Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » নিরুদ্দেশের দেশে || Sunil Gangopadhyay

নিরুদ্দেশের দেশে || Sunil Gangopadhyay

যারা জীবনে কখনো দিকশূন্যপুরে যায়নি, কিংবা সে জায়গাটার নামও শোনেনি, তারা বুঝতে পারবে না তারা কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যার অস্তিত্বই জানা নেই, তাকে না–পাওয়ার তো কোনো দুঃখ থাকে না। কিন্তু যারা দিকশূন্যপুরে একবার গেছে, কিন্তু বারবার ফিরে যেতে পারেনি, তাদের অতৃপ্তির শেষ নেই।

আমি মাঝে মাঝে সেই জায়গাটার কথা ভাবি, কিন্তু আমারও যাওয়া হয়ে ওঠে না। কেউ আমাকে ডেকে নিয়ে যায় দক্ষিণে, কেউ উত্তরে। এই তো কয়েকদিন আগে নিলয়দার সঙ্গে নর্থ বেঙ্গল ঘুরে এলুম, সেখানে সামসিং ডাক– বাংলোয় নিলয়দার পা ভাঙল। তার আগে প্রবালের সঙ্গে যেতে হলো পুণায়। সেখানে ফেরার ট্রেনের টিকিট হারিয়ে ফেলে কী কাণ্ড! প্রবাল সব দোষটা চাপিয়ে দিলে আমার ঘাড়ে। আমার জামার পকেট ফুটো ছিল, তা কি আমি জানতুম? প্রবালের কাছে আর যা টাকা বাকি ছিল, তাতে মাত্র একজনের ফেরার ভাড়া হয়। প্রবাল আমায় বলেছিল, তুই থেকে যা, আমার জরুরি কাজ আছে, ফিরতেই হবে!

আমি যেন একটা ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। বন্ধুবান্ধব, চেনাশুনো যার যখনই বাইরে কোথাও চাকরির ইন্টারভিউ কিংবা অন্য কাজে যাবার দরকার হয় কিন্তু একা যেতে ইচ্ছে হয় না, তখনই সে এসে আমাকে বলে, এই নীলু, চল, চল, একটা ব্যাগ গুছিয়ে নে, বেড়াতে যাবি আমার সঙ্গে! আমার যখন–তখন বেরিয়ে পড়তে ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু সব সময় তো ইচ্ছে না–ও করতে পারে? কিন্তু আমার মৃদু আপত্তি জানাবারও উপায় নেই। কিছু বলতে গেলেই ওরা ধমক দেয়, ধ্যাৎ, তুই বেকার বসে আছিস, তোর আবার কাজ কী রে? আমরা তোর ট্রেন ভাড়া দেব, হোটেলে এক ঘরে থাকবি, তোর তো কোনো পয়সা খরচাই নেই। যেন বিনা পয়সায় ট্রেন যাত্রা আর হোটেলের খাদ্য ভক্ষণ করাই আমার জীবনের মোক্ষ।

আজ সকালবেলা ঘুম ভেঙে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি সাদা–কালো মেলানো একটা বেশ বড় পাখির পালক পড়ে আছে। পালকটা তুলে নিতেই বুকের মধ্যে কেমন যেন শিরশির করে ওঠে। এটা কোন্ পাখির পালক, আমি চিনি না। পালকটা নিয়ে গালে একটু ছোঁয়াতেই আমার দিকশূন্যপুরের কথা মনে পড়ে যায়। কেউ যেন সেখান থেকে আমাকে ডেকেছে।

দিকশূন্যপুরে কোনো পোস্ট অফিস নেই, সেখানকার লোকেরা চিঠিপত্র লেখে না। এরকম তো অনেক গ্রামেগঞ্জেই এখনো পর্যন্ত পোস্ট অফিস খোলা হয়নি, কিন্তু সেইসব জায়গাগুলো তো আর সৃষ্টিছাড়া হয়ে থাকেনি, কোনো রকমে চিঠিপত্র যাওয়া–আসার একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছেই। তাহলে দিকশূন্যপুরের মানুষ কি পায়রা বা হাঁস উড়িয়ে তাদের বার্তা পাঠায়? না, না, না, সেরকম কিছু না। দিকশূন্যপুরে একটুও ইতিহাসের গন্ধ নেই।

তবু, সকালবেলার মেঘলা আকাশ, কচি কলাপাতা রঙের আলো আর পলিমাটির মতন ঠাণ্ডা নিস্তব্ধতার মধ্যে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই একটা পাখির পালক চোখে পড়লে মনে হয় না, কোনো একটা জায়গা থেকে ডাক এসেছে? এটা খুবই গোপন অনুভূতি, কারুকে জানাবার মতন নয়।

একবার ভাবলুম পালকটাকে রেখে দেব আমার কোনো প্রিয় বইয়ের ভাঁজে। কিংবা, ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখলে কেমন হয়? তারপর মনে হলো, নাঃ, এটা জমিয়ে রাখবার জিনিস নয়। আমি বারান্দার বাইরে হাত বাড়িয়ে গ্যালিলিও–র মতন পালকটাকে ছেড়ে দিলুম বাতাসে, সেটা পাক খেয়ে ঘুরতে ঘুরতে চলে গেল নিচে।

অমনি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল বন্দনাদির মুখ।

খানিকক্ষণ সামনের বাড়ির ফুলের টব সাজানো ছাদের ওপরের শূন্যতায় বন্দনাদির মুখখানি বসিয়ে নিঃশব্দে কথা বললুম তাঁর সঙ্গে। বন্দনাদির কপালটা রোদ–পড়া নদীর জলের মতন।

তখনি ঠিক করলুম, আজ আর খবরের কাগজ পড়ব না। রেডিও শুনব না। পাশের বাড়িতে সুজিতবাবু ও তাঁর স্ত্রী দ্বৈত ঝগড়া–ঝংকার শুরু করলে কান বন্ধ করে রাখব। ইচ্ছে মতন কান বন্ধ করার একটা নিজস্ব কায়দা আমার আছে। আজ একটি ভিখিরিকে আমার একটা পুরোনো জামা দিতে হবে।

দিকশূন্যপুর তো অনেক দূর, তার আগে একবার যেতে হবে বেকবাগানে।

মুড়ি–ডিমভাজা আর চা খেয়ে বেরুতে যাচ্ছি, মা জিজ্ঞেস করল, এত সাত তাড়াতাড়ি হুড়োহুড়ি করে কোথায় যাচ্ছিস? জামার বোতামটা পর্যন্ত লাগাস নি!

একটা খাঁকি রঙের খাম উঁচু করে দেখিয়ে আমি সুর করে বললুম, চা–ক– রি–র ই–ন্টা–র–ভি–উ!

এই খাঁকি খামটা বেশ উপকারী। আমার এক জামার পকেট থেকে আরেক জামার পকেটে নিয়মিত যাতায়াত করে। অনেক জায়গাতেই এটা দেখিয়ে নানারকম সুবিধে পাওয়া যায়।

আগে ইন্টারভিউ–এর দিন মা আমার পকেটে ঠাকুরের ফুল–বেলপাতা খানিকটা গুঁজে দিত। শততম ইন্টারভিউ পার হয়ে যাবার পর আর মা উৎসাহ পায় না। আমাদের মায়ের জেনারেশানও এখন বুঝে গেছে যে একালে চাকরি– বাকরি পাওয়ার ব্যাপারে ঠাকুর–দেবতাদের কোনো হাত নেই।

কলকাতা শহর আজ স্নান করে সেজেগুজে আছে। রাস্তায় অনেক চলমান ছাতা। এই রকম ইলশেগুঁড়িতে আমার মাথায় বেশ আরাম হয়। কাল রাত্তিরের জোরাল বৃষ্টিতে কোথাও কোথাও জল জমে আছে। আমার পায়ে রবারের চটি, কোনো অসুবিধে নেই। প্যান্টটা একটু উঁচু করে নিলেই হলো। এরকম চটি পরে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছি, তাতেও মা–র সন্দেহ হলো না। আজকাল সবই চলে। অবশ্য সে–রকম চাকরিতে আমি কোনোদিনই ডাক পাব না, যাতে টাই আর মোজাওয়ালা জুতো পরে দর্শন দিতে হয়।

ট্রামে–বাসে এখনো অফিস যাত্রীদের ভিড় শুরু হয়নি। স্কুলের ছেলে– মেয়েরাই যাচ্ছে এখন। সকালবেলা কিশোর–কিশোরীদের ঝলমলে মুখ দেখলে চোখ ভালো থাকে। বেশি বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেওয়া এখন মায়েদের ডিউটি। সুতরাং এখন রাস্তায়, চলন্ত রিক্সায়, বাস স্টপে প্রচুর যুবতী মা। হ্যাঁ, যুবতী মায়েদের দেখলেও চক্ষু ও হৃদয় প্রসন্ন হয়।

ইংরিজি স্কুলগুলি শুরু হয় তাড়াতাড়ি, বাংলা স্কুলগুলো দেরিতে। আমাকে তাড়াতাড়িই যেতে হবে।

বেকবাগানে ট্রাম থেকে নেমে দেড় মিনিট হাঁটলেই তপেশদার বাড়ি। বসবার ঘরে তপেশদা এখনো খবরের কাগজ পড়ছেন, ভেতরে কোনো ঘরে তারস্বরে চিৎকার করছে মাইকেল জ্যাকসন। আজকাল অধিকাংশ বাড়িতে গেলেই, সকালে দুপুরে বা সন্ধেয়, মাইকেল জ্যাকসনের গলা শুনতে হবেই। বীটলরাও ফিরে এসেছে।

তপেশদা কাগজটা নামিয়ে ভরাট গলায় বললেন, কী নীলু মাস্টার, কী খবর?

মাস্টার কথাটার মানে এই নয় যে আমি এ বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াই। ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীদের পড়াবার বিদ্যেই আমার নেই। ওটা তপেশদার আদরের সম্বোধন।

একটা সোফায় বসে পড়ে আমি জিজ্ঞেস করলুম, আজ আপনার অফিস নেই?

তপেশদা একটা বেশ ভালো কোম্পানির বিক্রি–বিভাগের মাঝারি সাহেব। প্রায়ই তাঁকে গৌহাটি–পাটনা–ভুবনেশ্বরে সফরে যেতে হয়। কলকাতায় থাকলেও কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত হবার বাধ্যবাধকতা নেই। ওঁর হয়তো কোনো শাঁসালো মক্কেলের সঙ্গে আজ গ্র্যাণ্ড হোটেলে লাঞ্চ খাবার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে, যা খুশি খাবেন, বিলের টাকা দেবে কোম্পানি। তারপর উনি ঢেঁকুর তুলতে তুলতে অফিস যাবেন। আরামের চাকরি আর কাকে বলে! প্লেনে চেপে বেড়ানো আর গ্র্যাণ্ড হোটেলে লাঞ্চ। আমায় এই চাকরি কেউ দেয় না? জিনিস বিক্রি করা আর কী শক্ত। আমায় কেউ তাজমহলটা বিক্রি করে দিতে বলুক না…।

তপেশদা বললেন, হ্যাঁ, যাব এখন! তারপর তোমার খবর–টবর কী? কাজ– টাজ পেলে কিছু?

–আপনি তো দিলেন না কিছু ব্যবস্থা করে।

–তোমায় বললুম, টাইপিং শিখে–টিখে নাও!

অর্থাৎ আমায় উনি কেরানিগিরিতে বসাতে চান। নিজে ঘুরবেন প্লেনে প্লেনে, আর আমি অফিসে রোজ এক চেয়ারে বসে টাইপ মেশিনে খটাখট করব? ঐ ফাঁদে আমি পা দিচ্ছি আর কি!

—আমি দুটো জায়গা থেকে অফার পেয়েছি। একটা কিছু হয়ে যাবে।

বেশি কৌতূহল না দেখিয়ে তপেশদা বললেন, ভালো, ভালো! উনি বুঝলেন আমি চাকরির উমেদারিতে আসিনি। তবু ওঁর চোখে খানিকটা কৌতূহল লেগে রইল।

আজকাল বিনা কারণে কেউ কারুর বাড়িতে যায় না। একটা কিছু উদ্দেশ্য বা উপলক্ষ থাকে। তপেশদা সেইটা বুঝতে চাইছেন, কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতেও পারছেন না। অন্য পার্টিকে কিছুক্ষণের জন্য ধাঁধায় রেখে দেওয়াই আমার স্বভাব।

মাইকেল জ্যাকসন অকস্মাৎ থেমে গেল ভেতরে। শোনা গেল অল্পবয়েসী মেয়েদের গলা। ওরা স্কুলে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। তিনজনের স্কুলই কাছে।

তপেশদা আবার খবরের কাগজটা তুলতে যাওয়ার ভঙ্গি করে বললেন, পাঞ্জাবের ব্যাপার–স্যাপার দেখেছ?

যেহেতু আজ আমি খবরের কাগজ থেকে দূরে থাকব, তাই সঙ্গে সঙ্গে প্ৰসঙ্গ পাল্টাবার জন্য বললুম, তপেশদা, আপনি বেশ রোগা হয়ে গেছেন কিন্তু! চেহারাটা খুব সুন্দর ফিট রেখেছেন!

চল্লিশের পর যাদের চেহারা ভারির দিকে যেতে শুরু করে তারা সবচেয়ে খুশি হয় এইরকম কথা শুনলে। তপেশদা লজ্জা লজ্জা ভাব করে বললেন, আমার নিজস্ব একটা সিস্টেম আছে, বুঝলে…।

তপেশদার চুলে সামান্য পাক ধরেছে, তবু তাঁকে এখনো যুবকের মতনই দেখায়। অতি–ভ্রমণের কিছুটা ক্লান্তির ছাপ তাঁর চোখের নিচে। তপেশদা দিকশূন্যপুরের নাম শোনেননি।

তিন মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকলেন অৰ্চনাদি। বর্নালী, শ্রাবণী আর রূপসা। তেরো থেকে সাত। এর মধ্যে রূপসাই সবচেয়ে ছোট, সে অর্চনাদির নিজের মেয়ে নয়।

অর্চনাদি তপেশদাকে বললেন, আমি তাহলে ঘুরে আসছি। বুঝলে?

তারপর আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী নীলু, কখন এসেছ?

—এই তো একটু আগে।

শুধু যে মেয়েদের স্কুলের জন্য সাজিয়েছেন তাই–ই না, অর্চনাদি নিজেও বেশ সেজেছেন। আটপৌরে শাড়ি পরে আর চুলটুল না আঁচড়ে তো মেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিতে যাওয়া যায় না। তাও অর্চনাদি যাবেন গাড়িতে। কোনো কোনো মা–বাবাকে আমি ট্যাক্সি করেও ছেলেমেয়েদের স্কুলে পৌঁছে দিতে দেখেছি। কে বলল, এ দেশটার কোনো উন্নতি হয়নি?

আমি রূপসাকে ভালো করে লক্ষ্য করলুম। বেশ হাসিখুশিই তো রয়েছে। স্বাস্থ্যও ভালো। নাকটা যেন একটু লালচে। তা বাচ্চাদের সর্দি হবে না?

তিনটি মেয়েরই চোখে চোখে তাকিয়ে আমি চেনা হাসি দিলুম। রূপসাকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমার গান শেখা চলছে?

রূপসা লাল–রিবন বাঁধা মাথাটা দুলিয়ে বলল, হ্যাঁ।

রূপসার মুখে তার মায়েরই মুখের আদল।

অর্চনাদি বলল, পৌনে নটা বাজে। চল, চল, দেরি হয়ে গেছে। নীলু, তুমি বসো!

তারপর স্বামীকে: তোমার গাড়িটা এক্ষুনি দরকার নেই তো? আমি একটু গড়িয়াহাট ঘুরে আসব।

তপেশদা উদারভাবে বললেন, দয়া করে এগারোটা–ট্যাগারোটার মধ্যে ফিরো! ওরা বেরিয়ে যাবার পর তপেশদা জিজ্ঞেস করলেন, নীলু, তুমি চা–টা কিংবা কফি–টফি কিছু খাবে–টাবে?

—কফি খেতে পারি।

কফি যে চায়ের থেকে আমার বেশি প্রিয় তা নয়। কফি বলার কারণ ওটা তাড়াতাড়ি বানানো যায়।

তপেশদা বললেন, তুমি বসে কাগজ–টাগজ দ্যাখো–ট্যাখো। আমি একটু আসছি!

তপেশদা সব সময়ে দ্বিত্ব দিয়ে কথা বলেন। খবর–টবর, কাগজ–টাগজ, টাকা– ফাকা, সিগারেট–টিগারেট। জিনিস বিক্রি করা যাদের কাজ তাদের বোধহয় সব কিছুই দু’বার বলতে হয়।

ক্যালেণ্ডারে একটা স্নিগ্ধ হ্রদের ছবি। খুব সম্ভবত সুইটসারল্যাণ্ডের। উঠে গিয়ে দেখলুম ছবিটা আন্দামানের। ভালো দৃশ্য দেখলেই কেন আমাদের বিদেশের কথা মনে পড়ে?

এ বাড়ির কাজের ছেলেটি কফি এনে দিল। তা বলে এত তাড়াতাড়ি। গরমজল বোধহয় তৈরিই ছিল। হাপুস হুপুস শব্দে আমি কফি শেষ করতে লাগলুম।

তপেশদা ফিরে এসে বললেন, এবারে নীলু মাস্টার, তোমার কথা–টথা শুনি।

আমার প্রয়োজন মিটে গেছে, আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললুম, তপেশদা, আমি এবারে চলি! পরে আবার আসব!

তপেশদার মুখে একটা গভীর বিস্ময় ঝুলে রইল। আমি চাকরির উমেদারি করিনি, ধার চাইনি, এমনকি তপেশদার একটা সিগারেট পর্যন্ত নিইনি। তপেশদার বৃত্তের মধ্যে এরকম কেউ আসে না।

বাইরে বেরিয়ে আমি বাড়িটার দিকে একবার ফিরে তাকালুম। ছিমছাম দোতলা বাড়ি, তপেশদাদের পৈতৃক।

এই বাড়িটাকে আজকাল আমার কাকের বাসা মনে হয়। কাকের বাসায় কোকিলের ছানা মানুষ হচ্ছে। না, না। তপেশদা বা অর্চনাদির সঙ্গে আমি কাকের তুলনা দিতে চাই না, ওঁরা দু’জনেই বেশ ভালো। গলার আওয়াজও তেমন খারাপ নয়। কিন্তু অর্চনাদির ছোটবোন বন্দনাদি সত্যিই কোকিলের মতন। বন্দনাদি একজন শিল্পী এবং তাঁর চরিত্রে খাঁটি বোহেমিয়ানা আছে।

রূপসার যখন তিন বছর বয়েস, তখন বন্দনাদি ওকে নিজের দিদির বাড়িতে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তারপর থেকে তপেশদারা তার কোনো রকম সন্ধান পাননি।

আমার দ্বিতীয় গন্তব্য মনোহরপুকুর।

অজিতকাকা রিটায়ার করলেও নিজেকে সবসময় ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসেন। তাঁকে বাড়িতে নাও পাওয়া যেতে পারে কিন্তু কাকিমা থাকবেন। নারী জাতির এক প্রথম শ্রেণীর প্রতিভূ এই লীলা কাকিমা। পৃথিবীতে জীবাণুশূন্য জল যেমন দুর্লভ, তেমনই দুর্লভ আত্মগ্লানিহীন নারী। অধিকাংশ মেয়েকেই আমি কখনো না কখনো বলতে শুনেছি, তাদের জীবনে যা পাওয়ার কথা ছিল, তার প্রায় কিছুই পাওয়া হলো না। লীলা কাকিমার জীবনে আমি এরকম মনোভাব মুহূর্তের জন্যও দেখিনি। এমনকি দু’একবার চরম সঙ্কটের সময়েও। এমন মানসিক স্থৈর্য তিনি কোথা থেকে পেয়েছেন কে জানে! লীলা কাকিমার কথা আমি যখনই ভাবি, তখনই একবার মনে মনে বলি, রিমার্কেবল লেডি! কেন যে ইংরিজিতে বলি কে জানে! বাংলায় কী বলা যায়? মহীয়সী রমণী? নাঃ, এটা বড্ড দেবী দেবী শোনায়! লীলা কাকিমা সাধারণের মধ্যেই অসাধারণ!

বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, পেছন থেকে কে যেন বলল, হ্যালো, ওল্ড বয়!

চমকে ফিরে তাকিয়ে, পুলকিত বিস্ময়ে দেখলুম রফিককে। এ যে মেঘ না চাইতেই জল! রফিকের বাড়িতে যাওয়ার কথা আমি একবার চিন্তা করেছিলুম বটে, কিন্তু সেটা আজকের প্রোগ্রামে ঠিক আঁটানো যাবে না। যদিও রফিকের বাড়ি কাছেই। রফিক বিয়ে করার পর ওর বাড়িতে আর বিশেষ যাওয়াই হয়নি।

এই বাদলার দিনেও রফিক দুধসাদা ট্রাউজার্সের সঙ্গে মেরুন রঙের হাওয়াই শার্ট পরেছে, তার ওপর একটা পাতলা রেন কোট। মানিয়েছে চমৎকার। একেবারে সাহেবদের মতন দেখাচ্ছে। জুতোর পালিসও নিখুঁত।

রফিক সাধারণত দশটার আগে বিছানা থেকে ওঠে না। আজ যে সে ন’টার মধ্যেই সেজেগুজে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে কলকাতা শহর ধন্য হয়ে গেছে। বিয়ে করলে মানুষ কোনো না কোনো ভাবে বদলাবেই। তবে, আশা করি রফিক এখন ভিড়ের ট্রাম–বাসে উঠবে না। রফিক একবার বলেছিল, অচেনা পুরুষ– মানুষদের গায়ের গন্ধ সহ্য করতে পারে না সেইজন্যই সে কোনো অচেনা মানুষের এক হাত দূরত্বে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না।

—কী রে, রফিক। কোথায় যাচ্ছিস?

আমার কথার উত্তর না দিয়ে রফিক হাত তুলে একটা ট্যাক্সি থামাল। তারপর বলল, তুই কোথায় যাবি? চল, নামিয়ে দিচ্ছি।

আমি যাব দক্ষিণে, রফিক যদি সুদূরতম উত্তরেও যায়, তা হলেও ওর আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে লাভ নেই। কতটা ঘুরে যেতে হবে না হবে, রফিক সেকথা চিন্তাও করবে না। তার বনেদিয়ানা এ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। পৃথিবী যদি একদিকে ধ্বংস হয়ে যেতেও শুরু করে, তবু রফিক তার আদবকায়দা ছাড়বে না।

ট্যাক্সিতে ওঠবার পর আমি জানালার কাচ নামাতে যাচ্ছি, রফিক মাথা নেড়ে নিষেধ করল আমাকে। পকেট থেকে বিলিতি সিগারেটের প্যাকেট বার করে প্রথমে একটা আমাকে দিল, তারপর লাইটার জ্বেলে দু’জনের সিগারেট ধরাবার পর বলল, এবার নামাতে পারিস। এইসব লাইটারগুলো শীতের দেশের জিনিস তো। তাই একটুও হাওয়া সহ্য করে না!

এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে রফিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে বেশ কয়েক মুহূর্ত। যেন সে আমার অন্তস্থল দেখার চেষ্টা করছে।

তারপর ওর সুন্দর পাতলা ঠোঁটে প্রায় অদৃশ্য একটা হাসি ফুটিয়ে, সম্পূৰ্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে বলল, তুই আমার বউকে আগে ভালোবাসতিস, সেইজন্যই আমার বিয়ের পর তুই আর আমাদের বাড়িতে আসিস না, তাই না?

প্রতিবাদ করা নিরর্থক। এখন রফিকই কথা বলবে এবং ওর মতামতটাই প্রাধান্য পাবে। বিয়ের আগে রফিকের স্ত্রী রোমিকে আমি মাত্র তিনবার দেখেছি, তার মধ্যে দু’বার কোনো কথাই হয়নি, তৃতীয়বার সব মিলিয়ে ছ’–সাতটা বাক্য বিনিময় হয়েছে মাত্ৰ।

আমি বললুম, তুই ঠিক বলেছিস। তুই এই বিশ্বের সুন্দরীশ্রেষ্ঠাকে বিয়ে করবি, তাতে আমার হিংসে হবে না?

রফিক শুকনো ভাবে হাঃ হাঃ করে হাসল। তারপর বলল, ঠিক আছে, দুটো বছর কাটতে দে। দু’বছর পার হয়ে যাক, তারপর তুই রোমির সঙ্গে যত ইচ্ছে প্রেম করিস!

–ওরে বাবা, দু’বছর অপেক্ষা করতে হবে? কেন?

– তা তো হবেই! ম্যারেজ ইজ আ টু ইয়ার্স লং পিকনিক! এই দু’বছর স্বামী– স্ত্রী একেবারে কপোত–কপোতী। তারপর তো রোজকার দানাপানি। তখন বউ কারুর সঙ্গে টুকটাক প্রেম করল কিংবা স্বামী অন্য মেয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটাল, এতে কিছু যায় আসে না। তবে, সংসারের শান্তিটা রাখতে পারলেই ভালো।

রফিক এই অদ্ভুত তত্ত্বটা কোথা থেকে জোগাড় করল কে জানে। কিন্তু এমন জোর দিয়ে বলল যেন এর ওপরে আর কোনো কথা চলে না। রোমিকে বিয়ে করবার জন্য ও কত কাণ্ডই না করেছে। সেই উন্মাদনার আয়ু মাত্র দু’বছর! আমার হাসি পেল। আমি রোমির সঙ্গে দু’বছর বাদে প্রেম করব? ততদিনে ও আমার নামটাও মনে করতে পারবে কিনা সন্দেহ!

খানিকক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থেকে রফিক আবার হঠাৎ বলল, ও হ্যাঁ, ভালো কথা। আম্মা প্রায়ই তোর কথা বলেন! আম্মা তো একতলার ঘরে থাকেন, তুই আমার কাছে না গেলেও একদিন তো আম্মার সঙ্গে দেখা করলে পারিস?

—হ্যাঁ, যাব। কেমন আছেন আম্মা?

—ওরকম আলগা ভাবে হ্যাঁ যাব বলিস না। শিগগিরির মধ্যে একদিন আয়! তুই তো জানিস, আম্মা তোকে দেখলে কত খুশি হন?

রফিকের আম্মার চোখে রফিকের দিদির স্বামী, অর্থাৎ আমাদের সকলের মুরাদ দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার চেহারা ও মুখের খুব মিল আছে। সকলেরই ধারণা মুরাদ দুলাভাই কোনো দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, যদিও তাঁর লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। রফিকের দিদি অবশ্য এখনো আশা ছাড়েননি, তিনি প্রতীক্ষায় আছেন যে মুরাদ সাহেব একদিন ফিরে আসবেনই

আমি বললুম, যাব, নিশ্চয়ই খুব শিগগির একদিন যাব!

—আবার আলগা ভাবে নিশ্চয়ই যাব বলছিস? আমি তোকে চিনি না? ঠিক কবে যাবি বল!

–তুই আমাকে এত বকছিস কেন, রফিক?

—আই য়্যাম সরি। সত্যি দুঃখিত, নীলু। আই সাপোজ আই য়্যাম ইন ব্যাড .মুড দিস মর্নিং!

–কেন, কী হয়েছে?

নিরুদ্দেশের দেশে

উত্তর না দিয়ে রফিক ফরাসি কায়দায় কাঁধ ঝাঁকাল।

–তোর দিদি কেমন আছেন রে?

—তা আমি কী করে জানব? দিদি আছে দিদির মতন। কে কী রকম থাকে তা কি অন্য কেউ বলতে পারে?

–কোথায় যাচ্ছিস তুই এই সাতসকালে?

এবারে রফিক কৌতুকের ভঙ্গিতে বাঁ দিকের চোখ টিপে মুচকি হেসে বলল, জীবিকা! হার্ড রিয়েলিটি। তুই তো বিয়ে করিসনি, তুই এসব বুঝবি না!

রফিক আমাকে ত্রিকোণ পার্কের শেষপ্রান্তে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। কারণ আমি ওখানেই নামতে চেয়েছি। আমি ঠিক কোন্ বাড়িতে যাব তা রফিক জানতে চায়নি একবারও। ছেলেটার এইসব গুণ সত্যিই মনে রাখার মতন।

যা ভেবেছিলুম তাই–ই, অজিতকাকা বাড়িতে নেই। তিনি ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট বিক্রির এজেন্সি নিয়েছেন, সেইজন্য সকাল থেকেই তিনি পরিচিত সার্কেলে ঘুরে বেড়ান। লীলা কাকিমা চোখে চশমা এঁটে সেলাই মেশিন নিয়ে বাচ্চাদের জামাকাপড় সেলাই করছিলেন, আমাকে দেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন। তাঁর চোখে কৌতূহল। কিন্তু তিনি তপেশদার মতন দ্বিধা করলেন না। পরিষ্কার গলায় বলেন, এসো নীলু, বসো। এই সেলাইটা শেষ করে নিই, কেমন? হঠাৎ এসে উপস্থিত হলে যে? নিশ্চয়ই তোমার কোনো উদ্দেশ্য আছে।

মিথ্যে প্রধানত দু’রকম। সাদা আর কালো। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিংবা অন্যের ক্ষতি করবার জন্যই কালো মিথ্যের ব্যবহার। আর সাদা মিথ্যে নিয়ে কৌতুক হয়, কখনো কখনো পরের উপকারেও লেগে যায়।

আমি সাদা, কালো, খয়েরি, বাদামি, বেগুনি ইত্যাদি সব রকম মিথ্যেতেই ওস্তাদ। তবে যাদের মনটা সাদা, তাদের সামনে কখনো কালো মিথ্যে বলি না। এইটুকু মাত্র নীতিবোধ আমার আছে।

লীলা কাকিমার প্রশ্নের উত্তরে আমি বিনা দ্বিধায় বললুম, আপনাকে দেখতে এসেছি শুধু!

চশমাটা খুলে, সদ্য পানা পরিষ্কার করা পুকুরের রহস্যময় গভীরতার মতন হেসে তিনি বললেন, কেমন দেখছ?

লীলা কাকিমার বয়েস আমার ঠিক দ্বিগুণ। এখনো মুখের চামড়া কুঁচকোয় নি। দৃষ্টি স্বচ্ছ। তিনি একটা সাদা খোলের চওড়া নীল কারুকার্যময় পাড়ের শাড়ি পরে আছেন, তবু তাকে যেন এখনো ঝলমলে ছাপা শাড়িতে মানাত।

আমার যখন পনেরো বছর বয়েস, তখন মনে হতো তিরিশ বছর বয়েসের লোকেরাই তো সব বুড়ো। শুধু চাকরি–বাকরি করে, নিছক কাজের কথা ছাড়া আর কিছু জানে না। এখন সাতাশ বছরে পৌঁছে দেখছি, পঞ্চাশ–পঞ্চান্ন বছর বয়েসের লোকরাও তো তেমন কিছু বুড়ো বা অপদার্থ নয়। একটু নিজেদের কথা বেশি বলে বটে, তবে কর্মক্ষমতা যেন যৌবনের চেয়েও বেশি। বাঁচতে বাঁচতে আরও কত কী শিখতে হবে!

লীলা কাকিমা অবশ্য নিজের কথাও একদম বলেন না। তাঁর মেজো ছেলে বিজন যখন চিঠি লিখে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, সেই সময়টায় আমি কলকাতায় ছিলুম না। প্রায় মাস দেড়েক বাইরে থাকতে হয়েছিল। বিজনের ওরকম আকস্মিক কাণ্ডতে লীলা কাকিমা নিশ্চয়ই খুব আঘাত পেয়েছিলেন, কান্নাকাটিও করেছিলেন। কিন্তু তা লোকচক্ষুর অগোচরে। সেই অবস্থায় লীলা কাকিমাকে কেউ দেখেনি।

আমি যখন কলকাতায় ফিরেছিলুম, তখন লীলা কাকিমা সম্পূর্ণ শান্ত। আমাকে তিনি বলেছিলেন, বিজন যে চলে গেল…ও বুদ্ধিমান ছেলে… নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই গেছে। কত ছেলে তো আজকাল বিদেশে থাকে, পাঁচ–দশ বছর অন্তর দেখা হয়। তারপর দ্যাখো আমরা সাধু–সন্ন্যাসীদের শ্রদ্ধা করি, কিন্তু তারাও তো কোনো মা বা বউয়ের মনে কষ্ট দিয়ে সংসার ছেড়ে এসেছে।

লীলা কাকিমা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, আমি বললুম, আপনাকে গত দশ বছর ধরে আমি একই রকম দেখছি।

লীলা কাকিমা বললেন, তাহলে তুমি দেখতে জান না। দশ বছর ধরে কি কেউ একরকম থাকতে পারে? পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়ে গেলে জীবনটা একটু অন্যরকম হয়ে যায়, শরীরটা আর আগের মতন থাকে না, শরীর নিয়েই তো জীবন! এই সময় ব্লাডপ্রেসার গণ্ডগোল করে, ব্লাড সুগার হবার ভয় থাকে, হাঁটুতে বা কোমরে ব্যথা হতে পারে…

–এর মধ্যে আপনার কোটা হয়েছে?

—কোনোটাই বোধহয় এখনো হয়নি। অন্তত টের পাই না। কিন্তু হতে তো পারে, সেইজন্য মনে মনে তৈরি থাকা ভালো।

–এইসব জামাকাপড় তৈরি করছেন কার জন্য?

—আমি এগুলো বিক্রি করি, জান না? সারাদিন বাড়িতে বসে থাকার বদলে একটা কিছু কাজ করা তো ভালো।

এটা একটা সাদা মিথ্যে। আমি জানি, লীলা কাকিমা ঠাকুরপুকুরের একটি সমাজসেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ওখানকার অনাথ আশ্রমের ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি বিনামূল্যে জামাকাপড় তৈরি করে দেন। কিন্তু লোকের কাছে বলেন, বিক্রি করি। এখনো সেই ব্যাপারটাই চালিয়ে যাচ্ছেন কি না সেটা আমি একটু ঝালিয়ে নিলুম।

উঠে গিয়ে উনি প্লেটে করে দুটি সন্দেশ নিয়ে এলেন আমার জন্য। তারপর বললেন, নীলু, তোমায় দেখে একটা কথা মনে পড়ল। বিজনের তো অনেক প্যান্ট–· শার্ট পড়ে ছিল। কিছু কিছু তপন নিয়েছে, কিছু গেছে বাসনওয়ালার কাছে। সেদিন দেখি আলমারিতে একটা শার্ট রয়ে গেছে এখনো। বেশ ভালোই আছে, ছেঁড়ে– ঢেঁড়ে নি। আর বেশিদিন থাকলে নষ্ট হয়ে যাবে। সেই শার্টটা তুমি নেবে? তোমার গায়ে হয়ে যাবে।

আলমারি খুলে লীলা কাকিমা জামাটা বার করলেন। ওরে বাবা, এ যে অনেক দামী জিনিস। একটা গরদের হাওয়াই শার্ট। এত দামী জামা আমি জন্মে কখনো পরিনি। কেই–বা দেবে!

নিজের জামাটা খুলে ওটা পরে দেখলুম বেশ ফিট করে গেছে।

লজ্জা লজ্জা ভাব করে বললুম, লীলা কাকিমা, আজ আমার জন্মদিন। বেশ আপনার কাছ থেকে একটা উপহার পেয়ে গেলুম।

–আজ তোমার জন্মদিন, সত্যি?

হ্যাঁ বলে আমি ঢিপ করে একটা প্রণাম করলুম লীলা কাকিমার পায়ে।

এটাও একটা সাদা মিথ্যে!

নিজের জামাটা একটা খবরের কাগজে মুড়ে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে আমি একজন পছন্দমতন ভিখিরি খুঁজতে লাগলুম। বৃষ্টি থেমে গেছে, রোদ উঠেছে চড়া, এখন রাস্তায় প্রচুর মানুষজন। প্যাচপেচে কাদা, এখন আর এই শহরটাকে পছন্দ করার কোনো কারণ নেই।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলুম গড়িয়াহাট মোড়ের কাছে। দরকারের সময় ঠিক জিনিসটি কিছুতেই খুঁজে পাওয়া যাবে না? এমনকি ভিখিরি পর্যন্ত। কলকাতা শহরে ভিখিরির অভাব? যে–ক’জনকে দেখছি তারা হয় স্ত্রীলোক বা বুড়ি বা একেবারে বাচ্চা।

শেষ পর্যন্ত বাজারের সামনে প্রায় আমারই যমজ চেহারার একজন ভিখিরির সন্ধান পেয়ে গেলুম। সে আমার সামনে পয়সার জন্য হাত পাততেই আমি মনে মনে বললুম, তুমি আজ একটা জামা উপার্জন করেছ।

আশ্চর্য, সকালবেলা যখন আমি কোনো ভিখিরিকে নিজের একটা জামা দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম, তখন স্বপ্নেও ভাবিনি যে আমি নিজেও আজ একটা চমৎকার শার্ট পেয়ে যাব!

মহাপুরুষরা যে বলে গেছেন কারুকে কিছু দিতে চাইলে নিজেরও অনেক কিছু পাওয়া হয়ে যায়, তা সত্যি নাকি? দু’একদিন মিলে যায় বোধহয়!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13
Pages ( 1 of 13 ): 1 23 ... 13পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *