বৈদিক যুগের পানীয় – সোমরস (পুরাণ কথা,বিজ্ঞান ও বেদ)
সোমলতা এক ভেষজ যা পানীয় হিসেবে পান করা হতো। মধু, সুরা ও সোমরস এই তিন প্রধান পানীয় ছিল সে সময় আর্যদের।
বৈদিক ঋষিরা সর্বদাই সর্বোচ্চ শক্তির খোঁজে অর্থাত একেশ্বর দেবতার ধ্যানধারণায় মগ্ন থাকতেন। সর্বোচ্চ শক্তির ধ্যান ধারণা নানাভাবে (ঋগ্বেদ১|৬৩|১ ) নিহিত যে –ইন্দ্রই সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা। কিন্ত বৈদিক ঋষিরা সংশয়াচ্ছন্ন ছিলেন, সন্ধানরত সে একেশ্বরের নাম “ব্রহ্ম”। পুরাণ যুগে সাকার “ব্রহ্মা” বর্তমান যুগে ঋষি অরবিন্দ বলেছেন ” “universal mind” ঋষিদের এই ধারণাকে ম্যাক্সমুলার সাহেব ” হেনোথিয়োজম্” আখ্যা দিয়েছেন। আর বিজ্ঞানে বলা হয়, “cosmic consciousness “
বলা বাহুল্য বৈদিক যূগের ইন্দ্র দেবতা মূলে– অগ্নি, বায়ু,জল। তখন জড় পদার্থও যেমন মেঘ, বায়ু, জল ইত্যাদি এবং কিছু পশু, বৃক্ষ ইত্যাদি দেবরূপে গণ্য হতো, কোন কাল্পনিক সাকার মূর্তি নয়।
সোমরস পাওয়া যেতো, সোমলতার পাতা নিষ্কাসন করে। এই সোমলতা “বৃক্ষ”ও ছিল এক দেব।
আশ্চর্য গুণাবলী সমৃদ্ধ এই রস ঋষিদের এক অন্যতম পানীয়, যা পান করা হতো যজ্ঞ সমাপনে। ঋগ্বেদ এর নবম মণ্ডলের এক থেকে ১১৪ টি সুক্তে অসংখ্য ঋক আছে সোমদেবকে নিয়ে। লিখেছেন নানা ঋষিরা যথা — মধুসূদন, দেবল, মেধাতিথি , গৌতম,অত্রি, প্রভুবসু প্রভৃতি বিভিন্ন ছন্দ প্রয়োগে।
সোমলতার রস যজ্ঞানুষ্ঠানে সোমদেবরূপী ইন্দ্রকে নিবেদন করা হতো সুন্দর সুন্দর ঋক্ উচ্চারণে। সোমপাতার বিন্যাস ছিল দুটি পাতা বক্রভাবে দুদিকে।
যেহেতু, নারীদের অঙ্গুলি পুরুষ অঙ্গুলি অপেক্ষা কোমল ও চিকন , সেজন্য নারীরাই সোমলতা থেকে রস নিষ্কাসন করতেন নিষ্ঠাভরে। ভারী সুন্দর সে পদ্ধতি। সপ্ত আঙ্গুল অর্থাত ডান হাতের পাঁচ আর বাম হাতের তর্জনী ও বৃদ্ধাঙ্গুল, বলা হয় এরা সপ্তনদী ( সিন্ধু ও তার পাঁচটি শাখা এবং সরস্বতী নদী) —-সোমদেবের স্ত্রী। রস নিঃসরণের সময় সুগন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ত, আর তাতে শ্যেন পক্ষী আকৃষ্ট হয়ে চলে আসত। মেষ লোমের সাহায্যে নিষ্ঠাভরে রস ছেকে নিয়ে সংরক্ষিত হতো গো- চর্মের পাত্রে।
ঘন রসের রঙ ঈষৎ পীতাভ সাদা, অনেকটা বর্তমানকালের সয়াবীন বীজের রসের মতো। যজ্ঞে নিবেদিত হতো দুধ বা ক্ষীরের সাথে মিশিয়ে। আধুনিক যুগে অনেকের ভ্রান্ত ধারণা যে সোমরস এক মাদক জাতীয় পানীয়। কিন্তু আদতে তা নয়। তবে কি ছিল তাতে যা পান করে আর্যরা যৌবন অটুট রাখতেন, দেহ রোগমুক্ত থাকত, বলবৃদ্ধি পেতো, পুষ্টি যোগাত, আর কাজে উৎসাহ পেতেন।
কিন্তু যে উপকারিতা আর্যরা পেতেন, তা কোনমতেই শুধু মাদক পদার্থের উপস্থিতির ইঙ্গিত দেয় না। অনুমান করা যায় তাতে অবশ্যই প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, অ্যান্টিঅক্সিজেন, এনজাইম ইত্যাদি ও মাদক উপাদান ছিল। দুঃখের বিষয় বর্তমানে ঐ সোমলতা সম্পূর্ণ রূপে বিলুপ্ত, নতুবা এ গবেষণায় প্রমাণ সাপেক্ষ হতো, সন্দেহ নেই।
তবে পৃথিবীর কোন কোন স্থানে সোমলতার অস্তিত্ব নিয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ আছে, কেউ কেউ দাবী করেন, তাও এখন এক বিতর্কের বিষয়।
যেমন, পারস্য মাইথোলজিতে “হোমা” এক ভেষজের উল্লেখ আছে, যা এখনও দেখা যায়, তবে ঋগ্বেদে বর্ণিত সোমলতা বৃক্ষ বা পাতার বিন্যাসের সাথে তার তেমন সামঞ্জস্য নেই। “Sarcostemma acidum ” হিমালয় পার্বত্য অনেকের মতে এই সেই সোমলতা— কিন্তু এখানেও সোমপাতার সাথে বৈসম্য, নীচে ছবিতে দ্রষ্টব্য।
বৈদিক যুগের আর্যরা নানা ভেষজের উপকারিতা সম্বন্ধে বিজ্ঞানসম্মতভাবে চিন্তাশীল ছিলেন। জীবন ও যৌবন অটুট রাখবার জন্য দেহকে ব্যাধি ও বার্ধক্য দূরে রাখতে উৎসাহি ছিলেন। কিন্তু সোমলতার বা অন্যান্য ভেষজের উপাদান কি কি আছে তার নথি কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় নি।
(ঋগ্বেদ ও উইকিপিডিয়া)