Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » যে আছে অন্তরালে || Saswati Das

যে আছে অন্তরালে || Saswati Das

ডাউন ট্রেন’টা মোটামুটি ফাঁকাই ছিলো। আমি নামবো দমদম স্টেশনে। ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন ছাড়তেই ওঠার তোড়জোড় করতে লাগলাম। সামনে একজন বাদাম বিক্রেতা বাদাম বিক্রি করছে। লোকটা বেশ বয়স্ক। দেখে আমার খুব মায়া হলো। প্রয়োজন না থাকলেও এক প্যাকেট বাদাম ওর কাছথেকে নিলাম। এর মধ্যে স্টেশন এসে পড়েছে। আমি ব্যাস্ত হয়ে নেমে পড়লাম। বৃদ্ধ বাদাম বিক্রেতাও নেমে ৩নং স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা আপ ট্রেন’টাতে উঠতে যাবে, তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বৃদ্ধ চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে পা পিছলে গেলো। সবার গেলো গেলো রবে, আমিও তাড়াতাড়ি দেখতে গেলাম, দেখি বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার বাদামের প্যাকেট গুলো ইতস্তত ছড়ানো, বৃদ্ধ প্লাটফর্মে পড়ে গেছে, হাত পা ছড়ে গিয়ে রক্ত বেরচ্ছে, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তবে যত না শারীরিক কষ্টে তারথেকেও বেশি তার বেশকিছু বাদামের প্যাকেট নষ্ট হয়ে যাওয়াতে। প্লাটফর্মের লোকজন বৃদ্ধকে ঘিরে ধরে খুব করে ধমক দিচ্ছে –
“এই বয়সে কেউ কাজে বেরোয়? এখন তো তোমার বাড়িতে থাকার বয়স দাদু, তুমি চলন্ত ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করছ? এখনি তো মায়ের ভোগে চলে যেতে! নিজেকে কি সিনেমার নায়ক ভাবছ না-কি দাদু?”
এমন হরেক রকম টিকা টিপ্পনী চারপাশ থেকে ছুটে এসে বৃদ্ধ কে বিদ্ধ করছে। বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা ফ্যাল-ফ্যাল করে সবার মুখের দিকে অপরাধীর মতো তাকাচ্ছে। আমি এতোক্ষণ সব কিছু দেখছিলাম, এবার এগিয়ে গিয়ে বৃদ্ধর হাত ধরে তুলে জিজ্ঞেস করলাম- ‘দাদু তুমি কোথায় থাকো? তোমার বাড়িতে কে কে আছে?’
জবাবে বৃদ্ধ বলল –
‘বাবা আমরা খুব গরীব। আমি বাদাম বিক্রি করে কটা টাকা নিয়ে গেলে সেই টাকা দিয়ে বাজার হবে। না হলে আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে। বাড়িতে আমার বৌ, আর একটা অবিবাহিতা পাগল মেয়ে আছে। আমাদের সংসারে আমিই একমাত্র রোজগেরে। বৌয়ের ও বয়স হয়েছে তাছাড়া মেয়েটাকে কে দেখবে? তাই ওকে রেখে বাড়ি থেকে বেরতে পারে না। ওই ট্রেনটায় উঠতে পারলাম না, এখন এক ঘন্টা আমাকে বসে থাকতে হবে বাড়ি ফেরার ট্রেনের অপেক্ষায়। আমি রোজই ওই ট্রেনটাতে বাড়ি ফিরি। আজকে ডাউন ট্রেনটা একটু দেরি করায় ওই ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেছে, তাই চলন্ত ট্রেনে উঠতে যাচ্ছিলাম..’
‘দাদু তোমার ছেলে নেই?’
‘আছে, দু’টো ছেলে আছে। দু’জনকেই লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছি। তারা বড় চাকরি করে। একজন কলকাতায় ফ্লাটে থাকে। আর একজন চেন্নাই থাকে। ওখানকার একটা মেয়েকে বিয়ে করেছে, ও কলকাতায় আসে না।’
আমি জিজ্ঞেস করলাম –
‘যে কলকাতায় থাকে সে আসে?’
এই কথায় বৃদ্ধর মুখটা খুব করুণ দেখালো, স্পষ্ট বোঝা গেলো অনেক কষ্ট বুকে চেপে রেখেছে। বলল-
“আমরা তাদের সমাজে পরিচয় দেওয়ার মতো না, তাই তারা এখানে আসে না। মাঝেমধ্যে কিছু টাকা পাঠায় তাই দিয়ে মেয়েটার চিকিৎসাটা কোনরকম হয়। আমি কাজ না করে কি করবো বলো? আমাদের পেটের জ্বালা মেটাবে কে! আমি ছাড়া?’
বৃদ্ধর কথায় আমার চোখটা নিজের অজান্তেই একটু জ্বালা করে উঠলো, হে ভগবান! আমি হাজার চেষ্টা করেও বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারলাম না আর এরা বাবাকে মরতে ছেড়ে দিয়েছে। জীবনে হয়তো এরাই সুখে থাকে। মনে পড়ছে বাবাকে নিয়ে আ্যম্বুলেন্সে করে ছোটাছুটির দিন’টার কথা। কোনো হসপিটালে সিট নেই শেষে একটা হাসপাতালে যদিও বা সিট পাওয়া গেলো ততক্ষণে বাবা কোমায় চলে গেছে। ডাক্তার বলল “কোনো আশা নেই, তবু যদি কোনো মিরাকল্ ঘটে তবে উনি বেঁচে যেতে পারেন।”
না! সেদিন কোনো মিরাকল্ ঘটেনি, বাবাকেও ফেরাতে পারিনি! আজ হয়তো সেই কারণেই আমি একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম।
পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালা’কে বললাম-
“তোমার তো অনেকগুলো বাদামের প্যাকেট নষ্ট হয়ে গেলো এই টাকাটা রাখো,আর চলো আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দিচ্ছি। “
উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন –
“না না বাবা তুমি ব্যস্ত হয়েওনা। আমাদের জীবন এ ভাবেই কেটে যায়। আমি ঠিক চলে যেতে পারবো।আর টাকা! না বাবা তুমি কিছু মনে করোনা, আমি হাত পেতে করো কাছ থেকে একটা টাকাও নিতে পরবো না। তবু তুমি যে বললে এটুকুই বা কে কার জন্য ভাবে। তোমার মঙ্গল হোক।”
বৃদ্ধ তার বাদামের চেন গুলো গলায় ঝুলিয়ে প্ল্যাটফর্মের সামনের দিকে হেঁটে যেতে লাগল । বয়সের ভারে এবং পায়ে চোট লাগার জন্য একটু খুড়িয়ে হাঁটছেন ঠিকই কিন্তু অন্তরের দৃঢ়তায় তার ঝুঁকে পড়া শরীরটা যেন ঋজু, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম বাড়ি ফেরারা কথা! হঠাৎ একটা পরিচিত কন্ঠে চেতনা ফিরলো-
আরে দাসবাবু যে! এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কারো অপেক্ষা করছেন না-কি ?”
কথায় যেন একটা বাঁকা ইঙ্গিত স্পষ্ট-
এরা যেন চেনা গন্ডির বাইরে বেরোতেই পারে না।
মুখে বললাম-
“আরে না না, এই তো এখন যাবো ।”
উনি আমার দিকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন
” বাড়ি যাবেন তো?”
বললাম-
“হ্যাঁ বাড়ি যাবো।”
পথে যেতে যেতে উনি আমার সাথে অনেক কথা বলে চলেছেন, কিন্তু আমার কোন কথাই এখন কানে ঢুকছে না; সারাটা পথ আমার চোখের সামনে বৃদ্ধ ফেরিওয়ালার চেহারাটা ভাসছিল, কি আত্মসম্মান বোধ, হয়তো এই মূল্যবোধ-ই ওনাকে এই বয়সেও দৃঢ় রাখতে সাহায্য করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *