পর্ব- ৭
পরদিন সূর্যোদয় হলে পাণ্ডবগণ শিখণ্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করতে লাগলো। ভীষ্ম, কৌরবসেনার অগ্রভাগে রইলেন। ভীষ্মের এতোদিনে নিজের জীবনের প্রতি ধিক্কার জন্মেছে। কৌরবদের এই অন্যায় দেখতে দেখতে তার বৃদ্ধ চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গেছে। তিনিও মৃত্যুর জন্য উপযুক্ত মুহূর্তের প্রতীক্ষা করছিলেন। তার পরমপ্রিয় পৌত্র শৌর্য-বীর্যে, ধর্মপরায়ণতায় যার তুলনা কারো সাথে হয় না, যিনি কৃষ্ণের পরম সখা, সেই অর্জুনের নিক্ষেপ করা শরে তার পরমগতি প্রাপ্তি হবে এই লোভটুকু চিরদুঃখী, কুরুবংশের জন্য নিবেদিত প্রাণ ভীষ্ম কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলেন না। তাই তো তিনি পাণ্ডবদের তাঁকে বধ করার উপায় অনায়াসে বলে দিলেন। শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মের প্রতি শরবর্ষণ করতে লাগলেন। শিখণ্ডী ভীষ্মের উপর শর নিক্ষেপ করলে ভীষ্ম শিখণ্ডীর দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বললেন- ‘তুমি স্ত্রীলোক, আমি কোনো স্ত্রীর সহিত যুদ্ধ করি না। বিধাতা তোমাকে শিখণ্ডিনী রূপে সৃষ্টি করেছিলেন, এখনো তুমি তাই আছো। গত জন্মেও তুমি স্ত্রীলোক ছিলে, আর এ জন্মেও তুমি একজন স্ত্রীলোক ভিন্ন অন্য কিছু নও।’ এদিকে অর্জুনের শরবর্ষণে কৌরবসেনা ত্রস্ত হয়ে পালাচ্ছে দেখে দুর্যোধন পিতামহ ভীষ্মের কাছে এসে বললেন,- ‘পিতামহ আমাদের বহু সেনা নিহত, বাকীরা ভয়ে পালাচ্ছে, আপনি রক্ষা করুন।’ ভীষ্ম মুহূর্তকাল চিন্তা করে বললেন- ‘দুর্যোধন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- হয় পাণ্ডবগণকে বধ করবো, না’হয় নিহত হয়ে রণভূমিতে শয়ন করবো। হে গান্ধারীপুত্র, তুমি আমাকে অন্নদান করেছ, তোমার সেই ঋণ আজ শোধ করার সময় এসেছে। এই কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে নিজের প্রাণ দিয়ে তোমার অন্নের ঋণ শোধ করে যাবো।’
শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে শরাঘাত করতে লাগলো। ভীষ্ম ক্ষিপ্রগতিতে বিভিন্ন যোদ্ধাদের অতিক্রম করে অর্জুনের কাছে এলেন। ভীষ্মের মনে হ’লো এ’টাই তার মৃত্যুর উপযুক্ত কাল। ভীষ্ম অর্জুনের সাথে যুদ্ধে বিরত হলেন। অর্জুনের তীক্ষ্ণ শর ভীষ্মকে বিদ্ধ করলো। যে ভীষ্মকে সহস্র বিপক্ষীয় যোদ্ধা কখনো হারাতে পারেনি, সেই ভীষ্মের সারা শরীরে বাণ এমনভাবে গ্রথিত হয়েছে যে, দুই আঙুল পরিমাণ স্থানও আর অবশিষ্ট রইলো না। সূর্যাস্তের কিছু সময় পূর্বে অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পিতামহ মহামহিম ভীষ্ম রণভূমি অনুনাদিত করে রথ থেকে পূর্ব দিকে মাথা রেখে নিপাতিত হলেন। কিন্তু তাঁর সমস্ত শরীর শরে আবৃত থাকায় তিনি ভূমিস্পর্শ করলেন না। দক্ষিণদিকে সূর্য দেখে ভীষ্ম বুঝলেন এখন দক্ষিণায়ন। অর্থাৎ তাকে এখনো উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করতে হবে। তার মৃত্যু যে পিতার বরে ইচ্ছামৃত্যু। তাই তিনি এই ভাবে শরশয্যায় শুয়েই উত্তরায়ণের প্রতীক্ষা করবেন। পিতামহ ভীষ্মকে শরশয্যায় শায়িত দেখে কৌরব-পাণ্ডব উভয়ই তখনকার মতো যুদ্ধে নিবৃিত্ত দিয়ে তাঁকে প্রণাম করে সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। ভীষ্ম বললেন- ‘আমি শরশয্যায় শায়িত, কিন্তু আমার মাথা ঝুলে আছে, আমার মাথায় উপাধান (বালিশ) দাও।’
কৌরবগণ আরামদায়ক নরম উপাধান নিয়ে এলে, ভীষ্ম অর্জুনের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন-
‘এই উপাধান বীরশয্যার উপযুক্ত নয়, তুমি আমাকে বীরশয্যার উপযুক্ত উপাধান দাও।’
অর্জুন তখন গাণ্ডীব থেকে মন্ত্রঃপূত তিন বাণ নিক্ষেপ করে ভীষ্মের মাথা তুলে দিলেন। ভীষ্ম তুষ্ট হয়ে বললেন,
– ‘উত্তরায়ণ আরম্ভ হওয়া পর্যন্ত আমি এই শয্যায় শুয়ে থাকবো। সূর্য যখন উত্তরায়ণে যাবে সেই সময় আমি প্রাণত্যাগ করবো। তোমরা আমার চতুর্দিকে পরিখা খনন করে দাও।’