Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

পর্ব- ১০

পরদিন প্রভাতে যুধিষ্ঠির ও তার চার ভাইকে নিয়ে কৃষ্ণ চললেন কুরুক্ষেত্রের রণভূমি পেরিয়ে ওঘবতী নদীর তীরে, যেখানে ভীষ্ম শরশয্যায় শায়িত। ভীষ্ম যেখানে শুয়ে আছেন সেখানে আজ আর কোনো জনশূন্যতা নেই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সমস্ত মুনিঋষিরা ওঘবতী নদীর তীরে এসে ভীষ্মকে ঘিরে বসেছেন। কারণ, সবাই জেনে গেছে সূর্যের উত্তরায়ণের সঙ্গে ভীষ্মের জীবনদীপও নিভে যাবে। এমনকি মহর্ষি দ্বৈপায়ন ব্যাসও সেখানে উপস্থিত হয়েছেন। তিনি সম্পর্কে ভীষ্মের ভাই। ব্যাসের ঔরসজাত হস্তিনাপুরের তিনটি পুত্রকে তিনি যে ভাবে পিতৃস্নেহে লালন-পালন করেছিলেন, তা একমাত্র ভীষ্মের মতো গৃহী-সন্ন্যাসীর পক্ষেই সম্ভব। এমন করে যিনি নিষ্কাম কর্মযোগ পালন করতে পারেন, সেই মহামতির শেষ সময়ে তার পাশে বসে, তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করার সুযোগ কি কেউ ছাড়তে পারে?
বাসুদেব কৃষ্ণ ভীষ্মের পাশে এসে বসলেন। খুব কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন-
– ‘কুরুশ্রেষ্ঠ, আপনার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা কিরূপ আছে? হে মহামহিম, আপনি ভিন্ন আর কেউ মৃত্যুকে রোধ করে এমনভাবে শরশয্যায় শুয়ে থাকতে পারে, এর আগে আমরা কেউ কখনো শুনিনি। কিন্তু আপনার জীবন প্রায় অস্তমিত। আর কিছুদিনের মধ্যে আপনি ইহলোক ত্যাগ করবেন। আপনি পরলোকে গেলে আপনার সঙ্গে সমস্ত জ্ঞানই লুপ্ত হবে। এই কারণে ধর্মরাজ আপনার কাছে এসেছে আপনার কাছ থেকে সমস্ত জ্ঞান আহরণ করার জন্য।’
ভীষ্ম কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন,
– ‘হে মাধব সব জ্ঞানই তো তোমার কাছে আছে, তোমার জ্ঞানের কছে আমি আর নতুন করে কী বলব? আর তাছাড়া দুর্বলতার কারণে আমার বাকশক্তি ক্ষীণ হয়েছে, বোধশক্তিও লোপ পেয়েছে। আমি কেবলমাত্র জীবিত আছি। নারায়ণ, তুমি শাশ্বত, জগৎপালক গুরু, তুমি থাকতে আমি কী করে উপদেশ দেবো?’
কৃষ্ণ বললেন,- ‘হে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, আমার বরে আপনার সমস্ত শারীরিক এবং মানসিক কষ্ট নির্মূল হয়ে যাবে, আপনার সমস্ত জ্ঞান পূর্বের ন্যায় প্রকট হবে, আপনি জ্ঞানচক্ষু দ্বারা সবকিছু আবার পূর্বের মতোই দেখতে পাবেন।’
সন্ধ্যা সমাগত দেখে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠির সহ সকল মহর্ষিগণ ভীষ্মের নিকট বিদায় নিয়ে প্রস্থান করলেন।
পরদিন কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠিরাদিকে নিয়ে পুণরায় ভীষ্মের কাছে এলেন। কৃষ্ণ ভীষ্মকে কুশল জিজ্ঞেস করলেন।
ভীষ্ম বললেন,- ‘মাধব তোমার কৃপায় আমার মানসিক ও শারীরিক সমস্ত গ্লানি দূর হয়েছে। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান সব আমি প্রত্যক্ষ করতে পারছি। সর্বপ্রকার ধর্ম আমার মনে পড়েছে। সব বিষয়ে বলার শক্তি আমি পেয়েছি। এখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির আমাকে প্রশ্ন করুক, সে কী জানতে চায়।’
কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের হয়ে উত্তর দিলেন,
– ‘ও অত্যন্ত লজ্জিত, কারণ কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অনেক স্বজন হত্যা করতে হয়েছে। এমন একটা জ্ঞাতিক্ষয়ী যুদ্ধের কারণে আপনি যদি ওকে তিরস্কার করেন সেই ভয়ে, লজ্জায় যুধিষ্ঠির সামনে এসে আপনাকে কোনো প্রশ্ন করতে সাহস পাচ্ছেন না।’
ভীষ্ম বললেন,- ‘যুধিষ্ঠিরতো ক্ষাত্রধর্ম পালন করেছেন। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হলো অন্যায়কে দমন করা। পিতা, পিতামহ, ভাই, আত্মীয়, এমনকী গুরুও যদি অন্যায়ের পক্ষে থাকেন, তবে তাঁদেরকে হত্যা করাই হলো ক্ষত্রিয়ের পরমধর্ম। যাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে ধর্মের সেতু লঙ্ঘন করেন, তাঁরা গুরুস্থানীয় হলেও তাঁদের বধ করেই ক্ষত্রিয় তার ক্ষাত্রধর্ম পালন করবে।’
ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন,- ‘বৎস তুমি নিঃসংকোচে প্রশ্ন করো, যা যা তোমার জানবার ইচ্ছে আছে, তা জেনে নাও।’
এরপর যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করে যেতে লাগলেন, ভীষ্ম তাঁর সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন। সেই যুগের সামাজিক গঠন থেকে শুরু করে সমাজের চতুর্বর্ণ, চতুরাশ্রম, রাজার কর্তব্য, রাষ্ট্রসংরক্ষণ, রাষ্ট্রব্যবস্থা, পররাষ্ট্রনীতি, সৈন্যবল, এবং সর্বোপরি প্রজা-কল্যাণের কথা, ভীষ্ম অতি সূক্ষ্মভাবে এবং নিপুণতার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে বোঝালেন। এবং বললেন- ‘আমি তোমাকে ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের জন্য যা করণীয় কর্তব্য সে কথা বলেছি। আর যা কিছু জানবার তুমি শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে জানতে পারবে। কারণ, কৃষ্ণের প্রকৃত তত্ত্ব আমি জানি, তাঁর শক্তিও আমার অজানা নয়। বস্তুত কৃষ্ণকে বা তাঁর বুদ্ধিকে কোনো সাধারণ মাপকাঠি দিয়ে মাপা যায় না। অতএব যখনই কোনো কর্তব্য বিষয়ে তোমার দ্বিধা সংশয় উপস্থিত হবে, তখন তুমি কৃষ্ণকে স্মরণ করো, তিনিই তোমাকে মার্গদর্শন করাবেন।’
ভীষ্ম এতদিন ধরে নানা বিষয়ে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে এবার নীরব হলেন।
মহর্ষি ব্যাস শরশ্যায় শায়িত ভীষ্মকে বললেন,
– ‘হে গঙ্গানন্দন, আমার মনে হয় যুধিষ্ঠির এতদিন আপনার কথা শুনে অনেকটাই প্রকৃতিস্থ হয়েছে। আপনি এখন অনুমতি করুন, যুধিষ্ঠির তার ভাইদের নিয়ে কৃষ্ণের সাথে হস্তিনাপুর ফিরে যাক।’ ভীষ্ম মধুর বাক্যে যুধিষ্ঠিরকে বললেন,
– ‘যাও মহারাজ, তুমি এখন হস্তিনাপুর ফিরে যাও, তোমার মনস্তাপ দূর হোক। তুমি শ্রদ্ধা সহকারে যযাতির ন্যায় বহু যজ্ঞ করে দেবগণ ও পিতৃগণকে তৃপ্ত করো। সুশাসক হয়ে প্রজাপালন ও সুহৃদগণের সম্মান করো। সূর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভ হলে আমার মৃত্যুকাল উপস্থিত হবে, তখন তুমি আবার এসো।’ যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে অভিবাদন করে হস্তিনাপুর যাত্রা করলেন।
এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে।
ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে ভাবছেন- তাঁর ভাতুষ্পুত্র ধৃতরাষ্ট্রর কথা, তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় পঞ্চপাণ্ডবের কথা। আজ আটান্ন দিন আমি এখানে তীক্ষ্ণ শরশয্যায় শুয়ে আছি, এই আটান্ন দিন যেন শত বৎসরের ন্যায় বোধ হচ্ছে। বুকের গভীর থেকে চাপা কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চাচ্ছে। এই কুরুবংশ রক্ষার জন্যই কি আমি অন্যায়ের পথে হাঁটলাম? পাণ্ডবদের সঙ্গে না গিয়ে কৌরবদের সঙ্গে থাকলাম? অধর্মের পক্ষে থাকবো বলেই কি আমি আমার সমস্ত জীবন আহুতি দিলাম? আজ খুব মনে পড়ছে পিতা শান্তনুর কথা। তাঁর আত্মত্যাগে প্রীত হয়ে পিতা যে তাঁকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন, সেই বর’ই যে তাঁর জীবনে কাঁটা হয়ে বিঁধে রইলো! জীবনের বিভিন্ন সময় যখন তাঁর মরে যাওয়া উচিত ছিলো, তখনও তিনি বেঁচে রইলেন ভরতবংশের সাক্ষী-চৈতন্য হয়ে। ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েও বেঁচে থাকাটা পুত্রের কাছে যে কতটা কষ্টকর হতে পারে, তা কি সেদিন বর দেওয়ার আগে শান্তনু ঘুণাক্ষরেও বুঝেছিলেন? কিংবা হয়তো সেদিন তিনি ভাবতেও পারেননি যে, তার পরমপ্রিয় জেষ্ঠ পুত্রটি কতকগুলো শুষ্ক দায়িত্ব পালন করার জন্য এক লম্বা জীবন বেঁচে থাকবেন!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress