Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay » Page 3

পাহাড় চূড়ায় আতঙ্ক (১৯৮১) || Sunil Gangopadhyay

গুলির আওয়াজে চার পাশের পাহাড়গুলো যেন কেঁপে উঠল। যেন অনেকগুলো গুলি ঠিকরে গেল অনেকগুলো পাথরে। তারপরেও দূরে-দূরে সেই আওয়াজ হতে লাগল।

কাকাবাবু এমন আচমকা গুলি ছুঁড়েছিলেন যে, সন্তু দারুণ চমকে উঠেছিল। পাহাড়ি জায়গায় প্ৰতিধ্বনি কেমন হয়, সে সম্পর্কেও সন্তুর প্রথম অভিজ্ঞতা হল।

কাকাবাবু রিভলভারটার ডগায় দুবার ফুঁ দিলেন। তারপর সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুই রিভলভার চালানো শিখতে চাস?

সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় নাড়ল।

কাকাবাবু রিভলভারটা সন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, শক্ত করে ধর! এখন বড় হয়েছিস, ঠিক পারবি। এবারে যে অভিযানে বেরিয়েছি, তাতে পদে-পদে বিপদ হতে পারে। ধরা আমি যদি হঠাৎ মরে যাই, তোকে তো বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।

সন্তু রিভলভারটা ধরে হাতটা বুকের কাছে রেখেছিল। সিনেমায় সে লোকদের ঐভাবে গুলি চালাতে দেখেছে।

কাকাবাবু বললেন, ওভাবে না! ওভাবে গুলি চালালে তুই নিজেই মরবি! হাতটা সোজা করে সামনে বাড়িয়ে দে। হাতটা খুব শক্ত করে রাখ, কনুইটা যেন কিছুতেই বেঁকে না যায়। গুলি ছোঁড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই খুব জোরে ঝাঁকুনি লাগে। কিন্তু

সত্যিকারের রিভলভার হাতে নিলেই একটা রোমাঞ্চ হয়। সন্তু এর আগে দু-একবার কাকাবাবুর রিভলভারটা খুঁয়ে দেখেছে। একবার, আনতাবড়ি গুলি চালিয়েওছিল। এবার সে টিপ করে ঠিকঠাক গুলি ছুঁড়বে।

কাকাবাবু বললেন, মনে কর, এই সময়ে যদি হঠাৎ ভালুকটা এসে পড়ে, তুই মারতে পারবি?

সন্তু বলল, হ্যাঁ।

কাকাবাবু বললেন, অত সোজা নয়। আচ্ছ, ঐ যে পাইনগাছটা, ওর মাথায় টিপ করে লাগা তো! সাবধান, কনুই যেন বেঁকে না যায়।

সন্তু কায়দা করে এক চোখ টিপে খুব ভাল করে দেখে নিল পাইন গাছের মাথাটা, তারপর ট্রিগার টিপল।

এমন জোরে শব্দ হল যে সন্তুর কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়। ও চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। তারপর চোখ খুলে দেখল, কাকাবাবু হাসছেন।

কাকাবাবু বললেন, বেচারা গাছটা খুব বেঁচে গেছে! তোর গুলিতে তার একটা পাতাও খসে পড়েনি।

সন্তু ভেবেছিল তার গুলিটা ঠিকই লাগবে। এই তো রিভলভারের নলটা ঠিক গাছটার দিকে মুখ করা। তবু গুলিটা বেঁকে গেল?

লজ্জা লুকোবার জন্য সেও কাকাবাবুর মতন কায়দা করে রিভলভারের নলে ফুঁ দিল দুবার।

কাকাবাবু আবার বললেন, অত সোজা নয়। আরও অনেকবার প্র্যাকটিস করতে হবে।

মালবাহক কুলি দুজন নীচের নদীটায় নেমে গিয়েছিল জল খাবার জন্য। পর-পর দুবার গুলির শব্দ শুনে তারা হস্তদন্ত হয়ে তরতর করে উঠে এল পাহাড় বেয়ে। সন্তুর হাতে রিভলভার দেখে ওরা অবাক।

এদের একজন কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, কেয়া হুয়া, সাব?

কাকাবাবু বললেন, এদিকে একটা ভালুক বেরিয়েছে।

এই পাহাড়িরাও ভালুককে ভয় পায়। ওদের মুখ শুকিয়ে গেল। এই সময় তিনজন জাপানি নেমে এল ওপরের পথ দিয়ে।

কাকাবাবু তাদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা ভালুক সম্পর্কে কিছু শুনেছ?

জাপানির ভাল ইংরেজি বোঝে না। কথাটা দু-তিনবার বলে বোঝাতে হল তাদের। তারপর তারা ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে জানাল যে, অনেক লোকজন বনের মধ্যে তাড়া করে গেছে, ভালুকটা পালিয়েছে।

একজন জাপানি হেসে বলল, আমরা খুব আনলাকি! আমরা ভালুকটা দেখতে পেলাম না।

কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, দেখলি! একে বলে সাহসী লোক। দিনের বেলা রাস্তা দিয়ে এত লোক যাওয়া-আসা করছে, একটা ভালুক কী করবে?

সন্তু বলল, কিন্তু ভাল্লুকটা যে একটা লোকের পেট চিরে দিয়েছে। দেখলাম!

কাকাবাবু বললেন, সে নিশ্চয়ই একটা বোকা লোক। চল, আমরা এবার উঠে পড়ি। ভালুকটা যদি এদিকে এসেও থাকত, গুলির আওয়াজ শুনেই পালিয়েছে। ভালুকেরও তো প্ৰাণের ভয় আছে।

মালবাহকদের তিনি বললেন, ভালুক ভোগে গেছে। মাল উঠাও!

তারা তবু দাঁড়িয়ে গা মোচড়াতে লাগল।

এইসময় কপকপী কাপাকপ শব্দ হল নীচের দিকে। সন্তু পেছনে তাকিয়ে দেখল, দুজন লোক ঘোড়ায় চেপে খুব জোরে এদিকে আসছে। তাদের চেহারা আর পোশাক দেখলেই বোঝা যায়, তারা পুলিশ।

কাছে এসে তারা জিজ্ঞেস করল, এদিকে কোথায় গুলির শব্দ হল, তোমরা শুনেছ?

কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ। আমি আমার ভাইপোকে শুটিং প্র্যাকটিস করাচ্ছিলাম।

লোক দুটি তড়িাক করে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে বলল, তোমরা গুলি ষ্টুড়িছিলে? এখানে শিকার করা নিষেধ, তোমরা জানো না?

কাকাবাবু বললেন, আমরা তো শিকার করিনি। তাছাড়া, একটা ভালুক যদি সামনে এসে পড়ে, তার দিকে গুলি ছোড়াও কি নিষেধ নাকি?

একজন লোক সন্তুর হাত চেপে ধরল। অন্য লোকটি রুক্ষ গলায় কাকাবাবুকে বলল, তোমরা বে-আইনি কাজ করেছ, থানায় চলো।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, থানা কোথায়?

লোকটা হাত তুলে দেখাল সিয়াংবোঁচির দিকে। সিয়াংবোচি খুব বড় জায়গা, হোটেল আছে, সেখানেই থানা থাকা স্বাভাবিক।

কাকাবাবু এবার কড়া গলায় বললেন, যে পথ দিয়ে একবার এসেছি, সেদিকে ফিরে যাবার ইচ্ছে আমার নেই। ওকে ছেড়ে দাও! ফাঁকা জায়গায় শুটিং প্র্যাকটিস করা কোনও বে-আইনি ব্যাপার হতে পারে না।

পুলিশটি ধমক দিয়ে বলল, চলো, ওসব কথা থানায় গিয়ে বলবে চলো!

কাকাবাবু এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, আমার গায়ে হাত দিও না!

তারপর কোটের ভেতর-পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা কাগজ বার করে বললেন, পড়তে জানো, এটা পড়ে দ্যাখে! সিয়াংবোচি থানার অফিসার আমার নাম জানে।

কাগজটা পড়তে-পড়তে পুলিশটির ভুরু উঁচু হয়ে গেল। সে তার সঙ্গীকেও দেখাল কাগজটা। তারপর দুজনে এক সঙ্গে ঠকাস করে জুতো ঠুকে সেলাম দিল কাকাবাবুকে।

কাকাবাবু ডান হাতটা একটু উঁচু করলেন শুধু।

পুলিশ দুজন অবাক হয়ে কাকাবাবুর চেহারা আর খোঁড়া পাটা দেখল। তারপর একজন বলল, স্যার, আমরা দুঃখিত। আগে বুঝতে পারিনি।

কাকাবাবু বললেন, আমরা কোনও বে-আইনি কাজ করিনি তবু তোমরা আমাদের ধরে নিয়ে যেতে চাইছিলে।

সেই পুলিশট বলল, মাপ করবেন, স্যার। আমরা সত্যি বুঝতে পারিনি।

অন্য পুলিশটি জিজ্ঞেস করল, স্যার, আপনি কি সত্যি এভারেস্টে যেতে be?

কাকাবাবু সংক্ষেপে উত্তর দিলেন, দেখা যাক?

সে আবার বলল, স্যার, আপনাকে আমরা কোনও সাহায্য করতে পারি?

কাকাবাবু বললেন, কিছু না! শুধু এই মালবাহক দুজনকে বলে দাও, যেন ওরা আমাদের সঙ্গে যেতে কখনও আপত্তি না করে।

পুলিশ দুজন আরও অনেকবার সেলাম-টেলাম করে বিদায় নেবার পর সন্তুরা আবার চলা শুরু করল।

সন্তুর মনের মধ্যে যে প্রশ্নটা ছটফট করছিল, মালবাহক দুজনে তা জিজ্ঞেস করল। কাকাবাবুকে। পুলিশরা কাকাবাবুকে ধরে নিয়ে যেতে চাইছিল, তারপর একটা কাগজ দেখেই এত সেলাম ঠুকতে লাগল দেখে ওরা অভিভূত। এসব জায়গায় পুলিশদের প্রায় দেবতার সমান ক্ষমতা। সেই পুলিশরা এই বাঙালিবাবুকে এত খাতির করল!

তারা কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, সাব, ঐ কাগজটাতে কী লেখা আছে?

কাকাবাবু ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে ওদের বুঝিয়ে দিলেন যে, ওটা নেপালের প্রধানমন্ত্রীর চিঠি। তিনি নেপালের অতিথি। একটা বিশেষ গোপনীয় আর জরুরি কাজে তিনি যাচ্ছেন এভারেস্ট-চুড়ার দিকে। প্রধানমন্ত্রী চিঠিতে লিখে দিয়েছেন যে, সব জায়গার পুলিশ যেন কাকাবাবুকে সব রকমে সাহায্য করে!

একথা শুনে মালবাহক দুজনও সেলাম দিয়ে ফেলল কাকাবাবুকে। একজন আর-একজনকে বলল, দেখলি, লেখাপড়া শেখার কত দাম! এই বাঙালিবাবু লেখাপড়া শিখেছেন বলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এঁকে খাতির করেন। ইশ, আমরা কেন দুটো-চারটে বই পড়তে শিখিনি! অন্যজন বলল, আমাদের মহল্লায় একটা ইস্কুল খুলেছে, আমার ভাইকে সেখানে ভর্তি করে দিয়েছি।

এর পর আর কোনও ঘটনা ঘটেনি। মাঝখানে একটা বড় জায়গায় বিশ্রাম নেওয়া হয়েছিল তিনদিন। এই জায়গাটার নাম থিয়াংবোচি। এর আগে যে বড় জায়গাটায় জাপানি হোটেল আছে, সে জায়গাটার নাম সিয়াংবোচি। দুটো নাম প্ৰায় একই রকম, সন্তুর গুলিয়ে যায়। তবে থিয়াংবোচি জায়গাটা যেন অনেক বেশি সুন্দর। বেশ একটা পবিত্ৰ ভাব আছে। এভারেস্টের পায়ের কাছে এই শেষ শহর। এখানে অনেক কিছু পাওয়া যায়। তাঁবু, পাহাড়ে ওঠার সরঞ্জাম আর খাবার-দাবার সেখান থেকেই কিনে নিলেন কাকাবাবু। দুজন শেরপা আর পাঁচজন মালবাহককেও ঠিক করা হল। তবে এত ছোট দল নিয়ে কাকাবাবু এভারেস্টের দিকে যেতে চান শুনে সবাই অবাক। সেখানকার লোক অনেক এভারেস্ট-অভিযাত্রী দেখেছে, কিন্তু একজন খোঁড়া প্রৌঢ় লোক আর একজন কিশোর এভারেস্টে উঠতে চায় শুনে অনেকে হেসেই আকুল। একজন ডাক্তার তো কাকাবাবুকে অনেকবার বারণ করলেন।

কিন্তু কাকাবাবু যে কী-রকম গোঁয়ার, তা তো। ওরা জানে না। সেখানে একটা চমৎকার মনস্টারি আছে। খুব শান্ত আর নিরিবিলি জায়গাটা। সকালবেলা সেই মনাস্টারির দিকে যেতে যেতে সন্তু দেখেছিল, সামনে তিনদিকে তিনটি সাদা পাহাড়ের চুড়া। তার মধ্যে একটি এভারেস্ট! সেই প্রথম সন্তু এভারেস্ট দেখল, মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য, তারপরই কুয়াশায় সব-কিছু মিলিয়ে গিয়েছিল।

থিয়াংবোচিতে ওরা ছিল গভর্নমেন্টের গেস্ট হাইসে। কয়েকজন সাহেব-মেমও সেখানকার অতিথি। তারা সন্তুর সঙ্গে আলাপ করে বারবার জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা এভারেস্টের দিকে যাচ্ছ কেন? এ তো পাগলামি!

সন্তু উত্তর দিতে পারেনি। কাকাবাবু যে তাকে বিশেষ কিছুই জানাননি। কাকাবাবুর কাছে কাচের বাক্সে যে জিনিসটা আছে, সেটা তিনি সব সময় খুব সাবধানে রাখেন। সেটা সম্পর্কে শুধু সন্তুকে বলে রেখেছেন, এটার কথা কখনও কারুকে বলবি না!

সেখানে একদিন সন্ধেবেলা কাকাবাবু বাইরে থেকে ফিরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু, আমার দাঁতটা কোথায় গেল?

আমার দাঁত মানে কাকাবাবুর নিজের দাঁত নয়। কাচের বাক্সর সেই জিনিসটা। সেটা কাকাবাবু নিজেই সব সময় সাবধানে রাখেন।

সন্তু বলল, আমি তো জানি না।

কাকাবাবু দারুণ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। খোঁজাখুঁজি করতে লাগলেন সব-কিছু উল্টেপাল্টে। একটু বাদেই সেটা পাওয়া গেল অবশ্য। অতি সাবধান হতে গিয়ে কাকাবাবু নিজেই কখন সেটাকে খাটের তলায় ঢুকিয়ে রেখেছেন।

সেটাকে পাবার পর কাকাবাবু স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, বাবাঃ! এমন ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমি না থাকলে তুই কক্ষনো ঘরের বাইরে যাবি না! সব সময় এটাকে চোখে চোখে রাখবি! এটার কত দাম জানিস!

সন্তু জিজ্ঞেস করেছিল, কাকাবাবু, ওটা কী?

কাকাবাবু উত্তর দিয়েছিলেন, এখন তোর জানবার দরকার নেই। সময় হলে বলব?

তারপর সেখান থেকে শেরপাদের সঙ্গে নিয়ে চলে আসা হয়েছে এই গোরখশেপে। এখানে অন্য অভিযাত্রীরা বেস ক্যাম্প করে। কাকাবাবু, কিন্তু এখান থেকে আর এগোতে চাইছেন না। তাঁবু ফেলা হয়েছে, এখানে কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

এখানে আর সন্তুর সময় কাটতে চায় না। সব সময় বরফ দেখতে-দেখতে যেন চোখ পচে যায়। একটা টিবির ওপর চড়ে সন্তু অনেকবার দেখেছে মাউন্ট এভারেস্ট। ওখানে কি সত্যিই যাওয়া যাবে?

শেরপা সদার মিংমার সঙ্গে দিনের বেলা সে মাঝে মাঝে খানিকটা দূর পর্যন্ত যায়। মিংমার গায়ে দারুণ জোর আর খুব চটপটে। এর আগে সে দুবার দুটি সাহেবদের দলের সঙ্গে এভারেস্ট অভিযানে গিয়েছিল। কিন্তু কোনওবারই সাহেবরা তাকে একেবারে চুড়ায় উঠতে দেয়নি। এজন্য তার মনে খুব দুঃখ।

মিংমার ইচ্ছে সেও এভারেস্টের চূড়ায় উঠে তেনজিংয়ের মতন বিখ্যাত হবে, তারপর সে বিলেত আমেরিকায় নেমন্তন্ন খেতে যাবে। সাহেবদের সঙ্গে মিশে মিশে সে ইংরেজি কথা অনেক শিখে নিয়েছে। সাহেবদের দেওয়া পোশাক পরে তাকে খুব স্মার্ট দেখায়।

মিংমা সন্তুকে বলে, শোনো সন্তু সাব, তোমার আংকল কিছুতেই এভারেস্ট যেতে পারবে না! এক পা নিয়ে কেউ পাহাড়ে ওঠে? এ এক আজব বাত

সন্তু বলে, তুমি আমার কাকাবাবুকে চেনো না! মনের জোরে উনি সব পারেন।

মিংমা বলে, আরো রেখে দাও মনের জোর। পাহাড়ে উঠতে তগত লাগে! আরও কত দূর যেতে হবে, তা তোমরা জানো না! তুমি এক কাজ করো, তোমার আংকলকে বুঝিয়ে বলো, তিনি এখানে থাকুন। তোমাকে নিয়ে আমরা কয়েকজন এগিয়ে যাই। দেখো, তুমি আর আমি ঠিক একদম সাউথ কল ধরে চুড়ায় উঠে যাব।

সন্তু জানে, এসব কথা আলোচনা করে কোনও লাভ নেই। কাকাবাবুর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছুই করা যাবে না!

দিনের বেলা যদিও কেটে যায় কোনওক্রমে, রাত আর কাটতেই চায় না। শীতের জ্বালায় সন্তু সন্ধে হতে না হতেই শুয়ে পড়ে ক্লিপিং ব্যাগের মধ্যে। তারপর ঘুম আসে না। আর।

কাকাবাবু গম্বুজের মাথার কাছে বসে থাকেন, হাতে দূরবিন নিয়ে। ওখানে বসে তিনি কী দেখতে চান, কে জানে! ওখান থেকে তো এভারেস্টও দেখতে পাওয়া যায় না।

সন্তুর মাথার কাছে আলোটা জ্বলে। কাকাবাবু না নেমে এলে ঐ আলো নেভানো যাবে না। টেবিলের ওপর কাচের বাক্সে রাখা সেই দাঁতের মতন জিনিসটা। ওটা নিশ্চয়ই দাঁত নয়, কোনও দামি পাথর। সন্তু ওটার দিকে তাকাতে চায় না, তবুওদিকে চোখ চলে যাবেই। এর মধ্যে সন্তু একদিন ওটা নিয়ে স্বপ্নও দেখেছিল। ও জিনিসটা যেন আরও বড় হয়ে একটা কোদালের মতো কোপ লাগাচ্ছে সন্তুর গায়ে!

সন্তু! সন্তু

সন্তুর একটু ঘুম এসে গিয়েছিল, হঠাৎ সে ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল। কিন্তু ক্লিপিং ব্যাগের মধ্যে উঠে বসা যায় না। কে ডাকল তাকে? সন্তুর মনে হল গম্বুজের বাইরে থেকে কেউ যেন ডাকছে তাকে।

আরও দুবার ফিসফিসে গলায় ওরকম ডাক শুনে সন্তু বুঝতে পারল, গম্বুজের ওপর থেকে কাকাবাবুই ডাকছেন তাকে।

কী?

শিগগির ওপরে উঠে আয়, এক্ষুনি।

কিন্তু ক্লিপিং ব্যাগের মধ্য থেকে খুব তাড়াতাড়ি বেরনো যায় না। সন্তু পড়পড় করে চেনটা টেনে খুলে বেরিয়ে এল। বাইরে আসা মাত্র শীতে কেঁপে উঠল ঠিকঠকিয়ে। বিছানার পাশেই রাখা থাকে তার ওভারকোট, সেটা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল ওপরে।

কাকাবাবু দুরবিনটা সন্তুর হাতে দিয়ে দারুণ উত্তেজিত হয়ে বললেন, দ্যাখ তো, কিছু দেখতে পাচ্ছিস? দূরে কিছু নড়ছে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *