মাসাইমারার রাত্তির
মাসাইমারার রাত্তির যে এত লম্বা হবে, সে সম্পর্কে কাকাবাবুরও কোনও ধারণা ছিল না।
সূর্যের আলো ফুরিয়ে যাবার এক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁদের তাঁবুতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে আর বেরোনো নিষেধ। তখন বাজে মাত্র আটটা।
রাত্তিরের ডিনার দেওয়া হয়েছিল বড় তাঁবুটার মধ্যে। তারপর প্রত্যেক তাঁবুর অধিবাসীদের এক-একজন মাসাইগার্ড সঙ্গে দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ফেরার সময় সন্তুদের একটা সাঙ্ঘাতিক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে গেল।
সন্ধে হতে না হতেই চতুর্দিকে একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। এই হোটেলে এত সব আধুনিক ব্যবস্থা থাকলেও ইচ্ছে করেই বোধহয় ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রত্যেক তাঁবুর মধ্যে রয়েছে বেঁটে-বেঁটে হ্যাজাক-বাতি। আর তাঁবুর বাইরে অন্ধকারের রাজত্ব। আর এই অন্ধকারের মধ্যে বণ্যপ্রাণীরা গিসগিস করছে, এ-কথা ভাবলেই গা ছমছম করে।
যে-মাসাই গার্ডটি সন্তুদের পৌঁছে দিতে এসেছিল, তার হাতে ছিল একটা বর্শা আর একটা শক্তিশালী টর্চ। তার নাম এমবো। কাকাবাবু তার সঙ্গে গল্প জমাবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সে মাত্র পনেরো-ষোলোটার বেশি ইংরেজি শব্দ জানে না। তা ছাড়া তার স্বভাবটাও গম্ভীর ধরনের।
সে আগে-আগে টর্চের আলো ফেলো-ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এক সময় সে চাপা গলায় বলে উঠল, স্টপ!
টর্চের আলোয় দেখা গেল, একটা ফাঁকা তাঁবুর পাশে দু-একটি কালো রঙের কী যেন জন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
মাসাইগার্ডটি আবার বলল, বাফেলো! ভেরি ব্যান্ড।
বাফেলো শুনেই সন্তুর বুক কেঁপে উঠল। এত কাছে মোষ? সকালেই ম্যানেজার বলে দিয়েছিল, এই মোষগুলো হঠাৎ রেগে গিয়ে পেট ফুটো করে দেয়!
মাসাই-গার্ডটি টর্চের আলো নাচাতে লাগল। জন্তুগুলোর ওপরে। অরণ্যের কোনও প্রাণীই আলো পছন্দ করে না। আলো দেখলে তারা চলে যাবে। কিন্তু মোষ কি এত বড় হয়? এ যে ছোটখাটো পাহাড়ের মতন দেখাচ্ছে। হাতি নাকি?
একটা জন্তু মুখ ফেরাতেই মাসাইগার্ডটি আবার বলল, হিপো।
তারপর সে নিজের ভাষায় কী যেন বিড়বিড় করতে লাগল।
জলহস্তী? খাওয়ার টেবিলে গুনার ওলেন নানা রকম জন্তু-জানোয়ারের স্বভাব সম্পর্কে গল্প শোনাচ্ছিলেন। জলহস্তী সম্পর্কে বলেছিলেন, ওরা সারাদিন জলে ড়ুবে থাকে শুধু নাকটা উঁচু করে। সহজে দেখাই যায় না। কিন্তু সন্ধে হলেই ওরা জল থেকে উঠে আসে, যেখানে-সেখানে ঘাসের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। জলহস্তী এমনিতে নিরীহ আর বোকা প্ৰাণী। কিন্তু সামনা-সামনি মানুষ পড়ে গেলে ওরা ছেলেমানুষি করে কামড়ে দেয়। ওদের হা-টা এত প্ৰকাণ্ড যে তার মধ্যে একসঙ্গে দুটো মানুষ ঢুকে যেতে পারে। ওরা মানুষের মাংস খায় না। মানুষকে কামড়ে তার শরীরটা দু টুকরো করে ফেলে দেয়।
কাকাবাবু সন্তুর হাত চেপে ধরে বললেন, ভয় নেই।
টর্চের আলোয় জলহস্তীর চোখকে মনে হয় আগুনের ভাঁটা।
মাসাইগার্ডটি ধমকের সুরে বলল, ইউ, টর্চ! ইউ, টর্চ!
সন্তু আর কাকাবাবুর পকেটেও টর্চ রয়েছে।. গার্ডটি ওদেরও টর্চ জ্বালাতে বলছে। এক সঙ্গে তিনটে টর্চের আলো পড়তেই জলহস্তী দুটো দৌড়ে গিয়ে নেমে পড়ল জলাভূমিতে। কয়েক টন ওজনের ওই জানোয়ারের কিন্তু ছোটার কোনও শব্দ নেই, শুধু জলে নামার সময় মনে হল, সেখানে কোনও পাহাড়ের চাই ভেঙে পড়ছে।
এরপর সন্তু আর কাকাবাবু দ্রুত নিজেদের তাঁবুতে পৌঁছতে মাসাইগার্ডটি বলেছিল, নো কাম আউট অ্যাট নাইট! গুড নাইট!
শীতের মধ্যেও সন্তুর সারা শরীর ঘেমে গেছে। কাকাবাবু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, বোকা জানোয়ার দুটো যদি ভুল করে আমাদের দিকেই ছুটে আসত, তা হলে ওদের পায়ের চাপেই পিষে যেতাম!
সন্তু জুতোটুতো না খুলেই ঝপাস করে শুয়ে পড়ল নিজের বিছানায়।
কাকাবাবু বললেন, মাত্র আটটা বাজে, এর মধ্যেই শুয়ে পড়ব! বাকি রাতটা কাটবে কী করে?
গুনার ওলেন বলেছেন, এটাই এখানকার নিয়ম। রাত্তিরবেলা বাইরে বেরুনো কোনওক্রমেই উচিত নয়। তাঁবুর মধ্যে থাকলে অবশ্য কোনও বিপদের সম্ভাবনা নেই। সে-রকম কোনও ঘটনা এখানে ঘটেনি। সারা রাত বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলিয়ে রেখে মাসাইগার্ডরা পাহারা দেয়। সিংহ, নেকড়ে, চিতা, হায়েনার মতন হিংস্ৰ প্ৰাণীরা আগুন দেখলে সেদিকে আসে না, তবে হরিণ, জেব্রা, শুয়োর, ওয়াইন্ড বিস্ট-এর মতন যে-সব প্রাণীরা দল বেঁধে দৌড়ীয়, তারা অনেক সময় এসে পড়ে, তাদের সামনে পড়ে গেলেও মুশকিল।
সন্তু জিজ্ঞেস করেছিল, একপাল জেব্রা কিংবা হাতি-টাতিরা তাঁবু ভেঙে দিতে পারে না?
গুনার ওনেল উত্তর দিয়েছিলেন, জীবজন্তুদেরও তো মনস্তত্ত্ব আছে। সে-সব স্টাডি করা হয়েছে। অকারণে ওরা তাঁবু ভাঙতে যাবে কেন?
ওদের যাওয়া-আসার পথে যদি পড়ে?
ওদের যাওয়া-আসার নির্দিষ্ট পথ আছে। হাতিরা তো ধরাবাঁধা পথ ছাড়া কক্ষনো অন্য পথে যায় না। তবু দু-চারটে জানোয়ার যদি ছিটকে এসে পড়ে, তারাও তাঁবু এড়িয়ে চলে। তাঁবুর চার পাশে যে দড়ি আছে, সেগুলো পায়ে লাগলে ওরা বিরক্ত হয়। এই দড়িগুলো এত শক্ত যে, সহজে ছেড়ে না! আমার তো এখানে রাত্তিরে বেশ ভাল ঘুম হয়?
কিন্তু ওই জলহস্তী দুটো দেখার পর থেকে গুনার ওলেনের কথায় বিশেষ ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ওই বোকা জলহস্তীরা যদি ভুল করেও তাঁবুর ওপরে একখানা পা রাখে তা হলেই তো সব কিছু চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে!
কাকাবাবুর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকা অভ্যোস। তিনি বললেন, এ তো মহা মুশকিল, রাত্তিরে বাইরে বেরুনো যাবে না, এরকম জায়গায় আমি আগে কখনও থাকিনি।
সন্তুও কোনওদিন আটটায় ঘুমোয় না। সে একটু পরে জুতোটুতো খুলে একখানা বই পড়বার চেষ্টা করল। বইটা আগে থেকে এখানে রাখা ছিল। সেটার নাম দ্য হিউম্যান জু। হ্যাজাকের আলোয় খুব ভাল পড়া যায় না।
কাকাবাবুও একখানা বই খুললেন। তারপর আপন মনে বললেন, দিনের বেলা এ-জায়গাটা খুব ভাল, কিন্তু রাত্তিরে যে একবোরে বন্দীদের মতন অবস্থা?
খানিক বাদে তাঁবুর বাইরে থেকে কে যেন অনুচ্চ কণ্ঠে ডাকল, মিঃ রায়চৌধুরী!
মানুষের গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু অত্যন্ত খুশি হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি খাট থেকে নেমে দরজা খুললেন।
হোটেলের সেই কালো ম্যানেজার। হাতে একটা টর্চ। সে বলল, আপনি এত তাড়াতাড়ি ঘুমোন না। আশা করি। আপনার সঙ্গে একটু গল্প করতে এলাম।
কাকাবাবু বললেন, আসুন, আসুন! না, ঘুমোবার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আপনি এই অন্ধকারের মধ্যে একলা এলেন?
জন্তু-জানোয়ারের মুখের সামনে পড়ে গেছি। আমার কিছু হয়নি।
সন্তুও উঠে বসিল। ম্যানেজারটি সন্তুর বিছানার এক ধারে বসে বলল, প্রথম রাতটায় অনেকেরই এখানে ঘুম হয় না। কাল দিনের বেলা ঘুমিয়ে নেবেন?
ম্যানেজারের নাম ফিলিপ কিকুইউ, পয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়স, বেশ গড়গড় করে ইংরেজি বলে। কয়েকটা ভারতীয় শব্দও জানে, যেমন নমস্তে, ধন্যবাদ, রুপিয়া, বিদেশি।
ওর নাম শুনে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কিকুইউ? তার মানে জেমো কেনিয়াটার জাতের লোক?
ফিলিপ সগর্বে বলল, হ্যাঁ, আমরাই এ-দেশের উঁহুরু মানে স্বাধীনতা এনেছি। তুমি জেমো কেনিয়াটা সম্পর্কে জানো?
কাকাবাবু সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, জেমো কেনিয়াটা ছিলেন। এখানকার স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা, এ-দেশ স্বাধীন হবার পর অনেকদিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
ফিলিপ বলল, আমি ইন্ডিয়াতে গিয়ে কিছুদিন পড়াশুনা করেছি। বোম্বাইতে এক বছর ছিলাম। তারপর ইংল্যান্ডে পড়েছি চার বছর।
কাকাবাবু বললেন, তুমি তো বেশ বিদ্বান দেখছি। তা হলে এই জঙ্গলে পড়ে আছ কেন?
ফিলিপ দু আঙুলে তুড়ি দিয়ে বলল, মানি! মানি! আমার অনেক টাকা চাই। এই হোটেলের মালিকরা আমাকে ভাল টাকা দেয়। অনেক টাকা রোজগার করে একদিন আমি নিজেই এরকম একটা হোটেল খুলব। এ-দেশে হোটেলের ব্যবসায়ে খুব লাভ।
কিন্তু এখন তো এই হোটেলটা ভাল চলছে না দেখছি!
হ্যাঁ, একটা বদনাম রটেছে। কিছুদিন বাদেই কেটে যাবে। লোকে ভুলে যাবে।
হঠাৎ বাইরে হুড়মুড় শব্দ হল। কয়েকটা বড় জন্তু ছুটে গেল যেন জানলার সামনে দিয়ে। সন্তু চমকে প্ৰায় লাফিয়ে উঠতেই ফিলিপ তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ভয় নেই, ও একটা ইল্যাণ্ড! এরকম শব্দ সারা রাত শুনতে পাবে। ওই জন্যই তো বললাম, প্রথম রাতে ঘুম হবে না?
সন্তু জিজ্ঞেস করলে, ইলাণ্ড কী?
তোমরা ইল্যাণ্ড দ্যাখোনি? ইলাণ্ডও এক জাতের হরিণ বলতে পারো, তবে এক-একটা প্ৰায় ঘোড়ার চেয়েও বড় হয়, মারলে সাতশো-আটশো কেজি মাংস পাওয়া যায়।
কী করে বুঝলেন ওটা ইল্যাণ্ড? যদি জলহস্তী হয়?
আমি সব জন্তুর পায়ের আওয়াজ চিনি।
কাকাবাবু জানলা দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করলেন। আকাশে চাঁদ নেই, বাইরেটা ঘুটফুটে অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। তবে খানিক দূরে কোনও প্রাণীর নিশ্বাসের ফোঁসফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা ক্রমশ বাড়ল, একসঙ্গে অনেক জন্তুর নিশ্বাস।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওগুলো কী?
ফিলিপ বলল, ওই যে ফোঁসফোঁস করছে? ওরা হচ্ছে এই জঙ্গলের সবচেয়ে নিরীহ আর বোকা প্ৰাণী। ওয়াইল্ড বিস্ট! মুখখানা মোষের মতন, কিন্তু ঘাড়টা লম্বা, তাতে আবার ঘোড়ার মতন কেশর, পেছন দিকটা আবার হরিণের মতন। এক কিম্ভূতকিমাকার জন্তু।
সন্তু বলল, হ্যাঁ, দিনের বেলা দেখেছি।
ফিলিপ বলল, কাল গাড়ি নিয়ে বেরোলে দেখতে পাবে হাজার-হাজার। লক্ষ-লক্ষও বলতে পারো। এই সময় ওরা টানজানিয়া থেকে দল বেঁধে এদিকে আসে, একটা দলের থেকে পঞ্চাশ-একশোটাকে মেরে ফেললেও কিছু এসে যায় না। ওদের মাংস কিন্তু খুব সুস্বাদু!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওদের মারা হয় নাকি?
ফিলিপ বলল, না, না, জন্তু মারা তো এ-দেশে নিষেধ। মাসাইরা লুকিয়েচুরিয়ে মারে। আর সিংহতে মারে। ওয়াইল্ড বিস্ট সিংহদের খুব প্রিয় খাদ্য। শুধু পেটের অংশটা খেয়ে বাকিটা ফেলে দেয়। সেই বাকি অংশ হয়েনারা খায়।
এখান থেকে যে দুজন টুরিস্ট অদৃশ্য হয়ে গেছে, তুমি তাদের দেখেছিলে?
হ্যাঁ, দেখব না কেন? এই তো কয়েক মাস আগের ঘটনা। আমি তখন ছিলাম এখানে।
তোমার কী ধারণা? তারা কী করে হারিয়ে গেল?
ওদের হারিয়ে যাবার একটাই কারণ থাকতে পারে। ওরা রাত্তিরে বেরিয়েছিল। অনেকে তো বেশি-বেশি সাহস দেখাতে চায়। রাত্তিরবেলা পায়ে হেঁটে ঘুরতে গিয়ে যদি এক পাল ওয়াইল্ড ডগের সামনে পড়ে, তা হলে আর চিন্তা নেই। একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
বুনো কুকুররা কি জামাকাপড়ও খেয়ে ফেলবে?
আশ্চর্য কিছু না। ওরা পাঁচ-সাত মিনিটের মধ্যে একটা বড় মোষকে পর্যন্ত শেষ করে দিতে পারে। কিছুই পড়ে থাকে না।
পুলিশ এই থিয়োরি মেনে নিয়েছে?
আর উপায়ই বা কী? কিছুই যখন পাওয়া গেল না, আমরাও তো অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি।
আচ্ছা, সেই টুরিস্ট দুজন একসঙ্গে এসেছিল, না আলাদা-আলাদা? ওদের সঙ্গে তুমি কথা বলেছিলে? ওরা মানুষ কেমন ছিল?
ওরা আলাদা এসেছিল। এখানে দু-তিনদিন থাকার পর বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এমনিতে বেশ ভালই লোক ছিল, হাসিখুশি, ফুর্তিবাজ, বেশির ভাগ টুরিস্ট যেমন হয়। একজন ছিল গায়ক, আর একজন অধ্যাপক। জানো তো, একটা গুজব আছে, এখানকার মাঠেঘাটে নাকি হঠাৎ হিরে খুঁজে পাওয়া যায়, সেই হিরের খোঁজেই ওরা রাত্তিরবেলা বেরিয়েছিল কি না কে জানে?
সত্যি এখানে হিরে পাওয়া যায়?
না, ওটা একেবারেই গুজব। হিরের খনি আছে সাউথ আফ্রিকায়, এখান থেকে অনেক দূরে।
আচ্ছা, আর-একটা কথা শুনেছিলাম। রাত্তিরবেলা এখানে তাঁবুর মধ্যে থাকলেও নাকি কী রকম একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয়। ঘুম আসতে চায় না!
সে ওই জন্তু-জানোয়ারের পায়ের আওয়াজ আর নিশ্বাসের শব্দ তো সারারাত ধরে লেগেই থাকে। সেই জন্য অনেকের ঘুম হয় না।
শুধু ওই? আর কোনও কারণ নেই?
না, আর কী থাকবে?
অনেক টুরিস্ট নাকি ওই জন্য দু-একদিন থেকেই ফিরে যাচ্ছে। সাধারণত এখানে দু-একদিন থাকার জন্যই লোকে আসে। রাত্তিরে ওইসব শব্দ অনেকেরই সহ্য হয় না। অন্যান্য দেশে লোকে সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে একটা-আধটা জন্তু দেখতে পায় কিংবা একটাও পায় না। তোমাদের ইন্ডিয়ার একটা জঙ্গলে আমি বাঘ দেখতে গিয়েছিলাম, গাড়ি নিয়ে, স্পট-লাইট জেলে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুরেও বাঘ দেখতে পাইনি। একটাও না। আর আফ্রিকায় তুমি এইসব জায়গায় এসে প্রথম দিনেই এত জন্তু-জানোয়ার দেখতে পাবে যে, দু দিনেই তোমার জন্তু দেখার শখ মিটে যাবে। তোমরা এখনও কী কী জন্তু দ্যাখোনি বলো? কাল সব দেখাবার ব্যবস্থা করে দেব।
আচ্ছা, এখানে রাত্তিরবেলা গাড়ি নিয়ে কি বেরোনো যায় না?
সে-রকম নিয়ম নেই।
সবাই কি নিয়ম মানে? ধরো, আজ রাত্তিরেই যদি আমি তোমাকে অনুরোধ করি আমাদের চুপিচুপি একটু গাড়িতে করে ঘুরিয়ে আনতে…
নাইরোবি থেকে স্পেশাল পারমিশন না পেলে সে-ব্যবস্থা আমি করতে পারব না। কোনওরকম বিপদ হলে তার দায়িত্ব কে নেবে? গাড়ি নিতে গেলে নদী পার হতে হবে। নদী পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ই অনেক রকম বিপদ ঘটে যেতে পারে। সাপের কামড় খেতে পারো যখন-তখন।
আগে এই হোটেলের অন্য মালিক ছিল। মানে, সেই মালিক এখনও আছে। কিন্তু দুমাস পরে অন্য দুজন মালিক হবে। এই নতুন মালিকদের তোমার পছন্দ?
নতুন মালিকদের মধ্যে একজন আমার আত্মীয়। অশোক দেশাইকেও আমি অনেকদিন ধরে চিনি। আগে আমি অন্য একটা হোটেলের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ছিলাম। ওরা ম্যানেজমেন্ট নেবার পরই আমি ম্যানেজার হয়েছি।
ও, তুমি তা হলে নতুন মালিকদের নিজেদের লোক। সেটা জানতুম না। তা হলে তুমি এই হোটেলের উন্নতির জন্য বেশি চেষ্টা করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। নতুন মালিকরা ভাগ্যবান, তোমার মতন একজন উৎসাহী, কর্মঠ যুবককে পেয়েছে।
ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। আমার দৃঢ় ধারণা, এই হোটেল আবার খুব ভাল চলবে। আমি তা হলে এখন যাই, তোমরা বিশ্রাম নাও। শুভরাত্রি!
ম্যানেজারটির জুতোয় মশামশ শব্দ হয়। সে বেরিয়ে যাবার পরেও খানিকক্ষণ সেই শব্দ শোনা গেল।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, লোকটাকে দেখে তোর কেমন লাগল রে সন্তু?
বেশ ভালই। তবে কথা বলবার সময় কী যেন লুকোবার চেষ্টা করছিল মনে হল।
তুই ঠিক ধরেছিস তো। গভীর জলের মাছ।
হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ক্ৰাচ দুটো বগলে নিয়ে কাকাবাবু ব্যস্তভাবে বললেন, তুই এক কাজ কর, হ্যাজাকটা নে! আমাদের এক্ষুণি বাইরে যেতে হবে।
সন্তু চমকে উঠে বলল, বাইরে যাব? সবাই যে বারণ করল রাত্তিরে বাইরে যেতে।
যা বলছি শোন। দেরি করা ঠিক হবে না। চল চল!
সন্তু কাকাবাবুর অবাধ্য হতে সাহস করল না। কিন্তু তার বুকের মধ্যে ছমছম করছে। তাঁবুর বাইরে উঁকি মেরে সে শিউরে উঠল, একটু দূরেই দুটো চোখ জ্বলজ্বল করছে।
কাকাবাবু সেদিকে টর্চ ফেলে বললেন, ওটা তো একটা জেব্রা। ভয়ের কিছু নেই। আয় আমার সঙ্গে।
সেই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে কাকাবাবু দ্রুত এগিয়ে চললেন। খানিক দূরে আর-একটা তাঁবুর সামনে এসে বললেন, দিনের বেলা লক্ষ করেছি, এটা খালি আছে। চটপট ঢুকে পড়, ভেতরে ঢুকে পড়।
এখানে তালা দেবার কোনও ব্যাপার নেই। জিাপারটা ধরে টানতেই তাঁবুর দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে বিছানা-টিছানা সবই পাতা আছে।
কাকাবাবু ভেতরে এসে টর্চ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পুরো তাঁবুটা পরীক্ষা করে দেখলেন। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললেন, আলোটা খাটের নীচে রেখে দে। শুয়ে পড়। আজকের রাতটা আমরা এই তাঁবুতেই কটাব। বনের হিংস্র প্রাণীর চেয়ে মানুষকেই ভয় বেশি রে!