সঙ্গে নিতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, নিতে চান নিতে পারেন, বেশি ভাঁজ করবেন না।

রামা রাও একেবারে তাঁর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে দেখে বললেন, কী ব্যাপার, হাতকড়া পরাবেন নাকি?

রামা রাও বাঁকা সুরে বলল, দরকার হলে তাও পরাতে হবে।

কাকাবাবু বললেন, উঁহু, তা চলবে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ আছে, প্রকাশ্যে কাউকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তাতে মানহানির মামলা হতে পারে।

শুনুন, আপনারা ডিউটি করতে এসেছেন, ওপরওয়ালার নির্দেশে আমাকে থানায় নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আমি আপত্তি করছি না। কিন্তু ডিউটির বাইরে গিয়ে কিছু করবেন না প্লিজ। আমার গায়ে হাত দেওয়া কিংবা ধাক্কাধাক্কি করার কোনও প্রয়োজন নেই। আগে থেকেই সাবধান করে দেওয়া ভাল, নইলে পরে আপনাদেরই এর ফল ভোগ করতে হবে।

রামা রাও বলল, যাঃ বাবা, এ যে আমাদেরই ধমকাচ্ছে দেখছি।

কাকাবাবু হাত বাড়িয়ে আদেশের সুরে বললেন, দেখি আমার কাচ দুটো।

রামা রাওয়ের দেওয়ার ইচ্ছে নেই, কিন্তু রঙ্গরাজ চোখের ইঙ্গিতে দিয়ে দিতে বলল।

কাকাবাবু ঘরের বাইরে এসে দরজায় চাবি দিলেন।

লিফটে করে নীচে নেমে কাউন্টারে চাবি জমা দিয়ে মণিকাকে বললেন, মিঃ ভার্গব নামে এক ভদ্রলোক আমার খোঁজ করতে পারেন। তাঁকে বলবে, আমি পরে যোগাযোগ করব।

পুলিশের জিপ অপেক্ষা করছে বাইরে।

রামা রাও কাকাবাবুর পাশে বসে মনের আনন্দে চুরুট টানতে লাগল।

কাকাবাবু বিরক্তিতে নাক কুঁচকে রইলেন, কিন্তু বুঝলেন যে আপত্তি জানিয়ে লাভ নেই।

ডক এলাকার থানাটি বেশ বড়। পুরনো আমলের বাড়ি, সামনের দিকে মোটা-মোটা থাম। শ্বেতপাথরে বাঁধানো দশ-বারোটা সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতরে যেতে হয়।

পুলিশ দুজন কাকাবাবুকে একটা ঘরে নিয়ে এল, সেখানে থানার বড়বাবু বসে আছেন, তাঁর টেবিলের সামনে অনেক মানুষের ভিড়, তিন-চারজন একসঙ্গে কথা বলছে।

কয়েকজনকে সরিয়ে কাকাবাবুকে টেবিলের সামনে দাঁড় করানো হল।

রামা রাও বলল, সার, এই সেই স্মাগলিং-এর কেস। রাজা রায়চৌধুরীকে অ্যারেস্ট করে এনেছি।

বড়বাবু মুখ তুলে তাকালেন। ভাল করে দেখলেনও না কাকাবাবুকে, বললেন, গারদে ভরে দাও!

কাকাবাবু বললেন, দাঁড়ান, আমার কিছু বলবার আছে। আমাকে মিথ্যে অভিযোগে ধরা হয়েছে। আমার পরিচয়টা একবার শুনুন।

বড়বাবু একটা কী কাগজ পড়তে-পড়তে বললেন, বিকেলে, বিকেলে, এখন আমি ব্যস্ত আছি।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে আদালতে পাঠাবেন তো। আমি জামিন চাইব। আমার একজন উকিল দরকার।

বড়বাবু আবার বললেন, বিকেলে, বিকেলে।

কাকাবাবু খানিকটা উত্তেজিতভাবে বললেন, বিকেলে মানে? আজ সকালেই আমাকে কোর্টে পাঠানো উচিত।

বড়বাবু এবার মুখ তুললেন। কাকাবাবুকে গ্রাহ্যই করলেন না। পেছনে দাঁড়ানো রামা রাওকে ধমক দিয়ে বললেন, এখানে দাঁড়িয়ে মজা দেখছ নাকি? বললাম না, আসামিকে গারদে ভরে দাও! শুধু-শুধু সময় নষ্ট!

অন্য লোকরা আবার কথা বলতে শুরু করে দিল। রামা রাও কাকাবাবুর বাহু চেপে ধরে বলল, চলো!

এবার কাকাবাবুকে আনা হল আর-একটি ঘরে। এ-ঘরে ভিড় নেই, বড় টেবিলের ওপাশে একজন লোক বসে আছে, সামনে একটা লম্বা খাতা।

রামা রাও বলল, তোমার সঙ্গে যা আছে, এখানে জমা দাও। খালাস হলে আবার ফেরত পাবে।

কাকাবাবু পকেট থেকে টাকাপয়সা, রুমাল, সুটকেসের চাবি ইত্যাদি বার করে টেবিলে রাখলেন। রঙ্গরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার রিভলভারটার কথাও খাতায় লিখিয়ে দিন।

রঙ্গরাজ বলল, তা দিচ্ছি। আপনার ক্রাচ দুটোও এখানে রাখুন।

কাকাবাবু বললেন, ক্রাচ ছাড়া আমি হাঁটতে পারি না। এ দুটো আমার সঙ্গে থাকবে?

রঙ্গরাজ বলল, ও দুটো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। ওধরনের কোনও জিনিস জেলের মধ্যে নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমি হাঁটব কী করে?

রামা রাও বলল, বাঁদরের মতন লাফিয়ে লাফিয়ে!

এর পর সে কাকাবাবুর ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে বলল, এবার ভেতরে চলো।

কাকাবাবু কঠিন মুখ করে বললেন, ধাক্কা দিতে বারণ করেছি না? আমি এমনিই যাচ্ছি।

রামা রাও কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বলল, বড়বাবু কী বললেন, শোনোনি? এখন তুমি আসামি!

কাকাবাবু বললেন, আসামি মানে কী? অপরাধী? সেটা এখনও প্রমাণিত হয়নি। আমি অপরাধী কি না তা ঠিক করবেন আদালতের বিচারক। পুলিশের বিচার করার অধিকার নেই। এখন সকাল নটা বাজে, আমাকে আজই কোর্টে পাঠানো উচিত ছিল।

রামা রাও একটা খুব খারাপ গালাগালি দিয়ে বলল, তুমি বড্ড বকবক করো।

একটা মস্ত লোহার গেট খুলে তার মধ্যে কাকাবাবুকে ঠেলে দিল সে।

জেলখানা কিংবা থানার গারদের ভেতরটা কেমন হয়, তা কাকাবাবু আগে কখনও দেখেননি। তাঁর ধারণা ছিল, এক-একজনের জন্য এক-একটা খুপরি-খুপরি অন্ধকার ঘর থাকে।

এখানে কিন্তু তা নয়। একটাই বেশ লম্বা ঘর, তার মধ্যে দশ বারোজন লোক কেউ দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে, কেউ মাটিতে গড়াগড়ি। দিচ্ছে।

ঘরটা অসম্ভব নোংরা। দেওয়ালে থুতু, পানের পিকের দাগ, একটা দিক জলে ভাসছে, তার মধ্যে ফরফর করছে আরশোলা। সব মিলিয়ে একটা বিকট গন্ধ।

রামা রাওয়ের ধাক্কা খেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে গিয়েও কাকাবাবু দেওয়াল ধরে সামলালেন কোনওরকমে।

পেছনে লোহার গেটটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। অসম্ভব রাগে কাকাবাবুর সারা গা থেকে যেন গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। এরকম একটা বিশ্রী অবস্থার মধ্যে তিনি জীবনে কখনও পড়েননি।

থানার বড়বাবু লোকটা এমনই অভদ্র যে, একটা কথাও শুনল না। যাকে তাকে ধরে আনলেই গারদে পোরা যায়?

যে ব্যক্তি কোনও দোষ করেনি, তাকেও এইরকম একটা নোংরা ঘরে থাকতে হবে? প্রত্যেক লোকেরই উকিলের সাহায্য নেওয়ার অধিকার আছে। এরা তাঁকে কোনও সুযোগই দিল না!

দুর্জন-দুশমনদের পাল্লায় পড়ে কাকাবাবুকে এর চেয়ে অনেক খারাপ জায়গায় থাকতে হয়েছে। মৃত্যুর মুখে পড়েছেন কতবার। তখনও এত রাগ হয়নি, কারণ সেইসব লোকেরা ছিল শত্রুপক্ষ।

কিন্তু সরকারি পুলিশের কাছ থেকে সামান্য ভদ্রতাটুকুও আশা করা যাবে?

অন্য কয়েদিদের দিকে কাকাবাবু তাকিয়ে দেখলেন। কেউ লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা, কারও গায়ে চিটচিটে ময়লা জামা, একজন ঘ্যাস-ঘ্যাস করে দাদ চুলকোচ্ছে। দেখলে মনে হয়, সবাই ছোটখাটো চোর বা পকেটমার, একজনের কাঁধে রক্ত-ভেজা ব্যাণ্ডেজ।

কয়েকজন কাকাবাবুকে ঢুকতে দেখে হা-হা করে হেসে তামিল আর তেলুগু ভাষায় কী যেন বলে উঠল, কাকাবাবু কিছুই বুঝতে পারলেন না।

তাঁর সারা মুখ ঘামে ভিজে গেছে। রাগে, অপমানে ছটফট করছেন। হঠাৎ তিনি চোখ বুজে ফেললেন।

তিনি মনে-মনে নিজেকেই বললেন, এত রাগ ভাল নয়। বেশি রাগলে নিজেরই ক্ষতি হবে। এই কারাগার ভেঙে এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়া যাবে না কিছুতেই। অপেক্ষা করতে হবে। দেখা যাক, শেষপর্যন্ত কী হয়।

নরেন্দ্র ভামও কোনও সাহায্য করতে পারল না। সে কি শেষপর্যন্ত ভাবল, আমি তার সঙ্গে রসিকতা করছি?

খুব বড় একটা নিশ্বাস ফেলে বুকটা হালকা করলেন কাকাবাবু। মেজাজ শান্ত করার জন্য গান সবচেয়ে ভাল ওষুধ।

এই পরিবেশটার কথা ভুলে যেতে হবে। মনে করতে হবে, এখানে কাছাকাছি আর কেউ নেই।

দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়লেন তিনি। চক্ষুদুটি বোজাই রইল। গুগুন্ করে শুরু করলেন তাঁর প্রিয় গান। সুকুমার রায়ের লেখা, তাঁর নিজের

সুর :

শুনেছো কী বলে গেল, সীতানাথ বন্দ্যো
আকাশের গায়ে নাকি টক টক গন্ধ?
টক টক থাকে নাকো হলে পরে বৃষ্টি
তখন দেখেছি চেটে, একেবারে মিষ্টি!

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে তিনি এই গানটাই গাইতে লাগলেন অনেকবার। আশেপাশে কে কী বলছে, তিনি কিছুই শুনছেন না। গাইতে-গাইতে এক সময় তাঁর ঘুম এসে গেল। রাগ কমাবার পক্ষে ঘুমও খুব ভাল জিনিস। তাঁর অনেকটা ইচ্ছে-ঘুম। ইচ্ছে করলে তিনি সারা দিন-রাত ঘুমোতে পারেন, আবার দরকার হলে একেবারে না ঘুমিয়ে কাটাতে পারেন। এক-দুদিন।

ঘুমোচ্ছেন, মাঝে-মাঝে একটু জাগছেন, আবার ঘুমোচ্ছেন।

এইভাবে সারা দুপুর, বিকেল পেরিয়ে গেল।

এক সময় তাঁর কাঁধ ধরে কে যেন ঝাঁকাল। আর তিনি শুনতে পেলেন, বাংলায় কে যেন বলছে, বন্দি, জেগে আছ? বন্দি, জেগে আছ?

প্রথমে কাকাবাবু ভাবলেন, তিনি স্বপ্ন দেখছেন। এখানে কে বাংলায় কথা বলবে?

তারপর চোখ মেলে দেখলেন, একজন কয়েদি তাঁকে ধাক্কাচ্ছে।

সে আঙুল তুলে লোহার গেটটার দিকে দেখিয়ে দিল।

সেই গেটের ওপাশে পাক্কা সাহেবদের মতন সুট-টাই ও মাথায় টুপি পরে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছিপছিপে লম্বা লোক।

সে বলল, কী গো বন্দি, ঘুম ভাঙল!

খুশিতে কাকাবাবুর সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল। এ যে তাঁর বন্ধু নরেন্দ্র ভার্মা!

কাকাবাবু উঠে এসে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, নরেন্দ্র, তুমি এত তাড়াতাড়ি কী করে দিল্লি থেকে চলে এলে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমার জন্য কি কম ঝঞ্ঝাট করতে হয়েছে! সঙ্গে-সঙ্গে প্লেনের টিকিট পাওয়া যায় নাকি? শেষ পর্যন্ত পাইলটের পাশে বসে চলে এলাম। এখানে পৌঁছেছি ঠিক দু ঘণ্টা আগে। এর মধ্যে অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হয়েছে।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে এই নরকের মতন জায়গাটায় আর কতক্ষণ থাকতে হবে?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, রাজা রায়চৌধুরীকে জেলে আটকে রাখে, এমন কারও সাধ্য আছে!

একজন সেপাই গটগট করে এসে লোহার গেটের তালা খুলে দিল এবং কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা সেলাম দিল।

অন্য কয়েদিরা চ্যাঁচামেচি করে কী যেন বলে উঠল। বোঝা গেল। বোধ হয় একজন এত তাড়াতাড়ি ছাড়া পাওয়ায় তারা আপত্তি জানাচ্ছে।

কাকাবাবু গেটের বাইরে পা দিয়ে বললেন, এসব তোমরা কী শুরু করেছ? আমার এতখানি সময় নষ্ট হল। বিনা অপরাধে তোমরা যাকে খুশি গারদে ভরে দেবে?

নরেন্দ্র ভামা হকচকিয়ে বললেন, আরে, আমাকে বকছ কেন? আমি তোমায় গারদে ভরেছি নাকি?

কাকাবাবু বললেন, তোমরা পুলিশরা কি যা খুশি করতে পারো নাকি? এ দেশটা কি হিটলারের জার্মানি হয়ে গেল?

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমি কি পুলিশ নাকি? সি বি আই-এর লোকদের ঠিক পুলিশ বলা যায় না। আমরা কেন্দ্রীয় তদন্তকারি। পুলিশের মধ্যে তো নানা ধরনের লোক থাকে, মাঝে-মাঝে দু-একটা ভুল হয়ে যায়।

কাকাবাবু বললেন, এই থানার বড়বাবু কোথায়? তার সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, সে বেচারি সব জানবার পর ভয়ে আর লজ্জায় একেবারে কাঁচুমাচু হয়ে আছে। প্রথমেই তোমার সামনে আসতে চায়নি। চলো, তার কাছে যাই।

কাকাবাবু বললেন, আগে আমার জিনিসপত্র আদায় করো। ক্রাচ দুটো দাও। রিভলভারটা দাও!

বড়বাবু সেই আগের ঘরটাতেই বসে আছেন, এখন সে-ঘরটা একেবারে ফাঁকা।

কাকাবাবুকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করে বললেন, আসুন, সার, বসুন সার, মাপ করে দেবেন সার। আমার লোকজন ঠিক বুঝতে পারেনি।

কাকাবাবু কড়া গলায় বললেন, আমি আপনার কাছে নিজের পরিচয় দিতে চেয়েছিলাম, আপনি শুনলেনই না।

বড়বাবু বললেন, ভুল হয়ে গেছে, সার। সকাল থেকেই এত লোকজন, এত কাজের চাপ, মাথার ঠিক রাখতে পারি না।

কাকাবাবু বললেন, হোটেল থেকে কাউকে অ্যারেস্ট করে আনা কি তুচ্ছ ব্যাপার? যতই কাজ থাক, আপনি তার একটা কথাও শুনবেন না?

বড়বাবু বললেন, বললাম তো সার, ভুল হয়ে গেছে। ক্ষমা করে দিন?

একজন কেউ বারবার ক্ষমা চাইলে তার ওপর আর তর্জন-গর্জন করা যায় না।

এবার কাকাবাবু নিজেকে অনেকটা সংযত করে বললেন, আমি রাজা রায়চৌধুরী হিসেবে বিশেষ কোনও সুবিধে চাইছি না। যে-কোনও লোক যদি বাইরে থেকে এখানে বেড়াতে আসে, হুট করে তাকে হোটেল থেকে এনে গারদে পোরা যায়? আমাকে স্মাগলার বলে সন্দেহ করলে আমার ওপর পুলিশ কয়েকদিন নজর রাখতে পারত, হাতেনাতে ধরে কিছু প্রমাণ পেলে তবেই অ্যারেস্ট করা উচিত ছিল। মনে করুন, কোনও একটা লোকের পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেল, যাতে লেখা আছে যে, এই থানার ও. সি. এক লক্ষ টাকা ঘুষ খেয়েছে কিংবা একটা মানুষ খুন করেছে। সেই চিঠি পেয়েই আপনাকে ধরে গারদে পুরে দেবে কেউ? সত্যি-মিথ্যে যাচাই করবে না?

বড়বাবু বললেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত। তবে ব্যাপার কী জানেন সার, যে স্মাগলারটা ধরা পড়েছে, তাকে জেরা করার পর এমনভাবে বলতে লাগল যে কবে, কোথায়, কতবার আপনার কাছে জিনিস পাচার করেছে যে, শুনলে মনে হবে সে সত্যি বলছে। অবশ্য তার মুখের কথা বিশ্বাস করা আমাদের উচিত হয়নি।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, সেই লোকটি কোথায়? তার সঙ্গে আমরা করতে চাই।

বড়বাবু বললেন, সে লোকটির নাম হরেন মণ্ডল। তার পায়ে গুলি লেগেছে। তাকে হাসপাতালে রাখা হয়েছে, দুজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে সেখানে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তা হলে একবার হাসপাতালে যাওয়া যাক।

কাকাবাবু বললেন, তার আগে আর একটা কাজ বাকি আছে। এখানে। বড়বাবু, আপনার রামা রাও নামে অফিসারটিকে একবার ডাকুন। তো।

তখনই হাঁকডাক করে রামা রাও-এর খোঁজ করা হল। সে এসে বড়বাবুকে স্যালুট করে দাঁড়াল।

বড়বাবু বললেন, ওহে তোমরা ভুল লোককে ধরে নিয়ে এসেছ। এঁর কাছে। মাপ চেয়ে নাও।

রামা রাও ঠিক বুঝতে না পেরে ঘাড় গোঁজ করে দাঁড়িয়ে রইল।

কাকাবাবু বললেন, মাপ চাইবার দরকার নেই। ওর একটু ওষুধ দরকার।

তিনি উঠে গিয়ে রামা রাওয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, পুলিশ হয়েছ বলে তোমার অনেক ক্ষমতা, তাই না? যাকে-তাকে ঘাড়ধাক্কা দিতে পারো। নিজে কখনও ঘাড়ধাক্কা খেয়েছ? দেখো তো কেমন লাগে?

কাকাবাবু রামা রাওয়ের ঘাড়ে ডান হাত রেখে এমন কঠিন একটা ধাক্কা দিলেন যে, সে হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে।

সে বেশ লম্বা-চওড়া জোয়ান পুরুষ, কাকাবাবুর মতো একজন খোঁড়া লোকের গায়ে যে এত জোর, তা সে কল্পনাও করেনি।

থানার মধ্যে কোনও পুলিশের গায়ে হাত দেওয়ার মতন ঘটনা আগে কেউ দেখেনি।

রামা রাও ক্রুদ্ধ ভাবে ও. সি.র দিকে একবার তাকিয়ে তেড়ে গেল। কাকাবাবুর দিকে।

ও. সি. চট করে কাকাবাবুকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ে হাত তুলে বললেন, ব্যস, ব্যস, হয়েছে, হয়েছে। শোধবোধ হয়ে গেছে।

শোনো রাও, মিস্টার রায়চৌধুরী একজন বিখ্যাত মানুষ, ওঁকে এইভাবে ধরে আনা ঠিক হয়নি। আমাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত।

রামা রাও গায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল।

নরেন্দ্র ভার্মা ব্যস্ত হয়ে বললেন, এখানে আর সময় নষ্ট করে কী হবে? হাসপাতালে গিয়ে সেই লোকটার সঙ্গে কথা বলা যাক।

বড়বাবু বললেন, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেই গাড়িতে চলে যান।

পুলিশ কমিশনার ফোন করেছিলেন, তিনি আপনাদের সঙ্গে সবরকম সহযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন।

কাকাবাবু বললেন, আমাকে যারা পুলিশে ধরাবার চেষ্টা করেছে, যাদের জন্য আমার একটা দিন নষ্ট হল, তাদের আমি ঠিক খুঁজে বার করব। তারা কঠিন শাস্তি পাবে।

বাইরে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠবার পর নরেন্দ্র ভার্মা হেসে বললেন,

রাজা, তুমি এখনও রাগে ফুঁসছ! অত রাগ ভাল নয়। থানার মধ্যে ওই লোকটাকে ঘাড়ধাক্কা না দিলে কি চলত না।

কাকাবাবু বললেন, আমার সহজে রাগ হয় না। কিন্তু একবার রাগ চড়ে গেলে সহজে যেতে চায় না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, এবার একটু অন্য কথা বলো। এখানে তুমি সত্যি-সত্যি এসেছ কেন? শুধু বেড়াতে?

কাকাবাবু বললেন, সারাদিন আমি কিছু খাইনি। আগে ভাল করে খেতে হবে, তারপর অন্য কথা।

নরেন্দ্র ভার্মা অবাক হয়ে বললেন, সে কী, দুপুরে কিছু খেতে দেয়নি? লপসি না খিচুড়ি। কী যেন দেয়?

কাকাবাবু বললেন, দিয়েছিল বোধ হয় কিছু। আমি চোখ বুজে ছিলাম। আমি জেলের খাবার খাব না বলেছিলাম না?

যদি আমার আসতে দেরি হত? তোমাকে জেল থেকে ছাড়াতেও দু-তিনদিন লেগে যেত?

তা হলে দু-তিনদিনই না খেয়ে থাকতাম।

এ-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এখন ভাইজাগে রয়েছেন। সেইজন্য পুলিশ কমিশনার খুব ব্যস্ত, তিনি নিজে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেননি। আমি সব বুঝিয়ে বলেছি। কমিশনার সাহেব তোমার সব কথা জানেন। উনি বললেন, একটা মিথ্যে অভিযোগ দিয়ে তোমার পেছনে যারা পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে, তাদের নিশ্চয়ই একটা কিছু মতলব আছে। তোমাকে আটকে রাখতে চায়, কারা চাইছে এবং কেন?

সেসব পরে ভেবে দেখা যাবে। আগে কিছু খেয়ে নিয়ে পেট ঠাণ্ডা করি।

শহরের মধ্যে একটা রেস্তরাঁয় গিয়ে বসা হল।

ভেতরটা অন্ধকার-অন্ধকার, প্রত্যেক টেবিলে শুধু মোমবাতি জ্বলছে। লোকজন যারা বসে আছে, তাদের মুখ দেখা যায় না।

একেবারে কোণের একটা টেবিলে বসলেন ওঁরা দুজন।

বেয়ারাকে ডেকে নরেন্দ্র ভার্মা একগাদা খাবারের অর্ডার দিতে যাচ্ছিলেন, কাকাবাবু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আরে, আরে, তুমি করছ কী? খিদে পেয়েছে বলে কি আমি রাক্ষসের মতন খাব? একটা মাশরুম-ওমলেট, দুখানা টোস্ট আর এক কাপ চা-ই যথেষ্ট।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমার জন্য একটা বড় গ্লাস লস্যি!

কাকাবাবু টেবিলে রাখা জলের গ্লাস তুলে এক চুমুকে শেষ করে বললেন, সকাল থেকে এই প্রথম জল খেলাম। হোটেলে গিয়ে স্নান করতে হবে। থানার গারদটা এত নোংরা যে এখনও আমার গা ঘিনঘিন করছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, তোমার খুব দুর্ভোগ গেল যা হোক। মিছিমিছি এই ঝঞ্ঝাট।

কাকাবাবু বললেন, তুমি যে এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে দিল্লি থেকে, তা আমার শত্রুপক্ষ ভাবতেই পারেনি। দিল্লি থেকে যে আমি এরকম সাহায্য পেতে পারি, তাও বোধ হয় ওরা জানে না।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, পুলিশ কমিশনারও সেই কথা জানালেন। এখানে স্মাগলিং খুব বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ থেকে তাদের ধরার একটা বড়রকম অভিযান শুরু হয়েছে। স্মাগলিং-এর সঙ্গে যাদের সামান্য সম্পর্ক আছে, তাদের ধরা হচ্ছে। সেইজন্যই তোমার ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য ভাবে সাজানো হয়েছিল। একজন ধরা-পড়া স্মাগলারের পকেটে তোমার নামে চিঠি। তুমি হোটেলে থাকো, বাইরের লোক, পুলিশের সন্দেহ তো হবেই। তুমি যদি দিল্লিতে আমাকে ফোন করে না পেতে, কিংবা এরা যদি তোমাকে টেলিফোন করতেই না দিত, তা হলে তোমাকে বেশ কিছুদিন জেলে থাকতে হত।

কাকাবাবু বললেন, কারা এই মতলবটি করেছিল, তাদের খুঁজে বার করতে হবে। হাসপাতালের লোকটাকে জেরা করলেই কিছু জানা যাবে!

নরেন্দ্র ভামা বললেন, রাজা, তোমাকে তো আমি খুব ভাল করেই চিনি! তোমাকে যারা বিরক্ত করে, তাদের শাস্তি না দিয়ে তুমি শান্ত হবে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, আমি এখানে থাকতে পারছি না। কাল সকালেই আমাকে বম্বে চলে যেতে হবে। সেখান থেকে আমেদাবাদ। খুব জরুরি কাজ, যেতেই হবে। তুমি একা-একা বিপদের ঝুঁকি নিতে যেয়ো না প্লিজ! আমি চার-পাঁচদিন পর ফিরে আসব। সেই কটা দিন তুমি চুপচাপ হোটেলে বসে থেকো, কিংবা কলকাতায় ফিরে যেতে পারো।

কাকাবাবু কিছু না বলে মুচকি হাসলেন।

বেয়ারা এসে খাবার দিয়ে গেল।

বাইরে থেকে যখন লোক আসছে বা কেউ বের হচ্ছে, তখন দরজাটা খোলায় আলো এসে পড়ছে ভেতরে। আবার অন্ধকার।

নরেন্দ্র ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আরাকু ভ্যালি না কী একটা ভ্যালিতে যাওয়ার কথা বলেছিলে, সেখানে কী ব্যাপার?

কাকাবাবু বললেন, সেখানে চোর-ডাকাত ধরার কোনও ব্যাপার নেই। প্রোফেসর ভার্গব কিছু ঐতিহাসিক মূর্তি আবিষ্কার করেছেন, সেগুলো দেখতে যাওয়ার কথা আছে।

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, আমার মনে হচ্ছে ভাইজাগে স্মাগলাররা আর চোর-ডাকাতরা বড়রকম কিছু একটা ঘটাবে। এর মধ্যে তুমি এসে পড়েছ। ওদের ধারণা, তুমি ওদের বাধা দিতে এসেছ। তাই ওরা তোমাকে সরাতে চায়।

কাকাবাবু বললেন, চোর-ডাকাত বা স্মাগলারদের নিয়ে আমি মাথাই ঘামাই! আমি এসেছি মূর্তি দেখার শখে।

এই সময় দরজা ঠেলে একটা লোক ঢুকল। তার পেছন দিকটায় আলো বলে মুখ দেখা গেল না।

কয়েক পা দৌড়ে এসে সে কাকাবাবুর দিকে কিছু একটা জিনিস খুব জোরে ছুড়ে মারল। ঠিক তখনই কাকাবাবু চায়ের কাপটা তুলেছেন চুমুক দেওয়ার জন্য।

সেই জিনিসটা এসে লাগল চায়ের কাপে, কাপটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে গেল, সব চা-টা ছড়িয়ে গেল টেবিলে।

সেই জিনিসটা একটা মস্ত বড় ছুরি। কাকাবাবু ঠিক সময় কাপটা না তুললে ছুরিটা তাঁর বুকে বিঁধে যেত।

ব্যাপারটা বুঝতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল।

লোকটা পেছন ফিরে পালাচ্ছে। নরেন্দ্র ভার্মা বাঘের মতন তাড়া করে গেলেন লোকটিকে, রেস্তরাঁর অন্য লোকজন হইহই করে উঠল।

কাকাবাবুর জামায়-প্যান্টে চা পড়ে গেছে।

তিনি একটুও উত্তেজিত না হয়ে একটা ন্যাপকিন দিয়ে ভিজে জায়গাগুলো মুছতে লাগলেন।

নরেন্দ্র ভার্মা ফিরে এলেন একটু পরেই। কাকাবাবুর টেবিল ঘিরে অনেকে দাঁড়িয়ে নানারকম প্রশ্ন করছে, কাকাবাবু কোনও উত্তর দিচ্ছেন না। নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, নাঃ, লোকটাকে ধরা গেল না। রাস্তা দিয়ে একটা মিছিল যাচ্ছে, লোকটা শট করে মিছিলের ওপারে চলে গিয়ে ভিড়ে মিশে গেল।

কাকাবাবু ছুরিটা দু হাতে ধরে বললেন, বেশ ধার আছে। জানো নরেন্দ্র, আমার ক্রমশ বিশ্বাস হয়ে যাচ্ছে যে, আমাকে কেউ কক্ষনও মারতে পারবে না। আমার ইচ্ছামৃত্যু!

নরেন্দ্র ভার্মা বললেন, দিনের বেলা এত লোকের মাঝখানে তোমাকে মারতে এসেছিল। ওরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। রাজা, তোমার আর বাইরে থাকা চলবে না। হোটেলে ফিরে চলো। সেখানে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করব।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, আগে হাসপাতালে চলল। সেই লোকটাকে দেখে আসি।

বিল মিটিয়ে দিয়ে বাইরে এসে নরেন্দ্র ভামা একবার চারদিক দেখে নিলেন।

কী একটা ধর্মীয় মিছিল এখনও চলেছে, গাড়ি-ঘোড়া সব থেমে আছে। এর মধ্যে দিয়ে যাওয়াও যাবে না।

গাড়ির মধ্যে বসে ওঁরা অপেক্ষা করতে লাগলেন। মিছিলটা শেষ হওয়ার পর গাড়ি স্টার্ট দিল।

হাসপাতালে পৌঁছে একটা দুঃসংবাদ শোনা গেল।

কোনও আসামি আহত বা অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে রাখা হলেও তার বেডের পাশে পুলিশ পাহারা থাকে। এখানে হরেন মণ্ডল নামে স্মাগলারটির জন্যও দুজন পুলিশ ছিল। গুলি লেগে হরেনের পা খোঁড়া হয়ে গেছে। তবু, ঠিক এক ঘণ্টা আগে বাথরুম যাওয়ার নাম করে হরেন পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে। খোঁড়া পা নিয়ে সে হাসপাতালের তিনতলা থেকে কী করে পালাল, কেউ জানে না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress