Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শজারুর কাঁটা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 10

শজারুর কাঁটা – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

হাপ্ত দুই পরে একদিন মেঘাচ্ছন্ন সকালবেলা ব্যোমকেশের বসবার ঘরে পারিবারিক চায়ের আসর বসেছিল। অজিত ছিল‌, সত্যবতীও ছিল। গত রাত্রি থেকে বর্ষণ আরম্ভ হয়েছে‌, মাঝে মাঝে থামছে‌, আবার আরম্ভ হচ্ছে। গ্রীষ্মের রক্তিম ক্ৰোধ মেহে বিগলিত হয়ে গেছে।

অজিত বলল–’এমন একটা গাইয়ে লোককে তুমি পুলিসে ধরিয়ে দিলে! লোকটা বড় ভাল গায়।–সত্যিই এতগুলো খুন করেছে?’

সত্যবতী বলল—’লোকটা নিশ্চয় পাগল।’

ব্যোমকেশ বলল—’প্রবাল গুপ্ত পাগল নয়; কিন্তু একেবারে প্রকৃতিস্থ মানুষও নয়। অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলে ছিল‌, হঠাৎ দৈব-দুর্বিপাকে গরীব হয়ে গেল; দারিদ্র্যের তিক্ত রসে ওর মনটা বিষিয়ে উঠল। ওর চরিত্রে ষড়রিপুর মধ্যে দুটো বলবান-লোভ আর ঈর্ষা। দারিদ্র্যের আবহাওয়ায় এই দুটো রিপু তাকে প্রকৃতিস্থ থাকতে দেয়নি।’

সত্যবতী বলল–’সব কথা পরিষ্কার করে বল। তুমি বুঝলে কি করে যে প্রবাল গুপ্তই আসামী?’

ব্যোমকেশ পেয়ালায় দ্বিতীয়বার চা ঢেলে সিগারেট ধরাল। আস্তে-আস্তে ধোঁয়া ছেড়ে অলস কণ্ঠে বলতে শুরু করল—

‘এই রহস্যর চাবি হচ্ছে শজারুর কাঁটা। আততায়ী যদি পাগল হয় তাহলে আমরা অসহায়‌, বুদ্ধির দ্বারা তাকে ধরা যাবে না। কিন্তু যদি পাগল না হয় তখন ভেবে দেখতে হবে‌, সে ছোরা-ছুরি ছেড়ে শজারুর কাঁটা দিয়ে খুন করে কেন? নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য আছে। কী সেই উদ্দেশ্য?

দেখা যাচ্ছে‌, প্রত্যেকবার আততায়ী শজারুর কাঁটা মৃতদেহে বিঁধে রেখে দিয়ে যায়‌, অৰ্থাৎ সে জানাতে চায় যে‌, এই খুনগুলো একই লোকের কাজ। যে ভিখিরিকে খুন করেছে‌, সেই মজুরকে খুন করেছে এবং দোকানদারকেও খুন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে—কেন?

আমার কাছে এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর-ভিখিরি থেকে দোকানদার পর্যন্ত কেউ হত্যাকারীর আসল লক্ষ্য নয়‌, আসল লক্ষ্য অন্য লোক। কেবল পুলিসের চোখে ধুলো দেবার জন্যে হত্যাকারী এলোপাথাড়ি তিনটে খুন করেছে‌, যাতে পুলিস কোনো মোটিভ খুঁজে না পায়।

তারপর চেষ্টা হল শজারুর কাঁটা দিয়ে দেবাশিসকে খুন করবার। দেবাশিস দৈব কৃপায় বেঁচে গেল‌, কিন্তু আততায়ী কে তা জানা গেল না।

আমার সত্যান্বেষণ আরম্ভ হল এইখান থেকে। দেবাশিসই যে হত্যাকারীর চরম লক্ষ্য তা এখনো নিঃসংশয়ে বলা যায় না‌, কিন্তু মনে হয় তার ওপরে আর কেউ নেই। ভিখিরি থেকে শিল্পপতি‌, তার চেয়ে উঁচুতে আর কেউ না থাকাই সম্ভব। যাহোক‌, তদারক করে দেখা যেতে পারে।

অনুসন্ধানের ফলে দেখা গেল‌, নৃপতির আড্ডায় যারা যাতায়াত করে তারা ছাড়া আর কারুর সঙ্গে দেবাশিসের বিশেষ ঘনিষ্টতা নেই; ফ্যাক্টরির লোকেরা তাকে ভালবাসে, ফ্যাক্টরিতে আজ পর্যন্ত একবারও স্ট্রাইক হয়নি। আর একটা তথ্য জানা গেল‌, বিয়ের আগে দীপা একজনের প্রেমে পড়েছিল‌, তার সঙ্গে পালাতে গিয়ে সে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তারপরে দেবাশিসের সঙ্গে দীপার বিয়ে হয়।

দীপার গুপ্ত প্রণয়ী কে ছিল দীপা ছাড়া কেউ তা জানে না। কে হতে পারে? দীপার বাপের বাড়িতে গোঁড়া সাবেকী চাল‌, অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মেলামেশার অধিকার দীপার নেই‌, কেবল দাদার বন্ধুরা যখন বাড়িতে আসে তখন তাদের সঙ্গে সামান্য মেলামেশার সুযোগ পায়। সুতরাং তার প্রেমিক সম্ভবত তার দাদারই এক বন্ধু‌, অর্থাৎ নৃপতি কিংবা তার আড্ডার একজন।

এই সঙ্গে একটা মোটিভও পাওয়া যাচ্ছে। দীপার ব্যর্থ প্রেমিক তার স্বামীকে খুন করবার চেষ্টা করতে পারে যদি সে নৃশংস এবং বিবেকহীন হয়। যে-লোক শজারুর কাঁটা দিয়ে তিনটে খুন করেছে সে যে নৃশংস এবং বিবেকহীন তা বলাই বাহুল্য। নৃপতির আড্ডায় যারা আসত তাদের সঙ্গে দেবাশিসের আলাপ মাত্র দু’মাসের। কেবল একজনের সঙ্গে তার স্কুল থেকে চেনাশোনা ছিল‌, সে প্রবাল গুপ্ত। চেনাশোনা ছিল কিন্তু সম্প্রীতি ছিল না। প্রবাল গুপ্ত যদি দীপার প্ৰেমাস্পদ হয়–

বাকি ক’জনকেও আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি। নৃপতির একটি স্ত্রীলোক আছে‌, তার কাছে সে মাঝে মাঝে গভীর রাত্রে অভিসারে যায়। সুজন মিত্র ব্যর্থ প্রেমিক‌, সে যাকে ভালবাসে বছরখানেক আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে। খড়্গ বাহাদুর এবং কপিলের জীবনে নারী-ঘটিত কোনো জটিলতা নেই। খড়্গ বাহাদুর শুধু ফুটবলই খেলে না‌, জুয়াও খেলে। কপিল আদর্শবাদী ছেলে‌, পৃথিবীর চেয়ে আকাশেই তার মন বেশি বিচরণ করে।

কিন্তু আর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দরকার নেই‌, সাঁটে বলছি। দীপার বাপের বাড়িতে তার ঘর তল্লাশ করে পাওয়া গেল একটি অটোগ্রাফের খাতা; তাতে নৃপতির আড্ডার কেবল একটি লোকের হস্তাক্ষর আছে‌, সে প্রবাল গুপ্ত। প্রবাল লিখেছে-তোমার চোখের বিজলি-উজিল আলোকে‌, পরাণে আমার ঝঞ্ঝার মেঘ ঝলকে। তার কথায় কোনো অস্পষ্টতা নেই। আরো জানা গেল দীপা গান ভালবাসে‌, কিন্তু প্রবাল যে বিবাহিত তা সে জানে না। সুতরাং কে গানের ফাঁদ পেতে দীপাকে ধরেছে তা জানতে বাকি রইল না।

তারপর আর একটি কথা লক্ষ্য করতে হবে। যেদিন ভোরবেলা ভিখিরিকে শজারুর কাঁটা দিয়ে মারা হয় সেইদিন রাত্রে দীপার ফুলশয্যা। সমাপতনটা আকস্মিক নয়।

এবার প্রবালের দিক থেকে গল্পটা শোন।

যারা জন্মাবধি গরীব‌, দারিদ্র্যে তাদের লজ্জা নেই; কিন্তু যারা একদিন বড়মানুষ ছিল‌, পরে গরীব হয়ে গেছে‌, তাদের মনঃক্লেশ বড় দুঃসহ। প্রবালের হয়েছিল সেই অবস্থা। বাপ মারা যাবার পর সে অভাবের দারুণ দুঃখ ভোগ করেছিল‌, তার লোভী ঈর্ষালু প্রকৃতি দারিদ্র্যের চাপে বিকৃত হয়ে চতুর্গুণ লোভী এবং ঈর্ষালু হয়ে উঠেছিল। গান গেয়ে সে মোটামুটি গ্রাসাচ্ছাদন সংগ্রহ করতে পেরেছিল বটে‌, কিন্তু তার প্রাণে সুখ ছিল না। একটা রুগ্ন মরণাপন্ন মেয়েকে বিয়ে করার ফলে তার জীবন আরো দুৰ্বহ হয়ে উঠেছিল।

কিছুদিন আগে ওর বউ মারা গেল। বউ মরার আগে থাকতেই বোধহয় ও দীপার জন্যে ফাঁদ পেতেছিল; ও ভেবেছিল বড় ঘরের একমাত্র মেয়েকে যদি বিয়ে করতে পারে‌, ওর অবস্থা আপনা থেকেই শুধরে যাবে। দীপার চরিত্র যতাই দৃঢ় হোক‌, সে গানের মোহে প্রবালের দিকে আকৃষ্ট হল। মুখোমুখি দেখাসাক্ষাতের সুযোগ বেশি ছিল না। টেলিফোনে তাদের যোগাযোগ চলতে লাগল।

পালিয়ে গিয়ে দীপকে বিয়ে করার মতলব প্রবালের গোড়া থেকেই ছিল; দীপা যে ঠাকুরদার অনুমতি চাইতে গিয়েছিল সেটা নিতান্তাই লোক-দেখানো ব্যাপার। প্রবাল জানত বুড়ে রাজী হবে না। কিন্তু পালিয়ে গিয়ে একবার বিয়েটা হয়ে গেলে আর ভয় নেই‌, দীপাকে তার বাপ-ঠাকুরদা ফেলতে পারবে না।

দীপা বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। তারপর তাড়াতাড়ি দেবাশিসের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া হল।

প্রবালের মনের অবস্থাটা ভেবে দেখ। অন্য কারুর সঙ্গে দীপার বিয়ে হলে সে বোধহয় এমন ক্ষেপে উঠত না। কিন্তু দেবাশিস! হিংসেয় রাগে তার বুকের মধ্যে আগুন জ্বলতে লাগল।

বিয়ের সম্বন্ধ যখন স্থির হয়ে গেল তখন সে ঠিক করল দেবাশিসকে খুন করে তার বিধবাকে বিয়ে করবে। দীপা তখন স্বাধীন হবে‌, বাপের বাড়িয় শাসন আর থাকবে না। দীপাকে বিয়ে করলে দেবাশিসের সম্পত্তি তার হাতে থাকবে। একসঙ্গে রাজকন্যে এবং রাজত্ব। দেবাশিসের আর কেউ নেই প্রবাল তা জানত।

কিন্তু প্রথমেই দেবাশিসকে খুন করা চলবে না। তাহলে সে যখন দীপাকে বিয়ে করবে তখন সকলের সন্দেহ তার ওপর পড়বে। ক্রূর এবং নৃশংস প্রকৃতির প্রবাল এমন এক ফন্দি বার করল যে‌, কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। শজারুর কাঁটার নাটকীয় খেলা আরম্ভ হল। তিনটি মানুষ বেঘোরে প্রাণ দিল।

যাহোক‌, প্রবাল দেবাশিসকে মারবার সুযোগ খুঁজছে। আমার বিশ্বাস সে সর্বদাই একটা শজারুর কাঁটা পকেটে নিয়ে বেড়াত; কখন সুযোগ এসে যায় বলা যায় না। একদিন হঠাৎ সুযোগ এসে গেল।

নৃপতির আড্ডাঘরের পাশের ঘরে টেলিফোন আছে। দোরের পাশে পিয়ানো‌, প্রবাল সেখানে বসে ছিল; শুনতে পেল খড়্গ বাহাদুর দেবাশিসকে টেলিফোন করছে‌, জানতে পারল ওরা রবীন্দ্র সরোবরের এক জায়গায় দেখা করবে। প্রবাল দেখল এই সুযোগ। শজারুর কাঁটা তার পকেটেই ছিল‌, সে যথাস্থানে গিয়ে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। তারপর–

প্রবাল জানত না যে প্রকৃতির দুর্জেয় খামখেয়ালির ফলে দেবাশিসের হৃৎপিণ্ডটা বুকের ডান পাশে আছে। দীপা অবশ্য জানত। কিন্তু প্রবাল যে দেবাশিসকে খুন করে তাকে হস্তগত করার মতলব করেছে তা সে বুঝতে পারেনি। হাজার হোক মেয়েমানুষের বুদ্ধি; বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছেন‌, ‘কখনো অর্ধেক বৈ পুরা দেখিলাম না।’

এই হল গল্প। আর কিছু জানবার আছে?’

অজিত প্রশ্ন করল–’তোমাকে মারতে গিয়েছিল কেন?’

ব্যোমকেশ বলল–’আমি সেদিন ওদের আড়ায় গিয়ে বলে এসেছিলাম যে শজারুর কাঁটা দিয়ে যদি আর খুন না হয়‌, তাহলে বুঝতে হবে দেবাশিসই আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য। তাই প্রবাল ঠিক করল আমাকে খুন করেই প্রমাণ করবে যে‌, দেবাশিস আততায়ীর প্রধান লক্ষ্য নয়; সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। আমি যে তাকে ধরবার জন্যেই ফাঁদ পেতেছিলাম তা সে বুঝতে পারেনি।’

সত্যবতী গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল–’বাব্বা! কী রাক্কুসে মানুষ! দীপার কিন্তু কোনো দোষ নেই। একটা সহজ স্বাভাবিক মেয়েকে খাঁচার পাখির মত বন্ধ করে রাখলে সে উড়ে পালাবার চেষ্টা করবে না?’

খুটি খুঁট করে সদর দরজায় টোকা পড়ল। ব্যোমকেশ উঠে গিয়ে দোর খুলল–’আরে দেবাশিসবাবু যে! আসুন আসুন।’

দেবাশিস সঙ্কুচিতভাবে ঘরে প্রবেশ করল। সত্যবতী উঠে দাঁড়িয়েছিল‌, দেবাশিসের নাম শুনে পরম আগ্রহে তার পানে চাইল। দেবাশিসের চেহারা আবার আগের মত হয়েছে‌, দেখলে মনে হয় না সে সম্প্রতি যমের মুখ থেকে ফিরে এসেছে। সে হাত জোড় করে বলল–’আজ রাত্রে আমার বাড়িতে সামান্য খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করেছি‌, আপনাদের সকলকে যেতে হবে।’

ব্যোমকেশ বলল—’বেশ‌, বেশ। বসুন। তা উপলক্ষটা কী?

দেবাশিস রুদ্ধ কণ্ঠে বলল–’ব্যোমকেশদা‌, আজ আমাদের সত্যিকার ফুলশয্যা। দীপাকে আমার সঙ্গে আনতে চেয়েছিলাম‌, কিন্তু সে লজ্জায় আধমরা হয়ে আছে‌, এল না। বউদি‌, আপনি নিশ্চয় আসবেন‌, নইলে দীপার লজ্জা ভাঙবে না।’

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10
Pages ( 10 of 10 ): « পূর্ববর্তী1 ... 89 10

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress